| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত কবিতা

অনুবাদ কবিতা: একগুচ্ছ কবিতা । নীলিম কুমার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

নীলিম কুমারসাম্প্রতিক অসমের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত কবি নীলিম কুমার ১৯৬১ সালে অসমের পাঠশালায় জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় চিকিৎসক। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ অচিনার অসুখ’,’ স্বপ্নর রেলগাড়ি’,’ জোনাক ভাল পোয়া তিরোতাজনী’, নীলিম কুমারের শ্রেষ্ঠ কবিতা‘ ইত্যাদি। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৪।


মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস

 

ভগবানও একজন কবি

চাঁদটা আধা

জ্যোৎস্না ও আধা

সেই আধা জ্যোৎস্নায় বসে আছি

আমি আর আমার শহরটি।

শহরটি কাছে এসে

ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল‐

তুমি কি আমার ভেতরে বাস কর নাকি

আমি তোমার ভেতরে?

 

আমি বললাম-

আমি প্রথমত কবি

দ্বিতীয়ত ও কবি

আর তৃতীয়ত যদি জিজ্ঞেস কর

তখনও কবি বলেই বলব।

আমার এই ভুলগুলিই আমার রক্ষক

ভগবানও একজন কবি

আমাকে টাকা ধার দেন

 


আরো পড়ুন: নীলিম কুমারের কবিতা


 

 

স্বপ্ন গুলি বেড়েই চলেছে

স্বপ্ন গুলি বেড়েই চলেছে মা!

একদিন আমার গলায় তুই

রূপালী তাবিজ পরিয়েদিয়েছিলি

প্রতি রাতে তোর ছেলেটি 

স্বপ্ন না দেখার জন্য!

এখন কেবল প্রতি রাতেই নয়

দিনের বেলাতেও স্বপ্ন দেখি মা!

কত রকমের যে স্বপ্ন–

লাল- নীল স্বপ্ন, কালো এবং

হলদে স্বপ্ন, ঠান্ডা স্বপ্ন

আর উষ্ণ স্বপ্ন যেগুলি

বরফ এবং আগুনের ভেতরে ঢুকে থাকে,

বাতাস এবং তুফানের, বৃষ্টি এবং

বজ্রপাতের স্বপ্ন, আলিঙ্গন

আর ঘৃণার স্বপ্ন, আত্মহত্যার স্বপ্ন

ফুলের বাগানের স্বপ্ন, নদীর–

নৌকাগুলির, সমুদ্রের– সমুদ্র জাহাজগুলির স্বপ্ন….

অট্টালিকা গুলির স্বপ্ন দেখিনা মা

ছটফটাতে থাকা ঝুপড়ি গুলিকে স্বপ্নে দেখি

আমিও ছটফটাতে থাকি মা!

কাউকে হত্যা করার স্বপ্ন দেখি মা

আর নিজ হাতে নিহত হওয়ার!

একদিন গলায় তুই

রূপালী তাবিজ পরিয়েদিয়েছিলি

তোর ছেলেটি যেন দুঃস্বপ্ন না দেখে!

স্বপ্ন কী দুঃস্বপ্ন আমি জানি না মা

আমার মাথাটা কেবল স্বপ্নে আছে ভরি!

তুই নাই হয়ে যাওয়ার পরে

স্বপ্নগুলি বেড়েই চলেছে মা!

এখন তোর থেকেই শুরু হয় 

সমস্ত স্বপ্ন।

আমার স্বপ্নগুলির সেতু তুই

স্বপ্নগুলি বেড়েই চলেছে মা!

স্বপ্নগুলি বেড়েই চলেছে মা

এখন দিনে রাতে স্বপ্নের স্রোত…

এত স্বপ্নের পথ আমার মাথায়

এত স্বপ্নের আসা-যাওয়া আমার মাথায়

এত স্বপ্ন এত স্বপ্ন এত স্বপ্ন

এত স্বপ্ন আমার মাথায় জায়গা হয় না…

আমার মাথায় জায়গা হয় না মা!

কোথায় আছিস মা?

আমার মাথায় কিছু একটাবেঁধে দে

কিছু বেঁধে দে মা

স্বপ্নগুলি থাকুক বেঁচে….

 

 

 

 

 

স্বপ্নের রেলগাড়ি

ইতিহাসের চেয়েও একটি পুরোনো রেলপথে

পুরোনো একটি রেলগাড়িতে

পৃথিবী থেকে আমাদের ভ্রমণ

স্বর্গ এবং নরকে

আমার পিতা স্বর্গে

আমার মা, আমার ঠাকুরদা- ঠাকুরমা

প্রপিতামহ স্বর্গে

স্বর্গ এবং নরক একই পথ

ওপর থেকে নিচে

নিচ থেকে ওপরে

পৃথিবী হল জংশন

দুরন্ত গতিতে পৃথিবীর ওপর দিয়েউড়ে গেল

আমাদের রেলগাড়ি

সাগরের পরে সাগর

মরুভূমির পরে মরুভূমি

মাঠের পরে মাঠ

অরণ্যের পরে অরণ্য

সমস্ত কিছু ফেলে রেখে দুরন্ত গতিতে

ঝকঝকঝকঝক

ইতিহাসের চেয়েও  পুরোনো একটি রেলগাড়ি

… আসতে  আসতে স্থির করতে না পারা সময়ে

স্বর্গ পেলাম। পিতা এবং মা

ঠাকুরদা এবং ঠাকুরমা এবং প্রত্যেককেই

আমরা সাক্ষাৎ পেলাম

মা আমাকে কোলে তুলে নিল

বলল– এখানেও শান্তি নেই

স্বর্গ ও পৃথিবীর মতো…

স্বর্গের আলো ভেদ করে এবার

আমাদের রেলগাড়িসর্পিল গতিতে 

নেমে এলো এবং

একটি প্রকাণ্ড গভীর গর্তের ভেতরে

ঢুকে গেল নরকে

আত্মহত্যা করা আমার বোন নরকে

পুলিশের গুলিতে নিহত আমার বিপ্লবী বন্ধু

নরকের অন্ধকারে

বোনকে চুমুখেলাম

বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলাম

ওরাও বলল

নরকে শান্তি নেই

নরকও পৃথিবীর মতো

মৃত্যুর পরেও পৃথিবী

মুক্তির পরেও পৃথিবী

তারপর নরকের অন্ধকার ভেদ করে

আমরা পৃথিবীতে উঠে এলাম

একই পথ

ইতিহাসের ওপার থেকে এপারে

এপার থেকে ওপারে

মানুষ আসা- যাওয়ার

ইতিহাসের চেয়েওপুরোনো সেই রেলগাড়িতে উঠে

আমরা আসতে থাকলাম

ইতিহাসের মধ্য দিয়ে

আসতে আসতে 

ঘড়িতে দেখতে পেলাম বর্তমান

আমরা নেমে পড়লাম

বর্তমানের চেয়েও নতুন অন্য একটি রেলগাড়িতে উঠে

 

 ওপারের দিনগুলিতে

আমার দ্বিতীয় ভ্রমণ রয়েছে…

 

 

 

 

 

বই

বইটা স্পর্শ কর না। তার ভেতরে একটি নদী বয়ে চলেছে।

গভীর একটি অরণ্য শুয়ে আছে। শুয়ে না থাকতেও পারে….

গাছপালা বন‍্যলতাগুলিঘুমোয় কিনা এ কথা

আমি জানিনা। বইয়ে লেখা আছে।

কোনো পৃষ্ঠায় সমুদ্র গর্জন করছে।আর যদি

সমুদ্রও শুয়ে থাকে, তাহলে জানবে

সেটি কবিতার বই। কেননা কেবল কবিতার বুকেই 

শুতে পারে সমুদ্র।

একটা প্রজাপতি একান্ত মনে উড়েবেড়াচ্ছে সেখানে।

বইটা স্পর্শ কর না। বইটির মধ্য দিয়ে

গাড়ি-মোটরগুলি চলেছে। ট্রাফিক জ্যামহয়েছে।

একটি রেল উঁকি দিচ্ছে। পুনরায় রেল ক্রসিঙে  ভিড়।

বইটা স্পর্শ কর না। সেখানে কেউ বলেছে–

তুমি আমার জীবনের ভাষা। কেউ বলেছে–

তুমি আমার জীবনের অর্থ। মানুষগুলি

জীবনকে না বুঝে জীবন শব্দটির প্রেমে পড়েছে।

এটাই বইয়ের উদ্দেশ্য।

এখানে এসে শুয়ে আছে সেই হারানোশিশুটি।

একজন ধর্ষিতা নারীও এসে কয়েকটি  অক্ষরের ছায়ায়

জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে এখানে। হাসপাতালের সঙ্গে

একটা আইসিইউ ও আছে

 এখানে। শব ঢাকা কাপড়।

ফাগুনের ধূলি। শীতের বরফ। বৃষ্টি ,পুকুর।

ভেঁটফুল । মাছের নৃত্য। একজোড়া চাঁদ সূর্য। উল্কা।

চারটি দুগ্ধ ঝর্ণার একটি গাভি। নারীর তৃতীয় স্তন।

বইটা স্পর্শ কর না হে পাঠক

বইটি পড়ে আছে গ্রন্থাগারে। রবীন্দ্রনাথ।

         

 

 

 

 

 

প্রতীকের বিরুদ্ধে

প্রতীকের ব্যবহার এখন পুরোনো হল। প্রতীকের দিন

অতিক্রান্ত। সূর্যকে এখন সূর্য বলাই ভালো।

সবুজের প্রতি  করা আতিশয‍্য থেকে আমরা এখন

সবুজকে মুক্ত করা ভালো। সবুজকে নিয়ে আমরা

কত কী যে না করেছিলাম!

লিখেছিলাম- সবুজ দুঃখ, সবুজ হাসি,সবুজ 

প্রেম, সবুজ ঠোঁট, সবুজ দিন ,সবুজ নিশান … আর ও কত কি!

এভাবে আমরা সবুজের রঙ কেড়ে নিলাম কেন?

সবুজ অধ্যুষিত অঞ্চল বলেই?

এখন আমার বিনম্র ইচ্ছা–

সবুজ কেবল ‘সবুজ’ হোক।

 

রক্তের রঙ লাল। এই লালকেও

আমরা সমস্ত বিপ্লবে ব্যবহার করেছি।

ব্যবহার করেছি কপালের ফোঁটায়!

অতি ব্যবহারে লাল এখন রক্তহীনতায় ভুগছে।

আমরা লালকে প্রতীক থেকে মুক্ত করা উচিত।

আমাদের মগজ থেকে বের করে দেওয়া উচিত প্রতীকগুলিকে।

প্রতীকের মতো মিথ্যা কথা কিছুই নেই।

প্রতীক কোথাও কিছুই সংঘটিত করতে পারল না।

এমনকি তুলে নিতে পারল না রাস্তার একটিও শিল,

তুলতে পারল না পুকুরের একটিও মাছ।

মগজে প্রতীকের বীজ ঢুকিয়েদিয়ে ভাষা

আমাদের চালাক করে তুলল।

চালাকিগুলি আমাদের এখন ত্যাগ করতে হবে।

আমরা কী যে ভুল করলাম–

আমাদের শেষ ভরসার স্থল, প্রেমের কথাতেও

প্রতীক ব্যবহার করতে শিখলাম। আমরা

পৃথিবীটাকে অযথা জটিল করে তুললাম।

কবিতাগুলিকে সরিয়ে নিলাম পাঠকের কাছ থেকে।

আমরা এখন ভাষার শক্তির গায়ে হেলান দিয়ে কথা না বলাই

ভালো।মগজের প্রতি আমাদের করুণা জন্মানোর অবস্থা হল।

আমরা এখন মগজকে ছেড়েহৃদয়ের সঙ্গে কথা বলা ভালো।

 

         

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত