| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

বঙ্গাব্দের প্রকৃত প্রবর্তক কে । অদিতি ফাল্গুনী

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

শশাঙ্ক, আকবর অথবা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৃষক জনতা: ‘বঙ্গাব্দে‘র প্রকৃত প্রবর্তক কে?

 

প্রতি বছরই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আগে-পরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও বিশেষত: নানা আন্তর্জালিক সংবাদ মাধ্যমে বা সামাজিক মাধ্যমে ‘বঙ্গাব্দে‘র প্রকৃত প্রবর্তক কে এটা নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়। ওপার বাংলার কিছু আন্তর্জালিক গোষ্ঠী যখন সপ্তম শতকের গৌড়ীয় নৃপতি শশাঙ্ককে ‘বঙ্গাব্দে‘র প্রবর্তক হিসেবে যুক্তি দিচ্ছেন, তখন এপার বাংলা সহ দুই বাংলারই লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই মোগল সম্রাট আকবরকে ইসলামী হিজরি সন (যা চান্দ্রেয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে প্রস্তÍত হয়) ও ভারত উপমহাদেশে ইতোমধ্যেই প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জীর সংমিশ্রণে ‘ফসলী সন-এর প্রবর্তক হিসেবে মান্যতা দিচ্ছেন এবং এই ‘ফসলী সনে‘র প্রথম দিন হচ্ছে পহেলা বৈশাখ- এমন একটি ভাবনাকে সমর্থন করছেন। ইতিহাসের কোন কোন সূত্র অনুসারে, আকবরের পূর্বে বাংলার সুলতান হুসেন শাহই নাকি বর্তমান ‘বঙ্গাব্দ‘ প্রবর্তন করে গেছেন। আমার এই প্রবন্ধে ব্যক্তিগত ভাবে আমি যাদের ‘বঙ্গাব্দে‘র প্রকৃত প্রবর্তক হিসেবে কৃতিত্বের অধিকারী করতে চাচ্ছি, সেই বাংলা ও উপমহাদেশ তথা সমগ্র দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৃষক জনতাকে বিজয়মালা পরানোর আগে ইতিহাসের নামী রাজা-বাদশাদের কি কারণে ‘বঙ্গাব্দে‘র প্রবর্তক মনে করা হচ্ছে সেটা সংক্ষেপে একটু বলে নিয়ে পরে নিজের যুক্তিতে আসব।

সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে যে ৫৯৩/৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সারা বছরের শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য যে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আবর্তিত হয়, আমাদের বঙ্গাব্দ সেই গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার থেকে বছরের হিসেবে ৫৯৩-৫৯৪ বছর পিছিয়ে। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে যেহেতু গৌড়ীয় নৃপতি শশাঙ্কের শাসনকালের ভেতর এই ৫৯৪ সালটি পড়ে, শশাঙ্কই প্রকৃতপক্ষে ‘বঙ্গাব্দে‘র প্রবক্তা। স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে আকবরের শাসনকাল সূচীত হবার বহু আগেই দু‘টো শৈব মন্দিরে ‘বঙ্গাব্দ‘ শব্দটির ব্যবহারের কথা বলা হয়।

প্রাচীন ভারতে ‘বেদাঙ্গ‘-এর অন্তর্গত ছয়টি প্রাচীন শাস্ত্রের একটি ছিল ‘জ্যোতিষ‘ শাস্ত্র যা ভারতীয়রা বৈদিক নানা যাগ-যজ্ঞ বা আচার-আচরণ পালনের সময় মেনে চলার জন্য আবিষ্কার করেছিলেন। বাংলার বাইরে ভারতের নানা অংশে প্রচলিত হিন্দু ‘বিক্রমী বর্ষপঞ্জী‘ বা ‘বিক্রম সংবত‘ খ্রিষ্ট-পূর্ব ৫৭ অব্দে মহারাজা বিক্রমাদিত্য প্রবর্তন করেছিলেন বলে মনে করা হয়। আজকের বাংলা বর্ষপঞ্জী ভারতের অন্য নানা প্রদেশ ও নেপালের মত এই ‘বিক্রমাদিত্য প্রবর্তিত বিক্রম সংবতে‘র কাছ থেকে প্রচুর সাহায্য গ্রহণ করেছে বলেও মনে করা হয়। কিন্তু ‘বঙ্গাব্দ‘ যদি পুরোপুরি বিক্রম সংবত‘ অনুসারীই হবে, তাহলে খ্রিষ্ট-পূর্ব ৫৭ অব্দ এবং ৫৯৩ বা ৫৯৪ সালে সূচীত ‘বঙ্গাব্দে‘র ভেতর সময়ের বিশাল ফারাক দেখা যাচ্ছে- এটা কেন?

তবে তেরো শতকের আগে বা বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের আগে যত রাজবংশই শাসন চালিয়েছে, তারা ‘বিক্রমী‘ বর্ষপঞ্জী অনুসরণ করতো। এমনকি পাল সাম্রাজ্যে প্রচলিত নানা বৌদ্ধ গ্রন্থ ও পুরাতাত্ত্বিক খোদাইকর্মেও ‘বিক্রম‘ শব্দটির ব্যবহার বা বাংলা মাসগুলোর অন্যতম ‘আশ্বিন‘ মাসের ব্যবহার দেখা যায়।

একথা সর্বজনবিদিত যে ভারতীয় সৌর বর্ষ-পঞ্জী শতাব্দীর পর শতাব্দী দিন ও মাসের নানা তারিখ গণনায় প্রায়-নির্ভুল একটি হিসাব প্রদর্শন করে আসতে সক্ষম হয়েছে। সূর্য, চাঁদ ও গ্রহসমূহের নানা আবর্তন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরিমাপের মাধ্যমে এই সৌর বর্ষ-পঞ্জী সৃষ্টি করা হয়েছিল। পঞ্চম শতকে আর্যভট্ট কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত জ্যোতিষ-শাস্ত্র বিষয়ক লেখা-পত্র, ষষ্ঠ শতকে লতাদেব রচিত ‘রোমাকা‘ এবং বরাহ মিহিরের ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা,‘ সপ্তম শতকে ব্রম্মগুপ্তের ‘খন্ডখাদয়ক‘ ছাড়াও ‘সূর্য সিদ্ধান্ত‘-এর মত জ্যোতিষ শাস্ত্র বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি গ্রন্থ পঞ্চম থেকে দশম শতকের ভেতর রচিত হয়ে থাকার কথা।

বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, আসাম এবং ঝাড়খন্ডে যে বাংলা বর্ষ-পঞ্জী প্রচলিত (বাংলাদেশে বর্ষ-পঞ্জী ১৯৮৭ সালে সামান্য সংশোধিত হয় যার প্রস্তাবনা করেছিলেন স্বয়ং বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা) তা‘ মূলত: মোগল বাদশার নির্দেশে সংস্কৃত জ্যোতিষ গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্ত‘-এর খানিকটা সংশোধিত সংস্করণ। এমনকি উদার শাসক আকবর বছরের বারো মাসের নামে অতীতের সংস্কৃত নামগুলোই বহাল রাখেন। যেমন, আমাদের বর্ষ-পঞ্জীর প্রথম মাসের নাম ‘বৈশাখ।‘ তাই বলে কি ইসলামী বা চান্দ্রেয় বর্ষ-পঞ্জীর কোন প্রভাবও এই বর্ষ-পঞ্জীতে নেই?

ঐতিহাসিকদের আর একটি অংশ আবার মনে করেন যে আজকের এই বাংলা বর্ষ-পঞ্জী প্রথম বিকশিত হয় বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেইন শাহের সময়ে (১৪৯৪-১৫১৯) এবং এই কাজে ইসলামী বা চান্দ্রেয় বর্ষ-পঞ্জী ও সৌর বর্ষ-পঞ্জীর মিশ্রণ ঘটানো হয়েছিল। তবে এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ আবার মনে করেন যে মূলত: আলাউদ্দিন হুসেইন শাহ রাজা শশাঙ্ক প্রবর্তিত বর্ষ-পঞ্জীই পুনরায় গ্রহণ করেন যেহেতু ‘হিজরি‘ বা চান্দ্রেয় বর্ষ-পঞ্জী অনুযায়ী বাংলার বারো মাসের হিসেবে কৃষকদের কাজ থেকে জমির কর বা খাজনা আদায় করা সম্ভব হচ্ছিল না। মোগল আমলে বাঙ্গালীদের কাছ থেকে শুরুতে ইসলামী হিজরি বা চান্দ্রেয় বর্ষ-পঞ্জী অনুযায়ী খাজনা আদায় হলেও যেহেতু এটি চান্দ্রেয় বর্ষ-পঞ্জী, এই চান্দ্রেয় বর্ষ-পঞ্জীর নতুন বছরের সময় আমাদের সৌর বর্ষ-পঞ্জীর চাষাবাদ-সংশ্লিষ্ট মাসগুলোর আবর্তনের সাথে মিল ছিল না। বাস্তববাদী আকবর তাই প্রতিবছর কৃষকদের ফসল ঘরে তোলার সময়ে নতুন বছরের সূচনা হিসেবে ঘোষণা করেন। এবং এই কাজে আকবর তাঁর রাজসভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ সিরাজিকে ইসলামী চান্দ্রেয় বর্ষ-পঞ্জী ও সৌর বর্ষ-পঞ্জী একীভূত করার নির্দেশ দেন। এই নতুন সংমিশ্রিত বর্ষ-পঞ্জীই ‘ফসলী সন‘ নামে পরিচিত। এভাবেই বাংলা বর্ষ-পঞ্জীর সূচনা বলে অনেকে মনে করেন। আবার প্রয়াত লেখক শামসুজ্জামান খানের মতে নওয়াব মুর্শিদ কুলি খান বাংলার মোগল সুবেদার হিসেবে প্রথম ‘পূণ্যাহ‘ বা ‘আনুষ্ঠানিক ভূমি কর সংগ্রহের দিন‘ চালু করেন এবং এই কাজেই আকবর তাঁর অর্থনৈতিক নীতির অংশ হিসেবে বাংলা বর্ষ-পঞ্জী সূচনা করেন। ইসলামী চান্দ্রেয় ও ভারতীয় সৌর বর্ষ-পঞ্জীর এই কাজটি প্রথম হুসেইন শাহ শুরু করেছিলেন অথবা আকবর সেটা নিয়ে অবশ্য খানিকটা সংশয় আছে। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, আকবরের দাপ্তরিক বর্ষ-পঞ্জী ‘তারিখ-ই-ইলাহি‘ মূলত: ১৫৫৬ সালে একটি ‘শূণ্য বর্ষ‘ হিসেবে শুরু হয়। তবে হুসেইন শাহ বা আকবর- যিনিই করে থাকুন, এই ফসলী সন প্রবর্তনের মাধ্যমে চৈত্র বা বসন্তের শেষে কৃষকের ফসল ঘরে তোলা এবং শাসককে নির্দিষ্ট মাত্রায় ভূমি কর দেবার প্রক্রিয়ায় নতুন ‘বঙ্গাব্দ‘ সূচিত হয়। ‘বাংলাপিডিয়া‘-র মতে, আকবরের পৌত্র শাহ জাহান রবিবার তাঁর পিতামহ প্রবর্তিত বর্ষ-পঞ্জীটির আরো কিছু সংস্কার করেন যার মাধ্যমে প্রতি রবিবার একটি সপ্তাহের সূচনা হয় এবং মাসগুলোর নামও পূর্বের ‘শক‘ বা ভারতীয় বর্ষ-পঞ্জীর সাথে মিলানো হয়।

‘বঙ্গাব্দ‘ অথবা দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সৌর নববর্ষ?

মজার বিষয় হলো আমরা যাকে বা বছরের যে সময়টা ‘বঙ্গাব্দ‘-এর নববর্ষ-এর সূচনা বলে মান্য করছি, সেই সময়টি (এপ্রিলের ১৪ তারিখ) শুধু বাংলা বা ভারতের কিছু প্রদেশে নয়, গোটা দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই নববর্ষ হিসেবে পালিত হচ্ছে। আমাদের এই ব্যস্ত সময়ে যখন প্যাপিরাস-ভূর্জ্জপত্র-লাইব্রেরিও নয়, হাতের কাছে চটজলদি তথ্যের জন্য ‘উইকি‘-ই সহজতম মাধ্যম, সেখানে এই নববর্ষ কে কিন্তু পশ্চিমা জ্ঞানকান্ড অনুযায়ী ‘দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-এশীয় সৌর নববর্ষ‘ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। একটু চোখ বোলানো যাক যে আমাদের ‘বঙ্গাব্দ‘ ভারত উপমহাদেশ ও উপমহাদেশ ছাড়িয়ে গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কি কি নামে ডাকা হয়? ভারতের আসামের বোডোল্যান্ডে এই নববর্ষ কে ‘বোহাগ বিহু‘ ও আসামেরই অন্যান্য অঞ্চলে ‘তাই ফাকে,‘ ‘তাই আইতন‘ এবং ‘তুরুং‘, নেপালে ‘বৈশাখ এক গাতে‘ অথবা ‘বিস্কেত যাত্রা,‘ বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় ‘পহেলা বৈশাখ,‘ উড়িষ্যায় ‘পানা সংক্রান্তি,‘ অরুণাচল প্রদেশে ‘সংকেন,‘ ‘খামতি,‘ ‘সিংফো,‘ ‘খ্যামইয়াং,‘ ‘তাংসা,‘ ত্রিপুরায় ‘বুইসু,‘ ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা ও আমাদের পাবর্ত্য চট্টগ্রামে ‘বিঝু,‘ কেরালায় ‘বিষু‘, কর্ণাটকের তামিল নাড়– এলাকাতেও ‘বিষু‘, তামিল নাড়– এবং পুদুচেরি, ভারত ও শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে ‘পুতান্ডু‘, কেরালায় ‘বিষু‘, বিহারের মিথিলা এলাকায় ‘জুর সিতাল,‘ পাঞ্জাব-উত্তর-মধ্য ভারতে ‘বৈশাখী‘ এবং শ্রীলঙ্কায় ‘আলুথ আভুরুদ্দা‘ নামে পরিচিত। এ ত‘ গেল ভারত থেকে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত অঞ্চলের নববর্ষের কথা। কিন্তু একটু দূরের লাওসের ‘পি মাই,‘ থাইল্যান্ডের ‘সংক্রাম‘, কাম্বোডিয়া বা কাম্পুচিয়ার ‘চৌল চনম থমে‘ বা ‘মহা সংক্রান্তি‘, মিয়ানমারের ‘সংক্রে‘ আর চীণের ইউনান প্রদেশের সিপসংপান্নায় ‘জল ছোঁড়ার অনুষ্ঠান‘ বা ‘দাইস‘ আয়োজনও যে অবিকল আমাদের বাংলা নববর্ষ-এর সময়ে অনুষ্ঠিত হয়- সেটা কি আকবর, মুর্শিদ কুলি খান, আলাউদ্দিন হুসেইন শাহ অথবা গৌড়ের নৃপতি শশাঙ্ক করেছেন? তাঁদের শাসনক্ষমতা কি অতটাই দূর-দূরান্ত অবধি পরিব্যপ্ত ছিল? অথবা বৃহত্তর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবহাওয়া ও জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, কৃষি ও ফসলের হিসাব অনুযায়ী এই বিপুল ভূ-খন্ডের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ অথবা কৃষকের জীবনাচারের প্রতিফলন আমাদের এই গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নববর্ষ? আমার যুক্তির এই দ্বিতীয় অংশে যাবার আগে আমি মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কাম্বোডিয়া এবং চীনের ঠিক আমাদের ‘বঙ্গাব্দে‘র সময়েই কিভাবে নববর্ষ পালিত হয়, সেটা খানিকটা সংক্ষেপে নিচে আলোচনা করছি।

সংক্রে :

ইংরেজিতে ‘সংক্রে‘ বানানটি  ‘Thingyan’ লেখা হয় বলে হতভম্ব বাঙ্গালী আমি উচ্চারণটি ঠিক কেমন হবে জানতে রামুর রাখাইন শিক্ষক ও এ্যাক্টিভিস্ট মং হ্লা প্রু পিন্টু দা‘কে ফোন করলে তিনি প্রথমে বললেন যে বাঙ্গালীদের পক্ষে এটা উচ্চারণ করাই সম্ভব নয়। তারপর বললেন বাংলায় এই শব্দের বানান হবে ‘সংক্রে‘ তবে মূল রাখাইন বা বর্মী উচ্চারণটি হবে ‘ছংগ্রে‘-র মত। ‘সংক্রান্তি‘ থেকেই শব্দটি এসেছে। বানানটি কেন ইংরেজিতে এত দূর্বোধ্য বলায় বললেন যে ইংরেজিতে ‘সুনামি‘ বানানটিও ত‘ ‘Ts দিয়ে শুরু হয়। হ্যাঁ, এপ্রিলের ঠিক মধ্যভাগেই আয়োজিত এই পার্বণে বাংলাদেশের মারমা ও রাখাইন সম্প্রদায় থেকে মিয়ানমারের বৌদ্ধ রাখাইন ও বর্মীরা এই সময়টায় সব ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালত পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা ছাড়াও এ ওর উপর পাইপে করে হোক বা বালতি কি মগ ছুঁড়ে হোক- এ ওকে জলধারায় ধুয়ে দেয়। সম্ভবত: এই সময়টা গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তীব্র দাবদাহের কারণেই পার্বণের এমন আয়োজন। মিয়ানমারে পাঁচ দিন ব্যপী চলা নববর্ষের সূচনা হয়েছিল তাগাউং রাজবংশের শাসনামলে (খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ) এবং বাগান রাজবংশের শাসনামলে (৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দ-১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) এই আয়োজন বিস্তার লাভ করে।

( ছবিতে ২০১৮ সালে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহরের নগর তোরণে নববর্ষ-এ সমবেত জনতা এবং আর একটি ছবিতে ২০১১ সালের ১৩ই এপ্রিল এক রাখাইন তরুণী পথচারীদের দিকে জলভরা পাত্র থেকে জল ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর একটি ছবিতে বর্মী ভাষায় ‘পাদাউক‘ ফুলে মঞ্জরীত গাছ দেখা যাচ্ছে এবং গাছটি আমাদের দেশের ‘রাধাচূড়া‘ গাছের মত মনে হচ্ছে। এর বৈজ্ঞানীক নাম ‘পেট্রোকার্পাস ম্যাক্রোকার্পাস‘)।


বর্মী ভাষায় এই ‘সংক্রে‘ (ছংগ্রে) শব্দটি সংস্কৃত ‘সংক্রান্তি‘ শব্দ থেকেই এসেছে যা সূর্যের মীন রাশি থেকে মেষ রাশিতে যাবার সময়কালকে বোঝায়।
(নিচে ছবিতে উনিশ শতকের একটি ‘পানি খেলা‘ আয়োজনের জল রং ছবি দেখা যাচ্ছে)।

১২৯১ সালে ‘স হ্লা উন‘ প্যাগোডায় একটি পাথরে খোদাই ছবিতে ‘সংক্রে‘-র আয়োজন দেখা যায়।

নিচের এই উনিশ শতকের জল রং ছবিতে সন্ধ্যা বেলায় বর্মী নারীরা নববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রদীপ জ্বালাতে তেল ঢালছেন।

মিয়ানমারে পাঁচ দিন ব্যপী এই বর্ষ-বরণের সময় বৌদ্ধ গৃহীদেরও শুধু ‘পঞ্চশীল‘ মানলে চলে না, রীতিমতো ‘অষ্ট শীল‘ মানতে হয়। ক্রিশ্চিয়ান ‘স্যাবাথ‘ পর্বের মত ‘উপোসথা‘ বা ‘উপোস‘ পালন করতে হয়। এই ‘উপোসে‘র শর্ত হিসেবে বেলা বারোটা বাজার আগে ২৪ ঘণ্টায় এক বার মাত্র আহার করা যায়। ভিক্ষু সঙ্ঘগুলোয় গিয়ে গৃহী জনতা ভিক্ষুদের ভিক্ষা ও নানা উপহার-সামগী প্রদান করেন এবং বুদ্ধ বিগ্রহের সামনে সবুজ কদলী পরিবৃত ডাব সাজিয়ে দেয়া হয়, সুগন্ধী জলে আলঙ্কারিক ভাবে বুদ্ধ বিগ্রহকে স্নান করানো হয়। প্রাচীন যুগে বর্মী রাজারা এসময় ‘গৌংসে কিয়ুন‘ বা ‘মস্তক ধোয়ার দ্বীপ‘ থেকে স্বচ্ছ ও পরিশ্রুত জল এনে ‘চুল ধোবার অনুষ্ঠান‘ সম্পন্ন করতেন। রাতে সঙ্গীত ও নৃত্যের আয়েজানের পাশপাশি বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি নানা কারুপণ্যের মেলা বসে। মেয়েরা এই সময়ে কোরাস গান ও নৃত্যে অংশ নেবার জন্য সারা বছর প্রস্তুতি নেয়। নতুন বার্মিজ থামি (স্কার্ট) ও চুলে ফুলের পাশাপাশি কড়া সূর্যের তাপ থেকে প্রাকৃতিক রৌদ্র-নিরোধী হিসেবে সারা মুখে চন্দন বাটা ব্যবহার করে। সত্যি বলতে পাঁচ দিন ব্যপী বর্মী বর্ষবরণের খুঁটি-নাটি লিখতে গেলে জায়গায় কুলোবে না। নববর্ষে ‘সাতুদিথা‘ নামে নববর্ষের মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের খাবার দেবার প্রথা আছে। অধিকাংশ বর্মী এই দিন তাদের মাথা বা চুল ধুয়ে বছরের ‘আবর্জনা‘ দূর করার স্বস্তি বোধ করে।

 

লাও নববর্ষ

লাও ভাষায় নতুন বছরের উদযাপন সাধারণত: ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিল থেকে ১৫ এবং ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত হয়ে থাকে। লাও ভাষায় নববর্ষ-কে ‘পিই মাই‘ বা ‘সংক্রান‘-ও বলা হয়। এই সময়টা তাদের দেশে ‘পবিত্রতম‘ সময় হিসেবে গণ্য করা হয় যেহেতু এসময়ই বৃষ্টিকালের আভাস দেখা দিতে শুরু করে- আবার এই মধ্য-এপ্রিল সেদেশে ‘সারা বছরের উত্তপ্ততম সময়‘ও বটে। এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল- দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ।‘ সেদেশে সরকারী ভাবে অবশ্য ১৪-১৬ই এপ্রিল নাগাদ নববর্ষ আয়োজন করা হয় আবার লুয়াং প্রাবাং-এর মত কোন কোন শহরে সাত দিন ব্যপী আয়োজন চলে। প্রথম দিনটিকে বিগত বছরের শেষ দিন হিসেবে ধরা হয়। এদিন লাওয়ের সব গ্রাম ও শহরে ঘর-বাড়ি জল দিয়ে ভাল করে ধোয়া হয়। সুগন্ধী, জল ও ফুলের আয়োজনে বরণ করা হয় নববর্ষকে। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনটি ‘বছরের কোন দিন নয়“ হিসেবে পালন করা হয়- এমন একটি দিন যেটি না বিগত বছরের না নতুন বছরের হিসেবে উদযাপিত হয়। শেষ দিনে নববর্ষের সূচনা হিসেবে ধরা হয়। এসময় তিন দিন সব অফিস-আদালত ছুটি পায়।

নববর্ষ
(লাওসে পি-মাই উদযাপন)

লাওসেও, মিয়ানমারের মতই, নববর্ষের আবাহনে প্রশস্ত জলধারায় ঘর-বাড়ি ধোয়া, বুদ্ধ বিগ্রহ, ভিক্ষুদের স্নান করানো সহ বন্ধু ও অচেনা পথচারীদেরও ভিজিয়ে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সসম্ভ্রমে বড়দের গায়ে জল ঢেলে দেয়, তারপর ভিক্ষুরা দীর্ঘ জীবন ও শান্তি কামনা করে সবাইকে আশীর্ব্বাদ করেন এবং সবার শেষে প্রত্যেকে প্রত্যেকের গায়ে জল ঢেলে দেয়। জলের পিচকিরিতে সাধারণত: ফুল ও প্রাকৃতিক সুগন্ধী মেশানো হয়। এছাড়া এসময় বৌদ্ধ মন্দিরে সাধারণ মানুষ বালু বয়ে এসে ‘স্তÍপ‘ বা ‘চৈত্য‘ তৈরি করে। কখনো কখনো সমুদ্র সৈকতে গিয়েও ‘চৈত্য‘ তৈরি করা হয়। পরে এই বালুর ‘স্তÍপ‘গুলো নানারকম পতাকা, ফুল দিয়ে সাজানো হয় এবং সুগন্ধী জলে ধোয়া হয়। বালুর এই ‘চৈত্য‘গুলো ‘ফৌখাও কাইলাত‘ পাহাড়ের প্রতীক যেখানে অতীতের লাও রাজা কাবিনলাফ্রোমের মস্তক তাঁর সাত মেয়ে পাহারা দিয়ে রেখেছিলেন।

এছাড়াও এদিনে লাওয়ের সাধারণ মানুষ কচ্ছপ, মাছ, কাঁকড়া, পাখি, ঈল মাছ ও এমন নানা ছোট ছোট প্রাণীদের মুক্ত করে দেয়। বুদ্ধ বিগ্রহে বা ছবিতে ফুল সাজানো ছাড়াও অপরাহ্নে বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুরা কনিষ্ঠ ভিক্ষুদের নিয়ে উদ্যানে যায় এবং ফুল তুলতে বলে। অনুজরা ফুল তুলে ‘ওয়াত‘ বা প্যাগোডায় এনে ফুল ধোয় আর যারা উদ্যানে ফুল তুলতে যায়নি, তারা ঝুড়িতে ফুল এনে বুদ্ধ বিগ্রহ সাজিয়ে তোলে। এছাড়াও লাওসের প্রাচীন রাজধানীতে ‘নাংসাংখান‘ নামে এক সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। সেখানে অংশগ্রহণকারী সাতটি মেয়ে রাজা কাবিনলাফ্রোমের সাত কন্যার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও বছরের ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা‘ বা ‘লুয়াং প্রাবাং‘-ও এসময়ই আয়োজিত হয়। এছাড়াও সনাতনী লাও সঙ্গীতের সাথে ‘মোলাম‘ ও ‘লামভোং‘-এর মত ‘বৃত্তাকারে‘ নৃত্য আয়োজিত হয় যেখানে সমাজের সবাই অংশ নেয়। বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে সবাই নতুন বছরে সুস্বাস্থ্য ও সাফল্য কামনা করে। ‘সোক দি পি মাই‘ বা ‘সৌকসান ভ্যান পি মাই‘ বা ‘সাবাইদি পি মাই‘ জাতীয় সম্ভাষণে সবাই পরষ্পরকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়।

নববর্ষ
(ছবিতে লাওবাসীকে নববর্ষের বিশেষ খাবার আয়োজনে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে)।

সংক্রান (থাইল্যান্ড)

থাইল্যান্ডে প্রতি বছরের ৯ই এপ্রিলে ‘সংক্রান‘ পড়লেও নববর্ষ উপলক্ষ্যে গোটা জাতি অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে ১৪ থেকে ১৫ এপ্রিল নাগাদ। ২০১৮ সালে থাই মন্ত্রীসভা ৯-১৬ তারিখ ব্যপী সাত দিনের আয়োজনের অনুমোদন দেন যাতে করে দূর-দূরান্তের সব নাগরিক নিজ প্রদেশ, শহর বা গ্রাম থেকে ঘুরেও আসতে পারে। থাই ভাষায় ‘সংক্রান‘-ও সংস্কৃত ‘সংক্রান্তি‘ শব্দ থেকেই এসেছে। গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হিন্দু ও বৌদ্ধ বর্ষপঞ্জী অনুসারে সূর্য এসময় মীন রাশি ছেড়ে মেষের দিকে যাত্রা করে এবং এই যাত্রা পরিক্রমনের সময়কেই ‘সংক্রান্তি‘ বা ‘সংক্রাম‘ বলে। সমাজ বিজ্ঞানীরা হালে মনে করছেন যে গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এসময়টাতেই ভিন্ন ভিন্ন দেশে ও ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় একইসময়ে নববর্ষের আয়োজন আসলে সহস্রাব্দের কৃষিজীবী এই জনপদগুলোয় বসন্তের শেষ ও ফসল ঘরে তোলার সময়কে মান্যতা দিতেই প্রবর্তিতত হয়েছে। যেহেতু গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই এপ্রিলে সূর্য থাকে প্রচন্ড চড়া, থাই চাষীরা ‘জলকেলি‘ বা ‘জলখেলা‘ এবং ‘দিনসোহফোং‘ (সাদা বর্ণ থাই কাদা) ছোঁড়ার মাধ্যমে শরীর শীতল করার আয়োজনে মেতে ওঠে। বাংলাদেশে হাজং কৃষকেরা একেই ‘প্যাক লাগানো‘ বা ‘কাদা খেলা‘ বলে অভিহিত করে।


আরো পড়ুন: বাঙালী ও পঞ্জিকা । রানা চক্রবর্তী


থাই বর্ষপঞ্জীতে ১৩ এপ্রিলকে ‘মহা সংক্রাম‘ বা ‘সংক্রান্তির শেষ দিন‘ এবং ১৪ এপ্রিলকে ‘ওয়ান নু‘ বা আগের বছর ও নতুন বছরের মধ্যবর্তী দিন এবং ১৫ই এপ্রিলকে ঠিক পশ্চিম বাংলার হিন্দু বর্ষপঞ্জীর মতই ‘ওয়ান সালোয়েং সোক‘ বা ‘নতুন বছরের সূচনা‘ হিসেবে মানা হয়। ১৪ এপ্রিল বা ‘ওয়ান নু‘ (আগের বছর ও নতুন বছরের মধ্যবর্তী দিন)-এর দিনে থাই জ্যোতিষীরা (স্থানীয়-রাজকীয় নির্বিশেষে) অর্থনীতি, কৃষি, বৃষ্টিপাত এবং রাজনীতির নানা গতি-প্রকৃতি বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করে। রাজা অথবা প্রধান রাজ জ্যোতিষী রাজার পক্ষে নতুন বছরের সূচনা জনসমক্ষে ঘোষণা করেন যাকে বলা হয় ‘প্রকত সংক্রাম‘; আর এই ঘোষনায় উল্লিখিত থাকে ‘মহা সংক্রাম‘ ‘সালোয়েং সোক‘, চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জী এবং বর্ষব্যপী বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাজকীয় অনুষ্ঠানাদির তারিখের উল্লেখ।
থাইল্যান্ডে ‘সংক্রানে‘র আয়োজনের উদ্ভব একটি লোকজ বৌদ্ধ পুরাণ থেকে যা বসন্তকাল ও ফসল তোলার সাথে জড়িত। সুবর্ণভ‚মির সুখাবতীতে এক দরিদ্র কৃষকের ঘরে বোধিসত্তে¡ও জন্ম। এসময় স্বর্গ থেকে দেবরাজ ইন্দ্র দেখতে পেলেন যে সুখবতী নগরী ছেয়ে গেছে দূর্নীতিতে, বয়োজ্যেষ্ঠদের কেউ সম্মান করা দূরে থাক উল্টো তাদের সাথে অপমানকর আচরণ করছে এবং এমনকি তাদের ঠিকমতো খাবার এবং ওষুধও দিচ্ছে না। দরিদ্র ও অসহায়দের কেউ সাহায্য করছেনা, ‘শীল‘ এবং ‘উপোসথ‘ কেউ পালন করেনা, কিন্তÍ সবাই পাপে মজা পায়, দান-ধ্যান করে না অথচ সম্পদের জন্য লোভী এবং ‘ধম্ম‘ কেউ পালন করছে না তবে ‘ধম্মে‘র ব্যবসা করছে। সব দেখে ক্রুদ্ধ ইন্দ্র বললেন, ‘ধম্মে বিশ্বাস হারালে মানুষের ‘শ্রী‘ হারায়। ধম্ম বিনা কোন ‘শ্রী‘ নেই।‘ একথা বলার সাথে সাথে সুখবতী নগর তার সব রূপ হারালো, বৃষ্টির অভাবে ও প্রচন্ড খরায় মানুষের চামড়া পুড়ে গেলা, অনাহার দেখা দিলো এবং গৃহস্থদের বাড়ির সামনে দূর্গন্ধে পরিপূর্ণ আবর্জনার স্তপ ভরে উঠলো। এই অসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বোধিসত্তে¡র নেতৃত্বে জনতা মা ধরিত্রী বা ‘শ্রী‘-র কাছে প্রার্থনা করলেন। শ্রী তখন তাদের ‘ধম্মে‘ আস্থা ফিরে পাওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং সেই সাথে তাদের দিলেন স্বর্গীয় উর্বরা জমি, স্বর্গীয় বীজ, বৃষ্টি নামানোর রহস্যময় সঙ্গীত ও কড়া রোদ থেকে বাঁচাতে দেহে মাখার নানা রঙের থানাকা রং-চূর্ণ। বোধিসত্তে¡র নেতৃত্বে মানুষ পুনরায় ‘শীল‘ ও ‘উপোসথা‘ পালনে সম্মত হলো। বোধিসত্ত¡ তখন তাঁর সহচরদের চাষের জন্য দৈবী, উর্বরা জমি ও দৈবী, উর্বরা বীজ দিলেন। রৌদ্রদগ্ধ মানুষ দেহে থানাকা রঙ-চ‚র্ণ ও জল দিয়ে তাপ এড়াতে চেষ্টা করলো। ক‘দিনের মধ্যেই জমিতে ফসল ফললো যখন কিনা ঠিক সূর্য মীন রাশি ছেড়ে মেষে যাচ্ছেন। ক্ষেতে উপুর্যপরি শস্য দানা ফললো। ফসল তোলার দিন তরুণেরা অগ্রজদের পা ধুয়ে দিল, তাদের প্রণাম জানিয়ে নানা সুস্বাদু খাবার ও বস্ত্র বিতরণ করলো। অসহায় ও দরিদ্রদের দান করা হলো এবং ‘ধম্ম‘ আবার প্রতিষ্ঠা পেল। কিছুদিন পর দেবরাজ ইন্দ্র পুনরায় স্বর্গ থেকে সুবর্ণভ‚মির দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে প্রশংসা করলেন, ‘মানুষের ‘শ্রী‘ তার ‘ধম্মে‘ এবং ‘ধম্ম‘ বিনা কোন ‘শ্রী‘ নেই।‘ তখন গোটা সুবর্ণভ‚মি আবার তার পুরণো রূপে ঝলমল করে উঠলো এবং সেই থেকে ফসল তোলার দিন গোটা শ্যামদেশে আজো মানুষ এ ওর দিকে জল ছিটিয়ে দেয় এবং নানা রঙের ‘থানাকা‘ গুঁড়ো ছুঁড়ে মারে।

থাইল্যান্ডে নববর্ষের উদ্ভব নিয়ে আরো একাধিক বৌদ্ধ জাতক রয়েছে যা স্থাণাভাবে বর্ণনা করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার ও লাওসের মত থাইল্যান্ডেও ফুল ও সুগন্ধীপূর্ণ জল ছুঁড়ে মারা ছাড়াও ‘লেডি সংক্রাম‘ বা ‘মিস সংক্রাম‘ নামের সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয় যেখানে প্রতিযোগিনীরা সনাতন থাই পোশাকে সজ্জিতা থাকেন।

থাই শাস্ত্র অনুযায়ী, ৮০০ বছর হচ্ছে ২৯২,২০৭ দিনের সমাহার আর প্রতিটি সৌর বর্ষে রয়েছে ২৯২,২০৭ ‘কম্মজা‘ বা কর্ম-উদ্ভুত দিবস এবং যেখানে এক ‘কম্মজা‘ অর্থ ১০৮ সেকেন্ড বা মূহুর্ত, সেখানে ৮০০ ‘কম্মজা‘ অর্থ একটি সৌর দিন। থাই বিশ্বাস অনুযায়ী ৩১০২ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে ‘কলি যুগে‘র সূচনা হয়েছিল। যাহোক, একটি সৌর বর্ষে ২৯২,২০৭ ‘কম্মজা‘ ৩৬৫.২৫৮৭৫ দিন থাকে যেখানে গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জীতে ২৯২,১৯৪ কম্মজা থাকে। এতে গ্রেগরীয় ও থাই বর্ষপঞ্জীর ভেতর ১৩ কম্মজা বা ২৩ মিনিট, ২৪ সেকেন্ডের ববধান থাকে এবং এর ফলে প্রতি বছর ‘সংক্রামে‘র সময় খানিকটা বদলায়। এভাবেই থাইল্যান্ডে ১৬০০, ১৭০০, ১৮০০, ১৯০০ এবং ২০০০ সালে ‘মহা সংক্রামে‘র তারিখ পড়েছিল ৭ই এপ্রিল, ৯ই এপ্রিল, ১০ই এপ্রিল, ১২ই এপ্রিল এবং ১৩ই এপ্রিল। তবে থাই বর্ষপঞ্জীতে চৈনিক রাশিশাস্ত্রের নানা প্রাণীর প্রতীক ব্যবহৃত হয়।

নববর্ষ
(ছবিতে থাই নববর্ষে বুদ্ধ বিগ্রহ পরিষ্কার করছে একটি ছোট মেয়ে। 

নববর্ষ
OLYMPUS DIGITAL CAMERA

( ছবিতে থাই নারীরা সনাতন পোশাকে নাচে অংশ নিচ্ছেন) ।

 

কম্বোডীয় বা খেমের নববর্ষ

হ্যাঁ- প্রিয় পাঠক- ধৈর্য্যচ্যুত বা অবাক হবেন না! কম্বোডীয় বা খেমের নববর্ষও ঠিক সেই ১৩-১৬ই এপ্রিল অবধি পালিত হয়। ‘চৌল চনম থমে‘ বা খেমের নববর্ষেও ‘মহা সংক্রান্তা‘ পালিত হয় ১৩ই বা ১৪ই এপ্রিল যেদিন ফসল তোলার মৌসুমে বসন্তের দিন শেষ হয়ে আসে। বৃষ্টির দিন বা বর্ষাকাল শুরু হবার আগে কৃষকেরা এসময়ই তাদের সারা বছরের পরিশ্রমের ফল হাতে পায়। খেমেররা নিছক ১৩-১৬ই এপ্রিল নয়, সপ্তাহব্যপী আয়োজনে মেতে ওঠে।

নববর্ষ
(ছবিতে খেমের পুরাণ অনুযায়ী প্রিয়াহ সোরিয়া বা সূর্যদেবতা তাঁর ঘোড়ায় টানা রথে চড়ে পুরণো বছর ফেলে নতুন খেমের বছরে পদার্পণ করছেন।)

নববর্ষ

(ছবিটিতে বয়ষ্করা সুগন্ধী জলে বুদ্ধ বিগ্রহ ধৌত করছেন)।

খেমের নববর্ষের তিন দিন ব্যপী মূল আয়োজনের প্রথম দিন হচ্ছে ‘মহা সংক্রান্তা‘ যেদিন মানুষ সুন্দর পোশাক পরে বৌদ্ধ স্তুপে দীপ জ্বালায় ও ধূপকাঠি প্রোথিত করে, প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা গিয়ে বুদ্ধ বিগ্রহের সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে। দ্বিতীয় দিন বা ‘বিয়ারিয়েক বানাবত‘-এ মানুষ তাদের সাধ্যানুসারে দরিদ্র, ভৃত্য, গৃহহীণ ও স্বল-আয়ের পরিবারগুলোকে সাহায্য দান করে। ভিক্ষু সঙ্ঘে পরিবারগুলো দান অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এবং তৃতীয় দিন বা ‘বিয়ারিয়েক লৌয়েং সাক‘-এ গৃহ থেকে মন্দির- সব স্থাপণা ধৌত করার মাধ্যমে বর্দ্ধিত আয়ু, সৌভাগ্য, সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। শিশুরা বাড়িতে বড়দের পা ধুইয়ে দিয়ে তাদের আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হয়।

নববর্ষ
(ছবিতে খেমের পরিবারের টেবিলে ফুল এবং খাবার সাজিয়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ বা শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হচ্ছে)।

এছাড়া বুদ্ধ মন্দিরগুলোয় বুদ্ধ ও তাঁর চার শিষ্য সারিপুত্ত, মোগ্গাল্লানা, আনন্দ এবং মহা কাশ্যপর জন্য বালু দিয়ে পাঁচটি ‘চৈত্য‘ বানানো হয়। এছাড়া রং মিশ্রিত জল ছোঁড়ার খেলা ত‘ আছেই। আঠালো ভাতের সাথে শীম অথবা মটরশুঁটি, কোরানো নারকেল এবং নারকেলের দুধ মিশিয়ে বাঁশের খোলে পুরে ‘ক্রালান‘ নামে এক বিশেষ প্রকার পিঠাও প্রস্তÍত করা হয়।

নববর্ষ
(ছবিতে নববর্ষের সাজে খেমের মেয়েদের দেখা যাচ্ছে)।

ক্রিড়াপ্রিয় খেমেররা এসময় নানা ধরণের ঐতিহ্যবাহী খেলা যেমন ‘চাপ কোন ক্লেং‘ বা ‘বস আংকুনহ‘ বা ‘লিক কানসেং‘ বা ‘বয় খোম‘ জাতীয় খেলায় মেতে ওঠে যার সাথে ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রচলিত নানা খেলার মিল আছে।

নববর্ষ
(ছবিতে খেমের ঢোলবাদক ও নৃত্যশিল্পীদের দেখা যাচ্ছে)।

এছাড়াও চীণের ‘দাই‘ নৃ-তাত্ত্বিক সংখ্যাকলঘু যারা থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী, তারাও ঠিক আমাদের ‘বঙ্গাব্দে‘র নববর্ষের সময়েই (১৩-১৫ এপ্রিল মূল আয়োজন হলেও আগে-পরে মিলিয়ে দশ দিনের আয়োজন থাকে) জল খেলা, পিতৃপুরুষের সমাধি পরিষ্কার করা এবং নানা সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়।

সময় সঙ্কটের কারণে শ্রীলঙ্কা সহ ভারতের নানা প্রদেশে একই সময়ে ‘নববর্ষ‘ উদযাপনের প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। এবার তবে সেই মৌলিক প্রশ্নটি মনে দেখা দেবেই: অত দূরের কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার বা চীণ অবধি কি রাজা শশাঙ্কের আদেশ ছড়িয়েছিল? বিস্তার লাভ করেছিল সুলতান হুসেইন শাহ বা মোগল বাদশা আকবেরর নির্দেশনামা? হ্যাঁ, প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ অবধি হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানেরই কিছুটা পরিমার্জ্জিত বৌদ্ধ সংস্করণ ছড়িয়ে পড়েছে মঙ্গোলয়েড ভূমির নানা দেশে। তাই এমন মিল থাকতেই পারে। কিন্তু রাজা বা ধর্মপ্রচারকরাই কি ‘জ্যোতিষ শাস্ত্র‘ বা সৌরবর্ষের তথা বর্ষপঞ্জীর সূচনা করেছিলেন নাকি এই বিপুল অঞ্চলের মৃত্তিকা-জলবায়ু-কৃষি ও কৃষিজীবী জনতার ফসল তোলার সময়ের সাথে মিলিয়ে রাজন্যবর্গকে কখনো শৈব মন্দির গাত্রে ‘বঙ্গাব্দ‘ লিখে আবার কখনো ফতুল্লা সিরাজিকে দিয়ে সৌর ও চান্দ্র বর্ষ-পঞ্জীর সম্মিলন ঘটাতে হয়েছে? আবার গাঙ্গেয় উপত্যকার সমভ‚মিতে ফসল ফলানোর পদ্ধতি আর আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার-শ্যাম দেশ-লাওস-কম্বোডিয়ার পাহাড়ি এলাকার ‘জুম‘ চাষ পদ্ধতি ভিন্ন। কিন্তু ভিন্ন হলেও বসন্ত, গ্রীষ্ম বা বর্ষার আগমন কাল একই সময়ে বলে কৃষকের ফসল তোলা ও ফসল তোলা উপলক্ষ্যে নানা আমোদ-অনুষ্ঠান নিশ্চিত একই সময়ে হয়েছে?

সত্যি বলতে গোটা বসন্ত বা চাষের ফসল ঘরে ওঠানোর সময়টিকেই যে ‘হিন্দু‘ ও ‘বৌদ্ধ‘ বর্ষপঞ্জীতে পরে রীতিমতো ধর্মীয় মান্যতা দেয়া হয়, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। যদিও এ আয়োজনের শেকড় রয়েছে কৃষিজীবী কৌম জনতার নানা আচারে। হালে সমাজতাত্ত্বিকেরাও তেমনটাই মনে করছেন। একই কথা ইরাণের ‘নওরোজ‘ বা নর্ডিক দেশগুলোয় ‘ইয়ুল‘ তথা বড়দিনের আয়োজন বা ইসরাইলে ‘পাসোভার‘ সহ নানা ধর্মীয় আয়োজনের সূচনাই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আদি কৃষিজীবী মানব সম্প্রদায়ের ফসল তোলাকে উপলক্ষ্য করেই আবর্তিত। শশাঙ্ক, হুসেন শাহ বা আকবরারও হয়তো শাসক হিসেবে নিজেদের প্রয়োজনেই অর্থনীতি ও রাজ্য শাসনের সুবাদে তাঁদের মত করে অবদানও রেখেছেন- কিন্তÍ এই ‘বঙ্গীয়‘ তথা ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ‘সংক্রান্তি‘ বা বর্ষশেষ এবং নববর্ষে‘র মূল আবিষ্কর্তা অবশ্যই এই মহা জনপদের মহানতর কৃষিজীবী সম্প্রদায়। মধ্যযুগের বা রোমান্টিক যুগের রাজা-বাদশা কেন্দ্রিক ইতিহাসের বদলে গণ-কেন্দ্রিক যে ইতিহাস রচনার দায় আমাদের সবার, সেখানে এই কৃষক ‘গণদেবতা‘কে তাঁর প্রাপ্য মূল্য বুঝিয়ে না দিয়ে আর উপায় নেই। বাকি থাকে বাংলার গরিষ্ঠ সংখ্যক ‘ধর্মান্তরিত‘ মুসলিম জনতার প্রশ্ন। বৌদ্ধ বা হিন্দু বর্ষপঞ্জী তারও ‘বর্ষপঞ্জী‘ কিনা? দুই বাংলাতেই শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্য গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যতীত হিন্দু ও বৌদ্ধদের নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য বাংলা বর্ষপঞ্জী এবং মুসলিমদের নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ‘হিজরি বর্ষপঞ্জী‘ দরকার হলেও গ্রাম-বাংলার কৃষক সহ বাংলাদেশের শহরেও গ্রাম থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিক সহ নিন্মবর্গের অসংখ্য ‘ধর্মান্তরিত‘ বাঙ্গালীও মধ্যবিত্তের মত গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর বদলে বাংলা বর্ষ-পঞ্জীকেই মান্য করে। আপনার-আমার মত ‘জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি‘ নয়, আজো বাংলা মাসের প্রায় সব তারিখ তার মুখস্থ থাকে। কারণ যুগের দাবিতে ধর্ম বদলাতে হলেও এই এলাকার কৃষি-মৃত্তিকা-অর্থনীতি-নৃ-তত্ত্ব-সংস্কৃতি আসলে অপরিবর্তিতই থাকে।
শেষ করছি কবি রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে‘-র কয়েকটি পংক্তি দিয়েই:
ওরা চিরকাল
টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,
ওরা মাঠে মাঠে
বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে-
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে।
রাজছত্র ভেঙে পড়ে; রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে;
জয়ষÍম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে;
রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত