| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-২০) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-২০।


 

প্রাইভেট পড়ে যখন রাজ বাড়ি ফিরল রাত নটা বেজে গেছে। খুব দুরে নয় স্যারের বাড়ি।কিন্তু রাতে বড় কুকুরের ভয়। দুচারজন বন্ধু  ছিল তারা চলে যাওয়ায় রাজ তাড়াতাড়ি সাইকেল চালাল।

অবশেষে বাবাদের নাটক সত্যি সত্যিই হচ্ছে। দিনক্ষন স্থির হয়েছে।সন্ধ্যেবেলায় প্রায়দিনই ছাদে  বাবাদের রিহার্সাল হচ্ছে।রাজের যাবার পারমিশন নেই। মায়ের কড়া হুঁশিয়ারি। তবু ফাঁক পেলে রাজ দু-একবার ঘুরে আসে। রাজ সাইকেলটা কোনওভাবে রেখে এখন দৌড়ে ছাদে গেল। জোরদার রিহার্সাল চলছে।ছোটমামা পার্ট পেয়েছেন একটা। বড় হোক,ছোট হোক তাতেই ছোটমামা খুশী।  তাকে দেখে একবার  ছোটমামা চোখ নাচালেন।ছোটমামা এরমধ্যে আবার কদিন বাড়ি ঘুরে এসেছেন। দাদুর সাথে তাঁর মান-অভিমান মিটে গেছে।এমন কি ছোটমামার আর তর সয় নি। দাদুকে অভিনয় দেখিয়ে এসেছেন।দাদু নাকি তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ।রাজও দেখেছে। সত্যি বলতে ছোটমামার অভিনয় তার ভালোই লাগছে। নাটকের দিন উৎরে গেলেই হল।

ছোটমামা বললেন,” আয়।“

ছাদের এক কোনে রাজ বসল।বাবার বন্ধুদের সে অভিনয় দেখতে লাগল। দেখার ফাঁকে ছোটমামা ফিসফিস করে বলল, “ হ্যাঁরে। পড়া হয়ে গেল?”

“হ্যাঁ। তোমার পার্ট হয়ে গেছে?”

“না। করব।“

 নাটকের নাম রাণা প্রতাপ। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।শেষপর্যন্ত সবাই এই নাটক করতেই রাজী হয়েছে।বেশ বড়  নাটক। মুঘলদের সঙ্গে মেবারের রানা প্রতাপের লড়াই।  রানা প্রতাপের ভাই শক্ত সিংহ বিশ্বাসঘাতক। তিনি মুঘলের দলে যোগ দিয়েছেন। বাবা হয়েছেন রানা প্রতাপ। ছোটমামা শক্ত সিংহের পার্ট করছেন।

একটু পরে অভিনয় শুরু হল। ছোটমামার পার্ট এল। দেখে খুব খুশি হল রাজ। বাবার অভিনয় ভাল হলেও এখনো সংলাপ মুখস্ত হয় নি। কিন্তু ছোটমামা ফাটাফাটি করছেন। বাবা থেমে গেলে বাবার অভিনয়টাও মাঝেমাঝে ধরিয়ে দিচ্ছেন।

রাজ ভাবে, ইস। সেও যদি অভিনয়ের সুযোগ পেত!স্টেজে উঠে কিছু করার ক্ষমতা একবারে আলাদা। তবে সময় পাওয়াও কঠিন তার। প্রাইভেট পড়তে যাওয়া, নিজের পড়া, তার উপর খেলতে যাওয়া। সবমিলিয়ে সে জেরবার। খেলার ধকলে সে রাতের দিকে বেশী পড়তেও পারছে না। মা না বললেও একটু চিন্তা বেড়েছে।তবু কষ্ট হলেও সে এটা মেনে নেবে। তাছাড়া আর কিছুদিনের মধ্যেই তাদের  খেলা আছে। তা মিটে গেলে সে  রেহাই পাবে।

একটু পরে রিহার্সাল শেষ হল। ছোটমামার সঙ্গে সে নীচে নেমে এল। সে জিজ্ঞেস করল,”কবে হবে ছোটমামা?”

“একবারে পুজোতে।“

“ব্যাপক হচ্ছে কিন্তু!“

“তাই?”

“হ্যাঁ।দাদু সত্যিই খুশী হবে।“

ছোটমামা হাসলেন।এখন ছোটমামা ও দাদুর  মানঅভিমান কেটে গেছে। ছোটমামার খুব প্রশংসা করেন দাদু।

নীচে নেমে রান্নাঘরে উঁকি মারল রাজ।খুব খিদে পেয়েছে।মা তাকে দেখেই বুঝেছেন।তার দিকে চেয়ে বললেন,“হাত ধুয়ে আয়।“

রাজ টেবিলে বসল।মাকে বলা হয় নি অনেক কথা। নির্ঝরের কথা জানাতে হবে। সে ছোটমামার দিকে তাকিয়ে এখন বলল, “এবার জিতবই ছোটমামা।“

“তাই?”

“কবে খেলা?”

রাজ কিছু বলার আগেই বাবা টেবিলে বসে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।রাজ সতর্ক হয়ে গেল। খেলা নিয়ে বেশী মাতামাতি বাবা পছন্দ করছেন না। সে বলল,”পরশু দিন।“

“হুম। ওই ছেলেটার কি যেন নাম? খেলছে তো? ফিরেছে না?”

মায়ের দিকে একবার তাকাল রাজ।  সে মাথা নাড়িয়ে বলল,”হ্যাঁ।“

বাবা আর তার দিকে তাকালেন না। এবার হঠাৎ  মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,” নির্ঝরের বাড়ি গেলে আমাকে বল নি তো?”


আরো পড়ুন: ফুটবল (পর্ব-১৯) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়


রাজ বুঝল বাবা তেতে আছেন। খবরটা তাকে কে জানাল? ছোটমামা? হতে পারে। এখন নিরীহমুখে খাবার খাচ্ছেন। যেন কিছু জানেন না! রাজ  নিজেকেই দায়ী করল। সেদিন মাকে সে বারণ করেছিল কিন্তু সে নিজেই কথাটা চেপে রাখতে পারে নি।ছোটমামাকে বলে দিয়েছিল নির্ঝরদের বাড়ি যাবার কথা। সেটা শুনেই ছোটমামা ফাঁস করে দিয়েছেন।

মা বললেন,” এটা কি বলার খবর !ছেলেটা আসছিল না তাই গেছিলাম।“

বাবা মাথা না তুলে বললেন, “ফালতু মাথা ঘামাচ্ছ।তোমাকে অনেকবার বারন করছি।আমি খবর নিয়েছি ওর জেঠা এখন কিছু করে না। তোমার ঘাড়ে ওকে চাপিয়ে দেবে।“

“দিক। তাতে কি!”

“তুমি বুঝতে পারছ না!”

“থামো। আমিই বুঝতে পারছি না তুমি এমন হয়ে গেলে কেন? তুমি  সারাজীবন লোকের উপকার করে গেলে এখন হঠাৎ বাধা দিচ্ছ?”

 বাবার মুখটা কেন জানি বদলে গেল হঠাৎ। মনে মনে কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “তা যা বলেছ।  কম তো উপকার করি নি। কতজনকে বইখাতা কিনে দিয়েছি।একটা ফান্ড করেছিলাম মেধাবী ছেলেদের জন্য।লাভ কী হল বল?  যারা উপকার পেল তারা একদিনও আর মুখ দেখায়?”

“সে কথা আর তুলো না। কষ্ট পাবে।“

“সেটাই বলছি।“

“তা বলে কি নিজের ভাল লাগার কাজ ছেড়ে দেবে?”

বাবা একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন, তারপর বললেন,”দ্যাখ। যা ভাল হয় কর। কিন্তু ঠকে গেলে বলতে এসো না।“

রাজ  খাওয়া ছেড়ে উঠল। বাবার কথা শুনে তার একটু মন খারাপ হয়ে গেল। বাবার দুঃ’খের কথাটা সে জানে। মা বলেছিলেন। বাবা সৈকত  বলে একজনকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করার জন্য  সাহায্য করছিলেন। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার পর  সে বাবার কাছে কোনদিন দেখা করতেও আসে নি। বরং লোকদের কাছে বাবার নামে নিন্দা করে বেড়ায়। সেই নিয়ে চাপা দু;খ আছে তাঁর। তবে এসব নিয়ে মাথা ঘামানোই ভাল। সে উঠে ঘরে গেল।আজ রাতে সে কিছুক্ষন পড়াশুনা করবে। কাজগুলো করে রাখবে।পড়াশুনা খারাপ হয়ে গেলে বাবা হয়ত মাকে তখন আরো কিছু বলার সুযোগ পাবেন না।সে সুযোগ বাবাকে সে দেবে না।

  রাতে ঘন্টাখানেক পড়ল রাজ।ছোটমামা  এল ঘরে শোবার জন্য।খুব খুশী খুশী দেখাচ্ছে তাকে। নাটকের জন্য। ছোটমামা ধপাস করে বিছানায় শুয়ে বললেন,- “রাজ। তোদের খেলাটা কোন মাঠে হবে?”

“ হাইরোড় পেরিয়ে বকুলতলা মাঠ।“

 “কিসে যাবি?”

“ সাইকেলেই যাব সবাই মিলে।তুমি যাবে তো?”

“সে তো যাবই। এবার জিতলে কি হবে?”

“এটা  জিতলেই সেমিফাইনাল।“

“হুম। তোদের টিমটা মনে হচ্ছে খুব শক্তিশালী হয়েছে। ঐ যে তীর্থজেঠু বলে ডাকিস যাকে, সেদিন চায়ের দোকানে দেখা হয়েছিল, নির্ঝর বলে ছেলেটার কথা বলছিল।“

“তাই?”

“হ্যাঁ।“

ছোটমামা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর কথাও বলছিল।“

রাজ বলল,”বাজে বকো না।“

“সত্যি।  তীর্থবাবু বলছিলেন রাজ বলে ছেলেটাও  ভাল খ্যালে। ওরও স্কিল আছে।ও যদি লেগে থাকে ওরও হবে।“

 কথাটা শুনতে ভালোই লাগল রাজের। তাছাড়া রামলাল স্কুলের সাথে  তারা হেরে গেছিল ঠিকই কিন্তু সেদিন সে  ভালই খেলেছে। সে অল্প সময়ের জন্য নেমেছিল। নবারুন বলে ছেলেটাকে সে মার্ক করে রেখেছিল। ওকে নড়তেচড়তে দেয় নি। ইন্দ্রদা তার প্রশংসা করেছে।বলেছে,” ব্যাড লাক। সৌম্য। জিততে পারলাম না। কিন্তু তুই ভাল খেলেছিস। চালিয়ে যা।“কথাটা মনে পড়তে তার ভাল লাগল।

ছোটমামা একটা হাই তুলে বলল,” সারাদিন খুব খাটাখাটনি গেছে। এবার লম্বা হব।“

“ঘুমিয়ে পড়বে?”

“হ্যাঁ। রেষ্ট না নিলে চলে। কাল সকালে অনেক কাজ। তুই এবার বই গোছা। নে নে শুয়ে পড়।“

রাজের এখন বললেও ঘুম আসবে না। তার কাজ হয়ে গেছে ঠিকই।কিন্তু এখন তার মাথায় হাজার কল্পনা। সে মনসচক্ষে ম্যাচটা দেখছে। আর তো মোটে দুদিন। এ ম্যাচ তারা জিতবেই।ভাবতে ভাবতে রাজ ঘুমিয়ে পড়ল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত