| 20 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস পুনঃপাঠ সাহিত্য

পুনর্পাঠ উপন্যাস: ঝুমরা । তিলোত্তমা মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 159 মিনিট
তিলোত্তমা মজুমদারের নতুন উপন্যাস “ঝুমরা” । কোনো পত্রিকায় প্রকাশ পায় নি এই লেখা। সরাসরি বইয়ে প্রকাশ। এই বই নিয়ে আগ্রহ ছিল খুবই। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে খুবই শক্তিশালী লেখা, প্রতিটি উপন্যাসেই নতুন আঙ্গিকের ছোঁয়া থাকে এই লেখিকার। পাঠকের সামনে খুলে যায় অন্য এক ভুবন। এই উপন্যাসও পরীক্ষামূলক। কথপোকথনের উপর ভিত্তি করে এগিয়েছে উপন্যাসটি। ছোটো ছোটো অধ্যায়ে, যেন এক-একটি মুহূর্ত ধরা পড়েছে। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ঝুমুর, সরল আর সাধারণ একটি মেয়ে। শৈশবেই মাকে হারিয়েছে সে, পিতা জ্যোতির্ময়ের কাছে পালিত হয়েছে তারা, ঝুমু আর তার বোন ঝিরি। ঝুমুই নিপুণভাবে ঘর সামলায়, আগলে রাখে সবাইকে। পাশের বাড়ির প্রতিবন্ধী ছেলে টোপর..শতরূপ। পিতৃবন্ধু প্রবীরকাকার ছেলে, তার প্রতি ঝুমুর স্নেহ অপরিসীম। ঝুমুর চেয়ে চার বছরের ছোট সে। তার জীবনযাপনও নির্ভর করে ঝুমুর ওপরে, সে তার পরম বন্ধু। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তা অতিক্রম করে তার মেধা ও ইচ্ছাশক্তিতে টোপর একদিন চাকরি পায়। সে তার ঝুমুদির প্রতি তার সুন্দর অনুভূতি আর মুগ্দ্ধতা প্রকাশ করে একদিন। ঝুমুর বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কোনো কিছুরই। তার বিবাহ স্থির হয় অন্যত্র। এই পরিস্থিতিতে কি করবে সে। নিজেও কি জানে! এই নিয়েই উপন্যাসটি। ঝুমু আর টোপরের কথোপকথনের অংশগুলি ভারি উজ্জ্বল । কথায় মিশেছে কবিতার অনুষঙ্গ। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ঝুমু। নীচে সরু গলির কলে জল এসেছে। মুন্নার মায়ের সঙ্গে ঝাড়ু নমিতার ঝগড়া শুরু হল বলে। ঝুমু দেখতে পাচ্ছে, ঝাড়ু নমিতা মুন্নার মায়ের অ্যালুমিনিয়ামের গামলা সরিয়ে নিজের লাল প্লাস্টিকের বালতি গুঁজে দিল। মুন্নার মা শিবুর বউয়ের সঙ্গে কথা বলছে। শিবুর বউ চোখ মুছল। তার দুঃখও ফুরোয় না, কথাও নয়। তার ঘরের কাছেই টাইমকল। সরু গলির মেয়েরা নিত্য দু’বেলা জল ধরতে আসে। প্রত্যেকেই অন্তত একবার শিবুর বউয়ের সঙ্গে কথা বলে যায়। ঝুমু সেসব শুনতে পায় না। কিন্তু ঝগড়া লাগলেই সব কথা তার ঘরে ঢুকে পড়ে। তখন, খুব জরুরি কাজে ব্যস্ত না থাকলে সে এই ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ায়। আর টোপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়। হবেই। টোপর মুচকি হসে, সে-ও হাসে। দু’জনেই নিবিষ্ট মনে ঝগড়া শোনে কিছুক্ষণ। দারুণ ভাল লাগে! বিনি পয়সায় অতুলনীয় উপভোগ্য জীবন্ত ধারাবাহিক। শুধু টেলিভিশনের কুশলিবের মতো এদের রংচঙে দামি শাড়ি-গয়না, কারুকাজের ঝলমলানো পাঞ্জাবি আর চড়া রূপটান নেই! অভিনয়ে তো তুলনাই হয় না। টেলিভিশনের ধারাবাহিক হল কথা-বলা পুতুলের সংলাপ, এখানে জলজ্যান্ত অভিনয়, বেঁচে থাকতে গেলে যা না করে উপায় থাকে না মানুষের! ঝুমুর গোটা ব্যাপারটাই উপভোগ্য মনে হয়। হাসি, কান্না, বিবাদ, ঈর্ষা, চক্রান্ত-সুন্দর ও অসুন্দর পাশাপাশি কিন্তু অবিচ্ছেদ্য এবং প্রাণস্পন্দনে ভরপুর। হাতে সময় থাকলে, মনমেজাজ ফুরফুরে থাকলে, দিব্যি পুরোটাই দেখা যায়। টোপর বলে, ‘আমার তো হতাশা, দুঃখ, বিরক্তি সমস্তই চলে যায় ওই কলহপুরাণ শুনলে। কী ভাষাবোধ বলো ঝুমুদি! আর কী স্বতঃস্ফূর্ত সংলাপ! অনর্গল মুখে এসে যাচ্ছে!’

সবাই পারে না এমন। অনেকেই শান্ত, ভীরু। বিবাদের উপক্রম হলেই হার স্বীকার করে নেয়। তারা সব ঝুমুর দলে।

ঝাড়ু নমিতার সঙ্গে ঝুমু-র ভারী অন্তরঙ্গতা! এই সরু গলিতে কত যে নমিতা, কত যে লক্ষ্মী, কত সাবিত্রী তার ঠিক নেই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত জটা নমিতা। ঈশ্বরের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক জটাজূট হয়ে দেখা দিয়েছে।

শিবের স্বপ্নাদেশ পাবার পর থেকেই জটা নমিতা আর চুলে চিরুণি দেয়নি। মাথায় জটার বোঝা নিয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিল। স্বপ্নের বোঝা বললেও হয়। দেবাদিদেব মহেশ্বর ত্রিভুবনে আর লোক পেলেন না ভর করার মতো। ওই এক বয়ঃসন্ধির বালিকা নমিতা, শিবের ভার বইবার ক্ষমতা কি তার ছিল? তিনমাস সে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। তার মা নিজ অদৃষ্টকে গালি পাড়ত, শিবের ভর না হয়ে বর পেত যদি, নাবালিকা হলেও নমিতার একটা গতি হত, অর্থাৎ শিব পাওয়া ইস্তক মেয়ের দশায় মেয়ের মা একেবারেই প্রীত ছিল না। তার স্বামী, নমিতার জন্মদাতা পিতা, দশাসই চেহারার এক মোদোমাতাল, পুরসভার আবর্জনা বহনের ট্রাকচালক, মেয়ের শিবপ্রাপ্তির মাসখানেক পরেই, বমি করতে করতে পট করে মরে গেল। এই ছিল, এই নেই। মরণের হরণ করার এই বিপুল ক্ষমতা, এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ, প্রত্যক্ষ করে, ভয় পেয়ে গিয়েছিল ঝুমু। যদি ভূত হয়ে গলা টিপতে আসে!

‘ধুর!’ ঝিরি ঝিরঝির করে হেসে তার ভয় উড়িয়ে দেয়। বলে, ‘কী বোকা রে তুই! আমাদের যে মা মরে গেল! ভূত হয়েও তো ফিরে এল না।’

‘যদি আসত, একই মা থাকত কি আমাদের?’

‘মা তো মা-ই। ভূত মা কি বদলে যায়?’

‘আমার তো মনে হয় আমরা প্রতি মুহূর্তেই বদলে যাই।’

‘যে শিশু ছিল সে বড় হয়। যে বড়, সে বুড়ো হয়, এইরকম?’

‘সেটা তো বাইরে। আমি মনের পরিবর্তনের কথা বলছি। কাল তুই যে ঝিরি ছিলি, আজ কি একই? তা হলে ধর, যে পৃথিবী ছেড়েই চলে গেছে, সে কি ঠিক একই মানুষ হয়ে ফিরে আসতে পারে?’

‘সে তো মানুষই নয়, ভূত।’

‘মা ভূত হয়ে এলেই বা কী হত!’

‘মা-কে দেখতাম। ইচ্ছে করে।’

এরকম কথা প্রায়ই হয়। অকারণ। মা ব্যতীত বেড়ে ওঠার মধ্যে মা কেবল স্বপ্ন আর কল্পনা। কেবল কথা আর ছবি।

ঝিরি পঞ্চম শ্রেণি, ঝুমু দশম। তখন থেকেই ঝিরি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, সপ্রতিভ, সচেতন। তখন থেকে ঝুমু শুনছে তার বাবা বলে, ‘আমার বড় মেয়েটা বড্ড সরল। বোকা। ওকে নিয়েই চিন্তা।’

এখন ঝুমু জানে, সে শুধু বোকা ও সরল নয়, সে সাধারণ। তার সাধারণ চেহারা, সাধারণ ক্ষমতা, সাধারণ চিন্তা। সারল্য আর সাধারণ্য একত্রিত হয়ে জ্যোতির্ময়ের বড় মেয়ে ঝুমু সংসারে এক দায় বটে। ইদানীং, ঝুমুর বিয়ে দিয়ে তিনি দায়মুক্ত হতে চান, কিন্তু পাত্র মিলছে না। তার বয়স সাতাশ হল। জটা নমিতার বয়সও তবে সাতাশ। এই ক’বছরে একফালি গৃহের বাইরের দেওয়ালে সাদা সেরামিক টালি বসিয়ে শিবের ছোট্ট মন্দির গড়েছে নমিতা। তার ত্রিকোণ চূড়ার শীর্ষে লোহার ত্রিশূল, অন্দরে শিবলিঙ্গের পাশে সিমেন্টের ষাঁড়, সাপ। ভাস্কর্য হিসেবে অতি নিকৃষ্ট। কিন্তু তার জন্য ভক্তি আটকায় না। ভক্তিরস বিষয়টি যতই টাকাকড়ি নিরপেক্ষ বলে প্রচারিত হোক, কানাই সামন্ত সরু গলির জটা নমি ও তার মা ভক্তিরসসাগরের রেজগি কুড়িয়েই গ্রাসাচ্ছাদন চালিয়ে যায়। শিবরাত্রির দিন ঝুমু নিজেও জটা নমিতার শিবলিঙ্গে ভক্তি ভরে দুধজল ঢালে। টোপর দুষ্টু চোখে তাকিয়ে বলে, ‘শিবের মাথায় দুধ ঢালবে?’

‘জানিসই তো।’

‘কতবার বলেছি ওটা মাথা নয়।’

‘জানি। চুপ কর।’

‘লিঙ্গে দুগ্ধসিঞ্চন, পত্রসমেত বেলফল আতঞ্চন? আহা! দেবতার ব্যথার কথা কে বোঝে!’

‘বাজে বকিস না। শিব নমিতাকে ছেড়ে তোকে ধরবে।’

নমিতার ভর বিস্ময়ের বস্তু। একদিন কৌতূহলে ভর দেখতে গিয়েছিল। শিউরে উঠেছিল সে। নমিতার চোখ দুটি টকটকে লাল। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। এই উঠছে, এই পড়ছে, এই হাত-পা ছুড়ে গোঁ গোঁ করছে। কী এক অকথ্য যন্ত্রণায় যেন আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে মেয়েটা। ঢোলা ম্যাক্সি ঊরু পর্যন্ত উঠে এসেছে। বন্ধনহীন স্তন দুটি ভয়ানক চোখ টানছে। মুন্নার মা ম্যাক্সি টেনে নামাতে গেল। তার বুকে এক লাথি মারল নমিতা। তাকেই মহাদেবের পদাঘাতরূপী আশীর্বাদ মনে করে মাটিতে গড় করল মুন্নার মা। বাবা মহেশ্বর, ভোলানাথ, দয়া করো প্রভু।

লাজলজ্জার বালাই থাকে না বলে এসময় মেয়েরাই নমিতাকে ঘিরে থাকে। বেহায়া পুরুষদের ধারেকাছে আসতে দেয় না। এসময় কলহপ্রিয়া রমণীরা একাত্ম। সরু গলির জীবনযৌবন সকলই অরক্ষিত। লোলুপ পুরুষ উঁকি মারে ভরাস্তনী ডাগর শরীরে। প্রহারও করে। গালি-খিস্তি দেয়। নারীত্ব বড় সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জটা-নমি যতই শিবের কৃপাধন্য হোক, তার অববাহিকার রক্ষা-ভার বর্তায় দেবী দুর্গতিনাশিনীদের দুই হাতে। তারা অপেক্ষা করে কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে সে। এ সময় শিবাঙ্গী, শিবলিঙ্গশক্তিপীড়িত নমিতার কাছে কায়মনোবাক্যে যাঞ্চা নিবেদন করলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়।কিন্তু নীলকণ্ঠ শিবের তাণ্ডব শরীরে ধারণ করে, বিপুল ক্ষমতাশালিনী হয়ে বিবিধ ভবিষ্যদ্বাণী করে, ওষুধ-বিষুধ দিয়ে ভারী ক্লান্ত হয়ে পড়ে মেয়েটা!

বিষহরির অংশ হওয়া চাট্টিখানি কথা তো নয়। লোকে তার সাহায্য পায়। তার জন্য মায়া বোধ করে! সেইসব সহায়তার অস্তি ও নাস্তির অর্থ নিজেকেই করে নিতে হয়। ‘মা গো, আমার মেয়ের প্রসব ঠিকমতো হবে তো?’ জটা-নমি খিঁচুনি দিল, লালা গড়াল কষ বেয়ে। ‘হবে মা? হবে! প্রাণটা শান্ত হল গো মা।’ আর ওষুধ বিষুধ? শিবলিঙ্গে মাখানো চন্দন, তুলসী বা বেলপাতায় মেখে প্রার্থীর হাতে তুলে দেয় নমিতার মা! ‘ভক্তিভ’রে খাও, ভাল হবে।’ ভাল না হলে ভক্তিতে খাদ, ওষুধে নয়!

ঝুমু-র বিশ্বাসের জগৎ বিপুল। তবু নমিতার অতিপ্রাকৃত শক্তিতে তার বিশ্বাস নেই। কারণ সে সত্য জানে। জটা নমিতার জন্য কষ্ট পায়। চিকিৎসা করালে হয়তো সে সেরে উঠত। বিকার ব্যতিরেকে ঈশ্বরপ্রাপ্তি কি সম্ভব নয়? ঈশ্বরের সঙ্গে সৌন্দর্য একাকার মনে হয় ঝুমু-র। ঈশ্বর নিখুঁত, অবিকার, পূর্ণ, সুন্দর! সেখানে গ্যাঁজলা, হাত-পা ছোড়া, অভব্য আচরণের কোনও জায়গা নেই। ঈশ্বর বর্ষপঞ্জীতে ছাপা দেবদেবী। সালঙ্কার, সদাপ্রসন্ন, আশীর্বাদক।

ঈশ্বরই ঐশ্বর্য। ঈশ্বরই সৌন্দর্য। বাকি যত অসুন্দর, তা মানুষের করণ। এই যে জটা-নমির শিবাশিস— সে-ও তাই। সে গোপালীমাসির কাছে মূল তথ্য প্রাপ্ত হয়েছিল।

‘বাপটা মানুষ ছিল নাকি? মরেছে বেশ হয়েছে। লোকে যেমন পিটিয়ে ছুঁচো মারে, তেমনি করে মারা উচিত ছিল। তা ওই ইঁদুর মারার বিষ-টিসই দিয়েছিল বোধহয়।’ গোপালীমাসির মুখ রাগে, ঘৃণায় গনগনে, তপতপে। শান্ত মানুষ, কর্তব্যপরায়ণ, মা মরে যাবার পর ঝিরি হয়তো মরেই যেত মাসিকে তত্ত্বাবধায়ক না পেলে। তাকে এমন উগ্র হয়ে উঠতে দেখে ভয়ে ঝুমু-র গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। কোনওক্রমে সে বলতে পেরেছিল, ‘বি-বিষ! মাসি! স-সত্যি?’

‘নিজের মেয়ের পেট করে দিয়েছিল মিন্সেটা। আমার সোয়ামি যদি এমন হত, জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ দিয়ে আগে ধন গালতাম, তারপর আর সব।’

‘এসব কী বলছ মাসি?’

‘সত্যি বলছি। এর এক বর্ণ মিথ্যে হলে আমার জিভ খসে যাবে। পেট খসাতে গিয়ে কম কাণ্ড? বেঁচেও মরে রইল মেয়েটা।’

‘কোনও বাবা এমন করতে পারে?’

‘দ্যাখ মা, দশবাড়ি ঘুরে কাজ করি, জীবনে কম দেখলাম না। ওই নমি-র বাপ মেয়ের জন্য এটা আনে, সেটা আনে। আর সব বাপের মতোই। কিন্তু একলা ঘরে পেলে হল। প্রথমে গায়ে হাত দিত আর ভয় দেখাত, মা-কে এসব বললে মা সঙ্গে সঙ্গে ফটাস মাথা ফেটে মরে যাবে! সরল মেয়ে ভয়ে কিছু বলেনি। শেষে ওই পশুবৃত্তি! ওইর’ম ধুমসো বিপুল পুরুষ মানুষ। জন্মদাতা বাপ। মেয়েটা দেহে-মনে কত যন্ত্রণা পেয়েছে বলো দি’নি! মিন্সেরা হল গিয়ে আপদ। ধনে রস জমলে পাগলা কুত্তা আর পুরুষমানুষে কোনও তফাত নেই। ভাদুরে কুকুরের মতো শুধু মেয়েমানুষ দেখে, সম্পক্ক, ভালমন্দ, সময়-অসময় কিছু বোঝে না। ওই এক অঙ্গতুষ্টির জন্য ওরা সর্বস্ব দিতে পারে, আবার নিতেও পারে।’

‘ইঃ! আমার গা গুলোচ্ছে! মা গো! উঃ ভগবান।’

‘তাই বলে কি সব পুরুষই এই? না। তা কক্ষনো না। বাজারে একশো কাঁচালঙ্কা কিনলে একটা দুটো পচা বেরোয় না? এ-ও সেইরকম। জানিয়ে রাখলাম। সচেতন থাকবে। বাসে, ট্রামে, পথে, ঘাটে নোংরা লোক থাকে, সতর্ক হয়ে চলবে। পোড়াকপালি রে। আজ তোদের মা বেঁচে থাকলে আরও অনেক ভাল শিক্ষে দিত। আমি কি তেমন পারি? তবু আমার জ্ঞানবুদ্ধি মতো বলি। তবে কী, ওই এক কষ্টিপাথরে সব যাচাই করে নিতে হবে। সে হল তোমার মন।’

‘তার মানে কী মাসি?’

‘মানে হল এই যে মনকে সদাজাগ্রত রাখবে। আমার গুরুদেব প্রসন্নানন্দজি মহারাজ বলে দিয়েছেন মনকে কখনও ঘুম পাড়াতে নেই, চিন্তা শিথিল করতে নেই, চেতনা আচ্ছন্ন করতে নেই। বুদ্ধির কলেবরে এই তিন অঙ্গ। মন, চিন্তা, চেতনা। তিনি বলেছেন, আমি বোঝার চেষ্টা করে চলেছি। তোমাদের মতো লেখাপড়া তো করিনি বাপু। তোমরা আরও বেশি করে বুঝবে।’

‘তা তো বুঝলাম। পুরুষমানুষেরাই কি শুধু খারাপ মাসি? মেয়েরাও তো খারাপ হয়। সিনেমায় দেখোনি?

‘দেখিনি আবার? সিনেমায় কেন মা? এ জীবনেই ঢলানি পুরুষখাকি মাগি কম দেখিনি। তবু বলব, তোলায় যদি ওজন করতে পারা যেত, ভালর বিচারে মেয়েরা হত ভারী। মেয়েমানুষ বড় অসহায় রে মা। তাদের হল মার খাবার কপাল। পুরুষেরা ভোগ করবে আর মেয়েরা তার সামগ্রী হয়ে থাকবে।’

মেয়েদের ভোগ্যসামগ্রী হিসেবে দেখার বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে মস্ত আন্দোলন চলছে। ঝুমু-র মনে হয়, তারও কিছু করার আছে। কিন্তু কী করবে ভেবে পায়নি। তাদের এই দোতলা ঝুলবারান্দা থেকে সরু গলির অভাবী জীবনসংগ্রাম দেখলে মনে হয় খেয়ে-পরে বাঁচাই হল প্রথম শর্ত। তারপর অন্য কিছু। জটা নমিতার শিবপ্রাপ্তির উৎসে যে করুণ মর্মঘাতী অত্যাচারের কাহিনি, তার ওপরই গড়ে উঠেছে মা-মেয়ের রুজিরোজগারের উপায় ওই শিবমন্দির। এটা যদি সত্যি হয় যে নমিতার মা মনের জ্বালায় স্বামীর আহার্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল, তা হলে সে স্বাধীনভাবেই তার প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে পেরেছে, মেয়েকে আরও বহুবার ধর্ষিতা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতেও পেরেছে। সামাজিক নিয়ম হল, আইন নিজের হাতে নেওয়া চলে না। কেউ অপরাধ করলে পুলিশ আছে, আদালত আছে, অপরাধীর বিচার করে সমাজ। ব্যক্তি নয়। কারণ, ঝুমুর মনে হয়, ব্যক্তি বলে কিছু হয় না। সবটাই সমাজ। লোকে কী খাবে, কী পরবে, কোথায় বেড়াবে, এমনকী ঘরবাড়ি কেমন হবে-এই সবই অদৃশ্য বা দৃশ্যমান সমষ্টি নিয়ন্ত্রণ করে। ছোটবেলায় সে এক গাধা ও ধোপার গল্প পড়েছিল। গাধার পিঠে বোঝা চাপিয়ে, নিজেও চেপে যাচ্ছে ধোপা। লোকে বলল, আরে দেখো, লোকটা কী নিষ্ঠুর! এত ভার বয়ে গাধাটা চলতেই পারছে না। শুনে লোকটা নেমে পড়ল। সে যত যায় তত নতুনতর মন্তব্য শোনে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলায়। জীবনে সবই এই ধোপার গল্প। সমাজ কোনও না কোনওভাবে ব্যক্তিজীবনকে সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। সমাজকে সংকুচিত ও প্রসারিত করা যায়, বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় না। নমিতার মা কি তবে আইনের চোখে অপরাধী নয়? সে কি সমাজের অংশ হিসেবে স্বামীকে শাস্তি দিল, নাকি বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে? সে কি নারী বলে শাস্তি দিল? মা বলে প্রতিশোধ নিল? নাকি শুদ্ধ মানবিকতাবোধে? জটা নমিতা ও তার মাকে কি নারীমুক্তি আন্দোলনের শরিক বলা যায়? নারীমুক্তি মানে ঠিক কী!

শিবুর বউয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে মুন্নার মা এবার জলের দিকে আসছে। পুরী গেলে যেমন করে সমুদ্রর কাছে যায় ঝুমু, দূরের ঢেউয়ে চোখ রেখে, সাদা ফেণশীর্ষের পটভূমিকায়, পায়ে পায়ে।

ঝাড়ু নমিতা খুব অবহেলায় মুন্নার মাকে দেখল। যেন কিছুই জানে না। ঝর ঝর করে জল পড়ছে। দ্রুত ভরে উঠছে বালতি-গামলা। মুন্নার মা ক্রম গুনছে। এক, দুই, তিন… কোমরে আঁচল প্যাঁচাচ্ছে এবার।

‘অ্যাই! অই লাল বালতিটা কার র‍্যা!’

নমিতার মুখে চাপা হাসি। ইচ্ছে করে মুন্নার মায়ের পেছনে লাগে মেয়েটা। তাতিয়ে দিয়ে মজা পায়। পুরসভার স্থায়ী পথঝাড়ুনে নমিতা। সপ্তম শ্রেণি পাশ। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে। ঝুমু-র কাছ থেকে পত্রিকা চেয়ে নেয় পড়ার জন্য। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীসংগঠনের দাবিদাওয়া ঘোষণা করতে করতে দলের নিশান হাতে সদর্পে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় যখন নমিতা—ঝুমু-র মনে হয়, রাস্তা, ঝাড়ু নমিতার পদস্পর্শে ধন্য হওয়ার জন্য বুক পেতে দিয়েছে। তার স্বপ্ন, সে সংগঠনের নেত্রী হবে। বাসন্তীদেবী কলেজের ঠিক উলটোদিকে, রোলের দোকানি কমলকে ভালবাসে নমিতা।

‘আমিই ওকে ‘আই লাভ ইউ’ বললাম জানো ঝুমুদি। মুখে না। মেসেজ করলাম। ও আমাকে ডাকল। ডাকবে জানতাম।’

‘তারপর? মারল এক চড়?’

‘ধুৎ! সে হলে তো সমস্যাই ছিল না। নাটক করার প্রচুর চান্স পেতাম। কিন্তু লোকটা ঘুঘু, বুঝলে?’

‘ছি ছি নমি, যাকে ভালবাসিস তাকে বলছিস ঘুঘু!’

‘বলব না তো কী? এক্কেবারে হারামজাদা! বলে কী, ‘হঠাৎ আমাকে ভালবাস! কেস কী?’ বললাম, ‘যা সত্যি, তাই বলেছি। আমি কি কাউকে ভয় পাই?’ বলে, ‘কী চাও কী? প্রেম করে দু’ দিনেই ফুড়ুৎ? নাকি সংসার-টংসার করবে? আমার পক্ষে রোলের কাউন্টার বন্ধ দিয়ে মাঠ-ময়দান ঘোরা সম্ভব না। দামি সেন্টও কিনে দিতে পারব না।’ বললাম, ‘বুঝলাম, এর আগে প্রেম করে আপনার দোকানে হেভি লস গিয়েছে।’ রেগে গিয়ে বলে, ‘বাজে বোকো না। কোনও দিন কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখেছ?’ হি হি হি! বললাম, ‘রোজই দেখি। বাসন্তীদেবীর মেয়েরা তো আপনার রোল চেটে খায়।’

‘কী বদমাইশ রে তুই! বলে দিলি এরকম?’

ঝাড়ু নমিতা হাসছিল। হেসেই যাচ্ছিল। তার উচ্ছল তরুণ শরীর সেই হাসির সঙ্গে জলকল্লোল হয়ে যাচ্ছিল। একরাশ চুলের খোঁপা ভেঙে সহস্র সর্পিণী ফণা।

‘রোল চেটে খাওয়া মানে বুঝলে তো ঝুমুদি? ইঃ হি হি হি! মালটা বোধহয় বোঝেনি! দুদু-ভাতু টাইপ গো! আমি খুব নজর করেছি, মেয়েদের যখন রোল বেচে, বুকের দিকে তাকায় না। আমাকে বলে…ওঃ হো হো… আমাকে বলে, ‘রোল কি আইসক্রিম যে চেটে খাবে?’ আমি তো হাসি চেপে বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি আমার দিকটা বলি, মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর টাইম আমারও নেই। আমিও জব করি। ইউনিয়নের কাজ করি। ঘরেও পায়ে পা দিয়ে বসে থাকি না। মাকে সাধ্যমতো সাহায্য করি। গরিব হতে পারি, হ্যাংলা নই যে কবে আপনি সেন্ট দেবেন তারপর গায়ে মাখার জন্য হাঁ করে থাকব।’ আমার দিকে তাকাল। চোখ দুটো কী শান্ত! এক মুহূর্ত কাজ থামাচ্ছে না কিন্তু। বোধহয় জিমে যায়। কী সুন্দর শরীরটা! বাড়িটা কোথায় জানো?’

‘আমি কী করে জানব?’

‘চেতলা রোডে। ঠিক রোডের ওপর না। চেতলা রোডে ‘উৎসব’ বিয়ে বাড়িটা আছে না? ভাড়া দেয়? তার ঠিক পাশের গলি। ওখানে একটা জিম আছে। দেখেছি।’

‘বাব্বা! তুই কি ওর সব খোঁজখবর নিয়েছিস নাকি? পাকা গোয়েন্দা!’

‘বাঃ! যাকে সারাজীবনের জন্য পেতে চাই, তার খোঁজ নেব না? যদি অন্য কাউকে গলায় লটকে থাকে? আমার সঙ্গে দুগ্গিবাজি করে? যদি নেশাভাঙের অভ্যাস থাকে?’

‘হুঁ। তারপর?’

‘আমার কথা শুনে বলল, ‘দেখো নমিতা, তোমার প্রস্তাবে হ্যাঁ-না বলার আগে পস্টাপস্টি বলে নেওয়া ভাল যে আমাদের ঘরের বউ যদি হতে চাও চাকরিটা তোমাকে ছাড়তে হবে।’ বললাম, ‘কেন?’ বলল কী জানো ঝুমুদি? ‘আমার বাড়ির লোক মানতেই পারবে না ঘরের বউ রাস্তা ঝাঁট দেয়।’ বললাম, ‘তো? ঝাঁট দেওয়া খারাপ কীসে? এলাকা পরিষ্কার রাখি বলেই না আপনারা ফুটপাথে দোকানদারি করে খাচ্ছেন। এলাকায় কলেরা, ডেঙ্গি ছড়াচ্ছে না। আমরা শুধু চাকরিই করি না। পরিষেবা দিই মানুষকে। সাফাই না করলে কলেরা, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়ায় দেশ ভরে যাবে। আমাদের গুরুত্ব বোঝেন? তা ছাড়া করপোরেশনের স্থায়ী চাকরি, রিটায়ার করলে কত পাব জানেন?’ বলল, ‘আমার যা বলার বললাম। এবার তুমি ভাবো।’’

‘ভাবলি?’

‘হুঁ তো।’

‘চাকরি ছেড়ে দিবি?’

‘না। কক্ষনো না। কেন ছাড়ব? ঝাড়ুদারনি বলে কি আমি মানুষ না? বইতেই লেখা আছে আমরা সমাজবন্ধু। এটা আমার কাজ ঝুমুদি। আমি গরিব মায়ের মেয়ে, সে কি আমার দোষ? নাকি গরিবিয়ানা আমার মায়ের দোষ? সমাজে কেউ ঘি খায়, কেউ পাত কুড়োয়, এ তো সমাজেরই সৃষ্টি! ঝাড়ু দিই বলে আমার এতটুকু লজ্জা-ঘৃণা নেই। সিস্টার নিবেদিতা নিজের হাতে ঝাড়ু তুলে মানুষকে পরিচ্ছন্ন হতে শিখিয়েছিলেন। আমি তো সামান্য মেয়ে। যা পারি, তাই করি। এর জন্য আমাদের সংসারটা খেয়ে-পরে আছে। ভাই কলেজে যেতে পারছে, আমি মাথা উঁচু করে চলতে পারছি। আমি তো খারাপ পথে যাইনি, চুরি করিনি, লোভ করিনি! ও আমার আত্মসম্মানের জায়গাটা বুঝতে পারল না? আমিও তো হিসেব কষতে পারতাম। আমার তো মনে হয়নি, ফুটপাথে রোল বেচে— সে আবার যোগ্য পাত্র!’

‘কী আর করবি। ভুলে যা।’

‘হয়তো ভুলে যাব। কিন্তু ভাবলেই বুকের ভেতরে কেমন করে ওঠে গো ঝুমুদি। এইরকমই যদি চলতে থাকে, আর কাউকে বিয়ে করেও কি আমি শান্তি পাব? তাই আর ভাবছি না। কোনও দিন যদি ওকে ছাড়া আর কাউকে ভাল্লাগে, তখন ভাবব। মাঝে মাঝে মনে হয়, মাধ্যমিকটা যদি পাশ করে নিতে পারতাম। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজের অনেক সুযোগ, জানো। প্রেস্টিজও দেয় লোকে।’

‘আবার শুরু কর না। প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়া যায়। পড়তে তো ভালবাসিস তুই।’

‘সে গল্প-টল্প পড়তে ভাল লাগে। সিনেমার খবর, খেলার খবর, পলিটিক্স। তাই বলে অঙ্ক, ইংরিজি, ইতিহাস, জীবনবিজ্ঞান?’

ঝাড়ু নমিতা দিব্যি আছে। এখন ঠিক করেছে, কমল বিয়ে করেছে জানলেই সে বিয়ের জন্য ভাবনা-চিন্তা শুরু করবে। তার ভাই পলাশের কলেজে তৃতীয় বর্ষ চলছে। একবারও অকৃতকার্য না হওয়া সাধারণ ছাত্র। ঝুমুর মতোই। সপ্তাহে তিনদিন টোপরের কাছে কম্পিউটার শেখে পলাশ। বিনিময়ে টোপরকে সে ওঠা-নামায় সাহায্য করে।

টোপর আর পলাশের মধ্যে কখনও বিচিত্র বিষয়ে কথা হয়। কখনও কথাই হয় না। দু’জনেই চুপ করে থাকে। তখন পলাশকে ছায়ার মতো লাগে। বড় বাড়ি ও সরু গলির অধিবাসীদের মধ্যে মানসিকতার নানাবিধ ফারাক। আত্মবিশ্বাসী ও আত্মকরুণাবাদীর মতো।

টোপরের সঙ্গে থাকাকালীন পলাশ যেন বৃত্যবৃত। কিছুতেই ওই ভেলভেটের মতো সবুজ আবরণ খুলে আগুনের রঙে প্রস্ফুটিত হয় না। ঝুমু-র দেখতে ইচ্ছে করে, কলেজেও পলাশ এইরকম ম্রিয়মান কিনা!

ঝুমু-র জগতের সবকিছুই তার চিন্তায় এমনি করে জায়গা পেয়ে যায়। ঘরের কাজ আর ভাবনা, এ নিয়েই সে আছে। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে টোপর থেকে শুরু করে মুন্নার মা অবধি সরস পরিক্রমা করতে লাগল।

‘অ্যাই! অই লাল বালতিটা কার র‌্যা!’

ঝুমুর সঙ্গে চোখাচোখি করল ঝাড়ু নমিতা। তারপর সরু গলায় যুদ্ধাহ্বান তুলে বলল, ‘আমার। কিছু বলবে?’

‘হারামজাদি নেকির ঢেঁকি! আবার বলে, কিছু বলবে!! রগা ঢিলে লুল্লু মাগি! বলি, আমার গামলি পাঁচ লম্বরে ছিল, ছয়ে এল কী করে র্যা!’

‘তোমার গামলির পাঁচ পা হয়েছে গো মাসি।’

‘দ্যাখ নমি, রোজকার এই রপোট আমার ভাল লাগে না বলে দিচ্ছি।’

মুন্নার মা নমিতার লাল বালতি তুলে নিজের গামলা স্থাপন করার উদ্যোগ নিতেই নমিতা লাফিয়ে উঠল, ‘রাখো! রাখো বলছি! লাইন রেখে গপ্পো মারবে, আর পরে লপচপানি, ও চলবে না। লাইন দিলে চোখ রাখতে হবে।’

‘ঢলানি মাগি! যমের অরুচি! তোর মরণ হয় না! হাটে হাঁড়ি ভাঙব। কিছু জানি না ভেবেছিস? সব লদগালদগির কুষ্ঠি যদি না খুলেছি…’

কণ্ঠ ছিঁড়ে চিৎকার করছে মুন্নার মা, কিন্তু নমিতার বালতি সরানোর সাহস করছে না। এই সম্ভ্রম দারুণ উপভোগ করছে নমিতা। মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ঝুমু নিশ্চিত, মেয়েটা একদিন নেত্রী হবেই।

উলটো দিকের জানালায় টোপর এল। হাসছে। ঝুমুকে ডাকছে ইশারায়। দুই বাড়ির মাঝে এই সরু গলি যেন নদীর মতো। এপার থেকে ওপারের সব দেখা যায়, শব্দ আসে, ডাক পৌঁছয়, এপারে বৃষ্টি নামলে ওপারের রোদ্দুর চেয়ে থাকে মেঘের তৃষায়, বৃষ্টি তখন নদী পারাপার করে। এপার থেকে গিয়ে ভিজিয়ে আসে ওপারের কাতরতা। মাঝখানে একটা সাঁকো থাকলে বেশ হত। কিন্তু সাঁকো নেই। পণ্ডিতিয়া রোড থেকে বেরিয়ে এসে বিজন ভট্টাচার্য লেন নামের ছোট রাস্তাটি পুবে-পশ্চিমে প্রলম্বিত দুটি ছোট গলিকে দাঁড়িয়াবান্ধা ছকের মতো উত্তর-দক্ষিণে কেটে উল্লাসকর দত্ত সরণি পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। সেই দুই ছোট গলির একটি, যেটি সরুতর, কানাই সামন্ত বাইলেন নাম নিয়ে টোপরদের বাড়িটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ঝুমুরদের বাড়ি থেকে। মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে কানাই সামন্ত সরু গলি পেরোলেই টোপরদের ফটক।

ঝুমু পায়ে চটি গলিয়ে নিল। ঝিরি তার অভ্যাসমতো সারা বাড়ি ঘুরে পায়চারি করতে করতে পড়ছিল। বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘টোপর ডাকছে।’

‘ওমনি তুই চললি?’

‘যাব না? ও মা! কেন?’

‘আমি কি বলেছি, যাবি না? তোর খুশি তুই যাবি। লেংড়ুটার জন্য তো তোর দরদের অন্ত নেই।’

‘ওভাবে বলিস না। কী কষ্ট বলতো! প্রবীরকাকা শুনলেই বা কী বলবেন?’

‘আমার যেন বুদ্ধি নেই। আমি যেন প্রবীর কাকার সামনেই এসব বলব!’

‘উনি যখন-তখন এ বাড়িতে আসছেন, শুনতেই পারেন।’

‘যা যা! গিয়ে শার্ট বেছে দে!’

‘অত খিটখিট করছিস কেন? মন দিয়ে পড় না।’

‘মন দিয়ে পড়ব? বাড়ির চারদিকটা তো তপোবন। মুনিঋষিরা সামগান গাইছেন। উফ্! সকাল থেকে ঝগড়া আর খিস্তি! নমিটা মহা বদমাইশ! পায়ে-পা লাগিয়ে ঝগড়া করে মজা পায়। বাবা আর বাড়ি করার জায়গা পেল না! হাড়কিপটে! শস্তায় পেয়েছে, নিয়ে নিয়েছে! অসহ্য! আমি হস্টেলে চলে যাব! শহরের বাইরে চলে যাব চাকরি নিয়ে।’

‘যাস। ছোটবেলা থেকে শুনেও তোর অভ্যাস হল না! আমি আর টোপর তো খুব মজা পাই। ওই ঝগড়া মারামারি আছে বলে দিনগুলোয় যেন আর একঘেয়েমি থাকে না! আর বাবাকে দোষ দিয়ে কী করবি! বাড়িটা তো বাবা করেনি। বাবার বাবা জমি কিনে একতলা করেছিল, বাবা শুধু দোতলা তুলেছে। সবই তো জানিস।’

ঝুমু সিঁড়ি দিয়ে নামছে। বাণিজ্যবিদ্যায় স্নাতক সে। ভেবেছিল ব্যাঙ্কের চাকরির পরীক্ষা দেবে আর পেয়ে যাবে। সেরকম আদৌ হল না। কেন হল না? ঝুমু তার জন্য নিজেকেই দায়ী করে। বারো-তেরো বছর বয়স হতে না হতেই সে কেমন সংসারে ঢুকে পড়ল। কলেজের পরীক্ষায় পাশ করার মতো লেখাপড়াই সে করেছে। ব্যাঙ্কের পরীক্ষার পড়া সে কিছুই করেনি। প্রথমবার যখন বসল, মনে হয়েছিল, এক অদ্ভুত জগতে ঢুকে পড়েছে। সাধারণ জ্ঞান বা অঙ্কের উত্তর যা-ও বা কিছু পারল, যুক্তিবোধের পরীক্ষার ধাঁধায় তারই যুক্তিবুদ্ধি সব গুলিয়ে গেল। এরপর সে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় গিয়ে ব্যাঙ্ক ও আরও অন্যান্য সরকারি পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বইপত্র কিনে এনেছিল। কিন্তু সেসব আয়ত্ত করার চেয়ে তার অনেক বেশি উৎসাহ ছিল বাবার চা লাগবে কিনা, যাই ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলে আনি, ইশশ্ পাখাগুলোয় ঝুল পড়েছে, আলমারির মাথায় দেখো—সাত পরত ধুলো, বিকেলে আজ নতুন জলখাবার কী বানানো যায়? টোপর পছন্দ করবে, ঝিরিও। যেহেতু ঝিরি ও টোপরের অভিরুচি সম্পূর্ণ আলাদা সেহেতু দুই ভিন্নরুচিকে এক পদে বাঁধতে যথেষ্ট বুদ্ধি প্রয়োগ করে ঝুমু। ব্যাঙ্কপরীক্ষার বইয়ের পাশে লীলা মজুমদারের রান্নার বই কিংবা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর আমিষ-নিরামিষ। সরকারি চাকরির পরীক্ষায় সে উতরোয়নি বটে, অন্য এক চাকরি জুটেছিল, সে-ও সংসারের টানে ছেড়ে এল। বোকা আর সাধারণ বলেই না সে এমন সুযোগ ছেড়ে এসেছে! যা গেছে তা যাক! টোপরের জন্য রাঁধতে সে আনন্দ পায়। ঝিরি ভাল খেলে ভারী খুশি বোধ করে। বাবা-প্রবীরকাকা রান্নার প্রশংসা করলে সে হেসে হেসে ঘোরে এদিক-ওদিক। তার মনে হয়, আনন্দ নুড়িপাথরের মতো ছড়ানো, তার উপরে টুপটাপ খসে পড়ে খুশির শিউলি। যখন খুশি আঁচলে তুলে নিলেই হল! সে এখন একজন পাকা রাঁধুনি। ঘর গুছোয় চমৎকার। দুই বাড়ির কোথায় কোন জিনিসটি, তার মতো আর কেউ জানে না।

গোপালীমাসি ঝিরিকে দুধ খাওয়াচ্ছে, তেলমালিশ করছে, কিংবা ঘুম পাড়াচ্ছে। রাতটুকুর জন্য আয়া আসে। জয়মাতা আয়া সেন্টার। এই কলকাতা শহরে টাকা ফেললেই সব পাওয়া যায়। এ বাড়িতে ঝিরির জন্য আয়া, ও বাড়িতে টোপরের জন্য। জয়মাতার সব আয়া ঝুমু-র চেনা হয়ে গেল। কোনও কোনও আয়া ভারী হিংস্র। একজন টোপারকে এমন ঘুম পাড়াল থাবড়ে-থুবড়ে যে টোপরের পিঠে লালশিটে পড়ে গেল। ঝিরি বা টোপর কাঁথায় হাগু করলে এক-একজন এমন মুখ করত যে ভয়ে চিল-চিৎকার জুড়ত তারা! আর গোপালীমাসি সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় ভারী দুঃখের সঙ্গে বলত, ‘ঘরের বউ ঘরে না ফিরলে সংসার ভেসে যায়। নইলে কি এই মেয়ে ফেলে যেতে মন চায় আমার?’

বানিয়ে বলে না মাসি। সত্যি বলে। শুধু সংসার কী করে ভেসে যায় ঝুমু বুঝতেই পারত না। খুব বৃষ্টি হলেও এ পাড়ায় জল জমে না। সংসার ভাসবে কেন?

সময় পেলেই চলে আসত বড়পিসি। তার মুখেও এক কথা। ‘তোর মা সংসারটা ভাসিয়ে দিয়ে গেল। ভাগ্যিস গোপালী হাল ধরল! মাইনেটা অবশ্য খুব বেশি নেয় এই সুযোগে।’

মাইনে? সে তো আজও নিচ্ছে মাসি। কিন্তু ঝুমু জানে, কলকাতা শহরে টাকা ফেললে সব পাওয়া যায়, গোপালীমাসির স্নেহযত্ন পাওয়া যায় না। অনেকদিন, অনেকদিন ঝুমু দেখেছে, ঝিরি চিৎকার করে কাঁদছে, লাল হয়ে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে, দম আটকে আসছে। চিৎকারের বেগে ছোট্ট লাল জিভ থিরথির কাঁপছে। গোপালীমাসি তাকে দোলাচ্ছে, থাবড়া মারছে। ভোলাচ্ছে! ব্যর্থ! সব ব্যর্থ করে দিয়ে ঝিরির খ্যাপাটে কান্না সারা বাড়িতে আর্ত কাঁপন লাগিয়ে দিচ্ছে। গোপালীমাসি ব্লাউজের হুক খুলল। ‘খ্যাপ উঠেছে। মাই না পেলে ছাড়বে না। আচ্ছা, বলো দেখি, আমার বুকে তো দুধ নেই। শুধু চুষবে।’ গুঁজে দিল ঝিরির মুখে। ঝিরি শান্ত। চক্ চক্ শব্দ তুলছে। ছোট্ট পা ছুড়ছে। ‘তুই তবু মায়ের দুধ পেয়েছিস ঝুমু, ঝিরিটা তাও পেল না। যা তো মা, বাবাকে একটু মুড়ি মেখে দিয়ে আয়। আপিস থেকে ফিরেছেন। পেটে খিদে। এই মেয়ে এখন সহজে ছাড়বে না।’

পঞ্চম বর্ষীয়া বালিকা ঝুমু, তৈল-লবণ-ঊষণ-গন্ধপত্র দ্বারা ভৃষ্টান্ন ম্রক্ষণ করতঃ উহা সুস্বাদু জ্ঞানে পিতার সম্মুখে ধরিয়া কহিল, ‘বাবা, খাও।’

জ্যোতির্ময় মেয়ের দিকে তাকালেন। বাতি নিভিয়ে বসলেন বাইরের বারান্দায়। ঝুমু কোলে। মুড়ি খাচ্ছেন। ঝুমুও খাচ্ছে। কী নুন! উঃ! কী ঝাল! জ্যোতির্ময় বলছেন, ‘তুই ভারী শান্ত মেয়ে। ভাল মেয়ে তুই। তোর মায়ের মতো।’

আর ঝুমু সত্যিই মায়ের মতো হয়ে গেল। কী মায়া! সকলের সুবিধার দিকে কী নজর! পাছে বাবা দুঃখ পায়, তাই জ্যোতির্ময় যা বলেন, ঝুমু তাতেই মাথা নাড়ে। বাবা দুঃখী মানুষ। অকালবিপত্নীক। ‘সাথীহারার গোপন ব্যথা বলব কারে সে জন কোথা।’ এখনও এ বাড়িতে কেসেট রেকর্ডে গান শোনা হয়। ঝুমুই শোনে বেশি। জ্যোতির্ময় শোনেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গান। জগন্ময় মিত্রর সুরেলা নাকী সুরে ‘তুমি আজ কত দূরে’ অথবা চিররমণীয় কণ্ঠ মান্না দে পরিবেশিত ‘কতদিন দেখিনি তোমায়, মনে পড়ে তব মুখখানি।’ বিচ্ছেদবেদনার উৎস মায়ের মৃত্যু। তখন থেকেই বাবা আর প্রবীরকাকার দাবা খেলার নেশা।

ঝুমু চটি খুলে ঘরে এল। প্রবীর সহাস্যে বললেন, ‘আয় তো মা। আমার ভাত-ডাল একটু গরম করে দে। প্রতিমা আজ দশটায় আসবে বলল। সময়মতো অফিস না পৌঁছলেই নয়। আর এই তাড়া ভাল লাগে না। একটা বছর পার করতে পারলে বাঁচি। আঃ! খুব বিশ্রাম করব। ছাতে বাগান করব। আর জ্যোতির সঙ্গে দাবা খেলব।’

ঝুমু হিমযন্ত্র থেকে ভাত, ডাল, সবজি বার করল। মাইক্রোচুল্লিবান্ধব উষ্ণায়ণ পাত্রে সব তুলে নিচ্ছে। সরকারি হিসাব নিরীক্ষণ দপ্তরে উচ্চপদস্থ প্রবীর, দেরি করে গেলে তাঁর চলে না। সেদিক থেকে জ্যোতির্ময়ের কিছু সুবিধা আছে। দশটা নাগাদ বেরোলেই তাঁর চলে যায়। তাঁর হল বিক্রয়কর দপ্তর।

সংসারে যাতে সুবিধা হয়, কাজ হতে পারে দ্রুত এবং অনায়াস, তার ব্যবস্থায় প্রবীর সদা উদ্যোগী। খরচে তাঁর পরোয়া নেই। তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় কথা-টোপরের পক্ষে ব্যবস্থা অনুকূল কিনা। মাইক্রোচুল্লি সদ্য বাজারে আসতেই প্রবীর তা কিনে এনেছেন। এ বিষয়ে দুই বাড়িতে বড়ই বৈপরীত্য! প্রবীর ও জ্যোতির্ময় যতই বন্ধু হোন, স্বভাবে তাঁদের মিল কম। প্রবীর গাছ পরিচর্যা করেন, হাহা হেসে, টোপরের সঙ্গে যুক্তি-তক্কো করে, দাবা খেলে দরাজ উড়িয়ে দিতে চান দুঃখ-বিষাদ! জ্যোতির্ময় চাপা, কৃপণ, সন্ত্রস্ত। তাঁর যে দুই কন্যা, এ যেন দুটি বিষম বোঝা হয়ে তাঁকে নিরানন্দ রাখে। স্ত্রী হারানোর বিষাদ মিশে তাঁর দুঃখ পথে ঢালা, রোদে জ্বলা, ঘন আঠালো পিচের মতো চটচটে, থকথকে। তিনি বড়ই কৃপণ! ঝুমুদের কেসেট রেকর্ড বাজানোর যন্ত্রখানা যেদিন মেরামত করেও আর বাজবে না, সেদিন হয়তো নতুন কিছু আসবে। কোনও স্বল্পমূল্য ব্যবস্থা! মাইক্রোচুল্লির কথা ঝুমু ভাবতেও পারে না!

চাকা লাগানো চেয়ারে বসে ঘরে এল টোপর। বলল, ‘তোমরা বড্ড তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ বাবা।’

‘কেন তোমার একথা মনে হল?’

‘অবসরের জন্য ব্যগ্র হয় তো বুড়োরাই।’

‘না। বুদ্ধিমানেরাও ব্যগ্র থাকে। চাকরি হল বন্ধন। তোমার ইচ্ছে না করলেও ভার বইতে হবে। ধোপার গাধা। অবসর হল স্বাধীনতা। দীর্ঘ সময় চাকরি করলাম, উপার্জন, ভবিষ্যতের সংস্থান, বাড়ি— সব হল। এখন আমার যেমন ইচ্ছে তেমন দিন কাটাব। মাঝেমধ্যে ভ্রমণে যাব। শান্তি শান্তি! এর মধ্যে ছেলে মানুষ করার একটা দায়িত্ব ছিল। তা তোমাকে দেখতে তো মানুষের মতোই লাগছে। এবারে রোজগেরে হও দেখি বাপ।’

‘আজ সন্ধ্যেয় ফিরে শুনবে আমি রোজগেরে।’

‘হুঁ? ব্যাপার কী?’

‘যাব এক জায়গায়। সাক্ষাৎ করতে।’

‘ইন্টারভ্যু?’

‘ইনফরমাল। বন্ধুর মতো কথা হবে।’

‘কোথায়? চাকুরিদাতারা আজকাল বন্ধুবৎসল হয় বুঝি?’

‘আমাদের কাজে হতে হয় বাবা। এ জগতে আত্মাভিমানের চেয়ে বাজার দখলের সাফল্য গুরুত্ব পায় বেশি। বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা তাই একান্তই প্রয়োজন। যেতে হবে ক্যামাক স্ট্রিট। বিকেল চারটে। কী সংস্থা, কোন তলে অবস্থিত, বেতনক্রম কী, আশা করি এসব প্রশ্ন করতঃ আপনি বিব্রত করিতে প্রবৃত্ত হইবেন না।’

‘পলাশ সঙ্গে থাকছে কিনা জানতে পারি?’

‘থাকছে।’

‘আশ্বস্ত হলাম। ধন্যবাদ।’

ঝুমু হাসিমুখ করে কথা শুনে যাচ্ছে। প্রবীর খাচ্ছেন। সে সামনে বসে জল-নুন সব এগিয়ে দিচ্ছে। আজ কাকার মেজাজ ভাল আছে। খোশমেজাজে থাকতে সচেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু কখনও গভীর অবসাদগ্রস্ত। অবসাদকালীন তাঁর চোখের তলায় গাঢ় কালি পড়ে। মূক নির্জীব এক মানুষ। জ্যোতির্ময় ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে একটি কথাও বলেন না। সেই সময় ঝুমুর গা ছমছম করে। এবাড়িতে এলে মনে হয় ঘরগুলো কেমন অন্ধকার। তখন সে সব জানালা হাট খুলে দেয়। সব পরদা সরিয়ে দেয়। আলো আসুক, আলো আসুক। আরও আরও আলো। মেঝে স্যাঁতসেঁতে, দেওয়াল স্যাঁতসেঁতে; মসৃণ, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর রঙের দেওয়ালে অতীতের অসহ বেদনার অভিঘাত ঝুলকালি হয়ে নেমে আসে হে আলোকময়, ধুইয়ে দাও সব। মুছে দাও দাগ। যে দাগ কেবল কিছু স্মৃতি। মূল্যহীন।

প্রবীর বেরিয়ে গেলেন। ঝুমু সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে এটা-ওটা গোছাচ্ছে। মশারি ভাঁজ করল। বিছানা পরিপাটি করল। এঁটো বাসনে জল ঢেলে ভিজিয়ে রাখল। প্রবীর ভিজে তোয়ালেখানা কোনও ভাবে দায়সারা ঝুলিয়ে দিয়েছেন, সেটি টানটান করে মেলে দিল।

‘এইজন্য তোমায় ডাকলাম নাকি?’

‘তবে কী জন্য?’

‘এসব কাজ তো প্রতিমাদিও পারে।’

‘আমি আরও ভাল পারি।’

‘রাগ করেছ কেন? এসো না এদিকে, আমার কাছে বোসো।’

‘হুঁ! আমার আর কাজ নেই। বাবা ডাকল বলে।’

‘না। তোমার আর কোনও কাজ নেই। তুমি এসো। এসো আমার সঙ্গে।’

টোপর শক্ত করে ঝুমুর হাত ধরল। টানছে। খুব জোর হাতে। পা দুর্বল বলে অনেক কাজ তাকে হাতের ভরে করে নিতে হয়। নিয়মিত ব্যায়াম ও প্রাণায়াম করে। শরীরের অর্ধেক নিষ্ক্রিয় বলে বাকি অর্ধেক সতেজ সবল রাখতে চায়। টোপরের কাছে এলে সৌরভের আঘ্রাণ পায় সে। জীবনীশক্তির গন্ধ। সে জানে পৃথিবীতে আর কারও অস্তিত্বে এ গন্ধ নেই।

‘লাগছে টোপর।’

‘ওঃ! বুঝতে পারিনি। তুমি রাগ করলে আমার ভাল্লাগে না।’

ঝুমু হেসে ফেলল। ‘বল কী বলবি।’

‘আজ আমার জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ।’

‘তো? আমি কী করব? বললি, তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।’

‘আচ্ছা। রাগ করেই থাকো তুমি।’

‘রাগ করবই তো। আমাকে বলিসনি তো? এত বড় একটা ব্যাপার, আমাকে বলবি না! আমিও কিছু বলব না, যা।’

‘কী?’

‘রবিবার আমার পঞ্চম প্রদর্শনী।’

‘অ! সেকথায় পরে আসছি। আগে আমাকে শুভেচ্ছা জানাও।’

ঝুমু হেসে টোপরের চুল ঘেঁটে দিল। ‘আশীর্বাদ করি। উপার্জনক্ষম হও। আমার আর ভাবনা নেই। দামি দামি শাড়ি-টারি পছন্দ করব আর তোর টাকা ওড়াব।’

‘শুধু শাড়ি?’

‘আর কী?’

‘তুমি তোমার ওড়না পেতে দাঁড়াবে, আমি সমস্ত উপার্জিত ধনসম্পদ দেব তোমার আঁচলে। তুমি তোমার লাল বাঁধানো খাতাখানি নিয়ে বসবে হিসেব কষতে। আমাদের সমস্ত জমাখরচের ভার যে তোমারই ’পরে। প্রতিমাদি কৃষ্ণপত্র ভেজানো চিনেমাটির কাতলিখানা রাখবে এনে তোমার-আমার মাঝখানে, সঙ্গে দুটি ধবধবে সাদা চিনেমাটির পেয়ালা। চায়ের সুগন্ধে তোমার আনমনা মুখে একচিলতে হাসির রেখা, তারই ’পরে বিজলি বাতির আলোছায়ার খেলা। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখব তোমার অপার্থিব লাবণ্য। দেখব আমার সুখ। আমার শান্তি।’

‘তুই সাহিত্যিক হয়ে যা টোপর। রবিঠাকুরের ভাষা চমৎকার টুকেছিস। কী ভাল মিথ্যে বুনতে পারিস! চালটা যে রাবীন্দ্রিক, সে বোধহয় তোর স্বেচ্ছানির্বাচন।’

‘হা হা! কেমন দিলাম!’

‘খুব ভাল। চমৎকার। এবারে আমাকে তোর শুভেচ্ছা জানাবার পালা। বিফল প্রদর্শনী আর ভাল লাগে না যে।’

‘বসো কেন?’

‘কী করব? এটাই যে নিয়ম।’

‘সব নিয়ম মানতে হবে?’

‘প্রেমও যে হল না একটা।’

‘ঠিক জানো? হয়নি?’

‘বা রে! আমার প্রেম হলে তুই জানতি না?’

‘কিংবা আমিই জানি, তুমি জানো না। উস্ মন্তর ফুস্ মন্তর হ্রিং ক্রিং ফট্! নাও, মন্তর পড়ে দিলাম। আর পাত্রপক্ষ তোমায় পছন্দ করবেই না। প্রত্যেকবার আমি এই মন্ত্র পড়ে দিই, আর ওরা সব মিষ্টি খেয়ে তোমার মিষ্টি লাজুক মুখখানা দেখে বিদেয় হয়।’

‘এরকম করিস না। তুই আমার শত্রু নাকি? জানিস বড়পিসি কী বলেছে? গোয়ালভরা বাঁজা গাই/আইবুড়ি ঘরে/ধন খায় মান খায়/অন্ন ধ্বংস করে।’

‘বড়পিসির ভীমরতি হয়েছে। একটা অচেনা অজানা লোক, টোপর পরে ক’টা মন্ত্র বলে তোমায় নিয়ে যাবে! টোপর পরে! ওঃ হোঃ হোঃ হোঃ! আঃ হাঃ হাঃ হাঃ! টোপর পরে!’

হাসতে হাসতে লাল হয়ে যাচ্ছে টোপর। বেদম হয়ে যাচ্ছে। এলিয়ে পড়ছে তার চাকাওয়ালা চেয়ারের হাতলে। তার এই বাহনটিকে সে বলে গড়গড়ি। ঝুমু টোপরের হাসি দেখছে। নিজেও হাসছে আর বলছে থাম্, থাম্ টোপর। বিষম লাগবে।

হালকা ঢেউয়ের মতো চুল, ফর্সা গালে প্রস্ফুটিতে লাল কয়েকটি ব্রণ, ভাসা-ভাসা চোখ দু’টি, পাতলা ঠোঁট, চিবুকের কাছে দাড়ি রাখছে আজকাল। সে যখন উপবিষ্ট, অপরিচিত যে কেউ তার প্রশংসা করবে, ফিরে দেখবে তাকে, ঈশ্বর যে কতখানি অবিচার করেছেন, কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। তার উপর আরোপিত নামগুলি বিষম ভার। শতরূপ। শতরূপ। শতরূপ। সে নিজেই নিজের অবস্থাকে পরিহাস করে বলে অর্ধশতরূপ। এখন সে হাসতে হাসতে বলছে, ‘ভাবো ঝুমুদি, ভেবে দেখো, একখানা ভঙ্গুর চোঙা, দু’পাশে ল্যাতপ্যাত করছে দুটি কদমফুল, ঠিক আমার পায়ের মতো না? একদম! বলো একদম! টোপর! হা হা হা! একজন পুরুষ ও একজন নারী মিলনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছে কদমফুল লাগানো চোঙা পরে! হাঃ হাঃ হাঃ! আমার নামটা! হোঃ হোঃ! নামটা! একদম সার্থক!’

হাসতে হাসতে চোখে জল এসে গেছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। মুখের পেশি ভেঙেচুরে যাচ্ছে। হাসছিল। কাঁদছে। হাসতে হাসতে কাঁদছে কেন? ও কাঁদছে কেন? সরলসোজা ঝুমুর ভাবছেই না এই হাসিকান্নার তীব্র বিপরীতমুখি আবেগের উৎস অন্য কিছু, অন্য কোথাও হলেও হতে পারে। নিজের অশক্ত অকেজো পা দুটি নিয়ে টোপরের অভিযোগ বিন্দুমাত্র, কৌতুকপূর্ণ ব্যঙ্গবিদ্রূপই বেশি। প্রতিবন্ধকতা ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার মতো আত্মবিশ্বাসীই কেবল এমনটি করতে পারে। স্বভাবত, আপন দুঃখ-কষ্ট অন্তরে ধারণের শক্তি তার আছে! তাই, তার আবেগ বড়ই গভীর।

‘এই! এই টোপর! কী পাগল তুই! কাঁদছিস কেন? তাকা। আমার দিকে তাকা। তোকে এভাবে কাঁদতে দেখতে আমার ভাল লাগে?’

‘বিশ্বাস করো ঝুমুদি, যতদিন, যতবার আমি ভেবেছি, তোমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তুমি চলে যাচ্ছ, আমার অসম্ভব কষ্ট হয়। ভীষণ কান্না পায়। কেন এরকম হয় ঝুমুদি? তুমি কে আমার? তুমি কি আমার মা? আমার দিদি? আমার বন্ধু? আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু? নাকি তারও বেশি? তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না কেন?’

ঝুমু নেমে এসেছে। এতক্ষণ যে বিছানায় কোমর ঠেকিয়ে না-দণ্ডায়মান না-উপবিষ্ট ভঙ্গিতে ছিল, সেখান থেকে নেমে এসেছে। একপাশে চওড়া আয়না লাগানো সাজের আয়ত টেবিল, শূন্য, রুপুকাকিমা ব্যবহার করতেন। ওই আয়নায় গড়গড়িসহ টোপরের পার্শ্বপ্রতিবিম্ব। সাজটেবিলের পাশে একটি দারুকোলাঙ্গ। আধাকুলুঙ্গি, আধাদেরাজ, রুপুকাকিমার শাড়িতে ভরা। প্রত্যেক বছর বর্ষা কেটে গেলে সোনার টোপর পরা শরতের রোদ যখন ঝিলিমিলি জলের মতো ছাতে বিছিয়ে যায়, যাবতীয় লেপ-তোষক-কম্বলের সঙ্গে ঝুমু রুপুকাকিমার শাড়িগুলিও রৌদ্রস্নানে দেয়। আর একবার দেয় বিষাদের হেমন্তে, যখন রোদ আসে ক্ষণিকের অতিথির মতো, জলের তলায় জলপোকা আর আলোকপিয়াসী মৎস্যকুমারদের কৃপণ আলোর পর ছায়া দিয়ে দিগন্তে পালায়। ঝুমু তখন লোক ডাকে ষাণ্মাসিক ঝাড়পোছের জন্য! তার জ্ঞাতসারে অথচ অন্তরালে থাকা সমস্ত দারুকোলাঙ্গের, সিন্দুকের, স্টিল আলমারির, দেরাজসমূহের লেপতোষক, কম্বল, শাল গরম জামাশাড়ি সে পুনরায় হেমন্তের আতপতাপে সিদ্ধ করে। এক নারীর ফেলে যাওয়া সংসার, অপর নারীর ছেড়ে যাওয়া সংসার সে রক্ষা করে চলে ইঁদুর, আরশোলা, উইপোকা, টিকটিকি, ছুঁচো, ছত্রাক, ব্যাকটিরিয়ার নিষ্ঠুর আক্রমণের থেকে।

ঝিরি যতই বলুক, এই এলাকা খারাপ, তপোবন নয়, অভিজাত পল্লি হতে হতেও হয়নি কারণ সরু গলি দিয়ে ঢুকে পড়েছে অশিক্ষা, অপরিশীলন, নির্ধন, শ্রমসম্বল মানুষের দল— নিত্য বিবদমান, মদ্যপ, লম্পট, নারীপীড়ক ও ধর্ষকে ঠাসা, তবু, ঝুমুর মনে হয়, ভাল তো। পারস্য গালিচায় চেপে সে দ্বিতীয় তলে অবস্থান করে, চাইলেই দেখতে পায় অন্য ভুবন মাটির সঙ্গে গাঁথা। এক বালতি জলের জন্য চুলোচুলি, বিকেলবেলায় পানদোক্তা মুখে পুরে এক চুলো অপর চুলির উকুন বাছতে বসে। আহা, ঝুমু বড় ভালবাসে এই কানাই সামন্ত গলিখান, বড় ভালবাসে বর্ষায় লেপ-কম্বল-কাপড়-জামায় ঢুকে পড়ে যে সোঁদা ভ্যাপসা গন্ধ, বড় ভালবাসে রান্নার বই, ঝিরির মুখঝামটা, টোপরের সর্বস্ব উজাড় করা দাবিগুলি। তুমি এসো। তুমি এখন যাবে না। এই রান্নাটা বিচ্ছিরি। চিঁড়ে ভেজে দাও সেদিনের মতো। ফালি ফালি কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ। ভালবাসে প্রবীরকাকার শার্ট থেকে খসে পড়া বোতাম পুনর্বহাল করার কাজ, বাবার জন্য প্রতি রাত্রে ইশবগুলের ভুষি গুলে দেওয়া। টোপরের কম্পিউটার, গানের রেকর্ড, বইবিনিময়, গড়গড়ি, তালবেতাল, দুঃখসুখের কথা, কথা, কথা— ‘ফুরায় না তো ফুরায় না। তোমায় পাওয়া।’ ঝুমুর চোখ ভিজে যাচ্ছে, কান্না কেমন সংক্রমক! পাগলটা কাঁদছেও দেখো, যেন কেউ মরে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে চিরবিদায় বলে। হাতের পরিবর্তে পা দিয়ে টা টা করতে করতে যাচ্ছে। আর ঝুমুকেও কাঁদতে হচ্ছে। এদিকে, যেন একেবারে ছায়াছবির দুঃখের দৃশ্য রচনার জন্য গেয়ে চলেছেন দেবব্রত বিশ্বাস-‘তোমার সুধারসের ধারা গহনপথে এসে/ ব্যথারে মোর মধুর করি নয়নে যায় ভেসে।’

‘পাগল, ও পাগল। চুপ কর সোনা। দ্যাখ আমার দিকে। তাকা। এই।’

গড়গড়ির সামনে হাঁটু মুড়ে ঝুমু। টোপরের চুল ঘাঁটছে, প্রায়নিষ্ক্রিয় পা দুটির ওপর হাত রেখেছে। টোপর খুব জেদ করলে ঝুমু এমনই নেমে আসে ভূমিতে। চিরকাল।

তাদের প্রতিবিম্বিত দৃশ্যে অবিরাম জলধারা।

‘তুমি চলে যাবে না, বলো।’

‘কোথায় যাব না?’ নাক টানছে, চোখ মুছছে ঝুমু। কান্না কেন? কেন কান্না?

‘আমাকে ছেড়ে।’

‘তোকে ছেড়ে? আমি কী করব? বিয়ে না হলে আমার বয়েই গেল। কিন্তু বাবা চাইছে যে। বড়পিসি চাইছে। ছোটপিসি এমনিতে খোঁজ করে না, আজকাল মাঝেমধ্যেই ফোন করে জানতে চায় আমার বিয়ে ঠিক হল কিনা। দিদার সঙ্গে দেখা হলেই এক কথা। কবে নাতজামাইয়ের মুখ দেখব।’

‘সত্যি বলো, বিয়ে হচ্ছে না বলে তোমার কষ্ট নেই?’

‘তোকে ছুঁয়ে মিথ্যে বলব আমি?’

টোপর হাসল। কী প্রশান্তি মুখটায়। ঝুমু উঠল, তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে দিল। টোপর মুখ মুছে নিল। বলল, ‘আমাকে এত আদরযত্ন করা কীসের জন্য? অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছ। এবার দায় এড়াবে কী করে?’

‘আমি দায় এড়াচ্ছি কোথায়? তা ছাড়া দায়টা কী? তোর আদরযত্ন করব না? ঝিরির জন্য করি না?’

‘সবার জন্য করো। সেইটাই তো তোমার দোষ ঝুমুদি। একটা নতুন শতাব্দী যে গড়িয়ে গেল ক’ বছর, তুমি যেন সেই শরত্চন্দ্রের বড়দিদি, মেজদিদি।’

‘না রে বাবা না, আমায় অত পাওনি। আজ সব কিছু ছেড়ে তুই আমাকে নিয়ে পড়লি কেন বলতো।’

‘আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো, আমরা সবাই তোমাকে ব্যবহার করছি।’

‘যাঃ! তোর মাথাটা পুরো গোলমাল হয়ে গেছে রে! নিজের লোক আবার ব্যবহার করবে কী!’

‘ওই তো। নিজের লোক। তার মায়া, স্নেহ, ভালবাসা! মানুষ খুব চমৎকার উপায়ে তার সুযোগ নেয়।’

‘খুব চমৎকার উপায়ে নয়, বলতে পারিস নানা উপায়ে, অভিনব পন্থায়, বিবিধ রকমে।’

‘হুঁ! আমি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তাই যা মনে আসে বলে দিই। আমার দেখা আর বলা দুটোই আলাদা জানো তো, কারণ আমার জগৎটাই আলাদা আর পাঁচজনের চেয়ে। আমার মাটিতে পা পড়ে না। আমি লক্ষ করে দেখেছি, আমরা সবাই নিজের শর্তে জীবনযাপন করি। আমাদের মেজাজ-মর্জি, খিদে, মনখারাপ, উদ্বেগ, ইচ্ছা-তুমি প্রত্যেককে সাহায্য করতে থাকো। কেবল তোমার কোনও শর্ত নেই। সবার জন্য তোমার চিন্তা। তোমার জন্য কেউ ভাবছে না তা নয়, ভাবছে তার নিজের শর্তে।’

‘দুর, আমি ওভাবে ভাবি না। আমার তো কোনও অভাববোধ নেই! গোপালীমাসির হয়তো স্কুল-কলেজের শিক্ষা-দীক্ষা নেই, কিন্তু মানুষটা তো ভাল, মায়ের মতোই আগলায়। মা নেই বলে আমার আর দুঃখ হয় না। আমি, তুই, ঝিরি— আমরা সবাই মাকে ছাড়া বড় হয়ে গিয়েছি। নিজেদের অভাব মেটাতে পারল না বাবা আর প্রবীরকাকা। দু’জনেই বেচারা। আমাদের মুখ চেয়ে আর একটা বিয়েটিয়েও করতে পারল না।’

‘করলেও আমরা বড় হয়েই যেতাম। তবে আমার বাবা যে আমার জন্য বিয়ে করেনি তা নয়। এ নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। আমি যাতে কোনও ভাবেই নিজেকে বাবার দায় মনে না করি, তার জন্য বাবা খুব সচেতন।’

‘তা জানি। তবে কাকা আর বিয়ে করল না কেন?’

‘কারণ বাবা মনে করে, বিবাহিত জীবনের জন্য প্রেম অত্যন্ত জরুরি। আমি বাবা-মায়ের যৌনাভ্যাসজাত সন্তান। কিংবা আপাত মুগ্ধতাজাত। যেটা ওরা ভালবাসা বলে ভুল করেছিল। পরে দু’জনেই বুঝেছিল, ওদের মধ্যে প্রেম জন্মায়নি কখনও।’

‘আমাদের দেশে এভাবেই কোটি কোটি মানুষ জন্মায়। টোপর। এটা একটা, কী বলব, বংশরক্ষার প্রথা। আরও বড় করে দেখলে নতুন প্রজন্ম বহমান রাখার পদ্ধতি। এর জন্য জৈবচাহিদাই প্রথমত প্রয়োজন। দুটো অচেনা মানুষ বিয়ে করল, তাদের মধ্যে প্রেম হল কী হল না, এটা একটা বাজি। আবার প্রেমের বিয়েও বিবাহিতর শর্তসাপেক্ষে অচল হতে পারে, ফুরিয়ে যেতে পারে। আমার দু’জন বন্ধু, কলেজে পড়ত আমার সঙ্গে, প্রেম করে বিয়ে করেছিল, এখন পস্তাচ্ছে। বাপের বাড়িতে ফিরে আসার মুখ নেই, বরকে ছেড়ে একলা বাচ্চা নিয়ে থাকার সাহস বা ক্ষমতা নেই। অতৃপ্ত, অসুখী, তবু ওই জীবনের সঙ্গে চিরকালের শেকলে বাঁধা। বিয়ে ব্যাপারটা আসলে একটা জুয়াখেলা।’

‘বাবা সেটাই আর খেলতে চায়নি। দু’রকম সংকল্প নিয়েছিল। এক, নারীবিবর্জিত পরিবার, আর আমাকে আমার প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। দুই, মন থেকে যৌনতার আকাঙ্ক্ষা উপড়ে ফেলা। বাবা আমাকে বুঝিয়েছিল, যৌনতা একটি স্বাভাবিক শারীর প্রক্রিয়া যা সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’

‘তুই কী ভাবছিস রে টোপর? আমি যে বিয়ে করতে রাজি, তা ওইসব করতে চাই বলে?’

‘না গো! সেজন্য এত কথা বলছি না। আজ আমার আর বাবার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাপেক্ষেও।’

‘কী যে বলিস পাগল! তোর অর্ধেক কথা আমি বুঝতেই পারি না।’

‘বুঝতে চাও না, তাই। ঝুমুদি, তুমি যেন ব্রত নিয়েছ, তোমাকে সাধারণ হয়ে থাকতে হবে। অর্ধেক বুঝবে না, অর্ধেক চাইবে না। নিজের জন্য শূন্য। অন্য কারও ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে। যেন, ঈশ্বর বলেছিলেন, ঝুমু, কী বর চাও বলো। ঝুমু বলল, ‘সাধারণের চেয়েও সাধারণ থাকি যেন প্রভু। তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুণা…!’ নীচে বসে থেকো না। তুমি বেশিক্ষণ আমার পায়ের কাছে বসলে আমার পায়ের সাড় ফিরে আসতে চায়।’

‘তাই যদি আসে, আমি সারাজীবন তোর পায়ের কাছে বসে থাকতে রাজি আছি রে টোপর।’

‘মুশকিল ঝুমুদি। একটাই মুশকিল।’

‘কী?’

‘আমার পায়ের সাড় এলে গড়গড়ির কী হবে?’

‘পাজি! আমি ভাবলাম তুই বলবি— ঝুমুদি, তোমার স্থান যে আমার মাথায়।’

‘দুত্তোর! তোমার বাহান্ন কেজি ওজন মাথায় নিয়ে মেরুদণ্ডের বারোটা বাজাব নাকি? আপাতত আমার লাঠি দুটো দাও। আমার তালবেতাল। আর তুমি ওই সোফায় বসো। আমি তোমার কোলে মাথা রাখব।’

‘প্রতিমা এলে বা অন্য কেউ এলে উঠে বসবি কিন্তু। তা ছাড়া বাবা ডাকল বলে।’

‘ডাকলে বলব তুমি নেই। এখন আমাকে অনেক কথা বলতে হবে। তোমার কোলে শুয়ে। তোমাকে ছুঁয়ে।’

‘আমি এখানে নেই তো এই সাতসকালে আমি কোথায়? ঝিরি জানে আমি তোর কাছে এসেছি।’

‘ওই সবজান্তা পাকাটাকে সব কথা বলো কেন?’

‘বাঃ! বলব না?’

‘না। বলবে না। আজ থেকে, এখন থেকে, আমি তোমাকে যা যা বলব, তোমার সঙ্গে যা যা করব, তুমি কিছু ঝিরিকে বলবে না। শুধু তোমার আর আমার একটা জগৎ হতে পারে না কেন ঝুমুদি?’

‘তোকে কি এমনি আমি পাগল বলি? তুই উন্মাদ।’

ঝুমুর পায়ে ঝঝি ধরে গিয়েছে। সে উঃ আঃ করতে করতে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে, টোপরের লাঠি এনে দিল। বাহুতে ধাতব বন্ধনী, শক্ত ধাতুর নির্ভরযষ্টি। টোপর এদের বলে সে তালবেতাল। গড়গড়ি ছেড়ে উঠতে-বসতে তালবেতাল প্রয়োজন তার। জানুসন্ধি থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অসাড়। ডাক্তারি ব্যাখ্যায় হাফ-প্যারালিটিক। জানু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আংশিক সক্ষমতা। দাঁড় করিয়ে দিলে পড়ে যায়। পায়ের উপর পা তুলতে পারে না। কিন্তু তুলে দিলে অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ছেঁচড়ে নামিয়ে নিতে পারে। ঊরু অবধি টানা একটি খাঁচায় পা গলিয়ে সে গাড়ি চালায়। মূলত ঊরুপেশির সঞ্চালনেই তা সম্ভব করতে হয়। খাঁচার মধ্যে যে শক্ত স্টিলের দণ্ড, প্রবল পরাক্রমে ঊরুপেশি তাকেই সঞ্চালিত করে, চাপ দেয়, পা উপলক্ষ মাত্র। প্রথম প্রথম অভ্যাস করতে গিয়ে সে ল্যাগব্যাগান্ডিসের মতো হয়ে যেত। ঊরু সঞ্চালন প্রয়াসে ঘর্মাক্ত শরীর ক্রমশ নেমে পড়তে চাইত আসন থেকে। সে তখন জ্যামিতিক নকশা তৈরি করতে লাগল। ঠিক কোথায় কীভাবে বলপ্রয়োগ করলে তা পূর্ণমাত্রায় কার্যকর হবে। জহর তাকে সাহায্য করতেন। সাহস জুগিয়েছেন কত!

‘ধরো, একটা পুতুল গাড়ি চালাচ্ছে। একটা রোবটই ধরো।’ সে বলত ঝুমুরকে। ঝুমু সাগ্রহে দেখত সেই নকশা। জটিল অঙ্কের মতো। হয়তো অঙ্কই। সে বলত, ‘পারবি, তুই ঠিক পারবি টোপর।’

ঝিরি বলত, ‘দরকার কী! একটা ড্রাইভার হলেই তো মিটে যায়।’

ঝিরি বোঝে না, প্রতিবন্ধকতা জয় করার অন্য নাম আনন্দ!

প্রবীর, টোপরের ব্যবহার্য গাড়ি কেনার আগে কয়েকটি অংশ বিশেষভাবে নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রযুক্তি প্রতিবন্ধীকে সেই সুযোগটুকু দেয়। কিন্তু প্রযুক্তি আয়ত্ত করা এক যুদ্ধ বটে।

প্রথম যেদিন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গাড়ি চালাতে পারল টোপর, তারা রীতিমতো উৎসব করেছিল। ঝুমু জটা-নমির শিব, লেক কালীবাড়ি, কালীঘাট, ২৩ পল্লির দুর্গাবাড়ি, পাড়ার শনিমন্দির সর্বত্র পুজো দিয়েছিল টোপরের জন্য।

অপরিসীম মনের জোরে টোপর এই সক্ষমতা আয়ত্ত করেছে। টোপর নিরন্তর সংগ্রামী। যতখানি সম্ভব, প্রতিবন্ধকতা জয় করার প্রয়াসী। ঘরের মধ্যে যাবতীয় কাজ সে একাকী পারে। বাইরে বেরুলে সঙ্গী ছাড়া চলে না। এখানেই সে চিরকালের জন্য হেরে বসে আছে। শৈশবে মা ছিল তার চলনদার। মা যখন ফেলে চলে গেল, সরু গলির মোহন বা জহর বা সুভাষ, তাকে ইস্কুলে দেওয়া-নেওয়ার ভার গ্রহণ করেছিল। টোপর মজা করে বলত— আমার রোজকার বাঁচায় ওরা রোজগার বাজায়। এখন পলাশ তার চলনদার। আগামী সময়ে আর কেউ তার সহায় হবে। সে বলে— বাবা ভাল রোজগার করে, আমাকে তেইশ বছর পর্যন্ত সহায়তা জুগিয়েছে। এবার আমিই আমার স্লেজগাড়ির বাহক। প্রচুর টাকা করতে হবে, বুঝলে ঝুমুদি। তুমি হবে আমার ধনলক্ষ্মী।

ঝুমুর কোলে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকল টোপর। চোখ বন্ধ। ঝুমু চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। নরম ঘন চুলে ঝুমুর নরম সরু আঙুল। তার বুকের ভিতর স্নেহসুধা-ধারার ঝরঝর ক্ষরণ! কী সুন্দর ছেলেটা! সে নিজের অজান্তেই টোপরের নাকে আঙুল রাখল। চোখে, গালে। তার বুক শিরশির করছে। কী করে রুপুকাকিমা টোপরকে ফেলে গেলেন? ঝুমু কি পারত?

না। অসম্ভব। সে মুখ নামিয়ে টোপরের কপালে চুমু খেল। গলার কাছটায় টনটন করে উঠছে। শ্বশুরবাড়ি তো যেতেই হবে। এই ছেলেটাকে রোজ আর দেখতে পাবে না তখন। কিছুই করতে পাবে না তার জন্য। এত কথা তখন কাকে বলবে টোপর? তার কথার নক্ষত্রকণা খেয়ালখুশিমতো সাজিয়ে তোলার জন্য, সাজসজ্জাবিহীনভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, ঝুমুই ছিল এক আকাশি আঁচল! মা যাকে ফেলে চেলে যায়, তার কাছে অন্য কোনও বান্ধব সহজে কি আসে? অন্য নারী কোনও? টোপরের স্কুলে, কলেজে, কম্পিউটারের ব্যয়বহুল সাবলীল প্রতিষ্ঠানে কোনও মেয়ে তাকে বলেনি ভালবাসি। টোপরও বলেনি কাউকে। অথচ সে এক আদর-কাড়া ছেলে। যারা তাকে কাছ থেকে চেনেন, তার গৃহশিক্ষকগণ, তার শরীরচর্চার প্রশিক্ষক সুপ্রিয়, কানাই সামন্ত সরু গলির বাসিন্দা গাড়িচালক শিক্ষক জহর, কম্পিউটার শিক্ষাসংস্থার দক্ষ, বুদ্ধিমান প্রযুক্তিবিদ— প্রত্যেকে টোপরকে গভীর ভালবাসেন। সকলেই টোপরকে উপলব্ধি করিয়ে দিয়েছেন, সে পারে। আর পাঁচটা লোকের মতোই তার সক্ষমতা।

নিয়মিত ইস্কুলে যেতে পারত না, তাই টোপরের কৈশোরের বন্ধু ঝিরি আর ঝুমু। মাঠে খেলা করতে পারত না, তাই তার শৈশবের সাথী ঝিরি ও ঝুমু। আজও, তেইশের যৌবরাজ্যে, টোপরের অন্য বন্ধু নেই। ঘনিষ্ঠ। প্রিয়। আজ কেবল ঝুমু। ঝিরি নয়। কেন ঝিরি টোপরের প্রিয় বন্ধু হল না? বন্ধু তারা ঠিকই। কিন্তু আলগা-আলগা। বন্ধুত্বের নানা স্তর থাকে! মাঝে মাঝে ঝুমু-র মনে হয়, সে যে টোপরকে এত ভালবাসে, এত, যে কোন পরিমাপ সম্ভব নয়, এতে ঝিরি একটু একটু ঈর্ষাকাতর! ছোট তো! অবুঝ! পরে ঠিক হয়ে যাবে! টোপরও তো ছোট! ঝুমু জানে। তাই এত মায়া। এত টান। তাই তো আদরে আদরে টোপরের কপাল ভিজিয়ে দিতে চায়।

‘আর একটা দাও।’

‘কী?’

‘চুমু দাও। ঠিক ওইখানটায়। যেখানে দিলে।’

‘উম্‌ম!’

‘আবার দাও।’

‘ম্‌ম্‌!’

‘আরও আরও! দিয়ে যাও ঝুমুদি যতক্ষণ না তোমার ঠোঁট থেঁৎলে রক্ত পড়ে।’

‘ধুৎ! বয়েই গেছে! ওমনি, না?’

‘আজ, এখন, আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে ঝুমুদি। মনে হচ্ছে, বিকেল থেকে আমার অন্য একটা জীবন আসছে, তার আগে এই জীবনে যা মনে আসে বলে ফেলি।’

‘বল। শুনি। খেয়েছিস সকালে কিছু?’

‘কেন? মুখে খিদে-গন্ধ?’

‘না। ভাল গন্ধ। তোর গন্ধ টোপর।’

‘হুঁ। অনেক কিছু খেয়েছি। প্রথমে দুধ আর ভুট্টার মুড়ি। সঙ্গে কলা। তারপর চুমু।’

‘আমার চুমু খেয়ে কী হবে!’

‘ওঃ! নিজে যেহেতু অন্য একজনের চুমু খাবে, তাই আমাকেও প্ররোচিত করতে চায়! তুমি তো খুব সহজ নও। পেটে পেটে বুদ্ধি ধরো, মাথা রাখো ফাঁকা, সেই লাজে সূর্যমুখী চাঁদ আজ বাঁকা!’

‘আমি আবার কার চুমু খাব। বরের? তা যদি খেতে হয়, খাব। কাবাব তো নয় যে ভাবতে ভাল লাগবে।’

‘চুমু খাবার কথা ভাব না ঝুমুদি?’

‘এ মাঃ! যাঃ!’

‘এ ব্যাপারে ঝিরি এগিয়ে আছে। বিবস্বানের সঙ্গে চুমু পর্যন্ত ভালই গড়িয়েছে। তুমিই সেকেলে হয়ে থাকলে।’

‘তুই ভাবিস?’

‘নিশ্চয়।’

‘কাকে ভাবিস?’

‘বলব?’

‘জানতেই তো চাইছি।’

‘রাগ করবে না কথা দাও।’

‘ও মা! রাগ করব কেন?’

‘না বাবা! যদি রাগ করো!’

‘করব না। বলছি তো।’

‘প্রিয়ঙ্কা চোপড়া।’

‘ইঃ! কী বিচ্ছিরি ঠোঁট!’

‘দারুণ ইয়ে! উত্তেজক! আকর্ষক! মোহময়ী!’

‘আমার কোনও নায়ককে এরকম চুমু খেতে ইচ্ছে করে না কেন?’

‘ভাগ্যিস করে না। সাধারণব্রতা শুদ্ধকুমারী, বিনম্রলতিকা বিনীতা, তুমি যে স্বপ্নে কল্পনায় চুমু খাবার জন্যও জ্যোতিকাকার অনুমতি চাইবে।’

‘মোটেই না!’

‘মোটেই না? চাকরিটা ছাড়লে কেন তবে? বললাম না, তোমাকে আমরা সবাই ব্যবহার করি। ভালবাসার ছলে, কিংবা ভালবাসার আড়ালে।’

‘না না। ওভাবে বলিস না। আমি তো সরকারি চাকরির পরীক্ষায় পারিনি। বড্ড কঠিন রে। আমার দ্বারা হতও না। আমি তো তেমন ভাল না লেখাপড়ায়। হয়তো সরকারি চাকরি করলে বাবা আপত্তি করত না। বড়পিসিরও একদম মত ছিল না। মা নেই তো। আমরা দুইবোন বাবার কাঁধে। ভয় পায় আসলে।’

‘ফক্স অ্যান্ড গুপ্তা কোনও সাধারণ কোম্পানি নয় কিন্তু। তোমার কমার্স ডিগ্রি, শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ পেয়েছিলে। নিজেকে তৈরি করার কত সুযোগ ছিল তোমার।’

‘বাবা বলল, প্রাইভেট কোম্পানি, কোনও নিরাপত্তা নেই। মেয়েদের নিরাপত্তাই সবার আগে।’

‘হুঁ! নিরাপত্তা! জিনিসটা আমার পায়ের মতো, বুঝলে। থেকেও নেই। পৃথিবীতে কেউ, কোথাও, সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। নামকরা হাসপাতাল— সেখানে আগুন লেগে লোক মরছে না? স্কুলে, কলেজে, রাস্তায়, মাঠে মেয়েদের অপমান হচ্ছে না? সরকারি আপিসে, খবরের কাগজের দপ্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হেনস্থা নেই? আসল কথা, তুমি সকাল-সকাল কাজে বেরিয়ে যাচ্ছ, সন্ধ্যায় ফিরছ, সক্কলের তাইতে ভারী অসুবিধা হচ্ছিল। আমারও। তুমি তিনমাস কাজ করেছিলে। তিন মাসে আমরা গড়ে ত্রিশবার বলেছি, ওঃ, ঝুমুর যে চাকরি করার কী দরকার! অর্থাৎ আমরা সবাই নিজের আখের গুছোব, আর ঝুমু আমাদের হাতের কাছে সব জুগিয়ে যাবে। বেতন চায় না, ঝগড়া প্রতিবাদ করে না, কোনও কিছুর দাবি নেই, সর্বদা হাসিমুখ, সবার সুবিধার দিকে নজর। জাপানি রোবোটের চেয়েও উৎকৃষ্ট গুণে-মানে। কারণ ঝুমুর আবার ভারী মায়াদয়া, স্নেহভালবাসা।’

‘এই, তুই আমার কান ভাঙাচ্ছিস কেন রে? আমি কি কলেজে যাইনি? বাবা কি আমার বিয়ের চেষ্টা করছে না? নিজের লোকদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেখব না? তুই কি চাস আমি স্বার্থপর হয়ে যাই?’

‘না। আমি চাই ভারসাম্য। প্রত্যেকেই যতখানি সম্ভব আত্মনির্ভরশীল হোক। আর তুমি তোমার স্নেহদাক্ষিণ্য নিজের জন্যও একটু বিলোও। নিজেকে ভালবাসাও যে দরকার ঝুমুদি।’

‘ধুৎ! ওসব আমার আসে না। মা নেই। কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হবে। কলেজ পর্যন্ত গেছি তো!’

‘কলেজ? বাড়ি থেকে তো চার পা। ভাত বসিয়ে একটা ক্লাস করে আসা যায়। বিয়ে দিতেও কোনও সমস্যা নেই এখন। বাবা, জ্যোতিকাকা চাকরি ফুরোলে করবে কী। ঘরে থাকবে, সামান্য যা করার নিজেরাই পারবে।— বাদাবাকি তো গোপালীমাসি বা প্রতিমা আছেই। তোমাকে তখন আর দরকার নেই— বুঝলে? ঝিরির যা মতিগতি, হয় চাকরি জুটিয়ে সটকে পড়বে, নয় বিবস্বানের গলায় ঝুলে নিজের রাস্তা দেখবে। ওর তোমার মতো এত মায়ের দয়া নেই। অন্যদিকে বাবা আর জ্যোতিকাকা তাদের তো আবার ‘লোকে কী বলবে’ ভেবে ঘুম আসে না। ওই জায়গাটা জয় করতে পারলে তোমার বিয়ের চেষ্টাই করত না। তাতে অবশ্য আমারই লাভ হত।’

‘হুঁ!’

‘হুঁ আবার কী! তোমার ওপর মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয় আমার। মনে হয় আঁচড়ে কামড়ে ছড়ে ফেলি।’

‘ফ্যাল দেখি! কেমন পারিস! একটু আগেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে বলে কাঁদছিলি, তুই মারবি আমাকে!’

‘মারব তো বলিনি। বলেছি ইচ্ছে করে। সব ইচ্ছে কি পূর্ণ করা সম্ভব, নাকি করা যায়?’

‘আমার কাছে যায়। আমার কাছে তোর কোনও ইচ্ছে লুকোবি না টোপর।’

‘যা বলছ, ভেবে বলছ তো ঝুমুদি? আমি কিন্তু আর ছোট্ট টোপর নেই। বড় হয়ে গিয়েছি। যদিও তুমি এমন করো যেন এই দুই বাড়িতে জ্যোতিকাকা, বাবা, আমি, ঝিরি সবাই বাচ্চা— কেবল তুমিই বড়! সব্বাইকে আগলাচ্ছ, অথচ তোমার বুক অবধি কেউ পৌঁছয় না। এভাবে, এমন করে স্বাধীনতা দিয়ে দিচ্ছ আমায় ঝুমুদি! অনেকটা জায়গা দিয়ে দিচ্ছ কিন্তু আমাকে। পরে কৃপণ হয়ে যেও না। সহ্য করতে পারব না। মা আমাকে ফেলে গেছে, সহ্য করেছি, তুমি কষ্ট দিলে আর পারব না ঝুমুদি।’

‘এ মা! তোকে আমি কখনও কষ্ট দিয়েছি? আমি যখন ছাতে যাই, রোজ না, যখন আকাশ পরিষ্কার থাকে, মনে হয়, আমাদের ওইরকম দরকার। একটা আকাশ। যেদিকে তাকালে আমার ভেতরটা অবিরল প্রকাশ হয়ে যাবে, কোনও বাধা, কোনও দ্বিধা থাকবে না। শুধু একটা আকাশ আর আমি। তোর আকাশ আর তুই। একটু আগে বলছিলি না, আমাদের নিজস্ব জগৎ, সেখানে আর কেউ নেই,ঝিরি নেই, বাবা, প্রবীরকাকা— কেউ থাকবে না— শুধু তোর আর আমার, তখন আমি তোর আকাশ। না হলে হয় না। ওরকম হয় না।’

‘ঝুমুদি…!’

‘হুঁ?’

‘তোমার আকাশ কে?’

‘আমার? ভেবে দেখিনি রে।’

‘ভাবো। আমি ততক্ষণ বিশ্বাস করতে থাকি, বুক ভরে, মন ভরে, আমার সমস্ত চেতনার মধ্যে পুরে দিতে থাকি, আমার পরমায়ুর মধ্যে।’

‘কী?’

‘তোমার কথা। কথা দেওয়া। তুমি আমার আকাশ। ঝুমুদি, তুমি ভাবো। আমি আর একটাও কথা বলব না যতক্ষণ না তুমি নামটা খুঁজে পাবে।’

‘এ আর এমন কী কঠিন? টোপর, আমার আকাশও বোধহয় তুই-ই রে।’

‘আকাশের কোলে আজ আকাশ শয়ান। কে কাকে দেবে এক থলে ভর্তি জ্যোতিষ্কবলয়, মেঘমল্লার। কে কার কপালে দেবে চাঁদটিপ। নক্ষত্র পরাবে মাথায়। ঝুমুদি, আজকের দিনটা খুব সুন্দর। আমি পারব। তোমার আকাশ হতে পারব। তোমার সব আমাকে দেবে তো? সব কথা? সব ইচ্ছা? সব স্বপ্ন?’

‘তুই আমাকে বলিস তো, সাধারণ, বলিস তো? সত্যি বলব? টোপর? আমার না ‘আমি’ হয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না। আমার ‘আমি’টা শ্রমিক মৌমাছির মতো, একটা মরলেও আরও একশোটা থাকে।’

‘তোমার কেমন ‘তুমি’ পছন্দ ঝুমুদি?’

‘তা ঠিক জানি না। আমার কখনও ঝিরি হতে ইচ্ছে করে, কখনও ঝাড়ু নমিতা। ছোটপিসি হতেও।’

‘ঝিরি কেন?’

‘কী ডাঁট না ওর? কাউকে পরোয়া করে না। বাবা তো জানিস, একটু মিতব্যয়ী, ও মানবেই না। একটা কিছু চাই তো চাই। কেঁদেকেটে, ঝগড়া করে, অভিমান করে আদায় করবেই। দারি করতে পারাও একটা গুণ রে টোপর।’

‘ঝাড়ু নমিতা কেন?’

‘কী সাহস! চাকরিটা ছাড়ল না তো! প্রেমে পড়লে লোকে কত কিছুই মেনে নেয়। পরে হয়তো আফশোস করে। কিন্তু মেনে নেয় তো! ও কিন্তু নেয়নি। কী আত্মবিশ্বাস! ও একদিন নেত্রী হবেই। হয়তো ও এই এলাকার কাউন্সিলার হয়ে যাবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বে এখন শিক্ষিত, অভিজাতর একচেটিয়া অধিকারে ভাগ বসিয়েছে অন্যরাও। সরু গলির মেয়ে বলে ওর কিছু আটকাবে না। ইস্কুল ডিঙোয়নি বলেও। কমলটা বোকা। নমিতার ভেতরের আগুনটা বুঝল না।’

‘কিংবা উলটোটা। বুঝেছে। তাই এড়াতে চায়। সাহসী মেয়েকে দূর থেকে দেখতে ভাল, নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই লোকে দুটো উপায় খোঁজে। প্রথমেই জোরের জায়গাটা মেরে দিতে চায়। না হলে, বর্জন করে। কমল ব্যতিক্রম নয়।’

‘কমলকে সত্যিই ভালবাসে ও।’

‘তাতে কী? সেবিকা ধরনের তো নয়।’

‘তাই বা বলি কী করে? চাকরি করে, পার্টি করে, সংসারের কাজ করে, সংসারটাকে বুক দিয়ে আগলে রাখে।’

‘বুক দুটো বেশ বড় তো।’

‘মারব এক চড়! অসভ্যতা হচ্ছে!’

‘অসভ্যতার কী আছে? সম্পর্কবহির্ভূতভাবে একটা ছেলে যখন একটা মেয়েকে দেখে তখন মেয়েটাকেই দেখে, তার অবয়ব, বুঝলে খুকুমণি?’

‘বুঝলাম।’

‘শোনো, মানুষ দাস্যভাব পছন্দ করে। সেটা ছদ্মবেশ হলেও আপত্তি নেই। দাস পোষার বর্বর মনোবৃত্তি কমবেশি আমাদের সবার মধ্যে আছে। কুকুর আমাদের দেখে লাঙ্গুল নর্তন করলে আমাদের মনে বেশ স্ফূর্তি হয় না? গাঁটের কড়ি খচ্চা করে লেড়ে বিস্কুট কিনে দিই না? কেন? জীবে দয়া? কচুপোড়া! প্রাণীপ্রেম যার আছে সে সাপেও প্রেম দেয়, ব্যাঙেও। আসলে কুকুরের ওই লেজ নাড়া, উঁ উঁ, সামান্য প্রশ্রয়েই আজীবন বশ্যতা, আমাদের ভেতরকার প্রভুত্ববোধকে তৃপ্ত করে। পুরুষের মধ্যে লোকে চায় দাস্যভাব। নারীর মধ্যে চায় দাস্য আর লাস্য। একইসঙ্গে সেবাময়ী ও মোহময়ী। সেবিকা ও গণিকা। দিনে লজ্জাশীলা, রাতে লজ্জাহীনা।’

‘না না। সবাই এমন প্রভুত্বপরায়ণ নয়।’

‘সবাই। এ যুগে নিন্দনীয়, তাই নিরন্তর নিজেকে সময়োপযোগী রাখার গোপন যুদ্ধ নিজেরই সঙ্গে জারি রাখতে হয়। যে যত বেশি সফল, সে তত মহৎ। এবার বলো তোমার ছোটপিসি হতে ইচ্ছা হয় কেন?’

‘ছোটপিসি কেমন দূরের মানুষ। কোনও বিপদে-আপদে আসে না। কিন্তু কোনও বিষয়ে যখন মন্তব্য করে, মতামত দেয়, সাতকাহন করে তা বলা হয়— ছোট তো অমুকটা বলছিল— যেন, সে সাতে-পাঁচে নেই বলে একেবারে দশ হয়ে বসে আছে। দূরত্বের গুরুত্ব। সে কিছুই করে না বলে ছিঁটেফোঁটাই বড় করুণা।’

‘তুমি ছোটপিসি হয়ো না ঝুমুদি, ঝিরিও না। তুমি যা, তা-ই ভারী সুন্দর। একটু একটু ঝাড়ু নমিতা হলেও হতে পারো।’

‘তার জন্য একজন কমল চাই।’

‘নিজের দাবি বুঝতে শেখো, দেখবে প্রায় সবাই এক একজন কমল।’

‘এই, অনেক বাজল। আমি যাই।’

‘তোমার তো ডাক পড়েনি। থাকো আর একটু।’

‘আচ্ছা।’

‘পায়ে ঝঝি ধরেনি তো? এতক্ষণ ধরে আমার হেঁড়ে মাথার ভার বইছ।’

‘ধরেছে।’

‘দেখছ, তুমি কেমন! বলছ না!’

‘বলতাম।’

‘কবে? নাও। সরে বসো। আমার ঘাড়ে একটা ছোট বালিশ দাও।’

‘চাকরি পেলে তোকে রোজ কাজে যেতে হবে?’

‘চাকরি! চাকরি! আজ যে দিনটা কতরকমভাবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ! বাবার কাছেও। মা যেদিন চলে যায় সেই দিনটা আমরা কোনও দিন ভুলব না, তাই না ঝুমুদি?’

‘ভোলা যাবে না। ওটা নিয়ে বেশি কথা বলার দরকার কী?’

‘শোনো না। মনে আছে তো, বাবা আর জ্যোতিকাকা সারা রাত্রি দাবা খেলল তোমাদের বাড়িতে। আর তোমাদের দোতলার ঘরের বড় বিছানায় তুমি আর ঝিরি আমার দু’পাশে শুয়ে ছিলে। সেদিন জ্যোতিকাকা আমাকে কোলে তুলে দোতলায় পৌঁছে দিয়েছিল। বাবা আমার সামনে আসতে চাইছিল না। ওই রাত্রে আমরা কেন তোমাদের বাড়িতে থেকে গিয়েছিলাম? মাকে ছাড়া আমাদের অভ্যস্ত হতেই হত। এ যেন লম্বা দৌড়ের আগে গা গরম করা। আমার মনে হচ্ছিল, বাড়িতে গেলেই দেখব মা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে। ঝিরি ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমাকে বলল, আমারও মা চলে গেছে, তোরও। মা-রা শুধু চলেই যায়।’

‘আমি ঘুমোইনি। ঘুম আসছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল আচ্ছা, আমি যদি বলতাম, রুপুকাকিমা যেয়ো না, থাকো, কাকিমা থেকে যেত। কাকিমা আমার চুল বেঁধে দিত, আর কী বলত জানিস? ঝুমু, তোমার পা দু’টো খুব সুন্দর। তোমার বিয়েতে আমি সোনার নূপুর গড়িয়ে দেব। পরে ছুমছুম হাঁটবে। আজও যখন কাকিমার শাড়িগুলো রোদ্দুরে দিই, মনে হয়, ফিরতেও তো পারে কোনও দিন, কত খুশি হবে শাড়িগুলো দেখে! আমাকে চিনতে পারবে? আমি তো কাকিমাকে আগের মতোই জড়িয়ে ধরব রে টোপর! বলব, কেন চলে গিয়েছিলে? তোমার টোপর কারও থেকে কম নয়। দেখো! সেদিন, কাকিমার চলে যাওয়ার সেই রাতটা, দুঃখ-শোক-যন্ত্রণা-ভয় সব মিলে আমাকে এক ধাক্কায় গড়ে দিয়েছিল বোধহয়! অতটুকু বয়সে অনুভূতি চিন্তার রূপ নেবার ভাষা পায় না। আমার বোধহয় মনে হচ্ছিল, কাকিমা বিশ্বাস ভাঙল। আমি এমন করব না। কাকিমা কষ্ট দিল, আমি দেব না। আমি ভালবাসব। সারা রাত জেগে আমি কত কী ভেবেছিলাম! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে মনে মনে ঠাকুরকে বলছিলাম, কাল সকালেই টোপরের পা দুটো ঠিক করে দাও ভগবান!’

‘আমি জানি তুমি ঘুমোওনি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলে। একটানা আমাকে ভালবাসছিলে। একটুও না থেমে ভালবাসছিলে। আজও আমি ওই ভালবাসাটা ছুঁতে পারি।’

‘তুই খুব কাঁদছিলি। কান্নার শব্দ ছিল না। শুধু নাক টানা। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরলি। কী গরম ছিল! পাখা চলছিল! তবু পুড়ে যাচ্ছিলাম যেন।’

‘তুমি আমাকে সরিয়ে দিলে না কিন্তু। একটা পা, আমার সাড়হীন বাঁ পা, তুমি টেনে নিলে তোমার গায়ে। ঝুমুদি, আমার খুব ইচ্ছে করছিল তখন। কাউকে বলিনি। ওইসময় তোমার গায়ে পা তুলে দিতে ইচ্ছে করছিল। বোধহয় মাকে পেতে চাইছিলাম। মা ওইভাবে আমার পা গায়ে টেনে নিত। মা বুঝতে পারত আমি আষ্টেপৃষ্ঠে মাকে জড়িয়ে থাকতে ভালবাসি। তুমি কী করে মায়ের মতো সব বুঝে গেলে? মাত্র বারো তোমার তখন। ঝিরির জন্যই বোধহয় তুমি খুব তাড়াতাড়ি মা হয়ে গিয়েছ ঝুমুদি। সেইদিন আমিও তোমাকে ভালবাসছিলাম, ক্রমাগত, অনর্গল। বেঁচে থাকার জন্য আমার জীবনে আর নতুন কাউকে দরকার নেই।’

‘আমি আছি তো রে সোনা। আছি তো।’

‘পরদিন সকালে বাবা আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। চোখ দুটো লাল। চুল এলোমেলো। বলল, ‘টোপর, তোমার মায়ের হয়ে এবং আমার তরফ থেকে তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। আমি পালাব না। আমি তোমাকে আমার সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসব। …আমাকে সিঁড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। বলল, তোমাকে স্বাবলম্বী হতে হবে। সিঁড়ির পাশে একটা ঢালু পথ করে দেব আমি। তুমি চাকাচেয়ার নিয়ে ওঠা অভ্যাস করবে। কাল সারা রাত ভেবে এই সমাধান পেয়েছি।…’ ভাবতে পারো, কী গভীর ভালবাসা, কী অসামান্য দায়িত্ববোধ! সেই রাতে আমরা সবাই নিজের মতো করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজেছিলাম। এটাকেই জীবন বলে। ধরো ঝঞ্ঝা, বন্যা, ভূমিকম্প, ধরো বোমায় বিধ্বস্ত ইরাক, সিরিয়া বা প্যালেস্টাইন-যারা থাকে, তারা শোক দিয়ে বুনতে থাকে জীবনের নকশিকাঁথা। কী রঙিন বিচিত্র কারুকাজ। রাজা পরে ভিক্ষুকের সাজ। জটিলের গলি বেয়ে রক্ত বয়ে যায়। এ ওকে আঁকড়ে ধরে যাতে না পালায়। মা আমার দায় বইতে পারছিল না। বাবা সেই দায় নিয়েছিল। বাবার নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছিল। প্রিয় কেউ ছেড়ে গেলে যন্ত্রণা হবেই তো। তারই মধ্যে বাবা আমার প্রতিবন্ধকতার সমাধান খুঁজেছিল। একটা মানুষ—যে অসবর্ণ বিয়ে করেছিল বলে আজন্ম চেনা প্রিয়জনেরা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল, যার জন্য ব্রাত্য হল, সে ছেড়ে গেল প্রতিবন্ধী সন্তানের ভার বইতে পারবে না বলে। মানুষটার একক যুদ্ধ চলতেই লাগল। তাকে রোজগার করতেই হবে, সংসার-সন্তান সামলাতে হবে, নিজেকেও। আজ বাড়ির মধ্যে আমি কারও কোলে চেপে ঘোরাফেরা করি না, স্নান-টান নিজে করতে পারি, আমি অক্ষম নই, এই আত্মবিশ্বাস বাবা আমার মধ্যে গড়ে দিয়েছিল। আজ, পনেরো বছর পর, আমি চাকরির জন্য কথা বলতে চলেছি। তোমাকে বলছিলাম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়। দেখো, আমার এই জুতো, লাঠি, আমার গাড়ি, গড়গড়ি আমাকে সচল রাখে। ওই কম্পিউটার, নেট দুনিয়ার মধ্যে দিয়ে লেখাপড়ার দিগন্ত উন্মোচন—আমাকে কত স্বাবলম্বী করেছে। খুব ছোটবেলায় আমি বুঝে গিয়েছিলাম প্রথাগত পেশার দিকে যাওয়া চলবে না আমার। এখন কিছু আমাকে জানতে হবে, শিখতে হবে, যার ওপর আমি নির্ভর করতে পারব কিন্তু নিয়মিত রোজ বাইরে গিয়ে ক্লাস করতে হবে না। এমনকী পেশাগত জীবনেও রোজ বেরোতে হবে না। ঘরের বাইরে বেরোলেই আমার এক সমান্তরাল সংগ্রাম শুরু হয়। নির্ভরশীলতা বাড়ে। আমার ভাল লাগত না কোনও দিন। শুধু ভাবতাম—কী করব আমি, কোন পথ, এমন কিছু যার মধ্যে কোনও করুণা থাকবে না, দয়া থাকবে না, প্রতিবন্ধী সংরক্ষণ থাকবে না। এত ‘আহা’ শুনেছি যে আমার আহা শুনলে বমনোদ্রেক হয়। একাদশ শ্রেণিতে আমাকে অংক, ফিজিক্স পড়াতে আসত তমোনাশদা, বলেছিল, তোর প্রার্থিত পথ খুঁজে পাবি কম্পিউটারে। যন্তরটার সঙ্গে গলায় গলায় ভাব করে নে। সেই হবে বন্ধু, সেই গুরু, সেই পথপ্রদর্শক।’

‘সেদিক থেকে তোর নির্বাচন একেবারে ঠিকঠাক। তমোনাশের পরামর্শও। কম্পিউটারের খেলায় কীরকম নেশা হয়ে গিয়েছিল তোর!’

‘নেশা নয়। আমি খেলা তৈরির পেছনের লজিক বোঝার চেষ্টা করতাম। তার বিজ্ঞানটা।’

‘তোর কাছে কম্পিউটারটাই ছিল খেলার মাঠ। আমি জানি।’

‘জানো, আজ যেখানে যাব, সেখানে আমার কাজটা পাকা, আজ শুধু মুখোমুখি কথা বলা। প্রথম তোমায় বললাম। বাড়িতে বসেই কাজ করতে পারব। সপ্তাহে দু’দিন যেতে হবে।’

‘পাকা? মানে চাকরি পেয়ে গিয়েছিস? কিন্তু এতক্ষণ যে বলছিলি ইন্টারভিউ?’

‘আন্তর্জালিক সংযোগে কথোপকথন আগেই হয়ে গিয়েছিল। বাংলায় বললে কিম্ভূত শোনায় না? স্কাইপে ইন্টারভিউ দিয়েছি ঝুমুদি। কাজের নমুনা পাঠিয়েছি। ওরা কয়েকটা প্রোজেক্ট দিয়েছিল, তাতে পাশ করেছি। ঘাটে ছিল নৌকার এ বাঁধা চঞ্চলতা। জোয়ারের টানে রশি ছড়ে চলে যাচ্ছে স্রোতে। তাকে ছুঁয়ে আরও এক নৌকার মাঝিনী। দেখে মনে হয় হলুদ হলুদ ফুলে ভরা শান্তিলতা। আসলে সে আগুন আগুন ভালবাসে তাই পুড়ে যায় নিজের তরাসে। বুঝলে? আজ শুধু সইসাবুদ। যতক্ষণ সেটা না হচ্ছে, চুক্তিপত্রের স্বাক্ষরিত দলিল হাতে না পাচ্ছি, ততক্ষণ আর কাউকে বলার কী প্রয়োজন! জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা।’

‘আমায় বললি যে!’

‘আজ থেকে তুমি আমার আকাশ ঘোষণা দিলে যে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি তোমার আকাশ হতে পারি ই ই ই!’

‘হতে পারিস মানে কী রে!’

‘ওঃ! পারি, মানে সক্ষম, তোমার সব কথা আমাকে বলবে তো ঝুমুদি? আর কাউকে না। শুধু আমাকে। ও ঝুমুদি, ও ঝুমুদি, ঝুমুদিইইই!’

‘দিদিইইই, এই দিদিইইই।’

‘হ্যাঁ। যাই।’

‘আসবি না নাকি? বাবা স্নানে চলে গেল। খেতে দিবি না? শুধু ভাইকে দেখলে হবে? বোনটাকেও তো দেখতে হবে।’

‘যাই। যাচ্ছি। এখুনি যাচ্ছি। টোপর, টোপর, হাত ছাড়। ডাকাডাকি করছে। যাই। ওরা বেরিয়ে গেলে আবার আসব তখন? সোনা আমার!’

‘ঠিক আসবে তো? আজ আমার এক মুহূর্ত তোমায় ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।’

‘ঠিক আসব।’

ঝুমু ও টোপর ও সুহাসিনী ভোর

প্রতিমা কাজ করছে। বাসনমাজায় হাত দিয়েছে সবে। বলেছিল দশটায় আসবে, এসেছে সাড়ে এগারোটায়। এখানে আসার আগে যে বাড়িতে যায়, তাদের বাড়িতে আজ অতিথি আসবে। অনেক বেশি কাজ করতে হয়েছে প্রতিমাকে। এখানে সেরে আরও একবার যাবে। প্রতিমা গজগজ করছে, ‘বাড়িতে লোক লেগেই আছে, বেশি বেশি কাজ করাবে, কিন্তু একটা টাকাও বেশি ছোঁয়ায় না। এমন হাড়কেপ্পন আর দেখিনি বাপু। ভগবান তোমাদের ঢেলে দিয়েছেন, তোমরাও একটু হাত খোলো। বুঝলে ঝুমু, এত টাকা ওদের তবু পুরনো কাপড়-জামা একটা দেবে না। সব গুছিয়ে রাখবে। ফিরিওয়ালা এলে একটা ইস্টিলের থালার জন্য দর কষাকষি। আচ্ছা, কী দাম বলো একটা থালার? ভাল ভাল সব কাপড়, তাই দিয়ে থালাবাসন না কিনে আমাদের দিলে তো পারে।’

মুখ চলছে, মুখের সঙ্গে হাত। ঝুমু বলল, ‘তা তুমি বাসন মাজছ কেন? সরসী আসবে তো বিকেলে। তোমার আজ সময় কম, রান্নার জোগাড় করো। আমি একটু হাতে হাতে এগিয়ে দিই।’

‘রাস্তায় দেখা হল সরসীর সঙ্গে। ওই যে ডাক্তারের বাড়ি কাজ করে, যাচ্ছে সেখানে, বলে শরীরটা মোটে ভাল নেই। আবার হবে তো। চার মাস।’

‘আবার হবে! সরসীর! দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু। চার মাস মানে পেট বেশ বড় হয়ে যায় না? ওর আরও দুটো আছে তো! খাওয়াবে কী? বরটা তো মাতাল।’

‘তবে আর বলছি কী। শরীরে কিছু নেই, পেট বাড়বে কী! ওর প্যাকাটি চেহারা দেখলে লোকে রাখতেও চায় না। ভাবে রোগ আছে। এখন কাহিল দশা। অন্তত বাসনটা ধুয়ে রাখি। পেটভরা খাওয়া নেই, রক্ত শূন্য। বরটা মানুষ নাকি? লাইগেশন করতে চেয়েছিল সরসী, দেয়নি জানো। বলে নাকি মজা নেই। ও করলে মেয়েমানুষ পুরুষমানুষের সমান।’

‘আহা রে! আমি রোজ একটু মাছভাত রেখে দেব ’খন ওর জন্য। একটু পেটভরে খাক ক’দিন।’

‘দিয়ো ঝুমু। ভগবানের আশীর্বাদে ভাল ঘর-বর পাবে। কাজ তো বন্ধ দিতে পারবে না সরসী, খাবে কী! ভরা পোয়াতি নিয়েই নড়তে চড়তে হবে!’

‘তুমি কি জামাকাপড় মেশিনে দিয়েছ?’

‘না গো, সময় পাইনি। বিছানা তুমিই গুছিয়ে গিয়েছ টোপর বলল। কী রান্না হবে বলো তো?’

‘পাঁকাল মাছ আছে দেখো। টোপর ভালবাসে। বেগুন-বড়ি দিয়ে পাতলা ঝোল করে দিই। ও তো খেয়ে বেরোবে আবার। তুমি মাছটা ধোয়ার ব্যবস্থা করো। নুন দিয়ে চটকে ধোবে। গায়ে খুব শ্যাওলা। আমি মেশিনে জামাকাপড় দিই। বাড়িতেও কেচে এলাম।’

‘এখানে রাঁধবে? আবার বাড়ি গিয়েও তো কাজ আছে না? তোমার বাবাকে বলো কাচার মেশিন কিনে দিতে। হাতে কেউ কাচে আজকাল? আমাদের ভগবান উপায় দেয়নি, তাই। তা, তোমার বিয়ে-থা হয়নি, ক্ষারে হাতের চামড়া খসখসে হয়ে গেলে জামাই বলবে কী।’

‘আমার আর কাজ কী বলো, ঘরে বসে খাই। গোপালীমাসি আর পারে না। তবু তো পরদা, বিছানার চাদর, যত বড় জিনিস, মাসিই কাচে। বাড়িতে এখন আর রান্না নেই আমার। বাবা আর ঝিরি তো বেরোল। দুপুরে আমি টোপরের সঙ্গেই দু’গাল খেয়ে নেব এখন। বিকেলে গোপালীমাসি এলে রাতের জন্য যা হোক করা যাবে।’

প্রতিমা দ্রুত কাজ সারছে। ঝুমু টোপরের আলমারি খুলে সামনে দাঁড়াল। প্রত্যেকটি পোশাক সুন্দর সাজানা। ঝুমুই গুছিয়ে রাখে। শুধু প্রবীরের আলমারি বা অন্যান্য ব্যক্তি গত জিনিসে সে হাত দেয় না। অনেকসময় প্রবীর নিজেই তাকে চাবি দিয়ে এটা-ওটা করিয়ে নেন।

টোপরের আলমারিতে মাঝের তাকটায় একটা নতুন প্যাকেট। কী আছে? খুলবে? এত কৌতূহল কি ভাল? ধুৎ! টোপরের জিনিস সে দেখতেই পারে। এ কী! শাড়ি! টোপরের আলমারিতে শাড়ি! গাঢ় লাল ঢাকাই জামদানি, হালকা সোনালি সুতোর কাজ। সুন্দর। খুব চেনা লাগছিল তার। রুপু কাকিমার চারটে ঢাকাই আছে। একটি ভাঁজে ভাঁজে কেটে গিয়েছে। শাড়িগুলো পরলে ভাল থাকত। কিন্তু প্রবীর কোনও দিন ঝুমুকে ওসব ব্যবহার করার কথা বলেননি। শাড়িগুলোর জন্য ভারী দুঃখ হয় তার। কত সব দামি সিল্ক, জর্জেট, তাঁত! এত বছরেও দিব্যি ব্যবহারযোগ্য আছে। চলে যাবার সময় শাড়ি-টারি নিয়ে যাননি রুপু। শুধু গয়না নিয়েছিলেন। তাঁর জিনিস তিনি নিয়েছেন। গহনা হল স্ত্রীধন। পরম্পরা অনুযায়ী মেয়েরা তার অধিকারিণী! এই অধিকার নিয়ে কোনও প্রশ্ন চলতে পারে না। পুরুষের জন্য হিরে-পান্না, সোনার বাট, ঘড়া ঘড়া মোহর। মেয়েদের জন্য শুধু গয়না, গয়না, গয়না। স্ত্রীধন মেয়ের জীবনের পাথেয়। প্রবীর আজও রুপুকে ভালবাসেন বলেই ঝুমু-র মনে হয়। সমঝোতাভিত্তিক বিচ্ছেদ হয়েছিল তাঁদের। রুপুকাকিমার পক্ষে কী শর্ত ছিল ঝুমু জানে না। হয়তো নির্বিঘ্ন বিচ্ছেদই ছিল একমাত্র পারস্পরিক শর্ত!

শাড়িটা ভাল করে দেখে যেমন ছিল রেখে দিল ঝুমু। গাঢ় নীলের ওপর সাদা চেক দেওয়া শার্ট আর ঘিয়ে রং ট্রাউজার্স নিল টোপরের জন্য। রুমাল গেঞ্জি জাঙিয়া গুছিয়ে রাখল। ওয়ালেট খুলে দেখে নিল যথেষ্ট টাকা আছে কিনা। টোপরের কাছে সবসময় টাকা থাকা দরকার। কখন কী প্রয়োজন হয়। তার টাকা তোলার কার্ড আছে। কিন্তু ব্যবহার করার বড় ঝক্কি। গাড়ি থেকে নেমে টাকার যন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছতে এত কিছু তাকে সামলাতে হবে যে সে বিপর্যস্ত বোধ করে। গাড়িতে ওঠা এবং অবতরণ করা-দুইই তার পক্ষে নিত্য সংগ্রাম। সে গাড়ি থামায়, পলাশ তার তালবেতাল লাঠি দুটি দেয়। দরজা খুলে একটু কোনাকুনি অবস্থানে গড়গড়িটি রাখে। টোপর ডানহাতের ভরে শরীরটি ঘষটে নিয়ে আসে আসনের প্রান্তে। ঘুরে বসে। দু’হাতের দুই লাঠি ভূমিতে ভালরকম স্থাপন করে কয়েক পলের জন্য শরীরটাকে দণ্ডায়মান অবস্থায় নিয়ে যায় এবং গড়গড়ির আসনে বসে পড়ে। গড়গড়ি ঝাঁকুনি খায়। পলাশ শক্ত করে ধরে তাকে। বাঁদিকে কেৎরে লটকে থাকা অশক্ত দুই পা হাত দিয়ে ধরে একটা একটা করে পাদানিতে রাখে টোপর। সচল হয়। সিঁড়ি এলে আবার সে লাঠি পরায় হাতে, আস্তে আস্তে সবল দুই বাহুর ওপর নিজেকে সঁপে দেয়। পলাশ তার গড়গড়িখানা সিঁড়ি দিয়ে সমতলে নিয়ে যায়। টোপর অতি সন্তর্পণে লাঠি রাখে ধাপে। প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ। তৃতীয় ধাপ। তার পা দুটি ছেঁচড়ে উঠতে থাকে। ঠোক্কর খেতে খেতে। ধুলো মাখতে মাখতে। টোপর ঘেমে ওঠে। নিজের অসাড় অঙ্গ বয়ে চলা কী ভীষণ কঠিন!

পলাশ তার পাশে পাশে চলে। টোপরের চেয়ে মাত্র তিন বছরের ছোট। কানাই সামন্ত সরু গলির অধিবাসী নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে পলাশ তার সম্পূর্ণ সুস্থ কলেবর ও অঙ্গসমূহের জন্য বারংবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয় আর প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকে— যেন পড়ে না যায় টোপর।

বাইরে বেরোলে এই স্বাদু পৃথিবী টোপরের জন্য যুদ্ধভূমি হয়ে যায়। তার জ্ঞান ও মেধা, বুদ্ধি ও হৃদয়— সমস্তই সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর। মেধা ও বুদ্ধির নিরিখে সে বিশিষ্ট একজন, হৃদয়খানি উদার ও বিশাল বটে। তবু, যারা অবিকলাঙ্গ, তারা বিকলাঙ্গের প্রতিবন্ধকতা তার সর্বত্র দেখতে শুরু করে। ব্যাখ্যাতীত ত্রাসে তার মনের নিকটে আসে না। টোপরকে, সর্বত্র, স্বাভাবিক মানুষের প্রতিবন্ধী চিন্তার সঙ্গেও রণে অবতীর্ণ হতে হয়।

ঝুমু ও বড়পিসি ও নিশি দিশি দিশি

শার্টে একবার হাত বুলিয়ে দিল ঝুমু। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। কে করবে এসব, যখন সে থাকবে না? লোক রাখা যেতে পারে। যত বেশি লোক রাখবে টোপর নিজের জন্য, তত বেশি করে বিচ্ছিন্নতা বোধ করবে। ঝুমু বিয়ে করে কলকাতা শহরের বাইরে যেতে চায় না। নিজের জন্য নয়, টোপরের জন্য আর বাবার কথা ভেবে সে শুধু বলেছিল, ‘বড়পিসি, কলকাতার বাইরে আমার সম্বন্ধ দেখো না।’

‘কেন রে?’

‘বাবাকে দেখাশোনা করবে কে বলো?’

‘শুধু বাবার জন্য দরদ? নাকি ওই ল্যাংড়া অপয়াটার জন্যও ভাবছিস? যা করিস ওর জন্য, নিজের ভাইয়ের জন্যও কেউ করে না।’

‘ওর জন্য কিছুই করার নেই গো। ও সব নিজে পারে। আমার জন্য ওর কিছু আটকাবে না। ওভাবে বোলো না ওকে। ও অপয়া হল কীসে?’

‘ছেলেটাকে ভাল লাগে না আমার। বড্ড যেন ডেঁপো। অল্প বয়সেই গেরেম্ভারী ভাব। কী জানি বাপু, যে ছেলে মায়ের স্নেহ টেনে রাখতে পারে না, তার নিশ্চয়ই কিছু দোষ আছে।’

‘ওসব কথা থাক পিসি।’

‘শোন ঝুমু, এ জগতে কারও জন্য কিছু আটকে থাকে না। এই যে তোর মা সংসার ভাসিয়ে, কচি মেয়ে ফেলে, সিঁথেয় সিঁদুর নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল, কিছু আটকেছে? ভাল ঘর-বর যেখানে পাবি, যাবি। আমার তো এ শহরেই বাড়ি, নিজের সংসার ফেলে আমি কি আসতে পেরেছি ঝিরিকে আগলাবার জন্য? তখন ঘরে বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি, তোর দীপদাদার বয়স মাত্র বারো, আসার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। নিজের সংসার হোক, তখন বুঝবি, মেয়েদের পায়ের বেড়ি আমরণ থাকে। সংসার যেমন চালাবে, মেয়েরা তেমনই চলবে। সে তুমি ডাক্তারই হও আর মোক্তারই হও।’

অবশ্য ঝুমু জানে, বাবার সঙ্গে বড়পিসির এ বিষয়ে মতে মেলেনি। জ্যোতির্ময় ঝুমুকে দূরে বিয়ে দিতে চান না।

সে বলেছিল, ‘বাবা, বিয়ে করার প্রয়োজন কী! এই তো ভাল আছি।’

‘বিয়ে তো দিতেই হবে। ওপরে গিয়ে তোর মাকে কী জবাব দেব। লোকে কী বলবে? তোরও একটা জীবন আছে।’

‘এ জীবনেই বেশ আছি আমি। এটাও তো আমারই জীবন! ভাল থাকাটাই তো আসল-না, বাবা? আমি তো পরমানন্দে আছি। বিয়ে করে কি আমার আনন্দ বাড়বে? কোনও নিশ্চয়তা আছে বাবা, বিয়ের পর ভাল থাকব? সেটাই হবে আমার আকাঙ্ক্ষিত জীবন? যা হচ্ছে চারিদিকে, বউ পুড়িয়ে মারছে, ফাঁসিতে লটকে দিচ্ছে। আমি গেলে কে তোমাদের দেখবে? ঝিরি যা ছেলেমানুষ। আমার আর বিয়ে করে কাজ নেই। কেউ কিছু বললে বলবে, ঝুমু আইবুড়ি থাকতে চায়।’

‘তুই বুঝবি না মা। বাপের কর্তব্য করতেই হবে। আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। তোদের নিরাপত্তা দেখতে হবে না?’

‘বাড়ি করে রেখেছ। টাকাকড়িও করেছ। লেখাপড়া শিখেছি। আর কী লাগে?’

‘তুই বড় সরলসোজা। তোর জন্যই তো চিন্তা।’

টোপর ও ঝুমু ও স্বপ্ন নিঝুম

ঝুমু রান্নাঘরে গেল। গ্যাসের উনুন জ্বেলে কড়া চাপাল। মাছ আর বেগুন আলাদা পাত্রে রেখে গিয়েছে প্রতিমা। সে কড়ায় তেল ঢালল।

‘কতদিন বলেছি তোমাকে, ওড়ানাটা রান্নার সময় খুলে রাখবে।’

‘কিছু হবে না রে টোপর।’

‘খুলে রাখবে কিনা।’

‘রাখছি।’

‘আমি সামনে থাকি আর না থাকি, আর যেন ভুল না হয়।’

‘আচ্ছা আচ্ছা।’

‘দাঁড়াও ঝুমুদি, আজ ফিরে এসে তোমার জন্য একটা দারুণ জিনিস আনতে দেব।’

‘কী রে?’

‘একেবারে আধুনিক চুল্লি। আগুনের শিখা নেই। শুধু তাপ। একে বলে ইনডাকশন কুকার।’

‘হিটার বুঝি?’

‘অনেকটা হিটারের মতো। কিন্তু বাইরে থেকে তার ইত্যাদি দেখা যায় না। তোমার মতো দুষ্টু আর বেখেয়ালি মেয়ের জন্য খুব দরকার।’

‘আমি মোটেই দুষ্টু না। বেখেয়ালিও না। বড্ড বাজে বকিস তুই টোপর!’

‘কতক্ষণ লাগবে তোমার রান্নায়?’

‘এই তো। বেগুন ক’টা ভেজে তুলি। তারপর বড়ি ভেজে মাছ সাঁতলে ঝোল চাপিয়ে দেব।’

‘লম্বা প্রক্রিয়া। থাক ওসব। আমার সঙ্গে কথা বলবে চলো।’

‘তুই থাক না এখানে, রান্না করতে করতে কথা বলা যায়।’

‘নুনপোড়া খাওয়াবে?’

‘না না’

‘আলুনি?’

‘মারব এক চাঁটা! বড়িভাজা খাবি? দেব করে?’

‘দাও। একটু কফি করবে? তুমিও খাও।’

‘করছি। তোর শার্ট বেছে রেখে এসেছি।’

‘জানি। শাড়িটা কেমন?’

‘খুব সুন্দর।’

‘কার জন্য জানতে চাইলে না? কে কিনল। কোত্থেকে। কোনও কৌতূহল নেই?’

‘তুই তো এমনিই সব বলিস রে।’

‘আচ্ছা আন্দাজ করো কার জন্য।’

‘প্রেমে পড়েছিস? না। তা হলে আমাকেই প্রথম বলবি তুই। আর তোর প্রেমিকা মানে তো একফোঁটা মেয়ে। শাড়ি-টাড়ি পরবেই না। ওরা পরে স্কার্ট, জিন্স।’

‘কেন?’

‘তোরই তেইশ। তোর প্রেমিকার বয়স হওয়া উচিত উনিশ-কুড়ি। সে পরবে শাড়ি? অসম্ভব! ঝিরিই পরতে শিখল না। এখনও শাড়ি পরলে ছ’টা সেফটিপিন লাগায়।’

‘এবার পুজোয় কী করেছিল জানো?’

‘কী?’

‘অষ্টমীর দিন। তুমি বড়পিসিকে নিয়ে চেতলা গেলে?’

‘হ্যাঁ। বড়পিসির গুরুমা এসেছিলেন কাশী থেকে।’

‘ঝিরি শাড়ি পরে বেরোবে, কারণ বিবস্বান বলেছে। আমার কাছে চলে এসেছে। দিদি বাড়ি নেই, শাড়ির কুচি ধরে দে টোপর।’

‘যাঃ!’

‘হ্যাঁ গো। শায়া আর ব্লাউজ পরে দিব্যি আমার সামনে। দু’বার ভুল দিকে শুরু করল। আমায় বলে, হাঁ করে দেখিস না। প্রেম করলে অনেক কঠিন কাজ করতে হয়। শাড়ি পরা তার মধ্যে একটা।’

‘তারপর?’

‘কী তারপর? আমি মুখ ফিরিয়ে রইলাম। ঝাড়ু নমিতার বুক দেখতে পারি, কিন্তু ঝিরির যৌবনের ঝাউবন দেখতে আমার ইচ্ছা করে না। ও যখন বলল, ধর এবার। প্রত্যেকটা কুচি যেন সমান হয়, আমি তাকালাম। ও শাড়ি-টাড়ি দলা পাকিয়ে টপাৎ করে খাটে উঠে পড়ল যাতে আমি হাত পাই।’

‘তুই ওর কুচি ধরে দিলি?’

‘সোজা কাজ।’

‘কী আশ্চর্য! আমাকে বলেনি তো!’

‘আমিও আগে বলিনি। ও-ই বলল, দিদিকে বলিস না। বকুনি দেবে।’

‘কেন? ও যদি তোকে নিরাপদ মনে করে, আমার কী।’

‘মানে? কী বলতে চাইছ? আমি নিরাপদ নই?’

‘ধুৎ! আমি কি তাই বললাম? ও তোর কাছে লজ্জা পায় না। এটাই তো স্বাভাবিক। তুই কি আমার কাছে লজ্জা পাস?’

‘এমনি এমনি লজ্জা পাব কেন? লজ্জা পাবার মতো কাজ করলে পেতে হবে।’

‘না রে বাবা! শরীরের স্বাভাবিক লজ্জা বলে একটা ব্যাপার আছে না?’

‘আসলে তুমি প্রথমে ঠিক বলেছিলে। নিরাপদ। ঝিরি বা অন্য মেয়ের কাছে আমি নিরাপদ। তার মানে এই নয় যে মেয়েরা আমাকে ভালমানুষ সন্ন্যিসিঠাকুর মনে করে। মেয়েরা বা ছেলেরাও মনে করে আমি যৌনভাবেও প্রতিবন্ধী।’

ঝুমু চামচে কফি তুলল। কাপে দিল। চিনি। গুঁড়ো দুধ। কড়া থেকে বেগুন তুলে বড়ি দিল। বড়ি নিঃশব্দে ভাজা হয়ে যায়। সে-ও নীরবেই ছ’খানা বড়িভাজা তুলে নিল রেকাবে। টোপরের হাতে দিল। মাছ ছাড়ল কড়ায়। ছাঁইই, ছ্যাক, ফর্‌র্‌ ফট্, ঠপ। খুন্তি দিয়ে মাছ এপিঠ ওপিঠ করে আঁচ কমিয়ে কফিতে জল ঢালল। নাড়ছে। ভারী মিঠে শব্দ উঠছে। টুংটাং। চিনেমাটির পেয়ালা ও স্টিলচামচের বাজনা। সঙ্গে রিন রিন ঠিন ঠিন। ঝুমুর হাতে দু’গাছি সোনার চুড়ি।

‘দারুণ হয়েছে কফি, ঝুমুদি। এবার বলো।’

‘কী?’

‘প্রেমিকা শুধু ছোটই হয়? বড় হতে পারে না?’

‘আজ তোকে নতুন লাগছে রে টোপর। তুই যেন অন্য কেউ।’

‘আমি বড় হয়ে গিয়েছি ঝুমুদি। আমি এখন অনেক দায়িত্ব নিতে পারি।’

‘কী দায়িত্ব?’

‘আমার কাছে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব কী জানো? সমস্ত প্রিয় সম্পর্কগুলো সযত্নে পালন করা। আমি তোমার সব কথার উত্তর দিচ্ছি। তুমিও দাও।’

‘কী?’

‘প্রেমিকারা শুধু ছোটই হয়?’

‘তাই তো হয়। বউ হোক আর প্রেমিকা— ছোট হবে, এমনটাই নিয়ম।’

‘কে ঠিক করেছে এই নিয়ম?’

‘প্রকৃতি।’

‘না। অন্য প্রাণীরা বয়স দেখে সঙ্গী বাছে না। তুমি কি প্রথম দর্শনের প্রেমে বিশ্বাস করো? লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট? সেইসব ভালবাসা বয়সের ঠিকুজি নিয়ে জন্মায় না! ভালবাসা আর বাস্তবের চাহিদা পূরণ একাকার করে দেওয়া ঠিক নয়।’

‘মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি, বলে না? কুড়ি না হোক, মেয়েদের বয়স তাড়াতাড়ি বাড়ে।’

‘সমাজ মেয়েদের তাড়াতাড়ি বুড়ি করে দেয়। কারণ এখনও মেয়েদের শরীরসর্বস্ব বস্তু বলে মনে করা হয়। টাটকা মুলো গাজর ধনেপাতা নটেশাক। দুঃখের কথা, মেয়েরাও তাই মনে করে নিজেদের।’

‘সে তুই যাই বল, একটা ত্রিশ বছরের ছেলে আর ত্রিশ বছরের মেয়ের তফাত আছে রে টোপর। মেয়েদের মা হওয়ার বয়স ভাবতে হয়।’

‘সেটাও তো শারীরবৃত্তীয় বিষয় না ঝুমুদি? টান টান মেদহীন পেট, নারকেল মালার মতো উঁচু শক্ত বুক, মসৃণ সাদা ত্বক-না হলে মাতৃত্ব-একজন মেয়ের গ্রহণযোগ্যতা এখানেই শেষ? তার মেধা, বুদ্ধি, প্রতিভা, প্রেম আর কিছুই থাকে না?’

‘মেধা, বুদ্ধি, প্রতিভা কি স্বীকৃতি পায় না? মেয়েরা কত জ্ঞানী-গুণী! কত প্রতিষ্ঠিত এখন! মুশকিল আমার মতো মেয়েদের। সমাজে প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম হয়ে আমাদের চলে না। আমরা যে অতি সাধারণ।’

‘সাধারণ আর অসাধারণের পার্থক্য ক্ষীণ। দুর্বল।’

‘কীরকম?’

‘বিনা প্রশ্নে, বিনা বিশ্লেষণে গতানুগতিক নিয়ম এবং অপরের ইচ্ছার স্রোতে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়া হল সাধারণীবৃত্তি। নিজের জীবন নিজের শর্তে গড়ে তোলার ইচ্ছাই মানুষকে অসাধারণত্বে নিয়ে যায়।’

‘সমাজের বিধি অস্বীকার করা কি অতই সহজ? বাড়ির লোকের কথাও তো ভাবতে হবে। তারা কী চায়, না চায়।’

‘কোন বিধি? কোন ভাবনা? শ্রীরাধা কৃষ্ণের চেয়ে বড় ছিলেন।’

‘সে তো চিরকালের বিয়োগান্তক প্রেম টোপর।’

‘খেলোয়াড় শচিনের স্ত্রী বয়সে বড়, তাঁরা তো সুখে আছেন।’

‘ওটা ব্যতিক্রম। তুই ‘লমহে’ ফিল্মটা দেখেছিস। ওটাই বাস্তব।’

‘‘লমহে’? একটা ফিল্ম। ভাল গল্প। কিন্তু কী ভীষণ রক্ষণশীল!’

‘আচ্ছা বাবা! তোর সঙ্গে কথায় পারি না। তোর কোনও প্রেমিকা নেই আমি নিশ্চিত। তা হলে শাড়িটা কার জন্য? কাউকে উপহার দিবি? কেউ নিমন্ত্রণ করেছে?’

‘নদীর নিমন্ত্রণে নৌকা ভাসাই। চঞ্চলা তরলিতা নদী ঢেউয়ের দোলায় উলটে পালটে দেখে। ভেঙে দেয় আমার তরণী। তারপর আমাকে আছড়ে ফেলে নরম ফেণিল জলদেহে। আমি তার বুক খুঁজি। স্তন খুঁজি। গাঢ় খাঁজে মুখ দিতে চেয়ে ক্রমশ গভীরে গহনে ডুবে যাই। কবে জল দেবে তুমি হে আকাশ। কবে তরলিত হবে যুগ যুগ ধরে বিশুষ্ক বিবাগী যোনি! কবে তুমি আমারই একান্ত হবে হে প্রিয় রমণী?’

‘আমার জন্য কিনেছিস, না? শাড়িটা?’

‘পরবে তো?’

‘পরব। এ তো অনেক দাম। এত দামি শাড়ি আমি কখনও পরিনি তো। একটু ইয়ে, মানে…পরব। পরব তো।’

‘জ্যোতিকাকা বড় কৃপণ ঝুমুদি।’

‘না না। আসলে আমরা দুটো বোন ঘাড়ের ওপর।’

‘ছিঃ! এভাবে আর কক্ষনো বোলো না। ভেবোও না। মা-বাবা নিজের সুখের জন্য সন্তান পৃথিবীতে আনে। সন্তানকে বোঝা মনে করার অধিকার কারও নেই। তোমাকে একটা ভাল শাড়ি কিনে দেয় না! একটা ভাল সালোয়ার-কামিজ! একটু সাজায় না তোমাদের!’

‘টোপর! এটা ঠিক নয়! সবাই সমান হয় না। আমার বাবাকে খারাপ বললে আমি রেগে যাই।’

‘মাপ করো ঝুমুদি। কথাগুলো সত্যি, তবু এভাবে বলা ঠিক হয়নি।’

‘এত দাম দিয়ে শাড়ি কিনলি, টাকা পেলি কোথায়?’

‘বাবার কাছ থেকে ধার নিলাম। চাকরি পেলে শোধ দেব।’

‘শাড়ির জন্য ধার? আর চাকরির জন্য শাড়ি?’

‘হুঁ।’

‘শাড়িটা আমার এত চেনা চেনা লাগছে কেন বল তো?’

‘মাকে আমরা শেষ যেদিন দেখেছি, মা’র চলে যাবার দিন, ঠিক এরকম একটা শাড়ি মা পরে ছিল।’

‘হ্যাঁ। লাল শাড়ি। হ্যাঁ। তোর মনে আছে? ঢাকাই জামদানি! কী করে জানলি ওটা ঢাকাই জামদানি ছিল? ওই বয়সে তুই শাড়ি চিনতি? এখনও কি চিনিস?’

‘না। শাড়িটা মনে ছিল। চটিটা। ব্যাগ। মায়ের গায়ের গয়নার নকশা-সব মনে আছে আমার। দোকানে শাড়ি সাজিয়ে রাখে, আমি সারাক্ষণ খুঁজতাম। খুঁজে যাচ্ছিলাম।’

‘কবে থেকে?’

‘জানি না। বোধহয় মা চলে যাবার পর থেকেই। দোকানে শাড়ি দেখলেই চোখ চলে যায়। দেখি। দেখতে দেখতে দেখাটা খোঁজায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। আমাদের শিশু থেকে তরুণ হয়ে যাওয়ার মতো।’

‘আমাকে ওই লাল মানাবে না।’

‘মানাবে।’

‘ধুৎ! আমি তো কালো।’

‘তাতে কিছু যায় আসে না শ্রীময়ী।’

‘কাকিমা খুব সুন্দর ছিল। রুপু। রূপাঞ্জলি। সার্থক নাম। কাকিমাকে যা মানায়, আমাকে তা মানাবে কেন?’

‘তুমিও যে খুব সুন্দরী, ঝুমুদি।’

‘ওরে পাগল, উন্মাদ, তুই স্নানে যা। খেয়ে একটু বিশ্রাম নে। পলাশ কখন আসবে?’

‘শাড়িটা পরবে না তুমি?’

‘আমি কি তাই বললাম। তোর দেওয়া প্রথম শাড়ি। তোর প্রথম চাকরির প্রথম উপহার। আমি না পরে পারি? শাড়ি পরতে আমার ভাল লাগে রে টোপর।’

‘খুব সুন্দর লাগবে তোমাকে। লাল ব্লাউজ পোরো, লাল টিপ। চুল খোলা রেখো। গলায় একটু চওড়া সোনার হার, দু’হাতে দুটি কঙ্কণ। নখে রং লাগিয়ো না। চোখে কাজল দিয়ো না। একটুও রং মেখো না ঠোঁটেও। পায়ে রুপোর নূপুর যেন থাকে। কিন্তু তাতে শব্দ নেই। আমার টাকা খানিক জমলে তোমাকে সোনার নূপুর গড়িয়ে দেব।’

‘বেশ।’

‘আসবে তো! আমার কাছে?’

‘আসব। তোর ওই সাজের বায়না মেটাবার জন্য আসল সোনার বদলে গড়িয়াহাটের ফুটপাথ থেকে কেনা সিটিগোল্ড হলে চলবে তো? গয়না সব ব্যাঙ্কে। বাবার হেফাজতে।’

‘নকল? তোমার যে এতটুকুও কৃত্রিমতা নেই ঝুমুদি! নকল গয়না তোমার বিশুদ্ধতায় গলে খসে পড়বে। আমি তোমার জন্য অনেক গয়না কিনব। ততদিন তুমি বিনা অলংকারে এসো।’

‘পাগলামো সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এবার বল তো, তুই নিজে দোকানে গেলি? শাড়ি কিনলি? এ যে অবিশ্বাস্য।’

‘ডোভার লেনের মুখে একটা নতুন ঝকঝকে দোকান। একদিন দেখি নানান নীলের বাহার। বিশাল কাচের দেওয়ালের ওপারে নীল শাড়ি উড়ছে। রঙের তারতম্য খুবই অল্প, কিন্তু পাশাপাশি মেলা বলে প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য বোঝা যাচ্ছে। শুধু নীল কেন? ভাবলাম গিয়ে জিজ্ঞেস করি। তারপর মনে হল, না, অপেক্ষা করি। আবার আসব। দেখব কী রং। কী সুন্দর না? তুমি রঙের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছ! রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছ-কাল কী রং থাকবে! সবুজ? হলুদ? গোলাপি? বেগুনি? কমলা? তুমি ভাবছ হলুদ থাকবে আজ। থাকবেই। কলেজে ক্লাস করছ, ভাবছ, বোধহয় গোলাপি! তোমার মনের মধ্যে একটা পিঙ্ক ঝরনা। গোলাপি আকাশ। গোলাপি মেঘ। গোলাপি প্রতীক্ষা। অনেকগুলি শর্ত ও চলরাশি সাপেক্ষে তোমাকে কম্পিউটারের জটিল নকশা তৈরি করতে হচ্ছে। অলঙ্ঘ্য যুক্তি বোধে, আঙ্কিক বিশ্লেষণে, নিখুঁত প্রোগ্রামিং। তার মধ্যেও তুমি মাখিয়ে দিতে পারো তোমার অপেক্ষার গোলাপি রং। এবং, শেষ পর্যন্ত, প্রায়ই আমার কল্পনার রং মিলত না। গোলাপির পরিবর্তে কমলা, হলুদের পরিবর্তে সাদা। শুধু লালের জন্য আমি কখনও অপেক্ষা করিনি। আর সব রং না মিললেও কিছু না। আমি নতুন করে অপেক্ষা আর কল্পনা নিয়ে খেলা করেছি। লাল আমার খেলনার রং নয় ঝুমুদি। সে আসতই। জানা ছিল আমার। লাল শাড়ি না থাকলে চলে নাকি? আমি তো রোজ বেরই না। হয়তো যেদিন লাল আছে, আমি নেই। পরশু দেখা হল। লালে লাল হয়ে আছে বিশাল কাচের আড়ালে দৃশ্যপট। আমি চিহ্নিত করলাম।’

‘নাম! শাড়ির নাম জানলি কী করে?’

‘ওইসব হলুদ নীল কমলা গোলাপি দেখতে দেখতে। ঝুমুদি, আমার হাতের মুঠোয় নেট দুনিয়া। আমাকে বিশ্বরূপ সে-ই দেখায়। যখন তুমি আমার কাছে থাকো না, সে-ই আমার সঙ্গী। সে-ই হবে আমার অন্নপূর্ণা, আমার রুজি রোজগারের বিশ্বস্ত মাধ্যম। তাকে বললাম শাড়ি চেনাও। সে সারা দেশ থেকে শাড়ি এনে ধরল। যেন আলাদীনের দৈত্য। বললাম, বাংলার শাড়ি। সে দিল দুই বাংলাকে মিলিয়ে। সত্যি বলব? শাড়ি আমাকে মুগ্ধ করেছে। কী সৌন্দর্য! কী বৈচিত্র্য! তখন জ্যোতিকাকার কৃপণতায় দারুণ রাগ করলাম। আমি যদি জ্যোতিকাকা হতাম, সাধ মিটিয়ে মেয়েদের শাড়ি কিনে দিতাম। সঙ্গে মানানসই গয়না। ওই যেমন দেয় মেয়েদের পত্রিকায়, এই শাড়ির সঙ্গে পরুন ব্ল্যাক মেটাল, এর সঙ্গে মানাবে এথনিক, মাটির গয়না আপনার যে কোনও সাজের সঙ্গী। তেমনই গোল্ড। রুপোর ওপর কস্টিউম জুয়েলারি আপনাকে দেবে ফ্যাশানেবল অথচ দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ভাব।’

‘কোথায় দেখিস এই বই?’

‘তোমার চোখে।’

‘যত বাজে কথা।’

‘আমি তোমাকে সব দেব। ধুত্তোর। দেব-দেব কেন করছি। তুমি আমার ধনলক্ষ্মী। তোমাকে সব টাকা সমর্পণ করব। নতজানু তো হতে পারব না। জানুর সঙ্গে সন্ধি আর হল কোথায় যে জানুসন্ধি ভূমিস্পর্শ মুদ্রা দ্বারা মাটি ছুঁইয়ে হাত পাতব-আমি তোমার কাছে দু’হাত প্রসারিত করে বলব দাও। তুমি তখন কার্পণ্য কোরো না।’

‘বাজে কথা রাখ। আমার মাছের ঝোল হয়ে গেছে। ভাত আছে। শুক্তো আর ওলকপির ডালনা। স্নানে যা।’

‘যাব তো। কবে পরবে বলো শাড়িটা।’

‘পরে চমকে দেব তোকে। আচ্ছা প্রবীরকাকাকে তুই কী বললি?’

‘আগে দোকানে কী বললাম শোনো।’

‘তুই নিজে গেলি?’

‘না। পলাশ গেল। আমাকে ফোনে ধরল। আমি অনুরোধ করলাম শাড়িটা সরিয়ে রাখতে। দাম জানতে চাইলাম।’

‘কত?’

‘এগারো হাজার টাকা।’

‘কী সর্বনাশ! ও শাড়ি পরে তো ঘরে বসে থাকতে হবে রে টোপর। বাসে-ট্রামে অটোয় তো চাপতে পারব না। একেবারে সোনা-সোনা যত্ন করতে হবে।’

‘ও! এগারো হাজার টাকা দাম বলে যত্ন করবে। এটা যদি সাড়ে চারশো টাকার শাড়ি হত, তবে তুমি ফেলে-ছড়িয়ে পরতে, কেমন? টোপরের দেওয়া শাড়ি বলে যত্ন করতে না!

‘টোপরের দেওয়া প্রথম শাড়ি, না রে? যত্ন করতাম। আমি তো সব কিছুরই যত্ন করি। কিন্তু দামি জিনিসের একটা আলাদা যত্ন প্রাপ্য হয় না?’

‘এই না হলে তুমি? এবার শোনো না। রাতে বাবাকে বললাম এগারো হাজার টাকা চাই। বাবা বলল, ‘কবে?’ ‘কালই।’ কুড়ি পেরোনর পর বাবা আমাকে আর জিজ্ঞেস করে না টাকা কীসের জন্য চাই। আমিই বলি। বললাম। বাবা খানিক চুপ করে রইল। অবাক হয়েছে। এতদিন আমি তোমার আর ঝিরির জন্য বই, সিডি, পারফিউম কিনেছি, শাড়ি এই প্রথম।’

‘জিজ্ঞেস করল না, শাড়ি কেন?’

‘না।’

‘আমি বাড়িতে কী বলব? এত দামি শাড়ি!’

‘আজই তার সমাধান। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তোমাদের নৈশভোজ দেব আমি। চমক ভোজন। কী খাবে বলো? চৈনিক, না মোগলীয়? তুমি যা বলবে। পদ ভেবে রাখো, আমি ফোন করব তোমায়।’

‘আমি তো মোগলাই খাব। খানাতল্লাসি নয় পরে করছি। তুই আমায় তখন শাড়িটা দিবি তো?’

‘ঠিক।’

‘না। ঠিক নয়। তোর এত বুদ্ধি, তবু মাঝে মাঝে বোকার মতো করিস কেন?’

‘কী করলাম?’

‘আমাকে দিবি, ঝিরিকে কিছু দিবি না টোপর?’

‘আমার ভাবনায় ঝিরি ছিল না। স্বীকার করছি। বাবা মনে করিয়ে দিয়েছে। ওর জন্য কী আনা যায় বলো তো!’

‘কত খরচ করবি? মানে ঝিরির জন্য বরাদ্দ বাজেট কত?’

‘উঁ? হাজার বারোশো।’

‘লেদার ব্যাগ আনিস। চেরি রং। বড় দেখে। একটা লাগবে বলছিল।’

‘তুমিই নিয়ে এসো এক ফাঁকে।’

‘আচ্ছা। টাকা রেখে যাস। বাবা সংসারের টাকা গুনে দিয়ে যায় তো। আমাকে হিসেব রাখতে হয়।’

‘হুঁ! জানি! দেখছি তো ছোট থেকে।’

ঝুমু ও ঝিরি ও বায়ু থিরি থিরি

কী সুবিধা হয়েছে এখন! বললেই বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেয়। টোপরের আয়োজিত নৈশভোজ সেরে, যথেষ্ট গল্পগাছা করে, রাত বারোটায় বাড়ি ফিরল ঝিরি আর ঝুমু। জ্যোতির্ময় ও প্রবীর মাত্র এক হাত দাবা খেলার অবকাশ পেয়েছেন আজ।

ঝিরি এসে ঝুমু-র বিছানায় বসল। বলল, ‘টোপরকে এত খুশি কোনও দিন দেখিনি। এত প্রাণবন্ত। এমন আড্ডাবাজ। কী ব্যাপার রে?’

‘কী আবার! চাকরি পেয়েছে, প্রথম, আনন্দ হবে না?’

‘উঁহু! ও তো ব্রিলিয়ান্ট! ভাল চাকরি পাবে জানাই ছিল।’

‘ভেবে দ্যাখ ঝিরি, মাত্র তেইশ ওর, পাশ করে বেরোতে না বেরোতেই প্রতিষ্ঠা পেল। সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায়। প্রতিবন্ধী কোটায় নয়। কারও সুপারিশে নয়। শুধু মেধা আর বুদ্ধি দিয়ে সব হয় না। ওর অদম্য মানসিক শক্তি। কী জেদ! কী আত্মবিশ্বাস! কত কষ্ট ওর! কত প্রতিকূলতা! সব জয় করেছে! আজ তো ও আনন্দ করবেই।’

‘শাপমুক্ত রাজকুমার।’

‘কেন?’

‘ছিল ব্যাঙ, হয়ে গেল রাজপুত্তুর।’

‘বাজে বকছিস কেন?’

‘চাকরিটার জন্য বিবস্বানও আবেদন করেছিল। তোর লাডলা ওর মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে।’

‘তাই বল। ঈর্ষানল পোড়ায় তোমায়। বিবস্বান বসে থাকবে নাকি? অত ভাল ছেলে।’

‘তা থাকবে না। কিন্তু টোপরের পক্ষপাতিত্ব নজর করার মতো। তোর শাড়িটার দাম অন্তত হাজার দশেক টাকা। আমার ব্যাগটা তো শিশু ভুলোন। সান্ত্বনা পুরস্কার। তুই-ই এনে দিয়েছিস বোধহয়। ঠিক আমি যেমনটি চাইছিলাম। চেরি কালার। মাল্টিপকেটস। ঢাউস লেদার ব্যাগ।’

‘হ্যাঁ। আমি তো নিয়ে এলাম লেদার ওয়ার্ল্ড থেকে। টোপর বলল এনে দিতে। টাকা দিয়েছিল।’

‘না দিলে তুই কিনবি কোত্থেকে! আমাদের চিপ্পু বাপ তো পারলে মোজা সেলাই করে পরে। নেহাৎ গোপালীমাসি আমায় বাঁচিয়েছিল, তাই চক্ষুলজ্জায় মাসিকে ফুটিয়ে দিতে পারে না। না হলে দেখতি কী করে।’

‘আমাদের কোনও কিছুর অভাব তো রাখেনি বাবা। একটু হিসেব করে চলে।’

‘হ্যাঁ। শুধু একটু হিসেব করে চলে। তাই মাকে মেরে ফেলল।’

‘ঝিরি! আবার!’

‘চুপ কর। ভালমানুষ সাজতে আমার ভাল লাগে না। মামাবাড়ির সঙ্গে আমাদের সেরকম সম্পর্ক নেই কেন? দিদা আমাকে সব বলেছে। মাকে ঠিকমতো চিকিৎসা করায়নি।’

‘আমরা কি মামাবাড়ি যাই না? আজকাল এর বেশি সম্পর্ক কে রাখে? দিদা যদি জানতই বাবা ঠিক কাজ করছে না, মাকে নিজের কাছে নিয়ে গেল না কেন?’

‘কেন আবার! দাদু অসুস্থ ছিল! সম্পর্ক তো ছিলই না কতদিন। তুই ভাল করেই জানিস।’

‘পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কী লাভ। বাবা আমাদের তো কোনও অযত্ন করেনি! দিদাই বা তোকে ওসব বলতে যায় কেন?’

‘বাবা ভয় পায়। টাকা না থাকলে যদি আমরা না দেখি। বুড়ো বয়সে বউ থাকলে চিন্তা নেই। আচ্ছা, বাবা আরেকটা বিয়ে করলেই পারত। কেন করল না? নিশ্চয়ই টাকা খরচের ভয়ে।’

‘ঝিরি থামবি?’

‘থামলাম। তোর শাড়িটা কোত্থেকে কিনলি রে? একাই গেলি? ‘ঢাকেশ্বরী’ না ‘প্রিয়ংবদা?’’

‘আমার শাড়ি আমি কিনিনি।’

‘কে কিনল? লেংড়ু? হাসাস না দিদি। লেংড়ু গড়গড়ি নিয়ে শাড়ির দোকানে গিয়েছিল? হি হি হি!’

‘সেটা তুই টোপরকেই জিজ্ঞেস কর ঝিরি।’

‘দরকার কী! শাড়িটা দারুণ কিন্তু। একঘর দেখতে। রবিবার পরিস। শাড়ির গুণে পরীক্ষায় পাশ করে যাবি।’

‘তুই নিবি? নে না।’

‘না বাবা। তোর টোপর তোকে দিয়েছে, তুই পর। আমি পরলে হয়তো গড়গড়ি চেপে তাড়া করবে।’

‘ঝিরি ঘরে যা। আমার ঘুম পাচ্ছে।’

‘টোপর এখনও জেগে আছে দ্যাখ।’

‘আমাকে ঘুমোতে দে ঝিরি। সেই ভোরবেলা উঠি। ক্লান্ত লাগে না?’

ঝুমুর বলল ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমোতে পারল না ঝুমু। সে নানা কথা ভাবতে লাগল। আজকের দিনটা খুব অদ্ভুত। খুব সুন্দর। জীবন হঠাৎ এমন সব ঝলমলে দিন উপহার দেয়!

টোপর একটা পাগল। কত কী বলল আজ! ঝিরিটা একটু হিংসুটে আছে। খুব জোরও আছে। বাবা ওর সঙ্গে পেরে ওঠে না। প্রত্যেককেই অল্পবিস্তর সন্দেহের চোখে দেখে ঝিরি। সমালোচনা করে। আর টোপর দ্বন্দ্ব হাঁকিয়ে বসে। সবকিছুই অন্যভাবে দেখতে চায়। ভাগ্য ওকে নিরন্তর যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছে। ওরও পৃথিবীর দিকে দ্বন্দ্ব নিক্ষেপ করার স্বভাব। কেমন বলছিল? প্রেমিকাকে ছোট হতেই হবে কেন! পাগল! একদম পাগল! না হলে অত দাম দিয়ে ঝুমু-র জন্য শাড়ি কেনে? ঝুমু-র জন্য? যার রূপ নেই, গুণ নেই, বিদ্যাবুদ্ধি অতি সাধারণ, একটা চাকরি পর্যন্ত করে না, কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, যে কিনা বসে আছে কবে কেউ তাকে পছন্দ করে মন্ত্র পড়ে সম্বন্ধ পাতিয়ে নিয়ে যাবে! বাবা চিন্তিত— মেয়ের বিয়ের যা খরচা আজকাল! বড়পিসি উদ্বিগ্ন। সময়মতো বিয়ে দিতে না পারলে মেয়ে গলার কাঁটা, বুকের পাথর। ঘাড়ের বোঝা। ঝুমুকেই বলে। খুব লজ্জা করে ঝুমু-র। বাবাই হোক আর পিসিই হোক, কারও গলার কাঁটা হয়ে বেঁচে থাকা গ্লানিকারক। টোপর রেগে ওঠে। উঠবেই। যা স্বভাব! না। সেজন্য রাগে না। আশ্চর্য! ঝুমু ভেবে দেখেনি কেন এতদিন? ও-ও ছিল ওর মায়ের বুকের পাথর!

ঝুমু-র ইচ্ছে করল, আবার টোপরের কাছে চলে যায়। আজ সারাদিনই প্রায় একসঙ্গে ছিল। থাকেও তো। টোপর বাড়িতে থাকলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে তো যায়ই বারংবার। হয়তো কথা হল কিছু, হলও না, হয়তো ছোটখাটো কাজ সেরে নিল চুপচাপ, প্রতিমা বা সরসীর সঙ্গে কথা বলল, কম্পিউটার বা বইতে নিমগ্ন টোপরকে দেখল খানিক।

ঘুমন্ত টোপর, ব্যস্ত টোপর, ব্যথিত, চিন্তিত, উৎসাহী, তার্কিক টোপর চেনা হয়ে গিয়েছিল। টোপরের আবেগ উচ্ছ্বাসের সমস্ত সরুগলিও ঝুমু-র চেনা। তবু এখন অসময়ে অকারণে কাছে যেতে কেন ইচ্ছা করে! ধ্যুৎ! ঝুমু টোপরের কাছে যাবে, তার আবার সময়-অসময়, কারণ-অকারণ কী!

একটা সাঁকো থাকলে ভাল হত না? ঝুমুর প্রিয় কল্পনা। টোপরদের বারান্দা থেকে তাদের এইদিকের ঝুলবারান্দা পর্যন্ত, কানাই সামন্ত সরু গলির উপর ঝুলন্ত সাঁকো!

রুপুকাকিমা ছিল যখন, ঝুমু-ঝিরি-টোপর বালক-বালিকারা রাবারের বল ছুড়ে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান খেলত। টোপর চেয়ারে বসে, ঝাড়ু নমিতা আর তার ভাই পলাশ টোপরের কুড়োনদার। তখন নমিতার নাম ছিল ফেলি। জন্মের পর, স্ত্রীলিঙ্গ দেখে ঠাকুমা তাকে ফেলে এসেছিল ছাইগাদায়। নমিতার মায়ের কাছে সে গল্প বহুবার শুনেছে ঝুমু।

‘আমাদের গেরাম, বুঝলে ঝুমু, সেই যাকে বলে মরিচঝাঁপি, তার নিকটে। সোনাচি। দ্বীপের মতন। একন আর নেইকো। ডুবে গেছে। সেবার সেই ঝড় হল নি কো? সেই যে কী নাম? আয়েশা! টুকুন জমিজমা যা ছিল, ডুবে গেসল নোনা জলে। আর আগে না, আমি ছেলতাম শ্বশুরের ভিটেয়। ঘরের বউ। স্বামী থাকেন কলকাতায়। শাউড়ি বলে— যা বউ, জল থে’ মীন ধর যেয়ে। কামটের ভয়ে মরি। মুয়ে রা নেই। পোয়াতি হলে বলে কী, লাতি হবে, ঘরকে থাক। আমি তো বাঁচলাম। কিন্তু ভয়ে ভয়ে নাই খাই। লাতি না হয়ে লাতিন তো হতে পারে। বুড়ি বলে— চাই না লাতিন। মুখে নুন ঠেসে মেরে ফেলাব। ওর বাপ রে বলি, শহরে সাথে নে চলো, বলে— ফাসসকালে কাজে যাই, এইটুকচাস বস্তিঘরে ডেরা, তোমারে দেকেশুনে রাখবে কে! বলি— পাড়ায় মেয়েছেলে নাইকো? বিয়োয় না তারা? বলতে তো পারি না, তোমার মা লাতিন হলে নুন ঠেসে মারবে! শেষে, কী হল, ব্যথা তো উঠল, বুইলে ঝুমু, সে যে কী ব্যথা, মা গো, মেয়েছেলে মানুষ, টের পাবে, সইতে না পেরে কখন জ্ঞান হারানু। জেগে বলি, আমার ধন কই? শাউড়ি বলে,’ চুপ যাও, মরা মেয়ে বিইয়েছ! আমার পোড়া কপাল! বলি, মরলে নাতি আমার ছাতি দেবে, কোথায় কী!’ দাই ছিল আমার সইমা। সে দেকি মুক টেনে রাকে। চোখে চোক ডালে না। সন্দ হল। বলি, মরা মেয়েকে দর্শাও। শাউড়ি বলে, ও ছাইগাদায় ফেলি রেখিচি। পারিস তো নেয়ায়!

আমি ধড়ফড় করি। কেঁদে বলি, মাসি, মেয়ে আমার বুকে দাও। পশ্য করি। শুনি যেন মেয়ে কাঁদে। টাঁই টাঁই। জোর না। জানুরি মাসের শীত গো ঝুমু, বলে— বাঘেও কাঁতা গায়ে দেয়— মাসি আমার মেয়ে নে এল। কোলে নিনু। শীতে নীল। কেঁদে বলি, মাসিগো, এ তো বাঁচবেনি! মাসে বলে— বাবা তাওকনাতের নামে দিব্যি কর, তাওকেশরের পুখরে বিসজ্জন দিবি, নাম রাক ফেলি, এপ্পর বাবার দয়া।

বলি, মাসি গো, তুমি তো ছিলে, তবু!

মাসি বলে, লাতনি দেখে তোর শাউড়ির মাতা খারাপ। বলে— দে। গেলে দে পেটটা।

আমি বলি— ও-কতা বোলোনি, জনম দেওয়ানো আমার কাজ, খুন কর্তে পার্বোনি। তোমার লাতিন, তুমি যা হোক করো। ত’ন ছাইগাদায় ফেলি এল। নিজ হাতে মার্তে কি পারে? বলে মরুক ছাই খেয়ে। ঠাণ্ডায়।

ত’ন তো কিছু বলি না। মেয়েকে সেঁক দিই। ওম দিই। গা মুছি। কাঁতা চাপা দিই। গায়ে একটুস বল পেয়ে একেবারে তেড়েফুঁড়ে উঠে শুরু দিলাম শাসানি। পেটে যত গালাগালি ছিল, গায়ে যত ঝাল ছিল, সব এক্কেবারে ঢেলে দিলুম। মাগী তো হতবাক। বলে, যে মেয়ে রা কাড়ত না তার এ কী মুত্তি! বলি, পুলিশে দেব আপনেকে, জেলের ঘানি টানাব, খবদ্দার যদি মেয়ের গায়ে হাত দিইছেন।’

একেকটি ক্ষণ কী আশ্চর্য নিখুঁত। যদি আর আধঘণ্টা পরে নমিতার মায়ের জ্ঞান আসত, পৃথিবীতে নমিতা থাকত না।

তারকেশ্বরের পুকুরে ফেলিকে বিসর্জন দিয়ে শিবঠাকুরের কাছে প্রতিজ্ঞা রেখেছিল নমিতার মা। নতুন নামে মেয়েকে ফিরিয়ে এনেছিল! নমিতা আপন জন্মবৃত্তান্ত শোনে আর মিটিমিটি হাসে।

বড়পিসি প্রায়ই বলে, ‘জ্যোতের একটা ছেলেও যদি থাকত।’

লোকে পুংলিঙ্গ চায়। জগৎ পুংলিঙ্গময়। কিন্তু কী লাভ, যদি ছেলের কোনও অক্ষমতা থাকে? টোপরের মতো? প্রতিবন্ধী পুত্রও ফেলির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত দায়। ঝুমু-র মতো মেয়ে প্রতিবন্ধী পুত্রের মতো বোঝা। ঝুমু যদি ছেলে হত, বাবার বিষাদ কিছু কম হত কি? ছেলে আছে— এই ভরসায় কৃপণতা কম হত? কিংবা টোপর একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে হত যদি? প্রবীরকাকার ওই সাময়িক মনোবৈকল্য কি সার্বক্ষণিক হয়ে উঠত মেয়ের নিরাপত্তার চিন্তায়, আপন ভবিষ্যতের সুরক্ষার স্বার্থে!

আচ্ছা, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যদি অত চিন্তা বাবার, তা হলে ঝুমুকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করল কেন?

বাধ্য করেছে বলা যাবে না। বুঝিয়েছে। ঝুমুও দিল ছেড়ে। বাবা চাইছে, কী করবে? তার জন্য কেউ দুঃখ পেলে, অসুবিধায় পড়লে, মনে মনে ভারী অস্থির হয়ে পড়ে সে। সবাইকে খুশি রাখাই তার অভিপ্রায়। সবার সুবিধা করে দিতে চাওয়ার মধ্যে তৃপ্তি আছে। এই যে প্রবীরকাকা, কত নিশ্চিন্ত, ঝুমু আছে, প্রবীরকাকার অনেক ভাবনা সে ভেবে দেয়। রান্নাঘরের জন্য ছোট্ট চিরকুট বই কিনেছে। যা যা ফুরোয়, লিখে রাখে তারিখ সমেত। কেনা হলে ছিঁড়ে ফেলে দাও। এই যাঃ ভুলে গেলাম— কোনও দরকার নেই। সকলের সুবিধার্থে সদা সতর্ক বলেই বাবা চাইল না সে ঘরের বাইরে যাক? টোপরের ধারণা। খানিকটা সঠিক হলেও হতে পারে। তবু প্রশ্ন আছে। সে যদি কাজটায় লেগে থাকত, এতদিনে দস্তুরমতো চাকুরিজীবী, প্রশিক্ষণ শেষে সে উপার্জন করত, তার বিবাহের বিপুল ব্যয় আংশিক হলেও বহন করতে পারত সে।

নিদ্রাহীন রাতের অবারিত চিন্তায় ঝুমু তার বাবা জ্যোতির্ময়ের একটি অঘোষিত চারিত্র্য উপলব্ধি করতে পারল অনায়াসে। অত্যন্ত রক্ষণশীল তিনি। যে প্রাচীনতা মনে করে মেয়েরা অভিনেত্রী হলে বেশ্যা বনে যায়, খেলাধূলা করলে মাতৃত্ব হারায়, বেসরকারি আপিসে কাজ করলে উচ্চপদাসীনের হাতে বলাৎকৃত হয়! জ্যোতির্ময় এর বাইরে বেরোতে পারেননি!

টোপর, নানারকম প্রশ্ন তুলে তাকে দিয়ে ভাবিয়ে নেয়। টোপর তার বোধের বিশ্লেষণের অবলম্বন। সে টোপরের শ্রোতা। টোপরের সহায়। কথাপুষ্পের পাত্র, সে টোপরের আকাশ। আকাশে আকাশে বড় ভালবাসাবাসি। কে আগে ধুলো চাটে, কোন মেয়ে আদি জন্ম নেয়, কোন তারা আগেভাগে সাঁঝের আকাশ থেকে নেমে আসে অনন্ত নয়ন তারায়।

ঝুমুর শরীর জুড়ে ঘুম আসে। কী শিথিল করে দেয় ঘুম! আজকের দিনটা কী সুন্দর! টোপর কি জেগে আছে? বাড়িটা অন্ধকার। নারীবিবর্জিত বসবাস। একেবারে নারী নেই? মেয়ে নেই, মেয়ে? ঝুমু মেয়ে? আজকের দিনটা… কিন্তু রবিবার!

আবার প্রদর্শনী! আবার হাসি-হাসি মুখ করে চায়ের থালিকা মেয়ে মিষ্টি দেয় ব্যর্থতার আগে। ঝুমু বড় সাধারণ। মূল্যহীন। নিজেকে বিকোতে চেয়ে বিবাহের হাটে, সে কেবল বাসি হতে থাকে। অবিক্রীত পসরার মতো, আত্মবিশ্বস্ততাহীন, ফ্যাকাশে, মলিন।

‘ঝুমুদি, চলো সব মিলে পুরী ঘুরে আসি।’

‘কবে?’

‘এই শুক্রবার।’

‘আজ বুধবার।’

‘হ্যাঁ। গাড়ি নিয়ে যাই চলো।’

‘কী আশ্চর্য!’

‘কেন?’

‘কাল সমুদ্র স্বপ্ন দেখেছি।’

‘আমিও তো। সমুদ্র আমার কাছে এল। বলল— চলো হে! চাকরির জাঁতাকলে পড়ে গেলে বন্ধ ওড়াউড়ি। বললাম— বেশ। যাও তবে। ঝুমুকে গিয়ে বলো। সে যদি রাজি থাকে। যদি সারস পাখিটি হয়ে, আমাকেও ঠোঁটে তুলে উড়ান লাগায়।’

‘আজ সরসী এসেছিল রে সকালটায়?’

‘হ্যাঁ। তুমি যেমন শিখিয়ে দিয়েছিলে তেমন বলেছি। আমি তো তোমার ভক্ত। ঝুমুদি যা বলে টোপর তা করে।’

‘ঝুমুদি কি ভুল বলে?’

‘না। ঝুমুদি টোপরের জন্য নির্ভুল।’

‘কার জন্য ভুল?’

‘তার নিজের জন্য।’

‘কেন রে, আমি নিজের তো কোনও ক্ষতি করিনি।’

‘চাকরিটায় আবার যোগ দেবে ঝুমুদি? বাবার কথায় ওঁরা তোমাকে নিয়েছিলেন। এখনও বাবার চাকরি আছে, জোর আছে। বললে হয়তো হয়ে যাবে। আরও অন্য সংস্থা আছে।’

‘এই সাতাশ বছর বয়সে কে আমাকে চাকরি দেবে টোপর? ফক্স অ্যান্ড গুপ্তা যখন ছেড়ে আসি, ওঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার অসুবিধা ঠিক কী।’

‘হ্যাঁ। আমার মনে আছে। তুমি বলেছিলে বাড়িতে অসুবিধা হচ্ছে। মা নেই তো আমাদের।’

‘হ্যাঁ। তাই বললাম। তখন আমাদের প্রধানত যিনি কাজ শেখাতেন, সুকুমার বাগচি, বললেন— মা, তোমার যখন বিয়ে হয়ে যাবে, বাড়ির লোক কী উপায় করবেন! আমি হাসলাম। উনি শুধু মাথা নেড়েছিলেন।’

‘তুমি তো বলতে পারতে বাবা চায় না, অথচ তুমি বললে, বাড়িতে অসুবিধা হয়। তুমি সত্যিটা বুঝেছিলে, বলেও ফেলেছ। কিন্তু অন্য সত্য গোপন করেছ।’

‘কাল রাতে তোর কথাগুলো ভাবছিলাম। আমার চাকরির সুযোগ, সেটা হারানো। বাবার একটা দিক নতুন করে আবিষ্কার করলাম।’

‘কী?’

‘আচ্ছা, টোপর, তোর তো আজ বেরোন নেই!’

‘নো, ম্যা অ্যা অ্যা মা! আজ আমি কোনও কাজ রাখিনি। সকালে নিজেকে পোড়ালাম!’

‘মানে? ছ্যাঁকা খেয়েছিস? কী করতে চেয়েছিলি?’

‘কুল বেইবি, কুল! আমার কোথাও লাগেনি! খুব সাবধানে থাকা অভ্যাস আমার। অসাবধানতা কি আমার পক্ষে বরদাস্ত করা সম্ভব? এমন হাঁক পাঁক করো!’

‘তবে যে বললি!’

‘ক্যালোরি বার্ন করলাম। সুপ্রিয়দা এসেছিলেন। যেমন আসেন। তাই বললাম নিজেকে পোড়ালাম। আমারই তো ক্যালোরি! তুমিও এবার থেকে খানিক আসন, প্রাণায়াম করো দেখি।’

‘করলেই হয়। স্কুলে অনেক শিখেছিলাম।’

‘ও দিয়ে হবে না। কাল সুপ্রিয়দা এলে তোমায় ডাকব, দেখে নিয়ো।’

‘না না। উনি তোর জন্য আসেন। সময় পরিমিত। টাকাও উনি তোরই জন্য নেন। আমি উপদ্রব জুটলে ওঁর মোটেই ভাল লাগবে না।’

‘মোটা হয়ে যাচ্ছ তুমি। তোমার রোজ শরীরচর্চা করা দরকার। তার জন্য সুপ্রিয়দার চেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি এ তল্লাটে আর পাবে না।’

‘তুই এমন বলিস টোপর! ভাল্লাগে না! মোটা হয়ে যাচ্ছি আমি জানি। আজ থেকে বিকেলবেলায় হাঁটব, হবে তো?’

‘হবে। কিন্তু শুধু হাঁটলেই হয় না। বসো। তোমাকে যোগাসন বিষয়ে খানিক লেকচার দিই।’

‘আমার দরকার নেই। আমি বাবাকে বলতেই পারব না মাসে মাসে টাকা খরচ করে আমার ওজন কমাও, কারণ বাবা কী বলবে আমি জানি।’

‘কী বলবে?’

‘আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে। অনেকক্ষণ কিছু বলবে না। তারপর দু’বার গলা খাঁকড়াবে। গেঞ্জি তুলে চশার কাচ মুছবে। অবশেষে লম্বা শ্বাস ফেলে বলবে— ‘এত টাকা কোথায় পাব রে মা? মাসে বারোশো টাকা নেবে, তাও সপ্তাহে তিনদিন, এত বাজে খরচ করা কি আমাদের সাজে? সামনে তোর বিয়ে। কত খরচ হবে বল তো। কোথা থেকে যে করব, ধারকর্জই বোধহয় নিতে হবে।’ সেদিন কী হল শোন! ক’দিন আগে খুব গলদা চিংড়ি খেতে ইচ্ছে করল, বাজারে পেয়েছিলাম, দেখে লোভ হল। কিনে ফেললাম।’

‘মনে আছে। মালাইকারি করে দিলে তো।’

‘মনে আছে তো? বাবা চিংড়ি দেখে বলল, ‘কত করে নিল?’ ‘সাড়ে পাঁচশো।’ ‘সা ড়ে পাঁ চ শো ও! ঝুমু, তোকে সারা সপ্তাহের বাজারের টাকা দিয়েছি, একদিনে শেষ? এভাবে চললে তো পথের ভিখিরি হয়ে যাব মা।’ আমার যে কী লজ্জা করল! আমি তো জানতাম বাবা খুশি হবে না, তবু কেন নিতে গেলাম! সামান্য চিংড়ির লোভ সামলাতে পারলাম না! ঝিরি ঝাঁঝিয়ে উঠল বাবার ওপর, ‘একদিন একটু চিংড়ি খেলে যদি পথের ভিখিরি হয়ে যাই আমরা বাবা, তবে তা হওয়াই উচিত।’ বাবা বলল, ‘এক টাকা বাঁচানো মানে একটাকা উপার্জন। নিজেরা রোজগার করলে বুঝতে পারবি।’ ঝিরি মুখঝামটা মারল, ‘বাজে কথা বোলো না, দিদি রোজগার করতেই গিয়েছিল, তুমি দাওনি! ও চিংড়ি কিনেছে, বেশ করেছে!’ বাবা আর কিছু বলেনি।’

‘আর সেই চিংড়ির মালাইকারি তুমি আমাদের খাইয়েছ।’

‘ভাল পদ কিছু হলে তোকে না দিয়ে খেতে পারি না রে।’

‘তোমার সব রান্নাই তো ভাল পদ ঝুমুদি।’

‘ওই একটাই তো পারি। তবু ভয়ে ভয়ে রান্না করি জানিস। এই বুঝি বেশি তেল দিয়ে দিলাম! তোদের জন্য সন্ধ্যাবেলায় মুখরোচক এটা-ওটা করি, কাজু দিই, কিশমিশ, গোলাপজল, আরও কত কী! বাজারের টাকা থেকে বাঁচিয়ে একটু একটু করে কিনি। বাবাকে দেওয়ার আগে, একটা একটা করে কাজু-কিশমিশ বেছে তুলি। গোপালীমাসি জানে। একবার আমি বেছে দিই, একবার মাসি বাছে। একটাও পেয়ে গেলে এমন করবে! রাগ তো করে না! যেন চোখের জল না ফেলে কাঁদে। তুই, ঝিরি— তোরা তো বাচ্চা, তোদের তো মুখরোচক খেতে ইচ্ছে করবেই। আমারই করে। রোজ চারাপোনার ঝোল, রোজ বাটামাছ, রোজ রুটি সাদা আলুর তরকারি— একঘেয়ে হয়ে যায় না? যদি টের পায়, বাজারের টাকা থেকে বাঁচাই, হয় টাকা আরও কম দেবে, নয়তো নিজেই বাজারে যেতে শুরু করবে। আমি সকাল-সকাল টাটকা বাজারে যেতে চাইলেও আপত্তি, তখন নাকি মাছ, আনাজ— সবকিছুর দাম বেশি থাকে। তোদের বাড়িতে এসে রান্না করতে ভাল লাগে আমার। স্বাধীনভাবে সব দিতে পারি। প্রবীরকাকার তো অত হিসেব রাখার বাতিক নেই। এটা আমার স্বাধীন দেশ।’

‘স্বাধীন দেশ? পাকাপাকি থেকে যাও না ঝুমুদি এ দেশে? দেশটা খারাপ কি? তুমি তো এর প্রতিটি কোনার খবর রাখো। মাকড়শা জাল বুনলে আমাদের আগে তুমি দেখতে পাও। এ দেশের টিকটিকিরা ক’টা পোকা খেল, সে খবরও তোমার অজানা নয়।’

‘দ্বৈত নাগরিকত্ব আমার। এদেশেরও লোক, ওদেশেরও। সেটাই তো ভাল।’

‘না। দেশাত্মবোধ ভাগ করা যায় বলে আমি মানি না। গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব— খুব খারাপ স্বভাব। দু’নৌকোয় পা দিয়ে আজ পর্যন্ত চলতে পেরেছে কেউ?’

‘দাঁড়া, প্রবাদ প্রবচনের অভিধান বার করি। তোকে নতুন কিছু সরবরাহ করা দরকার।’

‘দরকার নেই। তুমি বলো দু’দেশের মধ্যে যদি যুদ্ধ বাঁধে, তুমি কোন পক্ষ নেবে?’

‘কূটনেতিক পদক্ষেপ হিসেবে দু’দেশই দ্বৈত নাগরিকত্ব বাতিল করবে। আমি তখন চার আনা দিয়ে টস করব।’

‘চার আনাই কেন? শুনেছ তো সিকি অচল।’

‘আমার চার আনাই সম্বল। চার আনার গুরুত্ব, চার আনার অধিকার, চার আনার স্বাধীনতা। আমার মতো সাধারণ মেয়ের যা থাকে।’

‘ষোলো আনা স্বাধীনতা কি চাও তুমি, ঝুমুদি?’

‘আমি তো স্বাধীনই।’

‘দ্বিচারিণী। মিথ্যাবাদিনী। যে নিজেকে প্রতারণা করে তার দাসত্ব চিরকালের। আমি তোমার আকাশ। আমাকে বলো, বলো তুমি তোমার যন্ত্রণা, বলো অপমান বলো, চিংড়ি পোকার মাথা চিড়ে নেমে আসা লালগোলা যাতনাকাতর, বলো, বলে দাও, পাকশালে তেলের পাত্রের মতো ঝাঁঝালো ব্যথার হাতে নিস্তেজ শুখাল পাতা। আর একটু স্বাধীন যদি হতে তুমি, মশলার কৌটো থেকে বেরিয়ে আসত, পাঁচফোঁড়নের মতো রংদার আলোকরমণী আর সাদা ডানা সফেদ সারস।’

‘সরসী কী বলল রে? তুই যখন বললি?’

‘কী লজ্জা! একটু মাছভাত খাবে, কী লজ্জা! কিছুতে নেব না। বলে, ঝুমুদি আসুক, নেব এখন। বললাম, ঝুমুদি গুছিয়েই রেখে গেছে। নিয়ে গেল।’

‘খেল না? নিয়ে গেল? দাঁড়া ধরব বিকেলে। নিয়ে গেল মানে ছেলেমেয়ে সবাইকে খাওয়াবে। ওর আর কী লাভ হল!’

‘তুমি থাকলে জোর করে খাওয়াতে পারতে।’

‘তাই করতে হবে। আমাকে ডাকবি ও এলে।’

‘তোমার জোর আছে। স্বাধীনতা আছে। তোমার বাড়িতেই পাঠিয়ে দেব ওকে। বলব, খেয়ে এসো।’

‘কীসের শোধ নিচ্ছিস টোপর? বাবার কৃপণতার জন্য গোপালীমাসি আমাদের বাড়িতে এক কাপ চা দিলেও খায় না। তোদের ভাতই সরসীকে খেতে হবে।’

‘তুমি সরসীকে রোজ খাওয়াতে পারো, তুমি সুপ্রিয়দার কাছে শরীরচর্চা করতে পারো, ভাল কোনও জিমে যেতে পারো, নামকরা পার্লারে রূপচর্চা করতে পারো, দামি পোশাক হাতে নিয়ে ছ্যাঁকা লাগার মতো সরিয়ে রেখে বলার দরকার হয় না— সাড়ে তিনশো-চারশো— দু’শো-আড়াই শো, বাটি থেকে কিশমিশ-বাদাম লুকিয়ে তুলতে হয় না ঝুমুদি, চিংড়ির লজ্জিত মালাইকারি দিয়ে মেখে লোভ সংবরণ করতে না পারার গ্লানিসমেত ভাতের মণ্ড মুখে তুলতে হয় না। যদি তুমি নিজে রোজগার করো।’

‘রোজগারেই কি সব অধীনতার মুক্তি?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘রোজগারেই কি সব ইচ্ছাপূরণের চাবিকাঠি?’

‘নিঃসন্দেহে।’

‘কই তোদের এখানে তো আমার রোজগার বিচার করা হচ্ছে না।’

‘আরে তোমাকে আমরা সেভাবে দেখিই না তুমি জানো। আমাদের নারীবিবর্জিত সংসার তো চলে আসলে নারীরই পরিচালনায়। এবাড়ির নাড়িনক্ষত্র তোমার জানা।’

‘তার মানে ‘সেভাবে দেখা’ গুরুত্বপূর্ণ। সরসী তো রোজগার করে। ও কি স্বাধীন?’

‘ও পরিস্থিতির অধীন। হয়তো ও স্বামীর প্রতি অনুরক্ত, সেটাই দুর্বলতা। হয়তো সন্তানদের কথা ভেবে ও স্থিতাবস্থাই নিরাপদ বোধ করে। কোটি কোটি দরিদ্র ভারতবাসীর মতো আশা করে বসে থাকে, দিন ফিরবে। স্বামীর জ্ঞান ফিরবে। ছেলেমেয়ে বড় হলে টাকার মুখ দেখবে।’

‘তার মানে দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি ‘পরিস্থিতি’ শর্তটাও উঠে এল।’

‘আজ তুমি আমাকে যুক্তি তে হারিয়ে দিচ্ছ।’

‘কফি খাবি?’

‘করো। দেখি উত্তেজক পানীয় আমার তর্কবুদ্ধি বাড়ায় কিনা।’

ঝুমু কফির জল চাপাল। কাপে দুধ, চিনি, কফি দিল। ফুটে ওঠা জল ঢালছে। নাড়ছে। বলল, ‘দাম বেশি বলে আমাদের বাড়িতে কফি আসে না। ভাল চা আসে না। দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। আবার এই দেখাটাও নানান রকম।’

ছোট টুলে কফির কাপ দুটি নিয়ে বসল মুখোমুখি। বলতে লাগল, ‘জীবনে এক-একটা উপলব্ধি মনটাকে নতুন করে গড়ে দেয়। আমার মা যেদিন মরে গেল, তুই খুব ছোট্ট, আমি পাঁচ পূর্ণ করেছি, বোন কয়েক মাসের, বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বারান্দায়। বড়পিসি এসে বলল, ‘জ্যোতি, তোকে শক্ত হতে হবে। ছোট মেয়েটার জন্য আয়া রাখতে হবে। তোর শ্বশুরবাড়ির কেউ দায় নেবে না। আমার অবস্থা তো জানিস।’ বাবা বলল, ‘আয়া-টায়া রাখা সম্ভব না। চিনু আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে।’ ‘ওইটুকু শিশু, মরে যাবে যত্ন না পেলে। ভাল চাকরি তোর, অত চিন্তা কীসের, সংসারে কত দায়িদায়িত্ব থাকে।’ বাবা বলল, ‘দশ হাজার টাকা! চিনুর জন্য দশ হাজার টাকা চলে গেল। ওর ভাইরা তো একটা নয়া পসা ছোঁয়াল না!’ বড় হলাম। বুঝলাম মায়ের চেয়েও টাকার শোকই সেদিন বেশি ছিল বাবার। সেই বাবা, আমাকে চাকরি করতে দিল না কেন? কারণ, বাবা রক্ষণশীল। আমি যদি স্কুলে পড়াতাম, যদি সরকারি চাকরি করতাম, বাবা শেষ পর্যন্ত মেনে নিত। কিন্তু বাবার অনেক কথায় প্রকাশ পায় রক্ষণশীলতা। মেয়েরা ঘর সামলাবে। মেয়েদের প্রতি অত্যাচার বা নারীস্বাধীনতা নিয়ে কোনও মহিলা টিভিতে বক্তব্য রাখছে দেখলে বাবা টিভি বন্ধ কর দেয়। আমাকে বলে, ‘ওসব গিলিস না।’ বাবার মতে, অভিনয় করলেই মেয়েরা নষ্টচরিত্র। নার্স মানেই ডাক্তারদের সাথে শোয়। বিমানবালারা সবাই পাইলটদের মনোরঞ্জন করে। আমি একদিন বললাম, ‘তা হলে চিকিৎসক ও বিমানচালকরা মহিলা হলে কী হয়!’ তখন উত্তর— মহিলা চিকিৎসকের সঙ্গে নার্সের কোনও তফাত নেই। আর বেসরকারি সংস্থায় কোনও মেয়ে কাজ করে মানেই তার মালিক বা উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের হাতে ক্রীড়নক।’

‘আর তুমি তার বিরুদ্ধে যাবে না! তুমি বলবে না, জ্যোতিকাকার ধারণা ভিত্তিহীন!’

‘নিজের লোকের সঙ্গে লড়াই করতে পারি না আমি। ঝিরি পারে। তবু ঝিরি স্কুলে চাকরি পাবার চেষ্টা করছে।’

‘জ্যোতিকাকা একা নয় ঝুমুদি। এইরকম ধারণা, এমনকী বদ্ধমূল সংস্কার আরও অনেক পরিবারে আছে। অনেক লোকের মধ্যে আছে। আমাদের কলেজে যে মেয়েরা একটু খোলামেলা পোশাক পরত, কিংবা ধরো ধূমপানের অভ্যাস আছে, ছেলেরা তাদের সঙ্গ পাবার জন্য ব্যাকুল কিন্তু আড়ালে ‘বিচ’ ছাড়া সম্বোধন করে না। প্রেম-প্রেম ভান করেই শুয়ে পড়ার পরিকল্পনা করে। যদি বা সত্যিই কোনও খোলামেলাকে ভালবাসল কেউ, বলে-কয়ে তো প্রেম হয় না, সবার আগে সে ভালবাসার অধিকারে কোপ মারে প্রেমিকার পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষা বা সিগারেটের ওপর। স্তনসন্ধি প্রদর্শন করবে না, ওটা শুধু আমার জন্য। হাতকাটা জামা পরবে না—অন্যরা পুরো চাটে।… কথায় কথায় ওসব, ইয়ে, ফাক ইউ টিউ বলো কেন? তোমার মুখে মানায় না। কত বলব। ভালবাসা, না পাকানো দড়ি বোঝা ভার। মেয়েরাও অধিকারপ্রবণ হয়। যেদিক থেকেই শর্তগুলো আসুক না কেন, সম্পর্ক শ্বাসরুদ্ধকর হওয়ার আগেই নিজের পছন্দ-অপছন্দ জানিয়ে দেওয়া দরকার।’

‘বললাম যে, নিজের লোকের সঙ্গে শর্ত নিয়ে দর কষাকষি আমার পক্ষে অসম্ভব।’

‘সম্ভব করতে হবে ঝুমুদি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সম্মান করাই সভ্যতা। ব্যক্তি ও পরিবার, পরিবার ও সমাজ, সমাজ এবং রাষ্ট্র যদি পরস্পরের জগতে সম্মানজনক বোঝাপড়া করে না নেয়, তা হলে ভারসাম্য থাকে না।’

‘টোপর, এইসব কথা তত্ত্ব হিসেবে খুব ভাল, কিন্তু আমার এই ছোট্ট জগতে ওই শব্দগুলো কেমন বেমানান ঠেকে রে। আমার বাবা, তার মত প্রকাশ করছে, আমি তার মেয়ে, আমি কীভাবে বিচার করব আমার স্বাতন্ত্র্য সম্মান পেল কিনা! বাবা আর মেয়ে, এর মধ্যে এসব আসে নাকি?’

‘তুমি ব্যক্তি শব্দটাই ভাবনা থেকে বাদ দিয়ে দিলে ঝুমুদি। পরিবারের ধারণা কত বদলে গিয়েছে দেখো। আস্তে আস্তে সামাজিক সম্পর্ক আরও ব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। রক্তের সম্বন্ধে পরিবার বলে কিছু থাকবে না। ব্যক্তি সরাসরি সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। আজ যে আমরা স্বতন্ত্র ব্যক্তিপরিসর নিয়ে সচেতন হয়ে উঠছি, এরই বিশালতর প্রক্ষেপ হবে ভবিষ্যতের সমাজ। নিশ্চয়, বাবা আর মেয়ের মধ্যে বোঝাপড়া থাকতে হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে একজন নিজস্ব বিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দেবে। আমি স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা ইত্যাদি স্বাধীন হতে বলছি, দাস হতে নয়।’

‘ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে, সেই ভেবে বর্তমান অস্বীকার করলে চলবে?’

‘তুমি তো বর্তমানে নেই ঝুমুদি, অতীতে আছ। আমাদের চারপাশের বিপুল জনগণ অতীতে আছে। তারাই তোমার মতো আরও অনেককে অতীতে ধরে রাখতে চাইছে নিজের স্বার্থে। নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে। নিজের অহং চরিতার্থ করার স্বার্থে।’

‘আমার ভয়-ভয় করছে রে। টোপর, তুই যেন আমাকে নিষিদ্ধ কিছু করতে বলছিস।’

‘ঝুমুদি, আমি শুধু বলছি, নিজের ইচ্ছের মূল্য দিতে শেখো।’

‘স্বার্থপর হতে বলিস না আমাকে। এই বেশ আছি আমি টোপর। বাবা যেমন আছে থাক, ফেলে তো দিতে পারব না। কী লাভ অশান্তি করে?’

‘পৃথিবীটা শুধু তোমার বাবার নয়। আরও অনেক লোক আসবে যে।’

‘ও। তাই বল। তুই বিয়ের কথা বলছিস! বর কেমন হবে, শ্বশুরবাড়ি কেমন হবে! যা কপালে আছে হবে। ওখানে গিয়ে যদি সমাজ বিবর্তনের তত্ত্ব আওড়াই আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ নিয়ে কথা বলি, বউমা’র মাথা খারাপ বলে ফেরত দিয়ে যাবে। বুঝলি?’

‘আগেই আত্মসমর্পণ করে বসে আছ? এইজন্যই আমাদের দেশে এত বধূ হত্যা হয়। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া।’

‘আমার মতো মেয়ের আর গতি কী!’

‘তোমাকে দেখে আমার মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য লাগে, জানো?’

‘কেন?’

‘একজন আস্ত মানুষ, সকাল থেকে রাত্রি যে অন্য চারজন লোকের সুবিধা-অসুবিধা দেখে যায়, বিনিময়ে কিছু প্রশংসাবাক্য-টাক্য—আবার সংসার তাকেই ঘাড়ের বোঝা মনে করে অন্য সংসারে চালান করে দিতে চায়, সেও চালান হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে, আনন্দের সঙ্গে নয়, ত্রাসের সঙ্গে। কারণ তার জন্য বাবার টাকা খরচ হবে, শ্বশুরবাড়ি যেমনই হোক, মেনে নিতে হবে। আবার সেখানে গিয়েও সে অন্য আরও কয়েকজন লোকের সুবিধা দেখবে, কাউকে সেবায় তুষ্ট করবে, কাউকে যৌনভাবে, তাতে সে সফল হবেই, কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না।’

‘অত নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে দেখছিস কেন?’

‘আমি বুঝতে পারি না ঝুমুদি, কীভাবে একটি সুস্থ বুদ্ধিমান মেয়ে কেবল যৌনতা ও দাসত্বর জন্য অপেক্ষা করতে পারে। দু’জন নরনারী যৌনক্রিয়া করবে এবং নতুন প্রজন্মের মানুষ পৃথিবীতে আনবে—এই অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বেচাকেনার হাট করে তোলা হয় কেন! তা-ও আমি বুঝতে পারি না। আমি এটাও বুঝি না, এই সম্বন্ধ করা বিয়ে। প্রেমহীন, বাধ্যতামূলক সঙ্গমের পথ বেয়ে ভালবাসার জুয়াখেলা। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই সম্বন্ধ ঘটিয়ে বিবাহ, বিবাহ কেন্দ্র করে যত বাণিজ্য, লেনদেন, সব মিলে আসলে এক বৃহত্তর বেশ্যালয়।’

‘টোপর প্লিজ, লোকে এসব শুনলে বলবে তোর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। এদেশে আজও সম্বন্ধের বিয়ে উচ্চতম সামাজিক সম্মান। গরিব হলে ধার করে এই সম্মান কেনে, মধ্যবিত্ত নিজস্ব পুঁজি বিলিয়ে দেয়, বড়লোকের বিয়ে মানে প্রতিপত্তির প্রমাণ। একে তুই বেশ্যালয় বলছিস!’

‘নিশ্চয়ই। বেশ্যাপল্লিতে দু’জন অচেনা নারী-পুরুষ কী করে? যৌনতা কেন্দ্র করে ব্যবসায় করে তো? সেখানে প্রেম-ভালবাসা-বোঝাপড়া কিচ্ছু নেই। স্রেফ এবং স্রেফ যৌনতা ও বাণিজ্য! একটু বড় মাত্রায় ভাবো। দু’টি অচেনা ছেলে-মেয়ে, যারা পাত্রপাত্রী, তাদের যৌন সম্পর্কে শিলমোহর দিচ্ছে সমাজ। তাদের কেন্দ্র করে বাণিজ্যও বিপুল। পার্থক্য হল, বেশ্যাগমন ব্যক্তি র স্বাধীন নির্বাচন, বিবাহ পাত্রপাত্রীর সামাজিক নির্বাচন, অর্থাৎ সমাজ সেইসব কর্মকাণ্ড সহজে অনুমোদন করতে চায় না যেখানে ব্যক্তি স্বরাট, সমষ্টি গৌণ, এমনকী কখনও কখনও অস্তিত্বহীন! এ বিষয়ে সমাজমানস এমনই গূঢ় এবং বিস্তৃত যে কমিউনিস্টরা সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার—সকলের সৃজনশীলতাকে আক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে! আমাদের দেশে তো কে কী নিয়ে পড়বে, তা-ও পারিবারিক তথা সামাজিক নির্বাচন। বিয়ের ব্যাপারে তো কথাই নেই।’

‘সবার কি প্রেম হয়? সেই প্রেম কি আজীবন থাকে? ভালবাসা কি ফুরোয় না? শরীরের খিদে বলেও তো একটা কথা আছে। বাচ্চা আনাও জরুরি। না হলে তো মানবজাতি বলে কিছু থাকবে না। প্রেম কী জানিস? একটা আসক্তি! টান! হয়তো এর মধ্যে কোনও যৌনরসায়ন আছে! ভালবাসা অনেক বড়। অনেক বেশি মায়াবী আর গভীর। একসঙ্গে থাকলে তবেই ভালবাসা গড়ে ওঠে। প্রেমের জন্য একসঙ্গে থাকা জরুরি নয়। এমনকী চোখে না দেখেও প্রেম হয়। এই দ্যাখ, তোরা যদি আমাদের পাশের বাড়ি না হতি, বাবা আর প্রবীরকাকা যদি দুই বন্ধু না হত, তোর সঙ্গে হয়তো আমার আলাপ-পরিচয় থাকত, কিন্তু এত ভালবাসা আসত কি?’

‘কত ভালবাসা ঝুমুদি?’

‘অনেক, অনেক। জানিস না যেন!’

‘তাও বলো না, কতটা?’

‘ভালবাসা কি মাপা যায়? সে খুব ভালবাসা রে টোপর! ভগবান যদি এসে বলে, ঝুমু, আজ থেকে তোর পা দুটো নিয়ে নিলাম, টোপরের পা ভাল হয়ে যাক-আমি বলব, তাই হোক।’

‘ব্যস! এইটুকু!’

‘প্রাণও দিতে পারি।’

‘সে তো আরও সোজা।’

‘টাকা পয়সা সোনাদানা তো নেই।’

‘সম্পর্ক দিতে পারবে?’

‘সে আবার কী।’

‘আমার জন্য সবাইকে ছাড়তে পারবে?’

‘ছাড়তেই হবে না।’

‘যদি হয়, ছাড়বে?’

‘কাকে? বাবাকে? বোনকে?’

‘যাকে যাকে ছাড়তে হবে। কে, আমি জানি না।’

‘পাগলামো করিস না।’

‘বলো না!’

‘এভাবে বলা যায় না। তবে তুই যেভাবে বিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করছিলি, আমি মানতে পারলাম না। বিয়ের পর ছেলেরাও কি সব সময় প্রার্থিত জীবন পায়? আমার এক মামা আছে, দারুণ গান গায়। গানপাগল একদম। মান্না দে-র গান এমন নিখুঁতভাবে গাইতে পারে যে লোকে অবাক হয়ে যায়। বিয়ের দু-তিন বছরের মধ্যেই মামার গান বন্ধ। মামিমার সন্দেহবাতিক।’

‘ঝুমুদি গো, আমার সোনা ঝুমুদি, বিয়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা তুমি বন্ধ করো।’

‘পুরী যাবার কথা কী বলছিলি?’

‘তোমার স্বপ্নের কথা বলো ঝুমুদি। সমুদ্র স্বপ্ন দেখেছ তুমি। বলো।’

‘ওহো কী সুন্দর রে স্বপ্নটা! নীল আকাশ আর নীল জল। কত দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সমুদ্র। খুব একটা ঢেউ নেই। তুই জলের কিনার ধরে হেঁটে যাচ্ছিস। পেছন থেকে তোকে দেখছি। অনেক লম্বা। অমিতাভ বচ্চনের মতো। পারে আর লোক নেই। একজনও নেই। আমিও না। কিন্তু আমি তোকে দেখছি। ঝলমলে রোদ্দুরে তোর গায়েও নীল শার্ট, ব্লু জিন্স! হাওয়ায় চুল উড়ছে। আমি ভাবছি, টোপর তো বলেনি ও হাঁটতে পারছে!’

‘আর?’

‘আমার খুব ভাল লাগছিল। স্বপ্নের ভেতর ভাল লাগা ঢুকে পড়েছিল। আর দ্যাখ, তুই পুরী যেতে চাস। কী আশ্চর্য না? কিন্তু টোপর, রবিবার যে পাত্রপক্ষ আসবে। শুক্রবার গেলে আমরা রোববার কেমন করে ফিরব?’

সম্বন্ধ বড়পিসিই এনেছেন। পাত্রের মা তাঁর গুরুভগ্নী। ভগিনীর পুত্র যে ভাগিনেয়, নাম সন্দীপন, আটপৌরে দীপ। সুচাকুরে, দীর্ঘদেহী সুতনু, যদিও মাথায় টাক পড়ে গেছে, বয়স ছত্রিশ মাত্র, বড়পিসির অভিমত্যানুসারে এমন ছেলে লাখে একটা মেলে কারণ ভক্তিমান, শ্রীগুরুর শ্রীচরণে এত দূর মতি যে বিয়ে না করার দুর্মতি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গুরুভগ্নী কল্যাণী দুর্গতের গতি দীনজনশরণ শ্রীগুরুর পদাপন্ন হয়ে বিপদাপন্নের উদ্ধার প্রার্থনা করলেন। গুরুর আদেশে বাঘেগোরুতে একজোট -দীপ কোন ছাড়!

বাড়ি গড়িয়ায়। লেক গাডের্ন অঞ্চল থেকে কিবা দূর! বড়পিসির মতে, গুরুই এ সম্বন্ধ রচনা করেছেন। এ বিয়ে হবেই, যদি না টাক আছে বলে ঝুমু বাতিল করে দেয়। যদিও, যে মেয়ে চারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে—প্রথমবার সমগোত্র, দ্বিতীয়বার মাস্টার্স ডিগ্রি নেই, তৃতীয়বার শ্যামলা রং বলে এবং চতুর্থবার স্রেফ ব্যাখ্যাহীন অপছন্দে— সে মেয়েকে পঞ্চমপক্ষ যদি পছন্দ করে বসে তো হাতে পাওয়া চাঁদ পাঁপড়ভাজার মতো কুড়মুড় করে খেয়ে ফেলা আশু কর্তব্য! টাক তো কী! চুল ধুয়ে জল খাবে?

যদি উলটোটা হত? ঝুমু সুচাকুরে, ভক্তিমতী, মাথাজোড়া টাক—সন্দীপন রাজি হত?

এহেঃ। যত অবাস্তব কথা! নারীবাদীদের যত অর্থহীন নষ্টামি আর উসকানি, সব উল্টো করে ভাবা চাই। আরে বাবা, প্রতিবিম্ব দেখে চলতে গেলে ডান-বাম জ্ঞান থাকবে না!

‘ঝুমু আমাদের সেইরকম মেয়েই নয়। ওর মতো নম্র, ভদ্র, লজ্জীশীলা একালে পাওয়াই যাবে না। আমরা যা বলব, যেমন বলব, ঝুমু শুনবে।’ বড়পিসি বলেন।

অর্থাৎ, অতি বিরল চরিত্তির সন্দীপন এবং বিরলতম প্রজাতিকা ঝুমুর, ওরফে দীপ বনাম ঝুমু—খেলা লাগল বলে! আম পাকে, জাম পাকে, আর পাকে বেল, তোমায় আমায় শুরু হল খেল্ খেল্ খেল্।

‘বিয়েতে মত হওয়ার পর নাকি ছেলে বলেছে সে মেয়ে দেখতে আসবে না। মা যাকে পছন্দ করবে, তাকেই মেনে নেবে। শুধু মেয়ের যেন কোমর ছাপানো চুল থাকে। আজকাল মেয়েদের যে নানা ছাঁটের চুল, তা তার পছন্দ নয়। পুরুষছাঁটের চুলওয়ালা মেয়ে তো আসলে নারীকুলের ভ্রষ্টাচারিতা! সে নিয়ে তো ভাবনা নেই, ঝুমু-র যা চুল, কেশতৈলের বিজ্ঞাপন করা যায়।’ বড়পিসির গর্ব তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীর চুলে উৎকুন পোকার মতো সেঁধোয়।

‘আমাদের ঝুমু তো দেখতে-শুনতে খারাপ না। রংটা একটু চাপা। কিন্তু চোখমুখ? একেবারে কাটা কাটা না হলেও খাঁদাবোঁচাও নয়। সংসারে হেন কাজ নেই যে জানে না। আমি তো বললাম কল্যাণীদিকে, এমন কাজের মেয়ে তুমি আর দুটি পাবে না।’

সকলের আগে ওঠে। সবশেষে ঘুমোতে যায়। শাশুড়ির মশারিটি গুঁজে দিয়ে, বাতিটা নেভায়। বউ হয়ে এসেই নিয়ে নিল শ্বশুরের ঔষধ খাওয়াবার ভার। শ্বশুরবাড়িতে নব ননদ-দেওর সকলের রাখে আবদার। বরের খাবার গরম গরম দেয় পাতে। টিফিনের বাক্সে পুরে দেয় কত না ভোজের আয়োজন। খুশি রাখে নাভির তলায় অন্ধকার রাতে। বরকে একলা পেতে চায়? আ ছিছি! সে কথা কি কখনও বলেছি? তার জন্য রয়েছে তো মধুরাত। মধু না থাকলেও থাকে কঠিন আঘাত। যদিও আদর, শুধু যন্ত্রণার সাক্ষী থাকে নীরব চাদর। দিনে দাসী, রাতে সর্বনাশী! অবসরে? বউমানুষের অবসর হল চুনোমাছ কোটা। যদি সব কাজ হয়ে গিয়ে থাকে, অবসরে মেজে ঝকঝকে করে দিক পেতলের শুচিস্মিত লোটা। যত ছ্যাঁতলা পড়েছে কলতলে, কে তুলবে ঘষে, বউ ছাড়া? সবার পতন রোধে একমাত্র গুণবতী সুন্দরী বেচারা। বউ—এ টোটাল প্যাকেজ অব মেকিং এ ড্রিম হোম। যাকে খায় স্বামী, শ্বশুরাল, সমাজ ও যম! খরচ সামান্য। কন্যাদায়ত্রস্ত পিতা যা দেয় থোয় সেটা হল উপরি পাওনা। কাজের মেয়েরা বেতন-টেতন চেয়ে কেবল বাড়ায় দুখভার। বউমা অবৈতনিক! যত খুশি নাচিয়ে নাও না!

সেই বউ, শুক্তো না রেঁধে, পরিত্যক্ত শয্যা গুছিয়ে না তুলে, কাঁধে আলোকচিত্রগ্রাহী যন্তরটি ফেলে কিংবা স্রেফ বই পড়বে শান্তচিত্তে অভিপ্রায়ে যদি গন্তব্যে রওয়ানা হয়, সেটা কি দেশের প্রতি, দশের প্রতি, সমাজ, পরিবার, সর্বোপরি তার স্বামীটির প্রতি অসভ্য বিশ্বাসঘাতকতা নয়? লোক এলে চা দেবে কে? অ্যাঁ?

ছাঁটা চুল! ইয়ার্কি! লম্বা চুল না থাকলে মেয়েদের কমনীয়তা আসে না! মেরি কমের জীবনী চলচ্চিত্রে উত্তেজক, ভারোত্তোলক ভারতী জোয়ারদার আবেগ জোয়ারে আপনার প্রেয়সী হতে চাইলে, ও মশাই, আপনি থলে হাতে ভূতলে গড়াবেন!

‘আমাদের ঝুমুকে নিয়ে কোনও ভয় নেই। তার চুল আছে। পরিচর্যার অতুল প্রমাণ। সে রা-টি কাড়ে না। যা বলি, তা শোনে। বড় ভাল।’

‘বুঝলি রে টোপর, আমাকে কেউ দেখতে আসুক বা না আসুক, সম্বন্ধ এলেই বড়পিসি আমার গুণকেত্তন শুরু করে আর বাবা খুব মন দিয়ে সেই সব শোনে, যেন আমাকে দেখেইনি কখনও, বড়পিসির বর্ণনা শুনে মনে মনে এঁকে নিচ্ছে।’

‘পুলিশের আঁকিয়েরা ওইরকম। তুমি একজনের বর্ণনা দিলে, ওঁরা চেহারাখানা আঁকলেন, অনেকখানি মিলেও যায়।’

‘বাবা আমাকেও মেলায় বোধহয়। ফাইনাল ব্যালেন্স শিট ধরার আগে বারবার ট্রায়াল ব্যালেন্স চেক করে। তারপর অ্যাসেট লায়াবিলিটির সূক্ষ্ম বিচার।’

‘যে কোনও উৎপাদিত পণ্য যখন তুমি বাজারে ছাড়বে, তার গুণাগুণ সম্পর্কে তোমায় ওয়াকিবহাল থাকতে হবে, তবেই বিজ্ঞাপন জোরদার হবে। বিকিকিনি জমবে ভাল। এক্ষেত্রে জয়ীপিসিমার সঙ্গে আমাদের গড়িয়াহাটের ফুটপাথ জুড়ে বসা দোকানদারের কোনও তফাত নেই। সবে তো বাছাই চলছে ঝুমুদি, এরপর দর কষাকষি শুরু হবে।’

‘পাত্রপক্ষের দাবিদাওয়া? ছেলের নাকি কোনও দাবি নেই।’

‘ছেলের বাবার? মায়ের? সেজপিসিমার? ন’মাইমার? কুট্টিদিদির?’

‘এখনও সেসব বলেনি। আগে তো মেয়ে দেখা।’

‘একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করেছ?’

‘কী?’

‘বিয়ের কথা উঠলেই মানুষের নাম উড়ে যায়? তখন শুধু ছেলে আর মেয়ে। ছেলের বাড়ি, মেয়ের বাড়ি।’

‘তারপর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেই শুদ্ধভাষা। পাত্র আর পাত্রী। পাত্রপক্ষ, কন্যাপক্ষ।’

‘বিয়ের পর আবার চলিত প্রয়োগ। বর-কনে।’

‘কি অদ্ভুত না? কেউ শিখিয়ে-পরিয়ে দিচ্ছে না। প্রত্যেক পরিবারেই আপনা-আপনি ভাষাগুলো এসে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটায় একটা, কী বলব, নকশা আছে বা ধাপ আছে।’

‘যেমন?’

‘যখন সম্বন্ধ আসে, অর্থাৎ প্রস্তাব, তখন যে কোনও একটা ছেলের সঙ্গে যে কোনও একজন মেয়েকে জুড়ে দেবার জন্য সুতো টানা হচ্ছে। একটা মেয়ে বা ছেলে, তাকে কেন্দ্র করে সম্বন্ধের অনেক সুতো। এবারে একটা জুটি হল। এবার এল দাঁড়িপাল্লা। দেনা-পাওনা। কৌলীন্য মান-মর্যাদা। ঘটনা ওজনদার। ছেলে আর মেয়েও পাত্রপাত্রী। তারাই তো আধার। সচেতন স্বার্থসম্বন্ধের গুরুগম্ভীর আদানপ্রদান।’

‘ঠিক। ঠিক বলেছ। আবার বিয়ের আসরে আনন্দ-উৎসবের মেজাজ মুখের ভাষাও দেয় হালকা করে। টোপর পরা বর আর মুকুট পরা ঝুমু। তখন শুধু মাধুর্য।’

‘ওমনি নিজেকে বরের মাথায় বসিয়ে দিলি!’

‘আচ্ছা, টোপর একটা নাম হল! বলো তুমি! টুপুর-টাপুর, পুটুর-পাটুর, পুটে, টুকাই, টোকন, পটা, পটকা—কতরকম নাম হতে পারত! তুমি রাগ কোরো না ঝুমুদি, তোমার মাথায় মুকুট পরালাম তো।’

‘মাঝে মাঝে বড্ড বাজে বকিস। বাচাল একটা।’

‘ভাগ্যিস বেচাল বলোনি। ভয় হত, এই না বানচাল করে দাও।’

‘কী বানচাল?’

‘তা হলে কাল তোমায় দেখতে আসছে। বেশ। দেখিয়ে এসো।’

‘কী দেখাব?’

‘ওঁরা যা দেখতে চাইবেন।’

‘মারব এক চড়।’

‘সে তুমি মারতেই পারো। কিন্তু ওঁরা তো দেখতেই আসছেন। তুমিও দেখাবার জন্য তৈরি।’

‘আবার তোর একই কথা। রোজই কি তুই এই নিয়ে তর্ক করবি টোপর? আমি কী করব বল তুই?’

‘আমি যা বলব করবে তুমি?’

‘কেন করব না? তুই তো আমায় এমন কিছু বলবি না যা অসম্ভব!’

‘আন্দাজ করো তো, কী বলতে পারি?’

‘তুই বলবি, বিয়েই কোরো না। আমিও তোর কথা মেনে নিতে রাজি। কিন্তু বাড়িতে শুনছে কে! সমস্ত আলাপ আলোচনা, আয়োজন আমার জন্যই নাকি, আমারও একটা ‘জীবন’ আছে, সেটা পাইয়ে দেওয়া, কিন্তু আমায় কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না। ছেলের চুল নেই। বড়পিসি বলেই ফেলল, আমার এ নিয়ে আপত্তি করার উপায় নেই কারণ এর আগে—’

‘চারটি ছেলের বাড়ি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।’

‘হুঁ। তার জন্য ছেলের টাক থাকলেও মানতে হবে।’

‘বিয়ের পরে টাক পড়লে কী করবে?’

‘হুঁ। ততদিনে পুরনো হয়ে যাবে। তাই বলে—।’

‘ওঃ! পুরনো মানুষের কদর নেই, না?’

‘তা মোটেই বলিনি! তাই বলে ময়রার মতো ভুঁড়ি, জল্লাদের মতো বড় বড় কানের লোম, রামু মাছওয়ালার মতো ফাঁকা ফাঁকা দাঁত—সব আমাকে পছন্দ করতে হবে? না বলার উপায় নেই’!

‘হো হো হো হো হো হো! উঃ হু হু! আঃ হা হা হা! ঝুমুদি, ও ঝুমুদি, ও ঝুমুদি—এত মিষ্টি তুমি—এত মিষ্টি— তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতেই পারব না।’

টোপর হাসতে হাসতে লাল। হাঁপাচ্ছে। জল খেল। ঝুমু-র ডান হাতখানি নিল নিজের হাতে। হাতের ওপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আস্তে-আস্তে, আস্তে-আস্তে। ঘাড় অল্প কাত করা। দৃষ্টি দূরে। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।

‘টোপর!’

জবাব নেই। মুখের শব্দ সব বুকের তলায় বুজকুড়ি কাটে আর রক্তের ফেনা তোলে লুকোন পুকুরে। শীতল মাছেরা সচকিত। কত মাছ! দুখের সুখের! অপমানে জর্জর মাছের গলার ক্ষত এখনও সারেনি। অভিমানে ঘাই মারা ভুলে গিয়ে যে-মাছ অনড়, সেও আজ থরো থরো কাঁপে। পৃথিবী সুখের নয়। জেনে গেছে। ভালবাসা ভীষণ কঠিন। ভালবাসি, ছেড়ে চলে যেয়ো না কোথাও, বলা কি কঠিনতর নয়? তবুও এমন হয়। তবুও তবুও ঠিক এরকমই হয়!

‘টোপর!’

ঝুমু ভয় পাচ্ছে। সেদিনের মতো আবার কি কাঁদবে ছেলেটা? ওই দুটি চোখে জল ঝুমু সইতে পারে না। ওই মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে, বড় কষ্ট হয়। ঝুমু তো গভীর ভালবাসে। ভালবাসে ছেলেটাকে।

‘টোপর! কথা বল!’

ঝুমু-র হাতটি ছোঁয়াল গালে।

‘কফি করি? পাঁপড় সেঁকে দেব?’

ঝুমু-র হাতটি ছোঁয়াল দুই চোখে। বার বার। চুমু খেল। কী কাতর চোখমুখ! তবু কী গভীর! যেন মগ্ন হয়ে আছে। বলল, ‘ঝুমুদি।’

‘উঁ?’

‘ওদের না বলে দাও। আর কোনও দিন বোসো না পরীক্ষায়।’

‘উঁ?’

‘তোমার পরীক্ষা নেওয়ার সাধ্য এ জগতে কারও নেই।’

‘তারপর?’

‘ভালবাসি। তুমিও তো ভালবাস। বিয়ে করো। করবে?’

‘ক্কী! কাকে? ক্কী বলছিস?’

‘আমাকে? ঝুমুদি? আমি তো ভালবাসি, তোমাকেই। তুমিও তো, আমাকেই তো! আমরা তো ভালবাসি।’

স্থির। অনন্তকাল। স্থির। বিদ্যুৎপ্রভার মতো ক্ষণিক প্রণীত।

ঝটকায় সরিয়ে নিল হাত!

চড়!

সেই হাতখানি দিয়ে, যে হাতে একটু আগেই চুমু দিয়েছিল প্রতিবন্ধী ছেলে!

চড়! সেই হাতখানি দিয়ে! যে-হাত খানিক আগে দু’গালে ছুঁইয়েছিল অসাড়াঙ্গ যুবক ছেলেটা!

‘এরকম একটা কথা কীভাবে তুই বলতে পারলি আমাকে! ছিঃ!’

ওষ্ঠে অভিমান, অভিমান গ্রীবার ভঙ্গিতে, গালে কে জানে কীসের অঙ্গার আভা। স্ফুরিত নাকের পাটা ক্রোধে। দুই চোখ বাইরে ফেরানো। নগরের ধূসর আকাশ যতটুকু চোখে পড়ে, সেইখানে শূন্যের মতো, অসহায় শূন্যতার মতো, ব্যথিত, কাতর দুটি চোখ, ধীরে ধীরে মেঘ নেমে আসে।

‘ঝুমুদি!’

ঝুমু ঠোঁট কামড়ে ধরল। দু’হাতে শরীরের ভার, যেন ঢলে পড়া থেকে বাঁচতে দু’হাত স্তম্ভ অতিবল।

‘ঝুমুদি! তাকাও আমার দিকে।’

‘তোকে আমি সবচেয়ে বড় বন্ধু ভাবি…’

‘তাকাও ঝুমুদি। আমার দিকে দেখো। সত্যিই তো আমি তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু।’

‘তোকে কত বিশ্বাস করেছিলাম।’

‘আর করো না? করবে না আর? ঝুমুদি? বলো!’

জল পড়ছে চোখ থেকে। টুপ, টাপ, টুপ, টাপ। নৈঃশব্দের শব্দ। জলবিন্দু চোখ থেকে গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে, চিবুকের দু’পাশ ভিজিয়ে, গলায়। কোন পানে ধায় অশ্রুধারা? তারও কি প্রিয় ওই স্তনসন্ধি, গাঢ় ভাঁজ, নরম নরম দুই পর্বতের চূড়া?

‘ঝুমুদি কথা বলো। যা মুখে আসে। যা প্রাণে চায়। বলো। দেখো আমাকে।’

‘আর কি বিশ্বাস করতে পারব তোকে?’

‘আমি কীভাবে তোমার বিশ্বাসে আঘাত দিলাম? বলো। বলো আমাকে।’

‘তোর চেয়ে কত বড় আমি! চারটে বছর! তোকে কোলে নেওয়ার স্মৃতিও আছে আমার। আর তুই এই চোখে দেখে বসলি আমাকে? আমি কি সেইরকম মেয়ে?’

‘দাঁড়াও ঝুমুদি দাঁড়াও। অনেক আলাদা প্রসঙ্গ টেনে আনছ। তুমি আমার চেয়ে বড়, তো? কী এসে যায়? তুমি মাত্র চার বছর আগে পৃথিবীতে পৌঁছেছ বলে আমি তোমায় ভালবাসতে পারি না?’

‘আমি তোর দিদি না? আমাকে ঝুমুদি বলিস তুই। তোকে রাখি পরাই। ফোঁটা দিই। ইশ্ শ্ শ্! ছিছি! কেউ শুনলে কী বলবে।’

‘অন্য কারও কথা পরে। আগে তোমার কথা। রাখির অর্থ কী? রক্ষাবন্ধন। প্রিয়জনের মঙ্গল রক্ষা করার আবেদন। সম্বন্ধ যাই হোক, রাখি পরানো যায় গো ঝুমুদি। আর ভাইফোঁটা? শেষ কবে দিয়েছ আমায়?’

‘সে তুই নিতে চাস না তাই। ছোটবেলায় তো নিতি।’

‘কেন চাই না? ভেবেছ কখনও?’

‘আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করিস না তাই। কী মনে করছিস তুই টোপর? আমাকে যা খুশি বোঝাবি আর আমি বুঝে যাব?’

‘না। আমি তোমাকে যা খুশি বোঝাব না। তুমিও বুঝবে না। শোনো, আমার কথা তুমি না-ই মানতে পারো। আমি জোর করব না ঝুমুদি। ভালবাসার মধ্যে জোরাজুরি সবচেয়ে হীন কর্ম। কিন্তু আলোচনা হতে তো বাধা নেই। অন্তত আমরা যে বন্ধু, সে বিষয়ে তো তোমার সঙ্গে আমার মতানৈক্য নেই। তুমি আমাকে বিশ্বাসহন্তা বলেছ, আমাকে আমার উপলব্ধি ব্যাখ্যা করতে দাও। তুমি তো আমার আকাশ ঝুমুদি।’

‘আমি তোকে বিশ্বাসঘাতক বলিনি। আমার খারাপ লাগছে। লাগছে। আমি ভাবতেও পারিনি তুই…’

‘শব্দটা উচ্চারণ করোনি। বলেছ, ‘আর কি তোকে বিশ্বাস করতে পারব?’ ঝুমুদি, ছোটবেলায় তুমি, ঝিরি আমাকে ভাইফোঁটা দিয়েছ, তার গুরুত্ব বুঝে দিয়েছ কি? আমিই কি বুঝে নিয়েছি? সমাজ কত কী চাপিয়ে দেয় একেকটি মানবক ধরে দুই কাঁধে। ধর্ম, সংস্কার, রীতি। কাঁধ নিজেই জানে না সে কীসের বাহক। বুঝতে যখন শিখলাম, আর ভাল লাগল না। কেন? প্রথমত, আমার ছোট জগতে এই তো তোমরা ক’জন। তাই প্রত্যেকটি সম্পর্ক আমি গভীর যত্নে লালন করতে শিখেছি। আমার যখন এগারো-বারো, বুঝেছিলাম, তোমাকে ছাড়া আমার চলে না। তুমি একদিনের জন্যও যদি আমতার মামার বাড়িতে যেতে, আমার কান্না পেত। ছাতের এডিনিয়াম গাছগুলোকে বাবা যেমন ছোট্ট একটুখানি চারা থেকে প্যাঁচালো গুঁড়িওয়ালা অপূর্ব দারুশিল্পে নিয়ে গিয়েছে, তেমনই তুমি আমায়। মা যখন চলে গেল, তোমাকে আঁকড়ে আমি মায়ের অনুপস্থিতি ভোলার চেষ্টা করতাম। তুমি আমাকে বুকে চেপে ধরতে। তোমার ছোট্ট বালিকা বুক। কী গভীর ভালবাসা! কী মায়া! মাকে ছাড়া বাবাতে আর তোমাতে আমি ভরে উঠলাম। আমি মায়ের দায় ছিলাম, ওই শৈশবেই বুঝেছি। মা আমাকে যত্ন করত কিন্তু বাবার ওপর শোধ তুলত। আমার ওপরেও তুলত মা’র আবেগহীন হিম যত্নের মধ্যে দিয়ে। বড় হয়ে ছোটবেলা আরও ভাল করে চেনা যায় তো। আমি ছিলাম দায়, মা দায় ফেলে গিয়েছে। বাবা সেই দায় বুকে নিল এমন সহজে, অনায়াসে, তুমি আমাকে তোমার মধ্যে মিশিয়ে নিলে এমন যে আমার আর অভাববোধ রইল না। মায়ের প্রতি স্বাভাবিক টান তো আমার থেকেই গিয়েছিল বলো। যদি মা মরে যেত, সে ছিল একরকম। তোমাদের মতো আমিও মেনে নিতাম। আমার কী হল? মা আছে, আসে না, ফেলে গেছে। আর আমি তোমাকে, মাত্র চার বছরের বড় তোমাকে, মায়ের মতোই জড়িয়ে একটু বেড়ে উঠলাম। এগারো-বারো হল আমার, বয়ঃসন্ধিক্ষণে, তোমার পনেরো-ষোলো, তোমার জন্য আমি আকুল হয়ে গেলাম। একটা ছেলে কোন বয়সে প্রথম ভালবাসে জানো কি? সাত-আট বছরেই গো। কিংবা তারও আগে। তার মধ্যে চেতনা সঞ্চারিত হওয়া মাত্র কোনও না কোনও নারীকে সে ভালবেসে ফেলে। বিশ্বাস করো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভালবাসার আধার বদলে যায়। কিন্তু আমার হল না সেরকম। তোমাকে ছাড়া কাউকে আমার ভালই লাগেনি। কাউকে দেখে মনে হয়নি, কোলে মাথা রেখে শান্তি পাব। বয়সের ধর্মে তোমাকে চুমু খেতে চেয়েছি মনে মনে, বুকে আদর করতে ইচ্ছা হয়েছে, প্রকাশ করতে চেয়েছি কতবার—ভালবাসি—এই কথা বলার মধ্যেও বড় তৃপ্তি—কিন্তু তুমি এত সহজেই আমায় আদর করো, কোলে নাও, কতদিন তোমার বুক আমার গালে কপালে ছুঁয়ে যায়, অনায়াসে চুমু দাও তুমি, ভয় করত, ঠিক আজ তোমার যে প্রতিক্রিয়া, তার জন্য ভয় করত, যদি ছেড়ে যাও, যদি কেউ বুঝে ফেলে আর আলাদা করে দেয় আমাদের, যদি এ বাড়িতে তোমার আসা বন্ধ হয়ে যায়, আমি বাঁচব কী নিয়ে?’

‘তুই যা বলছিস, অসম্ভব! চার বছরের বড় আমি! চা-র!’

‘একটা করে সম্বন্ধ আসে তোমার, দেখতে আসে, আমার সারা রাত ঘুম আসে না। তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে, আমার একই সঙ্গে দুঃখ ও সুখ। সুখের-দুখের কাঁথা গায়ে আমি সারদিনমান কুয়াশা বানাই। সারা রাত তন্ত্রসাধনা করে একে একে নরবলি নারীবলি দিই যজ্ঞের লকলকে আগ্রাসী আগুনে। তারা সব নরকের জীব। পাপের আকার। এই ধরাধামে তোমাকে অবজ্ঞা করে যায়! তোমাকে! নেড়ে চেড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে পাড়ি দেয় নবজলসায়! অধিকার নেই। হোমকুণ্ডে মরা যত শব আমি ধরে রাখি নতুন নুতন ফোল্ডারে। তারপর নেমে আসে উৎসবরাতি। আমার হৃদয় জুড়ে সুরের বাজনা বেজে ওঠে। হাজার হাজার বাতি জ্বলে। শীতঘুম ভেঙে গভীর গর্ত থেকে সাপ এসে বলে, ঝুমু আছে, ঝুমু আছে, ছেলেপক্ষ পছন্দ করেনি।’

‘সম্ভব নয়। সম্ভব নয় টোপর। পাপ হবে।’

‘কোনও পাপ নেই ঝুমু। ভালবাসা অপাপবিদ্ধ। বিয়েও জরুরি কিছু নয়। ভাইফোঁটা নয়। সম্পর্ক হয়। তার একটা নাম হয়। সেই নাম দেবে মন, পাড়াপড়শি নয়। জন্মের শংসাপত্র মিলিয়ে কি ভালবাসা হয়? তুমি বললে বিশ্বাস ভেঙেছি। ‘ভালবাসি’ বললে বিশ্বাসভাঙা? নাকি ভাল না বাসাই বিশ্বাসে আঘাত? তুমিও তো ভালবাস। আমাকেই। বলো? বাসো না? বলার বাসনা নেই? বোলো না, সে বেশ। বলো যদি, সত্য বোলো, মিথ্যা নয়। মিথ্যা নয়।’

‘পাগলামো কেন করছিস টোপর? তোকে আমি ভালবাসি। একশোবার। হাজারবার। সেটা অন্য ভালবাসা।’

‘এভাবে পরীক্ষায় বসো, অনাদৃত হও, এভাবে অন্যরা তোমাকে দুঃখ দেয়, তোমার জীবন গছিয়ে দেয় তোমাকেই অবহেলা করে, নিজের খেয়াল খুশিমতো। ভাল লাগে? বলো? ভাল লাগে?’

‘অন্য উপায় নেই যে।’

‘ঝুমু, আমি বিয়ে নিয়ে ভাবিনি। না করলেই বা কী। কিন্তু অন্য কোথাও চলে যাবে, তা কি হয়? একটা ভাল চাকরি মানেই তো যোগ্যতা। বিবাহযোগ্যতা। এতদিন সে যোগ্যতা ছিল না, বলিনি কিছু। আজ আমি রাজা। তুমি শুধু রাজি হও। হ্যাঁ বলো। বলো। ভালবাস। আমাকে যে ভালবাস তুমি। আমি টের পাই।’

‘সেটা অন্য।’

‘সেটা কেমন? ঝুমুদি? কীরকম সেটা?’

‘আমি জানি না।’

‘এটাই তোমার সৎ উত্তর। তুমি জানতে পারোনি। সংস্কার পলি ফেলে বোধে। আমি জানি তুমি আমাকেই ভালবাস। আমারই মতো করে। আমার, আমারই জন্য পাগলিনী সেই মেয়ে, চিনি, তাকে চিনি। ঝুমুদি, ঝুমু, তুমি সত্যি আমাকেই ভালবাস, ভেবে দেখতে চাওনি। তুমি মিথ্যে বলতে পারো না, তাই ‘ভাইয়ের মতো’ বলোনি। মনের কোনায় কোথাও এ স্বীকৃতি আছে। ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানে আওড়ানো আকাট ছড়ার নীচে ঢাকা। কোনও অর্থ কি হয়? যমদুয়ারে কাঁটা কি পড়ে? রাখি-বাঁধা, ভাইফোঁটাসিক্ত ভাই-বোন পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে শত্রু কি হয় না? উদাসীন হয়ে যায় না কি পরস্পর? ভাবো ঝুমু, ঢাকনা তুলে দেখো, নিজেরই কাছে স্বপ্রকাশ হও। একবার হ্যাঁ বলো। বাকি পৃথিবীর সঙ্গে আমি লড়ে যাব।’

‘তোর পায়ে পড়ি রে টোপর, কাউকে কিচ্ছু বলিস না। তুই যা বলছিস, হয় না, অসম্ভব, এটা ছেলেমানুষী। মাঝখান থেকে আমাদের দুই বাড়ির মধ্যে এই সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে।’

‘সম্পর্ক কি গোদুগ্ধ যে নষ্ট হয়ে যাবে? নাকি মুসুর ডাল? হিম যন্তরে তিনদিন থাকলেই পচা?’

‘সবাই কি তোর মতো করে ভাবে? বাবা কীরকম রক্ষণশীল জানিস না? নিজে আর বিয়ে পর্যন্ত করল না খানিকটা হয়তো রক্ষণশীলতার কারণে। মাঝখান থেকে কেউ আমাদের বিশ্বাস করবে না। ভাববে তলে তলে আরও অনেক কিছুই চলছে।’

‘কী চলছে? শোয়াশুয়ি? একটা প্রতিবন্ধী ছেলে আর বিয়ের বাজারে ফিরি হতে থাকা কালো মেয়ে শুচ্ছে ঘন ঘন?’

‘কাদা ছেটাবে সম্পর্কটায়। ভাল লাগবে?’

‘তাতে কী প্রমাণ হবে জানো?’

‘কী?’

‘মেয়েটা চার বছরের বড় হলেও যৌনসম্পর্ক, প্রেম-ট্রেম সম্ভব, এটা আর সকলেই জানে, মানে, কেবল তুমিই জানো না জানেমন।’

‘আমি বাড়ি যাচ্ছি রে। কাল আর আসব না তোর কাছে।’

‘পরীক্ষায় ফেল কোরো ঝুমুদি। আমার শুভেচ্ছা। আর ভেবো। কী চাও। কী চাও না। আমি তোমাকেই চাই। বার বার মারো, বার বার। আমি সহস্র চাঁদের থেকে জ্যোৎস্না পানীয় করে ভালবাসা বানিয়েছি বুকের ভিতর। মস্তিষ্কে, হাতে, কোষে কোষান্তরে, এমনকী অসাড় পায়েও ছড়িয়ে দিয়েছি অশেষ অসীম প্রাণ। প্রাণ, তুমি প্রাণ, তুমি ভালবাসা, প্রাণের ভিতর প্রাণ হয়ে এসো তুমি। আমি আছি। তোমারই জন্য আমরণ। যতই প্রহার করো, যতই চড়ের বার্তা শরীরে পাঠাও, যতই আঘাত করো, তোমাকেই ভালবেসে যাব। তোমাকেই চেয়ে নেব জগতের কাছে। তোমাকেই বলব ভিক্ষা দাও আঁচল ভরিয়ে। তোমাকে তুমিই ভিক্ষা দাও।’

‘লেগেছে গালে?’

‘হুঁ।’

‘আহা! আয় হাত বুলিয়ে দিই টোপর।’

‘কাছে এসো। আরও কাছে।’

‘আজ নয় টোপর।’

‘একটা চুমু দাও।’

‘আজ আর নয়।’

‘কপালের মাঝখানে। একটা!’

‘না টোপর। পারব না।!

‘রাগ করে চলে যাবে? বিশ্বাস করো না?’

‘না। রাগ নয়। অবিশ্বাসও নয়। আমাকে ভাবতে হবে। বুঝতে হবে, টোপর।’

সকাল সকাল ঝুমু-র চলে মেহেন্দি লাগাতে এল ঝাড়ু নমিতা। ঝিরির আয়োজন। রূপচর্চার প্রাথমিক কিছু কায়দা জানে নমিতা। সুতো দিয়ে ভ্রূ চেঁছে ধনুক-বাঁকা, চুলের প্রসাধন, ফাটা পায়ের মসৃণতা উদ্ধার। এমনই কানাই সামন্ত সরু গলিতে বিয়ে লাগলে ঝাড়ু নমিতার কনে সাজাবার অগ্রাধিকার। সে এ কাজে পারিশ্রমিক নেয় না। স্রেফ শখ।

উত্তরের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছে ঝুমু। গায়ে গামছা। রং-চটা পুরনো ঢিলে ম্যাক্সি। মেহেন্দির রং মাখামাখি হলেও খেদ নেই।

ছোট টুলে মেহেন্দির পাত্র রেখে, দাঁত মাজার পুরনো বুরুশ দিয়ে ঝুমু-র চুলের গোছায় অল্প অল্প করে লাগাচ্ছে নমিতা। ঝিরি সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে। হাতে বই।

ঝুমু বলল, ‘ঠিক যেন একতাল গোবর। বাবাঃ! কী হয় এসব লাগিয়ে?’

ঝাড়ু নমিতা বলল, ‘দেখতে গোবর। কিন্তু গন্ধ? আ আঃ! দারুণ লাগে। খুব গুণ মেহেন্দির। মাথা ঠাণ্ডা করে, চুল ভাল হয়, দেখবে শ্যাম্পু করার পর একদম সিল্কি! চুল পড়াও কমায়।’

‘তুই তো মেহেন্দির বিজ্ঞাপন লাগিয়ে দিলি।’

‘জিজ্ঞেস করো ঝিরিকে। কী রে ঝিরি? বল!’

ঝিরি বলল, ‘মালটা আসলি তো?’

‘দেখেছ ঝুমুদি, কীসব ভাষা বলছে।’

‘মাল কি খারাপ কথা? মালগাড়ি হতে পারে, মাল মাটি, মাল গুদাম, মাল খালাস, মালদার— সবই তা হলে অচল।’

ঝুমু বলল, ‘রকের ভাষায় কথা খুব চলে এখন। ঝিরি স্মার্ট হতে চায়, না ঝিরি?’

‘চাই-ই তো। স্মার্ট, সাকসেসফুল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট। কিপ্টে বুড়োর অধীনে আমি থাকছি না, থাকব না। মাল্লু কামাব আর ওড়াব। সেই তো জীবন মামা, মাল নাকি পায়জামা? বেশ দিচ্ছিস তো নমি, আমারও লাগাতে ইচ্ছে করছে।’

নমিতা বলল, ‘আর মেয়েদের যখন ‘মাল’ বলে?’

‘বলে তো বলে। মেয়েদের তো ‘জিনিস’-ও বলে।’

‘আরও কত কী বলে। মাকড়ি, নিমকি, দুদমা।’

‘এতো পুরো মেয়েটাকে বলে। এরপর আছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।’

ঝুমু বলল, ‘হয়েছে। তোরা থাম এবার। আঃ! মাথাটা বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।’

“টোপর’ কাকে বলে জানো ঝুমুদি?’

‘হি হি হি হি!’ ঝিরি হাসছে। ‘দিদিকে বলিস না। রেগে যাবে।’

ঝুমু বলল, ‘রেগে যাব কেন? শুনি।’

নমিতা বলল, ‘টুপি, টুপি। কণ্ডোমকে বলে টোপর।’

‘যাচ্ছেতাই। মা গো। গা গুলোচ্ছে।’

‘এতেই? দিদি, তুই আর মানুষ হলি না।’

‘তুই কি বিবস্বানের সামনেও এই ভাষা বলিস?’

‘তো? ওর সামনে কি শুদ্ধভাষা বলব নাকি? ও কি আমার গুরুঠাকুর? না বট্ঠাকুর?’

‘বট্ঠাকুর মানে কী বল তো?’

‘কেন? বটগাছ ঠাকুর! বটগাছতলায় পুজো দেয় দেখিসনি? এ আর জিজ্ঞেস করার কী আছে?’

‘তোর মাথা আর আমার মুণ্ডু। বট্ঠাকুর হল বড়ঠাকুর। ভাসুরকে ভাইয়ের বউরা বট্ঠাকুর বলত।’

‘সত্যি বাবা, ভাশুর শ্বশুর ননদ নন্দাই জা শাশুড়ি— কী অদ্ভুত শব্দ সব! শুনলেই মনে হয় আজব এক দুনিয়া। সবাই খুব নিষ্ঠুর আর সমালোচক টাইপ্‌স্‌। কেমন অচেনা লাগে, না রে দিদি? ভয়-ভয় করে।’

‘ভয়-ভয় করে বলে তো মনে হয় না। এক পা বাড়িয়েই আছিস।’

‘দাঁড়া। দিল্লি আভি দূর হ্যায়।’

‘কেন?’

‘কেন আবার। প্রেম করছি ঠিক আছে। বিয়ের ব্যাপারে অনেক ভাবতে হবে।’

‘তার মানে?’

‘আমি বলছি না বিবস্‌কে বিয়ে করব না। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে অনেক তফাত। ও কোথায় চাকরি পাবে, আমি কোথায় পাব, একই শহরে পাব কিনা, না পেলে কী করব, দূরে গেলে এই প্রেম টিকবে কিনা…’

‘চোখের সামনে না থাকলেই প্রেম শেষ হয়ে যায় নাকি রে ঝিরি?’

‘যায়-ই তা বলব কী করে? তবে যেতে তো পারেই। রোজকার দেখাসাক্ষাৎ টান বাড়ায় তো।’

‘অদর্শনে টান কমে আসে? বাঃ! বেশ বললি তো! তাই যদি হবে, তবে দাম্পত্যে প্রেমের মরচে পড়ে কেন? একসাথে থাকা, খাওয়া, শোওয়া, অ্যান্টাসিড বা ঘেমো অন্তর্বাসের সহাবস্থানে প্রেম তো সবারই তুঙ্গে থাকা উচিত ছিল।’

ঝাড়ু নমিতা বলল, ‘আমি কিন্তু মানি না ঝুমুদি। টান অনেকরকম হয়। সব গাছের শিকড় কি সমান গভীরে যায়? দূরে গেলেই প্রেম ফিকে হয়ে যায়, এটা মানি না। আমার একটা অদ্ভুত কথা মনে হয়। এই ঝিরি, হাসবি না। রাস্তা ঝাড়ু দিই বলে কি আমি ভাবি না?’

ঝিরির হাসি থামছে না। সারা শরীর কাঁপন ছড়িয়ে হেসে যাচ্ছে। বলল, ‘দিদি, নমি কিন্তু তত্ত্ব আওড়ায়। পথের আবর্জনা পরিষ্কার করতে করতে ওর নাকি মনে হয়, ও দেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জগন্নাথের রথের রশিতে ওর হাতের শক্তিটুকুও পড়ছে। হি হি হি!’

ঝুমু বলল, ‘ভাবনাটা ভুল কীসে? ও বলছিল একটা কথা, তুই বাধা দিচ্ছিস, বল তো নমি।’

‘না। ঝিরি শুধু হাসে। আমার কাজটাকে আমি সনমান করব না? তো কাজটা আমি করি কেন?’

‘নমি, তুই ভবিষ্যতে সংগঠনের নেতৃত্বভার নিবি। সম্মানকে সনমান বলিস না।’

‘স্যরি!’

‘কী বলছিলি, তাই বল।’

‘ধরো, যারা ফৌজি বা জাহাজি, দিনের পর দিন ঘরে থাকে না, তাদেরও তো প্রেম থাকে! ধরো, মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছি। কিন্তু কমলকে ভাবছি। ওর সঙ্গে তো কথাই হয় না। আমি গিয়ে ওর দোকানের পাশে মঞ্জুমাসির চায়ের ঘরে বেঞ্চে বসে পা দোলাই আর আজেবাজে বকি। পাত্তাও দেয় না। তবু ওকে ভাবি কেন? কারণ ও আমার মাথার মধ্যে আছে। আমার চিন্তায়। যতদিন ওকে ভাবতে থাকব ততদিন ওকে ছাড়া আমার চলবে না। সে ও আমার সঙ্গে আশনাই করুক আর না করুক। তার মানে কী? একটা মানুষকে তুমি কোথায় রাখছ।’

ঝিরি একটু ভাবল। প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘নমি, দিদির আর কতক্ষণ?’ ‘আরও দশ মিনিট। অনেক চুল না? খুব ভাল চুলের জাত। ঝুমুদি, তোমাকে টপনট খুব মানাবে। আজ করে দেব।’

‘না। একদম না। ওই যেমন বিনুনি করি, তেমনি।’

‘ঝিরি তুই মেহেন্দি লাগাবি তো জামা পালটে আয়। যা আছে তোর হয়ে যাবে।’

‘তুই কি ভাল রে নমি। আমি চাকরি পেলে তোকে কী উপহার দেব বল।’

‘তোর বাজেট কত?’

‘বাবাঃ! তুই বাজেট ভাবিস নাকি?’

‘বাজেট তো আমরাই ভাবব ঝিরি। আগে-ভাগে খরচের পরিকল্পনা না করলে সংসার চলবে কী করে? উড়োনর মতো টাকা থাকলেও বাজেট, না থাকলেও। ভারত সরকার বছর বছর বাজেট করছে। আমাদের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী সংগঠনেরও বাজেট করতে হয়। আমাদের এলাকায় সংগঠনের ব্যয় পরিকল্পনা কমিটিতে আমিও আছি এখন।’

‘তুই তো বশ লকলকিয়ে উঠছিস রে নমি!’

‘উঠব না তো কী। ছাইগাদার মধ্যেও লাউ-কুমড়ো-চিচিঙ্গের লতা ফনফনিয়ে ওঠে, দেখিসনি?’

‘বাবাঃ! তোর সঙ্গে কথায় কে পারবে? মুন্নার মা পর্যন্ত তোকে সমঝে চলে। ওসব সংগঠন-টন করে কী হয় রে নমি? টাকা আসে?’

‘দুনিয়ায় সব কাজই কি টাকার জন্য? স্রেফ কাজের আনন্দও তো আছে।’

‘স্রেফ কাজের জন্য কাজ বলে কিস্যু হয় নাকি আবার? এই দ্যাখ, তুই যা বিউটিশিয়ানের কাজ শিখেছিস, একটা কোর্স নিলে অনায়াসে টু পাইস বাড়তি রোজগার করতে পারবি।’

‘যেদিন আমি কনে সাজিয়ে বা ভুরু তুলে টাকা নিতে শুরু করব, সেদিন থেকেই বিচার শুরু হয়ে যাবে, এক ঝাড়ুদারনির জ্ঞানগম্যি আছে কিনা, আদৌ অধিকার আছে কিনা এসবে, যদি থাকে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে এসেছে তো? বিনে পয়সার সার্ভিসে অনেক দোষ মাপ হয়ে যায়।’

‘তা কেন? ঝাড়ুদারনির গায়ে কি ময়লা লেগে থাকে?’

‘না। ময়লা লোকের চোখে। আমরা তো স্নান করলেই সাফ। আর তুই বলছিলি না, সংগঠন করে কী হয়! গরিবের দুঃখ গরিবই বোঝে। তাই একত্রিত হওয়া। ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য একযোগেই লড়তে হয়।’

ঝুমু বলল, ‘শুধু গরিব কেন? সমাজে সবারই ন্যায্য পাওনা অধিকারের প্রশ্ন আছে। ব্যাঙ্ককর্মী সংগঠন আছে। বাবা কিংবা প্রবীরকাকারও আছে। আবার মেয়েদেরও সংগঠন আছে। একজন মানুষকে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে লড়াই করে নানারকম অধিকার আদায় করতে হয়।’

‘তাই ঝুমুদি?’

‘তাই না? তোকেই দ্যাখ। কমলের সঙ্গে তোর একটা যুদ্ধ চলছে না? ও তোকে চাকরি ছাড়তে বলছে। তোর অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে, তুই প্রতিরোধ করছিস। যাকে পেলে তোর জীবন সুন্দর হয়ে যাবে, সে-ই তোর প্রতিপক্ষ। আবার একজন কর্মী হিসেবে তোর সংগ্রাম আছে। প্রতিদিন আরও কত যুদ্ধ!’

‘ঠিকই বলেছ। শ্বশুরবাড়িতে গেলে আবার কঠিন যুদ্ধ, না?’

‘সবার হয়তো নয়।’

ঝাড়ু নমিতা ঝুমুর মেহেন্দি মাখানো লম্বা চুল গোছা ধরে পেঁচিয়ে মাথার উপর স্তূপ করছে, পুরনো গামছায় বেঁধে দিল।

‘চুপ করে বসে থাকো। দু’ ঘণ্টা।’

‘না না। অত পারব না।’

ঝিরি পোশাক পালটে এসেছে। ঝুমুর মতোই ঢিলে ম্যাক্সি। কাঁধে ফিতে বাঁধা। টানলেই শরীর থেকে খসে পড়ে। বিশুদ্ধ রাতপোশাক। ঝিরি ঝুমুর চেয়ে লম্বা। গায়ের রং ধলোর দিকে। তার বুক কাঁধ দৃশ্যমান।

‘এভাবে বাইরে চলে এলি!’ ঝুমু ধমকে উঠল।

‘বাইরে আবার কী! এদিকে অত দেখা যায় না।’

‘কী করে বুঝলি? যা, গায়ে গামছা দিয়ে আয়।’

‘এটা কী! দেখছিস না? গায়ে গামছা তো দিতেই হবে।’

‘দে তবে। তলায় ব্রা পর্যন্ত পরিসনি। জল চুঁইয়ে সব ফুটে উঠবে না?’

‘ওঃ দিদি! তুই পারিস!’ গায়ে গামছা জড়াল। নমিতা বলল, ‘ঝুমুদি, তুমি চাইলে আর-সব কাজ সেরে নিতে পারো। ঝিরির লাগানো হলে একবার বাড়ি যাব। ফের এসে তোমার চুল ধুয়ে দিয়ে যাব।’

ঝিরি বলল, ‘কোন শাড়ি পরবি? টোপরের দেওয়া লালটা তো?’

‘টোপর তোমাকে শাড়ি দিয়েছে? কেন গো?’

‘কারণ ছাড়া শাড়ি দেওয়া যায় না?’

‘তা কেন যাবে না। টোপর শাড়ি দিয়েছে, তাই বলছি। বিজয়া, পয়লা বৈশাখ, ভাইফোঁটা, ফ্রেন্ডশিপ ডে— কিছুই তো নেই।’

ঝুমু বলল, ‘টোপর চাকরি পেয়েছে, তাই। পলাশ বলেনি বাড়িতে?’

‘পলাশ? একটা কথাও তুমি ওর পেট থেকে বার করতে পারবে না। এমনিই হয়তো কৌতূহলে জানতে চাইলাম, বলে কী জানো? টোপরদা আমাকে বিশ্বাস করে। তোর কিছু জানার থাকলে টোপরদাকে জিজ্ঞেস কর।’

‘এই তো জেনে গেলি। টোপর চাকরি পেয়েছে বলে আমাকে শাড়ি দিয়েছে আর ঝিরিকে ব্যাগ।’

‘কত খেলেছি ওর সঙ্গে, এখন ওকে দেখলে কীরকম ভয় ভয় করে ঝুমুদি।’

গাঢ় লাল শাড়িটা ভাঁজ খুলে বিছানায় ছড়িয়ে দিল ঝিরি। ঝুমুর বুকটা ধ্বক্ করে উঠল। হাতের তালু ঘামছে। কষ্টে ভরে যাচ্ছে মন। কীসের কষ্ট? সে টোপরকে কষ্ট দিচ্ছে, তার ফল ভুগছে। ঝুমুর পক্ষে বরং সোজা ছিল মরে যাওয়া, যদি টোপর বলত, তুমি মরে গেলে আমার ভাল হবে। কিন্তু টোপর ঝুমুর মরণ চায় না। বরং ঝুমুকে সর্বস্ব দিয়ে বাঁচাতে চায়!

অসম্ভব! টোপর উন্মাদ! বদ্ধ পাগল! ও যা চায়— অসম্ভব!

কিন্তু এই শাড়ি পরে সে নিজের প্রদর্শনী করবে? রুপুকাকিমার মতো লাল শাড়ি পরে বিদায়ের আয়োজন করবে ঝুমু? শাড়িটা এত সুন্দর, সবাই যে চায় সে এই শাড়ি পরুক। অন্তরতম সততায় সে অস্বীকার করতে পারছে না, সে নিজেও তাই চায়। তার ভারী বিশ্রী লাগছে এখন।

‘কী সুন্দর শাড়িটা ঝুমুদি!’ চুল বেঁধে দিচ্ছে ঝাড়ু নমিতা আর বলছে। ‘অপূর্ব সুন্দর, না ঝুমুদি?’

‘হুঁ।’

‘গয়না কী পরবি, দিদি? বাবাকে বলেছিলাম, ক’টা গয়না লকার থেকে নিয়ে এসো। এমনভাবে তাকাল যেন আমি বাবার পাঁজরের হাড় চাইছি। বলে, ‘তোর মায়ের জিনিস তোদেরই বিয়েতে দেব ভাগাভাগি করে। একটা হারালেই অপূরণীয় ক্ষতি। সোনার কী দাম জানিস? চারগাছা চুড়ি করতে লাখ টাকা খরচা।’’

‘গয়না লাগবে না ঝিরি।’

‘ঝট্‌সে সিটি গোল্ড কিনে আনবি নমি? এই শাড়ির সঙ্গে একটু গয়না না হলে বিচ্ছিরি লাগবে।’

‘শাড়িটা তুলে রাখ।’

‘পরবি না?’

‘এবার প্রবীরকাকা দিয়েছিল যে শাড়িটা, পুজোয়, ওইটা দে।’

‘গোলাপি মটকা? গোলাপি তোকে মানায় না দিদি, আরও কালো লাগে।’

নমিতা বলল, ‘এটাতে ফাটাফাটি লাগবে তোমাকে ঝুমুদি। ছেলের বাড়ি একবারে পছন্দ করে যাবে।’

‘আমিও ঠিক একথাই বলেছিলাম।’

‘তা হলে তো ওদের শাড়ির দোকানে পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল। ম্যানিকিন কিনে আনবে। বউ করবে।’

‘তার মানে?’

‘শাড়িটাই ওদের পছন্দ হবে। তার তলায় আমার চলনসই চেহারাটা নজরে পড়বে না। পরে যখন বুঝবে, আফশোসের শেষ থাকবে না। ওরকম একটা লালশাড়ি পরাটা কি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে না? যেন কনে সেজেই হাজির হচ্ছি! না না। গোলাপিটাই দে, নয়তো বাবা যে ছানার জল টাঙাইল দিল গতবার, ওইটা দে ঝিরি। ম্যাচিং ব্লাউজ়টা বেশ ফিটিংস হয়। ঝুটো মুক্তোর গয়না পরলেও মানিয়ে যাবে।’

‘তুই যা ভাল বুঝিস।’

‘কপালে থাকলে হবে, নইলে কপাল কুটলেও হবে না। অত ভেবে কী হবে?’

‘ঝুমুদি।’

‘উঁ।’

‘ওরা এসে পড়েছে।’

‘বেশ তো, চা বসা। মিষ্টির প্লেট সাজাতে পারবি তো?’

‘গোপালীমাসি করছে ওসব। আমাকে তোমার কাছে পাঠাল।’

‘বোস।’

‘মুখটা প্যাঁচা করে আছ কেন গো? একটু হাসি-হাসি হও না। লাল শাড়িটাও পরলে না।’

‘কোন আনন্দে লাল শাড়ি পরে হাসি-হাসি মুখে বসে থাকব?’

‘তা থাকবে না? বিয়ের দেখা বলে কথা। ছেলের বাবা কাকা কেউ আসেনি গো। শুধু মা, বোন আর মামা বলল।’

‘প্রথমবারের পক্ষে এই কি যথেষ্ট নয়?’

‘ছেলেও আসেনি।’

‘ছেলের বাবা শুনলাম অসুস্থ। একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। আর ছেলে বলেছেন মায়ের পছন্দই তাঁর পছন্দ!’

‘আসবে না? দেখবে না তোমাকে?’

‘আমি কী করে বলব।’

‘সে কী গো ঝুমুদি! আজকাল এমন রামচন্দ্র কেউ হয়? মা যাকে গলায় লটকে দেবে তাকেই? ডাল মে কুছ কালা নেই তো? সারা জীবনের ব্যাপার।’

‘কেন রে? এতে সন্দেহ করার কী আছে! আমায় ধরে যার গলায় লটকানো হচ্ছে, আমি তো বাপু তাকেই মেনে নিয়ে বসে আছি! বার বার দেখা দিচ্ছি, হেঁটে বোঝাচ্ছি হাঁটতে পারি, হেসে বোঝাচ্ছি গোমড়া নই, কথা বলে বোঝাচ্ছি বোবা নই, কিন্তু ছেলে দেখতে তো যাচ্ছি না। এই ভাল। এইটুকু দেখে কী আর বোঝা যায়। সবটাই তো জুয়ার মতো।’

‘আহা! ছেলেকে দেখে তো তার চেহারাটা বুঝতে! শেষে শুভদৃষ্টিতে পানপাতা সরিয়ে দেখলে বর ট্যারা চোখে চেয়ে আছে। তখন?’

‘ট্যারার কপালেই ঢ্যারা দেব। গলায় মালা। তারই দু’হাত ধরে বলব— তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি-ই প্রিয়, এ কি মোর অপরাধ!’

‘যাঃ! হি হি হি! তুমি না পারো! বিয়েটা যেন তোমার হচ্ছে না, তুমি প্রক্সি দিচ্ছ। দেখো, এরা যদি তোমায় পছন্দ করে, ছেলে ঠিক তোমার সঙ্গে বাইরে দেখা করবে।’

‘কেন?’

‘আজকাল সবাই তাই করে। প্রথমে বাড়ির লোক সম্বন্ধ ঠিক করে, তারপর ছেলে-মেয়ে চুটিয়ে প্রেম করে। কারও কিছু বলারও থাকে না।’

‘আমার বুকে যে অত মধু নেই রে! শোন নমি, ছেলে ভাল রোজগার করে বাবা খোঁজ নিয়েছে। ছেলে, ছেলের বাড়ির লোক— সবাইকে বড়পিসি চেনে। আমার আর দেখে কাজ কী। ওতে প্রেম হয় না। ছোলা ভিজিয়ে রাখলে যেমন অঙ্কুর হয়, প্রেম হল সেইরকম। ভিতরে থাকে, তারপর কোনও একসময় প্রকাশ পায়। তোর যেমন পেয়েছে।’

‘আমার কথা বাদ দাও।’

‘কেন?’

‘এক হাতে কি তালি বাজে? সে তো আমাকে চায় না।’

‘তালি না বাজলেও প্রেম মিথ্যে হয়ে যায় না রে। তোর অনুভূতি তো মিথ্যে নয়। কমল তোকে বুঝলে তোর কষ্ট কমত ঠিকই, প্রেম তো প্রেমের জায়গাতেই থাকত।’

‘না গো ঝুমুদি। প্রেম বোধহয় একটু বল্লী টাইপ। আঁকড়ে ধরতে চায়। স্বীকৃতি চায়। নইলে কী হয় জানো?’

‘কী?’

‘লতা নজর করেছ কখনও? আমাদের চানঘরের পাশে একটু মাটি, পলাশ ওখানে একটা জুঁইলতা লাগিয়েছিল। দড়ি দিয়ে পাইখানা ঘরের অ্যাসবেস্টাসে তুলে দিয়েছে। গাছ তো অনেক ডাল ছাড়ছে। মা ওর গোড়ায় মাছ-ধোয়া মাংস-ধোয়া জল দেয়। যত বল্লী উঠছে সব তো দড়ির নাগাল পাচ্ছে না। যে পায়, বেয়ে ওঠে, যে পায় না, ক’দিন শূন্যে সবুজ পাতাগুলো দোলায়, তারপর ডগা শুকোতে থাকে, ডগার পর গলা বুক পেট করতে করতে পুরো বল্লিকাই একটা কাঠি। একটা পাতা নেই। ঝরে গেছে। কালো। শুকনো। কাঠি।’

‘চুপ কর।’

‘কেন?’

‘বকবকানি ভাল লাগছে না।’

‘ভয় করছে?’

‘ওঃ! তোর যেন মুখের পাতা পড়ে না নমি।’

‘ওই তোমার সঙ্গেই তো একটু কথা বলি।’

‘চুপ কর। বিশ্বসুদ্ধু তোর বন্ধু।’

‘না গো। সব কথা কি সবাইকে বলা যায়? নাকি বলা উচিত?’

‘হুঁ।’

‘ঝুমুদি।’

‘উঁ।’

‘তোমার প্রেম হয়নি?’

‘জানি না রে।’

‘সে কি!’

‘সত্যি! এর উত্তর জানা আমার কাছেও খুব জরুরি।’

‘এই আমার ভাইঝি, কল্যাণীদি। বড়টা। ছোটটাকে তো দেখেছ। সারাক্ষণ চোখেমুখে কথা। এ কিন্তু একদম উলটো। বড্ড চাপা আর শান্ত। আমাদের সবার মা হয়ে বসে আছে।’

‘এসো। বসো আমার পাশে। বোনের নাম ঝিরি। তোমার নাম কী?’

‘ঝুমু। ঝুমুর।’

‘বাঃ! বেশ নাম! আর ঝিরির ভাল নাম?’

‘ঝরোকা।’

‘বাঃ! কে নাম রেখেছে?’

বড়পিসি বললেন, ‘ওদের মা। বই পড়ার নেশা ছিল খুব। ঝুমুও পেয়েছে মায়ের গুণ। ওই পাশের বাড়িতে ওদের এক ভাই আছে, তার নামও ওর মায়ের দেওয়া। টোপর, আর ভাল নাম কী যেন রে ঝুমু?’

‘শতরূপ।’ ঝুমু বলল।

‘বাঃ! সে কোথায়? কি, কাজিন ভাই?’

বড়পিসি বললেন, ‘না না। আপন ভাইয়ের মতোই। রক্ত সম্পর্ক নেই। আসলে ছেলেটা জন্মখোঁড়া। পঙ্গু। তাই এদের খুব টান। ঝুমুর বাবা জ্যোতি আর টোপরের বাবা প্রবীর কলেজকালের বন্ধু। একজনেরও বউ নেই। তার ওপর ওই পঙ্গু ছেলে।’

‘আহা!’

ঝুমু স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। কল্যাণী যেভাবে বাঃ বাঃ করছিলেন সব কথায়, টোপর প্রসঙ্গেও সে আশঙ্কা হচ্ছিল তার। সে ঠোঁট কামড়াল। ভ্রূ কুঁচকে আছে। পঙ্গু শব্দটা সে সহ্য করতে পারে না। সে বলে ফেলল, ‘টোপর ঠিক পঙ্গু নয় কিন্তু। ও নিজের সবকিছু পারে। গাড়ি চালায়। কারও ওপর নির্ভর করে না।’

‘বাঃ! তা হলে তো খুব ভাল!’ কল্যাণী তাঁর দাদা সুনন্দ এবং মেয়ে শাশ্বতীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। শাশ্বতী হাসল। সে বিবাহিতা। রোগা, লম্বা, ঝিরির মতো রং। মুখখানা ভারী সুন্দর, অনেকটা ঝুমু-র স্কুলের সরস্বতী প্রতিমার মতো। প্রতি বছর এক মুখ। এতটুকু এদিক-ওদিক নেই, শাশ্বতী হাসলে টোল পড়ে। ঠোঁট দুটি একটু ফোলা। চোখ টানে। খুব বেমানানভাবে তার চোখের তলায় গাঢ় কালি। অনেকদিন অসুখে ভুগে উঠলে যেমন হয়। শাশ্বতী ঝুমুকে নিজের পাশে ডেকে নিল।

‘দাদার ছবি দেখবে? মোবাইলে তুলে এনেছি।’

ঝুমু হাসল। তার কোনও আগ্রহ নেই। ‘দেখতে চাই না’ বললে শাশ্বতী আহত হতে পারে ভেবে চুপ করে রইল। তার সামনে এখন সেলফোনের ইঞ্চিখানেক বর্গাকার বা সামান্য আয়তাকার আলোকোজ্জ্বল পর্দা, তাতে এক যুবক। মাথায় অল্প চুল, মোটা গোঁফ। বেশ ফর্সা লাগছে। কল্যাণী ও সুনন্দকে ফর্সাই বলা যায়। যুবক গম্ভীর। চোখমুখ অনেকটা শাশ্বতীর মতো।

কল্যাণী বললেন, ‘আমি তোমার এই ভাইঝিকে কোথাও দেখেছি জয়ী।’

‘দেখেছই তো। আমার সঙ্গে তো যায়। গুরুমা এলে ও-ই তো যায় সঙ্গে। খুব ভক্তিমতী। তোমার খুব সুবিধে হবে।’

বড়পিসি ঝুমুর গুণপনা নিয়ে পড়লেন। এই যে ছাগলটা দেখছেন, এর জাত খুব ভাল। গোরুও ভাবতে পারেন একে। আর এই গোরুটা, হ্যাঁ, ঝুমু, দেখুন, এর দাঁত দেখে নিন সবার আগে, আরে দাঁতই হল গোরুর যৌবনের প্রমাণ। স্বাস্থ্য দেখেছেন? দুধ যা দেবে! ওলান দেখুন, যেমন আঁট তেমনি বাঁট! গা দেখুন গা দেখুন, যেন মসৃণ রেশম, হাঁ, যত্ন করি বটে আমরা, মরশুমের শাকপাতা খাওয়াই, বাজারের সেরা খড়বিচুলি, জাবনা, খায় না বেশি, বরং প্রচুর গোবর দেয়, দুধও তেমনি দেবে, বালতি কিনতে হবে নতুন নতুন। হেঃ হেঃ! যখন বিনা বাক্যে আদেশ মান্য করতে হবে— এ ছাগী হয়ে যাবে। একেবারে নধর বেঙ্গল ব্ল্যাক। আবার গাধাও আপনি একে বানাতে পারেন। যতই ভার চাপান, মেরুদণ্ড রামধনু হয়ে যাবে, তবু মুখ ফুটে বলবে না— আর পারি না, পারি না! তবে হ্যাঁ খবরদার! পায়ে একটা শিকলি দিয়ে রাখবেন। বিশ্বাস? না না। না-বিয়োন পর্যন্ত বিশ্বাস নেই। ছাগলি হোক, গাভী হোক, গোরু হোক— কাউকে পুরোপুরি বিশ্বেস করা যাবে না, বিয়োলেও না, কারণ? মার চকাচক লাগ্ ধকাধক্— জগতে সব মেয়েমানুষের পাখি হওয়ার বাসনা প্রবল। আমি মেয়েছেলে হয়ে দিব্যি গেলে বলছি— পঞ্ছি ছাড়া পেলে আকাশে উড়বেই।

ঝুমু ভেবেছিল, টোপর অন্ধকার ঘরে চুপ করে বসে থাকবে। গিয়ে দেখে সে বসে আছে কম্পিউটার নিয়ে। ভারী ক্লান্ত লাগছিল ঝুমু-র। আজ তাকে দেখতে আসবে বলে গোপালীমাসি সব সামাল দিয়েছেন, সকাল থেকে ঝুমু-র ত্বক, নখ, চুলের ঘষামাজা চলেছে। তাতে তার আরাম হয়েছে। মেহেদি আগে লাগায়নি সে কখনও। তাল তাল গোবর মাখার মতো মেহেদি ধুয়ে শ্যাম্পু করার পর নিজের সম্ভার থেকে শুষ্ককরণ যন্ত্র এনে গরম হাওয়ায় ঝুমুর চুল শুকিয়ে দিয়েছিল ঝাড়ু নমিতা। ‘যা গোছ তোমার চুলে, শুকোতে বিকেল হবে ড্রায়ার না দিলে। দেখো এবার চুলের রং।’

দেখল ঝুমু। তার কালো চুল এখন ঠিক অন্ধকারের আগেকার আকাশের মতো। কালোর ওপর গাঢ় লালের পোচ। যেন অলক্ষ্যে কোনও গোপন আলোকসজ্জা কারিগর গাঢ় সন্ধ্যা রঙের আলো ফেলছে তার মাথায়। ‘কী সুন্দর লাগছে। আমিও করি। চোখে পড়ে না। তোমার এত চুল। খুলে দাও। কী সুন্দর গন্ধ।’

‘না। চুল খুলে যাব না।’

‘মেহেদি করলে কালোদেরও ফর্সা লাগে।’

‘আমাকে লাগছে না তো। সেই কালো সাধারণ মেয়েটাই তো আয়নায়।’

ছেলের বোন শাশ্বতী বলল, ‘চুলটা খোলো না। একটা ছবি নিই। দাদাকে দেখাব।’

ঝুমু হেসেছিল। চুল খোলার কোনও উদ্যোগ নেয়নি। শাশ্বতী জোর করেনি। এমনিই ছবি নিল। ঝিরি বলে উঠল, ‘যার দেখার গরজ নেই তাকে জোর করে দেখাবেন!’

শাশ্বতী হাসল। বলল, ‘না বলা ওর স্বভাব। বিয়ে তো করবে না বলেছিল, এখন রাজি। ওর একটা কুকুর আছে। তার নাম বাঁটুল। বিশাল চেহারা যদিও। তাকে কুকুর বললে দাদা খুব রেগে যায়। সারাক্ষণ বাঁটুলের সঙ্গে ওর যুদ্ধ চলে। বাঁটুল নো। বাঁটুল না। বাঁটুল ডোন্ট! আই’ল কিল ইউ বাঁটুল! ডোন্ট মেক নয়েজ লাইক স্ট্রিট ডগস্! …আমাদের বাড়িতে আমরা সব অস্তিত্বহীন, শুধু দাদাকে আর বাঁটুলকে খুঁজে পাওয়া যায়।’

আজ অপরাহ্নবেলার সন্ধ্যাগামী দুটি ঘণ্টা ছেঁড়া-ছেঁড়া ভাবে ঝুমুর মনে আসছে। এঁরা কি পছন্দ করলেন তাকে? শীঘ্রই জানাবেন বড়পিসি। সে কি খুব উদ্বেগাকুল? পরীক্ষা যাই হোক, রক্তে কতখানি হিমোগ্লোবিন আছে, তারও ফলাফল জানার জন্য মন উচাটন থাকে। সে চুপচাপ টোপরের বিছানায় পা ছড়িয়ে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল।

‘ক্লান্ত?’ কম্পিউটার থেকে চোখ না সরিয়ে জিজ্ঞেস করল টোপর।

‘উঁ।’

আজ সকাল থেকে সে টোপরের কাছে আসেনি। ইচ্ছে করেই। দূরত্ব রচনা করা দরকার। সে ভেবেছে। পেরেছে কি? সারাক্ষণ টোপরকেই ভেবে গেছে।

‘কী ভাবছ?’

‘তোর জরুরি কাজ?’

‘না। তেমন কিছু না। পরে করলেও চলে।’

‘ওদের বাড়িতে কুকুর আছে।’

‘হুঁ।’

‘কুকুরকে ছেলেটা মানুষ ভাবে।’

‘তফাত কী?’

টোপর মুখ ফেরাচ্ছে না। কেন? রাগ করেছে? কেন? সকাল থেকে একবারও আসেনি ঝুমু, তাই?

‘কী মেখেছ? সোঁদা মাটির গন্ধ!’

‘অত দূর থেকে গন্ধ পাচ্ছিস?’

‘কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষরাও পেতে পারে।’

‘মেহেদি। চুলে।’

‘তোমার তো দাড়ি নেই। আর কোথায় দেবে!’

‘অসভ্য!’

‘কী অসভ্যতা করলাম রে বাবা!’

স্বাভাবিক হচ্ছে টোপর। আস্তে আস্তে। ঝুমুর ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত। এ ক্লান্তি কীসের তবে? ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাবার। কোন ইচ্ছে? কোন কোন ইচ্ছে?

‘আমি ক্লান্ত বুঝলি কী করে? ক্লান্তির তো গন্ধ নেই।’

টোপর কোল জোড়া কম্পিউটার টেবিলে রাখল। গড়গড়ি চালিয়ে ঝুমু-র দিকে আসছে। তালবেতাল দেওয়াল দণ্ডায়মান। ব্যবহৃত হতে চায়। বস্তু। সে কেবল ব্যবহৃত হতে চায়। ব্যক্তি। ইচ্ছানুসারে ব্যবহৃত হতে চায়। দুটির পার্থক্য ইচ্ছা নেই, ইচ্ছা আছে। ইচ্ছা। ঝুমু ইচ্ছার ভাসান দেয় আসমুদ্র জুড়ে। কারণ অকারণ বোঝে না। বোঝে না কি? উপলব্ধি ঘিরে আছে ঘা, পুঁজ, রক্ত, থুতু, কফ। ঝুমুর ঝুমুর বিপক্ষে সদাই সরব। হরবোলা পাখি যা শোনে তাই বলে। কেউ কেউ হরকরা। ডাক-হরকরা নয়। যা দেখে তাই করে। হর করা! প্রচলিত শব্দস্রোতে ভেসে যায়। ডুবে যায় নিষেধের পাঁকে। বাঁচার রাস্তা জানে পাঁকাল মাছেরা। মৎসগন্ধারা মরে প্রতিদিন রাতে। সুস্বাদু, নরম, আমরণ খলখল শব্দ করে বাঁচে, হুল দেয় জগতের প্রেমহীন হাতে।

‘ক্লান্তির গন্ধ বাসিপদ্মের মতো।’

‘বাসি পদ্ম?’

‘দেখো। এনে দেখো। বহুদিন থাকে। গন্ধও। একটু সোঁদা, মৃদু অথচ মধুর।’

‘কিন্তু এখন আমার ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে।’

‘গন্ধও সতেজ। তবে চুলের নতুন গন্ধে তোমাকে নতুন করে চেনা প্রয়োজন।’

‘আমার অপরাধবোধ হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘আমি কি তোকে প্ররোচিত করলাম?’

‘প্ররোচনা দিয়ে যুদ্ধ হয়। ভালবাসা নয়। কামার্ত করা যায়। আদিগন্ত পিপাসার্ত নয়।’

পা দু’টি ভাঁজ করল ঝুমু।

‘আয়। কোলে আয়।’

‘না।’

‘কেন? রাগ যায়নি?’

‘রাগ নেই ঝুমু। তুমি কেন বুঝবে না আমায়!’

‘বুঝি তো।’

‘আজ নয়। আজ তুমি ধ্বস্ত। বুঝবে না। আমি যতদিন নিজেকে প্রকাশ করিনি, সংযম ছিল। তুমি আমার কপালে চুম্বন করেছ, আমি তোমার ঠোঁট চাইনি। তুমি আমার গালে আঙুল রেখেছ, আমি সে আঙুল নিইনি জিহ্বায়, তুমি কোল পেতে নিয়েছ আমাকে, আমি তোমার অতলের গন্ধ সত্ত্বেও জাগাইনি ঘুমন্ত পাহাড়, তোমার ওই দুই আশ্চর্য মসৃণ গোলক— কতবার ছুঁয়ে গেছে, আমি তাকে দুই হাতে ধারণ করিনি। নিজেকে নিষেধ দিয়ে, কড়া প্রহরায় আমি অপ্রলোভন সংযত ছিলাম। আজ মনপাখি খাঁচা খুলে শেকল ছাড়িয়ে তার আকাশে উড়েছে। আর যদি না শোনে কথা? আর যদি শাসন না মানে? ঝুমু, সেই কোল দিও, যেখানে নিষেধ নেই, ভুল-করা জোর-করা অপমান সংস্কার বয়স ভাইফোঁটা নেই। যাব। তোমার কোলেই আমি আমরণ শুয়ে থাকতে চাই।’

দু’ হাঁটু মুড়ে, মুখ রেখে, নিঃশব্দে কাঁদছে ঝুমু, কেন হল? কেন এরকম হল? কেন সে টোপরের কষ্টের নিমিত্ত হল? এ কী জটিলতা, ভগবান!

কথা নেই। বসে আছে চুপচাপ। শুধু বসে আছে। কাঁদছেও না। গান নেই। টিভি স্তব্ধ। কোনও সিনেমাও চলছে না। টিকটিক ঘড়িগুলি প্রবাহিত সময়ের সাক্ষ্য দেয়। বাকি সব অনড় অচল।

ঝুমুর বেদনা, সম্পর্ক স্বাভাবিক রইল না আর। সুন্দর বোঝাপড়া, বিশ্বাস, প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তাদের।

টোপরের যন্ত্রণা সত্যদীপ্ত। সে চায় সম্পর্ক নিবিড় হোক। ব্যাপ্ত বিশাল হোক। সব তাতে ধরে যাক। সে চায়, ঝুমুর সর্বার্থসাধিকা হোক তার। মন যা চায়, তাকে ছাইচাপা দিয়ে মারা স্বাভাবিক নয়। টোপর অন্যায় কোনও কিছু চায়নি। কেন সে লালন করবে না তার প্রভাময়ী ইচ্ছা? তার হারাবার কিছু নেই। ঝুমু ছেড়ে যাবে। যেতে চায়। সে তবু হারাবে না। রেখে দেবে অসংখ্য ঝুমুর তার বুকের তলায়।

দরজার ঘন্টি বাজল। টোপরের জন্য এ বাড়িতে দরজার মাথার দিকে ছিটকিনি নেই। দ্বার খুলে দিল ঝুমু। পাকশালে গেল। প্রবীর এসেছেন।

‘চা খাবে তো কাকা?’

‘হ্যাঁ। খাবার আছে কিছু?’

‘ও বাড়িতে যাবে তো, ওখানে তোমার খাবার রাখা আছে।’

‘ও! তোর পরীক্ষা ছিল না আজ? বাঃ! এই সমুদ্ররঙে তোকে জলদেবীর মতো লাগছে রে মা! বেশ বেশ! তাঁরা কি এসেছিলেন?’

‘হ্যাঁ। টোপর, চা খাবি?’

‘বানাও। সবুজ কৃষ্ণপত্র।’

‘কৃষ্ণপত্র সবুজ কী করে হল? ওহো! গ্রিন টি!’

‘টি-এর শুদ্ধ বাংলা কৃষ্ণপত্র।’

রান্নাঘর থেকে ঝুমু-র স্বর ভেসে এল।

‘এত বাসন পড়ে আছে! আজ সরসী আসেনি?’

‘না।’

‘ও আর পারছে না। লোক দেখতে হবে।’

‘তুমি বাসন মাজতে বোসো না। কাল সকালে আসবে।’

‘ক’টা মেজে রাখলে কাল সুবিধা হত না?’

প্রবীর বললেন, ‘থাক, থাক। আজ অনেক গেল তোর ওপর দিয়ে। এসবে মনের ভিতর চাপ পড়ে। কেন আসছে? না দেখতে! অদ্ভুত নিয়ম! তা, ঝুমু মা, তোর কেমন লাগল তাঁদের? কেমন বুঝলি?’

‘কিছুই কি বোঝা যায় প্রবীরকা? তবে তারা কুকুরপ্রেমিক। কুকুরকে কুকুর বললে রেগে যায়।’

‘কী বলে? শ্বা? নিজের পদবি কুকুরের লেজে দেয় না তো?’

‘কুকুরের নাম বাঁটুল। সে প্রায় শামলা শাঁটুল, জানো! পাত্রের বোন বলল বাড়িতে বাঁটুল আর বাঁটুলের মনিব, তার দাদাই সব।’

‘তাই নাকি? তা পাত্র এল না কেন? এই সময়ের ছেলে এসব দেখাদেখির নিয়ম পছন্দ করে কী করে?’

টোপর বলল, ‘নিয়ম নয়। রীতি।’

‘একই ব্যাপার।’

‘না। এক নয়। নিয়মের মধ্যে কঠোরতা বেশি। বাধ্যতামূলক। রীতি অনেক নমনীয়।’

‘রীতি থেকেও নিয়ম হয়ে যায়।’

‘তা হতে পারে। তোমার প্রতিযোগিতা কেমন হল?’

‘দারুণ! বাচ্চারা খুব ভাল খেলছে। আজকাল সব কম্পিউটারের সঙ্গে দাবা খেলে। এরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী।’

‘সেটাই স্বাভাবিক। ছোট থেকে টিভি, কম্পিউটার, সেলফোন ঘাঁটছে।’

‘নব্য প্রযুক্তি নতুন প্রজন্মকে অনেক এগিয়ে নিচ্ছে।’

‘পিছিয়েও দিচ্ছে বাবা।’

‘বাচ্চাদের খেলা দেখে মনে হল না।’

‘ক’টা বাচ্চা দাবায় আগ্রহী? বেশিরভাগ চায় উত্তেজক খেলা। চ্যালেঞ্জ। কাউকে পরাস্ত করবে অথবা স্কোর করবে। অলীক জগতের জয়-পরাজয়, প্রতিযোগীর মনোভাব, নম্বর বাড়াবার নেশা তাদের অহং তৃপ্ত করে। সেই অলীক তৃপ্তি বাস্তবতাবোধ থেকে বিরত রাখে তাদের। খেলতে খেলতে একজন দক্ষ হয়, মাউস চালাবার বা আঙুল স্পর্শ করার ক্ষিপ্রতা অর্জন করে, চিন্তার নয়, হাতের, চোখ নাচানোর।’

‘ওতে বুদ্ধি লাগে না বলছিস?’

‘বুদ্ধির খেলা আছে, তাতে আগ্রহ কম।’

‘খেলা ছাড়াও ছোটরা অন্য জায়গায় চিন্তা ও বুদ্ধি প্রয়োগ করছে।’

‘ন্যূনতম। একটা প্যাটার্ন তাড়িয়ে নিচ্ছে এই প্রজন্মকে। একটা চাবি টিপলেই সব পেয়েছির আসর। সৃষ্টির মজা কুক্ষীগত করছে জনা কয় ব্যক্তি, আবিষ্কারের মজা-বাকি কোটি কোটি মানুষ যান্ত্রিকভাবে যন্ত্রের শরণ নিচ্ছে।’

‘আবিষ্কারের আনন্দ চিরকালই অল্প ক’জন পায়। তাই মানুষের মধ্যে সাধারণ আর অসাধারণের তফাত।’

‘না বাবা। বড় বড় আবিষ্কার ছাড়াও মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত ছোট্ট ছোট্ট আবিষ্কারের মজা থাকে। ধরো, আমি যখন স্টিয়ারিং হুইল ধরে ভার্চুয়াল গাড়ি চালাতাম, আমার আনন্দ-উত্তেজনা একরকম ছিল। কিন্তু সত্যিকারের স্টিয়ারিং ধরে যেদিন রাস্তায় বেরোলাম, ওঃ, সে যে কী অনুভূতি! প্রতি মুহূর্ত, প্রতি বাঁক, প্রত্যেকটি গর্ত, প্রতিটি ঋতুর আলাদা রূপ-রস গাড়ির ভিতর থেকে দেখতে দেখতে, আমার অসাড় পা দিয়ে যন্ত্রগুলোকে কব্জা করতে করতে প্রতি ক্ষণে আমি জীবন আবিষ্কার করেছি। সেটা ওই অলীক গাড়ি চালানোয় ছিল না।’

‘চা হয়ে গেছে।’ ঝুমু কাঠের থালিতে চায়ের পাত্র, পেয়ালা, বিস্কিট সাজিয়ে এনেছে। প্রবীর ব্যবহৃত মোজা ময়লা কাপড়ের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে এলেন। কাজুবাদামের আদলে গড়া মুচমুচে বিস্কিট মুঠো ভরে মুখে পুরছে টোপর। প্রবীর বললেন, ‘একটু নিমকি ভাজিস তো মা মুড়মুড়ে করে। আর তো ক’দিন। তুই শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে ক’দিন খুব কষ্ট পাব।’

ঝুমু মুখ নিচু করে আছে। টোপর বুড়ো আঙুলের চাপে একটা কাজু বিস্কিট গুঁড়ো করে ফেলল। প্রবীর বলছেন, ‘সবচেয়ে কষ্ট পাবে টোপর। তুই ওকে যেভাবে আগলে রাখতিস, একেবারে মায়ের মতো। তোর নাম হওয়া দরকার মহামায়া। সবার মা হয়ে আছিস। কখনও অন্নপূর্ণা, কখনও কল্যাণেশ্বরী! টোপরকে যেভাবে যত্ন করিস, কোনওদিন মনে হয়নি ও প্রায় তোরই বয়সি।’

‘চার বছরের বড়।’ টোপর বলল।

‘সে আর এমন কী! হ্যাঁ রে ঝুমু, টোপরের দেওয়া শাড়িটা তোর পছন্দ হয়েছে? ভাবি জিজ্ঞেস করব, ভুলে যাই।’

‘হ্যাঁ। সুন্দর শাড়ি। অনেক দাম।’

‘দাম তো কী আছে! টোপরের একটা ইচ্ছে হয়েছে। কেমন পছন্দ করেছে বল। টোপরটাও বড় হয়ে গেল। চাকরি করছে, দিদির জন্য শাড়ি কিনেছে।’

‘তোমার একটা এডিনিয়ামের গুঁড়িতে পচ ধরেছে প্রবীরকা।’

‘সে কী! কোনটা বল তো! কাজের চাপে ক’দিন যেতে পারিনি! আজও সকাল সকাল খেলা দেখতে চলে গেলাম। হারান প্রায় দু’হপ্তা আসেনি।’

‘হারান আসছে না বলে আমি জল দিচ্ছি। বেশি দিয়ে ফেললাম বোধহয়।’

‘এমনিতে বেশি দিলে কিছু হয় না। টবে জল দাঁড়াচ্ছে কোনও কারণে। কোনটা হয়েছে?’

‘ছোট গাছ। মাস দুয়েক আগে একটা আনলে।’

‘এখনও ফুল ধরেনি। নার্সারিতে বলল হলুদ ফুল হবে।’

নীচে কানাই সামন্ত সরু গলিতে শোরগোল। কেউই কান দিল না। ঝগড়া, মাতালের বকাবকি, এর দরজায় লাথি, তার বউয়ের শাপশাপান্ত, মারামারি কখনও বিরক্তিকরও বটে। বিশেষত যদি কেউ থাকে ক্লান্ত, বিষাদে ছাওয়া। ক্লান্তি ও বিষাদ অপনোদনের জন্য এ বাড়িতে চা ছাড়া অন্য কিছু নেই।

‘আ আঃ! চা পেয়ে বড় আরাম হল! যাই, তোদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। শ্বশুরবাড়িতে গেলে রোজ সন্ধ্যা করে এখানে চলে আসবি তো মা। বলবি, বুড়ো কাকা আমার হাতে চা না খেলে ভাল থাকে না।’

টোপর অসহিষ্ণু স্বরে বলল, ‘আজকাল বেশি কথা বলো বাবা।’

‘বয়সের ধর্মই হল এমন। বাল্যে কৌতূহল ও কল্পনা, তারুণ্যে চপলতা ও বন্ধুবাত্সল্য, যৌবনে বিষাদ ও গাম্ভীর্য, বার্ধক্যে বাচালতা ও অহং ক্ষয়।’

‘তুমি কি জ্যোতিকাকার সঙ্গে দাবায় বসবে?’

‘না। আজ বসব না। সারাদিন তো দাবার মধ্যেই গেল। যাই একবার দেখে আসি।’

‘বেশ! কেউ তোমারে আইজ দাবায় রাখতে পারবো না।’

‘হা হা! ভাল পান দিলি তো!’

‘ঠিক আছে ঘুরে এসো।’

‘আচ্ছা। ঝুমু যাবি?’

ঝুমু টোপরের দিকে চাইল। অন্য দিন টোপর স্পষ্ট বলে, ‘না, ঝুমুদি এখন যাবে না।’ আজ সে চুপ। দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুমু-র থাকতে ইচ্ছে করছে। টোপর কিছু বলছে না, সে বিড়ম্বনা বোধ করল, অন্যের ইচ্ছের সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত সে নড়তেও ভুলে গেছে। বলল, ‘তুমি যাও, আমি একটু পরেই আসছি।’

টোপর তাকাল। দুই চোখে অভিমান পূর্ণ হয়ে আছে। ঝুমু-র ইচ্ছে করল, ওই মুখ বুকে চেপে ধরে। আর তা সম্ভব নয়।

প্রবীরের সিঁড়ি ভাঙার শব্দ আসছে। দরজা বন্ধ করে ঝুমু টোপরের মুখোমুখি দাঁড়াল। ‘তুই কি আমাকে থাকতেও বলবি না?’

‘কোন অধিকারে বলব?’

‘যে অধিকারে গতকাল পর্যন্ত বকবক করেছিস।’

‘ভেবে দেখলাম, জোর করার অর্থ নেই। এটা আমাকে আয়ত্ত করতে হবে। এতদিন অনায়াসে জোর করেছি। এখন আমার জোর তোমার বিপন্নতা হয়ে উঠবে। তোমার যেমনটা ভাল লাগে, তাই কোরো। তোমার ইচ্ছা আমার শিরোধার্য ঝুমু।’

‘টোপর আমার ভাল লাগছে না।’

‘আমারও খুব বিশ্রী লাগছে। তো? জীবনে যে সব কিছু মনের মতো হয় না, আমি জানি।’

ঝুমু টোপরের পায়ের কাছে বসল।

‘তুই যেমন চাস, আমি পারব না টোপর। কেউ মানবে না।’

‘তুমি তোমার কথা বলো।’

‘অসম্ভব! তুই নিরর্থক আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করছিস। আমার মাথায় সারাক্ষণ তোর কথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে তোকে কষ্ট দিচ্ছি। অপরাধ করছি। মনে হচ্ছে তুই অন্যায় আবদার করছিস। কখনও রাগ হচ্ছে, কখনও ভীষণ দুঃখ হচ্ছে। টোপর, আমি যে তোর দাবি মেটাতে অভ্যস্ত। এই দোটানায় আমার মধ্যে তোর কাছে আসার আগ্রহ কমে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। লাল শাড়িটা পর্যন্ত ওদের সামনে পরতে পারলাম না।’

‘সম্পর্ক নষ্ট হতে শুরু করেছে? ঝুমু, আমি আমার ভেতরের সত্য প্রকাশ করেছি। জোর করিনি। আবদার করিনি। নাটুকে আবেগ দেখিয়ে তোমার ওপর বোঝাও চাপিয়ে দিচ্ছি না। তা হলে নষ্ট হল কীসে?’

‘টোপর, আমরা তো ভাল ছিলাম রে। তুই কি আমাকে ঝুমুদি বলে ডাকবি না? নাম ধরছিস, কী বলবে সবাই? অন্যদের সামনে অন্তত দিদি বল।’

‘আমি সতর্ক থাকব যাতে তোমাকে নাম ধরে না ডেকে ফেলি। আজও লক্ষ লক্ষ দম্পতি পরস্পরের নাম না ডেকেই ঠাকুরদা-ঠাকুমা হয়ে পরলোকে যায়। এই যে, এই, শুনছ-কত ডাক! আমিও বলব! এই ঝিরি, তোর দিদিকে ডাক।’

‘আমার ভয় করছে।’

‘কুকুরের? মানে বাঁটুলের ভয়?’

‘না। তোর এই সমস্ত পাগালামি বাবা, প্রবীরকাকা জানতে পারেন যদি! অসম্ভব! ওঁরা ভয়ানক আঘাত পাবেন!’

‘আগে নিজেকে বোঝো ঝুমু। বার বার বলছি।’

‘আমি বুঝেছি। তোর বোঝা দরকার, তোর মনের চিকিৎসা করতে হবে।’

‘এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ো না ঝুমুদি। ভুল করে ফেলবে।’

‘তুই খারাপ হয়ে গেছিস। একদম বাজে। বড় ছোট জ্ঞান নেই। এসব কেমনতর বদমায়েশি।’

‘কী চাও তুমি ঝুমু? আমাকে দিয়ে বলিয়ে নেবে যা করেছি ভুল করেছি? আজ থেকে তোমাকে আমি ভাইয়ের মতো ভালবাসব? আমার নীতি অন্যরকম। বোধ, বিশ্বাস অন্যরকম। আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ডেকেছি। বয়স বেশি মানেই তাকে চাচি, মামি, পিসিমণি বলতে হবে, আমি মানি না। আর বললেই তারা আমার মাসিমণি হয়ে যাবে না। আমি জানি, তুমি একদিন নিজেকে বুঝবে। যেদিন বুঝবে, ইচ্ছে হলে এসো। আমি তোমার জন্য রইলাম।’

জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে আড্ডা সেরে প্রবীর ফিরলেন। আজকের অনুপুঙ্খ খবর নিয়েছেন তিনি। যাঁরা সব এসেছিলেন তাঁরা লোক কেমন। কোনও পরিবার সম্পর্কে এই বিষয়টিই তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। প্রস্তাবিত পাত্র কী কাজ করে, তার উপার্জন ইত্যাদি বোঝা জ্যোতির্ময় বা প্রবীরের কাছে কঠিন নয়। কিন্তু মানুষ চেনা সবচেয়ে জরুরি এবং প্রায় অসম্ভব কাজ। ঘরের মেয়েটিকে যে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, তাদের ভালমানুষ হওয়া মুখ্য কাম্য। একটাই ভরসা, জয়ী ওঁদের অনেকদিনের পরিচিত। গুরুভগিনী। নানান সমাবেশে বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে। সন্দীপন নামের ছেলেটি এ কালের ছেলের মতো বহির্মুখী নয়। ঝুমু-র পক্ষে সম্বন্ধটা ভাল।

প্রবীর ভারী সন্তোষে এ দিনের খবরের কাগজগুলি নিয়ে বসলেন। অদূরে, নিজের গড়গড়িতে বসে আছে টোপর। হাতে ভারী বই। মনোযোগ সহকারে পড়ছে। প্রবীর বললেন, ‘বেশ ভাল সম্বন্ধ বুঝলি টোপর। শুনে তো যা মনে হচ্ছে, ঝুমু-র বিয়েটা এবার লেগে যাবে। সময়টা ভাল যাচ্ছে। তোর চাকরি হল, ঝুমু-র বিয়ে লাগছে।’

কোলের উপর বই রেখে টোপর সরাসরি তাকাল প্রবীরের দিকে। বলল, ‘তোমাকে কিছু বলার আছে বাবা!’

‘বলো।’

‘আমি বিয়ে করতে চাই।’

‘বিয়ে! তুমি! মানে আমি বলতে চাইছি সবে চাকরি পেলে, কাজে যোগ দেওয়া পর্যন্ত বাকি, এসময় বিয়ের প্রস্তাব, কোনও বিশেষ কারণ কি আছে?’

‘আছে বাবা।’

‘বলো। শুনি।’

‘আমি ঝুমুকে ভালবাসি। ভেবে দেখলাম, ওর বিয়ে হয়ে গেলে…’

‘কী বলছ তুমি জানো? কী বলছ এসব?’ প্রবীরের চোখমুখ তপতপে। বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তিনি ঘনঘোর উত্তেজিত।

‘ঝুমুকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।’

‘চুপ! একদম চুপ! ছি ছি ছি! আমি জ্যোতির্ময়ের কাছে মুখ দেখাব কী করে?’

‘এই প্রথম তুমি আমার কথা বোঝার চেষ্টাই করলে না। তুমি তো এরকম করো না।’

‘এতে বোঝার কী আছে টোপর। ঝুমু-ঝিরি আমার মেয়ের মতো। তোমরা একই পরিবারে ভাইবোনের মতো বড় হয়েছে। তার মধ্যে এসব কী! এ তো বিকার!’

‘বাবা, তুমিও আমাকে বোঝার চেষ্টা করবে না?’

‘কতদিন ধরে চলছে এসব টোপর? আমরা তোমাদের বিশ্বাস করেছিলাম।’

‘এখন এ আলোচনা থাক বাবা। তুমি আমার সততা, আমার ভণিতাহীন, সত্যকে মর্যাদা দিলে না। তুমি খুব রক্ষণশীল অনমনীয় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছ। এভাবেই পৃথিবীতে সন্ত্রাসের জন্ম দিয়ে আনন্দ চলে যায় গোপন কোটরে। এভাবেই হিঁচড়ে টেনে প্রাণময়ী ভালবাসা চিতায় জ্বলতে জ্বলতে রেখে যায় দুঃখিত বিষাক্ত ধোঁয়া। ভালবাসা, আহা ভালবাসা, অমন ভয়াল মৃত্যু কাম্য নয় তার, চলো তাকে ফসলের ক্ষেতে যত ধানের গোড়ায় বুনে বুনে, সাবলীল করে দিই জীবনের সুন্দরের সিক্ত বীজ রোয়া, তাকে বুকের ওপর তুলে আমি যাব তোমাদের চিতার আগুনে।’


আরো পড়ুন: পুনর্পাঠ উপন্যাস: জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা । শহীদুল জহির


প্রবীর উঠে পড়লেন। তিনি হতচকিত। বিভ্রান্ত। অনেক আঘাত তিনি সয়েছেন এ জীবনে। অনেক প্রতিকূল পথ হেঁটেছেন একা। তিনি অস্থির বোধ করছেন। শরীরে গরম ভাপ। হাত-পা কাঁপছে। একদিন জীবনসঙ্গিনীর জন্য নিজে বিদ্রোহ করেছিলেন, আজ ছেলে সেই বিদ্রোহী। এই প্রস্তাব অন্যায় ঠেকছে, অসহনীয়, এমনকী পাপমতিত্ব মনে হচ্ছে। কেন? এই কি স্থবিরতা? জীবন গতানুগতিক হলে, নির্দিষ্ট ছন্দোবদ্ধ হলে কি নব্য ভাবনার গ্রহণযোগ্যতা হারায়? হয়তো এই স্থাণুবৎ অস্তিত্বই দুই প্রজন্মে অনিবার্য দূরত্ব রচনা করে! তিনি স্নানঘরে ছিটকিনি তুলে আয়নায় দাঁড়ালেন মুখোমুখি। স্পষ্টতা। অকপট উন্মোচন। নিরাবরণ অনিচ্ছা-ইচ্ছার স্বাধীন প্রস্তাব! ছেলে ও বাবার মধ্যে আছে। এমনই জগৎ তাঁরা রচনা করেছেন। না হলে পথ চলা দুরূহ হত। অসহায় শিশুটিকে মা ফেলে গেলে লোকে তাকে নির্মমতা বলে। বলে কী করে পারল! বাবা যদি ফেলে যায়, বলে এমনই তো হয়, পুরুষ স্বভাবত স্বার্থপর। পিতা গর্ভে ধারণ করে না, তাই সন্তানের মাহাত্ম্যও জানে না।

আর মায়ের পরিত্যক্ত চিরনির্ভর শিশুটিকে যদি বাপ তুলে নেয় বুকে? সেও ধারণ নয়? গর্ভ থেকে নেমে ভূমিষ্ঠ বিকল শিশু উঠে আসে বক্ষগর্ভে পরম নির্ভয়ে। সে গর্ভ পিতার। সে গর্ভে মাতৃপুষ্প নেই। সে গর্ভে সন্তান ভালবাসা ফুল দিয়ে ঢাকা।

‘বাবা, মা আমার জন্য চলে গেল? হাঁটতে পারি না বলে?’

‘টোপর, যে যাবার, সে চলে যায়। ঝিরি-ঝুমু ওদেরও তো মা নেই।’

‘ওদের মা মরে গেছে। হাসপাতালে। না বাবা?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার মা কোথায় গেল?’

‘জানায়নি।’

‘কোনও দিন আসবে না!’

‘জানি না রে।’

‘আমার কী দোষ বাবা। আমি কি ইচ্ছা করে প্রতিবন্ধী?’

‘কে বলল, তুমি প্রতিবন্ধী?’

‘লোকে বলে। শুনেছি।’

‘যারা এমন বলে, মনে মনে তারাই প্রতিবন্ধী। আধুনিক সভ্যতা বিজ্ঞানমনস্ক। মানবিকতার জয়কারী। অক্ষমের ক্ষমতার জন্যই একালের লড়াই। ক্ষমতাবানের ক্ষমতালোভ সভ্যতার পরিপন্থী। নিকৃষ্ট কদাচার। ক্ষমতার সাম্য রচনা করা হল মানুষের ধর্ম। হেলেন কেলার নামে একজন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন অন্ধ ও বধির। অথচ তাঁর শিক্ষা, বুদ্ধি, চেতনা, সাহস ও অধ্যবসায় তাঁকে অসাধারণ নারী করে তুলেছিল। তিনি বই লিখেছেন, পড়িয়েছেন, স্বয়ং হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবনী তোমাকে পড়াব আমি।’

‘মা কি হেলেন কেলারকে চেনে?’

‘হেলেন কেলার ১৯৬৮ সালে মারা গিয়েছেন। তোমার মা অবশ্যই তাঁর নাম জানতেন।’

‘মা নেই। আমাকে কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে?’

‘এটা ঠিক, এতকাল তোমার মা-ই তোমাকে সবরকমে আগলে রেখেছিলেন। এবার আমি করব।’

‘মা’র ভাল লাগত না। চলে গেল। তোমারও ভাল লাগবে না। তখন তুমিও চলে যাবে?’

‘না টোপর। আমি তোমাকে ফেলে কোথাও যাব না। তোমার মা তোমাকে আট বছরের করে দিয়ে গেছেন। তোমাকে আমি স্বনির্ভর করে দেব। তুমি যাতে আমারও ভার না হয়ে ওঠো, আমারও তোমাকে বালাই মনে না হয়, তা-ই করব আমি।’

‘আগে কেন করলে না? মা তা হলে থাকত।’

‘সবকিছুই শুরু করার নির্দিষ্ট সময় আছে টোপর। তার আগে হয় না।’

‘আমার কেন এরকম হল বাবা?’

‘তোমার মায়ের একটা অসুখ করেছিল। তুমি মায়ের পেটে ছিলে। ডাক্তাররা বললেন, অসুখটার জন্য বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। তোমার মা বলল…’

‘মা কী বলল?’

‘বাচ্চা না হওয়াই ভাল।’

‘কেমন করে? আমি তো তখন হয়ে গেছি, না বাবা? মায়ের পেটে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছি।’

‘কেমন করে জানলে?’

‘ছবিতে দেখেছি না? হাসপাতালে ছবি থাকে।’

‘হ্যাঁ। ওই ছবির মতো। যে তুমি হয়ে গিয়েছিলে, তাকে নেই বলা যাবে কী করে?’

‘তা হলে মা কেন বলল?’

‘মা ভেবেছিল, ম্যাজিক, চাইলেই যা আছে তা ভ্যানিশ করে দেওয়া যায়।’

‘তারপর?’

‘মা বলল, ‘আমার ভয় করছে।’ আমি বললাম, ‘ভয় নেই। যা হচ্ছে হোক। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তারপর তুমি এলে। আমার ফুটফুটে জীবন্ত পুতুল। মা-ও পুতুল পেয়ে খুশি। কিন্তু যখন বুঝতে পারল সুন্দর পুতুলটার একটু খুঁত থেকে গেছে…’

‘খুব কাঁদল, না বাবা?’

‘কাঁদল, রাগও করল।’

‘বাচ্চারা কি ম্যাজিক প্লেটের আঁকিবুকি, বাবা?’

‘কেন বলছ?’

‘বোতাম টিপলে মুছে যায়, না? এই আছে, এই নেই। পেটে ছিল, পেটে নেই।’

‘তা সম্ভব। ডাক্তাররা পারেন ওরকমটা।’

‘তখন বাচ্ছারা কোথায় যায়?’

‘মুছে যায়। ওই যে বললে, ম্যাজিক স্লেট।’

‘আমিও যদি মুছে যেতাম, আমি নেই, তাই না?’

‘আমি তো চাইনি তুমি মুছে যাও। তোমার মা-ও চায়নি। শুধু চেয়েছিল নিখুঁত পুতুল। পেল না, ওমনি রাগ। বলে খেলব না। চলে যাব। চলে গেল।’

‘আমিও চলে যাব, বাবা?’

‘কেন যাবে?’

‘মা নেই। কষ্ট।’

‘আমারও তো কষ্ট। তুমি যদি চলে যাও, আমার কী হবে? কে আমার সঙ্গে কথা বলবে? কে ভালবাসবে?’

‘বাবা, কোলে নাও। তোমার কাছে যাব।’

গলা জড়িয়ে ধরত টোপর। মুখ গুঁজে দিত পিঠে। তার ঝুলঝুল করা পা দু’খানি প্রবীর নিজেই বের দিয়ে জড়িয়ে নিতেন। টোপর বড় হচ্ছিল। সেই বিকাশমান কৈশোর তারুণ্যের সমস্ত খবর জানা ছিল প্রবীরের। এই কথাটুকু ছাড়া। ওরা ভালবাসে। টোপর কাউকে ভালবাসে। কবে থেকে? জানায়নি কেন? প্রবীরের অভিমান হল। সেই বোধ অতিমানী হয়ে ঠোক্কর খেতে লাগল। ছেলে বলল না কিছু? তাঁকেও বলল না? ছেলের পৃথক জগৎ তাঁকে পীড়া দিল।

মুখে চোখে শীতল জলের ঝাপট কতক শান্ত করল প্রাণ। চিন্তার গতি ঘুরে ঘুরে পথ করে নিতে পারল স্নেহ অভিমুখে। সে যে পরম স্নেহের ধন। প্রিয়তম। আত্মসত্তার চেয়ে প্রিয় আত্মজ। প্রবীর অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন। যাই হোক। ঘটনাপ্রবাহ যেদিকেই যাক। তিনি ছেলেকে কোলে করে রাখবেন। মাটিতে পায়ের চিহ্ন পড়ে না ঈশ্বর। অক্ষম সেই পায়ে সক্ষমতা দাও সংগ্রামে। দাও মনে বল, চরিত্রে দৃঢ়তা, দাও অকপট স্বীকারের অপূর্ব হৃদয়।

বেরিয়ে দেখলেন, টোপর চোখ বন্ধ করে বসে আছে। নিমগ্ন ধ্যানে। বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল। কেন ওই প্রতিক্রিয়া? আর নয়। আর কোনও দিন নয়। ভালবেসে সরব হয়েছে। এ কি কোনও অপরাধ? কত নির্ভীক এই ছেলে! কত উদার হৃদয়! নরম করে ডাকলেন, ‘টোপর।’

টোপর তাকাল। ‘বাবা। রাগ করলে?’

‘না বাবা। হঠাৎ শুনলাম। ধাক্কা লেগে গেল। এখন ঠিক আছি। আবার নতুন করে শুনি। শুরু করো।’

‘ঝুমুকে ভালবাসি বাবা। এ কি অপরাধ? আজ নয়। আমি ভালবাসি বরাবর। অত ভেবে দেখিনি তো। ও আছে, থাকবে। আর কিছু ভাবিনি। ওর বিয়ে হবে শুনে খুব ভয় হল বাবা। আমি শুধু প্রার্থনা করে গেছি যেন না হয়। আর কাজ করে গেছি। চাকরি, চাকরি। উপার্জন। আমার অক্ষমতা জানি আমি। বাবা। আমার মেধাময় মস্তিষ্কই একমাত্র সহায়। ও ওইভাবে লোকের কাছে যায়, বসে, ওকে দেখে, কী দেখে বাবা? আলু-পটলের মতো নাড়াচাড়া, গোরু-ছাগলের মতো দর করা-এ কি মানুষের কাজ? দেখে কী বোঝা যায়? নিজেকে এইভাবে সাজিয়ে-গুজিয়ে তুলে ধরা বাবা-এ কি মধ্যযুগ? দাসব্যবসায়? তারপর…অচেনা লোকের সঙ্গে সোজা বিছানায় ঠেলে দেবে। বাবা, ঝুমুকে বাঁচাবে না?’

‘ঝুমু জানে, ওকে তুমি কীভাবে ভালবাসো?’

‘জানত না। সেদিন বলেছি।’

‘কী বলল?’

‘মারল।’

‘তারপর?’

‘কাঁদল। বলল, আমি বিশ্বাস ভেঙেছি।’

‘ওর দোষ নেই। আমরা সবাই সংস্কারে বাঁধা। বড় কঠিন শৃঙ্খল বাবা। ছাড়ানো সহজ নয়।’

‘জানি বাবা। আমি বুঝি। বার বার বলছে-ও আমার চেয়ে চার বছরের বড়। ভাই বলে।’

‘শোনো, তোমাকে কয়েকটা কথা বলি। শুধু বাবা হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবেও বলি। প্রকৃতির কারসাজিতে মেয়েরা তাড়াতাড়ি বড় হয়, বুড়িয়েও যায় তাড়াতাড়ি। যেহেতু বিবাহের অন্যতম উদ্দেশ্য যৌন সম্পর্ক স্থাপন, সেহেতু কন্যা হয় বয়ঃকনিষ্ঠ। আগে এই পার্থক্যে ভারসাম্য ছিল না। রক্ষণশীল অশিক্ষিত সমাজ বারো বছরের মেয়ের সঙ্গে অনায়াসে বাহাত্তর বয়সি পুরুষমানুষের বিয়ে দিত। সেই চূড়ান্ত অবমানকর এবং নিষ্ঠুর ব্যবস্থা আর নেই। মোটামুটিভাবে বয়সের তফাত যা আছে, সমাজ তাতে সন্তুষ্ট। সমবয়সি বিয়েও আর আপত্তিকর নয়। কিন্তু মেয়েটি বয়সে বড় হলে আমরা রক্ষণাত্মক। আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমি তোমার ইচ্ছায় বাধা হতে চাই না। তবু ভেবে দেখতে বলি, তোমার স্ত্রী তোমার ঢের আগে বুড়িয়ে গেলে তোমার পক্ষে মর্মান্তিক হবে না তো?’

‘বাবা, আমি ঝুমুকে ভালবাসি। ওর রূপ, শরীর, দাঁত, নখ আমার বিচার্য নয়। ও যদি রোগগ্রস্ত হয়, নষ্টযৌবনা হয়, যদি যৌনশৈত্য ওকে গ্রাস করে, তবু তো ঝুমু। ও আমার জীবনের অংশ বাবা।’

‘কবে তুমি এভাবে ভাবতে শুরু করলে আমি জানি না। আমার তো আশ্চর্যই লাগছে। যাই হোক, আমি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি, তোমার প্রস্তাবে ঝুমু সম্মত নয়, তাই তো?’

‘ও ভয় পাচ্ছে, যদি জ্যোতিকাকার সঙ্গে আমাদের এ নিয়ে মনোমালিন্য হয়?’

‘সে সম্ভাবনা আছে। জ্যোতি অত্যন্ত রক্ষণশীল। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে ও প্রায় অষ্টাদশ শতকে পড়ে আছে। কিন্তু ঝুমু নিজেও তো বয়সের সংস্কারে আটকে আছে।’

‘তুমি ওকে বুঝিয়ে বলবে, বাবা?’

‘টোপর, যে তোমাকে ভাই ভাবছে, তাকে আমি কীভাবে বোঝাতে পারি তুমি যা চাও!’

‘আমি অনুভূতি দিয়ে বুঝেছি ও আমাকে অসম্ভব ভালবাসে। কিন্তু সংস্কার পেরোতে পারছে না।’

‘সংস্কার নিজেকেই ডিঙিয়ে যেতে হয়। নিজের ভালবাসার রূপ কী, নিজেকে বুঝতে হয়। ঝুমু যতদিন অন্তরে তোমার যথার্থ অবস্থান উপলব্ধি না করবে, তোমায় অপেক্ষা করতে হবে। প্রেমের উন্মেষ উভয়পক্ষীয় না হলে বিনাশের সম্ভাবনা। আর একপক্ষীয় প্রেমের সঙ্গে অচেনা জনের সম্বন্ধ চাপিয়ে দেওয়ার কোনও তফাত নেই।’

‘যদি ও বুঝতে পারে, যদি আসে আমার কাছে, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে তো বাবা?’

‘টোপর, ঝুমু বড় ভাল মেয়ে। কত ভালবাসা ওর মধ্যে! কত করুণা! আমি যখন থাকব না পৃথিবীতে, তখন, তুমি ঝুমুর তত্ত্বাবধানে থাকো যদি, আমি শান্তি পাব। কিন্তু ওর পরিবার যদি না মানে? ঘরছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা, স্বজন পর হয়ে যাবার যন্ত্রণা আমি পেয়েছি। আজ আবার সব ফিরে পেতে ইচ্ছা হয়। তাড়া করে ছোটবেলার স্মৃতি। যার জন্য সবাইকে ছাড়লাম, সে-ও তো আমায় ছেড়ে গেল। ঝুমু কি পারবে, তার বাবার বিরুদ্ধে যেতে?’

‘ভালবাসার একটা শক্তি আছে বাবা। আজ যদি মা তোমার সঙ্গে থাকত, তোমার কি আত্মীয়বিচ্ছেদ বেদনা এত তীব্র হত?’

‘হয়তো নয়। তবুও টোপর, তুমি ঝুমুর সম্মতির অপেক্ষা করো। আর হ্যাঁ, একটা কথা, তুমি যথেষ্ট পরিণত, আত্মবিশ্বাসী, তবু ভেবে দেখতে বলি, তোমার শারীরিক অক্ষমতার জন্য ঝুমু আপত্তি করছে না তো?’

‘না। না বাবা। অসম্ভব। ঝুমুদি আমার জন্য কী না করে বলো।’

‘সে তো বাইরে থেকে করা। দায়িত্ব এসে গেলে বাধ্যবাধকতার প্রশ্নে সে রাজি হবে তো? ছেড়ে যাবে না তো?’

‘না বাবা। ঝুমু এরকম করতেই পারে না।’

‘মেয়েরা বড় দুর্বোধ্য টোপর। একই সঙ্গে তারা নির্মম ও করুণার প্রতিমূর্তি। আমি নারীকে বিশ্বাস করি না।’

‘আমি করি বাবা। নারী ব্যক্তি মাত্র। মানুষ। মানুষকে অবিশ্বাস করব কেন? প্রত্যেকটি মানুষই তো আলাদা।’

আইবুড়ো ভাতের দিন ঝিরি আর ঝাড়ু নমিতা জোর করে টোপরের দেওয়া লাল ঢাকাই শাড়িটি ঝুমুকে পরিয়ে দিল।

ক’দিন তাদের খুব মনখারাপ ছিল। গর্ভবতী সরসীকে তার মাতাল স্বামী পেটে সর্বশক্তি মান লাথি মেরেছিল।

এ পৃথিবীর নষ্ট পুরুষের সহজতম ক্রিয়া কী? যে কোনও স্ত্রীলিঙ্গ ধরো, আট মাস বয়সি থেকে আটানব্বই বত্সর-অপরিণত, অক্ষম, সুন্দর, কুত্সিত, অবোধ, দুর্বল-ধরো আর ফুঁড়ে দাও। ছিন্নভিন্ন করে দাও যোনিপদ্ম।

জগতের কোন কর্ম নষ্টের মহতী পুরুষকার? ধরো, বিদ্ধ করো নারী। গর্ভবতী করে দাও।

বাকি থাকে কিছু? থাকে না কি? মূল ধ্বংস করো। নারীভ্রূণ অর্থহীন। উপড়ে ছিঁড়ে আনো গর্ভ থেকে। তারও চেয়ে উপাদেয় গর্ভে লাথি মারা। গর্ভিণী নারীকে মেরে বড় পদসুখ! বড় তৃপ্তি। দেখ শালি, আমার কী পাঁকাল জাঁকাল পুরুষোচিত বিপুল ক্ষমতা। এক লাথিতে গর্ভ খানখান। স্বর্গ থেকে মর্ত্য থেকে মর্গে টেনে আন।

সরসী মারা যেত যদি না ঝাড়ু নমিতা, জটা নমিতা, মুন্নার মা, গোপালীমাসির দল চিল্লিয়ে পুরুষদের তত্পর না করত।

কানাই সামন্ত সরু গলির প্রায় সব পুরুষমানুষই সন্ধ্যায় চা পান করেই গাঁজায় মদে যার যার রুচি অনুযায়ী নিমজ্জিত হয়। কেউ কেউ চেতনাবলুপ্তির অচির সমাধি লাভ করে। কেউ কেউ ঝিমোয়। ভুল বকে। এন্তার গালিগালাজ করে যাবতীয় অসন্তোষ বিক্ষোভের ঝাল মেটায়। কিন্তু ঝাঁকুনি দিলে জেগে ওঠে। নারীকুলের মুখনাড়া অঙ্গুলিহেলনে এমনকী সামাজিক সচেতনে তত্পর।

তাই মরণ কামড়ে ধরা সরসীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সরসী মরবেই পণ করেছিল, হঠাৎ মনে পড়ল দুটি ছানা, সে না থাকলে ভিখিরির বাচ্চা হয়ে যাবে। কে গায়ে-গতরে খেটে খেতে পরতে দেবে, ইস্কুলে পাঠাবে জোর করে! সরসীর আদরের সন্তানেরা পথে মরে পড়ে থাকা চ্যাপটা ব্যাঙের মতো পায়ে পায়ে ধূলি হয়ে যাবে।

অতএব, বড় করে পেট কেটে সরসীর লাথিভোক্তা মরা ছানাটিকে ফেলে দিয়ে পেটখানা সেলাই করে প্রাণ দেওয়া হতে লাগল। এবারের মতো সরসী বেঁচে গেল।

তার মরণের মুখে যাওয়া আর ফিরে আসার মধ্যবর্তী দিনগুলি মনোরম ছিল না। প্রথম দিকের প্রতিটি দিন লম্বা-চওড়া রাস্তার দু’ধারের মধ্য ও উচ্চবিত্তের গেরস্থালি আগলানো বিজন ভট্টাচার্য গলির ঠিকানায় ঝুমু-র উদ্বেগের অন্ত ছিল না। কানাই সামন্ত সরু গলিতে ঝগড়া বাধাতে ভুলে গিয়েছিল মেয়েরা। পুরুষেরা নেশার আসরে বসে পাপিষ্ঠ স্বামীর কথা বলত আর হতভাগিনী সরসীর কথা।

আর তারই মধ্যে ঝুমুরের বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র ছাপা হতে গেল। তার প্রতিটি সোনালি অক্ষরে মিশে রইল বিষাদের হলুদ।

সরসী কেমন আছে? বাঁচবে তো? এই প্রশ্নে শুরু হত দিন, এই প্রশ্নে শেষ।

ঝুমু একদিন ঝাড়ু নমিতার সঙ্গে হাসপাতালে গেল। ফ্যাকাশে, হাড় কাঁকলাস সরসীর শরীরে বোতলের রক্ত ঢুকছিল। সে ছিল আচ্ছন্ন। ঝুমু তার জন্য কিছু ফল নিয়ে গিয়েছিল। জ্যোতির্ময় ত্রিশ টাকা দিলেন ফল কেনার জন্য, টোপর দিল আড়াইশো। ঝাড়ু নমিতা সব ফলগুলি হাসপাতালে না রেখে কিছু নিয়ে এল সরসীর বাচ্চাদের জন্য। সরু গলির মানুষেরা বিপদে-আপদে একযোগে ভাবনা-চিন্তা করে। প্রতিদিনই তাকে দেখতে যাচ্ছিল কেউ না কেউ। রোজ দু’বেলা কতক চেনা কথা ভাসছিল কানাই সামন্ত সরু গলিতে।

‘কেমন দেখলি আজ?’

‘ওই একইরকম।’

‘কী রে, এবেলা কেমন?’

‘একটু যেন ভাল দেখলাম। কথা বলল।’

‘উঠে বসেছে?’

‘না না। সে টাইম লাগবে। শুধু ছেলেমেয়ের কথা জানতে চায় আর মড়াটার জন্য কাঁদে!’

তারই মধ্যে ঝুমু-র গয়না এল। তাদের মায়ের গয়না ভাগাভাগি করে দুই বোনের। সেসব ঘষামাজার জন্য স্যাঁকরার কাছে দেবার আগে ঝিরি বলল, ‘বাবা, এসব পুরনো ডিজাইন। এগুলো ভেঙে নতুন গয়না গড়িয়ে দাও দিদিকে।’

‘সোনা নষ্ট হবে। অনেক টাকা যাবে। এমনিতেই বিয়ের কত খরচ।’ জ্যোতির্ময় বললেন। ‘তবু যদি ঝুমু চায়।’

‘না। আমি চাই না। গয়না পরার অত ঝোঁক নেই তো আমার। টাকা নষ্ট করার দরকার কী!’

‘ঝিরি বড় খরচ বাড়াতে চায়। আমার ঝুমু হল লক্ষ্মী। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে পথে বসছি, তার ওপর দুই মেয়ে। সঙ্গে ঝিরির নানান বায়নাক্কা।’

‘ও তো ছেলেমানুষ বাবা। তুমি অত ভেবো না। এই গয়নাই বা খারাপ কি!’

সেই গয়নাই কিছু পরানো হয়েছে ঝুমুকে আজ। লাল জড়িকাজ ঢাকাই। ঝুমু আজ রূপবতী।

আজ এক ছুটির দিন। আইবুড়ো ভাতের উদ্যোগ বড়পিসির। বহু আত্মীয় সমাগমে বাড়িটা আজ ছিল সরগরম। ঝিরি বলে বসল, ‘আমাদের এত আত্মীয়, এত হিতাকাঙ্ক্ষী আছে, আগে জানতাম না তো! অমুক মাসি, তুমুক পিসি, রাঙা দিদা, কুট্টি কাকি! বাপস্! গিয়ে বলব, এতদিন কোথায় ছিলেন?’

মৃত্যু এবং উৎসব কেন্দ্র করে আত্মীয়মিলন হয়। এই বাস্তব সত্য ঝুমু মেনে নিয়েছে, ঝিরি নেয়নি। ঝুমুর বিবাহে ছোটপিসির আবির্ভাব হবে। ঝুমু ভারী কৃতজ্ঞ বোধ করছে। কিন্তু ঝিরি রুষ্ট। এমনকী সে একথাও তুলছে-সন্দীপনদা তোর সঙ্গে একবার কথাও বলতে চাইল না?

ঝুমু বলে— সেই ভাল। কথা বলে কী হত?

‘এটা স্বাভাবিক না দিদি। এর থেকে দু’রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এক. সন্দীপনদা এখনও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করছে। দুই. ভদ্রলোক সেকেলে। প্রথমটা যদি কারণ হয়, তবে তার থেকে অনেক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়। এক. ভদ্রলোকের আর কেউ আছে যাকে বউ করা যাচ্ছে না। দুই. শারীরিক বা মানসিক গোলমাল আছে। এর কোনওটাই তোর পক্ষে ভাল নয়।’

‘বাব্বা ঝিরি, তুই তো পাকা গোয়েন্দার মতো কথা বলছিস। আমাদের ব্যোমকেশী বক্সী। অত ভেবে কী হবে? বাজি ধরতেই হবে তো। তবু তো বড়পিসির চেনাজানা।’

‘কতটা চেনা? গলা মিলিয়ে কেওন গাইলেই কি সব জানা হয়ে যায়?’

‘চেনাজানা, প্রেম, বন্ধুত্ব— কোনওটাই সম্পর্কের শেষকথা হতে পারে না ঝিরি। তুই দ্যাখ, আমাদের প্রবীরকা রুপুকাকিমাকে ভালবেসে সব ছেড়েছিলেন। তবু টোপর মা পেল না। টোপরের চাকরি পাবার দিনটা কত আনন্দের, কত সাফল্যের! রুপুকাকিমার পক্ষে সেটা চরম গর্বের দিন হতে পারত! অথচ কেউ একবার তাঁর নাম পর্যন্ত করল না। জীবন বড়ই অনিশ্চিত ঝিরি। যুক্তি দিয়ে যতই সাবধান হওয়া যাক, শেষরক্ষা না-ও হতে পারে।’

‘মা হিসেবে রুপুকাকিমা খুবই ব্যতিক্রমী দিদি। এত নিষ্ঠুর, এমন উদাসীন কেউ হতে পারে? উনি এমন করেছেন মানেই সবাই এমন তো নয়! অদ্ভুত! একবার জানতেও ইচ্ছে করে না, ছেলেটার কী হল?’

‘ছেড়ে গেলে হয়তো পিছুটান না রেখেই যাওয়া উচিত। তোর কথা থেকেই বলি, মানুষের কোনও ছাঁচ হয় না। দেখি কপালে কী আছে! নিজেকে আলু-পটলের মতো হাটে-বাজারে তুলতে তুলতে আমি ক্লান্ত ঝিরি। তবু তো ওঁরা আমাকে পছন্দ করলেন।’

‘তোকে যে কাছ থেকে দেখবে, সে-ই পছন্দ করবে দিদি। আশা করি সন্দীপনদাও করবে।’

ঝাড়ু নমিতা বলে—মজায় আছ, না ঝুমুদি?

‘মজা কীসের?’

‘বিয়ে হলে মজা হয় না?’

‘শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় পাশ করলাম। এই আর কি।’

‘আমাদের ভুলে যাবে না তো?’

‘না। ভুলব কেন? আমি কি সাত সমুদ্র পার হয়ে চলে যাচ্ছি?’

‘ফুলশয্যার রাতে কী হল, সব শুনব।’

‘কিছুই হবে না।’

‘কী করে জানলে?’

‘বিয়ে হলেই কি সব হয়? সময় লাগে।’

‘আজ তোমাকে রাজেন্দ্রাণীর মতো লাগছে। ‘সূর্যকন্যা’ সিনেমায় এই ডায়লগটা ছিল। প্রেমিকার বিয়ে হচ্ছে অন্য লোকের সঙ্গে, প্রেমিক বলছে ‘…তুমি আজ রূপে ঐশ্বর্যে রাজেন্দ্রাণী। আর আমি পথের ভিখিরি!’ খুব কেঁদেছিলাম ঝুমুদি।’

‘আমার জন্যও কাঁদিস। বুঝব তবু আমার দাম আছে।’

‘তোমার জন্য সবাই কাঁদবে। সবচেয়ে বেশি কে কাঁদবে বলো তো?’

‘কে?’

‘টোপরদা।’

টোপর! টোপর! নাম শুনলেই বুকের মধ্যে উথালপাথাল করে। টোপর যেন পুরীর সমুদ্র। গভীর, বিশাল, একাকী। আর কেউ না জানলেও ঝুমু জানে, টোপর প্রকাশ্যে কাঁদবে না।

বিকেল নাগাদ, অতিথি বিদায় নিয়ে গেলে, বড়পিসি বললেন, ‘সময়টা ভাল। গুরুমা এসেছেন। তোর বিয়েতে আনার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মা কাল সকালেই চলে যাবেন আসানসোলে এক ভক্তের বাড়ি। চল, তোকে নিয়ে যাই। আশীর্বাদ করুন।’

ঝুমু গাড়ি নিয়ে বড়পিসির সঙ্গে চলল। জ্যোতির্ময় গাড়ি রাখা বিলাসিতা মনে করেন। ঝুমুদের গাড়ি নেই। এ গাড়ি প্রবীরের। আজ থেকে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তার বাসে-ট্রামে-অটো রিকশায় যাওয়া মানা। কখন কী মানা হয়ে যাচ্ছে, কখন কী চালু হচ্ছে, ঝুমু তাল রাখতে পারছে না। তার দিনগুলো ভারী মধুর ছন্দে বাঁধা ছিল। তার সূর্য ওঠার সব লক্ষণ চেনা ছিল, তার চন্দ্রোদয় ছিল নিরুপদ্রব। গাঁয়ের যে নদীটি আপন খেয়ালে হাঁটুজল নিয়ে বয়ে যায়, হঠাৎ তার অভিমুখে পালটে দেবার চেষ্টা করলে নদী হয় দিশেহারা। ঝুমু-র সেই দশা। চিরকালের আত্মসমর্পিতা, নতুন করে নিজেকে সঁপে দিল নির্দেশের অর্থহীন মাননে।

কাশী থেকে আগত গুরুমায়ের কাছে ঝুমু এই প্রথম নয়। গুরুভক্তি তাকে অধিকার করেনি। এখানে সমাগত জনগণের মধ্যে যে ঐকান্তিক সমর্পণ, চোখেমুখে তদ্গতচিত্ততার যে ছবি আঁকা, ঝুমু তা দেখেছে ভারী দূর থেকে সিনেমার মতো। ‘মাতাজির আশীর্বাদে সব হয়।’ বড়পিসি তাকে বলেছেন, ‘এমন সাধিকা একালের দিনে আর হয় না।’

ঝুমু এই সব কথা, সব দেখা, টোপরকে বলেছে।

‘বুঝলি রে টোপর, বড়পিসি বলে, যখন প্রণাম করবি, মায়ের কাছে বলবি, মা আমাকে আদর্শবান স্বামী দাও। সুখের সংসার দাও। আমি না কিছুই বলতে পারি না।’

‘প্রণাম করো?’

‘তা করব না কেন?’

‘তখন কী বলো মনে মনে?’

‘কী জানি! আমার মন তখন কোথায় থাকে! হয়তো ভাবছি তোরই কথা, তবু প্রণাম করলাম। চাওয়া-টাওয়া আসে না।’

‘কেন বলো তো? তুমি কি বিবেকানন্দবাদী? জ্ঞান দাও মা, শুদ্ধা ভক্তি দাও?’

‘না রে টোপর, চাইলে ভগবানের কাছে চাইব। উনি সন্ন্যাসিনী হতে পারেন, ভগবান নন।’

‘সব মানুষের মধ্যেই ভগবান আছেন— জানো না? খুনি, ধর্ষক, প্রতারক, মিথ্যাচারী— সব্বাই ঐশিক বিভবে ঐশ্বর্যবান। তবু তুমি বলছ গুরুমায়ের মধ্যে ভগবান পাও না?’

‘তাঁর মধ্যে ভগবান, আর তিনিই ভগবান— এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নেই? টোপর? সে বিচারে ভগবান আমার মধ্যেও আছেন। মাতাজি কি আমার কাছে তাঁর প্রার্থনা জানাবেন?’

‘মাঝে মাঝে তোমার মধ্যে থেকে একটা তীব্র আলো বিচ্ছুরিত হয় ঝুমুদি। তখন তুমি মহামানবী হয়ে ওঠো।’

‘মহামানবী-টানবী নয়। আমি কেন হঠাৎ বর দাও, ঘর দাও বলে গড় করতে যাব! ওসব এমনিই হবে। আর হওয়ারই বা কী আছে। ঘর তো আমার আছেই। বর হলেও চলে, না হলেও! তাতে মাতাজির কী ভূমিকা? মাতাজি অমন দাতাজির ভূমিকা নিলেনই বা কেন? তিনি নিজেও জানেন, জগতে কোথায় কখন কী ঘটবে, তার ওপর হাতে আছে মাত্র দু’জনের।’

‘দু’জনের? একজন তো ভগবান। আরেকজন?’

‘কেন? সন্ত্রাসবাদী! মৌলবাদীও বলা যায়।’

‘ইনশাল্লা ঝুমু। সাধু সাধু!’

‘ঠিক বলিনি? কে জন্মাবে, কে নয়, কে মরবে, কে শিক্ষিত হবে, কে মুখ দেখাবে না, কে ট্রেনে চেপে ঘরে ফিরতে ফিরতে, আপিসে কাজ করতে করতে, কিংবা নিজের ঘরে, নিজের পরিবারের সঙ্গে ঘুমোতে ঘুমোতে খুন হবে— সব তো ওরাই ঠিক করে। প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর মারেন বন্যার জলে চুবিয়ে, পাহাড়ে ধস এনে, ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি ধ্বংস করে— ওরা মারে বোমাবন্দুকে। মারণ ক্ষমতায় মানুষ ঈশ্বরের চেয়েও শক্তিশালী। এবং নিষ্ঠুর।’

‘মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসবাদী এক নয়। মৌলবাদ হল কোনও তত্ত্ব সম্পর্কে বা দর্শন সম্পর্কে গোঁড়ামি। আর সন্ত্রাসবাদ হল ক্ষমতায়ণ। ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা দখল করা। মৌলবাদী গোষ্ঠী সন্ত্রাস সৃষ্টি করে একই উদ্দেশ্যে। সেই ক্ষমতা কুক্ষীগত করা।’

‘কোনও দর্শনের মূলতত্ত্বে বিশ্বাস রাখার মধ্যে যদি গোঁড়ামি ঢুকে পড়ে, তাকে যদি নিন্দনীয় বলা হয়, এই গুরুর দল নিন্দনীয় নয় কেন? এখানে তত্ত্ব প্রধান নয়। গুরু আত্মিক শক্তি দ্বারা সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করতে পারেন, এই বিশ্বাসটিও গোঁড়া এবং অন্ধ। এর মধ্যে একটি প্রলোভন আছে। সুখ, সম্পদ কেবল বাড়িয়ে তোলার লোভ। কেউ কি বলে, পাড়ার ওই অন্ধ ভিখিরির দৃষ্টি এনে দাও! ভিক্ষাচক্রের অবসান করো। রাজনীতি ও পুলিশের মধ্যে সততা দাও মা! বলে না। কেবল আত্মতোষ! গুরুর কাজ হবে অনুগতজনের দৃষ্টি উন্মোচন। তার পরিবর্তে তিনি অলীক বিশ্বাসের ছলনায় ক্ষমতা সৃষ্টি করছেন। গুরুর পায়ে পড়ছে গিয়ে সব। ফিসফিস করে কথা বলছে যাতে গুরুর ধ্যানে ব্যাঘাত না ঘটে। ব্যাঘাত হলে কী হবে? গুরু রুষ্ট হবেন। গুরু রুষ্ট হলে কী হবে? অকল্যাণ। আবার এক ভয় এসে গেল। লোকে শোকে তাপে হতাশায় জর্জরিত হয়ে গুরুমুখী হয়, কিংবা ভক্তিমার্গের টানে, পরলোকে পুণ্যের জমা বাড়াবার টানে, সেখানেও ভয় দেখাতে হবে? গুরু যদি শান্তি না দিয়ে ত্রাসেরই সঞ্চার করলেন, তবে তাঁর কাছে গিয়ে লাভ কী হল!’

‘তোমার গণধোলাই খাবার সময় হয়েছে ঝুমুদি।’

‘যা মনে হয়, বলি। সবার ভাল না-ও লাগতে পারে।’

‘প্রণাম তো করো।’

‘বড়পিসি বলে, তাই। গুরুজনের কথা অমান্য করব?’

‘গুরু অস্বীকার করো, আর গুরুজনের আদেশ বিনা প্রশ্নে মেনে নাও?’

‘তুই ভেবে দ্যাখ টোপর, মাতাজি মৌনী। শুধু হাসি দিয়ে যোগাযোগ করেন।’

‘কথার দায় এড়াতে চান।’

‘তুই প্রার্থনা করলি, মাতাজি মাথা নাড়লেন, তুই তো আশা অনুযায়ী তার ব্যাখ্যা করবিই। উনি নাকি মনে মনে বার্তা পাঠিয়ে দেন। সমাধিস্থ হয়ে সারা রাত ঘরের মধ্যে শূন্যে ভেসে বেড়ান। সেইসময় একজন মাত্র ওঁর কাছে থাকতে পায়। ওঁর প্রধান শিষ্যা অমৃতহৃদয়া। ওই ভেসে বেড়ানোর সময় মাতাজিকে স্পর্শ করলে বৈদ্যুতিক স্পর্শাঘাত লাগে।’

‘উরিব্বাস! আমাকে নিয়ে চলো ঝুমুদি। আমি ভেসে বেড়ানো শিখব। কী মজা বলো তো। গড়গড়ি বিদায়! যেখানে খুশি উড়ে যাব।’

‘সেখানেই আমার প্রশ্ন। উনি ভেসে বেড়ালে সমাজের কী লাভ!’

আবার বড়পিসির সঙ্গে সেই মাতাজির স্থানে এল ঝুমু। মাতাজিই বিবাহে অনিচ্ছুক সন্দীপনকে বলে-কয়ে রাজি করিয়েছেন। ঝুমুরও বিয়ের গেঁরো খুলেছে। কী করে বলে-কয়ে ব্যাপারখানা ঘটল! মৌনী গুরুমাতা কি বলা-কওয়ার সংকেতও পাঠান মনে মনে? না। কথোপকথন প্রলম্বিত হলে তাঁর সহায়িকা অমৃতহৃদয়া। তিনি মাতাজির চোখের পলক থেকেও ভাষা বুঝে নেন।

মাতাজি গেরুয়া আসনে, রেশমের গেরুয়া বসন পরে বসে আছেন। যার দিকেই চাইছেন, হাসছেন মধুর। তিনি বৃদ্ধা, কিন্তু রূপবতী। অদূরে অমৃতহৃদয়া। তাঁর পাশে শান্তহৃদয়া। অমৃতহৃদয়া কীর্তন গাইছেন। শান্তহৃদয়ার হাতে কর্ত্তাল। যে মেয়েটি চোখ বন্ধ করে শ্রীখোল বাজিয়ে চলেছে, তাকে আগে দেখেনি ঝুমু। সে গেরুয়া পরেনি। সাদা সালোয়ার কুর্তায় লক্ষ্মৌ চিকনের কাজ। লম্বা বিনুনী। কানে মুক্তোর দুল। মুখখানা পানপাতার মতো নয়, বরং ডিম্বাকৃতি, রোগা, ফর্সা মেয়েটিকে দেখে ঝুমুর মনে হল ভারী দুঃখী এ। হয়তো আদৌ তা নয়। কোনও কোনও মুখে বিষাদের চিরস্থায়ী রং লেগে থাকে। এই মেয়ের মধ্যে রিক্ততা।

মেয়েটির খুব কাছে একজন বসে গানে বিভোর তাল দিচ্ছে। ঝুমু-র তাকে চেনা লাগল। জয়ী তাকে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে বসলেন। কানে কানে বললেন, ‘ওই যে বসে আছে, ও সন্দীপন। কী ভক্তি ছিলেটার!’

এই ছেলেটির সঙ্গে ঝুমুর বিয়ে হবে? তারপর? যা যা হয়! উত্তেজনাকর! মালাবদল! হাতে-হাত রেখে যজ্ঞানুষ্ঠান! এটা ওটা! অবশেষে সেই! ফুলশয্যা! ভাবতেই ঝুমুর শরীর অস্থির হয়ে উঠল অজানা আতঙ্কে! সে তো দিব্যি ছিল। কেন এই বিয়ের আয়োজন? সে তার ভবিষ্যৎ জীবনের চিরসঙ্গী বিষয়ে এতটুকু আকর্ষণ বোধ করল না! যেন, যাই ঘটুক, এই অচেনার দূরত্বই আসলে স্থায়ী হবে। এই ভক্তিমান, বিরলকেশ, কুকুরপ্রেমী যুবক, কয়েকটি মন্তর পড়ে কী করে তার সর্বস্ব হতে পারে? এমনকী যার এই কৌতূহলও নেই যে তার ভাবী স্ত্রী কেমন! যে কেউ, যেমন-তেমন, কেবল এক স্ত্রীলিঙ্গময়ী হলেই তার চলে যাবে! হয়তো চলে যায়! ভিড়ের মধ্যে বসে, ভক্তি সঙ্গীতের সুর ও ছন্দের মনমাতানো আবেশে, ফুল-ধূপ-চন্দনের সুবাস ও শুদ্ধাচারের নানাবিধ নিয়মনিষ্ঠায় তার উপলব্ধি হতে লাগল, বিয়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য যৌনতার চাহিদা মেটানো, দ্বিতীয় উদ্দেশ্য বংশরক্ষা। সম্পর্ক সবচেয়ে গৌণ ও অর্থহীন। গড়ে উঠলে ভাল, না হলেও সমস্যা নেই। সে টোপরের অনেক কথা উপলব্ধি করতে লাগল নিঃশব্দে আর তার চোখ ভিজে উঠল! টোপরের জীবন আর সবার মতো নয়, টোপরের শরীর স্বাভাবিক নয়, টোপরের মেধা ও উপলব্ধি বৃহত্তর, গাঢ়তর, শক্তিমান! এই মুহূর্তে টোপরের কাছে যাবার তীব্র ইচ্ছা হল তার। সে সন্দীপনের থেকে চোখ ফিরিয়ে সুগ্রন্থিত মালাগুলি দেখতে লাগল। এর মধ্যেকার ফুলসজ্জা কী অপরূপ এক শিল্প! ভক্তির সঞ্চার হোক বা না হোক, এখানকার পরিবেশটি মনোরম। এখানে থাকলে মনে পড়ে না, বেরিয়েই মলময়, আবর্জনাময় পথে পা রাখতে হবে। তার মনে হল, বিয়ের আসরও ঠিক এইরকম। আয়োজনের ঔজ্জ্বল্য পরিণামের কারুণ্য ভুলিয়ে রাখে।

বাড়ি ফিরতে ঝুমু-র কাছে খবর এল, টোপরের জ্বর এসেছে। সে ব্যাকুল হয়ে উঠল। বিয়ে স্থির হয়ে যাবার পর সে আগেকার মতো ওবাড়ি যায় না আর। প্রবীর বা টোপর ডাকাডাকি করে না। কবে যেন সুর ছুটে গেছে, তালও টুটেছে। শুধু নিঃশব্দে বেজে চলেছে বিদায়ের নীরব বাঁশিটি।

টোপরের প্রস্তাবের পরও ঝুমু স্বাভাবিক থাকতে চেয়েছিল। সব কিছুই আগের মতো আছে, চাইলেই মনের যাবতীয় চঞ্চলতা, বেদনার আভাস মুছে ফেলা যাবে সে ভেবেছিল। টোপরকে না দেখে তারও কষ্ট। জানালা দিয়ে যে দেখা, ঝুলবারান্দা দিয়ে যে দেখা, তা কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। তবু, সে দৃঢ়চিত্ত হওয়ার সংগ্রামে রত। চলে তো যাবেই। যেতেই হবে। সকলেরই অভ্যাস হোক।

এ প্রয়াস নিত না সে। বিদায়ের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সে পুরনো জীবন পেতে চেয়েছিল। হল না। অবুঝ টোপর। একদিন ফের বলে বসল, ‘ঝুমু, সত্যি স্বীকার করবে?’

‘তোকে মিথ্যে বলেছি কোনও দিন?’

‘তুমি সত্যি আমাকে চাও না?’

‘টোপর, লক্ষ্মীসোনা, পাগলামি করিস না আর। তোকে আমি কত ভালবাসি। সব ভালবাসা কি একরকম হতেই হবে?’

‘আমার পা দুটি অশক্ত, আমি চলতে-ফিরতে অক্ষম বলেই কি আমায় চাও না?’

‘না টোপর! আমি তোকে এক মুহূর্তের জন্যও অক্ষম ভাবি না সোনা!’

‘কারণ তোমার দায়িত্বে বাধ্যবাধকতা নেই।’

‘থাকলে কী হত? টোপর, তোকে কোনও দিন দূর ছাই করেছি আমি? একবারের জন্যও বিরক্ত হয়েছি? এতদিনে আমাকে এই বুঝলি?’

‘মা যাকে ফেলে যায়, তাকে কি জগতের কেউ আর কোলে নিতে চায় গো?’

‘টোপর, জগতে রুপুকাকিমারা যেমন আছেন, মা টেরিজাও আছেন। প্রবীরকাকা কি তোকে আগলে রাখেননি? আমার কথা যদি বলিস, তোর সঙ্গে আমার অনেক আলোচনা হয়েছে, আমরা দু’জনেই মেনেছি, বাধ্যতা নয়, শুধু ভালবাসার টানে যে বাঁধন সম্পর্কের তার চেয়ে বড় সত্য আর কিছু হয় না।’

‘তা হলে কেন ঝুমু? কেন আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাবে?’

‘কেন আমাকে কষ্ট দিস টোপর? কেন এমন অবুঝপনা করিস? কেন মিথ্যে ভাবনা আঁকড়ে আছিস? আমাদের আনন্দের দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে না?’

‘না ঝুমু। আনন্দে থাকব বলেই তো তোমাকে ডাকছি। একসঙ্গে থাকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই। আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। তুমিও আমাকে ছেড়ে পাগল হয়ে যাবে এই সহজ কথাটা কেন বুঝছ না?’

‘আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে রে টোপর। তোকে কি ভূতে ধরল? সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে আমার তোকে। বাবা, প্রবীরকাকা একটুও জানতে পারলে কী হবে জানিস না? সব ভেঙেচুরে যাবে।’

‘আমাদের হৃদয়ভাঙার চেয়েও কি বেশি সেই ভাঙন? বাবা জানে। আমি বাবাকে বলেছি।’

‘টোপর! এসব কী করছিস তুই! ভগবান! ইশশ্ কী ভাবছেন আমাকে প্রবীরকাকা! ভাবছেন আমি তোর মাথাটি খেয়েছি!’

‘বাবা আমাদের সঙ্গে আছে ঝুমুদি!’

‘প্রবীরকাকা তোর এই পাগলামো মেনে নিলেন?’

‘বাবা আমাকে বুঝেছে ঝুমু। শুধু তুমি বুঝছ না।’

‘তোকে আমি বুঝি। শুধু এখন…ইদানীং…’

‘নিজেকে বোঝো তুমি, নিজেকে বোঝার চেষ্টা করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এ লজ্জা সে কোথায় রাখে? কেমন করে লুকোয় মুখ? রাতে ঘুম নেই। দিনে স্বস্তি নেই। কেমন রাগ হচ্ছে টোপরের ওপর! অসম্ভব খেলায় মেতেছে! যাবতীয় অসংবদ্ধতা আকাশে বাতাসে কেন ছড়িয়ে দিচ্ছে সে? ঝুমু বিরক্ত, ক্রুদ্ধ, উদ্বিগ্ন, দুঃখী! সে এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচে। এই নিরাপদ পারিবারিকতা সে হারাতে চায় না। কোনও উথালপাথাল সে পেতে চায় না। সকল নিষেধ মান্য করে সে ভারী নিশ্চিন্ত আছে, সকল চাওয়া পূর্ণ করে সে তৃপ্ত, কিন্তু এ কোন চাওয়ার কাছে টোপর তাকে এনে ফেলল যা তাকে নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করছে!

কিন্তু টোপরের জ্বর হলে সে কী করে নিষ্ঠুর হয়? সে ওবাড়ি ছুটে যেতে লাগল। সোনালি সুতোর কারুকাজ করা লাল ঢাকাই শাড়িটি পরে, নতুন মার্জনা করা প্রাক্তনী অলঙ্কার পরে, যেতে লাগল সে। তার চলার দোলায় দুলতে লাগল বিনুনী। তার সুগোল, সুপুষ্ট পশ্চাৎ-শরীরে নিরন্তর পাক খাচ্ছে নির্বিষ কালকেউটে যাতে প্রেমছোবলে নীল না হয়ে যায় ঝুমুর মেয়েটি।

বাড়ির ভেতরে আসতেই প্রবীর বললেন, ‘এলি? টোপর খুঁজেছে।’

‘অনেক জ্বর?’

‘একশো তিন ডিগ্রি উঠেছিল।’

‘কী বললেন ডাক্তার?’

‘তমাল আসবে রাতে একবার। আপাতত জ্বর নামার জন্য ওষুধ দিলাম।’

‘ডা. তমাল দত্তভৌমিক? অশ্বিনী দত্ত রোডে তোমার বন্ধু?’

‘কেন রে? হ্যাঁ, ওকেই ডাকলাম।’

‘না না। এমনি জানতে চাইছি।’

‘টোপরের তো অসুখ-বিসুখ তেমন করে না। চিন্তা হচ্ছে।’

‘ও কি ঘুমোচ্ছে?’

‘তুই কি এখন একটু থাকবি ঝুমু? সকাল থেকে বেরোইনি। ঝিরি এসেছে দু’বার। নমি-পলাশ ওরাও ছিল। কিন্তু তোকে দেখতে না পেলে টোপর মন খারাপ করে।’

‘তুমি কোথায় যাবে? যাও না! আমার এখন আর কাজ নেই।’

‘ঝুমু মা, এই শাড়িতে তোকে খুব মানিয়েছে। এমন শাড়ি রুপুর খুব পছন্দ ছিল।’

‘জানি প্রবীরকাকা।’

ঝুমু টোপরের কাছে গেল। মাথা অবধি চাদরে ঢেকে টোপর শুয়ে আছে মৃতদেহের মতো। ঝুমুর গলার কাছে কান্না পাকিয়ে উঠল। ক’দিন এমনই হচ্ছে। সে এখান থেকে চলে যেতে চায়। আবার চলে যেতে হবে মনে হলে খুব কান্না পায়। এ এক আশ্চর্য উপলব্ধি। এমন চাওয়া এ জীবনের কাছে যা বেদনাবিধুর। কেন মেয়েরাই সব ছেড়ে যায়?

ঝুমু আলতো করে টোপরের মুখের থেকে চাদরের ঢাকনা টেনে দিল। টোপর চোখ না খুলেই বলল, ‘বসো।’

‘তোকে কতদিন বলেছি, মুখ ঢেকে শুবি না।’

‘একটা ছবি তুলবে? নিজের মৃতদেহ কেমন হবে দেখে নেব।’

‘মারব এক চড়।’

‘আহা, মরব তো একদিন সবাই।’

‘আর মুখ ঢেকে শুবি না। জ্বর বাধালি কী করে?’

‘দুঃখে জর্জরিত হলে জ্বর তো আসবেই।’

ঝুমু টোপরের কপালে গলায় হাত দিল। টোপর চোখ খুলল। তার গায়ে জ্বরস্বেদ।

‘কতদিন পর তোমার স্পর্শ।’

‘তুই-ই তো আমায় ছুঁস না।’

‘ছোঁয়ার সে অধিকার দেবে কি আমায়।’

‘কথা বলিস না। চুপ করে থাক। কত জ্বর উঠেছিল! ঝিরি, নমি সব্বাই জানে, শুধু আমি জানি না।’

‘তোমাকে বলা হয়নি। আজ তোমার শুভানুষ্ঠানের সূচনা। তার মধ্যে জড়তা ঢুকিয়ে লাভ কী! লাল শাড়িতে তোমাকে কত মানিয়েছে ঝুমুদি!’

‘সব্বাই শাড়িটার প্রশংসা করল।’

‘শাড়িটা যে পরেছে, প্রশংসা তারই প্রাপ্য।’

‘ধুস! আমার আবার প্রশংসা!’

‘শাড়িটা তুমি সঙ্গে নেবে তো?’

‘নেব।’

‘শাড়ির প্রতিটি বুননে আমি থাকব তোমার সঙ্গে ঝুমুদি!’

‘যাক, ভাল লাগল।’

‘কী?’

‘তুই আমায় দিদি ডাকলি।’

‘দিদিমাও ডাকতে পারি। কী এসে যায়? এতকাল দিদি ডেকেছি, জিহ্বাস্খলন হতে পারে না? এইসব দিদি-দাদা ডাকাই অর্থহীন। গুরুদর্শন হল?’

‘আরও অনেক দর্শন হল।’

‘সন্দীপন?’

‘বুঝলি কী করে?’

‘অনুমান। গুরুমা এলেন। ভক্তিমানের উপস্থিতি অসম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে কথা বললেন?’

‘হাতজোড় করে দায়সারা নমস্কার। একটি মেয়ে শ্রীখোল বাজাচ্ছিল। তার নাম মালিনী।’

‘তো?’

‘মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় হল না, আমার একটু আগ্রহ হচ্ছিল, মেয়ে শ্রীখোল বাজায়, আলাপ করতাম। আমি সামনে যেতেই সে মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলে গেল!’

‘কাল যার সঙ্গে তোমার জীবন বাঁধা পড়বে, সে একটি কথাও কইল না! আর তুমি ভাবছ মালিনীর কথা?’

‘কী আর বলবে! এরপর তো বলতেই হবে।’

‘খুব আনন্দে আছ ঝুমু?’

‘না। কীসের আনন্দ?’

‘বিয়ে চেয়েছিলে, হতে যাচ্ছে।’

‘আমার মতো সাধারণ মেয়ের আর কীই বা চাওয়ার আছে? বিয়ে, সংসারধর্ম, সন্তান প্রতিপালন, হঠাৎ একদিন দেখব বুড়ো হয়ে গেছি। বড়পিসির মতো।’

‘ভাবতেই পারছি না পাশের বাড়িটায় তুমি নেই। এখন কত কম আসো তুমি। শাস্তি দিচ্ছ, বুঝতে পারছি। তুমি আমায় যা দেবে, তাই নেব। আমার অন্য উপায় নেই। সমস্ত দুঃখরাত দেবে যদি দাও, পাহাড়ের খাঁজ থেকে বজ্রপাখি বাঁকা ঠোঁটে তুলে নিল আমার নিশান, আমার আর কোনও চিহ্ন নেই, আমাকে নতুন করে এঁকো, যদি চাও। তোমার প্রাণের থেকে প্রাণ দিয়ো তাতে। আমার মুখের থেকে চাদরের আবরণ তুলে ফেলে দিয়ো মৃত্যুর ঝাঁপি খুলে। তোমাকে কোথায় পাব বলে যাও। এঘরে ওঘরে তোমাকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত আমার তরল মৃতস্বর বাবুইপাখির ঠোঁটে গুঁজে দেবে মৌন জোনাকি।’

‘চুপ কর টোপর। ভাল লাগছে না।’

‘কেঁদো না। যা চেয়েছ, পেয়েছ। কাঁদো কেন? দূরে যাচ্ছ। ছেড়ে তো যাচ্ছ না।’

‘আমার ভাল লাগছে না।’

‘যাও ঝুমু, আমার ডেস্কের দেরাজ খোলো। একটা সাদা প্যাকেট পাবে। নিয়ে এসো।’

‘নে।’

‘এটা তোমার।’

‘কী?’

‘তোমার সেলফোন। আমার নামে সিম পুরেছি। সিমের মাঝে অসীম আছে। যতখুশি কথা বোলো। বিলের তোয়াক্কা কোরো না। নিষ্পদ শতরূপ তার ভার বইতে পারবে।’

‘এ নিয়ে আমি কী করব?’

‘এই অর্ধমৃত আপদকে ফোন করতে ইচ্ছে করবে তোমার। তোমাকে যে জানি আমি ঝুমু।’

বাড়িটি দোতলা। বেশ বড়। তারই উত্তর-পশ্চিমের ঘরে ঝুমুর প্রথম রাতের শয়ন। সে-রাত হল কালরজনী। স্বামী-স্ত্রী একত্র শয়ন করবে না। এমনকী বধূ ঘরে পদার্পণ করার পর তাকে শ্বশুরগৃহে বরণ করে নিলে, বর সে রাতে বধূর মুখদর্শন করবে না। যদি করে তো বেহুলার মতো দুঃখী হবে সে।

বেহুলা। স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে যে ভেসে গেল কলার ভেলায়। সদ্য কিশোরী হওয়া একটি মেয়ে ভেসে চলল একা। বাকিরা সেই দৃশ্য দেখল চুপচাপ। কেউ কেউ চোখের জল ফেলল বটে, কিন্তু বেহুলার জীবনের অধিকার বিষয়ে একটি কথাও কইল না।

সেই থেকে মেয়েরা কলার ভেলায় চেপে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।

আজ ঝুমু-র বেহুলার কথা বড় মনে পড়ছে। আজ তার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। ছেড়ে আসা কী ভীষণ কঠিন! আজন্ম অধিকার, আশৈশব ভালবাসা, অভ্যাস, ছোট ছোট প্রিয় বস্তুগুলি, সে বিছানার নরম পরিচিত কোল, ঘরের গন্ধ, স্নানঘরের ভিজে ভিজে একান্ত দেওয়ালে কাল্পনিক আঁকিবুকি! সব কাজ। সব অধিকার। সবার সকল প্রিয়কর্ম সমাধা করার অপূর্ব তৃপ্তি ও পুলক!

আর মানুষেরা। সেইসব মানুষেরা! যারা প্রিয়! আপনার। যাদের শ্বাসের সঙ্গে শ্বাস মিলে গেছে এতকাল। যাদের সমস্ত দুর্বলতা জানা হয়ে আছে। যাদের কাছে বদহজম, চোঁয়া ঢেকুর বা আলসেমি— কোনও কিছুর জন্যই লজ্জিত হতে হয় না!

সব কিছু ছেড়ে আসা। সব লোক, সব বস্তু। এবং, নতুন, অচেনা কিছু লোককে আপনার করে নেওয়ার নির্দয় পাথুরে রাস্তা!

ঝিরি তাকে ধরে কাঁদল। ঝিরির মতো মেয়ে। খরতর। বেপরোয়া। স্বাধীন মেয়ের সমস্ত বৈশিষ্ট্যে অটল বিশ্বাসী।

আর সে? টোপর?

একবারও আসেনি বিয়ের আসরে। একবার দাঁড়ায়নি বারান্দায়। টোপর নিজেকে ঢেকে রেখেছিল। কী হবে ওর? কে দেখবে? জ্বর সারেনি ভাল করে। রক্তের নানাবিধ পরীক্ষা। আজ তার ফল জানা যাবে। সে ঝিরিকে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘টোপরকে দেখিস।’

‘আমার তোর মতো করে দেখাশুনো করার ক্ষমতা নেই দিদি। টোপর, প্রবীরকা, বাবা, আমি— আমরা কেউই শিখিনি কী করে আগলাতে হয়, দেখাশোনা করতে হয়, আমরা শুধু পেতে শিখেছি। এরপর যার যার তার তার।’

ঝুমু-র কান্না পাচ্ছে। সে রোধ করতে পারছে না। প্রবীর বললেন, ‘মা, তুই যে আমাদের সকলের মা ছিলি!’

‘তোকে ছাড়া শূন্য লাগবে ঘর।’ জ্যোতির্ময় বললেন।

মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় কাঁদবে, এ নিয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই। না কাঁদলেই অবাক ব্যাপার! দেখো, কাঁদল না, কী মেয়ে! একদম তৈরি! তৈরি কীসের জন্য? ন্যাকা! জানো না! বিয়ে করে কী জন্য? মেয়ে শোয়ার জন্য ব্যাকুল! একটি মেয়ে কামিনী। তার কাঁদায় কাম, হাসায় কাম, বসায় ভালবাসায় কাম, চক্ষে কাম, নখরে কাম, সাজায় কামযামিনী।

‘কাঁদছ কেন? এই যে! ঝুমুর! এত কাঁদার কী আছে? এই তো গড়িয়া আর লেক গার্ডেন্স! মেট্রোয় উঠলেই বাপের বাড়ি চলে যাবে!’

‘তেমন কচিও তো নয়। দিব্যি মানিয়ে নেবে।’

‘তোমার অনেক গুণগাথা শুনেছি। সংসারে সব কাজই পারো। এমন মেয়েই এ বাড়িতে দরকার। আজকাল তো মেয়েরা কুটোটি নাড়তে পারে না। আমার ছেলের বউ, বুঝলে, মন্টি, বলে, মা— কালোজিরে কোনটা? হাহা হো হো হেহে হিহি!’

‘মন্টি যেন কী চাকরি করে?’

‘চাকরি ভাল করে। এম বি এ করেছে তো। তাই বলে কালোজিরে…আমরাও তো এম এ বিএ করেছি। মা তাই বলে ঠুঁটো জগন্নাথ করেননি আমাকে। সব পারতাম। কল্যাণী তো লাকি। কাজ জানা বউ পেয়েছে।’

‘শান্তও তো। মুখখানা মিষ্টি। কী চুল দেখো মাথায়! হ্যাঁ গো বউ, মাথায় কী তেল দাও!’

‘তুই থাম! কলপ করে তো চুলের বারোটা সাত বাজিয়েছিস। ও কি আর গজাবে!’

‘আমি বাপু সাদা চুল নিয়ে ঘুরতে পারব না। সে তোরা যাই বল।’

‘এখানে কে আছে বল যে কলপ করে না? ভাল জায়গায় করালে কোনও ক্ষতি নেই।’

‘আজকাল অল্পবয়সিদেরও চুল পাকে।’

‘আমাদেরও এমন কী বয়স হয়েছে?’

‘তাই নাকি? ওই জন্যই তোর বরের মুখে সারাক্ষণ হাসি।’

‘চুপ কর, নতুন বউয়ের সামনে…’

‘নতুন বউ তো কী! ও তো এখন আমাদেরই।’

‘না। ও কল্যাণীদির। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবে। ছেলেটাকে দরকচা বানিয়েছে। আমরা নিমন্ত্রিত অতিথি। বিয়ের কোনও কাজে আমাদের হাত লাগাতে দিল? সব করল গুরুভগিনীরা। ওরাই আত্মীয়। এই বউ আমাদের কেউ নয়। অলকদা তো অর্ধপাগল। এবার বউটার পালা।’

‘চুপ কর, বউ শুনবে, কল্যাণী শুনলে ধুইয়ে দেবে তোকে।’

‘যা তো! ও কী ধোয়াবে? ওর সব জানি! আমি ছেড়ে দেব? বউ শুনবে না! ও অন্য জগতে আছে। কল্যাণী কী বলে জানিস? ছেলের বিয়ে দিয়েছি, কারণ নাতি চাই। আমি মহিলা সমিতি করা মানুষ, বললাম— আগে তো ছেলেবউয়ের প্রেম জমুক— তারপর নাতি! বলে-দাম্পত্যে প্রেম হয় নাকি?’

‘তো কী হয়?’

‘যা যা হওয়া সম্ভব। শুধু প্রেম বাদ। কল্যাণী নাতি চায়। বলে, এই বাড়ি, এই সম্পত্তি, কার জন্য রেখে যাব। বললাম— নাতিই চাই? নাতনি হলে হবে না? বলে, মেয়েরা জন্মায় পর হওয়ার জন্য। আর মেয়ে মানেই ঝামেলা। ও নাকি এক শাশ্বতীকে নিয়েই জ্বলেপুড়ে মরছে।’

‘শাশ্বতীর ব্যাপারটা কি সত্যি?’

‘পুরোপুরি। আমার মেয়ে হলে আমি ফিরিয়ে আনতাম। এরা যেন পাষাণ।’

‘কী বলছ গো তোমরা আমার নামে?’

‘তোর কপালের কথা বলছি। আবার কী!’

‘ও নিয়ে আর ভেবে কী হবে তনুমাসি? আমি মরলে মাঝে মাঝে অ্যালবাম খুলে ছবি দেখো।’

‘চুপ কর। হ্যাঁ রে, কাল্টু কি একটুও পালটায়নি?’

‘পালটাতে দেবে না ওরা মাসি। অসুখকে অসুখ বলে স্বীকার না করলে রোগ সারে বলো?’

‘সত্যি রে, তোর কথা ভাবলে ভেতরটা কেমন করে। আমার পুপু বলে, লালদির জীবনটা খারাপ করে দিল কালুমাসি। ওকে ফিরিয়ে আনা উচিত ছিল।’

‘যা কপালে আছে হবে মাসি। এই যে মেয়েটাকে আনল বিয়ে দিয়ে, ওর কী হবে?’

‘চুপ কর। শুনবে।’

‘জানবে তো সবই একদিন।’

‘কে জানে, আমাদের দীপের মন বদলে যেতেও পারে।’

‘দাদাকে তোমরা চেনো না মাসি।’

টুকরো টুকরো কথা ঝুমু-র কানে আসছে। কোনও কথাতেই তার মন নেই। প্রতিটি পরিবারেই কিছু না কিছু বিক্ষোভ বেদনার ইতিহাস থাকে। তার প্রতি ঝুমু-র আগ্রহ নেই। মন পড়ে আছে টোপরের রক্ত পরীক্ষার ফলাফলে। কী এল? খারাপ কিছু এল না তো?

মহিলারা একে একে বিদায় নিলেন। শাশ্বতী প্রত্যেকের খোঁজ করতে লাগল। কোন মাসি খেলেন না, কোন পিসি গাড়ি আনতে পারেননি, কোন মাইমা রাতের ওষুধ ভুলেছেন।

ঝুমু তার নতুন শাড়ির ভারমুক্ত হতে চাইছিল। শাশ্বতী এসে বলল, ‘চলো, খেয়ে আসি।’

‘আমি কিছু খাব না আর।’

‘কেন গো?’

‘অনেক মিষ্টি খেয়েছি। খিদে নেই।’

‘আমি খেয়ে আসি তবে। তোমার সঙ্গে শোবো। ততক্ষণ আরও কিছু কেঁদে নাও। ওই কাঠের আলমারিতে তোমার জিনিসপত্র আছে। চাইলে স্নান করতে পারো। ম্যাক্সিও আছে। পরে নাও। আমিই শুধু থাকব।’

শাশ্বতী চলে যেতেই ঝুমু ব্যাগ থেকে ছোট্ট মুঠোভাষখানি বার করে বিদ্যুতের সংযোগ পথ খুঁজে লাগল। যন্ত্রটি শক্তি বাহী করে তুলতে হবে। ঝুমু তাকে গালে ছোঁয়াল। টোপরের দেওয়া, যেন এ মুহূর্তে টোপর স্বয়ং। এবার বলতে হয়নি আর, টোপর ঝিরিকেও এ যন্ত্র উপহার দিয়েছে।

আজই এই গৃহে সে প্রথম এল। সম্ভবত এই ঘরেই সে থাকবে। অথচ তার মনে হচ্ছে সে কতকাল নিজের বাড়ির লোকের দেখা পায়নি। সে টোপরকে ফোন করল।

‘বলো ঝুমু।’

‘কেমন আছিস টোপর? জ্বর বেড়েছে?’

‘বেড়েছিল। এখন ঘাম।’

‘রক্তের কী রিপোর্ট?’

‘সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। চারিদিকে ডেঙ্গি হচ্ছে, তমালকাকা বললেন সাবধানে থাকতে। আমি তো জানি, রক্তে কিছু পাওয়া যাবে না।’

‘ডেঙ্গি হলে ধরা পড়ত।’

‘প্রথমবার ধরা না-ও পড়তে পারে।’

‘আমার ভাল লাগছে না।’

‘কেন?’

‘তোর জ্বর।’

‘তুমি চলে যাবে বলেই আমার জ্বর এসেছে গো ঝুমু।’

‘সেরে ওঠ সোনা।’

‘আমার কিছু হয়নি। ও আপনি সেরে যাবে। তুমি কেমন আছ বলো।’

‘জানি না রে টোপর। খুব কান্না পাচ্ছে।’

‘কান্না পেলে কেঁদে নিয়ো। মন হালকা হবে।’

‘ওষুধপত্র ঠিকমতো খাবি। রান্নাঘরে নিজে কিছু করতে যাস না। কেমন তো টোপর?’

‘যাব না ঝুমু। তুমিও কিন্তু দোপাট্টা বা আঁচল দিয়ে জ্বলন্ত উনুন থেকে কিছু নামাতে যাবে না। দোপাট্টা নেবেই না রান্নাঘরে। চাদরও নয়।’

‘আর শোন, ব্যায়াম নিয়মিত করবি। আমি বলি কী, তুই সারাক্ষণের জন্য কাউকে রেখে নে। সবাই যে-যার কাজে চলে যাবে। তুই যে একেবারে একা হয়ে যাবি। আমার ভাবনা হচ্ছে।’

‘আমার পায়ে জোর না থাকতে পারে, মনের জোর আছে। তুমি জানো।’

‘তোর কাছে সর্বক্ষণ কেউ আছে জানলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি।’

ঘরে প্রবেশ করলেন কল্যাণী।

‘এত আহ্লাদের কথা কার সঙ্গে হচ্ছে?’

‘আসুন…’

‘আসুন আবার কী। আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমাকেই আসতে বলছ!’

‘এক মিনিট, হ্যাঁ?… টোপর, আমি রাখি রে। যা বললাম ভেবে দেখিস। কাল আবার ফোন করব। কাল আবার ব্লাড নেবে? প্লেটলেট কাউন্ট? ঠিক আছে। ভাল করে খাবি কিন্তু। হ্যাঁ। খাবি। রাত জাগিস না, হ্যাঁ?’

‘লাল বলছিল, তুমি নাকি রাতে খাবে না। তাই দেখতে এলাম। তা, তোমার আরও যদি কথা থাকে, সেরে নাও।’

‘না না। আপনি বসুন। টোপরটা অসুস্থ, তাই।’

‘তোমার সেই পাড়াতুতো ভাই?’

‘আমরা ওকে নিজের ভাই বলেই মনে করি।’

‘কী হয়েছে?’

‘খুব জ্বর। ডেঙ্গি হতে পারে। ডাক্তার বলেছেন।’

‘অ। তা তুমি খাবে না কেন?’

‘খিদে নেই।’

‘দেখো বাপু। পরে যেন বাইরে বোলো না শ্বশুরবাড়িতে খেতে দেয়নি।’

‘এ মা ছিছি!’

কল্যাণী চলে গেলেন। ঝুমু ঝিরিকে ফোন করল। কালই সাবার সঙ্গে দেখা হবে। তবু ঝুমুর মনে হতে লাগল ছুটে চলে যায় নিজের ঘরটিতে। সে স্নানঘরে দোর দিয়ে খানিক কেঁদে নিল আবার। জল গরম করে স্নান করল ভালরকম। আয়নায় দেখল নিজেকে। কপালে সিঁথিতে সিঁদুরের লালে সে কেমন বদলে গিয়েছে। তার গা শিরশির করে উঠল। কাল ফুলশয্যা। এমন একজনের সঙ্গে কাল রাতে তাকে থাকতে হবে, যে চোখ তুলে তাকে দেখেনি পর্যন্ত। মাল্য বিনিময়ের সময়, শুভদৃষ্টির সময় সে তবু সলাজ দৃষ্টি দিয়েছিল মানুষটির দিকে, কিন্তু বিনিময় হল না। গোপন ইঙ্গিতে ঝুমু বুঝে যাচ্ছে, সে আকাঙ্ক্ষিত নয়। কাম্য নয়। কেমন করে একজন পুরুষের কাছে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলতে হয় ঝুমু জানে না। সে অকস্মাৎ শিরদাঁড়া টান করে দাঁড়াল দর্পণের প্রতিবিম্ব সমেত। সন্দীপন নামে মানুষটির অনুগ্রহ পেতে সে কি খুব ব্যগ্র হবে? জীবন হঠাৎ এমন জটিল কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি ঠেলে দেয়, যার উত্তর হতে পারে ভারসাম্যহীন। আজকের হ্যাঁ বলা কাল না হতে পারে।

ঝুমু কি তা জানে?

কাল সে যা না করে এসেছে, আগামী সকাল তাকে সেদিকেই টেনে নেবে কিনা, জানে কি সে? কেউ জানে? মহাযজ্ঞ নিরন্তর স্ফুলিঙ্গ ওড়ায়। সেইসব, কোথায় কখন ধরাবে আগুন, কে জানে! মাথার সিঁদুরে কারও নাম লিখিত থাকে না। মূর্খ পুরুষ, তুমি ভাবো, দু’আঙুলে নারী কিনে নেবে? তুমি ভাবো, সিঁদুরের দাগ মাথার খুলির তলা দিয়ে চলে যায় মস্তিষ্কে হৃদয়ে? জেনে রেখো, প্রেমে ও প্রজ্ঞানে কোনও মেয়ে সতীত্বশৃঙ্খলে বাঁধা নয়। তুমি যদি না চাও আমিও চাব না। না যদি দাও ভালবাসা, আমি পাশাপাশি শোয়াব খেয়াল। আমি সাধারণ মেয়ে। ধুলোবালি মেখে স্নান, রাতের অন্ধকার আমার কাজল। কালো মেঘ দিয়ে গড়া চুল। ঠোঁটে লেগে থাকে কষ, হাসি, মাদক ওষুধ। দুই বুক দুধে ভরা। যোনি অপূর্ব মৃত্তিকা দিয়ে গড়া। বুকের চাতালে আমি ইচ্ছাকে স্বদুগ্ধ খাওয়াই।

ঝুমু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। অচেনা মানুষ বিয়ে করা মানে অচেনার ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ নয়। এই কালে মেয়েরা কি অরক্ষণীয়া হয়? শব্দটি হয়েছে বিস্মৃতপ্রায়। কিন্তু তার ভাব? ব্যঞ্জনা? সংসারে ভারসাম্য বিপন্ন হয়, ব্যাহত হয় স্থিতি, যদি ছাব্বিশোর্ধ্ব কন্যে থাকে ঘরে। অবিবাহিত। যতই সে পণ্ডিতানী হোক, যতই সুফলা ও শস্যশালিনী, এমন গভীর সংস্কার, মেয়ের গলায় বরমাল্য না যদি দোলে, বাপের আত্মগ্লানি খলখল করে ওঠে, মায়ের গভীর বিষাদ রোগ ধরে, ভাইয়েরা আপনার বিবাহের পথে তাকে মনে করে কাঁটা— যে কাঁটা বছর বছর বোন মহাপ্রেমে দিয়ে আসে যমের দুয়ারে ভ্রাতৃগণে আয়ু রবে বলে। বোনের পরেও যদি থাকে কোনও ছোটবোন, তার দশা নিরাপত্তাহীন। অতএব বিবাহযোগ্যা তুমি যাও, চলে যাও, ঘর বর পাও, এ সংসারে ঠাঁই নাই তব। তোমার চাহিদা গৌণ। মুখ্য হল পরিপার্শ্ব কী কী চায়। একা তুমি কে হে?

তা হলে দাঁড়ায় কী? এত দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে মেয়েদের বিকাশের কাল ছাব্বিশ বছর। গৌরীদান থেকে পথ হেঁটে হেঁটে এই বরাদ্দ বেড়েছে।

অতএব ঝুমুরের প্রয়োজন ছিল একখানা হস্তান্তরযজ্ঞ থেকে ফেরা। পেয়ে গেল। আর কিবা চাই!

ছাতে গর্জন করছে দাপাদাপি করছে বাঁটুল। ঝুমু এখনও দেখেনি তাকে। আটক থাকায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।

নীচ থেকে চড়া স্বরে তর্ক ভেসে আসছে। নারী-পুরুষ উভয়েরই কণ্ঠ আছে। ঝুমু তার দীর্ঘ ঘন চুল আঁচড়ালো। পুরো ভেজায়নি, পাছে ঠাণ্ডা লেগে যায়। বসন্ত ফুলের রেণুর নীচে ঢেকে রাখে রোগজর্জরতা। বীজাণুর ভরা ঝাঁপি!

বিছানাটি ফুলে ফুলে সাজানো। গোলাপ ও রজনীগন্ধার জালে নতুন শয্যা ছত্রী সগৌরবে ঋজু। গোলাপি বেনারসি পরে জড়োসড়ো বসে আছে ঝুমু। কে আসছে, কে যাচ্ছে, সবই স্বপ্নের মতো। আজ শাশ্বতী নজরকাড়া রূপসী হয়ে আছে। তার বর আসেনি? শ্বশুরবাড়ির কেউ? সম্পর্ক নেই। শুধু লাল জেদ করে আসে।

লাল! অদ্ভুত নাম!

সব্বাই চলে গেলে ঝুমু গা ধুলো। একটি নতুন তাঁতের শাড়ি। কীসব মিষ্টি খাওয়া-দাওয়া নিয়ম। চুল দিয়ে স্বামীর পা মুছিয়ে দাও। আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দাও মুখ। পতি দেবতা। স্বামী প্রভু। রীতি মান্য করতে হয় ঝমর ঝমর শাঁখা নোয়া পলা পরে। নইলে অকল্যাণ! কার অকল্যাণ? কে তার রক্ষাকারী?

দোর টেনে চলে গেল লাল। ফুলশয্যা ঘিরে যেমন হইচই দেখেছে ঝুমু, হল না সেরকম। সন্দীপন গম্ভীর পুরুষ। হাসে কম। কথা বলে আরও কম। কেশবিরলতায় তার গাম্ভীর্য মানায়। সে ঘরের একধারে রাখা সোফায় বসল। আর প্রথম প্রাণীটিকে দেখতে পেল ঝুমু। বাঁটুল। চারপায়ের নখরে ঝমঝম শব্দ তুলে টগবগ করতে করতে সে প্রবেশ করল ঘরে। নাক দিয়ে ঠেলে সে অনায়াসে দরজা খোলে। ব্রিটানিয়া মারি বিস্কিটের মতো রং। ঘাড়ে ও লেজে ঝাঁকড়া চুল। কান অল্প ঝুলে আছে। ঝুমুর মনে হল, ঘরে একটা ঘোড়া ঢুকে পড়েছে। গম্ভীর স্বরে বাঁটুল ডাকল ঘ্রাউ! চোখ ঝুমুর দিকে! বন্য! তীব্র! কয়েক পা এগিয়ে এল। নাকের ডগা কাঁপিয়ে গন্ধ শুঁকল। ঝুমু সিঁটিয়ে বসে আছে। ঘ্রাউ ঘ্রাউ। বাঁটুল আবার ডাকল।

‘বাঁটুল! ডোন্ট বিহেভ লাইক এ বিচ।’

‘ঘ্রাউ!’

‘বাঁটুল, উনি এখন থেকে এবাড়িতেই থাকবেন। বুঝেছ? এসো। এদিকে এসো।’

ঝুমু স্পষ্ট দেখল বাঁটুলের মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল। চোখ থেকে বন্যতা সরে গিয়ে নরম সলাজ চাহনি। হালকা নাচের ছন্দে সে সন্দীপনের বুকের কাছে মুখ নিয়ে দাঁড়াল। লেজটা অল্প অল্প দোলাচ্ছে। সে দোলা কখনও পথের নেড়ি কুকুরের মতো নয়। তাতে আপ্লুতির উত্তাল নড়ন নেই। আছে গভীর আনন্দমগ্ন দোল। পাতলা লাল জিভ বার করে সে সন্দীপনের ঠোঁট চাটল, গাল চাটল, দু’পায়ের মধ্যখানে, যেখানে পুরুষত্ব ধারণ করা হয় বলে মনে করে পুরুষেরা -সেখানে নাক ঘষতে লাগল।

সন্দীপন বাঁটুলকে সাপটে নিচ্ছে। মুখে চুমু খাচ্ছে। সেই চুম্বনদৃশ্য জীবপ্রেম ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে আরও বহু দূর!

‘কী হয়েছে, উঁ? কী চাই? মাই সুইটহার্ট! মাই ডার্লিং!’

‘কুঁঃ কুঁঃ কুঁঃ! আঁউ!’

‘আমি তো তোমারই বাঁটুলিয়া, বুঁটুসোনা! তোমাকে আমি চোম্পু করে দেব তো! তোমাকে দিলখোশ করে দেব। আমার নূরজাহান বাঁটুলেশ্বরী!’

‘উঁ! উঁ! উঁ! উঁ! আ!’

বাঁটুল সবল দুটি পা তুলে দিয়েছে ঝুমুর সদ্যপ্রাপ্ত বরের কাঁধে। অস্থির লেহন করছে মুখ, বুক, গলা, ঘাড়। শব্দ করছে উঁ উঁ উঁ! আদরের শব্দ! যেন কুকুরের লোমশ চামড়ায় গড়া ওভারকোট পরে সন্দীপনের সতৃষ্ণ প্রেমিকা!

ঝুমুর গা শিউরে উঠছে। সে আড়চোখে দেখছে আর আঁচল প্যাঁচাচ্ছে আঙুলে। তার ইচ্ছে করছে, এখুনি ফোন করে টোপরকে, ঝিরিকে, ঝাড়ু নমিতাকে বলে এই দৃশ্যের কথা! সে অজ্ঞ বা অপরিণত নয়। ফুলশয্যার রাত কতখানি অর্থবহ সে জানে। এই রাতে দাম্পত্যের সূচনা। এই রাতে প্রেম অথবা অপ্রেমের সূত্রপাত। ওই লোক যদি ঝুমুকে চুমু খেতে চায়! ওই মুখে! অসম্ভব! ঝুমু দেবে না! তার মনে হচ্ছে, বাঁটুলের চুম্বন তার ঠোঁটে মিশে যাবে! সে কখনও পশুপালন করেনি। এই তন্ময় আদর মানুষে-পশুতে, সে অভ্যস্ত নয়। সে কি এক অসরল মেয়ে? মন্দমনা?

সময় যাচ্ছে। ঘ্রাউ, ভুক্, উঁইই, ওঁ ওঁ নানান শব্দ করছে বাঁটুল। তার সারা শরীরে সন্দীপনের আঙুল খেলছে। ঝুমু, কিছুক্ষণ দেখার পর, একটু বেশিই শব্দ করে হাই তুলে ফেলল।

সন্দীপনের মনে পড়ল ঝুমুরের কথা। সে বাঁটুলের গলায় আদর করতে করতে বলল— ঘুম পাচ্ছে! পাবেই তো।

‘না না, ঠিক আছে।’

‘আমার তোমাকে বিশেষ কিছু বলার নেই। মশারিটা টাঙিয়ে নেওয়া ভাল। মশা আছে।’

‘আমার ঘুম আসবে না। মশারির অভ্যাস নেই।’

‘মশার তেল জ্বেলে দিই তবে।’

‘ঠিক আছে।’

‘শুয়ে পড়ো।’

‘আপনি?’

‘এত ফুলের মধ্যে শুতে আমার গা ঘিনঘিন করে।’

‘কেন?’

‘অত প্রশ্ন কোরো না। ফুলে পোকা থাকে। কৃত্রিম সুগন্ধ! আমি কৃত্রিমতা ভালবাসি না।’

‘অকৃত্রিম খুব কম জিনিসই আছে এ জগতে। বাজারি ফুল বিশুদ্ধ থাকে না ঠিকই, তবে ঈশ্বরকে এই ফুলই দেওয়া হয়।’

‘ঈশ্বরের কাছে পৌঁছয় কেবল ভক্তি।’

‘প্রশ্ন করতে বারণ করছেন। জিজ্ঞাসা জাগলে কী করব?’

‘বেশি প্রশ্ন করতে বারণ করেছি। নিজের মতো থাকো। আমাকেও বেশি বিরক্ত কোরো না।’

‘বিরক্ত কেন করব?’

‘বলে রাখলাম। তোমার খরচের ভার ধর্মতঃ আমার। ওই আলমারিতে টাকা আছে। চাবি গোপন রেখো। যখন যা লাগে নিয়ে নেবে। কৈফিয়ত দরকার নেই।’

ঝুমু ফুলগুলি পরিষ্কার করল, রাখল একটি সেলোফেন প্যাকে। শুয়ে পড়ে তার মনে হল, এই ফুল সরিয়ে শয্যা সন্দীপনের উপযুক্ত করে তোলা কি আহ্বান হল? সে কেবল স্বভাবসিদ্ধভাবে সন্দীপনের অসুবিধা দূর করতে চেয়েছিল। কে জানে সে এর কোন ব্যাখ্যা করবে। তবু একপক্ষে স্বস্তি, লোকটা গোড়া থেকে গায়ে হামলে পড়ছে না। সে চোখ বুঁজে রইল। খানিক পর বড় আলোটি নিবে গেল। কেউ শুয়ে পড়ল পাশে, দূরত্ব রেখে। গদিখানা নড়ে উঠল। এবার আরও জোরে। শুঁক শুঁক। ঘ্যাস ঘ্যাস ঘ্যাস। বাঁটুলের শ্বাসের শব্দ। ঝুমু কুকুরের গন্ধ পেল। চোখ মেলে দেখল, বাঁটুল তার সারা গা শুঁকছে। সে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল-আঁঃ আঁঃ আঁঃ!

‘ভয় নেই। কিছু করবে না।’

‘ওকে সরান।’

‘ওকে গন্ধ নিতে দাও। না হলে রাতে বিপদে পড়তে পারো।’

‘ওমাঃ!’

শোঁকাশুঁকি শেষে সে থেবড়ে বসে পড়ল দু’জনের মাঝে।

ঝুমুর গলা শুকনো। সে বলল, ‘জল খাব।’

‘টেবিলে জল আছে।’

ঝুমু উঠতে পারছে না। নড়লে যদি ঘ্যাক করে কামড়ে দেয়!

‘কিছু বলবে না আর।’

‘ও কি এখানেই থাকবে সারা রাত!’

‘আমার সঙ্গে ঘুমোন ওর অভ্যাস।’

‘আমার অভ্যাস নেই।’

‘অভ্যাস করতে হবে। তোমার জন্য আলাদা ঘর বরাদ্দ করা যাবে না।’

সন্দীপনের কণ্ঠ নির্মম, শীতল। বড় অবহেলা সেই স্বরে। যেন ঝুমুকে বিবাহ করে, একখানি ঘর দিয়ে সে বড় ঋণদাতা, অনুগ্রহকারী। আলাদা ঘর বরাদ্দ করা যাবে না। যেন অমোঘ আদেশ। যেন ঝুমু এক ঘরভিখারিণী। সিঁদুরকাঙাল। কোনওখানে তার ঠাঁই নেই। অরক্ষণীয়া মেয়ে, বাপ তার নিরাপদ সামাজিক প্রতিষ্ঠা খরিদ করে দূরের মানুষ।

সে কী করতে পারে? কুকুরের সঙ্গে সহবাস অনভ্যাসে সে কি উৎপীড়িত বোধ করে চ্যাঁচাবে উদ্দাম?

তুলকালাম করে ফেলবে এই বলে যে সে এমন শয়ন নিকৃষ্ট ও অসহনীয় মনে করে। দু’জন মানুষের সম্পর্ক কেনাবেচার মধ্যে একটি কুকুর তৌল হওয়া সমীচীন নয়। গৃহপালিত প্রাণী থাকতেই পারে। কিন্তু এইভাবে, যে সে সম্পর্কের সশস্ত্র কোটাল। এই নিয়ে মুখর প্রতিবাদ করবে কি ঝুমু?

অসম্ভব। ঝুমু তা পারে না। তবে ঝুমু কী পারে? চুল ঝাড়ে। ফুল পাড়ে। সে সংকুচিত হয়ে ওঠে। আতঙ্কিতও। অকস্মাৎ মনে হয়, টোপরের অকপট নিবেদন ঠেলে দিয়ে সে এক মস্ত ভুল করে বসে আছে! পালাতে চেয়ে অন্ধনিশানায় ছুটে গেছে। তার চেয়ে ঝিরি অনেক অনেক বেশি চৌখস। অনেক বেশি স্পষ্ট ও বুদ্ধিধারিণী। তার চেয়ে এমনকী সামান্য শিক্ষিত ঝাড়ুদারনি নমিতাও স্থিতধী। সমঝদার।

এমনকী ঝিরি ও নমিতা দু’জনেই সমাজের সম্পূর্ণ পৃথক সামাজিক অবস্থানে থেকেও নিজস্ব অধিকার ও সম্মানবোধের ক্ষেত্রে সচেতন। দৃঢ়চিত্ত। বয়সের পাঁচ বৎসর ব্যবধান আঙ্কিক দূরত্ব ছাপিয়ে ঝিরি ও নমিকে ঝুমুর চেয়ে বস্তুত বছর পঞ্চাশ এগিয়ে দিয়েছে।

ঝুমুর সংকুচিত আত্মার ভিতর থেকে কথা উঠে এল। তার প্রথম সরব প্রতিবাদ। মৃদু। তবু অর্থবহ।

‘আপনি আশ্চর্য কথা বলছেন। একটা অচেনা কুকুরের পাশে শুয়ে কেউ ঘুমোতে পারে?’

‘ওকে কুকুর বলবে না। আজ প্রথমদিন। মাপ করে দিলাম।’

ঝুমু উঠল। জল খেল। বালিশ নিল। দেরাজ খুলে চাদর নিল। খাট ও তার পেছনে কাঠের আলমারি। মাঝে একফালি জায়গা। সে চাদর পাতল। নিল তার বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্বে দেওয়া নতুন কম্বল। তত্ত্বে আরও কত কী! কানাই সামন্ত সরু গলির মহিলারা নমিতার নেতৃত্বে সাজিয়েছে চমৎকার! ধুতির নৌকা। বেনারসি পরা কনে পুতুল। প্রণামী শাড়ির বাহারি আঁচলে কুচি করে পাখি, মাছ, প্রজাপতি! মিষ্টিও কতরকম! আয়োজনের ত্রুটি নেই। এই ভূমিশয্যা তার কাম্য ছিল না। তার প্রাপ্যও নয়। সে নিঃশব্দে হু হু কাঁদতে লাগল। সরল মেয়েটা বুঝতেও পারল না শয্যা প্রত্যাখ্যান করে স্বৈরাচারী উদ্ধত পুরুষতন্ত্রের দিকে সে কতখানি থুতু ঢেলে দিল!

‘জয়ীপিসি কি জানতেন না সন্দীপন কুকুর নিয়ে শোয়?’ টোপর বলল।

ঝিরি বলল, ‘জানত। ভেবেছিল বিয়ের পর কুকুরের জায়গায় বউকে ঠিকই শোয়াবে।’

টোপরের মুখ রাগে লাল। সে বলল, ‘তুমি কি ও বাড়ির বড়দের জানিয়েছ?’

‘এখনও কিছু বলিনি। আর বলবই বা কী! সবাই জানেন, আমাদের দু’জনের মাঝে বাঁটুলের কোলবালিশ!’

‘দিদি বলবে? দিদিকে তুই চিনিস না টোপর?’ ঝিরি রাগতভাবে বলল।

‘এভাবে কেউ একঘরে থাকতে পারে?’

‘স্বামী-স্ত্রীর একটা স্বাভাবিক জীবনও তো আছে। তার মধ্যে একটা ধামসা কুকুর ঢুকে পড়লে চলবে কী করে!’

‘জ্যোতিকাকা কী বলছেন?’

‘মানিয়ে নিতে বলছেন। বিয়ের পর মেয়েদের অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। সেই চেষ্টাই করতে বলছেন।’

‘চমৎকার! ঝিরি, এ বিষয়ে বাইরে থেকে আমাদের কিছুই করার নেই। যতক্ষণ না তোর দিদি নিজে কোনও উদ্যোগ নেবে, আমরা কী করব?’

‘আমার বাবাকে জানাবার কথা, বড়পিসিকে জানাবার কথা, জানালাম। আর কী করব?’

‘তা জয়ীপিসির কী পরামর্শ?’

‘একই। মানিয়ে নাও। এত ভাল ছেলে! ভক্তি বান! ভাল চাকরি! অত বড় বাড়ি, প্রচুর বিষয়সম্পত্তি। ঠিক আছে। লাজুক ছেলে। চরিত্রবান। কখনও মেয়েদের সঙ্গে মেশেনি। লজ্জায় এমন করছে। ক’দিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বাবা বলল, ‘অত খরচ করে বিয়ে দিয়েছি। একটা কুকুরের জন্য তো বিবাদ করতে পারব না। বাড়ির পোষা জানোয়ারের প্রতি ওরকম টান অনেকের থাকে। মানিয়ে নাও।’ তা এই ন’দিন মানিয়ে আমি নিয়েছি। বাবার খরচ বিফলে যেতে দেব কেন? বাঁটুল এখন আমায় চেনে। সত্যি বলব? আমার কুকুর ভয় লাগে! কখনও তো পুষিনি। হাঁ করলে ওই তীক্ষ্ণ দাঁত। মনে হয়, হঠাৎ যদি টুঁটি চেপে ধরে! মরে যাব! তবে সবই অভ্যাস! আমার সয়ে যাবে। কিন্তু ও ওর জায়গা ছাড়বে না। তাই আমিই জায়গা ছেড়ে বসে আছি।’

‘আমি জানি না ঝিরি, তোর দিদি কোন দিকে যাচ্ছে।’ টোপর বলল।

‘আমিও জানি না।’ ঝিরির বিষণ্ণ জবাব।

কেউই কি জানে? ঝুমু নিজেও জানে না। সন্দীপনের সঙ্গে এখনও তার ভাববিনিময় হয়নি। সে বিস্মিত। শরীরের চাহিদাও তো থাকে মানুষের। সন্দীপন কি শরীরে অক্ষম? শীতল? ঝিরির উদ্যোগে কিছু প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়েছিল সন্দীপন ও ঝুমু-র। শিক্ষিত সমাজের আধুনিক মনস্করা সম্বন্ধের বিয়ের জন্য এই আধুনিক ব্যবস্থার পক্ষে! চিকিত্সকের শংসাপত্র অনুযায়ী সন্দীপনের কোনও ত্রুটি নেই। তা হলে?

ঝুমু তল পাবার চেষ্টা করছে শুধু। মাস গেল। এর মধ্যে ঝুমু আর বাপের বাড়ি যায়নি। কোথায় গিয়েছে? কোথাও না। তার জীবনে এখনও কামরাঙার কুঁড়ি আসেনি। মধুচন্দ্রিমার চাঁদ ওঠেনি। সে রুটি রাঁধে, চুল বাঁধে, কচু কাটে, শাড়ি আঁটে। প্রকাশ্যে ম্যাক্সি পরা নিষেধ। সালোয়ার কামিজ মানা। কী যায় আসে। শাড়িতে শাড়িতে ভরা আলমারি। প্রায়ই নতুন শাড়ি পরে। কেউ চেয়েও দেখে না। সে আপনি পরে সানন্দে আয়নার কাছে দাঁড়ায়। টোপরকে ফোন করে। প্রতিদিন। বারবার। কী করছিস টোপর? আজ একটা শাড়ি পরলাম। ধূপছায়া রং। গোলাপি পাড়। নিজের ছবি নিজেই তুলতে একটুও ইচ্ছা নেই। তাই লেখে। কফি খেলি? ক’বার? রান্না ভাল করেছিল প্রতিমা? কী কী রাঁধল রে? তোর কাজ কেমন হচ্ছে? পারছিস তো? প্রবীরকাকা নিয়মিত হাইপ্রেশারের ওষুধ খাচ্ছেন তো?

রান্নাঘরে টোপরকে মনে পড়ে তার। সে আঁচলখানি কোমরে পেঁচিয়ে নেয়। পাছে আগুন লেগে মরে-এই ভয় টোপরের। মরবে না সে। টোপরের শুধু ঝুমু আর বাবা-ঝুমু কি তা জানে না? তার সবটুকু ভাল থাকা টোপরের জন্যই তো।

ঝুমু আলুপরোটা, ঝুমু কুকুরের জন্য মাংস সেদ্ধ, ঝুমু শ্বশুরের হরলিকস, ঝুমু শাশুড়ির আধকপালে রোগে উপশম, ঝুমু পটলের পেট থেকে শাঁস খুঁচিয়ে তুলে পুর রেঁধে পটলের পেটে পুরে তেলে ঝালে কষা কষা দোলমা, ঝুমু, কপালে সিঁদুরের টিপ পরে টোপরকে ফোন, ঝুমু, মেঝেতে শুয়ে থাকা ঝুমু অভ্যস্ত ভূমিশয্যা আশ্রিত নিদ্রায়, ঝুমু গ্রীষ্মের বিকেলে গেলাসে গেলাসে তরমুজ শরবৎ! আমপোড়া!

‘টোপর ও টোপর! তোকে, দেখি না কতদিন!’

‘দেখতে চাও? চলে এসো।’

‘চলে যেতে চাই। পারি না। দেয় না যেতে। বলে নতুন বউ ঘন ঘন বাপের বাড়ি গেলে লোকে নিন্দে করবে। আজ দুপুরে কী হয়েছে শোন। এ বাড়িতে ঘর বয়ে মাছ-সবজি পৌঁছে দিয়ে যায়। বাবুর সময় নেই বাজারে যাবার। পুঁটি, মৌরলা দিয়ে গেছে এই গাদা। আমায় কাটতে বললেন। আমি কি পারি? কোনও দিন কি কুটেছি? এসব গোপালীমাসিই করত না?’

‘তোমার বিয়ের আগে ও বাড়িতে কী ব্যবস্থা ছিল?’

‘বাড়তি তিরিশ টাকা দিলে কেটে দিত ঝি।’

‘তারপর?’

‘কুটতে তো বসলাম। মাছ পিছলে পিছলে যায়। দেড় ঘণ্টা ধরে কুটেই চলেছি। পিঠ টনটন করছে। হঠাৎ এঁদের এক আত্মীয় এলেন। বিয়েতে আসেননি তাঁরা। উনি, দীপের মা, আমায় বলছেন-যাও, বেনারসি পরো শিগগির। ভরদুপুর, হাতে মাছের গন্ধ, স্নান হয়নি, কিন্তু বেনারসি পরতেই হবে।’

‘পরলে?’

‘কী করব? পরলাম। ওই ঘরের ব্লাউজের ওপরেই। উনি অতিথিদের সামনে বলতে লাগলেন-‘ঝুমুরকে বলেছি, সারাক্ষণ সাজোগোজো, খুশি থাকো। এ বাড়িতে আর কাজ কী।’ ভেব দ্যাখ ধাপ্পাটা।’

‘স্বাভাবিক নয় বলছ?’

‘আরও আছে। যেই ওঁরা চলে গেলেন, উনি বলছেন ‘বেনারসি পরেই মাছ কুটতে বোসো না। সংসারে সঙ সাজতে হয়। শাড়িটা ভাল করে গুছিয়ে রেখে এসো! এই ক’টা মাছ কুটতে যে দিন পার করে দিলে। জয়ীদি বলেছিলেন মেয়ে সব পারে, সংসারে হেন কাজ নেই যে করে না! এখন বুঝি, বাড়িয়ে বলা স্বভাব! এ যেন বাংলার যাত্রাপালা! কিংবা আমি যেন একটা রোবট পুতুল! এই মাছ কুটতে বোসো! এই আমাকে এক গ্লাস জল দাও! গ্লাসে যেন মেছো গন্ধ না থাকে। এই বেনারসি পরো। এই হাসো। এই হেসো না। এই আটপৌরে বনে যাও। কী অদ্ভুত!’

‘খেলা বেশ জমে উঠেছে ঝুমু। তুমি যে এত কথা আমায় বলছ, যদি কেউ শুনে ফেলে।’

‘ওপরে আমি একা। শুনবে না। শুধু বাঁটুল আছে।’

‘সাবধান হও ঝুমু।’

‘চুপি চুপি কথা বলছি।’

‘শুধু শুধু ঝুঁকি নিয়ো না সোনা। আমাদের যে এই কথাটুকুই সম্বল। তুমি তো আসছও না।’

‘যেতে দেয় না। মিশতে দেয় না কারও সঙ্গে। পাড়ার কেউ এলে উনি পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এঁদের অনেক রহস্য টোপর। অনেক কিছু ঢাকাচাপা দেওয়া।’

‘সাবধানে থেকো ঝুমু। আমি চিন্তিত তোমাকে নিয়ে।’

‘আমারও তোকে নিয়ে ভারী ভাবনা হয় সোনা।’

‘পলাশকে নিয়ে নিলাম ঝুমু।’

‘নিলি মানে?’

‘তুমি বলেছিলে সারাক্ষণের একজন। ও রইল। আমার কাজের জন্যও সহায়ক দরকার। ওর বাড়ি তো এখানেই। সাড়ে আটটায় আসবে, থাকবে সারাদিন। বারো ঘণ্টা। বাবা ফিরে এলে ওর ছুটি। ওকে আমি শুরুতে দেব সাত হাজার টাকা।’

‘ও রাজি?’

‘খুব খুশি। ভেবে দেখো। ওর কোনও বাড়তি খরচ নেই। কাজও শিখতে পারবে।’

‘খুব ভাল করেছিস টোপর। একটা বড় চিন্তা গেল। সাবধানে থাকবি, হ্যাঁ?’

একদিন কল্যাণী ধরলেন।

‘কার সঙ্গে রোজ রোজ এতক্ষণ কথা বলো?’

‘বাড়িতে ফোন করি। ঝিরির সঙ্গে কথা হয়। টোপরের সঙ্গে।’

‘রোজই ফোন করো তোমার ভাইকে?’

‘হ্যাঁ।’

‘দিনে ক’বার?’

‘যখন মনে হয়। একা থাকে তো সারাদিন, চিন্তা হয়। এখন থেকে ওর জন্য একজন আসবে।’

‘তোমার ছোট?’

‘কে?’

‘ওই টোপর নামের প্রতিবন্ধী ছেলেটা?’

‘অনেক। চার বছরের।’

‘ঝিরির বয়সি? তা ভাল! মা-টা শুনলাম পালিয়ে গিয়েছে? বাবাঃ! অমন ছেলে জন্ম দেবার চেয়ে না দেওয়া ভাল ছিল। মায়ের কষ্ট একজন মা-ই বোঝে!’

‘ও কিন্তু নিজে সব পারে! কত জ্ঞান! কত মেধা! এই বয়সেই কত বড় চাকরি করে। আমরা তো এই তিনজন গায়ে গায়ে বড় হয়েছি। টোপর আমাদের বড়ই আপন। ওর জন্য আমাদের সব সময় চিন্তা!’

‘বিয়ে হয়ে গেলে এমন পিছু টানতে নেই। নতুন সংসারকে আপন করে নিতে হয়। এখন এ বাড়ির মানুষই তোমার সব। তোমার আত্মীয় বন্ধু। ওদেরটা ওদের বুঝে নিতে দাও।’

‘বাপের বাড়ির জন্য টান থাকবে না?’

‘থাকবে না কেন? তবে পাড়াতুতো ভাইয়ের প্রতি পিরিতটা বাড়াবাড়ি রকমের না?’

অপমানে ঝুমু-র চোখে জল এল। সৌজন্য, ভদ্রতা বড়ই ক্ষণস্থায়ী। কথা যেন বঁড়শি! ছুড়ে গলায় গেঁথে দাও। যেমন ‘পিরিত’ শব্দটা! উঠতে-বসতে-শুতে-খেতে মনে পড়ে। অস্তিত্ব জানান দেয়। সে খুব পাড়াবেড়ানি কখনও ছিল না। তবু এই বাড়িতে দমবন্ধ লাগে। এই দ্বিতল বাড়িতে দিন কাটে। কোথাও যায় না। কেউ দুটি গল্পও করে না। একদিন পাড়ার অপরাজিতা এলেন আলাপ করতে। ঝুমু তাঁর দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। পলক পড়ে না প্রায়। কী সুন্দরী! কল্যাণী ভ্রূ কুঁচকে টিভি দেখছেন। অসুস্থ শ্বশুর সারাক্ষণ থুম্ব হয়ে বসে আছেন। চোখে দৃষ্টি বেভুল। সারাক্ষণ কী যে চিবোন! একপাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে। চিবুক থেকে ঝুলঝুল করে ফোঁটা। বুকের জামা ভিজে যায়। কেউ চেয়েও দেখে না। ঝুমু মুছে দেয় মাঝে মাঝে। শ্বশুর ঘোলা চোখে তাকান। ভাষাহীন!

অপরাজিতার আগমন কেউই গ্রাহ্য করলেন না। অপরাজিতাই সপ্রতিভ শুরু করলেন, ‘দীপের বিয়ের সময় ছিলাম না বউদি। তাই আসা হল না।’

‘বোসো। কোথায় গিয়েছিলে?’

‘দিল্লি। আমাদের মেয়েরা একটা নাটক করল।’

‘বেশ। ঝুমুর, এ পাড়ায় ওই কোণের তিনতলাটা এঁদের।’

‘বউদির যেমন কথা। বাড়ি চেনালে হবে? মানুষটাকে চেনাতে হবে না? শোনো মেয়ে, আমি অপরাজিতা, আমার একটি সংগঠন আছে। মেয়েদের জন্য। মেয়েরাই চালায়। অসহায় মেয়েদের আমরা নানাভাবে সাহায্য করি। এ পাড়ার অনেক মেয়ে, অনেক বউ আমার সঙ্গী। যে যা পারে, যেভাবে পারে, সংগঠনের পাশে দাঁড়ায়। তোমাকেও আমাদের দলে পেতে চাই। বউদিকে বলতে বলতে হার মেনে গিয়েছি। তোমাকে ছাড়ব না।’

ঝুমু-র ভাল লাগছিল। সে তো কিছু করতেই চায়। সাধারণ থেকে অসাধারণে উপনীত হওয়া কঠিন, কিন্তু সাধারণের ক্ষমতা, ক্ষয় না করে প্রয়োগ করা ভাল। সে অপরাজিতার কাজের বিবিধ বর্ণনা শুনে বলল, ‘আমার আগ্রহ হচ্ছে।’

‘হচ্ছে? তা হলে এ মাসের শেষে যে সভা হবে তাতে এসো। একটা ধারণা হবে। কাদের জন্য কাজ, কী কাজ। কারা আছে আমার সঙ্গে। আমি আবার আসব তোমার কাছে ঝুমুর।’

অপরাজিতা চলে যেতেই কল্যাণী বললেন, ‘একটা কথা কাউকে বলার আগে আমার অনুমতি নেওয়াটা ভদ্রতা। কিছুই শেখোনি দেখছি। শিখবেই বা কোত্থেকে। মা নেই।’

‘আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’

‘ফট করে বলে বসলে আগ্রহ আছে। চেনো আগে, জানো, আমাকে জিজ্ঞেস করো।’

‘আমার আপনাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।’

‘ও এক ঢলানি মেয়ে। ষোলো বছর বয়সে ফিল্ম করতে নেমেছিল। দুটো-তিনটে ছবি করেছে। তারপর পাত্তা না পেয়ে থিয়েটারে নেমেছিল। ওখানেও সুবিধা করে উঠতে পারেনি। মুরুব্বি ধরে এনজিও করেছে। ওর সঙ্গে একদম যাবে না।’

ঝুমু তর্ক করল না। ভাবল, সে দাঁড়ের পাখি? শিকলি দিয়ে বেঁধে রাখবে? অবোধ কি সে? সারাক্ষণ তার আচরণীয় বিষয় প্রশ্নের মুখোমুখি হবে! নিজের বাড়িতে ঝুমুর আচরণে কোনও দখল ছিল না। দুটি সংসার সে চালিয়েছে। পদে পদে এত নিষেধ তার মন ক্ষুব্ধ করছিল। এ গৃহে তার ভূমিকা আসলে কী। যার হাত ধরে আসা, সে আজও কেমন দূরের। যদি এমনই হবে, বিয়ে করল কেন? তাদের প্রথম রাতের চিত্র পুনঃপুন রচিত হচ্ছে। সন্দীপন একদিনও বলেনি, নীচে শুয়ো না। আমি বরং বাঁটুলকেই নীচে শোয়াচ্ছি। এর অর্থ হল, সে যেমন চাইবে তেমনই হবে। ঝুমুরের কোনও স্থান নেই কোথাও। কে কার স্থান নির্ণয় করে? কী তার রীতি-নীতি? যে অপরাজিতা বিপন্ন মেয়েদের আশ্রয় দিতে চান, সমাজ কী চোখে তাঁকে দেখে? ষোলো বছর বয়সে একজন স্বপ্নের হাতছানি অনুসরণ করে পথে নেমেছিল। স্বপ্ন ছুঁতেও পারেনি, তাই আজও সে নিন্দনীয়। যদি আজ সে মহাতারকা হত, তার পদার্পণে ধন্য হত না কি এই গৃহ? মানুষের মর্যাদা কিছু লঘু শর্তাধীন।

এ প্রসঙ্গে সে আর কাউকে কিছু বলেনি। টোপর বা ঝিরিও জিজ্ঞেস করেনি। সে বোঝে, জানানো বা জানতে চাওয়ার নিরিখে বিষয়টি অতি ব্যক্তিগত। এ বাড়িতেও কেউ বলেনি-দীপ, তুই কেন কুকুর নিয়ে বউয়ের সঙ্গে ঘুমোতে যাস?

কিন্তু প্রশ্ন উঠল যখন শাশ্বতী এল আবার। সে এল এক বায়সবিলাসী ভোরে। যখন এমনকী ঘরের বউও জাগেনি। তবু দরজাঘণ্টা শুনে প্রথম জাগল বাঁটুল। সেও এমনকী বুঝে গেছে তার সংসারকৃত্যের প্রথম দাবি ঝুমু-র কাছে প্রকাশ করা উচিত। সে ঝুমু-র মুখের কাছে এসে বলল, ঘ্রাউ! ঝুমু চোখ মেলল। ঘণ্টি বাজল আবার। বাঁটুল বলল, উঁক উঁক!

ঝুমু উঠল। ম্যাক্সির ওপরেই শাড়ি জড়িয়ে নেমে এল নীচে। এই আধফোটা ভোরে নীচের তলা অন্ধকার। হঠাৎ তার মনে হতে লাগল, সে একা হয়ে গেছে, বাকি জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, কোনও সম্পর্ক ব্যতিরেকে সে একটি পৃথিবীতে পৃথিবীর কেউ নয়, তার মূল্য হারিয়েছে, তার আঙুলে জড়ানো নেই তার কোনও প্রীত্যর্থী আঙুল, এ অপূর্ব আঁধারে নিজেকে নিয়ে বিড়ম্বিত সে অদ্ভূত আবিষ্কার করল টোপরকে না দেখে সে আর এক মুহূর্ত পারছে না! টোপরের প্রতি এই অনিবার টান তার মধ্যে এক নতুনতর সত্তার জাগরণ ঘটিয়ে তুলল। সে যেন এক তৃষিত ক্যাকটাস। মরুচরাচরে শিকড় চাড়িয়ে দিচ্ছে বালুতলে জলের সন্ধানী। তার অস্তিত্ব কণ্টকময়, তবুও অতুলনীয় ফুলে ফুলে ভরে উঠতে সে-ও চায়। কার জন্য? কাকে দেবে ফুল, কাকে কাঁটা? তাকেই, তাকেই, সে তার ফুলের অধিকারী, সে-ই তার কাঁটার সম্রাট! আগেও কতবার, কতবার সে টোপরের টানে ওবাড়ি ছুটে গেছে, কিন্তু আজ এই মিশকালো ভোরের অন্তরতম আলো তার হৃদয় ভাসিয়ে দিতে লাগল শরতের দু’কূলপ্লাবী প্রেমবতী স্রোতস্বতী নদীটির মতো! এ তার অপার বিস্ময়! এ যেন তার ভেতরে অন্য এক ঝুমুর! অন্ধের মতো দরজার দিকে যেতে লাগল সে। যেন দরজা খুললেই সে টোপর দেখবে!

সে দরজা খুলল অল্প ফাঁক করে। আধো আলো আধো অন্ধকারে, ভোরের বেলায় পথবাতির পার্থিব অভিমানী আলোর তলায় শাশ্বতী। শাল মুড়ে চেয়ে আছে। ঝুমু তার চোখ দেখল। এই মুহূর্তে বড় আর্তি পেল সে। বড় কাতরতা।

‘লাল! এসো!’

‘তোমাকে বিরক্ত করলাম ঝুমু। জানতাম তুমিই আসবে।’

‘এসো লাল।’

‘আমি একটু ঘুমোতে চাই। কাল সারা রাত্রি ঘুমোইনি।’

‘এসো। তোমার ঘরে চলো। কালই গুছিয়েছি লাল। খাবে কিছু? খিদে পেয়েছে?’

‘পেয়েছে।’

‘তোমার ঘরে যাও। আমি আসছি।’

মুখেচোখে জল দিল ঝুমু। দাঁত মাজার সময় নেই। লাল নামের মেয়েটা ক্লিষ্ট। বিপন্ন। ক্ষুধাকাতর। দয়াবন্তী ঝুমু, বোকা-বোকা সরল-সরল সাধারণ-সাধারণ ঝুমু, পাকশালে গিয়ে চা বসাল। এই ভোরে কী খেতে ভাল লাগবে লালের? কেক গড়েছিল দু’দিন আগে। নিল দু’টুকরো। কলা সাজাল থালিতে। পেয়ালায় সোনালি চা। খুব গুছোন এদের সংসার। প্রাচুর্য আছে। কৃপণতাও নেই। বাড়ির আসবাবপত্র রুচিসম্পন্ন, দামি। আধুনিক যন্ত্রপাতির সবরকম সুবিধা আছে। সম্পর্ক যদি বলতে হয়, ঝুমুর সঙ্গে গড়ে উঠেছে এই আসবাবপত্রগুলির, এই যন্ত্রগুলির। সে এদের ঝাড়ে পোছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে, এরা প্রকম্পনে, মসৃণতায়, আবেশে ধরা দেয়। বলে, ভালবাসো। ঝুমু ভালবাসে। বিন্দু বিন্দু ময়লা তুলে ফেলে ফটোফ্রেম থেকে। টিপে টিপে মুছে নেয় পাকশালের ময়লা। তকমা জুটেছে তার, বউ কাজের, বউ শান্ত, বউ কথা কম বলে। তবে বড্ড ফোন করে বাপের বাড়িতে, আর বুদ্ধি কম। বোকা। সহজে বিশ্বাস করে ফেলে। কখন কী করতে হবে বোঝে না।

বোকা কেন? সেই যে সে অপরাজিতাকে বিশ্বাস করেছিল? কেন বোকা? নির্বিবাদী সেবিকাকে বোকা ছাড়া আর কিছু কি ভাবে মানুষ? যারা সেবা পায়, সেবা করিয়ে নেয়, হাতে পায়ে গেঁথে দেয় অদৃশ্য শেকল, তাদের প্রভুত্বপরায়ণতা তৃপ্ত হয়! কিন্তু যে পীড়নের সামগ্রী, তাকে বোকা ভেবে তারা বিস্মিতও হয় বুঝি!

ঝুমু খাবার নিয়ে এল।

শাশ্বতী নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ খোলা। হাতে পোড়া ছোপ। কালশিটে।

‘খেয়ে নাও লাল। হাত পুড়ল কী করে?’

‘আমার তো সবই পুড়েছে ঝুমু? জানো না?’

‘তুমি খাও লাল। আমি শাড়ি-টাড়ি ঠিকমতো পরে আসি। দাঁত মাজি। তারপর আসব।’

ঝুমু সকালের কর্তব্য সারছে। বাঁটুল ঘুরছে পিছু পিছু। শুঁকছে। আজকাল ঝুমু বাঁটুলের প্রতি একটু মায়া বোধ করে। জানোয়ারের গায়ে যে বুনো বোঁটকা গন্ধ, প্রথমদিন তার গা গুলিয়েছিল। দ্বিতীয়দিন,তৃতীয়দিন। কবে অভ্যস্ত হয়ে গেল সে। গন্ধে, ভূমিতলে, নিষ্কাম দাম্পত্য ব্যবস্থায়। সে এক সাধারণ মেয়ে, সে যে বেশিকিছু পারে না। সইতে পারে আদিগন্ত বেদনার ভার, আর মেনে নিতে পারে।

বাঁটুলের প্রতি তার মায়া আছে। ভালবাসা নেই। সে গা ঘাঁটতে পারে না। লোম বেছে রক্তশোষী পোকা তুলে আনতে পারে না। স্নান করাতে পারে না। বাঁটুলের দেহসেবার লোক আছে। করে যায়। সন্দীপন নিয়মিত তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে নিয়ে যায়। অন্য সমজাতীয় সারমেয় দ্বারা এই সারমেয়ীর যৌনতৃপ্তির ব্যবস্থাও আছে নির্দিষ্ট ঋতুকালে। এ বাড়িতে বাঁটুলের পরমাদর। প্রথমদিনই বলেছিল শাশ্বতী। অনাদর সে-ই বোঝে ভালরকম।

সে রান্নাঘরে গেল। চা বানাবে। নিজের। প্রতিবার বানাবে একেকজন উঠলেই। এ বাড়িতে কফির গন্ধ নেই। ভাগ্যিস নেই। টোপরকে ছাড়া ঝুমু কফি খেতে কোনও দিন পারবে না।

চা নিয়ে সে ফিরে এল। কলা ও কেক নিঃশেষিত। চা আধপেয়ালা পান করেছে। ঘুমিয়ে আছে লাল। চোখের কোণ থেকে জল পড়ছে। ঘুমের মধ্যেই। মুখখানা ম্লান। ঝুমুর বুক মুচড়ে উঠল। শাশ্বতী বলেছিল, ‘তোমার-আমার একই বছরে জন্ম। বউদি-টউদি বলব না।’

প্রায়ই ফোন করে শাশ্বতী। কল্যাণীর সঙ্গে কথা বিনিময় হয়। কখনও কখনও ঝুমুর সঙ্গে। বলে, ‘কেমন আছ ঝুমুর?’

‘ভাল আছি লাল। তুমি কেমন আছ?’

‘আমি ভাল থাকতে চাইছি। তুমি সত্যি ভাল আছ তো?’

‘ভাল থাকার চেষ্টা করছি। পেরেও যাচ্ছি। ভাল থাকা খুব কঠিন না।’

‘খুব কঠিন, ঝুমুর।’

‘কবে আসবে?’

‘যাব। ওবাড়িতে কেউ আমাকে চায় না।’

‘সে আবার কী! এ তো তোমারও বাড়ি।’

‘ক’দিন থাকো। তুমিও চাইবে না। আমি ফোন করলে ভ্রূ কুঁচকে যাবে তোমার। আমি গেলে মুখ অন্ধকার হয়ে যাবে। বেশিদিন থাকলেই বিরক্তি।’

‘ননদ-বউদির সম্পর্ক পৌরাণিক যুগ থেকে বৈরীতার। আমরা কী করে অন্যরকম হব?’

‘কী সুন্দর বললে ঝুমুর।’

‘এমন করে টোপর কথা বলে। ওর কথার ধরন আমাকে মাঝে মাঝে পেয়ে বসে। আমি বুঝি, ওর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছি।’

‘টোপরকে খুব ভালবাসো?’

‘তুমিও ভালবাসবে, যদি ওকে দেখো ক’দিন। ওর অসহায়তা, ওর সক্ষমতা। ওর যুদ্ধ, ওর জয়।’

‘আমাকে দেখাবে?’

‘নিশ্চয়ই।’

শাশ্বতী সুখে নেই। তার শ্বশুরবাড়িতে সমস্যা। কী সমস্যা? ঝুমু জানে না। এখন, এই মেয়েটির জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। সে টোপরের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। ভয় পেল। শাশুড়ির প্রশ্নাঘাত তাকে অন্তরে সংকুচিত করেছে। সে কি তবে লুকিয়ে কথা বলবে? না। সে কথা কম বলবে। কত কম? কেনই বা সে কল্যাণীকে ভয় পাবে? সে তো অন্যায় করছে না। সম্পর্কবিহীনতা কেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে? কল্যাণী কে তার? কিছু মন্ত্র, অগ্নিসাক্ষ্য, মাল্যবিনিময় মানেই কি সম্পর্ক? প্রাণে প্রাণ লাগল! তোমার মা আমার মা হয়ে গেল! তোমার যাবতীয় প্রিয়— কুঞ্জবন থেকে কুক্কুরী আমার প্রিয় হল। কিন্তু আমার টোপরকে আমি ফোন করতে পারব না। বধূ হিসেবে যাবতীয় কর্তব্য সে অস্বীকার তো করেনি। বিবাহের প্রস্তাব, দেনাপাওনা, মন্ত্র ও জনসাক্ষ্যে আত্মীয়তা বন্ধনের চুক্তিপত্রে কি স্বাক্ষর দু’তরফেই হয়নি? ওই মহিলা কি জানে, ঝুমুর অদ্যাবধি আসঙ্গবিবর্জিত কন্যকাকুমারী।

সে ফোন নিল। তার ছোট্ট মুঠোভাষ। ছাতে চলে গেল। কী এক ব্যাকুল হাওয়া আনাচে কানাচে। গ্রীষ্মের ছাঁট লাগা ধূসর আকাশ থেকে উড়ে উড়ে আসে এক উথালিপাথালি। তার শিরশির করে বুক তলপেট। তার ঠোঁট জিভ কার গোপন শলায় শোষণোন্মুখ। তার পাগলিনী হতে ইচ্ছা যায়। সে খুলে ফেলে চুল। মনে হয়-এই আকাশের নীচে, সব ভুলে, সে খুলে ফেলবে শাড়ি। ও হাওয়া, ও পাগল হাওয়া ও রোদ্দুর নরম-পরম প্রেমের স্পর্শে ঝুমুর কাহাকে জড়াবে, কোন দিকে হবে ধাবমান, কোন সে মানুষ-ঝুমু কার হাতে জন্মমৃত্যু চায়!

‘টোপর।’

‘বলো।’

‘মন ভাল নেই।’

‘না থাকারই কথা।’

‘কেন?’

‘সাতসকালে মনে পড়েছে আমাকে।’

‘মনে হচ্ছে ছুটে চলে যাই।’

‘এসো।’

‘পারি না কেন?’

‘একদিন পারবে।’

‘ও টোপর, তোকে দেখি না কতদিন।’

‘অন্তরে তাকাও। দেখো, আমি আছি। আমি তোমার অন্তরের হাতছানি। সেই আহ্বান অস্বীকার করে তুমি কতদূর যাবে?’

‘আমার ক্ষণে ক্ষণে কান্না পায় কেন? বাইরে ভাব দেখাই, যেন আমার কোনও কষ্ট নেই। কিন্তু আমার কোনও সুখ নেই টোপর। আমার কেন এত বিষাদ? কেন দুঃখ? কেন সারাক্ষণ তোকে ছাড়া আর কিছু ভাবতেও পারি না? তোকে ছেড়ে থাকা এত কঠিন হবে বুঝতেও পারিনি। টোপর, ও টোপর, তোকে গভীর করে ভাবলেই কান্না পায় কেন?’

‘কারণ আমি নিরন্তর কাঁদি। কেন তুমি চলে গেলে ঝুমু? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখিনি।’

‘ও টোপর! এভাবে বলিস না। লাল এসেছে। ওকে দেখে কী যে কষ্ট!’

‘তোমার ভালবাসা দিয়ে ওকে ভরে দাও ঝুমু।’

‘ভোরবেলা এল। কীসে এল। কেন এল। ঘুমোচ্ছে এখন।’

ঝুমুর! কল্যাণী ডাকছেন। ঝুমুর! ছাতে কী করছ? এটা কি ছাতে যাবার সময়?

‘টোপর, রাখি এখন?’

‘রাখো।’

‘সাবধানে থাকবি।’

‘তুমি সাবধান হও। ঝুমু, ঝড় আসছে। তুমি কি ঘন কালো ধূলিময় মেঘ দেখতে পাচ্ছ?’

‘না না। আকাশ রোজকার মতো। ঝোড়ো হাওয়াই বা কই।’

‘ওগো বালিকা, যদি ঝড় ওঠে, আমি রইলাম। আর কোনও দিকে যেয়ো না তুমি। তোমার জন্য আমি মহীরূহ হয়ে যেতে পারি। তোমার জন্য আমি হয়ে যাব পর্বত-পাহাড়। আমার আত্মার থেকে বের করে সর্বকর্মা দৈত্যজিন-তোমার প্রাসাদ বানাব। কেউ তাকে ছুঁতেও পারবে না। তুমি নিরাপদে থেকো। আনন্দে আনন্দে আনন্দে থেকো সেই আশ্চর্য অট্টালিকায়। আমার বুকের মধ্যে ঝুমু।’

‘যাই রে টোপর। আমি যাই। উনি ডাকছেন।’

ছিক্ ছিক্ ছিক্! ওঁয়াও! নখের শব্দ তুলে বাঁটুল পৌঁছল। ঝুমুর গায়ে গায়ে। কল্যাণীও। শুনো হে বড়াঞি। শাশুড়ি আমাকে বড় চোখে চোখে রাখে। ছায়ায় ছায়ায় ফেরে অতিকায় নিরর্থ নিষেধ।

‘এই সকালে ছাতে কী করছ? ফোন?’

‘কথা বলছিলাম। আপনারা কেউ ওঠেননি। ভাবলাম ছাতে যাই। লাল এসেছে ভোরবেলায়।’

‘জানি। এই এক মেয়ে। আমার হাড় জ্বালিয়ে খেল।’

আজ কী বার? রবি। আজ প্রাতঃরাশ করে সন্দীপন চলে যাবে। কোথায়? সারাদিন কোন দেশে? ঝুমুর জানে না। তার জীবনে শনিবার-রবিবার নেই। সে লুচি ভাজে। আলুর তরকারি। ঝি বলে-বউদিমণি, দুপুরের কী মশলা? কোন মাছ? কী মাংস? ঝুমু অতীতের খাবার টেবিলগুলি থালায় ভরে দেয়।… ঝিরি লুচি, বাবা লুচি। টোপর, ও টোপর কী খাবি লুচি দিয়ে? আবার সাদা আলুর ছেঁচকি। খাব না। আমায় বেগুন ভেজে দাও। গোল গোল। ডিপ ফ্রাই। ও লো রাই, তোর পাগল কানাই বাঁশিতে বাঁশিতে ডাকে রাধা রাধা রাধা। তোর ও হৃদয়মন অর্ধ আছে এঘরে সংসারে, অর্ধ আছে কুঞ্জবনে বাঁধা।

‘লাল, তোমাকে লুচি দিই?’

‘চারটে খেলাম ঝুমু।’

কল্যাণী বলেন, ‘এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি তোর লাল।’

সন্দীপন বলে ‘তোকে তোর সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

‘আমরা আর কতদিন দেখব?’

‘তখন তোকে বারণ করেছিলাম। আমাদের কথা শুনে চললে আজ এমন হত না।’

‘পাড়ার লোকে পর্যন্ত বলাবলি শুরু করেছে।’

শাশ্বতী বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে চোখ মুছল। ভারী গলায় বলল, ‘আমার দম আটকে আসে। তাই তোমাদের কাছে আসি। এই দেখো আমার হাত। কাল সারারাত বেঁধে রেখেছিল। খেতে দেয়নি। যখন আর থাকতে না পেরে বললাম, আনব, তখন ছাড়ল। আমার ছেলেটাকেও খারাপ করে দিচ্ছে মা। আমার সব শেষ হয়ে গেল।’

‘পঞ্চাশ হাজার! অসম্ভব! লাল, এভাবে চলতে পারে না।’

‘ছেলে নিয়ে তুই এখানে চলে আসবি, সেটাও হয় না। লোকে কী বলবে। ওদের বোঝাবার চেষ্টা কর।’

‘জানি না মা, কী বোঝাব, কীভাবে বোঝাব।’

এই প্রথম ঝুমুর সামনে আলোচনা। সে আন্দাজ করছে।

লাল নিজের পছন্দে অযোগ্য বিয়ে করেছিল। এখন তাকে নিষ্ঠুর পীড়ন করা হয়। চেনা কেচ্ছা। নিত্যকার কিসসা শ্বশুরাল কা! বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসো।

না।

মার।

টাকা নিয়ে এসো।

অনেক এনেছি। আর না।

পিটুনি।

নিয়ে এসো।

না।

খাওয়া বন্ধ। অত্যাচার।

টাকা নিয়ে এসো।

না।না।না।

পোড়াও, পোড়াও ওকে সস্তা কেরোসিনে। গলা টিপে মেরে ফেলো। বিষ আনো কিনে। পরিস্থিতি কি এতখানি ভয়ংকর? নাকি আরও বেশি! কানাই সামন্ত সরু গলির জীবন তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে!

দুপুরে খাওয়া সারা হলে ঝুমু-র কীই বা করার থাকে? টোপরের সঙ্গে অনন্ত কথোপকথনের দুপুর মনে পড়ে। হায়! মুখোমুখি কথার পরিবর্তে মুঠোভাষে মন যে তৃপ্ত নয়। সে যখন-তখনই যেত। সবসময়। কথা হত তাও নয়। একটু দেখে আসত। পড়ায় মগ্ন টোপর। ব্যায়ামরত টোপর। কম্পিউটার বিজড়িত টোপর। টোপরের থেকে প্রবীরকাকা। আহা প্রবীরকাকা! একমনে এডিনিয়ামের পাপড়ি থেকে মুছে দেন ধুলো। ফুলগুলি আঙুলে ছোঁয়ান যেন রুপুকাকিমার ঠোঁট ফুলগুলি। ওবাড়িতে এডিনিয়ামের প্রথম চারাটি তিনিই আনয়ন করেছিলেন। সেই বৃক্ষবীজ, সন্তানসন্ততি, আরও সব নানা রঙা আত্মীয়-স্বজনে ভরা ছাত। অতশত বোঝেনি তখন ঝুমু। এখানে এসে সে নতুনতর দৃষ্টিতে দেখে ফেলে আসা দিনগুলি।

ঝিরি! ঝিরি ঝিরি ঝাউপাতার মতো ঝিরি। তার প্রিয় বোন। হেঁটে হেঁটে পড়া করে। দুমদাম কথা বলে। স্বাধীনতা পাখি হয়ে উড়ে যেতে চায়। ফোন করে না বেশি। এস এম এস করে।

‘এভাবে কতদিন?’

‘জানি না।’

‘পুরাণের সতীসাবিত্রী হবি নাকি? পঞ্চসতীর পর ষষ্ঠসতী ঝুমুসতী।’

‘দেখি না কী হয়।’

‘বোকামো করিস না।’

‘কী করব?’

‘চেপে ধর। বল, এ সবের অর্থ কী? বিয়ে করে দূরে দূরে। করল কেন বিয়ে?’

‘আমি বলব, আপনি কেন দূরে? আমি যে আর পারি না! তার মানে বুঝিস?’

‘আমি বলব।’

‘তারপর? সে রোমান্টিক হয়ে যাবে? উতলা হোস না। সময় দেওয়া ভাল। তাড়া কী!’

‘বন্ধু হল?’

‘না। কথাই তো হয় না। তবে বাঁটুল আমার বশ হচ্ছে।’

‘তুই কি তবে বাকি জীবন কুকুর কুকুর খেলবি?’

কুকুর কুকুর খেলা! বেশ কথা! সে তো কুকুর কুকুরই খেলছে। ঝুমু এসো। এল। ঝুমু যাও। গেল। ঝুমু দাও। দিল। তার কি অপমান লাগে না, বিছানায় বাঁটুল, সে মেঝেতেই আঁটুল, সন্দীপন শামলা সাঁটুল একবারও অনুরোধ নাটুল!

ঝুমু কি চেয়েছে তাকে সাধাসাধি করুক ওই লোক কেননা সে কাজললতায় মাথা সিঁদুরে রাঙিয়ে এনেছে!

ধুত্তোর! ঝুমু সাধারণ মেয়ে, পতিধনের প্রেমপ্রার্থিনী বটে, ভিখারিণী হতে সে পারবে না।

তা হলে প্রেমকাঙালী কি বলা যায় তাকে? সম্পূর্ণ নিঃস্ব নিরহঙ্কার ভিক্ষাব্রতী না হলে কি প্রেম চাওয়া হয়? সে কি সন্দীপনের কাছে তেমনই আঁচলপাতা?

না। ঝুমু প্রস্তুত নয়। সে গতানুগতিক ধাপ পেরিয়েছে। নিজেকে প্রদর্শন করেছে প্রায় গণিকার মতো। পটল বা পাজামার মতো। বিবাহ করেছে উপবাস করে। নস্যাৎ করেছে এক পাগল অবুঝ প্রেম। সমস্ত সংস্কার মেনে সে শুদ্ধতার গৌরবে নারীত্বের অগৌরব অবমাননা ঢেকে এগৃহে এসেছে কেন? যৌনতার তৃপ্তিকারী সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার ছাড়পত্র আছে, তৃপ্তি নেই হায়! নয় নয় নয় তৃপ্তি, ঝুমুও প্রস্তুত নয়। কিন্তু মুখের আলাপটুকু শুরু হতে কি পারত না? কেউ কি বিশ্বাস করবে, বরকে সে আপনি সম্বোধন করে? লোকসমক্ষে এড়িয়ে যায় সম্বোধন, ঠিক যেমন টোপর এড়িয়ে যায় তাকে সরাসরি ঝুমু ডাকা! ওঃ টোপর! টোপর! আয়! ঝুমুরের চোখের ভিতর একবার তাকা। ঝুমুর দশদিশি এক মহাকাশ বিসারী টোপর দিয়ে ঢাকা!

ঝুমু পায়ে পায়ে এল শাশ্বতীর ঘরে। সে বসে আছে জানালার কাছে।

‘এসো, ঝুমুর।’

‘হাতে ছ্যাঁকা কেন লাল?’

‘ওরা দেয়। ও।’

‘ও বাবা! কেন দেয় লাল?’

‘দেখো, ওই যে ছোট্ট জমিটা দেখছ, ওটা আগে আরও বড় মাঠ ছিল। আমরা খেলতাম। আর ওই যে বড় উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি, ওখানে আমবাগান ছিল।

পুকুরও ছিল একটা। মাত্র পনেরো বছর আগেও পাড়াটা অন্যরকম ছিল ঝুমুর। পাড়া গাঁ মতো। আমরা ওই মুখুজ্জেবাড়িতে পাত পেড়ে সত্যনারায়ণের সিন্নি খেতে যেতাম। এখন কেউ কারও বাড়ি যায় না। আর ওই অপুদি, অপরাজিতা, ও ছিল আগুনের মতো।’

‘তোমার হাতটায় ওষুধ লাগানো দরকার।’

‘কী লাভ?’

‘এসো। লাগিয়ে দিই।’

‘তুমি বড় ভাল মেয়ে ঝুমুর। যত্ন কোরো না। আর যেতে চাইব না ওবাড়ি।’

‘ইচ্ছে না করলে যাবে না।’

‘এরা ঠেলে পাঠায়। আমি যে নিজে বিয়ে করেছি। তুমি আমার পদবি দেখোনি? প্রতিলোম বিবাহ আমার তরফে। বাড়িতে আপত্তি করেছিল। কত ভাল স্কুলে পড়তাম! কত আদর ছিল বাড়িতে! স্কুলের বাস নিতে আসত, আমাকে ব্যাগটুকুও বইতে দিত না বাবা। লোক ছিল। নিয়ে যেত। সেই আমি চোদ্দো বছর বয়সে পালিয়ে গেলাম। চোদ্দো! ভাবতে পারো?’

‘ও। তারপর?’

‘বয়ঃসন্ধি আমাকে অন্ধ করে টেনে নিল। লোকটা অনেক বড় ছিল বয়সে। আমাদের স্কুলগাড়ির ডোর হেল্পার। আমাকে দীঘা নিয়ে গিয়েছিল। বাবা ফিরিয়ে আনল। স্কুল আমাকে বহিষ্কার করল। লোকটারও চাকরি গেল। আমার ওই অল্প বয়সেই শরীরে বড় খিদে ছিল! সারাক্ষণ মাথায় ওইসব ঘুরত! বাড়ি ফিরে দু’দিনেই ওকে ভুলে গেলাম! কিন্তু শরীরের বোধগুলো জেগে রইল। লেখাপড়ায় মন নেই তবু খুব সাধারণ ওই স্থানীয় স্কুলটায় ভর্তি করল বাবা। আমি তখন উন্মাদ। ভূতগ্রস্ত। বছরখানেকের মধ্যেই কাল্টুর সঙ্গে প্রেম জমে উঠল আমার। লুকোতেও ভুলে গেলাম। কী বেপরোয়া! ওই মোড়ে দাঁড়িয়েই কথা বলতাম। মা মেরেছে পর্যন্ত। আমি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছিলাম ঝুমুর। অনেক করেও যখন আমাকে শোধরানো গেল না-দাদা আমাকে ঘরে আটকে রাখতে শুরু করল। তখন আমাদের দুটো গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুর ছিল। ডোরা আর কুট্টুস। বাঁটুল হল ওদেরই ছানা। আচ্ছা, দাদা এখনও বাঁটুল নিয়ে শোয়?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার ভয় করে না?’

‘করেছিল। আমি জায়গা ছেড়ে দিয়েছি।’

‘মানে?’

‘বাঁটুল তার জায়গায় ঘুমোয়। আমি নীচে।’

‘কী যা তা বলছ?’

‘তোমার কথা বলো।’

‘এ আবার কী! মা জানে? ঝুমুর, সত্যি বলো তো, তোমার সঙ্গে দাদার ভাব হয়েছে?’

‘হবে, তাড়া কী। একই বাড়িতে, একই ঘরে আছি।’

‘এই ভয় আমি পেয়েছিলাম। মাকে বলেছিলাম। হে ভগবান!’

‘তুমি ঝিরির মতো বিচলিত হয়ে উঠলে লাল। শান্ত হও।’

‘এটা মেনে নেওয়া যায় না।’

‘তুমি যে এত বছর ধরে মার হজম করছ!’

‘সে আমার নিজের দোষে।’

‘দোষ নয়, বয়সের ভুল। সে ভুল শোধরানো যায় এখনও।’

‘আর যায় না গো। আমার ছেলে। ভুটকান। তাকে দেখোনি তুমি। আসতে দেয় না। সে আমাকে একটুও ভালবাসে না। কিন্তু আমি মা। তাকে ছাড়ি কী করে? ঘর কামড়ে পড়ে থাকি। ভুটকান না থাকলে হয়তো চলে যেতাম যেদিকে দু’চোখ যায়।’

‘টোপরের মা ওকে ফেলে চলে গিয়েছিল।’

‘পারল কী করে? ওরকম ছেলে! ভাবতেও পারি না।’

‘রুপু কাকিমা পেরেছে। সবাই কি একরকম হয়?’

‘সেজন্য তুমি টোপরকে এত ভালবাসো?’

‘ও আমাকে আঁকড়ে বড় হয়েছে। ছোট তো অনেক। আমাদের ঝিরির মতোই তো। ঝিরি তো ছটফটে। পাড়া দাপিয়ে বেড়াত। টোপর খেলতে পারত না বলে আমি ওর সঙ্গে থাকতাম।’

‘কী সুন্দর তোমাদের সম্পর্ক!’

‘টোপর আশ্চর্য ছেলে জানো। ওর কথা উঠলে আমি থামতে পারি না। এই বয়সেই ওর কী গভীর মন, কী বিস্তৃত ভাবনা!’

‘আমাকে টোপরের কাছে নিয়ে যাবে না?’

‘যাব। অনেকদিন ও বাড়ি যাইনি।’

‘মা বাপের বাড়ি যাওয়া পছন্দ করে না। আমি এলে রাগ করে। বিরক্ত হয়। তোমার সঙ্গে তো করবেই। আমি সব বুঝি। এবাড়িতে আমি বালাই মাত্র। ও বাড়িতে গোরুছাগলের মতো। তবু যখন আর পারি না, চলে আসি।’

‘তুমি এখানেই থাকো।’

‘থাকতে দেবে না। কাল্টু এসে হুজ্জোত করবে। পাড়ার লোকর কাছে মায়ের মান যাবে। কতবার এমন হয়েছে। কাল্টু জানে, ছেলে আমার দুর্বলতা।’

‘মারে কেন?’

‘অনেক কারণে। ওর সঙ্গেও আমি পালিয়েছিলাম। স্কুল থেকে পিকনিকে গিয়েছিলাম, আলাপ হল। কোলাঘাটে। অনেকটা সঞ্জয় দত্তর মতো দেখতে। ওরকম চুল। ওরকম হাসি। বাগবাজারে ওর বাবার মিষ্টির দোকান। ও নাকি বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রর ব্যবসা করে। ভেবেছিলাম বিয়ে তো করি, বাড়িতে মেনে নেবে। এবারে কিন্তু বাবা আমাকে ফিরিয়ে নিতে এল না। মুখ নিচু করে আমিই এসেছি। কয়েক মাস কাল্টু ভালই ছিল। খুব সাধারণ বাড়িঘর। বাগবাজারে মিষ্টির দোকান শুনে যেমন মনে হয়, তা নয়। কাশী মিত্র ঘাটের কাছে একটা ছোট চায়ের দোকান। নিম্নবিত্ত। অসুবিধা হত। এই প্রাসাদের মতো বাড়ি থেকে আধবস্তির মলিন অন্ধকার ঘরে গিয়ে পড়লাম। তবু মানিয়ে নিয়েছিলাম। মাত্র ষোলো বছর বয়সে আমি গর্ভধারণ করলাম। ঠিক সে সময় প্রথম চাপ দেওয়া শুরু করল কাল্টু। বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসো। ব্যবসা করব। তোমার বিয়েতে তো খরচ হয়নি। সেই টাকা আমার প্রাপ্য। আপত্তি করলাম। শুরু হল মার। প্রথমে কাল্টু। তারপর মা ও কাল্টু। এখন মা, কাল্টু আর ভুটকুন।’

‘ভুটকুন তো ছোট।’

‘ওর শৈশব চলে গেছে। পাড়াটা তেমন ভাল নয়। তার ওপর বাড়ির প্রশ্রয়। কাল কী করল জানো? এই যাত্রায় পঞ্চাশ হাজার দাবি ওদের। রাজি হচ্ছিলাম না। লড়ে যাই যতক্ষণ পারি। ওরা মারে। খুন্তির ছ্যাঁকা দেয়। সহ্য করি। কাল আমাকে চেপে ধরল কাল্টু। ওর মা হাত বাঁধল খাটের পায়ার সঙ্গে। আমার বাবার টাকা নিয়ে নিয়ে কত কী করেছে! ভাঙা বাড়ি পাকা করেছে। কাল্টু বাইক কিনেছে। তবু লোভ যায় না। কাল্টু চড়-থাপ্পড় মারছে। আমিও চিৎকার করছি। আগে চুপচাপ সহ্য করতাম যাতে লোকে জানতে না পারে। লোক কিন্তু জেনেই গেল। তাই এখন আমি চ্যাঁচাই। তাতে লাভ হয়েছে গো। বেশিক্ষণ চালাতে পারে না। কাল আমায় মারছে মারছে মারছে। আমি চ্যাঁচাচ্ছি— পারব না, আনব না, শুনব না। মিছিলের লোকের মতো। মানছি না। মানব না। ভুটকুনকে ডাকল কাল্টু। বলল— পেচ্ছাপ কর। মা’র গায়ে পেচ্ছাপ কর।’

‘ঈশ্বর!’

‘করল ভুটকুন। আমারই সন্তান, আমাকেই তার পুরুষাঙ্গ তাক করে প্রস্রাব করল সারা গায়ে। ফুর্তিতে।’

‘কী করে সহ্য করো তুমি!’

‘আমি আমরণ সহ্য করব। আমার অপরাধ, পাপ নিঃশেষ করে যাব। পরের জন্মের জন্য একটুও রাখব না। সেই জন্মে আমি আবার নতুন করে লাল হব। ঝুমুর, কথা হল, তবু আমি রাজি হচ্ছিলাম না। আমার ছেলে, কতই তো হিসি করেছে গায়ে। তাতে কী! সারা রাত ওইরকম বেঁধে রাখল। জল দিল না। খেতে দিল না। তলপেট টাটিয়ে উঠল বেগে, বাথরুমে যেতে দিল না। আমি হার মানলাম। বললাম, ছেড়ে দাও। টাকা আনব। বাড়িটা আর সহ্য হচ্ছিল না। চলে এলাম।’

‘ওঃ! ঠাকুর!’

‘বাবা অনেক দিয়েছে। যতদিন ভাল ছিল। আর কত দেবে? কেন দেবে? আমি জানি আমি চেয়ে অন্যায় করছি। কিন্তু কী করব?’

‘তুমি চলে এসো। ওই টাকা দিয়ে মামলা করো। মুক্ত হও।’

‘কী লাভ? কী পাব? আর কি ফিরে পাব নতুন জীবন?’

‘নতুন জীবন নিশ্চয়ই পাবে।’

‘কেউ কি ভালবাসবে আমাকে? বিয়ে করবে? হয় না ঝুমুর। দশ বছরের বাচ্চার মা আমি। এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে আমি বুড়িয়ে গিয়েছি। আর দম নেই।’

‘নতুন জীবন মানে কি বিয়েই শুধু? স্বামী? সংসার? ওই যে অপরাজিতাদি— যেসব মেয়ে উদ্ধার করে জীবনের দিশা ফেরাবার চেষ্টা করছেন-তাদের কী ভবিষ্যৎ? দশ-এগারো-বারো বয়স। এরই মধ্যে যৌননির্যাতনের শিকার। তবু তাদের জন্য পথ খোঁজা চলছে।’

‘অপুদির খুব বদনাম জানো তো।’

‘হতে পারে। কিন্তু ওঁর কাজটা বড়। তুমি সেই কাজে যুক্ত হয়ে যাও। এ বাড়িতে অর্থাভাব তো নেই। তুমি থাকবে, তাতে কী!’

‘আমি ঠিক এ বাড়ির নেই আর। নীচে নেমে গেছি। ওরা যখন মারে আমাকে, আমি চ্যাঁচাই, কীরকম অচেনা লাগে। আমি কি সেই লাল? সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়তাম। কাজের লোক আমার ব্যাগ বয়ে দিত। নিউ মার্কেট, বরদান মার্কেট, শ্রীরাম আর্কেড থেকে যার জন্য উপহার আনত বাবা! যার জন্মদিনে পঁচিশজন বন্ধু পেত বেশ দামি প্রত্যুপহার। আদরের লাডলা থেকে এখন আমি ভিখিরি হয়ে গিয়েছি। হাতিবাগানের ফুটপাথ থেকে খুঁটে খুঁটে বাজার করি। সেলাই করে ব্রা পরি। আমি ফোন করলেই আমার মা ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি টাকা চাইব। আমি মরে গেছি ঝুমুর। আমার আর ফেরা হবে না। কতদিন পর আজ তোমার কাছে প্রাণ খুলে কথা বললাম। আজকাল এবাড়িতে আমার কথা শুনতেও কেউ প্রস্তুত নয়। বাবা অর্ধচেতন। মা চিরকালই খুব শক্ত। এখন আমার ব্যাপারে মা প্রায় নির্মম। কী করবে। আমার কথা ছাড়ো। আমার এখন ভাবনা বাড়ল তোমায় নিয়ে। তোমার কী হবে?’

রাতে খাবার টেবিলে ভাতে আঙুলের নড়াচড়া করে যাচ্ছে লাল।

‘দাদা, কিছু দিতে পারবি? না নিয়ে গেলে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।’

‘আমি কোথা থেকে দেব। পঞ্চাশ হাজার কি দশ টাকার মতো?’

ঝুমু বলে বসল, ‘কী অমানুষিক অত্যাচার করে! ওদের নামে থানায় ডায়েরি করা উচিত। লালকে লালের ছেলে সমেত এ বাড়িতে নিয়ে আসুন। তারপর পুলিশে যান।’

‘তোমাকে এখনও এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার দেওয়া হয়নি। ঝুমুর। নিজের সীমা লঙ্ঘন কোরো না।’

ঝুমু কেঁদে ফেলল। এবং, এই কান্না পাওয়া তাকে নিজের সম্পর্কে বিস্ময়াহত করে দিল। তা হলে কি সে মেনে নিচ্ছে সে এবাড়ির কেউ? ভালবাসাহীন সম্পর্ক সে নিজেই সম্পর্ক বলে মানে না। সে সামাজিক সম্মান রক্ষা করছে মাত্র। সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছে জীবনের রূপরেখা লাভের আশায়। তা হলে সে এমন বলল কেন? লালের প্রতি কি কোনও টান জন্মাচ্ছে তার? যা ন্যায্য সে তাই বলেছে। এরা কি মানুষ? টাকা দিচ্ছে। তাই রাগ। আবার মেয়েকে ওই নরকে পাঠাচ্ছে। হতে পারে শাশ্বতী ভুল করেছিল, ফিরে এলে লোক দু’চার কথা বলবে। কী এসে যায়!

কল্যাণীর স্বর কঠোর ও নিষ্প্রাণ। বললেন, ‘ঘটে বুদ্ধি থাকলে বুঝতে পুলিশ ডাকলে লোক হাসানোই হবে। মেয়ে আমাদের মুখে চুনকালি কম দেয়নি। আর মাখতে পারবে না কেউ। যেমন কর্ম তেমনি ফল। বাদুড়ে ফল খেয়ে গেলে সেই ফল নষ্ট ধরা হয়। ওর জন্য কে অত হ্যাপা পোয়াবে! ঘরে হাজার পনেরো টাকা আছে, দিয়ে দিচ্ছি, আপাতত এই নিয়ে যা। আমাদের কি টাকার গাছ আছে?’

‘আর দশ হাজার দাও মা। অন্তত অর্ধেক না নিলে আবার মারবে।’

‘লাল, মা তোকে পনেরো দিচ্ছে, চুপচাপ নিয়ে চলে যা। কাল্টুকে বলবি, আর চাপ দিয়ে টাকা নিতে পারবে না। যা হয় হোক, এস্পার ওস্পার। এবার একটা বোঝাপড়ায় আয়।’

‘দাদা, বিশ্বাস কর, মানে না।’

‘এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাস ব্যাপার না। সব কিছুর একটা শেষ আছে।’

‘আমার কি ভাল লাগে এই ভিখিরিপনা? তোদের না বললে আর কাকে বলব।’

‘এসব অভিযোগ আমার ভাল লাগে না। কাল্টু যখন মারে, হাতটা ধরে ভেঙে দিতে পারিস না? রান্না তো করিস। গরম খুন্তির পাল্টা ছ্যাঁকা দিতে পারিস না শাশুড়িকে? অতই ন্যাকাবোকা তুই? তোর লোভ কিছু কম নয়। তোর সায় না থাকলে কাল্টুর এত সাহস হয় কী করে?’

মাথা ঝুঁকে প্রায় ভাতলগ্ন লালের। পিঠ কাঁপছে। চোখের জলের স্রোতে ডিঙি বেয়ে যায় বিষাক্ত কঠিন পিঁপড়েরা। ঘরে ঘরে বিষ পিঁপড়ের ঘন ডেরা।

গভীর রাত্তিরে, যখন জগতের শয্যা প্রস্তুত, এমনকী ঝুমুরেরও ভূমিশয্যা, ছাতের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। বাঁটুল চেঁচিয়ে উঠল। ঘ্রাউ, ঘ্রোক। সে বিশেষ ডাকে না। অল্প ডাকলে বর্ষার নবোদিত মেঘডাকের মতো শোনায়। তার কন্ঠের মেঘশ্রী সুউচ্চ প্রপাতের গরজন মনে হয় যদি ক্ষেপে ওঠে। দুঃখে বা আহ্লাদে কাতর উঁ উঁ রব। তখন সে কুক্কুরী থেকে উন্নততর এক মানবী প্রাণীতে পরিণত হয়।

সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ছাতে যাচ্ছে শাশ্বতী। ঝুমু-র ইচ্ছে হল সে-ও যায়। বার বার যেতে চায় আকাশের তলে। কে জানে বারতা কী আনে ঝিরি বায়ু। নিজেরেই খুঁজিতে খুঁজিতে ছাতে সে কাহারে পায়। আকাশ মিশিয়া যায় ছাতের শরীরে। তারা জ্বলে তারা নেভে, কে জানে কখন মন ধায় কোন এক গহন সন্ধানে। কে আছে, কে আছে, কে আছে সেখানে!

‘লাল।’

‘বলো ঝুমুর।’

‘ছাতে একলা কী করছ?’

‘কিছু না। ভাবছি ভুটকুনটা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল কিনা।’

‘আমি আজ ঘুমোতে পারব না লাল।’

‘কেন?’

‘তোমার জীবন আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে। আতঙ্কে আছি আমি। যদি আবার তোমাকে মারে!’

‘মার খেলে আমার আর কিছু হয় না ঝুমুর। সয়ে গেছে। কষ্ট হয়, নিজেরই মায়ের কাছে, নিজেরই অধিকার খুইয়ে এই গ্লানির জীবন। আমার তো চাহিদা কিছু নেই গো ঝুমুর। একটা ভুলের জীবন টেনে টেনে পারি না যে আর। একটু শান্তি চাই। বড় ক্লান্ত আমি।’

‘জোর আনো লাল। থেকে যাও। এ বাড়িতে তোমার অধিকার কিছু কম নয়।’

‘আর দশ হাজার টাকাও যদি পেতাম, ওরা কিছুদিন ভাল থাকত।’

‘কতদিন?’

‘জানি না। ছ’মাস। আট মাস।’

‘তখন সব কিছু স্বাভাবিক?’

‘আমার স্বাভাবিকতার অর্থ মারধোর গালিগালাজ সব নিয়ে।’

‘কাল্টু কী করেন?’

‘আমার শ্বশুরের টিমটিমে মিষ্টির দোকান ছিল। চায়ের দোকানই আসলে। তুলে দিয়ে এস টি ডি বুথে, জেরক্স, ফ্যাক্স। সঙ্গে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। আসলে বিদ্যুৎ মিস্ত্রি। কাজ জানে। লোকে ডাকে। ও যায়। বাইক চেপে। ওর রূপ আমাকে শেষ করেছে, ওকেও। অমন নায়কোচিত রূপ নিয়ে ও কিছুতেই নিচুতলার জীবনে ও জীবিকায় অভ্যস্ত হতে পারল না। একটা টিউব লাইট লাগিয়ে, পাখা সারিয়ে, ও বড় জোর ত্রিশ টাকা পায়। ওর এক দিনের তেল। এ বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে নিয়ে এখন ছোটখাটো আলোকসজ্জার কাজ ধরে। যদি ও চায়, ভালভাবে বাঁচতে পারি। সামান্য সম্বল করে ভালবেসে ভালভাবে বাঁচা যায়। দেখি তো, বিত্তের লোভ, বৈভবের মিথ্যা প্রদর্শনের আত্মবঞ্চনা ওকে মানুষ রাখেনি।’

‘দশ হাজার টাকা আরও পেলে তুমি ছ’ মাসের ভাল থাকা কিনে ফেলতে পারো? তারপর?’

‘জানি না ঝুমুর। আমার কোনও তারপর নেই।’

‘আমি আসছি।’

ঝুমু নিয়ে এল মুঠোভাষ।

‘টোপর।’

‘বলো ঝুমু।’

‘তোর টাকা আছে?’

‘আছে।’

‘আমার দশ হাজার টাকা লাগবে।’

‘নিয়ে যাও।’

‘কেন লাগবে, বলি?’

‘বলা জরুরি নয়। তবে তোমার যদি ইচ্ছে করে বলবে নিশ্চয়ই।’

‘তোর সব ঠিক আছে তো বাবু?’

‘না।’

‘কেন রে সোনা?’

‘সন্ধ্যাবেলা চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম। মনে হল, তুমি কাঁদছ। তুমি ভাল নেই।’

‘এমন করে না সোনা। আমি ভাল আছি।’

‘না ঝুমু। আমি টের পাই। কী করে পাই, জানি না। বোধহয় কোনও মহাজাগতিক সংকেত কাজ করে। তোমাকে বাদ দিয়ে তো আমি নিজেকে ভাবিনি। তুমি আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছ। জানো কি, আমার উপার্জনের প্রথম অপরূপ টাকাকড়ি আমি ছুঁইনি এখনও। তোমার আঁচলে দেব। কথা ছিল।’

‘না টোপর, পাগলামি করে না। মন ভাল রাখ। আমার সোনা না তুই?’

‘সন্ধ্যা থেকে একবারও ফোন করোনি কেন?’

‘হল না। বুঝিস না? কত কাজ। লাল আছে। আসে না তো বেশি।’

‘হুঁ। টাকা ওর জন্যই তোমার প্রয়োজন ঝুমু।’

‘হ্যাঁ টোপর।’

‘জানি তো আমি তোমায়। তোমার মধ্যে যে এক বনদেবী বসে আছে। ফুলের গয়না পরা। তার কোনও বৈষয়িক চাহিদা নেই। সে শুধু ভালবাসে। প্রাণ দিয়ে মন দিয়ে ভালবাস। ভালবাসা পেল কিনা তাও ভাবে না।’

‘ও পাগল…! এবার রাখি?’

‘ঝুমু, তোমার ফোন না এলে মনে হয় আমি পাতালের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি। স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। পিচ্ছিল পথে আমি দ্রুত নেমে যাচ্ছি কোন অতল জগতে।’

‘এ রকম করে না। আমার সংসার আছে না?’

‘সেটা তো আমারও সংসার গো ঝুমু। তুমি কি জানো, যখন রান্না করো, আমি তোমার করতলে খুন্তি চেপে ধরি, আমি তোমার ফুসফুস ঢেকে দিই আমার দু’হাতে যাতে তেল, কালি, ধুলো না ঢুকতে পায়, তোমার গোপন বিজন অশ্রু, তোমার প্রকাশিত লজ্জিত আঁখিবারিধারা আমি হোমিওপ্যাথির শিশিতে লুকিয়ে রাখছি এক সুবিশাল দারুমঞ্জুষায়। তোমার বর কি তোমাকে চুম্বন করেছে? আমি জানি, করেনি, এখনও করেনি। তুমি জেনো, আমি তার দুই ঠোঁটে বিছিয়ে থাকব স্বয়ং চুম্বন।’

অন্ধকার কোণে ঝুমুরের হাত চেপে ধরল শাশ্বতী ননদিনী।

‘এ তুমি কী করলে?’

‘অন্তত ছ’মাস ভাল থাকো।’

‘তারপর? কতবার ঝুমুর? কেন? টোপর তো আমার কেউ নয়।’

‘আমি কি তোমার কেউ?’

‘আমার বান্ধব হও ঝুমুর। বড় একা আমি। কেউ নেই যাকে আঁকড়ে হৃদয় ভোলাব। আজ তুমি কত ভালবেসে নরম পাপড়ি দিয়ে ঢেকে দিলে ক্ষত, দাদা কি জানবে? বুঝবে তোমাকে কোনও দিন? ঝুমুর, তোমার ঋণ আমি কীভাবে শুধব?’

‘রইল ঋণ। সুদে বাড়ুক না। বুঝে নেব একদিন।’

‘কিন্তু এর মধ্যে টোপর যে এসে পড়ল। না না। ঝুমুর। যা হয় হবে। ও টাকা দিয়ো না আমায়। চেয়ে চেয়ে আমি নষ্ট হয়ে গেছি। লোভ বাড়িয়ে দিয়ো না। আমি যখন অসহায় বোধ করি, আমার কাণ্ডজ্ঞান চলে যায়। না হলে পোকামাকড়ের মতো আসি এভাবে? বাঁটুলের আত্মমর্যাদাবোধ আমার চেয়ে বেশি।’

‘আমি তোমাকে এভাবে থাকতে দেব না। কিছু একটা করব। টোপরকে বলব। ওর খুব বুদ্ধি। ও ঠিক পথ বলে দেবে। তোমার আপত্তি নেই তো? আমি একটু সময় শুধু চাই।’

‘আমার পথ বন্ধ। কেন মিছে মৃতকে জীবিত ভেবে বিছানা সাজাবে? কেন এক লোভী, বোকা, পালছেঁড়া, হালভাঙা মেয়ে তোমার করুণা পাবে বৃথা পরিশ্রমে!’

‘তুমি আজ কতদিন পর হৃদয় খুলেছে বলো। তার দাম নেই?’

‘দশ হাজার টাকা! টোপর চাইলেই দিয়ে দেয়!’

‘আগে তো চাইনি। এই প্রথম।’

‘ও তোমার কী ঝুমুর?’

‘আমার বড় প্রিয় ও। ওকে বড় ভালবাসি।’

‘আর ও?’

‘ও? ভালবাসে।’

‘খুব ভালবাসে। তুমি বোঝো না। মানুষ বিনা প্রশ্নে অনায়াসে টাকা দিয়ে দেয় দু’ কারণে।’

‘কী কী?’

‘বদ মতলবে, যাকে খাবে বলে জিভ চাটে আর বিপরীতে যাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।’

‘কাল কি যেতেই হবে?’

‘না। থেকে যাব। আরও একটু ভিক্ষা ভিক্ষা খেলা হবে। যদি দিয়ে দেয় দশ হাজার! কেন?’

‘একবার ওবাড়ি যেতাম। তুমি সঙ্গে গেলে উনি, মানে তোমার মা রাজি হলেও হতে পারেন।’

‘যাব। দেখব টোপর। এক আশ্চর্য ছেলে।’

ঝুমু ভারী স্ফুর্তিতে টইটম্বুর হঠাৎ। অনেক অনেকদিন পর। সে যাবে। কাল যাবে। তার বুকের ভিতর থরো থরো আনন্দলহর। বাবা নয়, কাকা নয়, ঝিরি, নমি, গোপালীমাসি নয়, তার মন জুড়ে শতরূপ, আনাচে কানাচে শতরূপ ভূমিতে আচ্ছাদে শতরূপ শতরূপ টোপর টোপর! সে ঘরে ফিরে এল।

খ্যাস্ খ্যাস্ সুঁক্ সুঁক্ ওঁয়াও মু উ উ উ! দেহলোমে বহুক্ষণ বিলি পেয়ে বাঁটুল তৃপ্তিতে উতরোল।

‘ইয়ে…খক্ খক্, খুক্…হুখুর হুঁখর…’

কাশি, গলা ঝাড়া, দ্বিধাবিজড়িত। সন্দীপন বলে উঠল, ‘আমি তো মেঝেতে শুতে বলিনি। ওটা তোমার সিদ্ধান্ত।’

‘লালের বিছানায় শুতে পারি। ঘর তো ফাঁকাই থাকে। লালের অনুমতি নিয়ে নেব।’

‘লালের সঙ্গে বেশি মেশামিশি না করাই ভাল। মাতাজি বলেছেন, ওর মধ্যে অশুভ শক্তির আধিক্য। ও এলে এবাড়িতে নেগেটিভ এনার্জি বেড়ে যায়। ওর জন্য বাবার এই দশা।’

‘ও খুব করুণ অবস্থায় আছে। আমি আর কী বলব, আপনারা অনেক বেশি জানেন। আমাদের কানাই সামন্ত সরু গলিতে কোনও মেয়ের ওপর মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার হলে বাকিরা কোমর বেঁধে তার প্রতিকারে লেগে পড়ে। সকালে গলা খুলে ঝগড়া, বিকেলে প্রয়োজন পড়লে একে অপরের সহায়। আমি ওদেরই কাছে শিখেছি।’

‘লাল নিকৃষ্ট জীবন বেছে নিয়েছে। আমরা ওর জন্য যথেষ্ট করেছি। ও তোমার সঙ্গে বন্ধু পাতাচ্ছে, এবার তোমার গহনায় টান দেবে।’

‘ছি ছি! না! এভাবে বলবেন না! আপনার বোন!’

‘বড় মাসির ছেলের বিয়েতে বেশ কিছু গয়না চুরি গিয়েছে। সবাই জানে এটা লালের কাজ।’

‘ধরা পড়েছিল?’

‘না। তবে ওই ঘর ছেড়ে যেন নড়ছিলই না। তুমি এখন এ বাড়ির। তোমাকে বলা দরকার। মা বলছিল, তোমার গয়না সব মায়ের লকারে রাখার জন্য। তুমি চাইলে আমি আলাদা লকার করে দেব।’

‘কীভাবে প্রমাণ হল ওটা লালেরই কাজ?’

‘লাল সেসময় টাকা চাইছিল। আমরা দিইনি। ও তখন সুনন্দ মামার কাছে চায়।’

‘তিনি কি দিয়েছিলেন?’

‘না। দেবে কেন? কেউ দেয়? আমরা নিরুপায় হয়ে দিই। মাতাজির আদেশ, বাংলা নববর্ষ এলে ভাল তিথি দেখে কাশীতে আমাদের নামে যজ্ঞ চড়াবেন। তারপর আর ওকে টাকা দেওয়া যাবে না।’

‘ওকে এ বাড়িতে নিয়ে আসাও যাবে না?’

‘ওর সংশ্রব ত্যাগ করতে হবে।’

‘লাল কি তা জানে?’

‘যজ্ঞের পবিত্র ভস্ম না আনা পর্যন্ত নয়।’

ঝুমু বালিশ নিচ্ছে, চাদর, আজকাল কম্বল লাগছে না।

‘ইয়ে, মা খুব রাগারাগি করেছে। তুমি নীচে শোও। আজ থেকে বাঁটুলই নীচে শোবে। বিছানাটা পাতো। এপাশে পাতো। আমার এদিকে। যাতে হাত বাড়ালেই ওকে পাই। তোমার ওই বিছানাতেই ও শুয়ে পড়ুক।’

‘আমি কিন্তু ভালই শুচ্ছিলাম।’

‘মা জানল কেন তবে?’

‘কথায় কথায় লাল জেনেছে। ও বলে থাকবে।’

‘সে যাই হোক। বাঁটুলকে বুঝিয়ে বলেছি। ও তোমার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি।’

ঝুমু নিজের শয্যাখানি বাঁটুলের জন্য পাতছে পরিপাটি। তফাতই বা কী! সন্দীপনের চোখে অন্তত পার্থক্য কিছু নেই।

সে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়ল। বিবাহের পরবর্তী মাসাধিককালে এই প্রথম প্রলম্বিত সংলাপ। ঝুমু-র ক্লান্ত লাগছিল। সে চোখ বন্ধ করল। ভাবছে। সে যদি এই শাশ্বতীর দশায় পড়ে, কী করবে ঝিরি? কিংবা ঝিরি পড়ল এমন অবস্থায়। সে কি ঝিরিকে দেখে গয়না লুকোবে? আলমারির চাবি সামলাবে? গণনা করাবে কোনও ভাসমান সন্ন্যাসিনীর বিদু্ৎক্ষমতা দ্বারা? মহাযজ্ঞ কাশীতে, হরদ্বারে? জগৎ কি এমনই নির্মম? তার বাবাও কি বলেনি কুকুরের সঙ্গে শয়ন মানিয়ে নেওয়া চাই। খরচা করে মেয়ের বিয়ে দিলে মেয়েরা সমস্ত দাবি ও অধিকার যজ্ঞের আগুনে খইয়ের উৎসর্গের মতো পুড়িয়ে দিয়ে আসে। এ যেন নির্মম অগস্ত্যযাত্রা! নগদ অর্থ ও অর্থহীন সম্মানবোধের নিগড়ে পড়ে এক লটারির জীবন। যে মেয়ে নিজে বর বাছে, তার সকলই বরবাদ। তার স্বেচ্ছাসিদ্ধান্ত ঘৃণা করা হয়।

চকাস চুকুম পুশ ফুচ উঁ অ্যাঁও চুমু চলছে বাঁটুলে-সন্দীপনে। ঘরে সারাক্ষণই বাঁটুলি গন্ধ। যখন তখন যেখানে সেখানে বাঁটুলের লোম। সাধারণ মেয়ে ঝুমু, অতি সাধারণ, শ্বশুরঘরে শয্যা পেলে, মানিয়ে নাও, নাও। তোমার একটি বিয়ে, তোমার পরম লোভন। মানিয়ে নিতে না পারলে জাহান্নামে যাও।

সে মানিয়ে নেবে বলে পাশ ফিরল। ঝিরিটা কী করছে? আজ এস এম এস একটাই। ‘দাবাখেলা যথারীতি চলছে। গোপালীমাসি পরোটা ভেজেছিল। শক্ত। তোর একটা ছবি ল্যামিনেট করা। টোপরের ঘরে। বেশ ভাল ছবি। হি লাভস ইউ সো মাচ্। মি টুউ। মিস ইউ দি।’

হি লাভস ইউ। লাভস ইউ। লাভস ইউ। ইউ। ইউ। ইউ?

ইউ?

বুকের তলে শিরশির করে। কী এক কষ্টের মতো সুখ। কী এক অপার্থিব আনন্দ। টোপরকে ছেড়ে এসে ঝুমু বশ্যতা স্বীকার করা লাজুক মেয়েটি। টোপর পাগল। ছবি রাখল কেন? পাগল! পাগল একেবারে! ঝুমু বড়। ঝুমু অনেক অনেক বড় বয়সে।

গভীর আবেশ নিয়ে নিদ্রা গেল ঝুমু। আলো নিভে গেছে। রাস্তার অ-বাঁটুল কুকুরেরা জেগে আছে। আর আকাশের তারা। ছাতের ওপর টুপটাপ ঝরে পড়ে তারাদের ধুলো। কার ক্ষতমুখে কে যেন চেপে ধরে প্রেমময় তুলো। কোন দেশে কোন এক আকুল প্রেয়সী মদ্যপ প্রেমিককে লেখে চিঠি। শোণিতে অশ্রুতে লেখে— মদ নয়। আমাকেই পান করো চুমুকে চুমুকে। আমি সুরাময়ী হব। আমি তোমার অতল হাতে ধীরে অতি ধীরে নিঃশেষে হয়ে যাব সুরা থেকে সুর। এসো, পান করো বিভব আমার।

কিন্তু কবিতা ও সুরা ছাড়া আরও কত হাত। ঘন ও কঠিন। চ্যাটচেটে। কাঁপা কাঁপা! স্বেদসিক্ত।

হাতখানি ঘোরে ফেরে। পাছায়। কোমরে। বুকে পেটে।

কে?

ঝুমু ছুড়ে ফেলে দিল। কী করছেন?

সন্দীপন ঘন ঊরু দিয়ে চেপে ধরল ঊরু। তার গরম নিশ্বাসে পুড়ছে ঝুমুরের মুখ। কামড়ে ধরছে গাল, কান, গলা। এক হাত বুকে। অন্য হাত গভীর অসুখে টানাটানি করছে পোশাক। এক জানু যোনিতে আঘাত করছে নির্মমতায়।

ছাড়ুন! ছাড়ুন! কী করছেন।

হাঁপাচ্ছে। পুরুষটা হাঁপাচ্ছে। গায়ে কী জোর। ঝুমু পারছে না। পেরে উঠছে না।

দেখুন। আমি তৈরি নই। আমাকে সময় দিতে হবে। আঃ! লাগছে! উঃ! বাবা গো! না! প্লিজ না। আজ না। আমাদের কথাই হয়নি ভাল করে। না। না।

চোপ! এসব আমার অধিকারের জিনিস। চোপ! আরে!

ঘ্রাউ! ঘ্রাউ! ভুক! গ র র র! রাগী গলা বাঁটুলের।

বাঁটুল, একটাও শব্দ নয়। চুপ।

ঘ্রাউ! ঘ্রাউ! ঘ্রাউ! ঘ্রাউ!

এভাবে না। প্লিজ। ছাড়ুন। বাঁটুলের সামনে না।

ঘ্রাউ! ঘ্রাউ! গরররর! ওঁও ওঁও! ঘ্রাউ!

বাঁটুল! যাও! যাও! যাও!

ঘ্রাও ঘ্রাও ঘ্রাও!

তবে রে!

লাফিয়ে উঠল সন্দীপন। দ্রুত হাতে পাজামায় দড়ি আঁটল। এক লম্ফে শেকল পরালো বাঁটুলকে। বেঁধে দিল খাটের পায়ায়। দেরাজ টেনে বার করল চাবুক। শপাং শপাং সাঁই সাঁই সাঁই। শপাং শপাং….

বাঁটুল কাঁদছে উঁ উঁ মু মু উঁক উ উ উ উ উ উ…

ঝুমু-র হৃৎকম্প হচ্ছে। সারা দেহে কাঁপন ছড়িয়ে গেল। এইভাবে মারে কেউ! দেখো, গুটিয়ে যাচ্ছে প্রাণীটা। লুকোতে চাইছে। পিঠ বেঁকে গেল। বাবা গো! আদরের কাউকে এভাবে মারা যায়!

কী করছেন! বন্ধ করুন! মারবেন না মারবেন না মারবেন না!

কল্যাণী উঠে এসেছেন। শাশ্বতীও। কী হচ্ছে! ঘরে কী হচ্ছে!

ঝুমু বেশবাস ঠিক করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সন্দীপন দরজা খুলল। টেনে হচড়ে নিয়ে যাচ্ছে বাঁটুলকে। ছাতে যাচ্ছে। বাঁটুল যাবে না। প্রতিরোধ করছে। কাঁদছে। উঁ উঁ মুম্ মুম্। তার গলায় ফাঁসের মতো চেপে বসেছে গলাবাঁধুনি!

কল্যাণী বলছেন, ‘কী হল দীপ! মারছিস কেন বাঁটুলকে?’

‘কী রে দাদা!’

‘যাও! যাও যে যার ঘরে! আদর পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছে। ওর পায়তারা বার করছি আমি।’

‘কী হল ঝুমুর? দীপ এমন রেগে উঠল কেন?’

ঝুমুর নীরব। তার আর শব্দ নেই। ছাতে আবার পিটাই চলছে। কল্যাণী জ্বলন্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন, ‘তুই বাড়ি এলেই একটা নয় একটা অঘটন! মনে হয় দূর করে দিই।’

সেই রাতে ঝুমু বর পেল। পরাক্রমের কাছে কৌমার্য হারাল।

ভোরবেলা তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা, গায়ে ব্যথা, কামড়ের দাগ, আঁচড়ের রক্ত ফুটে ওঠা। এর নাম বিয়ে! এর নাম দাম্পত্য। এর নাম আইনত যৌন সহবাস। ঠোঁটে রক্ত মাখা ফল তুলে উড়ে যায় বিয়ে। কেউ সুখ ভেবে আনন্দে বিভোর, কেউ নিরানন্দ, ভাবে, এরই নাম চাবুক ও অপূর্ব নিহিত সন্ত্রাস।

ঝুমুরের চোখ থেকে জল পড়ল টুপ টুপ টুপ। সে ফোন নিয়ে ছাতে গেল। ধীরে, অতি ধীরে! যেন তার গায়ে জোর নেই, দীর্ঘ অসুখে সে ক্ষীণজীবী এক। তলপেটে লাগছে প্রতি পদক্ষেপে। যেন তার মনই শুধু নয়, শরীরের সমস্ত পেশি বিদ্রোহ করে বসে আছে। তারা অসহায় ক্রোধে জমাট-কঠিন! সে নিঃশব্দে ডাকল টোপর… টোপর!

যাবতীয় যন্ত্রণা ও অশ্রু সমেত তার কাছে টোপর ও শান্তি একাকার হয়ে গেল। ছাতের এক কোণে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে বাঁটুল। চোখ তুলে চাইল। মুখ তুলল না। ডাকলও না। স্বামী কি ধর্ষণ করে? স্বামীর ভোগের থালা সাধারণ মেয়ে। সে কি বাড়ি ফিরে বলবে, বাবা, ওই সন্দীপন অপমান করেছে আমাকে। ধর্ষণ করেছে। যাব না যাব না যাব না ও ঘরে। বাবা বুঝিবে কি? বিবাহের অধিকারে স্বামীরা চড়াও হয় নির্মমে স্ত্রীদেহে। বাবা বুঝিবে কি? হাঁ করে থাকবে। মানিয়ে নে। ভাল ছেলে দীপ। যোগ্য ছেলে, ভাল রোজগার। ভাল পরিবার।

বাঁটুল কি বুঝেছিল ধর্ষণ? নাকি তার ঈর্ষা হচ্ছিল? বাঁটুল কি ঝুমুর প্রতি ন্যায়িক সমর্থন দেয়, নাকি সে-ই এক প্রতিপক্ষ?

ঝুমু থেবড়ে বসে পড়ল ছাতে। বাঁটুলের কাছে। গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আহা! অনুগত প্রভুভক্ত! অনুগতজনে এ কি হে এ বিরাট শাস্তি! রাত থেকে রক্তপাত তার। নরম গলিত স্রোতের স্পর্শ টের পাচ্ছে সে। যন্ত্রণার লোহিত কণিকা।

‘টোপর!’

‘বলো ঝুমু।’

‘কষ্ট হচ্ছে রে। খুব। আমার লেগেছে।’

‘আহা! ঝুমু! কাঁদে না! সোনা তো তুমি! আমার কত আদরের! কাঁদে না এভাবে!’

‘আমাকে …জোর করে… টোপর কী নিষ্ঠুর!’

‘আহা! ঝুমু! এসো! সব ধুয়ে দিই। মুছে দিই। এসো। চলে এসো সোনা।’

‘এভাবে বলছিস কেন? আমি কত বড়! বড্ড কষ্ট হচ্ছে। তাই তোকে ফোন করলাম। ঝিরিকে কি বলা যায়? আর কাউকে কি বলা যায়?’

‘ঝুমু। ফোনই যে সম্বল। কী দিয়ে সারাব তোমাকে বলো! কথা দিয়ে! শব্দ দিয়ে! আদরের শব্দ কিছু! সেরে ওঠো। সেরে ওঠো তুমি।’

বাঁটুল ঝুমুর হাত চাটছে। অল্প। জিভের এই এতটুকু বার করে। চাটছে তুপ তুপ তুপ। মানুষী ও কুকুরীতে বোঝাপড়া ভালবাসা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মাঝখানে দর্পিত পুরুষ। নির্বিচারে মারে প্রিয়জনে। লুঠ করে অবলীলাক্রমে। টনটনে নির্বোধ কাম দিয়ে ফুঁড়ে দেয় যাবতীয় তলপেট মহীতলে।

স্নান সেরে শুয়ে ছিল ঝুমু। কল্যাণী চা পাঠিয়ে দিলেন। তিনি কি জানেন, ছেলে বধূসম্পত্তির দখল নিয়েছে জোর করে?

শাশ্বতী কোথায়? লাল? লাল কই? সে যে বলেছিল, ঝুমুকে ওইবাড়ি নিয়ে যাবে!

ঝুমু এসএমএস পড়তে লাগল। ‘চলে গেলাম। কাল কষ্টে ছিলে তুমি। আমি মেয়ে, বুঝি। অনেক ভেবেছি রাতে। তোমার টাকা নিতে পারব না গো। বড্ড ছোট লাগবে নিজেকে। আমি পতিত। অপয়া। অশুভ। আমি জানি। তুমি বড় ভাল মেয়ে ঝুমু। ভগবান তোমাকে সুখশান্তি দিন। ফোন কোরো। আমার এ ফোনে ব্যালেন্স থাকে না।’

ধর্ষণ কাকে বলে?

নারীর মতের বিরুদ্ধে এবং বলপূর্বক যৌনসম্ভোগ চলছে। দিনের পর দিন।

বিবাহ মানে কি? দুইটি জীবনকে যুক্ত করা হল। তারা একে অপরকে আজীবন বিশেষভাবে বইবে। যৌনতায়। দুঃখে। সুখে। দারিদ্রে। সাফল্যে। ব্যর্থতায়। রোগে ও শোকে।

সন্দীপন ও ঝুমু-র বিবাহ যৌনতার দ্বারে এসে উচ্ছৃঙ্খল ব্যভিচারী। ভালবাসা প্রেম বহুদূর, সন্দীপন ঝুমু-র সঙ্গে সুভদ্র বোঝাপড়া করে নেবার আগেই ঝুমু মনোমন্দিরহীন শরীরের স্তূপ।

তা হলে সন্দীপন একমাস দূরে ছিল কেন? কেন আগ্রহ দেখায়নি? আজও যদি সে শরীরে আগ্রাসী হয়, মনে হয় না কেন? ঝুমু, এক সাধারণ মেয়ে, মন ও শরীর নিয়ে বড় চিন্তিত এখন। সে কী করে? এই সংকটে সে কী করে? সে আর প্রতিরোধ প্রতিরক্ষা রচনা করে না। চাইলেই সুড়ঙ্গ খুলে দেয়। চাইলেই, বরফবিমণ্ডিত ধ্যানী পর্বত তার, গা বেয়ে উঠে যাওয়া আঙুল প্রতিম প্রাণী সে সহ্য করে অপার স্থিরতায়। কিন্তু সে জানে, সে চায়নি। এইভাবে চায়নি। এর মধ্যে যদি থাকত একটু প্রেমের মশলা, একটু এলাচ-দারুচিনি-তেজপাতা-লবঙ্গ মিশ্রিত ভালবাসা সুগন্ধ! নেই! ভালবাসা নেই। প্রেম নেই! সে অপমানিত। সে ক্লেদ ও গ্লানি মেখে অহোরাত্র খরতর দাহে পুড়ছে।

অন্তরে অস্থির সে। বাইরে গম্ভীর। শান্ত বাঁটুল তার মুখপানে চেয়ে থাকে। গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সে বসে যদি, তার পায়ে মাথা রেখে পড়ে থাকে। ঝুমুর শোবার ঘরে বাঁটুল আর প্রবেশ করে না।

এক রাত্রে সে অপ্রিয় রমণ সয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘কথা আছে।’

‘হ্যাঁ, বলো।’

‘আপনি এ আচরণ কেন করলেন একজন শিক্ষিত পরিশীলিত লোক হয়ে?’

‘আমাকে আপনি বলার দরকার নেই।’

‘আপনি মাতাজিকে গুরু মেনেছেন। নারীজাতির প্রতি আপনার সম্মান সমীহ থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল না কি?’

‘আমি কাউকে অসম্মান করিনি।’

‘আমাকে করেছেন। আমার আপত্তি সত্ত্বেও আপনি জোর করেছেন।’

‘তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী। এখানে জোরের প্রশ্ন কী করে আসে?’

‘আসে। শুধু আপনি তা বোঝেন না।’

‘অপুদি আসে তোমার কাছে মা বলছিল। ওর কাজই হল পাড়ার মেয়ে-বউয়ের মাথা খাওয়া। শি ইজ এ বিচ। অসহায় মেয়েদের শেল্টার দেবার নামে ব্রথেল চালায় আর মুখে নারীবাদী বুকনি ঝাড়ে। ওর ফাঁদে পা দেওয়া আমি বা মা বরদাস্ত করব না।’

‘কিন্তু তাঁকে আপনারা বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।’

‘সেটা ভদ্রতা। এক পাড়ায় বাড়ি। করতে হয়।’

‘দেখুন, আমি অপুদির হয়ে ওকালতি করছি না। তিনি কেমন সেটা তাঁর ব্যাপার। সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে শ্রদ্ধা ও সম্মানের একটি জায়গা থাকে, আপনি তার পরোয়া করেননি। সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়।’

‘দেখো, তোমার প্রেমে তো পড়িনি আমি। দাম্পত্যে দেহ আসবে। তোমার ভাল না লাগলেও আমার অধিকার আমি ছাড়ব কেন? মাতাজির আদেশে আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। আরও অনেক যোগাযোগ ছিল। কিন্তু জয়ীমাসি আমার মায়ের কাছে কেঁদে পড়েছিলেন, তোমার বর জুটছিল না। তো তোমাকে আমি ঘর বর সংসার দিয়েছি। মাথায় সিঁদুর দিয়ে বিয়ে করেছি। আর কী চাও? কোলে করে বসে থাকব? সত্যি বলতে কী, আমার তোমার প্রতি কোনও আগ্রহ নেই এটা বলে দেওয়া ভাল। তুমি জানো মাতাজি আমাদের কতখানি। তিনি বলেছেন ছেলে পাবার জন্য এটা অমৃতযোগ। মা নাতি চায়। তোমারও নিশ্চয়ই ছেলে পাবার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।’

‘আপনি আমায় জিজ্ঞেস করেছেন আমি এখুনি ছেলে চাই কিনা? আদৌ চাই কিনা।’

‘তাজ্জব! মেয়েমানুষ ছেলে তো চাইবেই। চায় না কারা। অপুদির মতো। পুরুষ শিকার করা কাজ। তুমি তো একটা ভাল মেয়ে!’

‘অপুদির মেয়ে আছে যতদূর জানি।’

‘বাবা কে জিজ্ঞেস কোরো।’

‘দেখুন, আমার প্রতি যখন আপনার কোনও আগ্রহ নেই, আমাদের সন্তান আনারও কোনও প্রয়োজন নেই। জগতে আর একটা বোঝা বাড়িয়ে কোনও লাভ আছে?’

‘আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মা নাতি চায়। তা ছাড়া স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম করবে, এটা ন্যায়সঙ্গত অধিকার।’

‘স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে না কিন্তু!’

‘ন্যাকামো কোরো না। আরও হাজার পুরুষ যা করে, আমি তাই করেছি।’

হে ক্রোধ, হে কষ্ট, হে অপমানজর্জরতা, এই সাধারণী তবে কী করে? বড় গ্লানি হে ঈশ্বর। সাধারণ মেয়েদের বড় অসহায় গ্লানি! এই ক্লেদ সে কী প্রকারে ধোয়! তার মনের মূল্য নেই? ইচ্ছার মূল্য নেই? ভালবাসা পেতে পারে না সে?

সে ব্যাগ নিল। সামান্য কয়েকটি টাকা। কাজ পড়ে আছে। রান্না পড়ে আছে। বাঁটুলের সেদ্ধ মাংস। শ্বশুরের স্ট্যু। সারা বাড়ি থেকে ক্রমাগত ধুলো ঝাড়া। সে সোজা গেল কল্যাণীর কাছে।

‘আমি বেরোচ্ছি।’

‘বেরোচ্ছ! কোথায়?’

‘বাড়ি যাচ্ছি।’

‘বাড়ি যাচ্ছ? বলা নেই কওয়া নেই ওমনি বাড়ি যাবে কি?’

‘আমি যাব।’

‘ও মা! এ কী কথা! সব কাজ পড়ে রইল, উনি চললেন ড্যাঙডেঙিয়ে।’

‘আমাকে যেতেই হবে।’

‘কী আশ্চর্য! ভিজে বেড়ালটি হয়ে থাকো, মনে হয় না তো দেখে! মা গো, আমাকে অমান্য করছ! একেবারে ব্যাগ কাঁধে করে তৈরি! পাগলা নাকি? মাথা খারাপ লুকিয়ে বিয়ে দিল শেষে? জয়ীকে ফোন করছি আমি।’

ঝুমু বেরিয়ে পড়ল। চলতে লাগল পথ। হাঁটছে। দিকশূন্য। চিন্তাহীন। কাউকে ফোনও করছে না। তার চোখে জল আসছে। সে বেপরোয়া কাঁদতে কাঁদতে চলেছে একাকী। এ গলি ও গলি, অচেনা কানাগলি, অচেনা মানুষ, ঘরবাড়ি, পুকুরের ধারে ধারে সুবিশাল পাতাওলা মানকচু গাছ, ছাইগাদা, গাদা গাদা ছাই— যেখানে মেয়েদের শিশুজন্ম গতি পায়, গাদা গাদা পাঁক— যেখানে মেয়েদের নামিয়ে আনা হয়, গাদা গাদা ব্যবহৃত বস্তুর স্তূপ, আবর্জনা, ছেঁড়া চটি, কুকুরের দাঁতে কাটা রক্ত মাখা রজঃস্রাবশোষী তুলো ছড়ানো ছেটানো-সব মেয়ে, সব মেয়ে, সব নারী, পৃথিবীর সমস্ত অদরকারি, ফেলনা, দুর্গন্ধ আবর্জনা বৃহৎ নিটোল অর্থহীন ডিম্ব প্রসব করা স্ত্রীলিঙ্গ বিশেষ!

অবশেষে সে এসে দাঁড়াল ব্রিজি মেট্রো ইস্টিশানের দোরগোড়ায়, সড়ি ভাঙতে লাগল ক্লান্ত দুই পায়ে। এই ইস্টিশানের দ্বিতীয় নাম শহিদ ক্ষুদিরাম। কিংবা ক্ষুদিরামই নামের প্রকৃত পরিচয়। ব্রিজি মৌখিক নির্মাণ!

তার শ্বশুরঘর থেকে সবচেয়ে কাছে হয় গড়িয়া বাজারস্থিত কবি নজরুল ইস্টিশান। সেদিকে যায়ইনি সে। ঘোরের ভিতর সে ট্রেনে চাপল। নামল। হাঁটছে আলুথালু। চলছে এলোমেলো। মন চলো। মন চলো। কোথায় নিয়ে যেতে চাও হে!

তার ফোন বাজছে।

কে?

বড়পিসি।

সে ধরল না। ধরবে না!

একসময় পৌঁছে গেল তার পুরোন এলাকায়।

‘কেমন আছ ঝুমুদি?’

‘কেমন আছিস তুই নমি?’

‘ভাল আছি। কতদিন পরে এলে! শ্বশুরবাড়িতে গিয়েই বুঝি ভুলে গেছ! আমাদের মনে পড়ে না?’

‘খুব মনে পড়ে রে নমি। এখানে কী ভাল ছিলাম! মুন্নার মা’র সঙ্গে ঝগড়া করিস এখনও?’

‘না ঝুমুদি। সেই সুখ আর নেই। মাসির গলায় ক্যান্সার হয়েছে।’

‘ও মা! সে কি!’

‘অত দোক্তা খেত সবসময়! এই তো ধরা পড়ল। ক’দিন ধরেই অসুস্থ অসুস্থ। গলা ব্যথা। খেতে পারে না। শুধু বলে, জ্বলে যাচ্ছে। খাবার নামলেই জ্বলে যাচ্ছে। ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিল। সারল না, তখন ভাঙড়ে গেল।

‘আহা রে।’

‘সবাই বলছে বম্বে যাও। টাকা লাগে না, বলো? আমাদের আবার বম্বে-ট্রম্বে। চিত্তরঞ্জনেই যা করার করছে।’

‘সত্যি খুব খারাপ লাগছে রে।’

‘শিবুর বউয়ের কথা জানো?’

‘না।’

‘ওঃ! সে যা কেচ্ছা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে হবে না। রসিয়ে বলতে হবে। আজ থাকবে তো? রাতে যাব তা হলে।’

‘থাকতেও পারি। জেনে নিস।’

‘পলাশ আমাকে একটা ফোন কিনে দিয়েছে। সেকেন্ড হ্যান্ড অবশ্য। তোমার নম্বরটা দাও তো, একটা মিসড কল মারি।’

‘লিখে নে।’

‘টোপর চাকরি দিয়েছে তো পলাশকে, জানো তো?’

‘জানি। টোপরের সঙ্গে কথা হয়। মুন্নার মা, শিবুর বউয়ের খবর কিছু বলেনি। তাড়া থাকে তো।’

‘খুব বড় চাকরি করে টোপর। পলাশ বলছিল। একজন প্রতিবন্ধী যে কত বাধা অগ্রাহ্য করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে যায়, টোপর তার উদাহরণ। কিন্তু বড্ড বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে। ভয় লাগে। তুমি কিন্তু রোগা হয়ে গিয়েছ ঝুমুদি। জামাইবাবু ঘুমোতে দেয় না? সারা রাত জাগিয়ে রাখে? হি হি হি! প্রথম প্রথম খুব হয়, ঝুমুদি?’

‘অ্যাই, চুপ কর, ফাজিল কোথাকার। আমি বাড়ি যাই এখন। দেখি, গোপালীমাসির কাছ থেকে চাবি নিই।’

তাকে দেখে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে গেল গোপালীর। ঘর্মাক্ত কর্মক্লান্ত মুখখানা আলোয় আলো। দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন, যেন ঝুমু-র গর্ভধারিণী, বলছেন, ‘ওমা! ঝুমু! হঠাৎ এখন! কতদিন আসোনি মা! জামাই কই? পরে আসবে?’

ঝুমুকে জড়িয়ে ধরছেন। ঝুমু গোপালীমাসির গায়ে চিরপরিচিত গন্ধ পাচ্ছে। তেল, পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, ময়লা, ঘাম মিশ্রিত এক অসামান্য মাতৃত্বময়ী গন্ধ! সে বলল, ‘বড় মন কেমন করছিল মাসি! শাশুড়ির আপত্তি ছিল, তবু চলে এলাম!’

‘সে আবার কী? এটা কি ভাল হল ঝুমু?’

‘কেন নয়? আমার ইচ্ছে বলে কিছু থাকতে নেই মাসি?’

‘যাক, যাক! এসে যখন পড়েছ, আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। যাও, ঘরে যাও। আমি যাব’খন পরে।’

চাবি নিয়ে চলে এল ঝুমু! এই কানাই সামন্ত সরু গলি, এখানকার রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ তাকে মোহিত করে দিতে লাগল। যেন সে শাপগ্রস্ত প্রস্তরমূর্তি থেকে সদ্য মানুষতাপ্রাপ্ত! কতদিন…কতদিন পর!

সেই বাড়ি! আঃ! কতদিন পর! দরজা বন্ধ করল ঝুমু। বড় করে শ্বাস নিল। তারপর কাঁদতে লাগল হু হু করে। কোথায় যে ব্যথা বাজে, সম্পূর্ণ বুঝতেও পারছে না। সে যেন পরাজিত। নিঃস্ব। সাধারণ মেয়ে হিসেবে এই তার জীবন। কোনও ব্যতিক্রম নয়। তবু তার মনে হচ্ছে সে নিঃশেষিত। চতুর্দিকে পড়ে আছে তারই দেহমন পুড়ে যাওয়া ছাইভস্ম!

সে আধো আলো ঠান্ডা একতলার ঘরে মায়ের হলদেটে ছবির সম্মুখে দাঁড়াল। এই ছবি তারা ময়লা হতে দেয়নি। বছরে দু’দিন, জন্ম ও মৃত্যুর দিনে জ্যোতির্ময় মালা দিতে কখনও ভোলেননি। সে নিজেরই ভেতরকার গড়ে উঠতে থাকা মায়া ও মাতৃত্বচেতনার দ্বারা মাকে বুঝে উঠতে চায় আজ।

বড়পিসি বলেছিল, ‘তোর মা নেই, মা পাবি এইবারে। কল্যাণীদি বড় ভালমানুষ।’

শাশুড়ি কি মা হয়? সমস্ত জন্মদাত্রী মা হয়? সমস্ত প্রতিপালিকা গর্ভধারিণী কি মা হয়? ওমা ওমা ওমা আমি কী করব? আমাকে যে মরতে হবে মা। আমি যে টোপর ছাড়া থাকতে পারছি না। মা…! ও টোপর…!

‘তুমি! কখন এলে! ফোন করোনি কেন?’

‘চলে এলাম।’

‘বাড়ি গিয়েছিলে? এসো এসো।’

‘আসব? আসলে বাড়িতে বাবা-ঝিরি কেউ নেই। পলাশ, কেমন আছিস?’

‘আমি ভাল আছি। তুমি কীরকম আছ ঝুমুদি?’

‘ভাল আছি। টোপর, হুট করে চলে এলাম, তোর কাজের ক্ষতি হবে, না রে?’

‘তুমি কবে থেকে এত পর হয়ে গেলে? এবাড়িতে কোনও দিন ভেবেচিন্তে এসেছ তুমি? এটা এখনও তোমারই বাড়ি আছে ঝুমু।’

পলাশ একপলক তাকাল টোপরের দিকে। ঝুমু সম্বোধন সে লক্ষ করেছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আমি তবে ক্যামাক স্ট্রিট বেরিয়ে পড়ি?’

‘যা। সব গুছিয়ে নিয়ে যা। ফোন করবি।’

টোপর ঝুমু-র দিকে ফিরল। দেখছে গভীর অভিনিবেশে। ঝুমু দেখছে তার ছবি বাঁধিয়ে টেবিলে রেখেছে টোপর!

‘ফোন যে করোনি, আমি যদি ক্যামাক স্ট্রিট চলে যেতাম!’

‘তোর ফেরার জন্য অপেক্ষা করতাম টোপর!’

‘কী হয়েছে ঝুমু? এত অস্থিরতা কেন? যা হয়েছে তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলে না কেন?’

‘আমার কিছু ভাল লাগছে না।’

‘আবার কাঁদছ তুমি ঝুমু। এসো, আমার কাছে এসো। দরজা বন্ধ করে দাও।’

আগে যখন টোপরের রাগ হত, অভিমান হত, ঝুমু এসে পায়ের কাছে বসত। টোপর বলত, ঝুমু ওভাবে বসলে তার পায়ের সাড় আসবে। গড়গড়ির কী হবে তখন?

আজ দু’জনের মাঝখানে হাসি নেই, কৌতুক নেই, বিষাদ ও গাম্ভীর্য।

‘আমি তোমার পাশে বসতে চাই। আমাকে সাহায্য করো ঝুমু। আমার তালবেতাল দাও। কতদিন পর তুমি এলে! আর আমি ছাড়ব না তোমায়। আমার যে কিছুই ভাল লাগে না তোমাকে ছাড়া।’

‘আমারও লাগে না।’

ঝুমুর স্বর বুঁজে এল। এক পলক চোখ রাখল টোপরের চোখে। এঘরে পা দিয়ে টোপরকে দেখা মাত্র তার বুকে ধ্বক ধ্বক করছিল। তার সমস্ত শরীর কেমন অবশ বিবশ, মধ্যদেহতট বেয়ে কী এক শিরশির অনুভব নিম্নগামী স্রোতে বহমান। এ কোন আশ্চর্য বোধ? কোন বিহ্বলতা?

টোপর তার হাতখানি নিল হাতে।

‘বলো ঝুমু।’

‘টোপর, আমার সারাক্ষণ তোকে মনে পড়ে, সারাক্ষণ তোর সঙ্গে কথা বলতে প্রাণ চায়, আমার সব কাজে তুই, সবখানে তুই।’

‘সেটা যে হওয়ারই ছিল ঝুমু।’

‘এটা ঠিক নয়। আমি তো মানিয়ে নিচ্ছিলাম। আমাকে অপমান করল। প্রতিদিন করে। বলে, আগ্রহ নেই, শুধু উত্তরাধিকারী চায় বলে…আমি কি একটা মানুষ নই? বিশ্বাস কর, আমার আর বাঁটুলের মধ্যে কোনও তফাত নেই।’

টোপর চুপ করে আছে। এই বিষ নিতে নিতে সেও হবে বিষকলেবর। আজ সে বিষে নীল হোক। এই বিষ নিতে নিতে সে এক কালকূট ঝরাতে ঝরাতে যাবে কোন স্বর্গপানে? স্বর্গ, না নরক? যদি ঝুমু থাকে, তাহার সকলি স্বর্গ, ঝুমুহীন সর্বত্র নরক নরক!

কিন্তু কী বলে সে! ঝুমুকে যে কষ্ট দেয় তাকে সে হত্যাও করতে পারে। তবু, কিছু বলা সমীচীন নয়। সেও যে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করে আছে যদি ঝুমু আসে। যদি আসে! তার কোনও কথা যদি ভুল বোঝে ঝুমুদি প্রেয়সী! ভাবে যদি, মতলব ভাল নয়, বিবাদ বাধাতে চায় স্বামীতে স্ত্রীতে। যত কাছাকাছি হও, যত প্রাণের মধ্যে প্রাণ নাও, শেষাবধি প্রতিটি মানুষ একেকটি আলাদা দ্বীপ! মধ্যবর্তী জলভাগ ভুলে যেতে নেই!

সে পরম আদরে হাতখানি ধরে থাকে শুধু আর ঝুমুকেই কথা বলতে দেয়। অজস্র অজস্র কথা, অবিরল, কান্না মেশা, ক্ষোভ মেশা, ঘৃণা মেশা।

একসময় বলতে বলতে, শুনতে শুনেত, তারা ভুলে গেল কে আছে কোথায়। ভুলে গেল এ জগৎ কাকে কী আখ্যা দেয়। কী নিয়ম। কোন ন্যায়। কোন দোষে কেবা হয় দোষী।

‘আমাকে জোর করল কেন? জোর করল কেন? আমি তো মানিয়ে নিচ্ছিলাম। বাঁটুলকে নির্বিবাদে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিলাম। মন ছাড়া সম্পর্ক হয় নাকি? মন ছাড়া মা হওয়া যায়? ও টোপর, আমার সমস্ত শরীরে অপমান, মনে অপমান। আমাকে সারিয়ে দাও।’

‘এসো ঝুমু। সব শুষে নেব। সব দাগ মুছে দেব। এসো। কোনও ভয় নেই।’

এতকাল টোপর শুয়েছে কোলে, আজ ঝুমু মাথা রাখল টোপরের সবল, সাড়বান, যুবক ঊরুতে। অপূর্ব পুলকে সে কেঁপে কেঁপে উঠল। টোপর শক্তিমান বাহু দ্বারা তুলে নিল তাকে। কপালে চুম্বন দিল। নরম চুম্বন দুই চোখে। তাড়াহুড়ো নেই। আগ্রাসন নেই। কাম এক রিপু বটে, মানবিক প্রেরণায় রিপুরূপী কাম হয়ে ওঠে সুন্দরতর এক প্রেম। তাই তো মদনদেবতার কন্দর্প নাম! প্রেম গভীর ও সুন্দর। প্রেম সত্য ও অনির্বাণ। তার গভীরের তল নেই। উঁচুতার সীমা নেই। বিস্তার আদিগন্ত মেশা। তাকে পেতে জানতে হয়। ক’জন তা জানে?

ওষ্ঠে-অধরে মেশা বিপুল প্লাবন! নদী হয়ে গেল ঝুমু। সমুদ্রসমান হয়ে শতরূপ নামের যুবক তাকে পুরোপুরি অধিকার করে নিল।

কে ওই নারী? সংস্কারহারা! লজ্জাহীন! ভয়হীন! কেবল প্রেমের জোয়ারে ভেসে উঠে আসে কোন এক অর্থময় রতিব্যঞ্জনায়। অসাড় পা সমেত অর্ধাঙ্গ যুবক, রতিদেবী তাকে আলিঙ্গন করেন। অগ্নিময়ী দেবিকা ধীরে ধীরে ইন্দ্রাসনা হয়ে উঠলেন। শতরূপ দেব দু’হাতে ধারণ করলেন ক্ষীরামৃতভরা ঘট। আর মন্থন হতে লাগল রসপারাবারে।

প্রথম সঙ্গমের অতিশয়ী যন্ত্রণা টোপরের, প্রথম অদক্ষ ওঠাপড়া, ধর্ষণশাপমুক্ত ঝুমুর কামিনী, ছন্দে ছন্দে গড়ে নিল চিরবসন্তনগরী।

এই ভঙ্গি কোথা পেল ঝুমু? জানে না সে। এই আরোহিণী হয়ে ওঠা— সে কি বিগত মুহূর্তেও জানত এরকমই হবে?

হয়তো দেখেছিল ফিল্মে। হয়তো ছবিতে। মনে নেই। তবু মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে।

অতঃপর ঝুমু ও টোপর, সুদীর্ঘ সময়, শুয়ে রইল শরীরে শরীর।

টোপর ও ঝুমু ও মধুর মুরতি

কতদিন পর দু’জনে কফি নিয়ে মুখোমুখি। ঝুমু-র দু’নয়নে প্রেম। টোপরের দু’নয়নে ভালবাসা, ঝুমু সলাজ, নবজলতরঙ্গে নবকল্লোলিনী। শতরূপ গভীর পুরুষ মনোময়।

‘থাকো ঝুমু। যেয়ো না।’

‘এভাবে কি চলে আসা যায়?’

‘এ আনন্দ ফেলে কোথা যাবে?’

বড়পিসির সাতখানা অধরা ডাক, জ্যোতির্ময়ের পাঁচখানা, ঝিরির একটি। সঙ্গে বার্তা, ‘তুই কোথায়? বড়পিসি ও বাবাকে ফোন কর। ভাবছে।’

জ্যোতির্ময় বললেন, ‘শাশুড়িকে না বলে চলে এলি ঝুমু? এ কেমন ব্যবহার? কোথায় তুই?’

‘টোপরের কাছে। শাশুড়িকে বলে এসেছি।’

‘বড়পিসিকে ফোন কর।’

জয়ী বললেন, ‘ওভাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এলি?’

‘কীভাবে?’

‘ছিছি ঝুমু, তোর কত প্রশংসা করেছি। এভাবে বোকার মতো চলে এলি?’

‘আমি ওঁকে বলেই এসেছি। আসতে পারি না? আমি কি বন্দি?’

‘শ্বশুরবাড়িতে প্রথম প্রথম নিষেধ মানতে হয়। আপন করে নিতে শিখতে হয় ঝুমু।’

‘তুমি তো আপনজন বড়পিসি, তোমাকে মায়ের মতো মেনেছি! কী বলে আমাকে কুকুরের জায়গায় ঠেলে দিলে? আমি বোকা। আমাকে কোথাও গুঁজে দিলেই হল।’

‘এজন্যই উপকার করতে নেই। আইবুড়ি হয়ে শুকিয়ে মরছিলি, বর জুটিয়ে দিলাম, কোথায় বর্তে যাবি, উলটে চোপা করছিস। আমার হয়েছে জ্বালা। ছিছি। কী লজ্জা! কল্যাণীদি আমার মুখে চুনকালি দিলেন!’

‘আমি শুধু বাপের বাড়ি এসেছি, এতে তোমাদের মুখে চুনকালি কী করে পড়ে?’

‘এত চোপা তোর! এত মুখ! এমন তো ছিলি না তুই ঝুমু? সব শুনেছি আমি। ওই ল্যাংড়ার সঙ্গে তোর রোজ গপ্পো! ও-ই তোকে কুবুদ্ধি দেয়। আমি হলফ করে বলতে পারি, তুই ওরই কাছে বসে আছিস!’

‘হ্যাঁ গো পিসি! আমি টোপরের কাছে বসে আছি! চারদিক দেখে বুদ্ধি আমার আপনিই খুলে যাচ্ছে। বোল নিজেই ফুটছে। কী করব বলো! আমি জানি আমি কোনও অন্যায় করিনি!’

ঝুমু ও টোপর কফি খেল। গভীর চুম্বন করল ফের।

‘থাকো ঝুমু। ও বাড়ি তোমার জন্য নয়।’

‘আমি বড় টোপর। আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে। বাবার সম্মান, বড়পিসির সম্মান।’

‘তুচ্ছ করো। সব তুচ্ছ করে এসো। যে সম্মান বদ্ধমূল অর্থহীন সংস্কারের প্রতিনিধি মাত্র, অস্বীকার করো তাকে। তুমি মরে যাবে তিলে তিলে। ক্ষয় হয়ে যাবে। তোমার জীবনীশক্তি আহুতি দেবে কোন সংস্কার? আজ বলে দাও-যাবে না। যাবে না কোথাও।’

‘এভাবে চলে আসা যায় না।’

‘ঝুমু, আমি কখনওই তোমায় জোর করব না। আমি জোরে বিশ্বাসী নই। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে জোর করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে সে পন্থা অচল। সেখানে কোথাও অধিকার বলে কিছু নেই। যা আছে কেবল স্বীকৃতি। সেখানে উভয়েই দাতা, প্রার্থী উভয়ে। পরিস্থিতি ভেদে অবস্থান শুধু বদলে যায়। ঝুমু, আমি বলছি থেকে যাও, কারণ তা অনিবার্য। আমি তা দেখতে পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছ না কারণ মায়াঞ্জন পরে আছ। ওটা ধুয়ে ফেলো। জীবনের অভিমুখ পালটানো কি যায় না? আমরা কেউ বলিপ্রদত্ত নই গো।’

‘টোপর, হয়তো তুই সত্যদ্রষ্টা। আমার আগেই তুই আমাকে চিনেছিলি। তোকে ছেড়ে চলে না গেলে আমার হৃদয়ে প্রেম চিহ্নিত হত না। জানাই হত না মনোজগতের ইতিকথা। টোপর, আমার সমস্ত দিয়েছি তোকে। আজকের আদরটুকুই না। তুই আছিস, এইটুকু জানা দিয়ে সমস্ত সইব আমি। দায়িত্ব কীভাবে অস্বীকার করি। সমাজ বন্ধন দেয়, তার শক্তি সহজে কি অতিক্রম করা যায়? আমার যে ওই অপরাধবোধ, তুই ছোট, কত ছোট, কী করে তোকে আমি প্রকাশ্যে স্থাপন করি!’

‘লোকে কী কবে, তাই না? লোক, লোক। তুমি অল্প অল্প মরে যাচ্ছ, কেউ কি পাঠাবে মৃতসঞ্জীবনী? ওই যে মেয়েটা, লাল, মরে যাচ্ছে, কেউ কি জীবন দিল তাকে? টাকা দেয়। তবু বলে না তো, ছেড়ে আয়। ও নরক তোর জন্য নয়। টাকা দিয়ে কী কেনে? ঠুনকো বানানো সম্মান। সংস্কার এমনই গভীর, ভুল পথ মৃত্যুর চেয়ে বেশি মর্যাদা আদায় পায়। ওই লাল নামে মেয়েটাকে সবাই আসলে পুড়িয়ে মারছে চন্দনের মহার্ঘ চিতায়। ঝুমু, জীবনের দিকে দেখো। মৃত্যু নয়। মৃত্যুকে ডেকো না। আরোপিত অর্থহীন রীতিতে নীতিতে দিয়ো না হৃদয় বিসর্জন। ও ঝুমু।’

‘পারব না টোপর। ভালবাসি তোকে। ভালবাসি। তবু পারব না।’

‘আমি রইলাম ঝুমু। আজীবন তোমাকেই ভালবেসে। আমি আছি।’

সন্দীপন ও ঝুমু ও নদীর কুমীর

ঝুমু যাবে না। যাবে না বাপের বাড়ি। এক সাধারণ মেয়ে সামাজিক সম্বন্ধ অবলম্বন ছাড়া আর কী বা করতে পারে! শাশ্বতী কি পারল, ওই নিগ্রহ, অপমান, প্রেমহীন পীড়নের সম্পর্ক ছেড়ে আসতে? আসা যায় না। ঝুমু এমনই বিশ্বাস করতে চায়, এমনই আঁকড়ে নিতে চায়। তারই উপর নির্ভর করছে বাবার সম্মান। পিসির সম্মান। তার নিজের ভবিষ্যৎ মর্যাদা, অবস্থান।

এবাড়ির একজন হয়ে ওঠার জন্য ঝুমু প্রাণপণ প্রয়াসী।

সেই এক অপূর্ব মিলন সম্বল করে ঝুমু ফিরে এসেছিল, অবিস্মরণীয় এক বিজন দুপুরে। সে যখনই একলা হয়, নেড়েচেড়ে দেখে। গভীরতম প্রেম দিয়ে রচনা হয়েছিল যে মুহূর্ত তাকে ভাবলেই, তার মনে লাগে আনন্দজোয়ার। দেহে অভিসারিকার ভাব, কামোন্মাদনা। ঝুমু তার লালনপালন করে, যত্ন করে খুব। প্রতিদিন হাঙরের দাঁতে নিজেকেই ছেড়ে দেয় ছিন্নভিন্ন হতে। সেসময় টোপরকে ভাবে ঝুমু। টোপরকে জড়িয়ে ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে নামে। ও টোপর, টোপর। তুঁহু মম মৃতসঞ্জীবক।

এভাবে কি বাঁচা যায়? একদিন দু’দিন। তারপর? দু’ঠোঁটের মাছ ফেলে একদিন গাছের ডালের দিকে উড়ে যায় বক।

অভ্যাস হয়ে যাবে। সাধারণ মেয়ে, তার সব সয়ে যায়। তার তো টোপর আছে। শাশ্বতীর কে আছে? তবু টেনে যাচ্ছে তো! সাধারণীপনায়, প্রেমহীন নিকৃষ্ট জীবন নিয়ে প্রতিদিন ঘুম শয্যা জাগরণে সিদ্ধি প্রেরণায় শাশ্বতী ঝুমুর কাছে আদর্শ রমণী! সেখানেই সে নিরন্তর নিজেকে শাশ্বতীর অবস্থানে তুলনীয় রাখে। সে শাশ্বতীর চেয়ে ভাল আছে। শাশ্বতী, শাশ্বতী, লাল যার নাম, মোহাবেশে রাস্তায় বিছিয়েছিল কাম। কাম থেকে এখন সে কঙ্কালিনী নারী। গায়ে প্রস্রাবের দাগ, পায়ে পায়ে স্বগৃহে স্বয়ং ভিখারি।

ঝুমু নয়। ঝুমু ভিখারি তো নয়। ধারালো খাঁচায় প্রতিদিন একটু একটু করে ডানা কাটা যায়!

নিজেকে কঠোরে বাঁধতে সে আর টোপরকে ফোন করে ডাকে না। যখন আর না পারে, অন্তরাত্মা ছটফটিয়ে মরে টোপরের কণ্ঠলাগি, সে ছাতে যায়, ঘোরে, বাঁটুলকে জড়ায়, অপুদিকে পেলে দিব্য সামাজিক আলোচনা করে, ঝুল ঝাড়ে, অর্ধচেতন শ্বশুরের পায়ে ক্রিম ঘষে দেয়, আলমারি থেকে শাড়িগুলো নামায়, গুছিয়ে তোলে, ফোন করে ননদিনীকে, ফোন করে ঝাড়ু নমিকে, ঝিরিকে। অকারণ ঝুল ঝাড়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দেয়। টিভি দেখে। কিংবা দেখে না কিছুই। শোনে না কিছুই। যা করে, তাতে ফাঁকি নেই, কিন্তু প্রাণও নেই। ফাঁকি সে নিজেকেই অবিরত দেয়। বই পড়ে। একই পৃষ্ঠা বারংবার পড়ে। কিংবা দশ পাতা পড়ে মনেই করতে পারে না কী ছিল! তারও পর, সংবরণ অসম্ভবে ফোন করে।

‘টোপর।’

‘বলো ঝুমু।’

‘ভাল থাক।’

‘আমি ভাল আছি। ভাল নেই। আমাকে ডুবিয়ে ভালবাসা চেতনায় এ কোন আঁধার তুমি জড়াও রমণী। নিজেকে দিলেই যদি ঝুমু, কেন তবে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।’

‘টোপর। সোনা। আমি যে সারাক্ষণ তোকে নিয়ে থাকি। দিবানিশি। অণুতে অণুতে।’

‘ফিকে হতে দিয়ো না আমায় ঝুমু। তুমি ছাড়া কারও কাছ প্রেম যাচিব না। চাই না চাই না ঝুমু, আর কোনও মানুষী বা নারী স্রেফ মধুভাণ্ড এক।’

ঝুমু একমনে চুল ঝাড়ে, ফুল পাড়ে। নিতান্ত সাধারণ মেয়ে, শ্বশুরের ঘর প্রাপ্তি তাকে ভারী কৃতজ্ঞ করেছে। কৃতজ্ঞ হতে হয়। বর্তে যেতে হয়। শেখায় সমাজ। সেও শিখছে। অ আ ক খ।

বাঁটুল এসে দাঁড়াল পাশে। হাত চেটে দিল। ঝুমু বলল, ‘কী চাই?’

‘উঁ উঁ উঁ।’

‘তুই আমার কেউ না।’

‘ওঁয়াও। গর র র র।’

‘কে তুই? প্রভুভক্ত কুকুর। বুদ্ধি নেই? চেঁচিয়ে পিটুনি খেয়েছিলি কেন?’

‘উঁঃ! উঁ উঁ উঁঃ!’

‘কী ভাবলি তুই? তোর জায়গাটা হাতছাড়া হয়ে গেল? ঈর্ষায় চ্যাঁচালি নাকি? অথবা উলটোটা। বাঁটুল। তুই বুঝেছিলি, না রে? জবরদখল অপরাধ বুঝেছিলি? নারীর শরীর নিজেই নিজের প্রভু। কেউ তার আধিকারী নয়। এই সারমেয়, তুই যা বুঝিস, এরা তা বোঝে না। তোরও সময় আসে, প্রভুত্ব মাড়িয়ে প্রতিবাদ প্রতিষ্ঠিত করা রে বাঁটুল! নারীর শরীর নিজেই নিজের প্রভু। সে কি সাধারণ মেয়েরও শরীর? বাঁটুল? সাধারণ মেয়েরা কি নারী? নারীদিবসের সংজ্ঞা তাদের জন্য অর্থ রাখে কিছু?’

বাঁটুল গর্ভবতী। ঝুমুও। তার গর্ভই চেয়েছিল এ বাড়ির লোক। তারা খুশি। সন্দীপন অতি যত্নে বাঁটুলকে চিকিৎসালয়ে নিয়ে যায়। ঝুমুরকে নিয়ে যায় শাশুড়ি কল্যাণী। পাড়ার ডাক্তার শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় নামকরা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাছে যায় না। অপরাজিতার সংগঠনে তিনি সভামুখ্য, তাই ব্রাত্য। ঝুমু যায় যাদবপুর।

শীঘ্র গুরুমা চেতলায় আসবেন। সাজো সাজো রব। মহাযজ্ঞ হবে এইবার। কী এক অমৃতযোগ উপস্থিত যা নাকি সাড়ে তিন বছরের পর একবার আসে। এসময় চাওয়ার মতো চাইলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কল্যাণী বলেছেন, ‘ছেলে চেয়ো ঝুমুর। যজ্ঞাহুতির সময় থাকবে আমার পাশে।’

‘ছেলে যদি না হয়?’

‘ছেলে চাই। মেয়ে নিয়ে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছি। জানো তো সবই। ওই এক মেয়ের জন্য সর্বস্ব গেল। ধন গেল, মান গেল। আমাদের ভবিষ্যতের কাঁটা একেবারে। ওর বাবাকে খেয়েছে। আমাদেরও খাবে।’

মধ্যরাতে সঙ্গমের পর সন্দীপন বলতে লাগল, ‘মা ক’দিন এসব করতে বারণ করেছেন। যদি জিজ্ঞেস করে, বোলো, কিছু হয়নি। আর হ্যাঁ, যা বলছিলাম। মাতাজির কাছে ছেলে চেয়ো। মা নাতি চায়।’

‘ছেলে যদি না হয়?’

‘মা মানবে না। মন প্রস্তুত রাখো।’

‘তার মানে?’

‘ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা আছে। চিন্তার কিছু নেই। উনি খুবই অভিজ্ঞ। নাম করা।’

‘গর্ভপাত! কী বলছ?’

‘করতেই হবে, কে বলল। ছেলে হলেই সমস্যা নেই।’

‘যদি বার বার মেয়ে হয়? যদি বাচ্চাই না হয় আর?’

‘মাতাজির আশীর্বাদ আছে, তাঁর বাণী মিথ্যে হবে না।’

‘তোমরা অদ্ভুত!’

তুমি, তুমি সম্বোধন! ঝুমু পৌঁছেছে এখানে। কিংবা নিজেকেই নামিয়েছে হচড়ে টেনে। মানিয়ে নিতে হবে তো!

এবার সে কী করে? ভাবছে। এরা কি ছাড়বে তাকে? রাজি হতে বাধ্য করবে? একটি যুদ্ধের মধ্যে ঢুকে পড়ল আরও এক রণ। এমনকী টোপরকেও বলতে পারেনি। মায়া হল। মাতৃহারা একাকী, আজন্ম নিষ্ক্রিয় পদদ্বয়ের বৈরীতার কারণে কতই না কষ্ট তার। প্রতি সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, প্রতি পল-অনুপল, প্রতি পদক্ষেপ তার কাছে মহারণ! কখনও বলে না কষ্টের কথা! সহ্যাতীত অধ্যবসায়ে একে একে অভ্যাস করেছে তালবেতাল নিয়ে চলা, গড়গড়ি, গাড়ি চালানোর প্রক্রিয়া। সহ্য করতে শিখেছে ব্যঙ্গ। উপহাস। মা যাকে ব্রাত্য করে গেছে, তার মর্মবেদনা কে বোঝে! বয়সের তুলনায় টোপর প্রাজ্ঞ, গভীর। সে তরুণ অশত্থের মতো ডালপালা মেলে ঝুমু-র সহায় হতে চায়। ঝুমুও হতে চায় এক রাধাচূড়া গাছ। তার ভাল লাগে। তার আকণ্ঠ আসবাসব পানের মতো মধুরতম আনন্দবোধ হয় যখন সে ভাবে এক অনতিক্রম্য পথ পার করে শীর্ষে আরোহণ করার সেই মুহূর্তের কথা। সে পেরেছিল। টৌপরকে সেই স্বাদ দিতে পেরেছিল। টোপর, টোপর, কে তোকে প্রতিবন্ধী বলে! তুই সক্ষম, সার্থক পূর্ণ পুরুষ!

সেই পুরুষের কাছে ঝুমুর নামের মেয়ে সব নিবেদন করে। সব দুঃখ, কষ্ট, বেদনাজর্জরতা! কিন্তু ভাবনাও যে হয়। সঙ্কোচ। টোপর কত ভার নেবে আর? ঝুমু যে অনেক বড়।

শাশ্বতী মাঝখানে একবার এসেছিল। চেয়েচিন্তে নিয়ে গেল দশ হাজার। সে যেন আরও ম্লান, আরও কৃশ বিষাদকাহিনি। তাকেও কি বলা যায় গর্ভফুল বাঁচাবার কথা? কিংবা ওই নারীবাদী অপরূপা অপরাজিতা? তাকে? যদি ছেলে না হয়!

তার মনে পড়ে কলেজের খুব কাছে ছিল নিরাপদে গর্ভপাত। হাসাহাসি করত তারা। খেলুড়ি মেয়েরা, পুরুষশিকার যাদের লক্ষ্য ছিল দিবারাত্র-তাদের নাম ছিল ‘ক্লিনিক ফেরত’। মেয়েদের আত্মপ্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত মঞ্চ ছিল সি এ হওয়া। হিসাব বিশেষজ্ঞ। মজা করে তারা বলত— তোর লক্ষ্য কী? সি এ হওয়া, না সি এফ?…সেই ব্যঙ্গরসে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিত সমবয়সি ছেলের দল। তারা বলত, ওই কলেজে মেয়েদের ভ্রমণবৃত্তান্ত এরকম-সকালে উঠল। দাঁতটি মাজল। সাজল। পার্কে গেল। ঝোপের আড়ালে। পেট হল। কলেজে গেল। লেখাপড়া করল। বেরোল। ক্লিনিকে গেল। পেট খসানো হল। মেয়ে কুমারী হয়ে ঘরে ফিরে গেল। আবার সকাল।

সকালে উঠিয়া আমি

মনে মনে বলি

ইন্টু বিন্টু টিন্টু যেন

পার্কে করে চলি

পার্কের পরেই যাব

ক্লিনিকে ক্লিনিকে

কলেজের পাপ

ধুয়ে দেয় পাঁচসিকে!!

এই সমস্ত নিয়ে ঝিরি ও ঝাড়ু-নমির সঙ্গে কত হাসাহাসি করেছে ঝুমু। টোপরের সঙ্গে বিস্তর মজা লেনদেন করেছে। কিন্তু ইদানীং আর হাসি পাচ্ছে না! ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি, আদর্শ-অনাদর্শ, স্বাধীন বিধান ও অপরের অধীনতার দমবন্ধকর চাপ নিরন্তর দ্বন্দ্ব পাকাচ্ছে মনে। আদিরসে চুপচুপে ব্যঙ্গকৌতুক আজ ঝুমুকে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন সম্মুখীন করেছে!

ঝিরি, ঝুমু, জ্যোতির্ময় বসেছেন। মাত্র দুপুরটি হাতে নিয়ে এসেছে ঝুমুর। একবার টোপরের কাছে যাবে ভেবেছিল। গেল না যদি ধরা পড়ে যায় তার উদ্বেগব্যাকুলতা। ও ঠিক বুঝে যাবে! ওর অন্তর্ভেদী চোখ! ও ঝুমুকে ঝুমু-র চেয়ে বেশি জানে। যাবে না যাবে না ঝুমু। কিছুতে যাবে না। আতঙ্কে বিবর্ণ তার মুখে। সে যাবে না এ পোড়ামুখ নিয়ে।

‘তুই অত কেন উতলা হচ্ছিস। ডাক্তার কী বলেন দ্যাখ আগে।’

ঝিরি প্রতিক্রিয়াশীল। সে তীব্র বলে উঠল, ‘তোমার কথার অর্থ কী বাবা? সারাটা জীবন ও-বাড়িতে থাকতে হবে ওকে! এই যাদের মন! কী নিশ্চয়তা আছে, কোনও ছুতোয় দিদিকে মেরে ফেলবে না?’

‘দুটো এক নয় ঝিরি। ঝুমুকে ভালবাসেন ওঁরা।’

‘ভালবাসেন! ভালবাসার কী দেখলে? বিছানায় কুকুর শুইয়ে ওকে মাটিতে রেখেছে। ভালবাসা? এক পা বেরোতে দেয় না। ভালবাসা? দীপদা কোথাও নিয়ে যায় না, দু’দণ্ড কথাটি বলে না, ভালবাসা? গর্ভপাতের প্রস্তাব, ভালবাসা? টোপরের সঙ্গে পর্যন্ত কথা বলতে দেয় না। আমাদের কাছে আসতে দেয় না। ভালবাসা?’

‘শ্বশুরবাড়িতে এরকম একটু-আধটু হয়। পরে ঠিক হয়ে যাবে।’

‘পরে, পরে, কবে বাবা? ওরা নিকৃষ্ট প্রস্তাব করছে। তুমি কেন বুঝেও বুঝছ না? কন্যাভ্রূণহত্যা শুধু ভ্রূণহত্যার পাপ নয়, আইনবিরুদ্ধ। যারা পরিকল্পিতভাবে ভ্রূণহত্যা করে, তারা যে কাউকে খুন করতে পারে বাবা! ওই পরিবার ও ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা উচিত।’

‘দ্যাখ ঝিরি, জীবন অত সহজ নয়। সত্যিই কি ওরা এসব করবে? ভদ্র, শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত পরিবার! ওটা একটা কথার কথা।’

‘কে বলল তোমাকে? কথার কথা? তোমাকে প্রাণের কথা বলে গেছে? ওটা ভদ্র শিক্ষিতের প্রস্তাব? তুমিও কি মাকে এ প্রস্তাব করেছিলে বাবা? সন্দেহ হচ্ছে তো আমার।’

‘ঝিরি, তুই সীমা পার করে যাচ্ছিস।’

‘তুমি কী করতে বলছ? দিদি ওখানেই থাকবে? ওদের সব কথা শুনবে? বাবা, তুমি জানো তুমি কী বলছ?’

‘আমি ধৈর্য রাখতে বলছি। হঠকারিতা বারণ করছি। Life is an adjustment। এটা তোমাদের বুঝতে হবে। আমি একা হাতে তোমাদের বড় করেছি। টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছি বিয়ে ভাঙার জন্য নয়। আজ যদি ও ফিরে আসে, কে দায়িত্ব নেবে? ও একা নয়, ওর সন্তান সমেত কে ভার নেবে? তুমি নেবে?’

‘ও নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে পারত যদি জোর করে ওর চাকরি না ছাড়াতে!’

‘আমি যা করেছি, তোমাদের ভালর জন্য। মেয়েদের নিরাপত্তা সবার আগে। ঝুমু সরল, বাস্তববুদ্ধি নেই, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান! কে জানে কোন ফাঁদে পড়ত!’

‘এখন যেমন ফাঁদে পড়েছে, না বাবা? তুমি ও বড়পিসি ঠেলে ফেলেছ! চমৎকার নিরাপত্তা দিয়েছ না ওকে?’

‘ওঁরা যা বলছেন, তা অন্যায়, মানছি। কিন্তু ওখানেই ঝুমুর ভবিষ্যৎ। আমি সন্দীপন ও কল্যাণীর সঙ্গে কথা বলব দরকার বুঝলে। জয়ীও বলবে।’

‘আর অশ্রদ্ধাটা কিছু না? যদি মেয়ে হলে দিদির সঙ্গে দুর্ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়? যদি মারধোর করে? তুমি কি কিছুই বোঝো না বাবা? দীপদা দিদিকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায়নি, এ বাড়িতে আসে না, ওদের কোনও গল্প নেই। সম্পর্কটাই তৈরি হয়নি তো! সেখানে নিরাপত্তা কোথায়! এরকম ভয়ঙ্কর প্রস্তাব শোনার পর দিদি ওদের শ্রদ্ধা করতে, ভালবাসতে পারবে তো?’

‘সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সম্পর্ক দৃঢ় হবে। মনে ক্ষমা রাখতে হয়। দেখো, আমি চাই না ঝুমু সব ভাসিয়ে ফিরে আসুক। এমনিতেই টোপরের সঙ্গে রোজ কথা বলে এই নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। হাজার হোক রক্তে র সম্পর্কে তো ভাই নয়। বুঝতে হবে।’

‘আমি প্রবীরকাকে জানাব। আমি চুপ করে থাকব না। তুমি আমাদের একা হাতে বড় করেছ সেটা আমাদের অপরাধ নয়। তোমার দায়িত্ব ছিল। মায়ের অসুস্থতার জন্যও তোমার দায়িত্ব ছিল। হ্যাঁ, দিদির ভাল করার চেষ্টা করেছ তোমরা। কিন্তু ভাল না হলেও তাকে ভাল বলবে? তোমার সিদ্ধান্তে ভুল হচ্ছে বাবা। দিদিকে মরণফাঁদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছ বলে দিলাম। এরা যা খুশি করতে পারে। আমি জন্মে মা হারিয়েছি, দিদি হারাতে পারব না।’

‘প্রবীর কী করবে? ঝুমুর দায়িত্ব নেবে? হ্যাঁ, বিয়েতে খরচ করেছে প্রবীর, সোনার নূপুর দিয়ে আশীর্বাদ করেছে, ঝুমুর প্রতি স্নেহ আছে, কিন্তু ও কী করবে? ঘরের কথা বাইরে বলে লাভ?’

‘দেখো, কেমন মানুষ তুমি, এক মুহূর্তে প্রবীরকাকে বাইরের লোক বানিয়ে দিলে। কেন জানো, তুমি বুঝতে পারছ তোমার সিদ্ধান্তগুলো অমানবিক হয়ে যাচ্ছে। সেটাকেই আড়াল করতে চাও।’

‘দ্যাখ ঝিরি, জীবনে কিছুই দেখিসনি, বড় বড় কথা বলছিস। সম্পর্ক ভাঙা খুব সোজা। আমি বলব, ধৈর্য রাখো। তাড়াহুড়ো কোরো না। সমস্ত সংসারেই ভালমন্দ আছে।’

যজ্ঞের দিন স্নান সেরে গহনা ও বেনারসি পরে ঝুমু কল্যাণী শাশুড়ির সঙ্গে চেতলায় উপস্থিত হল। সন্দীপন আসবে। কিছু পরে।

চেতলায় পৌঁছে তার মনে হল ছুটে চলে যায়। টোপর, ও টোপর, আমি কত কাছে, তবু যেতে পারছি না!

সে বলল, ‘একবার বাড়ি যাব।’

কল্যাণী বললেন, ‘কী কারণে? তোমার বাবা, বড়পিসি, ঝরোকা— সকলেই আসবেন।’

ঝুমু চুপ করে বসে আছে। বাড়ি মানে কী? লোকগুলোই তো শুধু নয়! তার গন্ধ। তার স্পর্শ। তাতে নিহিত সময়। দেওয়ালে দেওয়ালে অদৃশ্য অক্ষরে লেখা কত মুহূর্তের ইতিহাস! বাড়ি মানে প্রবীরকাকা! রুপুকাকিমার শাড়ি। এডিনিয়াম গাছ। গোপালীমাসি, ঝাড়ু-নমি সমেত সমগ্র কানাই সামন্ত সরু গলি। আর? আর কী? আর কে? ঝুমু-র বাড়ি মানে শোলার কদম ঝোলানো, চিকিমিকি জড়ি দেওয়া অদ্ভুত চোঙাটিও নয়? টোপর নয়? টোপর? টোপর? টোপর! ও টোপর! টোপর!

সে শাশুড়িকে অতিক্রম করবে না তবু। সে উদ্ধত হবে না। সে এক সাধারণ মেয়ে। সাধারণ বধূ। সম্পন্ন ঘর-বর পেয়েছে! না-ই বা হল প্রেম! নাই বা সসম্মান সোনার মুকুট। এ কূট কুটিল পৃথিবী আসলে মৃত্যুর কালো ঢিবি! কখন যজ্ঞ হবে? এখনও সে খেতে পায়নি। খিদে পাচ্ছে খুব। ঝুমু-র খিদে বেড়ে গেছে। পুত্রার্থে ক্রিয়তে যজ্ঞঃ এতই সহজ? খিদে সহ্য করো। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে।

তিনতলা বাড়িটি আজ লোকারণ্য। সকলেই কি ছেলে চায়? ছেলে না পেলে গর্ভপাত চায়?

মৌনব্রতা মাতৃস্বরূপিণী গুরুআম্মা— গর্ভপাতের প্রস্তাব কি তাঁরও সম্মতিসাপেক্ষ নয়?

গুরু কত রকমের? গোপালীমাসির গুরু প্রসন্নানন্দজি ওই নিরক্ষর দরিদ্র মহিলাদের উন্নত মানবতার শিক্ষা দিয়েছিলেন। মন, চিন্তা, চেতনা— বুদ্ধির কলেবরে তিন অঙ্গ, তাদের ঘুম পাড়াতে নেই। কত সহজ ও গভীর শিক্ষা। আর এঁরা?

শাশ্বতীকে ধীর পায়ে প্রবেশ করতে দেখল সে। সে কি জানে, এ যজ্ঞ তারও বধ্যভূমি হতে পারে? সেও বুঝি কতশত মনস্কামনা নিয়ে মাতাজির শরণাগত!

ওই এল। সন্দীপন। ঝুমুর জীবনসঙ্গী। স্বামী। হ্যাঁ, স্বামী। জীবনসঙ্গী নয়। সে অন্যজন।

সন্দীপনের সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে। ফুটফুটে শিশু। মাথায় রিবন। লাল জামা। লম্বা খোলা চুলে সে যেন লালপরি। সন্দীপনের হাত আঁকড়ে আছে। মনে হচ্ছে সন্দীপনেরই মেয়ে। এমন একটি মেয়ে তো তাদের হতেই পারে! সমস্যা কোথায়? শাশ্বতীর জীবন ও পরিণতি দুর্ভাগ্যজনক। তার মানে কি মেয়েজন্মই নিষেধ করে দিতে হবে? অসম্ভব! এরকম কোনও শর্ত মান্য করতে পারবে না সে। কী করবে? প্রথমত, জন্মের আগে গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ আইনসঙ্গত নয়। দ্বিতীয়ত, অকারণ গর্ভপাত সে পাপ মনে করে। সে এক সাধারণ মেয়ে। সে গর্ভপাত কী করে মেনে নেয়?

সে কি এই শর্তের কথা তার টোপরকে বলবে?

সে কি পুলিশের কাছে যাবে?

কী করবে? কী করবে?

সে ঘেমে উঠল। হঠাৎ মনে হল সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তার সহজ স্বাভাবিক জীবন অকস্মাৎ জটিল দুর্বোধ্য ধাঁধায় ঢুকে পড়েছে। সে এই ভার নিতে পারছে না। সে ব্যাগ খুলে ফোন নিল।

‘টোপর।’

‘বলো ঝুমু। কী হয়েছে?’

‘আমার ভয় করছে।’

‘কেন ঝুমু?’

‘আমি চেতলায়। যজ্ঞবাড়িতে।’

‘ঝুমু, কিছু কি বিচলিত করছে তোমাকে যা আমাকে জানাতে পারোনি?’

‘টোপর, আমাকে ভুল বুঝিস না সোনা।’

‘আমি সাহায্য করছি তোমাকে ঝুমু। তুমি চাও, ও বাড়িতে মানিয়ে নিতে, মেনে নিয়েছি। তুমি ভাল থাকো। কিন্তু না থাকো যদি, অযথা নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। আমি আছি। আমি তোমার জন্য আছি।’

‘আয় না তুই টোপর। এ বাড়ির সামনে আয়। আমি দূর থেকে একটু দেখি তোকে। আয় সোনা। এই জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে।’

‘আমি আসছি ঝুমু, ওখানেই বসে থাকো। নড়বে না। কোথাও যাবে না। শোনো, আমি জ্যোতিকাকা আর ঝিরিকেও সঙ্গে নিচ্ছি। ওদের তো যাবার কথা।’

‘আয় টোপর।’

কথা বলতে বলতে সে দেখতে পাচ্ছিল সন্দীপনের ঠিক পিছনেই মালিনীকে। সেই মেয়ে, যে এক মনে খোল বাজাচ্ছিল। আজ শাড়ি পরে আছে। সেদিনও সন্দীপন মালিনীর পাশে বসেছিল।

‘কেমন আছ ঝুমুর?’ শাশ্বতী ডাকল।

‘এসো। বসো।’

‘তুমি আসবে বলেই এলাম। সুখবর পেয়েছি।’

‘হ্যাঁ। তুমি টোপর দেখবে লাল?’

‘টোপর আসছে?’

‘এখানে আসবে না। ওই রাস্তায়। বাবা আর ঝিরিকে পৌঁছে দেবে।’

‘বেশ। দেখি তাকে।’

‘কেমন আছ লাল?’

‘এই মুহূর্তে বড় ভাল আছি। কেন জানো?’

‘কেন বলো।’

‘কাল আমার ছেলে ভুটকুন হঠাৎ আমার গলা জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। আজকাল তো করে না এমন। বলল, মা, আমি খারাপ কাজ করেছি। আমার পাপ হয়েছে। বললাম, কী কাজ? সে বলল, তোমাকে কত কষ্ট দিই মা। জানো, আমাদের ক্লাসে সুকল্যাণ ওর মাকে কষ্ট দিত, তাই ওর মা মরে গেছে। গলায় দড়ি দিয়ে। তখন আমাদের ক্লাসটিচার রেজওয়ানা ম্যাম বললেন, মাকে কষ্ট দেওয়া পাপ। আমি আর কষ্ট দেব না তোমাকে মা। তুমি মরে যাবে না তো?… আমার হঠাৎ খুব আনন্দ হল ঝুমু। এত যে কষ্ট করি, ভুটকুনের জন্যই তো। ও আমাকে একটু ভালবাসলে আমি আবার নতুন করে বেঁচে উঠব। হয়তো দু’দিন পরেই ভুলে যাবে। আবার ওর বাবা যা বলবে, করবে। পীড়নের মধ্যে মজা আছে না ঝুমু? ছোটরা আকৃষ্ট হয়। তুমি কি ছোটবেলায় প্রজাপতির পাখনা ছিঁড়ে দিতে? পিঁপড়ে ছেড়ে দিতে গলন্ত মোমে? আমি দিতাম!’

রিবনবাঁধা লালপরি ছুট্টে এল ঘরে। ‘লালআন্টি।’

‘আরে! বুবুল! কেমন আছ তুমি?’

‘আমি তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছি।’

‘আমিও তো তোমাকে চিনলাম।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি।’

‘এই কাকিমাকে চেনো?’

‘কে?’

‘দীপকাকার বউ।’

‘মা তো দীপকাকার বউ।’

‘আচ্ছা চলো, তোমাকে ঠাকুর দেখিয়ে আনি।’

ত্রস্ত পায়ে ঘরে এল মালিনী। ‘বুবুল বুবুল বুবুল! তুমি এখানে কী করছ। চলো। চলো আমার সঙ্গে।’

‘কেমন আছ মালিনীদি?’

মালিনী তাকাল শাশ্বতীর দিকে। জবাব দিল না। বুবুলের হাত ধরে বলল, ‘এ প্রশ্ন করার কি কোনও অর্থ হয়?’

ঝুমু-র দিকে তাকাল না মালিনী। দ্রুত পায়ে চলে গেল বুবুলকে নিয়ে। বুবুল চ্যাঁচাচ্ছে— আমি বউ কথা বলব। বউ কথা বলব।’

শাশ্বতী আঁচলে মুখ মুছল। চকচকে নকল রেশমের শাড়ি পরেছে। হাতিবাগানের ফুটপাথ থেকে কেনা নকল সোনার দুল, নকল চামড়ার ব্যাগ। ক্ষয় লাগা সৌন্দর্য এবং অপরিশীলিত জগতের প্রতিনিধি মনে হচ্ছে তাকে। এখানে সে বেমানান। এখানে সবাই তসরে, রেশমে, গরদ ও বেনারসিতে সেজে আছে। গায়ে গয়না। সত্যিকারের সোনার। ঝুমু-রও গায়ে গয়না ঝলোমলো। কেউ কেউ পরে আছে লাল বুটি জামদানি ঢাকাই। কেউ দক্ষিণ ভারতীয় লম্বা পল্লু দেওয়া অপূর্ব কাতান। পুরুষের গরদ বা ফিনফিনে তসর পাঞ্জাবি, পাজামা, সোনার বোতাম। গলদেশে সোনার কণ্ঠহার।

তবু শাশ্বতী এসেছে। হাতে চাকা চাকা দাগ। পোড়া ছ্যাঁকা মিলায় না কোনও দিন। তার ভারী মায়া হল। সে ডাকল। লাল!

‘এটা পরো তো।’

‘একি! না না! ঝুমুর! না!’

বেশ পুরু ও ভারী কাঁকন খুলে দিল ঝুমু। ‘পরো। আমি দিচ্ছি।’

‘না গো। না। যদি হারিয়ে যায়!’

‘হারাবে কেন? দেখো তো, কী সুন্দর লাগছে হাতটা।’

হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ল ঝুমু। দাঁড়িয়ে পড়েছে। শাশ্বতীর কাঁকন পরা হাত চেপে ধরেছে আবেগে। তার করতলে স্বেদ। মুখে আনন্দচ্ছটা!

‘ওই দেখো টোপর। ওই যে।’

শাশ্বতী ঝুমুরকে দেখছে! কোথা থেকে আসে এই আলো? সে কি বোঝে না তা? নারীই নারীকে বোঝে। ভালবাসে যে মেয়েটা। অসম্ভব ভালবাসে ওই শতরূপ প্রতিবন্ধী ছেলেটাকে। বহুদর্শী অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া শাশ্বতী, বুঝে গেল। সংস্কার সংসার গুরুজনের দাবি— সব মিলে এক অপূর্ব প্রেমের হত্যালীলা সম্পাদন করছে!

সে বলল, ‘চলো। কাছে চলো।’

‘না লাল।’

‘কেন?’

‘না।’

‘বাঃ! আমি দেখব না কাছ থেকে?’

‘তুমি যাও। তুমি কাছে গেলেই ও চিনবে। ঝিরিও আছে।’

‘চলে যাচ্ছে। নামল না গাড়ি থেকে! তুমি যেন কী ঝুমুর।’

‘কী আবার।’

‘টোপর তো দেখল না তোমাকে।’

‘থাক।’

দিদিইইই! ঝরঝর হেসে ঘরে এল ঝিরি। পেছনে জ্যোতির্ময়।

ঝিরির সময় নেই। এই যজ্ঞযাগে তার আগ্রহও নেই। সৌজন্যসাক্ষাতে এসেছিল, চলে গেল। একবার একান্তে বলে গেল, ‘টোপরের কিছু একটা হয়েছে।’

‘কী?’

‘তুই জানিস না?’

‘কী, বলবি তো!’

‘হি ইজ় ইন লাভ! দিদি! কী বোকা আমি! ওই লাল শাড়ি থেকেই আমার বোঝা উচিত ছিল।’

‘চুপ কর।’

‘চুপ করব? হোয়াট ডু ইউ মিন দিদি? তুই অন্যায় করেছিস। মানছি টোপর হ্যান্ডিক্যাপড। কিন্তু তোকে পাগলের মতো ভালবাসে।’

‘চুপ, ঝিরি।’

‘তুই সত্যি বোকা রে দিদি। আর ভীষণ রক্ষণশীল! তুইও শেষ অব্দি গর্ভপাত মেনে নিবি। তুইও অসৎ ও প্রবঞ্চক হয়ে যাবি দিদি। তুই-ও শেষ অব্দি ছেলের জন্য ঢিল বাঁধবি বটগাছে। তোর শ্বশুরবাড়ির উপযুক্ত তুই! দিদি, আমাকে অন্তত এটা বোঝাস না প্লিজ়, যে, টোপরের মন তুই বুঝিসনি! তুই সব বুঝে ঘাপটি মেরে ছিলি। অন্তত আমাকে বলতে পারতি একবার দিদি!

সারা শরীর প্রকম্পিত। ঝুমু বোনের তিরস্কারের কাছে স্বেদাপ্লুত, নতমুখী। হে ঈশ্বর! এ সে কোথায় পৌঁছল!

তার ভারী ইচ্ছে করল একবার জিজ্ঞেস করে, কী করে জানতে পারল, বুঝতে পারল ঝিরি। কিন্তু মরমে লজ্জায় মিশে গেল একেবারে। টোপর বলবে না। বলতেই পারে না। সত্যিই কি প্রেমের আলো ফোটে? দুই প্রবল ঐশিক ঈহা মিলিত হলে প্রলয়ঙ্কর সংঘর্ষ ও বিষ্ফোরণ হয়? তার চোখ ধাঁধানো আলো, তার শব্দ, তার নিঃসৃত শক্তিই জগতে ঘোষণা করে প্রেম! প্রেম এল! এল প্রেম অই!

আঃ! কী কষ্ট ঝুমু-র! টোপর! ও টোপর! কত দূর থেকে দেখা! তুই ভাল থাক সোনা!

যজ্ঞের গন্ধ আসছে। ঝুমু-র ডাক পড়বে কখন? তার খিদেবোধ চলে গেছে। অল্প অল্প গা গুলোচ্ছে। এবার সে ছেলে চাইবে। চাইলেই হবে? পেটে যদি কন্যাভ্রূণ থাকে, সে ছেলে হয়ে যাবে? কত শত ভুল বিশ্বাস! কত প্রবঞ্চনা! ঐশী শক্তির নামে, ধর্মের নামে, পুণ্যের নামে কী মিথ্যাচার, কী পাপ!

শাশ্বতীর হাত ধরে কল্যাণী এসে দাঁড়ালেন। চাপা স্বরে বললেন, ‘এই বালা তুমি ওকে দিয়েছ ঝুমুর?’

‘হ্যাঁ। আমিই পরালাম তো।’

‘দেবে না। এসব অলক্ষ্মীপনা আর যেন না দেখি! বাড়ির বউ গা থেকে গয়না খুলে দিচ্ছ! লাল খুলে দে। আর শোনো, চারটেয় ডাক পড়বে। কিছু খেয়ে ফেল না যেন।’

ঝুমু স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কাঁকনখানি খুলে দিল শাশ্বতী। ঝুমু পরতে পারল না। ব্যাগে রেখে দিল। শাশ্বতী বলল, ‘মা ভাবল, আমি বুঝি নিয়ে নেব গয়নাটা। ভেবেছে, আমি চেয়েছি। মা’র দোষ নেই।’

ঝুমু তার হাত ধরে বসে রইল। বুবুলকে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছে মালিনী। চিৎকার করে কাঁদছে লালপরি।

‘ওভাবে মারছে কেন? মেয়েটাকে মারছে কেন?’

‘চেনো না ওকে?’

‘হ্যাঁ। মালিনী।’

‘আর কিছু জানো?’

‘না’

‘একদিন জানবেই। আমিই বলি। দাদার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর স্ত্রী ও। শুভ-দা। খুব প্রাণবন্ত ছিল। বাইক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। মালিনীদি চাকরি পেল শুভদা-র আপিসে। মানে দাদার ওখানে। সবাই জানে ওদের সম্পর্কে। দাদা কিন্তু বিয়ে করল না ওকে।’

‘কেন?’

শোক, তাপ, ঈর্ষা, উত্তেজনা কিছুই বোধ করছে না ঝুমু। এতটুকু ভালবাসেনি যাকে, তার জন্য কীসের অধিকারবোধ?

‘বিধবা বলে।’

‘বিধবাকে ভালবাসা যায়, বিয়ে করা যায় না?’

‘আমি ঠিক এটাই বলেছিলাম। ও বলল, সমস্ত জীবন শুভদা-র ছায়া ওকে বইতে হবে। কুচোটা আছে না? বুবুল?’

‘আহা!’

‘মা’রও মত ছিল না। বলেছিল— আমার সংসার কি গোয়ালঘর? গাইবাছুর এনে তুলতে হবে! দাদা বলেছিল বিয়েই করবে না। শেষ পর্যন্ত মায়ের জোরাজুরিতে…! বংশরক্ষা তো চাই! আমার ভুটকুন তো অন্য বংশ।’

‘ছুটির দিনেও যে তোমার দাদা সারাদিনের জন্য চলে যায়, সে কি মালিনীর কাছে?’

‘হ্যাঁ। ওটা ওর দ্বিতীয় বাড়ি। ঝুমুর, সত্যিটা দাদারই তোমাকে জানানো উচিত ছিল। বিয়ের আগেই। হয়তো আমারও তোমাকে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু ভাবলাম, পাত্রীপক্ষ সব সময়ই পাত্র বিষয়ে খোঁজখবর করে। এটা তাদের দায়িত্ব। আমি অগ্রবর্তী হয়ে জানালে মা আমাকে আস্ত রাখবে না। আমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছ।’

‘কিন্তু মালিনী মেনে নিল কেন?’

‘কী করবে? দাদার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ও। শোনো ঝুমুর, এখনও, বয়স্থা আইবুড়ি, বিধবা, বিবাহবিচ্ছিন্না সমাজে অপাংক্তেয়। বালাই বিশেষ। আমাদের পুরুষরা বিদ্যাসাগরকে আজও ছুঁতে পারল না। তারা মেয়েদের এখনও হাটবাজারের ক্রয়বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী ছাড়া কিছু ভাবে না।’

‘সবাই একরকম নয় লাল।’

‘বেশির ভাগ।’

‘তাই মালিনী আমার দিকে ফিরেও তাকাল না!’

‘ওর কী দোষ বলো! ও তো ভাবছে তুমি ওর নিরাপত্তা কেড়ে নিচ্ছ। একটা সাধারণ অসহায় মেয়ে। ওর তো ঈর্ষা হবেই।’

‘কিন্তু ও তো চাকরি করে বলছ। এত নির্ভরশীলতা কীসের জন্য?’

‘অভ্যাস ঝুমুর! নির্ভরতা একরকম অভ্যাস! সেই মেছুনির গল্পটা মনে নেই? ফুলের গন্ধে যার ঘুম আসেনি!’

বাড়ি ফিরে চার বার বমি করল ঝুমু। গর্ভবতী। তার ওপর সারা দিন উপোস। যজ্ঞের আগুনের পাশে বসে ছিল দু’ঘণ্টা। গর্ভে যদি মেয়ে থাকে, মাতাজির মন্ত্রশক্তিতে ভ্রূণের পুরুষ রূপান্তর ঘটছে। আর যদি না হয়?

যদি না হয়?

বারাণসীতে একবার যজ্ঞ হয়েছে। তারপর এই মহাযজ্ঞে লাল নামের ভিখারিণী উৎপাত বিদূরণ মন্ত্র পড়া হল, কন্যাভ্রূণ রূপান্তরিত হল পুত্রে, পুত্রং রক্ষতে নরকগমনং। মহাশক্তি! সূর্যের মতো তেজ! মিহিরের মতো উজ্জ্বল। ঊষাপতির মতো সত্য! সত্য?

শিরদাঁড়া বেয়ে এক হিমস্রোত নেমে এল। হয় যুদ্ধ নয় মৃত্যু। ঝুমু কী করবে?

অতি ভোরে ঝমঝমিয়ে বেজে উঠল ফোন। উপরতলায় নীচতলায়। বাঁটুল চিৎকার করে উঠ। ঘ্রাউ ঘ্রাউ গ র র র! সে এখন শাশ্বতীর ঘরে শোয়।

ক’টা বাজে? এসময় কার ফোন?

বিছানার অন্য প্রান্তে ঘুমোচ্ছে সন্দীপন। সে ডাকল। ‘ফোন বাজছে।’

‘বাজুক।’

‘এ সময়ে ফোন। নিশ্চয়ই দরকারি।’

‘আমি উঠতে পারব না।’

‘কে ফোন করছে? সেলফোনে কেন করল না?’

ফোন থেমে গেল। সারা বাড়িই কি জানে, ঝুমু আছে, ধরবে!

শ্লথ পায়ে হেঁটে এল বাঁটুল। তাকাচ্ছে ঝুমুর দিকে। হঠাৎ ঝুমুর মনে পড়ে গেল, আর একদিন, তার গর্ভস্থ ভ্রূণের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে। কী করবে সে। তার তলপেটে যন্ত্রণা হতে লাগল। হয় যুদ্ধ নয় মৃত্যু। সে মেনে নেবে? সে কি বশ্যতা স্বীকার করবে? বাঁটুলকে তার নিজের চেয়ে অনেক বেশি সফল ও স্বাধীন মনে হয়। এ পৃথিবীতে সাধারণ মেয়েরা আজও কেবল দাসী। চুক্তি পত্র দাসখত লিখে দেয় অন্ন কুড়োবে বলে। বাঁটুল কিন্তু খুশিমতো বাচ্চা দিতে পারে!

আবার বেজে উঠল ফোন। বাজছে। বেজে যাচ্ছে।

‘হ্যালো।’

উত্তেজিত হল্লাবোল স্বর ও প্রান্তে উৎকণ্ঠা সমেত।

‘হ্যালো! বউদির বাড়ির লোক বলছেন? হ্যালো।’

‘কে বউদি?’

‘ওই যে, কাল্টুদার বউ। এটা গড়িয়া তো?’

‘হ্যাঁ। কাল্টুর বউ? মানে লাল?’

‘লাল-নীল জানি না। শোনেন, সতী বউদি সতী বউদি। ভুটকুনের মা। আমরা পাড়ার ছেলে। সতী বউদি গায়ে আগুন দিয়েছিল। হাসপাতালে আসুন।’

‘গায়ে আগুন! কী বলছেন! কোন হাসপাতাল?’

‘আর জি করে। অবস্থা ভাল না।’

‘আপনি কে বলছেন? একটা নম্বর দিন। কাল্টু কোথায়?’

‘আপনি মেয়েছেলে মানুষ, একটা বেটাছেলে ডাকেন না। পুলিশ কেস-ফেস মিলে হেভি হুজ্জোতি হচ্ছে।’

ঝুমু-র গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করছে। দীপ শুনছ, দীপ শোনো, দীপ ওঠো ওঠো…

একেবারে ভেঙে পড়েছে ঝুমু। অথচ এ বাড়িতে শোক নির্লিপ্ত, নির্বিকার। সে ক্রমাগত বলছে, ‘এটা আত্মহত্যা হতে পারে না। এটা খুন। ও কত খুশি ছিল। কত কথা বলল সেদিন।’

‘এটাই ওর পরিণতি।’

‘আপনারা ডায়রি করছেন না কেন? থানায় অভিযোগ করছেন না কেন? সারা পাড়া বলছে।’

‘সারা পাড়া? তুমি গিয়েছ বাগবাজারের পাড়ায়?’

জ্বলতে জ্বলতে রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল লাল। শুধু শায়া আর ব্লাউজ়। শাড়ি কি জ্বলে গিয়েছিল, নাকি খুলে ফেলেছিল? লাল আগুনের ভিতর থেকে লাল নামের মেয়ে আর্তনাদ করতে করতে ধপ করে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। লোকে টের পেয়ে কাঁথা বস্তা কম্বল চাপা দিচ্ছিল যখন, অতি ব্যস্ত পায়ে কাল্টু ছুটে আসে। সে ঘুমোচ্ছিল। টের পায়নি কিছুই। জ্বলন্ত মৃত্যুও অবলীলাক্রমে অদর্শন করা যায়।

‘আত্মহত্যাই করবে যদি, লিখে গেল না কেন?’

‘দেখো ঝুমু, আমরা এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি চাই না।’

‘একটা মেয়ে জলজ্যান্ত মরে গেল, তার কোনও গুরুত্ব নেই? একটা মেয়ের জীবনের কোনও দাম নেই?’

‘যে যাবার সে গিয়েছে। ওকে নিয়ে আমরাও জ্বলেপুড়ে মরছি। আর অশান্তি ভাল লাগে না। তুমিও এ বিষয়ে যত কম মাথা ঘামাবে তত ভাল।’

‘ও তো নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিল। সে চাওয়ার কোনও মূল্য নেই?’

‘তোমার ক্লিনিকে যাওয়া পিছিয়ে যাচ্ছে। কাল নিয়ে যাব।’

‘লাল টোপরকে দেখতে চেয়েছিল। সেদিন দূর থেকে দেখে কত খুশি! কত সুখী ছিল! আপনি ওকে গয়নাটাও পরতে দেননি।’

ঝুমু অস্থির! তিক্ত! সন্দিগ্ধ! এবং বেভুল!

দুপুরে, সন্দীপন বাড়িতে নেই। কল্যাণী ঘুমিয়ে আছেন। ঝুমু তার স্ত্রীধন অলঙ্কারগুলি নিল, টোপরের দেওয়া লাল ঢাকাইখানি জড়িয়ে নিল গায়ে। একটুকু দাঁড়াল আয়নার কাছে। সে দেখল। এক অনন্য ‘আমি’ সে। এই বীভৎস জীবন স্বচক্ষে দেখার ভিতর, সে আর শাশ্বতী একই আগুনে পুড়েছে। সে পুনরুজ্জীবিত কারণ তার টোপর তার পূর্ণ জীবনশক্তি। একদিন এই বেশে রুপুকাকি টোপরকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, সে যাবে গ্রহণ করতে। চিরকালের মতো। ঝিরিকে বার্তা পাঠাল— কোথায় তুই?

‘পার্ক স্ট্রিটে। কেন?’

‘আমি বেরোচ্ছি।’

‘মানে? কোথায়?’

‘আমার জায়গায়। টোপর।’

‘দ্যাটস গ্রেট। সন্ধ্যায় দেখা হবে।’

‘আমি দ্বিধাহীন! তবে ঝড় উঠবে।’

‘just do whatever you said. বেঁচে যাবি দিদি।’

ঝুমু শাশ্বতীর ঘরে গেল। টেবিলে অল্প বয়সের ছবি। দুই বিনুনী। ঘাড় কাত করা। হাসছে। তুলে নিল ছবি। বাঁটুল দেখছে। ঝুমু বলল— চলি রে! তোর সব ক’টা ছানা মেয়ে হোক।

সে বেরিয়ে পড়ল।

‘টোপর, আমি এসেছি।’

‘এসো।’

‘আর যাব না।’

‘কোনও দিন যেয়ো না ঝুমু।’

‘ঝিরি আছে আমাদের দলে।’

‘বাবা আছে। বিবস্বান আছে। পলাশ আছে। জ্যোতিকাকাকেও টেনে নেব।’

‘এতজন পেয়ে গেলাম। হয় যুদ্ধ নয় মৃত্যু।’

‘মরব কেন? ঝুমু? এই তো শুরু হল আকাঙ্ক্ষিত জীবন। তুমি এসে গেছ। আর আমি কাউকে ভয় পাই না।’

ঝুমু টোপরের পায়ের কাছে বসল। টোপর বলল, ‘ওখানে নয় ঝুমু। তোমার কোলে মাথা রাখতে দাও। হাত বুলিয়ে দাও চুলে। আঃ! ঝুমু, আমি জানতাম তুমি আসবে। কোনও দিন। হয়তো আরও পঁচিশ বছর পর! না এসে পারবে না তুমি।’

‘অমানুষের জগৎ যদি না দেখতাম, আসতে পারতাম না রে।’

‘তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতেই পারো না।’

‘তুই ঠিক জানিস টোপর? ধর, খুব ভালবাসা যদি পেতাম ওখানে? আসতে কি পারতাম? আমি অসহায় বলেই কি তোর কাছে এলাম?’

‘তোমাকে ঝুমুআর কেউ কী করে ভালবাসবে? তুমি তো আমার!’

‘আর যাব না। আর যাব না তোকে ছেড়ে।’

‘যেতে দিলে তো!’

ঝুমু মুখ নামিয়ে আনল। তার মনে আর কোনও বাধা নেই। দ্বিধা নেই। পিছুটান নেই। একজন তার শরীরে বাড়ছে। সে কার সন্তান? সে তার হৃদয়ছেঁড়া। একজন কোলে শুয়ে আছে। সেই তো হৃদয়। সেই তো প্রেমের সংজ্ঞা। বয়ঃক্রম বিচার করে না। জাত, কুল, ধর্ম মানে না। মানে নাকো সমাজশাসন। শুধু ভালবাসে। ঝুমু সর্বস্ব সমর্পণে টোপরের মুখ সাপটে নিল। ঠোঁট কী নরম, কী মধুর গন্ধ ওর শ্বাসবায়ু ভরা, কী প্রেম! ওঃ! কী আশ্চর্য প্রেম! একটা সাধারণ মেয়ে এত ভালবাসা পেলে অসাধারণ হয়ে উঠবে না?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত