| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: রাবণ পত্নী মন্দোদরী। পারমিতা চক্রবর্ত্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 

মন্দোদরী সবে স্নান সেরে গায়ে সুগন্ধী মাখছেন৷ কেশ থেকে নির্গত হচ্ছে গোলাপের সুবাস৷ কেশের জল একটু একটু করে ছুঁয়ে চলেছে তাঁর শরীর৷ ৷

এলোমেলো শরীর যেন কারোর জন্য অপেক্ষায় রত।

কেউ কী অপেক্ষা করছেন মন্দোদরীর জন্য ! মন্দোদরীর সঙ্গীদের সাথে ইদানিং মন খুলে কথা বলেন না৷ তাঁর এক দাসী সর্বদা তাঁর সাথে থাকে৷সে মন্দোদরীকে এত উদাস হতে আগে কখনও দেখেনি। মন্দোদরীকে সে খুব ভালোবাসে৷ নিজের হাতে সাজিয়ে দেয় তাঁকে৷ সূর্যের আলো আয়নায় পড়ে এক দ্যুতি নির্গত হয় মন্দোদরীর মুখ থেকে৷ এমনই সময় অন্য এক দাসী এসে জানায়

– রাজকুমারী  রাজামশাই আপনাকে  সভাকক্ষে যেতে বলছেন৷ উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ৷ বাইরের দেশ থেকে এক রাজা  অনেক সৈন্যসামন্ত নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন ৷ তাঁদের অতিথিশালায় নিয়ে যাওয়া হবে৷

– আচ্ছা যাও তুমি৷ আমি এখনই আসছি৷

– রমা তোমার কী মনে হয় কেন এমন সময় ডেকে পাঠালেন পিতাশ্রী আমাকে?

– আপনি তৈরী হয়ে নিন রাজকুমারী৷ আমি সংবাদ নিয়ে আসছি৷

রমা মন্দোদরীর দাসী হলেও বন্ধু বলে মনে করে নিজেকে৷ মন্দোদরীর প্রতি মুহূর্তের খবর রাখে সে৷ রমা সব সংবাদ নিতে অক্ষম হয়৷ কেউ কিছু বলে না৷অগত্যা সে ফিরে আসে এবং মন্দোদরীকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। লাল রঙের বেনারসী ও লাল ভেলে মন্দোদরীকে অপূর্ব দেখতে লাগে৷ রমা তাঁর থেকে চোখ সরাতে পারছিল না৷ মন্দোদরীকে  সুন্দর রূপে সুসজ্জিত করে  তারা রওনা দেয়। রমার আগ্রহ ইতিমধ্যে বাড়তে থাকে৷ সে দেখে সভাকক্ষে প্রচুর ভিড়৷ চারিদিকে জনসামাগম। ইতিমধ্যে রাজকুমারী মন্দোদরীর আগমন ঘটে৷ কক্ষে প্রবেশ করেই মন্দোদরী দেখেন এক সৌম্যকান্তি পুরুষ বসে আছেন তাঁর পিতাশ্রীর ঠিক পাশেই। রমা লক্ষ্য করে মন্দোদরী আবেগমিশ্রিত নয়নে  তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে ৷

– কে এই অপরূপ পুরুষ? কী সুদর্শন চেহারা, মায়াবী ব্যক্তিত্ব৷ দুই চোখ রক্তজবা ৷ কে এই ব্যক্তি

রাজামশাই  তাঁর সাথে রাজকুমারীর পরিচয় করানোর সুযোগই পান না ৷ রমা বার বার ভাবতে থাকে অভ্যাগতর পরিচয়৷ তখনই পাশ থেকে রাবণ, রাবণ ধ্বনি ওঠে।

প্রাসাদকক্ষে  অন্যান্য মন্ত্রীদের সাথে কথা বলার সময় রাবণ লক্ষ্য করলেন অদূরে দাঁড়ি়য়ে এক সুন্দরী তনয়া  বহুুক্ষণ ধরে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করে চলছেন৷ রমা পুরো বিষযটি দেখে৷ তাঁরা একে অপরের থেকে চোখ সরাতে পারে না৷ রমা বুঝতে পারে মন্দোদরীর মধ্যে প্রবল ইচ্ছা জাগে তাঁর সাথে আলাপ করার কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল হয় না ৷ মন্দোদরীর মধ্যে শুরু হয় দোলাচল ৷ তারা  সেই স্থান থেকে  প্রস্থান করে কারণ রাজামশাই নতুন অতিথির  বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু রমা দেখে মন্দোদরীর নতুন অতিথিকে নিয়ে কৌতূহল কিছুতেই কমে না৷ সেই রাতে চোখে ঘুম আসে না মন্দোদরীর৷ সারারাত ধরে ভাবতে থাকেন তিনি সুন্দর অনুভূতির কথা৷ নতুন অতিথি  কী এখন তাঁকে নিয়ে ভাবছেন ! নিজের মনকে  বার বার প্রশ্ন করেন মন্দোদরী৷ রমা তাকিয়ে দেখে রাজকুমারী তখনও ভেবে চলছেন৷ সেই রাতে রাবণ মন্দোদরীর প্রাসাদের অতিথিশালায় রাত্রিবাস করলেন ৷ মাতা তখন মন্দোদরীর কক্ষে প্রবেশ করলেন। মন্দোদরী নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না। রমা শোনে তাঁদের কথোপকথন৷

– মাতা উনি কে? যিনি আমাদের অতিথিকক্ষে রাত্রিবাস করছেন?

মাতা  হেমা তাঁর কন্যাকে জানান

-উনি লঙ্কারাজ রাবণ ৷ তোমার পিতার আমন্ত্রণে এসেছেন৷

তিনি রাবণ সম্পর্কে নানা গল্প করলেন তাঁর কাছে৷ তিনি বললেন -ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রান্ত তাঁর ক্ষমতাধীন এবং তাঁর রাজ্যের প্রতিটি দেওয়াল সোনার তৈরী I প্রজাগণ এই সাম্রাজ্যের নামকরণ করেছে “স্বর্ণলঙ্কা” এবং রাবণকে তারা ” লঙ্কেশ” নামে অভিহিত করেন ৷ মন্দোদরীকে যিনি ছোট থেকে মানুষ করেছেন তাকে তিনি মাই বলে ডাকেন। মাই  এবং মাতা হেমা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অতিথিকক্ষে রাবণের আতিথেয়তার জন্য। তাঁরা মন্দোদরীর কক্ষ ত্যাগ করলেন৷  তাঁদের অতিথিশালাটি বেশ বিলাশবহুল এবং রাবণও খুব স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন সেখানে৷ মন্দোদরী  রমাকে জানান তিনি রাবণের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান৷ সে যেন কিছু ব্যবস্থা করে দেয়৷ মন্দোদরী নিজেকে প্রস্তুত করেন মনে মনে রাবণের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য৷ পরবর্তী দিন মাইয়ের থেকে সমস্ত তথ্য  সংগ্রহ করে মন্দোদরী রাবণের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাবেন স্থির করলেন কিন্তু তখনই জানতে পারলেন রাবণের ফিরে যাওয়ার সময় ৷ রমা তাঁকে জানান রাজা মায়াসুরের সাথে রাবণের সাক্ষাৎ হবে দুপুরের মধ্যাহ্নভোজের সময়৷ সুতরাং ওই সময়ের আগে তিনি ফাঁকাই থাকবেন এবং তাঁরা একে অপরের সাথে কথা বলতে পারবেন৷ তারপর পুষ্পক বিমানে রওনা দেবেন রাবণ ৷ এই বিমানটি কুবের তাঁকে দিয়েছিলেন Iপ্রথমত পুষ্পক নির্মাণ করেছিলেন দেবতা বিশ্বকর্মা পরবর্তীতে তিনি এটি কুবেরকে দিয়ে দেন ৷ পুষ্পক বিমানটি মূলত শহর ,সমুদ্র , রাজত্বকে যুক্ত করে ৷ রাবণের পুষ্পক বিমান যখন মায়ারাষ্ট্রে অবতীর্ণ হয় সারা রাজ্যের মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে৷ বিমান বা ভী- মানা সংস্কৃত শব্দ৷ যার আক্ষরিক অর্থ ” পরিমাপ করা ” ট্র্যাভারসিং “বা “মাপানো হয়েছে”I

মন্দোদরী মাইকে প্রশ্ন করেন এবং রমা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।

-রাবণ তাঁর ভ্রাতাদের সাথে শিকারে যাবেন কিনা ?

মাই জানান রাবণের শিকার করার প্রতি কোন নেশা নেই, তা তিনি আগেই জানিয়েছেন ৷ ফলত রাবণের সাথে সারাদিন থাকবেন পিতাশ্রী৷ মন্দোদরীর  সে দিনটা কাটে উৎকণ্ঠায়, যদি একটি বারের জন্য দেখা হয় তাঁর সাথে ৷ কিন্তু …

বিকেলের দিকে মাই জোর করে তাঁর কক্ষে নিয়ে যান মন্দোদরীকে ৷সেখান থেকে পুষ্পক বিমান উড়তে দেখা যায় ৷ মন্দোদরীর বয়স তখন সবেমাত্র বারো বছর৷ তাঁর শিক্ষা  সবে সমাপ্ত হয় ৷ শিক্ষা বলতে মূলত যোগের মাধ্যমে শারীরিক প্রশিক্ষণ ,সাহিত্য ,রন্ধনশিল্প , সামাজিক বিজ্ঞান এবং দেব ও ওসুর ইতিহাসের জন্য কয়েকটি বেদপাঠ I  মন্দোদরী বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারতেন৷ অসুররা বড় যোদ্ধা ও বিজয়ী  সর্বক্ষেত্রে৷ তাঁরা পরাজয় স্বীকার করতে জানেন না ৷ অসুরদের কাছে দেবতাদের পরাজয়ের ইতিহাস যুগ যুগ ধরে কথিত আছে । মাইকে নির্দেশ দেন মাতা হেমা মন্দোদরী যেন রাজকন্যার সাথে সাথে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠতে পারেন সে দিকে যেন সে নজর দেয়৷ পত্নী কিংবা রাজবধূ  হবার সমস্ত শিক্ষা তাঁকে যেন দেওয়া হয়৷ মন্দোদরীর মনের কল্পনায় তখন একটি মাত্র পুরুষের বিচরণ৷ তাঁকে নিয়ে দ্বিধা , দ্বন্দ্ব দুইই বিরাজমান তাঁর মনে৷ রমা সবটাই বুঝতে পারে। কিন্তু মন্দোদরীর স্বামী ব্রাক্ষণ হবেন না অসুর তা নিয়ে উৎকণ্ঠা ভোগে রমার মত  সবাই৷ কিছুদিন পর মন্দোদরী আবিষ্কার করলেন তিনি এক গন্ধর্ব’র প্রেমে পড়েছেন তা জানান রমাকে ৷ রাবণকে মন্দোদরী ‘দশানন ‘ নামে ডাকা শুরু করলেন মনে মনে৷ তাঁর সাথে প্রথম  সাক্ষাতের মুহূর্ত যেন ক্রশকাঠির মত বিঁধতে থাকে তাঁর মনে ৷এইভাবে চার মাস অতিক্রান্ত হয় ৷ রমা ও মন্দোদরী আরও বন্ধু হয়ে ওঠে৷

একদিন মাই মন্দোদরীর কাছে এক নতুন ঘটনা শোনান দশানন সম্পর্কে ৷ লঙ্কাপতি রাবণ সদ্যই ব্রহ্মার দ্বারা  এক বর পেয়েছেন এবং খুব শীঘ্রই হয়ত তাঁর পিতাশ্রীর  সাথে দেখা করতে আসবেন  কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য৷ মন্দোদরী চুপ করে শুনলেন তার কথা কিন্তু মুখে কিছু বললেন না৷ অবশেষে সেই মুহূর্ত উপস্থিত হল  রাজ্যে৷ বিশাল মহাভোজের আয়োজন করা হয় সে উপল্যক্ষে৷ বিভিন্ন প্রকার মাংস ,কারী, ভাত ইত্যাদি পদ  প্রস্তুত করা হয় দশাননের  উদ্দেশ্যে৷ সেই ভোজে মহিলাদের ব্রাত্য রাখা হয় কারণ পিতাশ্রী দশাননের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন  বলে বলা হয় সবাইকে৷ মন্দোদরী  নিজেকে অন্তরমহলে আটকে রাখলেন এবং অপেক্ষা করলেন  দশাননের  সাথে সাক্ষাতের জন্যI রমা তাঁর সাথেই থাকে সে সময়৷ পরদিন যখন  মন্দোদরী তাঁর মাতার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য নিজের কক্ষের বাইরে পা রাখলেন দেখলেন সাদা এবং লাল পোশাক পরিহিত বেশ কয়েকজন সোনার থালা নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন ৷ থালাটি সোনার জরি দিয়ে সজ্জিত কালো ভেলভেট  দ্বারা আবৃত৷ তার  মধ্যে একটি  থালার মধ্যে রাখা সোনার বীণা৷ দশানন খুব ভালো বীণা বাজাতে পারেন। মন্দোদরীর  কাছে এই রকম উপহার প্রদান নতুনত্ব ছিল না কারণ তাঁর পিতাশ্রীকে প্রায়়সই অন্য দেশের রাজারা উপহার প্রদান করতেন  যুদ্ধে জয়লাভ করলে অথবা নতুন সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হলে ৷ মন্দোদরী বুঝতে পারেলেন না  উপহারগুলি কে পাঠিয়েছেন এবং কেন পাঠিয়েছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেউ পাঠিয়েছেন কিনা৷ তিনি তাঁর মাতার কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখেন  মাতা হেমা মাইয়ের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত এবং  তাঁরা দুজনেই খুব উচ্ছ্বসিত৷ মাতা মন্দোদরীকে  জানালেন একটি সংবাদ অপেক্ষারত তাঁর জন্য৷ মন্দোদরী জানতে চান মাতার  কাছে

– উপহারগুলি কারা পাঠিয়েছেন মাতা? মায়ারাষ্ট্রে কি কোন বড় অনুষ্ঠান হতে চলেছে?

মাতা জানান মায়ারাষ্ট্রে এক বড় অনুষ্ঠান আসতে চলেছে৷ মাইয়ের হাসি মুখ দেখে মন্দোদরীর আরো কৌতুহলী হয়ে পড়েন I

-কীসের  অনুষ্ঠান?

রমা বুঝতে পারছিল মায়ারাষ্ট্রে নতুন উৎসব আসতে চলেছে।

মাতা মন্দোদরীকে জানান উপহারগুলি এসেছে লঙ্কা থেকে৷ লঙ্কেশ্বর  একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন এই প্রভাতেl যা মায়ারাষ্ট্রের কাছে খুবই সম্মানজনক৷ লঙ্কেশ্বর মন্দোদরীকে বিবাহ করার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন ৷ মন্দোদরী তাঁর মাতার চোখে এই সুসংবাদের উচ্ছ্বাস দেখতে পান ৷ মাতা  ও মাই দুজনেই মন্দোদরীকে জড়িয়ে ধরেন এবং মন্দোদরী সম্পূর্ণ ঘটনায় বাক্যহারা হয়ে যান৷ আনন্দ ও দুঃখ ঘিরে ধরে রমাকে৷ এবার সময় হল তাদের বিচ্ছেদের। রাজকুমারীর জীবনে নতুন একজন আসতে চলেছে।

এতদিনে কি মন্দোদরীর স্বপ্ন সত্যি হলো!  লঙ্কেশ্বর কি সত্যিই তাঁকে ভালবাসেন ! এমন সংবাদ যে কখনো আসতে পারে তা ভাবতেই পারেননি  মন্দোদরী৷ তাঁর হৃদয় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মন্দোদরীর পিতাশ্রী এই প্রস্তাবে দ্বন্দ্বে পড়েন I তিনি  মন্দোদরীকে খুব স্বাধীনচেতা রূপে মানুষ করেছিলেন ৷ তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন রকম প্রভাব খাটাতে চাননি  কন্যার উপর৷ মন্দোদরী পিতামাতার খুব আদরের সন্তান৷ পিতা মায়াসুর ও মাতা হেমা তাঁদের দুই পুত্র সন্তান থাকা সত্বেও মন্দোদরীকে নিজেদের প্রাণের অধিক ভালোবাসতেন ৷ পিতাশ্রী দশাননের  পাঠানো সংবাদের কোন উত্তর দেবেন না ঠিক করলেন  যতক্ষণ না মন্দোদরী  এই বিবাহে সম্মত হন৷ মাই মন্দোদরীকে পিতাশ্রীর  সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন৷ এতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ আলাপচারিতা  যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল মন্দোদরীর I তিনি তো কাউকে বলতে পারেননি মনে মনে তিনি এটাই চাইছিলেন। একমাত্র রমা জানে সে কথা৷ তিনি তো নিজের মন দিয়েই ফেলেছেন দশাননকে৷ তাঁর আর কোন উপায় নেই৷ মন্দোদরীর জীবনে প্রথম পুরুষ দশানন৷ মনে মনে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেই ফেলেছেন তাঁর কাছে।

মাতাকে প্রশ্ন করেই ফেললেন মন্দোদরী

-সত্যিই দশানন আমাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করতে চান?

মাতা বুঝতে পারেন মন্দোদরীর মনের অবস্থা ৷ তিনি বলেন

– অবশ্যই আমরা এর জন্য  গৌরবান্বিত এবং এই বিবাহ মৈত্রী স্থাপন করবে লঙ্কা ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে I

মন্দোদরী কোন ভাবেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না গোটা ঘটনাটি ৷ আনন্দে জড়িয়ে ধরেন রমাকে৷

রাজা মায়াসুর পায়চারি করেন তাঁর কক্ষের মধ্যে৷ তখনই মন্দোদরী প্রবেশ করেন সেখানে৷ রমা কক্ষের বাইরে অপেক্ষমান থাকে৷  মন্দোদরীকে দেখে পিতাশ্রী কিছুটা তৎপর হয়ে পড়েন

-পুত্রী  আমি  এবং তোমার মাতা দুজনই  খুব আনন্দিত তোমার মত কন্যাকে পেয়ে৷ তুমি নিশ্চই  তোমার মাতার থেকে  দশাননের  প্রস্তাবের কথা জানতে পেরেছো ?

মন্দোদরী জানান

– হ্যাঁ পিতাশ্রী ৷  মাতা সম্পূর্ণ ঘটনাই  আমাকে বলেছেন৷

রাজা কন্যার আচরণ দেখে প্রসন্ন হন এবং তাঁর  মনোভাব সম্পর্কে জানতে চান৷ মন্দোদরী  বড় হওয়া তাঁর পিতার আদর্শ ও মূল্যবোধের দ্বারা৷ পিতাশ্রী মন্দোদরীকে জানান

-দশাননকে  যদি তুমি  আদর্শ স্বামী রূপে  মেনে নিতে পারো তবেই বিবাহ হবে৷

কথাটি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন মন্দোদরী  ৷

পিতাশ্রীকে তিনি জানান

– দশাননকে স্বামী রূপে গ্রহণ করতে তাঁর কোন প্রকার অসুবিধা নেই ৷

পিতাশ্রী তাঁকে আরও জানান

-সম্রাট দশানন এক অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন রাজা একথা ঠিকই। একই সাথে তাঁর জীবনের অন্ধকার দিকগুলো খুবই প্রকট I তাঁকে স্বামী রূপে  গ্রহণ করতে গেলে তাঁর সম্পর্কে পুরোটা জানা দরকার ৷

পিতাশ্রীর কথা শুনে কন্যা চুপ করে থাকলেও মন্দোদরী বদ্ধপরিকর নিজের কাছে৷

পিতাশ্রী জানান

– দশানন  শক্তিশালী রাজা হয়েও বহু মানুষের কাছে বিরুদ্ধচারণ করেছেন৷ তিনি দেবতাগেণের  কাছে বর হিসেবে যা যা পেয়েছেন সবগুলোই দেবতাগণকে প্রতারিত করে৷

পিতাশ্রী রাবণের বুদ্ধিমত্তা, বিরত্ব  সবকিছুর  প্রশংসা করলেও কন্যার স্বামী রূপে দশাননকে চাননি ,একথা মন্দোদরী বেশ বুঝতে পারলেন।

পিতাশ্রী আরও জানান

– দশাননের উশৃংখল চরিত্র সম্পর্কে শুধুমাত্র লঙ্কা নয় পার্শবর্তী  দেশের রাজারাও জানেন ৷ তাই  আমি চাই না তুমি দশাননকে বিবাহ করো। তাই দশাননের থেকে প্রস্তাব আসা মাত্রই আমি  সরাসরি কিছুু উত্তর দিইনি৷ তুমি ভেবে দেখো…

রমা বাইরে থেকে শোনে তাঁদের পুরো কথোপকখন৷

রাজা মায়াসুর কোনভাবেই দশাননের  সমকক্ষ ছিলেন না ৷ তিনি বুঝতেই পারেননি এই প্রস্তাবের কারণ কি হতে পারে৷ তিনি তাঁর কন্যা এবং দশাননের মনের খবর জানতেন না।

তাই মায়াসুর সরাসরি দশাননকে প্রত্যাখ্যান করতেও পারছেন না ৷ তিনি বুঝতে পারছেন না তাঁর কন্যার মনোভাব। অদ্ভুত রকমের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মন্দোদরী ও পিতাশ্রী I মন্দোদরী পুরো ঘটনাটা বুঝতে পেরে বেশ ভয় পান৷ পিতাশ্রী মন্দোদরীকে বোঝান এই প্রস্তাব যদি তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন তবে  দশানন কোন ভাবেই বুঝতে চাইবেন না এই প্রত্যাখ্যান  তাঁকে নয় তাঁর প্রস্তাবকে করা৷ দশানন পিতাশ্রীকে জোর করে বোঝাবেন এই বিবাহ লঙ্কার  সাথে মহারাষ্ট্রের৷ এই বিবাহ যদি সংগঠিত হয় তবে লঙ্কা সমস্ত রকম ভাবে আত্মরক্ষা করবে মায়ারাষ্ট্রকে৷  দশানন একথা বুঝতেই  চাইবেন না যে মায়ারাষ্ট্র পুরোপুরি আত্মনির্ভর একটি রাষ্ট্র ৷ তাঁদের লঙ্কার দ্বারা আত্মরক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই৷ মন্দোদরী এই প্রস্তাব গ্রহণ না করলে গোটা মায়ারাষ্ট্র এক সমস্যার সম্মুখীন হবে৷ দশানন তাঁদের এও বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে তিনি  ভগবান শিবের  সবথেকে বড় ভক্ত ৷ তাঁর থেকে আদর্শ পুরুষ মন্দোদরীর জন্য আর কেউ হতেই পারেন না৷ সুতরাং মন্দোদরীর বুঝতে অসুবিধা হল না তাঁর পিতাশ্রী কতটা চিন্তান্বিত গোটা ঘটনাতে  এবং মন্দোদরীও একটি বড় পরীক্ষার সম্মুখীন ৷ সর্বশেষে  পিতাশ্রীর সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে  মন্দোদরী জানান তিনি দশাননকেই বিবাহ করবেন৷ পিতাশ্রী মন্দোদরীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি কোন সামান্য নারী নন৷ ভগবান শিবের আশীর্বাদধন্য কন্যা৷ তাঁর স্বামী যে শিবের পরম ভক্ত হবে এটাই স্বাভাবিক৷ শেষ পর্যন্ত পিতাশ্রী মন্দোদরীর

মনোভাবে প্রভাবিত হয়ে বিবাহটি মেনে নেন এবং মন্দোদরীও  পিতাকে  বোঝান  তিনি সঠিক পাত্র নির্বাচন করেছেন ৷ পিতাশ্রী চোখের জল মোছেন৷ তাঁর কন্যা  অবশেষে লঙ্কার রানী এবং দশাননের স্ত্রী রূপে প্রতিষ্ঠিত হবেন৷ এটি মন্দোদরীর কাছে জীবনের চরম মুহূর্ত ৷ রাজা মায়াসুর  তাঁর সকল মন্ত্রীদের নির্দেশ দেন মায়ারাষ্ট্রের কন্যার বিবাহের আয়োজন অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে করারI  রমার দিকে তাকিয়ে থাকেন মন্দোদরী৷ রাজা মায়াসুর  আদেশ দেন এই বিবাহ যেন শতাব্দীর সেরা বিবাহ হয় ৷ বিবাহমন্ডপের  স্থান নির্বাচন করা হয় নিকটবর্তী স্থানে এবং সেই  মন্ডপটির নাম রাখা হয় ‘রাবণা  চানওয়ারি৷ ভালোবাসা পূর্ণতা পায় বিবাহ দ্বারা ।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত