| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: শ্মশান-বন্ধু । প্রতিভা সরকার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

গল্পটা তো খুব সহজ, আজকাল গ্রামেগঞ্জে যেমন আকছার ঘটছে, ঠিক  তেমনই। আর কালকূট নদীর ধারে এই জনবিরল গ্রামগুলোতে এগুলো ঘটা খুব সহজ। কারণ এখানে মড়া পোড়াতে ডাক্তার অথবা পঞ্চায়েত প্রধানের কোনো সার্টিফিকেট লাগে না। মরলে বা মেরে ফেললে আগুনে পুড়িয়ে দিলেই হল।

তাই এঁটেল মাটির সর্বস্ব ডুবে যাওয়া কাদায় লোকটা তাকে যখন ঠেসে ধরল, ধরিত্রী নিজের শরীরের ভারেই যেন আধ হাত ভেতরে ঢুকে গেল। কাদাতেও বুদ্বুদ্ ওঠে জলের মতন, কিন্তু যারা কাদায় পড়েনি কখনও, তারা সেটা জানতেই পারে না। ধরিত্রী টের পাচ্ছিল তার কান মাথা ডুবে যাবার আগে  বগবগ শব্দ হচ্ছে, নাক ভরে যাচ্ছে একটা অদ্ভুত গন্ধে। মাটি তো পচে না কখনও, তবু যেন মনে হচ্ছে মাটির অনেক ভেতর থেকে উঠে আসা একটা পচা গন্ধ তাকে অবশ করে ফেলছে। 

কানের ফুটো কাদায় ভর্তি হয়ে গেলে সে আর বাতাসের শনশন, মেঘের গম্ভীর গর্জন, কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। শুধু রক্তের ডেলা ভরা চোখ দিয়ে দেখছিল তাকে কাদায় ঠেসে রেখেছে দুটো শাল গাছের গুঁড়ির মতো হাত আর হাঁটু, সে শোল মাছের মতো খলবলাচ্ছে আর হাতের মালিক হাসছে। ধস্তাধস্তিতে লোকটার মাড়ি কাদায় ভর্তি, ফাঁকফোকর দিয়ে যে ক’খান দাঁত দেখা যাচ্ছে সেগুলো যেন শিশু মুলোর ভেতরের অংশের মতো সাদা ধবধবে। 

লোকটার মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে কেমন যেন মেঘলা একটা আকাশ, ছাই ছাই রঙের চাদরে মুখ ঢেকে যেন চুপিচুপি ধরিত্রীর হেনস্থা দেখছে। সন্ধের ঠিক পর পর, তাই উদভ্রান্তের মতো কিছু রাতচরা পাখি লোকটার মাথার  ওপর দিয়ে একবার এদিক একবার ওদিক ওড়াউড়ি করছে। ব্যস এইটুকুই। জ্ঞান হারাল ধরিত্রী, আবার ফিরেও পেল, স্বাভাবিকভাবে সব কিছুই করতে  লাগল, কিন্তু এই ছবিখান সারা জীবন তার মস্তিষ্কে ঝুলে রইল, যেমন গোটা বছর বাঁশের বাতার বেড়ায় ঝুলে থাকে শহর থেকে নিয়ে আসা নববর্ষের ক্যালেন্ডার।  

পরের দিন পঞ্চায়েতে যখন ধরিত্রীকে হাজির করা হল, তখনও তার কোমর অব্দি চুলে কাদা লেপা, কাদামাটি শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে বলে তাকে লাগছে যেন ষাট বছরের বুড়ি। সারাদিন খাওয়া নেই, রাত ভরে ঘুম নেই, মামির অবিশ্রান্ত নাকী কান্না আর দোষারোপ শুনতে শুনতে মেয়েটা হা ক্লান্ত মুখ আর ছেড়ে দেওয়া শরীর নিয়ে যখন পঞ্চজনের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন অতি বড় দুর্বৃত্তেরও প্রাণ হাহাকার করে ওঠা উচিত। তবু ন্যায় বিচার বলে কথা। পঞ্চানন বর্মণ কাকা হেঁকে বলল, ”আত্তির বেলাত নদীর চরত কী করির ধরছুলু মাও?” নদীর চরে সোমত্থ মেয়ে রাতের বেলা গিয়েছিল কেন?  

প্রশ্নটার মধ্যেই যে একটা অভিযোগের ছুঁচলো তীর তাক করা আছে, সেটা বোঝবার মতো ডাঙশ তো ধরিত্রী তখনও হয়নি। বুঝলেও সে সবার সামনে বলতে পারত না, নদীর চরে হুদুম রাজার পুজো করতে করতে সঙ্গিনীদের ছেড়ে সে কাদাভর্তি জলার দিকে যায় নিজের শরীরে অনেকক্ষণ ধরে জমতে থাকা জল বার করে দিতে। বরং অতি সুশীলা এবং  সাত-চড়ে-রা-না-কাড়া ধরিত্রী পঞ্চানন কাকার মাও বা মা ডাক শুনেই ফুঁপরে কেঁদে উঠল। তার সঙ্গে গতরাতের চূড়ান্ত অপমান ও নিষ্ঠুরতার পর এই একটুখানি প্রশ্রয় আর আদরের আভাস তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলে সে হঠাৎ কাটা কলাগাছের মতোই মাটিতে আছড়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল!

সকলে হায় হায় করে উঠলেও ধীরু নামের সেই লোকটা ফিক ফিক হাসছিল। তার যুক্তি ছিল খুব সহজ। কাল গেছে হুদুম রাজার রাত। এ অঞ্চলে বৃষ্টি নামাবার মেয়েলি পরব। অতোগুলো আধ ল্যাংটো মেয়েমানুষ নদীর চরে পোঁতা কলাগাছে থাই ঘসছে, কান্ডে বুক ঘসছে দেখে সে আর ঠিক থাকতে পারেনি। গুরুর কৃপায় সবচেয়ে সরেসটাকে একা পেয়ে কাদায় ঠেসে ধরেছে। কে না জানে ক্ষুধার্ত বাঘ আর কামার্ত পুরুষে কোনো ভেদ নাই! শিকার ধরাই এই দুইয়ের ধর্ম। তাছাড়া চেটেপুটে খেয়ে যে থালায় সে থুথু ফেলে উঠে গেছে, সেটাতে তো আর কেউ খাবে না, তাই মেয়েটার সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক, তারও একা থাকতে ভালো লাগে না, বাপ মা মরা মেয়েটারও একটা হিল্লে হয়। 

সংক্ষেপে এই হল ধরিত্রীর শ্মশানে ঘর বাঁধবার কাহিনি। রুদ্রাক্ষ মালা এবং লম্বা সিঁদুর টিপ পরা ধীরু হল বাংলাদেশী ভাটিয়া। শোনা যায় রংপুরের আঙরাপোতায় কাকে নাকি খুন করে এসে সে এপারে গা ঢাকা দিয়ে আছে। শ্মশানের পাশে উঁচু ডোয়ার ওপর একটা ধারার বেড়ার ঘর তুলে নিয়ে সেখানে বসবাস। তবে এখনও কারণে অকারণে সে ধরিত্রীকে একা ফেলে বেশ কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। তা যাক, কিন্তু দিনে দিনে সে যে মাতব্বর হয়ে উঠছে এটা বেশ টের পাওয়া যায়। ভোটে সে দাঁড়ায়নি ঠিকই, কিন্তু নামাবলী জড়ানো পঞ্চায়েত সদস্য জাম্ভুরা দাস প্রায়ই তার কাছে আসে, নাকের ওপর রসকলি, গলায় কন্ঠি  নিয়ে কথা বলে খুব নিচু স্বরে, কিন্তু চোখ ঘোরে যেন দুরন্ত লাট্টু। 

এমনিতে এদিকটায় মরা পোড়ানোর বলো হরি পার্টি ছাড়া বিশেষ কেউ আসে না, কিন্তু যেদিন যেদিন জাম্ভুরা আসে, সেই রাতগুলো ঘোর নিশুতি হয়ে গেলে অগুনতি গরুর দলকে হাতের লাঠি দিয়ে তাদের ঘরের সামনে দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায় কিছু গামছায় মুখ মাথা জড়ানো মানুষ। প্রথম খুরের আওয়াজ কানে যেতেই ঘর থেকে লাফিয়ে বেরোয় ধীরু, উত্তেজিত হয়ে অকারণে ধরিত্রীকে খিস্তি করতে থাকে, “এই মাগি, দরজায় হুড়কা দিয়া বইয়া থাক। ছলবলাইয়া উইঠ্যা বাইরে আইছিস কী তরে কাইট্যা ফেলামুঅনে।” ছঞ্চায় গোঁজা ডাল কাটা হাত দা খানার দিকে ইশারা করে দেখায় সে।

তবে বারান্দায় না বেরোলেও ঘরে তো অজস্র ফাঁকফোকর। ধরিত্রী ঠিকই দেখতে পায় অবলা জীবগুলোকে ল্যাজ মুচড়ে, পাছায় খেটো মেরে পালে পালে জলে নামিয়ে দিচ্ছে ধীরু আর তার দলবল। ওপাশের নদীতীরে  অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে যারা, তারা সব ক’টাকেই তুলে নেবে গুনে গুনে। 

ঘরে ফিরে লুঙির খুঁটে টাকার বান্ডিল ঢোকায় ধীরু, তারপর আচমকাই বৌকে মাটিতে ঠেসে ধরে। প্রত্যেকবারই পাচারের কাজ শেষ হলে এই তার প্রিয় অভ্যাস, সাফল্যের উদযাপন। আর প্রত্যেকবারই প্রথমদিনের মতোই কাদার বুদবুদ শব্দ করে ফাটতে থাকে ধরিত্রীর কানের কাছে, শাল গাছের নিচে চাপা পরা ছিতরানো ব্যাঙের মতই তার সাদা শাঁখা পরা রোগা হাতদুটো ছিটকে ছিটকে ওঠে ধীরুর বিশাল শরীরের দুপাশে।  

 যা সওয়াবে তাই সয়, সেজন্য  ধরিত্রীরও সব সয়ে গেছে। তবে ধীরু না থাকলে সে ভাল থাকে বেশি। সকালে নিজের শাকের খেত, লাউ মাচার পরিচর্যা করে, শ্মশানের পাহারাদার ভুলোকে খেতে দেয়। বাঁশবনের সরসর শব্দ, হাওয়ার ঘূর্ণি বেয়ে শুকনো পাতা, খড়কুটোর ওপরে উঠে যাওয়া, সুপুরি গাছে সোজা উঠতে থাকা বহুরঙা গিরিগিটির ল্যাজের দোলানি, এইসব দেখতে দেখতে নিজের রুখু চুলে বিলি কেটে অলস দুপুর তার কেটে যায়। পড়ন্ত বেলায় গা ধুতে গিয়ে কালকূট নদীর ঢেউয়ের মাথায় মাথায় ছড়ানো গুঁড়ো সোনা মাখা বুক অব্দি জলে অনেকক্ষণ বসে থাকা, তারপর পাহাড় থেকে নেমে আসা দলছুট হাতির ভয়ে দোর বন্ধ করে জলঢালা ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ব্যস একদিন কেটে গেল।   

কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট নিরিবিলি ধরিত্রীর কপালে নেই কিনা, তাই ধীরু নেই, তবু জাম্ভুরা এসে হাজির। গরু পাচার হবে না, কিন্তু লাশ পোড়ানো হবে।  গোলমেলে লাশ। নাহলে আর সে নিজে আসে ! ধরিত্রীর গ্রামের নয়, তার পাশের গ্রামের মেয়ে, স্কুলে পড়ত, ক্লাস নাইন। হ্যাপি বার্থডে করবে বলে  ডেকে নিয়ে গিয়ে যারা নেশা করিয়ে দল বেঁধে ধর্ষণ করেছে, তারা সব বড়লোক এবং মাতব্বরদের পোলাপান। মেয়েটা ক্রমাগত রক্ত ক্ষরণে চোখ না ওল্টানো অব্দি তারা একের পর এক উঠেছে ওর ওপর। কেউ কেউ একাধিক বার। এই ছেলেছোকরারা পেটে দু পাত্তর পড়তে না পড়তে হুঁশ হারিয়ে ফেলে। জাম্ভুরারা যৈবনকালে কতো নেশা করেছে, কিন্তু কোনো অঘটন ঘটতে দেয়নি কখনও। কালে কালে কত কী যে দেখতে হবে। কালী করালবদনী শ্যামা ! 

জাম্ভুরাকে আজ কথায় পেয়েছে।

যাই হোক, এখন লাশ যাতে নির্বিঘ্নে পুড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটা দেখা ধরিত্রীর  কর্তব্য। কারণ ধীরু নেই, কবে ফিরবে কেউ জানে না, কিন্তু বেশি লোক জানাজানি হবার আগেই লাশ পুড়িয়ে দিতে হবে। নাহলে কেউ বলবে মর্গে নিয়ে রাখ, সুরতহাল  করতে হবে, কেউ বলবে ডিএনএ টেস্ট করাও। মাঝখান থেকে পুলিশ বেঁকে বসলেই সর্বনাশ। তার বকবকানি শুনতে শুনতে ফাঁকতালে ডিএনএ টেস্ট বস্তুটা যে কী তা জাম্ভুরা কাকার কাছ থেকে জানা হয়ে গেল ধরিত্রীর।   

কিন্তু আজ যে হুদুম দ্যাওয়ের পূজা গো! গ্রামের ঘরে ঘরে স্থানীয় মেয়েদের মধ্যে আজ চূড়ান্ত গোপন ব্যস্ততা। কালকূটের চরে এক মোটাসোটা কলা গাছ পোঁতা হবে, অনাবৃষ্টির বছরে যেমন হয়। যখনই মাঠের ধানচারাগুলি হলুদ বর্ণ হতে শুরু করে তখনই মেঘের রাজা হুদুম দ্যাওয়ের পূজার প্রস্তুতি শুরু করে দেয় মেয়েরা। কাকা তো জানেই এই পূজা সম্পূর্ণ মেয়েদের পূজা, ধীরুর মতো জঘন্য লোক ছাড়া বেটাছেলেরা সেদিন ঘর থেকেই বেরবে না। কারণ কলাগাছকে জড়িয়ে ধরে নাচতে নাচতে মেয়েদের বসনের ঠিক নাও থাকতে পারে। হুদুম দ্যাওকে তুষ্ট করবার জন্য তারা তখন মরিয়া। সব ভুলে তারা সেই অতিপ্রাকৃত প্রেমিকের সামনে নাচবে আর গাইবে, যতোক্ষণ না পূর্ণিমার চাঁদ ঢলে পড়ে দূরের বাঁকে, যেখানে কালকূট মিশেছে কালজানি নদীর সঙ্গে। আদিম পৃথিবীর আশ্চর্য ইন্দ্রজাল ! 

আজই ভোরবেলা গ্রাম থেকে সনকা এসে তাকে বলে গেছে সন্ধের পর যেন ধান দুর্বা ফুল আর আঁটিয়া কলার ছড়া নিয়ে সে চলে যায় নদীর চরায়।  

জাম্ভুরার গোল চোখ ভাটার মতো ঘোরে,”তাতে কী হইসে ধীরুর বৌ? পূজা তো সন্ধার পরে, চইলবে রাইত ঘোর হইলেও। আর লাশ তো আইসা পড়বে আর আধঘন্টার মইদ্যে। ভালো চাও তো দ্যাখো গিয়া সব ঠিক আসে কিনা। পাটখড়ি, নতুন মাটির সরা। কুনো ত্রুটি হয় না জানি। এমনিই অপঘাতের মড়া। বাপরে বাপ।”

 

শাক ক্ষেতে জল না দিয়েই মড়া পোড়ানোর বেদিটা পরিষ্কার করতে লেগে গেল ধরিত্রী। ঘড়া ঘড়া জল আনে নদী থেকে আর ঢালে। সিমেন্টের চারকোণা বেদি, তার ওপর চৌকো করে কাঠ সাজানো হয়। পুড়তে পুড়তে অদ্ভুত একটা পাঁশুটে রঙ ধরে গেছে। তাতে কালো কালো ছোপ। হঠাত দেখলে মনে হয় কারো দেহরেখা ওখানে চিরকালের মতো আঁকা হয়ে গেছে। চিতা জ্বলে যখন, ধীরু থাকলে সেই আগুন থেকে বিড়ি ধরায়, গলায় চোলাই ঢেলে এমন অট্টহাস্য করে যে দূরে ধরিত্রীর গ্রাম থেকেও শোনা যায়। তাতে ক্ষতি কিছু নেই, বরং তান্ত্রিক জামাইয়ের ভয়ে মামা মামিকে আর কেউ ঘাঁটায় না।

যে মড়াটা পুড়েছিল মাসখানেক আগে, ধরিত্রীর মনে আছে সেটা একটা চামড়া ছাড়ানো বুড়ো, ছাল ওঠা মুরগির মতো। এবারের মড়াটা তাড়াতাড়িই এসে গেলে সে দেখল  ফুটফুটে মুখ বেরিয়ে থাকা একটা ছোট মেয়ে, বাকি শরীরটা রক্তে কালচে হয়ে যাওয়া কাঁথা জড়িয়ে দড়ি দিয়ে একসঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। এক ঝলক তাকিয়ে মনে হল নাকের নিচে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে। সঙ্গে যে ক’টা মস্তান এসেছে সব মাল খেয়ে টাল হয়ে আছে, তাড়াতাড়ি পোড়াবার জন্য তাদের সেকি হুড়োহুড়ি ! কাজ শেষ করে পালাতে পারলে  যেন বাঁচে।

পোড়ানো শেষ হতে চললে বামুন বলল, ”কই গো ধীরুর বৌ, একটা ফুটা মালসা আগায়া দিবা না”, তাই শুনে অতো নেশার মধ্যেও ছেলেগুলোর সেকি হাসি ! ধীরুকে ভয় পায় এ তল্লাটে সবাই, মেয়েটাও চড়বড় করে পুড়ছে এখনও, তবু তার মধ্যেই সিটি মারার আওয়াজ ভেসে এল। মাটি পচার সেই গন্ধটা কোথা থেকে ধরিত্রীর নাকে ধাক্কা মারল কে জানে, মৃত মেয়েটার অচেনা বাপ মায়ের কথা ভেবে বহুদিন বাদে তার চোখ জলে ভরে উঠল। আহারে, এই মদ্যপদের হাতে সঁপে দিতে বাধ্য হয়েছে জ্যান্ত এবং মৃত মেয়েকেও! সব প্রমাণ লোপাট করবার জন্যই না বিছানার চাদর,গায়ের কাঁথা শুদ্ধ দড়ি বেঁধে চিতায় তুলে দিয়েছে বাচ্চাটাকে ! ধীরু যখন তার ওপর চড়াও হয়েছিল, তখন তার যা বয়স ছিল, এই মেয়েটার বয়স তার থেকেও কম। ধরিত্রীর মনে হল, ধীরুর অত্যাচারে মৃত তার নিজের শরীরটাই তুমুল পুড়ছে ! 

উঃ মাগো, অস্ফূটে বলেই নুয়ে পড়ে ধরিত্রী। তার বাঁ পায়ের আঙুলগুলোতে জড়িয়ে গেছে বেদির নিচে পড়ে থাকা এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়। যেন বাঁচার ঐকান্তিক ইচ্ছায় মেয়েটাই তার ঠান্ডা নিঃসাড় আঙুল দিয়ে ধরিত্রীর পা জড়িয়ে ধরেছে! 

হৈ হল্লা সব থেমে গেছে। নদী থেকে একঘড়া তুলে নিলে যেমন জল এসে জলের জায়গা অধিকার করে নেয়, কালকূটের চারপাশ জুড়ে তেমন চেনা নৈঃশব্দ আবার জাঁকিয়ে বসেছে। দূরের চড়া থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের কোলাহল, গানের সুর। কথাগুলোও চেনা-

                                  আয়রে হুদুম দ্যাও, আয়রে হুদুম দ্যাও

ওকি হুদুম গা ধুইবার জল দ্যাও! 

                                কালা ম্যাঘ উঠিল- ওকি ও ম্যাঘের ভাই

এক ঝাক দ্যাও বর্ষণ গা ধুইয়া যাই!

সব পুরুষেরা ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে সম্প্রদায়ের মেয়েদের প্রতি সহজাত সৌজন্যে, শুধু ধীরু আর ধীরুর নেশাখোর সাঙ্গোপাঙ্গরা ইতি উতি ঘুরে বেড়ায় হাঁস মুরগির বাচ্চা দাঁতে তুলবে বলে। হাতির ভয় ভুলে দরজায় শেকল দেয় ধরিত্রী। তারপর বারান্দার বাতার ফাঁকে গোঁজা প্লাস্টিকে মোড়া কিছু একটা তুলে  নিয়ে ব্লাউজের  অনেক ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।

হুদুম দ্যাও শুধু বৃষ্টি দেয় না, সে বিরাট পুরুষ এক, মেঘবরণ পুরুষসিংহ, ঝাঁকড়া কেশর নাড়ালেই বৃষ্টির ফোঁটা নেমে আসে শুকনো খটখটে আকাশ থেকে, সঙ্গে জন্ম দুখিনী মেয়েছেলেগুলার মনেও প্রেমের বর্ষণ নামে। কলা গাছ আর গাছ থাকে না, হয়ে ওঠে আদরের আশ্রয়। এই রাতে যা চাইবে তাইই পাওয়া যায়। তাই নাচে গানে সবাই সেই পুরুষশ্রেষ্ঠকে তুষ্ট করতে চায়। জড়িয়ে ধরে চুম্বনে সোহাগে ভরিয়ে দেয়।

ধরিত্রীও তাই করে। কলাগাছ থেকে উঠে আসা একটা সবুজ সতেজ গন্ধ  তাকে কাদার বুদবুদের কথা ভুলিয়ে দেয়। সে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে কলা গাছের মোটা কান্ড, কোথাও কোথাও সবুজ আঁশ ঝুলে পড়ে, থেঁতলে যায় তার দুই স্তন, দুই থাইয়ের মাঝে কঠিন ঘর্ষণ তার রোমাঞ্চ জাগায়। যা আপনি দেবার কথা তাকে ছিঁড়ে নেওয়া কাকে বলে ধরিত্রী জানে, সেই জানা থেকে বেরোবার জন্য সে হুদুম দ্যাওয়ের প্রতীক কলাগাছের গোড়ায় একটি আগ্রাসী চুম্বন রাখে, তারপর সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে বুকের গভীর খাঁজ থেকে বার করে প্লাস্টিকের ভেতর শুকনো কালচে রক্ত মাখা ছেঁড়া কাঁথার টুকরোটা। দুহাতে সেটাকে আকাশের দিকে তুলে ধরে ফিসফিস করে বলে “হুদুম দ্যাও একবার মুখ তুলি চাও কেনে ! উমরা সব প্রমাণ নষ্ট করি দ্যায় দিক, শুধু ডিএনএ পরীক্ষাটা একবার হবার দ্যান। যদি হয় তো মুই পুলিশের হাতত ছিঁড়া কাঁথার টুকরাখান তুলি দ্যাং। তোমরালা খালি পাশে থাকিও কেনে।”

তার এই কাতর আর্তি হুদুম দ্যাওয়ের কানে পৌঁছল কিনা বোঝা যায় না, কিন্তু কালকূটের দিক থেকে মিহি বালি জড়ানো বাতাসের একটা ঝোঁক আসে হঠাৎ। তার সঙ্গে আকাশ থেকে নেমে আসে পুজোর সময় জড়ো করা দূর্বা ঘাসের থোপা দিয়ে ছেটান শান্তিজলের মতো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। নাচ গান থামিয়ে মেয়ের দল সোল্লাসে হোওওও বলে লাফিয়ে ওঠে। 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত