| 29 মার্চ 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

ইরাবতীর মুখোমুখি কবি,কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক তৃষ্ণা বসাক

আনুমানিক পঠনকাল: 24 মিনিট

সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য ও অনুবাদের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের কাছে তৃষ্ণা বসাক খুব পরিচিত নাম। তৃষ্ণা বসাকের মুখোমুখি হয়েছিলেন শৌনক দত্ত। জানা অজানা অনেক কথা উঠে এসেছে সেই আলাপচারিতায়। অনেক বিষয়ে তৃষ্ণা বসাক আলো ফেলেছেন। কথা বলেছেন অনুবাদ, কবিতা- গল্প ও আরো অনেক বিষয় নিয়ে। এই আলাপচারিতার আগে এভাবে তৃষ্ণা বসাক কে জানা বা চেনা যায়নি।


শৌনক দত্ত: কবিতা,কথাসাহিত্য নাকি অনুবাদ? কেন?

তৃষ্ণা বসাক: কবিতাই আমি প্রথম লিখতাম। যদিও সেই প্রথম আত্মপ্রকাশের সময়তেই একটা আস্ত নাটক লিখেছিলাম। বোধহইয় আট বা ন বছর বয়স তখন। তারপর থেকে শুধু কবিতাই অনেক বছর, গল্প গোপনে, গল্প প্রকাশের আত্মবিশ্বাস ছিল না। আবার একটা সময় আসে, যখন কথাসাহিত্যই হয়ে ওঠে আমার প্রধান পরিচয়। গদ্য লেখার একটা বিপুল পরিশ্রম আছে। তার মাঝে খানিকটা দুরূহ তানকারির মধ্যে শ্বাস নেবার মতো করে কবিতা । তাই কোন একটিকে বেছে নেওয়া সম্ভব নয়। আর অনুবাদ নিশ্চয় আমার মৌলিক সাহিত্যের পরে আসবে, যদিও সেটি করার সময় আমি প্রচুর সময় ও মনোযোগ দিয়ে থাকি। আর অনুবাদে পরিশ্রম অনেক বেশি হয়, কারণ প্রথমে আমাকে মূল টেক্সটের ভেতরে ঢুকতে হয়, তারপর তো অনুবাদের প্রশ্ন।
কথাসাহিত্য বা কবিতার তুলনায় অনুবাদে সময় নিশ্চয় কম দিই, তবে কিছু সময় অন্তর অন্তর আমি অনুবাদ করে চলি, কারণ এক- অনুবাদ আমাকে নিজের লেখার স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে, দুই-একটা দ্বিতীয় ভাষার চিন্তাবিশ্বে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।

জীবনের এমন কোন ঘটনা তোমার বিশ্বাস গঠনে প্রভাব ফেলেছে?

তৃষ্ণা বসাক:মণীন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন ঘটনার মতো না -ঘটনাও আমাদের প্রভাবিত করে। অনেক এমন না- ঘটনা আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা না পাওয়া, প্রতিষ্ঠানের ছাতা মাথার ওপর না থাকা- এসব আমাকে একেবারে স্ব-অধীন এবং স্ব-তন্ত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আবার ঘটনার মধ্যে বলা যায়, মাত্র আঠেরো বছর বয়সে বাবার মৃত্যু, আমার একেবারে ভেতরে একটা পরাবাস্তব জগত গড়ে দিয়েছে। আরেকটি ঘটনা- একটি বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তার বাবাকে হাতে উল বুনতে দেখা- চিন্তার স্টিরিওটাইপিং থেকে মুক্ত করেছে।
আর একটি বড় ঘটনা, বিবাহসূত্রে অন্য বাড়ি এসে যখন জানতে পারলাম, আমার শ্বশুরবাড়ির অনেক আত্মীয়স্বজন এখনো বাংলাদেশে আছেন, আমার ভীষণ একটা ধাক্কা লেগেছিল। আমার কেমন যেন ধারণা ছিল ৪৭-র দেশভাগের পরে আর ওদেশে কোন হিন্দু ছিলেন না। ক্রমে আমি টেক্সট বইয়ের বাইরের জীবন থেকে পাঠ নিতে শুরু করলাম। আমার দ্বিতীয় জন্ম হল।

কোন কোন বই, কোন কোন লেখক তোমার বিশ্বাসকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে, কেন?

তৃষ্ণা বসাক: আমার ওপর যদি সত্যি কারো সুস্পষ্ট ছাপ থাকে তা রবীন্দ্রনাথের। তার কারণ , ওই যে অক্ষরপরিচয়ের আগে থেকেই বাবার মুখে মুখে অবিশ্রান্ত রবীন্দ্রকবিতা শোনা। আমার ছন্দের কান এইভাবেই তৈরি হয়। বললে অনেকে বিশ্বাস করবে না, ফাইভ সিক্সে ওঠার আগেই আমার রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র এবং কিছু প্রবন্ধ বাদ দিলে প্রায় সব পড়া হয়ে যায়। কবিতায় প্রথম দিকে অর্থাৎ এগারো বারো বছরে লেখা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের বেশ ছাপ আছে। যদিও, অচিরেই আমার কবিতা নিজের ভাষা খুঁজে নেয়। সে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হবার অনেক আগে থেকেই। আশৈশব দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত আমি বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে খেলতে পারতাম না, জানলায় বসে দেখতাম। সবাই বলে যেত ‘অমল কেমন আছ?’ ।ডাকঘর নাটক আমাকে খুব প্রভাবিত করে, যেহেতু আমিও জন্মের অসুখ আক্রান্ত জানলায় বসে থাকতাম, খেলতে পাইনি, সবাই অমল বলে ডেকে যেত। এইভাবে আমি রবীন্দ্রনাথের একটি চরিত্র হয়ে উঠি। সেসময় বাবা, রবীন্দ্রনাথ এবং বই এই তিন আশ্রয় ছিল আমার, এঁরাই আজকের আমিকে গড়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্র ভক্তি এতটাই ছিল যে সেইসময় শরৎচন্দ্রকে অস্বীকার করতে শুরু করেছিলাম। তাঁর ঐশ্বর্য আবিষ্কার করেছি অনেক পরে। আমার একটি গল্পের ট্রিটমেন্টে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’ গল্পকে অন্যভাবে ব্যবহার করেছি সচেতন ভাবে। আসলে সবচেয়ে বড় প্রভাব, তাঁর ঐ ব্রিলিয়ান্স, আন্তর্জাতিক ও যৌক্তিক মেধা ও চেতনা, সেটা আমি অনুভব করি। আমার রুচি অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের নির্মাণ।সেইস্ম্য শার্ল্ক হোমস। চিন্তার জগতে একটা বিশ্লেষ্ণাত্মক ঝঁক আসে। পাশাপাশি ক্তহামৃতের ক্তহাও বলতে হবে। কথাসাহিত্যের যে সরসতা, উপমা, গল্প ব্লার মৌলিক ধ্রন, ের জন্যে ক্তহামৃতের কাছে অনেক ঋণ। এছাড়া বংকিমচন্দ্রের কাছে শিখেছি সাহিত্য আসলে সৌন্দর্য নির্মাণ। শরৎচন্দ্রের বিরাট মানবিক মনকে আবিষ্কার করেছি অনেক পরে।তিন বাড়ুজ্জের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি বিভূতিভূষণকে । মনে হয় তিনি হাঁটেন আমার সঙ্গে। সতীনাথ ভাদুড়ী অসাধারণ। বিমল করের পরিবেশ রচনার ক্ষমতা বিস্ময়কর। ঋতুর গন্ধ টের পাওয়া যায়।আর একজন মণীন্দ্র গুপ্ত, নব্বই বছর বয়সেও লেখায় এত তারুণ্য আর মেধা-আর দেখিনি। সমারসেট মমের মুন অ্যান্ড দা সিক্স পেন্স পড়ে তো সরকারি চাকরিই ছেড়ে দিই। আর আধুনিক সাহিত্য জগতের সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন মিলান কুন্দেরা। অস্তিত্বের যে নাথিংনেস, এক অবহনীয় শূন্যতা, এবং তাঁর কমিউনিস্ট শাসনের অভিজ্ঞতা, তাঁর অনাবাসী জীবন আমি মর্মে মর্মে টের পাই।না–ঘটনা কিংবা ইতিহাসের ধুলো থেকে কীভাবে গল্প উপন্যাস লেখা যায়, তা হয়তো তাঁর কাছে শিখেছি। অজিত সিং বনাম অজিত সিং –আমার মতো অরাজনৈতিক লোক যে বিগত চল্লিশ বছরের রাজ্যের রাজনীতি নিয়ে এরকম একটা পলিটিকাল থ্রিলার লিখতে পারল, তার সাহস হয়তো কুন্দেরাই দিয়েছেন।

এর পরে অ্যালভিন টফলার, তাঁর ফিউচার শক বইটি আমার চিন্তার ধরন পালটে দেয়। সম্প্রতি মহাকান্তার উপন্যাস, অনিতা অগ্নিহোত্রীর, আমাকে আচ্ছন্ন করেছে। মুরাকামির কিছু গল্পের কথাও বলতে হয়। আর তপোভূমি নর্মদা, শৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী, সুলেখা স্যান্যালের নবাংকুর। আরো কত বই, বন্ধুর মতো, আত্মীয়ের মতো, অভিভাবকের মতো, কিছু না কিছু দিয়ে গেছে, খালি হাতে ফেরায়নি।

লেখক জীবনের শৈশবটা কেমন ছিলো জানতে চাই।

তৃষ্ণা বসাক: জন্ম থেকে দেখেছি দেওয়ালে টাঙ্গানো বংশ পরিচয়, আমার বাবার লেখা যা আসলে একটা সনেট-
নিজ বংশ পরিচয়
অংশুমান ভট্টাচার্য
পরম আরাধ্য পিতা নরোত্তম গুণী
বরদাপ্রসাদ নাম ভট্টাচার্য শ্রেণী
পূজনীয়া মাতৃদেবী অয়ি বীণাপাণি
আদি গ্রাম বোলসিদ্ধি তিষ্ঠে শূলপাণি
অগ্রজ নরেশচন্দ্র বচন মহান
অধম দ্বিতীয় কীর্তি নাম অংশুমান
গতায়ু তৃতীয় ভ্রাতা অতি সুকুমার
ফাগুনে শ্রাবণ ধারা ষষ্ঠে পরপার
ভগিনী মাধুরী একা গুণে বৃহস্পতি
বুদ্ধির বাগান চষে সাবলীল গতি
মমতা সংগীতময়ী পত্নী প্রিয়তমা
মানস তনয় যার, কন্যা তৃষ্ণাসমা
চতুর্থ পঞ্চম ভ্রাতা সুনীল অনিল
বংশ পরিচয়ে কবি আনন্দে ফেনিল।।

আমার বাবা ছিলেন পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, নেশায় কবি। পেশাগত ব্যস্ততার কারণে খুব বেশি লেখা হয়তো প্রকাশিত হয়নি।বাবার আদি গ্রাম বোলসিদ্ধি, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায়। ডায়মন্ডহারবার থেকে যাওয়া যায়। আবার ডায়মন্ডহারবার ট্রেন লাইনের গুরুদাসনগর স্টেশনে নেমেও যাওয়া যায়। বাবার মুখে শুনেছি আমাদের নৈয়ায়িকের বংশ, পঠন পাঠ অধ্যয়ন ছিল জীবিকা। বাড়িতে মূর্তিপূজা হত না, পরে আমার দিদার তাড়নায় মা লক্ষ্মীর আসন পাতে। বোলসিদ্ধি গ্রামে পাতালফোঁড়া শিবের মন্দির। এই শিবের বোল অর্থাৎ বাক সিদ্ধ। তাই থেকে গ্রামের নাম। অনেক কিংবদন্তী, অলৌকিক কথা প্রচলিত এই গ্রাম ও শিবকে নিয়ে। শুনেছি ছ বছর বয়সে বাবাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল বিখ্যাত কবিরাজ, তখন ঠকুরদা এই শিবের সামনে ফেলে আসেন বাবাকে, তারপর মরা ছেলে বেঁচে ওঠে। বাবা একটা আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন ‘যুক্তি তর্কের বাইরে’, সেটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং। বাবার জন্ম ১৯৩৬। সেই সময়ের গ্রাম জীবন, তারপর পঞ্চাশের দশকে যখন কলেজে পড়তে কলকাতায় আসেন, সেই সময়কার কলকাতা, দারুণ আকর্ষণীয় স্মৃতিচিত্র এক। তবে খুব বেশি না, আমার অসমাপ্তই মনে হয়েছে। বাবা অডিটের কাজে সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছেন, কত মানুষ, কত অভিজ্ঞতা, সেসব থাকতে পারত। হয়তো সময় পাননি। মাত্র বাহান্ন বছরে চলে গেলেন।বরাবর বলতেন ‘আমরা অল্পভুগীর বংশ’। ঠাকুরদা ঠাকুমা তো পঞ্চাশ পার হননি। আমার ঠাকুমা এসেছিলেন জয়নগর মজিলপুরের এক পণ্ডিত বংশ থেকে। পাঁচ বছরে কন্যা দান। তিনি ছিলেন অক্ষরপরিচয়হীন, কিন্তু আশ্চর্য মেধাবিনী ও শ্রুতিধর।আমার বাবা জোরে জোরে যা পড়তেন, সেই শুনে ঠাকুমা সব মুখস্থ করে নিতেন।একবার ঠাকুমা কলকাতায় এসে ট্রামে চেপেছেন, এক মেমসাহেব ছিলেন সেই ট্রামে। মেমসাহেবের দুধে আলতা রঙ সত্যি কিনা পরখ করার জন্য তাঁর বাহুতে আঙুল ছুঁইয়েছেন, বিরক্ত মেম তাঁর দিকে কটমট করে তাকাতে ঠাকুমা টকাটক ফার্স্ট বুক অব রিডিং থেকে বলে গেলেন ‘ওয়ান ডে আই মেট আ লেম ম্যান…’ মেম তো চমৎকৃত। দাদু ছিলেন মাটির্ন বার্ন কোম্পানির চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট। কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন। বেয়াল্লিশের অসহযোগ আন্দোলনের মিছিলে হাঁটার জন্য অত বড় চাকরি চলে গেল। অফিসে গিয়ে দেখেন তাঁর টেবিলে বরখাস্তের চিঠি। তিনি তখন তাঁর ঊর্ধবতন সাহেবের কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কেন তাঁর চাকরি গেল? উত্তরে সেই সাহেব বলেছিলেন ‘আস্ক গান্ধী’
এরকম সব মৌলিক, বর্ণময় মানুষ ছিলেন তাঁরা। ছাঁচে ঢালা নয়। তেমনই আমার মাতামহও। বোলসিদ্ধি গ্রামের পাশের গ্রামের নাম বারাদ্রোণ, তারপর হটুগঞ্জ। একবার দেখেছিলাম রবীন্দ্রনাথের গেছোদাদায় হটুগঞ্জের গামছার উল্লেখ আছে। তাতে যারপরনাই আহ্লাদিত হয়েছিলাম। ওটা যে আমার মামাবাড়ি। দাদুর বাবা ছিলেন এক্সাইজ ইন্সপেক্টর। তিনি অকালে প্রয়াত হলে ব্রিটিশ সরকার তাঁর পরিবারকে এই গ্রামে একটি আবগারি দোকান দেয় গ্রাসাছদনের জন্য। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই পরিবারটির আদি শিকড় বিষ্ণুপুরে। দাদু ধ্রুপদী শিল্পী। তিনি সেই সময়, আনুমানিক তিরিশের দশকে সিনেমায় গান গাওয়ার জন্যে ডাক পেয়েছিলেন, তখন তাঁর থেকে বয়সে ছোট তাঁর সদ্য বিধবা বিমাতা, তাঁকে দিয়ে পা ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যে তিনি আর টকিতে গান গাইবেন না। পরিবারটিকে বাঁচাতে তিনি তাঁর এই পুত্রকে এবং বাকি সবাইকে জোর করে নিয়ে হটুগঞ্জে চলে যান।তিনি ভেবেছিলেন হটুগঞ্জে ওই আবগারি দোকানে দাদুকে বসাতে পারলে সংসারটা রক্ষা পাবে। দাদু বিমাতার কথা ফেলতে পারলেন না, শহর ছেড়ে গ্রামে গেলেন। কিন্তু গানের স্রোতে সব ভেসে গেল। সেই প্রত্যন্ত গ্রামে দাদু হয়ে উঠলেন সংস্কৃতির ভগীরথ। গান শেখানো তো বটেই, ফ্লাওয়ার শো, গ্রামের মেয়েদের বানানো জিনিস নিয়ে হস্তশিল্প প্রদর্শনী, হিন্দু মুসলমানদের মিলিত রথযাত্রা- এইসব বিবিধ কাজের ধাক্কায় সেই আবগারি দোকান বন্ধ হয়ে গেল, তবে দাদুর ছেলেমেয়েদের মানে আমার মা, মামা, মাসীদের সবাই বলত ‘গেঁজা বেপারির মেয়ে বা ছেলে’। এই সম্বোধনের মধ্যে সেই বন্ধ আবগারি দোকানটা বেঁচে রইল। তবে গ্রামে শুধুমাত্র গানের টিউশনি সম্বল করে একটি আদ্যন্ত শহুরে পরিবার, যেখানে প্রতিদিন মিনিমাম পাঁচ সাতজন অতিথি লেগেই থাকত, চলত একমাত্র আমার দিদার জাদুকরী ক্ষমতায়। ক্লাস ফোরে বৃত্তি পাওয়া মেয়ে, নৈহাটির গরিফা অঞ্চলের। চালের ড্রামের মধ্যে লুকিয়ে বই পড়তেন। বিয়ের জন্য পড়া বন্ধ হল, এসে পড়লেন এক বাউন্ডুলে শিল্পীর সংগতিহীন সংসারে। কিন্তু তাঁর এমনি ব্যক্তিত্ব ও পরিচালন ক্ষমতা যে সংসারে দারিদ্র থাকলেও অলক্ষ্মীপনা ছিল না। সে সংসারের খাওয়া দাওয়া লোক লৌকিকতা ছিল যে কোন সম্পন্ন পরিবারের মতোই। ছেলেমেয়েরা তাঁর জন্য কোনদিন একটি কু বাক্য বলার সাহস পায়নি। বিশেষ করে প্রতিটি মেয়েকে তিনি ন্যূনতম গ্র্যাজুয়েট করেছিলেন। আমার মা ছিলেন দশ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। দাদুর খুব আদরের মেয়ে। এই মেয়েকেই নিজে গান শিখিয়েছিলেন দাদু। মা পুজো প্যান্ডেলে লতা মঙ্গেশকরের ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ শুনে লতাকে গুরু মেনেছিলেন। তাঁর ছিল অসামান্য গানের গলা ও সুরবোধ। যদিও তা পরিণতি পায়নি।মা ঘরোয়া আসরে গান গেয়েই স্নতুষ্ট ছিলেন।
আমার সেজকাকু এই দাদুর কাছে গান শিখতে আসত। এই কাকুই তার মেজদা অর্থাৎ আমার বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়ের ঘটকালি করেছিল। ১২ মার্চ, ২৮ ফাল্গুন ১৯৬২ সালে বিয়ে হল। বাবা তখন কলকাতায় থেকে সি এ পড়ে। ঠাকুরদার তখন অবস্থা পড়ে এসেছে, বাবাকে পড়াবার ক্ষমতা নেই। ম্যাট্রিকের পর থেকেই এই অবস্থা। সম্পূর্ণ আমার ঠাকুমার জেদে আর নিজের ইচ্ছের জোরে বাবার পড়া চলেছিল। নিজে রাতে চাকরি করে, দিনে টিউশনি করে সিটি কলেজের ফিজ জোগাড় করেছিল বাবা। রাস্তার আলোয় পড়েছে বাড়িওলা রাত দশটার পর আলো নিভিয়ে দিত বলে।
বিয়ের কিছুদিন পর মা বাবার কাছে এসে থাকতে শুরু করে, দেবেন্দ্র মল্লিক লেনে, তারপর ডঃ জগবন্ধু লেন। এখানে থাকার সময়ই আমার জন্ম, লেডি ডাফরিন হসপিটালে, ২৯ অগস্ট, ১৯৭০। আমার বয়স যখন চারমাস, দাদার বয়স আট বছর, সেইসময় কলকাতার পাট তুলে বাবা একটু সবুজের খোঁজে বারুইপুর চলে এলেন, সেখানে এক বছর ভাড়া থেকে নিজেদের বাড়ি হল রাসমাঠ রথতলায়। অর্থাৎ আমার কলকাতায় জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা মফস্বলে, বছর সাতাশ সেখানে থেকে বিবাহসূত্রে কলকাতায় আসি, সেও সিকি শতাব্দী হল। আর এই পুরো সময়টাতেই গ্রামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থেকে গেছে। আমার সাহিত্যযাপনে তাই গ্রাম, মফস্বল ও নগর- তিন ভরকেন্দ্র, ফর্ম আর কন্টেন্টের রকমফেরে।
আমার অক্ষরজীবনের শুরুতে আছে একটা জানলা, ফুটবলমাঠের মতো একটা ছাদ আর একসারি পামগাছ। এই পামগাছের মাথার ওপর দিয়ে মেঘ উড়ে আসত, আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতাম। তিনতলার চিলেকোঠার ঠাকুরঘরের মেঝেতে খাতা কলম নিয়ে আমি যখন লিখতাম, তখন একপাল নিরীহ ঠাকুর আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত, জানলার গরাদে থুতনি ঠেকিয়ে আমাকে দেখত বৃষ্টি।
‘আমার কতকগুলো পোষা ঠাকুর আছে,
রোজ সকালে
তাদের ছোলা-জল খাওয়াতে
তেতলার চিলেকোঠায়
উঠতে হয়!
ওপরে গেলেই
আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই,
জানলায় থুতনি ঠেকিয়ে দেখি
রাসমাঠে পামগাছের সারি,
পামগাছের মাথায়
বাসা বেঁধেছে মেঘ,
রাজহাঁস উঠে আসছে কোষাঘাট থেকে…।

আমি ছোলাগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে দিই,
বলি ‘চরে খাও বাছারা,
আমার সঙ্গে কোন
চালাকি চলবে না!’

কেউ কেউ না শোনার ভান করে
দুলতে থাকে হাওয়ায়,
কেউ বা তাকিয়ে থাকে, আমার মতোই, মাঠের দিকে,
পামগাছের মাথায় ততক্ষণে,
নতুন নতুন মেঘ,
জানলা দিয়ে ঢুকে আসছে
নতুন নতুন বৃষ্টি!’
(যে পুজোর যা)
অভিমন্যুর মতোই তো মাতৃগর্ভে শুয়ে কবিতা শুনেছি। বাবা কবিতা লিখেই পড়ে শোনাতেন মাকে। এই যে কবিতা লিখে পড়ে শোনানো, এটা বাবার বরাবর ছিল। বিয়ের আগে সেজকাকুকে পড়ে শোনাতেন, ছোটবেলায় মারাত্মক পক্স হয়ে সেজকাকুর অঙ্গহানি হয়। একটা হাত, একটা পা, একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। আর স্কুল যেতে পারেনি। অথচ অমন শিক্ষিত মানুষ কমই হয়। এর পুরোটাই বাবার মুখে মুখে শোনা। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, সিনেমা, নাটক, রাজনীতি। গানের ব্যকরণ গুলে খেয়েছিল। পরবর্তীকালে সঙ্গীত জীবিকা হয়ে ওঠে।ভি বালসারার সঙ্গে কাজ করেছে, প্লেব্যাকও করেছে সিনেমায়। হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মত।বহুবছর পর্যন্ত এই সেজকাকুই ছিল বাবার কবিতার প্রথম শ্রোতা। তারপর বাবা পড়াশোনা করতে কলকাতায় চলে এলেন। সেজকাকু তখনো গ্রামে, যেহেতু সে স্কুলে যায় না। ছোট ভাইও চলে এল কলকাতায়। পুরুষ অভিভাবকহীন হয়ে তার পড়াশোনা কিচ্ছু হচ্ছিল না। কলকাতায় আসার পর তার কাজ ছিল স্টুডিওপাড়ায় ঘোরা আর হিরো হিরোইনের অটোগ্রাফ সংগ্রহ। ফিল্মে নামার বাসনায় সে নিজের একটা নামও দিয়ে রেখেছিল আগে থেকে –লাভলি কুমার। এই লাভলি কুমার যেদিন সুলতা চৌধুরীর অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরল, সেদিন ওকে চড় মারার জন্যে হাত নিশপিশ করলেও বাবা চড়টা মেরে উঠতে পারেননি, কারণ সেই সময়, কাছে সেজকাকু না থাকায় এই লাভলি কুমারই ছিল বাবার কবিতার শ্রোতা। আর প্রতিবার কবিতা শোনার জন্য সে একটা দর্শনী নিত। সেটা হল, হয় একটা ফিশ ফ্রাই কিংবা নিউ এম্পায়ারে একটা সিনেমার টিকিট অথবা দুটোরই টাকা। মনে হয় বিয়ের পর বাবার এই সমস্যাটা ঘুচেছিল, আর টাকা দিয়ে কবিতা শোনাতে হত না। আমার মা গানের বাড়ির মেয়ে ছিলেন। দাদু ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদী গায়ক। যাঁকে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে গানের টিউশনি করতে হত। বিয়ে হয়ে আসার পর বাবা, মা, সেজকাকু –এই তিনজনের একটা চমৎকার বন্ধুতা তৈরি হয়েছিল তার ছাপ পড়েছিল তাদের শিল্পচর্চায়। এরকম অনেক গান আছে, যার কথা বাবার লেখা, সুর সেজকাকুর আর গাইত মা। এরকম একটা গান এখনো মনে আছে-
‘তোমার পূজার ফুল কোথায় আমি পাই গো
বনে বনে ফুলের মেলা ডালিতে ফুল নাই গো
বনে বনে ঘুরি মিছে/ ছুটি শুধু ফুলের পিছে
নিচে থেকে তুমি বলো, ভুলেরও নাই ঠাঁই গো,
ফুল খুঁজে হায় ভুল করেছি, আমি যে গো ক্লান্ত,
এখন মনফুলে পাইগো আমি বনফুলের ঘ্রাণ তো
এবার মনের পাপড়ি ছিঁড়ে /রাখব আমি তোমায় ঘিরে
তুমি এখন ফিরিয়ে দিলে কোথায় আমি যাই গো’
গর্ভের তরলে ভাসতে ভাসতে এই সুর আর কবিতা আমার মধ্যে ঢুকে এসেছিল তাই কবি না হয়ে আমার উপায় ছিল না।
বাবাকে চোখের সামনে লিখতে দেখেছি। মোটা লম্বা পিচবোর্ডের খাতা ছিল তাঁর লেখার। সেটা দেখে আমার মনে হত এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। আসলে আমি খুব বাবার ন্যাওটা ছিলাম তো। সবসময়ে তাঁর গা ঘেঁষে থাকতে চাইতাম। তাই বাবা যে কাজ করছে, সেটা তো আমাকে করতেই হবে। বাবার খাতায় বাবার কবিতার ওপর প্রথম লিখিত কবিতা লাল-নীল পেন্সিল দিয়ে- এক যে ছিল বাঁদর/ তার গায়ে ছিল চাদর- এই জাতীয় কিছু। অবশ্য তার আগে আমি মুখে মুখে ছড়া বানাতাম। প্রথম যেটা মনে আছে, একতলার টুকটুকে লাল মেঝের বারান্দায় গ্রিলের নকশা দিয়ে শীতের রোদ এসে পড়েছে, কোথাও আলো কোথাও ছায়া। আমি তার ওপর লাফাতে লাফাতে মুখে মুখে বানালাম-
আলোছায়ার সঙ্গে মোদের খেলা রে ভাই খেলা
আলোছায়ায় পা ফেলে ভাই কাটিয়ে দিই যে বেলা’
আর একদিনের কথাও খুব মনে পড়ে। বিকেলে মাঠে খেলতে যাচ্ছি, বন্ধুরা আছে, হঠাৎ আমার মাথায় এল সদ্য শেখা পরিচয় শব্দটা। আমার মনে হল শব্দ ভাঙ্গা যায়, মাথায় কেবল খেলতে লাগল চয়, পরি চয়, পরি। সেদিনই কেমন মনে হয়েছিল আমি লেখক হব।
আমার প্রথম গদ্য বাক্য- সিমেন্ট কিনে আমাদের এবার খুব লস হয়েছে।
বাড়িতে মাঝে মাঝে এসব আলোচনা কানে আসত। তখনো বাড়ি ব্যাপারটা প্রোমোটাররাজের হাতে চলে যায়নি। বাড়ি হচ্ছে মানে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির থেকে থেকে সিটিং, চা, আড্ডা। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা গেরস্ত ছোঁয়া ছিল। কর্পোরেট হয়ে যায়নি।মাঝরাতে রাসমাঠে লরি এসে থামত, পাণ্ডুয়ার বালি নিয়ে। কখনো আবার রায়চৌধুরীদের আপত্তিতে রাসমাঠে ঢুকতে দেওয়া হত না লরি, সে নিয়ে কি উত্তেজনা।পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙত চায়ের কেটলি আর রোদের ঠোকাঠুকির আওয়াজে, ভেসে আসত মধ্যরাতের লরি, পাণ্ডুয়ার বালির কথা।রোদ, স্টোনচিপস, সিমেন্ট, বালি। এইসব শব্দ ঢুকে যাচ্ছিল আমার অক্ষরশরীরে। এরাই হয়তো প্ররোচিত করল ওইরকম একটা বাক্য লিখতে। সেই সপাট ঋজু গদ্য বাক্যটি আমাকে এখনও বিস্মিত করে। অথচ তারপর দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে গদ্য লিখি নি।
এরপর একটা মজার ব্যাপার হল। পাশের বাড়ির দিদি পাড়ার ছেলেমেয়েদের জুটিয়ে একবার নাটক করিয়েছিল। একটা রূপকথার গল্প, যেখানে সত্য বলে এক রাখাল বালকের সঙ্গে এক রাজকন্যার প্রেম হয়। প্রতিদিন বিকেলে গিয়ে খুব মন দিয়ে রিহার্সাল দেখতাম, বাগানের দিকের বারান্দায় সে নাটক অভিনীত হতেও দেখলাম।কিন্তু পছন্দ হল না একটুও। আমাকে কোন পার্ট দেওয়া হয়নি, সেটার জন্যে হতে পারে, কিন্তু সেটাই মুখ্য কারণ নয়। আমার মনে হয়েছিল, এর থেকে অনেক ভালো নাটক আমি লিখতে পারি।
ব্যস, লিখতে শুরু করলাম। সে এক রোমহর্ষক ব্যাপার।একটি মেয়ে, সে আবার সমাজবিরোধী গুন্ডা, পুলিশের গুলি খেয়ে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছে, তার এই পরিণতির জন্যে কারা দায়ী। আসল অপরাধী কারা? এরপর পুরো নাটকটাই ফ্ল্যাশব্যাকে। ভাবা যায়? আসলে পড়তে শেখারও আগে তো সিনেমা দেখার শুরু। আর এই ভালো গুন্ডা ও তার কৈফিয়ত সেই সিনেমাবাহিত হয়েই আমার মাথায় ঢুকেছিল নিশ্চয়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, আমি তখনো অভিশপ্ত চম্বল পড়িনি, কিংবা মেয়েমস্তান কেন্দ্রিক কোন সিনেমাও দেখিনি। আজকাল অনেকে বলেন আমি নাকি লেখায় বহুত মাস্তানি করি, সে হয়তো আমার আদিযুগের সেই নাটকটির প্রভাব!
অনেক ভালো জিনিসের মত সেই নাটকটিও হারিয়ে গেছে।
এরপর বহু বছর পর্যন্ত আমি শুধু কবিতাই লিখেছি। দত্তপাড়া থেকে ভারতদর্শন বলে একটি পত্রিকা বেরোত, আর স্কুল ম্যাগাজিন সুন্দরম- এই দুটো জায়গায় কবিতা বেরিয়েছে অল্প সল্প। গদ্য তখন তৈরি হচ্ছিল। সেসময় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা ও ইংরেজি দুটোতেই অনেক প্রবন্ধ, ভাব সম্প্রসারণ, গল্প এসব লিখতে হত। সেসব আমি কখন রচনা বই থেকে লিখিনি। নিজে লিখতাম আর বাবার কিছুই পছন্দ হত না। একটু আলুলায়িত গদ্য দেখলে এমন বিদ্রূপ করতেন যে সেই ট্রেনিং-এ আমার গদ্যে একটা ঋজুতা এসে গেল। আমার গদ্যের শব্দ তাই প্রায় নিক্তি মেপে লেখা। এটা যে আমি সচেতনভাবে করি তা না। ওই যে বললাম বাবার কঠোর ট্রেনিং। আর অবশ্যই প্রচুর প্রচুর বই পড়া আর শোনা।
অক্ষর পরিচয়ের আগে থেকে বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ পেয়েছি বাবার কাছে। চেকভ, মপাসা টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই। শুধু এঁদের সাহিত্য নয়, এদের জীবনও।
বাবার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। সাহিত্য সিনেমা, নাটক সব শিল্পের অন্দরমহলের গল্প এমনভাবে করতেন মনে হত চোখের সামনে দেখছি চরিত্রগুলোকে।আমি জীবনের মাত্র আঠেরো বছর বাবাকে পেয়েছি। উচ্চমাধ্যমিক দেবার দু মাস আগে হঠাৎই মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে বাবা চলে গেলেন। সরস্বতী পুজোর দু দিন আগে।দুমাস পরেই উচ্চমাধ্যমিক আর জয়েন্ট এন্ট্রান্স। আজো মনে আছে স্পষ্ট, মারা যাবার আগের দিন, একটা শীতের দুপুর, বিশে জানুয়ারি, ১৯৮৮ সাল, বাবা আমাকে পড়ে শোনাচ্ছেন কালকূটের পৃথা। মা এসে বকছেন ‘এত ছোট মেয়েকে তুমি এসব কী পড়ে শোনাচ্ছ?’ বাবা বলছেন ‘ওকে আমি তৈরি করে দিয়ে গেলাম’ খুব সত্যি কথা। বাবা আমাকে প্রকৃতই তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আমি নিজে পড়লে এত বই আমার পক্ষে একজীবনে পড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না।
বাবার মৃত্যু আমার জীবন র‍্যাডক্লিফের ছুরির মতো দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে গেল। আমার কবিতার স্বর বদলে গেল। সেই প্রথম মোড় ঘোরানো কবিতা পিতৃতর্পণ, যা বাবা মারা যাবার পরদিন বসে লিখি। দীর্ঘ কবিতা। মা সেটা লিখিয়ে দেওয়ালে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন।
বাবা চলে যাবার পর আমি কবিতাকেই বেশি করে আঁকড়ে ধরলাম। এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক ও জয়েন্ট এন্ট্রান্স। ডাক্তারি আর এঞ্জিনিয়ারিং –দুটোতেই পেয়েছিলাম। মা চাননি আমি হস্টেলে থাকি, তাই ডাক্তারি পড়া হল না।যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকলাম। আমি কোনদিন কোন সঙ্ঘে থাকিনি, লেখা নিয়ে কফি হাউসে বসায় বিশ্বাসী ছিলাম না। বরাবর একা একাই থেকেছি। এর মধ্যে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আমার পাশের বাড়ির এক দাদা, ভবানীদা, আমার ডায়েরি থেকে কবিতা টুকে দেশে দিয়ে এসেছিল, একদিন এঞ্জিনিয়ারিং -এর ফাইনাল ইয়ারে টাইমস অব ইন্ডিয়াতে ইন্টারভিউ দিতে গেছি, এক বন্ধু বলল ‘তোর কবিতা দেশে বেরোচ্ছে এবার’ তখন চা দিয়েছিল। চমকে তো আমার চা টা পড়ে এক কাণ্ড। ১৯৯২ সালের ২০শে জুন আমার প্রথম কবিতা দেশে বেরোল। ‘সামগন্ধ রক্তের ভিতরে।’ আর পয়লা জুলাই আমি ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হিসেবে সরস্বতী প্রেসে যোগ দিলাম। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে পাওয়া আমার প্রথম চাকরি। কবিতা প্রকাশ নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। ভবানীদা দেশ সম্পাদকমণ্ডলীকে সম্ভবত ইম্প্রেস করতে চেয়েছিল একটা বাচ্চা মেয়ে কত ভালো কবিতা লেখে দেখিয়ে। তাই আমার নামের পরের লাইনে লিখে দিয়েছিল ২২+। সে নিয়ে নাকি দেশ দপ্তরে তুমুল হাসাহাসি হয়। সে কথা শীর্ষেন্দুদার মুখে পরে শুনেছি।কয়েকবার ডাকে পাঠানো কবিতা বেরোবার পর দেশ দপ্তর থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়। শীর্ষেন্দুদা সবাইকে ডেকে বলেছিলেন ‘এই সেই তৃষ্ণা ভট্টাচার্য, ২২ +’ তখন আমি ভট্টাচার্য পদবীতে পরিচিত ছিলাম। ১৯৯৭ পর্যন্ত সেইটা ছিল। সেসময় আনন্দবাজার অফিস এমন লোহার বাসরঘরের মতো ছিল না। ভেতরে গিয়ে আমার তো তারকাহতের অবস্থা। সুনীল শীর্ষেন্দু, জয় গোস্বামী। পাশাপাশি সানন্দা আনন্দমেলা প্রবাসী আনন্দবাজার। সেসব জায়গাতেও প্রচুর লিখেছি। এইসময় গল্পও লিখছি চুপি চুপি। একদিন সাহস করে রবিবাসরীয় আনন্দবাজার বিভাগে দিয়ে এলাম রমাপদ চৌধুরীর টেবিলে। সেটা বেরিয়েও গেল কয়েক মাসের মধ্যে। ১৯৯৫ সালে। ‘আবার অমল’। যদিও এর আগে আমি গল্প লিখেছি, সেগুলো কোথাও পাঠাইনি।

সাহিত্যকে পুরোটা সময় দেবার জন্য চাকরী ছেড়েছো, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে লেখালেখি এখনো প্রফেশন হয়ে উঠেনি কি কারণ তার জন্য দায়ী মনে কর? এত ভাল চাকরী যে ছাড়লে তার জন্য কোন আক্ষেপ আছে?

তৃষ্ণা বসাক: সাহিত্য পেশা হয়ে ওঠেনি, মানে আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য। যতদূর জানি মলয়ালম ভাষায় লিখে খুব স্বচ্ছল না হলেও ডাল্ভাত জুটে যায়। কিন্তু বাংলায় তা হচ্ছে না এই মুহূর্তে। একটা সময় পূর্ণ সময়ের লেখক ছিলেন অনেকেই। বিভূতিভূষণ কদিন আর শিক্ষকতা করেছেন? তারাশংকর তো লিখে গাড়িবাড়ি করেছিলেন। পরে সমরেশ বসুও। কিন্তু সেই ব্যাপারটা এখন ভাবাই যায় না। তার কারণ সার্বিক ভাবে বাঙ্গালির নৈতিক অবক্ষয় এবং সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনা ঘটেছে। সে নিজের ভাষা সংস্কৃতি এবং নিজের খাদ্যের প্রতি আর সেই ভালবাসাটা রাখতে পারেনি। যার ফলে বাংলায় কিছু পড়া মানে তার স্ট্যাটাস নেমে যাওয়া। বাংলা এখন কাজের ভাষা নয়, কাজের লোকের ভাষা। তবে মফস্বলে কিছুটা অন্য চিত্র। কিন্তু সেখানে বই পৌঁছয় না। আমাদের বিপনন ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা চিন্তা ভীষণ জ্রুরি। জ্রুরি লেখক আর প্রকাশকের সুস্থ ও স্বচ্ছ সম্প্র্ক, যাতে লেখক তার প্রাপ্য রয়্যালটি পান। রয়্যালটি কিন্তু পাঠক দেন লেখককে, প্রকাশক নয়, এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। আর প্ত্র প্ত্রিকা যারা লেখকের কাছে লেখা আমন্ত্রণ করছেন, তাঁদের সেই লেখার বিনিময় মূল্য দেবার অভ্যাস করতে হবে। বিদেশে থাকা বাংলাভাষীদের কাছেও বই পৌছনর ব্যবস্থা করতে হবে। এইভাবে ধীরে ধীরে বাংলাভাষায় লেখাও একটা অর্থকরী পেশা হতে পারবে।

প্রথম গল্প লেখার গল্পটা কেমন?

তৃষ্ণা বসাক: আমি আমার প্রথম প্রকাশিত গল্পের নেপথ্য কাহিনি বলি একটু। রবিবাসরীয় আনন্দ বাজারে বেরিয়েছিল গল্পটা। আবার অমল গল্পটা একটা অদ্ভুত ধাক্কা থেকে লেখা। সেসময় আমি বরানগরে সরস্বতী প্রেসে চাকরি করতে যেতাম।বারুইপুর লোকাল ধরে শেয়ালদা, তারপর নর্থে ডানকুনি লোকাল ধরে বরানগর, অথবা মেন লাইনের ট্রেন ধরে বেলঘরিয়া নেমে অটোতে।বারুইপুর লোকালে লেডিজে যেতাম। খুব মজা হত। আড্ডা, গান, তার মধ্যে আমার হাতে একটা বই ঠিক থাকত। সোনারপুর থেকে একটা মেয়ে উঠত, ছোটখাটো, খুব সাধারণ চেহারা, প্রাইভেট ফার্মে সামান্য চাকরি করত। তাকে দেখে আমি ভাবতাম অবিবাহিত, সদ্য কলেজ শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে। একদিন সে পার্স থেকে একটা বছর ছয়েকের খুব সুন্দর দেখতে বাচ্চার ছবি বার করে দেখাল, বলল তার ছেলে। আমি তো হতবাক। পরে সে জানাল সে খুব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের একটি রাজপুত্রের মতো ছেলে তাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল বাড়ির অমতে। বছর দুয়েক সুখের সাগরে তাকে ভাসিয়ে একদিন হঠাৎ সে পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। খুব জোরে বাইক চালাচ্ছিল বাইপাসে, হেলমেট ছাড়া। গতি ছিল তার প্যাশন। শ্বশুরবাড়ি থেকে কোন সাহায্য পায়নি, বাপেরবাড়ির কাছেও তারা স্বাগত নয়। পড়াশোনাও সামান্য জানে। নিজের চেষ্টায় সে এই চাকরিটুকু জোগাড় করেছে, ছেলেকে স্কুলে ভরতি করেছে। তার ওপর রয়েছে একা মেয়েকে সহজলভ্য ভাবার উৎপাত। মেয়েটির আইশ্যাডো তার চোখের কালিকে ঢাকতে পারেনি। আমি কেমন একটা নাড়া খেয়ে গেছিলাম। জীবনের পরতে পরতে যে এমন কত বিস্ময়, ধাক্কা লুকিয়ে থাকে সেই প্রথম যেন উপলব্ধি করেছিলাম। সেই গল্পটি আমার কথাকার জীবনের বীজ বপন করেছিল। মানে কথাসাহিত্য যে মানুষের কথা, তার আনন্দ বেদনা পরাজয় পরাভব, উত্তরণের কথা বলে-এই কথাটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। এরপর আমার পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত করল দুটি গল্প। ‘পতাকার দুটো রঙ’ আর ‘সংখ্যালঘু’। দুটোই বোধহয় ‘দিবারাত্রির কাব্যে’ বেরিয়েছিল। আর প্রথম কবিতার বই – ‘বেড়াল না নীলঘন্টা?’
অ্যাম্বিশাস লেখা যদি বলেন সব লেখাই তাই। কারণ আমি যেকোন লেখা লেখার সময়ই আসলে চোখ বেঁধে গ্লোবের মধ্যে মোটর সাইকেল চালানোর মতো এক রুদ্ধশ্বাস যাত্রায় বেরোই।মরণখেল যাকে বলে। জানি না বাঁচব কিনা। এখানে মৃত্যু মানে লেখাটির মৃত্যু, যা বলতে চাই আর যেভাবে বলতে চাই, সেই উচ্চতায় পৌঁছতে না পারলেই মৃত্যু। দেখবেন অনেক অ্যাথলেট, যাদের কোচ জোটে না, একা একা প্র্যাক্টিস করে। তারা প্রতিদিন নিজেই তাদের লক্ষ্যমাত্রা একটু একটু করে বাড়িয়ে দেয়, নতুন আকাশ ছুঁতে চেষ্টা করে। আমিও তাই। তাই আমার সব লেখাই অ্যাম্বিশাস। তবে এ তো শকুনির পাশা, পাশারা কী দান দেবে আমার জানা থাকে না। আসলে সবাই তো খেলবে বলেই নামে, কিন্তু সব মার কি আর ব্যাটে বলে হয়? সবই কি বাউন্ডারি কি বাহার হয়? একেকদিন ডাক হয়, শূন্য রানে আউট হয়ে ক্রিজে ফিরতে হয়। এসবই খেলার অঙ্গ।

এমন কি কখনো হয়েছে, তুমি লিখতে শুরু করেছ… কিন্তু খুঁজে পাচ্ছো না কী লিখবে, পরবর্তী ঘটনা কী হতে পারে, তুমি বসেই আছো… কিন্তু কিছু লিখতে পারছো না?

তৃষ্ণা বসাক: এরকম যে হয় না তা নয়। সেক্ষেত্রে আমি ছোটবেলায় অংক না মিললে যা করতাম, একদিন ফেলে রাখতাম, পরের দিন নতুন করে শুরু করতাম, সেটাই করি। তাতে একটা রাস্তা বেরিয়ে আসে সবসময়ই।

ঘুমের মধ্যে গল্পের প্লট নিয়ে কাজ কর?

তৃষ্ণা বসাক: আমার এক একটা স্বপ্ন এক একটা উপন্যাস। তবে বেশিরভাগটাই আমি ধরে রাখতে পারিনা। সামান্য কিছু পারি। এবং স্বপ্নে আমি খুব ডিটেল্ড এবং ইন্টেন্স টেক্সট পাই, এমনকি হাইপার টেক্সটও। খানিকটা সুররিয়েল ঘেঁষা।

তোমার গল্প সমাজ,দর্শন,রাজনৈতিক শূন্যতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং পুরুষশাসনের জাঁতাকলের বিরুদ্ধে কথা বলে,ঘটনাগুলোকে নিজের করে নেবার পেছনের গল্পটা কি রকম?

তৃষ্ণা বসাক: আসলে নিজের জীবন তো আমি নিজেই বাঁচি,তার থেকেও বড় কথা, চারপাশে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ, মানুষের কথা বার্তা, কথা বলার সময় শারীরিক অভিব্যক্তি, বিশেষ শব্দ ব্যবহারের ঝঁক, এমনকি রাস্তাঘাটে লোক্মুখে তৈরি হওয়া মহাকাব্যের শাখা গল্প- এসব আমি শুষে নিই। ভাল লেখককে আসলে ব্লটিং পেপার হতে হয়। খুব ছোট থেকেই আমি প্যাসিভ লিসনার। মায়ের কাছে অনেক রকমের লোক আসত। মা খুব মানুষকে সাহায্য করতেন, প্রায়ই নিজের ভাত ক্ষুধার্তকে দিয়ে নিজে দুধ মুড়ি বা পাঁউরুটি খেয়ে নিতেন দেখেছি। সেইসব মানুষরা অনেকেই সমাজের চোখে খুব সম্মানীয় ছিলেন না। কেউ চুল কাটতেন, কেউ লোকের বাড়ি কাজ করতেন, কেউ একদম জন্ম ভবঘুরে। তাঁরা মায়ের কাছে দুঃখের কথা বলে হালকা হতেন। আমি শুনতাম কাছে বসে। বাবার কাছে আবার উঁচু থাকের লকেরা আসত। তাদের থেকে ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাপারটা পেতাম।আর ট্রেন, আমার জীবনের খুব বড় রিসোর্স। আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ গল্প আমি ট্রেনে পেয়েছি, বা অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টে।

তুমি কি বিজ্ঞানের ছাত্রী?

তৃষ্ণা বসাক: আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়ি একাদশ দ্বাদশ শ্রেণিতে। তারপর জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে, ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোতেই স্থান পাই। সেইসময়, পরীক্ষার দুমাস আগে বাবা মারা গেছিলেন, তাই মা ডাক্তারি পড়তে দিতে রাজি হলেন না, অনেকটাই হস্টেলে থাকতে হবে এই বলে। যাদবপুর বিশববিদ্যালইয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। তারপর ওখান থেকেই এম টেক, ন্যানো সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে।

আত্মারামের নতুন খাঁচা বইটি পড়লে তোমাকে অন্যভাবে চেনা যায় ২১৭৫ সালকে তুমি তুলে এনেছ কল্পবিজ্ঞানের গল্পে কিন্তু ঠিক কল্পবিজ্ঞান যেমন হয় সেই রকম না এখানে রাজনীতিও আছে গল্পগুলো পড়তে পড়তে বোঝা যায় এটা একটা প্রজেক্ট ওয়ার্ক যা অনেক সময় নিয়ে গবেষণা করে লেখা তোমার মূল্যায়ন কি এই বইটির গল্পগুলো নিয়ে?

তৃষ্ণা বসাক: এটা কল্পবিজ্ঞান তো বটেই , তার থেকেও বেশি এগুলো ফিউচার প্রজেকশন। পৃথিবীর ভবিষ্যত জানার নেশা চাপে অ্যাল্ভিন টফলারের ফিউচার শক পড়ে। আসলে এগুলো মূল্ধারার সাহিত্যই, যেখানে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে সমাজের চেহারাটা কেমন দাঁড়াবে, নৈতিক মূল্যবোধ কতটা পালটাবে, সমাজে আদৌ সাম্য আসবে কিনা, যন্ত্রের সঙ্গেই বা মানুষের সম্পর্ক কেমন হবে, এগুলোই বলেছি। মুখবন্ধে আমি লিখেইছি, কল্পবিজ্ঞান মানেই নক্ষত্রযুদ্ধ নয়। মজার মোড়কে কিছু অতি গুরুতবপূর্ণ ইস্যু যেগুলো ভবিষ্যতের রাষ্টনায়কদের মাথাব্যথার কারণ হবে, যেগুলো আমাদের চেনা সম্পর্কের সংজ্ঞা পালটে দেবে, সেগুলোই এসেছে এখানে। উদাহরণ হিসেবে বর্জ্য গ্রহ, যেখানে একটি বাতিল গ্রহে ময়লা ফেলাকে কেন্দ্র করে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধার উপক্রম হয়। নতুন মানুষ গল্পে দেখা যাচ্ছে রোবটরা ঘুষ নেয়, আবার একটি গল্পে দেখা যায় একটি রোবট কুকুর, একটি ছোট ছেলের থেকে অনেক বেশি মানবিক গুণ সম্পন্ন।

অতীতে যাওয়ার যন্ত্র বানানো বিজ্ঞানী নীলমণি কি আদতে লেখক? নাকি বিজ্ঞান উদাসীন ঘনশ্যাম চরিত্রটি লেখক?

তৃষ্ণা বসাক: দুজনেই লেখক। আমি যেমন বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছি, এবং চর্চা চালিয়ে যাই, লেখায় যতদূর সম্ভব সঠিক তথ্য দেব বলে। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত জীবনে গেরস্থালির গ্যাজেট ব্যবহার করার বিষয়ে আমি বেশ অনিচ্ছুক। মিক্সি বা ওয়াশিং মেশিন অন্য কেউ চালিয়ে দিলে ভাল হয়।

বাড়িঘর উপন্যাসটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ঘরের ভেতরের আদলে তুমি আমাদের সমাজ ও দেশকে দেখিয়েছো, দেখাতে চেয়েছ হিংসা ও সন্ত্রাসের গতিবিধি ও পরিবার সমাজ ও দেশের অবক্ষয় ও ভাঙনকে?

তৃষ্ণা বসাক: ঠিকই। আমি বলতে চেয়েছি, পৃথিবী জুড়ে যে সন্ত্রাস ও হিংসা- তারই একটা ছোট নমুনা আমাদের ঘরের দেওয়ালে ঘটে। পরিসর ছোট হয়তো, কিন্তু হিংসার তীব্রতা একরকম, হয়তো বা বেশি। কারণ এই হিংসা বেশিরভাগ সময়েই নথিবদ্ধ নয়। আর হিংসার শুরু তো আদারনেস সিন্ড্রোম থেকে। অন্য বাড়ি থেকে বিয়ে হয়ে আসা নারী শ্বশুরবাড়িতে বাইরের লোক, অন্য রক্তের লোক। সে অন্য, আদার। তাই তার সঙ্গে যা খুশি করা যায়। সারা বিশ্ব জুড়ে জাতিগত ধর্মগত লিংগগত-যত সন্ত্রাস, দাঙ্গা তার মূল কারণ এই আদারনেস বলে আমার মনে হয়।

তোমার পূর্বপুরুষ কি দেশভাগের শিকার হয়েছিলেন?

তৃষ্ণা বসাক: না। একেবারেই না। আমরা কাঠঘটি। চরের মানুষ লিখতে শুরু করার আগে তোমার ভাবনা ও হোম ওয়ার্কটা শুনতে চাই। একটু আগেই তো বলেছি একটা ধাক্কা থেকে আমার মাথায় ঘুরতে থাকে যে সমস্ত হিন্দু ওপারে রয়ে গেলেন, তাঁরা কেমন আছেন। আমি কোন গল্প উপন্যাসে, তাঁদের কথা সেভাবে পাইনি। মুক্তিযুদ্ধের পর নবনির্মিত একটি দেশে তাঁরা কি সবার সঙ্গে মিশে গেলেন, না স্মৃতির বেদনা তাঁদের তাড়া করে বেড়াল? এর বহু আগে থেকেই আসলে আমার অন্বেষণ মাইক্রো স্কেলে হিন্দুদের নিয়ে, এবং ম্যাক্রো স্কেলে সারা পৃথিবীর সব দেশের সংখ্যালঘুর সঙ্কট থেকে। কোমলগান্ধার’ সিনেমায় একটা থেমে যাওয়া রেললাইন ছিল, যার আর কোন জায়গা ছিল না যাবার। বুক ধক করে উঠেছিল এই দৃশ্যে, আর দেশভাগের বেদনা আমাকে পেড়ে ফেলেছিল। অথচ তার কোন পূর্ব-প্রস্তুতি ছিল না। আমার পরিবারের মূল একেবারেই এপার বাংলার, দেশভাগের বেদনা কোনভাবেই স্পর্শ করেনি যাঁদের। বেদনা নয়, বরং বিরক্তি দেখেছি ওপার বাংলার লোকেদের নিয়ে। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের চাপে যে পশ্চিমবঙ্গের নাভিশ্বাস উঠেছে, এ দেশের ভালো ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না বাঙ্গালদের জ্বালায়, এমন কথা বা কথার আভাস পেয়েছি বরং। এই আবহে যারা সব হারিয়েছে, তাদের বেদনা বুঝতে শিখিয়েছে সাহিত্য এবং সিনেমা। ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমলগান্ধার’ যেমন, তেমনি প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’, কিংবা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, আরও পরে সাদাত হোসেন মান্টো, কৃশ্ন চন্দর, কিংবা আবদুস সামাদ বা হরি মোটোয়ানি, ক্রমে বিশ্ব সাহিত্যের মাইগ্রেশন বিষয়ক লেখা – এইসবই আমার আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠল। দেশভাগ আর স্থানান্তর। চোখের সামনে ভেসে উঠল কত মানুষ, যাদের আদপে কোন দেশই নেই। আর এঁদের মধ্যে মেয়েদের কথা তো অনুচ্চারিতই থেকে গেছে। যুদ্ধ, দেশভাগ কিংবা দাঙ্গা সবচেয়ে ক্ষতি করে যাঁদের। তাঁরা কি আদৌ পেলেন নিজেদের কোন দেশ? কিংবা অখণ্ড বাংলার স্বপ্নের মতো আছে কি কোন চিরকালের বাংলার নারী প্রতিমা, যাঁদের মুক্তির মধ্যেই হয়তো আছে হিন্দু আর মুসলমান –এই দুই সম্প্রদায়ের মিলনের চাবিকাঠি? এইসব প্রশ্ন এতটাই তাড়িত করতে থাকে যে কয়েক বছর ধরে লিখে চলি এই উপন্যাস – চরের মানুষ। হয়তো আরও দেখা বাকি রয়ে গেল, হয়তো এ লেখা আরও বড় হতে পারত- এমন আক্ষেপ থাকবে পাঠকের। তবু , সামান্য হলেও শুরু তো হল যাত্রা, দেশহীন, আশ্রয়হীন মানুষের, এক কাঁটাতারবিহীন পৃথিবীর স্বপ্নের দিকে । এই লেখার জন্যে আমি ইতিহাস যেমন পড়েছি, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা প্রচুর। কিন্তু পড়ার থেকেও আমি রসদ বেশি পেয়েছি যাঁরা দেশভাগের শিকার, মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার বাহিনির নির্যাতনের শিকার, তাদের মুখের কথা থেকে। অর্থাৎ ওরাল হিস্ট্রির ওপর। আমার মনে হয় ইতিহাস বইয়ের শুখনো সাল তারিখের থেকেও ওরাল হিস্ট্রি অনেক বেশি সাহায্য করে কথাবস্তুকে গড়ে তুলতে।

টুনুর বাবা কিংবা টুনুকে চরের মানুষ বইতে যেভাবে উপস্থাপন করেছো ৪৭ পরবর্তী ‍পূর্ব বাংলা এবং বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ের বাস্তবতা অনেকটা এইরকমই কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি তোমার ভাবনা কি?

তৃষ্ণা বসাক: চরের মানুষ অত্যন্ত বাস্তব পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে। সংখ্যালঘুকে তাড়ানো হয় ধর্মের থেকেও বেশি রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কারণে। রাষ্ট্রনায়করা চাল দেন, সাধারণ মানুষ সেখানে দাবার ঘুঁটি। দেশভাগের পঁচাতর বছর পরেও এই উপমহাদেশ তার ক্ষত থেকে মুক্ত নয়। ধর্ম ভিত্তিক বিভাজনের পাপ আরো অনেক পাপের জন্ম দিল। মৌলবাদ সারা পৃথিবীতেই মাথা চাড়া দিচ্ছে। তার মধ্যেই চরের মানুষ একটা স্বপ্নের ইশারা দিয়েছে। অখণ্ড বাংলার সবপ্ন, ভালবাসার স্বপ্ন। এইটুকুই বলব। বাকিটা পাঠক খুজে নিন।

অতীত বন্দ্যোপাধ্যায় নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে যেখানে শেষ করেছিলেন চরের মানুষ কি তবে তার পরের অংশ?

তৃষ্ণা বসাক: এতটা সরল করে ঠিক বলা যাবে না। আমার উপন্যাসে আরো মাইক্রো স্তরে সমস্যাকে দেখান হয়েছে।মেয়েদের যে কোন দেশ নেই, সেই অনিকেত অবস্থাকে দেখান হয়েছে- এটা অন্যতম দিক।

আত্মারামের নতুন খাঁচা, চরের মানুষ, পচিঁশটি গল্প সহ আরো অনেক লেখার কথাই বলতে পারি যেগুলো পড়লে মনে হয় তুমি রাজনীতি সচেতন মানুষ এবং বিশ্বরাজনীতি তোমাকে এবং তোমার লেখাকে স্পর্শ করে?

তৃষ্ণা বসাক: একটা কথা আছে সব লেখাই পলিটিকাল। আগে আমি ভাবতাম, আমি যেহেতু কখনো প্রত্যক্ষ রাজনীতি করিনি, তাই আমার লেখায় রাজনীতি আসতে পারে না। কিন্তু দলীয় রাজনীতি নয়, আমি বলতে চাইছি সেই রাজনৈতিক চেতনার কথা, যা যেকোন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আত্মারামের নতুন খাঁচা বইতে আমি কল্পবিজ্ঞান কে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছি। এমন কিছ রাজনৈতিক শোষণ, অসঙ্গতি, বৈষম্য আছে যা সরাসরি প্রতিবাদ করলে বিপদ ডেকে আনা হবে, তাই সে কাজ আমি করি কল্পবিজ্ঞানের ঢালের আড়ালে বসে। আমার উকুন সিরিজও আপাদমস্তক রাজনৈতিক। উকুন এখানে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রতীক।
আর সম্প্রতি শেষ হল আমার রাজনৈতিক থ্রিলার অজিত সিং বনাম অজিত সিং।

তোমার লেখা গল্পে নারীবাদ চোখে পড়ে।মনে হয় লেখায় নারীবাদ খুব পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রবণতা তোমার ভেতরে এবং লেখায় কী করে সঞ্চারিত হলো?

তৃষ্ণা বসাক: খুব শৈশব থেকে প্রান্তিক মানুষদের দেখেছি। তাদের দুঃখ বেদনা, তাদের ওপর করা অন্যায় এসব দেখেছি, তাই তাঁরা আসেন আমার লেখায়। মেয়েরা তো তাঁদের বাইরে নয়। পরিকল্পনামাফিক নয়, এসব লেখার মধ্যে স্বতস্ফূর্তভাবেই আসে। তবে জ্যাবতীর জয়যাত্রা বলে একটি কিশোর উপন্যাস যা এখন লিখছি তাতে পরিকল্পনামাফিক এই জেন্ডার সেন্সিটাইজিংর কাজ করছি। কারণ আমার মনে হয়, ছোটদের মনে এই চেতনা প্রথম থেকেই রোপিত করাই ভাল।

কবিতা দিয়ে হাতেখড়ি তারপর গদ্যে জড়িয়ে পড়ার কারণ?

তৃষ্ণা বসাক: আমি কবিতা দিয়ে শুরু করেছি, এটা ঠিক। তবে আমি নাটক দিয়েও শুরু করেছি এটাও সত্য। তবে আমার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ কবিতার বই। তারপর কবিতা জগত থেকে নির্বাসিত করা হলেও আমি কবিতা লেখা থামাইনি, তবে একইসঙ্গে গল্পকার হিসেবে পরিচিত হয়েছি। হয়তো কথাকার- এই পরিচয়টাই হয়ে উঠেছে মুখ্য। আসলে এই যে টাইট কম্পার্টমেন্ট, খোপ খোপ চিন্তা কবি, গল্পকার প্রাবন্ধিক- এগুলোতে আমার বিশ্বাস নেই। আমি সামগ্রিকতায় বিশ্বাস করি। একজন সাহিত্যিক, সে সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করতেই পারে। যেমন একজন মানুষ কখনো অফিসে বড় অফিসার, বাড়িতে বাবা/মা, স্বামী/স্ত্রী, ছেলে/মেয়ে, পাড়ায় অমুকদা/ অমুকদি, – একটা থেকে আরেকটা ভূমিকায় নির্বাধ যাতায়াত কিন্তু। আমারো সেইরকম। কিছু কথা কবিতায় বলতে ইচ্ছে করে, কিছুর জন্য গল্প আর কিছু মনে হয় উপন্যাস ছাড়া হবে না। আমরা কি শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাই? প্রথম পাতে তেতো, তারপর দু একটা সবজি, ডাল ভাজা, মাছ মাংসের কত পদ, শেষ পাতে চাটনি, দই মিস্টি। একটা মানুষই তো খাচ্ছে। যার খিদে বেশি, বৈচিত্রের দিকে ঝোঁক, সে তো সবই চাখতে চাইবে। আর আমি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে তো বহুগামী বটেই।
রহস্য কিছুই নেই। আমি শুধু বিচিত্র ধরনের লেখা লিখি না, একসঙ্গে অনেকগুলো গল্প, অনেকগুলো উপন্যাস চলে। কুমোরটুলির প্রতিমা গড়ার মতো। কোনটা হাত, কোনটা পা গড়ে আধমেটে করে রেখে দি, যে যেটা তাড়া দেয়, তারটা শেষ করি। এই মুহূর্তেই তো আমার পলিটিকাল থ্রিলার অজিত সিং বনাম অজিত সিং আর কিশোর উপন্যাস জয়াবতীর জয়যাত্রা চলছে।এক একটা লেখায় যখন প্রবেশ করি, সেই পোশাকটা গলিয়ে নি।

কবিতা কি আদতে তোমার সব কথা বলতে পারছিল না?

তৃষ্ণা বসাক: ঠিক সেটা নয়। আসলে কীবলতে চাই র থেকেও কীভাবে বলতে চাই সেটা আমার কাছে জরুরি। গদ্যের ফর্ম টা আমার সেই ঝঁকের জন্য উপযুক্ত কখনো কখনো। আবার কিছু কিছু আমি কবিতার আঙ্গিকেই বলতে চাই। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি যে কোথাও ফেরে না আমার একটি গল্প। আবার পরে আস্ত একটা কবিতার বই এই নামে আছে। দুটোর মূল সুর এক হলেও ফর্ম ট্রিট্মেন্ট সব আলাদা।

কবিতা তোমার কাছে কি?

তৃষ্ণা বসাক: জটিল তানকারির মধ্যে শ্বাস নেওয়া।

দেশের সার্বিক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কবিতা কতখানি ভূমিকা রাখতে পারছে? নতুন প্রজন্মের কাছে কবিতার প্রাসঙ্গিকতাই বা কতটুকু?

তৃষ্ণা বসাক: এইটুকু বলতে পারি কবিতা নিরন্ন মানুষের পেটে ভাত দিতে পারে না, খুব বড় রাষ্ট্র বিপ্লবও হয়তো ঘটাতে পারে না, তবে জীবন যখন শুকিয়ে যায়, তখন ক্রুণাধারা হয়ে ঝরতে পারে। ফিরিয়ে দেয় সাহস আর বিশ্বাস, তারপর আবার আমরা নতুন শক্তি সঞ্চয় করে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারই।
কবিতার প্রাসঙ্গিকতা আবার কী? নিঃশ্বাস নেবার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কেউ কি জিজ্ঞেস করে? এই প্রজন্মের অনেককেই জানি যারা কবিতায় ডুবে থাকে, লেখে পড়ে, অনুবাদ করে।

উত্তর আধুনিকতা ও পোস্টমডার্নিটি, পোস্ট কলোনিয়াল এবং সাবঅল্টার্ন লিটারেচার ইত্যাদি সম্পর্কে তোমার ভাবনা বা মতামত কি?

তৃষ্ণা বসাক: এসব উত্তর দিতে পারবেন সাহিত্যের অধ্যাপকরা। এসব তথ্য ও তত্ত্ব তো গুগল ঘেঁটেই পাওয়া যায়। আমি এইটুকুই বলব যেকোন বড় লেখকই পোস্ট মডার্ন। কারণ তিনি কোন না কোন বিন্দুতে আধুনিক সময়টাকে পেরিয়ে যাচ্ছেন। মৌলিকতাই উত্তর-আধুনিকতা। আমার লেখায় উত্তর আধুনিকতার যে চিহ্নগুলো ফোটে- তা হচ্ছে শূন্যতা, অনিশ্চয়তা, একধরনের নাথিংনেস, অ্যানালগ সিগ্নালের বদলে কাটা কাটা ডিজিটাল সঙ্কেত, কিন্তু কয়েক দশক পরেই এগুলো হয়তো উত্তর আধুনিকতার চিহ্ন থাকবে না। নতুন যুগ নতুন ভাষা আর ভঙ্গি খুঁজে নেবে।পোস্ট কলোনিয়াল নিয়ে ভাবার আছে। এখন ব্রিটিশ উপনিবেশ নেই বটে, কিন্তু আমরা কি নতুন উপনিবেশ-বহুজাতিক উপনিবেশের দাসত্ব করছি না? সেটা তো চলছে, সাহিত্য সেটাকেই ধরবে। আর সাব অলটার্ন নিয়ে বলার আগে লেখার আগে ভাবতে হবে আমি কতটা অধিকারী? ক্ষেত্র সমীক্ষা করে যা লেখা যায়, তাতে প্রাণ ফোটে কি? তাই ভঙ্গি দিয়ে ভোলানর চেষ্টা না করাই ভাল।


আরো পড়ুন: ইরাবতীর মুখোমুখি কবি, কথাসাহিত্যিক পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়


একজন নবীন কবি ও কথাসাহিত্যিক নিজেকে তৈরি করতে কি ধরনের পড়ালেখা করতে পারে?

তৃষ্ণা বসাক: যা ইচ্ছে। এটা তার আগ্রহের ওপর নির্ভর করবে।যেকোন পেশায় যেতে গেলে একটা বেসিক এডুকেশন দরকার। এর পর সে স্পেস সায়েন্স নিয়েও পড়তে পারে, কিংবা মধ্যযুগের মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে। সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, তার ভেতর থেকে কোন বিষয়টা টানছে। সেইটা নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলে কী কী পড়া দরকার। শার্লক হোমস ওয়াটসনকে একবার বলেছিলেন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে না পৃথিবী সূর্যের চারদিকে-তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি আগ্রহী লন্ডনের কোন অঞ্চলে মাটির রং কেমন, বিভিন্ন বিষের কার্যক্ষমতা এইসব বিষয়ে। লেখককেও সেইটুকুই জানতে হবে। বহুভাষী, বা মস্ত পণ্ডিত হয়ে খুব লাভ নেই। কথামৃতে আছে, সাধুর কমণ্ডলু কত তীর্থ ভ্রমণ করে, কিন্তু যে তেতো সেই তেতোই থাকে।

দল বা গোষ্ঠীতে তোমাকে সেভাবে পাওয়া যায়না। প্রচলিত একটা কথা আজ প্রায় প্রবাদের মতো হয়ে গেছে দল বা গোষ্ঠীতে না থাকলে সাহিত্য হবে না। দল বা গোষ্ঠীবাজি নিয়ে তোমার ভাবনা কি? সাহিত্য করতে কি আসলেই দল বা গোষ্ঠী প্রয়োজন? তুমি কি মনে কর তুমি কোথাও গোষ্ঠীবাজির শিকার হয়েছ বা কোন গোষ্ঠীতে থাকলে আরো বেশি লিখতে পারতে?

তৃষ্ণা বসাক: সাহিত্য অকাদেমির জার্নালের কভারে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের একটা দামি কথা লেখা থাকতে দেখেছি। সাহিত্য হচ্ছে নির্জন মনের সৃজন। যে মানুষ নিজের মনে একা হতে পারে না, সে সৃষ্টি করতে পারে না। তাই একলা মানুষ হিসেবে পথ চলছি বলেই লিখতে পারছি। দল করে ক্রিকেট ফুটবল খেলা যায়, দলীয় রাজনীতি করা যায়, কিন্তু সৃষ্টি করা যায় না। আমি তো কোনদিন কফি হাউসে বসিনি, কোন সাহিত্য গোষ্ঠীতে নেই।বাংলাসাহিত্যে আমার কন ধর্ম-মা বা ধর্ম-বাপ নেই। কাজই আমার বাপ, মা, আমার মাথার ছাতা। সেই কাজ করে গেছি বরাবর। নিজের লেখার পাশাপাশি সম্পাদনা। সে নিজের কোন প্রণোদনায় বা বাইরের আমন্ত্রণে হোক। এইভাবে অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমি ভীষণভাবে পেশাদারিত্বে বিশ্বাসী, এবং পেশাদার বন্ধুত্ব কিন্তু খুব চমৎকার হয়, যদি তা মেন্টেন করা যায় ঠিক মতো। তাছাড়া আমি বরাবর দেখেছি, ওয়ান ইজ টু ওয়ান –এইরকম কমিউনিকেশন আমার জন্য শুভপ্রদ হয়েছে।একটা গোষ্ঠীতে অনেকসময়ই চোরাস্রোত কাজ করে, সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। বোঝার আগেই দেখি আমার এই একা একা, নিজের মনে কাজ করে যাবার ব্যাপারটা অনেকের ভালো লাগছে না, তাঁরা আমাকে দলছুট করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন।
তাই একা হাঁটতেই ভালো লাগে, তবে রাস্তায় অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁদের সঙ্গও মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না। অনেকে কোন অজ্ঞাত কারণে হাত ছেড়ে দেন, অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক হয়তো পারিপার্শবিকের জন্যে রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু তাঁরা সবাই আমাকে কিছু না কিছু, ধন্যাত্মক কিছু দিয়ে গেছেন। সেইটুকুই মনে রাখি।
আমার বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ ‘যে কোথাও ফেরে না’ এবং এর আগে একটি কবিতার বই ‘অজাতক সমগ্র থেকে’- এ দুটির মধ্যে আমার একলা পথ চলা, কোথাও না ফেরা এক অনিকেত জীবন, এমনকি জন্ম না হওয়ার চিহ্ন রেখে গেছি। গোষ্ঠীতে থাকলে জাগতিক সুবিধে কিছু নিশ্চয় হত, তবে লেখার উন্নতি কিছু হত বলে মনে হয় না। আমি এভাবেই থাকতে আরাম বোধ করি। একা কিন্তু নিঃসঙ্গ নই। পাঠক আছেন কিছু।

তুমি যখন শুরু করেছিলে তখন একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল? আজ সেই চ্যালেঞ্জ কতটুকু আছে মনে কর এর সমাধানই বা কী?

তৃষ্ণা বসাক: যেকোন মানুষ যদি বাঁধা রাস্তায় না হেঁটে নিজের রাস্তা নিজে তৈরি করতে চায়, তার ভাগ্যে দুঃখ থাকে। আর মেয়েদের রাস্তা তো সব যুগেই বন্ধুর। তবে কেউ যদি ভেতর থেকে কিছু করতে চায়, এবং তার জন্য সব জাগতিক সুবিধে ছাড়তে প্রস্তুত থাকে, তবে তাকে আটকানো খুব কঠিন। বুন মোষের মতো গঁ আর শক্তি থাকতে হবে। শুধু মানসিক নয়, শারীরিক ক্ষমতাও দরকার। কথাকারকে একজন ইমারতি মজুরের মতোই খাটতে হয়। ইঁট গেঁথে গেঁথে প্রাসাদ বানাবে না ছোট্ট এককামরার ঘর, সবই কথাকারের শক্তি আর একাগ্রতার ওপর নির্ভর করে।

কবি বা লেখক কতটা প্রতিভার কতটা প্রস্তুতির বলে তুমি মনে কর?

তৃষ্ণা বসাক: ওই যে কথা আছে ৯৯% ইন্সিপিরেশন আর ৯৯% পারস্পিরেশন- সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি পেশাদার ভাবে লিখতে এসে। প্রতিভা মানে আমি বুঝি সবার থেকে আলাদা একদম মৌলিক চিন্তা করার ক্ষমতাকে। কিন্তু সেটাকে কথারূপ মানে রক্তমাংসের চেহারা দিতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়।

বাংলা গল্পের বাঁক পরিবর্তনের দিশারী বললে কাদের কথা বলবে? কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে একটা আলাদা প্রবন্ধ হয়ে যাবে। তবে আমি যাদের কাছে শিখেছি, তাদের নাম বলি- রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুবোধ ঘোষ, জীবনানন্দ দাশ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যপাধ্য্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বিমল কর- এঁরা প্রত্যেকেই বাঁক পরিবর্তন করেছেন। একেবারে সাম্প্রতিকদের কথা এই সাক্ষাৎকারে আর বলছি না।

অনেককেই বলতে শুনি মৌলিক লেখা যখন লিখতে পারছেন না তখন অনুবাদ করেন, তোমার ক্ষেত্রেও কি তাই?

তৃষ্ণা বসাক: কোন লেখা যখন খুব টানে, একমাত্র তখনি তা অনুবাদ করতে পারি, কিংবা যখন মনে হয় বাঙালি পাঠকের সেই লেখককে পড়া দরকার। আর আমি ভারতীয় ভাষা থেকেই অনুবাদ করি। বিদেশি নয়। এটা আমার একটা মিশন।আমার মনে হয় বাঙালি পাঠক বিদেশি সাহিত্য নিয়ে যত জানেন, ভারতীয় সাহিত্য তত পড়েননি। সেই সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করে যাব নিজের লেখার পাশাপাশি। তাই মৌলিক লেখা লিখতে পারা না পারার সঙ্গে অনুবাদ করার কোন সম্পর্ক নেই আমার ক্ষেত্রে। আমি বিভিন্ন রকম কাজ করি কম্পার্ট্মেন্টালাইজ করে।

বাংলায় অন্যভাষার অনুবাদ যত হয় তার আংশিক যদি অন্যভাষায় বাংলা অনুবাদ হতো এই আক্ষেপ শুনি অন্যভাষায় বাংলা অনুবাদ না হবার কি কারণ?

তৃষ্ণা বসাক: আমি তো এর উল্টো কথাটাই জানি। ভারতের অন্য ভাষায় বাংলা প্রচুর অনুবাদ হয়, যেমন মলয়ালম। কিন্তু অন্য ভাষা নিয়ে বাঙ্গালির তেমন উৎসাহ নেই। তুমি যেটা বললে সেটা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে সত্যি। আসলে সবই অর্থনীতির ব্যাপার। অনুবাদ করে তো পারিশ্রমিক পেতে হবে, তারপর সেই অনুবাদ প্রকাশককে ছাপতে হবে। এই নেটওয়ার্ক ঠিকমত গড়ে ওঠেনি।

অনুবাদক,কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজের প্রস্তুতি ও নির্মাণ কৌশলটা যদি বলো।

তৃষ্ণা বসাক: কৌশল কিছু নেই। রোজ কাজ করার চেষ্টা করি। একসঙ্গে অনেকগুলো লেখা চলে। একাধিক উপন্যাস, গল্প, কবিতা, অনুবাদ, প্রবন্ধ, এছাড়া সম্পাদনা করি। যখন যতটুকু ভাল লাগে ততটুকু করি, তবে সম্পাদকের তাগাদা থাকলে একটু বেশিসময় কাজ করি। দেখি কাজটা যেন আমার বোঝা না মনে হয়। তাই ফাঁকে ফাঁকে রান্না, ঘরের কাজ, শাশুড়ির দেখাশোনা, মেয়ের বায়না- সব থাকে। এমনকি কাঁঠাল কিনতে এসে লোকে আমাকেই জিজ্ঞেস করে এটা খাজা না রসা। যথেষ্ট গাম্ভীর্য নিয়ে কথা বলি, যাতে সে মনে করে আমি এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। আসলে এই যে পূর্ণ সময়ের লেখক বৃত্তির চাপ, যেখান থেকে মোবাইলের বিল তোলাও শক্ত, সেই কাজটিকে রস টানতে হয় তার পরিপার্শব থেকে। আমি সেটাই খেয়াল রাখি যাতে আমার কাজটা শুষ্কং কাষ্ঠং না হয়ে যায়, আর আমার লেখার কেন্দ্রে যে মানব, সেই মানব সমুদ্রে অবগাহন করার সুযোগ ছাড়ি না। পৃথিবীর মাটি জল রোদ আকাশ- এই যে মহাজাগতিক সিম্ফনি, আমি ও আমার লেখা তার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ। পৃথিবী আছে, প্রাণ আছে, তাই আমি আছি।

সৃষ্টিশীল মানুষের বোধে প্রেমের প্রভাব কতটুকু? মানে, প্রেম সৃষ্টিশীলতাকে প্রভাবিত করে বলে মনে কর?

তৃষ্ণা বসাক: প্রেম তো জীবনের একটা অভিমুখ দেয়, সে সবাইকেই। সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনেও প্রেমের দরকার।

অধিক পাঠে কি একই লেখা দুই লেখক লিখতে পারে?

তৃষ্ণা বসাক: ছাপ তো পড়তেই পারে। অচেতনে। সচেতন হলে সেটা প্লেগিয়ারিজম। লেখার চুরি ব্যাপারটা আমার খুব বোকা বোকা লাগে। নিজের লেখা না থাকলে লিখব না, অন্যের লেখা চুরি করে কি লাভ?

তোমার প্রিয় বই? যা সব সময় কাছে রাখতে চাও?

তৃষ্ণা বসাক: লীলা মজুমদারের খেরোর খাতা, মণীন্দ্র গুপ্তের গদ্যসংগ্রহ, রামকৃষ্ণ ক্থামৃত, রবীন্দ্রনাথ, রাস্কিন বন্ডের আত্মজীবনী, চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনী

প্রিয় কবি?[br]
তৃষ্ণা বসাক: রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, দেবারতি মিত্র, মণীন্দ্র গুপ্ত, অনিতা অগ্নিহোত্রী, প্রবুদ্ধসুন্দর কর।[br]

প্রিয় ব্যক্তিত্ব?[br]
তৃষ্ণা বসাক: আগাথা ক্রিস্টি।[br]

প্রিয় লেখক?[br]
তৃষ্ণা বসাক: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মিলান কুন্দেরা।[br]

প্রিয় গল্প?[br]
তৃষ্ণা বসাক: মধ্যবর্তিনী, আমি শুধু একটা ফোন করতে এসেছিলাম (গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ)।[br]

প্রিয় উপন্যাস?[br]
তৃষ্ণা বসাক: মুন অ্যান্ড দা সিক্স পেন্স, সমারসেট মম, চাঁদের পাহাড়, ঢঁড়াই চরিত মানস, মেমারি অফ আ মেলানকলি হোরস, আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইয়িং,নোটন নোটন পায়রাগুলি,মহাকান্তার।[br]

আগামীর কোন বিশেষ পরিকল্পনা?[br]

তৃষ্ণা বসাক: মহাভারতের প্রান্তিক মানুষজন, যাদের কথা সেভাবে জানা যায় না, তাদের নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা।[br]

ভবিষ্যতে কি মানুষ সাহিত্য লিখবে–পড়বে? সাহিত্যের কি আর প্রয়োজন হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে?[br]

তৃষ্ণা বসাক: অত ভাবার দরকার কি? একি ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট না করোনার ভ্যাক্সিন? সাহিত্য শিল্প তো প্রয়োজনের উর্ধ্বে। কেজো লোকের স্বর্গে কি সাহিত্যিককে ঢুকতে দেবে? তাতে লেখকের কিই বা এসে যায়? কিছু লোক এসব না ভেবেই লিখে এসেছে, লিখেও যাবে।

One thought on “ইরাবতীর মুখোমুখি কবি,কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক তৃষ্ণা বসাক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত