| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায়- দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ, সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার, নয়নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল। এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম।

পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত। পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয়। পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মিত হয়েছিল। মন্দগপ্পত্তুর গুহামন্দির (দক্ষিণ আর্কট জেলা) একইসাথে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এর প্রতি উৎসর্গীকৃত এবং কোনরকম ইট-কাঠ ধাতু ছাড়া নির্মিত। চেন্নাই এর নিকটবর্তী পল্লবরাম এর পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট বৃহৎ গুহামন্দিরের দেওয়ালের লেখতে মহেন্দ্রবিক্রম, মত্তবিলাস, চেত্তকরি, বিচিত্রচিত্ত প্রভৃতি উপাধি খোদিত রয়েছে। উত্তর আর্কট জেলার মামুন্দুরে ও চারটি গুহামন্দির মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকালে নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলির মধ্যে একটি শৈব মন্দিরের গায়ে প্রাপ্ত  লেখ থেকে জানা যায় যে রাজা মহেন্দ্রবর্মন সংস্কৃত ভাষায় ‘মত্ত বিলাস প্রহসন’ নামে একটি নাটক রচনা করেছিলেন (সৌভাগ্যবশত যা রক্ষিত)। উত্তর আর্কট জেলার শিয়মঙ্গলমে অবনিভজন পল্লবেশ্বরম্‌ নামে একটি শৈব মন্দিরও মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকালে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাহাড় কেটে মন্দির তৈরীর এক অসামান্য নিদর্শন পাওয়া যায় তিরুচিরাপল্লী মন্দিরে। মন্দিরের গায়ে গঙ্গাধরের মূর্তি পদ্যাকারে রচিত একটি লেখ (যা থেকে মহেন্দ্রবর্মনের শৈব ধর্ম গ্রহণের কথা জানা যায়) এবং অন্যান্য ভাস্কর্যের সংমিশ্রণে এই মন্দিরটি পল্লব স্থাপত্য শৈলীর আকর্ষণীয় লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলি আজও বহন করছে। উপরোক্ত মন্দিরগুলি ছাড়া মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকালে আরো কয়েকটি শৈব ও বৈষ্ণব মন্দির নির্মিত হয়েছিল। যার নিদর্শন মহেন্দ্রবাড়ির মহেন্দ্র বিষ্ণু, গৃহ, শ্রী গবরমের রঙ্গনাথ প্রভৃতি মন্দিরে পাওয়া যায়। 

 প্রথম মহেন্দ্রবর্মন পরবর্তী পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন পাওয়া যায় চেন্নাইয়ের ৩২ মাইল দক্ষিনে মামল্লপুরম বা বর্তমান মহাবলীপুরমে। পল্লব সমসাময়িক যুগে মামল্লপুরম ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বন্দর ও নগর। নগরটির ধর্মনিরপেক্ষ স্থাপত্যের বিশেষ কোন নিদর্শন পাওয়া না গেলেও এখানকার অসামান্য দ্রাবিড় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য আজও তার শোভা বর্ধন করছে। বস্তুতপক্ষে ১০০ ফুট উচ্চতা আধ মাইল দৈঘ্য ও সোয়া মাইল প্রস্থ বিশিষ্ট গ্রানাইট পাথরের একটি পর্বত পল্লব যুগের শিল্পীদের কাজকে সহজ করে দিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখিত যে সমসাময়িক দক্ষিণ ভারতে মামল্লপুরম ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রবেশদ্বার এবং পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বাহির পথ যা দিয়ে হিন্দু সংস্কৃতি স্বমহিমায় ইন্দোনেশিয়া এবং ইন্দচিনে ছড়িয়ে পড়েছিল। 

 মহাবলীপুরম বা মামল্লপুরমের স্থাপত্যগুলিকে চারটি মূল ভাগে ভাগ করা যায়- ১) পাথর কেটে নির্মিত গুহামন্দির, ২) পাহাড় কেটে নির্মিত এক শৈলিকে মন্দির, যেগুলিকে বর্তমানে ‘রথ’ বলা যায়, ৩) খোলা আকাশের নিচে অবস্থিত পাথরের উপর তৈরি ভাস্কর্য (Bas-relif Sculptures in the open air rocks) এবং ৪) কাঠামো যুক্ত মন্দির বা structural temples। মামল্লপুরমে মোট ১৫টি গুহামন্দির রয়েছে যেগুলিকে মন্ডব বলা হয়। এই মন্ডপ শৈলির মধ্যে মাত্র কয়েকটির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এক একটি মন্ডপের নির্মাণশৈলী এক এক রকম। কোনটির মুল উপাসনা কক্ষ (যেখানে বিগ্রহ থাকে) পিছনের দেয়ালে গহ্বর তৈরি করে নির্মিত, কোনটির মুল কক্ষ আবার হলের মধ্যে, কোনোটিতে মূল কক্ষ ছাড়া ও একটি খাম বিশিষ্ট প্যাভিলিয়ন রয়েছে, কোনোটিতে আবার পর্বত মুখের বাইরের দিকে দেওয়াল কেটে মুল কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এই গুহামন্দিরগুলির মধ্যে পঞ্চপান্ডাব গুহাটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ‘গঙ্গার অবরোহন ভাস্কর্য যুক্ত পাথরের নিকট অবস্থিত এই গুহামন্দিরটির মুল কক্ষের চারপাশে প্রদক্ষিণের জন্য একটি পথ লক্ষনীয়। মামল্লপুরমের মহিষমর্দিনী, আদিবরাহ, বরাহ ত্রিমূর্তি প্রভৃতি মন্ডবগুলির অপরূপ ভাস্কর্য আজও রক্ষিত। অন্যদিকে রামানুজ প্রভৃতি গুহার ভাস্কর্য নষ্ট হয়ে গেছে। উদত্ত সিংহের উপর অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা মহিষাসুরকে আক্রমণ করছেন- এই বিখ্যাত চিত্র মামল্লপুরম শৈলির সৃষ্টি। অশুভ শক্তির উপর দৈব প্রকৃতির বিজয় লাভ- এই ধারণার এত অপরূপ পর্বত ভাস্কর্যের নিদর্শন বিরল। এই চিত্রের সাথে সাথে বিপরীত দেওয়ালে উৎকীর্ণ মহাজাগতিক নিদ্রায় শায়িত বিষ্ণুর প্রতিচ্ছবি ও অসংখ্য দর্শককে মুগ্ধ করে। আদি বরাহ গুহার লক্ষ্মী এবং দুর্গার প্রকৃতির পাশাপাশি পল্লব রাজ সিংহবিষ্ণু ও মহেন্দ্রবর্মনের প্রতিকৃতি বরাহ গুহামন্দিরের দেওয়ালে অঙ্কিত বরাহ, ত্রিবিক্রম, শ্রীদেবী এবং দুর্গার প্রতিকৃতি এবং সলুবঙ্কুপ্পমের বাঘগুহার ভাস্কর্য ও দারুণভাবে চিত্তাকর্ষক। 

মামল্লপুরমে দশটি এক শৈলিক মন্দির আছে যেগুলির মধ্যে পঞ্চপান্ডব রথ বিখ্যাত। নগরের পশ্চিম প্রান্তে এক জোড়া ‘পিদরি রথ’ ও বলয়ঙ্কুটত্তৈ রথ এবং বৃহৎ ভিত্তিপ্রস্তর ভাস্কর্যের নিকটে গনেশ রথ অবস্থিত। পঞ্চপান্ডব রথগুলি (পাঁচটি রথের সমষ্টি) এক একটি এক এক শৈলীতে তৈরি। অর্জুন ও দ্রৌপদি রথের একটাই উপপীঠ। কুড়ে ঘরের আকৃতিবিশিষ্ট দ্রৌপদী রথ দুর্গার প্রতি উৎসর্গীকৃত। এই রথের মূল কক্ষ বা Sanctum এর পেছনে দুর্গার মূর্তি খোদাই করা আছে। অর্জুন রথ হল দ্বিতল বিশিষ্ট মন্দির, যার শিখর অষ্টকোন বিশিষ্ট এবং যার সম্মুখে একটি ধর্মমন্ডপ রয়েছে। ভীম রথ তুলনায় লম্বাকৃতি এবং আয়তকার যার কেন্দ্রে মূল কক্ষ বা Sanctum অবস্থিত। ধর্মরাজ রথটিতে তিনতলা বিশিষ্ট বিমান রয়েছে এবং প্রত্যেকটি তলায় একটি করে গর্ভগৃহ রয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার দেওয়ালে অপরূপ ভাস্কর্য লক্ষণীয়। এই রথগুলির নির্মাতাদের যে উপাধি বা পদবীর তালিকা পাওয়া যায় তাদের অনেকগুলি আবার কাঞ্চির কৈলাসনাথ মন্দিরে পাওয়া যায়। মন্দিরের আকৃতি বিশিষ্ট সহদেব রথ এর সামনে একটি স্তম্ভশ্রেণি বিদ্যমান। পিদরি রথদ্বয়ের একটির শিখর অষ্টকোন বিশিষ্ট, অন্যটি বর্গাকার শিখর যুক্ত। রথগুলির মধ্যে কেবলমাত্র গণেশ রথটির নির্মাণকার্য প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং আয়তকার বিমান এবং সম্মুখভাগে অর্ধমন্ডপ এই রথটির বৈশিষ্ট্য।

 মামল্লপুরমের পল্লব স্থাপত্য ভাস্কর্যের গৌরবময় সৃষ্টি গঙ্গার অবরোহন বা অর্জুনের প্রায়শ্চিত্ত পাথর কেটে চিত্রপ্রদর্শনের এই প্রয়াস অকল্পনীয়। বাস্তবিকই এগুলি হল classical poem in stone। চিত্র বিশিষ্ট পাথরটির মাঝখানে রয়েছে একটি জলপ্রপাত যেখানকার পবিত্র জলে সন্ন্যাসীরা স্নান করে এবং যার দুদিকে পাথরের দেওয়ালে অসংখ্য পাথর কেটে প্রতিকৃতি খোদাই করা হয়েছে। Grousset এই ভাস্কর্যটিকে ধ্রুপদী শিল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলে চিহ্নিত করেছেন ( “what we have before us here is a vast picture, a regular fresco in stone, this relief is a  master piece of classic art in the breadth of its composition the sincerity of impulse which draws all creatures together round the beneficent waters and its deep fresh love of nature” R. Grousset – Indian the civilizations of the East series) গঙ্গার অবরোহন নিকটে অবস্থিত কৃষ্ণা গোবর্ধনধারীর ভাস্কর্যও অপরূপ।

 কতিপয় পন্ডিত মনে করেন যে, মামল্ল প্রথম নরসিংহবর্মনের সময় থেকে শুরু করে রাজসিংহের রাজত্বকাল পর্যন্ত ১০০ বছরের (৬৩-৭২৮) সময়কালে মামল্লপুরমের স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল। অন্য মতানুযায়ী মামল্লপুরমের স্থাপত্য কেবলমাত্র রাজসিংহের রাজত্বকালেই নির্মিত হয়েছিল। মামল্লপুরমে ধর্মরাজ মন্ডপম্‌ এবং একশৈলীক গণেশ রথে ভিত্তি সংক্রান্ত যে লেখ পাওয়া গেছে তার সঙ্গে রাজসিংহ প্রতিষ্ঠিত সলুবঙ্কুপ্পমের গুহায় প্রাপ্ত লেখর প্রচুর মিল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় নরসিংহের উপাধিগুলির অন্যতম হল ‘অত্যন্তকাম’ ( King of Endless Desire) ধর্মরাজ রথকে বলা হয় অনন্তকাম পল্লবের ঈশ্বরগৃহ। উপরোক্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে নীলকন্ঠ শাস্ত্রী প্রমূখ পন্ডিত মনে করেন যে দ্বিতীয় মতটাই অধিক গ্রহণযোগ্য।

পল্লব রাজত্বকালে নির্মিত কাঠামো যুক্ত মন্দিরগুলিকেও দুই ভাগে ভাগ করা যায় ক) রাজসিংহ গোষ্ঠী (৭০০-৮০০) এবং খ) নন্দী বর্মন গোষ্ঠী (৮০০-৯০০)। প্রথমোক্ত ভাগের নিদর্শন হল মামল্লপুরমের শোর ঈশ্বর ও মুকুন্দ মন্দির পানামালাইর মন্দির এবং কাঞ্চিপুরমের কৈলাসনাথ ও বৈকুণ্ঠ পেরুমল মন্দির। এদের মধ্যে প্রাচীনতম উপকূল মন্দিরটি (shore temple) বারোশো বছরের সামুদ্রিক ঝড় ঝাপটা সামনে আজও দাঁড়িয়ে আছে। একদম জলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এই মন্দিরটি cella কক্ষ সমুদ্রের দিকে মুখ করা, মন্দির সংলগ্ন অন্যান্য কক্ষগুলি মন্দিরের পেছনে অবস্থিত। মূল গৃহের চারপাশে একটি বিশাল প্রাচীর, পশ্চিম দিক থেকে মন্দিরের প্রাঙ্গণের প্রবেশ পথ। পশ্চিমের দুটি অতিরিক্ত মন্দির রয়েছে, একটিতে ক্ষুদ্রবিমান, মূল মন্দিরের দুটি বিমান থাকলেও তার জন্য এর স্বাভাবিক সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়নি। বস্তুতপক্ষে এই মন্দিরটির মধ্য দিয়ে স্থাপত্য শৈলীর দুটি রূপান্তর অত্যন্ত স্পষ্ট। পাথর কেটে মন্দির নির্মাণ পদ্ধতি থেকে কাঠামো যুক্ত মন্দির তৈরি এবং বিহারের পরিবর্তে হালকা বিমান তৈরি। এই মন্দিরের গায়ে খোদাই করা সিংহের প্রতিকৃতিটিও percy Brown প্রমুখ পণ্ডিতের প্রশংসা কুড়িয়েছে। মন্দিরটির গায়ের বাইরের অংশটিও কারুকার্য শোভিত, তোরনদ্বারটিও দারুণভাবে সুসজ্জিত।

উপকূলের মন্দিরের নির্মাণের অল্পকালের মধ্যেই কাঞ্চির কৈলাসনাথ মন্দির নির্মাণ শুরু হয়, যদিও এর নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয় রাজসিংহের পুত্র মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকালে। পিরামিড এর আকৃতি বিশিষ্ট বিমান যুক্ত মূল উপাসনা কক্ষ ছাড়াও একটি অসংলগ্ন স্তম্ভবিশিষ্ট মন্ডপ সম্মুখভাগে মন্দিরটির শোভা বর্ধিত হয়েছে। সমগ্র চত্বরটি একটি কক্ষ বিশিষ্ট প্রাকার দ্বারা বেষ্টিত। পরবর্তীকালে একটি অর্ধ মন্ডপের মাধ্যমে মূল কক্ষের সঙ্গে মন্ডপটিকে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যার ফলে সামগ্রিক রূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল কক্ষ এবং বিমানের সঙ্গে ধর্মরাজ রথের মূল কক্ষ ও বিমানের যথেষ্ট মিল রয়েছে। মূল মন্দিরের চারকোণে এবং তোরনদ্বার ব্যাতিত বাকি তিনটি দিকের মাঝখানে একটি করে ছোট্ট মন্দির অবস্থিত- এই সাতটি ছোট মন্দির সামগ্রিক শোভা বাড়িয়েছে। পল্লব স্থাপত্য শৈলীর প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই এই মন্দিরটিতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। উপকূলের মন্দিরের তুলনায় কৈলাসনাথের বিমান গঠনগত দিক দিয়ে আরও উন্নত। কৈলাসনাথ মন্দিরের সম্পূরক মহেন্দ্রবর্মেশ্বর মন্দিরের তোরনদ্বার নির্মাণের ক্ষেত্রে গোপুরম বেশ কয়েকটি লক্ষণ দেখা যায়। কৈলাসনাথ মন্দিরের ভিত্তি গ্রানাইটের, যা প্রচুর ওজন ধরে রাখতে পারে, উপরের ভাস্কর্য পূর্ণ কাঠামোর ক্ষেত্রে বেলে পাথরের ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে সময়ের সাথে সাথে নির্মাণশৈলীতে ও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটেছে।

পল্লব স্থাপত্যের পরিণত নিদর্শন কাঞ্চির বৈকুণ্ঠ পেরুমল মন্দির। কৈলাসনাথ মন্দির থেকে আয়তনে কিছুটা বড় এই মন্দিরের প্রধান অংশগুলি- আচ্ছাদিত উদ্যান পথ, স্তম্ভ শ্রেণি, প্রধান কক্ষ চমৎকারভাবে গ্রথিত। এর বাইরের প্রাচীরে সরল কারুকার্য, ভেতরের খোলা বারান্দা, উদ্যান পথের সিংহ স্তম্ভ ও পল্লব ইতিহাসের বিশিষ্ট ঘটনার প্রদর্শনকারী ভাস্কর্য মন্দিরটির শোভা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। স্তম্ভ যুক্ত বর্গাকার বারান্দা থেকে একটি গলি দিয়ে আয়তকার cella বা ভূগর্ভস্থ কক্ষে যাওয়া যায়, যার উপর ষাটফুট বিশিষ্ট বর্গাকার বিমানটি তৈরি হয়েছে। চারতলা এই বিমানটির গঠন ও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক।

নন্দীবর্মন গোষ্ঠীভুক্ত কাঠামোযুক্ত মন্দিরগুলি অধিকাংশই আকারে ছোট। কাঞ্চিপুরমের মুক্তেশ্বর ও মাতঙ্গেশ্বর,  বাগদামের বাড়ামল্লীশ্বর, তিরুপতির বিরাটানেশ্বর, গুড়িমল্লমের পরশুরামেশ্বর মন্দিরগুলি এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই মন্দিরগুলির মধ্যে কাঞ্চিপুরম মন্দিরগুলি সম্ভবত প্রাচীনতম। উভয় মন্দিরের প্রবেশ পথেই দুই স্তরবিশিষ্ট পোটিকো দেখা যায়। এই গোষ্ঠীর অপর চারটি মন্দির গঠনগত দিক দিয়ে অনুরূপ, প্রত্যেকটিতেই মামল্লপুরমের সহদেব রথের প্রভাব লক্ষণীয়। এই ক্ষুদ্র কাঠামো বিশিষ্ট মন্দিরগুলি পল্লব রাজশক্তির ক্রমহ্রাসমান রাজনৈতিক শক্তির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহ্যগত অমরাবতীর মত পল্লবরাও তাদের সংস্কৃতিকে সমুদ্রের ওপর পাড়ে দক্ষিণ-পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

পল্লব রাজত্বকালে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা কেবলমাত্র স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সঙ্গে তালমিলিয়ে সাহিত্যের জগতও আলোড়িত করেছিল। পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মন কেবলমাত্র শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না, ‘বিচিত্র চিত্ত’ এই সম্রাট স্বয়ং একজন লেখক, সঙ্গীতজ্ঞ ও চিত্রশিল্পী ছিলেন। তাঁর ‘মত্ত বিলাস প্রহসন’ সমসাময়িক সাহিত্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকালে বা তার অল্পকাল পরেই দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিরুদ্ধে এক প্রবল ধর্মীয় পুনর্জাগরণ মূলক আন্দোলন শুরু হয়। শৈব নয়নার ও বৈষ্ণব আলওয়ারদের মন পাগল করা ভক্তিগীতি পরবর্তীকালে ‘দেবারং’ বা ‘দিব্যপ্রবন্ধম্‌’ নামে সংকলিত হয়। তাদেরই এই ভক্তিগীতি সংকলন তামিল সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ রূপে আজও পরিগণিত। পল্লব যুগেই বাস করতেন মহান কুমারিল যিনি বেদকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং যাগ-যজ্ঞপূর্ণ ধর্মকে পুনরায় সমর্থন করেছিলেন। পল্লব রাজত্বকালেই এসেছিলেন মহত্তর শংকর যিনি অসামান্য প্রজ্ঞার মাধ্যমে অদ্বৈত বেদান্তকে জন্ম দিয়েছিলেন। চীন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে দৌত্য বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পল্লবরা কেবলমাত্র সমসাময়িক সমুদ্র বাণিজ্য জনিত লাভটাই গ্রহণ করেননি, সেইসাথে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভারতের বাইরে ছড়িয়ে দিতেও সাহায্য করেছিল। সার্বিকভাবে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পল্লব রাজত্বকাল ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক সৃজনশীল যুগ হিসাবে আজও সমাদিত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত