| 29 মার্চ 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: ভালোবাসি, ভালোবাসি । সংগ্রামী লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
স্কুলে পড়া মেয়েটি “টা টা বাই বাই” করে বাসে উঠলে তার চোখদুটো চিকচিক করে ওঠে। অনেকক্ষণ দেখা হবে না যে! আবার স্কুলফেরত বাস এসে থামলেই সে দরজায় লাফিয়ে পড়ে। নিয়ন-জ্বলা বিকেলে পার্কে হেঁটে যায় দুজনায় পাশাপাশি। স্কুলের মেয়েটার সর্বক্ষণের সঙ্গী ‘বুশি বল’। নামটা শুনলেই বোঝা যায় গায়ে তার ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া লোম। থাকবেই তো। স্প্যানিয়েল কুকুর অমনিই হয়। নরম ফারে ঢাকা গা, ঝোলঝোলা কান, মায়াময় চোখ। ভালো না বেসে থাকা যায়? তাই ‘কুচকুচে কালো সে জাতে স্প্যানিয়াল, তুলতুলে গা যেন রেশমি রুমাল’ গানের নায়ক বুশি বল কুকুরটি মুহূর্তে আমাদের হৃদয় জিতে নেয়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা গানে একটু আধটু পপ সংগীতের আনাগোনা শুরু হয়েছে। পপ মানে পপুলার, অর্থাৎ জনপ্রিয়। বৈঠকী মেজাজ থেকে সচেতনভাবেই একটু আলাদা। গানের স্টাইলে, সুরে পাশ্চাত্য পপ গানের আদল আসে। কথা বেশ অভিনব, তরতরে চলতি ভাষা, ফুল-চাঁদ-পাখি-র বৃত্ত থেকে দূরে। তা বলে কি প্রেম নেই? নিশ্চয়ই আছে! এই তো,পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ভি বালসারার সুরে গায়িকা রাণু মুখোপাধ্যায় ভালোবাসায় জড়িয়ে নিলেন ‘বুশি বল’ নামের ককার স্প্যানিয়ালটিকে।

‘বুশি বল, বুশি বল তুমি যে আমার
বুশি বল, বুশি বল আমিও তোমার…’
ভালোবাসার লাইনদুটি ঘুরে ঘুরে আসে গানে, বিদেশী পপ গায়কির স্মার্টনেস মেখে। সেইসঙ্গে নির্দ্বিধায় ঘোষণা, আদরের কুকুরটিই সবার সেরা – ‘বুশি বল এ শহরে আছে একটাই’।
এমন প্রেম তো আমাদের অচেনা নয়!
কালো তুলতুলে কুকুরের ঘোর কাটতে না কাটতেই পাখির ডাক!
সত্যি পাখির ডাক? না না, ও তো গিটারের সুর। এমন মিষ্টি করে বাজছে যেন পাখির গলায় ঘুমভাঙানিয়া গান!    
‘ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা, একটি শিসে জাগিয়ে গেল, লাগছে তাও মন্দ না!’

আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় নচিকেতা ঘোষের গান। গানের মাঝে কিবোর্ড, গিটার, পিয়ানোতে অবিকল পাখির চিকন সুর সৃষ্টি করেছেন কম্পোজার। কী যে মায়ায় জড়ায় ছোট্ট পাখিটি, তার ‘ছোট্ট দুটি কথা’ দিয়ে! হৃদয় দুলে ওঠে, এ ভালোবাসার তুলনা হয় না।
আবার রাণু মুখোপাধ্যায়ে ফেরত যাই। হেমন্ত-কন্যার গলায় বসন্ত ছিল, এক অন্যরকম বসন্ত। সেই পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে বাংলা গানের জগতে যখন পাতলা, হাই-ফ্রিকোয়েন্সি, চিকন গলার অধিকারিণীরা রাজ করছেন, সে সময় রাণুর ব্যতিক্রমী গলা অন্যরকম মাদকতা ছড়াত। ঈষৎ ভারী, ঘন আওয়াজে মাতিয়ে দিত ছোট্ট রাণু। ‘বাদশা’ নামে একটি ছায়াছবি রিলিজ করেছিল ষাটের দশকের প্রথমে। ছোট্ট একটা ছেলে গান গেয়ে গেয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। সঙ্গী বলতে একটি বাঁদর, কুকুর আর ছাগল। ডুগডুগি বাজিয়ে গায়-
‘শোন শোন শোন মজার কথা ভাই
আমায় বান্দর শুধায়, কুত্তা শুধায়, ছাগল শুধায় ভাই –
সকলেরই মা আছে রে আমার কেন নাই?’    
               
বাহারী জামা পরা বাঁদর ডুগডুগির তালে নাচে, ছাগল তার লম্বা লম্বা কান দোলায়, ছোট্ট বাদশা গায়, কী হবে আর দুঃখ করে, আয় আয় আয় সব ব্যথা ভুলে যাই…
মা না থাকার ব্যথাও ভুলিয়ে দেয় বাঁদর, ছাগল আর কুকুর সঙ্গীরা।  
‘মা না থাকুক তোরা আছিস, তোরাই আমার সাথী,
তোদের নিয়ে সুখেদুখে কাটে দিবস রাতি
আমি তোদের সাথে জীবনটা যে কাটিয়ে দিতে চাই…’          
রাণুর কচি গলায় গাওয়া এ গান একসময় ঘরে ঘরে বাজত। না-মানুষ তিন সঙ্গীর ভালোবাসার শক্তিতে দুঃখকে জয় করার গান।  

মা হারানোর শূন্যতা, বেদনা বড় গভীর। শূন্য মন অবলম্বন খোঁজে, নিজের প্রিয় বন্ধুটির কাছে একটু আশ্রয় খোঁজে। ‘ও তোতা পাখিরে’ – প্রবীর মজুমদারের কথায় ও সুরে নির্মলা মিশ্রের গাওয়া এই গানটি শুনে চোখে জল আসেনি, এমন মানুষ বোধহয় কমই আছেন। ছোট্ট একটি প্রাণ আকুল হয়ে খুঁজছে মাকে। কখন চলে গেল, কোথায় হারাল মা? সে তো মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে ছিল! খাঁচার তোতাপাখিটিই একমাত্র ভালোবাসার আশ্রয়, যাকে বলা যায়, “শিকল খুলে উড়িয়ে দেব, মাকে যদি এনে দাও।” নয়তো আকুল হয়ে মিনতি করা যায়, “পাখি তুমি লক্ষ্মী, আমায় মায়ের কাছে নিয়ে যাও…”
ছোট্ট মানুষটি তোতাপাখিকেই তার মনের কথা বলতে পারে। পাখিই তাকে বুঝবে। দুঃখের গান, ভালোবাসারও গান।
শেষে আবার সেই ছোট্ট ছেলেটিই আসুক, বাদশা ছবিতে যার প্রাণের বন্ধু ছিল বাঁদর, কুকুর আর ছাগল। তিনসঙ্গীকে নিয়ে সোহাগ করে সে, গান গেয়ে গেয়ে আদর করে:
‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না
চাই তার লাল ফিতে, চিরুনি আর আয়না -‘
 

রাণু মুখোপাধ্যায়ের কচি গলায় শিশুটির সেই আহ্লাদ ঝরে ঝরে পড়ে। আমরা ভিজতে থাকি এক অন্যরকম ভালোবাসায়, যে ভালোবাসায় কোনো শর্ত নেই, স্বার্থ নেই। এ ভালোবাসা চিরকালের।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত