| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-২৬) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-২৬।


ফিরতে দেরী হয়ে গেল রাজের। তার মাথায় ঘুরছে তীর্থজেঠুর রাগী চেহারাটা। একটা বড় ভুল করে ফেলল সে! নির্ঝরবঙ্কুর  ভাইপো শুনেই কেমন যেন হয়ে গেলেন। দুজনের মধ্যে কি গন্ডগোল আছে তাই  সে বুঝতে পারছে না। সামান্য গোল করা নিয়ে গন্ডগোল? তার জন্য দুজনেই খেলা ছেড়ে দিলেন? দুজনেই বন্ধুত্ব ত্যাগ করলেন।রাজ ভাবে। সে কোন স্পষ্ট উত্তর পায় না।   যেন একটা মস্ত ধাঁধার সামনে পড়েছে। এর উত্তর  সে কিভাবে পাবে? অথচ উত্তর না পেলে তার স্বস্তি হচ্ছে না। রাজ  আনমনা হয়ে বাড়ি ফিরল।

 ফিরতে ফিরতে তার মনে পড়ল মা গেছিলেন নির্ঝরের বাড়ি। ভাবতেই সে সাইকেল রেখে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকল। এখন আর অন্যকিছু মাথায় নেই। কিন্তু ঘরে মা নেই। সে ছোটোমামাকে দেখতে পেল।সে জিজ্ঞেস করল,“মা কই গো?”

ছোটোমামা বললেন,” ছাদে।“

রাজ তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠল।ছাদে  গাছ আছে মায়ের। নানারকম ফুল গাছে ভরা। সে গিয়ে দেখল মা পরিচর্যায় নেমেছেন। একটা গোলাপ ফুলগাছ  দুদিন আগে হওয়া ঝড়ে বেঁকে গেছে। তারজন্য মা তাকে ঠিক করছেন।“

 সে পেছনে  দাঁড়িয়ে বলল “মা।“

“দেরী হল কেন?”

রাজ মাথা চুলকে বলল, “ওই একটু গল্প করছিলাম?”

“বাহ! তা বলে নিজের হুঁশ থাকবে না?”

রাজের ধৈর্য কুলোল না। সে বলল,“আচ্ছা। মা শোন না। তুমি গেছিলে আজ? নির্ঝরের বাড়ি।“

“হ্যাঁ।“

“তারপর? ওর জেঠু কি বলল? খেলবে তো নির্ঝর?”

“না।“

ধপাস করে মাটিতে বসে রাজ বলল, “ খেলবে না? তুমি বোঝাতে পারলে না ওর জ্যেঠাকে?”

মা উঠে পড়লেন। মুখ গম্ভীর করে বললেন, “ কি করি বল? বঙ্কুদাদের জেদ গেল না। তাকে কত করে বললাম নির্ঝর ভাল খ্যালে তাকে ফাইনালে খেলতে দাও। ওর একই কথা। তীর্থ যেখানে আছে সেখানে যাবার প্রশ্নই নেই।উফ! কি ঝঞ্ঝাট বল।“

রাজের খুব হতাশ লাগছে। মা যে শুন্য হাতে ফিরবেন সে ভাবতে পারে নি। নির্ঝর না খেললে তারা জিতবে না তা নয়। কিন্তু নির্ঝর না খেললে তার বড় কষ্ট হবে। সে তো কতকিছু পায়, মা-বাবার আদর,-স্নেহ, মায়া, অথচ নির্ঝরের ভাগ্যে কিছু জুটল না! মন ভারি হয়ে গেল তার। সে বলল, তীর্থজেঠুরও খুব জেদ।

মা বললেন,“ তুই কি করে বুঝলি?”

 রাজ একটু আগের সব ঘটনা মাকে জানাল। মা শোনার পর একটা নিঃশ্বাস ফেলে  বললেন, “ওরা দুজনেই একইরকম।

রাজ জিজ্ঞেস করল,“ ওমা! ওদের মধ্যে কি  হয়েছিল গো?

মা বললেন,“সে অনেক কথা। সব কি আর মনে আছে?”

“বলোই না।“

রাজএর ছাদের একদিক সিমেন্ট দিয়ে ঘেরা। সেখানে  সবসময় মা সুন্দর করে রাখেন।মা বললেন,”আয়। এখানে বস।“

রাজ হাঁটুমুড়ে বসল। গল্পটা শোনবার জন্য তার মন হাঁকপাক করছে।সে বলল, “ বল না?”

 মা বললেন, “দাঁড়া। বলছি?তুই ওই মিলটা দেখেছিস?”

“কোনটা?ওই মাঠের পাশে?”

“হ্যাঁ।“

রাজ দেখেছে। ভাঙাচোরা বিবর্ন মিল।প্রাচীল বেয়ে বড় বড় গাছ উঁকি মারছে। ভেতরে নাকি বহু মেসিন আছে, সেগুলির মধ্যে সাপখোপ বাস করে। সে বলে, “হ্যাঁ। রোজই তো দেখি। তীর্থজেঠু ওখানেই বাস করেন।“

 মা  অবাক হয়ে বললেন, “তাই নাকি?”

“হ্যাঁ।“ বলে রাজ চুপ করে গেল। লোকটার কথা মনে পড়লে তার ভয় লাগে।বাবা! বঙ্কুর কথা বলার সময় কেমন রাগি চোখে তাকাচ্ছিলেন। সে বলল, “ তো কি?”


আরো পড়ুন: ফুটবল (পর্ব-২৫) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়


“আমাদের ছোটবেলায় মিলটা এমন ছিল না। বন্ধ ছিল না। এখানকার কত লোক ওখানে কাজ করত। মিলে ঘটা করে খেলা হত। তোদের যেমন স্কুলে স্কুলে খেলা হয় তেমন   এই কারখানা-ওই কারখানায় খেলা হত।  বঙ্কুদা আর তীর্থদা দুজনই তখন   এলাকার নামকরা ফুটবল প্লেয়ার। মিলের ম্যানেজার ছিলেন কোন এক দত্তসাহেব। তিনি ওদের নিজে থেকে কাজে নিলেন। বললেন, ‘তোমাদের বেশী কাজ করতে হবে না। তবে  ফি বছরে মিলের খেলায় আমার ট্রফি চাই।‘ বঙ্কুদা, তীর্থদা রাজি হয়ে গেল। দত্তসাহেব বললেন, “এখন অবশ্য কাজ করবে  ক্যজুয়ালি।মানে অস্থায়ী।যদি  জিতলে চাকরি পাকা নইলে কিন্তু নয়।‘ তীর্থদারা খুব খুশী। দেখতে দেখতে সেই খেলার সময় চলে এল। এর মধ্যে্ তীর্থরা খবর পেল খেলায় যে গোল করবে তাকেই নাকি দত্তসাহেব পাকা করবেন”

রাজ বলল,“এ বাবা! এত ভারি অন্যায় কথা।“

মা বললেন, “ হুম। সত্যিমিথ্যে জানি না দুই বন্ধুর এজন্যই গোলমাল লেগে গেল। বঙ্কুদা ভাবল  তীর্থ গোল করলে ওর চাকরী পাকা হবে। আমার কি হবে? তীর্থদা্র মাথায় এসব কিছু আসে নি। সে জানত গোল সে করবে।তার চাকরী পাকা। রোজই দুই বন্ধু মাঠে প্র্যাকটিশ করে। আমিও তখন সকালে মাঠে যাই। বঙ্কুদা আর  তীর্থদা দুজনেই আমাকে খেলায় হেল্প করে। তো একদিন গেছি সেদিন হঠাৎ একটা কান্ড ঘটল।“

রাজ বলল, “কি?”

মা বললেন, “মাঠে গেছি। তখন বিকেল।আমাদের কোচ সত্যকাকু তখন আসেন নি। ওদিকে দেখি দুই বন্ধুর হঠাৎ  ঝগড়া লেগেছে।বঙ্কুদা চিৎকার করে বলছে,“তুই কি ভেবেছিস গোল করবি সেদিন? অত সহজ? আমি না পাস বাড়ালে তুই গোল করতে পারবি বল?”

 তীর্থদার মাথা তখনও ঠান্ডা।সে বলল, “ আরে। জানি তো। তুই পাশ দিস বলেই আমি গোল করি।“

বঙ্কুদা বলে,- “ফাইনালে গোল করবি তুই? দত্তসাহেব তোকে চাকরি দেবে? আমাদের কি হবে?”

তীর্থদা বলে,“আরে। খেলা বহুদুর আছে। এখুনি এত ভাবছিস কেন? খেলায় জিতি আগে।“

বঙ্কুদা বলল,- “আগেই ভাবতে হবে।তুই বল সেদিন আমিও গোল করার জন্য উঠব।“

বঙ্কুদা খ্যালে স্টপারে। তার উঠে গোল করার কথা নয়। সে বল ধরে আর পাস করে তীর্থদাকে।ওর কথা শুনে  তীর্থদা মাথা নাড়িয়ে বলে,“তা কি করে হয়?”

শুনেবঙ্কুদা আরো রেগে গেছিল।বঙ্কুদা বলেছিল “আলবাতহবে। আমি গোল করব।তুই কি ভেবেছিস একা গোল করতে পারিস?”

  তীর্থদা বলেছিল, “ঠিক আছে। তাই হবে।চাকরির আমার যেমন প্রয়োজন তোরও আছে। তাই করিস।“

রাজ উত্তেজনায় হাঁটু মুড়ে বসল। সে যেন সিচুয়েশনটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। রাজ কি একটা বলতে গেল তার আগেই নীচ থেকে ছোটোমামার ডাক শোনা গেল।মা তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। ছাদের কার্নিশ থেকে বললেন,“কি হয়েছে?”

“জামাইবাবু এসেছেন। তোকে ডাকছে।“

“যাই।“

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত