| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

প্রবন্ধ: সাহিত্যপত্র । বুদ্ধদেব বসু

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই-যদি না কোনাে সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন আমাদের। আর-এক রকমের পত্রিকা আছে যা রেলস্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি, চেখে-চেখে আস্তে-আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তােরঙ্গে তুলে রাখি-জল, পােকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচাবার জন্য। যে-সব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুত হতে চায়— কৃতিত্ব যেইটুকুই হােক, অন্ততপক্ষে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে : চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।লিটল কেন? আকারে ছােটো বলে? প্রচারে ক্ষুদ্র বলে? না কি বেশিদিন বাঁচে না বলে? সব ক-টাই সত্য, কিন্তু এগুলােই সব কথা নয়; ঐ ‘ছােটো’ বিশেষণটাতে আরাে অনেকখানি অর্থ পােরা আছে। প্রথমত, কথাটা একটা প্রতিবাদ : এক জোড়া মলাটের মধ্যে সব-কিছুর আমদানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বহুলতম প্রচারের ব্যাপকতম মাধ্যমিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। লিটল ম্যাগাজিন বললেই বােঝা গেলাে যে জনপ্রিয়তার কলঙ্ক একে কখনাে ছোঁবে না, নগদ মূল্যে বড়ােবাজারে বিকোবে না কোনােদিন, কিন্তু হয়তাে—কোনাে-একদিন এর একটি পুরােনাে সংখ্যার জন্য গুণীসমাজে উৎসুকতা জেগে উঠবে। সেটা সম্ভব হবে এইজন্যেই যে এটি কখনাে মন জোগাতে চায়নি, মনকে জাগাতে চেয়েছিলাে। চেয়েছিলাে নতুন সুরে নতুন কথা বলতে ; কোননা-এক সন্ধিক্ষণে যখন গতানুগতিকতা থেকে অব্যাহতির পথ দেখা যাচ্ছে না, তখন সাহিত্যের ক্লান্ত শিরায় তরুণ রক্ত বইয়ে দিয়েছিলাে—নিন্দা, নির্যাতন বা ধনক্ষয়ে প্রতিহত না-হয়ে। এই সাহস, নিষ্ঠা, গতির একমুখিতা, সময়ের সেবা না-করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা—এইটেই লিটল ম্যাগাজিনের কুলধর্ম। আর এটুকু বললেই অন্য সব কথা বলা হয়ে যায়, কেননা এই ধর্ম পালন করতে গেলে চেষ্টা করেও কাটতি বাড়ানাে যাবে না, টিকে থাকা শক্ত হবে, আকারেও মােটাসােটা হবার সম্ভাবনা কম। অবশ্য পরিপুষ্ট লিটল ম্যাগাজিন দেখা গেছে—যদিও সে-সময়ে ঐ শব্দের উদ্ভব হয়নি—যেমন এলিয়টের ‘ক্রাইটেরিয়ন’ বা আদিকালের পরিচয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে তারা ত্রৈমাসিক ছিলাে ; সমসাময়িক গণসেব্য মাসিকপত্রের তুলনায় তারা যে ওজনে কত হালকা তা অল্প একটু পাটিগণিতেই ধরা পড়বে। ভালাে লেখা বেশি জন্মায় না, সত্যিকার নতুন লেখা আরাে বিরল ; আর শুধু দুর্লভের সন্ধানী হলে পৃষ্ঠা এবং পাঠকসংখ্যা স্বতই কমে আসে। অর্থাৎ আমরা যাকে বলি সাহিত্যপত্র, খাঁটি সাহিত্যের পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন তারই আরাে ছিপছিপে এবং ব্যঞ্জনাবহ নতুন নাম।

সাহিত্যের পত্রিকা—তার মানে সৃষ্টিশীল, কল্পনাপ্রবণ সাহিত্যের। যে-সব পত্রিকা সাহিত্যবিষয়ক জ্ঞানের পরিবাহক, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব বা পাঠমূলক গবেষণায় লিপ্ত, দৃশ্যত কিছু মিল থাকলেও সাহিত্যপত্রের সংজ্ঞার মধ্যে তারা পড়ে না। তারা বিশেষজ্ঞের পত্রিকা, জ্ঞানের একটি বিশেষ বিভাগে আবদ্ধ, আপন সম্প্রদায়ের বাইরে তাদের আনাগােনার রাস্তা নেই। কিন্তু সাহিত্যপত্রের দরজা খােলা থাকে সকলেরই জন্য, কেননা সাহিত্য যেখানে সৃষ্টি করে সেখানে তার আহ্বান অবারিত, যদিও তা শুনতে পায় কখনাে পনেরাে জন আর কখনাে বা পনেরাে লক্ষ মানুষ। আজকের দিনে যাদের কণ্ঠ লােকের কানে পৌঁছচ্ছে না, যারা পাঠকের পুরােনাে অভ্যাসের তলায় প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে, তাদের এগিয়ে আনা, ব্যক্ত করে তােলাই সাহিত্যপত্রের কাজ। এর উল্টোপিঠে আছে যাকে বলে অম্নিবাস ম্যাগাজিন, সর্ববহ পত্রিকা ; তাদের আয়তন বিপুল, বিস্তার বিরাট, সব রকমের পাঠকের সব রকম চাহিদা মেটাবার জন্য ভূরিপরিমাণ আয়ােজন সেখানে মাসে-মাসে বা সপ্তাহে-সপ্তাহে জমে ওঠে। বাছাই-করা পণ্যের সাজানাে-গুছােনাে দোকান নয়, পাঁচমিশেলি গুদোম-ঘর যেন ; সেখানে রসজ্ঞের কাম্য সামগ্রী কিছু হয়তাে কোথাও লুকিয়ে আছে, কিন্তু বিজ্ঞাপনের গােলমাল পেরিয়ে, বর্জইস অক্ষরের অলিগলি বেয়ে সেই সুখধামে পৌঁছনাে অনেক সময়েই সম্ভব হয় না-পাতা ওল্টাতেই শ্রান্ত হয়ে পড়তে হয়। এ-সব পত্রিকা তাদের জন্য যারা নির্বিচারে পড়ে, শুধু সময় কাটাবার জন্য পড়ে—আর সংখ্যায় বৃহত্তম তারাই। এরা উৎকৃষ্ট লেখাও পরিবেশন করে না তা নয়, কিন্তু দৈবাৎ করে, কিংবা নেহাৎই লেখক ‘নামজাদা’ বলে স্থান দেয় ; সেটা প্রকাশ নয়, প্রচার মাত্র ; তার পিছনে কোনাে সচেতন সাহিত্যিক অভিপ্রায় থাকে না। এ-সব পত্রিকা শুধু সমাবেশ ঘটায়, সামঞ্জস্য সাধন করে না, যা সংগ্রহ করে তার ভিতর দিয়ে কোনাে-একটি ভাবনাকে মূর্ত করে তােলার চেষ্টা এদের নেই—শুধু কালস্রোতে ভেসে চলা এদের কাজ ; কোনাে নতুন তরঙ্গোৎক্ষেপ নয়।

যথাস্থানে প্রাপ্তিস্বীকার করতেই হয় ; এই সর্ববহ পত্রিকার বর্তমান রূপ যেমনই হােক, বাংলা দেশে তার ইতিহাস অনুজ্জ্বল নয়। এই আদর্শ নিয়েই প্রবাসী’ দেখা দিয়েছিলাে, এবং তারপর বহু বছর ধরে পত্রিকার অন্য কোনাে রূপ কারাে ধারণার মধ্যেই আসেনি—যদিও ‘ভারতী’ আর ‘সাহিত্যের সাহিত্যঘটিত বৈশিষ্ট্যে আধুনিক লিটল ম্যাগাজিনের পূর্বাভাস ছিলাে। কিন্তু ‘প্রবাসী’র উত্থানের দিনে ‘ভারতী’ নিস্তেজ হয়ে আসছে, আর সমাজপতির সমালােচনায় ধ্বংসবিলাস অত্যধিক ছিলাে বলে সৃষ্টির ক্ষেত্রে তা কাজে লাগেনি। বহু বছর ধরে প্রবাসী’ ছিলাে দেশের মধ্যে পয়লা নম্বর, তার বহুমিশ্র পঞ্চশস্যে সাহিত্যের সােনার ধানেরও অভাব ছিলাে না, আর নতুন লেখকের পরিচয়সাধনও কোনাে-এক কালে তাকে দিয়ে যে সম্ভব হতাে, তার প্রমাণ আছেন মণীন্দ্রলাল বসু। তার চরম গৌরবের দিনে প্রবাসী’—আর প্রথম কয়েক বছরের বিচিত্রা’-এ-দুটি পত্রিকায় কৌলীন্য না-থাকলেও সংগ্রহের বৈদগ্ধ্য ছিলাে ; কোননা সর্ববহ পত্রিকা কতদূর সুপাঠ্য, পাঠযােগ্য ও রক্ষণযােগ্য হতে পারে তার কোনাে তুলনীয় উদাহরণ বাংলা ভাষায় তৃতীয়বার ঘটেনি। একদিক থেকে ‘বিচিত্রার কৃতিত্ব আরাে বেশি, কেননা প্রবাসী’তে অনুচ্চার্য শরৎচন্দ্রকে আর ‘ভারতবর্ষে’ অনুপস্থিত রবীন্দ্রনাথকে প্রথমবার একসঙ্গে পাওয়া গিয়েছিলাে বিচিত্রা’য় ; উপরন্তু প্রমথ চৌধুরী, ‘সবুজপত্র’ ও ‘ভারতী’র ভাঙা দল, এমনকি ‘কল্লোলের সদ্যোজাত লেখকরা পর্যন্ত, সকলেই সেখানে একত্র হয়েছিলেন। নানা বয়সের নানা ভাবের লেখকদের এ-রকম উদার সম্মেলন আর কখনাে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু শুধু রচনা প্রকাশ করাই পত্রিকার কাজ নয়—সে-রচনা যতই ভাললা, যতই সুনির্বাচিত হােক না। লেখককে প্রকাশ করাও তার কর্তব্য, পরিবর্তনের ধাত্রী এবং আধার হওয়াও তার কাজ। যতদিন পাঠকের সংখ্যা অল্প ছিলাে, পাঠ্যবস্তুর চাহিদা পরিমিত, আর শিক্ষিত-নামধারী মানুষমাত্রেই সুশিক্ষিত ছিলেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে রুচির বৈষম্য যতদিন উগ্র হয়ে ওঠেনি, ততদিন জনপ্রিয়তার সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার বিরােধ এমন দুস্তর ছিলাে না। ভিক্টরীয় যুগে লন্ডন শহরে যে-সব ক্রিসমাস-বার্ষিকী বেরােতাে, যেগুলি মহিলারা সযত্নে তাঁদের বুদোয়ারে সাজিয়ে রাখতেন, শুনতে অবাক লাগে সেগুলােই ছিলাে তখনকার দিনে কাব্যপ্রচারের প্রধান বাহন ; টেনিসনের, এমনকি ব্রাউনিঙেরও নতুন কবিতা স্থান পেতাে তাতে—হয়তাে আমাদের আজকালকার পূজা-বার্ষিকীতে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতােই অসংগতভাবে। কিন্তু এই সময়ের অনতিপরেই সাক্ষর মানুষ অসংখ্য হয়ে উঠলাে, বিদগ্ধ সমাজ কোণঠাসা হলাে, পাইকেরি ভেজালের ব্যবসা জমে উঠলাে সাহিত্যে। তখন সৃষ্টির বেগ প্রবাহিত হবার জন্য ভিন্ন পথ খুঁজে নিলে ; এমন পত্রিকার প্রয়ােজন অনুভূত হলাে, যার অনতিস্থায়ী জীবনের মধ্যে সাহিত্যের সদ্যতন বিশেষ সাধনাটি মূর্ত হয়ে উঠবে। দেখা দিলাে রসেটির ‘বীজাণু, তারপর ‘নব্বই’-যুগের নিশেন উড়িয়ে হলুদ পুঁথি। আর তারই সঙ্গে দুই দশকের ব্যবধানে ‘সবুজপত্রে’র উদ্দম, বাংলা পত্রিকার অপূর্ব আদর্শের জন্ম।

দুই.

‘সবুজপত্র’ বাংলা ভাষার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন। কারাে-কারাে মনে হতে পারে, ‘বঙ্গদর্শন’ বা ‘সাধনা বিষয়ে ও-কথাটা প্রয়ােজ্য। কিন্তু যখন অন্য কিছুর প্রায় অস্তিত্বই নেই, প্রতিতুলনার যােগ্য কিছু নেই, তখন শ্রেণীবিভাগে সার্থকতা কোথায়। বাংলা পত্রিকার সেই আদিযুগে, যখন পাঠক ছিলাে স্বল্প এবং আজকের তুলনায় অনেক বেশি সমভাবাপন্ন, তখন বঙ্কিম আর রবীন্দ্রনাথ ঐ পত্রিকাদুটিকে তাদের একান্ত সাহিত্যসাধনার মধ্যেই নিবিষ্ট করে নিতে পেরেছিলেন, প্রতিবাদের প্রয়ােজন তখনও প্রবল হয়ে ওঠেনি। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন নামেই যখন প্রতিবাদ, তখন রূপে ও ব্যবহারেও তা থাকা চাই—আর সেটা শুধু একজন অধিনায়কেরই নয়, একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর। ‘সবুজপত্রে’ এই লক্ষণ পুরােমাত্রায় বর্তেছিলাে। তাতে বিদ্রোহ ছিলাে, যুদ্ধ-ঘােষণা ছিলাে, ছিলাে গােষ্ঠীগত সৌষম্য। তার মানে সাম্প্রদায়িকতা নয়, শুধু ‘দীক্ষিতের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকা নয়। যেখানে সমধর্মীরা পরস্পরের মনের স্পর্শে বিকশিত হয়ে ওঠেন তাকেই বলে গােষ্ঠী, আর সেটা যখন ঘটে তখনই কোনাে পত্রিকায় ‘সবুজপত্রের মতাে সুরের ঐক্য দেখা দেয়, চরিত্রের অমন অখণ্ডতা, প্রকাশের অমন প্রথামুক্ত নির্ভয় ভঙ্গি। মনে পড়ছে ‘সবুজপত্রের কোনাে-একটি সংখ্যায় ‘ঘরে-বাইরের একটি সুদীর্ঘ কিস্তি ছাড়া আর কিছুই ছিলাে না। আর এমন সংখ্যা তাে অনেক হয়েছে যেটি রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ও বীরবলের রচনাতেই সমাকীর্ণ। কিন্তু যে-সংখ্যায় বহু লেখক স্থান পেয়েছেন, সেটিও রূপ নিয়েছে সম্পূর্ণ একটি রচনার, অর্থাৎ, সেই বহুর মধ্যে দপ্তরির সুতাে ছাড়াও আন্তরিক একটি সম্বন্ধ থেকে গেছে। এই অখণ্ডতা গােষ্ঠীসাপেক্ষ, তাই গােষ্ঠী ছাড়া সাহিত্যপত্র হয় না।

‘সবুজপত্র’ আমাদের জন্য কী করেছে তার আলােচনা নানা স্থলে করেছি, এখানে তার চুম্বক দিতে চেষ্টা করি। এর প্রথম দান প্রমথ চৌধুরী বা বীরবল, দ্বিতীয় দান চলতি ভাষার প্রতিষ্ঠা, তৃতীয় (এবং হয়তাে মহত্তম) দান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রমথ চৌধুরী আর রবীন্দ্রনাথ-এ-দু’জনের সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন ছিলাে ‘সবুজপত্রে’; প্রথম জনের আত্মপ্রকাশের জন্য, দ্বিতীয় জনের নতুন হবার জন্য। প্রচলিত অন্য কোনাে পত্রিকায়, অন্য কোনাে সম্পাদকের আশ্রয়ে প্রমথ চৌধুরীর স্বকীয়তার বিকাশ হতে পারতাে না; তাছাড়া শুধু রচনাতেই নয়, সম্পাদনাতেও তিনি ছিলেন প্রতিভাবান। আর রবীন্দ্রনাথ—তিনি ‘সবুজপত্রের কাছে পেয়েছিলেন পুরােনাে অভ্যেসের বেড়ি ভাঙার সাহস, যৌবনের স্পর্শ, গদ্য ভাষার জন্মান্তর-সাধনের প্রেরণা—বরং, যে-প্রেরণা তার নিজেরই মনের নেপথ্যে কাজ করছিলাে, তাকে নিঃসংকোচে মুক্তি দেবার পথ পেয়েছিলেন। যেমন টেনিসন ক্রিসমাস-বার্ষিকীতে কবিতা ছাপাতে আপত্তি করেননি, তেমনি রবীন্দ্রনাথ তার সর্বোত্তম এবং সর্বাধিক রচনাবলি বহু বছর ধরে প্রবাসী’তে প্রকাশ করেই তৃপ্ত ছিলেন ; এ-ব্যবস্থায় তার কোনাে বিক্ষোভ ছিলাে না, বরং ছিলাে ‘প্রবাসী’র উদার আশ্রয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা। প্রবাসী’র নানা গুণের মধ্যে দোষ ছিলাে এই যে কোনােই দোষ ছিলাে না ; ঐ রেসপেক্টেবিলিটির দুর্গের মধ্যে ঘরে-বাইরে’ উড়ে এসে পড়লে কী-রকম অভ্যর্থনা হতাে বলা যায় না; কিন্তু সহজ বুদ্ধিতে অনুমান করা যায় যে ঘরে-বাইরে’ রচনার পিছনে ‘সবুজপত্রের উদ্দীপনা কাজ করেছে। বলাকা’র সময় থেকে গদ্যে-পদ্যে যে-নতুন রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি, তার স্রষ্টা অবশ্য রবীন্দ্রনাথ নিজেই, কিন্তু ধাত্রী ‘সবুজপত্র’।

তিন.

আমরা যখন বড় হয়ে উঠছি তখন পর্যন্ত প্রবাসী’তে প্রকাশিত হওয়াই কোনাে নতুন লেখকের মােক্ষ বলে গণ্য হতাে। প্রায় বালক বয়সেই আমার সেই পুণ্যলাভ ঘটেছিলাে, তবু প্রথম যখন কল্লোলে আমার লেখা বেরােলাে, তখন বিশেষভাবে সার্থক মনে হলাে নিজেকে। তার কারণটা কী, বলি। কল্লোলে’ যাঁদের লেখা পড়তুম-গগাকুলচন্দ্র নাগ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র—নতুন নাম সব, কিন্তু আমার মন যেন তাঁদের সঙ্গে এক সুরে বাঁধা, তারা যেন আমার আত্মীয়, তাদের জন্য আমি রক্তের মধ্যে চঞ্চলতা অনুভব করতাম—অনেকটা রাজহাঁস দেখে হান্স আন্ডেরসেনের কুরূপ হংসশাবকের মতাে। সেই ‘কল্লোলে’ স্থান পাওয়া আমার পক্ষে অনিবার্য ছিলাে—কিন্তু তাই বলে পাবার মুহূর্তের উৎসাহ ভােলবার নয়। মনে হলাে বাড়ি খুঁজে পেলাম, পথে-পথে সরাইখানায় আর ঘুরতে হবে না। প্রবাসী’তে যে-লেখাটা বেরােলাে সেটা হয়তাে বহু পাঠকের চোখে পড়লাে, কিন্তু ঐ ঠেলাঠেলি ভিড়ের মধ্যে আমি গেছি হারিয়ে। কিন্তু কল্লোল’ যেন চিনতে পারলাে আমাকে, সেই অভিজ্ঞানে আমিও নিজেকে চিনলাম। অর্থাৎ, ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হওয়া মানে বিজ্ঞাপন, আর কল্লোলে প্রকাশিত হওয়া মানে নিজেকে আবিষ্কার করার আনন্দ। লেখকের পক্ষে, বিশেষত কাঁচা বয়সের অস্থির লেখকের পক্ষে, এ-দুয়ের মধ্যে কোনটা বরণীয় তা বলবার কোনাে প্রয়ােজন করে না।

আজকালকার যুবকেরা আমাকে মাঝে-মাঝে বলে থাকেন, ‘কেন যে “কল্লোলের কথা এত বলেন আপনারা–পড়ে দেখেছি, বাজে লেখায় ভরতি।‘বাজে’—সে-কথা মানতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ফুলের পক্ষে পল্লব যে-রকম বাজে, এও সেইরকম। ‘কল্লোল’ বেছে-বেছে ফুলের তােড়া বাঁধেনি বলে আমি তাকে দোষ দেবাে না, সে যে আস্ত গাছের মতাে উঠে দাঁড়িয়েছিলাে, সেটাই তার প্রাণশক্তির প্রমাণ। তার পরিবেশের মধ্যে বুদ্ধির চর্চা বেশি ছিলাে না, কিন্তু প্রাণ ছিলাে, আবেগ ছিলাে, তার টানে কিছু আবর্জনা তত ভেসে আসবেই। সেটা কিছু না—স্রোতটাই আসল কথা। স্রোত ছিলাে ‘কল্লোলে’, জোয়ার এসেছিলাে, রবীন্দ্রনাথের কুসুমশয়নে দীর্ঘ সুখতার পর আমরা হঠাৎ নিজের মধ্যে জেগে উঠেছিলাম। ঐ আবেগেই আমাদের প্রয়ােজন ছিলাে তখন, প্রয়ােজন ছিলাে ভুল করবার স্বাধীনতায়, কেননা আমরা বুদ্ধি দিয়ে অনেক রকম ভুল বুঝলেও সৃষ্টিকালে আমাদের প্রাণ তার আপন কথা ঠিক বলে নেয় যদি প্রাণ জেগে ওঠে। আমরা প্রথম যখন নিজের প্রাণের সাড়া পেয়েছিলাম, নিজের কথা বলে উঠতে পেরেছিলাম, সেই সময়কার বহুনিন্দিত ধিকৃত রচনাগুলি—কোনাে ভদ্রগােছের সম্পাদক-দ্বারা স্পষ্ট হবার সম্ভাবনা যাদের ছিলাে না—সেগুলিকে কল্লোল’ যে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছিলাে, তার এই প্রশ্রয়ের দ্বারাই সে সার্থক করেছে, সার্থক হয়েছে। বলা বাহুল্য, এটা শুধু আমার সমকালীন লেখকদের ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ নয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের মধ্যেই এই সত্য আজ স্বীকৃত। জঞ্জাল তলিয়ে গেছে কবে, উদ্বৃত্ত পলিমাটির খবর বাংলাদেশের পাঠক এবং তরুণতর লেখকদের অজানা নেই। যে-সব অখ্যাত, কিংবা কুখ্যাত, এবং সন্দেহভাজন যুবক সেই সময়ে বলার জন্য আকুলিবিকুলি করছিলাে, যাদের আক্ষরিক অর্থে কণ্ঠরােধ করারও প্রস্তাব উঠেছিলাে, তাদের ব্যক্ত হতে দেবার মতাে, যাত্রাপথে এগিয়ে দেবার মতাে বন্ধুতা কল্লোল’ ছাড়া সারা দেশের মধ্যে আর কোথাও ছিলাে না। লেখকরা যেমন পত্রিকা গড়ে তােলেন, তেমনি পত্রিকার প্রভাবও লেখকদের উপর পড়ে থাকে। কোনাে-এক কালে অচিন্ত্যকুমার নীহারিকা দেবী ছদ্মনামে ‘প্রবাসী’তে যে-সব পদ্য ছাপিয়েছিলেন, আশা করি তার বন্ধুরা সেগুলাে মনে রাখেননি; কিন্তু কল্লোলে স্থান পাবার পরেই দেখা দিতে লাগলাে তাঁর স্বকীয় রচনাবলি। অবশ্য এমন নয় যে এটা কল্লোলের জন্যই হয়েছিলাে- কোনাে পত্রিকার বিষয়েই তা বলা চলে না—সাহিত্য তার আপন অন্তরের বেগেই চলতে-চলতে নিজের পথ তৈরি করে নেয়, পত্রিকাগুলাে শুধু প্রয়ােজনীয় যন্ত্রের কাজ করে। কিন্তু ফসল যদি সঞ্চয়যােগ্য হয় তাহলে যন্ত্রটাও শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠে ; লেখকরাও কি ঈশ্বরের যন্ত্র নন, তবু কোনাে সুন্দর সৃষ্টির জন্য আমরা কি তাদের অভিনন্দন জানাই না?

চার.

‘প্রগতি’ ও ‘কালি-কলম’-কল্লোলের এই শাখা দুটি অল্পকাল পরেই ঝরে পড়লাে, আর কল্লোলে’র সমাপনের জের টেনে তারই ধারা এগিয়ে নেবার উদ্যম দেখা দিলাে কুমিল্লা থেকে পূর্বাশায়। কিন্তু ইতিমধ্যে পৃথিবীর মনের ঋতুতে অলক্ষ্যে যে হাওয়া-বদল ঘটে গেছে, যা আমরা আভাসে-ইঙ্গিতে অনুভব করছিলাম, তার স্বাদ প্রথম স্পষ্ট হলাে যখন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পরিচয় প্রকাশ করলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাপ্রান্তে পৌঁচেছি, আমার শেষ পরীক্ষার প্রথম দিনে ‘পরিচয়ের প্রথম সংখ্যা চোখে দেখেছিলাম। পরীক্ষামণ্ডপে রক্ষী ছিলেন শ্রীযুক্ত সুশােভন সরকার ; তিনি নিঃশব্দে পাইচারি করতে-করতে যে-পত্রিকাটি পড়ছিলেন, তার মলাটে ‘পরিচয়’ লেখা দেখতে পেয়ে আমি খাতা লিখতে লিখতে ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিপাত করছিলাম মাঝে-মাঝে। সেদিনই বিকেলে এই নতুন পত্রিকার একটি খণ্ড আমারও হাতে পৌছলাে ; দেখে মানতে হলাে নতুন বটে।

‘পরিচয়ের সঙ্গে ‘সবুজপত্রে’র তুলনা অপ্রতিরােধ্য, নানা দিক থেকে এ-দুটিতে সাদৃশ্য আছে। ‘সবুজপত্রে যেমন প্রথম চৌধুরীর, তেমনি পরিচয়ে জরুরিতম প্রয়ােজন ছিলাে সুধীন্দ্রনাথেরই নিজের, তার ব্যক্তিস্বরূপের ঘূর্তির জন্য। এর আগে পর্যন্ত সুধীন্দ্রনাথের খ্যাতি তার বন্ধুমহলে আবদ্ধ ছিলাে ; আমি, বাংলা সাহিত্য বিষয়ে অবিরল ঔৎসুক্য নিয়েও, তার নাম আগে শুনিনি। তিনিই সেই নতুন জ্যোতিষ্ক, যিনি ১৯৩১ সালে আমাদের দিগন্তে উদিত হয়েছিলেন ; তবু, তার সঙ্গে আমাদের পরিচয়স্থাপনেই ‘পরিচয়ের দায়িত্ব চোকেনি। সবুজপত্রের মততা, সেও একটি নতুন (লেখক-গােষ্ঠী গড়ে তুলেছিলাে, এবং সেই লেখকরা—কেউ বা আনকোরা নতুন, কেউ বা ‘সবুজপত্রের প্রাক্তন সদস্য—তাঁরা ছিলেন প্রধানত ব্যাখ্যাতা, বিশ্লেষণপন্থী, শিল্পী ৩৩টা নন যতটা জ্ঞানী, রসের স্রষ্টা ততটা নন যতটা রসজ্ঞ ;-এও ‘সবুজপত্রেরই মতাে। এবং সম্পাদনাকর্মে সুধীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব প্রমথ চৌধুরীর মতােই স্মরণীয়।

সুধীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়ের কথা ভাবলে আজ আমার মনে হয় যে কল্লোলের তোলপাড়ের পর ঘর গােছাবার কাজ নিয়ে সে এসেছিলাে। কল্লোলে’ যা ছিলাে না, তাই ছিলাে ‘পরিচয়ের সম্পদ ; বিদ্রোহের উন্মাদনা যখন কেটে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে পরিচয় নিয়ে এলাে রুচি, বিচারবুদ্ধি, চিন্তার শৃঙ্খলা। ততদিনে ইংরেজি সাহিত্যে ‘টোয়েন্টিজ’-এর রঙিন দিন অস্তমান ; অল্ডাস হাক্সলি ও লিটন স্ট্রেচির ব্যঙ্গ, লরেন্সের সংরাগ, ভার্জিনিয়া উলফের অতি সূক্ষ্ম ভাবনা-জাল—এই সবের উপর দিয়ে এলিয়টীয় পােড়াে জমির হিম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। পশ্চিমী মানসের এই নূতন সারাটিকে পরিচয় আমাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল করে তুললাে, শোনালাে এই প্রাপ্ত শতাব্দীর কণ্ঠস্বর—শুধু সাহিত্যে নয়, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা, সকল ক্ষেত্রে। অন্তত ত্রৈমাসিক অবস্থায় তার পাতায় বৈদেশিক চিন্তার আলােচনায় যে-রকম প্রাচুর্য ও দক্ষতা দেখা গিয়েছিলাে, বাংলা ভাষায় তার কোনাে তুলনা আমার জানা নেই। হতে পারে তার অনেকটা অংশই সংগ্রহ অথবা ভাষ্য, কিন্তু প্রসাধনের পরিচ্ছন্নতায় তার বিশেষ মর্যাদা ছিলাে, তাছাড়া একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না-করে পদার্থতত্ত্ব, মনােবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে যে বাংলা রচনা সম্ভব, এই আদর্শের জন্যও ‘পরিচয়’ আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন।

বিষ্ণু দে-র সাহিত্যিক জন্ম ‘কল্লোল’-যুগেই ঘটেছিলাে, তাই এ-কথা বললে ভুল হয় না যে সৃষ্টিশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে পরিচয়ের অনন্য দান সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। অন্য যাঁরা এই ঘাটে ভিড়েছিলেন, যাঁদের লেখা এখানেই প্রথম, ও কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে এখানেই শেষ দেখা গেছে, তারা কেউ প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যিক নন, অর্থাৎ জাত-লিখিয়ে নন। এটা ৩খন অপবাদরূপে উল্লেখ করেছেন কেউ-কেউ, শৌখিন বলে বক্রোক্তি করেছেন, কিন্তু আমি বলবাে সাহিত্যে শৌখিনতা বাদ দিতে গেলে সেটা নিতান্তই লেখকদের একটা পরােয়া ব্যাপার হয়ে পড়ে। লেখকদের দিয়েই সাহিত্যের সৃষ্টি হয়, কিন্তু শুধুমাত্র লেখকদের দিয়ে কোনাে সাহিত্যসমাজ গঠিত হতে পারে না, তার সার্থক অস্তিত্বের জন্য প্রান্তিক অধিবাসীদের একটি পরিমণ্ডল চাই। চাই রসিক, কলাবিদ, বিদগ্ধজন। চাই আদি অর্থে amateur অর্থাৎ প্রেমিকের দল। যে-লােকটা লেখে তার তাে লেখাটাই আর মৎস্যজীবী মৎস্যগন্ধে ব্যাকুল হবে না তাে কে হবে। কিন্তু যে-মানুষ নিজে লেখে না অথচ সাহিত্য ভালােবাসে, শুধু ভালােবাসে না, চিন্তাও করে তা নিয়ে, লেখকরা যে পণ্ডশ্রম করেননি সেই মানুষই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আর এই শৌখিনদের। হাতে কখনাে-কখনাে উত্তম রচনাও বেরিয়েছে, ইতিহাসে তার নজিরের অভাব নেই। ‘পরিচয়ের যে-বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে উল্লেখ্য ছিলাে, সেই সমালােচনা বিভাগটি নিবিড় হয়েছিলাে সুধীন্দ্রনাথের অ-সাহিত্যিক বন্ধুদের সমবায়-সাধনে। সে-সব সমালােচনা নিষ্কাম কর্মের উদাহরণরূপে গণ্য হতে পারে, কেননা তারা বই কিনে বেছে-বেছে রিভিয়ু লিখতেন, প্রকাশকের উপকার করা তাঁদের উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিলাে না, সব ক্ষেত্রে গ্রন্থকর্তারও নয়, কেননা গ্রন্থকারটি অনেক সময়ই ছিলেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তের অধিবাসী, পরিচয় এবং বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিষয়ে অচেতন। কিন্তু অন্য কারাে উপকার হােক বা না হােক, এতে উপকৃত হয়েছিলাম আমরা, বাংলা দেশের সাহিত্যিকসম্প্রদায়। শুধু যে নানা দেশের নতুন সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তা নয়, রচনার উৎকর্ষেও আমরা বিস্মিত এবং শিক্ষিত হয়েছি। অমন বুদ্ধিদীপ্ত রসােজ্জল সমালােচনা, অমন অজস্র পরিমাণে আমাদের জীবৎকালে বাংলা ভাষায় ইতিপূর্বে রচিত হয়নি। লেখকদের মধ্যে যােগ্যতার তারতম্য নিশ্চয়ই ছিলাে ; অন্যান্য বিভাগে ভালাের সঙ্গে মাঝারি লেখাও বেরিয়েছে, কিন্তু আশ্চর্য এই যে গ্রন্থ-সমালােচনার অংশে প্রায় প্রত্যেক রচনাতেই কিছু-না-কিছু গুণপনা দেখা যেতাে। অবশ্য এমন লেখাও দেখেছি, যেখানে দুই বা তিন পঙক্তির মধ্যে দশ-বারােটি বিদেশী লেখকের নামাবলি অঙ্কিত হয়ে ব্যাপারটাকে প্রায় অর্থহীন করে তুলেছে, কিন্তু এমনও উদাহরণ জানি যেখানে কোনাে লেখক দশ বছর ধরে অবিরাম লিখেও কারাে মনে রেখাপাত করতে পারেননি, কিন্তু ‘পরিচয়ে একটি ধারালাে সমালােচনা লিখে হঠাৎ আমাদের বিস্মিত করে দিয়েছেন। একবার আবহাওয়া জমে উঠলে এই রকমই হয়। যুদ্ধে সেই আবহাওয়া ধ্বংস হলাে, সুধীন্দ্রনাথ পরিচয় ত্যাগ করলেন, এবং চতুরঙ্গ, যা পরিচয়ের সগােত্ররূপে আশাপ্রদভাবে আরম্ভ হয়েছিলাে, তাও তৎকালীন বিশৃঙ্খলার জন্য সংহত হয়ে উঠতে পারলাে না।

পাঁচ.

‘পরিচয়ের কোনাে-এক বৈঠকে অন্নদাশঙ্কর রায়ের হাতে একটি পত্রিকা দেখেছিলাম। রােগা চেহারা, ইট-রঙের মলাটের উপর শেলির ছবি ছাপাননা, নাম মনে নেই। ভাষা ইংরেজি, জাতি মার্কিন, ভিতরে ছিলাে চওড়া মার্জিনে সুন্দর করে সাজানাে কবিতা, শুধু কবিতা, আর কবিতারই বিষয়ে কিছু আলােচনা। এই প্রথম আমি কবিতার কোনাে পত্রিকা চোখে দেখলুম।

এর আগে অনেকদিন ধরে মনে-মনে অত্যন্ত পীড়া পেয়েছি আমাদের দেশে কবিতার অবমাননার কথা ভেবে। বালক বয়সে প্রথম যখন পাঠকশ্রেণীতে ভর্তি হই, তখন থেকে দেখে আসছি আমাদের সর্ববহ পত্রিকাগুলি কবিতার প্রতি কীরকম শ্রদ্ধাহীন ব্যবহার করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য যে-কোনাে লেখকের পদ্যজাতীয় রচনার কাজ হচ্ছে পাদপূরণ, গদ্য ভােজের এঁটো পাতে সসংকোচে তাকে বসতে হয়, তার বাছাইয়ের মাপকাঠি হচ্ছে ইঞ্চিমাপা স্কেল। নামজাদা কবির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম দেখিনি, ‘প্রবাসী’র কোনাে-কোনাে সংখ্যায় সত্যেন্দ্র দত্তের পাঁচটি-ছটি করেও কবিতা পাওয়া গেছে, কিন্তু ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে, ডবল-কলমের ঠেলাঠেলির মধ্যে কখনাে মনে পড়ে না আস্ত পাতাটা ছেড়ে দেয়া হয়েছিলাে। বড়ােজোর আমিষান্নের ফাকে-ফাকে চাটনির মতাে পরিবেশন, কিন্তু কবিতাটাই যে একটা ভােগ্য বস্তু এমন ভাব কোথাও নেই। বাংলা মাসিকপত্রের এই অবিচল প্রথার মধ্যে ‘সবুজপত্র’ বিস্ময় নিয়ে এলাে—শুধু চরিত্রে নয়, চেহারাতেও, আর কল্লোল ও তার পরবর্তী সাহিত্যপত্রগুলিতেও কবিতা ছাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যবস্থার প্রবর্তন হলাে। কিন্তু আমি কখনাে-কখনাে এমন পত্রিকার স্বপ্ন দেখতাম যেটা শুধুই কবিতার জন্য। নিছক স্বপ্ন বন্ধুদের কাছেও উচ্চার্য নয়। সেই স্বপ্নের একটা বাস্তব রূপ ঐ মার্কিনি নমুনাটিতে দেখতে পেয়ে আমি একটা দুঃসাহসিক কথা চিন্তা করে ফেললাম :এ-রকম একটা বের করা যায় না বাংলায় ? তাহলে তাে কবিতা—এবং কবিরা—পদপ্রান্তিক অবমাননা থেকে বেঁচে যান। অগ্নিবাসের বদলে একেবারে রিজার্ভ-করা সেলুনগাড়ির ব্যবস্থা—অন্য কারাে জায়গাই নেই সেখানে।

ইতিপূর্বে আমাদের দেশে কোনাে কবিতা-পত্রের জন্ম হয়নি, সে-রকম কোনাে প্রস্তাবও শুনিনি কখনাে। আমার কল্পনাকে সম্ভবপরতার পরপারে বলেই ধরে নিলাম, অথচ সেটা মন থেকে বিদায় নিতেও নারাজ, মাঝে-মাঝে সেটাকে নিয়ে খেলা না-করে পারি না। যখন ‘কবিতা’ বেরােলােলা, সেও খেলাচ্ছলেই। কোনাে সম্বল বা আয়ােজন ছিলাে না ; দেখা যাক না কী হয়—এই গােছর মনের ভাব নিয়ে আরম্ভ হলাে। বিষ্ণু দে, আর একজন অ-কবি বন্ধু, পাঁচ টাকা করে চাঁদা দিলেন, প্রথম দুই সংখ্যা বিনামূল্যে ছেপে দিলেন সদ্যস্থাপিত পূর্বাশা প্রেস। কলকাতার সুধীসমাজে যাঁদের মুখ চিনি বা নাম জানি, এই রকম পনেরাে-কুড়ি জনের কাছে প্রথম সংখ্যাটি পাঠিয়ে দিলাম—গ্রাহক হবার অনুরােধ জানিয়ে। সেই অনুরােধ প্রায় সকলেই সম্মানিত করলেন—এতটা আমি আশা করিনি-বাহক ফিরে এলাে এক মুঠো ছােটো-বড়াে রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে। সমর সেন নিয়ে গেলেন এসপ্লানেডের স্টলে ; তারা বললে এইটুকু কাগজ ছ-আনা দিয়ে কে কিনবে, চার পয়সা দাম হলে ঠিক হতাে। দু-দিন পরে আরাে কুড়ি কপি পাঠাতে হলাে সেখানে—এতে স্টলওলা নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিলাে কিন্তু আমি আরাে বেশি। (* আমি সম্প্রতি জানতে পেরেছি যে এ-কথা তথ্য হিশেবে ভুল। উনিশ শতকে একাধিক কবিতা-পত্রিকা বেরিয়েছিলাে, তার একটি ঢাকা থেকে।—দ্বিতীয় সংস্করণের পাদটীকা।) কয়েক দিন পরে, একটু ভয়ে ভয়ে, রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিলাম, তিনি চিঠি লিখলেন, লেখা পাঠালেন। কী মনে করে এডওঅর্ড টমসনকে পাঠালাম ; ‘পরিচয়’, ‘কবিতা, রবীন্দ্রনাথের সদ্যপ্রকাশিত ‘বীথিকা’ ও মাদ্রাজের ‘ত্রিবেণী’ অবলম্বন করে তিনি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখলেন টাইমস-এর সাহিত্যিক ক্রোড়পত্রে।

চেষ্টা দ্বারা আরাে কিছু গ্রাহক করা গেলাে, কিন্তু প্রথমে যাঁরা অযাচিতভাবে গ্রাহক হলেন তারা রাজবন্দী। ভয় হতে পাছে অর্থাভাবে বৎসর পূরণ হবার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। সুখের বিষয়, ত্রৈমাসিক ; দুটো সংখ্যা বেরােলেই ভাবতে পারতাম— যাক, অর্ধেক চাঁদা কাটানাে গেলাে। রাজবন্দীদের মুক্তির সময়ে খাতা থেকে একসঙ্গে অনেকগুলাে নাম কাটা পড়লাে—একটু শঙ্কিত বােধ করলাম। কিন্তু চতুর্থ বছরের মুখে এসে বােঝা গেলাে আকস্মিক অপমৃত্যুর অবস্থা পেরিয়েছে। | শ্রদ্ধার সঙ্গে কবিতা ছাপা হবে—নামজাদা বা অনামজাদা যার লেখাই হােক না—প্রসাধনেও বৈশিষ্ট্য থাকবে—এই পত্রিকা-প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য এটুকুর বেশি আমার জানা ছিলাে না। কিন্তু রচনাকালীন উপন্যাসের মতাে, ‘কবিতা’ সেই প্রাথমিক পরিকল্পনা অতিক্রম করে নিজে-নিজেই বেড়ে উঠলাে। সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত তার প্রায় দুই দশকের ক্রিয়াকলাপ কেউ-কেউ অবগত আছেন। কবিতা—বিশেষত বাংলা ভাষার আধুনিক কবিতা—এই বিষয়টার একটি একান্ত রঙ্গমঞ্চ গড়ে উঠলাে যেন-রচনায়, আলােচনায়, কোনাে-এক সময়ে সংলগ্ন ‘এক পয়সায় একটি গ্রন্থমালায়। সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র কবিতাকে এই প্রাধান্য দেবার প্রয়ােজন ছিলাে, নয়তাে সেই উঁচু জায়গাটি পাওয়া যেতাে না, যেখান থেকে উপেক্ষিত কাব্যকলা লােকচক্ষুর গােচর হতে পারে। কবিতা’ যখন যাত্রা করেছিল, সেই সময়কার সঙ্গে আজকের দিনের তুলনা করলে এ-কথা মানতেই হয় যে কবিতা নামক একটা পদার্থের অস্তিত্ব বিষয়ে পাঠকসমাজ অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন, সম্পাদকেরাও একটু বেশি অবহিত—এমনকি সে এতদূর জাতে উঠেছে যে কবিতা লিখে অর্থপ্রাপ্তিও আজকের দিনে কল্পনার অতীত হয়ে নেই।

ছয়.

সমিতি করে, মন্ত্রণাসভা ডেকে, কিংবা লিমিটেড কোম্পানি স্থাপন করে, কখনাে সত্যিকার লিটল ম্যাগাজিন সম্ভব হয় না। এর আসল কথা স্বতঃস্ফূর্তি ; বাইরে থেকে বানিয়ে তােলা যাবে না একে, ভিতর থেকে হয়ে ওঠা চাই। এই হয়ে-ওঠার প্রেরণারূপে থাকে কখনাে কোনাে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের বল, কখনাে কোনাে লেখক-গােষ্ঠীর মিলিত প্রভাব। সবুজপত্র’ ও ‘পরিচয়ের সঙ্গে প্রমথ চৌধুরী ও সুধীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে তা-ই, যে-সম্বন্ধ রেলগাড়ির সঙ্গে এঞ্জিনের, কিন্তু কল্লোলের সৃষ্টি হয়েছিলাে তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের হাতে নয়, তার লেখকদেরই নিবন্ধগুণে। দীনেশরঞ্জন দাশ বের

করেছিলেন গল্পের পত্রিকা, যার সিকি-সচিত্র বিজ্ঞাপন দেখা যেতত—কিন্তু তার রূপান্তর ঘটলাে গােকুলচন্দ্র ও অচিন্ত্যকুমারের সংযােগে, তারপর নবযুবক লেখকরাই ‘কল্লোল’কে দখল করে নিলাে, দীনেশরঞ্জন স্মিতহাস্যে অভ্যর্থনা জানালেন। সেই অভ্যর্থনার উষ্ণতায় তার কৃতিত্ব, বন্ধুতার প্রতিভায় তার গৌরব। বন্ধুতা এখানে খুব বড়াে কথা ; কেননা বন্ধুতাই সেই শক্তি, যার দ্বারা কোনাে-এক সময়ে সদ্যোঙ্খিত বিক্ষিপ্ত চঞ্চলতা একটা জায়গায় সংহত ও মূর্ত হতে পারে। অর্থাৎ, যাঁরা মিলবেন তাদের প্রাণের টানে মেলা চাই, কর্তব্যবােধে বা জীবিকার তাগিদে নয়। তা না-হলে মিলন হয় না—যদিও সম্মেলন হতে পারে, গােষ্ঠী হয় না, শুধু ভিড় হয়। বিচিত্রা যে সেই সময়কার সকল লেখকদের একত্র করতে পেরেছিলেন তার পিছনে শুধু সুবুদ্ধি ছিলাে না, অর্থবলও ছিলাে ; সেখানে লেখকদের সমাবেশের মধ্যে কোনাে সমন্বয়ের সূত্র ছিলাে না। কিন্তু কল্লোল’ বা ‘পরিচয়ের লেখকরা সেই-সেই পত্রিকার-ই অন্তর্গত ছিলেন, ছাপার অক্ষরে পরস্পরকে নমস্কার জানিয়েই তারা যে যার বাড়ি ফিরে যেতেন, সেই প্রকাশের নেপথ্যে পরস্পরের জীবনে তাদের যে-অংশ ছিলাে, তাতেই সমস্ত পরিবেশ উর্বর হয়ে উঠেছে। বন্ধুতাই এ-সব পত্রিকার প্রকৃত ক্ষেত্র—আপিশ নয়, আঁটোসাঁটো সাহিত্যসভা নয়—খােলা হাওয়া, প্রীতি, স্বাচ্ছন্দ্য, যাকে বলে আড্ডা। অবশ্য এ-রকম যােগাযােগ ঘটলেই যে পত্রিকা সার্থক হবে তাও নয়, মৌলিক প্রতিভাও চাই, সত্যিকার নতুন সুর বেজে ওঠাও চাই— আর সেটা সময়ের বিশেষ লগ্নসাপেক্ষ। কিন্তু সেই বিশেষ লগ্নটি কবে আসবে তা তাে আমরা আগে থেকে জানতে পারি না, তাই অবিরাম চেষ্টা করে যাওয়া দরকার। বর্তমান কালের যে-কোনাে যুগেই এই ধরনের সাহিত্যনিষ্ঠ পত্রিকার অস্তিত্ব থাকা ভালাে ;—তাতে পাঠকদের লাভ এই যে চলতি কালের রচনাধারার একটি সংবদ্ধ রূপ দেখতে পাওয়া যায়, আর লেখকদের লাভ এই যে তারা উদাসীন বহুর বদলে সমনস্ক স্বল্পসংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারেন। আমি যদি তিন মাসের মধ্যে একটি কবিতা লিখে উঠতে পারি, তাহলে সেটি ‘কবিতা’তেই ছাপাতে ইচ্ছে করবে—তার কারণ লেখাটা আমি বিশেষভাবে যে-ক’জনকে শােনাতে চাই, তারা ঐ পত্রিকার পাঠক। এ-কথাটা তরুণ লেখকদের পক্ষে আরাে বেশি সত্য ; বহু-কাটতির পত্রিকার মধ্যে অসংখ্যের দৃষ্টিপাতসুখের বদলে সুনির্বাচিত স্বল্প পাঠকের অভিনিবেশেই তাঁদের প্রয়ােজন। আর বস্তুত, বাংলা ভাষার উপরােক্ত পত্রিকাগুলির মধ্য দিয়েই অধিকাংশ আধুনিক লেখক প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন, এ-কথাও আজ অনেকেরই অজানা নেই।

লিটল ম্যাগাজিন ব্যবসা হিশেবে অচল, তাকে চালাতে হলে আর্থিক অপব্যয়ের শক্তি চাই। সে শুধু ধনের শক্তি নয়, মনেরও শক্তি ; কিন্তু তবু এই পশু-তথ্যটা অকাট্য যে রাজকীয় নামাঙ্কিত কাগজগুচ্ছেরও প্রয়ােজন হয়। পশ্চিমী দেশে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বদান্যতা দ্বারাই এ-সব অসাধ্যসাধন ঘটে থাকে ; ‘ইউলিসিস’ প্রকাশ করার অপরাধে যে-পত্রিকা আদালতে সােপর্দ হয়েছিলাে, সেই ‘Transition’-এর কারয়িত্রী ছিলেন একজন ধনী মার্কিন মহিলা। ক্রাইটেরিয়নে’র একবার প্রায় উঠে যাবার দশা হলাে ; এলিয়ট দুদিনের জন্য সুইৎসাৰ্ল্যান্ডে গেলেন, ফিরে এলেন আশ্বাস নিয়ে—শুধু মৌখিক আশ্বাস নয়। শিকাগাের ‘Poetry’ এবং আমেরিকার অন্যান্য সাহিত্যপত্র প্রভূতভাবে দানের উপরেই নির্ভর করে থাকে। স্থানীয় ধনীদের কাছে এ-রকম সাহিত্যিক আগ্রহ বাংলা দেশের বিশ শতকে আমরা কল্পনা করি না, আমাদের কোনাে রকফেলার বা ফোর্ড ফাউন্ডেশনও নেই, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আনন্দের কথা এই যে প্রমথ চৌধুরী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং অন্য কোনাে-কোনাে সাহিত্যিকের দগ্ধ করার মতাে অল্পবিস্তর অর্থ ছিলাে, আমাদের সাহিত্যপত্রের ধারাটি তাই সম্ভব হতে পেরেছে। ‘কবিতা’র অর্থবল ছিলাে না, কিন্তু বন্ধুবল ছিলাে, আর ছিলাে সম্পাদকের পূর্ববঙ্গীয় গোঁয়ার্তুমি। মনে হতে পারে আর্থিক কারণেই এ-সব পত্রিকা দীর্ঘজীবী হতে পারে না, কিন্তু সেটা শুধু আংশিক সত্য। স্বল্পায়ুতাই এদের চরিত্রলক্ষণ। বিশেষ-কোনাে সময়ে, বিশেষ-কোনাে ব্যক্তির বা গােষ্ঠীর উদ্যমে, বিশেষ কোনাে একটি কাজ নিয়ে এরা সঞ্জাত হয়, এবং সেটুকু সম্পন্ন হলেই এদের তিরােধান ঘটে। সেটাই শােভন, সেটাই যথােচিত। ইদানীং ‘কবিতা হয়তাে সেই শশাভনতার সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে, এ-কথা ভেবে মাঝে-মাঝে আমি অস্বস্তি বােধ করি।

 

 

 

১৯৫৩

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত