| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৫)

আনুমানিক পঠনকাল: 20 মিনিট

বাংলা ভাষার উদ্ভব, উনিশ শতকে কলিকাতার সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের দ্বারা সংস্কৃতায়িত বাংলার সৃষ্টি, বাঙালির সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে পরতে পরতে লেখা হয়েছে মিথ্যা আর ভুল তথ্যভিত্তিক বানোয়াট ইতিহাস। দুইশ বছর  ধরে আমরা  অইসব ভুল বা বানানো ইতিহাস মেনে নিয়ে এর ভিত্তিতেই পুনরায় আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির বয়ান রচনা করে গেছি। আর এভাবে বাংলা ভাষা পরিণত হয়েছে সংস্কৃতের উপনিবেশে। এই প্রথমবারের মত বানানো ইতিহাসের স্তর খুঁড়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বাঙালি সংস্কৃতির রদবদলের আদত ইতিহাস উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়েছেন উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম তার “ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস”বইয়ে।

ফয়েজ আলম ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা’ এটি সচেতন চেষ্টায় তৈরি একটি মিথ্যা বয়ান, যে মিথ্যা রচনার পিছনে কাজ করেছে ধর্মীয় আবেগ ও উপনিবেশি প্রশাসকদের প্রশ্রয়। আসলে সংস্কৃত এবং বাংলা দুটো ভাষাই এসেছে স্থানীয় ভাষা থেকে (যাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হয়ে থাকে)। প্রাচীনকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান পাকিস্তানের অংশ বিশেষসহ) প্রচলিত স্থানীয় ভাষাকে কিছু নিয়মে বেঁধে দেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা পাণিনি নামের এক পন্ডিত; সেটিই পরে ধর্মচর্চা আর ধর্মীয় লেখাজোকায় কাজে লাগানো হয় আর সংস্কৃত ভাষা নাম পায়। এটি কখনো কোনো মানবগোষ্ঠির মুখের ভাষা ছিলো না। একই সময়ে আমাদের দেশে প্রচলিত স্থানীয় ভাষা মানুষের মুখে মুখে স্বাভাবিক রদবদলের নানা ধাপ পার হয়ে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বাংলা ভাষার আদি রূপ নেয় । সংস্কৃতের সাথে বাংলার কোনো সরাসরি সম্পর্কই নাই। অথচ দুইশ বছর ধরে ভাষার ইতিহাসে আর পাঠ্য বইপুস্তকে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের মা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এরকম অনেক বানোয়াট ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন ফয়েজ আলম ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস এই ধারাবাহিকে  আজ থাকছে পর্ব- ৫।


 

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও  মালিকের দরকারে আর পণ্ডিতদের আবেগে বাংলার রূপ বদল

 

উনিশ শতকে বাংলা ভাষার কৃত্রিম রূপান্তর বা বিবর্তনের সূচনা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। ১৭৫৭ সাল থেকে কলেজ বসানো পর্যন্ত ৪৩ বছর লম্বা সময়। এর মধ্যে ইংরেজ উপনিবেশকরা বাংলার শাসক হিসাবে জাঁকিয়ে বসেছে। খাজনা ও কর আদায়, নানা ধরণের ব্যবসা এইসব উৎস থেকে স্রোতের মত সম্পদ আসছে তাদের হাতে। উপনিবেশ যে আর্থিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক সেই বোধের সন্তুষ্টি এবং  জনশাসন ও শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারের সূত্রে মনের আনন্দময়তার স্বাদ তারা ভালো ভাবে নিতে পেরেছেন। এইটা অনেকটা বাঘের শিকার প্রক্রিয়ার সেই অবস্থার মত যখন শিকারকে আহত করে দাঁতে গিঁথে রেখে সামান্য রক্তের স্বাদ পেয়েছে আর বিভোর হয়ে আছে গোটা শিকারের রক্ত মাংস খাওয়ার স্বপ্নে। এ অবস্থায় বৃটিশদের মনে বাংলার দখল দীর্ঘায়িত করা এবং শাসন-শোষন নির্বিঘ্ন ও মসৃণ করার চিন্তাভাবনা চলছিলো। উপনিবেশের মালিক ইংরেজরা আরো আগে থেকেই মনে করছিলেন শাসনের সাথে জড়িত কর্মচারিরা যদি স্থানীয় প্রজাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে মোটামুটি ওয়াকিবহাল হয়ে তাদেরকে ভালোভাবে বোঝার কাজটা করতে না পারে তাহলে শাসন ও শোসন মৃসণও হবে না, বেশিদিন টিকবেও না। বিশেষ করে ওয়ারেন হেস্টিংসের ধারণা ছিলো এরকমই। পরে ওয়েলেসলি একই ধারণা নিয়ে জুনিয়র স্তরের কর্মচারীদেরকে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান দেয়ার নিমিত্তে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এ সংক্রান্ত রেগুলেশন পাশ হয় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মে’র ৪ তারিখে, আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের যাত্রা শুরু হয় সে বছর ১৮ আগষ্টে। সিদ্ধান্ত হয় বাংলা প্রেসিডেন্সীতে যেসব তরুণ সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা নিযুক্ত হবেন তাদের জন্য কলেজে তিন বছর পড়া বাধ্যতামূলক।

১৮০১ সালের মের ৪ তারিখে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন উইলিয়াম কেরি। পরে বাংলা এবং সেইসঙ্গে সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক হন তিনি। এখানে যোগদানের আগেই বাইবেলের বঙ্গানুবাদের কারণে তিনি ইউরোপীয়দের সমাজে বাংলা বিশেষজ্ঞ হিসাবে সুনাম কুড়িয়েছেন। সেইসূত্রেই তাকে ওখানে চাকরি  দেয়া হয়। যোগদানের পর বাস্তব কাজে নেমে প্রথমেই পাঠ্যপুস্তকের প্রবল অভাব দেখেন কেরি। অতএব বাংলা বইপত্র রচনার জন্য উপযুক্ত লোক নিয়োগের প্রসঙ্গ আসে। কেরি বিদেশী, এ সমাজে বহিরাগত। ফলে বাংলা বই লেখার লোক খুঁজতে নেমে পরিচিত লোকদেরই ‘খুঁজে’ পেলেন তিনি। তারা হলেন সংস্কৃতজ্ঞ কয়েকজন পন্ডিত, যারা বাংলা ভাষা ভালো জানতেন না। কেউ কেউ বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞাও করতেন। এভাবে বাংলা ভাষার শিক্ষক-লেখক হিসাবে যাদেরকে জোগাড় করা হলো তারা সংস্কৃতের বটগাছ, কিন্তু বাংলার আগাছা। এই আগাছাদের হাতে বাংলা বই রচনার ভার পড়লো। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতই প্রমথনাথ বিশী এই পরিস্থিতির একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, “যাঁরা কোনকালে বাংলাভাষার চর্চা করেন নি, করবেন এমন স্বপ্নেও ভাবেন নাই, অনেকে হয়তো বা মনে মনে বাংলা ভাষাকে ‘ভাষা’-মাত্র জ্ঞানে অবজ্ঞা করতেন, হঠাৎ একদিন ভবিতব্যের ইঙ্গিতে তাঁদেরই উপর বাংলা গদ্যসাহিত্য গড়ে তুলবার ভার পড়ল।”৩১ 

কলেজের প্রথম দিকের কয়েকজন বাংলা-লেখনিয়া পন্ডিত হলেন. উইলিয়াম কেরি( ১৭৬১-১৮৩৪),  রামরাম বসু (১৭৫১-১৮১৩),  মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (আনু.১৭৬২-১৮১৯), রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায় (১৮-১৯ শতক), তারিণীচরণ মিত্র (স্কুল বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা), গোলক নাথ শর্মা, কাশীনাথ তর্ক পঞ্চানন, হরপ্রসাদ রায়। এদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়, তারিনীচরণ মিত্রের রচনা সবিশেষ প্রভাব ফেলে। বিদ্যালঙ্কার ছিলেন সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রধান মুনশি। তিনি অবাঙালি ছিলেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন জোশুয়া মার্শম্যান। তার মতে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার উড়িষ্যার মানুষ, উড়িয়াভাষী।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিনিধি হিসাবে কেরি যখন এদের উপর বাংলা গদ্য বই রচনার ভার দেন তখন কলিকাতার বোদ্ধা মহলে হ্যালহেড-জোনসের এই ভুল বয়ান পুরা চাউর হয়ে আছে যে, ভারতের সকল ভাষার উৎস হলো সংস্কৃত। তারা এ পরামর্শও দেন যে, বাংলা ভাষার উন্নতি করতে হলে সংস্কৃতকে অনুকরণ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুঞ্জয়রা শুরুতেই ধরে নেন তারা সংস্কৃতের অনুকরণেরই বাংলা ভাষার সবিশেষ উন্নয়ন ঘটাবেন, রচনা করবেন বাংলা গদ্যের বইপত্র। ইংরেজরা জানতেন বাংলা গদ্য নাই, লেখা হয় নাই। তাই ইংরেজের তাবেদার হিসাবে মৃত্যুঞ্জয়রাও জানলেন বাংলা গদ্য লেখা হয় নাই, তাদের এখন লেখতে হবে।

কিন্তু আমরা জানি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও জোনস হ্যালহেডের বহু আগে থেকেই বাংলা ভাষা স্বাভাবিক গদ্যের জন্ম দিয়েছিলো। সেই গদ্য তৈরি হয়েছিলো সাধারণ মানুষের হাতে, তাদের পারস্পরিক ভাব, সংবাদ ও নির্দেশনা বিনিময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃত অনুসারী ছাত্র-পাঠ্য বইয়ে রচিত বাংলাগদ্য এতটাই মূল্য ও গুরুত্ব পায় যে নিজেদের রচিত গদ্যের কথা নিচে ফেলে তাকেই মাথায় তুলে নেয় সবাই। অবশ্য উনিশ শতকের শেষ থেকে অনেকে পুরোনো বাংলা গদ্যের কথা বলতে থাকেন। এ বিষয়ে প্রথম তথ্যভিত্তিক আলোচনা শুরু করেন কৈলাসচন্দ্র ঘোষ। তুলনামূলক সাম্প্রতিক কালে ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় পুরানো বাংলা গদ্যের নমুনা সহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তার বাংলা গদ্যের আদিপর্ব বইয়ে। বইটি অত্যন্ত তথ্যবহুল ও সুচিন্তিত মতামতে সমৃদ্ধ।৩২  ড: আনিসুজ্জামানের লেখা পুরোনো বাংলা গদ্যও গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রচার-প্রসারে শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা সবার জানা। সেইযুগে বাংলা ভাষার চর্চা সম্পর্কে ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন:

মুসলমান শাসনাধিষ্ঠান অথবা দেশীয় রাজসভা–সকলে বাংলায় পত্রাদি লিখতেন। ইসলামী রাজবৃত্ত ইতিমধ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলে। বাংলায় এসময় মুসলমানী ভাবধারা যেমন ব্যাপক হয়েছিল অন্যপক্ষে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বৈদেশিকতার বর্ম ভেদ করে তেমনি মহম্মদীয় সমাজ রাষ্ট্র-ধর্ম্মীয় প্রবণতার অভ্যন্তরে রচনা করেছিল একটি নিবিড় অচ্ছেদ্য প্রচ্ছদ। সুতরাং হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতেন।৩৩ 

এ রকম উদার ও উৎসাহদায়ক পরিবেশে বাংলা গদ্যের ধারা পরিপুষ্ট হতে থাকে। ভক্তিমাধব উল্লেখ করেন, “গদ্য জগতের সম্পূর্ণ পরিচয়ের সন্ধানে প্রাচীনতার দিকে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত যেতে পারি। তবে ষোড়শ শতাব্দী থেকে নিশ্চিতভাবে বাংলা গদ্যের নিদর্শন আমাদের হাতে এসেছে।”৩৪ তার সংগ্রহ থেকে আমরা কিছু উদ্ধৃত করি। প্রথমটা ১৭৮৬ সালে লেখা, পরেরটা ১৭৪৮ সালে:

তাঁতীদের হাতে বুনা তাঁত ব্যবসা বন্ধের জন্য তাদের উপর ইংরেজ ব্যবসায়ীদের অত্যাচারের প্রতিকার বিধান চেয়ে লেখা আবেদনের অংশ বিশেষ: “. . . মে ওয়াল সাহেব জবরদস্তী করিয়া তাতী লোককে কাপড় বুনিতে দেয় না মুচলক লইয়াছেক সেওয়ায় ইঙ্গরেজের কোম্পানি আর কোন মহাজনের কাপড় বুনিতে পারিবে না ইহাতে তাতী লোক আমাদিগের কাপড় বুনিতে রাজী জদি ছারীয়া আমাদিগের কাপড় কেহ বোনে তাহা ছেনাইয়া লন এবং মারপিট করেন ইহাতে আমাদিগের কর্ম্মবন্ধ হইয়াছে–জাহাতে কাজ চলে এমন তদারক করিতে হুকুম হয়. . . (১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দ, ১২ আগষ্ট)”। ৩৫

“ইজ্জত আসার আনন্দীরাম হাজরা সিকদার ও গোলাম সরকার সুচরিতেষু, আগে পাত্রড়ের জাহির করিল যে, মৌজে মজকুরের বাবুরায় আপন বাড়ি ঘর ও বাহির বাড়ি ও পুষ্করিণী দিগর এবং পুষ্করিণীতে গাছ আছে ইহা আমাকে লিখিয়া দিয়াছেন। ইহার সনদ ১১৫৪ সালে আপন আহেলাতে দিয়াছেন, তাহা বর্গীর হেমগামে খোওয়া গিয়াছে, এখন সনদ হুকুম হয় তবে আমি করি, ইহার যেমত হুকুম হয়। অতএব বাবুরায় আপন বাড়ি ঘর ও বাহির বাড়ি ও পুষ্করিণী দিগর ও গাছ দিগর দিয়াছে ইহার সনদ ১১৫৪ সাল আপন আহেলাতে দেওয়া গিয়াছে, তাহা খোয়া গিয়াছে। এসবের পুনশ্চ পরোয়ানা করিয়া দেওয়া গেল। রায় মজকুরের বাড়ীঘর পুষ্করিণী গাছ সকল ইহো ভোগ করিবেন তোমরা কেহ মোজাহেম না হবে। ইতি

সন ১১৫৫, ৩১শে বৈশাখ”৩৬ 

ভক্তি মাধবের বই থেকে আমরা চিঠিপত্রের গদ্যের নমুনা দিলাম। এবার চিন্তাচর্চার গদ্যের উদাহরণ দেখবো ড: আনিুসুজ্জামানের পুরানো বাংলা গদ্য বইয়ের বরাতে। বৈষ্ণব মহাজনেরা বাংলাকেই ধর্মচর্চার ভাষা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। চৈতন্যর মৃত্যুর পর সতর শতকে বৈষ্ণব সাধনতত্ত্বের ব্যাখ্যায় মতবিরোধ দেখা দেয়। এসময় বৈষ্ণব সহজিয়াদের হাতে ভাবচর্চার অবলম্বন হিসাবে বাংলা গদ্যের  ব্যবহার লক্ষ করি আমরা। আনিসুজ্জমান বলেছেন যে, বস্তুত বৌদ্ধ সহজযানী সাধকেরা যেমন বাংলা কাব্যক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন, ভাবের গদ্য রচনায় তেমনি পথিকৃৎ ছিলেন বৈষ্ণব সহজিয়া সাধকেরা। রচয়িতার নামহীন কারিকা ও অষ্টসখীর গণনির্ণয় পুস্তক থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করেছেন আনিসুজ্জামান। বইটি সতর শতকের প্রথম দিকের রচনা বলে ধারণা করা হয়। সেই উদ্ধৃতি আমরা এখানে তুলে দিচ্ছি:

“শ্রীপঞ্চমিকে তিন থাকিতে (শ্রীমতি) বাপের বাড়ি জান: ॥ মাঘ ফাল্গুন চৈত্রের

ফুলদোল পর্যন্ত বাপের ঘরে থাকিয়া হুলি খেলা খেলেন। জতদিন হুলিখেলা তত [দিন] গোচারন নাঞি:॥ হোলি-খেলার ছলে মধ্যাহ্নে শ্রীকৃষ্ণমিলন:॥ বৈসাখ মাষে সসুর ঘরকে আইসেন:॥ বৈসাখ জৈষ্ঠ আসাড়ের সাতাইশ দিন পর্যন্ত ঘরে থাকিয়া আরবার বাপের ঘরকে আইসেন:॥”৩৭ 

এ গদ্যের ভাষা সরল, সবল, প্রকাশক্ষমতা প্রশ্নাতীত। তবে ধর্মীয় রচনা বলে সংস্কৃত/তদ্ভব শব্দের মোটামুটি ব্যবহার লক্ষণীয়। আনিসুজ্জামানের বই থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া যাক:

“সহী শ্রীজুত মহারাজ বাহাদুর–

দস্তক বনাম রাহাদারান চৌকিদারান ও জমিদারান ও কানুনগোয়ান তালুকদারান ও সিকদারান ওদেদারান ও পাইকান পেয়াদাগান ও হরকরআন ডিহিদারান তাহদ্দে রাইয়তান ওগরহ আমলাদারানাং চাকলে মুরসিদাবাদ হদ্দ নাগাদি রাজগঞ্জ প্রতিবেদনান্দ আগে নয়নষুক কাপড় তিন গাটী লবন পাঁচহাজার মোন এই দুই জিনিষ মোকাম রাজগঞ্জ জাইতেছে তোমরা কেহ রাহাঘাটে আটক না করিবা ঠিকানায় জেখানে এ জিনিষ উত্তরিবা তাহা তোমরা চৌকি পহরা দিয়া খরবদারি করিবা আর জখন নৌকা  খুলিয়া জাইবেক তখন আপন লোক দিয়া সরহদ্দ ছাড়াইয়া দিবা ইহা খুব তাগিদ জানিবা।  ইতি–” ৩৮ 

উদ্ধৃতির ভাষা খুবই সহজবোধ্য, প্রকাশক্ষম। শুধু তাই না, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন যে ভাষায় কথা বলে তার সাথেও এ গদ্যের যথেষ্ট মিল রয়েছে। এ ধরণের প্রচুর গদ্য রচনা এখন প্রকাশিত হয়েছে। এসব রচনা থেকে প্রমাণ হয় আমাদের পূর্বপুরুষরা স্বাভাবিক সামাজিক প্রয়োজনে সেই ষোল শতক থেকে মোটামুটি বোঝার মতো গদ্য লিখে আসছিলেন। সেইসব রচনা কেবল চিঠিপত্রের আদান প্রদান বা সরকারী নির্দেশনা চুক্তি ইত্যাদির সমাহার মাত্র নয়। এগুলো যেমন আছে, তেমনি আছে ভাবচর্চার গদ্যও যার সাহিত্যিক গুণ অস্বীকার করা যাবে না। এমনকি এর মধ্যে শিক্ষামূলক রচনাও আছে। তাহলে ইংরেজ কর্মচারীদেরকে বাংলা ভাষা ও আচার-সংস্কৃতি শিখানোর জন্য নতুন গদ্য সৃষ্টির প্রয়োজন পড়ল কেন?

এর কারণ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোক্তরা সে সময় প্রচলিত কিছু ভুল ধারণায় চালিত হয়েছিলেন : এক. তারা বাংলা ভাষা সম্পর্কে ভালোভাবে জানাশোনা না করেই কেবল হ্যালহেড ও জোনসের ভুল ধারণার উপর নির্ভর করেছিলেন, দুই. তারা হ্যালহেড-জোনসের এই ভুল-বক্তব্যে স্থির ছিলেন যে, ভারতের সকল জীবিত ভাষার মত বাংলাও সংস্কৃতের সন্তান। তাই সংস্কৃত পন্ডিতরাই ভালো বাংলা গদ্য লেখতে পারবেন, ৩. তারা জানতেন না যে, বাংলা গদ্য রচনা শুরু হয়েছে আরো দ্ইুতিনশ বছর আগেই। শেষ কারণটিই  তাদেরকে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত করে থাকবে। এ বিষয়ে আনিসুজ্জামানের মন্তব্য যথার্থ বলে মনে হয়। তিনি লিখেছেন: “বোঝাই যায়, এর আগে কখনো বাংলা গদ্য লেখা হয়েছিল কেরী এবং তাঁর সহকর্মী ও মুনশিরা তা জানতেন না। পূর্ববর্তী ধারা সম্পর্কে অজ্ঞতাবশত তারা বাংলা গদ্যের যে ধারা নির্মাণ করেছিলেন, তা ছিল স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।”৩৯  বস্তুত, অজ্ঞতাবশত বাংলা গদ্যের প্রচলিত রীতির বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থেকে সংস্কৃত গ্রন্থাদির অনুকরণে সংস্কৃত শব্দবহুল ও ব্যাকরণিক নিয়মে  নতুন গদ্য সৃজন করলেন ফোর্ট উইলয়ামের পন্ডিতরা। সে এমনই গদ্য যে, লেখকদেরও রপ্ত করতে লেগে যায় দুইতিন দশক। আর সে ভাষা কোনদিনই মানুষের প্রাণের ভাষা হয়ে উঠতে পারে না।

১৮০১ সালে কলেজ চালু হওয়ার পর বাংলা গদ্যের প্রথম বই রামরাম বসুর প্রতাপাদিত্যচরিত্র, ছাপা হয় ১৮০১ সালে। এটি কোনো বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ। প্রায় সাথে সাথেই বের হয় উইলিয়াম কেরির কথোপকথন। এরপর একে একে বের হয় রামরাম বসুর অপর রচনা লিপিমালা (১৮০২), গোলকনাথ শর্মার হিতোপদেশ (১৮০১), মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বত্রিশসিংহাসন (১৮০২), হিতোপদেশ(১৮০৮) ও রাজাবলী(১৮০৮), রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়ের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্যচরিত্রং (১৮০৫), চন্ডীচরণ মুনসির তোতা ইতিহাস (১৮০৫), হরপ্রসাদ রায়ের পুরুষপরীক্ষা(১৮১৫) ইত্যদি।

কি গদ্য ‘সৃজন’ করলেন ফোর্ট উইলিয়ামের পন্ডিতরা? তার কিছু নমুনা দেয়া দরকার। প্রথমে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বত্রিশ সিংহাসন থেকে:

অনন্তর দেবদত্তের পিতা দেবদত্তকে তাবত শাস্ত্র অধ্যয়ন করাইলেন দেবদত্তকে বিবাহ দিয়া সংসারের ভারে নিযুক্ত করিয়া আপনি তীর্থ ভ্রমণ করিতে গেলেন দেবদত্ত গৃহকর্ম্ম করত: গৃহে থাকেন। এক দিবস দেবদত্ত হোমের নিমিত্ত কাষ্ঠ আনিতে বনে গেলেন রাজা বিক্রমাধিত্য অশ্বের উপর আরোহণ করিয়া মৃগয়া করিতে সেই বনে গিয়াছিলেন বনের মধ্যে মৃগ অন্বেষণ করিতে ২ সৈন্য সামন্ত সকল নানা স্থানে গেল। রাজা বিক্রমাধিত্য তৃষ্ণার্ত হইয়া বনের মধ্যে ভ্রমণ করিতে ২ ঐ দেবদত্ত নামক ব্রাহ্মণের সহিত সাক্ষাত হইল। রাজা ব্রাহ্মণকে দেখিয়া বিনয়পূর্বক কহিলেন হে ব্রাহ্মণ আমি তৃষ্ণার্ত হইয়াছি আমাকে জলপান করাও। ব্রাহ্মণ এই কথা শুনিয়া সুস্বাদু সুপক্ক উত্তম ফল সুশীতল জল লইয়া রাজার নিকট দিলেন রাজা সে ফল খাইয়া এবং জল পান করিয়া পরমাপ্যায়িত হইলেন… । ৪০

রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়ের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্যচরিত থেকে:

“মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় শিবনিবাসের বাটীতে মহাহর্ষে বিশ্রাম করিতেছেন সর্বদা আনন্দিত পুরবাসীরা সর্বদা উত্তম কর্ম্মে নিযুক্ত নানা দেশীয় গুনবান ব্যক্তি আসিয়া রাজসভায় বসিয়া গুণের পরীক্ষা দিতেছেন পন্ডিতেরা ছাত্র সমভিব্যাহৃত রাজার নিকটস্থ হইয়া শাস্ত্রের বিচার করিতেছেন এই প্রকার প্রত্যহ হইতেছে দ্বিতীয় রাজা বিক্রমাধিত্যের ন্যায় সভা সকলেই মহারাজকে প্রশংসা করে দিন ২ রাজ্যের বাহুল্য প্রজার বাহুল্য হইতেছে”। ৪১ 

এ গদ্যরীতি বাঙালির ঐতিহ্যে নতুন, মাত্রাতিরিক্ত সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারে আড়ষ্ট, সংস্কৃত নিয়মের অনুসারী অন্বয় এখানে বিদেশীভাবের, সরল ও সুবোধ্য নয়। মৃত্যুঞ্জয়রা যে-বাংলা গদ্য লেখেন তার সাথে বাংলা গদ্যের তিনশ বছর বয়সী ধারা ও ধরণধারনের কোনো সংযোগ ছিলো না। তারা সেই গদ্য পাঠ করেছেন এমত সম্ভাবনাও খুবই কম। মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্যে সংস্কৃত শব্দের ঠাসবুনন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের অপচ্ছায়া খুব বেশি বলে তিনি সমালোচনার সম্মুখিন হয়েছেন বেশি। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সকল লেখকের লেখাতেই সংস্কৃত শব্দ ও নিয়ম আমদানীর সমকালীন হিড়িকের ছাপ আছে। তার কারণগুলো আমরা আগেই ব্যাখ্যা করেছি। মৃত্যুঞ্জয়রা বই লিখেছিলেন একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে–সিভিলিয়ান কর্মকর্তাদের বাংলা শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এ কারণে এক শ্রেণীর লোক বাধ্য হয়ে সেই বইপত্র পড়েন এবং সেরকম গদ্য লেখার রীতিই আয়ত্ত করেন। তবে মৃত্যুঞ্জয়ী রীতি পুষ্ঠ হয়ে বাঙালির আয়ত্তে আসতে লেগে যায় আরো কয়েক দশক। তার আগে পুরানা বাংলা গদ্যের রীতি কিছুদিন প্রভাব বজায় রেখেছিলো কিছুকিছু বইপত্র, চিঠি ও সাংবাদিকতার ভাষায়। আমরা ১৮২৯ সালের একটি খবর থেকে উদ্ধৃতি দেব:

“২৬ ডিসেম্বর ১৮২৯ টোনহালে সভা। শ্রী শ্রী যুক্ত কোম্পানি বাহাদুরের ইজারার কাল উত্তীর্ণ হইলে হিন্দুস্থান ও চীনদেশের মধ্যে বানিজ্যকার্য সবর্ক্ষসাধারণ হয় আর ইউরোপীয় লোকেরা এদেশে আসিয়া তালুকদারী ও কৃষি ব্যবসায় করিতে পারেন এতদভিপ্রায়ে কলিকাতাবাসি কতগুলীন সওদাগর ইঙ্গরেজ ও বাঙালি বাবুরা ইংল-ের মহাসভায় দরখাস্ত পাঠাইবার পরামর্শ স্থির নিমিত্ত গত ১৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার টোনহালে এক সভা করিয়াছিলেন. . . এতদ্দেশীয়দিগের মধ্যে ঐ সভায় আর কেহ না গিয়া থাকিবেন কিন্তু কেবল শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর দ্বিতীয় শ্রীযুক্ত বাবু প্রসন্ননাথ ইংরেজী কাগজে লিখিয়াছে অনুমান হয় বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর হইবেন . . . (তা যদি ঘটে তবে ইংজেরা) . . . ইহার পর জমিদার বা তালুকদার হইয়া সম্পূর্ণ স্বামীত্বরূপে এদেশের দীনদুনিয়ার মালিক হইবেন সে যাহা হউক বাঙ্গালী মহাশয়েরা যাহারা এ প্রার্থনাপত্র স্বাক্ষর করিয়াছেন বা করিবেন তাহারদিগের ইহাতে কি উপকার তাহা জানিতে বাঞ্চা করি . . .।”৪২ 


আরো পড়ুন: ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৪)


এখানে মূল সংবাদ সামান্য–ইউরোপীয় দেশের মানুষদেরকে যাতে ভারতে এসে জমিদারী তালুকদারী কিনার এবং কৃষি ব্যবসায় করার অনুমতি দেয়া হয় সে জন্য ইংল্যান্ডের মহাসভায় কলিকাতাবাসীদের এক আর্জি পাঠানোর পরিকল্পনা। এই বিশ্বাসঘাতকতুল্য কাজে অল্প কজন বাঙালিই যোগ দেন যাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। সংবাদ লেখক বা প্রকাশক জানতে চান এ সর্বনাশা উদ্যোগে বাঙালি বাবুদের কি লাভ। কোনো বিশেষ সুবিধা হাতিয়ে নিয়ে নাকি উপনিবেশক মালিকের জাতের প্রতি খুব বেশি আনুগত্যের তাড়নায় দ্বারকানাথ উপনিবেশ পোক্ত করার কাজে ইংরেজদেরকে সাহায্য করেছিলেন আজ তা জানার উপায় নেই, কিন্তু ঐটুকু খবরের লেখনরীতি থেকে আমরা নিশ্চিত জানতে পারি যে বাঙালি খুব তাড়াতাড়ি কিংবা সহজে মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলা মেনে নেয়নি। নেয়নি বলেই উপরের উদ্ধৃতিটি পুরানা বাংলা গদ্যের রীতিতেই লেখা হয়, যদিও বাংলায় আত্তীকৃত আরবীফারসিজাত শব্দ পরিহার এবং বেশি বেশি সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে।

তবে এ অবস্থা বেশিদিন টিকেনি। কারণ বঙ্কিমের ভাষায় ‘সংস্কৃতানুযায়ী বাংলা’ভাষা সৃষ্টির ব্যাপারে অবিরাম চাপ ছিলো। সংবাদপত্রের সূত্রেই আমরা তা জানতে পারি:

“বঙ্গদূত। ৬ মার্চ ১৮৩০

সংস্কৃতাধিক্যে বঙ্গভাষার কাঠিন্য বৃদ্ধি সম্ভাবনায় সংশোধন সিদ্ধি হইতে পারে না। . . . সংস্কৃতানুযায়িকা ভাষা যাহা সাধু পরম্পরায় ব্যবহার হওয়াতে সাধুভাষা-রূপে খ্যাতা তাহাই শুশ্রাব্যা বিশেষত: এ বঙ্গদেশে যাহার প্রাচীন নাম গৌড়দেশ ইহা অতিব্যাপক এতন্মধ্যে যোজনান্তর ভাষা প্রসিদ্ধা আছে . . .।

. . . ইদানীং নানাদেশীয় কথা বাঙ্গলা ভাষাতে মিলিত হইয়াছে। বিশেষত ব্যবহার কান্ডের তাবত শব্দ লুপ্ত হইয়া বহুকাল জবন ও ম্লেচ্ছাধিকারপ্রযুক্ত তজ্জাতীয় ভাষা প্রচলিতা হইয়াছে। এই বঙ্গদেশের মধ্যে মধ্যে স্থানে ২ ভাষার প্রভেদ ও শ্রুতিকুটুতা আছে কিন্তু গঙ্গার উভয় তীরস্থ লোকের বাক্য উত্তম ও সুশ্রাব্য।

. . . ইহার মধ্যেও বিশেষ সুশ্রাব্য এবং সভ্য শৌভ্য ভব্যসকলের বক্তব্য যাহা তাহাকেই সুন্দর বচন নিরাকরণপূর্বক তাহারি রচনার নিয়ম সংস্কৃত ব্যাকরণানুকরণপূর্বক সৃষ্টিকরণ কর্তব্য।”৪৩ 

এতক্ষণে আমরা এই উদ্ধৃতির মধ্যে পাচ্ছি বাংলা ভাষা নিয়ে ঐ কালে চলমান উত্তাপের সবকটি বৈশিষ্ট। বাংলা ভাষার মৃত্যুঞ্জয়ী রীতির অনুকরণের প্রবল ইচ্ছা, মুসলমানের প্রতি প্রচন্ড ধর্মীয় বিদ্বেষ, ব্রাহ্মণসুলভ দম্ভ, নিজ অঞ্চলের ভাষাকে সারাদেশের জন্য সবচেয়ে সুশ্রাব্য বলার যুক্তিহীন প্রবণতা, ধর্মীয় আবেগে সংস্কৃতকে মাতৃভাষা বাংলার উপর প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা–সব। আরেকটা সংবাদ এখানে ঘাপটি মেরে রয়ে গেছে। সেটি হলো ‘জবন ও ম্লেচ্ছাধিকারপ্রযুক্ত তজ্জাতীয় ভাষা প্রচলিতা হইয়াছে’। ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক এই বাক্যের মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি, বহুকাল হিন্দুমুসলিম মিশ্রিত সমাজে থেকে বাংলা ভাষা ও আরবীফারসির দেয়ানেয়ায় নতুন ভাষারীতি দেখা দিয়েছিলো মানুষের মুখে মুখে ও পুরানা গদ্যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যাকে বলেছেন ‘বিষয়ীলোকের ভাষা’ অর্থাৎ জনসাধারণের ভাষা। এই ভাষা তাদের পচ্ছন্দ নয়, কারণ তা ‘জবন’ ও ‘ ম্লেচ্ছ’দের সংস্পর্শ দোষেদুষ্ট। ফলে এদের পীড়াপীড়ি এবং সর্বাত্মক প্রয়াসে হাজার বছরের পুরানা বাংলা ভাষার রূপ এবং ৩০০ বছরেরও বেশি পুরানা বাংলা গদ্যরীতি টিকে নাই। ধীরে ধীরে সংস্কৃতের দুরন্ত ছায়া তাকে গিলতে শুরু করে যা পুরাপুরি সম্পন্ন হয় ১৮৫০-৬০ সালের দিকে। মৃত্যুঞ্জয়ী গদ্য এ পর্যায়ে এসে একদিকে সংস্কৃত শব্দ ও ব্যাকরণের ছাঁচে ঢালাই হয়ে একটা স্থির রূপ পায়, অন্যদিকে অবিরাম তর্কবিতর্ক উকালতিতে লেখার ক্ষেত্রে এ ভাষাই মেনে নেয় বাঙালি, এমনকি তাতে অনেকে দক্ষও হয়ে উঠেন। মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলা বা ফোর্ট উইলিয়ামী বাংলা যাই বলি তার সবচেয়ে পুষ্ট রূপের প্রকাশ উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী দশক দুয়েকের রচনায়। কিছু নমুনা এখানে তুলে দেয়া যাক: 

বৎসে প্রভাবতি! তুমি, দয়া, মমতা ও বিবেচনায় বিসর্জন দিয়া, এ জন্মের মত, সহসা, সকলের দৃষ্টিপথের বহির্ভুত হইয়াছ। কিন্তু আমি, অনন্যচিত্ত হইয়া, অবিচলিত স্নেহভরে তোমার চিন্তায় নিরন্তর এরূপ নিবিষ্ট থাকি যে, তুমি, এক মুহূর্তের নিমিত্ত, আমার দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইতে পার নাই। প্রতিক্ষণেই আমার স্পষ্ট প্রতীতি হইতেছে–. . . ।৪৪ 

ভাগীরথীতীরে আম্রকাননে বসিয়া একটি বালক ভাগীরথীর সান্ধ্য জলকল্লোল শ্রবণ করিতেছিলো। তাহার পদতলে নবদুর্বাশয্যায় শয়ন করিয়া, একটি ক্ষুদ্র বালিকা, নীরবে তাহার মুখপানে চাহিয়াছিলো–চাহিয়া, চাহিয়া, চাহিয়া, আকাশ নদী বৃক্ষ দেখিয়া, আবার সেই মুখপানে চাহিয়া রহিল। বালকের নাম প্রতাপ বালিকার শৈবলিনী। শৈবলিনী তখন সাত আট বৎসরের বালিকা–প্রতাপ কিশোরবয়স্ক। মাথার উপরে, শব্দতরঙ্গে আকাশমন্ডল ভাসাইয়া, পাপিয়া ডাকিয়া গেল। শৈবলিনী তাহার অনুকরণ করিয়া, গঙ্গাকূলবিরাজী আম্রকানন কম্পিত করিতে লাগিল। গঙ্গার তর তর রব সে ব্যঙ্গ সঙ্গীত সঙ্গে মিলাইয়া গেল। বালিকা ক্ষুদ্র করপল্লবে, তদ্বৎ সুকুমার বন্য কুসুম চয়ন করিয়া মালা গাঁথিয়া, বালকের গলায় পরাইল; আবার খুলিয়া আপন কবরীতে পরাইল, আবার খুলিয়া বালকের গলায় পরাইল।৪৫ 

এখন আর সূর্য্য নাই। পশ্চিম গগনে মাত্র লোহিত আভা আছে। সন্ধ্যাদেবী ঘোমটা খুলিয়াছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ নহে। কেহ কেহ সন্ধ্যা সীমন্তিনীর সীমন্ত উপরিস্থ অম্বরে ঝুলিয়া জগত মোহিত করিতেছেন; কেহ বা সুদুরে থাকিয়া মিটিমিটি ভাবে চাহিতেছেন, ঘৃণার সহিত চক্ষু বন্ধ করিতেছেন; আবার দেখিতেছেন। মানবদেহের সহিত তার দলের সমন্ধ নাই বলিয়াই দেখিতে পারিতেছে না। কিন্তু বহুদূরে থাকিয়াও চক্ষু বন্ধ করিতে হইতেছে– কে দেখিতে পারে? অন্যায় নরহত্যা, অবৈধ বধ, কোন চক্ষু দেখিতে পারে?৪৬

উদ্ধৃতিগুলোর গদ্যে আরবী ফারসি ও বাংলা শব্দের বদলে ইচ্ছামতো সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার ভাষাকে করে তুলেছে আড়ষ্ট, কৃত্রিম, অর্থ প্রকাশে অক্ষম, বুঝার ক্ষেত্রে কষ্টসাধ্য। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, গদ্য সৃষ্টির প্রয়োজনে এই সংস্কৃতায়িত বাংলার জন্ম। অন্যদিকে, মধ্যযুগেই বাংলা কাব্যচর্চার রীতি, ঐতিহ্য, সমৃদ্ধি অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো। এ সত্ত্বেও আমরা দেখছি মৃত্যুঞ্জয়ের সংস্কৃতানুযায়ী বাংলার প্রভাব অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় বাংলা কাব্যচর্চায়ও। এ ধারাবাহিকতায় মধুসূদনের হাতে আমরা এমন এক বাংলা কাব্যভাষা পেলাম যাকে বাংলা বলে মানতে গেলে অনেক ছাড় দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। এই বক্তব্যের সপক্ষে মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দেয়া যেতে পারে:

“এতক্ষণে”, অরিন্দম কহিলা বিষাদে

“জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল

রক্ষঃপুরে ! হায়, তাত, উচিত কি তব

একাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,

সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ ? শূলী-শম্ভূনিভ

কুম্ভকর্ণ ? ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী ?

নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে ?

চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে ?

কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি

পিতৃতুল্য । ছাড দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,

পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,

লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।

সাধারণ একজন পাঠকের পক্ষে এই লেখার অর্থ বুঝা দুরূহ; অগ্রসর পাঠককে অভিধানের সাহায্য নিতে হবে। শুধু মধুসূদনই নয়, তার কালের ও পরের আরো বহু কবি এরকম দুর্বোধ্য মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলায় কাব্যচর্চা করে গেছেন। ১৮৬০-৭০ সাল নাগাদ আমাদের গদ্য ও পদ্য দুইক্ষেত্রেই আড়ষ্ট, দুরূহ, কৃত্রিম ‘সংস্কৃতানুযায়ী’ লেখনরীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। যার সূচনা হয়েছিলো হ্যালহেড-জোনসের ভুল অনুমান থেকে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভুল লোক নির্বাচন, ধর্মীয় আবেগ আর উপনিবেশী উম পেয়ে তা পরিণত হয় এক বিরাট গাছে– এমন এক আশ্চর্য গাছ যার ফল কলিকাতা-নদীয়ার উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের মুখে হয়তো ঢেলে দিয়েছিলো বানোয়াট মিষ্ট স্বাদ, আর, সমস্ত সাধারণ বাঙালির মুখে তিতা।

সংস্কৃতানুযায়ী বাংলা অনেকদিন শাসন করেছে আমাদের লেখন রীতিকে। মাঝখানে প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালি প্রসন্ন সিংহ নদীয়ার কথ্য রীতি লেখায় প্রচলনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের আগে এই লেখ্যভাষাকে অঙ্গীকার করে নিয়ে আরো হৃষ্টপুষ্ঠ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল লেখক।

রবীন্দ্রনাথই প্রথমবারের এই বানোয়াট ভাষারীতির বাইরে গিয়ে মুখের ভাষার কিছুটা বৈশিষ্ট নিয়ে স্বতন্ত্র এক ভাষাভঙ্গি নির্মাণের চেষ্টা করেন। সহজ, প্রতিদিনের কথাবার্তায় বলা হয় এমন শব্দ লেখায় নিয়ে আসেন তিনি। তার বাকভঙ্গিতেও কথ্যরীতির ঢঙ আছে। তিনি নিজে এবং তার অনুসারী অনেকে সে ভাষার চর্চা করে গেছেন। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের সহজ ভাষার চর্চা থেকেই বাংলা গদ্য ও পদ্যের ভাষা মৃত্যুঞ্জয়ী সংস্কৃতায়িত বাংলার কবল থেকে মুক্তি পেতে শুরু করে।

রবীন্দ্রনাথের প্রথমজীবনের রচনা অনেকটাই বঙ্কিমী রীতিকে মান্য করে লেখা। রাজর্ষি কিংবা বৌঠাকুরাণীর হাট পড়লে বঙ্কিমের উপন্যাসই পড়ছি বলে মনে হতে পারে। ধীরে ধীরে এই ভাষা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঘরে বাইরে চলিতরীতিতে লেখা, প্রথম প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রে। তার আগে থেকেই তিনি ভাষাকে সহজ ও সাবলীল করার চেষ্টা করে আসছিলেন। এমনকি  সোনারতরী, চৈতালী, চিত্রা পর্যায়েও এ প্রবণতা চিহ্নিত করা যায়। যেমন চিত্রা’র ‘অন্তর্যামী’ কবিতার উদ্ধৃত অংশের ভাষা লক্ষ্যণীয়:

এ কী কৌতুক নিত্য নতুন

ওগো কৌতুকময়ী,

আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে

বলিতে দিতেছ কই।

অন্তর মাঝে বসি অহরহ

মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ

মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ,

মিশায়ে আপন সুর।

 কিন্তু যে লিখিত ভাষার যে ঐতিহ্যে তার পড়ালেখা আর বেড়ে উঠা তার দুর্মর বর্ম ভেঙ্গে বেশিদূর যাওয়ার উপায়ও ছিলো না। তা ছাড়া এরই মধ্যে বহু বাংলা শব্দ অপরিচিত হয়ে উঠেছিলো। অনেক সংস্কৃত শব্দে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন বিদগ্ধ পাঠকরাও। এসব কারণে বিরাট কোনো পরিবর্তন আনতে পারেন নাই রবীন্দ্রনাথও। মাঝেমধ্যে তার কবিতায় মৌখিকরীতির সহজ বাকভঙ্গি ঝিলিক দিলেও আবার ফিরে গেছেন প্রথাসিদ্ধ কাব্যভাষায়, যেমন পূরবী কাব্যের ‘শেষ অর্ঘ’ সনেটে:

. . . . . . . . দিল আনি

ইন্দ্রাণীর হাসিখানি দিনের খেলার

প্রাণের প্রাঙ্গণে; যে সুন্দরী, যে ক্ষণিকা

নি:শব্দ চরণে আসি, কম্পিত পরশে

চম্পক অঙ্গুলি পাতে তন্দ্রাযবনিকা

সহাস্যে সরায়ে দিল, স্বপ্নের আলসে

ছোঁয়াল পরশমণি জ্যোতির কণিকা;

অন্তরের কণ্ঠহারে নিবিড় হরষে

প্রথম দুলায়ে দিল রূপের মণিকা–

রবীন্দ্রনাথে আমরা এটুকু পাই, মাঝেমধ্যেই তিনি ভাষাকে সহজ, সরল ও সাবলীল করে তুলেছেন মুখের ভাষার থেকে নিয়ে। উপরের দুটো উদ্ধৃতির প্রথমটিতে সেই ছাপ পরিষ্কার। রবীন্দ্রকাব্যে ভাষার এই মুক্তির সম্ভাবনা নিরবচ্ছিন্ন নয়, বরং ধারাহীন, কিছুটা খেয়ালী; তবুও তা অন্তত মুক্তির পথনির্দেশক তো বটে।

বাংলা ভাষার এই এ ধরনের মুক্তি আপেক্ষিক এবং আংশিক। তাছাড়া সংস্কৃতের ভার থেকে মুক্তি পায়নি সামগ্রিক গদ্যভাষা। যেসব বাংলা শব্দ ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছিলো সেগুলোকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও নেয়া হয়নি। তবে বাঙালির মুখের ভাষায় আদত বাংলার বহু শব্দ, বাকভঙ্গি, বাক্যের অন্বয় থেকে যায়। বাংলাদেশের মান কথ্য বাংলায় এখনো তার ব্যবহার অটুট রয়ে গেছে।

বিশ শতকের শুরুতে প্রমথ চৌধুরী বাংলার লেখনরীতিতে আরেকটা বড় পরিবর্তনের সূচনা করলেন। সেই ১৮৩০ সালে বঙ্গদূতের নিবন্ধে ‘গঙ্গার উভয় তীরস্থ লোকের বাক্য উত্তম ও সুশ্রাব্য’ বলে নদীয়া-কলিকাতার মুখের ভাষার সপক্ষে যে উকালতি করা হয়েছিলো সেই ভাষার পক্ষেই নামলেন প্রমথ চৌধুরী। এ ভাষার আশ্রয়ে গড়ে তুললেন বীরবলী রীতি যা পরে চলিত রীতি নামে প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম ‘বীরবল’ থেকেই এ রীতি বীরবলী রীতি হিসাবে পরিচিত হয়েছিলো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বাংলা সাহিত্যের বিরাট মহীরূহ। প্রমথ চৌধুরীকে সমর্থন করলেন তিনি। ফলে মুখের ভাষার আদলে লেখার দাবীকে আর ঠেকানো সম্ভব হলো না। প্রমথ চৌধুরী আর রবীন্দ্রনাথের মিলিত চেষ্টায় বিশ শতকের প্রথম দিকেই নদীয়া-কলিকাতা অঞ্চলের মুখের ভাষার অনুসরণে গড়ে উঠা চলিত রীতি আমাদের লেখার রীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

কলিকাতার মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা গদ্যের এই রূপবদল যথার্থ ছিলো। উপনিবেশী মালিকের নির্দেশে এবং ভুল তথ্য আর ধর্মীয় আবেগে চালিত হয়ে যে-গণবিচ্ছিন্ন ভাষা তৈরি করেছিলেন মৃত্যুঞ্জয় গংরা তার সাথে বাঙালির প্রাণের সংযোগ ছিলো না। সাধারণ মানুষের বুঝক্ষমতার বাইরে ছিলো সেই ভাষার সাহিত্য। শিক্ষিত পন্ডিতরা হয়তো ধর্মীয় আবেগের বশীভুত হয়ে সংস্কৃতানুযায়ী ভাষা মেনে নেন। কিন্তু সে ভাষায় ভাব বিনিময়ের কাজ তো সার্বজনীন হলো না। এ জন্যই কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন কোন কোন মানুষ যেমন প্যারীচাঁদ ও কাল্রীসন্ন সিংহ মুখের ভাষার আদলে একটা লিখিত রূপ পত্তনের চেষ্টা করেছিলেন। তাদের সময়ে তা ব্যর্থ হলেও কুড়ি শতকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ পেয়ে সফল হলেন প্রমথ চৌধুরী। এর মধ্য দিয়ে কলিকাতা-নদীয়া এলাকার বাঙালি সমাজের পক্ষে এক বড় দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

কিন্তু বিপত্তি থেকে গেল আরেক জায়গায়। সাধু চলিত রীতির পরিবর্তনটা হয় মূলত ক্রিয়াপদের রূপে। অন্যান্য শব্দ আগের মত সংস্কৃত বা সংস্কৃত-ঘেঁষাই  থেকে যায়। মধ্যযুগেই যে-সব শব্দ সহজ রূপ নিয়েছিলো যেমন চান্দ, সুরুজ, ধরম, মূরতি, চক্কর ইত্যাদি, ফোর্ট উইলিয়ামের পন্ডিতরা সেগুলো সরিয়ে সংস্কৃত শব্দ বসিয়ে দিয়েছিলেন। তারা মনে করতেন আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার জাতিনাশ করেছে। বাংলায় আত্তীকৃত আরবি-ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে তার বদলে নিয়ে আসা হলো সমার্থক সংস্কৃত শব্দ। চলিত রীতিতে এইসব সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার সামান্য কমে মাত্র। কেবল তাই না পরবর্তী সময়ের লেখকরা বিশেষত প্রবন্ধ লেখোয়ারা (নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী) গাম্ভীর্য আনার জন্য আরো বেশি সংস্কৃত ও তৎসম শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন। তিরিশের পাঁচ কবির কবিতায় ও গদ্যে সংস্কৃত শব্দের অতিরিক্ত ব্যবহার তার প্রমাণ। এ প্রবণতা এখনো জারী আছে। বাংলাদেশে এখনো এমন সব ‘পন্ডিতমনষ্ক’ লেখোয়া আছেন যারা মনে করেন প্রবন্ধের ভাষায় বেশি বেশি সংস্কৃত-তৎসম শব্দ ব্যবহারে গাম্ভীর্য ও পন্ডিতি বাড়ে। এইসব কারণে প্রমথ চৌধুরীর প্রবর্তিত চলিত রীতিতেও থেকে যায় বঙ্কিমীয় ভাষার সংস্কৃত শব্দবহুলতা, তেমনি কলিকাতা নগরকেন্দ্রিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং কলিকাতা-নদীয়ার আশপাশের সমাজ জীবনের বিশিষ্টতার ছাপ।

মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষারীতির উপর বাঙালির মুখের ভাষার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এখানে উল্লেখ করা দরকার। যে মৌখিক ভাষা রীতি অবলম্বনে আলালী বা হুতুমী রীতি গড়ে উঠে তা ছিলো মূলত কলিকাতা-নদীয়া ও আশপাশের অঞ্চলের কথ্য ভাষা। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভাষা থেকে তার যথেষ্ট পার্থক্য দেখা দিয়েছিলো আগেই। উইলিয়াম কেরির কথোপকথন-এ তার কিছুটা আভাস মিলে।

এ উপ-ভাষার ক্রিয়াপদের পরিবর্তনগুলো সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। ক্রিয়াপদ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও দুই উপভাষার পার্থক্য সূচিত হয় বহু আগেই, অন্তত আধুনিক যুগের আগে। মোট কথা বাংলাদেশের ভাষার সাথে নদীয়া-কলিকাতার ভাষার পার্থক্য বেশ উল্লেখযোগ্য। আলালীরীতি ও হুতুমী রীতি গড়ে উঠেছিলো এই ভাষার আশ্রয়ে। বঙ্কিমের ‘সংস্কৃতানুযায়ী বাংলা’র চেয়ে এ ভাষা সংশ্লিষ্ট কথকদের কাছে ছিলো অনেক সহজবোধ্য, সহজে আয়ত্তযোগ্য, মনের ভাব প্রকাশে বেশি সক্ষম। তবু তা বাংলাদেশের ভাষা নয়। তাই এর সাথে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের সংযোগ পুরোপুরি ঘটেনি। বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও অভিজ্ঞতার বাহন যে-ভাষা তার উপাদান লিখিত ভাষার বাইরেই রয়ে যায়।

লেখার ভাষা মুত্যৃঞ্জয়ী রীতি থেকে নদীয়া-কলিকাতার চলিত রীতিতে রূপান্তরিত হওয়ার সময়টাও অবশ্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে বাংলাদেশকে আলাদা প্রদেশ করা হয়, অবশ্য কলিকাতাসহ পশ্চিবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন রবীন্দ্রনাথ থেকে নিয়ে অনেক হোমড়চোমরার জমিদারী বাংলাদেশে। তারা সবাই কলিকাতার হর্তাকর্তাদের শামিল। কাজেই বাংলাদেশ আলাদা হলে সর্বনাশ। সফল স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯১১ সালে এই প্রশাসনিক পদক্ষেপ উল্টে দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় হিন্দু ও মুসলিম উভয় তরফের নেতাদের একটা বড় অংশ আন্তরিক চেষ্টায় আপাত ধর্ম-নিরপেক্ষ ঐক্যের একটা জায়গাও তৈরি করে নিতে সক্ষম হন। ততোদিনে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলন পৌঁছেছে তার পরম পর্যায়ে। এইসব উত্তেজনা-জাগরণের  উপর নির্ভর করে দেশপ্রেম আর মুক্তির সংক্ষুদ্ধ আবেগ ছড়িয়ে পড়ে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকসহ তরুণ প্রজন্মের বহুজনের মধ্যে আর তাদের কাজে। পরে এ যুগের সাহিত্যকে অগ্নিযুগের সাহিত্য হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরেবাইরে’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী, নজরুলের ‘কুহেলিকা’ ইত্যাদি ঐ কালের ও উত্তাপের পটভূমিতে লেখা। এ অবস্থায় রবীন্দ্র-প্রমথের চলিত রীতির সাথে সাথে বাংলাদেশের মান কথ্যরীতির ভিত্তিতে আরেক লেখনরীতি প্রচলনের চেষ্টার অনুকূল ছিলো না গোটা পরিবেশটা। তখন পর্যন্ত কলিকাতাই সব। ঢাকায় মুদ্রণযন্ত্র, পত্রিকা, ইস্কুল কলেজ, লাইব্রেরী ইত্যাদি আছে বটে কিন্তু সবই কলিকাতার রীতিনীতির দিকে তাকিয়ে চলে। তাই ঐ যুগে বাংলাদেশে আলাদা লেখনরীতি প্রবর্তনের দাবী যে এখানকার লেখকরা করেন নাই সেজন্য তাদেরকে দোষা দেয়া যায় না।  

তবে আমাদের লেখকদের চিন্তায় ও লেখালেখিতে এ বিষয়টা ছাপ ফেলা উচিত ছিলো। তাও হয়নি। যাইহোক, কলিকাতায় চলিত রীতি প্রচলিত হওয়ার পর বাংলাদেশের লেখকরা তা মেনে নিলেন এবং রপ্তও করে ফেললেন। অবশ্য এখানে আরো কিছু চাপও কাজ করেছিলো। যেমন প্রেস. পাঠপুস্তক বোর্ড, শিক্ষাপদ্ধতি এগুলো ছিলো কলিকাতার মানুষের দখলে, সেইসঙ্গে নতুন পুঁজিও। তাই বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে নিজের মুখের ভাষা নিয়ে কাজ করার সুযোগ তখন ছিলো না। ইংরেজীর মত একটা বিদেশী ভাষার প্রভাব যা স্পষ্ট ধরা পড়ে আমাদের লেখালেখি, কথাবার্তায় চিন্তা চেতনায় তা-ই ঠেকাতে পারে নাই বাঙালি মন, এমন কি বৃটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৭৫ বছর পরও তারা তা বয়ে চলেছে নির্বিরোধ মনে। সেখানে বাংলা ভাষারই একটি উদ্দেশ্য-প্রণোদিত কৃত্রিম রূপের সর্বাত্মক প্রভাব বুঝতে পারা এবং প্রতিরোধ করার চিন্তা মাথায় আসা একটু দূরূহ বৈকি। এই যে বাংলা ভাষার রূপান্তরের দীর্ঘ পথচলায় উপনিবেশী রাজনীতি, ধর্মীয় আবেগ, ভুল অনুমান ইত্যাদির সমন্বয়ে প্রায় একশ বছর ধরে বহাল থাকলো মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের সংস্কৃতানুযায়ী গদ্যরীতি আর তার পর থেকে এখনো জারী থেকে গেলো নদীয়া কলিকাতার মুখের ভাষার আদলে গড়ে উঠা সংস্কৃতবহুল চলিতরীতি এ অবস্থাটাকে বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের উপনিবেশ বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। এর কি প্রভাব পড়লো আমাদের শিল্পসাহিত্যসহ সামগ্রিক চিন্তাচর্চায় তার একটা বিশ্লেষণ আমরা হাজির করেছি পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে।

তথ্যসূত্র:

১.  Nathaniel Brassey Halhed, A Grammer of the Bengal Language, Hoogly, Bengal, 1778, Preface iii| হ্যালহেড লেখেন: The grand Source of Indiản literature, the Parent of almost every dialect from the Persian Gulph to the China Seas , is the Shanscrit ;

২.  Lord Teignmouth (edt.) The Works of Sir William Jones. With a Life of the Author London, printed for John Stockdale and John Walker, 1807, vol. III, pp. 24-46 †_‡K †bqv Z…Zxq e³…Zv. Original citaion: The Sanscrit language, whatever be its antiquity, is of a wonderful structure; more perfect than the Greek, more copious than the Latin, and more exquisitely refined than either, yet bearing to both of them a stronger affinity, both in the roots of verbs and the forms of grammar, than could possibly have been produced by accident; so strong indeed, that no philologer could examine them all three, without believing them to have sprung from some common source, which, perhaps, no longer exists;

৩.  Nathanial Brassey Halhed, A Grammer of the Bengal Language, Hoogly, India, 1778,  preface xxi-xxii. Original citation: The Following work present the Bengal language meerly as derived from its parent the Shanscrit. In the course of my design I have avoided, with some care, admission of such words as are not natives of the country, and for that reason have selected all my instances from the most authentic and ancient composition. . . . But I would advise every person who is desirous to distinguish himself as an accurate translator to pay some attention both to the Persian and Hindostanic dialects.

৪.  Nathanial Brassey Halhed, A Grammer of the Bengal Language, Hoogly, India, 1778,  preface ii

৫. শ্রীপ্রমথনাথ বিশী ও শ্রীবিজিতকুমার দত্ত, বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা ১৩৬৭, পৃষ্ঠা- ভুমিকা: ১৫।

৬.  Nathanial Brassey Halhed, A Grammer of the Bengal Language, Hoogly, India, 1778,  preface v; Original citation: The Raja of Kishenagur, who is by much the most learned and able antiquary which Bengal has produced within this century, has very lately affirmed, that he has in his own possession Shanscrit books which give an account of a communication formerly subsisting between India and Egypt ; wherein the Egyptians are constantly described as disciples, not as instructors , and as seeking that liberal education and thote sciences in Hindoftan, which none of their own countrymen bad sufficient knowledge to impart .

৭.  Metcalf, G. J., “The Indo-European Hypothesis in the Sixteenth and Seventeenth Centuries”, Studies in the history of linguistics: traditions and paradigms, D. Hymes (ed.), Bloomington: Indiana U.P., 1974, p-233.-G D×…Z| Original citation: An ancient language once spoken in the distant past in the area of the caucasus mountains and spreading by waves of migration throughout Europe and Asia, had itself ceased to be spoken and had left no linguistic monuments behind, but as “mother” generated a host of “daughter languages”, many of which in turn had become “mothers” to further “daughters”. (For a language tends to develop dialects, and this dialects in the ourse of time become independent, mutually unintelligible languages.) Decendants of the ancestral languages include Persian, Greek, Italic (whence Latin and in time mordern Romance tongue) , the Slovonic languages, Celtic, and finally Gothic and the other German tongues.

৮.  Nathenial Brassy Halhed, A Grammer of the Bengal Language, Hoogly, India, 1778,  Preface iii-iv. Original citation: I have been astonished to find this similtude of Shanscrit words with those of Persian and Arabic, and even of Latin and Greek; . . . This extraordinary mode of combination . . . is a forcible argument that they are all derived from the same source.|

 ৯.  Lyle Campbell, “ Why Sir William Jones got It All wrong, or Jones’ Role in How to Establish Language Families”, Studies in Basque and historical linguistics in memory of R.L. Trask, Joseba A. Lakarra, José Ignacio Hualde (eds.), Guipuzkoa Provincial Council, San Sebastian, Spain, 2006, pp-249-উদ্ধৃত।

১০. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা- ২৪৯-এ উদ্ধৃত।
১১. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা- ২৫০-এ উদ্ধৃত।
১২.দ্র: পূর্বোক্ত।
১৩.দ্র: মনীন্দ্র সমাজদার, সংস্কৃত, প্রাকৃত, অবহট্ঠ সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
১৪.সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, আনন্দ পাবলিশার্স, কলিকাতা, ভারত, ১৯৯৪; পৃষ্ঠা-৮৬।
১৫.পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৮৭।
১৬.পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৮৯।
১৭.পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৮৭।
১৮. শ্রীপরেশচন্দ্র মজুমদার, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ, দেজ পাবলিশিং, কলিকাতা, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০০, পৃষ্ঠা-৬০।
১৯.পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা, ৩৭-৩৮।
২০.সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, আনন্দ পাবলিশার্স, কলিকাতা, ভারত, ১৯৯৪; পৃষ্ঠা-৮৭।
২১.পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৮৯।
২২.পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৮৭।
২৩. শ্রীপরেশচন্দ্র মজুমদার, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ, দেজ পাবলিশিং, কলিকাতা, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০০, পৃষ্ঠা-৬৫।

২৪.https://www.britannica.com/topic/Prakrit-languages

২৫.Andrew Ollett ‘Prakrit in the Language Order of India’ Language of the Snakes, University of California Press 2017, p-12-13.

২৬.George Abraham Grierson,  Prakrit, Encyclopaedia Britannica. – 11th ed. – Vol 22. – 1911. – pp. 251 – 254.(Source studies on Indian history up to 1858 / Alois Payer; 3rd inscriptions, 6th). – Version dated 2008-03-21. – http://www.payer.de/quellenkunde/quellen036.htm-থেকে উদ্ধৃত। There were two main groups of ancient Indo-Aryan dialects, or Primary Prakrits, viz. the language of the Midland or Āryavārta, and that of what is called the Outer Band. The language of the Midland became the language of literature, and was crystallized in the shape of literary Sanskrit about 300 B.C. Beside it all the Primary Prakrits continued to develop under the usual laws of phonetics, and, as vernaculars, reached a secondary stage marked by a tendency to simplify harsh combinations of consonants and the broader diphthongs
২৭.দ্র: ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, মাওলা ব্রাদার্স ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৯৯২।
২৮ .দ্র: ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, মাওলা ব্রাদার্স ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৯৯২।
২৯.বাঙ্গালা ভাষা, হরপ্রসাদ রচনাবলী, শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও শ্রীঅনিলকুমার কাঞ্জিলাল (সম্পা.), ইস্টার্ন ট্রেডিং কোম্পানি, কলিকাতা, ১৯৫৬, পৃ-১৯৯-২০০।
৩০.শ্রীপমথনাথ বিশী শ্রীবিজিতকুমার দত্ত (সম্পা.), বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা, ১৩৬৭; ভূমিকা, পৃ-১৫।
৩১.শ্রী প্রমথনাথ বিশী ও শ্রীবিজিতকুমার দত্ত, বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা, ১৩৬৭, ভূমিকা-১।
৩২.ভক্তিমাধাব চট্টোপাধ্যায়, বাংলা গদ্যের আদিপর্ব, নয়া প্রকাশ, কলিকাতা, ১৯৮৮।
৩৩.পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৬৩।
৩৪.পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৬।
৩৫. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৯১-৯২।

৩৬. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৯৬-৯৭।
৩৭. আনিসুজ্জামান, পুরানো বাংলা গদ্য, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৮৪; পৃষ্ঠা-৫৯।
৩৮. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৮৬।
৩৯. আনিুসুজ্জামান, পুরোনো বাংলা গদ্য, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০১; পৃষ্ঠা-৭২।

৪০. মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ‘চুতুর্থী পুত্তলিকার কথা’, বত্রিশ সিংহাসন; শ্রীপ্রমথনাথ বিশী ও শ্রীবিজিতকুমার দত্ত, বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা, ১৩৬৭, পৃষ্ঠা-৫-এ উদ্ধৃত।
৪১. রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়ের, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্যচরিত; শ্রীপ্রমথনাথ বিশী ও শ্রীবিজিতকুমার দত্ত, বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা, ১৩৬৭, পৃষ্ঠা-১১-তে উদ্ধৃত।
৪২. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, সংবাদপত্রে সেকালের কথা প্রথম খন্ড, দেবেশ রায়, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, কলিকাতা, ১৯৯০, পৃষ্ঠা-১২-তে উদ্ধৃত।

৪৩. সংবাদপত্রে সেকালের কথা প্রথম খন্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পা.); দেবেশ রায়, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, কলিকাতা, ১৯৯০, পৃষ্ঠা-৬১-তে উদ্ধৃত।
৪৪. ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’; বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, শ্রীপ্রমথনাথ বিশী শ্রীবিজিতকুমার দত্ত (সম্পা.), মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা, ১৩৬৭, পৃষ্ঠা-৪৯-এ উদ্ধৃত।
৪৫. বঙ্কিমচন্দ্র চণোপাধ্যায়, ‘চন্দ্রশেখর’, বঙ্কিম রচনাবলী উপন্যাস সমগ্র, তুলি কলম, কলিকাতা, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০১, পৃ-২৯৮।
৪৬. মীর মশাররফ হোসেন, ‘হানিফার পরিণতি’, বিষাদ সিন্ধু: শ্রীপ্রমথনাথ বিশী শ্রীবিজিতকুমার দত্ত (সম্পা.), বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা, ১৩৬৭, পৃষ্ঠা-১৫৪-তে উদ্ধৃত।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত