| 20 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা সিরিজ কবিতা: পাথর মন্ডল । মঈনুস সুলতান

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

।। এক।।

খানিক যেন চেনা মনে হয়, কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারি না এসেছি কোথায়। সান্ধ্যভাষার মতো তাবৎ কিছু কেমন যেন আধেক অচেনা,  নদীজলে খানিকটা গলুই ভেসে যায়। চাদরে জড়ানো মুখমাথা ঠিক স্পষ্ট নয়; দাঁড়িয়ে ভাবি, চাইলে করা তো যায় খানিক লেনাদেনা। যষ্ঠি হাতে একজন মানুষ পোষা গাধাটির পিটে ভেষজ চাটের বোঝা নিয়ে হেঁটে আসেন। সাথে ক্ষীণ কটি নারী, দীর্ঘাঙ্গীর মাথায় ঠিল্লা, কাঁখে শিশু, হেঁটে আসছে পিছু পিছু — একটি ছাগল, কিনি চাটের সবুজিম পত্র, বাক্য বিনিময় হয় না তেমন কিছু। দু’পা সামনে বাড়িয়ে ফিরে তাকায় নারীটি, কেন জানি তার চোখ দুটিকে দেখায় সজল। এদিকে কোথাও আছে কী কোন সরাই..জলসত্র?

[br]

 

[br]

 

 

।। দুই।।[br]

চলমান জলের শরীর নিশানা করে আগ বাড়ি। দিগন্তকে মনে হয় না তেমন দূর, আড়াল করে দাঁড়িয়েছে প্রবল পাহাড়, কাঁটাদার ঝোপঝাড়ে উতল হাওয়া কাটা-ঘুড়িটি হয়ে তৈরী করে বিচিত্র ছন্দসুর, পর্বতের পাকস্থলি থেকে যেন বেরিয়েছে ছোট বড় মাঝারি মাপের পাহাড়, , উষর প্রান্তরে পড়ে আছে মৃত জন্তুর সাদাটে হাড়, দেশটি তবে কী ইথিওপিয়া, ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো কিছু বৃক্ষে লালচে সোনালি আভায় জ্বলে কাকরোলপ্রতিম পুষ্পের দীপন দিয়া।

 

[br]

 

[br]

 

 

।। তিন ।।[br]

না হয় চলা গেলো কিছুটা পথ অস্পষ্ট আভায়, করোটিতে না হয় ঝেঁপে নামলো বিস্মরণের অমানিশা, অচেনা সরণীতে হাঁটা ঝুঁকিপূর্ণ কিছু তো নয়, খানিক ঘুরে-ফেরে হয়তো মিটতে পারে দূর দিগন্তের তৃষা। কিছু ভুলবাল, অবচেতনের তুমুল জলে ডুবে থাকা পরিযায়ী প্রবাল, দিনযাপনে ডুবুরি হওয়ার সুযোগ নাই থাকলো, খামখেয়ালের বাগিচায় প্যাসন ফ্রুটটি না হয় নাই পাকলো। সঠিক মানচিত্র কী আসলেই খুব প্রাসঙ্গিক? প্রস্তরীভূত বৃক্ষের বনানীও জোগাতে পারে অনুসাঙ্গিক, গন্তব্য থাকাটা খুব জরুরি কিছু কী, নিরিখ করে তাকাই প্রান্তরে ফের, বেলাও হয়েছে ঢের, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপুল সব বোল্ডারে লেপ্টে আছে স্ফটিক, সুরুযের তেজে ফুলকি ছোটায় জোনাকি।

 

[br]

 

[br]

 

 

।। চার।।[br]

এসে পড়ি নদীটির সন্নিকটে। পাড়ে স্বর্ণলতায় সমাচ্ছন্ন কী যেন এক কাঠামো, মনে হয়— পড়ো মন্দির, ওপাড় থেকে পাহাড়ের নিশানায় উঠে গেছে রক-ওয়াল, পুরোটা পরিসর জুড়ে— কে জানে কোন যুগে— কারা যেন এঁকে রেখে গেছে হৃৎপিন্ড বেঁধা বিপুল মাপের তীর। পাথর গেঁথে তৈরী করা হয়েছে একটি পুল, পাড়ি দিতে গিয়ে মনে হয়, আজো শুধরানো গেলো না যে, শৈশব থেকে বার বার স্মৃতিতে ফিরে আসে সে ভুল। অনুশোচনায় মস্তিষ্ক হয়ে ওঠে ভারাক্রান্ত, যারা এক যুগে গড়েছিল সাঁকো কিংবা দেবদেউল, তাদের দিনযাপনের মানচিত্র ছিলো কী অভ্রান্ত?

[br]

 

[br]

 

।। পাঁচ।।[br]

সোপানে ঠেকা দিয়ে উপরে উঠে গেছে অসংখ্য সোপান। কায়ক্লেশে ফেলি পা, মুখে পুরি চাট এর ভেষজ পাতা, তাতের মেশাই কৌতূহলের অনুপান। মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে যাদুময় আবেশ, চলে আসি লুকআউট স্পেসে, একটু দাঁড়াই,দম ফেলে বারেক ফিরে তাকাই; নিরিখ করে দেখে নেই উপত্যকার প্রতিবেশ। গন্তব্য সুষ্পষ্ট না হলেও মনে হয়, যাত্রাপথের সীমান্ত হতে পারে আজ সুদূর, কঞ্চির মতো শক্তপোক্ত ঘাসে দোল খাচ্ছে পাখি, ছড়ানো ছিটানো পাষাণে রোদ পোহানো গিরিগিটির সংখ্যা সুপ্রচুর। ফের পা ফেলি, সামিটের কাছাকাছি নড়বড়ে হয়ে আছে কতিপয় সোপান, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে ওঠে তোড়জোড়, নিখাদ ভালোবাসার বিনিময়ে কখনো কেউ কী পেয়েছে প্রতিদান?

[br]

 

[br]

 

।। ছয়।।

মেরুদন্ডপ্রতিম রিজটি পাড়ি দিয়ে চলে আসি প্লাটোতে। পাওয়া যায়— আকারে বেটেখাটো আচানক একটি বিরিক্ষের দেখা, ফুটেছে পাঁচটি আংগুলের মতো ফুল, বর্ণীল দুটি বেজায় ক্ষুদ্র সানবার্ড খুঁটছে পালা করে, জল ঝরার ঝিরিঝিরি শব্দে নিজেকে মনে হয় ভারি একা, স্বচ্ছ ডানায় সুরুযের সাত রঙ মেখে খেচর-জোড়া সুঁচালো ঠোঁটে যেন বেঁধাচ্ছে হুল। কেবলই শব্দ শুনি, ঝিরিঝিরি আওয়াজে ছড়াচ্ছে জনমের বিধুর সম্মোহন, নুড়ি পাথরের ফাঁকে ফুটেছে স্পর্শে এলিয়ে পড়া কিছু ফুল, বুজকুড়ি তোলে দ্রবিভূত হয় অবদমন; গৃহ ছেড়ে কতোটা পথ পাড়ি দিলে নিজেকে মনে হতে পারে উন্মূল?

 

[br]

 

[br]

।। সাত।।

ডিঙ্গাতে হয়— এলিয়ে পড়া বাল-হাতিটির মতো একটি জগদ্দল শিলা। তারপর নামতে শুরু করি। ধাপের পর ধাপ…এদিকের পাষাণের আকৃতি ভারি বিচিত্র, একটি প্রস্তরে তৈরী হয়েছে আদিম যুগের প্রমীলা, ভাবি, আছে কী তেমন কোন কৌশল— যাতে শণাক্ত করা যেতে পারে প্রকৃত মিত্র? ঢালুতে পা দেই, গড়িয়ে নামি বেশ খানিকটা, অতিক্রম করি বিরাট আরেকটি ধাপ, পাশেই সংকীর্ণ প্রস্রবণ, পাথরে হোঁচট খেয়ে চলন্ত পানি তুলছে ফণা, যেতে যেতে ভাবি, যাপিত জীবনের মনস্তাপ, দখিনা হওয়ায় উড়ে আসে— প্রতিসরিত সূর্যে বর্ণাঢ্য জলকণা।

 

[br]

 

[br]

।। আট।।

ঢালেও যেন তিমি মাছের মতো পিট বাঁকিয়ে ঝুলছে মিনিয়েচার একটি উপত্যকা, ছড়িয়ে আছে অজস্র ক্যকটাস, বিশুষ্ক কিছু ফুলের পাপড়িতে বাস করছে ছানাপোনা নিয়ে ছায়ামায়া রঙের পোকা। পাথরে পাথর ঠেকিয়ে কারা যেন তৈরী করেছে রীতিমতো আল, উছলে ওঠছে তাতে জলধারা, আর্দ্রতায় স্যাঁতস্যাঁতে মস দানা বেঁধে সৃষ্টি করেছে বিরল প্রজাতির শৈবাল। যেতে যেতে চোখের সামনে— ক্রমে ক্রমে তৈরী হয় পুরোদস্তুর জলপ্রপাত, নেমে যাচ্ছে নিচে.. .. আরো নিচে.. গড়িয়ে পড়ছে দ্রবিভূত রূপায় ঝিলিক পাড়া আকৃতি, ঝলসে ওঠছে বিচূর্ণ সুরুযের তুমুল সম্পাত। বহতা জল ছুটে যেতে যেতে.. স্তরে ..স্তরে.. তৈরি করে চলেছে তরল কাসকেইড, ইচ্ছে হয়, নাম না জানা এ জলনৃত্যজোৎস্নাকে নিজেই নামকরণ করি— বলি, আজ থেকে তুমি না হয় হলে কাসকেডেলা, থামতে পারি না, কেবলই নামতে থাকি, আধভেজা পাথর ডিঙ্গাতে ডিঙ্গাতে দেহমন থেকে মুছে যায় এ জনমের যত অবহেলা।

[br]

 

[br]

 

।। নয়।।

চলিষ্ণু জল চলে গেছে শিলাস্তম্ভের ওপারে। ভূইফোঁড়ে দলচ্যুত কিছু তরল তৈরী করেছে কয়েকটি গহ্বর। সৌধপ্রতিম পাষাণের ভাঙ্গাচোরা পিনাকোল গলে চুঁইছে আসছে রশ্মি, তাতে একটি জলাধার হয়ে আছে আল্পনাময় পসর। কৃষ্ণাভ গতরে বাষ্প মেখে আধডোবা এক নারী বার বার জড়িয়ে ধরছে উষ্ণতা, তাঁর পৃষ্টদেশ জুড়ে উল্কিতে আঁকা উর্বরতার প্রতীক, নিমেষে করোটিতে খেলে যায় নৃগোষ্ঠির বিশেষ এক প্রথা, জল তোলপাড় করে পাশ ফেরে, গায়ে মাখে কর্দম, আন্দাজ করতে পারি না- কী-বা তার ভাবগতিক?

 

[br]

 

[br]

 

।। দশ।।[br]

আলাভোলা হাওয়ায় জুড়িয়ে শরীর-গতর, অতিক্রম করি ছোটখাট একটি গিরিখাত। চলতে চলতে স্পষ্ট শুনতে পাই,খানিক আড়ালে বয়ে যাচ্ছে ইষ্পিত প্রপাত। নামতে গিয়ে ঝরঝরিরে ধ্বসে পড়ে খুচরা পাথরখন্ড, পথ এদিকে রীতিমতো অগম্য, স্লাইড করে কিছুটা গড়িয়ে এক্রোব্যাটদের কায়দায় রক্ষা করি ভারসাম্য, দাঁড়াই কিছুক্ষণ, নিচের দিকে বালুকা ঘষটে— আস্তে-ধীরে নেমে যাচ্ছে পৃথুলা একটি পাষাণ, মেরুদন্ডে হেঁটে যায় স্নায়ুবৃশ্চিক, সমগ্র স্বত্তায় অনুভব করি আসন্ন পতন। ফের পা বাড়াই, মাথার ওপর ঝুলে ছায়াদার জগদ্দলের সাক্ষাৎ খাঁড়া, কী এক প্রেষণায় এবারকার মতোও অতিক্রম করি মৃদু ফাঁড়া।

 

[br]

 

[br]

 

।। এগারো।।[br]

এখানে জলের ধারাছন্দ-দীপ্তি ঘুরে ফেরে তৈরী করেছে দুর্দান্ত একটি দহ, ঠিক মধ্যিখানে আধডোবা পাথর, তার ধূসরিমে ডানা-নখ-ঠোঁটে যুঝে স্বর্ণনীলে সবুজ দুটি পাখি, স্পষ্টত বেঁধেছে তুমুল কলহ। নিরিখ করি, মনে হয় যুঝ্যমান জলময়ূর, শণাক্তকরণ হতে পারে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, এবেলা আমি পথশ্রান্থ.. ইনসানের উপস্থিতি পছন্দ হয় না তাদের, জংগল জুড়ে তেড়েফুঁড়ে আওয়াজ তোলে অপসৃয়মান অশ্বখুর। ডানায় বর্ণের বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে উড়ে যায় তারা নিদাগ নীলিমায়, এতদূর এসেছি যখন, বসে পড়ি সটান, পাষাণ-প্রপাতের নিবিড় ঠিকানায়।

 

[br]

 

[br]

 

।। বারো।।[br]

আধডোবা পাথরটিতে ফুটে আছে বহুবিধ রেখা, রেখার সঙ্গে যোটক বেঁধেছে রঙ— পাটকিলে, তাম্র ও ধূসর, তৈরী হয়েছে কিছু চিত্র— ছুটন্ত হরিণ, ইনসানের আকৃতি, ধনুক ও ঘর। মৃদু স্রোতে শিলাটি ঘিরে ঘুরপাক করে ঝরা পাতা, সোনালি-লোহিতে সেঁটে আছে গাঢ় সবুজের চন্দ্রহার, ছিন্নপত্র একটি-দুটি নয়, বেশ ক’টি, তাতে জাঁকিয়ে বসেছে শুঁয়োপোকা, গড়েছে নীড় পরিপাটি, নীরবে চেখে নিচ্ছে জলখাবার। ধুন ধরে চেয়ে থাকি, ফিরে আসে জোড়া জলময়ূর, চক্রাকারে মাথার উপরে ঘুরে স্বর্ণনীলে সবুজের বিচ্ছুরণ ছাড়ানো দুটি পাখি।

 

 

[br]

 

[br]

 

 

।। তেরো।।[br]

শুমার করি নীরবে, শুঁয়োপোকার সওদা নিয়ে সুরুজ ঠিকরানো পাথরকে কেন্দ্র পরিক্রমা করছে— একটি শিশুপত্রসহ মোট নয়টি পত্রালী, আধডোবা শিলাটির নামকরণ হয়ে যেতে পারে আজ, রোমাঞ্চিত হই ভেবে— যাদিবা বনানীতে এখন ওঠে দৈব করতালী; ধরা যাক — তালিয়ে যেতে যেতে ভেসে থাকা পাষাণটি পাথর মন্ডল, তাকে ঘিরে ঘুরছে নয়টি গ্রহপ্রতিম পত্র স্রোত জলজোৎস্নার কক্ষপথে, সিনা ও কল্বে নীরবে কল্লোল ওঠে প্রবল, সম্পূর্ণ অপরাহ্ণ না হয় এ নিরলে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেই, তাড়া তো নেই কিছু—বাঁধা পড়িনি কারো ঘরে সাঁঝবেলা প্রত্যাবর্তনের শপথে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত