| 17 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২০) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

 অনেক কিছুই পাল্টেছে। ছোট বড় নির্বিশেষে রকের সেই আড্ডার পাট উঠতে বসেছে।বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে কমবয়সীরা আর তেমন গল্পগাছায় উৎসাহ দেখায়না। পাড়ার বড়দের সেই অভিভাবকের ভূমিকার কোথাও কোন কদর নেই।বয়সে বড় বলেই তুমি কিছু শিক্ষা দিতে পারো, এমন কথা কেউ ভাবেনা।

পাড়ার বাড়িগুলোর পরিবর্তন কিন্তু বেশ চোখে পড়ছে আজকাল।আগে অনেক বাড়ির গায়েই ছিল শ্যাওলার পুরু আস্তরন। দেওয়ালের রঙ উঠে গিয়েছে আর ধূসর ইঁট বার করা খাঁচা নিয়ে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে,এ দৃশ্য এমন কিছু বিরল ছিলনা।এখন কিন্তু খুব অসুবিধা না থাকলে নিজের বাড়ির বাইরের দেওয়ালটি চকচকে রাখার ব্যাপারে সকলেই ভীষণ সচেতন।গলির গলি তস্য গলিতেও বেশ সুন্দর রঙচঙে বাড়ির হামেশাই দর্শন মেলে।

হারিয়ে গিয়েছে সেইসব মাঠ।যেখানে স্কুলের শেষ পরীক্ষার শেষে জমে উঠত শীতের খেলার আসর।পাড়াশুদ্ধু ছেলেমেয়েদের হুটোপাটি চিৎকার চেঁচামেচিতে সরগরম হয়ে থাকা মাঠটা এখন শীতের কুয়াশা মাখে একাএকা।পাড়ার মাঝে মাঝে সেই পুকুর,দিঘির দেখা মেলা ভার। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সেইসব জলাশয়ের জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে বড় বড় দোকানপাটের শৌখিন প্রাসাদ।শীতের ভোরের খেঁজুর রস আর কেউ ফেরি করেনা।কমবয়সীরা পড়তে ,চাকরি করতে চলে গিয়েছে বিদেশে।মাঝরাতের তৈরি হওয়া পুজোপ্যান্ডেলে আর কোন বরদায়িনী বীণাপাণির আবির্ভাব হয়না।

পাড়ার রাস্তায় চক্কর মারা সেই নবীন সাইকেল আরোহীদের জায়গায় দ্রুতগতির দ্বিচক্রযানে ঝড় উঠিয়ে চলে যায় কারা।তাদের তেমন চেনাজানা মনে হয়না।


আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-১৯) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


বড় বড় বাড়িগুলোর কার্নিসে পায়রার বাসা।কুমোর পাড়ায় প্রতিমা নির্মাণ দেখতে উঁকিঝুঁকি মারেনা কেউ।কোন বাড়ির বিয়েতেই আর সেই পাড়াতুতো রসায়ন কাজ করেনা।এবাড়ির বরণডালা ,শ্রী, ওবাড়ির বিয়েতে দরকার পড়েনা। বিয়ের যাবতীয় আচার অনুষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ির লোকেরা অনায়াসে ঝাড়া হাতপা হয়ে যেতে পারেন।পান সাজা, নাড়ু ভাজা, গায়ে হলুদের তত্ত্ব সাজানোর জন্য, পাশের বাড়ির কাকিমা,মাসিমার উপস্থিতি বাহুল্য মাত্র। এধরণের আচরণ এখন সয়ে গিয়েছে।যদিও কিছু কিছু পুরনো বাড়ি এযুগেও এসব টিঁকিয়ে রেখেছে। তাই সবটাই টিভি খুলে সিরিয়ালে দেখতে হবে এমন নয়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


আর নিশ্চিত করেই বলা যায় , পাড়ার মেয়ের নতুন কনে সেজে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় পাড়াশুদ্ধু লোকের কান্না , এখন হারিয়ে যাওয়া পুরনো সিনেমার দৃশ্য মাত্র।

যদিও পাড়ার পুজোর ঘনঘটা দিন দিন বাড়ছে।আগের থেকে মানুষের সামর্থ্য বেড়েছে যে তার প্রমাণ পাওয়া যায় পাড়ার পুজোয়। এখন পাড়ায় পাড়ায় সবাই অনেক টাকা চাঁদা দেয়। সেই কাপড়ের ঝালর দেওয়া পুজোর প্যান্ডেল আর নেই। প্যান্ডেল, আলো,প্রতিমা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় যে অনুক্ত প্রতিযোগিতা চলে তার দাপট দিনদিন বেড়ে চলেছে।পাড়ার মানুষের মধ্যেও ওই কটা দিন যে পাড়া পাড়া ভাবের উদয় হয়, সারা বছরের প্রেক্ষিতে সেটুকুই বা মন্দ কী?প্রতিদিনের পুজোর যোগাড় করতে দল বেঁধে নামেন মেয়েরা।ভোগ রান্না,কুটনো কোটা,লুচি বেলা ,ভাজা, নৈবেদ্যর উপচার সাজানোতে তাদের অর্জিত গৃহিনীপনার একটা নীরব প্রতিযোগিতাও চলে। অন্যদিকে পাড়ার ছোট বড় নির্বিশেষে সব মানুষ দিনের বেশিটাই প্যান্ডেলে উপস্থিত থেকে পুজোর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা সামলান।

সারা বছরের পারস্পরিক নির্লিপ্তি, বিচ্ছিন্নতার শেষে কদিনের মিলনোৎসব।একসঙ্গে অঞ্জলি দেওয়া,পুজোর প্রসাদ,ভোগ খাওয়ার মধ্যে যৌথ পরিবারের চেনা অনুষঙ্গ। তারপরেও প্রতিমা বিসর্জনের পরে বিজয়া দশমীর রেশ চলে বেশ কিছুদিন।আবার ফিরে আসে ব্যস্ততা।সম্পর্কের সুতো আলগা হয়ে গড়িয়ে যায়।পরের বছরে নতুন করে গিঁট বাঁধা হবে বলে ।

পাড়া আছে,অথচ পাড়া নেই,এমন একটা ব্যাপার গা সওয়া হয়ে যায়নি কী?না হয়েই বা উপায় কী? জীবন এবং জীবিকার ঘোড়দৌড়ে আমরা সবাই যে সম্পর্কটাই বাজি ধরেছি, সেকথা তো আর অস্বীকার করা যাবেনা।বিদেশে বা অন্য অন্য প্রদেশে ঘরসংসার পাতা এই প্রজন্মের মানুষজন তো ফিরে এসে পুরনো পাড়ার আড্ডায় যোগ দিতে পারেনা।তাই ল্যাম্পপোস্টের জোরালো আলোর নীচে পাড়ার রকগুলোর শূন্যতা দিন দিন আরো বেড়েই চলেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত