| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

বিশেষ রচনা: সত্য ক’রে কহো মোরে হে বৈষ্ণব কবি । দিলীপ মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
যুবক রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘বৈষ্ণব কবিতা’। কবিতার শুরুতে বিস্ময়: শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান! কেবল বৈকুণ্ঠ বা স্বর্গের জন্য কি বৈষ্ণব কবিরা তাঁদের প্রেম পদাবলি রচনা করেছেন ! এই যে বৃন্দাবনগাথা, এই পূর্বরাগ-অনুরাগ-অভিসারবিজড়িত প্রেমলীলা, শ্রাবণ রজনীতে কালিন্দীর কুলে চার চক্ষুর মিলন –এ কি শুধুই দেবতার? এই সংগীতরসধারা দীন মর্তবাসী নরনারীদের প্রতি দিবস ও রজনীর তপ্ত প্রেমতৃষ্ণা কি মেটাবে না? এই গীতোৎসবে বিরাজ করবেন শুধু ভক্ত আর ভগবান? বাহিরদ্বারে পৃথিবীর নরনারীরা উৎসুক শ্রবণ পেতে তার দু-একটি তান শ্রবণ করে ষদি, সেই তান শুনে নবীন ফাল্গুনে অন্তর পুলকে ওঠে যদি, পৃথিবী আরও মধুময় হয়ে ওঠে, মধুময় হয়ে ওঠে যদি বনচ্ছায়ের নদী আর কুটির প্রান্তের কদম্ব পুষ্প, সেই প্রেমাতুর তানে মৌন ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষমান আমার ধরার সঙ্গিনীর দিকে দৃষ্টিপাত করি, ওই গানে যদি আমাদের প্রেম ভাষা পায়, তাহলে তোমার বা তাঁর কার কি ক্ষতি?
কবিতার প্রথম ও দ্বিতীয় স্তবকে প্রশ্ন ও বিস্ময়। বার বার , পর পর। সেই প্রশ্ন আরও স্পষ্ট হল তৃতীয় স্তবকে। সত্য করে কহো মোরে হে বৈষ্ণব কবি, কোথা থেকে তুমি এই প্রেমচ্ছবি পেয়েছ? এই বিরহতাপিত প্রেমগান শিখেছ কার কাছ থেকে? প্রশ্ন শুনে অন্ধ বৈষ্ণবরা কানে আঙুল দেবেন। বলে কি বালখিল্য! দেবতার লীলা আবার শিখতে হবে কার কাছ থেকে? তবু থামছেন না রবীন্দ্রনাথ। আবার প্রশ্ন। এবার আরও স্পষ্ট। হেরি কাহার নয়ান রাধিকার অশ্রুআঁখি পড়েছিল মনে? কোন রমণীর নয়ন দেখে শ্রীরাধার অশ্রুসিক্ত নয়নের কল্পনা এসেছে কবির মনে? পৃথিবীর সেই নারীই তো বিজন বসন্ত রাতে দুটি বাহুডোরে বেঁধে রাখেছিল তার প্রিয়তমকে। হে বৈষ্ণব কবি, রবীন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা, কোন পার্থিব নারীর মুখ আর নয়ন থেকে অনুকরণ করে রচনা করেছ রাধিকার চিত্তদীর্ণ এত ব্যাকুলতা। এবার একটু বুঝি বক্রোক্তি রবীন্দ্রনাথের, যার কাছ থেকে চুরি করা হল, তাকেই শেষে উপেক্ষা? তারই নারী হৃদয় সঞ্চিত তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্চিত চিরদিন?
রবীন্দ্রনাথ জয়দেব পড়েছেন , বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাস পড়েছেন; পড়েছেন জ্ঞানদাস-গোবিন্দদাস-বলরামদাস। রবীন্দ্রনাথ বৃন্দাবনের ছয় গোস্বামীর কীর্তি-কলাপের কথাও জানেন। রাধা-কৃষ্ণপ্রেমকথাকে তত্ত্বমণ্ডিত করেছেন তাঁরা। রাধা জীবাত্মা, কৃষ্ণ পরমাত্মার প্রতীক। গোস্বামীদের তত্ত্ব প্রচারিত হয়েছে। প্রচারিত প্রচারিত হয়েছে। মানুষের মনে গড়ে উঠেছে সংস্কার। সেই সংস্কার পরিহার করে রবীন্দ্রনাথ উৎস সন্ধান করেছেন। ‘মানুষই দেবতা গড়ে’ তিনি জানেন। মানুষের রূপ তাই আরোপিত হয় দেবতায়। মানুষের প্রেমও আরোপিত হয়েছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমে। শূন্য থেকে কিছু গড়ে তোলা অসম্ভব। নিরঙ্কুশ কল্পনা বলে কিছু নেই। কোন না কোনভাবে করতে হবে বাস্তবের অনুকরণ। শিল্পীরা অনুকরণপ্রিয় বলে প্লেটো তাঁদের নির্বাসন দিয়েছিলেন তাঁর ‘রিপাবলিক’ থেকে। তবুও রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ছিল, কিন্তু তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বর নন। আর সেই ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে কোন বিভাজন নেই। ‘বৈষ্ণব কবিতা’র শেষ দুটি স্তবকে সে কথাই এসেছে। দেবতারে যাহা দিতে পরি দিই তাই প্রিয়জনে। এভাবেই দেবতা প্রিয় হয়, প্রিয় হয় দেবতা। বৈষ্ণব কবির প্রেমগীতি উদ্বেলিত করে মাটির পৃথিবীর নরনারীকে। এত গীতি, এত ছন্দ, এত উচ্ছ্বসিত প্রীতি, এত মধুরতা লুঠ করে নিতে চায় সৌন্দর্ষের দস্যুরা। এতে অপরাধ নেই কোন। রবীন্দ্রনাথ তাই সাধু-পণ্ডিতদের বলেন , মিছে করিতেছ রোষ।
বৈষ্ণবগীতি নিয়ে এই কাড়াকাড়ির কারণ আছে। এ যদি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের মতো কাহিনি কাব্য হত, তাহলে এমন কাড়াকাড়ি হত না। কাহিনি এক সময়ে শেষ হয় । মানুষের প্রয়োজনে প্রাণ তার হবে আসে ক্ষীণ। কিন্তু গীতি শেষ হয়ে না হইল শেষ । অফুরন্ত প্রাণশক্তি তার , সে যে সীমা ছাড়িয়ে অসীমকে স্পর্শ করে। বিদ্যাপতির বিরহের একটি পদ—- তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী— আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তার মধ্যে সৃষ্টির আগুনজ্বালা বিরহ দেখেছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে চেতন বা অচেতনভাবে আছে এই বিরহ , আছে আক্ষেপ। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত