| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

ইরাবতী পুনর্পাঠ গল্প: উড়ন্ত শৈশবের ঘুড়ি । নলিনী বেরা

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

আজ কথাসাহিত্যিক নলিনী বেরা’র শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


১.

যা দিনকাল পড়ল আর নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করা যাচ্ছে না! এরকম একটা ধারণার বশবর্তী হয়ে ডোমপাড়ার ভটা ডোম হাতিবান্ধির বটতলায় গামছা পেতে শুয়ে থাকল। নিদারুণ গ্রীষ্মের দিন, তার উপর খর মধ্যাহ্ন। ঝিরি ঝিরি হাওয়া দিচ্ছিল, হাওয়ায় তার ঘুম এসে গেল। সে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।

গরুর কারবারি সে। গরু কেনাবেচার নাম করে কাঁহা কাঁহা মুলুক না সে ঘুরে বেড়ায়! কখনও বিহার তো কখনও ঝাড়খণ্ড। গ্রামের এমন কী আশেপাশের গ্রামের মানুষজন তার চালচলন গতিবিধির উপর নজর রাখে, তাকে সন্দেহ করে। ব্যাপারটা ভটা ডোমেরও অজানা নয়। সত্যিই তো কার মনে কী আছে কে জানে!

কাজে-অকাজে ঘুরতে ঘুরতে ভটা ডোম এসে পড়েছিল শ্বশুরবাড়িতে। ক-দিন কুটুম্বিতা সেরে ভালোমন্দ পেটপুরে খেয়ে এখন সে বাড়ি ফিরছে। বাড়ি তার ‘নদী-সেপারে’। কিন্তু এখন এই দুপুর-দুপুর ভরা গ্রীষ্মে আগুনের মতো নদীর বালিয়াড়ি পেরিয়ে ‘নদী-সেপারে’ যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এসময় নদীবালি এতটাই তেতে থাকে যে বালিতে পা পড়লেই পায়ের তলায় ফোস্‌কা পড়ে যায়। তার উপর আকাশে যদি গনগনে সূর্য থাকে তো কথাই নেই, ‘সান্-স্ট্রোক’ হতে আর কতক্ষণ। ‘ছাতি’ ফেটে তক্ষুনি তক্ষুনি মৃত্যু। তাই ‘নদী-সেপারের’ মানুষ এপারে এলে ফিরে যাবার গা করে না, আগে ও নদীবালি জুড়োক, ‘বস্‌মতা’ শীতল হোক, তবে তো যাওয়া!

অনেক ভেবে-চিন্তে ‘নদী-সেপারের’ ভটা ডোম এপারে হাতিবান্ধির বটতলায় গামছা পেতে শুয়ে ধীরে ধীরে ‘র্নিধুমসে’ ঘুমিয়ে পড়ল।

অনেক দূরের কেশিয়াড়ির হাটে গিয়েছিল ধনঞ্জয় কুম্‌হার হাঁড়ির ভার নিয়ে। হাটে তেমন সওদা করতে পারেনি, তাই হাট থেকে সেদিনই না ফিরে কুরকুটসোল, গুড়গুড়িপাল, বড়োপেলিয়া, ছোটোপেলিয়ার গাঁয়ে গাঁয়ে অবিক্রীত হাঁড়ির পসরা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে। তিন দিনের মাথায় বিক্রিবাটা শেষ। আজ ঘরে ফেরার পালা। কেশিয়াড়ি থেকে রোহিণী বাসেই আসা যায় কিন্তু ঐটুকু বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে পাছে ‘ইনকামের’ অনেকটাই খরচ হয়ে যায়, তাই ‘সিকা-বাঁহক’ কাঁধে হন্টন। ধনঞ্জয় কুম্‌হার টঙস্ টঙস্ করে হাঁটছিল।

গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরে। কত কথাই তো তার কানে আসে। কে জানে কী আছে কার মনে! ধনঞ্জয় কুম্‌হারের অত কথায় কাজ কীই-বা। সে হাঁড়ির কারবারি, জাহাজের কারবারের খোঁজে তার কী যায় আসে! অতএব এক কান দিয়ে যা শোনে আরেক কান দিয়ে সেসব বের করে দেয়।

ভরদুপুরে নদীবালির মানুষমারা গরমের কথা তারও অজানা নয়। তার উপর এ বছরটায় বৈশাখ-জষ্টিতে বৃষ্টি ও বৃষ্টি, ছিটেফোঁটা কালবৈশাখীরও দেখা নেই। লোকজন বলাবলি করছিল নাকি ‘রেকর্ড’ গরম পড়েছে! বিগত চল্লিশ বছরেও এমনটা পড়েনি। এই রকম টঙস্ টঙস্ হাঁটলে হাসিবমত নদীতীরে পৌঁছুতে ‘বেলা’ও পড়ে যাবে, ততক্ষণ নদীবালিও ঠান্ড হবে।

একটা বাস অল্পবিস্তর যাত্রী নিয়ে গুমর দেখিয়ে পিচরাস্তায় ‘হুঁকরে’ ছুটে গেল। ধনঞ্জয় তবু তাঁর হাঁটার গতি বাড়ালো না, বরঞ্চ কমিয়ে আনল আরেকটু— টঙস্ টঙস্! টঙস্ টঙস্!

গ্রামপ্রধান সর্বেশ্বর সিং সদরে গিয়েছিল পার্টির জরুরি মিটিঙে যোগ দিতে। একদিনের মিটিঙে, আরও দু-দিন সেখানে কাটিয়ে আজ সে বাড়ি ফিরছে। এইমাত্র বাস থেকে নামল। তারও তো বাড়ি ‘নদী-সেপারে’। এইটুকু রাস্তা যাবার আর কোনও উপায় নেই, পায়ে হেঁটেই যেতে হবে তাকে। কিন্তু এখনই পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না, নদীবালি আগুন হয়ে আছে তেতে! সে দুপুরটা বিশ্রাম নিতে ঢুকে পড়ল রোহিণী বাসস্ট্যান্ডের চেনাজানা এক চুলকাটা ‘সেলুনে’। সেলুনের নাম ‘স্টাইল’।

চেনাজানা ‘স্টাইলের’ মালিক খুব খাতির করল সর্বেশ্বরকে। গ্রামপ্রধান বলে কথা, কে না খাতির করবে! গদি-আঁটা ‘রিভলভিং’ চেয়ারটা চুল-কাটার ওড়না দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে বসতে দিলো। চাইলে ‘ম্যাসেজসহ চুলদাড়ি’ও কাটতে প্রস্তুত সেলুনওয়ালা। হাত নেড়ে নিষেধ করে বরঞ্চ কাগজের বাসি খবর পড়তে থাকল সর্বেশ্বর। ইচ্ছে করেই দুইয়ের পাতার উপরের দিকে একেবারে কোনায় চলে গেল সে, ঐ যেখানে আছে, ‘প্রিয়জন অন্যের বশীভূত? দাম্পত্য কলহ? ব্যর্থ/গুপ্ত প্রেমে বশীকরণে ২৪ ঘণ্টায় মন্ত্রবৎ সুফল। বিবাহে পত্রজাপতি যজ্ঞ, নিঃসন্তানে-গোপাল যন্ত্রে অব্যর্থ ফল। ফাঁকিবাজ, বিদ্যায় বাধা—সরস্বতী যন্ত্রে নম্বর বাড়বেই, কর্ম, ব্যবসায় ধনদা যন্ত্রে ১০০% কাজ। চেম্বার : উঃ পাড়া, হজরা…’। পড়ব না পড়ব না করেও ফের পড়তে হলো প্রথম পাতার ডান দিকের কলম, ‘এবার খুনের ঘটনা ঘটল ঝাড়গ্রাম শহরের উপকণ্ঠে। শনিবার সন্ধ্যায় শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে কেঁউদিসেলের জঙ্গল লাগোয়া রাস্তায় খুন হলেন গ্রামীণ জোনাল কমিটির সদস্য জলধর মাহাত।’ দ্বিতীয়টা গোয়ালতোড়ে, ‘গোয়ালতোড়ের জঙ্গল এলাকায় খুন হলেন এক ব্যবসায়ী। মৃতের নাম অলোক ঘোষ (৪০)। রাত নটা নাগাদ বড়ো-নাগদোলা গ্রামে তার বাড়ি লাগোয়া দোকানে হানা দেয় ২০-২৫ জনের সশস্ত্র দল। পাঁচটি গুলি করে মারা হয় তাকে।’ হাত থেকে ফসকে খবরের কাগজটা পড়ে গেল মাটিতে। দোকানদার কাগজটা কুড়িয়ে দিলো। অনুচ্চস্বরে ‘কে জানে কী আছে কার মনে।’ বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সর্বেশ্বর।

২.

বালিয়াড়ি সহ নদীর এপার-সেপার দূরত্বে প্রায় দু-থেকে আড়াই মাইল। মাঝখানে চর, চরের এধারে সেধারে ছোটোনদী আর বড়ো নদী, ধূ ধূ বালি আর বালিয়াড়ি। কিন্তু বর্ষায় শ্রাবণ-ভাদ্রে যখন ‘এপার’-‘সেপার’ এক হয়ে যায়, জলে জলাৎকার, তখন সরেস ‘নউড়ীয়ারও’ পারাপার করতে বুক কাঁপে যায়! দিনের মধ্যে বড়োজোর একটা ‘ভরা’ কী দুটো ‘ভরা’। ‘ভরা’ তারমানে যাত্রী বোঝাই নৌকা নিয়ে মোট পারাপার করা। তা সে তো গেল বর্ষার দিনগুলোর কথা, এমনি রুখোশুখো গরমের দিনগুলোয় নদী কমে প্রায় অর্ধেকের অর্ধেক হয়ে যায়। বাড়ে, বাড়তে থাকে শুধু ধূ ধূ বালিয়াড়ি।কাঁটা ঝাড় আকন্দ আর ফনিমনসার গাছ। তৈরি হয়ে যায় অজস্র বালিখাদ, চড়াই-উৎরাই। পথচলতি মানুষ খাদে নেমে অদৃশ্য হয়ে যায়, পরক্ষণেই ভেসে ওঠে বালিঢিবির চূড়ায়। তার মানেই উঠন্তি-ডুবন্তি ভুসভুসে মাথা! কোথাও কোথাও খাদের ভিতর চকচকে এক চিলতে জল, ঝাঁজি শ্যাওলা আর চানাচুনো মাছ। ছোটো ছোটো বালির বাঁধ দিয়ে জলে ‘গুড়মন’ গাছের রস মিশিয়ে ছেঁকে তোলা হয় চানাচুনো মাছ, যাকে বলে ‘সতীবাঁধা মাছ’ যার লোভে লোভে মাথার উপর অনেকটা দূরে উড়ে বেড়ায় চিল, ফাঁকতালে নেমে আসে নীচে, দাঁও বসিয়ে যায় মেছুড়ে-মেছুনিদের ভাগে। এছাড়া সবই তো ঝাঁ ঝাঁ নদীবালিতে নিদারুণ গ্রীষ্মে দাবদাহে ‘জলভ্রমি’ মরীচিকা। মরীচিকা, মরীচিকা। বেভুলে বা অত্যাধিক জেদের বশবর্তী হয়ে কেউ যদি এই অসময়ে নেমেও পড়ে নদীবালিতে, যখন ফুটন্ত বালির কড়াইয়ে পুড়তে থাকবে তার পা, তখন পা-দুটি জুড়োতে সে ‘হা জল’ ‘হা জল’ করে ছুটে যাবে ঐ বালিখাদের দিকে, ঐ যেখানে দুই বালিঢিবির মাঝখানে টলটলে জলের উপরিতল থেকে যেন চুঁইয়ে উঠছে ধোঁয়া, ধোঁয়াধার জলধোঁয়া! পড়ি-কি-মরি ছুটে সেখানে পৌঁছে দেখবে—কোথায় জল! সমস্তটাই মায়া, নদীবালির খেলা। খেলা তো নয় মরণখেলা। কে আর জেনেশুনে এই খেলায় পড়ে মরতে ঝাঁপাতে আসবে!

তবু তো কেউ কেউ আসে, না এসে তাদের উপায় থাকে না। এপারের যারা, ‘হাটুয়া’ ঘরের গরিব দুঃখী ঝিউড়ী-বউড়ীরা, যারা সেই কোন ভোর ভোর নদী, নদীবালি পেরিয়ে ‘নদী সেপারের’ জঙ্গলে গিয়েছিল জ্বালানির জন্য কাঠকুটো সংগ্রহ করতে, তারা তো ঘরের টানে কাঠের বোঝা মাথায় পেঁকাটির মতো হেলতে-দুলতে কী গ্রীষ্মে কী বর্ষায় ফিরবেই ফিরবে। আর যারা ‘নদী সেপারের’ জঙ্গলের মানুষ, কী নারী কী পুরুষ, সকাল সকাল ‘খালিপাতা’ ‘দাঁতনকাঠি’ ‘চ্যালাকাঠ’ ‘গোটাকাঠ’ ‘ভুড়রু-মুড়রু’ নিয়ে এপারের হাটে কিংবা মহাজনের ‘টাটে’ এসছিল বিক্রি করতে, তারাও ফিরবে নদীবালিতে ভাজা হতে হতে। মাঝে মাঝে ছইয়ে ঢাকা গরুর-গাড়িও দেখা যাবে একটা-দুটো। হয়ত কুম্‌হারপাড়ার গরুরগাড়ি হাঁড়ি-কলসি নিয়ে দূরের গাঁয়ে গিয়েছিল ‘ফেরি’ করতে, ধকল যেটুকু যাবে অবলা গরুর পায়ের খুরে, গাড়োয়ান তো তখন পা ঝুলিয়ে ‘ধাঁচা’ বা ছইয়ের ছায়ায় বসে!

এ তো গেল দিনমানের নদীবালির কথা, রাতের নদীবালি চেহারা-চরিত্রে একেবারেই আলাদা। ‘বেলা’ ডুবতে না ডুবতেই বালি ঠান্ডা হতে শুরু করে, রাত যত বাড়ে বালির তাত ততই কমতে থাকে, ভোরের দিকে কমতে কমতে বালির উপর শিশির-কাঁকরের সর পড়ে যায়। হাঁটতে-চলতে পায়ের তলা ভিজে সপ সপ করে। সকাল হলেই নদীবালিতে আঁকা হয়ে যায় দ্বিপদ-ত্রিপদ-চতুষ্পদ ছোটো-বড়ো কত বিচিত্র পায়ের ছাপ। রাস্তায় বে-রাস্তায় কত রাতমানুষই যে মস মস করে হেঁটে যায়। চিড়িক চিড়িক করে দূরে-অদূরে আলো জ্বলে উঠে তক্ষুনি নিভে যায়—কে জানে সে ‘কাহাদের’ আলো! ঐ দুর ‘ছাতিনা’ গাছের তলায় টর্চের আলো একবার মাত্র ফোকাস ফেলে নিভে গেল ও ফের জ্বলে উঠল পুবে—পুবে পুবে—ঐ মশারির দহে। অন্ধকারে ও কাদের চোখ জ্বলে ফসফরাসের মতো। তাহলে কি দলবেঁধে খেঁকশিয়াল ভুঁড়া-শিয়াল বেরুল কাঁকড়ার খোঁজে! সাবধান! ধানপাকা, আখকাটার মরশুমে দলমা ধানঝোরি থেকে দলবেঁধে নেমে আসে দলমাদের হাতির পাল! ফিনফোটা ‘জনের’ আলোয় নদীবালিতে যেন শুঁড়ে শুঁড়ে এড়িয়ে একসঙ্গে ষাট-সত্তরটা ‘মেঘপাতাল’ মসর মসর বালি ছিটিয়ে হেঁটে যায়। যাবে ছাগলপোতা পাটাসোল বাবুইবাসা কলাইমুড়ি পিংবনি পাথরডাঙা, আরও কত নাম-না-জানা অচেনা গ্রামে-গঞ্জে, ঝিট্‌কা ভাদুতলা চাঁদড়া হুমগড় ধাদিকা আরও কতসব দূর দূর জঙ্গলে।

হাটবার নদীবালিতে লোকজনের যাতায়াত একটু বেড়ে যায়। বেচা-কেনা সেরে মান ‘গোস্ত’ করতে করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। ছাতিনা গাছের মাথায় সাঁঝতারা জ্বল জ্বল করে। কলরব কোলাহলে নদীবালি তবু মুখর থাকে। এমন দিনে ভয়ের কিছু থাকে না। তবু তো সেই ঝঞ্ঝাটের দিনগুলোয় এই নদীবালিতেই খুন হয়ে যান ভবানী ডাক্তার! জুতো পায়ে নদীবালিতে হাঁটতে তাঁর অসুবিধা হচ্ছিল, জুতোয় বালি ঢুকে যাচ্ছিল। তাই জুতোজোড়া হাতেই ধরা ছিল। ধরাই থাকল।


আরো পড়ুন: বনপাটির জঙ্গল । নলিনী বেরা


৩.

সেলুন মালিকই তুলে দিলো সর্বেশ্বরকে, নচেৎ ঘুমটা খুব গাঢ় ছিল, সহজে ভাঙত না। সেলুন মালিক মনে করেছিল—একে গ্রামপ্রধান, পার্টির লোক, তার উপর গায়ে ‘গন্ধ’ আছে—সেহেতু বেলা থাকতে নদীবালি পেরিয়ে যাওয়াই ভালো। শুভানুধ্যায়ী লোকটা সঙ্গে যেতেও চেয়েছিল খানিকটা পথ, তাঁকে নিষেধ করে দিলো সর্বেশ্বর। না, তার দরকার নেই। চেনাজানা পথ, তার উপর নদী পেরিয়ে বড়ো ইস্কুলে আসতে-যেতে নদীবালির নাড়িনক্ষত্র তার চেনা। নদীর চরে কত কাঁটাকুল খেয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে ভিড়ে! তাছাড়া নদীবালিতে কেউ কখনও একলা হয় না। ‘স্যাঙাৎ হে-এ-এ-এ’ বলে ডাক দিলে সে-ডাক অদূরবর্তী তিলকমাটিয়া ‘হুড়ি’ থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে, ‘আছি হে-এ-এ-এ’! কেউ না কেউ জুটে যায়। তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ল সর্বেশ্বর। জোড়া বটতলা পেরুলো, নীলকুঠি পেরুল, গড়কাটা খাল ডিঙিয়ে বাজে-শিমুলের তলা দিয়ে বেগুনা-বাঘনক্ষীর ঝাড় পেরিয়ে দু-পায়ে ঢিস্ ঢিস্ বালি উড়িয়ে ছোটোনদীতে গড়গড়িয়ে নেমে গেল। যেন ‘উরালি’ হাওয়া পিছনে তৈল মারছে। ‘বেলা’ এখন ঝিরিঝিরি। সব কিছু ঠিকঠাক চললে সূর্যডোবার আগেই নদীবালি পেরিয়ে যাবে সর্বেশ্বর।

‘শিকা-বাঁহুক’ কাধে টঙস্ টঙস্ হাঁটতে হাঁটতে ধনঞ্জয় কুমহারও এইমাত্র বাজেশিমুল পেরিয়ে গেল। হাঁটছে তো হাঁটছে, কোথাও বসে দু-দণ্ড জিরিয়ে নিলে বেশ হতো। কিন্তু ‘করছি-করব’ ‘এইখানে না ওইখানে’ করতে করতেই কাবার হয়ে এলো গোটা রাস্তাটাই। তার আর বিশ্রামের দরকার নেই। কেমন যেন একটা ‘টান’ তাকে টেনে নিয়ে চলেছে সামনের দিকে—সামনের দিকে—সামনের দিকে। রাস্তার দু-ধারে বেগুনা-বাঘনখীগাছের বেড়ার ওধারে পাল-চাষিদের আবাদি আনাজখেতি। নদী থেকে ‘তেঁড়ায়’ ভরে জল তোলার ব্যবস্থা। লোকজন নেই, সুনশান, জল বাতানের বালি এখন মরা টাঙ টাঙ, ঢেঁড়স গাছের পাতাগুলোও জলাভাবে মরা হলুদ, ধুঁকছে। ‘তেঁড়া কাঠের’ মাথায় বসে একটা ল্যাজ চেরা ‘ঢেপচু’ পাখি, তার ঠোঁটটি নদীবালির দিকে তাক করা। ঠিক তার তলায় একটা কাটা ঘুড়ি সুতায় জড়িয়ে লটকে আছে। ঘুড়ির গায়ে  লাল কালিতে কী যেন লেখা! এতদিনে ঝাপসা হয়ে গেছে, ধনঞ্জয় পড়তে পারল না। মনে মনে বলল, ‘যত্তসব চ্যাঙড়াদের কাণ্ডকারখানা!’ তারপরেই গড়ানে নেমে গেল, ছোটো নদীর জল তার পায়ের পাতা ছুঁলো। সে ঘাড় তুলে দেখল—হব্‌লস্ ফব্‌লস্ পা ফেলে জল পেরিয়ে চরে উঠে যাচ্ছে আরেক জন। তাহলে নদীবালিতে সে একলা নয়, দোকলা। চরের ওধারেই নদীবালি। দ্রুত পা চালালে লোকটাকে নদীবালিতেই ধরতে পারবে ধনঞ্জয়।

বটতলায় ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল ভটা ডোম। সুনশান দুপুর, এদিকটায় লোকজনেরও তেমন যাতায়াত নেই, খালি যা আ-কাটা বরোধনের বিলে ঝাঁকবেঁধে বসে থাকা গোলা পায়রা চড়ৈচটি মাঝে মাঝেই ডানা ভদ্‌কে হুর্ হার্ ফুর্ ফার্ উড়ে উঠছে। আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল তার। ঘুম ভেঙে সে দেখল—‘বেলা’ প্রায় ডুবতে বসেছে। এখনও দৌড়োলে নদীবালি পেরুতেই আঁধার ঘনিয়ে আসবে। আঁধারের নদীবালিতে একলা হেঁটে যেতে ভটা ডোমের ভয় করবে। কেননা সে শুনেছে যে ভর সন্ধ্যাবেলাতেই ওখানে যতসব ‘চিড়্‌কিন্’ ‘গোমুহা’ ‘কাল্‌মুহা’ ‘বাউটিয়াদের’ দৌরাত্ম্য। অথচ ওড়িশা-বিহার-ঝাড়খণ্ড গরুর কারবারে কাঁহা কাঁহা মুলুক না সে ঘুরে বেড়ায়। ভটার আর কতই-বা বয়স। এই তো সেদিন সে গোঠটাঁড়ের মাঠে ‘হাটুয়া’ ‘মাহাত’ ‘রাজু’ ‘ভূমিজ’ ‘ভুঁইয়া’ ঘরের ছেলেদের সঙ্গে হাফ-প্যান্ট পরে ‘ওলডাঁটার’ ফুটবল খেলত। ‘ওলডাঁটার’ ফুটবল—সে এক ‘গ্যাঁড়াকল’। বড়ো বড়ো বুনোওলের ডাঁটা, কেটে এনে শুকিয়ে নিলেই রাবারের স্পঞ্জের মতোই তার হাবভাব। শনের দড়ি দিয়ে চার নম্বর ছ-নম্বর সাইজ করে বেঁধে পায়ে ঠেকালেই তিন তালগাছ ‘হাই শট’! ভটা ডোম খেলত সেন্টারে। গুলির মতো দৌড়াত। সেই ভাটাই আবার রাজুর পো অনন্ত দত্তের ‘বালক সঙ্গীত অপেরায়’ বৃন্দাদূতীর রোল করত—‘আজ কেন সেই নিধু বনে। রাধাকৃষ্ণ একাসনে।’

ভটা ডোম দৌড়োল।—দৌড় দৌড়—। পেরিয়ে যাচ্ছে হাতিবান্ধির ‘সাতভাউনী’র থান, কুস্তড়িয়ার নীলকুঠি, কাঁটাবাঁশের ঝাড়, ভিটকেল ঘুঘু, পাঁড়কা কপ্‌তি, গোলা পায়রা, চড়ৈচটি চর্চিত মুগ-চুনার খেত, চরন্তি গরুমোষ। মাড়িয়ে গেল দড়িতে লট্‌কানো ধুলায় গড়াগড়ি খাওয়া পার্টির ফেস্টুন। গড়কাটা খালের ঝিরঝিরে জলে হল্‌হল্ করে সরে গিয়ে পথ করে দিলো ঢোঁড়া সাপ। বাজে শিমুলের জলে ভটা ডোমের দৌড়োনোর দাপটে পাখি ভদকালো। ভটা দৌড়চ্ছে।—দৌড় দৌড়—। ‘বেলা’ ঝিল্ ঝিল্ করছে, ভটা দৌড়োচ্ছে। প্রায় দৌড়েই ছোটোনদীটা পেরিয়ে গেল ভটা। চরে উঠল। গ্রীষ্মের চর, খরার দাপটে কাঁটাকুলের গাছগুলি শুকিয়ে ঝাঁটি। খালি যা আকন্দের গাছগুলি এত দাবদাহেও রসটেনে হয়ে আছে সবুজ। দু-পায়ে অনবরত বালি ছিটিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে চর ছেড়ে নদীবালিতে নেমে গেল ভটা ডোম। চোখ তুলে দেখল—সে একা নয়, সামনে আরও দুজন!

৪.

পিছনে লোক আসছে, একজন নয় দুজন, দেখেই হাঁটার গতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছিল সর্বেশ্বর। ধীরে ধীরে এইজন্য যে, কে জানে চেনা না অচেনা লোক। চেনা হয় যদি তো একরকম ভালো, গল্পগুজব করে নির্ভয়ে যাওয়া যায়, তাছাড়া কার মনে কী আছে কে জানে! লু হাওয়ার দাপট এখনও থামেনি, তবে কিছুটা কমের দিকে। মাঝে মাঝেই ছোটো ছোটো ঘূর্ণি হাওয়া, যাকে বলে ‘বিঁড়োল বাও’, ছুটে এসে ঘিরে ধরেছিল আর চোখে-মুখে বালি ছুড়ছিল। ততক্ষণ চোখ মুখ বন্ধ রেখেই হাঁটতে হচ্ছিল। নদীবালিতে পায়ে চলার নির্দিষ্ট কোনও পথরেখা নেই, চলতে চলতেই পথ একটা তৈরি হয়ে যায়। যে যেমন হাঁটে। কত অজস্র পায়ের ছাপ যে আঁকা হয় আছে নদীবালিতে! আরও কত অজস্র যে মুছে গেছে হাওয়ার দাপটে বালি চাপা পড়ে। এতক্ষণে দু-চারটে কুকুরের ডাকও শোনা যাচ্ছে, তবে সে কী আর নদীবালিতে! কোথায় কোন গৌদামৌলি পানিসোলা বীরকাঁড় খয়রাশুলি আন্ধারী মৌভাণ্ডার হরিপুরা—সব নদীধারের গ্রামগুলিতে। একটা বালিঢিবির চড়াইয়ে উঠে সর্বেশ্বর দেখল বড়ো নদীর জলের কাছে পৌঁছুতে এখনও অনেকটা।

ধনঞ্জয় কুম্‌হারের হাঁটা সেই ঢঙস্ টঙস্। সামনে আছে একজন, পিছনে আরেক জন, সে পড়ে আছে মাঝখানে। কাঁধে হাঁড়ির ভার থাকলে হাঁটার একটা ছন্দ থাকে— টিপিক্ টিপিক্! বাঁশের ‘বাঁহুক’ কাঁধের উপর হাঁড়ির ভারে দুলতে থাকে। দুলতে থাকে, দুলতে থাকে। সারা রাস্তা গ্রামগঞ্জ সে এই ছন্দে হেঁটে বেড়ায়। এখন হাঁড়ির ভারও নেই সেই ছন্দটাও নেই, আছে কেবল শিকে-বাঁহকের এককোণে বাঁধা কয়েক আঁটি কলমি শাক। তাই নিয়েই ধনঞ্জয় নদীবালির উপর হাঁড়িভারের সেই ছন্দটাই নিয়ে আমার চেষ্টা করল। নদীর জল অবধি বিস্তৃত বালিয়াড়ি, কখনও উপরে উঠছে কখনও নিচে নামছে। খাদে নেমে গেলে সামনে-পিছনে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। খালি পায়ের তলায় ‘মাম্‌ড়ি’-ওঠা চাগড়া চাগড়া শুকনো মড়মড়ে কাদা। বুঝতে অসুবিধা নেই—এককালে এখানে জল ছিল, জলে চানাচুনো ‘সতীবাঁধা’ মাছ ছিল, টুরটুরি ব্যাঙ ছিল, এখন সব খাঁ খাঁ। ধনঞ্জয় কুম্‌হার পায়ের পাতায় একটা চাগড়া তুলে ‘শট’ মারল। চারদিকে শুধু ঝলমলে বালি, মাঝে মাঝে ‘পিট্‌না-সিজের’ কাঁটাগাছ, তাতে ফুলও ফুটে আছে হলুদ হলুদ। জলছাড়া কী করে যে তারা বেঁচে আছে, ধনঞ্জয়ের মাথায় আসে না! সে শুনেছে মরুভূমির দেশেই এমনটা হয়, একমাত্র উটই ক্লান্তিহীনভাবে দিনের পর দিন রাতের পর রাত বালির উপর দিয়ে কাঁটাগাছ চিবোতে চিবোতে রক্তঝরা মুখে মসর মসর হেঁটে চলে। তাই উটকে নাকি বলা হয় ‘মরুভূমির জাহাজ’। ধনঞ্জয় কখনও উট দেখেনি, ক্লাস থ্রি-ফোরের ‘ভূগোল ও প্রকৃতি বিজ্ঞানেই’ পড়েছে। লু হাওয়ার দাপটে উড়ে আসা বালিঝড় থেকে চোখ-মুখ বাঁচাতে সে এখন উট হয়ে লম্বা পায়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। এই হারে হাঁটলে সামনের লোকটাকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলবে সে।

দৌড়োচ্ছিল ভটা ডোম। না, আর দৌড়োনোর দরকার নেই। একটু জোরে পা চালালেই সামনের দুজনকে টপকে যাবে সে। কিন্তু ভস্‌ভসে বালি, শক্ত তো নয় মোটেও, পা দিলেই বালিতে পা দেপে বসে যাচ্ছে, কোনমতে বালি ছিটিয়ে পা তুলে হাঁটতে হচ্ছে। তার উপর টায়ারের চটি, গরুর কারবারে তাকে কাঁহা কাঁহা মুলুক না যেতে হয়, তাই একজোড়া জাবদা দেখে টায়ারের চটি কিনেছে সে। জলে-স্থলে দিব্যি হাঁটা যায়, তা বলে বালিতে! বালি ঢুকে ঘষা লাগছে পায়ে, হাঁটতে খুব অসুবিধা হচ্ছে, পায়ের চটি হাতেই ধরল ভটা ডোম। তার জামার বুক পকেটে একগাদা কাগজ, হয়তো গরু কেনা-বেচার হিসাবনিকাশ, একটা ফাউন্টেন পেন, তার থেকে কালি ‘লিক’ করে বুকপকেটের তলাটা জ্যাবড়ে আছে। ভটা ডোম ক্লাস সিক্স। সে ঝিরি ঝিরি পড়ন্ত আলোয় সামনের লোকদুটোকে চিনে ফেলার চেষ্টা করল। চেনা হয়েও কেমন যেন অচেনা লাগছে। ভাবে-ভঙ্গিতে ঠাটে-বাটে সে যেন মেলাতে গিয়েও পারছে না মেলাতে। কে জানে কী আছে কার মনে! সে বিড় বিড় করে গান ধরল, ‘ও হে একবার এস শ্রীহরি। আমার এই হৃদকমলে, বামে হেলে, দাঁড়িয়ে বাজাও বাঁশরী।….’

তারপর তো সেই এক অঙ্ক। ‘একই অভিমুখে ক যাত্রা করিল ৪ টা ৩০ মিনিটে, খ যাত্রা করিল ৪টা ৫০ মিনিটে, গ যাত্রা করিল ৫টা ১০ মিনিটে; ক, খ ও গ-এর হাঁটার গতিবেগ যথাক্রমে ঘন্টায় ১০ কি.মি., ১৫ কি.মি. ও ২০ কি.মি.। মোট দূরত্ব ২.৫ কি.মি.। কে কতটা হাঁটার গতিবেগ বাড়াইলে বা কমাইলে তারা একত্রে মিলিত হইবে?’ একত্রে মিলিত হতে হলে সর্বেশ্বরকে হাঁটার গতি সর্বাধিক কমাতে হবে, ধনঞ্জয়কেও যৎকিঞ্চিৎ কমাতে হবে, হাঁটার গতি সামান্য বাড়াতে হবে ভটা ডোমকে। তাহলে তারা কোথাও না কোথাও মিলিত হতে পারবে। যথারীতি দৌড় থামিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল ভটা ডোম, সর্বেশ্বর তার হাঁটার গতি আগেই কমিয়ে দিয়েছিল, ধনঞ্জয় এইমাত্র কমাতে শুরু করল।

৫.

এতক্ষণ ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে এ-ওকে দেখে যাচ্ছিল, চেনার চেষ্টা করছিল পরস্পরকে, পরস্পর ভরসাও পাচ্ছিল এই ভেবে যে, যাক নদীবালিতে সে তাহলে একলা নয়, সঙ্গে আছে আরও দুজন! ডরভয়ের কিছু নেই। ক্রমে ক্রমে অঙ্কের নিয়মে একটা সময়ে মুখগুলি কাছাকাছি হলো, পরস্পর পরস্পরকে চিনে ফলল, সর্বেশ্বর দেখল ধনঞ্জয় আর ভটা ডোমকে, ধনঞ্জয় আর ভটা দেখল সর্বেশ্বরকে, আর তারপরই তাদের ভিতরে এসে গেল ডরভয়, শুরু হলো বুক ধড়ফড়ানি, কে জানে কী আছে কার মনে! যে ভটা ডোম এতক্ষণ জোরে জোরেই হাঁটছিল সে তার হাঁটার গতি কমিয়ে আনল। সর্বেশ্বর পিছন পিছন আসা লোকগুলোর সঙ্গলাভের জন্য একসময়ে উদগ্রীব হয়ে হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়েছিল, সে এখন জোরে জোরেই পা চালিয়ে ‘রেডি-অ্যাট-স্যাট-গো’ প্রায় দৌড়োনোর ভঙ্গী করে হাঁটতে লাগল। মাঝে পড়ে গিয়েছিল ধনঞ্জয় কুম্‌হার, সে এগোবে না পিছোবে—ভেবে পাচ্ছিল না। খানিকক্ষণ ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভটা ডোমও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে থাকল। তারা হাঁটছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় এক লাইনে একই রাস্তা ধরে, যদিও নদীবালির উপর স্পষ্ট কোনও পথরেখা ছিল না, তবু তো পায়ের উপর পা ফেলে চলতে চলতেই চলনরাস্তা একটা তৈরি হয়ে যায়। তার উপর ভরা বর্ষায় নদী যখন ডাগর, ফুলতে থাকে ফাঁপতে থাকে, ঘাটের মাঝি হংসী নাউড়ীয়া তখন ‘চড়া’ এড়িয়ে নৌকা পারাপারের একটা ‘দিশা’ বা দিক ঠিক করে, সেই মতো অস্থায়ী ঘাটও গড়ে ওঠে। নদীবালিতে ঐ অস্থায়ী ঘাটকে নিশানা করেই পায়ের ছাপ পড়ে, ছাপের উপর ছাপ, লোকজনের হাঁটাহাঁটিতে রাস্তার আড়াধাড়াও তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু সম্বৎসর তো আর নদী ডাগর থাকে না, ধানকাটা শেষে ন্যাড়া ধানবিলে কাটা ধানগাছের নাড়ায় ‘পোঙ’ গজাতে না গজাতেই, ভোরের শিশিরজল ফাঁপা ধাননাড়ার মুখে মুক্তোর মতো জমতে না জমতেই নদী ‘খালাস’ হয়ে যায়, নদীতে তখন একহাঁটু জল, ঘাটের মাঝি ঘাট থেকে নৌকা ডাঙায় তুলে উল্টে রেখে যজমানের বাড়ি বাড়ি মাগনে বেরোয়। তার আগে সে পায়ে হেঁটে নদী পারাপারের নিশানাস্বরূপ নদীজলে স্বহস্তে পুঁতে আসে বড়ো বড়ো ‘টাঁড় কলমির’ ডাল। টাঁড় কলমির জলের টানেই আগের পথরেখা মুছে গিয়ে নদীবালিতে নতুন পথরেখা আঁকা হতে থাকে। একেক বছর একেক রকম, কখনও উপরের দিকে তো কখনও নীচের দিকে। জলে নামাতে গিয়ে সামান্য এধার-ওধার হলেই হাঁটুজল থেকে ডুবজল, ডুবে যেতেও আর কতক্ষণ!

সে যাহোক, হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ধনঞ্জয় কুম্‌হার ভাবছিল—সে কী আর সামনের দিকে এগোবে? না, দলছুট হয়ে ডাইনে বা বাঁয়ে মোড় নিয়ে দৌড়োবে? এগোলেও বিপদ পিছোলেও বিপদ, কী যে দিনকাল পড়ল আর নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এমন একটা ধারণা ধনঞ্জয়কেও পেয়ে বসল। ধনঞ্জয়ের দেখাদেখি দাঁড়িয়ে পড়েছিল ভটা ডোমও, সে ভাবছিল—আজ আর ঘরে ফিরে কাজ নেই, বরঞ্চ শ্বশুরবাড়িতেই ফের রাতটা কোনওমতে কাটিয়ে কাল ভোর ভোর নির্ভয়ে নদীবালি পারাপার করা যাবে। মনস্থির করে পিছনে ফিরে দৌড়োনোর ভঙ্গি করছিল ভটা ডোম, দু-গজ দৌড়োলোও, তারপর কী ভেবে তেড়িয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, দু-পায়ে বিস্তর বালি ছিটিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। তাই দেখে ধনঞ্জয়ও আর দাঁড়িয়ে থাকল না, সামনের দিকেই চোখ-কান খোলা রেখে চলতে থাকল বেশ দ্রুতগতিতেই। পিছনের দুজনকে ঐভাবে হাঁটতে দেখে, বিশেষত ভটাকে, সর্বেশ্বর ভাবল না জানি কার মনে কী আছে! ভঙ্গি-টঙ্গি নয় সে এবার সত্যিকারেই দৌড়োতে শুরু করল—দৌড়-দৌড়—

নদীবালি যেমনকার তেমন, ধূ ধূ, নির্বিকার। নির্বিকার, নির্বিকার। যেমনকার লু তেমনই বইছে, বইছে ‘বিঁড়োল বাও’, ছোটো ছোটো ঘূর্ণি। ছাতিনা গাছের ‘দুধাল’ বোঁটাওয়ালা ভারী পাতাগুলি কিন্তু কাঁপছে না, মাঝেমধ্যে ঐ একটা-দুটো একটুখানি নড়ে উঠেই থেমে যাচ্ছে। আজ আশ্চর্যজনকভাবে তল্লাটজুড়ে নদীবালিতে ঐ তিনজন ছাড়া আর কোনও জনপ্রাণী নেই। তা-ও তো ছাড়া ছাড়া বালিখাদের অভ্যন্তরে একই সময়ে চলার ছন্দে তিনজনই নেমে গেলে আর একটাও জনপ্রাণী চোখে পড়ছে না। আলো পড়তে পড়তে ক্রমে নিভে আসছে।

৬.

গ্রাম তিনটি প্রায় এর-তার ঘাড়ের উপর, খুবই কাছাকাছি। গ্রামগুলির আসল নাম গোপন করে এখানে নকল নামই করি, এই যেমন—ডাইনটিকরি কুকুরমুড়ি আর কাঁটাপাহাড়ি। গায়ে গায়ে গ্রাম, মাঝখান দিয়ে বালিরই ‘কুলহি’ রাস্তা যেন-বা ‘ওপারে তুমি শ্যাম এপারে আমি, মাঝে নদী নীরবে বহে—।’ না এতটা সহজিয়া মরমিয়া নয় মোটেও গ্রামগুলি। হয়তো আগে ছিল, ছিল ছিল, এখন নেই। এখন কুকুর তো কুকুর, এ গ্রামের একটা শুকনো পাতাও সে গ্রামে হ্যাল্‌হ্যাল্ করে উড়ে যায় না, যেতে দিলে তো! গ্রামগুলির মধ্যে এমনই ভাবসাব, লোক-লৌকিকতা!

ভটা ডোমের গ্রামের নাম ডাইনটিকরি, ধনঞ্জয় কুমহারের কুকুরমাড়ি আর সর্বেশ্বর সিংয়ের কাঁটাপাহাড়ি। গ্রামগুলি পিছনের দিকে, কী পুবে কী পশ্চিমে টাঁড়-টিকর ‘হেঁতু’ ধানের খেত-খামার আঁটারি-চুরচু-পড়াশের ঝাঁটিজঙ্গল, ডুব্‌ক-ডুঙরি। এককালে এইসব জমি-জিরেতের ‘আলে’ ‘আলে’ কাগজের ঘুড়ি-হাতে দৌড়োচ্ছে সর্বেশ্বর, বেলের আঠায় চিটানো বারো-তেরো হাত লম্বা ঘুড়ির ল্যাজ ধরে পিছনে পিছনে দৌড়োচ্ছে ভটা আর ধনঞ্জয়, ঘুড়ি তবু উড়ছে না, ক্রমশ কাগজ চিটিয়ে চিটিয়ে ল্যাজ আরও লম্বা করা হচ্ছে, লম্বা লম্বা, ঘুড়ি খানিক উপরের দিকে গোঁত্তা মেরে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে, গ্রামেরই প্রাইমারি ইস্কুলের তিন ‘ক্লাস-ফোর’ অতঃপর তিতিবিরক্ত হয়ে ঘুড়ি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে, ঘুড়ি না উড়ুক কাগজ কুটি যে উড়ে উড়ে অনেক দূর আন্ধারি-লবকেশরপুর-থুরিয়া-কলমাপুখুরিয়ার ওদিকে চলে যাচ্ছে, আর তিন কিশোর নেচে নেচে হাততালি দিচ্ছে—এ দৃশ্য তো ডাইনটিকরি-কুকুরমুড়ি-কাঁটাপাহাড়ি গ্রামের বয়স্ক লোকেদের দেখা। ‘সেন্টার পরীক্ষায়’ একই বেঞ্চিতে বসা তিন পরীক্ষার্থী শ্লেট-পেনসিলে ল.সা.গু-গ.সা.গু-র অঙ্ক কষে গোপনে এর-তার হাতে হাতে পরস্পর পাচার করে দেয়ার ঘটনা আর কেউ না জানুক ভটা-ধনঞ্জয়-সর্বেশ্বর তো জানে। ছোটো ইস্কুল ছেড়ে বড়ো ইস্কুলের ক্লাস সিক্স পর্যন্ত একসঙ্গেই তিন জন, তারপর তো ভটা-ধনঞ্জয় ছিটকে গেল। একা সর্বেশ্বর ক্লাস টেন অবধি পড়ে গ্রামের ইস্কুলেরই মাস্টার। ধাপে ধাপে উঠে এখন তো গ্রামপ্রধান! কথায় বলে, ‘উপরে ভগবান নিচে গ্রামপ্রধান’। গ্রামেই একতলা একটা পাকা বাড়ি বানিয়েছে সর্বেশ্বর।

ভটা আর ধনঞ্জয়ের তেমন কিছু হয়নি। একজন তো গরুর দাঁত দেখে বয়স অনুমান করে, ল্যাজ তুলে দাবনায় থাপ্পড় মেরে গরুর তাকত দেখে, ‘হঁ, আইজ্ঞা’ ‘অবধান করুন’ ‘শ্রীচরণে দন্ডবৎ হই’ ইত্যাদি কথার পুলটিশ মেরে গরু কেনা বেচা করতে বিহার-ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড কাঁহা কাঁহা মুলুক না যায়! আরেক জনও কাঁধে হাঁড়ির ভার নিয়ে পূর্ণপানি, সখীসোল, পিংবনি, খয়রাশুলি, দুধপাথ্‌রি, পানিশোলা, হুমগড়, সুন্দর গেড়িয়া কতসব দূর দূর গ্রাম টঙস্ টঙস্ করে চষে বেড়ায়, হাঁড়ির ভারে কাঁধে তার কড়া পড়ে যায়। তবু চলতে থাকে, চলতেই থাকে। অচেনা কেউ যদি তার পথ আটকে জিজ্ঞাসা করে, ‘যাব পিড়াকাটা, পিঁড়রাকুলি, ভীমপুর হয়ে ধানসোলা, সিজুয়া, শর্টকাট বলতে পারো?’ সে নির্দিধায় হাত নেড়ে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেবে, ‘ঐ তো নারবরাবর সিধা’। ভটা ডোমকে জিজ্ঞাসা করতে হয় রাজ্যের নয় ভিনরাজ্যের কথা, এই যেমন বেতনুটী-ভদ্রক টাটানগর-সম্বলপুর গিরিডি-পাটনা-গয়া-রাঁচির কথা, বালিগুড়া-বেলঘর-পাকড়াঝোড়-তপ্তপানি-সিমলিপাল-বেতলা-মধুচুয়া জঙ্গলের কথা। ঘরের ধারের কথা তার তেমন জানা নেই।

ডাইনটিকরি-কুকুরমুড়ি-কাঁটাপাহাড়ি, গ্রামগুলিও হয়েছে তলে তলে তেমন। ধান রোয়ার মরশুমে ডাইনটিকরির দল বেশ ঘটা করে জোতজমিনে ধানের চারা আজ পুঁতে গেল তো কাল কাঁটাপাহাড়ির দল এসে সে চারা উপড়ে ফেলল, পরশু এসে সে জায়গায় ধানতলা লাগিয়ে গেল কুকুরমুড়ি। কুকুরমুড়ি ধান রোপন করল, বেশ হলো, ধানের চারা ফন্‌ফনিয়ে বাড়তে লাগল, বাড়তে লাগল। ধানের ‘বোয়ালি’ হালি হয়ে ধানে ফুল এসে গেল। ধানফুল ঝরে ‘আলা’ হয়ে যাচ্ছে, তার তলায় তলায় ভেসে যাচ্ছে ‘ধানাহুল’ মাছ। কুকুরমুড়ির লোকজন এসে হাঁটুতে হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে তারিয়ে দেখল প্রথম প্রথম, তারপর ‘পাটা-ঘুনি-ঝুলি’-জাল পেতে চ্যাঙ-গোড়ুই-গেঁতি-ধানাহুলু মাছ ধরল। কার্তিক মাস পড়তে না পড়তেই ধান পেকে ঝুনো হয়ে গেল, উত্তুরে হাওয়া চালাতেই ধানের শিষ ঝুন্ ঝুন্ করে বাজতে লাগল। বাজতে লাগল, বাজতে লাগল। সে আর ক-দিন! ডাইনটিকরির লোকজন এসে দলবেঁধে কুকুরমুড়ির পাকাধানে মই দিয়ে একদিন সমস্ত ধান কেটে নিল। পরের দিনই কুকুরমুড়ির দল এসে আগুন ধরিয়ে দিলো ডাইনটিকরির গ্রামে, পুড়ে ছাই হয়ে গেল মাটির বাড়ি, ধানের গাদা! সেদলে অবশ্য ধনঞ্জয় কুম্‌হার ছিল না, সে তখন সুদূর কোনও গ্রামে হাঁড়ির ভার নিয়ে—টঙস্-টঙস্—।

তবু আজ এখন এই নদীবালিতে হাঁটতে গিয়ে তার কেবলই মনে হচ্ছে— সেদিন সে দলে সে-ও ছিল—ছিল ছিল—অন্তত পিছন পিছন আসা ডাইনটিকরির ভটা ডোম কী আর সে কথা ভাবছে না? মনে হতেই ভয়ে-ত্রাসে ধনঞ্জয়ের বুকের ধড়ফড়ানি বাড়তে লাগল! বাড়তে লাগল, বাড়তে লাগল। তার উপর শুধু সে কেন, তামাম লোকই তো সন্দেহ করে ভটার সঙ্গে নাকি সেই ‘তাদের’ যোগসাজস আছে, ঐ যারা জঙ্গলে গামছায় বা কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে—। ভটার সঙ্গে কি আর পিস্তল-টিস্তল নেই? আছে আছে, চোরাগুপ্তা যেকোনও মুহূর্তেই পিছন থেকে—। ঠক ঠক করে হাঁটুদুটো কেঁপে যাচ্ছিল তার, ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না সে। অথচ হাঁড়ির ভার নিয়ে কাঁহা কাঁহা দূর দূর গাঁয়ে না সে ঘুরে বেড়ায়! লোকে ভাবে কথা চালাচালি করে সে, ‘ইনফর্মার’। ভটা ডোমও কী আর ভাবে না? ‘খোঁচড়ামি’ বা চরবৃত্তি করার অজুহাতে তারা তো হামেশাই মানুষ মারছে। তাকেও কি আজ মেরে ফেলবে ভটা? ধনঞ্জয়ের হাতের লেখা ছিল দেখবার মতো। লাইন সোজা রাখত মাছের কাঁটার মতো। কতদিন চৈতক ঘোড়ায় চড়া রানা প্রতাপ আঁকা দু-নম্বর ‘এক্‌স্‌সেরসাইজ্ বুকে’ হাতের লেখা লিখে দিয়েছে ধনঞ্জয় আর সে খাতা মাস্টারমশাইকে দেখিয়ে ‘গুড’ ‘ভেরিগুড’ পেয়েছে ভটা! ভটা রে! সেসব কি আজ তোর একটুও মনে পড়ছে না! কাঁদুল মাদুল মুখ করে ধনঞ্জয় কুম্‌হার ভাবছে—সে এখন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োবে—দৌড়োবেই—

কুকুরমুড়ির রোয়া ধান পাকলে ধানকাটার দলে ছিল না ডাইনটিকরির ভটা ডোম। সে তখন কোথায়! ওড়িশা-বিহার বা ঝাড়খণ্ডের সুদূর কোন মুলুকে গরুর চোয়াল ফাঁক করে দাঁত দেখছে! দাঁত দেখে তবেই দর কষাকষি, দু-দাঁত হলে দর একরকম, ছ-দাঁত হলে আরেক রকম। তাহলেও আজ এখন এই নদীবালিতে তার যেন মনে হচ্ছে—হচ্ছেই—ধানকাটার দলে সে ছিল—ছিলই—। অন্তত ঐ যে কী বলে ‘শ্রেণীশত্রু না ফত্রু’ ধনঞ্জয় কি আর ভাবছে না! আজ এই নদীবালিতে হাতের এত কাছে পেয়ে তাকে কি ছেড়ে দেবে ধনঞ্জয়? পাকা ধান কেটে ফেলার বদলা নেবে না? ধনঞ্জয় হাঁটার গতি যতই মন্থর করে, ভয়ে হোক ভাবনাতেই হোক, ভটা ডোমও ততই পিছিয়ে পড়ে। অনেকটাই এগিয়ে আছে সর্বেশ্বর—ঘুড়ি ওড়ানোর সময়ও সে যেমন ঘুড়ি-হাতে এগিয়ে থাকে, অনেক পিছনে ঘুড়ির ল্যাজ ধরে ভটা ও ধনঞ্জয়। ক্রমে আলো নিভে আসছে। ঝিল্‌ঝিলে আলোর বিপরীতে উড়ন্ত শৈশবের ঘুড়ি এখন মেদুর ছায়া ফেলেছে নদীবালিতে—সর্বেশ্বর-ভটা-ধনঞ্জয়-তিন জনেরই মনে।

যেকোনও মুহূর্তে যা কিছু ঘটতে পারে। নদীবালি এখনও তেতে আছে।

 

 

 

 

সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৭ পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত