| 29 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: স্বর্গ দরজার দারোয়ান । সাদিয়া সুলতানা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

১.

জালালের শেষকালের সন্তান পামোছা যে এমন একটা দুঃসাহসের কাজ করে ফেলবে তা কেউ ভাবেনি। জালালও ভাবেনি। কিন্তু আজ কাকডাকা ভোরে হিরু, যোগেশ বাড়ি বয়ে এসে পামোছার বাবা হওয়ার পুণ্যে তাকে যে বাহবা দিয়ে গেল, সে কথা তো আর ফেলে দেওয়ার নয়। যদিও নিজের ছেলের সাহসিকতার বিষয়টি এখনো এই ভরদুপুর পর্যন্তও জালালের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। ঔরসজাত পুত্রের গুণের দৌড় তার অজানা নয়। হিরু আর যোগেশের কাছে ছেলের গুণকীর্তন শুনতে শুনতে জালালের মাথার ভেতর একটা প্রশ্নই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘হারামি জুতাচোরটা রাত দুপুরে মন্দিরে কী করতে গেছিল?’

সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে জালাল উদভ্রান্তের মতো স্ত্রীকে ডাকে, ‘পামোছার মাও। তোমার গুণের পোলার কিত্তি দেখছ? মসজিদে ঘুমানোর জায়গা পায় না হারামি জুতাচোর, মন্দিরে ঘুমায়।’

স্বামীর কথা শুনে বরাবরের মতো স্নেহের প্রাবল্যে শেষকালের সন্তান পামোছার জন্য খুনখুন করে কাঁদে জয়তুন। তবে আজ এই কান্নার সঙ্গে অহংকারের অনুভবও মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে, যদিও সেই অনুভব বাইরের পৃথিবীকে বুঝতে দেয় না সে।

সন্তান জন্ম দিতে দিতে জয়তুন আর সংসার উভয়ের শরীর-স্বাস্থ্যের যখন ভঙ্গুরদশা তখন আর শেষ বয়সের অনাকাঙিক্ষত সন্তানের নামকরণ নিয়ে বাড়ির কেউ মাথা ঘামায়নি। অযত্ন আর চিহ্নিতকরণের সুবিধার্থে শেষকালের সেই সন্তানের তবু একটা নাম জুটে গিয়েছিল। পামোছার দাদীর চাপাচাপিতে পামোছার বাবা জালালকে ষষ্ঠ সন্তান জন্মের মাস ছয়েক পর নামকরণসহ আকিকার জন্য নগদে একটা খাসি জবাইও দিতে হয়েছিল কিন্তু নিজের সেই ভালো নাম পামোছার আজো অজানা। জালালও ঐ নাম মনে করে না। ছেলের কীর্তিকলাপ দেখে দিনরাত শাপ-শাপান্ত করতে করতে কবে যে ছেলের নাম পামোছাই টিকে গেছে তাও জালাল জানে না।

অবশ্য নাম যাই হোক পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে পামোছাকে গ্রামের যে কেউ গোনায় ধরতে বাধ্য। বড় সুশীল বেশভূষা তার। মাথায় হালকা ঢেউ খেলানো চিরুনি টানা তেলে ভেজা চুল, পরনে পরিষ্কার লুঙ্গি, গেঞ্জি অথবা ফতুয়া, পায়ে বাটার ঝকঝকে স্যান্ডেল। পামোছার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে তার এই পরিপাটি সাজ বেশ বেমানান। তবে তার এই ধোপধুরস্ত চেহারার পেছনে কারো বিস্তর প্রশ্রয় আছে বোঝা যায়।

পামোছার বন্ধু বান্ধবের কাছে ইদানিং গল্প শোনা যায়, শীঘ্রই নতুনবাজার হাট থেকে সে একটা সাইকেল কিনবে। শেষকালের সন্তানের প্রতি জালালের দরদ না থাকলেও পামোছার মায়ের ব্যাখ্যাহীন মায়া মহব্বতের সীমা নেই। স্বামীকে আড়াল করে মুরগির ডিম বেচার টাকা থেকে সে ছেলের হাতে দু-দশ টাকা দেয়। আর দিবেই না কেন। ছয় সন্তানের মধ্যে একে একে সবাই জীবন-জীবিকার তাগিদে নিজেদের বুঝ বুঝে নিলেও পামোছা কখনো বাবা-মার সঙ্গে হিসাব-নিকাশে জড়ায়নি। তাছাড়া তার পেটের দোষেই তো শেষকালে ছেলেটার জন্ম, যার হুজ্জোতে গ্রামে বাপের মুখ দেখানো দায়। তবে মা হয়ে তিনি সন্তানকে ফেলে দেন কী করে! তাই তো মওলানা সাবের কাছ থেকে পানি পড়া এনে আর মানত রোজা রেখে ছেলের কৃত দুষ্কর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তিনি প্রতি সপ্তাহে পানাহ চান। যদিও মায়ের এত সাধনার পরেও পামোছার বাউন্ডুলে স্বভাবের কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না।

এখন এই গ্রামে ধর্ম-কর্ম না করে বেড়ানো এক উপদ্রবের নাম পামোছা। সাত বছর বয়সে মসজিদে জুতা চুরি করতে গিয়ে যেদিন পামোছা ধরা পড়েছিল, সেদিনই জালাল বুঝে গিয়েছিল পামোছা জীবনভর অধর্ম করেই কাটাবে। ছেলেকে আমপারা-কায়দা ধরিয়ে মক্তবে পাঠানোর পরও জালালের মন কুডাক ডেকেছিল। জালালের খুব ইচ্ছে ছিল ছেলেকে হাফেজি পড়াবে। অন্য ছেলে-মেয়েরা কেউই প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিয়েছেন বিবাহযোগ্য হবার সঙ্গে সঙ্গেই। এক ছেলে বাদশাহ ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে আর এক ছেলে খাদেমকে ছোট একটা মনোহরি দোকান করে দিয়েছেন, সে এখন গঞ্জেই থিতু হয়েছে।

জালালের বয়স হয়েছে, শরীরের সঙ্গে মনও দুর্বল হয়ে গেছে। মনের গহীনে তার সাধ ছিল, পামোছাকে হেফজ করাতে পারলে তিনি সহজ পথে জান্নাতী হবেন। কিন্তু মাদ্রাসামুখো হলোই না ইবলিসটা। একবার ধরে বেঁধে ভর্তি করে দেওয়ার পরের দিনই পালিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। সেবার নিমের ডাল দিয়ে ছেলেকে পেটাতে পেটাতে প্রায় মেরেই ফেলেছিল জালাল। অত মার খেয়েও ছেলের মতি পাল্টায়নি। আজকাল গ্রামে এমন কোনো অধর্মের কাজ নাই যে পামোছা আর তার সঙ্গীরা করে না। ছেলের কীর্তিকাণ্ডে লজ্জায় জামাতে নামাজ পড়া ছেড়েছে জালাল।

ছেলে আর ছেলের মাকে গালমন্দ করতে করতে নিজের শরীরে সাবান ঘষে গায়ে পানি ঢালে আর সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে জালাল, ‘হারামি জন্ম লইসে তোমার প্যাটে। জালিমটার নাম পামোছা না রাইখা আমার নাম পামোছা হওনের কাম আছিল। জীবনভরা আমার শইলে পা মুছলো হারামিটা। মাইনষে এখনো আমারে মসজিদের জুতাচোরের বাপ কয়। আইজ আবার নতুন নাম দিবো। মুসলমানের ছাও হইয়া হিদুর মন্দিরে ঘুমায়? চোর পাহারা দেয়? হারামি, ঘুমাইলে মসজিদে ঘুমা! মন্দিরে গেছস ক্যা?’

কান্না ভিন্ন জয়তুনের আর কোনো অস্ত্র নেই। সন্তান তার পেট থেকে পড়েছে তাই তার অধর্মের দায় তো তারই। নিজের অপরাধবোধে স্বামীকে মুখ ফুটে একবার বলতেও পারে না যে, ছেলেকে দেখতে হাসপাতালে যাবে আর ছেলের বিবাগী হবার কারণ ছেলের বাপই। মাচার লাউ বিক্রির দোষে দুদিন আগে ছেলেটাকে বাড়ি ছাড়া করেছে। অতটুকু পোলা কই যাইব? জুতাচোরের বদনাম নিয়া কী মসজিদে থাকন যায়? কিন্তু সাহস করে জয়তুনের স্বামীকে আর কিছুই বলা হয় না বরং স্বামীর গোসল সারা হলে অনুগামী ভৃত্যের মতো কলপাড়ে কাপড় ধুতে বসে যায়।

২.

বহদ্দারপুরের সর্বজনীন দূর্গা মন্দিরের শ্যামা প্রতিমার ডান হাতের তিনটি ও বাম হাতের দুটি আঙুল এবং মহাদেবের হাতের সাপ গতকাল মাঝরাতে কে বা কারা যখন ভেঙে চলে যাচ্ছিল, তখন বটগাছের তলায় ঘুমিয়ে থাকা পামোছা তাদের জাপটে ধরতে গিয়েছিল। এই ঘটনার দুদিন আগে পামোছার বাপ ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় মন্দিরের সামনের এই বটতলাতে আস্তানা গেড়েছিল সে। নিজাম ওর বাড়ি থেকে একটা পাটি, দুটো কাঁথা এনে দিয়েছে। এমনিতে রাত্রিতে ঘুমোতে ঘুমোতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল পামোছার। নতুন বাজারে ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে আড্ডাবাজি করে, তাস পিটিয়ে গাঁয়ে ফিরেছে। এরপর বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বটতলায় বসে বন্ধু জসিমের সঙ্গে মনের সুখ-দুখের কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গিয়েছিল। হাতে টাকা নেই বেশি। এদিক-সেদিক করে বন্ধুরাই খাওয়াচ্ছে। বন্ধুরা পামোছাকে খুব ভালোবাসে। চুরির বদনাম থাকায় কেবল কেউ ওকে বাড়ি পর্যন্ত তোলার সাহস করে না।

পামোছার বয়স এখনো আঠারো পেরোয়নি। সামনের অগ্রহায়ণে আঠারো হবে। শরীরের গড়ন মাঝারি, পেটা শরীর। আজকাল গোঁফের সরু রেখাটাকে কায়দা করে ছেঁটে রাখে। ছায়াবানী হলে দুচারটা সিনেমা দেখে দেখে পামোছা মারের ভালো প্যাঁচও কষতে জানে। কিন্তু মাঝ রাত্তিরে হানা দেওয়া অত দশাসই লোকের সঙ্গে পারবে কেন পামোছা? অন্ধকারে ওরা ভালো করে দেখতে পায়নি বলে চাকুর ঘাঁইটা ওর সিনায় লাগেনি। চাকুটা তেছরা হয়ে ওর বাম বাহুতে আটকে ছিল। পামোছার চিৎকারে ঠাকুরমশাই যখন দৌড়ে আসে তখনও পামোছা বুঝতে পারেনি কতটা ব্যথা পেয়েছে। সে দ্বিগুণ উৎসাহে চিৎকার করে উঠেছিল, ‘পালাইলো কাকা, চোর পালাইলো।’

গ্রামে পামোছার দুর্নামের কমতি ছিল না বলে ঠাকুরমশাই পামোছাকেই চেপে ধরেছিল, ‘মায়ের ঘরে পা দিছিস! ওরে পাপিষ্ঠ!’ পরে আহত পামোছার মুখে সব শুনে ঠাকুরমশাই প্রতিমার সামনে দুহাত তুলে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে পামোছাকে মন্দিরে তুলেছিলেন। দু-চারজন লোক যোগাড় করে দলে-বলে পামোছাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই পামোছাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে আর্শীবাদ করে এসেছে। জালাল ছেলেকে দেখতে যায়নি, বাড়িতেও ফিরিয়ে আনেনি। এদিকে পামোছার চাকরি হওয়ার খবরটা বাতাসে ভেসে ভেসে জালালের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশি দেরি হয়নি। সকালে সেই খবর পেয়ে অন্ধক্রোধে জালাল পাতের ভাত শেষ না করে উঠে পড়েছিল। আনন্দের আতিশয্যে জয়তুন স্বামীর চোখের অগ্নিবলয় খেয়াল করেনি। বারান্দায় ছড়ানো ঝুটা বাসন-কোসন দ্রুতগতিতে সরিয়ে নিয়ে ছেলের জন্য বাটিতে তোলা তরকারি সযতনে সরপোশে আড়াল করে তাকে তুলে রেখেছে। এরপর গর্বিত চেহারায় স্বামীর হাতে পানের খিলি তুলে দিতে দিতে মনের ভেতর চেপে রাখা আনন্দ সংকোচহীন প্রকাশ করে বলেছে, ‘এই পরথম আমাগো পোলা কামাইরুজি করবো। মাজারে সিন্নি দিমু, মানত করছি। পোলাডারে আইজ একটু বাড়িত ডাক দিয়া আনবেন?’

মূর্খ মেয়েলোকের দিকে তাকিয়ে জালালের শরীর জ্বালা করতে থাকে। সে চিৎকার করে ওঠে, ‘চাকরি তোর পোলার…ভর। কি চাকরি নিছে শুনছস? তোর ঘরে একখান বেজাত, কাফের পয়দা হইসে।’ অপরাধের মাত্রা বুঝতে না পেরে থতমত জয়তুন ভেতর ঘরে চলে যায়। চৌকিতে বসে নিজের মাতৃ জীবনকে পূর্বাপর পরখ করে। তের বছর বয়সে মনোহর দোকানী জালালের ঘরে পা দিয়ে তিন মাস না ঘুরতেই বমি করে কলপাড় ভাসিয়েছিল। এরপর তার প্রথম সন্তান হেনা। মাস-বছরের চাকা ঘুরে একে একে মিনা, নবাব, বাদশাহ, খাদেম, পামোছা এসেছে কোলজুড়ে। আরেক মেয়ে আঁতুড়ঘর থেকে বের হয়েই নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছিল। ছেলে নবাব মারা গিয়েছিল বছর দুই ডাঙর হলে। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ায় পামোছা ছাড়া হাতের নাগালে এখন আর কেউ নেই। সেই ছেলের গৃহ প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায় জয়তুন সতৃষ্ণ চোখে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

৩.

মন্দিরে দারোয়ানের চাকরি পেয়ে পামোছার জীবনে বেশ পরিবর্তন এসেছে। দায়িত্ববান পামোছা এখন রোজ বটতলাতে বসে থাকে। কাজের সময়ে বন্ধু-বান্ধবের ডাকে সে এদিক-সেদিক কোথাও যায় না। ঠাকুরমশাই হরির সহকারী হিসেবে তাকে কাজে নিয়োগ দিয়ে হরি আর পামোছার দিন-রাতের কাজের সময় ভাগ করে দিয়েছেন। কিন্তু পামোছা কাজে যোগদানের মাস খানেক যেতে না যেতেই একটা অঘটন ঘটে গেল।

আজ সকালে ঠাকুরমশাই মন্দিরে ঢুকে দেখেন মেঝেতে পূজার বাসি ফুল ছড়ানো। পিতলের পূজার থালা-বাসনকোসন নেই। দেবীর আসনটা বাঁকা হয়ে আছে। অলংকারহীন দেবীর দিকে তাকিয়ে ঠাকুরমশাই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। নিজেকে সামলে নিয়ে তখন থেকে ঠাকুরমশাই মাথায় হাত দিয়ে নিশ্চুপ বসে আছে। ঠাকুরমশাইকে চুপ করে থাকতে দেখে হরি হৈ হৈ করতে করতে জানায়, শ্যামা প্রতিমার গলার হারখানাও নেই। সকালে হরি মন্দিরে পা রেখে সবার প্রথমে এই দুর্দশা দেখে অদৃশ্য পাপিষ্ঠকে শাপ শাপান্ত করতে করতে ঠাকুরমশাই এর ঘুম ভাঙিয়েছে। এই অঘটন ঘটেছে ভোর-রাতের আগে। ভোর রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত হরির ডিউটি থাকে আর পামোছার ডিউটি বাকি সময়টা। হরি আসার পর থেকে পামোছাকে আশে-পাশে কোথাও দেখেনি।

মন্দিরে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভিড় করা জনতার মাঝে মৃদু গুঞ্জন চলছিল! ঘটনা তরঙ্গে ধাতস্থ হতে জনতার সময় লাগে না। অতি দ্রুত বাড়তে থাকা মানুষের জটলা তার আদিম খোলস ধারণ করে বচসায় লিপ্ত হয়। উৎসুক জনতার মধ্যে ধর্মের নামে অধর্মের আলোচনা দেখে অদ্ভুত এক বিপন্নতায় কাতরান ঠাকুরমশাই। গেলবার হিন্দুপাড়ার দুর্গোৎসবের ঢোলের সঙ্গে যে যুবকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেচেছে তারাই আজ সন্দিগ্ধ চোখে পরস্পরের তফাতে দাঁড়িয়ে আছে।

উঠতি বয়সের তরুণদের কেউ কেউ মারমুখী হয়ে মায়ের নামে প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করে। পাঁচ মাসের ব্যবধানে মন্দিরে দু’দুবার হামলার ঘটনায় বিচলিত গ্রামবাসী নিজেদের মধ্যে বিভেদের দেয়ালে ইট গাঁথতে তৎপর হয়। দুপুরের মধ্যেই ডিসি অফিসে স্মারকলিপি নিয়ে যাবে বলে মন্দির কমিটি বেলা দশটা নাগাদ বিশেষ সভা আহবান করে। গ্রামের কয়েকজন আলেম ব্যক্তি ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাদের সহযাত্রী হবে বলে জানান। এসব হুল্লোড়ের মাঝে কে যেন অভিযোগ করে, ‘বেড়ায় আবার খেত খাইয়া যায় নাই তো!’ এই কণ্ঠের সঙ্গে অনেকেই সম্মতি দেয়, যে মানব সন্তান মসজিদে জুতা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, মন্দিরে দেবীর গহনা চুরি করা তো তার কাছে ছেলেখেলা। হরি পুরো নিশ্চিত হয়ে হাহাকার করে ওঠে, ‘পামোছাই দেবীর গয়না চুরি কইরা ভাগছে।’

জনতার ভিড় থেকে চৌকস একজন ঠাকুরমশাইয়ের নির্বুদ্ধিতাকে ভর্ৎসনা করে বলে, ‘বিধর্মীকে মায়ের ঘর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিলে তার দণ্ডতো পেতেই হবে।’ জোয়ান তাগড়া দুজন ছেলে পামোছাকে খোঁজার জন্য কোথা থেকে বাঁশের লাঠি যোগাড় করে যুদ্ধসাজে প্রস্তুত হয়ে জনতার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে, ‘ওর পাইলে জ্যান্ত চিতায় তুলুম। আসেন, সাথে যাইবেন কে কে? আওয়াজ দ্যান খালি।’

ঠাকুরমশাই যুবকদের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলে, ‘পামোছা সাক্ষাৎ দেবতার অবতার। ছেলেটা নিজের প্রাণ দেবে তবু মায়ের অনিষ্ট হতে দেবে না। ঠাকুর জানে আর আমি জানি পামোছা একাজ করেনি।’ বলতে বলতে ঠাকুরমশাই চোখ মুছতে থাকেন। জনতার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বমুখর কোলাহল ভেদ করে কে একজন চিৎকার করে জানায়, পামোছাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। মন্দিরে হানা দেওয়া ডাকাতরা ওকে আধমরা করে ফেলে রেখে গেছে। সে নিজের চোখে পামোছাকে মন্দির থেকে পূর্ব পাশে আধ মাইল দূরের রাস্তার ধারের নয়নজুলির ঝোপের আড়ে পড়ে থাকতে দেখেছে। ছেলেটার মাথা রক্তে ভেসে গেছে। উৎসুক জনতা হৈহৈ করে বক্তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে।

পামোছা শুয়ে আছে নির্জীব। উপুড় করা আকাশের একপাল মেঘ ঘিরে আছে ওকে। পামোছা অপলক সেই আকাশে তাকিয়ে থাকে, যেন তন্ময় হয়ে থাকে কোনো দূর লক্ষ্যের দিকে। ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টি আকাশের পথ অতিক্রম করে ওপরে উঠতে থাকে। কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিবাতাস মিহি দানার মতো পামোছার শরীর ছুঁয়ে উড়ে উড়ে চলে যায় দূর শূন্যলোকে। ভেজা মাটির পাললিক ঘ্রাণ ভেসে আসে। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস গায়ে এসে লাগতেই কোনো দৃশ্যাতীত পারলৌকিক মোহ ওকে আচ্ছন্ন করে ওর শরীরের ব্যথা কমিয়ে দেয়। ঠাকুরমশাইয়ের কথা মনে পড়ে ওর।

ঠাকুরমশাই বলেছিল, জগৎসংসারের বেশিরভাগ লোকই ক্ষুধার্ত শেয়ালের মতো। যাদের চারপাশে শুধু লোভের পাহাড়। এই দিগভ্রান্ত মানুষেরা দিনরাত চোখ-মুখ দিয়ে আত্মার ক্ষয় করেই চলে। নিজেরাও টের পায় না, মিথ্যার উৎকট দূর্গন্ধ তাদের আত্মাকে কখন বিষাক্ত করে ফেলে। স্বর্গে এদের কোনো স্থান নেই। স্বর্গের সিঁড়িতে পা রাখতে পারবে অল্প সংখ্যক সৌভাগ্যবান মানুষ, যারা মানুষ নামক দেবতা। যাকে অভ্যর্থনা জানাতে স্বর্গের দরজার দারোয়ান অপেক্ষো করছে। ঠাকুরমশাইয়ের কথা শুনতে শুনতে পামোছা ভেবেছিল, সে স্বর্গের দরজার দারোয়ান হবে।

পামোছা বোঝে না স্বর্গের সিঁড়ি দিয়ে কি কেবল দেবতারাই উঠবে? আর স্বর্গের প্রবেশদ্বারের চেকপোস্টে আটকে যাওয়া মানুষগুলো কি জ্বলতেই থাকবে পাপের উত্তাপে? স্বর্গ আর নরকের দরোজার দূরত্ব কয় হাত কাছে-দূরে? এসব কঠিন কঠিন প্রশ্ন পামোছার মাথার ভেতর পাঁক খেতে থাকে। রক্তের চিকন ধারা নাকের ধার বেয়ে ওর ঠোঁটের কোণে পৌঁছে থমকে যায়। পামোছা ঠোঁট চেটে নোনতা স্বাদ নিতেই মায়ের হাতের নুন মাখানো ভাত-সালুনের লোকমার স্বাদ ওর জিহবাকে সরস করে তোলে। পামোছা ক্ষীণ স্বরে ডাকে, মা, মা। কে একজন পরম আদরে ওর মাথায় হাত বুলায়, পামোছা এক হাতে সে হাত আঁকড়ে ধরে বুকের পরে রেখে কাতরায়, ব্যথা লাগে রে মা! খুব ব্যথা। পাশে থাকা মানুষটি মায়ের মমতায় কাতর গলায় বলে, ‘বড় পুণ্যির কাজ করছিস রে! চিন্তা কী! তুই স্বগ্গে যাবি।’

পাপ-পুণ্যের দোলাচলে ভাসতে ভাসতে পামোছা নিজেকে আবিষ্কার করে অচেনা এক সিঁড়ির ধাপে। তারপর অহিংস সাদা আলোয় ভাসতে ভাসতে স্বর্গের প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। পামোছা চোখ বুঁজে দেখতে পায় সামনে স্বর্গীয় আলোর ঝলকানি, যে আলোতে দেখা যায় স্বর্গ দরজার দারোয়ান ওর জন্য সফেদ পোশাক হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত