| 23 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য (পর্ব-৫) । ফয়েজ আলম

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

পশ্চিমারা শাসন শোষণের স্বার্থে, উপনিবেশ কায়েম রাখার স্বার্থে যেজ্ঞানভাষ্য তৈরি করেছে তাতে উপনিবেশিতদের মানসিকভাবে দাসে পরিণত করেছে। মনোজগতের এই উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই উত্তর উপনিবেশী ভাবচর্চা জরুরি। উপনিবেশ স্বাধীন হওয়ার পর উপনিবেশক সংস্কৃতির প্রভাব বহাল থাকে স্বাধীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে, যাকে বলা হয় উত্তর-উপনিবেশী পরিস্থিতি। এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই হলো বি-উপনিবেশায়ন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতার পর এখন আত্ম-উদবোধন ও প্রতিরোধ সংগ্রাম মূলত উত্তর-উপনিবেশী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, সাংস্কৃতিক ও ভাবাধিপত্যের নিরবচ্ছিন্ন কিন্তু অসম উপস্থিতি ছুড়ে ফেলার জন্য। এর শুরু সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতায়, বোধ ও ভাবের সংগ্রামে। উত্তর উপনিবেশবাদ নিয়ে আরো গভীরভাবে জানতে ইরাবতীর ধারাবাহিক ফয়েজ আলমের উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য লেখাটির আজ থাকছে পর্ব-৫।


 

 

উত্তর-উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিক হেলেন টিফিন উত্তর-উপনিবেশবাদকে কাউন্টার-ডিসকোর্স হিসেবে বুঝতে আগ্রহী। হেলেনের বিবেচনায় বি-উপনিবেশন হলো একটি প্রক্রিয়া, নির্দিষ্ট কোনো অবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়ার ব্যাপার নয়। এ হলো (ইউরোপের) কেন্দ্রমুখী আধিপত্যবাদী পদ্ধতি এবং সে-পদ্ধতি ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার জন্য প্রান্তের তৎপরতার দ্বান্ধিক প্রক্রিয়া।  উত্তর-উপনিবেশবাদী লেখাজোখার লক্ষ্য হচ্ছে ইউরোপীয় ডিসকোর্স ও ডিসকার্সিভ কৌশলগুলোকে জিজ্ঞাসার কাঠগড়ায় দুাড় করানো, ইউরোপীয় আধিপত্যের কায়দাগুলো খুঁজে দেখা। এক্ষেত্রে ইউরোপের ঐতিহাসিক ও সৃজনশীল কাজের তথ্যলিপিগুলো পুনর্পাঠ ও পুনর্লিখন গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক কাজ (অ্যাশক্রফ্ট, ১৯৯৯; ৯৬)।

মনে হতে পারে, সাঈদ-রুশদি-ভাবার সঙ্গে নৈকট্য বেশি হেলেনের চিন্তার। এমন ধারণা অমূলকও নয়। তবে হেলেন নিষ্ক্রিয় করা বা ধ্বংস করার লক্ষ্য সম্পর্কে পরিষ্কার, মানদন্ড-বিষয়েও। তিনি তাই আমাদের সতর্ক করে বলেন, উত্তর-উপনিবেশবাদী কর্মপ্রক্রিয়ার যেসব নমুনায় সংকর ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর জোর দেওয়া হয় সেগুলোয় (উপনিবেশী বিন্যাস) ধ্বংস করার প্রক্রিয়া পরিচালনার একটা জায়গা পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ্য যদি কাউন্টার-ডিসকার্সিভ না হয়, তাহলে এই মডেল শেষমেশ আরেকটি আধিপত্যশীল ব্যাপার হয়ে দেখা দেবে। হেলেন অস্ট্রেলিয়ার আদি সাদাদের ব্রিটিশ প্রবণতার আধিপত্য নিষ্ক্রিয় করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করার সময় জোর দিয়ে বলেন যে, এতে প্রাক-উপনিবেশিক লেখালেখি এবং মৌখিক রীতিগুলোকে কাউন্টার-ডিসকার্সিভ কৌশল হিসেব গণ্য করতে হবে (অ্যাশক্রফ্ট, ১৯৯৯; ৯৬)।

আসলে বি-উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক প্রশ্ন হলো প্রাক-উপনিবেশী অতীতকে কোন দৃষ্টিতে দেখছি আমরা, কোন মূল্যে স্থির করছি। প্রথমত, উপনিবেশে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক আধিপত্য শেষ হওয়ার পর আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উপনিবেশী বিন্যাসের শাসনপ্রক্রিয়ার ওপর সওয়ার হয়ে অগ্রসর হতে পারি। অনেক উপনিবেশে ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে। এতে জনগণের বিরাট এক অংশ যেমন তখনো অবদমিত থেকে যায়, তেমনি উপনিবেশী সংস্কৃতির উপাদানগুলোও পুরো জোর নিয়ে বহাল থাকে। উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-অর্জনের প্রক্রিয়ায় স্থানীয়দের এক অংশে বুর্জোয়া চরিত্র্যের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ফানো আমাদের দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, এই জাতীয়-বুর্জোয়াদের ওপর সওয়ার হয়ে বহাল থেকে যায় উপনিবেশী বিন্যাস ও আধিপত্য। ফানো বলেন:

স্বাধীনতার পূর্বে নেতারা মানুষের স্বাধীনতার আকাঙক্ষা, রাজনৈতিক মুক্তি ও জাতীয় মর্যাদার কথা তুলে ধরেন। কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণার পর পর সাধারণ মানুষের প্রয়োজন–রুটি, জমি (সরবরাহ) ও দেশকে জনতার পবিত্র হাতে তুলে দেওয়ার পরিবর্তে নেতারা প্রকাশ করে তাদের ভেতরের উদ্দেশ্য, এই লাভজনক কোম্পানিটির (অর্থাৎ দেশটির) জেনারেল প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তাদের অধৈর্য আগ্রহ; এটি চিত্রিত করে জাতীয় বুর্জোয়া চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। (ফানো ১৯৬৮; ১৬৬)   

কাজেই কার্যকর বি-উপনিবেশনের প্রসঙ্গে এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। আরেকটা কথা। যে-প্রক্রিয়াই অবলম্বন করা হোক বি-উপনিবেশনে, একটি বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। এমনও দেখা যায়, উত্তর-উপনিবেশী সমাজের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ উপনিবেশী শাসনকালে এবং স্বাধীনতার পর উপনিবেশী প্রভাব বলয়ে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সাদামাটা প্রক্রিয়ার মধ্যেও প্রাক-উপনিবেশী ভাবজগৎ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছে। জীবনচর্চার এই দিকগুলোও শনাক্ত করতে হবে। এগুলোকে ওতিহ্যের মূল্যে ও মর্যাদায়  দাঁড় করানো দরকার। কারণ উপনিবেশের শুরু থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে লড়াইয়ের যে-চেষ্টা হয়েছে তার নানা রূপ ও উপায় এবং মোট ফলাফলও আমাদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভাবজগৎ ও সংস্কৃতির মধ্যে এ-ধরনের অনেক প্রাক-উপনিবেশী উপাদান বহাল আছে। গত কয়েক দশক ধরে ভারচুয়াল টেকনোলজির আগ্রাসী প্রসারের কারণে সেগুলো লোপ পেতে বসেছে। আবার তথাকথিত মার্গীয় সংস্কৃতিতে অনুরক্ত লোকেরা–যাদেরকে ফানো বলেছেন উপনিবেশক শোষকের বিকল্প, তারা-প্রাক উপনিবেশী এইসব উপাদানকে প্রায়-নিকৃষ্ট ‘আন’-এর অবস্থানে স্থাপন করে ওগুলোর নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশে ওই জায়গাটা লড়াইয়ের একটা জরুরি ও বিস্তৃত ক্ষেত্র।

বি-উপনিবেশনের বিভিন্ন কৌশলের দু-একটা সাহিত্যিক দৃষ্টান্তও দিয়েছেন সাঈদ তার কালচার অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম  গ্রন্থে (সাঈদ ১৯৯৪; ২৫৪-৫৫)। জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেসে অভিব্যক্ত উপনিবেশী মনকে বিশ্লেষণ করেন তিনি, যার কেন্দ্র জুড়ে আছে উপনিবেশ-প্রতিষ্ঠা ও সেই উপনিবেশকে নিকৃষ্ট চিত্রিত করার রোখ। সাঈদ দেখান, এই পরিস্থিতি উলটে যেতে পারে উত্তর-উপনিবেশী বয়ানে। যেমন দেখা যায় কেনীয় লেখক এনগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর দি রিভার বিটুইন (১৯৬৫) এবং সুদানিজ লেখক তাইয়্যেব সালিহ্ সিজন অব মাইগ্রেশন টু দি নর্থে (১৯৭০)। এনগুগি হার্ট অব ডার্কনেসের মরা নিকৃষ্ট নদীটার একটা নাম দেন, তাতে প্রাণ সঞ্চার করেন আর মিলিয়ে দেন স্থানীয় জনজীবনের সঙ্গে। এনগুগি লেখেন:

নদীটার নাম হোনিয়া; এর অর্থ হলো সুস্থতা দান করা বা প্রাণ সঞ্চার করা। হোনিয়া কখনো শুকায় না, যেন খরা বা আবহাওয়ার পরিবর্তনকে অবজ্ঞা করে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা তার মধ্যে। এবং তা বয়ে চলে একইভাবে, কোনো তাড়াহুড়া নাই, দ্বিধা নাই। লোকেরা তা দেখে আর সুখ পায়।

এভাবে উপনিবেশকের বয়ানে স্থানীয় যে-নদীটি মরা, বিবর্ণ, বৈশিষ্ট্যহীন, এনগুগির লেখায় তা হয়ে ওঠে জীবন ও প্রাণময়তার প্রতীক।

সালিহ্ উপনিবেশী অভিযানের গতিমুখ উল্টে দেন। তিনি দেখান, তাঁর প্রধানতম চরিত্র মোস্তফা সুদানের পাড়াগাঁ থেকে নীল নদ ধরে উত্তরে ইউরোপের কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হয়েছে। মানসিক আধিপত্যের উৎস ও আরোপণের মুখ এখানে উল্টে গেছে।

এনগুগি ও সালিহর রচনায় প্রতিরোধের সংস্কৃতিকে প্রশংসার চোখে দেখেন সাঈদ। তিনি মূলত উপনিবেশী রচনার পুন:পাঠ ও পুনর্লিখনের ওপর জোর দেন; তেমনি সাম্প্রতিক সাহিত্যে প্রতিরোধের মনোভঙ্গি জোরদার করার ব্যাপারেও আগ্রহী।

বি-উপনিবেশনের ক্ষেত্রে ভাষার প্রশ্নটি গুরুত্ববহ। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে উপনিবেশকের ভাষার জবরদস্তির মুখে স্থানীয় ভাষা প্রায় হারিয়ে গেছে। ওখানে এখন ফরাসি বা স্পেনীয় কিংবা ইংরেজি ভাষার দাপট। বি-উপনিবেশনের প্রক্রিয়া ভাষার ওপর চলবে কিনা  সে-বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মত এক নয়। কেউ  কেউ মনে করেন উপনিবেশকের যে-ভাষা স্থানীয় জনগোষ্ঠী গ্রহণ করে নিয়েছে তাকে বাদ দেওয়ার দরকার নেই। বরং সে-ভাষাকে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিপার্শ্ব অনুযায়ী ঘষেমেজে, উলটে-পালটে মেনে নিতে হবে অর্থাৎ এ-ভাষাকে নিজের মতো পুননির্মাণ করে নিতে হবে। এ-পরামর্শ যাঁদের, তাঁরা মনে করেন, এতে পশ্চিমের জ্ঞানভাষ্যে  হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, তাকে ভেঙেচুরে নিজেদের করে নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে। পশ্চিমের জ্ঞানভাষ্যে প্রান্তজনকে ও তার চাপা-দেওয়া ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং এভাবে সম্ভব হচ্ছে সেই ভাষার বি-উপনিবেশন।

এ-ধরনের প্রস্তাব শুনতে খারাপ লাগার কথা নয়, বিশেষত আমাদের বাঙালিদের কাছে, যারা নিজেদের ভাষাকে নিজভূমে নির্বাসনে রাখতে বাধ্য হইনি। কিন্তু উপনিবেশের কারণে যারা তাদের ভাষা হারিয়েছেন তাঁদের মনে পূর্বপুরুষের মুখের ভাষার প্রতি অফুরান দরদ থাকাই স্বাভাবিক। যেমন এনগুগি ওয়া থিয়োঙ্গা উপনিবেশকের ভাষা বর্জন করতে চান। তিনি মনে করেন, কোনো জনগোষ্ঠীর  প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে, এমনকি সমগ্র বিশ্বজগতের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তার নিজস্বতা বা আত্মপরিচয় কী, সে-ধারণার মূলে থাকে ভাষার ব্যবহার ও ভাষা-নির্বাচনের বিষয়টি। এ-কারণে বিশ শতকের আফ্রিকায় প্রতিদ্বন্দী দুই সামাজিক শক্তির মূলে ছিল ভাষার প্রসঙ্গ। (এনগুগি ১৯৮৬, ৪)

আফ্রিকায় যারা প্রচলিত উপনিবেশী ভাষাব্যবহারের পক্ষপাতী তাঁদের মধ্যে নয়া উপনিবেশের প্রতি সমর্থনও লক্ষ্য করেন এনগুগি। আর যাঁরা নয়া উপনিবেশায়নের বিরুদ্ধে লড়েছেন তাদের মধ্যে প্রবল পক্ষপাতিত্ব রয়েছে স্থানীয় ভাষার প্রতি। তিনি নিজে শ্রমজীবী কেনীয়দের ভাষা কিকুইয়ুতে সাহিত্যচর্চার পক্ষে কথা বলেছেন। এ-ভাষায় সাধারণ মানুষের অন্তর স্পর্শ করা সম্ভব।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক: উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য (পর্ব-৪) । ফয়েজ আলম


উত্তর-উপনিবেশবাদে উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর নিজস্বতার কথা যে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গের প্রসঙ্গ এমনিতেই এসে পড়ে। বরং ফানোকে মেনে আমরা যদি ধরে নিই যে, ক্ষমতার ধারক আধা-বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি শেষ পর্যন্ত অনেকাংশে উপনিবেশক প্রশাসকদের বিকল্প, তাহলে প্রাক-উপনিবেশী চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির জন্য আমাদেরকে সাব-অলটার্নদের খোঁজ করতে হবে। এদেশে সাব-অলটার্ন স্টাডিজ সম্পর্কিত কথাবার্তার সঙ্গে রনজিত গুহর পাশাপাশি গায়ত্রী চক্রবর্তীর নামও জড়িয়ে আছে। কিন্তু আদতে গায়ত্রীর অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। যেমন সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে তার আলোচনায় বুঝানোর চেষ্টা করেছেন স্বামীর মৃত্যুর পর প্রথা অনুযায়ী তার বিধবা স্ত্রী চিতায় উঠে মরতে চায় কি না সেই ফয়সালায় বিধবাদের নিজস্ব মতামত নাই। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কিত আলোচনায় প্রমাণের চেষ্টা করা হয় ভারতীয়রা বর্বর, বিধবা নারীদেরকে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারে। আর বৃটিশ উপনিবেশ সেইসব বিধবাদের রক্ষা করে। কিন্তু গায়ত্রী মনে করেন বৃটিশদের কর্তৃক ভারতে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ নিয়ে যে বয়ান তৈরি হয়েছে তাতে সতীর নিজের কথা নাই। সতী তার স্বামীর চিতায় আত্মহুতি দিতে চায় কিনা তা সে কখনো জানান দেয়ার সুযোগ পায়নি। বৃটিশ প্রশাসক-লেখকদের কথাই হিন্দু বিধবাদের কথা হিসাবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে নি¤œবর্গের নিজস্ব কণ্ঠ চাপা পড়ে গেছে। গায়ত্রী আসলে এখানে প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটা আবার তুলেছেন, সাঈদ যা আলোচনা করেছেন অরিয়েন্টালিজমে।

বি-উপনিবেশন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার্য তাত্ত্বিক কৌশলগুলো নিয়েও কথা আছে। অনেকে মনে করেন, পশ্চিমের তাত্ত্বিকদের দ্বারা সংগঠিত কৌশল ব্যবহার করা ঠিক হবে না, কেননা, এতে একরকম  হেজেমনির সম্পর্ক তৈরি হয়। যেমন হোমি ভাবা ফুকো, দেরিদা ও ল্যাঁকাকে ব্যবহার করেন। তবে উত্থাপিত অভিযোগের বিরুদ্ধে ভাবার যুক্তিও বিবেচনা করার মতো। তিনি বলেন, এ-ধরনের অভিযোগের কারণে পশ্চিমে উদ্ভূত কতিপয় শক্তিশালী তত্ত্ব ব্যবহার না করার অর্থ হলো নিজের ক্ষতি করা এবং পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া (ভাবা ১৯৯৪; ১৯)। তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যে যে-বিপুল সাংস্কৃতিক শক্তি আছে, তা গলিয়ে প্রবাহিত করার জন্য ওইসব তত্ত্বের সহায়তা প্রয়োজন। তাছাড়া তত্ত্বের ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন পূর্ব-পশ্চিম বিভাজন প্রাচ্যতাত্ত্বের পুব-পশ্চিম দ্বিমেরুকরণে’র মতোই সীমা-আরোপক।

এ-সত্ত্বেও ভাবা-গায়ত্রীর কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে অনেক উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিক  আপত্তি করেন। প্রথমত ভাবা ও গায়ত্রীর অবস্থান সংঘাতপূর্ণ। ভাবা মনে করেন, শুরু থেকেই উপনিবেশিতরা প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে, যার ছাপ আছে সংস্কৃতির সংকররূপে। ভারতের পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভাবা কিছু নমুনাও তুলে ধরেছেন।

এখানে কথা আছে। অনেক দেশের প্রাক-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি ছিল সুগঠিত, সুবিন্যস্ত। সেখানে সংকর সংস্কৃতি দেখা দিলেও পুরানো রীতি বিভিন্ন পরিসরে সক্রিয় রয়ে গেছে। ওইসব দেশে প্রাক-উপনিবেশী রীতি পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব। যেমন আমাদের এখানে। এক্ষেত্রে সংকর সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করার দরকার আছে কিনা, তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।

চন্দ্রা তালপাদে মোহান্তি উপনিবেশিত নারীদের সম্পর্কে একটা জরুরি কথা বলেছেন। যেহেতু স্থানীয় নারী বিভিন্নমুখী সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্মিত এবং শ্রেণি, বর্ণ ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হিসেবে নির্দিষ্ট অবস্থানে আসীন, তাই নারী যেখানে ওঝা, সাধিকা, কারিগর, কারু ও চারুশিল্পী, পবিত্র গানের গায়িকা হিসেবে নিজের ছাপ রেখেছে–সেখান থেকে তার কণ্ঠস্বর উদ্ধার করা সম্ভব।

এ-প্রসঙ্গে আমরা গৌতম ভদ্রের ইমান ও নিশান গ্রন্থের নাম করতে পারি। ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে টিপু শাহর ইংরেজবিরোধী বিদ্রোহের ইতিহাস পুনর্গঠনে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বয়ান ব্যবহার করেছেন লেখক। বিদ্রোহীদের এই বয়ান উপনিবেশী রেকর্ড কিপার, ইতিহাস লেখক ও উপনিবেশক শাসকবর্গের এদেশীয় দোসরদের রচনার আড়ালে চাপা পড়েছিল দীর্ঘদিন। (ভদ্র, ১৯৯৪; ৬৮-৬৯) আমাদের ঐতিহ্যে আঠারো  শতকের শেষ ও উনিশ শতকের সূচনায় লিখিত বহু পুঁথিতেও নিুবর্গের কণ্ঠস্বর শনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়া আছে লোকসাহিত্যের বিপুল ভান্ডার। লোকসাহিত্যে নিুবর্গের প্রতিনিধিত্ব নানা কারণে প্রবল। এ সাহিত্য বিকশিত ও লালিত হয়েছে নিুবর্গের মানুষের মধ্যে। ওই কালে দরবারি/নাগরিক সংস্কৃতি ছিল ভৌগোলিকভাবে সীমাবদ্ধ, রক্ষণশীল ও ব্যয়বহুল। এইসব কারণে নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিুবর্গের মানুষের পরিচয় প্রায় ঘটেনি বললেই চলে। তাই নিুবর্গের কণ্ঠ উদ্ধারে মৌখিক সাহিত্য সমৃদ্ধ জায়গা। এমনকি কোনো একটি জনগোষ্ঠীর মৌখিক সাহিত্য থেকে তাদের প্রাক-উপনিবেশী সংস্কৃতির মূল কাঠামোর অনেকখানি উদ্ধার করা সম্ভব (দ্র: ফয়েজ আলম, ২০০৪)।

ভাবা ও গায়ত্রীর অনুরুপ ঘরনার যেসব তাত্ত্বিক কেবল টেক্সটের মধ্যে উপনিবেশিতের অবস্থান বিচার করেন, তাদের সমালোচনা করেছেন অনেকে। এ-বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন বেনিটা পারি তার ‘প্রবলেমস ইন কারেন্ট থিয়োরিজ অব কলোনিয়াল ডিসকোর্স  প্রবন্ধে। ভাবা ও গায়ত্রীর মতামত বিশ্লেষণ করে তিনি মন্তব্য করেন:

বিশ্লেষণের জটিলতা সম্পর্কে এ অভিযোগ নয়, বরং এ হচ্ছে আমার এই পর্যবেক্ষণ যে উপনিবেশবাদের এইসব বিকল্প বয়ান ‘দুই প্রধান চরিত্রের প্রাণসংহারী ও নিয়ামক লড়াইকে অস্পষ্ট করে তোলে (ফানো, ১৯৬১, ৩০)’ এবং প্রতিটি মুক্তি আন্দোলন যে প্রতিরোধী-জ্ঞানভাষ্য অঙ্কিত করে রাখে, তাও মুছে ফেলে। ভাবা ও স্পিভাকের যথেষ্ট বিসদৃশ সমালোচনা চিন্তা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি প্রোগ্রামে এসে মিলে যায়। সেই প্রোগ্রামের লক্ষ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ডিসকোর্সের অতিমূল্য নির্ধারণ এবং নিয়ামক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সামাজিক প্র্যাক্সিস সম্পর্কে উদাসীনতা। (পারি ১৯৯৯; ৪৩)।

শেষে ফানোর এই কথা মনে করিয়ে দেন পারি যে, ফানোও সেইসব স্থানীয় লেখক ও বুদ্ধিজীবীর সীমাবদ্ধতা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন, যারা (ফানোর ভাষায়) ‘তাদের দেশের বহিরাগতদের কৌশল ও ভাষা ধার করে ব্যবহার করে’। পারির অভিযোগের তীর্যমুখ যে গায়ত্রী, ভাবা ও সমজাতীয়দের দিকে, তাতে সন্দেহ নেই।

আরেকটা বিষয় আলোচিত হওয়া উচিত। অনেক সমাজের প্রাক-উপনিবেশী ঐতিহ্যে নারীকে দমন করার অভিজ্ঞতা আছে। বি-উপনিবেশন প্রক্রিয়ায় ওইসব প্রবণতাকে কীভাবে গ্রহণ করা হবে তার একটা হেস্তনেস্ত আগেই হওয়া দরকার। প্রাক-উপনিবেশী ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের প্রসঙ্গে নারীর অবস্থানের দিকটি  গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সংস্কৃতির এমন কোনো উপাদান হুবহু পুনঃস্থাপিত করা ঠিক হবে না, যা উপনিবেশী প্রভাব নিষ্ক্রিয় করলেও নারীকে আবার ব্যক্তিগত উপনিবেশ হিসেবে দেখতে উৎসাহী।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত