| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-৪) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
দ্রৌপদীর প্রথম প্রেম অর্জুন। অন্য চার ভাইকেও তিনি ভালোবাসেন। কাউকে সম্মান করেন। কাউকে নির্ভর করেন। কারুর প্রতি বাৎসল্য। কাউকে মনে হয় বন্ধুর মতো। কিন্তু যাকে প্রেম বলে, একজন নারী মনে প্রাণে যেমন ভাবে পুরুষকে চায়, অর্জুনকে তিনি সেই ভাবেই চেয়েছিলেন। সেই প্রেমিক চলে গেল শুধুমাত্র একটি মৌখিক চুক্তিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে। আরও তিনজন নারীর সঙ্গে তার শরীরী সম্পর্ক হল। প্রথম দুজন অবশ্য যে যার নিজের জায়গাতেই রয়ে গেল। কিন্তু তৃতীয় জন? সুভদ্রা? গুণবতী, বুদ্ধিমতী এবং রূপবতী সুভদ্রা? পাণ্ডবদের সবথেকে হিতাকাঙ্খী এবং স্বজন কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা? সে তো আসছে। অর্জুন তাকে নিয়েই আসছে। ইন্দ্রপ্রস্থে। দ্রৌপদীর সামনেই সেই মেয়ে হবে একমাত্র অর্জুনের ঘরণী। অর্জুনের একমাত্র। আর দ্রৌপদী? সেও তো চেয়েছিল একমাত্র হতে। শুরুতে তো সে আর অন্য কিছু ভাবেই নি। এমনকী, পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের পরেও না। কারণ অর্জুন তো থাকবেই তার হয়ে। এইভাবে অর্জুন চোখের সামনে আরেক নারীর হয়ে যাবে, একথা তো কৃষ্ণা কখনও কল্পনাও করে নি! যতবার এই কথা মনে আসছে, কৃষ্ণার বুকের ভেতরটা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। তবু কাজ করতে হচ্ছে তাকে। পট্টমহিষী সে। রাজকোষের দায়িত্ব তার। এই বিরাট প্রাসাদের সকল মানুষের প্রতিটি মুহূর্তের ছোট বড় সমস্ত কিছুর দায়িত্ব তার।
সমস্ত দিনের কাজ সেরে কৃষ্ণা নিজের একান্তের ঘরটিতে বসে ছিলেন। এই ঘরটি বড় প্রিয় তাঁর। এই একটি ঘরকে তিনি নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছেন। ঘরটিতে বেশি আলো নেই। ঘরের এককোণের ছাদটির জায়গা ফাঁকা, ঠিক তার তলায় ছোট একটি পুষ্করিণী। যখন বৃষ্টি আসে, কৃষ্ণার ঘরে আকাশ থেকে সরাসরি বৃষ্টি এসে নামে আর ওই পুষ্করিণীতে পড়ে লাফিয়ে ওঠে। ভারী সুন্দর দেখায় তখন। ঘরটির দুদিকের দেওয়ালে মাটি চাপড়ে ঘাস আর নানারকম লতাপাতা লাগানো। ভেতরে ঢুকলেই কেমন একটা বুনো গন্ধ নাকে এসে লাগে। ঘরের এক কোণে একটি মাত্র মাটির শয্যা। নরম পাতলা একটি আস্তরণ তাতে। পাশে একটি কুচকুচে কালো জলের আধার। নিরাবরণ এই ঘরটি দ্রৌপদীকে নিজের পুরোনো দিনের কথা মনে করায়। এই ঘরের একা বিছানাটি শুয়ে বসে দ্রৌপদী আরাম পান। এখানে নিশ্চিন্তে এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা যায়। কেউ আচমকা তাঁর শরীরে হাত দেবে না। কেউ এসে গদগদ স্বরে তাঁর স্তুতি করবে না। এখানে তিনি একাই। আর এই একাকীত্ব মাঝে মাঝেই বড় বেশি প্রয়োজন হচ্ছে তাঁর। বিশেষ করে যেদিন থেকে অর্জুন চলে গেলেন। 
অর্জুন যখন চলে যাচ্ছেন, সবার আগে কুন্তীকে প্রণাম করলেন। কুন্তী মাথায় চুমু খেলেন। “সাবধানে থেকো বাছা। কল্যাণ হোক”। কৃষ্ণা একটু অবাক হলেন। কুন্তী তো চাইলেই অর্জুনকে আটকাতে পারতেন! মা বারণ করলে কী অর্জুন শুনতেন না! তাহলে কী কোনও কারণে কুন্তীও চান অর্জুন বাইরে যান?  দূরে চলে গেলে দ্রৌপদীর মনের ভেতরে কী হবে, তা কি তিনিও বুঝতে পারছেন না? নাকি বুঝতে চাইছেন না? তিনিও কি ভাবছেন, অর্জুন থেকে গেলে তাঁর প্রতি দ্রৌপদীর পক্ষপাত বারে বারে প্রকাশিত হয়ে পড়বে আর তাঁর বাকি ছেলেদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে? 
 যুধিষ্ঠির তো একেবারে জড়িয়ে ধরলেন। “এখনও ভেবে দেখো অর্জুন। তোমার যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই কিন্তু! তোমাকে ছাড়া সবার মন অত্যন্ত খারাপ হবে। বিশেষ করে দ্রৌপদীর। তাঁর কথাটাও ভাবো”। অর্জুনের মুখে যেটুকু সহজ ভাব ছিল, সেটুকুও চলে গেল। আর “বিশেষ করে দ্রৌপদীর”, এই কথাটি সবার সামনে বলার দরকার কী! দ্রৌপদী যে অর্জুনকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসেন, অথচ তাঁকে আপন করে পান না, সেই অন্তরের ব্যথাটা যে তিনিও জানেন, সেইটাই বোঝাতে চাইলেন? এমন অব্যক্ত যন্ত্রণার সময়ে এ কী নিষ্ঠুরতা! ভীম বরং বড় আন্তরিক ভাবে অর্জুনকে বলেন, “ভাই, তোমার জন্য মনটা খারাপ হয়েই থাকবে। যদি মাঝপথেও ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়, ফিরে এসো। দ্বিধা করো না”। নকুল আর সহদেব শুধু প্রণাম করলেন। অর্জুন আর কোনও দিকে তাকালেন না। দ্রৌপদী প্রাণপণ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন অর্জুন তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিতে এলে কী বলবেন! বলবেন, “যেও না! আমাকে ছেড়ে যেও না! হে অর্জুন! তোমাকেই তো আমি সবথেকে বেশি করে চেয়েছি আর তোমাকেই পেলাম না! বারো বছর পাবো না তোমাকে আর। দেখতে পর্যন্ত পাবো না। যেও না। যেও না। অথবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো। সেই ভালো। এই প্রাসাদের, এই রাজবাড়ির নিয়মকানুন, কর্তব্যের সীমানা পেরিয়ে চল যাই দুজনে। বনের পথে। শুধু তুমি আর আমি। নদী থেকে মাছ ধরে মশলা মাখিয়ে আগুনে আস্তে আস্তে ঝলসাব। গাছের বড় বড় পাতা আনবে তুমি। আগুনের পাশে বসে দুজনে খাব। তারপর তোমার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ব”। ভাবতে ভাবতে কোথায় তলিয়ে গেছিলেন তিনি। কুন্তীর কথায় চমক ভাঙল তাঁর। “চলো সবাই ভেতরে। আমি অর্জুনের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনায় বসব। তোমরাও নিজেদের কাজে যাও। মন খারাপ করো না। এই যাত্রা অর্জুনের পক্ষে, আমাদের সবার জন্য শুভই হবে। আমার মন বলছে”। দ্রৌপদী চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন, অর্জুন কখন চলে গেছেন। তাঁকে আর দেখা পর্যন্ত যাচ্ছে না। আসেন নি তিনি দ্রৌপদীর কাছে। বিদায় নিতে। দ্রৌপদী শুধু অপেক্ষায় ছিলেন। একাই।

আরো পড়ুন: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-৩) । রোহিণী ধর্মপাল


 মায়ের পেছনে পরপর সবাই চলে গেলেন। ভীম শুধু একবার ফিরে তাকালেন কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণার দিকে। এই মেয়েটির প্রতি কেমন যেন একটা মায়া কাজ করে তাঁর বুকের ভেতর। যেন একটা মনখারাপী ছোট্ট মেয়ে কৃষ্ণা। অথচ বাইরে থেকে তো তা বোঝার উপায় নেই কারও। আর কেউ এমন ভাবেনও না হয়ত। কিন্তু ভীম ভাবেন। মনে হয় আগলে রাখেন মেয়েটিকে। অথচ কৃষ্ণার ব্যক্তিত্ব এমনটাই, যে নিজের মনের ভাবটি মনেই চেপে রাখেন তিনি। এখনও, অদ্ভুত, যে তিনি বুঝতে পারছেন ভাই অর্জুনের জন্য দ্রৌপদী অবর্ণনীয় কষ্ট পাচ্ছেন, তবু, কই, তাঁর তো এতটুকু ঈর্ষা হচ্ছে না! যদিও তিনিও বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। এগিয়ে গেলেন। জায়গাটা যেন হঠাৎই শূন্য হয়ে গেল। দ্রৌপদীর পেছনে শুধু দুজন দাসী দাঁড়িয়ে। দ্রৌপদী হাতের ইশারায় তাদের চলে যেতে বললেন। তারপর ধীর পায়ে এগোলেন নিজের ঘরটির দিকে। ওই ঘরটি যেন তাঁর মা। তাঁর একার। ওই একটি জায়গায় তিনি নিজেকে মেলে ধরতে পারেন।
 সেই রাতটিতেও তিনি ওখানেই কাটালেন। পর পর তিন রাত। সারাদিন সব কাজ নিখুঁত ভাবে করে গেলেন। কোষাগার থেকে টাকা বার করা, ভাণ্ডার থেকে রান্নার উপকরণ বার করা, কী কী পদ হবে তার নির্দেশ দেওয়া, প্রাসাদ ঘিরে যে বিরাট বাগান–  তার তদারকি করা। এছাড়া তিনি নিজে প্রতিদিন গোশালা, ঘোড়াশালা, হাতিশালায় যান। অন্তত কয়েকজনকে নিজের হাতে খাওয়ান। বোধহয় কোনও ভাবে ওদের সঙ্গে নিজের তুলনা করেন। স্বাধীন প্রাণী। অথচ কেমন বন্ধন দশা। তাঁর মতোই তো। তাই ওদের সঙ্গ তিনি ভালো বাসেন। এই সমস্ত কাজ সেরে রাতে চলে আসছিলেন তাঁর ঘরে।  সেখানে স্নানের জায়গায় দাসীরা শীতল জল ভরে রেখে, তাতে নানা ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখে। এক কোণে জ্বলতে থাকে কোনও হালকা সুরভিত ধূপ। তিনি সেখানে ঢোকার পর কোনও একজন মেয়ে আস্তে আস্তে খুলে নেয় তাঁর গয়নাগুলি। তারপর পোষাকগুলি। সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে তিনি ঢুকে যান সেই সুগন্ধী জলে। তিনি না চাইলে সেই স্নানঘরে আর কেউ থাকে না। এই তিন রাতেও তিনি অনেকক্ষণ ধরে ভিজলেন। বাইরে। ভেতরে। মনের তাপ যেন কিছুতেই কমছে না। অর্জুন তাঁকে বলে গেলেন না পর্যন্ত! মা আর ভাইদের সামনে লজ্জা! নাকি ভাবলেন দ্রৌপদী তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করবে? তাঁর একবার ইচ্ছা হল না দ্রৌপদীর মুখটা দেখে যাওয়ার? রাতের অন্ধকারে অভিমান আর যন্ত্রণা মিশে যেতে লাগল সেই জলে। আর দিনের বেলায় শুকনো দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে। চতুর্থ রাতে ঘরে ঢোকার আগে দেখলেন যুধিষ্ঠিরের বার্তা নিয়ে এক দাসী দাঁড়িয়ে। “রাণীমা, মহারাজ আপনাকে বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন, যদি আজ আপনার মনে হয়, তবে তাঁর কাছে যেতে”। 
দ্রৌপদী ঘরের দিকে পা বাড়িয়েও সরে এলেন। মুখ ফিরিয়ে এগোলেন যুধিষ্ঠিরের ঘরের দিকে।
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত