| 20 এপ্রিল 2024
Categories
২৬ মার্চ

২৬ মার্চ সংখ্যা: ফেরা না ফেরা । মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

যখন গর্ভেশ্বরীর পুবপ্রান্ত অবধি এসে সাইকেলের ব্রেক কষে কাছের একটি ঝোপ বা ঘনিভুত ছায়া আগাছার আড়ালে নিজেকে রেখে সামনে তাকাই, সেই দৃষ্টিতে যেনবা অনুসন্ধিৎসু অবলোকন, বুকে কাঁপন সন্ধিগ্ধ আবেগ এবং সময় সত্যি সত্যি ভয় ভয় আচ্ছাদনে ডুবে গেছে, যেভাবে মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত জলযান থেকে ছিটকে পড়া মানুষ প্রাণের আকুতিতে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়, সেও কোনো অজুহাত এবং নিঃসন্দেহে বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি নয়, মন সেই রকম কারণ অনুসন্ধানে কিংবা ওজন তুলতে শশব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর সেটি ছিল এই যে, দরজার চাবি আনা হয়নি। সে-সময় কানে গুনগুন সাইরেন বাজতে থাকে, শহরে বিহারিরা যাকে পাচ্ছে, জবাই করছে, সেই ছুরি বা খাঁড়ার ধার আছে কি নেই পরখ করা হয় না, রক্তে রক্তে শুকিয়ে যাওয়া কালো আর দুর্গন্ধে ভুরভুর; তখন চোখের সামনে প্রতিবেশী রফিক আহমদের চেহারা ভেসে ওঠে। তার দু-চোখ এমনিতেই বড় বড় কটকটে লাল, এই একাত্তরে না জানি বলয় দুটোর আকৃতি আরও ভয়াবহ রক্তজবার মতো রক্তিম, এমন কল্পনা-বিকারের মধ্যে দেখি মানুষটা বিশাল এক ছুরি নিয়ে দুদ্দাড় ছুটে চলেছে; পেয়ারে পাকিস্তান। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। এই অশুভ বিকৃত ছবির মধ্যে মশান কালি মন্দির জেগে ওঠে। এখন কি রফিক আহমদের গলায় কাটামুণ্ডু ঝুলে থাকে? জগদ্ধাত্রীর মহাকাল রূপে তো এমনই দেখে এসেছি আর ভয়ে সিঁটিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করি, –

‘দেবীর এমন ভয়ংকর রূপ কেন?’

‘তুই ওদিকে যাবি না বাবা। সে হিন্দুদের দেবী। ওরা সেই দেবীর পূজা করে। ওদের ধর্ম।’

‘বন্দনা হিন্দু। ওরা পূজা করে? ওদের দেবী তো অনেক সুন্দর। পুতুলের মতো।’

‘সে হলো দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী, কালির অন্যরূপ।’

‘সেটা কেমন?’

‘জানি না।’

তারপর শরতের দিনকালে দুর্গোৎসব শুরু হলে একাডেমির স্কুলে সারাদিন পড়ে থাকি, বাদাম-বুট, জলপাই সেদ্ধ আচার-গুড়ের চটপটি-চিঁড়ের নাড়ু এইসব ইত্যাদি ধরনের প্রভৃতির মতো প্লাস্টিকের খেলনা লাটিম-ঘুরনি-বেলুন, আর নাগরদোলায় একআনায় ষোলো চক্কর; এসবের মধ্যে বন্দনার হাত ধরে থাকা। একটি সিঁকি দিয়ে দশহাত দূরের রং-বেরঙের বেলুন ফাটানো খেলা। সেই প্রথম বন্দুক হাতে নেওয়া। মানুষজন বলে, ওটা বন্দুক নয় এয়ারগান। যে যা বলুক বন্দুক তো, হাতে নিলে অদ্ভুতরকম সাহস আসে, নিজেকে আর ক্লাস নাইনের বালক মনে হয় না, কেমন পুরুষ-পুরুষ দৃপ্ত অহংকার; তখন বন্দনাকে খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে করে একবার, না বারবার জড়িয়ে ধরি, কিন্তু সাহস হয় না, সে তার মাকে বলে দেবে। একবার অনেক আগে তার ফরসা গালে চুমু দিয়ে হাজার কথা হয়েছিল। সে কেন বলে দিল? লজ্জা লজ্জা অভিমান। কাকি এসে মাকে অভিযোগ করে বসে। মা খুব সাধারণ মানুষ, কাকির সঙ্গে কত কথা বলে, বন্ধু নাকি সই, গল্পে গল্পে কোনো দুপুর বিকেল হয়ে যায়, বিকেল সন্ধের অনুরাগে ঢলে পড়ে; কথা ফুরোয় না। সব শুনে দু-জনে মুখ চাপাচাপি হাসাহাসি শেষে অবশেষে ডেকে নেয়, সব তো বুঝি অথবা কিছু বুঝি না; মা কান টেনে চুল ধরে বকে যায়।

‘বড় বান্দর হয়েছিস। অমন করেছিস কেন? দিন দিন ছোট হচ্ছিস নাকি বান্দর হচ্ছিস? আসুক তোর বাপ।’

‘মা ক্ষমা আর কখনো করব না। কাকিমা ক্ষমা।’

‘ছেড়ে দিন দিদি ছোট ছেলে। বড় হলে বুঝতে পারবে।’

‘কি বলছেন দিদি! ক্লাস ফাইভে উঠেছে, কিছু বোঝে না মনে করেছেন? সব বোঝে। এই-ই…আর অমন করবি?’

‘কক্‌খনো না, এই দিব্বি কাটছি…আল্লার কসম।’

‘সাদিককে জামাই করব দিদি। আমাদের সই পাতানো ষোলো আনা পূর্ণ করতে হবে না!’

‘তাই? হি হি হি! যান জামাইকে নিয়ে যান। আমি এখন আর দায়িত্ব নেব না। মা গো! শয়তান ছেলে।’

সেদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে বুঝি রাত হয়ে যায়, কী করি, এই ভাবনা-দুর্ভাবনার দোলাচলে বিশাল উঁচু জামগাছের নিচে এসে দাঁড়াই, বন্দনা কোত্থেকে ছুটে এসে ফেরত চুমু দিয়ে ফেলে আর আমার দুটো ডানা গজিয়ে যায়। আমি জামগাছের উঁচু শাখায় উঠে যাই যেনবা একটি রঙিন ঘুড়ি উড়ে উড়ে ভেসে ভেসে আকাশের প্রান্তসীমা ছুঁয়ে দিতে থাকি।

এখন এই আবছায়া মেঘ মেঘ দুপুরে আরও একবার, না বারবার সেই মুখছবি ভেসে ওঠে। সেও তো বিশাল আশ্চর্য, সেই দিনক্ষণের পর কতদিন চলে গেল, কত ঘুড়ি আকাশে উড়ে যায়, কতগুলো তার ফিরে আসে, কতক ভোকাট্টা; বন্দনা তো আমার বন্ধুজন একান্ত আপনার মানুষ; প্রিয় মানুষ। কখনো তার অভিমান রাগ-অনুরাগ খুনসুটি আড়ি-আড়ি-আড়ি, কতদিন আর দূরে সরে থাকে? এখন যে কতদিন দেখা হয় না, কোনো খবর কোনো খোঁজ, কোথায় আছে কতদিন দেখা হবে না কিছু জানি না। এই সময়েও কেন জানি তার কথা মনে আসে, কেনই বা বসে থাকি, রাগ করে গ্রামের নিরাপদ আশ্রয় থেকে ক্রমশ দূর থেকে দূরে, বিপদের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে হয়, সেও বলতে গেলে অস্ফুট ক্ষোভ বা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস, একপ্রকার বোকামি, অথবা আর সহ্য করা যায় না। গত সন্ধেয় একমাত্র ছোটভাইটিকে কবরে শুইয়ে দেওয়া হলে, তার আশপাশ-ঝোপঝাড়-বাঁশবাগান ঘিরে যখন চক্রাকারে জোনাকিরা স্বর্গের পথরেখা বুনতে থাকে, সেটি যেন প্রলম্বিত বিষাদের সুতোবোনা কারুকাজ, বাবা কি নিশ্চুপ শোকপাথর পাশের মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে যান, আমি দরজায় দাঁড়িয়ে খানিক দূরের আলো ঝলমল খেলার মধ্যে অচেনা নিশ্চুপ শোকগাঁথা খুঁজে নিই। শহর থেকে পালিয়ে আসতে হলো তেরো এপ্রিল উনিশ শ একাত্তর, মঙ্গলবার; চোদ্দো-পনেরো দিনের মুক্ত বাতাস পুনরায় অন্ধকার-অমনিশায় ঢেকে যেতে শুরু করে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুর থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আর সাঁজোয়া বহরে সেজে নির্দয় কঠিন কৌশলে দিনাজপুর দখলে এগিয়ে আসে, আসতে থাকে তিন দলে বিভক্ত হয়ে, প্রথম দল সড়ক পথের বদলে মেঠোপথ ধরে রামডুবি হাট আর চেহেলগাজি অভিমুখে, দ্বিতীয় দল রাজবাড়ি শালবনের মধ্য দিয়ে আর তৃতীয় দল পার্বতীপুর-মোহনপুর, তাদের ভারী ট্যাংকের গোলা আর মর্টারশেল মুহুর্মুহু ছুটে ছুটে ভেঙে দিতে থাকে সবকিছু, ঘরবাড়ি-রাস্তা আর বিশ্বাস, বজ্রনিনাদে উড়ে পালায় গাছের পাখি, ঝরে পড়ে বসন্তের ফুল, বারুদের গন্ধে জমে ওঠে মলিন কালিমা পাতায় পাতায়, আর আকাশের উপরে মেঘের সঙ্গে মিশে যায় মানুষের ঘরদোর পোড়ানোর ধূসর-কালো ধোঁয়া। মানুষ প্রাণভয়ে দিশাহীন দিগ্‌বিদিক ছুটে পালাতে থাকে। কোন্‌ ভরসায় তবে থাকা যায়? কোথায় গেল বিশ্বাস আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন? সবই যে মুখোশ, মিথ্যে প্রপঞ্চ উপাখ্যান আর কী কী সব ঝুলে যেতে থাকে, উন্মুক্ত হয়ে পড়ে মিথ্যের বসবাস। এসবই তো খোলস, যেভাবে কাল গোক্ষুর সময়ের ব্যবধানে রূপ বদলায়। আমরা পশ্চিম কিংবা উত্তর-দক্ষিণ দিশা ভারতের দিকে না গিয়ে পুবে তিনটি নদী-খাল পেরিয়ে চিরিরবন্দর পালিয়ে আসি। সেও তো কষ্টে কষ্টে দুর্ভাবনা-দুশ্চিন্তা-দুঃস্বপ্নে কেটে গেল অনেক দিন অনেক রাত। আকাশ মেঘলা প্রাণ-সংহার বারুদের গন্ধে উৎসবে ভয়ার্ত জল ঢালে নিত্যদিন। ধানের ক্ষেতে জমে ওঠে নিষ্ফলা চাষাবাদ। একাত্তর হায় একাত্তর! মানুষ বিনে চিকিৎসায় মরে যায়, মানুষ একজন আরেকজনকে মেরে ফেলতে আস্তিনের তলা থেকে খঞ্জর বের করে আনে, মানুষ প্রাণ বাঁচাতে নিজের ঘরদোর আদরের জিনিস ফেলে শূন্যহাতে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধেয়ে যায়, সে কি কোনো গন্তব্য নাকি দিশাহীন গোলকধাঁধায় নিজেদের অস্তিত্ব হাতড়ে দেখা, হায় কোথায় সেই জীবন-শান্তি আর নিরাপদ ঘুম? সব বুঝিবা অস্তিত্বের পলায়ন। সেই গর্ভেশ্বরীর ছায়া ছায়া মেঘ-অন্ধকারে সামনে তাকিয়ে শহরে যাওয়া যাবে কি না আতঙ্ক-আশঙ্কায় সন্দিহান বসে থাকি কতক্ষণ বোধ নেই।


আরো পড়ুন: মুঠি ভরে ধরে রাখা ছায়ার শব্দ । সেলিনা হোসেন


তারপর সেদিন দুপুরে যখন মহারাজার মোড় অভিমুখে পুবালি মিলের কাছাকাছি এসে গেছি প্রায়, বুকের ধুকধুক কিছু কি স্তিমিত হয়ে আসে, এইসব কালো দিনকালে শত শত রহস্য আর অ্যাজপায়োনেজ গল্পের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-প্রভাব মাথা উঁচু করে সাহস জোগায়, অথবা হতে পারে অদৃষ্টবাদী মনের বোকা বোকা সতরঞ্জ খেলা, নির্মোহ-দিগ্‌ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস, ক্রমে ক্রমে স্বস্তির মুহূর্তগুলো বড় সন্দিহান হতে শুরু করে, ভুল করলাম না তো, কিংবা বোধহীন চলার মতো, কোনোদিকে না তাকিয়ে কাউকে না দেখে অন্ধের মতো যাত্রা আর নিজেকে আবিষ্কার করি মডার্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। কোনো ভয়হীন সাহসী বাতাস ভেসে যায়। একাত্তরে তো সবকিছু স্বাভাবিক থাকার কথা নয়, মানুষের চোখে-মুখে এই কয়েকদিন যে ঘোলা ছায়া, সন্দেহের বিষকাঁটা পরস্পরের দিকে ছুটে যায়, আশ্চর্য ‘আযাদ সেলুন’ হাট হয়ে খোলা, দু-জন ক্ষৌরকার চিরুনি-কাচি-ক্ষুর নিয়ে সবকিছু সুন্দর করে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত, তখন চারপাশে ছড়িয়ে আছে আতর-ই-দরবার বা মযমুয়ার কড়া-মিঠেল সুবাস। মডার্ন সিনেমা হলের শিখরদেশে পাকিস্তান পতাকা বাতাসে পতপত ঝোলে যেভাবে একটু নিচে চলচ্চিত্র ‘রঙ্গিলা’-র নায়িকা নিশোর চটুল মুখ-বুক, শ্রুতিতে বেজে ওঠে, ‘কিস্‌নে তোড়া দিল হুজুর কা…কিস্‌নে টোক্‌রায়া তেয়ার পেয়ার।’ সেলুনের চকচকে আয়নায় ঘষে ওঠা চেহারাছবি কার ভালোভাবে বুঝে উঠতে না উঠতে, কারও প্রতিচ্ছবি অনুসন্ধানে বারবার সরল অঙ্কের মতো পরিচিত হতে হতে খুঁজে পেতে পেতে হতবিহ্বল পেরেশান, সেই যে এই কয়েকদিনে দু-চারজন মুক্তিযোদ্ধা, অকুতোভয়, তাদের পরনে প্যান্ট-সার্ট-লুঙ্গি কতদিন ধোয়া হয়নি, বিদঘুটে গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তাদের গলায় লাল-সবুজ গামছা, কারও কাঁধে ব্যাগ, সকলের হাতে হাতে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল আর অচেনা মারণাস্ত্র, কেউ বলে রাশিয়ান এসএলআর, ভারতীয়ও হতে পারে, সেগুলোর মাথায় চকচকে বেয়োনেট, নিচের নল মাথা উঁচু আকাশ বিদীর্ণ করতে সদাপ্রস্তুত-উন্মুখ, সেগুলোর কোনোটির মুখ মাটির দিকে তাক চোখে কি নিবিষ্ট মৌন-শান্ত-গম্ভীর-সতর্ক সর্বংসহা প্রতীতিতে অসম্ভব দীপ্ত, মানুষগুলোর মাথায় লম্বাচুল গালে দাড়ি আর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি কি মহতী মায়ায় চারপাশ দেখে নিতে থাকে, এরই মধ্যে কেউ কেউ খুব গোপনে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়, তারপর বেলাডোবা সন্ধের অন্ধকারে তারা চলে গেলে মানুষজন স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর অনুচ্চ ভলিউমে শুনতে ব্যগ্র হয়।

আযাদ সেলুনের দু-জন ক্ষৌরকার কি নিশ্চুপ ভাবলেশহীন উদাস অথবা কে জানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছু খুঁজতে থাকে…খুঁজতে থাকে, গণেশতলায় গণেশ মন্দিরের ভেতরে ঠাকুর ভাঙাচুরা স্তূপ, ওপরে শিখরদেশে মুখোমুখি দুই সিংহ আহত নখদন্তহীন পরস্পরের প্রতি কোন্‌ অভিযোগ বা অভিমানে রংহীন-অস্বচ্ছ-ধূসর, চোখে পড়ে সাইকেলের পেছনের চাকা বসে গেছে আর গর্ভেশ্বীর পাড়ে দ্রুত উঠতে গিয়ে একটু আগে বাঁ-পায়ের গোড়ালিতে যে ক্ষত হয়েছে, সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে তখনো। আমি কী করে রক্ত লুকোই? এ যে নিজের কাছে থেকে নিজের পলায়ন। সে হলো ভয়াবহ আশঙ্কার হতচকিত কিংকর্তব্যবিমুঢ় সময়, তখন কয়েকজন বোধকরি পাঁচ-ছয়জন মহিলা হেঁটে-দৌড়ে ছুটে আসে, তাদের কারও হাতে নগ্ন কৃপাণ, বাতাসে ছড়িয়ে দেয় চিৎকার-চেঁচামেচি কখনো যা শোকসন্তপ্ত হাহাকার অভিযোগ-ফরিয়াদ, দূর আকাশে হাত তুলে অভিসম্পাত, এরপর চূড়ান্ত ফয়সালা-সিদ্ধান্তের হট্টগোল; একজন বাঙালি পাওয়া গেছে পবিত্র পাকিস্তান রাস্ট্রে। তারা গোল হয়ে ঘিরে ধরে আর বাতাসে ভেসে যায় নিষ্ঠুর প্রতিশোধ জিঘাংসা।

‘ইয়ে শালে বাঙালি হ্যায়, ইয়ে মেরি সহর কো মারা, ইসে আভি মারো।’

এই ভয়াবহ-দুঃস্বপ্নের মধ্যে পা থেকে রক্ত গড়ান বেগবতী হতে শুরু করে, কোথায় আচমকা চুলকোয়, চুলকোতে থাকে, চারিদিক ফ্যাকাশে অন্ধকার, আকাশে কি পুনরায় মেঘ ছেয়ে গেছে? সেলুনের একজন যার নাম সঠিক মনে নেই, স্মরণে কিছুতেই আসে না, সে কি আবু ইব্রাহিম নাকি শাহাদত খান, ধরে নিই প্রথমটিই ঠিক, সে হট্টগোল থামানোর জন্য অথবা অন্যকোনো উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে। তার বাঁ-হাতে চিরুনি, হলদেটে ময়লা রং, অন্য হাতে কাঁচি বারম্বার ‘খ্যাচাং-খ্যাচাং’ নিনাদ তোলে, খানিক দূরে সিনেমা হলের আউটডোর লাউডস্পিকারে মালার গান বেসুরো হয়ে যায়, মনের মধ্যে জীবনের সরগম বেভুল হতে শুরু করে, যেনবা একজন নয় শত শত আযরাইল বা মৃত্যুদূত দাঁড়িয়ে আছে; সবকিছুই জিঘাংসা-বিভাস অব্যাখ্যাত কাল তাণ্ডবনৃত্যের অচেনা রূপ। মানুষ মরে গেলে বেশিক্ষণ রাখতে নেই, পচন ধরে, শুরু হয় পেট থেকে; এরা কি সেখানেই ছুরি বসাবে? কতবার আঘাত করবে? প্রথম ধাক্কায় মরে যাব? মরে গেলে কী হয়? অন্য মানুষের যারা স্বজন-আপনজন, শোক জেগে ওঠে, সন্তাপ বাতাসে দীর্ঘ কান্নার সুর তোলে, তুলতে থাকে, পাথরকুচির শেঁকড়ে যেমন সাদা মূল বের হয়, সেটি থেকে গাছ, শোকের গাছপালা বিশাল মহিরুহে উঠে দাঁড়ায়; এখানে কোনো শোক নেই, কোনো শাখাপ্রশাখা চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে না, এখানে মডার্ন মোড় আযাদ সেলুনের বাইরে ফাঁকফোকরে রাস্তার ধারে যে মরে পড়ে রবে, তার বয়স সবে পনেরো পেরিয়ে গেছে, তার একলা অভিযান, একাকী অভিমান-ভালবাসা, একটি স্বপ্ন একটি অদেখা স্বপ্নসাধ কোথায় হারিয়ে যাবে? অন্ধকার কালোগহ্বর অথবা বিশাল ছায়াপথ নক্ষত্রলোকের কোন্‌ সৌরজগতে নতুন কোনোরূপে কোনো জীবন কে জানে কী। মানুষ এইসব গল্পকাহিনি পড়ে, নিজেদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তুলে নেয়, ক্ষমতা আর ভোগের সাম্রাজ্য গড়ে; তারপর সব শেষ। নটে গাছটি মুড়োল আমার গল্প ফুরোল। গল্প ফুরোয় না, যেখানে যার শেষ সেখানে অন্য এক কাহিনির শুরু হয়। এই-ই নিয়ম। এই তো জানুয়ারি হিমহিম সন্ধেয় যে ছেলেটি আকস্মিক মারা গেল, মহল্লার প্রত্যেকে শোক মুহ্যমান, খারাপ লাগে বইকি, আনওয়ার আর আমাদের কাছে আসবে না, রস-কশ-শিঙাড়া-বুলবলি-মস্তক বলে ব্যর্থ বারবার হাতের চাপড় খেতে হাত এগিয়ে দেবে না, কিংবা দুপুরের রোদে মায়ের গালমন্দ খেয়ে শখের লাটিমে সুতীক্ষ্ণ আলের কোপ খাবে না, বিষাদ চোখে লাজুক দৃষ্টিতে আর তাকাবে না, সত্যি খুব খারাপ লাগে; সে আমার ক্লাসমেট ছিল। পুণর্ভবার শীতল জলে লাফিয়ে নামতে গিয়ে ব্রিজের নিচে ছড়িয়ে রাখা পাথরের ফাঁকে মাথা আটকে যায়, কোনো ফাঁকফোকর পায় না, আর লালে লাল হতে থাকে চার ফুট গভীর জল। মহল্লায় দুপুর থেকে সন্ধে, সন্ধে থেকে রাত কি গভীর শোকছায়া নেমে আসে, অনেক দূরের কোনো বাঁশবেড়ার ঘর থেকে প্রলম্বিত কান্নার সুর দিকে দিকে ভেসে যায়; তিনি আনওয়ারের মা। কোটি কোটি মানুষের পৃথিবীতে একটি মানুষ চলে গেলে কারও কারও কষ্ট হয়, কারও কিছু হয় না, একদিন সবাই সব ভুলে যায়। মৃত্যুর এই প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে যুগপৎ মায়ের কথা মনে পড়ে আমার, আবার বন্দনাকে একবার দেখে যেতে কি গভীর অদ্ভুত সাধ হয়; তাকে বোধকরি খুব ভালবাসি। বন্দনা তুমি কোথায়? তুমি কেমন আছো? আমার কথা কি ভারতের শরণার্থী শিবিরে বসে মনে পড়ে? তুমি যে চাঁদ দেখ, দেখ ঠিক সেই চাঁদের আলো আমারও মন জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। সেদিন নিস্তব্ধ শোকমুহ্যমান রাতে শজনের শাখায় বাতাসের দোলায় ঘি-রং ফুল ঝরে যেতে থাকে, হিম হিম আলোকিত আকাশ, অবসর পেয়ে জিজ্ঞেস করি। মা বলে, –

‘গোরস্তানে গিয়ে সালাম দিতে হয়। আস্‌সালামু আলায়কুম ইয়া আহলাল কবুরি। সালাম দিয়েছিলি?’

‘মরে গেলে তো সব শেষ, আর মুর্দারা সালামের জবাব দিতে পারে? জবাব দেয়?’

‘দেয় বাবা।’

‘আমরা শুনতে পাই না কেন তবে?’

‘তুই যে ভূতের ভয় পাস, ভূত দেখেছিস?’

‘ভূত জ্বিন এসব আছে। আমরা দেখতে পাই না।’

‘ভূত আছে কি না জানা নেই, তবে জ্বিন আছে।’

‘তাদেরও দেখা যায় না।’

‘জ্বিন আমাদের দেখতে পায়। একটা সময় আমরা তাদের দেখতে পাব, তারা দেখতে পাবে না। দৃশ্যের অন্তরালে অদৃশ্য কতকিছু আছে আমরা জানি না। বিশ্বাস রাখতে হয়।’

‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু…তর্কে বুহুদূর।’

মানুষ মরে গেলে কী হয়? এই যে নিস্তব্ধ সময়ের কোনো স্তরে দাঁড়িয়ে আছি, কতিপয় ক্রোধান্ধ বেওয়া মহিলা প্রতিশোধ স্পৃহায় আকুলি-বিকুলি করতে থাকে, যার দায় আমার নয়, কেননা আমি তাদের চিনি না, কোনোকালে দেখেছি কিনা জানা নেই, তারা ছুরি হাতে লকলকে জিহ্বায় লালা ঝরাতে শুরু করে, আর আবু ইব্রাহিম কিছু একটা বলতে মুখ খোলে, তার হাতের কাঁচি ‘খ্যাচাং-খ্যাচাং’ ছন্দোবদ্ধ ঝংকার তুলে যায়, কি ভয়ংকর, চারিদিকের বধির অস্তিত্ব সময়কে স্থির থমকে দিয়ে পুলসিরাতের মতো ঝুলে থাকে, মৃত্যু কোনো মোহমায়া, কতটুকু সত্য অবধারিত, মৃত্যু বুঝি অদৃশ্য শক্তি যা জীবনকে রূপান্তর করে দেয়, Gateway to another life form, এরপর কী আছে, আছে কি নেই, স্বর্গ-নরক, যেমন কেউ জানে না জন্মের আগে কোথায় ছিল, কোন্‌ অস্তিত্ব, মৃত্যুর পর কোন্‌ গন্তব্য, কোথায় যাবে; সবটুকুই ভাসা ভাসা আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বোধ আর কাহিনি। এই পৃথিবীতে মানুষ তবু ইমারত গড়ে যায়, রাজনীতির কূটকৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে, মানুষের চাওয়া-পাওয়ার খেরোখাতা-খতিয়ান, আনন্দ-সুখ-দীর্ঘশ্বাস; এই তো জীবন আর সভ্যতার বড়াই।

বোস্তান সিনেমা হলে ছবি দেখি, শোনেন শোনেন জাঁহাপনা…শোনেন বলি ঘটনা। আমরা কল্পকাহিনি শোনায় মশগুল থাকি, পলকহীন চোখে মাথা দোলাই, তারপর খেল্‌ খতম পয়সা হজম; কেউ কেউ প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকার থেকে বের হয়ে আলোর মধ্যে হাঁক পাড়ে ‘হক মাওলা’ কিংবা ‘মুশকিল আসান’। সেই আমাদের সচেতনতা-জ্ঞান-বুদ্ধি, যা হলো হুজুগে বাঙাল, কে তাদের ধাক্কা দেয়? তার যে কৌপিনখানাও লটকে আছে আশ্চর্য মোহমায়া-আচ্ছন্ন কোনো রূপকথার গল্পে। ‘আমার আল্লাজি নবীজান’ গাইতে গাইতে কোনো প্রতিবন্ধী ভিখিরি রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যেন অন্ধ মহাকাল। কতদিন আর হাত পেতে নেবে? এই কাঙাল হাতে নিয়ে এসো শক্তি, কর্মের উদ্দীপনা আর স্বাধীন চিন্তা। এইসব ভাবনার মধ্যে একটি সিদ্ধান্তের জন্ম হতে চলে। স্বাধীনতা। আচ্ছা মৃত্যু কি খুব ভয়ংকর-বিস্বাদ খুব কষ্টের, অদৃশ্য যন্ত্রণায় নিশ্চুপ ছফফট ব্যথা, তবু তো রেহাই নেই, আজ আর কাল। আমি কি তবে সাইকেল ফেলে একলাফে সেলুনে প্রবেশ করব, করতে পারি অথবা পারব না, সে সম্ভব নয়, কেননা পাঁচ-ছয়জন মহিলা প্রেতাত্মার মতো ঘিরে থাকে ভয়াবহ নিশ্চুপ-নির্জন শহরের বৃষ্টির জল শুকিয়ে যাওয়ায় রাস্তায় আর চিৎকারে ভেসে যায় ফয়সালা। তখন আবু ইব্রাহিম বলে উঠে, –

‘আ রে ইয়ে লাড়কা কো আপলোগ পেহেচানতে নেহি? ইয়ে হামারা উকিল সাবকা বেটা হ্যায়।’

‘কৌন উয়াকিল…কিসকা বেটা? ইসে মারো, বাঙালি শালে মাদারচোদ সব গাদ্‌দার হ্যায়। সব শালে মালাউন।’

এই অমোঘ সিদ্ধান্তের মধ্যে যখন আমার আমি নেই হতে শুরু করে, অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকি, পা-দুটো অস্থির কম্পমান, গলা শুকিয়ে মরুভূমি শুকনো কাঠ, জিহ্বায় ভয়ংকর তৃষ্ণা এই বুঝি দম যায় যায়, সামনের সবকিছু অস্বচ্ছ-ঝাপসা, গ্রীষ্মের দুপুরে দগদগে রোদ ঝিলমিল, কোনোকিছু দেখা যায় না কিংবা মৃত্যুর বিমূর্ত অবয়ব দাঁড়িয়ে জ্বলজ্বল করে, নিশ্চিত কোনো বোধ নেই, অস্তিত্বহীন; আশ্চর্য কেউ ফাঁকফোকর পেয়ে বলতে শুরু করে, –

‘মাজাবর কী কারলো? ওই শালে গাদ্‌দারের ফাঁসি চাই। ইয়ে শালে বাঙালি লোগ মেরে সহর কো মার ডালা, মেরি আওলাদ, মেরি মুন্‌নি কো উঠা লে গেয়া, ক্যায়া কসুর থি? মুন্‌নি…মেরি মুন্‌নি…কিধার হ্যায় বেটি…মেরি লাডলি? মেরে সিনে কো দেখ্‌ বাঙালি শালে, ইয়ে দাস্ত কারবালা, কারবালা হো গেয়া। হায় হাসান…হায় হোসেন। ইয়া আল্লাহ্‌!’

এই শোকসন্তাপের মধ্যে বাতাসে জোরালো হতে থাকে ‘মাজাবর কী কারলো…মাজাবর কী কারলো’ খেদোক্ত জিজ্ঞাসা। সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। শেখ মুজিবর রহমান কী করেছেন? মন তুমি কতটুকু জানো দেশ আর মানুষ, কতটুকু জানা আছে মিরাটের দাঙ্গা আর সাতচল্লিশের মোহাজিরনামা কাব্যকথা? সে তো ইতিহাস, সেখানেও থেকে গেছে হাজার প্রপঞ্চকথন আর মিথ্যে ভ্রাতৃত্বের নাগপাশ। কতদিন ঢেকে রাখতে পারো মেষের খোলসে নেকড়ে-হায়নার লোল জিহ্বা আর তিক্ত ক্ষরণ? এই সময়ে দেবদূতের মতো উপস্থিত হয় শাকিল, শাকিল না আকিল, এ হলো অনেকদিনের ধাঁধা, স্মৃতির অলিগলি খুঁজে বের করতে হয়, কখনো কোনো চিহ্ন রেখে দিই, এরা যমজ দুইভাই আমার ক্লাসমেট…অন্তরঙ্গ বন্ধু। ক্লাস সিক্স থেকে এইট বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত বিষয় উর্দু অথবা আরবি, কিছুদিন আরবির ক্লাসে মা হাজা…হাজা কিতাবুন, মা হাজা…হাজা কিত্তাতুন অভিযান শেষে লাট্টুচক্কর উর্দু পড়তে আসি, প্রতিবেশী নূর হাসান মামার কাছে প্রাইভেট টিউশন, মানব সভ্যতায় মানুষের যত চোহারাছবি তত ভাষা, যাপিত জীবন, কোথাও তবু কেউ কেউ মৌন-মুক থেকে যায়। আমি সহস্র বাক্যের ছন্দপাঠ আর কাহিনি, খুদ্‌গরজ্‌ দোস্ত পড়তে পড়তে কতকিছু ভেবে নিই। আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এও আমাকে দেখতে হলো গোলাম হোসেন?’ মুকুটহীন নবাব যে বাংলার ঘরে ঘরে কোন্‌ আক্ষেপে ফিরে পেতে চায় আঁজলাভরতি একটু বাতাস, সূর্য ওঠা ভোর, কে তাকে সান্ত্বনা দেবে, কে তাকে আশা দেবে? আমার মুখের ভাষাও তো কেড়ে নিতে চেয়েছিল, রাজপথে রক্ত ঢেলে দিয়েছে অকুতোভয় বাঙালি, আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? একটি শহিদ মিনারের জন্য তো ভাষা আন্দোলন হয়নি, যেখানে তোমরা বসন্তের হাজার হাজার ফুল ছিড়ে এনে সাজিয়ে দেবে, সে যে চেতনা, সে যে বোধ, সেখান থেকেই তো মুক্তি অভিযাত্রার সূচনা। সেখান থেকেই তো বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ ধ্বনিত হয়, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ কার তর্জনী ইঙ্গিত করে স্বাধীনতা? কার অঙুলি নির্দেশ বলে যায়, চাই ত্যাগ চাই বিসর্জন, তবেই তো স্বাধীনতা; সেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধে তো কেউ কেউ নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়, ব্যক্তিগত স্বার্থের হিংসা চরিতার্থ করে, একে মেনে নিয়েই উৎপাটন করেই বাঙালি এগিয়ে যায়, যেভাবে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জল গড়িয়ে চলে বিশাল সমুদ্রের বুকে।

আমি শাকিলের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেখানেও কি কোনো প্রতিহিংসা জ্বলজ্বল করে? যেভাবে এই বেওয়া মহিলা কয়জন উন্মত্ত ক্রোধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আশ্চর্য শাকিল সেই জটলা থেকে বের করে নেয়। আমি ভয়ে ভয়ে সামনে এগোতে এগোতে কষ্টের গল্প শুনি, আমরা কে কেমন আর কোথায় কীভাবে বেঁচে আছি, কোথায় যাব জানি না, হয়তো জানা থাকে বলি না, কেননা বিশ্বাসের ভিতে চির ধরে গেছে; তারপর অন্ধকার কালোগহ্বরের মতো সবকিছু হারিয়ে অদৃশ্য হতে হতে আচমকা নীরবতা গ্রাস করে নিতে থাকে। আকিল-শাকিলের পরিবারে কেউ বেঁচে নেই, সে আর তার বাবা কোনোভাবে বেঁচে গেছে, তারা করাচি চলে যাবে খুব শিগগির। সাতই মার্চ, রবিবার, শেখ মুজিবের ভাষণ অব্যবহিতপরে জেলায় জেলায় যখন প্রস্তুতি শুরু হতে থাকে, ঘটনার পর ঘটনা, সৈয়দপুরে বিহারি-বাঙালি দাঙ্গার খবর, সেখানে পাকিস্তান সেনা সাদা পোশাকে বাঙালি নিধনে মত্ত হয়, রক্তে রঞ্জিত সেখানে অলিগলি আর পথ, এখানে দিনাজপুর শহরের মোড়ে মোড়ে মানুষের চোখে-মুখে সন্দেহ-অবিশ্বাস আর ভয়ার্ত-দুঃস্বপ্নের দিনরাত নেমে আসে। তারপর উনত্রিশে মার্চ, রবিবার, কুঠিবাড়িতে ইপিআর বিদ্রোহ শুরু হলে আকাশে আতশবাজির মতো গুলির শব্দ ছড়িয়ে যায়, মুক্তাঞ্চল ঘোষিত হয় পরদিন, অথচ তা বেশিদিন রাখা সম্ভব হয় না। তেরো এপ্রিল, মঙ্গলবার, দুপুরে পাকিস্তান বাহিনী তিনদিক থেকে প্রবেশ করতে থাকে, এখানে-ওখানে জ্বলতে থাকে আগুন আর আগুন; কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় রাতদিন। সেই আগুন প্রতিশোধ-জিঘাংসা বিহারিদের মনে মনে, শহর নিরাপদ নয়, কেন এসেছি তবে? শাকিলের প্রশ্ন, যে জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর নেই, কী বলব, মন কি জানে অথবা জানে না, কি জানি কোনোসময় ভেবেছি কিনা, আমি বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়াই, শাকিল বিশুষ্ক দৃষ্টিতে একবার নাকি শেষবার, আর দেখা হবে না, তাকিয়ে দেখে নেয়, আমরা পরস্পরের প্রতি আরও একবার নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকি, সেই মৌনতার মধ্যে শত শত কথা লেখা থাকে যা কেউ জানে না, আমরা কি জানি? বিদায় বন্ধু!

তখন এইসব কূটকৌশল-পারস্পরিক নিন্দাঝড়-হট্টগোল-হত্যা-উপহত্যার বীভৎস ঘটনার মধ্যে কোনো আস্থা-বিশ্বাস নেই, জোরালো হয়ে দেখা দেয় মানুষের বিষাদকাহিনি, সেগুলো প্রলম্বিত মিহিকান্নার মতো খুব কষ্ট দিতে থাকে। আমি বাড়ির দিকে তাকিয়ে খুব অকারণ চাবি প্রাপ্যতার কথা ভেবে নিই, কেন এত ব্যাকুল ছিলাম, কে এখন শহর রক্ষা করে, যেখানে মানুষের নিশ্বাস নিশ্চিত নয়, প্রাণবায়ু বড় ঠুনকো হয়ে আছে। বাড়ির কোনো দরজা নেই, এখানে-ওখানে ঘাস-ধুলো-আবর্জনার ছড়াছড়ি, ঘরের ভেনটিলেটরের দিশায় মেঝে আর বারান্দায় কবুতর বিষ্ঠার জমাট স্তূপ, আমাদের আদরের আবাস শান্তির নীড় যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপমা হয়ে চোখে দৃষ্টিকটু ভাসে। এখন কোন্‌ অসহায় চাহনি, কবে ফিরে পাব সেইদিন, আদৌ কি পাব কে জানে, এই দরজাহীন ঘরগুলো বুঝি দিশাহীন বেআবরু কৈফিয়ত দাবি করে বসে, কেন ছেড়ে গেলে আমায়? আমার বই-খাতা-কলম, উদার আকাশে ডানা মেলে দেওয়া নীল-লাল-বর্ণিল ঘুড়ি-নাটাই টিউবওয়েল চত্বরে এখানে-ওখানে ছিটকে পচে-গলে পড়ে আছে। এ-সবের মধ্যে ডায়রি মতো কিছু একটা খুব চোখে লাগে, সে কি মাও সেতুং-এর বাণীবদ্ধ বই? কখনো ক্রিসেন্ট বুক স্টলে বুঝে না বুঝে কিনে নেওয়া হয়, এখন কি সবকিছু আকুল আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে কাছে ডেকে নিতে চায়, আর যা কোনোভাবেই দমন করতে পারি না, কেননা এমন কোনো বইয়ের পৃষ্ঠার ফাঁকে তার ছবি রেখেছিলাম, সে আমার বুকের গোপন উষ্ণ প্রকোষ্ঠ, হৃদয়ের শব্দ শুনে যেতে আর শোনাব বলে; সে আমার বন্দনা। কত দিন দেখি না তাকে। আমি খুব দ্রুত ডায়রি নাকি বই হাতে তুলে নিই, এই তো কিছুক্ষণ আগে মৃত্যু-স্বর্গ-নরক আর অমীমাংসিত কোনো অদ্ভুত জীবনের কথা ভেবেছিলাম, তার সব ভুলে যাই, আর কিছু বুঝতে না বুঝতে ডায়রির ভেজা ভেজা পৃষ্ঠাগুলো হাতড়ে দেখতে থাকি, কোথায় কোথায়? আকস্মিক একটি ছবি বেরিয়ে আসে, জলের দাগে ঝাপসা ফ্যাকাশে-ধূসর চেনা-অচেনা, তবু তো ছবি, ছবি নয়, সে কী কথা বলতে থাকে, কোনো রাগ-অনুরাগ না বলা কথা? তখন কেউ একজন বাতাসের দেয়ালে সেঁটে থাকা মানুষ হয়ে জেগে ওঠে, তার চোখে-মুখে দুষ্টুমি হাসি, এই একাত্তর, আমার গোপন অভিযান সবকিছু অবিমিশ্র পুলকে ভরে উঠতে থাকে। আমি আঙিনায় নেমে সামনে রাস্তার ধারে জামগাছ দেখতে দেখতে সেই ক্ষণ-অনুক্ষণ খুঁজে নিতে নিতে মানুষের চলে যাওয়া দৃশ্যছবি পুনরায় দেখে নিই, এই তো এগারো এপ্রিল, রবিবার বন্দনা চলে গেল। রিকশা দুটো কত দূর যাবে? কোথায় গন্তব্য কে জানে? একফাঁকে জিজ্ঞেস করে জানলাম।

‘কোথায় যাবে তোমরা? আসবে কবে?’

‘আর আসব না। বাবা বলেছে, ওখানেই থাকব।’

এখন মধ্যদুপুর আঙিনায় দাঁড়িয়ে, যেখানে জট পাকানো জটিল লতাগুল্ম আর কোমর-উঁচু লম্বা ঘাস বাতাসে মৃদু লকলকে ঢেউ তুলে নেচে যায়, সেই কথা নাকি শেষকথা উপসংহার, আবারও বড় দিগদ্ধ অস্থির করে দেয় ঠিক সেদিনের মতো আর দিশাহীন কল্পনায় ছবি আঁকতে সাধ জাগে, কেউ একজন বুকের মধ্যে আনমনে কি গভীর বেদনায় উচ্চারণ করে যায়, তার কিছু বুঝি কিছু বুঝি না; অচেনা দোলা শূন্য হাহাকার।

‘তুমি ফিরে আসবে তো বন্দনা?’      

                                  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত