| 29 মার্চ 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: গল্প: বৃষ্টির দিন   । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

জোরে জল আসছে। হাওয়ার বেগও বেশি। ঘরের মধ্যে জল এসে ধুয়ে দিচ্ছে মেঝে, গতকালের লক্ষ্মী পুজোর আলপনা। সোমা এখনও ফেরেনি। দেরি হবে বোধহয়। চারদিকে ছড়ানো, কাপড়ে বসানোর ফলস্‌। ওরা হাওয়ায় উড়ে ছড়িয়েছে। মেঝের এক কোনায় মাদুরে রাখা কাঁচি, কাপড়ের প্যাকেট, খাটে তুলে রাখে দীপক।ফলস্‌গুলো একহাতে যতটা পারে গুছিয়ে জড়ো করে। সোমা এখনও এলো না কেন কে জানে? সন্ধে হওয়ার আগে আগেই না এসে গেলে মুস্কিল হবে। মোমবাতি জ্বালানোর জন্য মেজ বউদিকে না ডাকতে হয়। না ডাকবে না। অন্ধকারেই বসে থাকবে ও। বুঝুক সোমা। এতটা দেরি করার ফল বুঝে নিক।

পুজো এসে গেছে। চারদিকে পুজোর দোকান সাজিয়ে রাস্তাগুলো কেমন জ্বলে উঠেছে। ছোটবেলায় বাবা থাকতে পুজোর অনেক আগেই কেনাকাটা শুরু হয়ে যেত। এবারে বোধহয় তেমন জমবে না পুজো। যা বৃষ্টি!দিন নেই রাত নেই বৃষ্টি লেগেই আছে।

সোমা বলছিল গতকাল, “এবারে পুজোয় তোমায় একটা শার্ট করিয়ে দেব।”

“না না, শার্ট কী হবে? আমার ওই হাফহাতা ফতুয়াই ভালো।”

“না না ফতুয়ায় কেমন যেন…।”

“আরে বলেই ফেল না।হাতটা দেখা যায়, এই তো। তা এ আর না বলার কী আছে? পাড়ায় আমার নামই এখন হাতকাটা দীপক।”

“বাজে কথা বলো না তো! কতদিন বলব এসব বলো না। আমার খারাপ লাগে।”

“ঠিক আছে।” দীপক হেসেছিল মনে মনে। সত্যিটা চাপা দিয়ে লাভ আছে কিছু? হাতকাটা লোক কী তাতে হাতওলা হবে?

                        

সেদিন সোমার একটু দেরি হয়েছিল। মিতা বৌদির কাপড়গুলো দিতে গেছিল সোমা। টেনশান হচ্ছিল দীপকের। রাগ করে জানলা দেয়নি। সোমার সেলাইএর ব্যাগ, অর্দ্ধেককরা দড়ির পাপোশ, সব ভিজেছে। কখন সোমা এসেছে, আলো জ্বেলে সব গুছিয়ে ঘর মুছেছে, খেয়াল রাখেনি তেমন। সোমার এই এক রোগ।রেগে গেলে কথা বলেনা। চুপচাপ থাকে। তেমনই ছিল।

মাঝে মাঝে মনে হয় সোমা দয়া করে তাকে। এই যে নিঃশব্দে সংসারের সব কাজ সারে। সেলাই করে, ট্যুশানি করে সংসার চালায়, এ কি দয়া নয়?

সোমা তুমি আমাকে বিয়ে করলে কেন? কতদিন মনে হয়েছে, তবু কথাটা বলেনি ও। দীপক তো জানে সোমার কথা। বউদির বোন সোমা। মধ্যপ্রদেশ থেকে বিয়ের সম্বন্ধ করবেন বলে নিয়ে এলেন ওর বাবা,মা। তখন দীপকের শরীর তাজা, ঝকঝকে! মাথা ভর্তি চুল।একটা হাত নেই শুধু। বাড়ির বড় ব্যবসা, বাবার পয়সা, সব আছে। নিজস্ব কোন উপার্জন তেমন ভাবে না থাকলেও পাত্র হিসাবে খারাপ নয়। ট্রেন দুর্ঘটনায় হাত গিয়েছে, শরীর শক্ত, সমর্থ। বিদ্যে, বুদ্ধি আছে।


আরো পড়ুন: অশরীরী । মোজাম্মেল হক নিয়োগী


মা বললেন, “এ মেয়েটিকেও যদি আমাকেই দেন বেয়ান।”

সোমা বলে, “তুমি ভুল করো। মত দিয়েছিলাম আমি।”

“কেন সোমা,তুমি কেন বললে না তোমার মত নেই।কেন তোমার আস্ত জীবন, একটা হাতকাটা লোকের সঙ্গে জড়ালে তুমি?কেন সোমা, কেন?” এসব কথা মনে মনে বলে দীপক।

বাবা চলে গেলেন।শুরু হল দুর্ভাগ্যের দিন।বাবার ব্যবসা দেখার অভাবে ডুবল। ডিমের পোলট্রি, পাঁউরুটির বেকারি, একে একে হাতছাড়া। একহাতে লড়া যায়? বাঁচা যায়? যায় হয়ত। পারেনি ও।

মুদিখানার খাতা লিখে মাস গেলে দু’পাঁচশো আসে। টিউশানির ধৈর্য্য নেই। অস্থিরতা বাড়ছে দিনদিন। বাবা চলে যাবার পরেও রয়ে গেল ব্যাংকে জমা বাবার দেওয়া কিছু টাকা, বড় বাড়ির অংশ, আর অনেকখানি সম্ভ্রম।সব ভাইয়েরা একে একে আলাদা হল। পাশে সোমা না থাকলে ও ঠিকঠাক বাঁচত কী? ওই রোগা শরীরে, শ্যামলা রঙে, কেমন নিঃশব্দে যুদ্ধ করেছে। কেউ কিছুই টের পায়নি।

সোমা বলে, “আমি কী করেছি? তোমার এই বাড়ি না থাকলে পারতাম? বাবার দেওয়া অতগুলো টাকা না থাকলে ব্যাংকের এই সুদ আসত কোথা থেকে? আমি একা মেয়েমানুষ, তোমাদের পয়সা না থাকলে…।”

দীপক ভাবে আমার হাত যদি ঠিকঠাক হত! আমি যদি দেশলাই জ্বালিয়ে চা বানাতে পারতুম! তোমার অসুখে যদি একদিন একটু ভাত রেঁধে উপকার করতাম! তবে এই সংশয় আসত না আমার। দীপক বলে মনেমনে, “সোমা তুমি কি দয়া করো আমাকে?”

                          

দীপক দেয়নি কী কী? দিল কী কী?

সোমা সেলাই করতে করতে সূঁচ ফোটালো হাতে। সন্ধে নেমেছে অনেকক্ষণ। আলো জ্বালানো হয়নি।অন্ধকারেই অভ্যাসে হাত চালাচ্ছে সোমা। দেওয়ালে কালো ছায়া। ঘরের আর এক কোনে বসে আছে দীপক।সবসময়েই বিষণ্ণ! একহাতে জল এনে দেয়।বিছানা করে। বিছানা তোলে।ওইরকমই তো অভ্যাস হয়ে গিয়েছে সোমার।

সন্তান হল না তাদের। বিয়ের পর পর অনেক আশা ছিল। তারপর এল হতাশা, দুঃখ। সেসব দিন ঘিরে কখনও বা ঝড়ের মত কখনও বা পায়রার মত দুঃখের বক্‌বকম্‌। সারা দিনরাত সোমা শুধু ভেবেছে, কেন কেউ এল না। দয়া নয়, মায়া নয়, একটুকরো ভালোবাসা হয়ে কেন এল না কেউ? কেন ?

সেসব দিনের হাহাকার এখনকার শুকনো বাতাস নিয়েছে শুষে। কোন দাগ নেই কোথাও। রোজকার টানাপোড়েনের দিনযাপনে দীপক শুধু ভাবে দয়া করেছে সোমা, মায়া করেছে।

ভাবতে ভাবতে উঠে পড়ল সোমা। দীপকের মাথায় সবসময় একটাই চিন্তা ঘোরে। ওদের সবাই দয়া করে,করুণা করে। মান সম্মান নিয়ে সারাক্ষণ দুর্ভাবনা ওর।

সোমার রান্নার হাত চমৎকার। পাশের বাড়ির লোক  ঘরোয়া অনুষ্ঠানে রান্না করতে ডাকলে, দীপক  বলে, “না।যাবেনা। কম অবস্থার লোকেদের ডাকে সবাই। কই মেজবৌদি, বড়বৌ্দি, এদের বলে না তো।”

দীপকের বারণ না শুনে ও যায় কী করে? “পাড়ার লোক। বিপদে আপদে কত দেখেছে ওরা। অমন বলতে আছে?” তবু সেই এক গোঁ।

“হ্যাঁ। আছে। আমার হাত নেই, তাই ওরা…।” গজ্‌গজ্‌ করেছে দীপক।

“তোমার হাত নেই? না আমার ছেলেপুলে নেই, কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই।”

না বলেনি সোমা। এমন কী বলা যায়?হাত নেই বলে সবাই বলে হাতকাটা দীপক। তাই সবেতেই এক চিন্তা।দীপক কেন ভাবে না আমার কী নেই?ভয় পায় সোমা। ওদের সবচেয়ে বড় নেইটাকে যদি চিনতে পারে ও।কোঁকড়ানো মানুষটাকে কিছুতেই ও এই দুঃখটা পেতে দেবেনা।

                         

দুঃখটা গুঁড়ি মেরে মেরে আসে। যবে থেকে দীপকের সঙ্গে বিয়ে হল ওর, দুঃখটা তবে থেকেই ওদের মাথার চালে বাসা নিয়েছে। পাকা বাড়ি বাবার আমলের। মাঝেমাঝে দেওয়াল থেকে বালি ঝরে। তবু শক্ত কাঠামো।মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে না। বাইরে থেকেও দেখায় শৌখিন।

দীপকের হাত নেই। কিন্তু মাথায় ছাদ আছে।অনেক না থাকা জিনিসের গোছানো সংসার আছে একটা।মেঝেতে ঝরা বালিও নজর এড়ায় না। সোমা  ঘরদোর গুছিয়ে রাখে। অপচয় ছাড়া যেটুকু ভালো থাকার আরাম, সেটুকু ঠিক যুগিয়ে দেয় দীপককে। দীপক সবসময় কাঁসার বড় জামবাটিতে মুড়ি খায়। কখনও বা দুটি ছোলাভাজা দেয় ও। চাল বেছে রাঁধে। মশলাপাতি রোদ্দুরে শুকোয়। গরীব মানুষের পরিশ্রমের সুখ, দুঃখটার সঙ্গে কুস্তি লড়ে মাঝে মাঝেই।

দীপকের এক হাত নেই। তাই দীপক দুঃখ দুঃখ করে। দুঃখটা তখন খোঁড়া পায়ে লাফায়। গুঁড়ি মেরে ঢুকতে চায় ওদের ছেঁড়া কাঁথায়। সোমা অদ্ভুত মেয়ে! জেনেবুঝে দুঃখের কাঁথা তুলে রোদ্দুরে শুকোয়। দীপক মনেমনে বারবার বলে, “আমায় দয়া করো নাকি? ও সোমা…।”

সোমা  যে কেন শুনতে পায় না।

আসলে সোমার যে অন্য দুঃখ। ওর কোল ফাঁকা। দুঃখের ভারি মুস্কিল! বাচ্চার না কেনা খাবার হয়ে, না পরা পোশাক হয়ে ঢুকতে পারে না। রাতে যখন এক বিছানায় গুটিশুটি হয়ে দুটি মানুষ ঘুমোয়, দুঃখ হাঁ করে দেখে।কী সুন্দর! ওদের মাঝের ফাঁকে একটা আলো জ্বলছে যে!

ওই আলোকে দুঃখ ভয় পায়। লুকিয়ে ফেলে নিজেকে। হঠাৎ তাপে ঝলসে যায় যদি!

জোরে জল আসে। হাওয়া আসে। সোমার কাজের জিনিস এলোমেলো হয়। দীপক রাগ করে। সোমা ভাবে মানুষটার যদি দুটো হাতই থাকত, হয়ত এত রাগত না।

দীপক ভাবে, এতদিন ধরে সোমা  তো আমায় অনেক দিল। আমি ওকে কী কী দিতে পেরেছি? আমাদের ঘর ফাঁকা। কচি বাচ্চার কান্না, বায়না নেই। আমার এক হাত কাটা। দুহাতে আমি কাজ করতে পারি না। সোমা  কি তবে আমায় মায়া করে? দয়া করে শুধু?

দীপক ওঠে। সোমার ঘুমিয়ে পড়া শরীরের কাপড় ঠিক করে দেয়। গুটিয়ে যাওয়া হাতদুটো সোজা করে রাখে।মাথার চুলে ডানহাতটা বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবে, আমার যদি দুটো হাতই থাকত, সোমাকে আমি আর কী কী দিতে পারতাম?

                       

                                

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত