| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: হরিয়াল উড়ে যায় । তিলোত্তমা মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 32 মিনিট

 

 

। ১ ।

ভোর হল । গাছগাছালিতে পাকাসোনা রঙের আলো ছড়িয়ে পড়ল । নদীতেও এখন থেকে অনেক বেলা পর্যন্ত, যতক্ষণ সূর্য ঢলে যাবে না পশ্চিমে, আলো জ্বলে ঝিকমিক করবে । লালগোলা সোনালি রঙের থেকে আলোর রং ত্রক্রমেই হয়ে উঠবে রুপোলি ঝিলিক । চকচকে করে মাজা রুপোর থালা-বাসুনের মতন ।

শীত ফুরিয়েছে । এই সকালে তাই অল্প অল্প হিম । নাজিমুন গায়ে মাথায় হালকা সুতির চাদর জড়িয়েছে । হিম পানিতে প্রক্ষালন করা হল এতক্ষণ । ঘুম থেকে উঠেই প্রক্ষালন করে নেয়া তার ছোটবেলার অভ্যাস । ছোটবেলায় তার আব্বাজি তাকে ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল । সেখানে পাণ্ডে মাস্টারজি তাদের স্বাস্থ্যবিধি শিক্ষা করাতেন । ঘুম থেকে উঠে প্রাথমিক কাজ প্রক্ষালন করে নেওয়া – এ তিনি মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন । নইলে, নাজিমুনের মনে আছে, তার আব্বাজি আর মা, ঘুম থেকে উঠে প্রথমে বিড়ি খেত । তারপর পান্তা বা রোটি চাপাটি খেয়ে খেতের কাজে লেগে যেত । দুপুরবেলা গোসল করার সময় নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করত তারা ।

এই মা, নাজিমুনের নিজের মা ছিল না । নাজিমুনের মায়ের নাম ছিল আশমানি বেগম । আকাশের মতো সুন্দর ছিল সে আর আকাশের মতোই দিলওয়ালি । এ কথা নাজিমুনের আব্বাজিই বলেছে তাকে । নইলে, নাজিমুনের, তার মা আশমানি বেগমকে মনেই নেই । তার যখন দু’মাস বয়স তখন আশমানি বেগমের মৃত্যু হয় । তার গায়ে রক্ত ছিল না । নাজিমুনের আব্বাজি অনেক ভাড়ালি খাইয়েছিল তাকে । নিজের বাড়ির ফলন্ত কলাগাছগুলিও সে কেটে ফেলতে দ্বিধা করেনি । তবু, লাভ কিছু হল না । আশমানি বেগমের ইন্তেকাল হয়ে গেল । আর নাজিমুন তার আব্বাজির বুকের ওপর বড় হতে লাগল । এক নয়, দুই নয়, সাত বছর সে তার আব্বাজির বুক দখল করে রেখেছিল – একা । শেষ পর্যন্ত সে নিকাহ করে আর সুরাইয়াবিবিকে ঘরে আনে ।

বাচ্চা বড় করার কাজ, ঘরের কাজ, মাঠের কাজ – সবটাই নাজিমুনের আব্বাজি একা-একাই করেছিল সাত বছর । কিন্তু এইসব কাজে সাহায্য পাবার জন্যই সে সুরাইয়া বিবিকে ঘরে আনে । যদিও নাজিমুন তখন ঘরের কাজে তার আব্বাজিকে সাহায্য করছিল আর মাঠের কাজেও অল্প-স্বল্প হাত লাগাচ্ছিল – তবু ।

তখন নাজিমুনকে ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয় । ইস্কুল থেকে ফিরে সে সোজা আব্বাজির জমিতে চলে যেত । দেখত, শক্ত-পোক্ত চেহারার সুরাইয়াবিবি জমিতে একমনে কাজ করছে । সে জমিতে পৌঁছলেই আব্বাজি তাকে কোলে তুলে নিত । মাটি-লাগা হাত ঝেড়ে ফেলবার কথাও তার মনে থাকত না । আর নাজিমুনের ফ্রক মাটি লেগে ময়লা হয়ে যেত । নাজিমুনও সেসব খেয়াল করত না । পরদিন ওই ময়লা ফ্রক পরে ইস্কুলে গেলে পাণ্ডেমাস্টার বকতেন ।

এ সবই এই ভোরবেলায় নাজিমুনের মনে পড়ে । যখন পৃথিবীতে সোনারঙের রোদ্দুর, যখন গাছপালায় বসন্তকালের আভাস, যখন সারাদিনের কাজের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পাখিরা আর সকালবেলার ফুল একটি একটি করে ফুটিয়ে তুলছে সব পাপড়ি তখন – এমনকী শীতে, শরতে গ্রীষ্মে বা বর্ষায়, নাজিমুনের ছোটবেলা মনে পড়ে, আব্বাজিকে মনে পড়ে, সুরাইয়া বিবিকে মনে পড়ে । সেই সময়কার জীবনের এক অন্যরকম গন্ধ ছিল । সব গন্ধ ভোরবেলাকার টাটকা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে এসে হাজির হয় । সে-ও, একধামা খুদ কুড়ো আর কাঁকড়িদানা নিয়ে নদীর দিকে হাঁটে । নিজের বাড়ির আঙিনাতেও ছড়িয়ে দেয় কিছু । কেননা, নাজিমুনের সাড়া পেয়েই চারটে চোরকাক আর চারটে বামুনশালিক উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে । ওদের চেয়েও বেশি আছে ঘুঘু আর পায়রা । ওরা সবই নাজিমুনের উঠোনের পাখি । ওরা ছাড়াও আরও অনেক পাখি আছে তার । বনের পাখি । ভোরবেলা নদীর ধারে নাজিমুনের জন্যই উড়ে আসে তারা । আগে নাজিমুনের আব্বাজির জন্য আসত । এখন নাজিমুনের জন্য আসে । আব্বাজিই সব পাখিদের নাজিমুনকে চিনিয়ে দিয়েছে । নদীর পারে ইটভাটার কাছেই ওরা আসে । ইটভাটার খুব কাছে আসতে চায় না । আগে আসত, যখন এটা নাজিমুনের আব্বাজির জমি ছিল । ইটভাটা হওয়ার পর নাজিমুনকে নদীর জলের লাগোয়া চ্যাপ্টা বড় পাথরটায় বসতে হয়, আর ওরা আসে । একটু একটু করে জল খায়, একটু একটু দানা । কত পাখি যে আসে ! জংলি চড়াই, লাল পেট ছাতারে, ছিট আবাবিল, ধুলোচাটা, তালচটক, ধাপার, করোটিয়া … আর আসে হরিয়াল । নাজিমুন সব পাখিই ভালবাসে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভালবাসে হরিয়াল । তিনটে-চারটে আসে ওরা একসঙ্গে । হলুদ হলুদ পা ওদের । গলাও হলুদ । কালচে মাথা আর সবুজ পিঠ । তুড়ুক পুড়ুক করে ঘুরে বেড়ায় যখন, নাজিমুনের ভেতরটা তরল হয়ে যায় । আনন্দে তরল হয়ে যায় । সে হরিয়ালদের জন্য আলাদা করে ফল নিয়ে আসে । কেননা হরিয়াল ফল খেতে ভালবাসে । গাঁয়ের বাচ্চাগুলোকে দশ-বিশ পয়সা দেয় সে । আর বিনিময়ে বাচ্চারা তাকে বট, অশ্বথ, ডুমুর আর কাঁইজল ফল এনে দেয় । তার ইচ্ছে করে, একদিন অনেক হরিয়াল উড়ে আসবে, ঝাঁক ঝাঁক হরিয়াল – আর নদীর চর হলুদে-সবুজে পাকাধানের জমিন হয়ে যাবে । যেমন আগে, ধান পাকার কালে, যখন ইটভাটা ছিল না , তার আব্বাজির জমিতে রং ধরত !

ইটভাটার দিকে দেখতে দেখতে নাজিমুন ভাবছিল – এই ইটভাটা তার কিন্তু তার আব্বাজির নয় । কেননা এই ইটভাটা তার ঘরের মানুষ ইরফানের । ইরফানের আব্বা ইফতিকার নাজিমুনের আব্বাজির কাছ থেকে জমিটা কিনে নিয়েছিল । ইটভাটা করেছিল । এক বছর পার হয়ে গেল, এই ভাটিতে আর ইট ফলে না । নাজিমুন জানে, ইরফান নতুন ভাটির জন্য জায়গার সন্ধানে আছে । এসব নিয়ে সে ভাবে না । জায়গা, জমি, সম্পত্তি, টাকা – এসব নিয়ে তার ভাবতেও ইচ্ছে করে না । ভাবার মতন কোনও পরিস্থিতিও নেই । শুধু এই পরিত্যক্ত ভাটির জায়গাটা নিয়ে ইরফান কী করতে চায় তা জানার কৌতূহল নাজিমুন নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে । কোনও কিছু সম্পর্কেই কৌতূহল প্রকাশ করতে তার ইমানদারিতে লাগে । তবু, মানুষ হিসেবে কিছু অনুসন্ধিত্সা তার থাকেই যা সে ছড়িয়ে দেয় পাখি-সন্দর্শনে, পৃথিবীতে ঋতুর আনাগোনায় আর তাদের বাড়িতে কাজ করতে আসা সায়রা ও পহেলির জীবনের বিস্তারে । তবু যে ওই জায়গাটুকু নিয়ে তার মনে মনে কৌতূহল – সে কেবল, একদা ওই জায়গার অধিকারী তার আব্বাজি ছিল বলেই । এই গোপন কৌতূহলের জন্য, সে নিজের কাছে বারংবার কবুল করেছে, তার ইমানদারি ধাক্কা খায়নি ।

 

। ২ ।

পাখিদের খাওয়া হয়ে যাবার পরও কিছুক্ষণ পাথরে পা ছড়িয়ে বসে থাকল নাজিমুন । ইটভাটা আর আব্বাজি সংক্রান্ত ভাবনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখল । রোজই, এমনই সে করে থাকে । শুধু বর্ষার কোনও কোনও দিন, সপাটে বৃষ্টি নামলে সে ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে বৃষ্টি থামার জন্য । এভাবে তখন তার ভোর গড়িয়ে যায় । সকাল, দুপুর বিকেল গড়িয়ে যায় । কোনও কোনও দিন এমন বৃষ্টি যে দিনের আলো থাকাকালীন বৃষ্টি আর কমে না, নাজিমুনেরও যাওয়া হয় না আর । সেইসব দিনে নাজিমুন দু:খী থাকে । কেউ তা বুঝতে পারে না । কারণ সেই দু:খও সে তার কৌতূহলের মতোই লুকোয় । ইরফান নাজিমুনের দু:খী মুখ দেখতে পারে না । নাজিমুনের মুখে দু:খ লেগে থাকলেই ইরফান বলে – কী হয় ?

নাজিমুন বলে – কিছু না ।

– মুখ কেন অন্ধকার ? নাস্তা করা হয় ?

– হয় ।

– ভাতের থালায় মাংস ছিল ? সব্জি ছিল ? মাছ ?

– ছিল ।

– হাতের পয়সা ফুরায় ?

– না ।

– বিন্দি ফুরায় ?

– না ।

– আলমারিতে নতুন কাপড় কয়টা ?

– পাঁচটা ।

– তবে ?

– তবে কী ?

– মুখে অন্ধকার ?

– দিল জুত পায় না ।

– আগে নাস্তা ছিল কী ? পরোটা ছিল ? সিমাই ছিল ? দুধ ছিল ? শহরের মশালা ম্যাগি ছিল ? থামস আপ ? লিমকা, মিরিণ্ডার বোতল ছিল ?

– না ।

– কী ছিল ?

– পান্তা । রোটি । চাপাটি ।

– ভাতের সঙ্গে মাংস ছিল ? মাছ ছিল ? সব্জি ছিল ? ডাল ?

– না ।

– কী ছিল ?

– পানি । পানি আর ভাত । পান্তা ভাত । অথবা নুন চাপাটি ।

– আঠা লাগানো রঙ-বেরঙের বিন্দি ছিল ?

– না ।

– কপালে কী দিতে ?

– হলুদের গুঁড়ো – সুরাইয়াবিবির পাকঘর থেকে চুরি করে । ইস্কুলের দেওয়ালের ফাটলে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে নিতাম ইটের গুঁড়ো । সুরেশচাচার দোকান থেকে এতটুকু চুন আনতাম, তাই দিয়ে হত সাদা টিপ । আর সুরাইয়াবিবি নিজের জন্য কাজল পাতত, তার থেকে একটু নিতাম ।

– হলুদ গুঁড়োর হলুদ টিপ ?

– হ্যাঁ ।

– চুরি করতি কেন ?

– হিসেবের হলুদ ছিল । মাস টানতে হত যে ।

– খেতিস তো পানি পান্তা । হলুদ দিয়ে কী করতিস ?

– তরকারিও খেতাম । তখন তোমার ইটভাটাও হয়নি যে ইটের গুঁড়ো পাব অনেক । পয়সা ছিল না যে চুন কিনব ।

– তবে ? এখন কতরকম টিপ ?

– তাই তো ।

– এখন কতরকম শাড়ি ? আগে ছিল কত ? আগে ছিল কত ?

– দুটো । গোসল করে একটা শুকতে দিতাম । আরেকটা পরতাম ।

– তবে ?

– কী তবে ?

– মুখ অন্ধকার কেন ? মুখে অন্ধকার থাকলে সংসার উজায় না । আর যেন না দেখি ।

নাজিমুন তাই মুখ আলো করে রাখে । অন্ধকার ঢেকে রাখে । ইরফানের সংসার উজায় । কিন্তু মানুষ হিসেবে নাজিমুনের কিছু দু:খ পাবার অধিকার আছে । পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাত, রুটি, কাপড়, প্রসাধন ও হাতখরচ পেলেও সেই দু:খ ধরা দেয় । আর নাজিমুন, পাখিরা চলে যাবার পর, পাথরে বসে দু:খগুলি একা একা নাড়াচাড়া করে । মুখে ইচ্ছেমতো অন্ধকার মাখে । ইচ্ছেমতো বিষণ্ণ হয় । তারপর নদীকে দিয়ে দেয় । গোগলোকে দিয়ে দেয় । গাঁয়ের লোক এ নদীকে বলে গোগলো । আসলে সে সুবর্ণরেখা । নাজিমুন সুবর্ণরেখা জানে । সুবর্ণরেখা । সুবন্নরেখা । স্বর্ণরেখা । সোনে কি ধারা । তাদের পাণ্ডেমাস্টার বলেছিলেন, গোগলো ডাকনাম, আসলে এর নাম সুবর্ণরেখা । এ নদীর বালি ছাঁকলে সোনা পাওয়া যায় । – হায় আল্লা ! … নাজিমুন বিস্ময়ে বলে ফেলেছিল । সবাই তা হলে বালি ছেঁকে সোনা নিয়ে নিচ্ছে না কেন ?

তখন তার তেরো । সাত ক্লাসে পড়ছে । আর এক ক্লাস পড়লেই এই স্কুলের গণ্ডি পুরো হয়ে যাবে, কেননা স্কুলটি অষ্টমশ্রেণী পর্যন্ত ।

এই তেরো বছর আর সপ্তমশ্রেণীর পাঠ মিলে সে দারিদ্র্যকে গভীরভাবে অনুভব করেছে ।

পাণ্ডেমাস্টার বলেছিল – সোনা এখন আর পাওয়া যায় না । এতদিন ধরে এত লোক এই বালি ছেঁকে সোনা তুলেছে যে সব সোনা শেষ ।

শুনে কষ্ট পেয়েছিল নাজিমুন । তাদের জন্য আর একটুও সোনা রইল না ?

সেদিন আব্বাজির জমি থেকে সে গোগলোর জলে চলে গিয়েছিল । গলার কাছটা ব্যথা করছিল তার, কেননা সেখানে কষ্ট জমে ছিল । তার ঠোঁট বেঁকেচুরে যাচ্ছিল । সে বলেছিল – নদী, আমাদের একটু সোনা দিয়ে দাও । আমাদের বড় কষ্ট । আমাদের গাঁওয়ের সব মানুষের কষ্ট । দু’তিন ঘর বাদ দিলে, নদী, আমরা কেউ মানুষের মতো বাঁচি না । …

তার চোখ থেকে গাল ভিজিয়ে জল পড়েছিল সুবর্ণরেখার জলে আর কষ্টের জল সমেত নদী কল কল করে ঢুকে গিয়েছিল নাজিমুনের বুকে । সেই থেকে নাজিমুনের সব কান্নার সঙ্গে, কষ্টের সঙ্গে, বুকের রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশে আছে গোগলো ।

নাজিমুন অনেকটা যেন নদী থেকে নুড়ি তোলার মতো দু:খ তুলে নেয় আর নেড়ে- চেড়ে, একটু লুফে, একটু ঠোকাঠুকি খেলে ফিরিয়ে দেয় নদীকে । শুধু, নদীর জলে হাত ভিজে যাবার মতো তার মনের মধ্যে লেগে থাকে বিষণ্ণতার রেশ ।

নদীর পার থেকে ফেরার পথে সেই রেশ সে যতখানি সম্ভব মুছতে মুছতে আসে । এবং মুখে খুশির আলো মেখে উঠোনে পা দেয় ।

 

। ৩ ।

উঠোনে পা দিয়ে নাজিমুন রোজকার মতো আজও দেখল পহেলি এসে গেছে । এ গাঁয়ের বলে পহেলি একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারে । সায়রা আসে আরও দেরি করে, কেননা তার বাড়ি পাশের গ্রামে । নাজিমুনের সংসারে কাজ করে দিয়ে ওরা পড়ন্ত বেলায় বনের পথে যায় । শালের পাতা সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরে । রাতে কেরোসিনের আলোয় বাড়ির সবাই বসে শালপাতার থালা-বাটি বানায় । সপ্তাহে একদিন মহাজন এসে কিনে নিয়ে যায় । আলাদা কোনও দাম পায় না । কেননা ওরা ঋণ নিয়েছিল । শুধছে । কোনও প্রয়োজন দেখা দিলে আবার ঋণ নেবে । আবার শুধবে ।

ওদের সামান্য জমি আছে । রুক্ষ । পাথুরে । পুরুষেরা সেগুলি চাষ করে । সারা বছরের ধানও ফলে না । গমও না । কিছু ভুট্টা ফলে । কিছু ডালের দানা পাওয়া যায় । কোনও ত্রক্রমে চলে । মাঝখানে ইফতিকারের ইটভাটায় কাজ করে ওরা কিছু কাঁচা পয়সার স্বাদ পেয়েছিল । সেই পয়সা জমেনি । মাঝখান থেকে ওরা ভুলে গিয়েছিল ইটভাটার কাজ দীর্ঘ সময়ের আয়ের উত্স নয় । ভাটি বন্ধ হয়ে গেলে আবার পুরনো কাজে ফিরে গেছে । কিন্তু বাড়তি পয়সার স্বাদ পেয়ে গেলে আগের মতো নিপয়সায় চালানো কঠিন । সুখ অতি দ্রুত মুছে দেয় দু:খের অভ্যাস । দু:খ থেকে বিনা আয়াসে সুখের কাছে চলে যাওয়া যায় কারণ দু:খের পিছুটান নেই । কিন্তু সুখের আছে । সুখের থেকে দু:খে যাওয়া বড় শক্ত ।

সুখের জন্য এখন অনেকেই জমি বিক্রি করে শহরে ঠেলা টানা কিংবা মাল বহনের কাজ করছে । সেইসব জমি কিনে নিচ্ছে ইরফান । বুড়ো ইফতিকারই তাকে এসবের পরামর্শ দেয় ।

গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে নিজের জায়গা করে নেওয়া সহজ নয় । তাছাড়া শহরের নানা চটক আছে । নেশার বস্তু প্রচুর । সিনেমাহল, ভিডিও হল, খেলা, মেলা, সার্কাস – যা আয় হয়, তার বেশিটাই এসবে উড়ে যায় । গাঁয়ে সামান্য যা পৌঁছয় তাতে দিন চলে না ।

একটু সুখের জন্য, একটু স্বস্তির জন্য আর সামান্য টাকার জন্য পহেলি আর সায়রা নাজিমুনকে এসে ধরেছিল । বলেছিল – আমাদের রাখো ।

নাজিমুন বলেছিল – আমি কি রাখার মালিক ? তারা বলেছিল – তুমিই মালিক । ইরফানমিঞা তোমার কথাই শোনে । আশেপাশের দশ গাঁ জানে তোমার প্রতি তার ভালবাসা কত গভীর !

নাজিমুন গর্ব বোধ করেছিল । সে-ও মনে মনে জানে ইরফান তাকে ভালবাসে । তার মুখের অন্ধকার সহ্য করতে পারে না । সাদি হয়েছে সাত বছর পেরিয়ে গেছে, এখনও নাজিমুনের সন্তান হয়নি । ইরফানের মা, আব্বা এবং গাঁয়ের লোক ইরফানকে নিকাহয় বসার পরামর্শ দিয়েছিল । ইরফান গায়ে লাগায়নি । নাজিমুন, নিকাহ প্রসঙ্গ শোনার পর কষ্ট পেয়েছিল । কিন্তু নদীকে কিছু জানায়নি । পাখিদেরও না । কেননা এই কষ্ট লুকোবার কোনও প্রয়োজনই তার ছিল না । ঘরের লোক নিকাহয় বসলে কোনও বৌয়েরই মনে আনন্দ হয় না । তারও হবে না এতো সবারই জানা কথা । যারা ইরফানকে প্রস্তাব দিচ্ছে তারা সব জেনেই দিচ্ছে । তবু সে, ইরফানের কাছে নিকাহর প্রসঙ্গ তোলার দায়িত্ব বোধ করেছিল । সংসারে পুরুষেরা বেশি ব্যস্ত থাকে । তাই কোনও কোনও বিশেষ কথা বলার জন্য মেয়েদের অনেক ভেবে সময় নির্বাচন করতে হয় । রাত্রে, ইরফানকে একা পাবার পর কথা তুলেছিল নাজিমুন ।

প্রত্যেক রাত্রেই নাজিমুন বেশ কিছুক্ষণ ইরফানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । এই সময়টুকু ইরফানের একান্ত প্রসন্নতার । সারাদিন বাইক ছুটিয়ে শহরে গাঁয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ইরফানকে জেদি শিশুর মতন দেখতে লাগে নাজিমুনের । নিকাহ বিষয়ে কথা বলার জন্য এই সময়টিই বেছে নিয়েছিল নাজিমুন । বলেছিল – কথা আছে ।

ইরফান নাজিমুনের কোলের কাছে সরে এসেছিল । তারপর ভারি গলায় বলেছিল – কী ?

– সবাই যখন বলছে নিকাহ বসার কথা, বসলেই তো পারো ।

কিছুক্ষণ চুপ করেছিল ইরফান । তারপর বলেছিল – সবাই যা বলবে তাই আমাকে করতে হবে নাকি ?

নাজিমুন বলেছিল – না । তা না । তবে বাড়িতে বাচ্চা না থাকলে ভাল লাগবে কেন ?

– বাচ্চা আসবে । অত তাড়ার কী আছে ?

– না, সাত বছর তো হয়ে গেল ।

– হোক । যতসব গাঁওয়ার চিন্তা-ভাবনা । জানিস, শহরে কেউই বিয়ের গায়ে-গায়ে বাচ্চা চায় না ।

– বিয়ের গায়ে-গায়ে চায় না । আমাদের সাত বছর হয়ে গেল না ? এ কী বিয়ের গায়ে গায়ে হল ? সাদির রাত পেরিয়ে গেলেই বৌ পুরানা ।

– হল তো হল । নসিবে বাচ্চা থাকলে হবে, না হলে হবে না ।

– আব্বাজান, মা … সবাই তো বংশের মুখ দেখতে চান ।

উত্তেজিত হয়ে উঠে বসেছিল ইরফান । ঝাঁঝিয়ে বলেছিল – আমি একটা মেশিন ? ইটভাটার ছাঁচ ? চাইলেই নিকাহয় বসব ? চেনা নেই, পহচানা নেই, মেয়ে পেলেই হল ?

নাজিমুনের মুখে কোনও ভাষা ছিল না । কারণ সে অনিশ্চিত ছিল । সে ভাবছিল ইরফানকে আরও জোর করবে কিনা । মানুষ অনেকসময় নিজের গোপন ইচ্ছার সাপেক্ষে জোরালো সমর্থন প্রত্যাশা করে । সেই সমর্থন আদায়ের জন্য সে অনেকসময় সেই ইচ্ছার বিরুদ্ধ মত ঘোষণা করতে সোচ্চার হয়, যাতে অন্যরা তার ওপর জবরদস্তি করে । এর ফলে সাফাই গাওয়ার বেশ একটা সুযোগ পাওয়া যায় ।

কিন্তু নাজিমুন মনস্থির করার আগেই ইরফান নরম হয়ে গিয়েছিল । ফের শুয়ে পড়ে বলেছিল – মানুষ যেমন এক জীবনে দু’বার জন্মাতে পারে না, তেমনি সাচ্চা ইনসান এক জীবনে দু,বার ভালবাসতেও পারে না । আমি তোকে ভালবাসি নাজিমুন ।

নাজিমুন হতবাক হয়ে গিয়েছিল । এটা ঠিক যে ইরফান নাজিমুনকে নিজে পছন্দ করেছিল । ইরফানের আব্বাজান কিংবা মা, কেউ-ই নাজিমুনকে বাড়ির বৌ করতে চায়নি । ইরফানের আব্বাজান ইফতিকারের আপত্তি ছিল নাজিমুনের আব্বাজির কোনও অর্থসম্পদ ছিল না বলে । আর ইরফানের মায়ের আপত্তি ছিল নাজিমুন আট ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনো করেছে বলে । তার মতে লেখাপড়া করলে মেয়েদের আখলাক যথাযথ হয় না । তারা নাপাক কর্মে জড়িয়ে পড়ে । সংসারে অশান্তির কারণ হয় ।

ইরফান এই সমস্ত আপত্তিকেই প্রতিহত করেছিল । লোকে বলে নাজিমুন পরিদের মতো দেখতে । হয়তো সেজন্যই ইরফান তাকে সাদি করার জন্য পাগল হয়ে থাকবে । কিন্তু সে- পাগলামি সাদির রাত্রি পেরিয়ে সপ্তম বছরে পৌঁছলেও বজায় থাকবে এমন প্রত্যাশা নাজিমুন করেনি । তার নসিব খুবই ভাল তাই সে ইরফানের বৌ হয়েছে – এ কথা সে জানে । তাই ইরফান চায় না বলে সে তার দু:খ পর্যন্ত নদীর কাছে রেখে আসে । প্রত্যাশার অতিরিক্ত কোনও প্রাপ্তি মানুষকে দায়বদ্ধ করে ফেলে । স্বাধীন চিত্তে, সহজে সেই প্রাপ্তি স্বীকার করা হয়ে ওঠে না । বরং সারাক্ষণ এই ভাবনপ্রক্রিয়া তাকে বিষণ্ণ রাখে যে এতসব তো তার পাবার কথা ছিল না ।

সুতরাং ইরফানের মুখে ভালবাসার কথা শুনে প্রথমে সে হতবাক হয়ে যায় । তারপর অবশ্য ঝাঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল । ইরফান তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল – তোর বুঝি কষ্ট হবে না ? আমি নিকাহ করলে ?

নাজিমুন একটু শান্ত হয়ে বলেছিল – আমার কষ্টের চেয়েও তোমাদের বংশ বেশি জরুরি ।

ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল – নিকাহ করলেও আমার সন্তান নাও হতে পারে । শহরের বড় ডাক্তার আমাকে আর তোকে পরীক্ষা করে বলে দিতে পারে বাচ্চা কার জন্য হচ্ছে না । আমার না তোর জন্য । ছেলেদের দোষ থাকলেও বাচ্চা হয় না তুই জানিস না ?

মাথা নেড়েছিল নাজিমুন । জানে ।

– তুই পরীক্ষা করাতে চাস ?

কঠিন প্রশ্ন । নাজিমুন ভাবছিল সে কী বলবে ! তার আগেই ইরফান বলেছিল – আমি চাই না । যেমন আছে থাক।

সেইদিন থেকে নাজিমুন মনে মনে বিপুল গর্ব বোধ করেছে সেইসঙ্গে অপ্রত্যাশিত আনন্দজনিত বিষণ্ণতাও । তার মানুষটা তাকে ভালোবাসে । এবং ইরফানের নিকাহ না করার সিদ্ধান্ত থেকে অন্যরাও সহজেই বুঝে গিয়েছিল যে ইরফান নাজিমুনকে দারুণ ভালবাসে । পহেলি আর সায়রা সেই সুযোগই নিয়েছিল । নাজিমুন রাতে কথা তুলেছিল ইরফানের কাছে । ইরফান বলেছিল – তা বেশ তো । কাজ করুক । কত নেবে ?

– টাকার কথা কিছু বলেনি ।

– ইটভাটায় দু’টাকা রোজ পেত । এখানে আমি মাসে চল্লিশ টাকা দেব ।

– আচ্ছা । কিন্তু আব্বাজান-আম্মাজান যদি রাগ করে ?

– সে আমি বলে দেব । তোমাকে ভাবতে হবে না । এ বরং ভালই হল । ইরফান মিঞার বিবি সব কাজ নিজের হাতে করে এ ভাল দেখায় না । শহরে আমার কোনও বন্ধুর বিবি এত কাজ করে না ।

তারপর নাজিমুনকে কাছে টানতে টানতে বলেছিল – আমার পরির মতন বিবি একটু বিশ্রাম পেলে আরও সুন্দর হয়ে যাবে । আমার শহরের বন্ধুদেরও ঈর্ষায় চোখ টাটাবে তখন ।

 

। ৪।

নাজিমুন একজন সুখী মহিলা । তার চারপাশে অন্যান্য বউদের সঙ্গে তার সুখের কোনও তুলনাই হয় না । শুধু তার যখন আব্বাজি আর সুরাইয়াবিবির কথা মনে পড়ে তখন কষ্ট হয় । এতদিন, এই সমৃদ্ধ সংসারে থেকেও তার কষ্ট থাকার কথা ছিল না । ইটভাটায় যেমন মাটি পুড়ে শক্ত ইট হয়ে যায় সেরকম তারও দু:খ-কষ্ট পুড়ে এতদিনে শক্ত ইট হয়ে যাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু হয়নি ।

তার মনে আছে সেই দিনটা, যেদিন ইফতিকার তার আব্বাজির কাছে জমিটা কিনতে চায় । সেদিন আব্বাজি আর সুরাইয়াবিবি উঠোনে মাদুর বিছিয়ে ঘন ঘন বিড়ি টানছিল । নাজিমুন তখন আট ক্লাস পাশ করেছে । তার ইচ্ছে আস্তে আস্তে ইস্কুল ফাইনালের পড়া করে । পাণ্ডেমাস্টার বলেছিলেন – তোর বাবা যদি বই জোগাতে পারে তো আমি তোকে পড়িয়ে দেব । একদিন আমার সঙ্গে ধলভূমগড়ে গিয়ে ইস্কুলে নাম লিখিয়ে আসবি, আর যখন পরীক্ষা হবে পরীক্ষা দিবি । নাজিমুনের আব্বাজি রাজি হয়েছিল । কিন্তু ইফতিকার জমিটা কিনতে চাওয়ায় সব গোলমাল হয়ে যায় । নাজিমুন বলেছিল – আমাদের জমিটাই কেন ? এ গাঁয়ে আর কোনও জমি ছিল না ?

তার আব্বাজি বলেছিল – দ্যাখ, এ জমির পরই গোগলোর চরা শুরু হয়েছে । জমি তো এখানে রুক্ষই । কিন্তু নদীর কাছাকাছি হওয়ায় আমার জমিতে রুক্ষতা কম । খোদার ইচ্ছায় আমার জমির অংশটায় কাঁকর নেই বললেই চলে । সামনেই নদী বলে জমিটার নানারকম সুবিধা আছে ।

ইফতিকার জমি চাইলে দিয়ে দিতে হয় নাজিমুনের আব্বাজিকে । না হলে ইফতিকার অনেক কিছু করে দিতে পারে । অনেক কিছু মানে কী কী ! নাজিমুনের আব্বাজি সেটা ব্যাখ্যা করেনি । সম্ভবত সেও স্পষ্ট জানত না । এটা এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত বোধ যে ইফতিকার জমি চাইলে জমি দিয়ে দিতে হয় । প্রতিষ্ঠিত বোধ বা আরোপিত বিশ্বাস । কোনও মানুষের ওপর এইসব আরোপিত বোধ বা বিশ্বাস প্রযুক্ত হলে তার পক্ষে আর নিজস্ব সত্যকে আলাদা করে দেখার উপায় থাকে না । কারণ মানুষ সর্বদা সচেতন নয় । সতর্ক নয় । সচেতন বা সতর্ক হলে তার ওপর কোনও বিশ্বাস আরোপ করা যেত না । এটা কি কোনও সামাজিক সত্য ? নাজিমুন জানে না । ব্যক্তিগত সত্য ও সামাজিক সত্য সম্পর্কে পৃথক কোনও বোধ নাজিমুনের নেই । তবু তার মনে হয়েছিল, কেন, কেন, দিয়ে দিতে হয় ?

ব্যাক্তি মানুষ যা বিশ্বাস করে তা-ই সত্য বলে জানে । সামাজিক বিশ্বাস বস্তুগত চরিতার্থতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত । কিন্তু আপাত উপলব্ধি দ্বারা তা বোঝা সম্ভব হয় না । সামাজিক বিশ্বাস ব্যক্তিমানসে এমন চতুর প্রক্রিয়ায় প্রযুক্ত যে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিশ্বাসের বিরোধ নেই – চলতে থাকে এমনই গতানুগতিক স্রোত । কোনও এক দিন কারও চোখে দুই বিশ্বাসের বিরোধ স্পষ্ট হয় । তখন গোল পাকে । ব্যক্তিমানুষ নিজস্ব বিশ্বাস আঁকড়ে, নবলব্ধ চেতনার প্রেরণায় সামাজিক গতানুগতিকতার উল্টো দিকে চলে । তার নাম বিপ্লব দেওয়া যেতে পারে কারণ বিপ্লব জনমানসে উত্সারিত হয় অনেক পরে । সবার প্রথমে কোনও-না-কোনও ব্যক্তি, একা, বিপ্লবের জন্ম দেয় ।

নাজিমুনের আব্বাজি তেমন বৈপ্লবিক না । সুতরাং তার জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল । জমিতে ইটভাটা তৈরি হয়েছিল । সেই সময়ই জমির বিষয়ে এ বাড়িতে বেশি বেশি যাতায়াত করতে গিয়ে ইরফান নাজিমুনকে পছন্দ করে বসে । নাজিমুনের আব্বাজি ইফতিকারকে জমি দিয়ে দেয় আর ইফতিকারের ছেলে ইরফানকে মেয়ে দেয় । মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ছোট্ট মাটির বাড়ি আর উঠোন ঘেরা ফলের গাছ কিছু ইরফানকে দিয়ে সুরাইয়াবিবিকে নিয়ে চলে যায় দেওঘর শহরে । সেখানে সে বেঁচে ছিল পাঁচ বছর । মাল টানার কাজ করত । মোষের বদলে মানুষ টানা যে গাড়ি, সেগুলি । বেশিদিন টানতে পারল না । অবিকল মোষেরই মতো জোরে শ্বাস ফেলেই সে নাকি ধপ করে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল । হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় । সুরাইয়াবিবি এখন লোকের বাড়িতে কাজ করে ।

নাজিমুনের এই কষ্ট । কিন্তু আব্বা আম্মা কারও চিরকাল থাকে না । তাই নাজিমুনের যে আব্বাজির জন্য কোনও কষ্ট থাকতে পারে তা কেউ ভাবতেও পারে না ।


আরো পড়ুন:মেট্রো ও মন্থন । তিলোত্তমা মজুমদার



।৫।

ইরফান বাড়ি ছিল না, এই ফাঁকে এক দুপুরে ইরফানের আম্মা বউকে ঝাড়ফুঁক করাবার জন্য ওঝা ডমরু মুর্মুকে নিয়ে এল । নাজিমুন ওঝাদারিতে বিশ্বাস করে না । সে ওঝার কাছে আসতে চাইল না । ইরফানের আম্মা রেগে গেল । নাজিমুন পড়াশুনো করা বউ বলেই তার পেটে বাচ্চা আসছে না এ-কথা চোখের জল মিশিয়ে বলতে লাগল ।

গাঁয়ের মেয়ে-বউরা সব জমেছে । পুরুষরাও এসেছে । কেননা ওঝার ঝাড়ফুঁকের সময় কোনও আবরুর চাহিদা থাকে না ।

ইফতিকার কিছুই বলছে না । যেন মেয়েদের ব্যাপারে তার কিছু বলার নেই – এমনই মুখভাব । ইরফানের আম্মার কান্নাকাটি দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল নাজিমুন । ডমরু ওঝার মুখোমুখি হল । আজকাল ওঝা গুণিনের তেমন ডাক পড়ে না । অসুখ করলে লোকে ধলভূমগড় চলে যায় । বড় অসুখ করলে ঘাটশিলা । সুতরাং ইরফানের বাড়িতে ডাক পেয়ে ডমরুর তেজ বেড়েগেছে । বিত্তশালী হিসেবে এ-গাঁয়ে ও-গাঁয়ে ইরফানের এমনিতেই জোর । তার ওপর ইদানিং সে পার্টির টিকিট নিয়েছে । পার্টির লোকেরা ওঝা-গুণিনের বিরুদ্ধে খুব প্রচার চালায় ।

ডমরু নাজিমুনের চারপাশে তিনপাক ঘুরল । তারপর বলল – হুঁ । জটিল রোগ । পাঁচ বছর, চারমাস, তিনদিন, দু’ঘন্টা, এক মিনিট আগে ভূতের হাওয়া লেগেছিল । পুরনো রোগ । কিন্তু তার জন্য কোনও ভয় নেই । ডমরু ওঝা কোনও ভূতকে পরোয়া করে না । ভূত ছেড়ে গেলে দেখবেন আপনার আঙ্গিনা বাচ্চাময় হয়ে যাবে ।

দু’হাতে ডুগডুগি বাজিয়ে হু র র র ফট ফট বলতে বলতে তিনবার লাফ মারল সে । নাজিমুনের উঠোনপাখিরা ভয়ে গাছের উঁচু ডালে চড়ে বসে পাখা ঝাপটাতে থাকল । ডমরু তিনবার আভূমি প্রণত হল । নাজিমুন দেখল ডমরুর চোখ দুটি লাল হয়ে উঠেছে । তার ভয় ভয় করতে লাগল । মনে মনে খোদার কাছে মোনাজাত দিল সে যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে ইরফান । তখন ডমরু হাঁক দিল – এই মেয়ে, বস এখানে ।

বসে পড়ল নাজিমুন । উদাসীন । গা-ছাড়া । ডমরু একজন মহিলাকে বলল নাজিমুনের খোঁপা খুলে দিতে । তিনটি মেয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল নাজিমুনের ওপর । নির্দয়ভাবে খোঁপা খুলে দিল তারা । নাজিমুন যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল । ডমরু ওঝা দুটি শালপাতায় ফুঁ দিয়ে পড়ল –

জায়লেকা জায়লেকা জায়লেকা

শালপাতা দুটি উড়িয়ে দিল শূন্যে । আবার অন্য দুটি পাতা নিয়ে তেল মাখিয়ে শুরু করল –
তেল তেল রায় তেল
মান তেল কুসুম তেল
ই তেল পড় হায়েতে
কি উঠো, ডান উঠো
ভূত উঠো, যুগিন উঠো
বিষ উঠো, কে পড়াহে
গুরু আজ্ঞা মাত্র পড়াহে
আম্মো ডমরু কইলাম ভূত
তু বেটা পেত্নির পুত …

তখন মোটরবাইকের শব্দ শোনা গেল । ইরফান ফিরছে । মুহূর্তে হালকা হয়ে গেল ভিড় । ডমরু তখন সর্ষে পোড়াচ্ছে । সঙ্গে শুকনো লংকা । বাতাস করে ধোঁয়া পাঠিয়ে দিচ্ছে নাজিমুনের দিকে । নাজিমুন কাশছে । কাশতে কাশতে দম আটকে আসছে তার । ইরফান বাইক রাখছে । সে-ও কাশছে । সে চিত্কার করছে – কী হচ্ছে এসব ? কী করছ ? নাজিমুন ?

ইরফানকে দেখামাত্র নাজিমুনের কান্না আসছে । সে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কাঁদছে । ইরফানের আম্মাও কাশছিল । ইরফান পহেলিকে আদেশ করল – যাও, জল আনো ।

তার কন্ঠস্বর ঠাণ্ডা । কঠিন পহেলি জল নিয়ে এল । ডমরুর আগুনে জল ঢেলে দিল ইরফান । বলল – আর এক সেকেণ্ড যদি তোমাকে এ-বাড়িতে দেখি তবে পুলিশে দেব ।

ডমরু বলার চেষ্টা করল সে স্বেচ্ছায় আসেনি । কিন্তু ইরফানের কোনও কথা শোনার ধৈর্য ছিল না । সে শীতল চোখে তাকাল আরেকবার । ডমরু পায়ে পায়ে বেরিয়ে গেল উঠোন থেকে । ইরফান দু’ হাতে তুলে নিয়ে গেল নাজিমুনকে । তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ডাকল – মা !

ইরফানের আম্মা তৈরিই ছিল । ঝাঁঝিয়ে বলল – অত চ্যাঁচাচ্ছিস কেন ? যা করেছি তোদের ভালর জন্যই ।

ইরফান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল – আমাকে না জিজ্ঞেস করে আর আমার ভাল করার চেষ্টা কোরো না মা । তোমরা জানো আমি পার্টির টিকিট নিয়েছি । বাড়িতে ওঝা ডেকে আমার সর্বনাশ করেছ তুমি । আমাকে আর আমার বউকে নাঙ্গা করে দিয়েছ গাঁয়ের লোকের মধ্যে ।

ইরফানের আম্মা কাঁদতে বসল – এমন বউ-আঁকড়া ছেলে আর দেখিনি বাবা । তা-ও যদি একটা বাচ্চা পয়দা করত …।

 

।৬।

ওঝা আসার পর দু’দিন কোথাও যায়নি নাজিমুন । ভোরে পাখিদের কাছেও না । পাখিরা এসে তাকে খুঁজে খুঁজে ফিরে গেছে । সে শুয়ে থেকেছে চুপচাপ । খোদার কাছে হয়তো-বা একটি সন্তান প্রার্থনা করেছে সে, কিংবা তা-ও নয় । সে, এমনই বিকল হয়ে ছিল যে প্রার্থনা পর্যন্ত ইচ্ছা করেনি । ইরফান এই বৈকল্যকে দোষ দেয়নি । এমনকী কোনওরকম জোর করে নাজিমুনকে স্বাভাবিকতায় আনার চেষ্টাও করেনি ।

নাজিমুন জানে গোগলোর ধারে ধারে এইসব গ্রাম এখনও ওঝা-গুণিনে ভরসা করে । আগের চেয়ে অনেক কম, তবু করে । বিশেষত, যাদের দিন চলে না, তারা চিকিত্সকের ব্যয় সমঝে নেবে কী প্রকারে ? অতএব ওঝা-গুণিনরা বিচেকলার রস, তেঁতুল, বাসক, নিম আর কুসমির গোড়া দিয়ে ; ডুমুর, আমলকি আর বহেড়া দিয়ে দিব্যি ওষুধ বানিয়ে রাখে । লুণ্ডা-ঝার.ংআ এখন আর চলে না তেমন । শুধু গুণিনকে অপেক্ষা করতে হয় – কখন মানুষের চূড়ান্ত বেদনা জাগে, চূড়ান্ত অসহায়তা নামে কার ! যমের চতুর্দোলা এলে কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের ওপর ঝাড়ন-মারণ-উচাটন বিধি প্রয়োগ করে বাড়তি রোজগার ও বাড়তি মর্যাদা পাবার জন্য এখন তাদের তেমনই অনন্ত প্রতীক্ষা যেমন ডালে ডালে শকুনেরা শবদেহ অপেক্ষা করে ।

নাজিমুন নিজেকে তেমনই শবদেহ কল্পনা করে মৃতবৎ ছিল । বা জড়বৎ । তিনদিনের দিন তার মনে হরিয়াল উড়ে আসে । সে বুঝি বা শোকগ্রস্ত এমনই ভঙ্গিমায় শোক শুষে নিতে তারা ঠোঁট এগিয়ে দেয় । নাজিমুন ছটফট করল তখন । গোগলোর পারে যেতে ইচ্ছে করল তার । পাখিদের সঙ্গ ইচ্ছে করল । ইটভাটা দেখতে ইচ্ছে করল । ধীরে ধীরে প্রাণ ফের ইচ্ছের পথ বেয়ে শরীরে পৌঁছেছিল । তাই ভোরবেলা পার করে দিল সে বিছানাতেই কিন্তু ইরফান কাছে টানল যখন, আর পাথর থাকল না । ইরফানের বুকের কুচি কুচি চুল তাকে কিছু নরম আরাম দিল । ইরফানের কর্মঠ আঙুল তার শরীরকে প্রতুল প্রশস্তি দিল । যেন কোনও মনস্তাত্ত্বিকের গোপন ওষুধ – এমনভাবেই ইরফানের স্বর স্পর্শ করল তাকে – বিবিরে, কষ্ট মনে রয়ে যায়, না ? আমি বুঝি ।

নাজিমুন নিরুত্তর থাকছে কিন্তু আরও একটু ঘন হচ্ছে তার নাসিকাগ্র, ইরফানের বুকের রোমরাজিতে ।

– আর কষ্ট পায় না । আমার বিবিজান … আমার আদরের বউ … আমার ফুলটুসি – আজ উঠে পড়ো বিবিজান । আজ উঠে পড়ুন বউঠাকরুণ । তুই উঠোনে না হাঁটলে আমার ভাল লাগে না । তুই আমার নাস্তা-পানি না দিলে ভাল লাগে না । তুই কথা না বললে ভাল লাগে না । তোর মুখ অন্ধকার ভাল লাগে না রে, লাগে না রে, লাগে না …!

নাজিমুন, ইরফানের বুক থেকে সরে আসছে, দু’হাতে আপন ভার সামলে উঁচু হল । মুখ দেখছে ইরফানের । না, চোখ দেখছে । না চোখের মণি দেখছে । না, চোখের মণিতে কার মুখ তা-ই দেখছে । কার মুখ ? নাজিমুন ? তোর মুখ ? হরিয়ালরা নাজিমুনকে প্রশ্ন করছে -ইরফানের চোখের মণিতে তোর মুখ ? তোর ? জানি না, কীরকম অন্ধকার মতো দেখলাম।

– অন্ধকার ?

– হুঁ ! অন্ধকার ?

– কালো ?

– হুঁ ! কালো !

– আলো দেখার চোখের মণি – সেই মণিতে অন্ধকার ?

– হ্যাঁ । অন্ধকার । তবে অন্ধকারের মাঝবিন্দুতে আমারই মুখ থাকবে ।

– তোরই মুখ ?

– হ্যাঁ । আমারই । ইরফান আমাকে ভালবাসে । আশে পাশে দশটি গাঁও জানে ।

দুপুরে গোসল করার সময় পহেলি নাজিমুনের চুলে সাবুন মেখে দিল । এই সাবুন ইরফান শহর থেকে এনেছে । এখন, পহেলি গল্প করে, ধলভূমগড়েও পাওয়া যায় । সায়রা নাইলনের ঝিকরি দিয়ে নাজিমুনের গোড়ালি ঘষে দিল । এই ঝিকরি ইরফান শহর থেকে এনেছে । সায়রা বলে, ধলভূমগড়ে এ জিনিস পাওয়া যাবে না । এর জন্য তোমাকে যেতে হবে ঘাটশিলা ।

দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ হল । ইরফানের আম্মা নাজিমুনের সঙ্গে কথা বলছে না । নাজিমুনও কথা বলার চেষ্টা করছে না । তাইতে ইরফানের আম্মার ক্রোধ বিপুলতর হয়েছে । আর নাজিমুন উঠোনের একপ্রান্তে চুল মেলে বসে আছে । চুল শুকোচ্ছে । উঠোন না বলে এ দিকটাকে বাগান বলাই ভাল । বাড়ির পিছন দিক এটা । উঠোনে দাঁড়ালেও এ দিকটা দেখা যায় না । কারণ উঠোন আর এই বাগানের সীমানায় গোরুর পোয়াল গাদা করে রাখা । এখানে বসে নাজিমুন চুল শুকোয় । আচার করে । সেউ বানিয়ে রোদ্দুরে দেয় । সায়রা আর পহেলি তার সঙ্গে থাকছে এক বচ্ছর যাবৎ । আজ নাজিমুন কোনও কাজ করছে না, তাই সায়রা আর পহেলিও বসে আছে । কথা বলছে । সায়রা তার বরের কথা বলছে । ধলভূমগড়ে একটা ধাবায় মিস্ত্রির কাজ করছে । ধাবা পাকা হচ্ছে । দালান হচ্ছে । তার কাজ । আসলে মিস্ত্রি না, জোগালির কাজ । সায়রার পনের বছরের ছেলে তার বারো, দশ, সাত আর পাঁচ বছরের ভাইবোনদের নিয়ে তাদের সামান্য জমি চষার চেষ্টা করছে । তাতে লাভ কিছু হচ্ছে না । পাথুরে জমি । জায়গাও কম । কোনও দিন ভাল ফলন দেয়নি । তার ওপর সারা দিন মাঠে কাজ করে বাচ্চারা আর শালপাতার বাসন বানাতে পারছে না । ঘুমিয়ে পড়ছে । বাচ্চাদের বাবা রোজ ফিরছে মদ খেয়ে । আগে মাঝে-মধ্যে খেত । এখন রোজ খাচ্ছে । রোজগারের পয়সা মদে ফুঁকে দিয়ে খালি হাতে ফিরছে । ঘরের চাল ফুটো হয়ে গিয়েছিল । মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল সায়রা চাল সারাই করবে বলে । সে টাকা শুধতে পারছে না । ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে ।

নাজিমুন শুনছে । শুনতে শুনতে সব মুখস্থ তার । দারিদ্রের গল্প তার কাছে নতুন নয় । তবে তার আব্বাজিকে এভাবে ঋণে জড়িয়ে পড়তে হয়নি । মদ সে-ও খেত ঠিকই, তবে তা মাঝে-মধ্যে । আর মদ খেলেই আব্বাজি নাজিমুনকে তার ছোটবেলার গল্প শোনাত । ফুলডুংরির গল্প শোনাত । আর গল্প শোনাবার সময় খুব হাসত । তখন তার ঘোর লাগা শরীরের গিঁটগুলি কেঁপে কেঁপে উঠত । বাত্সল্যের গভীর ও চিরন্তন প্রক্রিয়ায় চোখ দুটি উজ্জ্বলও হয়ে উঠত । নাজিমুন লজ্জা পেত তখন আর সুরাইয়াবিবি মজা পেত । তারা দু’জনেই জানত আব্বাজি এখন কী বলতে চলেছে !

আব্বাজি বলত – কী বিচ্ছু ছিলিরে তুই । তোকে নিয়ে জমিতে যেতাম । মাঝে মাঝে এমন বায়না করতিস, আল্লার কিরা , ইচ্ছে করত তোকে শালগাছের ডগায় চড়িয়ে আসি । সে আর পারলাম কোথায় । উল্টে তোকে বুকে সাপটে নিতাম । বিচ্ছু বদমাস তুই । আমার মাই বুকে নিয়ে সে কী হাঁচড়-পাঁচড় । আরে বোকা, বুদ্ধু কাঁহিকা, বেহুদা লেড়কি, মরদের মাইতে কি আর দুধ থাকে রে … ।

এই কথাগুলি উচ্চারণ করত যখন, নাজিমুনের আব্বাজিকে উদাস লাগত । হয়তো আশমানিবিবিকে তার মনে পড়ত । তার ঠোঁটের পাশ দিয়ে নাল গড়াত । দু’চোখে পানির বানভাসি । জলে-নালে যেন গোগলো আর গঙ্গা ।

নাজিমুন দেখল পহেলি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে । সে যে সায়রার গল্প শুনতে শুনতে হারিয়ে গেছে আর অন্যমনস্ক হয়ে গেছে – তাই দেখে হাসছে । পহেলি সাঁওতালদের মেয়ে । খুব হাসে । হাসলে ওকে খুব সুন্দর দেখায় । পহেলির গল্পও, নাজিমুন জানে, সায়রার থেকে আলাদা নয় । ওদের গল্পের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে নাজিমুন । এবং কষ্ট পায় ।

মানবসত্তা, তাত্ক্ষণিকতা থেকে সার্বিকতায় সহজে মুক্তি পায় না । বহু অবস্থান্তরের জীবনকে সার্বিক গ্রহণ না করে মানবচেতনা একটি বিশেষ সময়কালে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখে । একটি নির্দিষ্ট সময়ের আমিত্বকেই কেবল জগতের সঙ্গে সচেতনভাবে সংযুক্ত করতে সমর্থ হয় । সত্তার অখণ্ডতা তার নিজের কাছেই সহজে গ্রহণীয় হয় না । নিজেকে নিজের মধ্যে খণ্ডিত করে যে-কোনও একটি খণ্ডের মধ্যেই সে আমিত্ব সমর্পণ করে বসে । অনেকটা পুতুলের দোকান থেকে পুতুল খরিদ করার মতো ।

নাজিমুন এই খণ্ডিত আমিত্বের অধিকার । দারিদ্রের মধ্যেই সে নিজেকে পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে । তার সাদি ও ইরফানের বাড়ির নিশ্চিত নিরাপদ জীবন সে আচরণ করে মাত্র । একমাত্র ইরফানের ভালবাসাই তার কাছে আচরণের বাইরে গভীর গ্রহণযোগ্যতা পায় ।

 

।৭।

মাস পেরিয়ে গেল । বসন্ত গ্রীষ্মের দিকে ঝুঁকে আগুন বর্ণ পেয়েছে । রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে আর বসা যাচ্ছে না । বাগানের পূর্বদিকে একটি কিশোর কুসুমগাছের নীচে সায়রা আর পহেলিকে নিয়ে বসেছিল নাজিমুন । গাছটার গোড়ায় উই লেগেছে । তাদের গাঁয়ে, জঙ্গলে, গোগলোর দু’পার ঘেঁষা বনে গাছেদের প্রাণ শুষে নেয় ওইসব উই । পহেলি বলছিল – আগে ওসব ছিল না । পরে হল ।

– কী ছিল না ?

– উই । এখানে উই ছিল না ।

– ছিল না তো এল কী করে ?

– ফুলডুংগি পাহাড়ে বাস করত বোঙ্গা আর মারাংবুরু । ভাল লোকেরা তাদের দেখতে পেত । একদিন একটা সাদা আদমি পেলেনে চড়ে নামল ধলভূমগড়ের পেলেনের ইস্টিশনে । নেমেই এখানকার যত পাহাড় – সব চষতে লাগল । ফুলডুংগা পাহাড়ে যেই চড়তে গেল, আমাদের গাঁওশুদ্ধু কেঁপে উঠল । তখন তো আমার জন্ম হয়নি । আমার বাপেরও না । কিন্তু যারা থাকত এখানে শুনল এক ভয়ঙ্কর স্বর ।

– কী স্বর ? কার ?

-বোঙ্গার স্বর । বোঙ্গা বলল, ওই সাদা আদমিকে আটকাও । কেউ আটকাও । কে আটকাবে ? সাদা লোকটার কাছে বন্দুক । তখন বোঙ্গার স্বর বলল, আমরা তোদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি । তোরা আমাদের ফুলডুংগা পাহাড়কে অপবিত্র হতে দিলি । আমরা চলে গেলেই তোদের সব গাছে পোকা লেগে যাবে । সব গাছ ধ্বংস হয়ে যাবে ।

– তারপর ?

– শোঁ শোঁ হাওয়া বইল । উড়ে গেল । গাঁয়ের লোক ক’দিন পরে দেখল গাছের তলায় উইয়ের বাসা ।

– ওরে বাবা !

– এই গোগলো এরকম ছিল না । এই মাটিও এরকম ছিল না । এত পাথর, বালি ছিল না ।

– কী ছিল ?

– তখন গোগলোর বালিতে সোনা ছিল, সোনা, বালি ছাঁকলে সোনা পাওয়া যেত ।

– হ্যাঁ । পাণ্ডেমাস্টারজিও এ কথা বলতেন ।

– গায়ের মানুষ কিন্তু কখনও সোনার লোভ করেনি । তারা শুধু চাষবাস করত । তখন মাটি ছিল অন্যরকম । নদীর চরা থেকে সোনা নেবে কি, জমিতেও তখন সোনা ফলত । ধান, গম, ডাল, ভুট্টা । যে যা চাইত তাই ।

– তারপর ?

– মারাংবুরু বলল, আমিও চলে যাচ্ছি তোমাদের ছেড়ে । আর তোমাদের নদীতে সোনা মিলবে না । আর তোমাদের জমিতে ধান-গম ফলবে না । আর তোমরা সুখে-শান্তিতে থাকবে না । তোমাদের দুনিয়াতে জজমবঙ্গা লেগে থাকবে চিরকাল ।

তিনজনেই স্তব্ধ হয়ে থাকল । সেই একটা সাদা আদমির জন্য কতই-না ভোগান্তি । কত যুগ ধরে সেই বোঙ্গা আর মারাংবুরুর অভিশাপ সকলকে কষ্টে রেখেছে ।

নাজিমুন বুঝে পাচ্ছিল না বোঙ্গা আর মারাংবুরুকে বিশ্বাস করবে কিনা । সব লোকেরই আলাদা আলাদা খোদাতাল্লা আছেন । তাদের খোদা । পহেলিদের বোঙ্গা, মারাংবুরু । পাণ্ডেমাস্টারজিদের বজরঙ্গবলী, রাধা-কিষুন । আলাদা আলাদা ঈশ্বর অথচ দেখো, অভিশাপ সবার লেগে বসে আছে ।

সায়রা বলল – তবে সেই এনজুবাবু বলল, এখানে মাটি চিরকালই এরকম । বই-কিতাব পড়েছে, তাতে লিখা আছে । কেউ এই মাটি ভাল করার চেষ্টাও করেনি । এনজু বাবুরা করবে ।

নাজিমুন প্রশ্ন করল – এনজুবাবু কে ?

সায়রা আর নাজিমুন বিস্মিত বলে – ও মা ! তুমি জানো না ? ইরফানমিঞা কিছু বলেনি তোমাকে ?

– না ।

– জিজ্ঞেস করে নিয়ো ইরফানমিঞাকে । সেই তো এনজুবাবুকে বাইকে চাপিয়ে দশ গাঁ ঘোরাচ্ছে ।

– পাট্টির লোক ?

– পাট্টির লোক না । ইরফানমিঞা তো বলল, কোনও পাট্টির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই এনজুবাবুর । গাঁয়ের লোকের ভাল করতে এসেছে, তাই ইরফানমিঞা তাকে একটু সুবিধা – সাহায্য দিচ্ছে ।

– তা হলে গরমিন্টের লোক ।

– না । গরমিন্টের লোকও না । ব্যাঙ্কের লোক । টাকা দিবে ।

– ব্যাঙ্কের লোক ? এখানে ব্যাঙ্ক কোথায় ? টাকা কাকে দেবে ?

– হ্যাঁ, হ্যাঁ, ব্যাঙ্কের লোক । আমরা তো ভাল বুঝি না । তোমাকে ইরফানমিঞাই সব ভাল করে বুঝিয়ে দেবে ।

– টাকা দেবে কাকে ?

– আমাদের ।

– তোদের ?

– হ্যাঁ, আমরা যারা মহাজনের কাছে ধার করি তাদের দেবে ।

– তোদের এমনি এমনি টাকা দিয়ে দেবে ? কেন রে ? কোনও বদ মতলব নেই তো ?

– না, না । বদ মতলব থাকলে ইরফানমিঞা ওকে নিয়ে দশ গাঁও ঘুরে বেড়াবে কেন ?

– তা-ও ঠিক ।

পহেলি বলল – আর টাকা তো এমনি এমনি দিচ্ছে না । আমাদের কাজ করার জন্য দিচ্ছে । সুদও নেবে । তবে অনেক কম সুদ ।

সায়রা বলল – হ্যাঁ । রোজ একটাকা করে শোধ করতে হবে । ঋণ দেবে একশো টাকার মধ্যে । রোজ একটাকা করে শোধ করতে হবে । প্রথমবার ঋণ শোধ করলে আবার দেবে । এক বছর ধরে ঠিক ঠিক কাজ করতে পারলে বাড়িঘর ঠিকঠাক করার জন্য বেশি টাকাও দেবে । আমি তো ভাবছি এক বছর কাজ করে টাকা নিয়ে বাড়িটাকে বানিয়ে নেব । আর একটা পাকা পায়খানা করব । তোমাদের মতো ।

নাজিমুন পহেলির দিকে তাকাল । পহেলি মুখ নিচু করল । নাজিমুন জিজ্ঞেস করল – তুই নিবি না ?

বিষণ্ণ মুখ তুলল পহেলি । বলল – ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলব ।

– কী বিষয়ে ?

– এই, এই বিষয়েই । টাকা নেওয়া উচিত কি না ।

নাজিমুন হঠাৎ এই দুই মেয়ের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব বোধ করতে থাকল । যেন তারা, এতকাল নাজিমুনের ঝি-স্তরীয় নয়, তার বান্ধবীই ছিল । যেন তারা, নাজিমুনকে না জানিয়ে কোনও বাড়তি আস্বাদনে ব্যাপৃংঋত থাকছে । নাজিমুনকে বঞ্চিত করছে । অথবা, সায়রা আর পহেলি যুক্তি করে নাজিমুনকে একা ফেলে চলে যাচ্ছে কোথায় । নাজিমুনের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।

কেন ? মনখারাপ কেন ?

নাজিমুনের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হল ।

কেন ? কেন ? কেন ?

নাজিমুন, কীরকম সে একলা মানুষ, বোধ করতে করতে উঠে দাঁড়াল চুপচাপ । পহেলিকে বলল – মুরগিদের আটা মেখে দে, আজ আমিই খাওয়াব । আটার সঙ্গে হলদি মাখতে ভুলিস না ।

সায়রাকে বলল – শুকনো কাপড়গুলো তুলে ভাঁজ করে দে ।

সায়রা আর পহেলি যে-যার কাজ করে বনের দিকে চলল । শীত থেকে পাতাঝরার কাল পড়ে । বসন্ত পর্যন্ত গড়ায় । এ সময় ওদের কাজ বেশি । কিন্তু পাতা ঝরে পড়লে কুড়িয়ে নেওয়া মানেই কাজ ফুরোয় না । পাতা বেশি শুকিয়ে গেলে কাজে লাগে না । শুধু আখা ধরানো যায় । থালা-বাটি বানাতে গেলে মচমচ করে ভেঙে যাবে । গাছ থেকে কাঁচাপাতা পেড়ে বানাবে যে, সে-ও হবে না । ঘরে শুকনো পাতা তেমন পোক্ত থাকে না ।

নাজিমুন মুরগিদের খাওয়াতে প্রস্তুত হয় । তার আগে একবার গোয়ালের পাশ থেকে ঘুরে আসে । দুপুরের রান্নাবান্না সারা হলে পড়তি আঁচে জাবনা বানায় সায়রা । গোয়ালের পাশে সিমেন্টের বড় গামলায় ঢেলে রেখে যায় । মাঠ চষে ফেরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত বলদ বা বন চষে ফেরা গাভীগুলি হামলে জাবনা খেয়ে ঘরে ঢোকে । নাজিমুন সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নেয় । আর এই কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে তার মনে পহেলি ও সায়রার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ উত্পাদিত হয় । আর সেই বিক্ষোভ, ত্রক্রমে, বহিরাকাশে ছড়িয়ে যায় । এক বিরাটকায় হাহাকার দৈত্য নাজিমুনের মধ্যে বসে ঠা ঠা করে হাসে । লম্বা চাবুক আছড়ায় শালগাছের গায়ে । শালপাতা ঝরে পড়ে । বৃক্ষের শরীর ঝলসে যেতে চায় । আত্মপ্রসাদে হুম হুম করে বসন্তের উড়নি ধরে টান দেয় দৈত্য আর কুসুমগাছে পড়ন্ত রোদের রং লাগে ।

নাজিমুন ওই পড়ন্ত রোদ্দুর দেখল তখন । তার হৃদয়ের বিক্ষোভের থেকে সে গৃহকত্রীসুলভ গর্ব আবাহন করল । যেন পরদিন, সায়রা আর পহেলি এলে, আর সে গল্প-গুজব করবে না । একটি নতুন বাছুর নাজিমুনকে ঘিরে উঠোনময় লাফ-ঝাঁপ করল । নাজিমুন আটার মণ্ডগুলি পাকাতে পাকাতে হাঁক দিল – আ: আ: ট্টি ট্টি ট্টি ট্টি …! যাবতীয় মোরগ-মুরগি ছানাপোনা সমেত ছুটে এল তখন । নাজিমুন গর্বিত হতে চাওয়ার সংকল্পে গাম্ভীর্য অভ্যাস করতে করতে আটার গুলি ছড়িয়ে দিতে থাকল । মুরগিগুলি হামলে পড়ছে । কে কার আগে যাবে । কে কার আগে নেবে । উঁচু কালো চিত্রল মোরগটি মাথা দুলিয়ে সাবধান করছে সবাইকে – না: না: না: না: … … এরকম আদেখলেপনা করিস না । সে অন্য মুরগিদের ঠুকরে দিচ্ছে । দাঁড়া, দাঁড়া, যাদের ছানাপোনা আছে তারা খেয়ে নিক । সে নিজে কিছু খাচ্ছে না । মোরগঝুঁটি ফুলগাছের তলায় খুঁটে খুঁটে কিছু পোকামাকড় সংগ্রহ করছে । তার মাথার রক্তাভ জবাফুলটি দুলছে । ফুটি-ফুটি মুরগি তার কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসল – কোঁক কোঁক কোঁক … … আপনি কিছু নিন মহারাজ । সুস্বাদু আটার গুলি দু’এক টুকরো মুখে দিন । এমন সব অনুরোধ, ঠেলা তো যায় না । হেডমোরগ দু’এক গুলি খেলেন । হ্যাঁ, তা বেশ, চমত্কার খেতে । আর আটার গুলির সঙ্গে এতে হলুদের কুঁড়ো মেশানো আছে । হলুদকুঁড়ো মুরগিকুলকে রোগতাপ থেকে রক্ষা করে থাকে ।

মুরগিদের এইসব রকমসকম আর ছুটোছুটি দেখতে দেখতে বিক্ষোভ ভুলে গেল নাজিমুন । তার আঙিনায় পহেলি আর সায়রার মতো মানুষের যে হরদম আনাগোনা, সে যে এক বিত্তশালী মানুষের বিবি আর মর্যাদাসম্পন্ন মানুষের বউ, তার যে কিছু বাড়তি গর্ব ও গাম্ভীর্যকেই পাঁচজনে সঠিক ভাববে, এ কথা আর তার মনে রইল না । শুধু এক করুণ বিষণ্ণতার দাগ লেগে থাকল । কেননা, সে ভেবে দেখল, পাতার বাসন বানিয়ে ধার শুধতে গেলে, আর সে-ধার যদি মহাজনের কুটিল ধার না হয় তা হলে সায়রা আর পহেলি সে-কাজেই নিজেদের ব্যাপৃত রাখবে । ওই কাজই তাদের দেবে যাবতীয় আয় এবং কাঁচা পয়সার ভবিষ্যতের সন্ধান । সুতরাং তার বাড়িতে ফরমায়েশি খাটার প্রয়োজন আর ওদের থাকবে না । তখন সে কী করবে ? ওরা আসার আগেকার একলা দুপুরে যাবে । এবং, এই একাকীত্ব তার অভিপ্রেত নয় । সে, অতএব, তার আব্বাজির গৃহে থাকাকালীন সেই পুরনো দারিদ্রের কাছে নতজানু হয় । তাকে প্রার্থনা করে । দারিদ্র প্রার্থনা করে যাতে স্বপ্ন দেখতে পায় । হরিয়ালের স্বপ্ন ছাড়া, একটি সন্তান আসবে এমন স্বপ্নও তার মধ্যে খুব গাঢ়ভাবে বাস পায়নি । দারিদ্র, সে জানে, পরস্পর সংবদ্ধ বহু স্বপ্নের জন্ম দেয় । সেই স্বপ্নই গরিবের সম্বত্সরের সম্পদ । নাজিমুনের আব্বাজি যেমন ভাবত – এ বছর একটু ভাল বৃষ্টি হলেই জান লড়িয়ে দেব । ভাল আবাদ করব । ফলন ভাল হলে আর ভাবনা নেই । মেয়ের জন্য গয়না গড়াব । নতুন করে চাল ছাইব । ভাল সার কিনব জমির জন্য । আরও ভাল বীজধান । নসিব যদি খুব ভাল থাকে, তবে, আরও কিছু পয়সা যদি আসে তবে, বলদ কিনে নেব একখানা । ইফতিকার মিঞার বলদ আর ভাড়া করতে হবে না । ভাড়ার টাকাটা বাঁচবে । সেই টাকা আর খরচ করব না । ডাক আপিসে একটা জমা-খাতা খুলব । অল্প অল্প করে জমালে একদিন অনেক টাকা হবে । … কত স্বপ্ন ! টাকা জমানোর স্বপ্ন ! তারপর, অনেক টাকা জমে গেলে, টাকা খরচ করার স্বপ্ন । বসন্তের এই ভর সন্ধ্যায়, নাজিমুন, এক গরিবের মেয়ে, এক পয়সাওয়ালা ইমানদার মানুষের বিবি, স্বপ্নের জন্য দরিদ্র হয়ে যেতে চায় আর মনে মনে স্থির করে, রাত্রে, ইরফান এলে সে এনজুবাবুর প্রসঙ্গ তুলবে ।

 

।৮।

রাত্রে, ইরফানের চুলে বিলি দিতে দিতে প্রশ্ন করল নাজিমুন – এনজুবাবু কে ?

– এনজুবাবু না, এন জি উ বাবু ।

– কে ?

– তুই কোথা থেকে জানলি ?

– সায়রা বলছিল ।

– হ্যাঁ । এনজিউবাবু খুব ভাল লোক । আমাদের এই জায়গায় গরমিন্ট তো কিছু করল না, তাই এনজিউবাবুদের কোম্পানি এখানকার মানুষকে সাহায্য করতে চায় ।

– এমনি এমনি ?

– হ্যাঁ । ফরিন থেকে ওদের টাকা আসে । ডলার । অনেক টাকা । দুনিয়ার যেখানে যত গরিব লোক আছে, সবকে ওরা সাহায্য করবে । এটাই ওদের কাজ । আমার পাট্টি ওদের সাহায্য করছে । ভাল কাজ তো । মানুষের সাহায্যও হল, আর পাট্টির পয়সাও লাগল না । পাট্টি যদি গরমিন্ট পেয়ে যায় তখন অনেক কাজে লাগবে এই এনজিউবাবুর সাহায্য ।

নাজিমুন চুপ থেকে বিলি কেটে যাচ্ছিল । অনেক ভাবনা আসছিল তার মনে । এইসব এনজিউবাবুরা আরও আগে যদি আসত, তার আব্বাজি বেঁচে থাকার সময় … । ইরফান চোখ বন্ধ করে আরাম খেতে খেতে বকে যাচ্ছিল – শুধু মেয়েদেরই দেওয়া হবে এই ঋণ । পুরুষদের নয় ।

– কেন ?

– কারণ মেয়েরা ঋণ শোধ করবে । মরদগুলো তো টাকা পেলেই ওড়াবে । মদ খাবে । জুয়া খেলবে । ফুর্তি করবে ।

নাজিমুন, হঠাতি, যেন এক মুহূর্ত আগেও জানত না সে কী বলতে চলেছে, বলে ফেলল – আমাকে দেয় না ?

– তোকে ? কী ?

– আমাকে ঋণ দেয় না ?

আরামের বন্ধ চোখ খুলে ফেলল ইরফান । বলল – কাছে আয় নাজিমুন ।

ইরফানের পাশে শুয়ে পড়ল নাজিমুন । বলল – আমার ইচ্ছা হয় ।

– কী ।

– আমাকেও ঋণ দেয় ।

– কী করবি ঋণ দিয়ে ?

নাজিমুন চুপ করে থাকল । সঙ্গত প্রশ্ন । কী করবে সে ঋণ নিয়ে ? সে জানে না । এই ঋণ পাওয়ার মধ্যে, নারী হিসেবে, একজন স্বাধীন মানুষের উপস্থাপনা আছে, হতে পারে এটুকুই তাকে লুব্ধ করেছে । ইরফান নাজিমুনকে জড়িয়ে নিল । বলল – শাড়ি কিনবি ?

– না ।

– বিন্দি কিনবি ?

– না ।

– সুরমা কিনবি ?

– না ।

– গন্ধ সাবান, তেল, ক্লিপ ?

– না, না ।

– জুতো ? জামা ? বাহারি ক্লিপ ?

– না, না, না ।

– চাল-আটা কিনবি ? মাছ-মাংস ?

– না ।

– ফিল্ম দেখতে যাবি ? ট্রেনে চেপে বেড়াতে যাবি ?

– না । না । আমি জানি না । কিচ্ছু, জানি না । কী করব জানি না ।

ইরফান, নাজিমুনকে আরও সাপটে নিতে থাকল । তার কানে ঠোঁট চেপে বলল – তোকে ওরা ঋণই দেবে না ।

একটা ঝাঁকুনি খেল নাজিমুন । ইরফান তাকে বলতে থাকল – তুই আমার বিবি । ইরফানমিঞার বিবি । ইরফানসাহেবের বিবি । তোর কি টাকার অভাব ?

 

।৯।

পার্টি সহায়তা দিলে কী হবে, দশ গাঁওয়ের যে বড় মসজিদ তার মৌলবিসাহেব বলে বসলেন, মেয়েদের এইরকম ঋণ দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয় । কারণ এতে মেয়েদের আখলাক ঠিক থাকবে না ।

মেয়েরা যখন ইটভাটিতে কাজ করতে গিয়েছিল তখন মৌলবিসাহেবের কোনও আপত্তি দেখা যায়নি । তখনও মেয়েরা খোলা আকাশের নীচেই শ্রম দ্বারা অর্থোপার্জন করেছিল । হতে পারে যে ইফতিকারসাহেবের ইটভাটা হওয়ার দরুন মৌলবিসাহেব আপত্তিকর কিছু খুঁজে পাননি । ইফতিকারসাহেব এই ক’বছর আগেও প্রায়ই মসজিদে আসত এবং বরাবরের মতো মৌলবিকে খুশি রাখত । কিন্তু ইরফান মৌলবিকে পাত্তা দেয় না । অতএব এনজিউবাবুর কাজে মৌলবিসাহেব আপত্তি খুঁজে পেয়েছেন । ইরফান নিজে কথা বলতে গিয়েছিল দু’বার কোনও ফল হয়নি । সায়রার মতো পহেলিও ঋণ নেবে মনস্থ করেছিল । মৌলবি আপত্তি করায় গোটা ব্যাপারটাই থমকে গেছে । এনজুবাবু বেছে বেছে ঋণ দিতে নারাজ । সে গরিবকে সাহায্য করতে এসেছে । কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের গরিবকে নয় ।

সায়রা আর পহেলির মতো আরও অনেক মেয়ে এই ঋণের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে স্বপ্ন জড়িয়ে ফেলেছিল । প্রত্যেকেরই নিজের নিজের মতো কাজের পরিকল্পনা তৈরি । সায়রা আর পহেলি ঋণ পেলেও নাজিমুনের কাজ ছাড়বে না । ওরা শুধু নাজিমুনকে অনুরোধ করেছে যেন ওদের দুটোর মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয় । কেননা এনজুবাবু বলেছেন তাদের সামগ্রী তারা নিজেরাই বিক্রয় করতে পারে । তাই বেশি করে থালা-বাটি বানিয়ে তারা রোববারে ধলভূমগড়ের হাটে গিয়ে বেচে আসবে । নাজিমুন রাজি । ইরফানও । কেননা এটা ইরফানেরও কাজ । বাড়ির ঝিকে এত বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে ইরফানের আম্মা ইরফানের আব্বার কাছে গজগজ করছিল । তাতে ইফতিকার বলেছে – দিনকাল বদলাচ্ছে । সেইমতো চলতে হবে ।

যে-অভাব এতকাল সায়রা ও পহেলিদের ভবিষ্যত্কে অধিকার করে ছিল সে-অভাব নিয়ে তাদের কোনও বাড়তি প্রতিক্রিয়া ছিল না । কিন্তু এনজুবাবুর দেওয়া সম্ভাবনা অতি দ্রুত সেই অভাব প্রতিস্থাপিত করে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠা করেছে । সেই স্বপ্নগুলি এত প্রিয়, এত মানবিক অধিকারের দ্যোতক যে এই স্বপ্নের থেকে মুখ ফেরাতে কেউ রাজি ছিল না ।

পুরুষরা খুব বেশি স্বপ্ন দেখেনি কারণ তাদের নামে ঋণ দেওয়া হবে না এই ঘোষণা কিছু অপমান ও বিক্ষোভের সঞ্চার করেছে । ইদানিং পুরুষরা মাতাল হয়ে এই ঋণ নিয়ে স্ত্রীদের উত্যক্ত করছে । কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েই বদ্ধপরিকর । বিশেষত যারা ইটভাটায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল । কিন্তু মৌলবির বিরুদ্ধে কেউ সরব হতে সাহস করছিল না প্রায় একমাস যাবৎ । দেখতে দেখতে গ্রীষ্মের মধ্যভাগ এসে গেল । ইরফানের বাড়ির টিনের চাল তেতে উঠল । এ-গ্রামে একমাত্র ইফতিকারের বাড়িই পাকা । গাঁয়ে বিদ্যুৎ নেই বলে পাখা লাগানো সম্ভব হয়নি । দারুণ গরম । নাজিমুন যখন ভোরবেলা পাখিদের কাছে যায়, তখনই একমাত্র স্নিগ্ধতা অনুভব করে । এই গ্রীষ্মে তার হরিয়ালের সংখ্যা দুটো বেড়েছে ।

ইরফানের বাড়ির পূর্বকোণে আঙিনার ওপর একটি আতাগাছ, তার ডালে বুলবুলিরা খুশিতে নেচে বেড়ায় । টিনের চালের তলা দিয়ে বেরিয়ে থাকা কাঠের কোনায় পায়রা আর পায়রানি গা ঘেঁষাঘেষি বসে আদরের অভিযোগ তোলে পরস্পর – তুমি কতক্ষণ ছিলে না … হুমম তুমিও তো উড়ে বেড়াচ্ছিলে … কত্তম্‌ কত্তম্‌ কত্তম্‌ … কে হারে কে জেতে, এই গরমের কাল, তাই আর কথা না বাড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে বসে থাকছে তারা । দিন যাচ্ছে । কুবোপাখি ডিম পেড়েছিল, তার ছানা হয়েছে । গাছের কোটর পেলেই সাদা সাদা ডিম পাড়ছে পুঁটিয়াল ধনেশ । আর সায়রা এর বাড়ি ওর বাড়ি যাচ্ছে । তার স্বপ্নের জন্য সে শলা করছে । গরমে তার গায়ে ঘামাচি । শরীর রোগা ডিগডিগে । পরনের কাপড় ছেঁড়া । শুধু মাথার খোঁপাটি মস্ত । আর তার খোঁপার মতো মেঘ যেদিন আকাশে সেদিন নাজিমুন দেখল এই সকাল থেকে দলে দলে মেয়েরা এসে জমা হচ্ছে ইটভাটায় । পাখিদের খাইয়ে ফিরছিল সে । কিছু বুঝতে না পেরে ভিড়ের কাছে দাঁড়াল একটু । তাকে দেখে ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সায়রা । বলল – আজ দুপুর নাগাদ আসব তোমার কাছে ।

নাজিমুন জিজ্ঞেস করল – তোরা সব এখানে কেন রে ?

– আজ আমরা মৌলবিসাহেবের কাছে যাচ্ছি ।

– কেন ?

– কথা বলতে ।

– কী বলবি তোরা ?

– জানি না । আগে যাই তো ।

– আগে বলিসনি তো ।

– ইরফানমিঞার বারণ ছিল ।

– কেন ?

– পাঁচকান হলে যদি ভেস্তে যায় !

– ও ।

– তোমাকে বলিনি বলে রাগ কোরো না, বরং আমাদের জন্য দোয়া করো ।

নাজিমুন চুপ করে রইল । দেখল চারপাশ । রাগ নয়, বরং কীরকম কষ্ট হল তার । চারপাশে কত কিছু চলছে । সেসবে তার কোনও ভূমিকা নেই । সে, ইরফানের সুখী বিবি, আর আব্বাজির দু:খী কন্যা, সে শুধু আটার গুলি পাকিয়ে মুরগিদের খাওয়াবে ।

তাকে চুপ থাকতে দেখে সায়রা বলল – তোমার নসিব ভাল, ভাল মানুষ পেয়েছ । সত্যি বলছি, ইরফানমিঞার মতো মানুষ হয় না । এই মানুষের ভালবাসা পেয়েছ তুমি । আমাদের নসিব দেখো । খোদা একটা সুযোগ করে দিল তো মৌলবি বাদ সাধছে । ইরফানমিঞা ঘাটশিলার পুরনো মসজিদে গিয়ে কথা বলে এসেছে । ওই মসজিদের মৌলবি বলেছে, এটা কোনও অন্যায় হচ্ছে না ।

– তবে ?

– এনজুবাবু মানবে না, বলে আপত্তি যখন একবার উঠেছে তখন না মেটা পর্যন্ত কাজ শুরু করা যাবে না ।

অন্য মেয়েরা, নাজিমুনকে যারা চেনে না, তারা ফিসফাস করছিল । দেখে নিচ্ছিল ইরফানসাহেবের বিবিকে । নাজিমুনও বুঝতে পারছিল তাকে সবাই দেখছে । এই যাত্রায় ইরফান উপস্থিত নেই কিন্তু সে সর্বত্রই আছে । নাজিমুনের, ইরফানের বিবি হিসেবে বেশ কিছু গর্ববোধ হল । এক পলক চোখ বন্ধ করে সে দেখতে পেল হাজার হাজার হরিয়াল । উড়ছে । চক্রাকারে । যেন এখুনি এসে বসবে নাজিমুনের চারপাশে । সে চোখ খুলল । সায়রা বলল – ফিরে এসে বলব তোমাকে কী হল ।

দাঁড়িয়ে থাকল নাজিমুন । দেখল, নদীর পাড় ঘেঁষে সার বেঁধে মেয়েরা চলেছে ।

 

।১০।

শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় দুপুর পার করে ফিরল সায়রা । পহেলি আর নাজিমুন তার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল । সায়রা ঘেরা-কলে গিয়ে গোসল সারল । খেল । তারপর নাজিমুনের কাছে বসল । নাজিমুন বলল – বল কী হল ।

– সে অনেক কিছু । মৌলবিসাহেব তো প্রথমে দেখাই করতে চায় না । তখন, ইরফানমিঞার কথামতো আমরা খুব হল্লাচিল্লা করলাম ।

– তারপর ?

– মৌলবিসাহেব এল । বলল, আমার কথা না শুনলে আল্লা তোদের কোনও দিন কৃপা করবে না । আমি বললাম, বেশ তোমার কথা শুনব । আগে বলো তোমার আপত্তিটা কোথায় ? সে বলে – অনেক আপত্তি । আমরা বলি, কীসে আপত্তি ? ঋণে ? সে তো আমরা আগেই নিয়েছি । সে বলে – না, ঋণে না । তাহলে কাজে ? কাজ তো আমরা জন্ম থেকে করছি । সে বলে – না কাজে না । একজন অচেনা লোক বলল ঋণ দেব, আর সব দেব ওই মেয়েছেলেদের – এটা কেন ? আমরা বলি, আমরা কাজ করতে পারি আর ঋণ নিতে পারি না ? বলে – পারিস, তবে একটা আনজান লোক । তোদের ভালর জন্যই বলি । আমরা বললাম, বেশ, ওর কাছ থেকে নেব না । কিন্তু তুমি তো আমাদের খুব চেনা, টাকাটা তা হলে তুমিই দাও । লোকটা তখন পিছু হটতে লাগল । বলে – তোদের ভাল হলেই ভাল । তবে কিনা অজানা লোককে চট করে বিশ্বাস করতে নেই । আমরা বললাম, সে ইরফানসাহেবের লোক । তাকে তো আমরা চিনি । তখন বলে কি – ইরফানের লোক ? তা হলে তো কোনও কথাই নেই । যা যা বাড়ি যা, এ কথা আগে বললেই হত !

 

।১১।

প্রাণীমাত্রই জীবনযুদ্ধে হার মানে না । সামান্য কীটানুকীট থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের থেকে মানুষের পার্থক্য এই যে, জীবনযুদ্ধের হাঁচোড়-পাঁচোড় করা অন্যান্য প্রাণীদের ইচ্ছাধীন নয়, তাদের সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক নিবন্ধ । কিন্তু মানুষের যুদ্ধ-প্রবণতা প্রাকৃতিকমাত্র নয় । এই যুদ্ধ মানুষের ইচ্ছাধীন । ইচ্ছে হলে জীবনের জন্য কোনওরকম প্রয়াস সে নাও করতে পারে । ইচ্ছে করলে নিজের মৃত্যু বা ধ্বংসের কারণ সে হতে পারে নিজেই । আবার, ইচ্ছে করলে, জীবনকে সহজতর করার যুদ্ধের গতি বাড়িয়েও দিতে পারে মানুষ ।

সামান্য আর্থিক সাহায্য ইরফান ও তার চারপাশের গ্রামগুলিতে একটি আপাত অনুচ্ছল পরিবর্তনের সূচনা করল । এই পরিবর্তনের উদ্ভাস দেখতে, এনজিউবাবুর কথামতো ইরফানকে অপেক্ষা করতে হবে আরও দু’বছর । হিসেব মতো তার ঠিক এক বছর পরই ভোটের মরশুম ।

পহেলি নাজিমুনের কাজ ছেড়ে দিয়েছে । ও এখন নিজেই ধলভূমগড়ের হাটে যায় । সায়রা আসে । ও ছেলেকে হাটে পাঠায় । নিজে যায় না । সায়রার বরের মদ খাওয়া কমেনি । আগের মতোই নিজের কামাই উড়িয়ে দিচ্ছে সে । সায়রার এখন আর কিছু যায় আসে না । ও আর ওর ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট উপায় করতে পারছে । কিন্তু নাজিমুনের কোনও পরিবর্তন নেই । শুধু তার পাখিদের সংসারে একজোড়া নতুন পাখি এসেছে – তার নাম হরবোলা । সবুজ রং । হলদে কপাল আর বেগুনী গলা । ছোট্ট বাঁকা ঠোঁট । বেশ পাখি !

নাজিমুন লক্ষ করেছে, দিনকতক খুব ঝিমিয়ে আছে সায়রা । সে ভাবছিল একবার জিজ্ঞেস করে । কিন্তু জিজ্ঞেস করার আগেই দুপুরবেলায় সায়রা বলল – মনটা ভাল নেই ক’দিন ।

– কেন ?

– এত খাটলাম এতদিন ধরে যে একটা ঋণ শোধ করলে এনজুবাবু বাড়ি করার ঋণ দেবে । সে আর হল না ।

– কেন ?

– বলছে ঋণ আমার নামে হবে, তাই জমিও আমার নামে লিখে দিতে হবে ।

– বরকে বল ।

– সে কি আর দেবে ? মেরে আমার হাড় ফাটিয়ে দেবে ।

– একবার বলেই দেখ না । যদি না দেয় না দেবে । বুঝিয়ে বলবি । চেষ্টা করতে দোষ কী !

নাজিমুনের উপদেশ মেনে সে-রাত্রেই ঘরের লোককে জমি লিখে দেবার কথা বলল সায়রা । প্রথমেই লাফিয়ে উঠল তার বর । হুঙ্কার পাড়ল – কী ? জমি লিখে দেব তোর নামে ? এত খাঁই তোর ?

সায়রা ঝাঁঝিয়ে উঠল – কেন ? দিলে কী হয় ? ভাল ঘর হলে কি তাতে আমি একা থাকব ? তুমি থাকবে না ? তোমার ছেলেমেয়েরা থাকবে না ?

– কী বললি ? ঘর দেখাচ্ছিস ? ঘর ? যত বারফট্টাই । তাও বুঝতাম যদি পাকাবাড়ির পয়সা দিত ।

– পাকা বাড়ি ? পাকাবাড়ির ঋণ শুধতে পারবে জীবনে ? না হোক পাকা বাড়ি, এই যা হবে এও তো তুমি জোটাতে পারোনি ।

দিতে না পারার খোঁটা মারাত্মক । এতে পুরুষ জখম হয় । এই জখম থেকে সে ত্রক্রুদ্ধ হতে পারে, আবার বিবাগীও হতে পারে । সায়রার ঘরের পুরুষ ত্রক্রুদ্ধ হল এবং পরদিন যখন সায়রা কাজে এল তখন মার খেয়ে তার চোখ মুখ ফুলে গেছে । চোখের তলায় কালশিটে । নাজিমুন বুঝল । কোনও প্রশ্ন করল না । সায়রাও কিছু না বলে মুখ নিচু করে কাজ করল । দুপুর নাগাদ জ্বর এল তার । নাজিমুন তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল ।

এরপর চারদিন কাজে এল না সায়রা । নাজিমুন খোঁজ নিয়েছিল । সায়রা জ্বর নিয়ে শুয়ে আছে । ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল নাজিমুন । সায়রার অসুস্থতার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছিল তার । কিন্তু সায়রা যেদিন কাজে এল সেদিন সব অস্বস্তি কেটে গেল নাজিমুনের । সায়রার মুখের ফোলা কিছু কমেছে । কালশিটের দাগ কালো থেকে ফিকে হয়েছে । দাগ মেলায়নি কিন্তু সায়রার মুখে হাসি বিস্তার করেছে । নাজিমুনকে আড়ালে ডেকে সায়রা বলল – হয়ে গেছে জানো ।

– কী ?

– ও রাজি হয়েছে । আমাকে ওইভাবে মারার পর ওর কষ্ট হচ্ছিল তো । তারপর আমার জ্বর এসেছে দেখে রাত্রে আমাকে জড়িয়ে কী কান্না ! এই ক’দিন মদ পর্যন্ত খায়নি ।

ঝলকে মন ভাল হয়ে গেল নাজিমুনের । একটি গোপন ইচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে বুক ঠেলে মুখোমুখি হল তার । সে মনস্থির করল । সারাদিন সংকল্পের সঙ্গে সঙ্গে থাকল সে । তার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব থাকল না । কোনও বহির্নেতিকতা বা আন্তর্নেতিকতা তাকে বিচলিত করতে পারল না । মনে মনে বাক্যগুলি সে সাজাতে থাকল পর পর ।

রাত্রি হল । এল চুলে বিলি কাটার সেই মহার্ঘ সময় । নাজিমুন ইরফানকে বলল – ইটভাটার জায়গাটা তো ওরকমই রইল ।

আরামে আধোঘুম এসেছিল ইরফানের । বলল – হুঁ ।

– কী করবে জায়গাটা নিয়ে ?

– কেন ?

– বলো না ।

– ভাবিনি এখনও ।

– ওখানে আর চাষ হয় না ?

– না ।

– জমিটা আমার নামে লিখে দেবে ?

একটা ঝাঁকুনি খেল ইরফান । সে নিজের দু’কানে আস্থা রাখতে পারছে না । তার তন্দ্রা চটকে গেছে । বলল – কী-কী-কী বললি ?

– জমিটা আমার নামে লিখে দেবে ? ওটা তো আমার আব্বাজির জমি ছিল ।

ঝটিতি উঠে বসল ইরফান । এবং নাজিমুন কিছু বোঝার আগেই একটি সপাট চড় বসাল নাজিমুনের গালে । তাদের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম । নাজিমুন প্রস্তুত ছিল না, তাই খাট থেকে আছড়ে পড়ল মেঝেয় । ইরফানের দুই চোখ ধক ধক করছে । নাজিমুনের মাথা ঠুকে গেছে খাটের পায়ায় । সে এখন শুধু সবুজ দেখছে। অনেক অসংখ্য সবুজ । তার চেতনায় হাজার হাজার হরিয়াল । উড়ছে । উড়ে চলে যাচ্ছে কোথায় ! যেন, তার কাছে আর ফিরে আসবে না কোনও দিন ।

 

 

 

 

 

কৃতজ্ঞতা: পরবাস

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত