| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-৫) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ভেলোরেডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার’ আরু ‘অর্থ’ এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি। ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’। শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িতরয়েছেন।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকা গিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

আলোচ‍্য উপন্যাস ‘রক্তের অন্ধকার'(তেজরএন্ধার) একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস। এটি লেখার সময় কাল ২০০০-২০০১ ছিল অসময়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্যোগের সময়। সেই অশান্ত সময়ে, আমাদের সমাজে, আমাদের জীবনে এক দ্রুত অবক্ষয়ের স্পষ্ট ছাপ পড়তে শুরু করেছিল। প্রতিটি অসমিয়াইমর্মেমর্মে   একথা উপলব্ধি করে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। রাজ্যের চারপাশে দেখা দেওয়ানৈরাজ্যবাদী হিংসা কোনো ধরনের মহৎ রূপান্তরের সম্ভাবনাকে বহন করে তো আনেই নি, বরঞ্চ জাতীয় জীবনের অবক্ষয়কে আরও দ্রুত প্রকট করে তুলেছিল। আশাহীনতা এবং অনিশ্চিয়তায় সমগ্র রাজ্য ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই যেন থমকে যেতে চায় কবির  কবিতা , শিল্পীর তুলি, লেখকদের কলম। তবে একথাও সত্যি যে শিল্পী-সাহিত্যিকরা সচেতন ছিলেন যে সমাজ জীবনের ভগ্নদশা’ খণ্ডহর’এর মধ্যে একমাত্র ‘সৃষ্টি’ই হল জীবন এবং উত্তরণের পথ। এই বিশ্বাস হারানোর অর্থ হল মৃত্যু । আর এই বিশ্বাস থেকেই সেই সময় লেখক লিখেছিলেন কালান্তর ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব – রক্তের অন্ধকার ।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম। আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবেন ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা


 

বুড়োঠান্ডা হয়ে যাওয়া গরম জলের মগটি থেকে দুই ঢোকের  মতো জল খেয়ে নিল। মোটা কেঁচোর মতো শিরা  বেরিয়ে পড়া জীর্ণ হাতের পেছনটাদিয়ে সে মুখটা মুছে নিল।

আকাশটা নীল হয়ে উঠেছে।

ছাতিম গাছটির সামনে থেকে হালকা  রোদ নেমে এসে উঠনের কাছটাতে  পৌঁছেছে । একটু একটু বাতাস বইছে । শীত শীত ভাব থাকা বাতাস। একটা পেঁচা ছাতিম গাছটার উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে  লাফিয়ে  উড়তে শুরু করেছে । পাখিটা যেন উষ্ণ হয়ে উঠা রোদের তাপে গা ধুতে শুরু করেছে বলে মনে হল রতিকান্তের। সে গায়ের চাদরটা ভালো করে মুড়েনিল।

একটা দীর্ঘশ্বাসছেড়ে আস্তে করে বলল–’ যে যাবার সে তো চলেই গেল। যারা বেঁচে রয়েছে তাদেরকে তো বাঁচতে হবে।’

ভোগেই ধীরে ধীরে দরজার পাশ থেকে স্বামীর কাছে এগিয়ে এল। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া জলের মগ হাতে নিয়ে এবার সে ভেতরে ঢুকে গেল। কাঁঠাল কাঠের বড় পিড়িটার ওপর বসে বেড়ায় হেলান দিয়ে রতিকান্ত চোখ দুটি বুজিয়ে ফেলল।

‘ হায় যারা বেঁচে আছে তাদেরকে তো বাঁচতেই হবে’– রতিকান্ত বিড়বিড় করে নিজেকে শোনানোর মতো বলল।

অনেক কাজই করার রয়েছে। অনেক বাকি আছে। ঘরটাকে ছাউনি দিতে  হবে। খুব খারাপ ভাবে ছনগুলি খসে পড়ছে। জায়গায় জায়গায় আকাশ দেখা যায়।জমিটাকেও ছাড়িয়ে আনতে হবে।আর– মনে মনে ভাবতে থাকা যে কথাটা সে পরিবারের সামনে বলল না–তাঁর চিকিৎসার কথাটা– সেটারও কিছু একটা করতে হবে।

রতিকান্তের খুব ইচ্ছা তার হাঁপানি রোগটা একবার মেডিকেল কলেজে গিয়ে দেখিয়ে আসবে। তার কাছে প্রায় রোজই বিকেলে আড্ডা মারতে আসা বুদুরাম সেদিন বলেছে– এসব অসুখ তো  আজকাল ভালো হয়ে যায়।ভালো জায়গায়  দেখিয়েচিকিৎসা করাটা আসল কথা।তুমি একবার ভেলোরে  গিয়ে দেখে আস।’

‘ভেলোরে!’

 ‘ হ্যাঁ, ভেলোরে। মন্ডলের বাবা– কেন, বুড়োটার অসুখ তো তোমার চেয়েও খারাপ ছিল। এক জায়গায় বসে মানুষের সঙ্গে কথাই বলতে পারত না। বুড়োর উদরী  ব্যামার ছিল। উদরী,উদফাই দুটোর ঠেলায় বুড়ো প্রায় মরতে বসেছিল। একটু ভালো হওয়ায় ছেলে বুড়োকে ভেলোরে  নিয়ে গেল। সেখানে একমাস থেকে চিকিৎসা করিয়ে পুরো সুস্থ হয়ে এল। কেন দেখনি? বুড়ো এখন ঘুরে বেড়ায়।

‘ ভেলোর তো অনেক দূর…’ রতিকান্ত দুর্বল ভাবে বলেছিল।

‘ রেল মোটরের যুগে কিসের দুর হে?’– বুদুরাম বলেছিল।’ বিমানে গেলে নাকি এক বেলাতেই পৌঁছে যাওয়া যায়। আমি নিজেই বুড়োর সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি।’

রতিকান্ত চুপ করে ছিল।

‘তাছাড়া এবার তো টাকাও পাবে। টাকা জমিয়ে রাখার কী দরকার। টাকাটা নিয়ে একবার ভেলোরেগিয়ে শরীরটা ভালো করে দেখিয়েএসো। নিজের শরীরটা ভালো করে রাখাটাই আসল কথা। না হলে টাকার আর কি প্রয়োজন?’

সঙ্গে বসে থাকা দুয়েক জনও কথাটিতে সায় দিয়েছিল।

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার ভেলোরে দেখিয়ে আসা উচিত।’


আরো পড়ুন: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-৪) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


ভেলোরে না হলেও রতিকান্ত মেডিকেল কলেজে অসুখটা একবার ভালো করে দেখিয়ে  আসার একটা আশা মনের মধ্যে অনেকদিন ধরেই পুষে রেখেছিল।এখন টাকার প্রসঙ্গটা ওঠার পরে তার সেই দমিয়ে রাখা ইচ্ছেটা দুর্বার হয়ে উঠেছিল।হ‍্যাঁ, টাকাগুলি পাওয়া গেলে মেডিকেলে যাওয়া যেতে পারে।গ্রামের গোলকের ট্যাক্সিটা  রিজার্ভ করে ভালো ডাক্তারকে দেখিয়ে আসা যেত – এই অবস্থায় এখন সে বাসে করে তো আর  যেতে পারবেনা ।

ভেলোরে নাহলে মেডিকেল। মেডিকেলে তো পারবে।

ইস, টাকাগুলি তাড়াতাড়ি পেলে অনেক কাজই করতে পারা যাবে ।

রতিকান্ত পুনরায় একবার আকাশের দিকে তাকালো। পেঁচাটা নেই। রোদ এসে কাঁঠালপিড়িটার কোণ স্পর্শ করছে। কিছুক্ষণ পরে তার শরীরে উত্তাপ বহন করে আনবে। রোদের উষ্ণতার কথা ভেবে তার মনটা ভালো লেগে গেল। ছিঃপ্রেম এখনও এসে পৌছালো না। কোথায় গিয়েপড়ে আছে সে? মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কিনা। মানুষটা কি চলে গেছে। পুনরায় এক ধরনের উৎকণ্ঠারতিকান্তকে এসে চেপে ধরল। 

প্রেম লেংচেলেংচে মাঠের মাঝখানের পথটা দিয়েবাড়ি ফিরে আসছিল ।

সকালের উজ্জ্বল রোদে চারপাশটা ঝলমল করছে।

আধা কাঁচা আধা পাকা ধানে মাঠ ভরে উঠেছে। সকালের রোদে সোনালী রং ধরতে শুরু করা মাটি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিল। প্রেম সেই প্রখর উজ্জ্বলতা সহ্য করতে না পেরে চোখ দুটি বুজেনিয়েপিরপির করে তাকাতে লাগল।

আকাশটা এত গাঢ় নীল হয়ে পড়েছে যে চারপাশে পাতলা বেগুনি রং একটা ছড়িয়েপড়ছে বলে মনে হচ্ছে। গাছের পাতাগুলি হয়ে পড়েছে উজ্জ্বল সবুজ।

প্রেম চোখ জোড়া পিরপির করে দূরের ধূসর বাঁশ গাছের সীমা ঢেকে রাখা বিশাল মাঠটার দিকে তাকাল। এক ঝাঁক কোমল বাতাস ধানক্ষেতের উপর দিয়েবয়ে চলেছে। বাতাসে শীত শীত ভাবটা তখনও রয়েছে।

ভোরবেলা চারপাশ আলোকিত হওয়ার  আগেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

বাবা ঠিকই অনুমান করেছিল। গতরাতে রাজধানী থেকে আসা মানুষটার সঙ্গে সে দেখা করতে পারল না। যতীনদেরবাড়িতে আসা মানুষটা এসেই কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে। প্রেম অনেকক্ষণ ধরে মানুষটার জন্য যতীনদের বাড়ির বারান্দায় বসে অপেক্ষা করল। উচু পাকা বারান্দা থেকে পা দুটো ঝুলিয়ে বসতে আরাম লাগে। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত প্রেম যতীনদের বাড়ির বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসেছিল।

তার বিরক্তি লাগছিল।মানুষটাএসে কোথায় যে গেল সে কিছুই বুঝতে পারল না। সে কোনো খোঁজ খবর এনেছে কিনা তাও বুঝতে পারল না। বাবার গালিগালাজেরভয়ে সে অপেক্ষা করে থেকে কিছু একটা খবর নিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করে বসে রইল। বারান্দাটাতেমশার বিরাট উৎপাত। মশাগুলি গুনগুন করে তার শরীরের চারপাশে উড়েবেড়াচ্ছিল। কাঁধে ফেলে রাখা গামছাটা দিয়ে সে মশাগুলিকে তাড়াচ্ছিল।

নটারসময় সে বুঝতে পারল যে মানুষটা আর ফিরে আসবে না। রাতে সে অন্য কোনোখানে থাকবে। সকালে শহরে ফিরে যাবার সময়চিঠিপত্রনেবার জন্য একবার যতীনদেরবাড়িতে ঢুকে যাবেন। যতীনের মা দরজা বন্ধ করতে বাইরে এসে তাকে দেখে চমকে উঠেছিল।

‘ কে, ও কে  বসে আছে?’ মানুষটাচিৎকার করে উঠেছিল।

‘ আমি, আমি প্রেম।’ সে  থতমতখেয়ে উত্তর দিয়েছিল। মুহূর্তের জন্য তার চোখেও ঘুম নেমে এসেছিল।

‘ তুই এখনও যাস নি নাকি?’

‘ না। মানুষটা আসবে বলে অপেক্ষা করে রয়েছি।’

‘ আজ আর আসবে না। অন্য কোনোখানে থাকবে। এসেই বেরিয়েগেল।ভোরে আবার আসবে।যাবার আগে দেখা করে যাবে। আমি দুটো চিঠি দেব।’

প্রেম লাঠিটতে ভর দিয়েবারান্দায় বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়াল।

‘ তুই সকালে আসবি যা’– মহিলাটি বলেছিল।’ তাড়াতাড়ি আসবি। তাহলেই দেখা হবে। মানুষটা এখানে এসে চা জল খাবার খাবে।’

লেংচে লেংচে সে ওখান থেকে রাস্তায়বেরিয়ে এসেছিল। মাঠের মাঝখান দিয়েজ‍্যোৎস্নালোকে সে ফিরে আসছিল।

রাতের বেলা মাঠটা এত আলাদা আলাদা বলে মনে হচ্ছিল, এখন দিনের বেলায় তার একটি সম্পূর্ণ আলাদা রূপ। রাতে কাসিরমতো চাঁদটা বেগুনি আকাশে চকচক করে ঘুরতে থাকা বলে মনে হচ্ছিল তার। পাতলা গোলাপি রঙের কিছু মেঘ চাঁদটার আশেপাশে উড়েবেড়াচ্ছিল। পথের একপাশে বাঁশ বনে অহরহ ঝিল্লি ডেকে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই শব্দময়তার ওপরে চারপাশে যেন বিরাজ করছিল এক আদিম নৈশব্দ। প্রেমের ভয় লাগছিল। গতরাতে এই পথ দিয়ে ফেরার সময় তার শরীরে তীব্র শিহরণ জেগেলোমগুলিখাড়া হয়ে পড়েছিল। আজ দিনের বেলা সেসব কিছুই নেই– রাতের রহস্যের কোনো চিহ্ন নেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত