| 29 মার্চ 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া

বই আলোচনাঃ পরম সুন্দরী । শেলী জামান খান

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বই  কিনতে গিয়ে পাঠকমাত্রই খুব বিচক্ষণ হন। তারা কাংখিত লেখকের বই খোঁজেন। তারপর নাম-জানা  বা নাম না শোনা লেখকের বই পেলে নেড়েচেড়ে দেখেন। তবে মাঝেমধ্যে এর ব্যত্যয়ও ঘটে। অনেক সময়  বইয়ের সুন্দর প্রচ্ছদ, আকর্ষণীয় নাম, কাগজ এবং চমৎকার বাঁধাইয়ের কারনেও পাঠক ভালমন্দ, সাতপাঁচ না ভেবেও বই কিনে ফেলেন। ‘পরম সুন্দরী’ বই পছন্দ করার এই শর্তগুলো অনেকাংশেই পূরণ করেছে। লেখক মনিজা রহমানের  লেখা আমার পরিচিত। তার বেশ কিছু গল্প পড়েছি। ‘পরমসুন্দরী’  পড়ার পর মনে হচ্ছে লেখকের কলম ক্রমেই শানিত হচ্ছে। যত লিখছেন, ততই তার বর্ণনায়, বাক্যে পরিমিতি বোধ বাড়ছে। পর্যবেক্ষণ বাড়ছে। যা লেখকের মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়।

মনিজা রহমানের উপন্যাস ‘পরম সুন্দরী’ শুরু হয়েছে একটু অন্য ধাঁচে। একটি পর্ব সমবেত ভাবে। সেখানে গল্পের চার প্রধান চরিত্রই উপস্থিত থাকে। এই সমবেত পর্বটি খোলা বাতায়নের মত। এখানে এসে চরিত্রগুলো যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। অক্সিজেন সংগ্রহ করে। উপন্যাসের এই প্রধান চারটি চরিত্র হল রেবেকা, ফাল্গুনি, আয়শা এবং জেসি। তারা চারজন যখন একত্রিত হন তখন পরস্পরের কাছে নিঃসংকোচে নিজেদের হৃদয়ের আগল খুলে ধরেন।মনের গোপন কুঠরি উন্মোচন করেন।এটি তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা গতানুগতিক জীবন থেকে মুক্তির উপায়।জীবনের জটিলতা থেকে সরে এসে একটু  হাফছাড়া।


আরো পড়ুন: অদেখা কাশবন । মনিজা রহমান


পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় সম্পর্কের নাম বন্ধু। আমরা আমাদের জীবনের নানা টানাপড়েন থেকে মুক্তি পাই বন্ধুদের সাথে নির্ভেজাল আড্ডা দিয়ে। গল্পের প্রধান চার নারী চরিত্র একে অপরের বন্ধু হয়েছে মনের তাগিদে। অসমবয়সী হলেও আড্ডা, আলাপ, মনের ভাব আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে তারা একজন আরেকজনের উপর নির্ভরশীল, আস্থাশীল হয়ে উঠেছে।

সমবেত পর্বটির পরেই আসে পরপর চারটি একক পর্ব। চার প্রধান চরিত্রের ব্যাক্তিজীবন, সংসার, জীবনযাপন প্রনালীর সাতকাহনে ঠাঁসা এই পর্বগুলো। এই একক পর্বগুলোতে প্রধান চরিত্রগুলো তাদের নিজস্ব গন্ডিতে ফিরে যায়। সেখানে তারা তাদের যাপিত জীবনের আপন পারিবারিক বলয়ে ঘুরপাক খায়। সেখানে যেমন আশা আছে; আছে আশাভঙ্গের বেদনা। সেখানে আনন্দ আর দুঃখ যেন পরস্পরকে অবলম্বন করেই হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনও আলোর স্বল্পতা, কখনও বাতাসের ঘাটতিতে তারা হাপিত্যেস করে। ছটফট করে। কিন্তু পরমূহুর্তেই টানেলের অন্তিম প্রান্তে একটু আলোর ঝলকানি, বাতাসের একটু ঝলক তাদের আরও ভালভাবে বাঁচার আশাকে উজ্জীবিত করে তোলে। তাই উপন্যাসটি পাঠে পাঠক নিজেকে সহজেই গল্পের সাথে একিভূত করার সুযোগ পাবেন। চরিত্রগুলোকে পাঠকের নিজস্ব বলয়ের, চেনা-জানা, কাছের মানুষ বলে ভ্রম হবে।

পরম সুন্দরী’ উপন্যাসটি রচিত হয়েছে নিউইয়র্কে প্রবাসী চার জন নারীর জীবন কাহিনি নিয়ে। বাংলাদেশের মত অর্ধ উন্নত একটি দেশ থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী মানুষের জীবন সংগ্রামকে উপজীব্য করে তৈরি হয়েছে  উপন্যাসের পটভূমি। নিউ ইয়র্কের ঘনবসতিপূর্ণ কুইন্সের অভিবাসী এলাকা জ্যাকসন হাইটস হল গল্পের চারনভূমি। তাই অতিচেনা চরিত্রগুলোর পাশাপাশি বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসের সাথেও পাঠকের পরিচয় ঘটে। নিউ ইয়র্কের যে কোন পাঠকের মনে হতেই পারে, “আরে, জ্যাকসন হাইটসের ‘আপনা বাজারে’ আমি এই রেবেকার মতই একজনকে দেখেছিলাম। অথবা আমার ছেলের এক বন্ধুর মায়ের সাথে ‘আয়শা’র অনেক মিল আছে।”

আমি নিজে থাকি নিউ ইয়র্কে। দীর্ঘদিন জ্যাকসন হাইটস এ বসবাস করেছি। তাই প্রবাসী জীবন তথা জ্যাকসন হাইটসের জীবনযাত্রার সাথে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত। উপন্যাসটি পড়ার সময় আয়শা, ফাল্গুনি, রেবেকা এবং জেসি আমার চেনাজানা মানুষগুলোর মত রক্তমাংসের মানুষ হিসেবেই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই সুবাদেই তাদের সাথে নিজের একাত্মতা অনুভব করেছি। তারা যেন আমার দিকে ভ্রুকূটি করে বলতে চেয়েছে, “কী আশ্চর্য! আমায় চিনতে পারছো না? এই যে আমি! আমায় তুমি বহুবার দেখেছো। দেখেছো ইত্যাদি রেস্টুরেন্টে। হাটবাজারে। পিএস ৬৯ স্কুলের সামনে।”

একজন উপস্থাপক তার অনুষ্ঠানে দর্শক বা শ্রোতা ধরে রাখতে চাইলে সেই অনুষ্ঠানটি হতে হবে একেবারে ঠাঁশবুননী। অনুষ্ঠানের কোথাও একটু  শ্লথ হলেই অনুষ্ঠানটি ঝুলে পড়বে। সফল উপস্থাপকরা  আনন্দ, বেদনা, হাস্যরস দিয়ে দর্শক ধরে রাখেন। পরম সুন্দরীর গল্প কোথাও ঝুলে পড়েনি।  লেখা মেদ বর্জিত বলেই গল্পের প্রবাহ কোথাও শিথিল হয়নি।  গল্পের প্রতি পর্বে ছোটখাট  কিছু টুইস্ট বা চমক ছিল বলে পড়ে আনন্দ পাওয়া গেছে।

জেসি, আয়শা, রেবেকা আর ফাল্গুনী– এই চার নারীর সাথে পরিচয় হওয়ার পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্য এবং এদের সাথে জড়িত পার্শ্ব চরিত্রগুলোর সাথেও পাঠকের পরিচয় ঘটে। চরিত্র বর্ণনা এবং সম্পর্ক নির্ণয়ে  সাবলীলতার কারনে চরিত্রগুলো আরোপিত মনে হয়নি।  গল্পের তাগিদেই এরা এসেছে।

সহজ-সরল এবং ভীতু প্রকৃতির ‘রেবেকা’র জীবন অনেকটাই তার স্বামীর উপর নির্ভরশীল। স্বামীকে ছাড়া যার স্বাধীনভাবে কোন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু গল্পে একসময় তাকেও প্রতিবাদী হতে দেখা যায়। সেও জোড় গলায় নিজের সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহসী হয়ে ওঠে।

খানিকটা আধুনিকা, শিক্ষিতা মায়াবতী  চেহারার মেয়েটির নাম ‘আয়শা’।  জীবনসঙ্গী এবং দুটি সন্তান নিয়ে মোটামুটি অভিযোগহীন সুখী জীবন তার। সেই সংসারে আচমকা ঝড় ওঠে। সেই ঝড়ের নাম অটিস্টিক। আয়শা একসময় জানতে পারেতার ছোট সন্তানটি অটিস্টিকের শিকার।

আমার জানা মতে লেখক মনিজা রহমানের জীবনে  অটিজম একটি পরিচিত নাম। অটিজম বা অটিস্টিক শিশুদের তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। অটিজম নিয়ে তার পড়াশোনা এবং জ্ঞান আছে। তাই ঘরে এবং বাইরের পৃথিবীতে একটি অটিস্টিক শিশুকে নিয়ে কীভাবে নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় তার গল্পে তিনি তা যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রায়ানের মত স্পেশাল নীড শিশুদের পরিচর্যা এবং সেই পরিবারকে কীভাবে যৌথভাবে সবকিছু হ্যান্ডেল করতে হয় তা লেখক তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে তুলে ধরেছেন।

ফাল্গুনী এবং জেসি’র গল্প অভিবাসী জীবনের খুব চেনা গল্প। কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের দূর্ভোগ, যন্ত্রনা যেমন গল্পে এসেছে; তেমনি এর প্রতিকার হিসেবে এসেছে কাগুজে বিয়ে প্রসঙ্গটি। যা অনেক প্রবাসীদেরই জীবনের রূঢ় সত্য। যেহেতু আমেরিকা একটি বহুজাতিক দেশ, তাই এখানকার অধিবাসীরা এর ডাইভার্সিটিতে অভ্যস্ত। তাই জেসি’র মত উদার মনা নর-নারীরা অনায়াসেই  গ্রীক বা পর্তুগীজ কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে। অভিবাসী মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিজাতীয় এবং বিধর্মীয়  বৈবাহিক সম্পর্কটিও মনিজা তার গল্পে তুলে এনেছেন।

কোন গল্প বা উপন্যাস পড়ার সময় পাঠক শুধু তার মস্তিস্ক নয় হৃদয় দিয়েও পড়েন। তাই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে গল্পের কোন চরিত্র, ঘটনা বা বাক্য পাঠকের মনে গেঁথে যায়। পাঠকের মনে তখন ঘোর তৈরি হয়। যে লেখক পাঠকের মনে সেই ‘ঘোর’ তৈরি করতে পারেন, সে তত সার্থক লেখক। লেখক মনিজা রহমানের উপন্যাস ‘পরম সুন্দরী’ পড়ার পর আমার মনে হল লেখক তার গল্পে খানিকটা  ঘোর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

তবে বেশ কয়েকটি  শব্দের বহু ব্যবহার এবং একই বাক্যের বার কয়েক পুনরাবৃত্তি চোখে পড়েছে। যা বাহুল্য বা সম্পাদনার ত্রুটি হিসেবে ধরা যায়। আশা করি, মনিজা রহমানের লেখায় আরও সমৃদ্ধি আসবে। বাংলা সাহিত্যকে তিনি আরও সমৃদ্ধ করবেন তাঁর শক্তিশালী কলমের ছোঁয়ায়।

উপন্যাস:পরম সুন্দরী
লেখক: মনিজা রহমান
প্রকাশক:অন্যপ্রকাশ, বইমেলা ২০২৩
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর।
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৮৩

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত