| 28 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

পারফিউমের ইতিবৃত্ত এবং বাঙালির সুগন্ধি চর্চা । রানা চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিতের পর ইংরেজ অনুরাগীদের অনেকেই বন্যার জলের মতো বিত্ত-বৈবভের অধিকারী হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে কলকাতার শোভাবাজারে পাশাপাশি দু’জন প্রতিবেশী ছিলেন। একজন রাজা নবকৃষ্ণদেব। অন্যজন চুড়ামনি দত্ত। দেব আর দত্তদের মধ্যে তখন চলছে তুমুল লড়াই, কে বড় আর কে ছোট এই নিয়ে। রাজা নবকৃষ্ণদেবের আরেকটি কীর্তি হচ্ছে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর ঠিক সে বছরই, অর্থাৎ ১৭৫৭ সালে তিনি চোখ ধাঁধানো এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে কলকাতায় দুর্গা পূজা উৎসবের গোড়াপত্তন করেছিলেন।
নবকৃষ্ণ তাঁর মায়ের উৎসাহে ইংরেজি, ফারসি ও আরবি ভাষা শেখেন সুচারুরূপে। এর ফলে প্রথমে ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি শিক্ষক নিযুক্ত হলেন নবকৃষ্ণ। সেখান থেকে নিজের যোগ্যতা ও বুদ্ধিবলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনশির পদ লাভ করলেন। লর্ড ক্লাইভ তখন কোম্পানির প্রভাবশালী ব্যক্তি। নবকৃষ্ণ ক্রমেই তাঁর কাছের লোক হয়ে উঠলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিরোধে রাজা রাজবল্লভ, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, মীরজাফর, জগত শেঠদের সঙ্গে নবকৃষ্ণও কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর সিরাজের বিশাল টাকা ও সম্পত্তির একটি ভাগও পেয়েছিলেন তিনি।
তো হয়েছে কি সেই নবকৃষ্ণদেব কিংবা চুড়ামনি দত্তরা এতটাই ধনী হয়েছিলেন, তাঁরা কীভাবে যে তাঁদের অর্থ খরচ করবেন সে বিষয়ে প্রায়ই দিশা পেতেন না। সে সময়কালেরই একটি ঘটনা- একদিন এক ব্রাহ্মণের ছেলের কানে পুঁজ জমেছে। ছেলেকে নিয়ে ব্রাহ্মণ ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সাহেব সব শুনে-বুঝে বললেন, এই রোগের মোক্ষম ওষুধ হচ্ছে পচা আতর।
গরিব বামুন আঁতকে উঠলেন- পচা আতর!! তা পচা আতর আমি কোথায় পাব ডাক্তার সাহেব? ডাক্তার বেচারাই আতরের সন্ধান বাতলে দিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণকে। ডাক্তারের পরামর্শমতো বামুন গিয়ে হাজির রাজা নবকৃষ্ণদেবের দুয়ারে। কী চাই, জিজ্ঞেস করলেন নবকৃষ্ণের ছেলে গোপীমহনদেব। বামুন কাচুমাচু কণ্ঠে বললেন- আজ্ঞে আমার ছেলের কানে পুঁজ জমেছে একটু পচা আতর প্রয়োজন। গোপীমহন তো রেগে আগুন। আমরা কি পচা আতরের আড়ৎ খুলে বসেছি। পচা আতর চাই তো পাশেই চুড়ামনি দত্তের বাড়ি সেখানে চলে যাও। আর শোন তোমার ওই ছোট পাথর বাটি দেখে চুড়ামনি দত্ত হয়তো রেগে যাবেন। একটি কলসি নিয়ে যেও। বামুন এবার চুড়ামনি দুয়ারে গিয়ে হাঁক ছাড়লেন। চুড়ামনি দত্ত বললেন, কি চাই। আজ্ঞে একটু আতর। চুড়ামনির দত্ত বললেন, পাত্র এনেছ। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই যে কলসি। কলসি দেখেই চুড়ামনি সব বুঝতে পারলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আতরওয়ালাকে ডেকে বললেন, এই কলসিখানা ভরতে কত টাকার আতর লাগবে। আড়াই হাজার টাকার মতো, হেসে বললেন আতরওয়ালা। তাহলে এক্ষুণি এক কলসি আতর দিয়ে দাও এই বামুনকে। চুড়ামনি দত্ত বামুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যাও এবার ওদের দেখিয়ে এসো। আর শোনো, গোপীমহন ছোট মানুষ ওকে দেখিয়ে কোন লাভ নেই তুমি বরং নবকৃষ্ণকে দেখাবে। বামুনও কলসি ভর্তি আতর নিয়ে হাজির নবকৃষ্ণের বাড়িতে। গোপীমহন আর নবকৃষ্ণ দু’জনেই তখন লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। সে কথা জানাতে বামুন আবার ফিরে এলেন চুড়ামনি দত্তের বাড়িতে। বললেনও সে কথা। চুড়ামনি বামুনকে বললেন, এক কলসি আতর নিয়ে তুমি কি করবে। বরঞ্চ তোমাকে আমি আড়াই হাজার টাকা দিচ্ছি আতরের কলসিটা আমাকেই দিয়ে যাও। আর অল্প একটু আতর তোমার ওই বাটিতে নিয়ে যাও। চুড়ামনির মোট খরচ হয়ে গেল পাঁচ হাজার টাকা! তাতে কি? আতরের লড়াইয়ে তো জিত হল তার। নব-র মাথাটা তো নিচু করা গেল! এই বা কম কি! সে সময় কলকাতার বাবুরা যে শুধু কলস কলস আতর ঘরে মজুদ রাখতেন তাই নয়। সমস্ত ঘরদোর, বাড়ির দেয়াল, মেঝে, বারান্দা সব ধোয়া-মোছা হতো আতর দিয়ে। সেকালের কলকাতার বিখ্যাত ধনী নিমাইচরণ মল্লিকের পৌত্রের বিয়ের সময় চিৎপুর রোডের দু’মাইল পথে গোলাপজল ছড়ানো হয়েছিল। বিয়ের শোভাযাত্রাতে পথের ধুলো আর দুর্গন্ধে যাতে বিঘ্ন না ঘটে। সেকালের ধনী বাঙালিবাবুর বনেদিয়ানা বজায় রাখতেও সুগন্ধের বড় একটা ভূমিকা ছিল। বার মহলে অতিথি আপ্যায়ন করা হতো গোলাপ পাশ থেকে গোলাপজল ছিটিয়ে। এছাড়া আসরে সাজিয়ে রাখা হতো আতরদান। তুলোয় মোড়া ছোট্ট ছোট্ট কাঠি। অতিথিরা আতরদান থেকে তুলোয় মাখিয়ে তুলে নিতেন মনপছন্দ আতর, খস, চামেলি, বেলি।
উপরোক্ত ইতিহাস থেকে অনেকের মনে হতে পারে যে, সহস্র বছর ধরেই হয়তো ভারতবর্ষের এই ভূ-খণ্ডে সুগন্ধির চর্চা ও ব্যবহার হয়ে আসছে। আসলে মোটেও সেরকম কিছু নয়। যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও তিন-চার হাজার বছর আগে যেখানে মিশর ও মেসোপটেমিয়ার রীতিমতো সুগন্ধের জয়জয়কার সেখানে ভারতবর্ষে সুগন্ধির ব্যবহার শুরু হয় আরবদের হাত ধরে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সুগন্ধির ইংরেজি শব্দ হল- Perfume এই শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Perfumare থেকে। বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘ধোঁয়ার মাধ্যমে’। অর্থাৎ ধোঁয়ার মাধ্যমে যে সুগন্ধ ছড়ানো হয় তাকে পারফিউম বলে। বর্তমানে পারফিউম বলতে যা দেখি বা বুঝি তা হচ্ছে সুদৃশ্য বোতলের ভেতর তেলজাতীয় এক প্রকার পদার্থ যা স্প্রে করে শরীরে কিংবা পোশাকে ছিটানো হয়। কিন্তু পাঠকবৃন্দের একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত হবে, সুদৃশ্য বোতলে সুগন্ধির ব্যবহার হচ্ছে তিন হাজার বছর ধরে চলমান একটা সংস্কৃতির সবচেয়ে উৎকর্ষিত রূপ। তিন-চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়া ও মিসরে সুগন্ধি সাধারণত ব্যবহার হতো ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং সেটা প্রধানত ব্যবহার হতো উপাসনালয়ে, রাজপরিবার, রাজআমাত্য ও সমাজের উচ্চকোটির মানুষের মধ্যে। উপাসনালয়গুলোতে দেবতাদের সামনে প্রার্থনারত মানুষের ও দেবতাদের সঙ্গে সেতু তৈরি করত এ সুগন্ধিযুক্ত ধোঁয়া। সহস্র বছরের পুরনো এ সংস্কৃতি কিন্তু এখনও চালু আছে। এখনও আমরা মিলাদ কিংবা ধর্মীয় উৎসব বা মাহফিলে আগরবাতি জ্বালিয়ে চারপাশ সুগন্ধময় করে তুলি। তাছাড়া সে সময় দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদন করতে হতো দামি কোনো বস্তু যেমন- সোনা, রুপা কিংবা কোনো কোনো সংস্কৃতিতে মানুষের শিরশ্ছেদ। বেশিরভাগ মানুষই একাধারে ধর্মপ্রাণ ও বুদ্ধিমান এজন্য সোনা, রুপা কিংবা মানুষের মুণ্ডুর পরিবর্তে ধর্মভীরু মানুষ বেছে নিয়েছিল সুগন্ধি বস্তু। এতে করে একই সঙ্গে অর্থের কৃচ্ছতা সাধন ও ধর্মকৃত্য দুটোই সম্পন্ন হতো।
কেউ কেউ বলেন সুগন্ধি আবিষ্কার করা হয়েছিলো মেসোপটেমিয়া সভ্যতায়, যখন অন্যরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এটা আরবের সৃষ্টি৷ এখনো আরবের একটি স্থানকে বলা হয় “সুগন্ধির ভূমি”৷ খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর পূর্বে মিশরে সুগন্ধির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়, যেখানে বিশ্বাস করা হতো সুগন্ধি হচ্ছে ঈশ্বরের ঘাম এবং মিশরের মমিগুলোর সমাধিতে ‘অঞ্জলি ‘ হিসেবে ধূপ ব্যবহার করা হতো৷
মানুষ প্রথম যখন সুগন্ধি আবিষ্কার করেছিলো তখন এটি ব্যবহার করা হতো ঈশ্বরকে অর্পণের জন্য৷ সুগন্ধিযুক্ত আঠা অঞ্জলি দেয়া হতো পুজোর বেদির আগুনে৷ সুগন্ধি শব্দটির ল্যাটিন অর্থ “ধোঁয়া”৷ এটা প্রকৃতিগতভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় যে, বহু বছর পূর্ব থেকেই নারী, পুরুষরা শরীরের দূর্গন্ধ দূরীভূত করতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন সতেজ ও স্বচ্ছ ঘ্রাণানুভূতির জন্য।
চীনের তরুনীরা শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সুগন্ধিযুক্ত তৃণ ব্যবহার করতেন এবং ফারাওদের যুগে সভাসদরা লিলিফুলের সুঘ্রাণযুক্ত পরচুলা পরতেন৷ ধর্মীয় ব্যবহারের বাইরে সুগন্ধির প্রথম প্রয়োগের কথা উল্লেখ আছে যীশুর জন্মের চারশত বছর পূর্বে, তখন আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট এর দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য তাঁর বুকের বর্মতে সুগন্ধি দিয়ে সম্মান জানানো হতো ৷
প্রথম সুগন্ধির বাণিজ্যিক ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায় জেনেসিস এর বইয়ে, যদিও সেটা গঠনগত ভাবে ধূপ ছিলো৷ যখন যোসেফের ভাইদের সবাই মিলে তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিলো মিশরগামী সওদাগরদের নিকট, যারা সুগন্ধিযুক্ত আঠা, বৃক্ষের নির্যাস এবং বাহারি মশলা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলো৷ প্রাচীন মিশরীয় গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, রাণী ক্লিওপেট্রা নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখতেন ধূপের ধোঁয়া দিয়ে ৷
মক্কাতে পবিত্র কাবা ঘরের দেয়ালগুলো সুগন্ধি দিয়ে সিক্ত করা হয়৷ ইতালির “টেম্পল অফ মিনারভা” এর দেয়াল গুলো নির্মাণের সময় এর উপরিস্তরে দুধ ও জাফরান মিশ্রিত প্রলেপ ব্যবহার করা হয় ৷ বর্তমানেও আপনি যদি আপনার আঙুলে মুখের লালা লাগিয়ে টেম্পল অফ মিনারভা এর দেওয়ালে ঘষেন তাহলে সেখান থেকে জাফরান এর স্বাদ পাবেন এবং সুবাস অনুভব করবেন ৷
প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এ প্রকাশ পায় যে, তৎকালিন সময়ে পরিষদবর্গদের চন্দন কাঠের নির্যাস মিশ্রিত সুগন্ধি দিয়ে সিক্ত করা হতো এবং যোদ্ধাদের সুগন্ধিযুক্ত গুঁড়ো দিয়ে আচ্ছন্ন করা হতো যা ছিলো যুদ্ধ যাত্রা শুরুর একটি ধাপ৷ ভারতীয় সম্প্রদায়দের নিকট আতরওয়ালারা পরিচিত একজন স্তম্ভ হিসেবে৷ তাঁরা দেবদেবীর মূর্তি ধৌত করতেন চন্দনের নির্যাস, আগরজল ও কস্তুরী দিয়ে ৷
আরবের প্রসাধনী সামগ্রী সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান আহরণ করা যায় ইউসুফ আল কিন্দি এর সুগন্ধি প্রসাধনী সামগ্রী বিষয়ক গ্রন্থ “রসায়ন ও পাতন” (খ্রিস্টাব্দ ৮৩০ -৮৭০) থেকে৷ পারস্যে ৭ম শতকে সুগন্ধি প্রসাধনী সামগ্রী প্রস্তুত একটি শিল্পের মাধ্যম ছিলো৷ ৭ম শতকে বাগদাদ ছিলো সুগন্ধি ব্যবসায়ের কেন্দ্র৷ আরবের সুগন্ধি বণিকরা পুরো আরব সাম্রাজ্যে সুগন্ধি সামগ্রী বিক্রি করতো৷ ব্রিটেনের ধর্মযোদ্ধারা আরব থেকে ফিরে আসার সময় ক্রয় করে নিয়ে আসতো আরবের বিখ্যাত সুগন্ধি, এভাবেই ব্রিটেন আবিষ্কার করেছিলো সুগন্ধি সামগ্রীর সৌন্দর্য্য ও মোহনিয়তা৷
সুগন্ধি পাতন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ইরানিরা৷ ইবনে সিনা দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম, যিনি রসায়নের মূলনীতিসমূহ সুগন্ধি প্রস্তুত প্রনালীতে ব্যবহার করেছিলেন এবং ফুলের মন মাতানো সৌরভ সুগন্ধি সামগ্রীতে সঞ্চিত করতে পেরেছিলেন৷ এভাবে খ্ৰীস্টিয় ১৩শ শতকে পারস্য সুগন্ধি তৈরীর কাঁচামাল প্রস্তুতে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত করেছিলো৷
যখন সুগন্ধি ভালো ভাবে প্রস্তুত করা হয় তখন এটা টিকে থাকে কয়েক দশক মোড়কে আবদ্ধ অবস্থায়৷ আরেকটি ব্যাপার লক্ষনীয় যে, মিশরীয় সুগন্ধির স্থায়ীত্ব শক্তি স্বীকৃত ছিলো। ১৯২২ সালে যখন তুতেনখামেন “তুত” এর সমাধি ফলক খোদাই করা হয়, সুগন্ধি তৈলের প্রলেপ যা তিন হাজার বছরের পুরনো উপাদান দিয়ে নামাঙ্কিত করা হয়েছে তা এখনো ছড়িয়ে দেয় মহিমান্বিত সুঘ্রাণ ৷
মিশরীয় ফারাও রাজারা যে কী পরিমাণ সুগন্ধি ব্যবহার করতেন তার একটি জাজ্বল্যমান প্রমাণ মেলে ফারাও রাজা তুতানখামুনের মমি আবিষ্কারের সময়। তুতানখামুন জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ১৩২৩ অব্দে এবং মৃত্যুবরণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪১ অব্দে। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার পিরামিডের ভেতর যখন তুতানখামুনের সমাধিস্থল আবিষ্কার করেন তখন সেখানে স্বাভাবিকভাবেই সোনা, রুপা, হীরে, জহরতসহ পাওয়া যায় অনেক মূল্যবান বস্তু। তবে লোকজন সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হোন এটা দেখে যে, তখনও তীব্র ও ঝাঁঝালো সুগন্ধ বের হচ্ছিল মমিটির শরীর থেকে। চিন্তা করেই অবাক হতে হয় কী পরিমাণ অমূল্য ও ব্যতিক্রমী সুগন্ধি ঢালা হয়েছিল মমিটার শরীরে, যে তিন হাজার বছর পরও এর সৌরভ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি। ফারাও যুগে সুগন্ধি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হতো মোমের মাধ্যমে। সুগন্ধি ফুল, লতাপাতার নির্যাস মোমের মধ্যে মিশিয়ে তা শরীরে মাখা হতো। পিরামিডে আঁকা চিত্র দেখে ধারণা করা যায় যে ফারাও রাজা-রাণীরা এক ধরনের মোম মাথায় সেঁটে রাখতেন। প্রচণ্ড রৌদ্রের তাপে মোম গলে পুরো শরীরের কোষে কোষে সেই সুগন্ধ ছড়িয়ে দিত। তবে ফারাও রাজরাণীদের মধ্যে কুইন ক্লিওপেট্রা বোধ করি ছিলেন খোশবাইয়ের সবচেয়ে বড় সমঝদার। তিনি তার ব্যক্তিগত সৌগন্ধিকদের নির্দেশ দেন একেক সময় একেক রকম সুগন্ধি তৈরি না করে উৎকৃষ্ট ধরনের একটি নির্দিষ্ট সেন্ট পুনরায় তৈরি করতে।
সুগন্ধি প্রস্তুতকারকরা এ প্রথম নির্দিষ্ট ফরমুলার মাধ্যমে ক্লিওপেট্রার জন্য একটি সেন্ট তৈরি করে দেন যার নাম ছিল ‘কিফি’। সুগন্ধির ইতিহাসে কিফি-ই হচ্ছে পারফিউমের প্রথম ব্র্যান্ড। ক্লিওপেট্রা যে শুধু পারফিউমের ভক্ত ছিলেন তা-ই নয়, পারফিউমের ব্যবসায়ও নেমেছিলেন তিনি। খুলেছিলেন পারফিউমের কারখানা। তবে সেকালে তার খদ্দের কে ছিল সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। মিশরের পাশাপাশি গ্রিক রোমান ও পারস্যেও সুগন্ধি ব্যবহারের প্রচলন ছিল। রোমান সম্রাট নিরো (৩৭ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দ) রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন মুক্ত হস্তে। সম্রাটের হিসাবপত্রের খাতা ঘেঁটে দেখা যায় শুধু একদিনে সুগন্ধির পেছনে তিনি ব্যয় করেছেন লক্ষাধিক টাকা!
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে যখন পারস্যের রাজা তৃতীয় দারিয়ুসকে হারিয়ে প্রথম রাজদরবারে এসে পা রাখলেন তখন তিনি পারস্য সম্রাটের অনেক কিছু দেখেই অভিভূত হয়েছিলেন। বিশেষ করে জাঁকালো রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদে পরীর মতো অজস্র সুন্দরী নারী। ডারিয়ুসের সিংহাসনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ভাস্কর্য। এছাড়া বিবিধ জেল্লা জৌলুস তো ছিলই। কিন্তু আলেকজান্ডার সবচেয়ে বেশি অভিভূত হোন প্রাসাদের ভেতর ঐশ্বরিক এক সুগন্ধির সন্ধান পেয়ে। যোজনগন্ধা প্রাসাদটি সুগন্ধে যেন মঁ মঁ করছিল। তিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের পূর্তি করেন জোরে জোরে শ্বাস টেনে। তারপর এক সতীর্থ সমর নায়ককে উদ্দেশ্য করে বলেন- “একেই বলে যথার্থ এক মহান রাজা ও তার সম্রাজ্য। মনে হচ্ছে যেন সুগন্ধির কোনো এক মহান স্বর্গে তৈরি করা হয়েছে এই রাজপ্রাসাদ।”
এবার ভারতবর্ষে সুগন্ধিচর্চা প্রসঙ্গে আসা যাক। যদিও হিন্দু আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ শুশ্রুত ও চরক সহিংতায় আতরের কথা উল্লেখ আছে কিন্তু ভারতের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য কিংবা ধারাবাহিকভাবে যেসব পর্যটকরা এই ভারত ভূখণ্ডে এসেছিলেন তাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় জোরালোভাবে সুগন্ধির চর্চা এদেশে আরবদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত শুরু হয়নি। বিখ্যাত পর্যটক আলবেরুনী ভারতীয়দের প্রসাধন চর্চা প্রসঙ্গে লিখেছেন- উৎসবের দিনে তাঁরা তাঁদের দেহে সুগন্ধির বদলে গোবর লেপে। মেয়েদের সাজ-পোশাকের জিনিস পুরুষরা পরে। তাঁরা তাঁদের শরীরের কোনো চুল কাটেন না। আসলে, গরমের প্রভাব থেকে রক্ষা পাবার জন্য তাঁরা প্রায় নগ্নভাবে চলাফেরা করেন। আর মাথার চুল না কাটার মূল কারণ হল সর্দি-গর্মির কবল থেকে আত্মরক্ষা করা। এক গুচ্ছের আকারে তাঁরা তাঁদের গোঁফ রাখেন। নখ না কেটে তাঁরা তাঁদের কুড়েমিকে মহিমান্বিত করেন। এ দেশিরা একের পর এক, একা একা ভোজন করেন। গোবরের প্রলেপ দেওয়া স্থানে তাঁরা একাজ সমাধান করেন। (আলবেরুনী – প্রেমময় দাশগুপ্ত কর্তৃক অনুদিত, পৃষ্ঠা- ৫০ ও ৫১)। আলবেরুনী ছিলেন মধ্যযুগের বিশ্বখ্যাত আরবীয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক তার প্রণীত ভারততত্ত্ব গ্রন্থটি ইতিহাসের আলোকে বেশ প্রণিধানযোগ্য।
অন্যদিকে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন- “সধবা নারীরা কপালে পরিতেন কাজলের টিপ এবং সীমন্তে সিঁদুরের রেখা; পায়ে পরিতেন লাক্ষারস অলক্তক, ঠোঁটে সিঁদুর; দেহ ও মুখমণ্ডল প্রসাধনে ব্যবহার করিতেন চন্দনের গুঁড়া ও চন্দনপঙ্ক, মৃগনাভী, জাফরান প্রভৃতি। বাৎস্যায়ন বলিতেছেন, গৌড়ীয় পুরুষরা হস্তশোভা ও চিত্তগ্রাহী লম্বা লম্বা নখ রাখিতেন এবং সেই নখে রং লাগাইতেন, বোধ হয় যুবতীদের মনোরঞ্জনের জন্য। নারীরা নখে রং লাগাইতেন কিনা, এ বিষয় কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে না। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা- ৪৬০)।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তার ‘প্রাচীন ভারতীয় সমাজ’ বইটিতে বাঙালির সুগন্ধি চর্চা বলতে শুধু চন্দনের ব্যবহারের কথাই বলেছেন। আর লিখেছেন- নেপালের মেয়েরা গ্রীষ্মকালে মুখে কস্তুরি চুর্ণ ব্যবহার করত। আরবদের হাত ধরেই ভারতবর্ষে সুগন্ধি চর্চার বিস্তার লাভ করে। একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, ইসলামে সুগন্ধি চর্চার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হজরত মোহাম্মদ (সা.) নিজে সুগন্ধি পছন্দ করতেন। নামাজে যাওয়ার আগে তিনি শরীরে সুগন্ধি লাগাতেন বিশেষ করে শুক্রবার জুমা-মোবারকে তিনি বিশেষ বিশেষ সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। তাঁর প্রিয় সুগন্ধি ছিল মাস্ক ও আম্বার। পরবর্তীতে মোগল আমলে সুগন্ধ চর্চার বিস্তার বেশ ব্যাপকভাবে ঘটে। বিশেষ করে মোঘল সম্রাটরা সাধারণত পারস্য সম্রাটদের আদব, কায়দা, কেতা, স্বভাব ও ফ্যাশন অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। সে কারণে গোলাপ ও সৌরভের দেশ পারস্য থেকে আসত তাদের জন্য উৎকৃষ্ট আতর ও সুগন্ধি। এখানে বিশেষভাবে বলতে হয় আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক জ্যোর্তিবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও গণিতবিদ ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) পরিপূর্ণ ও স্বার্থক পারফিউম আবিষ্কার করেন। তাঁকেই বলা যায় আধুনিক অর্থাৎ আমরা যে ধরনের পারফিউম বর্তমানে ব্যবহার করি তাঁর জন্মদাতা।
প্রথম মোঘল সম্রাট বাবরের ছিল গোলাপের প্রতি আসক্তি এজন্য ইরান থেকে তাঁর জন্য আসত সহস্র বোতল ভর্তি হরেক রকমের গোলাপের নির্যাস। বাবর ইরানের ইস্পাহান ও ইরাকের বসরা থেকে উৎকৃষ্ট প্রজাতির গোলাপ এনেছিলেন তাঁর বাগানের জন্য। এই গোলাপের সম্মানে ভারতের কিছু গোলাপ এখনও ‘বসরাই’ গোলাপ নামে পরিচিত। মোগল যুগে সুগন্ধি চর্চার সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটে চতুর্থ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ও তার পত্নী সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সময়ে। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর ঘোড়ার লেজেও নাকি মাখিয়ে দিতেন নানারকম সুগন্ধি, যাতে করে চলার পথের আকাশ-বাতাস ছেয়ে যায় সুগন্ধের সৌরভে। সৌন্দর্য চর্চায় নূরজাহানের সবচেয়ে খ্যাতিমান আবিষ্কার গোলাপের আতর, যার পোশাকি নাম ‘আতরে জাহাঙ্গীরী’। তবে আতর তৈরির আরেকটি প্রাচীন স্থান হল ভারতের মুর্শিদাবাদ। মোঘল আমল থেকে এখানকার আজগর হোসেনের তৈরি গোলাপি আতর ভুবন বিখ্যাত। নুরজাহানের বিশিষ্ট স্নানঘরটিও একটি গবেষণার বিষয়। বিলাসবহুল স্নানঘরের চৌবাচ্চায় গোলাপ মিশ্রিত জলে তরলাকার ভাসমান পদার্থের মধ্যে গোলাপের নির্যাস ছড়িয়ে রাখা হতো। তাঁর স্নানের জলে আতর, গোলাপ, চন্দন, রূপটান ও অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী মিশ্রিত থাকত।
সুকন্যা নামের এক গবেষক নূরজাহান শিরোনামের এক জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন : “নূরজাহান নিজে সুরভিত হতেন গোলাপ নির্যাসের স্নানে, যার দৈনিক খরচ পড়ত তৎকালীন তিন হাজার টাকা।” নূরজাহানের উদ্যোগে কাশ্মীরের বিশিষ্ট উদ্যান শালিমার, নিশাতবাগ প্রভৃতির স্থাপনা ঘটে।
কার্নিসের নকশা ঝুলনি, খড়খড়ি আর ঝোলা বারান্দা। উঁচু বাড়ির দেওয়াল বেয়ে নেমে আসা গাছের শিকড়। লাল মসজিদের ঝকঝকে রুপোলি চুড়োয় সোনালি তুলির টান। চোখ নামাতেই দেখা যায়, ঐতিহ্যের এ পথে হাজার লোকের ব্যস্ততা। হরেক দোকানের সারির মধ্যে নজর টানে নকশাদার পাঞ্জাবি, জারদৌসি কাজের টুপি, সুগন্ধি, সুরমা আর শৌখিন পিতলের সম্ভার। সময় যেন এক মুহূর্তে বহু বছর পিছিয়ে যায়।
তখনও গ্যাসবাতি বসেনি চিৎপুর রোডে। কেরোসিন বাতি ছিল কোথাও কোথাও। চওড়া খোলা নর্দমা ছিল রাস্তার ধারে। এ শহরের পুরনো রাস্তা গঙ্গাতীরের চিৎপুর তখন বাণিজ্যে জমজমাট। কিন্তু অন্ধকারে খরিদ্দার মেলা ভার! তাই ভোর থেকেই বেচাকেনার শুরু। ভোর পাঁচটায় রবীন্দ্র সরণি আর কলুটোলার কোণে ফৌজদারি বালাখানার একতলায় দোকান খুলে বসে পড়তেন হাজি খুদা বক্স। সন্ধ্যায় ঝাঁপ পড়ে যেত। নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ১৮৫৬ সালে মেটিয়াবুরুজে আসার বহু আগেই কনৌজের কারখানা থেকে সুগন্ধি নিয়ে এ শহরে চলে আসেন খুদা বক্স ও তাঁর ছেলে নবি বক্স। ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই দোকান আজও একই জায়গায়। ভাড়াটা বেড়ে হয়েছে ১২০০ টাকা। কয়েক পা দূরেই রয়েছে কলকাতার আতর ঐশ্বর্যের ১৪০ বছরের আর এক সাক্ষী। নাখোদা মসজিদ তৈরি হয়েছে এ সবেরও বহু পরে। মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে আরও খানদুয়েক আতরের দোকান। কোনও এক অজানা কারণে কলকাতার আতর সাম্রাজ্য এ অঞ্চলেই আটকে থেকেছে।
সেই সাম্রাজ্য ঘেঁটে ঋতুর সঙ্গে বদলে আতর সংগ্রহকারী এখন হাতে গোনা। গরমে বেল, জুঁই, গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দনের পাশাপাশি মনের আরাম দেয় খস সুগন্ধি। আগেকার দিনে গরমে, পাটের ঝোলানো খসে জল ছিটিয়ে ঠান্ডা রাখা হত ঘর। বিশেষ ঘাস থেকে তৈরি খস আতর সেই ঘ্রাণ মনে করায়। শীতকালে শামামা, মুস্ক, হিনার সুঘ্রাণ গায়ে মাখতে এখনও পছন্দ করেন গন্ধবিলাসীরা। জাফরান-সহ বিভিন্ন মশলার মিশ্রণে তৈরি হয় শামামা। মুস্ক তৈরিতেও লাগে বিভিন্ন মশলা। আতরের সব থেকে জরুরি উপাদান চন্দন তেল। দুর্মূল্য চন্দন তেল এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের মিশ্রণে তৈরি খাঁটি আতরের দাম তাই বেশি। দশ গ্রাম আতরের দাম হয় ছ’শো থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। আতর তৈরিতে কম করে সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগে। তবে আগর গাছ থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি উদ আতর সময় ও খরচসাপেক্ষ। তাই এর দামও বহুগুণ বেশি। এ ছাড়া দু-তিন রকম খাঁটি আতর মিলিয়ে তৈরি হায়াতি, সাবা এবং অপ্সরাও জনপ্রিয়।
অথচ রাজা-নবাবদের আগল থেকে বার করে আনা আতর কিন্তু এক সময়ে বাঙালি বনেদি ঘরেও আদর পেয়েছিল। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের মনে ধরেছিল গোলাপ আর জুঁইয়ের সুগন্ধি। ঠাকুরবাড়ি থেকে নিয়মিত বরাত আসত আতরের। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শাহিদ সুরাবর্দি, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান-সহ বহু নেতারা এসেছেন কলুটোলার আতর সাম্রাজ্যে। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের বংশধর, প্রয়াত রাজ্যপাল নুরুল হাসান এবং গনি খান চৌধুরীর পরিবার সাবেক আতরের একনিষ্ঠ খরিদ্দার। জাকারিয়া স্ট্রিটে থাকাকালীন বিড়লা পরিবারেও নিয়মিত যেত চন্দন সুগন্ধি, বলছিলেন খুদা বক্সের নবম বংশধর নেওয়াজউদ্দিন আল্লা বক্স। স্মৃতি রোমন্থনে উঠে এল সাবেক ফুলবাগানের নাম মাহাত্ম্য। বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছেই ছিল বিশাল ফুল বাগিচা। সেই ফুল থেকেই এ শহরে আতর তৈরি হত। সে সব চুকেছে স্বাধীনতারও আগে। এখন আতর আসে কনৌজের কারখানা থেকে।
যদিও তা কেনেন কিছু পুরনো খেয়ালের মানুষ। এ ছাড়া ইদ, বনেদি বিয়ে, দুর্গাপুজোয় আতরের বিক্রি হয়। অন্য এক আতর ব্যবসায়ীর কথায় কিছুটা হতাশার সুর। তাঁর মতে, এখন তো বহু মানুষের হাতেই অঢেল টাকা। তবু লোকে সুগন্ধি বলতে বোঝেন, বিদেশি পারফিউম। ফলে আতর ব্যবসা তলানিতে ঠেকেছে। অথচ খাঁটি আতর এক বার যিনি ব্যবহার করবেন, তিনি বাঁধা খরিদ্দার হতে বাধ্য। নয়া প্রজন্মকে আতর প্রেমে মজিয়ে দিতে অবশ্য অনলাইন ব্যবসার কথা ভাবছেন, জানালেন সফিকুদ্দিন আল্লা বক্স। তাঁর মতে, সরকারি সহযোগিতা পেলে, বেঁচে যাবে ঐতিহ্য। এ শহরে অবশ্য ‘বিশ্ব বাংলার’ শোরুমে এখন গোলাপ, চন্দন, জান্নাতুল ফিরদৌস ও হায়াতির মতো আতর বিক্রি হচ্ছে।
কিন্তু দীর্ঘ লড়াই করে টিকে থাকা সুগন্ধ কত দূর ছড়াবে?
উত্তরটা অজানাই।
পারস্য ও তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যখন সুগন্ধের সাগরে ভাসছে সেসবের অল্প কিছু ঢেউ হয়ত এসে পড়ছে ভারতবর্ষেও। অথচ সুগন্ধি ব্যবহারের দিক দিয়ে ইউরোপ তখনও ম্রিয়মাণ। ইউরোপে প্রথম সুগন্ধি ব্যবহার করার ইতিহাস রচিত হয় ১৩৭০ সালে হাঙ্গেরীয় রাণী এলিজাবেথ অব পোল্যান্ডের হাত ধরে। তিনি যে পারফিউমটি ব্যবহার করতেন সেটার নাম ‘হাঙ্গেরীয়ান ওয়াটার’। পারফিউমটি নাকি তৈরি করা হয়েছিল রোজমেরি ফুলের নির্যাস থেকে। এ তো গেল হাঙ্গেরির রাণীর কথা। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ (১৪৬০-১৫৫০) সুগন্ধির এতটাই ভক্ত ছিলেন যে উনি প্রসাদের বাইরে বেরুলে সেই স্থানে আগে শ’খানেক বোতল পারফিউম স্প্রে করা হতো। তারপর রাণী নামতেন ঘোড়ার গাড়ি থেকে। এবার ফরাসি দেশের সৌরভ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। ফ্রান্সে প্রথম সুগন্ধির প্রচলন করেন রাণী ক্যাথেরিন মেডেচি।
ক্যাথেরিন মেডেচি জন্মেছিলেন ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে, ইতালির বিখ্যাত মেডেচি পরিবারে। দ্বিতীয় লরেঞ্জো মেডেচি ছিলেন ক্যাথেরিনের পিতা। ক্যাথেরিন ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে কেতাদুরস্ত ও বহুগুণ সম্পন্না নারী। এমন কিছু নেই যে সে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল না। তো সেই ক্যাথেরিনের বিয়ে হয় ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় হেনরির সঙ্গে। ক্যাথেরিন যখন রানী হয়ে ফ্রান্সে আসেন তখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সুগন্ধি প্রস্তুতকারকদেরও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন ফ্রান্সে। রাণী ক্যাথেরিন রাজা হেনরিকেও সুগন্ধি বিষয়ে সচেতন করে তোলেন। তিনিই প্যারিসে প্রথম পারফিউমের দোকান খোলেন। কথিত আছে যে তাঁর ওই পারফিউমের দোকানের নিচে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল যাতে করে অতি গোপনীয়তার সঙ্গে যাতায়াত করা যায় তাঁর ব্যক্তিগত পারফিউম প্রস্তুতকারকের বাসভবনে। সুগন্ধির উদ্ভাবিত নতুন নতুন ফর্মুলা যাতে ফাঁস না হয়ে যায় তার জন্যই এমন ব্যবস্থা। রাণী ক্যাথেরিন মেয়েদের মধ্যে প্রথম হ্যাট, দস্তানা অর্থাৎ হাত মোজা প্রভৃতির প্রচলন করেছিলেন। সেই দস্তানাতেও ব্যবহার হতো সুগন্ধি। ফ্রান্সে যথার্থ অর্থেই পারফিউম কিং ছিলেন রাজা চৌদ্দতম লুই (১৬৩৮-১৭১৫)। তাঁর কোর্টকে বলা হতো পারফিউম কোর্ট। রাজপ্রাসাদের সমস্ত পর্দা, সোফা, বেড কভার, দৃশ্যত সবকিছুতেই ঢালা হতো সুগন্ধি। তিনিই বোধকরি বিশ্বে একমাত্র রাজা যিনি প্রজাদের মধ্যে বাধ্যতামূলক ভাবে সুগন্ধি ব্যবহার করার জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি নিজেও রোজ চার-পাঁচ বোতল পারফিউম নিজের শরীর ও পোশাকে ঢালতেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ বোধকরি তিনি জীবনে মাত্র তিন বার স্নান করেছিলেন! হ্যাঁ পাঠকবৃন্দ সত্যি তাই, বিশ্বাস না হয় তো ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে পারেন। একটা প্রচলিত কথা চালু আছে যে ফরাসিদেশের লোকেরা স্নান করেন না বলেই সেখানে এত এত্তো সুগন্ধির উদ্ভব! যদিও আমার পরিচিত কিছু ফরাসি ব্যক্তিবর্গ আছেন এবং তাঁদের বয়ান অনুসারে ফরাসিরাও নিয়মিত স্নান করেন। কিন্তু তারপরও কেন এই অপবাদ? এর উত্তর জড়িয়ে রয়েছে প্লেগের মতন রোগের সাথে। মধ্যযুগে একটা সময়ে ম্যালেরিয়া, প্লেগ, যক্ষ্মা প্রভৃতি রোগে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে শুধু প্লেগ রোগেই মারা পড়ে ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ জনগণ। তখন সবাই ধারণা করত যে জলের মাধ্যমেই হয়তো এসব রোগ ছড়ায়। আর এজন্যই জল পরিহারের একটি প্রবণতা তৈরি হয়। সে সময়টায় ফ্রান্সের বেশিরভাগ লোকজনই বছরে সাধারণত একবারের বেশি স্নান করতেন না। একই সঙ্গে তখন মানুষ ধারণা করত যে কোনো একটি সুগন্ধি হয়তো এসব রোগ দূর করতে সক্ষম। শরীরের বিবিধ অসুখে ব্যবহার করা হতো সুগন্ধি মলম। মানুষ গলায় যে লকেট পরত তার বিভিন্ন খোপে খোপে থাকত সুগন্ধি। কোনো খোপে ল্যাভেন্ডার তো কোনোটায় রোজমেরি। আর এ কারণেই সে সময়ের পারফিউমের নামগুলোও হতো একটু অন্যরকম। যেমন- মধ্যযুগের একটি পারফিউমের নাম ‘টালিশমান’ কিংবা ‘প্রমেন্ডা’ প্রভৃতি। টালিশমান অর্থ হচ্ছে পরশপাথর। আর পরশপাথর অর্থ যে কি সেটা পাঠকমাত্রই হয়তো জানেন। এছাড়াও কীট-পতঙ্গ, জন্তু-জানোয়ার, শ্বাপদ প্রভৃতি বিতাড়িত করতেও ব্যবহার হতো গাছ-গাছড়া, ফল ও ফুলের নির্যাসের ধোঁয়া। সুগন্ধি যে শুধু মানুষকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে তাই নয়। মাঝে মধ্যে মানুষের বিপদেরও কারণ হয়ে উঠতে দেখা যায় এই সুগন্ধি ব্যবহার।
ফ্রান্সের রাজা অষ্টাদশ লুই ও রানি আতোঁয়ানেত দুজনেই ছিলেন সুগন্ধ অনুরাগি। বিশেষ করে রানি ছিলেন ভীষণ ভোগ বিলাসি। তাঁর সুগন্ধি গুলো তৈরিতে খরচ হতো শত সহস্র মুদ্রা। ফরাসী বিপ্লবের সময় রানি আতোঁয়ানেত যখন পালাচ্ছিলেন। হয়তো বা তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষমও হতেন কিন্তু বাদ সাধলো শরীর থেকে ভেসে আসা সুগন্ধি। রানির শরীর থেকে এতো কড়া সুগন্ধ ভেসে আসছিলো যে বিপ্লবীরা সহজেই বুঝে ফেলে ঘোড়ার গাড়িতে নিশ্চয়ই রানিই যাচ্ছেন। তা না হলে এতো দামি সুগন্ধি এই মুলুকে আর কে বা ব্যবহার করতে পারে।
প্রেম, ভালোবাসা ও যুদ্ধের সঙ্গে সুগন্ধির রয়েছে প্রগাঢ় সম্পর্ক। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যুদ্ধে যাওয়ার সময় দুটি জিনিস সবসময় সঙ্গে রাখতেন। প্রথমটি বই আর দ্বিতীয়টি হল সুগন্ধি। সুগন্ধির প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব আসক্তি। রাজসুগন্ধ প্রস্তুতকারীদের কাছে প্রতি মাসে তাঁর চাহিদা ছিল ৬০ বোতল সেন্ট। নেপোলিয়নের প্রিয় সুগন্ধি ছিল জেসমিন। অন্যদিকে বাংলার নবাব আলিবর্দি খানও না কি যুদ্ধে যেতেন পারস্যের বিভিন্ন সুগন্ধি সঙ্গে নিয়ে। এটা নাকি তাঁর ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলত। সেই সঙ্গে যুদ্ধেও উৎসাহ জোগাত। আলিবর্দিখানের দৌহিত্র যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলারও সুগন্ধির প্রতি ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। নিজে গায়ে মাখতেন হরেক রকমের দামি সুগন্ধি। বিভিন্ন পালা পার্বণে হীরা ঝিল প্রসাদের কোনো কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে পায়রা, কাকাতুয়া, টিয়া, ময়ূর বা অন্যান্য পাখি পারস্যের সুগন্ধির তরলে ভিজিয়ে উড়িয়ে দেয়া হতো হল ঘরে। আর এতে সুন্দর স্নিগ্ধ পারস্যের সৌরভে ছেয়ে যেত বাংলার যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলার স্বপ্নরঙে রাঙানো হীরা ঝিল প্রাসাদ।
সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসাও সুগন্ধি ভালোবাসতেন। ঋতুভেদে বিভিন্ন উৎসবে পারস্যের ফুল ও চন্দন ছিল লুৎফার প্রিয় প্রসাধন। সুগন্ধি অলঙ্কার পরা ছিল সে সময়ের ফ্যাশন। যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসা হেঁটে গেলে সবাই বলতেন ‘পদ্মগন্ধা’। লুৎফার সাতনরী হার হাতে নিয়ে শুঁকে দেখত অনেকেই। আতর-চন্দনের গন্ধ লেগে থাকত সেই গহনায়। সুগন্ধে ভুরভুর করত চারপাশ। গ্রীষ্মের দহন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য লুৎফুন্নিসা স্নান করতেন পারস্যের সুগন্ধি জলে। তারপর চন্দনচর্চিত দেহে, নানাবিধ দ্রব্যে প্রসাধন পরে নিজেকে সজ্জিত করতেন কুসুম আভরণে। লুৎফার নিজের ব্যবহৃত নানা সুগন্ধির মধ্যে চন্দন ও কস্তুরির নিজস্ব গন্ধ তো ছিলই। তাছাড়া তিনি জটামাংসী নামে এক প্রকার গাছের শেকড় দিয়ে তাঁর পোশাককে সুগন্ধী করে নিতেন।
তবে বাঙালির সুগন্ধি চর্চার কথা বলতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির লোকজনদের সুগন্ধি ব্যবহারের কথা না বললেই নয়। সেকালে ঠাকুরবাড়ির সুগন্ধি চর্চার ইতিহাস অনেকটা কিংবদন্তিতূল্য বলা চলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জেঠাতো ভ্রাতুস্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন- “আমাদের বাড়িতে পুজো না থাকলেও পুজোর আবহাওয়া এসে লাগত আমাদের বাড়িতে। পুজোর আগেই আসত চীনেম্যান-বার্নিশ করা নতুন জুতোর জন্য পায়ের মাপ নিতে। সব বাড়ির ছেলেরা মিলেই পায়ের মাপ দিতুম। তারপর আসত দরজি। তার নামটা ভুলে গেছি। যতদূর মনে পড়ে ‘আবদুল’। তার মাথায় গোল গম্বুজের মতো একটা মস্ত সাদা টুপি। গায়ে সামনে-বোতাম- দেওয়া দিব্যি ধবধবে সাদা চাপকান, মস্ত ভুঁড়ি। পিঠে কাপড়ের পুঁটলি। তাঁর কাছে দিতে হতো সক্কলের জামার মাপ। পোশাকের পালা চুকে গেলে আসত গ্রিবেল সাহেব। ইহুদি সাহেব সে। টকটকে রং, গোঁফ-দাড়িতে জমকালো চেহারা। তার চেহারাটা হুবহু শাইলকের ছবি। তার ওপর ইহুদি-জামার আস্তিনে রুপোর বোতাম সারি সারি লাগানো থাকত। তা দেখে চমক লাগত। সে আসত গোলাপ আর আতর বিক্রি করতে। কর্তারা, বাবুরা, সব্বাই ছিলেন তাঁর খদ্দের। আমাদের ছোটদের জন্য ছোট ছোট শিশিতে সে আনত গোলাপি আতর। সেটা আমাদের বার্ষিকী। তার জন্য পয়সা দিতে হতো না তাঁকে।” তিনি আরও লিখেছেন- তার দিদিমা অর্থাৎ গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী যোগমায়া ছিলেন অতি রূপবতী মহিলা। পাশ দিয়ে চলে গেলে মনে হতো পদ্মগদ্ধ ছড়াচ্ছে কেউ। সেই দিদিমার সাতনরী হারটি হাতে নিয়ে শুঁকে দেখতেন তার নাতি-নাতনিরা। আতর-চন্দনের সুগন্ধ লেগে থাকত সে গয়নায়। তখনও খুসবো ভুরভুর করছে, সাতনরী হারের সঙ্গে যেন মিশে আছে মহাকালের সুগন্ধি। সেকালে আতর মাখবার খুব রেওয়াজ ছিল; আর তেমনি সব আতর। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী লিখেছেন- জোড়াসাঁকোর ৬নং বাড়ির গৃহিণী তার শাশুড়ি সারদাদেবীর কথা। শ্বশুর দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি থাকলে ‘শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে, আর মা একখানি ধোয়া সুতি শাড়ি পরতেন। তারপর একটু আতর মাখতেন। এই ছিল তাঁর রাতের সাজ।’
চার হাজার বছর পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করতো উচ্চ শ্রেণির মানুষ। হিসেব কষে দেখা যায় এখনও সুগন্ধির ব্যবহার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এতো বছর পরেও মানুষের অভ্যাস বা রুচির কিন্তু তেমন পরিবর্তন হয়নি। দেখা যায় অনেক স্বচ্ছল মানুষ আছেন যারা শরীরে ঘামের বোটকা গন্ধ নিয়ে ঘুড়ে বেড়ান কিন্তু সুগন্ধ ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক। এটা নিঃসন্দেহে একটি সচেতনতার বিষয়। এই শিক্ষা পরিবার থেকেও আসতে হয়।
কৃত্রিম সুগন্ধির সুচনা হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। রসায়ন বিজ্ঞানের ক্রমশ উন্নতির ফলে তৈরী হয় নানা রকম সৌরভযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ। যার কিছু কিছু সুগন্ধি হিসাবে ব্যাবহৃত হতে শূরু করে। ব্রিটিশ আমলে এদেশে প্রচলিত ‘বিলিতি এসেন্স’ আর কিছুইনা এক ধরনের কৃত্রিম সুগন্ধি। আধুনিক সুগন্ধি শিল্প পুরোটাই ফরাসিদের দখলে। ফ্রান্সের দক্ষিন প্রভিন্সে রয়েছে সুগন্ধি লতা গুল্মের বিশাল সমারোহ। দুশো বছর আগে সেখানে ছিল ট্যানারী শিল্প, চামড়ার র্দূগন্ধে সেখানে টেকাই দায় ছিল। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু। আজ সারা বিশ্বে সুগন্ধি মানেই ফরাসী পারফিউম।
সুগন্ধি শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে এক নতুন ধরনের পেশাদারের আর্বিভাব হল, এদের নাম পারফিউমার। পারফিউমারদের কাজ হল সুগন্ধি তৈরীর ফর্মুলা ডিজাইন করা। অর্থ্যাৎ সুগন্ধি কি ভাবে তৈরী হবে, কোন উপাদান কত অনুপাতে মিশ্রিত হবে এসব বের করাই পারফিউমারদের কাজ। কেউ একজন পারফিউমার হতে হলে তাঁর জীবনের অন্তত পনের বছর ব্যায় করতে হবে সৌরভ শেখার সাধনায়। প্রথমে তাঁকে যেতে হবে সুগন্ধি শেখার স্কুলে, ফ্রান্স ও আমেরিকায় এ ধরনের অল্প কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, সুগন্ধি শেখার প্রথম বছর চলে যায় কাঁচামাল বিষয়ে জ্ঞান আহরন করতে করতে। যে কোন রকমের সুগন্ধি তৈরী করতে গেলে কয়েক হাজার রকমের জিনিস নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। তারপর চার পাঁচ বছর কাটবে সুগন্ধি নির্যাসের মিশ্রন শেখার জন্য। এরপর প্রায় নয় বছর কাটাতে হবে কোন প্রতিষ্ঠিত পারফিউমারের সহকারী হিসাবে। এতেই শেষ নয় একজন ভাল পারফিউমারের থাকতে হবে ভাল সূক্ষ্ম ঘ্রান শক্তি, বুঝতে হবে গন্ধের রসায়ন। গন্ধের রসায়ন একটু জটিলই বটে। প্রসঙ্গক্রমে বলি, আমার একজন পরিচিত মানুষের প্রিয় ঘ্রান হল বৃষ্টির পর মাটির যে সোদা গন্ধ সেইটি, এইবার বুঝুন সুগন্ধি তৈরী করা কতখানি কঠিন কাজ।
সুগন্ধি আমরা সবাই ব্যাবহার করি কিন্তু এর ব্যাকরন আমরা কজন মানি? কোন পারফিউমের মজা পুরোপুরি পেতে হলে এর গন্ধ নিতে হবে তিনটি পর্বে –
প্রথমে আসবে টপ নোটঃ অর্থাৎ শুরুতে যে গন্ধটি এসে মানুষকে মুগ্ধ করবে।
মিডল নোটঃ আপনি বুঝবেন সুগন্ধিটি কোন ধারার।
এন্ড নোটঃ আপনি বুঝবেন কতক্ষন গন্ধটি থাকবে। সুগন্ধির মূল্য কিন্তু নির্ভর করে এর ‘ষ্টেয়িং পাওয়ারের’ ওপর। মানে সুগন্ধিটি কতক্ষন থাকবে আপনার কাপড়ে।
বাজারে কিনতে পাওয়া সব সুগন্ধিকেই আমরা পারফিউম বললেও ব্যাকরন অনুসারে তা কিন্তু পারফিউম না। যে কোন সুগন্ধির বেশিরভাগই (৭৮%-৯৫%) অ্যালকোহল বাকি সুগন্ধি নির্যাস। যেমন পারফিউম যেখানে সুগন্ধির নির্যাস সব চেয়ে বেশি ২২%। এরপর রয়েছে Eau de parfum যেখানে ১৫-২২% সুগন্ধি থাকে। এরপর Eau de Toilette যেখানে সুগন্ধি ৮-১৫%। সর্বনিম্ন Eau de cologene যেখানে মাত্র ৪% সুগন্ধি থাকে।
সুগন্ধির উপাদান নিয়ে অনেকেরই কৌতুহল আছে, ফুল ছাড়াও হরেক রকম উদ্ভিদজাত ও প্রানীজাত উপাদান লাগে পারফিউম তৈরী করতে। ফুলের মধ্যে গোলাপের পাশাপাশি লাইলাক, লিলি অভ ভ্যালি, ম্যাঙ্গোলিয়া প্রভৃতি। কস্তুরীর কথা অনেকেই শুনেছেন এ ছাড়া স্পার্ম তিমির অ্যাম্বার্গিস, বিভার ও সিভেটের ব্যাবহার আছে পারফিউম তৈরি করতে। বৃক্ষজাত পদার্থের মধ্যে আছে চন্দন, সিডার, ইউক্যালিপটাস প্রভৃতি। আমাদের পরিচিত কিছু মশলাও পারফিউম তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। ধনে, এলাচী, দারুচিনি, তেজপাতা এরাও সুগন্ধির উপাদান। ফলও কিন্তু বাদ যায়না, লেবু, কমলালেবুর খোসা, লেবু গাছের ছালও কিন্তু ব্যবহার হয় সুগন্ধি তৈরীতে। পারফিউমাররা সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছেন সুগন্ধির খোঁজে।
একটি বিশ্ববিখ্যাত পারফিউমের কথা না বললেই না আর্নেষ্ট বো ১৯২১ সালে শ্যানেল নং-৫ তৈরী করেন, শুরুতেই বাজার মাত করে এই সৌরভ। মুলতঃ ফুলের নির্যাস থেকে তৈরী এই সুরভীর টপনোট হচ্ছে গোলাপ ও জেসমিনের মিশ্রন। আরো আছে চন্দন ও অন্যান্য কাঠের মিশ্রন। ১৯২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই সুগন্ধির বাজার একই রকম আছে। বিশ্বে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একটি শ্যানেল নং-৫ বিক্রি হচ্ছে।
তথ্যসূত্র:
১- Essence and Alchemy: A Book of Perfume by Mandy Aftel.
২- Hand Book Of Perfumes With Formulations by Eiri Board.
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে মার্চ ২০১৮ সাল।
৪- আলবেরুনী – প্রেমময় দাশগুপ্ত কর্তৃক অনুদিত, পৃষ্ঠা- ৫০ ও ৫১।
৬- উইকিপিডিয়া।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত