| 16 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২৮) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

দুর্গা পুজো এগিয়ে আসছে, সামনের মাসেই মহালয়া।শ্রাবণের ধারাবর্ষণের মাঝেও চোখে পড়ছে নীল মেঘের ভেলা ,আকাশের একোণ থেকে ও কোণে তাদের নিঃশব্দ পদচারণা।

বর্ষার ঠিক পরেই শরৎ।তাই বুঝি প্রকৃতি তার দূতকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন শরৎকে অভ্যর্থনা করার জন্য।তবে আমার কাছে পুজো বলতে কখনই শুধু দুর্গাপুজো ছিল না। এখনও যেকোন ছোটখাটো পুজোর আনন্দ অনুভব করি,উৎসবে মাতোয়ারা হই।

সেরকম একটি পুজোর কথাই এখানে বলব।আমার বাবা ছিলেন খুব হুজুগে মানুষ। যেকোন আনন্দ উৎসবে তাঁর কর্মব্যস্ত চেহারা দেখতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম।তখন বেশ ছোট, বাবার সঙ্গে তাঁর অফিসের কোন এক কন্ট্রাক্টারের বিশ্বকর্মা পুজোর নেমন্তন্নে যোগ দিয়েছিলাম আমি আর আমার পরের বোন।লরি করে যাওয়া।অফিস থেকে অফিসের বেশির ভাগ মানুষকে নিয়ে লরি ছাড়ল বিকেলবেলা।খুব হৈ হৈ করতে করতে যাওয়া হল,ঠাকুর দেখার পর ফল মিষ্টি খাওয়ার পর্ব ভালই উতরে গেল। কিন্তু তার পরেই অঘটনের পূর্বাভাষ দেখা দিল।

বাবা খুব ভালো রান্না করতে পারতেন।শুধু তাই নয় অনেক লোকের জন্য রান্না করতেও তিনি কখনোই পিছপা হতেন না। রান্নার আয়োজন কেমন হচ্ছে দেখতে গিয়ে জানলেন কোন ব্যবস্থাই হয়নি।তাঁর উদ্যোগে বেশ কিছু মানুষ কাজ শুরু করল। তখন মুরগীর মাংস রান্নার চল ছিল না।পাঁঠার মাংস সহজে সেদ্ধ হয়না।আমার মনে আছে অনেক রাতে আধসেদ্ধ মাংসের ঝোল দিয়ে মাখা ভাত খেয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে আমরা বাড়ি ফিরেছিলাম।

তখন এমনই ছিল। এখন যেমন যেকোন উৎসবে সব দায়িত্ব পয়সা দিয়ে কোন পেশাদার উদ্যোক্তার হাতে তুলে দিয়ে মানুষ নিশ্চিন্ত হয়ে যায়,তখন সেরকম কোন ব্যবস্থা ছিলনা।নিজেদের খেটেখুটেই সবটা করতে হত।হয়ত আয়োজন তেমন নিখুঁত হত না। সেসব নিয়ে বাকবিতন্ডা চলতই।তবু প্রতিমুহূর্তের আনন্দে ঘাটতি হতনা।

আমাদের পাড়ায় বড় কোন পুজো হতনা।সারাবছর ধরে আমরা সরস্বতী পুজোর জন্য অপেক্ষা করতাম। সে গল্প এখানে আগেই করেছি।

বাড়িতে বাড়িতে লক্ষ্মী পুজো বা সত্যনারায়ণ পুজোর আয়োজনেও থাকত ওইরকম পটুত্ব।আল্পনা দেওয়া ,নাড়ু বানানো,ঘর পরিষ্কার করা বা ঘট আঁকার ব্যাপারগুলো আগেই শুরু হত। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় ছিল পূর্ব পাকিস্থান থেকে চলে আসা মানুষদের একচেটিয়া অধিকার।আর সারা বছরের চারটি বা ছটি লক্ষ্মী পুজো হত  পশ্চিমবাংলায় সবার  ঘরে ঘরে।কালীপুজোর দিনও লক্ষীপুজো হত এবাংলার অনেক মানুষের ঘরে।নানা কারণে সত্যনারায়ণ পুজো হতে দেখেছি।তবে পশ্চিম বাংলায় বিয়ের পরে ‘সুবচনী সত্যনারায়ণে’র ঘটাপটা ছিল একটু বেশী রকমের। আমরা ছোটবেলায় ওই পুজোর সিন্নি খেতে এবং তার সঙ্গে ফাউ হিসেবে পাওয়া  নতুন বেনারসী পরা বউএর পুজোয় অংশগ্রহণ দেখতে, খুব ভালবাসতাম।এ যেন বিয়েবাড়ি শেষ হয়েও হলনা গোছের ব্যাপার-স্যাপার।


আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-২৭) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


মনসা পুজো, শেতলা পুজো হত কোন কোন কালীমন্দিরে।এছাড়াও প্যান্ডেল করে বারোয়ারি পুজো করার রেওয়াজ ছিল। ধূমধাম করে শেতলা পুজো হত শ্রীরামপুরে চাতরা শেতলাতলায়।সেখানে দল বেঁধে যাওয়ার সময় আমরাও বড়দের সঙ্গ ধরতাম। আমাদের আগ্রহ ছিল পুজো উপলক্ষ্যে গড়ে ওঠা মেলায়।কত মানুষ, খেলনা,খাবারের দোকান, নাগরদোলা, সার্কাসের ছোট তাঁবু,সবমিলিয়ে এক বিরাট হই-চই, আনন্দ উৎসব।

এখন বারবার মনে হয়, সেসময়ে সহজ আনন্দের কোন অভাব ছিল না।সঙ্গতি কম বলে আনন্দ কম হত একথা মনে করারও কোন কারণ নেই।যেকোন অনুষ্টান ঘিরে যে যেমন পারত আনন্দ লুটেপুটে নিত।আমাদের পাড়া ছাড়িয়ে গণেশজননী পুজোর মেলায়, সঙ্গ পাবার জন্য আমাদের মামাতো বোনকে খড়দা থেকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসতাম আমরা।আবার খড়দহের রাস উৎসবে আমরাও হাজির হতাম।

 চুঁচুড়ার কার্তিক পুজো,নৈহাটির কালীপুজো,আর চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর এখনও খুব নামডাক। রাস উৎসবে খড়দহ আর শান্তিপুরের নাম সকলেই করে। শ্যাম নগরের কালী মন্দিরের সামনের মাঠে মুলোজোড়ের মেলা বেশ বিখ্যাত।এসব উৎসব ঘিরে অনেক মানুষের মেলামেশা বরাবর চলে আসছে।তবে যত দিন যাচ্ছে মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে।বিনা উদ্দেশ্যে শুধু আমোদ করার জন্য সমবেত হওয়ার ইচ্ছে কমছে।

আগে অনেক মফস্বলেই চড়কের আসর বসত।নীলের দিনে শিব ঠাকুরকে পুজো করার জন্য মন্দিরে মন্দিরে সমবেত হতেন মহিলারা।শিবরাত্রি পালন এখনও অনেকেই করেন।তবে তখন মেয়েদের চাকরি বজায় রাখার ঝামেলা ছিলনা।এখনও মহিলারা সব সামলেই আসেন।পুজো হয়ত নিষ্ঠাভরেই হয়, কিন্তু তাতে সবসময় অকারণ আনন্দের মলয়বাতাস বয় না।

  

   

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত