| 18 এপ্রিল 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: অন্য প্রেমের উপাখ্যান । শুক্তি চট্টোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

“ওগো রুদ্র দুঃখে সুখে, এই কথাটি বাজল বুকে,

 তোমার প্রেমে আঘাত আছে নাই গো অবহেলা…” 

কবি সেই কবেই প্রেমকে, ভালোবাসাকে এক বিশ্বাসের জায়গায় রেখেছেন। আর সত্যিই তাই বিশ্বাস না থাকলে ভালোবাসা কি আর ভালোবাসা হয়? সে তো তখন হয়ে যায় নুন ছাড়া আলুকাবলি কিংবা ঝাল ছাড়া ফুচকার মতো। সে কি আর কখনো একান্ত আপন হয়ে উঠতে পারে?

ভালোবাসার কথা সব ভাষার সব পুরাণে, গল্পে, নাটকে, কবিতায়, গানে এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। কখনো কোন কবিতার লাইন পড়ে আমরা কোন ভাবনার প্রেমে পরেছি, কখনো বা কোন চরিত্রের, আবার কখনো শুধু “গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি” এই অবস্থা হয়েছে। তাই ভালোবাসা যে ঠিক কখন এসে মনের চৌকাঠে দাঁড়াবে বা মনের দরজায় কড়া নাড়বে তা বোঝা বড্ড কঠিন।

ভালোবাসা কোন বাধা মানে না। মানে না সবসময় রূপ বা সৌন্দর্যের বেড়াজাল। ভালোবাসা মনের একান্ত আপন আবেগের বহিঃপ্রকাশ।

“I love to hear her speak, yet well I know

That music hath a far more pleasing sound;

I grant I never saw a goddess go;

My mistress, when she walks, treads on the ground.

   And yet, by heaven, I think my love as rare

   As any she belied with false compare.”(Shakespeare, Sonnet 130)

আজ ভালোবাসার দিনে কতগুলো গ্রীক পুরাণের গল্প বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, যা কখনো বিশ্বাসের জোরে তার প্রিয় মানুষকে ফিরিয়ে আনতে তাকে নিয়ে যায় নরকে আবার কোনো প্রেমিকের দেহজ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করে কোনো প্রেমিকাকে। এ জগৎ মোহময়। চারিদিকের মোহময়ী অথছ চঞ্চল রূপসী নারীদের দেখে ভাস্কর পিগম্যালিয়ন ঠিক করেন তিনি চিরকুমার থাকবেন। একদিন তিনি তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে এক অত্যন্ত সুন্দর, একদম তার স্বপ্নের মতো এক নারীমূর্তি গড়েন। এই মূর্তিটির প্রতি উনি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যে মাঝে মাঝে তিনি তার সঙ্গও পেতে চাইতেন। যদিও এটা যে সম্ভব না তা উনি জানতেন,তবুও তিনি সেই মূর্তিটিকে ভালোবেসে ফেলেন। একদিন দেবী ভেনাসের পুজোর এক উৎসবে পিগম্যালিয়ন দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন যেন এই মূর্তিটি প্রাণ পায়। এরপর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন ও এসে এক আশ্চর্য জিনিস দেখেন। বাড়ি ফিরে তিনি সেই মূর্তিকে আলিঙ্গন করলে বুঝতে পারেন যে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে ও সেটি আর মূর্তি নেই বরং রক্ত মাংসের মানুষের শরীর নিয়ে পিগম্যালিয়নের কাছে ধরা দিচ্ছে। এইভাবেই ভালোবাসা ও অপেক্ষার মাধ্যমে পিগম্যালিয়ন তার কাঙ্ক্ষিত নারীকে পেয়েছিলেন। ভালোবাসায় তাই অপেক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।

শুধুই অপেক্ষা? অপেক্ষার পর কি প্রেমের মিলনে আকর্ষণ থাকে না? অবশ্যই থাকে। সেই রকমই একটা গল্প বলবো এবার। এই গল্পটি পমোনা (Pomona) ও ভারটামনাসের(Vertumnus) কথা। Nymph (নিম্ফ) পমোনা নিজের দায়িত্বে থাকা ফল-ফুল, গাছপালা ইত্যাদির উৎপাদনে নিজের মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছিল। সে ছিল অত্যন্ত সুন্দরী, তাই অনেকেই প্রেম নিবেদন করতে তার বাগানের আশেপাশে ঘোরাফেরা করলেও পমোনা তাদের বিতাড়িত করত আবার অনেক সময় সেই বিষয়ে উদাসীন থাকত। তাদের মধ্যে ভারটামনাস নামক এক যুবক পমোনার সঙ্গ ছাড়তে নারাজ ছিল। সে অনেক চেষ্টা করেছিল পমোনাকে পেতে। কিন্তু সেইসব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় অবশেষে সে বিভিন্ন ছদ্মবেশে পমোনার কাছে আসত। কখনো সে নিত কৃষকের রূপ, কখনো বা জেলের বেশে সে পমোনার কাছে আসত। একদিন ভারটামনাস এক বৃদ্ধা মহিলার ছদ্মবেশে পমোনার কাছে যায় ও ভারটামনাসের বিষয়ে অনেক সুমধুর কথা বলে ও প্রশংসা করে। সে একজন দেবতার গল্পও পমোনাকে শোনায়, কিভাবে সেই দেবতা একজনকে এক পাহরের মূর্তিতে রূপান্তরিত করেছিল তাঁকে প্রত্যাখ্যানের জন্য। কিন্তু তবুও পমোনার উদাসীনতার কোনো পরিবর্তন হয়নি দেখে ভারটামনাস তার বৃদ্ধার সেই ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করে ও নিজের রূপে নগ্ন অবস্থায় পমোনার সামনে দেখা দেয়। পমোনা সেই সুদর্শন যুবকের ভালোবাসায় আকৃষ্ট হয়। তারা একে অপরের বাহুপাশে আবদ্ধ হয় ও বাকি জীবনটা গাছপালা, ফল-ফুল ইত্যাদির পরিচর্যাতেই কাটিয়ে দেয়।

“বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর…” 

বিশ্বাসে কি না মেলে! আবার সামান্য একটু অবিশ্বাসে মাঝে মাঝে সবথেকে প্রিয় মানুষটাও চলে যায় কতদূরে। বিশ্বাসের এই দোলাচল আজ আমরা আমাদের মধ্যে বা আশেপাশে দেখতে পাই। কিন্তু সে কি শুধুই আজকের গল্প? কখনোই না। এ গল্প চিরকালের। আসুন জেনে নিই সেইরকমই একটা গ্রীক পুরাণ। বলি অর্ফিউসের (Orpheus) গল্প। অর্ফিয়ূস ছিলেন একজন সঙ্গীতবিদ, বাদক ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। সুরের উপর ছিল তাঁর অলৌকিক দখল। তিনি তাঁর এই বিশেষ গুণের জন্য গ্রীকদের সূর্য দেবতা অ্যাপোলোর (Apollo) কাছ থেকে Lyre (লায়ার, একটি যন্ত্র) উপহার হিসেবে পান। অর্ফিয়ূস ভালবাসতেন ইউরিডাইসকে (Eurydice)। তাঁরা ছিলেন অভিন্ন আত্মা। এমত অবস্থায়, তাঁদের বিয়ের দিন রাতে বাগানে ভ্রমনরত অবস্থায় ইউরিডাইসকে একটি বিষধর সাপ দংশন করে। অনেক চেষ্টা করেও অর্ফিয়ূস তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ইউরিডাইসকে বাঁচাতে পারেননি। সেই রাত্রে হেডিস (Hades, গ্রীকদের মৃত্যুর দেবতা) –এর দূতরা ইউরিডাইসকে মৃত্যুলোকের উদ্দেশ্যে নিতে এলে অর্ফিয়ূসও তাঁর স্ত্রী’কে ফিরিয়ে আনার জন্য হেডিসের মৃত্যুলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে গিয়ে হেডিসের কাছে তাঁর স্ত্রী’র প্রাণ ফেরত চাইলে প্রথমে হেডিস রাজি না হলেও অর্ফিয়ূসের Lyre (লায়ার) –এর মূর্ছনায় অভিভূত হয়ে গিয়ে ইউরিডাইসকে আলো ও প্রাণচঞ্চল জগতে পূর্বের রূপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। তবে একটি শর্ত দেন অর্ফিয়ূসকে, যতক্ষন অর্ফিয়ূস এই মৃত্যুলোকের দরজা পার করে ভিন্নলোকে পা না রাখছে, ততক্ষন তিনি পিছন ফিরে তাকাতে পারবেন না ও ইউরিডাইস তাঁর সাথে আসছে কিনা তা দেখতেও পারবেন না। তবে আশ্বাস দেন, ইউরিডাইস তাঁকে অনুসরণ করেই যাবে। কিন্তু বিশ্বাস রাখতে না পেরে অর্ফিয়ূস একদম শেষ মুহূর্তে ইউরিডাইস তাঁকে অনুসরণ করছে কিনা তা দেখতে গিয়ে দেখতে পা সত্যিই ইউরিডাইস তাঁকে অনুসরণ করে আসছিল। কিন্তু হেডিসের শর্ত না মানায় ইউরিডাইসকে আর অর্ফিয়ূস পান না। ইউরিডাইসকে সেই লোকেই থেকে যেতে হয়, আর অর্ফিয়ূসকে চলে আসতে হয় তাকে ছেড়ে।

‘Psyche’ আর ‘Cupid’ (Greek= Eros) এর পুরাণ কাহিনীর কথা মনে করিয়ে দেয় ভালোবাসা খুব অদ্ভুতভাবেও এসে ধরা দেয়। রোমের পুরাণে ভালোবাসার দেবতা হলেন ‘Cupid’ (গ্রীক পুরাণে ইনিই এরোস নামে পরিচিত) যিনি ‘মারকিউরি’ (Mercury) এবং ‘ভেনাস’ (Venus)-এর পুত্র। কিউপিডকে দেখা যায় এক শিশুর রূপে, যার হাতে থাকে তীর ধনুক। এই তীর কারুর বুকে বিঁধলে সে প্রেমরসে জর্জরিত হতে বাধ্য।

সাইকি (Psyche), এক অপূর্ব রূপবতী রাজকুমারী, তার বড় দুই বোনের থেকেও সুন্দরী সে। তার রূপের গল্প দেশ-বিদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজকুমারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে ভেনাসের পুজোর ঘাটতি হওয়ায় ওর সাথে তার রূপের সঙ্গে তুলনা করায় ভেনাস ঈর্ষান্বিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। তিনি তার পুত্র কিউপিডকে পাঠান এর প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু ঘটে একটি আশ্চর্য ঘটনা। ভেনাসের কথা মতো কিউপিড সাইকির কাছে যায় তাকে তীরবিদ্ধ করতে, যাতে সাইকি তীরবিদ্ধ হয়ে কোনো ভয়ংকর প্রাণীর প্রেমে পরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই তীরটি বুমেরাং হয়ে কিউপিডের কাছেই ফিরে আসে, কিন্তু সেই সময় সে এক অদ্ভুত চেহারায় ছিল, যা প্রকৃত মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। সেই তীরের কারণে  সে নিজেই সাইকির প্রেমে পড়ে যায়।  তার মায়ের আদেশ অমান্য করে ও তাঁকে লুকিয়ে সে সাইকিকে বিয়ে করে, কিন্তু তাকে শর্ত দেয় যে, সাইকি সব পাবে, কিন্তু তার স্বামীর মুখ কখনও দেখতে পারবে না। প্রতি রাতেই কিউপিড যখন ঘরে আসত, তখন সাইকি নিজেকে তার স্বামীকে একবারের জন্য দেখা থেকে বিরত রাখত। কারণ সাইকি তাকে এক ‘Beast’ (পশুরুপী মানুষ) রূপেই জানত। এক রাতে তার বোনদের পরামর্শে সে তার স্বামীকে দেখার চেষ্টা করে। সে দেখে যে, তার স্বামী একজন অত্যন্ত রূপবান পুরুষ, জান্তব চেহারার অভাসমাত্র নেই। কিন্তু ঠিক সেই সময়ই কিউপিডের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে সাইকিকে ত্যাগ করে চলে যায়। যদিও অবশেষে  গল্পে তাদের মিলন হয়।

ভালোবাসা বিভিন্নরূপে মানুষের মনে এসে ধরা দেয়। মাঝেমাঝে তা হয় অদ্ভুত, আবার কখনো তা বেদনাদায়ক। তবু ভালোবাসা ছাড়া আমাদের জীবন অচল। জন্মের পর থেকে মা-বাবার ভালোবাসা। তারপর বন্ধুদের ভালোবাসা , আর পরে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটার ভালোবাসা আমাদের জীবনের চলার পথকে অনেক বেশি সহজ করে তোলে। তাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, প্রেমে থাকুন।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত