| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-২)

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

বাংলা ভাষার উদ্ভব, উনিশ শতকে কলিকাতার সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের দ্বারা সংস্কৃতায়িত বাংলার সৃষ্টি, বাঙালির সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে পরতে পরতে লেখা হয়েছে মিথ্যা আর ভুল তথ্যভিত্তিক বানোয়াট ইতিহাস। দুইশ বছর  ধরে আমরা  অইসব ভুল বা বানানো ইতিহাস মেনে নিয়ে এর ভিত্তিতেই পুনরায় আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির বয়ান রচনা করে গেছি। আর এভাবে বাংলা ভাষা পরিণত হয়েছে সংস্কৃতের উপনিবেশে। এই প্রথমবারের মত বানানো ইতিহাসের স্তর খুঁড়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বাঙালি সংস্কৃতির রদবদলের আদত ইতিহাস উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়েছেন উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম তার “ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস”বইয়ে।

ফয়েজ আলম ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা’ এটি সচেতন চেষ্টায় তৈরি একটি মিথ্যা বয়ান, যে মিথ্যা রচনার পিছনে কাজ করেছে ধর্মীয় আবেগ ও উপনিবেশি প্রশাসকদের প্রশ্রয়। আসলে সংস্কৃত এবং বাংলা দুটো ভাষাই এসেছে স্থানীয় ভাষা থেকে (যাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হয়ে থাকে)। প্রাচীনকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান পাকিস্তানের অংশ বিশেষসহ) প্রচলিত স্থানীয় ভাষাকে কিছু নিয়মে বেঁধে দেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা পাণিনি নামের এক পন্ডিত; সেটিই পরে ধর্মচর্চা আর ধর্মীয় লেখাজোকায় কাজে লাগানো হয় আর সংস্কৃত ভাষা নাম পায়। এটি কখনো কোনো মানবগোষ্ঠির মুখের ভাষা ছিলো না। একই সময়ে আমাদের দেশে প্রচলিত স্থানীয় ভাষা মানুষের মুখে মুখে স্বাভাবিক রদবদলের নানা ধাপ পার হয়ে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বাংলা ভাষার আদি রূপ নেয় । সংস্কৃতের সাথে বাংলার কোনো সরাসরি সম্পর্কই নাই। অথচ দুইশ বছর ধরে ভাষার ইতিহাসে আর পাঠ্য বইপুস্তকে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের মা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এরকম অনেক বানোয়াট ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন ফয়েজ আলম ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস এই ধারাবাহিকে  আজ থাকছে পর্ব- ২।


জোনসের সময় ভারত ও সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ দেখা দেয় ইউরোপের অগ্রজ ও সমকালীন লেখকদের মধ্যে। এর দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন জোনস। তার কাছে ভারত ছিলো পেশাগত উন্নতির জায়গা। তিনি এ মনোভাব নিয়েই ভারতে কোন লাভজনক পদে নিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করে আসছিলেন অনেক আগে থেকে। দীর্ঘ তদ্বিরের পর সুপ্রীম কোর্টের বিচারক হিসাবে নিয়োগ পান এবং ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে পৌছেন। এখানে পৌছেই তিনি সংস্কৃত ভাষা, ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদির দিকে মনোযোগ নিবিষ্ট করেন। এবং প্রাচ্যতাত্ত্বিক হিসাবে নাম কেনার জন্য অনেকটা অগ্রাসীই হয়ে উঠেন। এখানে আসার আগেই তার জ্ঞানপিপাসু মন গড়ে উঠে একজন প্রাচ্যতাত্ত্বিকের মনোভঙ্গি নিয়ে। এটি তাকে ঠেলে দেয় প্রাচ্যতাত্ত্বিক চিন্তার দিকে। উপরের উদ্ধৃতিগুলো লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে তিনি ইউরোপের দেশগুলোকে এক দলে আর গোটা প্রায় দুনিয়াকে আরেক দলে ফেলে চিন্তা করেছেন। তাই ভারত, ভারতীয় ভাষা ও জনগোষ্ঠীর সাথে সাদৃশ্য আবিষ্কার করে ফেলেন চীন, জাপান, মিশর, এমনকি দূরদেশ মেক্সিকো ও পেরু পর্যন্ত। এই চিন্তা পরিস্কার একজন প্রাচ্যতাত্ত্বিকের যার চিন্তার কায়দাটা বিকশিতই হয়েছে ইউরোপকে কেন্দ্রে আর বাকী পৃথিবীকে কিনারায় রেখে। তাই পৃথিবীর প্রায় সবই তার কাছে ‘আন’ (আদার)।

অন্যদিকে, এদেশে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখা ও দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা হিসাবে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসাবে ক্ষমতাধর ব্রাহ্মণশ্রেণীকে হাতে নেয়ার চিšতা ছিলো ইংরেজদের। এজন্য তারা হিন্দুদেরকে প্রাধান্য দিতে থাকে ১৭৫৭ সালের পর থেকেই। হিন্দুদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রশংসা করে তাদের হাতে রাখার কৌশল গ্রহণ করে ওরা। উপনিবেশী নীতির সাথে সাজুয্য রেখেই সংস্কৃতের অতিরিক্ত প্রশসংসায় পঞ্চমুখ হন হ্যালহেড-জোনস-কেরি। তাদের এরকম আন্দাজ ছিলো যে, এর মধ্য দিয়ে সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতাধর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের যেমন মুঠোয় রাখা যাবে, তেমনি জাতি হিসাবে মুসলমানরাও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে।

তৃতীয়ত, ভারতে জোনস ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারক, রয়েল সোসাইটি অব বেঙ্গলের প্রেসিডেন্ট, ইংল্যান্ডে প্রাচ্যতাত্ত্বিক হিসাবে কমবেশি খ্যাতিমান। এসব কারণে তার বক্তৃতা ভারতে বসবাসকারী ইংরেজদের নিকট প্রশ্নাতীতভাবেই জ্ঞানগর্ভ কথা বলে মনে হবে বৈকি। মোটকথা, উইলিয়াম জোনস এসব কথা বলেন ভারতে উপনিবেশী বিন্যাসের সর্বোচ্চ চূড়ায় দাড়িয়ে, সেই চূড়ায় তার আশপাশে ক্ষমতাধর ইংরেজ উপনিবেশকরা, তার নিচে ভারত-প্রবাসী সাধারণ ইংরেজ উপনিবেশক কর্মচারী, তারও নিচে অনুগত উচ্চশ্রেণীর হিন্দু প্রজার দল। তাই তাঁর কথা তখন ইংরেজদের নিকট জ্ঞানী মানুষের পর্যবেক্ষণপ্রসূত বক্তব্য, আর, অনুগত সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের কাছে প্রভুর বানী হিসাবে পরিগণিত হওয়ারই কথা। বা¯তবে হয়েছেও তাই। আর, যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজে জড়িত ছিলেন অর্থাৎ সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা, তারাও প্রতিবাদ করলেন না। কারণ সংস্কৃত ভাষাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসালে তাদের মনের গোপন কোণে দীর্ঘদিন ধরে লালিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও অনেকটা প্রশমিত হওয়ার সুযোগ পায়। এভাবে ইংরেজের উপনিবেশী শাসন-শোষণের আকাঙ্খা আর সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এক বিন্দুতে মিলে যাওয়ার ফলে হ্যালহেড-জোনসের ভুলভাল বক্তব্যই টিকে যায়, যা ২০০ বছর ধরে আমাদের ভাষাচর্চাকে এবং সেইসূত্রে সাংস্কৃতিক  ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতকে শাসন করে আসছে।

ভারতীয় ভাষাসমূহের উদ্ভব অন্যান বিষয়ে

ঐতিহাসিক সময় বলে একটা কথা ইতিহাসকারেরা তো ব্যবহার করেনই, আমাদের মত ইতিহাস-পাঠকরাও শুনে আসছি। এটি সাধারণভাবে বুঝায় অতীতের দিকে প্রাচীন যুগের সেই সময়সীমা পর্যন্ত যে সময়পর্ব থেকে সেই যুগের মানবগোষ্ঠী ও তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে কমবেশি প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়। ঐ সময়ের কমবেশি প্রামাণ্য তথ্য আর তার পরবর্তীকালিন উল্লেখ থেকে যতটা সম্ভব ততটা ইতিহাসই রচিত হয়। তার সাথে বড়জোর যোগ করা যায় আনুমানিক বিশ্লেষণ, ইঙ্গিত ইত্যাদি; যদিও তা প্রামান্য সত্যের মর্যাদা পায় না।

সংস্কৃত ভাষা এবং আর্যজাতির গৌরব গাথা সম্বলিত যে-ইতিহাস এখন আমাদের জ্ঞান জগতে জারি আছে তার ভিত কিন্তু ঐ রকম ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর গড়ে উঠেনি। বরং আমরা দেখব এই ইতিহাস রচিত হয়েছে গত দুশো- সোয়াদুইশ বছরে–বেশিরভাগই অনুমান, আনুমানিক বিশ্লেষণ, তথ্যের ভুল ব্যাখ্যা এসবের উপর ভর করে। এই আশ্চর্য ফাক চিহ্নিত করা যায় উপনিবেশী শক্তির উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার আকাঙ্খাকে ভিত্তি বানিয়ে সংষ্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ শ্রেণীর ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকেন্দ্রিক আবেগ হিন্দু-পুনর্জাগরণের নামে বিস্ফারিত হওয়ার মধ্যে।

সংস্কৃত প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু ধর্মীয় পূজা-অর্চনা ও ভক্তি প্রকাশের ভাষা হওয়ায় এ ভাষা বিকাশের বিবরণ লেখার কাজটি অন্যান্য ভাষা বিকাশের বিবরণ লেখার মত নয়। ধর্মীয় আবেগের কারণে সংস্কৃতকে সকল ভারতীয় ভাষার মাতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের গূঢ় উদ্দেশ্যে অনেকেই তার প্রাচীনত্বের উপর অতিরিক্ত জোর দিয়েছেন। এমনও লেখক আছেন সংস্কৃতকে অনাদিকাল থেকে অস্তিত্বশীল ভাষা হিসাবে মানেন। লোকমুখে প্রচলিত ভাষাকে নিয়মে বেঁধে ‘সংস্কৃত’ বা ‘পরিশুদ্ধ’ করার কাজটি করেন পাণিণি। অথচ কোন কোন লেখক সংস্কৃত ভাষাকে পাণিনিরও বহু আগে থেকে প্রচলিত ভাষা বলে দাবী করেছেন।১৩ আমরা এক্ষেত্রে ধর্মীয় আবেগপ্রসূত এসব দাবী ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে পাত্তা না দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে খ্যাত পন্ডিতদের মতামত যাচাই করে দেখব।

এ যাবত পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষিক নির্দশনের বিশ্লেষণ অনুসারে জানা যায় মধ্যএশিয়ায় উরাল পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী একটা জনগোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলস্বরূপ অথবা অজ্ঞাত কোনো কারণে সেই জনগোষ্ঠীর একটা অংশ দেশান্তরী হয়ে ভারতে এসে বসতি করে। এরাই হলো আজকের ভারতের উচ্চশ্রেণীর হিন্দু। ওখানে যারা থেকে যায় তার আরো কিছুকাল পরে পাড়ি জমায় বর্তমান ইরানে। এশিয়ার ঐ মানবগোষ্ঠী আর্যভাষী বা ভাষাভিত্তিক গোষ্ঠী ‘আর্য’ হিসাবে পরিচিতি পায় আঠারো-উনিশ শতকে। আনুমানিক ১৫০০ খ্রি. পূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে। কয়েক দফায় এই অনুপ্রবেশ চলে। তাই ধরে নেয়া যায় আর্য নামে পরিচিত মানুষেরা এরপরও কয়েক দলে ভারতে প্রবেশ করে থাকবে। তাদের ভাষাই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা নামে পরিচিত। বৈদিক সাহিত্য এই ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন নমুনা বলে কথিত। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ড: সুকুমার সেন, ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড: পরেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখের মতে ভারতে বৈদিক  ভাষা বিকাশের সূচনা ধরা হয় ১২০০ খ্রি. পূর্বাব্দের কাছাকাছি।

বৈদিক ভাষা বলতে সাধারণভাবে হিন্দুদের প্রাচীন পবিত্র গ্রন্থ বেদের ভাষাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এই বেদও চাররকম: ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। বৈদিক ভাষার শেষকাল নিয়ে পন্ডিতদের সামান্য মতভেদ আছে। সুনীতি কুমার মনে করেন বৈদিক সাহিত্য বিকাশের উর্ধ্বকাল ৭০০ খ্রি. পূ., সুকুমার সেনের মতে ৬০০ খ্রি. পূ., পর্যন্ত, পরেশ চন্দ্রের মতে খ্রি. পূ. ৩০০অব্দ, শহীদুল্লাহর মতে ৫০০ খ্রি. পূ.। ভারতে আসার পর আর্যদের ভাষা ও স্থানীয় ভাষার মিশ্রণে নতুন ভাষারূপ দেখা দেয় যাকে বলা হয় প্রাকৃত ভাষা। বৈদিক ভাষা বা সাহিত্যের কালের পরই এই প্রাকৃত ভাষার কাল, যার নাম দেয়া হয়েছে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার যুগ। এরপর নব্যভারতীয় আর্যভাষা। আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষা বলতে বর্তমানে প্রচলিত ভাষাগুলোকে বোঝানো হয়। যেমন অসমিয়া, উড়িয়া, হিন্দী ইত্যাদি। বাংলা ভাষা বিকাশের শুরু সুনীতির মতে ১১০০ খ্রি., সুকুমারের মতে দশ শতক।


আরো পড়ুন: ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-১)


কিন্তু বৈদিক ভাষা বা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার বিভাগ, প্রাকৃত ভাষা এবং অন্যান্য আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিবর্তনের বিষয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য আছে তাদের মধ্যে। সুকুমার সেন, পরেশচন্দ্র মজুমদারসহ অনেক ভারতীয় পন্ডিত ভারতীয় আর্য ভাষা বিকাশের একটা সরল গতিপথ দেখিয়েছেন। তা এরকম : প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা (বা বৈদিক) থেকে প্রাকৃত, প্রাকৃত থেকে কালক্রমিক বিবর্তনে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির সৃষ্টি। সুকুমার সেন মনে করেন ৬০০ খ্রি.পূর্বাব্দের পর থেকে খ্রিষ্টিয় দশম শতাব্দি পর্যন্ত মধ্যভারতীয় আর্য ভাষার কাল অর্থাৎ প্রাকৃত ও অতপর অপভ্রংশের বিকাশের সময়। সুনীতি কুমার আরেকটু পিছিয়ে এর সর্বোচ্চ সীমা ধরেছেন ১১০০ খ্রিস্টাব্দ, শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ। এটি তিন স্তরে বিকশিত হয়, আদি, মধ্য ও অন্ত বা প্রথম, দ্বিতীয় ও অন্ত উপস্তর। এরপরই নব্যভারতীয় আর্য ভাষা বিকাশের সময়–খ্রিস্টীয় দশ হতে অদ্যাবধি।ড: শহীদুল্লাহ মনে করেন বাংলা ভাষার সূচনা আরো আগে, ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে।                                                                                                                     

এই সরল গতিপথের যে ব্যাখ্যা তারা হাজির করেছেন তার মধ্যে রয়ে গেছে অনেক ফাঁক ফোকর। সুকুমার সেন বিভক্তি ও শব্দ ভান্ডারের পার্থক্য লক্ষ করে এক জায়গায় বলেছেন :

ঋকবেদ ও যজুর্বেদ ছিল মান্যব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সম্পত্তি আর অথর্ববেদ ছিলো জনসাধারণের প্রথম পুরোহিতের বা রাজার সম্পত্তি। সুতরাং ঐ স্তরের বৈদিক ভাষাকে Hieratic আর অথর্ব সংহিতার ভাষাকে Demotic বলিতে পারি। এই ভাবে দেখিলে ভারতীয় আর্য ভাষার এই রকম শ্রেণী বিভাগ করা যায়:

ব্রাহ্মণ্য (: (১) ঋকবেদের ভাষা (২) যজুরবেদের ভাষা। আবার যজুর্বদের ভাষা থেকে সংস্কৃত। অন্যদিকে, অব্রাহ্মণ্য > অথর্বসংহিতা > প্রাকৃত (মধ্যভারতীয় আর্যভাষা)।১৪ 

বৈদিক ভাষার দুটো বিভাগের কথা বলে ব্রাহ্মণ্য বিভাগ হতে সংস্কৃত আর অব্রাহ্মন্য বিভাগ হতে প্রাকৃতের বিকাশ নির্দেশ করেছেন সুকুমার সেন। সেকালে সমাজে লোকের সংখ্যা খুব বেশি ছিলো না। নগর বলতে অল্পসংখ্যক মানুষের বসতিকেই বোঝাতে। এরকম সংখ্যাল্প মানুষের একটা সমাজে একই ভাষার ব্রাহ্মণ্য ও অব্রাহ্মণ্য ধারার চিন্তা করাটা কি ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ও বর্ণবাদী মনোভাব থেকে উদ্গত অবাস্তব কষ্ট কল্পনা নয়? আড়াই তিন হাজার বছর আগের সামাজিক অবস্থায় এ ধরণের চিন্তা কষ্টকল্পনা মাত্র। তিনি যৌক্তিক কোনো কারণ উল্লেখ করেননি যে, কেন ব্রাহ্মণের ভাষা ও রাজা-জনগণের ভাষা আলাদা আলাদা হলো আর দুয়ের ভাব বিনিময়ের মাধ্যমই বা কি ছিলো। আবার কেন বা কি প্রক্রিয়ায় যুজুরবেদের ভাষা সংস্কৃতে রূপান্তরিত হলো এবং কেনই বা অব্রাহ্মণ্য গোত্রের অথর্ববেদের ভাষা প্রাকৃত হয়ে উঠলো তার কোন ব্যাখ্যা তিনি দেননি।

তবে ‘অথর্ববেদের ভাষা থেকে প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি’ বিষয়ক বক্তব্যের পরিণাম আমরা বুঝতে পারি। তা হলো এই যে, অথর্ববেদের যে  পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে তা অনেক পরবর্তী কালের রচনা, এমনকি এতে আল্লাহ ও ব্রহ্মের অভেদ সম্পর্কিত একটি পরিশিষ্টও রয়েছে। কাজেই অথর্ববেদের ভাষা থেকে প্রাকৃতের উদ্ভব কল্পনা করলে এটিই বোঝাতে সহজ হয় যে, প্রাকৃত ভাষা সংস্কৃতের অনেক পরে বিকশিত হয়েছে। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, এখানে সংস্কৃত থেকে সরাসরি প্রাকৃতের উদ্ভব দাবী করা হয়নি। বরং  বৈদিক ভাষার একটি ধরণ থেকে প্রাকৃত এসেছে বলা হয়েছে।

এরপরই তিনি তার পূর্বোক্ত বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক এই মত হাজির করেন:

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার সাহিত্যিক বা সাধু ছাঁদ ছিলো দুইটি। একটি প্রাচীনতর– যেটিতে ধর্মসাহিত্য রচিত হইয়াছিলো–ঋকবেদের এবং পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের ভাষা, অপরটি নবীনতর, সেকালের শিষ্ট অর্থাৎ শিক্ষিত ব্যক্তির ব্যবহারের এবং লৌকিক আখ্যান উপাখ্যানের ভাষা। এই শেষোক্ত ছাঁদে লেখা কোন প্রাচীন রচনা এ যুগ অবধি পৌঁছায় নাই, তবে পরবর্তীকালের প্রাচীন কাব্য ও পুরানের মধ্যে এই ভাষার ছাঁদ আভাসে রহিয়া গিয়াছে। এই শেষোক্ত ভাষার ভদ্র এবং পাণিনী অনুশাসিত রূপই  আমাদের পরিচিত সংস্কৃত।১৫  

প্রথম উদ্ধৃতিতে সংস্কৃতকে ব্রাহ্মণ্য বেদের ভাষা থেকে বিকশিত বললেও এখানে তিনি বলছেন বৈদিক ভাষার যে-রূপটি শিক্ষিতজনের ব্যবহারের ( অর্থাৎ মুখের) সুতরাং জনমানুষের ও আখ্যান উপাখ্যানের তার উপর পাণিনীয় নিয়মাবলী আরোপের ফলে সংস্কৃতের উৎপত্তি।

আরেক জায়গায় লিখেছেন,

সংস্কৃত এবং প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষা সর্বদা সমার্থক নয়। তেমনি প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষা বলিতে শুধু বৈদিকই বোঝায় না। কেননা এমন অনেক পুরানো শব্দ ও প্রয়োগ সংস্কৃতে আছে যাহার মূল বৈদিক ভাষায় মিলে না। যেমন সং নট > *নৃত, সং খেলতি > *ক্রেড়তি। আর বৈদিক এবং সংস্কৃত এই উভয় ভাষাতেই আর্যতের ভাষা হইতে গৃহীত শব্দের অপ্রতুলতা নাই। সুতরাং বৈদিক সংস্কৃতে আর্য ভাষার যে ছাঁদটি রক্ষিত হইয়াছে প্রাচীন ভারতীয়-আর্য বলিতে তাহাই বোঝায়। তবে মোটামুটিভাবে প্রাচীন ভারতীয় আর্য বলিতে বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষা দুইই বুঝিব।১৬ 

লক্ষ্যনীয়, সংস্কৃতকে প্রাচীন ভারতীয়-আর্য হিসাবে অস্বীকার করেও পরে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছে। একবার সাহিত্যের ভাষা বলা হয়েছে, পরে ‘শিষ্টজনে ব্যবহারের ভাষা’ কথায় মুখের ভাষার ইঙ্গিত দিয়ে তা থেকে সংস্কৃতের উদ্ভব বলা হয়েছে। শেষে আরো এক জায়গায় বলেছেন সংস্কৃত হলো “কথ্য ভাষা হতে লেখ্য ভাষায় প্রত্যাবর্তন।”১৭  প্রকৃতপক্ষে, বৈদিকের সাথে মিলে না এমন অনেক শব্দ ও প্রয়োগ সংস্কৃতে থাকার অর্থ হলো সংস্কৃত ভাষা বৈদিক ভিন্ন অন্য কোন ভাষার প্রভাব স্বীকার করে নিয়েছিলো যার প্রমাণ ঐসব শব্দ ও প্রয়োগ।  

এখানে কয়েকটি বিষয় পুনরায় বিবেচনায় আনা দরকার। প্রথমত, সংষ্কৃতকে ব্রাহ্মণ্য গোত্রের ভাষার মধ্যে ফেলেও পরে শিষ্ঠজনের ব্যবহারের ভাষা বলা। একই ভাবে এ ভাষাকে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভুক্ত করেও খারিজ করা, পরে প্রমাণ ছাড়াই অর্বাচীন প্রাচীন ভারতীয় আর্য গোত্রে ফেলা। সবশেষে সংষ্কৃতকে ‘মুখের ভাষা হতে লেখ্য ভাষায়’ প্রত্যাবর্তন আখ্যায়িত করা। এসব সিদ্ধান্ত পরস্পর সমর্ধমী নয়। তাছাড়া, উদ্ধৃতিগুলোতে সুকুমার সেনের ভাষা যেন বেশ প্যাঁচালো, বাক্যের অর্থ একটির সাথে আরেকটিকে জড়িয়ে সামগ্রিক বক্তব্য দুরূহ করে তুলছে। এসব উদ্ধৃত অংশসহ বইটির সংশ্লিষ্ট কয়েকটি পৃষ্ঠা (৮৪-৮৯) পাঠের সময় গভীর মনোযোগ দিয়ে বুঝতে গেলে এর দুটো কারণ ধরা পড়ে।

এক, ঋকবেদের ভাষা হতে সংস্কৃতের বিভক্তিগত ও শব্দভান্ডারগত পার্থক্য, অর্বাচীন বেদের ভাষায় যথেষ্ট সংখ্যক নতুন শব্দের অনুপ্রেবেশ. বৈদিক ও সংস্কৃত উভয় ভাষায় আর্যেতর ভাষা হতে গৃহীত শব্দের প্রাচুর্য–সুকুমার সেনের নিজের এসব কথা একটা ঈঙ্গিতই করে যে সে কালে প্রচলিত স্থানীয় কোন ভাষা বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল; সেই ভাষার অস্তিত্বের বিষয়টি সেনবাবু আড়ালে রাখতে চেয়েছেন, যদিও পুরা অস্বীকার করেন নাই, ‘আর্যেতর ভাষা’ বলে একটু ইঙ্গিত দিয়েই শেষ করেছেন। তার এবং তার অনুসারী অন্যান্য ব্যাকরনবিদদের বিশ্লেষণ পড়লে মনে হবে আর্যরা ভারতে প্রবেশের সময় সেখানে কোন মানুষ ছিলো না, কিংবা থাকলেও তারা কথা বলতে জানতো না। যেন বা তাদের কোনো ভাষা ছিলো না, তাই ভারতীয় ভাষাগুলির বিকাশের ইতিহাস রচনায় তার ভূমিকা আলোচনা করার প্রয়োজন নাই।

দুই, ভারতের সকল জীবিত ভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত–এ ধারণা বিশ্বাসযোগ্য করার পরিকল্পনার মাঝখানে প্রাকৃত ভাষা গলার কাঁটার মত। কারণ জীবিত ভাষাগুলোর সাথে প্রাকৃতের সম্পর্কই ঘনিষ্টতর। প্রাকৃত ভাষাগুলোকে এড়িয়ে বাংলা, অসমিয়া, উড়িয়া বা হিন্দীকে সরাসরি সংস্কৃতের কাছে নিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক। প্রখর মেধাবী মানুষ সুকুমার বাবু সেটি জানতেন। তার পূর্বসূরীরাও সে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। এ কারণে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ও মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষার আলোচনায় প্রাকৃত ভাষাকে সময়ের বিবেচনায় সংস্কৃতের পরে স্থান দেয়া জরুরি ছিলো। তাহলে প্রাকৃত ভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত–এ দাবী প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। এই গোজামিল করতে গিয়ে সুকুমার বাবুর ভাষা স্থানে স্থানে জট পাকিয়ে গেছে। এ সত্ত্বেও তার লেখার মধ্যেই রয়ে গেছে প্রাকৃত ভাষার প্রাচীনত্বের ইঙ্গিত। সে আলোচনায় আসার আগে আরেকজন ভারতীয় ভাষাতাত্ত্বিকের মতামত জেনে নিই।  

পরেশচন্দ্র মজুমদার তার সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ বইয়ে লিখেছেন, “সাধারণ ভাবে অবশ্য প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার প্রতিশব্দ হিসাবে ‘সংস্কৃত’ অভিধা ব্যবহার করা যেতে পারে।১৮  তিনি প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার শ্রেণী বিভাগ করেছেন এভাবে:

“ভারতীয় আর্যের প্রাচীনতম নিদর্শনগুলি এই–

(ক) মিটান্নি-ভারতীয় উপাদান। ভাষাকেন্দ্র: উত্তর মেসোপোটেমিয়া। সময় খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ ১৫০০।

(খ) বৈদিক (সংস্কৃত): কথ্যভাষার প্রভাব সমন্বিত সাধু ভাষার রচনা সংকলন। ভাষাকেন্দ্র: ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল। সময় খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ ১২০০-১০০০।

(গ) সংস্কৃত: সাধু ভাষার মাধ্যম। ভাষাকেন্দ্র: ভারতের মধ্যদেশীয় অঞ্চল। খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ ৬০০-৪০০।

(ঘ) বৈদিক প্রাকৃত বা কথ্য সংস্কৃত (Spoken Sanskrit): কথ্যভাষা হিসাবে এর উপাদান যদিও অলিখিত কিন্তু এর পুনর্গঠন করা হয়ে থাকে। . . . ভাষাকেন্দ্র সম্ভবত আরও ব্যাপক–ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে পূর্ব-ভারত পর্যন্ত। সময় ১২০০ – ৪০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ।”১৯  পরেশবাবু দাবী করেন এই ‘বৈদিক প্রাকৃত বা কথ্য সংস্কৃত’ থেকে কালক্রমে প্রাকৃত ও অপভ্রংশ হয়ে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলি বিকশিত হয়েছে।

এখানে বিশেষ গুরুত্বের সাথে যা দেখা দরকার তা হলো প্রাচীন ভারতীয় সকল আর্যভাষাকে ‘সংস্কৃত’ নামের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা। সেই সাথে বৈদিক প্রাকৃত বা কথ্য সংস্কৃত নামে বৈদিকেরই সমকালীন আরেকটি উপভাষিক ধারা দেখানোর প্রয়াস যার মূল উদ্দেশ্য ভারতীয় সকল আর্য ভাষা এবং প্রাকৃত ভাষাগুলির গায়ে ‘সংস্কৃত’ মার্কা লাগিয়ে দেয়া। পরেশ বাবু ভাষার রকমফের যেভাবে দেখিয়েছেন তাতে সংস্কৃত সর্বত্র বিরাজমান, সেই অনাদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত। অথচ সংস্কৃত ধারাটির জন্মই পাণিনীর সময় থেকে, খ্রি. পূ. ৩৫০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে, আর ভাষা হিসাবে পরিভাষাটির ব্যবহার আরো অনেক পরে, সম্ভবত ১২০০ খ্রিস্টাব্দ হতে। 

উল্লেখ্য যে, এই ‘কথ্য সংস্কৃত’-এর অস্তিত্ব  ও তার থেকে প্রাকৃতের উদ্ভবের ব্যাপারটি সুকুমার সেন ও পরেশ বাবুর অনুমান, যার সপক্ষে অদ্যাবধি লিখিত কোনো প্রমাণ হাজির করা যায়নি। তাছাড়া তাদের বিশ্লেষণেই এমন সব তথ্য  ও সূত্র রয়ে গেছে যে সেসব সূত্র থেকে অন্য একাধিক ভাষার উপস্থিতি, সেসব ভাষার প্রভাবে বৈদিক ভাষার রূপান্তর, তার থেকে কালক্রমে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির উদ্ভবের বিষয়টি অধিকতর যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা এখন সেগুলো বিশ্লেষণ করতে চাই।

সুকুমার বাবু এক জায়গায় লিখেছেন,

“এ দেশে উপনিবিষ্ট বৈদিক আর্যদের ভাষা সাধারণের সঙ্গে ব্যবহারে ব্যাকরণের বহর কমাইয়া যথাসম্ভব শব্দার্থের উপর নির্ভর করিয়া প্রাত্যহিক কাজ চালানোর উপযুক্ত রূপ লইয়াছিল। অবশ্যই ইচ্ছা করিয়া নয়, প্রাকৃতিক কারণে। শিষ্টব্যক্তিরা–যাঁহারা বৈদিক ভাষা উত্তমরূপে জানিতেন তাঁহারা নিজেদের প্রয়োজনে এই কথ্যভাষার উপরে ব্যাকরণের সাজ চড়াইয়া ও উচ্চারণে বিশুদ্ধি আনিয়া ‘সংস্কৃত’ ছাঁদে লিখিতেন অথবা কথা কহিতেন।২০ 

এরপরই তিনি লেখেন, আনুমানিক খ্রি. পূ. পঞ্চম শতাব্দিতে বা তার পরবতী সময়ে বর্তমান লাহোরের নিকটবর্তী শালাতুরা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী পাণিনী তার নিজ জন্মস্থান উদীচী বা উত্তর-পশ্চিমা অঞ্চলের ভাষা আদর্শরূপে গ্রহণ করে তার উপর নিয়ম কানুন আরোপের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষার নমুনা তৈরি করেন। আরেক জায়গায় লেখেন “ঋগবেদের ভাষা সর্বাংশে ঋগবেদেতর বৈদিকের পূর্বরূপ নয়। অর্বাচীন বৈদিকের মূলে ছিলো অন্য একটি উপভাষা যে উপভাষা ঋগবেদের ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠসম্পর্কযুক্ত কিন্তু যাহার মধ্যে আর্যেতর প্রভাব বেশি প্রকট। ”২১ 

এখানে তিনি স্পষ্টত বার বার আর্য ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষার প্রভাবের কথা বলেছেন, সংস্কৃত ও বৈদিক ভাষায় সেই অন্য ভাষা হইতে “গৃহীত শব্দের অপ্রতুলতা নাই” স্বীকার করেছেন, অর্বাচিন বৈদিকের মূলে আর্য ভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার প্রভাবে গড়ে উঠা একটি উপভাষার কথা উল্লেখ করেছেন। তবু স্পষ্ট করে বলেননি কোন সে ভাষা বা ভাষাগোষ্ঠী এবং সেই আর্যতের ভাষা বা উপভাষার পরিণতি কি।

অন্যদিকে, পরেশবাবু সুকুমার সেন কথিত এই আর্যতের ভাষাকে আর্যমধ্য ভাষা বানানোর স্বার্থে প্রাচীন ভারতীয় আর্যের সমবয়সী দুটি ধারাই তৈরি করে নিয়েছেন–একটি ‘বৈদিক (সংস্কৃত)’ আরেকটি ‘বৈদিক প্রাকৃত বা কথ্য সংস্কৃত’, দুটোরই প্রাচীনতর সীমা ১২০০ খ্রি. পূর্বাব্দ। অতপর কথ্য সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের উৎপত্তি প্রমাণের প্রয়াস পেয়েছেন। সংস্কৃত ভাষার জন্মই যেখানে ৩৫০ খ্রি. পূ. বা তার পরে সেখানে ১২০০ খ্রি. পূর্বাব্দের ভাষা নির্দেশে সংস্কৃত নামটি ব্যবহার করার সুযোগ কোথায় আর উদ্দেশ্যই বা কি? বৈদিক ভাষার শুরুতেই কেন দুটো ধারা তৈরি হলো তার ব্যাখ্যাও তিনি দেননি। তাছাড়া, বৈদিক প্রাকৃত বা কথ্য সংস্কৃত নামের মধ্যেও যে কালগত সাংঘর্ষিক উপাদান থেকে গেছে তার কোন যৌক্তিক সমাধানও করেননি।

সুকুমার সেন কথ্য ভাষা হতে লেখ্য ভাষায় প্রত্যার্বতনকে ‘সংস্কৃত’ আখ্যা দিতে গিয়ে পূর্বোক্ত উদ্ধৃতিতে বলেছেন যে, “এ দেশে উপনিবিষ্ট বৈদিক আর্যদের ভাষা সাধারণের সঙ্গে ব্যবহারে ব্যাকরণের বহর কমাইয়া যথাসম্ভব শব্দার্থের উপর নির্ভর করিয়া প্রাত্যহিক কাজ চালানোর উপযুক্ত রূপ লইয়াছিলো। অবশ্যই ইচ্ছা করিয়া নয়, প্রাকৃতিক কারণে।” কি সেই প্রাকৃতিক কারণ? সাধারণের ব্যবহার উপযোগী হওয়ার জন্য প্রাকৃতিক কারণে যে পরিবর্তন হয়েছিলো সে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনায় আনা হয়নি। অথচ এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই ভারতের জীবিত ভাষাগুলির বিকাশ সাধিত হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত