| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

মানব সভ্যতায় টাকার ইতিহাস । জাভেদ ইকবাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আমারা জানি, কৃষির অবিষ্কারের আগে, মানুষ, আমাদের পূর্বসুরীরা, শিকারী-সংগ্রাহক ছিল। শিকারীরা নিজেদের অস্ত্র নিজেরাই তৈরি করত; প্রাগৈতিহাসিক সেই যুগে হয়তো কোনও শিকারী তার হত্যা করা প্রাণীর চামড়া বা মাংসের সাথে অন্য কারো তৈরি অস্ত্র বিনিময় করে ইতিহাসের প্রথম বাণিজ্যিক লেনদেন করেছিল, কে জানে!

তারপর এরকম লেনদেন ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। কিন্তু একজন অস্ত্রের বিনিময়ে কতই বা আর মাংস নিতে পারে? ফলে বিনিময়ের জন্য সবাই নেবে, এমন একটি নিরপেক্ষ বস্তুর দরকার হলো। সেই নিরপেক্ষ মাধ্যম হলো গবাদি পশু—গরু, ভেড়া, ইত্যাদি। তারপর জমিতে চাষাবাদ শুরুর পর   গম, ধান, ইত্যাদিও বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হতে থাকল। এখনো গ্রামে শ্রমিকদেরকে চাল দিয়ে মজুরি দেয়ার প্রথা আছে।বিভিন্ন সভ্যতায় পালক, হাড়, পাথর বা কাপড়ও ব্যবহার করা হতো – প্রশান্ত মহাসগরের Yup নামের দ্বীপে এই একশ সাড়ে আটষট্টি পাউন্ডের পাথরটা ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক পণ যেমন ধরুন যৌতুক হিসেবে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেতনের ইংলিশ প্রতিশব্দ স্যালারি-র পেছনেও আছে লেনদেনের ইতিহাস। রোমান সৈন্যদেরকে তাদের বেতন দেয়া হতো লবণ দিয়ে যার  ল্যাটিন নাম “স্যালারিয়াস” , সৈন্যরা সেই লবণ বিনিময় করে প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনতে পারত, আর সেই থেকে  বেতনের নাম হয়েছিল স্যালারিয়াম।। প্রায় দুই হাজার বছর পরে বেতনের কড়কড়ে নোট বা ব্যাংকে সরাসরি জমা হওয়া টাকাকে আমরা এখনও তাই স্যালারি বলেই চিনি।

অর্থাৎ, দুইপক্ষ বিনিময় করতে রাজী, এমন যে কোন কিছুই মুদ্রার কাজ করে পারে। কিন্তু এই বিনিময় প্রথা বা বার্টার সিস্টেমেও বেশকিছু সমস্যা দেখা দিল।
ধরুন, আমার লবণ আছে, কিন্তু দরকার জুতো। যে জুতো বানায়, তার লবণ দরকার নেই, তার দরকার চামড়া। যার চামড়া আছে, তার দরকার লবণ। সুতরাং আমরা ত্রিপাক্ষিক দরদামের পর যা চাচ্ছিলাম, সবাই তা পেলাম।

বুঝতেই পারছেন, দুইজনে বিনিময় করা না গেলে এভাবে তৃতীয় পক্ষ খুঁজে পাওয়া ঝামেলার কাজ, এবং একটি লেনদেনের জন্য যত বেশি পক্ষ লাগবে, কাজটা ততই কঠিন –  এভাবে সঞ্চয়, মূল্য স্থানান্তর, ঋণ পরিশোধ এগুলো  নিয়েও  নানারকমের  সমস্যা দেখা দিল- সার্বজনীন বিনিময়ের জন্য একটা মাধ্যম জরুরী হয়ে উঠলো।

প্রায় তিন হাজার দুইশ বছর আগে চীনে এক ধরণের ঝিনুকের খোলসের বিনিময়ে পণ্য বা সেবা কিনতে পাওয়া যেত। আমাদের উপমহাদেশেও এই কয়েকশ বছর আগেও মুদ্রা হিসাবে এই কড়ির প্রচলন ছিল। কিন্তু কড়ি-মুদ্রার একটা সমস্যা —যে কেউ পানিতে যথেষ্ট ডুব দিলে। এই মুদ্রা যোগাড় করতে পারত। ফলে এমন মুদ্রার প্রয়োজন হলো, যা প্রকৃতিতে সহজে পাওয়া যায় না, আবার নিজে বানানোও খুব একটা সহজ না- চীনই ৩০০০ বছর আগে প্রথম ধাতব মুদ্রার প্রচলন করে।
মুদ্রা প্রচলনের মাধ্যমে দ্রব্য বিনিময় প্রথার যে সমস্যাগুলো ছিল তা দূর হল। আসল মুদ্রা চেনার জন্য ঐ মুদ্রাতে দেবতা বা সম্রাটের ছবি খোদাই করা থাকত। তারপর বর্তমান তুরষ্কের লিডিয়া থেকে পাশের দেশ আয়োনিয়া হয়ে ক্রমশ গ্রিস ও তার পরে বর্তমান ইউরোপে খোদাই করা ধাতব মুদ্রা প্রচলিত হতে থাকে। সমান্তরালভাবে ভারতেও উদ্ভাবিত হয় ধাতব মুদ্রা।  ২৪০০ বছর আগে চাণক্য বা কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্র বইয়ে ময়ুর সাম্রাজ্যে ধাতব মুদ্রা ও তা জালিয়াতির শাস্তির কথা লিখে গিয়েছেন।

এরপর  চীনে প্রচলন হয় চামড়ার মুদ্রার। প্রায় এক বর্গফুট ক্ষেত্রফলের এই মুদ্রায় সুন্দর ছবি আঁকা থাকতো যেগুলি  জাল করা কঠিন ছিল।

টাকার সাথে আজন্ম জড়িয়ে আছে জালিয়াতির সমস্যা। তাই মুদ্রায় লেখা হতো, “জালিয়াতির শাস্তি মৃত্যুদন্ড”। মুদ্রা জালিয়াতদের ধরায় জড়িয়ে আছে নিউটনেরও নাম। নিউটনকে ইংল্যান্ডের রাণী টাকশালের প্রশাসক বা মাস্টার অফ দ্যা মিন্ট নিয়োগ করেছিলেন। তিনি নিজেই মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে জালিয়াতদের ধরার কাজে নেমে পড়তেন।

চামড়ার পরে নবম শতাব্দীতে চীনে প্রথম কাগজের নোট দেখা গেল , কিন্তু ১৫ শতাব্দীতে তারা কাগজের নোট বাদ দিয়ে আবার ধাতব মুদ্রায় ফিরে যায়।  চীনারা কাগজের মুদ্রা বাদ দেয়ার কারন সম্ভবত কাগজের টাকা জালিয়াতি সহজ হয়ে গিয়েছিল। তাই মুদ্রা বাদেও নিজস্ব দাম আছে এমন কোনো ধাতু, যেমন সোনা বা রূপার মুদ্রা ব্যবহার হতে থাকে চীন ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও মহাদেশে।

কিন্তু এই ধাতব মুদ্রার সমস্যা ছিল অনেক—প্রথমত এটা বেশ ভারী। আর মুদ্রার দামের চাইতে মুদ্রার  ধাতুর দাম বেশি হলে মানুষ মুদ্রা গলিয়ে ধাতুটা বের করে নেয়। ফলে অনেক দেশ আবার কাগজের টাকায় ফেরত গিয়েছিল, কিন্তু তারাও দামী ধাতুর বাজারদর দিয়ে নির্ধারণ করে রেখেছিল মুদ্রার মূল্য।  
৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ১ পাউন্ড ভরের রূপার যে দাম ছিল, সেটাকে মুদ্রায় হিসাব করলে যত পাওয়া যেত, সেটার নাম দেয়া হয়েছিল এক পাউন্ড মুদ্রা। ব্রিটিশ মুদ্রার নাম যে আজ পাউন্ড, সেটা এসেছে রূপার সেই ভর থেকে।

মুদ্রার প্রচলন আর ব্যবসায় প্রসারের সাথে কয়েক হাজার বছর আগেই শুরু হয়েছিল বাণিজ্যিক ঋণ দেওয়া-নেওয়া। প্রাচীন রোমে বেঞ্চে বসে মুদ্রা লেনদেন হতো। বেঞ্চের ল্যাটিন নাম ব্যাংকু, আর সেই থেকেই এসেছে ব্যাংক শব্দটা।


আরো পড়ুন: মমতাজের মৃত্যু ও শাহজাহানের হিন্দুস্তান বিক্রয়


ভেনিসের এক ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের রশিদ দিত লাল রঙের কাগজে, ফলে তারা পরিচিত হয় “রেড ব্যাংক” হিসাবে, আর সেই লাল ব্যাংক থেকেই এসেছে  আমাদের পরিচিত কিছু শব্দগুচ্ছ—ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলা, হিসাবের খাতা লাল, লাল কালি দিয়ে ক্ষতি বোঝানো, ইত্যাদি।

বড় ব্যাংকগুলো ঋণ হিসাবে প্রচলিত মুদ্রা না দিয়ে অনেক সময় নিজেদের দলিল দিতে থাকল। একজন কৃষকের গরু কেনা লাগবে? ব্যাংক তাকে একটা কাগজ দিল, সেই কৃষক কাগজটা গরু বিক্রেতাকে দিল। গরু বিক্রেতা সেই কাগজ নিয়ে ব্যাংকে গেলে ব্যাংক তাকে প্রচলিত মুদ্রা দিত। এভাবে ব্যাংকের দলিল আর প্রচলিত মুদ্রার মান প্রায় সমান হয়ে গেল।

কিন্তু আবার ওদিকে বেসরকারী ব্যাংকগুলো দলিলের মাধ্যমে মুদ্রা তৈরি করায় কিছু সমস্যা হতে থাকল। কারন  ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে সেই মুদ্রার আর কোন দাম থাকতো না। ফলে ধীরে ধীরে সব দেশের সরকারই আইন করে টাকা ছাপানোর অধিকার শুধুমাত্র নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়, এবং সরকারের ক্ষমতা ও সম্মান তার টাকার ওপর প্রয়োগ করে। আর এই ব্যাংকগুলোর উপরেও সরকার তার কর্তৃত্ব আরোপ করতে শুরু করে।  সরকার যখন তার ছাপানো নোটে লেখে, “চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে”, এই টাকাকে ফিয়াট কারেন্সি, বা আদেশকৃত মুদ্রা বলা হয়, কারন এর মূল্য নির্ধারন হয় সরকারী আদেশে, আর এই যাদুতেই একটা কাগজ মুদ্রা হয়ে যায়।

আর ব্যাংকের সেই দলিলগুলো? সেগুলি এখনো প্রচলিত, তবে মুদ্রা হিসাবে না। আমরা সেই দলিলগুলিকে এখন “পে অর্ডার” বা “ক্যাশিয়ার্স চেক” নামে চিনি।
আমরা যখন টাকা হাতে নিই, আমরা ভাবিও না বা অনেকে জানিও না, মানবজাতির অতি প্রাচীন একটা আবিষ্কার এখনও আমরা ব্যবহার করে যাচ্ছি, এবং এটা আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কিন্তু হয়ত কিছুদিন পরেই এই কাগজের টাকার স্থান হবে যাদুঘরে। আসলে তো টাকা আর কিছুই নয় – একটা বিনিময়ের মাধ্যম যাকে একটা রাষ্ট্রের বা জনগোষ্ঠির সবাই বিশ্বাস করবে, মেনে নেবে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে।। এই ইন্টারনেটের যুগে কাগজের টাকার বদলে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে। অর্থ পরিশোধের জন্য এখন আর নগদ টাকা না হলেও চলে।  এসেছে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড। মোবাইল ওয়ালেটেও আস্তে আস্তে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। ফোন রিচার্জ করা থেকে শুরু করে বিল পরিশোধ—সবই করা যাচ্ছে ডিজিটাল মুদ্রা দিয়ে।

আর তার সাথে এখন যুক্ত হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সির মত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণহীন মুদ্রাও। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত