| 19 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-৪) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মিষ্টুর বাড়ি ফিরতে একটু রাত হলেই দুশ্চিন্তা শুরু হয় বিশাখার। অসম্ভব ভুলোমনের মেয়ে মিষ্টু। অথচ নিজে মানতে চায় না। চুপ করে থাকে। তর্ক করা বা মুখে মুখে কথা বলা তার ধাতে নেই। তবে তার চুপ করে থাকার মধ্যেই একটা প্রতিবাদ আছে। বিশাখা বেশ বুঝতে পারেন, আজ যে চুপ করে শুনছে, কাল তার উত্তর আছড়ে পড়তেই পারে। আর সেই উত্তর বা পালটা যুক্তি উলটোদিকের মানুষটির জন্য সহনীয় বা মানানসই না’ও হতে পারে।

       বিশাখা সেই দিনটাকে ভয় পান।  

       বিশাখা তার এই বাহান্ন বছরের জীবনে বহু কিছু মেনে নিয়েছেন, যেমন আর পাঁচজন মেয়ে মেনে নেয়। তেমন বহু কিছু অগ্রাহ্য করেছেন, অস্বীকার করেছেন, অবজ্ঞা করেছেন। যেটা আর পাঁচজন মেয়ে করে না, বা করার সাহস পায় না।

       ছেলেবেলা থেকে নিয়ম ভাঙে না কেউ। তখন নিয়ম বোঝে না। নিয়মেরও তো একটা নিয়ম থাকে, কতগুলো সুতো, কতগুলো গিঁট, কতগুলো ভাঁজ, প্যাটার্ন। সেগুলো পুরোপুরি বুঝতে, তার ভিতরের ফাঁকগুলো ধরতে অনেক সময় লাগে। তার আগেই পরিবার একটা নির্দিষ্ট ছাঁচের মধ্যে বসিয়ে দেয় একটি শিশুকে। সে সেই ছাঁচকেই ভাবে জীবন। ওই যাপনকেই তাকে স্বাভাবিক ভাবতে হয়। তারপরেই নিজস্ব বোধ বুদ্ধি চেতনা অভিজ্ঞতা যখন পাকতে থাকে, তখন নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করার শুরু। কেউ কেউ পারে। সকলে পারে না।

       বিশাখা বড় হয়েছেন যে পরিবারে, সেখানে বাবা হিন্দু, মা খ্রিস্টান। উদার ধর্মমত ছিল, বলাই বাহুল্য। কিন্তু হিন্দু ছেলের খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসায় তীব্র প্রতিরোধও ছিল। প্রাথমিক প্রতিরোধ হবার কথা পরিবার আত্মীয় পরিজনের কাছ থেকে। কিছুটা ঘটেছেও তাই। বিশাখার মা তাঁর শ্বশুরবাড়িতে কোনওদিনই ঠাঁই পাননি। বিশাখা নিজে তার পিতৃকূলের কাউকেই তেমন চেনেন না।

দুর্গাপুজো কালীপুজো লক্ষ্মীপুজোর দিনগুলো কাটত কষ্টে। একলা। আশেপাশের প্রতিবেশিদের বাড়ি থেকে ভোগ আসত, প্রসাদ আসত। চেটেপুটে খেতে মজা…

পাশের ঘরের ভাড়াটে সীমাদের বাড়িতে হত কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। আশ্বিনের হিম সন্ধ্যায় শাঁখ বেজে উঠত ওদের ঘরে। ওইটুকু ছোট্ট ঘরখানা হেসে উঠত সাদা চালের গুঁড়োর আলিম্পনে। কতরকম ফুল লতা আঁকতেন কাকিমা। ধানের ছড়া, আয়না চিরুনি সিঁদুরকৌটো পান-সুপুরি আর ছোট্ট ছোট্ট পায়ের ছাপ। সেই জোড়া পায়ের ছাপ সবজায়গায় সমান মাপের। ছেলেবেলায় বিশাখার খুব অবাক লাগত দেখে। এত দ্রুত এত নিখুঁত আলপনা দেন কী করে কাকিমা! কালচে সিমেন্টের মেঝেতে রান্নাঘরের চৌকাঠে, বারান্দার আলসেতে, উঠোনের ছোট্ট তুলসীমঞ্চের সামনে, মিটসেফের সামনে, কাঠের আলমারির পাল্লার কাছে অপূর্ব সব পায়ের চিহ্ন। যেন ওখানেই এসে দাঁড়াবেন কেউ। সন্ধেবেলার আকুল আবাহন আর রাতভ’র প্রতীক্ষা। কে জাগে!  

সীমাদের বাড়ির নাড়ু নিমকির চেয়েও বেশি লোভ হত খিচুড়ির জন্য। কলাপাতায় মুড়ে খিচুড়ি দিয়ে যেত কাকিমা। লাবড়া। গন্ধচালের পায়েস। পায়েস অল্পই থাকত। তাতে কিশমিশ না পেলেও এলাচের গন্ধ পাওয়া যেত। ওরা তেমন স্বচ্ছল ছিল না। কিন্তু আন্তরিকতা কম পড়েনি কখনও। 

মান্তু-শান্তুদের বাড়িতে কালীপুজোর সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুজো। সেদিন শুধু লক্ষ্মীকে ডাকা নয়, অলক্ষ্মীকে দূর করার প্রথা ছিল।

বাঁহাত দিয়ে গোবরের মূর্তি গড়া হল কোনওরকমে। চোখের জায়গায় দুটি কড়ি। সর্বাঙ্গে ছেঁড়া চুল। পাশেই পিটুলি দিয়ে গড়া হল লক্ষ্মী কুবের ও নারায়ণ। উঠোনের এক কোণে দরজার বাইরেই অলক্ষ্মী বসে রইলেন। তার ওপর বাঁহাত দিয়ে খানিক ফুল ছুঁড়ে দেওয়া হল কোনওমতে। তারপর কুলো পিটিয়ে ঝাঁটা দিয়ে অলক্ষ্মী বিদায়। সকলে মিলে ‘অলক্ষ্মী বিদেয় হও, মা লক্ষ্মী এসো…’ এইসব গাইতে গাইতে তাকে তেমাথার মোড়ে গিয়ে ফেলে আসা হল।

সবাই ফিরে এসে আলো জ্বেলে দিল ঘরে ঘরে। প্রদীপ, মোমের আলো। শুরু হল দীপান্বিতা লক্ষ্মীর আরাধনা। ঝলমলে হয়ে ওঠে চারপাশ। বিশাখার হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা কালোকুলো ওই মেয়েটা কী করছে এখন? তাকে যে সকলে মিলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এল… সে ওখানে একা পড়ে থাকবে সারা রাত? তার হিম লাগবে না? যদি শেষরাতে জ্বরজারি হয়? এই আশ্বিনশেষের হিমে কে দেখবে তাকে? কোনও বিপদ হলে?

একবার এসব দেখে বাড়ি ফিরে এগারো বছরের বিশাখা তার মা’কে জিজ্ঞাসা করে, “অলক্ষ্মী কে মা?”

মায়ের শক্ত হতে থাকা মুখটায় এমন কিছু একটা কঠিন উত্তর লুকিয়ে ছিল, যে উত্তর আর শুনতে ইচ্ছে করেনি বিশাখার। নিঃশব্দে সে মায়ের সামনে থেকে সরে আসে। প্রদীপ জ্বালিয়ে বাজি ফাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে অনেক রাতে যখন সকলে মিলে খেতে বসেছে, দাওয়ায় প্রত্যেকের পাতে ভাত বেড়ে দিতে দিতে মা বলেন, “লক্ষ্মীও যা, অলক্ষ্মীও তা’। আসলে সেই মেয়েমানুষ। নিয়ম মেনে কথা শুনে চললে আমরা বলি লক্ষ্মী মেয়ে আর অবাধ্য হলেই বলব অলক্ষ্মী। এর বেশি আমি কিছু জানি না।”

বাবা ভাত ভাঙছিলেন। তিনি চোখ তুলে তাকান।

“হঠাৎ এসব কথা এল কোত্থেকে?”

“তোমার মেয়ে আজ শান্তুদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো দেখত গিয়েছিল। সেখানে অলক্ষ্মী বিদায় দেখে এসেছে। প্রশ্ন করছিল, তাই উত্তর দিলাম।” 

বাবা পাশে বসা একাদশী কন্যার পিঠে হাত রাখেন।

“মানুষই দেবতা গড়েছে রে। সভ্যতার ইতিহাসে আগে এসেছে মানুষ, তারপর তারাই কল্পনা করে নিয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীকে। এদের নানা রূপ, নানা আচার অনুষ্ঠান। যে যার মতো করে মেনে চলেন। যত বড় হবি, ইতিহাস পড়লে তত জানতে পারবি।” 

“ইতিহাস কি আর সকলের জন্য? তোমার আমার সংসারে আর ইতিহাসের জায়গা কোথায়?”

মায়ের কথার অর্থ বুঝতেই পারে না বিশাখা। চুপ করে খেয়ে নেয়। তবু কোথায় যেন একটা খটকা এঁটে লেগে থাকে।  

গভীর রাতে জানালার পর্দা যখন অল্প হাওয়ায় উড়তে দেখে ঘুম নেমে আসে চোখে, ঠিক তখনই মায়ের ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজটা স্পষ্ট হয়। বাবার অস্ফুট স্বর পরিষ্কার নয়। অলক্ষ্মী শব্দটাতে জড়িয়ে থাকা কোনও অসম্মান বা অপমানের কাঁটা সেদিনই বিঁধে গিয়েছিল।

বহু পরে বড় হয়ে বিশাখা জেনেছে, বিধর্মী মেয়েকে ঘরের বউ হিসেবে মেনে নেননি বিশাখার ঠাকুমা। বলেছিলেন, অলক্ষ্মী। শব্দটার অভিঘাত সইতে পারেননি মা।    

বিশাখাদের বাড়িতে তেমন কোনও আচার অনুষ্ঠান হয় না। অক্ষয়তৃতীয়া, শিবরাত্রি, নীলষষ্ঠী বা পয়লা বৈশাখের নিয়মকানুন বলে দেয়নি কেউ। মাসের সংক্রান্তি, পূর্ণিমা অমাবস্যা একাদশী বা বিবিধ লোকাচারের উৎস বা তার প্রয়োজন বা পালন নিয়ে বিশাখা ছেলেবেলা থেকেই অজ্ঞ। সরস্বতীপুজোর সময় একটি বড় মূর্তিতে মালা পরিয়ে ফুলদানিতে অনেক ফুল সাজিয়ে দেওয়া। পাশে বইপত্র, হারমোনিয়মের বাক্সের ওপরে খাতাপেনপেনসিল। ব্যস। আর কিছু নয়। বাবা-মা এইসব দিনগুলোতে নিজেদের মতো করে চারপাশটা সাজিয়ে নিতেন। বিশাখার বড় হতে হতে মনে হল, তারা আলাদা। তাদের বাড়িতে আলাদা পুজোর আসন নেই, পুজোর বাসন নেই। শুধু তাদের ঘরের দেওয়ালে যীশু, রান্নাঘরের তাকে লক্ষ্মীর পট আর পড়ার টেবিলের সামনে সরস্বতীর মূর্তি।   


আরো পড়ুন:  কদমতলি (পর্ব-৩) । শ্যামলী আচার্য


ছেলেবেলায় বোঝা সম্ভব হয়নি কেন তারা আত্মীয়স্বজন ছাড়া এমন নির্বান্ধব হয়ে ভাড়াবাড়িতে দিন কাটায়। ইস্কুলের সব বন্ধুদের তো দাদু-ঠাকুমা কাকা-জ্যাঠার মতো অনেক আপনজন থাকে; তার বেলাতেই কেউ নেই কোত্থাও? বরং মায়ের সূত্রে মামাবাড়ি গিয়ে ডিসেম্বরের ছুটি কাটত তুমুল হট্টগোলে। সেখানে দুই মামা, দুই মামী, তাদের ছেলেমেয়ে মিলে পুরো নরক গুলজার। বড় আভেনে কেক বানানো চলছে। কুকিজ তৈরি হচ্ছে বাড়িতেই। ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর জন্য তিন-চারদিন ধরে সে এক তুমুল হইচই।      

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বিশাখার শাশুড়ি এই ভিন্নধর্মের দো-আঁশলা সংস্কৃতিতে বড় হওয়া বিশাখাকে প্রথম দিন থেকেই বড্ড আপন করে নিলেন।

বিশাখা আচার বিচার মানতে শেখেননি। প্রথম দিকে অস্বস্তি হত। বিশেষ করে বাড়ির ঠাকুরঘরে ঢোকা-বেরোনোর নিয়ম সম্বন্ধেও কিচ্ছু জানা ছিল না তার।  

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত