| 29 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

উপন্যাস: আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা । মলয় রায়চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 84 মিনিট

রেজিস্ট্রেশানের সময় বানান ভুল করে ফেলেছিল ক্লার্ক নবীন খান্না, মুখে পান সত্ত্বেও পরশ্রীকাতর ফিকে হাসি,  ঠোঁটের কোনায় লালচে ফেনা, পেটের ভেতর  কৃষ্ণচূড়া ছড়িয়ে চলেছে ফিনফিনে পাপড়ি, টাকের জেদি কয়েকটা চুল ফ্যাকাশে,  আলস্য দেখে মনে হয় যেন ঠাকুমার পালঙ্কের পাশে হাঁটু গেড়ে সম্পত্তির আশায় সময় কাটাচ্ছে । 

তখনও পর্যন্ত জংধরা টাইপরাইটার সরিয়ে ঝকঝকে কমপিউটার আর ঝুলেল টুনিবালব নিভিয়ে কুয়াশাময় সিএফএল ঢোকেনি সরকারি দপতরে ।

রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ের জন্মদিন কে নিশ্চিত করবে; করল একটা ভুল, যেমন নামের ভুল, ভুল লেখা হল বার্থ সার্টিফিকেটে, তোর জন্মদিন পয়লা জানুয়ারি, হ্যাপি নিউ ইয়ার আর হ্যাপি বার্থডে । 

কত মজার, না? উঁহু, তুই বলবি, মোটেও মজার নয়। 

দিল্লিতে প্রথম আষাঢ়ের ফোঁটায় ফোঁটায় ভেজা সকাল,  গাড়ির কাচে ওয়াইপার  নিজের মনে গাইছে , মুছে দাও মুছে দাও মুছে দাও। 

               চিরুনিধার বৃষ্টিতে, ভুরুকোঁচকানো হাওয়ায়, সমস্ত ডানা সরিয়ে ফেলা হয়েছে আকাশ থেকে।

               রুলটানা শুকনো অশথ্থপাতা ওড়ে। নারকেল পাতার ওপর কাকগৃহিণীর বলশয় ।

                ফুটপাতের বালিতে জল সেঁদোবার রিনরিন রিনরিন রিনরিন রিনরিন।

                শোনা গিয়েছিল অন্ধের পা রাখার আওয়াজ । বৃষ্টির টুপটাপে সময় পড়ার শব্দ।

               ভাসিয়ে নিয়ে গেলি ধাঁধার উড়ন্ত মেঘের পালকে শুয়ে চাই চাই চাই চাই, তোর দাবি।

                যায়নি মোছা, মুছতে পারিনি রে।

                কত জরুরি ছিল মুছে ফেলা ।

জগদীশ ব্যানার্জি তখন পানিপতে পোস্টেড, এজিএমইউ ক্যাডার বলে হার্ড পোস্টিঙ ঘুরে এসে আমি দিল্লিতে প্রথম পোস্টিঙে, ওকে বলেছিলাম আসতে, তোকে পছন্দ করার জন্য । 

               জগদীশ ব্যানার্জির নতুন টাকের ফিকে উঁকির ওপর বৃষ্টি, খবরের কাগজ দিয়ে আড়াল করছে বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টি আমার ভালোলাগে, মাত্র কয়েকটা তো  ফোঁটা, আদর করতে করতে গড়িয়ে চলে যায় বুকে, পেটে বা আরও তলায়।

                আমরা দুজনে, বৃষ্টির পিছুধাওয়া এড়াতে, প্রায় দৌড়ে ওদের হলঘরে ঢুকতেই, প্রথমে তুই-ই চোখে পড়লি, তোর খিলখিল হাসি, এক বছর বয়সেই। অন্য বাচ্চাদের চেয়ে তোর পা লম্বা, নজরে পড়ে গিয়েছিলি, সবার চেয়ে ঢ্যাঙা। কোলে তুলে নিলাম তোকে ।  

              এটা সেই মুহূর্ত, যা সবায়ের জীবনে আসে, এমনই এক মোড়, যেখান থেকে ফিরে যাওয়া যায় না, সবুজ প্রতিভা, সুরের গমক, মায়া ;  নিজের অবস্হান এক মুহূর্তের মধ্যে নির্ণয় করে ফেলতে হয় । আমি অনুপ্রাণনা-তাড়িত পুরুষ, ঠিক সময়ে যথার্থ নির্ণয় নিতে না পারলে জীবনের ভারসাম্য গোলমাল হয়ে যেতে পারে, এরকমটা মনে হয়, শেষে জমে-থাকা হতাশা হয়ে উঠবে অত্যন্ত কষ্টকর, ভবিষ্যতে কি হবে আঁচ করে নির্ণয় ঝুলিয়ে রাখতে পারি না। 

স্পর্শের মর্মার্থ হয়, মর্মার্থের রসায়ন, রসায়নের সম্পর্কে, রেণু, পরাগ, উড়াল, জীবন।

চাউনির কোলাহল, উতরোল শ্বাস । প্রতিরোধে ক্ষয়ে অনড় ঝর্ণাপাথর। জিওল মাছের নিঃশব্দ ছটফট। তোর মতো তোর মতো তোর মতো করে নিয়ে গেলি আমাকে আমার আমি থেকে ছিঁড়ে।

                 এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

                 যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

তোর নাকে নাক দিয়ে আদর করেছিলাম, গালে আর নাভিতে চুমো খেয়েছিলাম, উসকে দিয়েছিলাম তোর খিলখিল, পাখিদের গান শুধরে দেবার হাসি, খাঁজকাটা রোদ্দুরের ডালে-ডালে দোয়েল-কিশোরীরা স্বরলিপি ভুলে যায়, পায়ের তলায় আদর করতে পা গুটিয়ে নিয়েছিলি, ওঃ, তোর সেই মিডাস টাচ ।

তোর নাম আমি রাখতে চেয়েছিলুম নীতি, আসলে ওটা আমার ঠাকুমার নাম; উনি আমায় সবচেয়ে বেশি আদর করতেন, খাওয়ার পরও জানতে চাইতেন, কি রে খাওয়া হয়েছে ?

                 নকশিকাঁথা, আমসত্ব, শেতলপাটি, তামার পয়সা, গোবিন্দভোগ, কুমড়োবিচির মেঠাই, রেড়ির তেলের গন্ধ, কুপির আলো, পুকুর, ধানখেত, টিয়াপাখি । রামধনু গড়তে শিখছে আকাশ । গাছের ছায়া কিনে নিয়ে গেছে পাইকার । পায়ের শিরায় মাইল-পাথরের স্হায়ীত্ব । ঠাকুমা ।

                 একটা ইংরেজি ই বাদ পড়ায় তোর নাম হয়ে গেল নেতি ; শুনেছি, বন্ধুরা তোকে নেটি নাটি নাট করে দিয়েছে, তা তো আমার দোষ নয় । 

                 শুনেছি, তোর একাধজন  ক্লাসমেট  খুনসুটি করে  নেটা বলে ক্ষ্যাপায়, নেটা মানে শিকনি। তুই একেবারে গা করিস না, তাও শুনেছি, তোর এক সহপাঠিনীর অভিভাবকের কাছে, আমার সঙ্গে সেও তখন পুডুচেরিতে পোস্টেড, কাঁধ শ্রাগ করে নাকি বলিস, সো হোয়াট , আই’ল স্টিক ইট টু ইওর আস, ক্লাস ফোর থেকেই। 

                 জগদীশের স্ত্রী অমরিন্দর, কখনও হরিয়ানভি জাঠ ছিল, বিয়ের পর মাছভাত খেয়ে, জামদানি পরে, দুর্গাপুজোয় গরদের শাড়িতে সিঁদুর খেলে, জলসায় গলাকাঁপা বাংলা গান গেয়ে, পুরোপুরি বাঙালি, তোকে নিত্তু বলে ডাকে, জানি,  নিত্তু বেটি, কি খাবি, বাংলা না পাঞ্জাবি রেসিপি, সরসো কা সাগ উইথ মক্কি কি রোটি, ছোলে ভাটুরে, রাজমা চাওয়ল। বলেছে জগদীশ, চেককাটা লুঙ্গিতে বাইফোকাল পুঁছে ।

               তুই বলতিস, নো নো, আন্টিমা, আমি মাছ ভাত খাবো, মুড়িঘন্ট বানাও না, আঙ্কলবাপির ফেভারিট। শুনেছি।

                জগদীশের বড় মেয়ে বৈদেহী বিরক্ত হতো, এতো সাধাসাধি কিসের ? যা সবাই খায় তা-ই খাবে। পরে মানিয়ে নিয়েছিল, তোর আপন করে নেবার বৈশিষ্ট্যের আদরে। তোর আয়ত্বে আছে গোপন উষ্ণমণ্ডল, শুনেছি।

                অমরিন্দরের বিয়ের সময়ে ঝামেলা করেছিল ওদের  এক ভঁয়সাপেটা জাঠ পঞ্চায়েত কর্তা; জগদীশ সিলকের পাঞ্জাবি খুলে, পৈতে দিখিয়ে হেঁকেছিল, আমি হলুম বাঙালি ব্রাহ্মণ, স্যারজি, ব্যানার্জি, সবচেয়ে উঁচু ব্রাহ্মণ। 

                ওদের ষণ্ডাদের ব্যানার্জির হাঁটু ছুঁয়ে সে কি পরনাম, পরনাম, পরনাম। এও শোনা, বলেছে অমরিন্দর।

                পৈতেতে বুড়ো আঙুল জড়িয়ে বাপের বয়সী ভুঁড়োদের পাগড়িতে হাত রেখে জগদীশ বলেছিল, জিতে রহো পুত্তরজি , ফুলো ফলো, পিও পিলাও।

               বিয়ে হল, বিয়েতে মদ খেয়ে ব্যাণ্ডবাজিয়েদের তালে-তাল  নাচ হল, জগদীশ যৌতুকে পেল গুড়গাঁওয়ে জমি, যার ওপর ও দোতলা বাঙলো তুলেছে, আর ঘুষের টাকায় তাকে ক্রমশ ফিল্মসেটের মতন করে ফেলেছে, মায়াবি। ঘুষের টাকায় কলকাতায় নিউটাউনে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে, অমরিন্দরের নামে,মায়াবি। চণ্ডীগড় ছেড়ে বেরোতে চায় না, তাই। ছুটিতে বোতলক্রেট গুড়গাঁও কিংবা যেখানে আমি বা কোনো বাঙালি কলিগ পোস্টেড; থ্রি চিয়ার্স।

               ঘুষের টাকা নেবার জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলে আর বছর দুয়েক পরে বন্ধ করে আবার অন্য অ্যাকাউন্ট খোলে ; কখনও নিজের নামে, কখনও অমরিন্দরের নামে, কখনও শিডুল্ড ব্যাঙ্ক, কখনও প্রায়ভেট ব্যাঙ্ক, কখনও আরবান কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক, কখনও টয়লেটের লফ্ট ব্যাঙ্ক, কখনও পুজোর ঘরের ফাঁপা দেয়ালে আনারকলি ব্যাঙ্ক।

  

               গলা অব্দি কুয়াশায় ডোবা মানুষের নাম না-পালটাতে পারার মজাদার অসুখের আনন্দ। চাঁদবণিক প্রায়ভেট লিমিটেড বললে, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ । প্রতি বদলির বিদায় সম্বর্ধনায় একই বক্তৃতা দ্যায়, লিখে রাখা আছে।

               সকালে স্নানের পর গামছা-কোমর জগদীশ, টাকের চুল ফুরিয়ে গিয়ে করোটিতে রূপান্তরিত, বাঁহাতে পেতলের ছোটো ঘন্টিতে টুংটাং, ডানহাতে দুশো এম এল গঙ্গাজল, গ্যাঁদাপাপড়ি, দরোজায় দরোজায়, সংস্কৃত মন্তরের ফিসফিস, বৈশাখ জৈষ্ঠ আষাড় শ্রাবণ ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক অঘ্রাণ পৌষ মাঘ ফাল্গুন চৈত্র, কিছুটা ঝুঁকে, যেন সময়ের সঙ্গে বেমানান আধ্যাত্মিক কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার ।

               পুজোর ঘর পাথর-মাটি-কাঠ-পেতলের দেবী-দেবতায় ছয়লাপ, দেয়ালের পেরেকে-পেরেকে কুড়ি-পঁচিশ বছরের পুরোনো বাংলা ক্যালেণ্ডারের দেবী-দেবতা, থাক-থাক পাঁজি, পুজোর বই, পাঁচালি, পিলসুজ, পুজোর ন্যানো সাইজের থালা-ঘটি-বাটি, রুপোর; হেসে, গলার লাল শালুতে শালিগ্রামশিলা ঝুলিয়ে, বলেছিল ওর পার্টটাইম পুরুত অবিনাশ ভট্টচাজ্জি, যে নিজেই গজগজ করে দেবী-দেবতারা সংস্কৃত মরা ভাষা থেকে আজও বেরোতে পারেনি, বুঝতে পারে না কোন বিসর্গের কি অর্থ।   

               জগদীশের জ্বরজারি হলে, অমরিন্দর, কালোর চেয়ে কালো কলপে ভেজা চুল, কোমরে এক গামছা বুকে আরেক, আজও জিগ্যেস করে, এর পর কোন মন্তর? গামছা যায় কলকাতা থেকে, বাঙালি জুনিয়ার অফিসারদের দৌলতে। অবশ্যই লাল, অবশ্যই সবচেয়ে বড় মাপের, যদিও অমরিন্দরের জাঠনি বুক ঢাকতে পারে না সে-গামছা, পেটে সিজারিয়ানের কাটার দাগ উঁকি দিয়ে ঝোলে। তিন বছর লেগেছিল শাঁখ-বাজানো শিখতে, শুনেছি।

               কী করে আপনাদের পরিচয় হল, অমরিন্দর তো দু-এক ইঞ্চ লম্বা, জানতে চেয়েছিলাম। 

                জগদীশ বলেছিল, ভাঁজের প্রতিভায় ছিল সীমাভাঙার টান, জগদীশেরই দপতরে, পানিপতে, এসডিও অফিসে এসেছিল কোনো কাজে । ব্যাস, বাস্তববাদিনীর উদ্যমের  সঙ্গে বলগাছেঁড়া কল্পনা ; দেহের আনাচে-কানাচে টই-টই জাঠনির অবিমিশ্র উপঢৌকন ; ধুলোয় মোচড় দেয়া গন্ধ । জাঠনির মতো উরু পাবেনা ভারতে ; মোষের দুধ-দই খায়, গোরু একদম নয়।

                পানিপতের রঞ্জক গোলাপ, সাদা গোলাপ, লাল গোলাপ, হলুদ গোলাপ, কমলা গোলাপ, গোলাপি গোলাপ, কালো গোলাপ, ইরানি গোলাপ, মিরিন্ডা গোলাপ ; শাখা কলম, দাবা কলম, গুটি কলম, চোখ কলম। আহাআহা। দেহজুড়ে চুমুর দাঙ্গা ।

                 সংবেদনশীল আলোড়ন, জলসিক্ত উড়ন্ত ছাতা।

                 শান্তির মৌনতা হাওয়া থেকে হাওয়ায়, স্হান থেকে স্হানান্তরে।

                 উতরোল কোলাহল।

                 অমরিন্দর:  যাক ওই করওয়া চৌথের জুঠঝামেলা থেকে বাঁচলুম, না খেয়ে থাকো সারাদিন, ওসব আমার দ্বারা হবে না, চালুনি দিয়ে বরের মুখ দেখে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে আমি সিঁদুর-খেলা খেলে তাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখব । বরকে বরং আলুর পরোটা, মেথি-শাকের পরোটা, পুদিনার পরোটা, বেসনের পরোটা, কিমার পরোটা খাওয়াবো, সিঁদুর খেলা থেকে ফিরে, ঘিয়ে চপচপে পরোটা। করওয়া চৌথ হল চালুনি কারখানাগুলোর কারসাজি; নয়তো কবেই বন্ধ হয়ে যেত, পুরোনো কারখানা বন্ধ হয়ে এখন বের করেছে প্লাস্টিকের চালুনি। 

                 সাহেবরা চাঁদে গিয়ে গোসল করে এলো, সেই চাঁদের দিকে তাকাও, মানে হয় কোনো, অ্যাঁয়জি!

                 জগদীশ : কিন্তু তুমি লাঞ্চ আর ডিনারে কাঁচা পেঁয়াজ কামড়ে খাবার অভ্যাস ছাড়তে পারলে না।

                 অমরিন্দর : তোমার শুঁটকি মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারি, আর তুমি কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ সহ্য করতে পারো না? প্যার মোহব্বত প্রেম ভালোবাসা হল গন্ধের আপোস । বাজারে পেঁয়াজ না এলে হরিয়াণার সরকার উলটে যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাজারে মাছ না এলে কি সরকার ওলটায় ?

                 জগদীশ : অমন কখনও হয় না, মাছ আসবেই, বাঙালি মাছ খাবেই, যত দামই হোক, সরকারকে ফেলবে না। সেখানে সরকার পড়ে মাৎস্যন্যায়ে।

                 অমরিন্দর : তোমরা বাংগালিরা পরৌনঠাকে পরোটা বলো কেন, অ্যাঁয়জি?

                 চাবির ঘোলাটে ফুটোয় যাবৎজীবন চোখ। অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে-আনা সকালের বিকল্প।

                 সান্নিধ্যের নৈকট্য ঘিরে অফুরন্ত অবসর। প্রেম-টিকলিং নিড়ুনি। 

                 কৃষ্ণবিবরের অচিন্ত্যনীয় ভর, আলো পর্যন্ত বেরোতে পারেনি।

                জগদীশ আর অমরিন্দর আমাকে ব্রো-প্রো বলে ডাকে, এল বি এস ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশানে ট্রেনিঙের সময় থেকে আমাকে সকলে ব্রো-প্রো করে নিয়েছে, ব্রাদার প্রভঞ্জন। জগদীশ আমার চেয়ে পাঁচ বছরের সিনিয়র, ঘোঁৎঘাঁত বিশেষজ্ঞ। ও ঠিক খবর রাখে  কখন বিরোধীদলে চলে যাবার কথা চিন্তা করছে সকালবেলার সূর্য। 

                 তুই কি কখনও আমার নাম জানতে পারবি নেতি?   

                 আমার গোপন কোষাগারে তোর নাম নেতি থেকে ইতি করে নিয়েছি ; তুই জানিস না, জানতে পারবি একদিন, যখন আমার উইলে তোর নাম থাকবে, আমি এতদ্বারা আমার স্হাবর ও অস্হাবর সমস্ত সম্পত্তি নেতি ওরফে ইতি ব্যানার্জিকে। তেমনই তো ভেবে রেখেছিলাম রে।

                পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে তার আগেই সব জেনে ফেলেছিলি ; তোর গায়ে  গোখরোর ঠাণ্ডা রক্ত। কোনো যুবতীর গা এত ঠাণ্ডাও হয়! প্রতিশোধ নেবার ষড়যন্ত্র শিরায়-শিরায়, রসতরঙ্গিনী তুই। তোর দুই হাতে অ্যানাকোণ্ডার দমবন্ধ করা পাকের পর পাকের পর পাকের পর পাক, উফ কি ঠাণ্ডা, আঁস্তাকুড়ের হেমন্তের শীতেল জঞ্জালের জাপট।

                 চব্বিশ বছরের শ্যামলী দীর্ঘাঙ্গী, জানি না কেমন দেখতে হয়েছে তোকে, খুঁজে বেড়াচ্ছিস তোর নামকরণকারীকে, জন্মদিন নির্ধারণকারীকে, যেন তোর অস্তিত্বকে সেই লোকটা করায়ত্ব করে গুমখুন করে লুকিয়ে রেখেছে নিশুতি রাতের পোড়োবাড়ির সিঁড়ির স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে । 

                  শিমুলের পাকা ফল ফেটে রোঁয়া উড়ছে, তুই তাদের ধরতে চাইছিস, শিমুলের লাল টকটকে ফুলগুলো শুকিয়ে তৈরি করেছে রোঁয়াবীজ, সেগুলোকে উড়িয়ে চলেছে দূরান্তরে, কোথাও গিয়ে অঙ্কুর তুলে লুকিয়ে গাছ হয়ে উঠবে, বসন্তের আকাশকে রাঙিয়ে দেবে। 

                  তুই কি চাস না যে বিশাল একটা শিমুলগাছ সবুজ মুকুট মেলে আকাশের চিরনবীন শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ছুঁয়ে দেখুক, মেখে নিক বসন্তের উদাসীন রক্তাক্ত তাড়না, বল তুই ?

                 আমারই মস্তিষ্কে ওই গাছ পুঁতে দিবি, রোঁয়া উড়বে, আঁচ করিনি। তুই মারাত্মক। বৃষ্টি ফোঁটারা কি হলুদ পাতার রঙ তুলতে পারে, বল তুই? মোম-আলোয় শ্যামাপোকা নাচতে ভোলে না।

                 প্রেপ থেকে তোকে ভর্তি করা হল নৈনিতালের সেইন্ট মেরি কনভেন্ট হাই স্কুলে, বোর্ডিঙের অঢেল, সিসটাররা ছাত্রীদের সুখসুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখেন, স্কুলের রেজাল্টও ভালো হয় প্রতিবছর। ফিস বেশি হলেই বা, আমার মাইনেটা আছে কি জন্য ! ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত টানা পড়লি সেখানে। ব্যাস, জিভে সেই যে কনভেন্টি অক্সব্রিজ ইংরেজি ঘাঁটি গাড়ল, তা কখনও ছাড়ল না তোকে। এও শোনা, সূত্র অমরিন্দর, টেলিফোনে, আমি তখন পোর্ট ব্লেয়ারে।   

                জগদীশের মেয়ে তোর চেয়ে চার বছর সিনিয়র, ও কি  জিভে অক্সব্রিজ কনভেন্টি ইংরেজি জড়াতে দিয়েছে? বলেনি কেউ, কেনই বা জানতে চাইব, বল? আমার আগ্রহের কেন্দ্রে তো তুই। ওই স্কুলের বোর্ডিঙেই তো ছিল বৈদেহী।   

                কত ইচ্ছা করছিল, তবু ভর্তির সময়ে আমি স্কুলে যাইনি, কিন্তু নৈনিতালে গিয়েছিলাম, উদ্বেগ, উদ্বেগ, যাতে তোর অ্যাডমিশানে অসুবিধা না হয় । এডুকেট এ গার্ল চাইল্ডের দপতরের পর আমি তোকে আর চাক্ষুষ দেখিনি, কেবল ফোটোতে যা। তারপর থেকে, জগদীশের মেয়ে আর ছেলেকেও দেখিনি । ওদের বাড়িতে আমি যাই না, তোর কারণেই যাই না।

               এনজিওর মনোবিদ তনজিম হায়দার বলেছিল, আপনি  নেতির সামনে কখনও যাবেন না, স্মৃতিতে আপনার মুখ থেকে যাবে, খুঁজবে আপনাকে, শেষে আপনাকে না পেলে ডিসগ্রান্টলড আর রিভেঞ্জফুল ফিল করবে ; আপনি তো তা চাইছেন না। অচেনা একজন মানুষ ওর সমস্তকিছু ফানডিং করছে জানতে পারলে হীনম্মন্যতার দোষ ফুটে উঠবে চরিত্রে।

                আমি চেয়েছি তুই বোল্ড হয়ে ওঠ। তাই বলে এরকম বোল্ড, অ্যাঁ?

                শাদা ঘোড়া, কেশর হাওয়ায়, দৌড়োচ্ছে, সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে, ওই দূরে সূর্য, ওই দূরে পূর্ণিমার চাঁদ, দৌড়চ্ছে ঘোড়া, ওই দূরে ঝড়, ওই দূরে বৃষ্টি।

                ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ… মরুভূমিতে ঘোড়ারা দৌড়োলে বালি ওই শব্দকে শুষে নেয়। 

                 নৈনিতাল তোর পছন্দ হল। কত সুন্দর না? জায়গাটা ? বিশেষ করে শীতের সময়ে, তুষার দেখতে দেখতে তোর স্কুল ছুটি। বৈদেহীরও প্রিয় ছিল স্কুল আর শহরটা, শুনেছি। 

                 সতীর নয়ন পড়েছিল বলে নৈনিতাল, শুনেছি। 

                 সতীর চোখ, ভেবেছিস কখনও ! 

                 অমরিন্দরের মতে সতীর মতন চোখ কোনো মহিলা পেতে পারে না; ওই তিনটে চোখই তৈরি হয়েছিল। 

                 আইডেনটিটিকার্ডে তোর ফোটো, আইগ্লাস দিয়ে এনলার্জ করে দেখে,  অনুমান করতে পারি,  চোখ দুটো কত সুন্দর, যতো তোর বয়স বেড়েছে, ঠিক জানি,  তত সুন্দর হয়েছে তোর চোখ, কালো গভীর আর বেশ বড়ো, যেমন বাঙালি মেয়েদের হয়। কাঁদলে কেমন হয় তোর চোখজোড়া ? হাসলে কেমন হয় ? কারোর সঙ্গে ঝগড়া করলে কেমন হয় ? তোর এখনকার জীবন্ত চাউনিগুলো দেখার বড়ো ইচ্ছা হয় রে।

                 কবে দেখলাম তোর চোখ? দেখেছি বৈকি। চোখ বুজলেই দেখতে পাই আর ভাবি কত ভুল যে করেছিল তোর মা তোকে ডাস্টবিনে  ফেলে দিয়ে। আমার মনে হয় দূর থেকে লক্ষ্য রেখেছিল, তোকে কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে কিনা দেখার জন্য ; তখনই তোর চোখের টান এড়ানো ছিল অসম্ভব।

                 আমি তোর চোখের টানেই সন্মোহিত হয়েছিলাম। তোর গন্ধে। কেন বল তো ? কারণ তোর গন্ধ অন্য শিশুদের থেকে আলাদা ছিল, তুই তোর মায়ের দুধ খাসনি, বোতলের দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছিস।

                এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

                যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় । 

                বড়ো হয়ে উঠলি, বড়ো হয়ে উঠলি, অমাবস্যাকে একরাতে পরিযায়ী করে চলে যাবি বলে !

 

                 তোর ক্লাস সেভেনের ডায়রিতে, হস্টেলের ওয়ার্ডেন দেখেছিলেন, একটা পৃষ্ঠায় তুই লিখে রেখেছিস, লাল ডটপেন দিয়ে, “আই নো, সামওয়ান ওনস মি, বাট ইজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি।” পৃষ্ঠাখানা ছিঁড়ে অমরিন্দরেকে দিয়েছিলেন ওয়ার্ডেন, এই ভেবে যে তুই কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম করছিস । 

                ওই স্কুলে ছেলেরা পড়ে না, কি করেই বা কোনো ছেলের সঙ্গে তোর যোগাযোগ হবে, তা নিজেও চিন্তা করেছিলেন ওয়ার্ডেন।

                জগদীশ বুঝিয়েছিল অমরিন্দরকে, না, না, ও জেনে ফেলেছে, যে ওর পড়াশুনা থাকা খাওয়া পোশাক আর জীবনে যা প্রয়োজন তা কেউ একজন অলক্ষ্যে যুগিয়ে যাচ্ছে, আর তার জন্য তুমিই দায়ি অমরিন্দর, আমাদের ছেলে আর মেয়ের চেয়ে দামি জুতো জামা উপহার ইত্যাদি কিনে  ওর মনে সন্দেহ তৈরি করে দিয়েছ। ও ভাবে, ওকে কেন স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে। 

                মেয়ে বৈদেহী আর ছেলে আরিয়ানও প্রশ্ন তোলে, কেন স্পেশাল ট্রিটমেন্ট। শুনেছি।

                অমরিন্দর উত্তরে বলেছিল, আর ব্রো-প্রো যে অন্যদের দিয়ে নেতিকে বাংলা-ইংরেজি বই পাঠায়, প্রতি বছর দূর্গাপুজোয় দামি টোম্যাটোরেড পোশাক পাঠায়, তার বেলা ?

                যাতে ওর জ্ঞান বাড়ে, কালচার্ড হয়, সেজন্য পাঠায় ; ব্রো-প্রোর মগজে আঁস্তাকুড়ের ভয় কি আর নেই !

                 তা বইগুলো বৈদেহী আর আরিয়ানই বেশি পড়ে, নেতি স্কুল থেকে ছুটিতে এলেও ম্যাথস ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতেই বসবাস। বৈদেহী বইগুলো পেয়ে সাহিত্যের পোকা হয়ে গেছে ; বাংলা সিডি এনে গান শোনে। শুনেছি। 

                আমি চেয়েছিলুম তোকে সবচেয়ে ভালো পোশাক আর জুতো কিনে দেয়া হোক; বই কিনে দেয়া হোক। কিন্তু কি করেই বা তুই জানলি, বিশ্বাস করলি ? বিশ্বাস আর সন্দেহ  তো একই ব্যাপার নয় । জানিস তো, মানুষের সন্দেহ হল বিশ্বাসঘাতক প্রক্রিয়া, কিন্তু নিজের ভেতরের আলো-অন্ধকার খুঁজে পেতে হলে সন্দেহ ছাড়া উপায় নেই, না রে? 

               তোর কি মনে হয় না যে বিশ্বাস ব্যাপারটা জঘন্য, দূষিত, মন্দ ? বিশ্বাসের বিপরীত হল সন্দেহ, কিন্তু তা যদি বিশ্বাসের উপাদান হয়, তাহলে কি করবি ? তোর মাথায় নিশ্চয়ই এই দোনামনা দোল খেয়েছে, টিং টুং টিং টুং, জানি আমি, ফর শিওর ।

 

               পথপ্রদর্শকের হাত ধরে প্রতিবিম্ব পালটে যায়, পাহাড় ফাটিয়ে বের করে আনে প্রতিধ্বনি।

               রোদে নিকানো আকাশে তখন ঝুলে থাকে পরিযায়ী পাখির একাকীত্ব।

               রোদ্দুর উত্তরায়ন মেনে চললে কী-ই বা করার ! অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো।

                সেভেনথ স্ট্যাণ্ডার্ড থেকে তোর প্রতিটি ক্লাসের আইডেনটিটি কার্ড রেখেছি যত্নে, চণ্ডীগড় থেকে ডাকে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল তোর অভিভাবক পরিবার , যখন তোর বারো ক্লাস শেষ হল, আমি তখন সিলভাসাতে পোস্টেড ।  তুই কি টের পাসনি  যে কোথায় গেল স্কুলের আইডেনটিটিকার্ডগুলো ? ওগুলো দেখি মাঝেসাজে, কেমন একটু একটু করে ডাগর হয়ে উঠেছিস; ফিচার্স স্পষ্ট হয়ে উঠছে । জগদীশের বাড়িতে আছিস বলে তোকেও নাকি বৈদেহী আর অমরিন্দরের  মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে, শুনেছি। 

              জাঠনি! ভাবা যায়!

              তুই তো বাঙালি ; মোষের দুধ হজম করতে পারিস তো?

               আশ্চর্য না? তুই কলকাতার আঁস্তাকুড় থেকে এসে যাদের বাড়ির সদস্য হলি, তাদের মা-মেয়ের মতনই দেখতে হয়ে গেলি ক্রমশ, বারো ক্লাস পর্যন্ত তোর আইডেনটিটি কার্ডের ফোটো দেখে তেমনটা অনুমান করতে ভালো লাগে।

                তুই কি  ঢ্যাঙা হয়েছিস,  তোর পাদুটো লম্বা হয়ে চলেছে নাকি, বৈদেহী-আরিয়ানের মতন, জাঠদের মতন?  নাচ শিখতে পারতিস, তা নাচ তোর প্রায়রিটিতে নেই, শুনেছি।

                 ক্লাস টেনে যখন ফার্স্ট হলি, সিস্টার অ্যানি তোর সাক্ষাৎকার নিয়ে ছাপিয়েছিলেন স্কুল ম্যাগাজিনে, তার কপি আছে আমার কাছে, পড়ে পড়ে মুখস্হ হয়ে গেছে প্রশ্ন আর উত্তরগুলো ; শুনবি ? 

                 তুই তো এখন আমেরিকায়, চাকরি করিস, শুনেছি গাড়িতে অফিস যাস, তবু শোন, তোরই ইনটারভিউ।

                 সিসটার অ্যানি : তোমার নাম নেটি, এর অর্থ কী ?

                 তুই : নেটি মানে নিও টেরেস্ট্রিয়াল, শর্টে নেটি রেখেছিলেন আমার ফসটার ফাদার । বাংলায় নেতি।

                 সিসটার অ্যানি : তুমি বড়ো হয়ে কী হতে চাও ?

                 তুই : আমি অ্যাস্ট্রনট হতে চাই, স্পেস সাইন্টিস্ট হতে চাই । চাঁদের মাটিতে, মঙ্গলগ্রহের মাটিতে হাঁটতে চাই ।

                 সিসটার অ্যানি : কেন ? তোমার সহপাঠিরা বেশির ভাগই ডাক্তার হতে চাইছে, বা কমার্স পড়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে চাইছে, পলিটিশিয়ান, উকিল, বিজনেসউওম্যান হতে চাইছে ।

                 তুই : জানি । আমার ম্যাথেম্যাটিক্স খুব ভালো লাগে, ফিজিক্স ভালো লাগে; সীমাহীনতার বিস্ময় আমাকে মোটিভেট করে। আমি আইআইটিতে কমপিট করতে চাই ।

                 সিসটার অ্যানি : তোমার প্রিয় ফিল্ম নায়ক কে?

                 তুই : ব্র্যাড পিট।

                 সিসটার অ্যানি : কেন ? দেখতে অ্যাট্রাকটিভ বলে ?

                 তুই : শুধু তাই নয়, উনি আর অ্যানজেলিনা জোলি বেশ কয়েকজন শিশুকে অ্যাডপ্ট করেছেন। একিলিসের ভূমিকায় মানিয়েছিল ওনাকে।

                 সিসটার অ্যানি : তুমিও বড়ো হয়ে কোনো শিশুকে অ্যাডপ্ট করার কথা ভাবো কি ?

                তুই : হ্যাঁ, আমি বিয়ে করব না। কয়েকটি শিশুকে অ্যাডপ্ট করব ।

                 সিসটার অ্যানি : যদি কাউকে তুমি ভালোবেসে ফ্যালো ? কিরকম সঙ্গী চাও ?

                 তুই : আমি চোখ বুজে তাকে দেখতে পাই, কিন্তু বর্ণনা করতে পারব না । আমি আমার ফসটার ফাদারকে আজও দেখিনি, তাঁকে আমি আমার ফাউনডিং ফাদার মনে করি, আমার প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর মতো পুরুষ আমার পছন্দ, তাঁকেই পছন্দ।

                 সিসটার অ্যানি : তোমার উড বি হাজব্যান্ড কোথায় তোমাকে প্রোপোজ করুক, তুমি চাও ?

                 তুই : যদি বিয়ে করি, চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রোপোজ করলে ভালো। তবে আমি ওই পুরোনো প্যাট্রিয়ার্কাল রিচুয়াল রিভার্স করতে চাই, আমিই প্রপোজ করব, সে গ্রহণ করবে। বিয়ে আমি করব না বলেই মনে হয়।

                 সিসটার অ্যানি :  ফিল্ম দ্যাখো, মুভিজ ?

                 তুই : না, ফিল্ম দেখতে আমার তেমন ভালো লাগে না, ওয়েস্টেজ অফ টাইম মনে হয়।      

                 সিসটার অ্যানি : কোন ধরণের ফিকশান তোমার ভালো লাগে?

                 তুই : ফাইভ সিক্সে পড়ার সময়ে হ্যারি পটার সিরিজের  বইগুলো ভালো লাগত ; এখন ট্র্যাশ মনে হয় । এখন আমার  সিমপ্লিফায়েড শেক্সপিয়ার ভালো লাগে, বিশেষ করে ট্র্যাজেডিগুলো।

                 সিসটার অ্যানি : কমিকবুকের কোন চরিত্র তোমার পছন্দ?

                 তুই : অ্যাস্টারিক্স আর ওবেলিক্স। ওতে আমি নিজের একটা চরিত্র কল্পনা করে নিই, নেটিফিক্স, যে নেটওয়র্কিং করে সকলের সমস্যা সমাধান করে, কেননা ওই কমিকবুকে চরিত্ররা কেবল একের পর এক সমস্যা গড়ে তোলে।

                 সিসটার অ্যানি : কোন খেলা ভালো লাগে?

                 তুই : ফুটবল।

                  সিসটার অ্যানি : কোন টিমকে সমর্থন করো?

                 তুই : ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

                 সিসটার অ্যানি : কার কবিতা ভালো লাগে?

                 তুই : টি এস এলিয়ট, কবিতায় গল্প না থাকলে ভালো লাগে না।

                 সিসটার অ্যানি :  ওনার কবিতা তো বেশ কঠিন, বুঝতে পারো?

                 তুই : বুঝতে বিশেষ পারি না, অনুভব করতে পারি। 

                 সিসটার অ্যানি : বেঙ্গলি পোয়েট্রি পড়ো না?

                 তুই : না, পড়ি না , পড়তে ইচ্ছা করে না। আমার বেঙ্গলি বার্থ পোয়েটিকাল নয়, আই অ্যাম এ ডিসাকার্ডেড বেঙ্গলি। তবে একজন বেঙ্গলি কবির আত্মহত্যার ঘটনা আমায় সন্মোহিত করেছে ।

                 সিসটার অ্যানি : তোমার প্রতি বছরের ডায়েরিতে একটা লাইন লেখো, “ আই নো, সামওয়ান ওনস মি, বাট ইজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি।” তুমি কি ঈশ্বরের কথা ভেবে লেখো ? নাকি তুমি কবিতা লিখতে চাইছ?

                 তুই : হ্যাঁ, উনি আমার ব্যক্তিগত ঈশ্বর, আমার ফাউনডিং ফাদার । ওই লাইনটা লিখে ওনার আরাধনা করি, সম্পর্ক পাতাই। আই লাভ হিম ইন অ্যাবসেনশিয়া।

                এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

                যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

         

                 জগদীশ একবার বলেছিল,  নিজের ছেলেমেয়ের চেয়ে তোকে বেশি ভালোবাসে, ও যা চায়, তুই তেমন করেই গড়ে তুলছিস নিজেকে, কখনও অবাধ্যতা করিস না। প্রায় তোর মতনই ওদের গায়ের রঙ ; জগদীশের রঙ পেয়েছে দুজনেই। হাইট পেয়েছে অমরিন্দরের। ফর্সা হলে তিনজনের মধ্যে কমপ্লেক্স গড়ে উঠত, সে আরেক হ্যাঙ্গাম। কী করে এরকম মানিয়ে নেবার চরিত্র পেলি রে? 

              বৈদেহী আর আরিয়ানের খারাপ লাগতে পারে, তুই ওদের বাবা-মায়ের ওপর ভাগ বসাচ্ছিস ভাবতে পারে বলে, জগদীশকে আঙ্কলবাপি আর অমরিন্দরকে আন্টিমা সম্বোধন আবিষ্কার করে ফেললি। সবই অবশ্য শোনা, একবছর বয়সের পর  তো আজও দেখিনি তোকে, আর ওদের ছেলেমেয়েকে।

                জগদীশ জানিয়েছিল, বৈদেহী আর আরিয়ান নাকি চাইত না  যে তুই বাপি আর মা বলে সম্বোধন করিস  ওনাদের, বাপি আর মা কেবল ওদের।

                 তুই জেনে ফেলেছিস যে তোর জন্মের পরেই তোর মা তোকে অনাথ করে দিয়েছিল ; অনাথ শিশুদের হামাগুড়ি থেকে কেউ একজন তোকে পছন্দ করে তুলে দিয়েছিল  ‘এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড’ সংস্হার হাতে।

                 বৈদেহীর সঙ্গে ঝগড়ায় ওর আলটপকা মন্তব্যে সন্দেহ হয়েছিল তোর ; তারপর জগদীশ-অমরিন্দরের কথাবার্তা শুনে ফেলে থাকবি কখনও । ওরা দুজনেই মদ খাবার পর বড্ড বকবক করে, বিছানায় শুয়েও গ্যাঁজায়, ব্রো-প্রোর টাকা এসে পড়ে আছে রেলিভ্যান্ট অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দাও, এই ধরণের কথাও বলাবলি করে থাকবে।

                 আমি তোকে দিতে চেয়েছিলাম কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতের বসন্তকাল, শীতের পশ্চিমবাংলার ফিনফিনে গ্রামীণ রোদ, চিরসবুজ অ্যামাজন অরণ্যের ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও পাখিদের রঙিন উড়াল । 

                 তুই চাইলি আরও ওপরের আকাশে ভেসে বেড়াবার স্বাধীনতা, আরও উঁচু, আরও উঁচু, আরও উঁচু, বাধাবন্ধনহীন  নীল, যেখানে পাখিদের ডানার রঙ কালো বা ধূসর। 

                 যে আঁস্তাকুড়ে অবহেলায় ভোররাতের শিশিরে ভিজছিলিস তা পশ্চিমবাংলায়; তোর  রোষ চাপিয়ে দিলি পশ্চিমবাংলার ওপর, কলকাতা শহরের ওপর।

                জানি, ব্লু-গোল্ড পোশাকে তোকে মানায়। কিন্তু আমার পছন্দ টোম্যাটোরেড লাল রঙের পোশাক।

                কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতের কথা কেন বলছি বলতো? তোর গায়ের রঙ শ্যামলা, বৈদেহীর চেয়ে এক পোঁচ বেশি,শুনেছি। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওর ওই সমুদ্র সৈকতে পয়লা জানুয়ারি অজস্র মানুষ-মানুষীর ভিড় হয়; অন্য সময়েও নগ্নিকারা শুয়ে থাকেন বালির ওপর নরম ম্যাট বিছিয়ে। তারা তোর মতোই শ্যামলী, অনেকে কৃষ্ণাঙ্গীও। কেবল শেতাঙ্গিনি আর শেতাঙ্গদের জমায়েত তোকে বিব্রত করত, যেমনটা ইউরোপের সমুদ্র সৈকতগুলোয় হয়। গোয়ার সমুদ্র সৈকতের কথাও বলতে পারতাম, সেখানে রাশিয়ার নগ্নিকারা ভারতীয় চোরাদর্শকদের হাতছানি দ্যায়।

                যখন রিও ডি জেনেরিও আর সাও পাওলো যাবি, দেখিস সেখানকার কার্নিভাল, চোখ জুড়িয়ে যাবে, ইচ্ছা করবে কার্নিভালের নর্তকীদের সঙ্গে নাচতে। 

                আমি তো ছিলাম রিও ডি জেনেরিওর ভারতীয় এমব্যাসিতে, ট্রেনি হিসাবে, প্রোবেশানারি  পোস্টিঙের আগে। সেসময়ে পরিচয় হয়েছিল দূতাবাসের অফিশিয়াল ট্রানস্লেটর-ইনটারপ্রেটার কণিকা হালদারের সাথে, হৃদ্যতা বলতে পারিস; দজনেই বুঝতে পারছিলাম একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি, বাঙালি বন্ধুর অভাব মেটাতে, বাংলায় কথা বলার লোভে । আমরা দুজনেই টের পেয়েছিলাম যে প্রেম বিয়ে সংসার করা টাইপের নই, দুজনেই, ক্যারিয়ারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে শেষকালে, জীবনকে রুদ্ধ করে দেবে, পরস্পর আলোচনা করে আর এগোইনি।

                কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতে অন্য যুবক-যুবতীরা চুমু খাচ্ছিল, দেখাদেখি বলতে পারিস, আমরাও খেলাম, কণিকা হালদার বলল, ছিঃ, চুমু জিনিসটা নোংরা, স্মেলি, কি যে হয় চুমু খেয়ে। 

               আমারও মনে হয়েছিল, একে তো ভালোবাসি না, কেনই বা একে চুমু খাচ্ছি, এর মুখে ক্যাণ্ডললাইট শুয়োর-ডিনার খাবার দুর্গন্ধ । ব্যাস, আমার জীবনে শেষ তরুণী।

                এখন ভেবে দেখলে, মনে হয়, ভাগ্যিস কণিকা আর আমি জড়িয়ে পড়িনি। পড়লে, তোকে অন্য কেউ স্পনসর করত, আর আমার জীবনের অভিমুখ থাকত না কোনো।

                অভিমুখ সব সময় যে নিজের নির্ণয়ের ওপর নির্ভর করে না, তাও জেনেছি, পরে।

               পূর্বপুরুষ না থাকলেও উত্তরাধিকার বর্তায়, পাখিরা ওড়ে তবু কিন্তু হাওয়ায় দাগ পড়ে না।

               মাঘ মাস আসতে না আসতেই পাতারা সবুজ রঙ খরচ করে ফ্যালে। ধুলো, ধুলো, ধুলো।

               মুখমেহনের স্বাদ, উল্লাসধ্বনি, স্ফীতির কনকনে চড়াই-উৎরাই, কেবল ঘণ্টাখানেকের উগ্রতা।

               তোর মতো তোর মতো তোর মতো অনুচক্রিকা, ভাবতে পারিনি আমিই ঘুটি, আমিই জুয়া।

                জগদীশ আর ওর বউ একবার দুজনে এসেছিল লাক্ষাদ্বীপে, কাভারাত্তিতে, আমার কাছে, তোরা দুজনে নৈনিতালে আর আরিয়ান আজমেরের হোস্টেলে। বৈদেহী ক্লাস টুয়েলভে, পরীক্ষায় টেন্সড আপ। 

               অমরিন্দর কয়েক পেগ টানার পর রোজই সন্ধ্যায় বলত, প্রধান ইউ হ্যাভ স্পয়েল্ড ইওর লাইফ, জীবন নষ্ট করে ফেললে, এখনও চান্স আছে, লাইফ পার্টনার যোগাড় করে নাও, নয়তো চুল পেকে গেলে ভিষণ লোনলি ফিল করবে।

                বিয়ে করার জন্য আমাকে চাপ দেবার পেছনে যে অন্য উদ্দেশ্য আছে, তা তখন বুঝতে পারিনি।

                লোনলি ? একা ? নিঃসঙ্গ ? নাঃ, মনে হয়নি কখনও যে আমি একা। এইজন্য নয় যে তুই আছিস আমার জীবনে, আমি তোর পালক পিতা, তোর কথায় ফাউনডিং ফাদার, আসলে আমার চরিত্রে একাকীত্বের বিষ নেই রে, একেবারেই নেই। ফাইল খুললেই মানুষের ভিড় দেখতে পাই, তারা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকে।

               পালক পিতা বলতে পারব কি নিজেকে, ধাত্রীবাবা?  

             একরাতের ঘটনা বলি তোকে ; তখন আমি পুডুচেরিতে। তোর বারো ক্লাসের আইডেনটিটি কার্ডের ফোটো দেখে অব্দি পরাভূত টান অনুভব করেছি । কার্ডটা পাবার পর কতবার যে দেখেছি ফোটোটা। আর তার ফলে কী হল জানিস? স্বপ্ন দেখলুম তোকে, স্বপ্নে পেলুম তোকে,  ভরাট শরীর, আর আমার, বহুদিন পর, এই বয়সে, ভেবে দ্যাখ, এই বয়সে আমার নাইটফল হল । 

             উড়তে লাগলাম, ঝড়ের চক্রব্যুহে থেকে অতিঝড়ের চক্রব্যুহে, বাজপাখি হয়ে, ঈগল হয়ে, নখের রক্ত চাটছি, নিচে চোখ মেলে দেখছি উপত্যকায় তুই দৌড়োচ্ছিস দু-হাত দুই দিকে মেলে, পোশাক পরিসনি, নামছি, নামছি, নামছি, ব্যাস, ছোঁ মেরে তুলে নিলাম তোকে; কিন্তু তুই-ই আমাকে খেতে লাগলি, বললি, বদলা, বদলা, প্রতিশোধ, কারাগারে আটক রাখার প্রতিশোধ। 

            তোর কনকনে দেহ, বললি, আগুনের ফোয়ারা দিন, বরফকে গলিয়ে ফেলুন, গলিয়ে ফেলুন, দ্রুত নয়, দ্রুত নয়, এক ঘণ্টা মানে ষাট মিনিট, প্রচুর সময় রয়েছে, অন্ধকারকে রোমশ হতে দিন, হাতের আঙুলের ডগায় দৃষ্টি নিয়ে যান, প্রচুর সময় আছে, সময়ই সময়।

                ঘরের ভেতরে ঢুকে ঝোড়ো ঝড় যদি নিজের হাতে চুপিচুপি দরোজা বন্ধ করে দ্যায়, অন্ধকার পোড়োবাড়িতে আটক প্রতিধ্বনির ঢঙে, যেন গর্তের হৃদয়ে ইঁদুরের ধান জমা করার রাত।

                বলা যাবে কি জীবন নষ্ট? 

                স্বপ্নে তুই যবে থেকে আসা আরম্ভ করেছিস, তোর আইডেনটিটি কার্ডের ফোটোগুলো আর দেখি না । তোকে স্বপ্ন থেকে চলে যেতেও বলেছি একদিন স্বপ্নের ভেতরেই, তুই-ই আষ্টেপৃষ্টে  শরীরের ফেরোমোন দিয়ে জড়িয়ে ধরলি, আমি ছাড়াতে পারলাম না, সারা স্বপ্ন ছেয়ে গিয়েছিল তোর উড়ালক্লান্ত সুগন্ধে।

                আসলে নষ্টামির স্বপ্ন দেখি ; ভালো লাগতে আরম্ভ করেছে রে,  স্বপ্ন, উঞ্ছমজুরিতে-পাওয়া সম্রাজ্ঞীর প্রেরণার অপ্রত্যাশিত আক্রমণে কাহিল। এছাড়া অন্য উপায় আমার জানা নাই, আয়ত্বে নেই।

                আহ, কি আরাম, কি আরাম, কি আরাম ।

                জীবন নষ্ট কাকে বলে ? জগদীশের ছোটোবোন চিন্ময়ীর বর অর্নব চ্যাটার্জি প্যাংক্রিয়াটিক ক্যানসারে মারা গেল, যেদিন চিন্ময়ীর শাশুড়ির শ্রাদ্ধের ভোজ, সেই দিনকেই । রান্নাবান্নাও আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল শাশুড়ির শ্রাদ্ধের ভোজের জন্য । অতিথিরাও বাইরে থেকে এসে পড়েছিল অনেকে । আমিও গিয়েছিলাম জগদীশের সঙ্গে । শ্মশান থেকে যখন আমরা ফিরে এলাম, চিন্ময়ী কান্না থামিয়ে বলেছিল, কী পেলুম সারা জীবন ? আইবুড়ো নাম ঘোচাবার জন্যে একটা বর, আর বাঁজা নাম ঘোচাবার জন্যে দুটো বাচ্চা, সারাজীবন তো ও নিচের তলায় মায়ের সেবা করায় ম্যা ম্যা ম্যা ম্যা করে কাটিয়ে পাড়ি মারল ; এত বড় বাড়িটার কী হবে এখন, বাগানের, গাছগুলোর, গাছের ফলের, ফুলের ? ছেলে আর মেয়ে বিদেশেই থাকবে । আমি দোতলায় শুচ্ছি দ্বিতীয় বাচ্চাটা হবার পর থেকে । আমি যে পৃথিবীতে আছি তা ওর খেয়াল ছিল না কখনও । বিধবা শাশুড়ির জন্যে চারবেলা টাটকা নিরামিষ রেঁধে কেটে গেল; তিনি চলে গেলেন, ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন, সগগে গিয়ে স্যাবা নেবার জন্য ।

                কী বলবি তুই?

                আমি তো উচ্চিংড়ের স্বরলিপিতে গাওয়া ফুসফাসুরে গান ; বেড়াজালের হাজার যোনি মেলে ধরে রেখেছি ইলশে ঝাঁকের বর্ণালী। তাকিয়ে-তাকিয়ে যে যুবতীর কৌমার্য নষ্ট করেছি, তারই অদৃশ্য হাতের মাংসল আলিঙ্গনে চোখে পড়েছে কাঁকড়ার আলোতরল বুকে আমার ছককাটা ঠিকুজি, শনি বক্রি, কালসর্পযোগ, কপালের বলিরেখায় গৃহত্যাগী বিষপিঁপড়ের সার। সে যুবতী স্বপ্ন ছেড়ে যেতে চায় না । 

                 জগদীশ ব্যানার্জিকে বলেছিলাম তোর নামটা স্কুলেই সংশোধন করে এফিডেভিট আর গেজেট নোটিফিকাশান দিয়ে নেতি থেকে ইতি করিয়ে নিতে। জগদীশের স্ত্রী অমি,  রাজি হয়নি, বেশ হ্যাঙ্গাম বলে নয়, স্পনসর যে করেছে তাকেই করতে হতো, আর আমি চাইছিলাম না যে তুই কখনও আমার উপস্হিতি তোর জীবনে টের পাস । আমার সাহায্যের ভারে ঝুঁকে পড়িস।

                জগদীশের মেয়ে আর ছেলেও মত দিয়েছিল, নেতি নতুন ধরণের নাম, বদলাবার কোনোই প্রয়োজন নেই।

                তেইশ বছর বয়সে নিজেকে পালক পিতা, ফসটার ফাদার, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, জাস্ট ইডিয়টিক, ভাবতেই পারিনি আমি একজন মুকুটপরা বাবা, তোর কুড়িয়ে পাওয়া বাবা। ফসটার মাদারদের বলে ধাই-মা ; আমি তার মানে তোর ধাই-বাবা।

                আমার মা যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন তাঁকে বলেছিলাম যে আমি বিয়ে এইজন্যই করিনি, কেননা আমি একটি শিশুর পালক পিতা। সংবাদপত্রের কাটিংটা দেখিয়েছিলাম মাকে, একজন নার্সের কোলে তুই, সদ্য আঁস্তাকুড় থেকে থানা হয়ে হাসপাতালে পৌঁছেছিস।

                 নিয়ে আয় না, যাবার আগে চাক্ষুষ করে যাই, মার নাক থেকে কেরালিয় নার্স ভেন্টিলেটার সরিয়ে দিতে, বলেছিলেন। 

                 আমি ওকে জানতে দিতে চাই না মা, যে আমি ওর জীবনে ঈগলপাখির মতন ডানা মেলে আছি; জগদীশ আর ওর বউ অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছে ।

                 সত্তা, মুহূর্ত, ভাষা, বীর্য, স্পন্দন, উৎসমুখ, কচুর জঙ্গলে ফড়িং, কলার মান্দাস, কাপড়ের খুঁট ।

                 বরফঝুরির গ্রন্হি শুভ্রবিষ অনন্ত শিকড়ে । কাদায় কলকা এঁকে রেখে গেছে কীট । 

                 কাঠঠোকরার বাসার ফুটোয় সাইক্লোনের মতন ফুঁ দিয়ে বাজানো বাঁশির সুর । বাজাও হে বাজাও  

                 বুদবুদেরা জাতিস্মর হয়, তা এক মাদারির ইন্দ্রজাল।

                এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

                যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

                 ব্যানার্জি পরিবারকে তোর স্হানীয় অভিভাবক করতেও চাপ দিতে হয়েছিল। ওরা প্রথমে রাজি হয়নি। অযথা ঢুকতে চাইছিল না আমার আর তোর জীবনের আগাম জটিলতায়। ব্যানার্জি যখন হরিয়ানায় হিসারের এসডিও ছিল তখন আমিই ওকে বাঁচিয়েছিলা জাঠদের গোঁসা থেকে। 

                ব্যানার্জি কীই বা করত ! মারোয়াড়ি আর গুজরাতিদের ছেড়ে দেয়া ধর্মের ষাঁড়গুলো হেলতে দুলতে হরিয়ানায় পৌঁছে মাদি মোষদের সঙ্গে সঙ্গম করছিল আর মোষগুলোর কিছুদিনেই গর্ভপাত হচ্ছিল, শরীর খারাপ হচ্ছিল, দুধের ঋতু হাতছাড়া হচ্ছিল। ষেঁড়োমোষগুলোকে ওরা বেঁধে রাখে, প্রজননের ঋতুতে মাদিমোষদের চাষিরা নিয়ে যায় ষেঁড়োমোষদের মালিকের গোয়ালে ; মালিকদেরও রোজগার হয়। 

                 জাঠ পঞ্চায়েতের কর্তা জগদীশকে টিটকিরি মেরে বলেছিল, বাঙালি ষাঁড় চাপছে হরিয়ানার মাদিমোষের ওপর, সে আর কি করে বুঝবে যে গোরু আর মোষ একই প্রজাতির প্রাণী নয়। 

                 ষাঁড়গুলো গরু খুঁজে পায় না হরিয়ানার পথে আর খেতে। তারা তাড়নায় এলে সামনে মাদিমোষ পেয়ে তাদের ওপরই চাপে। 

                 আমি হিসারের জাঠসভার কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে, গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগের বাজেট থেকে  লোকসানের টাকার সরকারি ব্যবস্হা করে মন্ত্রীর রোষ থেকে বাঁচিয়েছিলুম ব্যানার্জিকে । তখন আমি ওই বিভাগে।

                পৌরুষের গরিমা, মৌমাছিদের প্রত্যাখ্যাত ফুলের মধু।

               অন্ধকারে স্পর্শের মর্মার্থের সাথে আলোয় স্পর্শের মর্মার্থের প্রভেদ, সব দেশের সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজে না।

                পশ্চিমবঙ্গের ক্যাডারের জগদীশ হারিয়ানাতে পোস্টিং নিয়েছিল।  না,  অমরিন্দরকে হাসিখুশি রাখার জন্য নয় ; নয়তো সরকারি আধিকারিকদের তো শাসকদলের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ আর না-তে না মেলানো ছাড়া কোনো কাজ নেই, পুঁজিবাদ হোক, সাম্যবাদ হোক, গান্ধিবাদ হোক, খিচুড়িবাদ হোক, হিন্দুবাদ হোক, মুসলমানবাদ হোক, গণতন্ত্র হোক, আমিরতন্ত্র হোক, একনায়কতন্ত্র হোক, দেশে-দেশে তা-ই তো ঘটে চলেছে । 

                 না, না, বউয়ের জন্য নয়, হরিয়াণায় উপরি রোজগার করাকে সমাজ স্বাভাবিক  মনে করে, তাই। পশ্চিমবাংলায় ঘুষও খায় আবার সৎসন্ন্যাসী সেজে থাকে, প্যাঁচ-পয়জার মারতে হয়, বুঝিয়েছিল জগদীশ, অমরিন্দরের সামনেই,  ওদের অ্যানিভার্সারির  ককটেল পার্টিতে, হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে, চণ্ডীগড়ে । পশ্চিমবাংলায় ঘুষের গুড় খেয়ে ফ্যালে নেতারা । ব্যুরোক্র্যাটদের তোল্লাই দেয় না। হরিয়াণায় খাও আওর খিলাও, পেয়ারে, মজাদার চানা জোরগরম ।

                পশ্চিমবাংলাকে জগদীশ বলে ওয়েএএএএস্ট বেঙ্গল, বামপন্হীরা সুযোগ ওয়েএএএস্ট করেছে, তারপর যারা এলো তারা ওয়েএএএস্টকে সুযোগ দিয়েছে, যারা জঙ্গলে লুকিয়ে বিপ্লব করছে তারা নিজেদের জীবন ওয়েএএএস্ট করছে । কোথায় খাবে, খাওয়াবে, তা নয়, কেবল বাকতাল্লা । জগদীশের ওয়েস্টলাইন পাছার দ্বিগুণ হতে চলল ।

                প্রেগনেন্ট বলে অমরিন্দর তিন পেগ মাত্র সিঙ্গল মল্ট  খেয়েছিল, ঘুষের । জাঠনি, মাতাল হয় না, মাতন লাগে ।

                আমি বাড়ির বাইরে ড্রিংক করতে পারি না, যুৎসই মনে হয় না, নিজেকে অগোছালো না করে, লুঙ্গি পরে, ঠ্যাঙ ছড়িয়ে, একা-একা, চুপচাপ, বসে  ড্রিংক করি ।

                 জগদীশ আর অমরিন্দর প্রথমে গররাজি থাকলেও, নেতি, তোকে ওনারা  ডানার আড়ালে নিয়েছিলেন, তা তুই স্বীকার করিস  কিনা জানি না । 

                 আমি ব্যানার্জির বলে-দেয়া অ্যাকাউন্টে প্রতিবছরের শুরুতে টাকা জমে করে দিয়েছি, আজও করি। ওরা যে অ্যামাউন্ট বলে, জমা করে দিই । বারবার নতুন অ্যাকাউন্ট খোলে, বড্ড মনে রাখার ঝামেলা। তুই অ্যাডাল্ট হলে তোর নামে খুলবে হয়ত, কিন্তু তখন তো তুই স্বাবলম্বী । আমাকে কি বিদায় করে দিবি স্বাবলম্বী হলে ?

                এনজিওকে সাহায্যের রিবেট পায় আয়করে, তাই ব্যানার্জিও মেনে নিয়েছিল বন্দোবস্তটা। 

                ব্যানার্জিকে স্হানীয় অভিভাবকই শুধু নয়, ওদের পদবীটা্ও আমি তোর নামে জুড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি তো ব্রাহ্মণ নই, জানি অব্রাহ্মণদের নিয়ে কেমন ঠেলাঠেলি চলে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে। 

               আমার পদবি তো প্রধান, প্রভঞ্জন প্রধান। গুজরাতি, কর্নাটকি, মারাঠিদের মধ্যেও প্রধান পদবি আছে। 

                আমি তোকে বাঙালি করে তুলতে চেয়েছি ; তাতেও তোর চাপা অস্বস্তির কথা অমরিন্দর জানিয়েছিলেন একবার। তখনও পর্যন্ত তুই জানতিস না যে তোকে কলকাতা শহরের এক আঁস্তাকুড়ে ফেলে চলে গিয়েছিল তোর মা। যখন জানলি তখন তোর গোঁসা গিয়ে পড়ল পশ্চিমবাংলার ওপর।

                বৈদেহী আর আরিয়ানের চরিত্রে, শুনেছি, বাঙালি হয়ে ওঠার  গোঁ, সব দ্রুত সেরে ফেলতে হবে, শিখে ফেলতে হবে, ক্লাস ফাইভ থেকে, গান, নাচ, বইপড়া, শাড়ি, নলেন গুড়, ছানার মুড়কি, পলাশ ফুল, মাছরাঙা, শুঁটকি মাছ, রাধাবল্লভি, পান্তুয়া-লুচি, ভাপা ইলিশ, সরস্বতী পুজো, বলেছিল অমরিন্দর।

                 পদবি ব্যাপারটা কত  গুরুত্বপূর্ণ তা তোকে স্পনসর করতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম।

                 আঁস্তাকুড় তো পদবি দিতে পারে না, নাম দিতে পারে না, জন্মদিনও দিতে পারে না।

                ব্যানার্জি, বন্দ্যোপাধ্যায়, চ্যাটার্জি, চট্টোপাধ্যায়, মুখার্জি, মুখোপাধ্যায়, গাঙ্গুলি, গঙ্গোপাধ্যায়।

                কারা তুলে নিয়ে যাবে পথপার্শে পড়ে থাকা কয়েকদিনের বাসি লাশ?

                মৃতদেহে পোকা ? মৃতের দেহ থেকে তাহলে প্রাণও জন্মায়, অবাক অবাক হও।

                শ্মশানে কাদের হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে চলে যেতে চাও !

                শকুন, পদবি বলো, কাদের মাংসপিণ্ড অসীম আকাশে গিয়ে খাও।

   

                  তুই বেশ পরে সুস্পষ্টভাবে জানতে পেরেছিলি,  যে তোকে ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পেয়েছিল কলকাতার যাদবপুর থানার পুলিশ, ভোররাত থেকে যারা বাঁশদ্রোণী বাজারের সামনে বাঁধাকপির সবুজ পাহাড় গড়ে তোলে, একের পর এক দূরপাল্লার ট্রাক থেকে, তখনই ওরা তোর কান্না শুনতে পেয়েছিল । 

                  এত জায়গা থাকতে ডাস্টবিনেই কেন ? তুই বার বার নিজেকে আর তোর  অভিভাবকদের প্রশ্ন করেছিস, শুনেছি । তারাই বা এর উত্তর কী করে দেবে । হয়ত তোর মা চেয়েছিলেন যে তুই বেঁচে থাক, বাজারের সামনে ভোর রাত থেকেই সবজির ট্রাক আসে একের পর এক। 

                  তোর মায়ের হয়তো আশা ছিল যে ট্রাকচালদের কেউ যদি সন্তানহীন হয়, সে তোকে কোলে তুলে নেবে । নেয়নি রে, নেয়নি। ওরা কাছের ক্লাবের ছেলেদের খবর দিলে, তারা থানায়, আর থানা তুলে নিয়ে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে, নয়তো তুই সত্যিই মরে যেতিস। 

                 হাসপাতাল থেকে সমাজসেবীদের চ্যানেল হয়ে এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড এনজিওতে পৌঁছোলি ; আরও বহু পরিত্যক্ত শিশুদের একজন । 

                 সংবাদপত্রে তোর ওই সময়ের যে ফোটো বেরিয়েছিল, তা আমার সংগ্রহে আছে ; হলুদ হয়ে গেছে, ভাঁজে-ভাঁজে ছিঁড়ে গেছে, কতোবার যে দেখেছি । তোর এখনকার মুখের সঙ্গে একেবারে মেলে না, ভাগ্যিস মেলে না । 

                 তোর চোখমুখ, এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড দপতরে, ওই বয়সেই এমন আকর্ষক মনে হয়েছিল যে চব্বিশটা শিশুর মধ্যে থেকে তোকেই স্পনসর করার জন্য বেছে নিয়েছিলাম আমি ।

                 বাঁশদ্রোণী বাজার  যে  কোথায় স্পষ্ট করে বলতে পারেনি পরিচিত বাঙালি অফিসাররা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা যেতে পড়ে, বলেছিল কেউ । কলকাতায় গিয়ে, জিপিএস নিয়ে, পৌঁছেছিলাম । আঁস্তাকুড় বা ডাস্টবিন বলা উচিত হবে না; জায়গাটা আসলে ভ্যাট, সারাদিনের বাতিল পচাগলা শাক-সবজি আর মাছের আঁশ-পোঁটা ওখানে ফেলা হয়, হয়তো সবজির নরম সবুজ পাতার ওপরে শুয়েছিলি, হেমন্তের রাতে । 

                বাজারের ভেতরে গিয়ে দীর্ঘদেহী কোনো বিক্রেতাকে দেখিনি, সবজিঅলারা অধিকাংশই মুসলমান,  চাষি পরিবারের । 

                অন্য কোনো এলাকা থেকে তোকে এনে ওখানে ফেলে গিয়ে থাকবে তোর মা কিংবা বাবা, যাতে সহজে তাদের  খুঁজে পাওয়া না যায় ।

                 আঁস্তাকুড়ের প্রসঙ্গ উঠলেই তুই বিব্রত হতিস, তোর মনে হতো সারা গায়ে নোংরা, কখনও উৎসাহ প্রকাশ করিসনি জায়গাটা দেখে আসার, শুনেছি । বরং বিরক্ত হতিস প্রসঙ্গটা উঠলে।

                 জগদীশ বলেছিল আমাকে, ক্লাস সেভেন থেকে পড়াশুনার শেষ ধাপ পর্যন্ত তুই প্রতিবছরের ডায়রিতে একটা বাক্য অবশ্যই লিখেছিস, “আই নো সামবডি ওনস মি, বাট হি ইজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি ।” তোর সেই সব ডায়রির ওই পাতাটা ছিঁড়ে আমাকে দিয়েছে অমরিন্দর।   

                শেষে, বাঁশদ্রোণী বাজার তুই গেলি দেখতে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে।  যৌবনের শীর্ষে তখন তুই, আঁস্তাকুড়ের কথা শুনলেই যার সারা গায়ে র‌্যাশ বেরোতো ? শুনেছি,  অমরিন্দরের মুখে । 

 

      

দুই

                 ইলেকট্রিক? এরকম নাম হয় নাকি! 

                 তাই তো বললেন।

                 অনুমান করিনি তুই কখনও আমার শান্তি ইনভেড করবি, এইভাবে, হাতে লাল সুটকেস, কাঁধে হলুদ ব্যাগ, ফেডেড জিন্স, লাল ঢিলেঢালা টপ কিংবা জার্সি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি মনে হল, তার ওপর শাদা ব্লেজার, পায়ে সাতরঙা ফ্ল্যাপার, ডান হাতে গোটা পাঁচেক স্লোগানচুড়ি, কানে চুড়ির মাপের লাল রঙের মাকড়ি, হাতের আর পায়ের নখে ব্রাউন-লাল নখপালিশ, হাতের নখ ততো বড়ো নয়, পোশাক অত্যন্ত দামি, আঁচ করতে পেরেছিলাম, ঘাড় পর্যন্ত কোঁকড়া চুল। অথই আলগা চটক, অথই ।

                দেখছি দেখছি দেখছি দেখছি দেখছি দেখছি ; সন্মোহনকে অনুবাদ করা নির্বাক দৃষ্টি; আজ দশটা বেজে তিন মিনিটে সময় কিছুক্ষণের জন্য স্হির, অবিচল, পৃথিবী শুরু হল, রাতে  ঘুমিয়েছিলাম কিনা মনে করতে পারছি না, ধুনুরিরা কি আমাকে পিটিয়ে মেঘ করে উড়িয়ে দিয়েছে !

                তুই ছাড়া আর কে-ই বা এভাবে শান্তিভঙ্গ করতে চলে আসবে নিজের বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে?

                দুই হাতে মেহেন্দির নকশা ! 

               মেহেন্দি? কেন ? প্রশ্নের উদ্বেগে আক্রান্ত হল মস্তিষ্ক ; মরুভূমির বালিতে মাকড়সাপায়ে আঁকা মানচিত্র।

                তুই তো চাকরি নিয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলি, নিঃশব্দে নিজেকে বললাম, নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম শুনে, যাক, সেটল হলি, আমার মিশন সাকসেসফুল, ভাবছিলাম, ভাবছিলাম, ভাবছিলাম, তোকে দেখতে দেখতে, তোকে দেখে যে চিনতে পারিনি তা বলব না, চিনতে পারার আক্রমণে বিপর্যস্ত, সেই ক্লাস টুয়েলভের পর তোর ফোটো দেখার সুযোগ হয়নি । কিন্তু ঝলকানি, ঝলকানি, ঝলকানি ।

                কেবল স্বপ্নে যেটুকু আবছা ঢেউ।

                আমার সমান ঢ্যাঙা হয়ে উঠেছিস।

                আমি স্তব্ধ হতবাক থ দেখে তুই বলে উঠলি, ঠিকই বলেছে তোমার পিওন না অর্ডারলি, হোয়াটএভার, আমি এলেকট্রা, মহাকাব্যের নায়িকা, কবিকল্পনার মেয়ে।

                মগজের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটল, এলেকট্রা, কবিকল্পনার নায়িকা, অপার্থিব, রহস্যময়? 

               একটা শব্দের ভেতরে কতটা বারুদ যে লুকিয়ে থাকতে পারে তা আমিই জানি। নিজেকে বললাম, হ্যাঁ, স্বপ্নের ভেতরে তোকে, যার পালক পিতা আমি, যাকে তুই বলেছিস ফাউনডিং ফাদার, পেয়েছি, এলকট্রার মতনই নিষিদ্ধ সম্পর্ক পাতিয়েছি ।

               সেই সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা দিতে এলি নাকি, মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না, গলা শুকিয়ে গেছে ।

                আমার চাঞ্চল্য গোপন করতে গিয়ে প্রবল আবেগে আপ্লুত হলাম, টের পাচ্ছিলাম যে প্রতিক্রয়ার বিস্ফোরণ ঘটছে নিঃশব্দে, তোকে ঘিরে তেজোময়তার দুর্নিবার জ্যোতি, তুই এই মুহূর্তে যদি না আসতিস তাহলে আমি পচনে ধ্বসে পড়তাম – এরকম মনে হল, বাসনার , চকিত দ্যুতি দিয়ে আমাকে নতুন দৃষ্টি দিলি তুই, এতদিন পর্যন্ত আমি বন্দি ছিলাম ফালতু জাগতিক জীবনে, তুই মুক্ত করে ছড়িয়ে দিলি মঙ্গলময় লিবিডোর গোপন রঙ্গ । উচ্ছ্বাস ।

               এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

               যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

                ইতি, তুমি, আমার মুখ দিয়ে এইটুকই বিস্ময় ক্ষরিত হয়েছিল, সন্তর্পনে, নিয়ন্ত্রিত শ্বাসে।

                কান থেকে ইয়ার-প্লাগ বের করে বললি, ইতি, এখন ইতি, নেতি নাম রেখেছিলে তো ! নেটি, বাঃ, কি একখানা নাম রেখেছিলে ! আশ্চর্য লাগছে না? কী করে তোমায় খুঁজে বের করলুম ? এনিওয়ে, আজ তো রবিবার, তোমার কর্মীদের দিয়ে আজও খাটাচ্ছো? ওদের তো পরিবার পরিজন আছে । টেল দেম টু গো হোম । 

               বোধহয় বাবলগাম খাচ্ছিস, কথাগুলো চিবিয়ে বললি, চিবিয়ে বলা সংলাপে থাকে বেপরোয়াভাব, জানি । ইয়ার-প্লাগ  জিন্সের সামনের পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে-রাখতে বললি, তোমাদের ঈশ্বরগুলো সব কালা হয়ে গেছে, কেউ তাকে ছাদে দাঁড়িয়ে লাউডস্পিকারে ডাকছে, কেউ আবার দল বেঁধে জগঝম্প বাজিয়ে ডাকছে, ডিসগাস্টিং টোটালিটেরিয়ানিজম । ঈশ্বরগুলোও আমার মতো সকাল থেকে বিরক্ত হয়ে গিয়ে থাকবে জগঝম্পের ঝালাপালায় ।

              অ্যাটিট্যুড, অ্যাটিট্যুড, আই অ্যাম কুল, আই অ্যাম গার্লি, আই অ্যাম ফেমিনিন, অ্যাটিট্যুড । তোর দিকে, চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এক পলক তাকিয়ে, নিজেকে নিঃশব্দে বললাম আমি।

               আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে, স্লোগানচুড়ির ঝিনঝিন বাজিয়ে, নিজেই হুকুম দিলি, আপ লোগ ঘর যাইয়ে, আজ কিঁউ কাম কর রহেঁ হ্যাঁয়? ছুট্টি হ্যায় না আজ ।

               সেকশান অফিসার পেনডিং ফাইলগুলো দিতে, আর রাতে যেগুলো ক্লিয়ার করে দিয়েছি সেগুলো নিতে এসেছিল । পিওন রবিন্দর সিং ওর সঙ্গে  । ওরা আমার দিকে তাকিয়ে নির্দেশের অপেক্ষা করছে দেখে তুই বললি, হাঁ, হাঁ, যাইয়ে, ঘর যাইয়ে, ম্যাঁয় ইনকি রিশতেদার হুঁ, বিদেশ সে আয়া হুঁ বহুত দিনোঁ বাদ ।

               আমি তো জাস্ট বোবা, মাথা নাড়িয়ে, ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে, বললুম, করিম সাহব, যাইয়ে, ফাইলোঁ কো লে যাইয়ে, কল অফিস যাকর হি দেখুংগা ।

               হুকুম করার কন্ঠস্বরে তুই বললি, চাপরাশি কুক আর কে কে আছে, সবাইকে যেতে বলো, আমি রাঁধতে পারি, ইনডিয়ান, ওয়েস্টার্ন, চাইনিজ, থাই, মেক্সিকান, টার্কিশ, যা খেতে চাও । টেল অল অফ দেম টু গো ; আমি চাই না যে তোমার কোনো কর্মচারী আজ বাড়িতে থাকে।

                চাপরাশি নানকু প্রসাদ তোর সুটকেসটা তুলে আমাকে জিগ্যেস করল, গেস্ট রুমমেঁ রখ দুঁ ?

                তুই তাকে বললি, আপকো কুছ করনে কি জরুরত নহিঁ হ্যায়, আপ ভি ঘর যাইয়ে, রসোই বনানেওয়ালে অওর মালি কো ভি বোলিয়ে আজ সবকি ছুট্টি ।

                তোর হুকুমে সন্মতি দিলাম, চলে গেল ওরা ।

               ফেনিল কথার ঢেউ, আলোকোজ্জ্বল চাউনি, উসকে-দেয়া রক্তসঞ্চালন।

               চৌম্বকীয় আঠা, আকস্মিকতার টান, অমেয় চিরন্তন ।

   

               ইলেকট্রিসিটি নয়, আমি এলেকট্রা । জানো তো এপিকের নায়িকা এলেকট্রা ? গ্রিক মহাকাব্যের এলেকট্রা ? এলেকট্রা কমপ্লেক্সের এলেকট্রা । আমি সেই এলেকট্রা কমপ্লেক্সের এলেকট্রা, মহাকবির কল্পনা দিয়ে গড়া । তুমি তো ইংরেজি সাহিত্যে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিলে !

              আমি চুপ করে আছি, দেখছি তোকে, অবাক, কুয়াশা, অঝোর বৃষ্টি, বাতাসে শিউলিফুলের গন্ধ বলে চলেছে উৎকীর্ণ করো, শিহরিত করো, উষ্ণ করো। 

              ভাবছি, তুই কি করে এলেকট্রার গল্প জানলি, তুই তো ম্যাথামেটিক্স, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির বইপোকা ছিলিস, ইলেকট্রনিক্স পড়েছিস। আমি যেসব বইপত্র তোর নামে জগদীশের বাড়ি পাঠিয়েছিলাম, তাতে কি এলেকট্রা প্রসঙ্গ ছিল, মনে পড়ছে না, উঁহু, মনে পড়ছে না । থেকে থাকবে, বইগুলো বাছাই করত পড়ুয়া জুনিয়ার অফিসাররা, আমি পেমেন্ট করে দিতাম।

               ভাবছ কী করে তোমাকে লোকেট করলুম, তাই না? না, বাপি, আই মিন আঙ্কলবাপি, বা আন্টিমা বলেননি, ওনাদের কাছে জানতে চাইনি কখনও ; জানতে চাইলে ওনারা তোমাকে নোটিফাই করে দিতেন, আর তুমি তোমার পায়ের ছাপ মুছে ফেলার চেষ্টা করতে। 

               হাত ঝাঁকিয়ে স্লোগানচুড়ি বাজিয়ে বললি, তোমাকে লোকেট করা ছিল বেশ সিম্পল । প্রায়ভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিকে বলেছিলুম, আঙ্কলবাপির অ্যাকাউন্টের ফিনানশিয়াল ট্রেইল ফলো করতে, কোথা থেকে টাকা আসত ওনার অ্যাকাউন্টে আর যেত আমার স্কুলে,  এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড সংস্হায়, যাদের আজও সাহায্য করে চলেছ । আর যিনি ফানডিং করতেন তাঁর নাম কি, এখন কোথায় থাকেন ।  বাপির, আই মিন আঙ্কলবাপির, বড্ড বদভ্যাস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অহরহ বন্ধ করা আর খোলা ।  প্রতিটি অ্যাকাউন্ট নম্বর জানি ।

               গত রবিবার তোমার লোকেশান জানতে পেরেছি, সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাইট নিয়ে চলে এসেছি ।

               তারপর তুই যা বললি, তা আরও আক্রমণাত্মক, বললি, তোমার বেডরুমটা কোথায়, জিনিসগুলো রাখি । 

              বললুম, ওদিকে নয়, ওই রুমটা জিম, এক্সারসাইজ করি ।

              ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, জিম, রিয়ালি ? তাই এমন পেটা মাসকুলার বডি রেখেছ, ব্রোঞ্জপুরুষ, হি-ম্যান । ভালো, ট্রেডমিলও রেখেছ দেখছি, কাজে দেবে । ঘুষের টাকায় নয়তো ?

              জিমঘরটা আমার আগে যিনি এই বাংলোয় ছিলেন, তাঁর ।

              জানি, তুমি ঘুষ নাও না, তবু জিগ্যেস করতে ভালো লাগল । তুমি তো জ্ঞানবৃক্ষ, বোধিবৃক্ষ, তাই না ? ফাঁসিবৃক্ষ বলা যাবে কি? ঘুষ নিতে ভয় পাও ? না এথিকসে বাধে ? ঘুষ ছাড়া দিল্লি শহরে সৎ থাকা শুনেছি অলমোস্ট ইমপসিবল, টিকে আছ কেমন করে ? মন্ত্রীদের প্লিজ করতে হলে তো ঘুষ ছাড়া উপায় নেই ! ঘুষ নেয়া হল এ ফর্ম অফ আর্ট, দুর্বলহৃদয় মানুষ রপ্ত করতে পারে না, বিশেষ করে ডুগুডাররা । দিল্লিতে কতদিন আছো ? ট্রান্সফার অর্ডার এলো বলে, ঘুষ না খেলে আর তা শেয়ার না করলে ট্রান্সফার অনিবার্য, তাও তুমি আবার এজিএমইউ ক্যাডারের, পাঠাবে সিলভাসা, পোর্ট ব্লেয়ার বা পুডুচেরি ; অরুণাচল প্রদেশ বা সিকিমেও পাঠিয়ে দিতে পারে ।

              শিশিরে কেউটের গন্ধ ।  উতরোল কোলাহল ।

              স্ফিংক্স, মরুভূমি, পিরামিড, মমি । চাউনির অতিশয়োক্তি ।

              এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

               আমি সুটকেসটা তুলে নিচ্ছিলাম, তুই নিজেই তুলে নিয়ে বললি, যথেষ্ট শক্তি আছে গায়ে, ড্যাডি ডিয়ারেস্ট, আই নিউ, সামওয়ান ওনস মি, অ্যান্ড ওয়াজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি ।

              এক পলকে দেখলাম, তোর সোনালি আর রুপালি স্লোগান-চুড়িগুলোতে গোলাপি রঙে লেখা লাভ ইউ, কিস ইউ, ইউ আর মাইন, ইংরেজিতে । দু-হাতে কনুই পর্যন্ত মেহেন্দির নকশা । আমেরিকায় মেহেন্দির ব্যবসা পৌঁছে গেছে, আশ্চর্য লাগল দেখে ।

              বললাম, কি মাথামুণ্ডু বকছিস ! আমার গলায় শ্লেষ্মার বদলে অবাক হওয়ার শেষে অতিপরিচিতির স্ফূর্তি ।

              এই তো, এই তো, তুমি থেকে তুইতে এলে তো ? তুই বললি । 

              আমার কাছে এসে, নিঃশ্বাস ফেলা দূরত্বে দাঁড়িয়ে বললি, প্রায় ফিসফিস করে বললি, ফ্রম টুডে অনওয়ার্ডস, আই ওন ইউ ইন দ্য সেম ওয়ে অ্যাজ ইউ ওনড মি ওয়ান্স আপঅন এ টাইম । হ্যাঁ, তুমি আমার অস্তিত্বের মালিক ছিলে এতকাল, এখন আমি তোমার অস্তিত্বের মালিক, বা মালকিনি, হোয়াটএভার । অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোল এবার আমার মুঠোয় ।

              এগোলুম বেডরুমের দিকে, তোর হাত থেকে সুটকেসটা কেড়ে নিয়ে, পেছন-পেছন তুই । আবৃত্তি করতে লাগলি, খোশমেজাজি কন্ঠস্বরে, কোনো পরিচিত গায়িকার মতন গলা, কার গলা যেন, কার গলা যেন :

               You do not do, you do not do

               Any more, black shoe

               In which I lived like a foot

               For thirty years, poor and white,

               Barely daring to breathe or Achoo

             

                Daddy, I have had to kill you

                You died before I had time

                Marble-heavy, a bag full of God

                Ghastly statue with one gray toe

                Big as Frisco seal

               

                And a head in the freakish Atlantic

                Where it pours bean green over blue

                In the water of beautiful Nauset.

                I used to pray to recover you

                Ach, du

                

                পেছন ফিরে জিগ্যেস করলাম, কার কবিতা। 

                তোর মুখেচোখে কেমন যেন পরিতৃপ্ত ব্যঙ্গের ছায়া।

                তুই বললি, জাস্ট দ্যাট ? কবিতাটা সম্পূর্ণ মুখস্হ ; আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা। যিনি লিখেছেন তিনি বলেননি কি যে কবিতাটা একজন মেয়ের এলেকট্রা কমপ্লেক্স? আর হলোকস্টের মেটাফরগুলো? ভয় পাচ্ছ কেন?  শোনো না পুরোটা। তোমাকে তো আউশউইৎসে পাঠাচ্ছি না। আর হ্যাঁ, বইগুলো তুমিই বাপির, আই মিন আঙ্কলবাপির, ঠিকানায় আমার জন্য পাঠিয়েছিলে। মনে করো, মনে করো, মনে করো।

                ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেছি, কবিতাটা কার লেখা মনে করতে পারলাম না ; সিলেবাসে ছিল না, বোধহয়। এমিলি ডিকিনসন কি ? নাহ, অন্য কারোর। ক্রিস্টিনা রসেটি, এলিজাবেথ বিশপ, এডিথ সিটওয়েল? মনে আসছে না। এই কবির বই তো পাঠাইনি বলেই মনে হয়, কে জানে হয়তো ভুলে গিয়ে থাকব, আমি নিজে তো পাঠাইনি, জুনিয়ার অফিসারদের দিয়ে কিনিয়ে পাঠিয়ে দিতাম। 

               অফিসের ফাইলের জগতে ঢুকে গিয়ে সাহিত্য উধাও হয়ে গেছে মগজ থেকে ; সরকারি ফাইলের আঁকশি হয়, অক্টোপাসের মতন ।

                বাবলগাম ফুলিয়ে ফাটালি, বললি, নিও-ফ্রয়েড মনস্তত্ব, কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং, মনে পড়ছে? তুমি তো ইংরেজিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস এম এ ! কবির নাম মনে পড়ছে না ? তোমার স্নাতকস্তরে সাইকোলজি ছিল, তাও জানি।  না, আমি পেনিস এনভির প্রসঙ্গ তুলছি না, ন্যাটালি অ্যানজিয়ার তো বলেই দিয়েছেন, পেনিস এনভি আবার কি, শটগান নিয়ে কী হবে, যখন মেয়েদের রয়েছে অটোম্যাটিক অস্ত্র । 

                কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, বোধহয় আমার উত্তরের প্রতীক্ষা করে, জবাব না পেয়ে, বললি, লিবিডোও নয়, জাস্ট ফ্যাসিস্ট ড্যাডি আর মহাকাব্যের এলেকট্রার সম্পর্কের প্রসঙ্গ, ইনসেস্ট, ইনসেস্ট, ইনসেস্ট।

               পেনিস শব্দটা এমনভাবে বললি, যেন প্রায়ই বলিস ; হতে পারে, আমেরিকানদের তো কথার আড় নেই। আর ইনসেস্ট ? রক্তচাপে শিবের তাণ্ডবনাচ শুনতে পাচ্ছি ; হলোকস্ট ? আউশউইৎস ? রগের দপদপ কানের ইয়ারড্রামে ।

               কবিতাটা আবৃত্তি করে কী বলতে চাইছিস বুঝতে পারছি না, তবে তোর কন্ঠস্বর বেশ মধুর, বললাম, শুকনো গলায় খাঁকারি দিতে না হয়, তাই ঢোঁক গিলে ।

               বেডরুমে ঢুকে তোর সুটকেস নামিয়ে রাখতে, তুই দেখলি সেন্টার টেবিলের ওপর ব্ল্যাক ডগ স্কচ আর একটা গেলাসে সামান্য মদ, কাল রাতে অর্ধেক খাইনি, কাজে মশগুল ছিলাম, বেঁচে গেছে কিছুটা । 

               তুলে খেয়ে নিলি, এক চুমুকে,বললি, বড়ো ক্লান্ত হয়ে গেছি, জেট ল্যাগ, এত দীর্ঘ ফ্লাইট, কই আরেকটু দাও তো, গিলে বাকি অংশ শোনাই তোমায় । ভাবছ নাকি, যে ইলেকট্রনিক্স ইনজিনিয়ার কি করে কবিতা শোনাচ্ছে? তোমার দেয়া লিরিকাল ব্যধি। হ্যাঁ, তোমারই দেয়া, থরে-থরে বই, তাক-তাক বই, এনজয় করতুম, স্যাডনেস এনজয় করতুম, গ্রিফ এনজয় করতুম, তোমার অদৃশ্য বন্দিত্ব এনজয় করতুম, আর প্যাঁচ কষতুম, কে লোকটা, আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, আমার হাঁটবার রাস্তায় অ্যাসফাল্ট পেতে সুগম করে দিচ্ছে, জীবনে একবারও হুঁচট খেয়ে পড়তে দিল না ।

               এক পেগ মতন ঢালার পর সোডার বোতল খুলতে যাচ্ছিলুম, বললি, নো, নো, মাতন লাগতে দাও, খাবো তবে তো মনের কথা বলতে পারব, কতকাল যাবত চেপে গুমরে উঠেছে কথাগুলো । 

               এক চোঁয়ে খেয়ে, ফ্ল্যাপার ছুড়ে ফেলে দিলি দীর্ঘ ঢ্যাঙ নাচিয়ে, বিছানায় চিৎ শুয়ে-শুয়েই আবৃত্তি করতে লাগলি, চোখ বুজে :

               In the German tongue, in the Polish town

               Scraped flat by the roller

               Of wars, wars, wars.

               But the name of the town is common

               My Polack friend

              

               Says there are a dozen or two

               So I never tell where you

               Put your foot, your root,

               I never could talk to you.

               The tongue stuck in my jaw.

               আবৃত্তি থামিয়ে, আরও বারোটা স্তবক আছে, বললি,  মনে রেখো আই ওন ইউ, আমি তোমার অস্তিত্বের সত্বাধিকারিণী । কবির নাম জানো না ? খুঁজো , খুঁজো, খুঁজো ।

               আমি : ঘুমিয়ে পড়, ক্লান্ত হয়ে গেছিস, দেখাই যাচ্ছে, রেস্ট নিয়ে স্নান করে, লাঞ্চ সেরে তারপর কথা হবে।

               তুই : না, না, না, না, পালিও না, বসে থাকো, আমি ঘুমোবো আর তুমি এদিক ওদিক টেলিফোন ঘোরাবে, সেটি হচ্ছে না, মোবাইল কোথায়, অফ করে দাও বা সাইলেন্ট মোডে করে দাও । বসে থাকো, চুপটি করে বসে থাকো, আমি ঘুমোবার চেষ্টা করছি, ঘুম ভেঙে যেন তোমাকে বসে থাকতে দেখি । নয়তো, এতক্ষণে জেনে গিয়ে থাকবে আমার বিহেভিয়ার কেমন রাফ, আনকালচারড, মোটেই ভদ্রজনোচিত নয় , জাস্ট রিক্লাইন অন দ্যাট সোফা । 

               বিছানা থেকে উঠে, সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা মোবাইল তুলে সুইচ অফ করে দিলি, ল্যাণ্ডলাইনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখলি , আর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লি আবার, চোখ বুজলি । 

              তুই চোখ বুজতেই খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম তোকে ।  তোর বারো ক্লাসের আইডেনটিটি কার্ডের ফোটোর সঙ্গে যৎসামান্য মিল আছে, ভরাট হয়ে উঠেছিস, ডেলিবারেটলি সেক্সি। 

               তোর আদেশ শুনে আশ্রয়ের ভালোলাগায় পেয়ে বসল আমায়, অথচ অতিথি তো তুই । আমার শরীর থেকে ব্যুরোক্র্যাটের পার্সোনা ছিঁড়ে ফেলে দিলি যেন ।

               প্রজাপতিদের ফ্রিল-দেয়া শালুকের কোঁচকানো ঢেউ । আমি ? পাগলের ওড়ানো ঘুড়ি ।

               বুকে, বিজয়ের আহ্লাদে মিশেছে জয়ের আছাড়, স্বপ্ন দেখার জন্য গড়ে-নেয়া দ্যুতিময় অন্ধকার ।

               এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

               যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

                প্রায় দুঘণ্টা বসেছিলাম সোফায় হেলান দিয়ে, চোখ লেগে গিয়ে গিয়েছিল । চোখ খুলতে দেখি তুই পাশে বসে, আমার মুখের কাছে মুখ এনে, ল্যাভেণ্ডার আইসক্রিমের গন্ধের দূরত্বে, গভীর কালো চোখ মেলে, আমাকে তারিয়ে দেখছিস,  হাতে স্মার্টফোন । এত কাছে একজন যুবতীর মুখ, সুগন্ধ পাচ্ছি হাঁ-মুখের, ল্যাভেণ্ডার মাউথ ফ্রেশেনার ইনহেল করে থাকবি ।

                কি গভীর চোখজোড়া, আমার ভেতর পর্যন্ত তিরতিরিয়ে সেঁদিয়ে গেল । কোথা থেকে পেলি এরকম চোখ, চোখের পাতা? তোর মা তোকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেবার সময়ে জানত কি যে  তুই এরকম সুশ্রী আর স্মার্ট যুবতী হয়ে উঠবি, সেক্সি অ্যাটিট্যুড ঝলকাবে !

                বললি, দেখছি, তোমার ভেতরের সোকল্ড ঈশ্বরের চেহারাটা কেমনতর, কত পার্সেন্ট হিউমান আর কত পার্সেন্ট গডলি, কিংবা কোনো গডজিলা বা কিংকং লুকিয়ে রয়েছে কিনা । 

                গম্ভির হবার অভিনয় করলাম ।

                তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, দুচারগাছা পাকাচুলে রোমের গ্ল্যাডিয়েটারদের মতন দেখাচ্ছে তোমায় ; হেয়ার ডাই করা আমি একেবারে পছন্দ করতে পারি না । তোমার ঘুমন্ত পোজের গোটা দশেক ফোটো তুলে নিয়েছি, ইন্সটাগ্রাম, পিন্টারেস্ট, গুগল প্লাস আর আমার ফেসবুক পাতায় পোস্ট করে দিয়েছি, যাতে ফোটো তুলছি দেখে ডিলিট করার চেষ্টা না করো । একটা সেলফি তুলি, কি বলো, বলে আমার গলা বাঁহাতে জড়িয়ে সেলফি তুলে নিলি, বললি, এটা আপলোড করছি না, আপাতত করছি না, কখনও করব ।

               তোকে প্রশ্রয় দিতে আমার ভালো লাগছিল । আর স্পর্শ ? অবর্ণনীয় । নবীকরণ, নবীকরণ, নবীকরণ ।

                নারী শরীর, নারী শরীর, নারী শরীর । সুগন্ধ সুগন্ধ সুগন্ধ । 

                স্পর্শের মর্মার্থ, মর্মার্থের রসায়ন, রসায়নের সম্পর্কে, রেণু, পরাগ, উড়াল, জীবন ।

                শিশিরে কেউটের গন্ধ । উতরোল কোলাহল ।

                তুই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিলি, আমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, পারফিউম মেখেছিস, সিল্কের নাইটগাউন পরে নিয়েছিস, হালকা গোলাপি লিপ্সটিক লাগিয়েছিস, কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়া চুলে হয়ে উঠেছিস আকর্ষক, বললুম, ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছিস ?

                 তুই জানালি ফ্রিজ থেকে ব্রেড নিয়ে টোস্টারে টোস্ট করে খেয়েছিস, কিচেনে গিয়ে দুমুঠো অ্যাসর্টেড বাদাম খেয়েছিস । 

                 তুই : হ্যাজেলনাট দেখলুম, ইনডিয়ায় আজকাল সবই পাওয়া যায় দেখছি, বললি ।

                 আবার ব্যঙ্গের পরিতৃপ্তি তোর কথায় ঝরল, বললি, তোমার প্যানিকড হবার প্রয়োজন নেই, ওয়াচম্যান না কি সেন্ট্রি, তাকে বলে দিয়েছি কেউ এলে বলে দিতে যে আজ সাহেব কারোর সঙ্গে দেখা করবেন না, ওনার এক আত্মীয় এসেছেন বিদেশ থেকে, সদর দরোজা বন্ধ করে এসেছি, এই ঘরের পর্দাও টেনে দিয়েছি, আর তুমি যা চাইছিলে, আমাকে অন্য ঘরে স্হানান্তরিত করতে, পাশের ঘরে আমার বিলংগিংস রেখে এসেছি, দেখলুম ঘরটাতে অ্যাটাচড বাথ রয়েছে, টিশ্যু পেপারের রোলও রয়েছে, আমার এখন রোল ইউজ করার অভ্যাস হয়ে গেছে । ডেস্কটপটা ইউজ করে নিলুম, বেশ কয়েকটা ই-মেল লেখা জরুরি ছিল । একটা শাঁখ দেখে ভাবলুম বাজাই জোরে আর তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাই, তারপর মনে হল, নাঃ, বেচারা ব্যুরোক্র্যাট, সরকারি চেস্টিটি বেল্ট পরে বসে আরাম করছে ।

                স্মার্টফোনটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে , তুই আমার কাঁধের ওপর দিয়ে দুটো হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললি, আই লাভ ইউ, আমি তোমায় ভালোবাসি, ইউ আর মাই লাভার, আই অ্যাম ইওর বিলাভেড, ওই ব্যুরোক্র্যাটিক চেস্টিটি বেল্ট খুলে ফ্যালো, আর স্বচরিত্রে এসো ।

                আমি : কী বলছিস কি, আবোল তাবোল, বললুম।

                তুই : ডোন্ট ট্রাই টু বিহেভ লাইক অ্যান ওল্ড বাবা । বাবা সাজার চেষ্টা কোরো না, আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি বাবা অভিনয়কারীদের ।

                আমি : আবার মদ খেলি ?

                তুই : হ্যাঁ, মেরে দিলুম এক পেগ তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে, কিছু করার নেই, মদের খোঁয়ারিতে তোমাকেই দেখছি কতক্ষণ হয়ে গেল, তোমাকে দেখার মাদকতার সঙ্গে ব্ল্যাক ডগের নেশা, আইডিয়াল । কতকাল তোমাকে দেখার কথা ভেবেছি, কেমন দেখতে ভেবেছি, দেখা পেলে কতগুলো টুকরো করব ভেবেছি, কোন টুকরোটা আগে খাবো ভেবেছি । বিছানায় রুবিক কিউব রয়েছে দেখলুম, ও আমি চেষ্টা করেও পারি না, আমার বোন অবশ্য এক মিনিটে করে ফেলতে পারে ।

                আমি : ছাড় দিকি, গলা ছাড় ।

                তুই : আবার অ্যান ওল্ড বাবা সাজার চেষ্টা করছ, ভুলে যেওনা মিস্টার প্রভঞ্জন প্রধান, আমার নাম ইতি প্রধান নয়, আমার নাম নেতি ব্যানার্জি । তারপর নাকে নাক ঠেকিয়ে, চোখে চোখ রেখে বললি, বলিউডি ফিল্মে যেমন দেখায়, সেই কাঁথাটা রাখোনি, যেটায় আমাকে মুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল আমার রেপিস্ট বাবা আর ভিতু মা । রেপিস্ট ছিল নিশ্চয়ই, দেখছ তো আমি কতো ওয়েল বিল্ট লম্বা চওড়া, বায়োলজিকাল বাবা গায়ের জোর খাটিয়ে রেপ করেছিল বায়োলজিকাল মাকে, মা হয়ত কাজের বউ ছিল কিংবা চাষি বউ বা পরিচারিকা বা হোয়াটএভার, হু কেয়ার্স ।

                আমি : ঠিক আছে, গলা ছাড় ।

                তুই : মিস্টার প্রভঞ্জন প্রধান, গলা ছাড়ব বলে অত দূর থেকে উড়ে আসিনি । থাকব এখন, একমাস, দুমাস, তিনমাস, যত দিন না আমার উদ্দেশ্যপূরণ হয় । ছাড়াবার চেষ্টা কোরো না, আমার গায়ে তোমার চেয়ে বেশি জোর আছে বলে মনে হচ্ছে, তোমার হাইটের সমান আমি, হাতও তোমার চেয়ে দীর্ঘ ।

               তোর চোখের আইল্যাশ কি নকল, এত বড়ো দেখাচ্ছে ? এড়াতে চাইলাম ।

               আমার কিচ্ছু নকল নয়, বলে, উঠে দাঁড়ালি তুই, ফাঁস খুলে গাউনটা ফেলে দিলি কার্পেটের ওপর, নগ্ন, জড়িয়ে ধরলি আমাকে, বললি, দেখে নাও, আগাপাশতলা খাঁটি ।

               কী করছিস কি ! আমি চড় কষিয়ে দিলাম তোর গালে ।

                তুই আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলি, ঠোঁটের ওপর ঠোঁটের আলতো ঠোক্কোর মেরে মেরে বলতে লাগলি, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ ।   

              আচমকা দুহাত দিয়ে আমার পাঞ্জাবির বোতামের জায়গায় টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললি, মুখ গুঁজে দিলি আমার বুকে, ঠোঁট ঘষতে লাগলি, বলতে লাগলি, আমি এখনও ভার্জিন, তোমার জন্য, তোমার জন্য, তোমার জন্য, কবে থেকে খুঁজছি তোমায়, সেই ক্লাস এইট থেকে, আমি তোমাকে ভালোবাসি । শুইয়ে দিলি সোফার ওপরে, টান মেরে খুলে দিলি আমার লুঙ্গি, বললি, তবে, ইউ আর গেটিং ইনটু ফর্ম, নাউ মেক লাভ, আমাকে টেনে নামিয়ে দিলি কার্পেটের ওপর, মেক লাভ, প্রভঞ্জন, তোমার অদৃশ্য ব্যুরোক্র্যাটিক চেস্টিটি বেল্ট খুলে ফ্যালো ।

               শিশিরে কেউটের গন্ধ । উতরোল কোলাহল ।

               স্ফিংক্স, মরুভূমি, পিরামিড, মমি । চাউনির অতিশয়োক্তি ।

               স্পর্শের মর্মার্থ, মর্মার্থের রসায়ন, রসায়নের সম্পর্কে, রেণু, পরাগ, উড়াল, জীবন ।

               আমি উঠে বসে আরেকবার চড় মেরে বললাম, স্টপ দিস। 

               চড় মেরে ফিলগুড অনুভূতি হাতের তালু বেয়ে ছড়িয়ে পড়ল শিরা-উপশিরায়, নেমে গেল বুক-পেট-জানু হয়ে পায়ের দিকে, শিউরে-ওঠা কাঁপুনির  এক ভালো লাগা ।

                তুই : স্টপ ? তোমার শরীর তো রেসপণ্ড করছে, লুকোচ্ছ কেন যে তুমিও আমাকে ভালোবাসো । বাবাগিরি ফলিও না, যথেষ্ট বাবাগিরি ফলিয়েছ, এবার প্রভঞ্জনে এসো মিস্টার প্রধান, আমি নেতি ব্যানার্জি, এসো, আমার চোখের দিকে স্পষ্ট করে তাকাও । তাকাও, চোখের পাতা ফেলবে না, তাকাও, আমার মুখের দিকে তাকাও। তুমি যে আমার সো কল্ড বাবা নও, ভুলে যাচ্ছ কেন ? আর হলেই বা বাবা, সম্পর্ক পাতাও, ইনসেস্টের সম্পর্ক, প্রিহিসটরিক যুগে যেমন মেয়েদের সঙ্গে বাবাদের সম্পর্ক হতো, যেমন বাঘ সিংহ হাতি ঘোড়ার হয় ।  

               বলতে লাগলি আই ওয়ান্ট ইওর বেবি, আমি তোমার বাচ্চা কনসিভ করতে চাই, ডোন্ট রেজিস্ট, তোমার মুখে আঁচড়ে-কামড়ে বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেবো কয়েক দিনের জন্য । নখ দেখেছ, যৎসামান্য ছুঁচালো ; দাঁতও ব্যবহার করতে পারি । আমার সেক্সের চাহিদা নেই ; আমি বাচ্চা চাই ।

                দুহাতের চেটো দেখিয়ে বললি, এই দ্যাখো, মেহেন্দির নকশায়  ডান হাতে লেখা রয়েছে ড্যাড আর বাঁহাতে ব্রো-প্রো ; আমার উদ্দেশ্য পরিষ্কার ।

                 প্রলোভনের সমস্যা চিরকাল এই যে জীবনের তাৎক্ষণিক সুযোগ আর পাওয়া যায় না । 

                 ছেড়ে দিলাম শরীরকে তোর হাতে, টেনে তোকে বিছানায় নিয়ে যেতেই বুঝতে পারলাম যে  তোকে এই ভাবেই পেতে চেয়েছি, বড়ো করে তুলেছি, অপেক্ষায় থেকেছি যে একদিন না একদিন তুই আসবি ; নেতি ব্যানার্জি আমার, আমিই তাকে আঁস্তাকুড় থেকে তুলে আনার পর নারীত্বে প্রতিষ্ঠা দিয়েছি। 

                আমাকে জড়িয়ে তুই নিজের ওপর তুলে নিলি । তোর বুকে মুখ গুঁজলুম, কী তপ্ত তোর বুক । উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরলুম তোকে।

              বললুম, আমিও ভার্জিন রে, সেক্স করিনি এখনও । দুবছর আগে পর্যন্ত আমার নাইট ফল হতো, স্বপ্নে তোকে পেয়ে, চটকে-মটকে । ইউরোলজিস্টকে কনসাল্ট করেছিলাম, সে বললে ম্যাস্টারবেট করে বের করে দিতে । কম বয়সে করতাম, তোর মুখ মনে করেই করতাম, কিন্তু এত বয়সে কেউ কি ম্যাস্টারবেট করে ; ইচ্ছে করেছে, কিন্তু করিনি, কেমন নোংরা মনে হতো, ওই যে তুই চেস্টিটি বেল্টের কথা বলছিস । 

               আমিও করিনি, ইন দ্যাট সেন্স করিনি, তোমাকে ইম্যাজিন করে ডিজিটালি যতটুকু  আনন্দ পাওয়া যায় ; ননডিজিটালি করলে নাকি ভার্জিন থাকা যায় না, জাঠনি বাড়ির ভিতু মেয়ে বলতে পারো । এই তো তোমার বেডশিটে দ্যাখো, ব্লাড । চাদরটা তুলে দিতে হবে, আমি এই অংশটা কেটে নেবো, মেমেন্টো হিসাবে, নয়তো তোমার সারভেন্ট সকালে এসে সন্দেহ করবে ।

                মগজে প্রশ্ন উঠল, কত স্বাভাবিক বোধ করছি এখন, কেন, এই দৈহিক সম্পর্ক ঘটে গেল বলে ? আড়ষ্ট লাগছে না তো! আমাদের দেখা হয়নি কত বছর, অথচ দুজনেই দুজনের অতিপরিচিত ছিলাম।

                 বললাম, তুলে দিস, অনেক চাদর আছে, কালারড প্রিন্টেড চাদরও আছে । জাঠদের সংস্কৃতি থেকে পেয়েছিস নাকি এই বিদকুটে প্রদর্শনী ?

               তুই : হতে পারে, অভিভাবক মা যখন জাঠনি, কিছু তো পাবো । যাকগে, এবার এলেকট্রা বলে ডাকো ।

                আমি : এলেকট্রা, মাই ডিয়ার চাইল্ড, জানি তুই নিও টেরেস্ট্রিয়াল । 

               তুই :  জানলে কি করে ? 

               আমি : আন্দাজে, নেটি যখন, তার মানে নিও টেরেস্ট্রিয়াল । আমি মনে মনে তোকে ইতি নাম দিয়েছি ।

              তুই :না, তুমি হলে ইটি,  এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল । মঙ্গলগ্রহের সরকার তোমায় চেস্টিটি বেল্ট পরে পাঠিয়েছে।

              আমি : কিন্তু তুই আনওয়েড মাদার হয়ে সমাজে থাকবি কী করে ?

              তুই : ধ্যুৎ, আমি আমেরিকায় থাকি । তুমি কি আমাকে রিচুয়ালি বিয়ে করতে চাও ?

              আমি :  হ্যাঁ ।

              তুই : আমি কনসিভ করতে চাই, বিয়ে-ফিয়ে আবার কি ? এক পাকেই বাঁধতে চাই না নিজেকে তো সাত পাকে । তোমার রিমোট কন্ট্রোল যথেষ্ট প্রয়োগ করেছ, এবার আমার পালা, ড্যাডি ডিয়ারেস্ট । বাট আই উড  থিংক ওভার ইয়র প্রোপোজাল ।

              আমি : কি করে জানলি যে বাচ্চা পেতে হলে এই সব করতে হয়?

               তুই : আঁস্তাকুড়ে শুয়ে শুয়ে শিখে ফেলেছি ; তুমি কি করে শিখলে?        

              আমি : শরীরের জিপিএস কাজ করল ; উ উ উ উ উ উ করছিলিস কেন? অরগ্যাজমের উত্তেজনা রিলিজ করার জন্য?

              তুই :হাঃ, এতক্ষণ তোমাকে কবিতা শোনালুম, রাইমিং মার্ক করোনি? উ উ উ উ ? মহাকাব্যের এলেকট্রার স্বপ্নপূরণ হল বলে মনে হচ্ছে । 

              আমি : না, মার্ক করিনি, টেন্সড আপ ছিলাম, তুই হঠাৎ এসে পড়েছিলিস, কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না, লস্ট ফিল করতে আরম্ভ করেছিলাম । 

              তুই বললি, লস্ট ? নিজের মধ্যে নয়, আরেকজনের মধ্যে হারিয়ে যেতে হয়, ইতস্তত করতে নেই, সব সীমা মানুষের বানানো, ভাঙো যেদিন যখন চাও, নেভার গেট লস্ট  । তারপর আরম্ভ করলি তোর গায়িকাসুলভ  কন্ঠস্বরে :

                It struck me a barbed wire snare

                Ich, ich, ich, ich,

                I could hardly speak

                I thought every German was you

                And the language obscene

                

                An engine, an engine

                Chuffing me off like a Jew.

                A Jew to Dachau, Auschwitz, Belsen.

                I began to talk like a Jew.

                আমি : আমাকে শোনাবি বলে মুখস্হ করে রেখেছিস ? কার কবিতা বললি না তো ?

                তুই : খুঁজো, খুঁজো । হ্যাঁ, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করেছি, কল্পনা করেছি তোমাকে কেমন দেখতে।

                আমি : কেমন ? ফানুসনাভি ব্যাঙ-থপথপে শুশুকমাথা আমলা, চোখে-চোখে শেকল আঁকা ভিড়ের মধ্যে এঁদো বিভাগের কেঁদো ?

                তুই : হা হা, সেল্ফডেপ্রিকেট করছ কেন, লেডিজ টয়লেটের দেয়ালে আঁকা ড্রইংয়ের মতন । কোরো না, শিরদাঁড়া ঘিরে তালের আঁটির মতন শুকিয়ে যাবে ।

                 আমি :কত কথা বলতে শিখে গেছিস ।

                  তুই : থ্যাংকস ফর দি কমপ্লিমেন্ট, সবই মোর অর লেস বরোড ফ্রম বাঙালি ক্লাসমেটস  ।

                  আমি : তাহলে কি করব ? পোলকাফোঁটা পুঁইফুলে দুভাঁজ করা হেঁইয়োরত বাতাস হয়ে উড়ব? 

                  তুই : হ্যাঁ, হেঁইয়ো করাতেও তো পাল তুলতে হল আমাকেই । 

                 আমি : এখন দ্যাখ, চিংড়িদাড়া আঙুল দিয়ে খুলছি বসে জটপাকানো মুচকি-ঠোঁটের হাসি ।

                 তুই : ইয়েস, বেটার দ্যান আই এক্সপেক্টেড ; আমি ভেবেছিলুম তুমি সত্যিই ড্যাডি টাইপের হবে, পেট মোটা, আনস্মার্ট, লেথারজিক, বুকে চুল নেই, বগলে চুল নেই, কুঁচকিতে চুল নেই ।

                আমি : কী করতিস অমন হলে ।

                তুই : এখন যা করলুম, তা-ই করতুম, তোমাকে কেমন দেখতে ওটা ইররেলিভ্যান্ট ।

                 আমি : আমি তো আরোহী-ফেলা পুংঘোড়ার লাগাম-ছেঁড়া হ্রেষা ।

                তুই : হ্যাঁ, আই ওয়ান্টেড ইউ, দি পার্সন হু ওনড মি । নাউ আই ওয়ান্ট দি সোয়েটিং স্ট্যালিয়ন, প্রত্যেকদিন , অফিস থেকে ফিরতে দেরি করবে না, আর, আমি সকালেও তোমাকে চাই, দি মর্নিং গ্লোরি । আমার কাছে সেক্স অত গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি তোমাকে আমার জীবনে কখনও অতীত হতে দিতে চাই না, তাই আমার বেবি চাই, সম্পর্ককে যে বাচ্চা অতীত হতে দেবে না, যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিন, আর তারপর তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ককে নিজের ছেলেমেয়ের মাধ্যমে বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে বয়ে নিয়ে যাবে । ক্যারি অন অ্যাণ্ড অন অ্যাণ্ড অন ইনটু ইটারনিটি, ইনটু নিউ সানরাইজ এভরি ডে ।

                 তোকে বললুম, এত ফ্যাক-ফ্যাক করে কনভেন্টি ইংলিশ বলিসনি, দিল্লিতে এখন হিন্দিঅলাদের রাজত্ব শুরু হয়েছে, ওপরে উঠতে হলে হিন্দির বাঁশের মই বেয়ে উঠতে হবে, নেহেরুভিয়ান অক্সব্রিজ বাবু-মন্ত্রীদের যুগ ফুরিয়েছে । মোগল সম্রাট আকবরের বংশধররাও ক্যারি অন করে পোঁছেছিল ক্যাবলা বাহাদুর শাহ জাফরে, যত ক্যারি অন হয় তত ফিকে হতে থাকে ভবিষ্যত । মোতিলাল নেহেরু পৌঁছেচে রাহুল আর বরুণ গান্ধিতে ।

                 তুই : ভালো বলেছ, ফাক-ফাক হিন্দির বাঁশ; এ হল অকলোক্র্যাসি বা টির‌্যানি অফ দি মেজরিটি, মেজরিটি সেক্টের পুরুষরা পাকিস্তানে কি করছে দেখতেই পাচ্ছ, তুই খিলখিলিয়ে বললি । যোগ করলি, কাঁধ শ্রাগ করে, হিন্দি সাবজেক্টেও প্রতিটি ক্লাসে সবচেয়ে বেশি মার্কস পেতুম, সো আই ডোন্ট কেয়ার ; আই ওন ইউ ইন অল দি ইনডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস । আমার জিভে আছে তোমার অস্তিত্বের মালিকানা ।

      

                 এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

                 যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

                 আমি : আই ডিডন্ট ওন ইউ ; তুই তোর নিজের মালিক, কেউ কাউকে ওন করে না ।

                 তুই : করে, সম্পর্ক হল অন্যের আত্মার মালিকানা । তুমি আমার আত্মার মালিক, আমি তোমার ।

                 আমি : আত্মা ? হয় নাকি সেরকম কিছু ?

                 তুই : কেন হবে না ! না হলে কী করে তোমাকে খুঁজে বের করলুম, কাঠঠোকরা যেমন গাছের বাকলে ঠোঁটের ঠোক্কোর মেরে মেরে পোকা বের করে আনে ।

                 আমি : পোকা ?

                 তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, দি মেল অরগ্যান লুকস লাইক এ বিগ ক্যাটারপিলার, উত্তুঙ্গ গুটিপোকা, প্রজাপতির নয়, টাইগার মথের । টু বি ফ্র্যাংক, আজকেই আমি স্পষ্ট করে দেখলুম প্রত্যঙ্গখানা কতটা আর্টিস্টিকালি বিল্ট । তোমার প্রত্যঙ্গখানা বোধহয় গ্রিসে বা রোমে তৈরি, খাজুরাহোয় নয় ।

                   আমি : চণ্ডীগড়ে, জগদীশের বাড়িতে আগে যাওয়া উচিত ছিল তোর ।

                  তুই : দুটো কারণে যাইনি ; উনি তোমাকে ইনফর্ম করে দিতেন আর তুমি নির্ঘাত লুকিয়ে পড়তে, আমার পরিকল্পনা, জীবন নিয়ে ভাবনা, তোমাকে আগাপাশতলা খেয়ে ফেলার ইচ্ছে, সব গোলমাল হয়ে যেত ।

                  আমি : আর দ্বিতীয় ?

                  তুই : বৈদেহী ওর বরকে ডিভোর্স দিয়েছে, বরটা গে, নেশাভাঙ করে, বাস্টার্ড, কোনো গে ছেলেকে বিয়ে করলেই পারত, কোর্ট তো অ্যালাউ করে দিয়েছে । স্কাউন্ড্রেলটা বৈদেহীকে কামড়ে দিয়েছিল, হাতে, কাঁধে। ওর বিধবা শাশুড়ি আর ওর বর দুজনে মিলে এক রাতে, তখন রাত দুটো, বৈদেহীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল, ওর মোবাইল কেড়ে নিয়ে, হায়দ্রাবাদের  রাস্তায় ভেবে দ্যাখো ; সাইবারাবাদ আইটি ইনডাস্ট্রির এক এমপ্লয়ি  স্কুটারে  ফিরছিল, তাকে থামিয়ে বাড়িতে ফোন করতে বাপি, আই মিন আঙ্কলবাপি, ওনার আইএস বন্ধুকে জানায়, তিনি বৈদেহীকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখেন, আর পুলিসে এফ আই আর করেন ।

                 আমি : জানি, আমাকে আবার কি বলছিস, আমিই তো পরিচিত একজন আন্ডার সেক্রেটারিকে বলে বৈদেহীর চণ্ডীগড় ফেরার ব্যবস্হা করেছিলাম । জগদীশের তো শুনেই ব্লাড প্রেশার লো হয়ে গিয়েছিল ; সারাজীবন হরিয়ানায় কাটাল, বাইরের ক্যাডারের অফিসারদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ প্রায় নেই।

                 তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, তুমি? তুমি? তুমি? তোমার ভূমিকা, অ্যাজ ইউজুয়াল, ওনারা চেপে গিয়েছিলেন, বলেননি আমাকে। বলতে পারতেন, আমি তো আর তক্ষুণি আমেরিকা থেকে উড়ে তোমায় কবজা করতে আসতুম না।

                তুই : আরিয়ানও আঙ্কলবাবা আর মাকে, আই মিন আন্টিমাকে, না জানিয়ে বিয়ে করে চলে গেছে ছত্তিশগড়ের রায়পুরে। ওনারা যথেষ্ট ডিপ্রেসড, আই অ্যাম শিওর । যাবো না ওনাদের বাড়ি, জানতে দিতেও চাই না যে আমি ইনডিয়ায় এসেছি।

                  আমি : জানি, আমি জগদীশকে বলেছিলাম যে বৈদেহীর পাত্র বিশেষ সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না, একটা পুলিশ এনকোয়ারি করিয়ে নিই, তা ওর আর অমরিন্দরের টাকাকড়ি সম্পর্কে এমন লোভ যে কানে হিরের টপ-পরা পাত্রের বানজারা হিলসের বাড়ি, বিএমডাবলিউ গাড়ি  আর ব্যবসার সাইনবোর্ড দেখে ভিরমি খেয়ে গিয়েছিল, শেষে এই বিপদ ডেকে এনেছে । 

                 তুই আচমকা বললি, আমি তো শুনেছিলুম, বৈদেহী অব্রাহ্মণ কাউকে পছন্দ করত, তার বয়স নাকি ওর চেয়ে চোদ্দো-পনেরো বছর বেশি, ওনারা তাতে রাজি হননি, সেই লোকটি সুদর্শন, ওয়েল বিল্ট, আইএএস, তোমার মতো এজিএমইউ ক্যাডারের ।

                আমি : তা জানি না, ওরা বলেনি কখনও এ-ব্যাপারে, বললে মধ্যস্হতা করতাম । 

                তুই : করতে ? আর ইউ শিয়র ? 

                আমি : আরিয়ানের পছন্দ করা মেয়েটাকে অ্যাকসেপ্ট করে নিতে বলেছিলাম, করল না, ট্রাইবাল ফ্যামিলির বলে । আরিয়ান হল অ্যানথ্রপলজিস্ট, যে মেয়েটিকে বিয়ে করল তাদের সমাজে ঢুকে বিস্তারিত জেনে নিতে চাইছে, তাতে দোষের কি? শুনতে ট্রাইবাল, আমি ফোনে কথা বলেছি মেয়েটির সঙ্গে, স্কুলে পড়ায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী ছিল । জগদীশ ভাবল যে ওর ভবিষ্যৎ প্রজেনির ব্রিড নষ্ট হয়ে গেল । ব্রিড বলে কিছু হয় নাকি, তোকে দেখে শেখা উচিত ছিল ওদের, তোর ব্রিড কেউ জানে ? আজ কোথায় পৌঁছে গেছিস ।

                 লোকে বলে, বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নয় আমার….

                 মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে…..

                 কানাই তুমি খেইর খেলাও কেনে….

                 নিশা লাগিল রে, নিশা লাগিল রে, নিশা লাগিল রে….

                  তুই : ধ্যুৎ, এইসব প্রসঙ্গ তুলছ কেন ! আমার তো অ্যাপ্রিহেনসান ছিল, আতঙ্কও বলতে পারো, এসে দেখব, একজন হাড়গিলে টাকমাথা চশমাচোখ বুড়ো অন দি ভার্জ অফ রিটায়ারমেন্ট । আমার ডিটেকটিভ এজেন্সি প্রচুর সময় নষ্ট করে দিলে তোমায় লোকেট করতে, আমিই ওদের আঙ্কলবাপি আর মা, আই মিন আন্টিমায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে বললুম ফাইনানশিয়াল ট্রইল ধরে এগোতে । আঙ্কলবাপি তো এতো ঘুষ খায় যে ওরা ডাইভার্টেড হয়ে যাচ্ছিল ; তখন ওদের বললুম পুরোনো ট্রেইল ধরে এগোতে, যখন আমি আইআইটিতে  পড়তুম, আর আমার অ্যানুয়াল ফিস এটসেটরা পে হচ্ছে, সেই সময়ের ট্রেইল ।

                 আমি : বুড়ো হলে কি করতিস ।

                 তুই : সুইসাইড, জোক করছিনা, বুড়ো হলে তার কোঁচড় থেকে ফুলঝুরির বদলে কুয়াশা উড়ত । কুয়াশায় বাচ্চা হয় না।

                  আমি : ইশারার সাহায্যে বেশ পোয়েটিক কথাবার্তা বলতে শিখেছিস দেখছি ।

                 তুই : বাঙালি ব্যাচমেটদের কনট্রিবিউশান । প্রচুর বাংলা গালাগাল জানি। বলব ? হিন্দিও জানি, গিগলিং টাইপ। হরিয়ানভি গালাগাল কিন্তু বেশি ইউজার-ফ্রেণ্ডলি।

                 আমি : না না, বলতে হবে না। বুড়োর বদলে কি পেলি?

                 তুই : কোঁচড় থেকে বকুল ফুলের ঝরণা ঝরাতে পারে এমন মাসকুলার স্ট্যালিয়ন। এসো, বুলশার্ক, আরেকবার হয়ে যাক।

                নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনলাম, প্রভঞ্জন, তুমি কতোকাল নেতির জন্য অপেক্ষা করেছ, আর লজ্জায় বিব্রত বোধ কোরো না, নিয়ে নাও, যতো পারো নিয়ে  নাও, একেই যদি প্রেম বলে তাহলে চুটিয়ে ভালোবেসে নাও, প্রেমকে গোপন রেখো না, একেই তো চাইতে তুমি, নিজেকে এই মেয়েটির বাবা বলে মনে কোরো না। 

               এতকাল যুবক-যুবতীদের পারস্পরিক সান্নিধ্য আর প্রেমের প্রদর্শনী দেখে হিংসে করতাম, আড়চোখে,   ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি প্রভঞ্জন প্রধান, নিজেকে নিজে ভাবতে আড়ষ্ট বোধ করতাম, ভয়ও পেতাম, মনে মনে তোকে ধন্যবাদ দিলাম, নিজেকে প্রভঞ্জন প্রধান হিসাবে নিজের কাছে তুলে ধরার যোগ্য করে তোলার জন্য, আমার ভেতর থেকে আমাকে প্রসব করার উপযুক্ত করে তোলার জন্য, বুঝতে পারলাম রে, যে আমি কোনও স্হাবর-স্হির বস্তুপিণ্ড নই, তোর শিশুকাল থেকে আমিও তোর পাশাপাশি গড়ে উঠেছি, তুই না এলে আমার অতীত থেকে যেত একেবারে ফাঁকা , ব্যথার মোড়ক খুলে আরেক ব্যথার সাথে মেশানো হয়ে উঠত না ।

                বললাম, হোক, উ উ উ উ করিসনি, প্লিজ ।

               তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, তুমি এক্টিভ হও, আমি তোমাকে কবিতাটার একটা রেলিভ্যান্ট প্যারা শোনাচ্ছি, বেশ মজার হবে, না ? কবি কখনও ভাবতেও পারেননি যে ওনার কবিতা এইভাবে কাজে লাগানো হবে, স্টার্ট ।

               No God but a swastika

               So black no sky could squeak through

               Every woman adores a Fascist,

               The boot in the face, the brute

               Brute heart of a brute like you

               পাশে শুয়ে পড়লাম, বললাম, আমাকে ফ্যাসিস্ট বলছিস, ব্রুট বলছিস, অতদূর থেকে উড়ে এই কথা বলতে এলি ?

                তুই : ব্রুট ফ্যাসিস্ট ছাড়া আর কি ? আমার জীবনকে একেবারে আয়রন গ্রিপে রেখেছিলে, গেস্টাপো কেজিবি সিআইএর মতন নজর রেখেছো সদাসর্বদা । আমি ভিতু টাইপের নই, তুমি যদি বিদ্রোহ না করো তাহলে ভালোবাসা পাবে না, ভালোবাসতে গেলে গায়ে আঁচড়-কামড়ের রক্ত ঝরবে, ভালোবাসায় মাংসের সঙ্গে মাংসের জখমগুলো খুবই সুন্দর, এমনকি মধুময় বলা যেতে পারে, প্যাশনে রক্ত গরম হয়ে উঠবে, তবেই তো ভালোবাসার আমেজ নিতে পারবে। ভয়ও যদি করে, ঝাঁপাতে হবেই।

                 আমি : এলি কেন তাহলে?

                 তুই : আমি ঝাঁপিয়ে পড়লুম। তোমার গ্লোরি দখল করে তোমার প্রথম রক্ত প্রথম স্পার্ম নেবো বলে ; এখন তোমার মাথার পেছন থেকে হ্যালো ঝরিয়ে দিয়েছি, তোমার রক্ত পালটে দিয়েছি, তোমার যিশুখ্রিস্টগিরি শেষ করে দিয়েছি। তুমি আর আগের প্রভঞ্জন প্রধান নও, না ব্রো-প্রো ?

                 আমি : জানিস ব্রো-প্রো ?

                 তুই :  জানিতো, আঙ্কলবাপি আর আন্টিমা ওই নামেই তো উল্লেখ করেন তোমায়, তুমি সামনে কোনোদিন না এলেও আমি অনুমান করেছিলুম যে এই ব্রো-প্রো লোকটাই আমাকে কনট্রোল করছে, দি ব্লাডি ফ্যাসিস্ট ড্যাডি, দি ডিকটেটরিয়াল পালক পিতা, অ্যাবরিভিয়েট করলে হয় পাপি । তোমার ব্যাচমেটরা আর পরের আগের ব্যাচের সবাই তোমাকে ব্রো-প্রো মানে ব্রাদার প্রভঞ্জন বলে ডাকে, জানি ।

                আমি : বিয়ের মেহেন্দি-নকশা কোথায় করালি ?

               তুই :  হোটেলে রিসেপশানিস্ট কে বলতেই ও পাঠিয়ে দিলে ঘরে ; লাগিয়ে বসে রইলুম চার ঘণ্টা, তোমার প্রতি ডিভোটেড, একা-একা আমার মেহেন্দি সেরিমনি, পরে দুজনে মিলে সঙ্গীত সেরিমনি করব ।

                স্পর্শের মর্মার্থ, মর্মার্থের রসায়ন, রসায়নের সম্পর্কে, রেণু, পরাগ, উড়াল জীবন ।

                 চাউনির কোলাহল, উতরোল শ্বাস ।

                 এর মতো, এর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

                 যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

                আমি : ওই স্টিলের আলমারিটা খোল, বাঁদিকে একটা সেফ আছে, সেটাও খোল, চাবি সামনের ড্রয়ারে আছে ।

               তুই : কী আছে সেফে ? আমার গয়না-ফয়না টাকাকড়ি সম্পত্তি-ফম্পত্তি চাই না ।

                আমি : খুলে তো দ্যাখ, যা আছে নিয়ে আয় বিছানার ওপর ।

                তুই সম্পূর্ণ নগ্ন,  ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে সেফ থেকে কাগজপত্র বের করে প্রায়-স্তম্ভিত হয়ে গেলি, বললি, এতো আমার স্কুলের আইডেনটিটি কার্ডগুলো, ফাইনালের রেজাল্টগুলো, আর এটা, আরে, মাই গড, এতে তো আমার ইনটারভিউ বেরিয়েছিল, সিসটার অ্যানে নিয়েছিলেন, আর এটা, এটা তুমি ?

                আমি : হ্যাঁ, আমি, তোকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তুই তখন এক বছরের ।

                তুই : তুমি তো দারুন দেখতে ছিলে গো , পালক পিতা হের হিটলার, ওয়ান হু ওনস মি । ফোটোতে তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পুরো সূর্যের গুঁড়ো মুখে মেখে হাসছ । ডানহাতে ওটা তোমার কনট্র্যাক্ট, তাই না, আমার লাইফ লং এডুকেশান স্পনসর করার ?

                আমি : দুটো কনট্র্যাক্ট রে, একটা তোর স্বনির্ভর না হওয়া পর্যন্ত এডুকেশান স্পনসর করার, আরেকটা তোকে অ্যাডপ্ট করার ? তোর পদবির এফিডেভিট জগদীশের কাছে ছিল, তোর স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট পাবার পর হয়তো ডেসট্রয় করে দিয়েছে ।

                তুই : মাই গড, তুমি অ্যাডপ্ট করেছিলে ? আমি ভাবতুম বাপি, মানে আঙ্কলবাপি, করেছিল, আমার নামে তোমার পদবির বদলে তাহলে আঙ্কলবাপির পদবি জুড়লে কেন ? অ্যাডপ্ট করেও ডিজওন করতে চাইলে, আমি তোমার কনট্র্যাকচুয়াল ডটার বলে ?

                 আমি : না, আমি তো মোড়লচাষার ছেলে, প্রধানরা মাহিষ্য হয় ; তোকে ব্রাহ্মণ করার জন্যে জগদীশকে দিয়ে এফিডেভিট করিয়ে তোর পদবি ব্যানার্জি করিয়ে নিয়েছিলাম । 

                 তুই : ধ্যুৎ, আমার ওবিসি হবার সুযোগটাই কেড়ে নিয়েছিলে, কত সুযোগ-সুবিধা পেতুম, তা নয়, বামুন, শ্যাঃ। অবশ্য একদিক থেকে ভালো যে আমি তোমার মেয়ে নই, জাস্ট অ্যান অ্যাডপ্টেড বেবি, এলেকট্রা অফ দি এলেকট্রা কমপ্লেক্স লাস্ট । দি ইনফেমাস এলেকট্রা, বুকের মধ্যে পুষে রাখা ইনসেসচুয়াস ব্যাটলক্রাইয়ের এলেকট্রা, ফসটার ফাদারের  প্রতিষ্ঠিত সন্তান । ইইইইইএএএএএ।

                আমি : সিচুয়েশান ভিলিফাই করছিস কেন ?

                তুই :  তোমার সংগ্রহের কাগজপত্রগুলো দেখব পরে সময় করে । 

                আমি : হ্যাঁ, পরে সময় করে বসে বসে দেখিস, যখন অফিস চলে যাব । একটা পেপার কাটিং আছে, দেখতে পারিস, তুই যে ডাস্টবিনে পড়েছিলিস, তার সংবাদ ।

               তুই :  তোমার বাঁহাতের কাটা দাগটা সেই বালি মাফিয়াদের আক্রমণে পাওয়া, না ?

               আমি : তুই কি করে জানলি ? ও তো অনেককাল আগের ঘটনা । হ্যাঁ, বেআইনিভাবে নদীর বালি তুলে নিয়ে গিয়ে বেচত বালিমাফিয়ারা, তাদের ট্রাক ক্রেন লোডার সিজ করার অর্ডার দিয়েছিলাম, তারই পরিণতি ।

              তুই : জানি, তার পরের দিনই তোমার বদলি হয়ে গেলে ।

              আমি : আর টিভিতে দেখালো মাফিয়াকর্তা জেল থেকে বেরিয়ে দু-আঙুলে ভি এঁকে হাসছেন ; সাঙ্গোপাঙ্গোরা তার জয়ধ্বনি করছে ।

              প্রদাহ, যন্ত্রণা, আশঙ্কা, আতঙ্ক, উদ্বেগ, মুখের ভিতরে জিভে ।

              তোর মতো, তোর মতো, তোর মতো, তোর মতো  ঐশিতা, উপলব্ধি, সান্ত্বনা, অনুবোধ ।

               তুই : আমি তোমাকে তিনটে চিঠি লিখেছিলুম, জানো ?

              আমি : চিঠি ? কই পাইনি তো ? স্কুল কি সেন্সর করে দিয়েছিল ? নাকি জগদীশ-অমরিন্দর ?

              তুই : ধ্যুৎ, সেসব চিঠি পাঠাই-ইনি তোমায়; তুমি তো ইনভিজিবল ডুগুডার, জাস্ট অ্যান্টিসিপেট করে যে তুমি আমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছ, আমি দশ, এগারো আর বারো ক্লাসে তোমায় চিঠিগুলো লিখেছিলুম।

                আমি : রেখে দিতে পারতিস তো ! পড়তাম ।

               তুই : তোমাকে প্রেমিকড্যাডি মনে করে লিখেছিলুম ।

               আমি : ডেসট্রয় করে দিলি কেন ?

               করিনি, আমার সঙ্গেই এনেছি ।

               তুই : কই, দে দে দে, কেউ তো কোনো কালে আমাকে চিঠিই লেখেনি, প্রেমপত্র তো বাদ দে ।

               আমি : ওই তো টেবিলের ওপরে রাখা খামে আছে, চাইলডিশ যদিও, পড়ে দ্যাখো । বাংলায় লিখেছি, তার কারণ স্কুলে সিসটার আর ওয়ার্ডেনরা বাংলা জানতেন না ।

              আমি : কার কাছে শিখলি বাংলা ?

              তুই : কেন , আঙ্কলবাপির কাছে, উনি ভিষণভাবে বেঙ্গলি, দেখছ না আন্টিমাকে কত তাড়াতাড়ি বাঙালি বানিয়ে দিয়েছিলেন, আণ্টিমাও বাংলা পড়তে-লিখতে পারেন, তাই স্কুলের পর্ব শেষ হলে গুড়গাঁওয়ের বাড়িতে চিঠিগুলো লুকিয়ে রেখেছিলুম, তারপর নিজের সঙ্গেই রেখেছি । তোমার খবর পেতেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, যাতে আমার ফিলিংস বুঝতে পারো, চিঠিগুলোর এমোশান দেখেই বুঝতে পারবে কত পুরোনো আনুগত্য আর ডিপরুটেড ফিলিংস ।

              তোর চিঠি আমি এক -এক করে পড়া আরম্ভ করলাম, পড়তে-পড়তে তোর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম, বুঝতে পারছিলাম বিব্রত বোধ করছিস, আবার আহ্লাদিতও হচ্ছিস, ঠোঁট বন্ধ রেখে গিগল করছিস ।

ক্লাস টেন ( ২৫ ডিসেম্বর )

ডারলিং ড্যাড,

তুমি সান্টাক্লজের মোজায় লুকিয়ে চলে এসো, আমি স্লেজগাড়ি পাঠাচ্ছি । আমরা দুজনে শীতের এই ঠাণ্ডায় মোজার ভেতরে ঢুকে বেশ মজা করব । আমি তোমার পোশাক খুলে মোজার বাইরে ফেলে দেব আর বলব, ড্যাড, এই দ্যাখো, তোমার বুকে মিথ্যা কথা বলার জন্য লোহা গরম করে ডেভিল তোমায় নরকে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে । তুমি কেমন লোক ড্যাড, আমার জন্যে তোমার একটুও মনকেমন করে না ? কেন তুমি লুকিয়ে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছ ? যদি নিয়ন্ত্রণ করছই, তাহলে আমার সামনে আসার তোমার সাহস নেই কেন ? আমি তোমাকে ভালোবাসি ড্যাড, তুমি মনে কোরো না যে তুমি দূর থেকে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে চিরকাল আড়ালে থেকে যাবে । আমি তোমাকে একদিন নিশ্চিত খুঁজে বের করব । আর যেদিন তোমায় খুঁজে পাবো, সেদিন তোমায় আমি খুন করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলব । ইয়েস, আই উইল কিল ইউ অ্যাণ্ড ইট ইউ । সামনে এসো, দেখা দাও, প্রক্সি দিও না । তুমি কি বুড়ো, ফোকলা দাঁতে হাসো, গুটকা খাও, ছাতা মাথায় অফিস যাও ? তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছ ? তোমার নাতি-নাতনি কয়টা ? যতই যাই হোক, তোমাকে আমি ছাড়ছি না, ছাতা উড়িয়ে তোমায় টেনে নিয়ে আসব ঝাঁঝা রোদ্দুরে, কাদা-জমা বৃষ্টিতে, মনে রেখো, হুশিয়ারি দিয়ে রাখছি। পুরাণের ঋষিমুনিরা তো বুড়ো হয়েও কত কি করতেন, যেখানে সেখানে সিমেন ফেলতেন, সেই সিমেন থেকে শিশুরা জন্মাত, যা ঋষিমুনিরা জানতেও পারতেন না । পুরাণ অনুযায়ী ওল্ড এজ ইজ নট এ ফ্যাক্টর ইন ইমমরাল লাভ অ্যান্ড ইনহিউম্যান ওয়ার । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা চিন্তা করেছ কখনও, কিংবা হেলেন অফ ট্রয়ের জন্য যুদ্ধ ? এপিকগুলোয় বুড়োরাই যুদ্ধ করেছে, চিরকাল । এপিক লেখা তাঁমাদি হয়ে গেলেই বা, আমি আর তুমি তো আছি, আমাদের এপিক প্রোপোরশানের সম্পর্ক তো আছে, ইন পারপেচুইটি ? আরেকটা কথা । তুমি গোপন থাকতে চাও কেন ? তোমার গোপন জীবন আমি একদিন ঘা মেরে আখরোটের মতন দুফাঁক করে দেবো । তবে গোপনীয়তা তোমাকে বেশ রহস্যময় করে তুলেছে ; তোমার কি মনে হয় না যে গোপনীয়তাও একরকমের ভার, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাকে রিলিজ করার পথ করে না দিলে উন্মাদ হয়ে যাবে? ইনসেস্টকে অস্বাভাবিক মনে কোরো না । তোমার সন্মোহনপ্রবৃত্তিকে এবার ক্ষান্ত দাও। 

তোমার মেয়ে ও প্রেমিকা 

নেতি ( দি আগলি নেম ইউ গেভ মি )

ক্লাস ইলেভন ( দুর্গাপুজো, বিজয়া দশমী )

ডিয়ার ড্যাড দি মহিষাসুর 

আমার আগের বছরের চিঠি তুমি পাওনি বলেই মনে হচ্ছে, তুমি এই এক বছরে নিজেকে অসুর হিসাবে প্রমাণ করেছ ; বৈভবী আর আরিয়ানের জন্য কমদামের পোশাক , আর আমার জন্য দামি পোশাক । আমার তা একেবারে পছন্দ নয় । জানি তুমি পাঠাওনি,  আন্টিমা কিনেছেন, কিন্তু আন্টিমা এই কাজ করে ফাঁস করে দিলেন যে তুমি আছ কোথাও । এরকম করার উদ্দেশ্য ? তুমি কি আমাকে এনটাইস করার চেষ্টা করছ ? সিডিউস করতে চাইছ? করো, করো, যতো পারো করো । তুমি অমন না করলেও আমি তোমাকে ভালোবাসি । আগের চিঠিতে লিখেছিলুম যে আমি তোমার প্রেমিকা । তুমি কি জানো প্রেমিকা কাকে বলে ? জীবনে কখনও প্রেম করেছ ? নাকি এরকম আড়ালে থেকেই মদনের শর চালিয়েছ । মদনের কথা কার কাছে জানলুম । আন্টিমায়ের কাছে । উনি পুরানের গল্প আমাকে শোনান যাতে আমি বাইবেলের কাহিনিতে নিজেকে গুলিয়ে না ফেলি । আমি কিন্তু মেরির চেয়ে বেশি ভার্জিন । তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চাইনি, চাইবো না কোনোদিন, দেখে নিও । আগের চিঠিতে তোমার ফ্যামিলির কথা জানতে চেয়েছিলুম, বললে না তো কিছু, তুমি এরকম ভিতু কেন ? ফ্যামিলি থাকলেই বা, তুমি যদি কাউকে বিয়েও করে থাকো, তবু আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করব, আর প্রেম করার পর পুরুষ মাকড়সাকে যেমন প্রেমিকা মাকড়নি মেরে ফ্যালে, তেমন করে কুচিয়ে মেরে ফেলব । তোমাকে কিন্তু বলে রাখলুম, আমি সবকয়টা ঋতু তোমার কাছ থেকে চাই, শুধু বসন্তকাল নয় । তুমি আমার শরীরের সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো, ও তোমাকে খাঁটি সত্য কথা বলবে ; আমার ঠোঁট, জিভ, মুখের ভিতরটা তোমার। চিঠি লিখো । লিখে না পাঠালেও আমি পেয়ে যাব । গুড নাইট ডিয়ার ব্রহ্মা, ইট ইজ পদ্মা হেয়ার ফ্রম হেভেন। তুমি আমার নাম নেতি কেন রেখেছ, আমি জানি । কারণ ইমমরাল প্রেমের মতন স্বর্গীয় সুষমা আর নেই ; প্রেমে ইমমরাল না হওয়া হল নৈতিক শূন্যতা, ব্যানালিটি । আমাদের বয়স প্রতি বছর বাড়ে কেন ? যাতে আমরা ক্রমশ ইমমরাল হতে পারি, প্রেমকে মেনে নিতে পারি । হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ । তুমি আমার ইনটারভিউটা কি করে পড়লে । নিশ্চয়ই পড়েছ । ছুটিতে বাড়ি ফিরে দেখলুম, আঙ্কলবাপি দেখালেন, আমার আলমারিতে নতুন বই, বাংলা কবিতার, ইংরেজি কবিতার । ঘরে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি ঝুলছে । আন্টিমাকে জিগ্যেস করতে উনি বললেন, ফার্স্ট হয়েছি বলে গিফ্ট এসেছে । কার গিফ্ট, তা উনি জানেন না, যে পাঠিয়েছে সে ঠিকানা লেখেনি । তুমি কেমন পাগল গো ? ধ্যুৎ, এত এত বই আমি পড়তে পারব না, বড় হলে পড়ব । রিমাইন্ড করিয়ে দিই, ইনসেস্টকে অনৈতিক মনে কোরো না ।

ফাক ইউ অ্যান্ড লাভ ইউ ।

তোমার নেতি ( ইওর এলেকট্রা অফ দি ম্যাজিকাল এপিক )

ক্লাস টুয়েলভ ( দোলযাত্রা )

ইউ ফ্যাসিস্ট বাস্টার্ড বাবা

আজকে দোলযাত্রা, আমাদের ছুটি নেই। সিজনটা ভিষণ খারাপ। বাজে হাওয়া দিচ্ছে। আমার রুমমেট পামেলা ঝিংরণ পারমিশান নিয়ে বাড়িতে দোল খেলতে গেছে । সুতরাং দুই দিনের সুযোগ । তোমাকে ইম্যাজিন করে কী করলুম জানো ? রাতের বেলায় আলো নিভিয়ে, জামা-কাপড় খুলে ফেলে পুরো উলঙ্গ হয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম । চোখ বুজে নিজেকে বিছানার ওপর ঘষতে লাগলুম, এগোলুম, পেছোলুম । তোমার জন্যে আমি আমার জীবনের প্রথম অরগ্যাজম ডেডিকেট করলুম। হস্টেলে আমার ক্লাসে সবাই করে, আমিও শিখে নিয়েছি । আমি কিন্তু হাত দিয়ে বা কোনো জিনিস দিয়ে ম্যাস্টারবেট করি না । করলে আমি ভার্জিন থাকব না । ডিয়ার ফ্যাসিস্ট ফাদার অলমাইটি, তোমার জন্য আমি নিজেকে ভার্জিন রেখেছি । তুমি কি চাও যে আমি ভার্জিন হয়েই মরে যাই ? কবে দেখা দেবে তুমি ? কেমন দেখতে তোমায় ? তুমি বুড়ো নও তো ? বুড়ো হলে ভিষণ খারাপ হবে কিন্তু, ছিঁড়ে খেয়ে নেবো । তুমি কি আমার জন্যে তোমার ইম্যাজিনেশান ডেডিকেট করো ? কালকেও আরেকবার ডেডিকেট করব । আমি কি তোমার স্বপ্নে আসি, যেমন তুমি আমার স্বপ্নে আসো ? স্বপ্নে আমাকে কষে জড়িয়ে ধোরো, আমি তোমার বুকের চাপ অনুভব করতে পারব । তুমি যে মিথ্যাবাদী তা ধরে ফেলেছি, প্রেমিকরা অমন মিথ্যাবাদী হয় ; আসলে প্রেম তো এক ধরণের সন্ত্রাস, তাই না? তুমি কি নিজের প্রতি বিশ্বস্ত । চিন্তা কোরো না, ইনফেডেলিটি প্রেমিকদের সাহসী করে তোলে । আমি বলছি তুমি খোলোস থেকে বেরিয়ে এসো, আমি তোমাকে আগাপাশতলা চাই, এই চাওয়াকে যেন সেক্সুয়ালি ইনটারপ্রেট কোরো না । যেদিন দেখা হবে সেদিন আমি তোমার মাথায় এমন ঠুসে-ঠুসে উদ্বগ, অশান্তি, আশঙ্কা, আতঙ্ক, যন্ত্রণা ভরে দেব যে যতদিন বেঁচে থাকবে মাথার জায়গায় এক কুইন্টালের বাটখারা বইবে । আমি নিশ্চিত যে সবাই, তোমার পরিচিত মানুষেরা, তোমাকে ভিষণ নিরাশ করেছে, তাই তুমি আমার সঙ্গে বায়বীয় সম্পর্কে পাতিয়েছ ; ওভাবে স্মৃতিকে ধরে রেখো না, পশ্চাত্তাপ হবে, আমি তো রয়েছি, তোমার নিঃসঙ্গতার একমাত্র নিরাময় । মনে আছে তো যে ইনসেস্ট ব্যাপারটা প্রকৃতির অবদান ?

নেতিস্মর ( যার  স্মৃতি নেই)

               চিঠি তিনটে পড়ার পর দুজনেই চুপচাপ বসেছিলাম কিছুক্ষণ । দুজনেই জানতে পারছিলাম কে কি ভাবছে। আমিই প্রথমে কথা বলা আরম্ভ করলাম।   

               আমি : তোর বাংলা হাতের লেখা খুব স্পষ্ট, স্ট্যাণ্ডার্ড টেন থেকেই রবীন্দ্রনাথের মতন হাতের লেখা রপ্ত করে ফেলেছিস।

                তুই : হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ; আসল প্রসঙ্গে এসো, কনটেন্টে, বিষয়ে, হ্যান্ডরাইটিঙের প্রশংসা করে পাশ কাটিয়ে বেরোতে চাইছ কেন, টেক্সট ডিকন্সট্রাক্ট করো, সম্পর্ক, রিলেশানসিপ, রক্তের খেলা ।

                আমি : ডিকন্সট্রাক্ট আবার কি করব, জানি তো, তুই কোল্ড ব্লাডেড রিভেঞ্জ নেবার ফাঁদ পাতছিলিস, আমি তো তোর ভালোর জন্যই সবকিছু করেছি, আর নেতিস্মর লিখে জানিয়ে দিয়েছিস তুই কি বলতে চাস , ওয়ার্ডটা শুনিনি আগে ।

               তুই :নেতিস্মর শব্দটা আঁস্তাকুড়ে পেয়েছিলুম, ইউ লায়ার লাভার, লুকিয়ে রিমোট কনট্রোল করে গেছ, আর এখন অ্যালিবাই খাড়া করছ, ইউ আর এ কাওয়ার্ড।

               আমি : বলে নে, বলে নে, মেটা তোর ঝাল, আমি ছাড়া কার কাছেই বা পুষে রাখা ক্রোধ, ক্ষোভ, আক্রোশ, দুঃখ, নিঃসঙ্গতা রিলিজ করতিস ।     

               তুই আহত হলি আমার কথায়, কাঁদতে আরম্ভ করলি, ফুঁপিয়ে, সামলে নিলি, তারপর বললি, আমাকে ফেলে যাওয়া হয়েছিল কলকাতার এক আঁস্তাকুড়ে, আমি দিল্লির এনজিওর হাতে গেলুম কেমন করে গো, তুমি তো আমাকে দিল্লির সংস্হা থেকেই সেলেক্ট করেছিলে ?

                 আমি : ওঃ, বেশিরভাগ এনজিও বিদেশ থেকে ডলার-ইউরোর ধান্দায় যতো পারে আনওয়ান্টেড বেবিদের নিজেদের আওতায় আনতে চায় ; বিদেশীরা অ্যাডপ্ট করার জন্য ওদের কাছে আসে বা ওদের ফাণ্ডিং করে, বাচ্চাদের পড়াশুনা করাবার জন্য, স্বাস্হ্যের জন্য । দিল্লির এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড  চালায় একজন অবসরপ্রাপ্ত আই এ এসের স্ত্রী। ওরা অ্যাবানডণ্ড চিলড্রেনদের সংবাদের দিকে লক্ষ্য রাখে , তোর সংবাদ কাগজে পড়ার পর ওদের প্রতিনিধি কলকাতা পুলিসের সঙ্গে কথা বলে দিল্লি এনেছিল ।

                 তুই : তুমি মাঝখান থেকে কি করে উদয় হলে ? তুমি স্পনসর করলেই বা কেন ? তুমি তো ব্যাচেলার ছিলে, ফ্যামিলি লাইফ শুরু করোনি, নেহাতই কাঁচা অভিজ্ঞতা তখন ।

                 আমি : আমার কাছে চিঠি এসেছিল একটি গার্ল চাইল্ডকে স্পনসর করার জন্য । জানি না কে আমার ঠিকানা ওদের দিয়েছিল । আমি কিছু একটা ভালো কাজ করতে চাইছিলাম, চাকরিতে ঢুকেই তো চারিদিকে দেখছিলাম রাজনীতিকদের জোচ্চুরি আর লোকঠকানো, আমার কলিগরাও এই ধান্দায় প্রথম থেকেই ফেঁসে যাচ্ছিল, যেচে ফেঁসে যাচ্ছিল, যারা বিয়ে করেনি তারা মোটা ডাউরি হাঁকছিল, সে এক বিরাট নরক, আমি সেখানে এক টুকরো স্বর্গ গড়তে চাইছিলাম, আর ব্যাস, পেয়ে গেলাম তোকে। জগদীশও পড়েছে গিয়ে ওই নরকে, তাই জন্যেই ও হরিয়ানা ছেড়ে যেতে চায় না ; মন্ত্রিদের তেল দাও, তাদের কথামতো চলো আর আনলিমিটেড কালোটাকা রোজগার করো।

                 তুই : ভাগ্যিস দিয়েছিল ; নয়তো বাচ্চাগুলো কোথায় যাচ্ছে, তাদের শেষপর্যন্ত কি হচ্ছে, তার ফলো আপ হয় না। আমিও পড়তুম কোনো বাজে ফ্যামিলির খপ্পরে ।

                 আমি : হ্যাঁ, তুইও তো নিজেই যেচে আমার খপ্পরে পড়তে এলি । নীতি আমার ঠাকুমার নাম, তাই আমি ওই নামটা বেছেছিলাম, কিন্তু রেজিস্ট্রেশানের ক্লার্কটা গোলমাল করে একটা ই বাদ দিয়ে তোকে করে দিলে নেতি। 

                তুই : স্বর্গে সামান্য নরকের নুন-মিষ্টি থাকা দরকার, নয়তো বিস্বাদ লাগতো, তোমার আমার দুজনের রসায়নই। আমি নেতি আর তুমি ইতি, ব্যাস, প্লাস-মাইনাসের যোগফল যা হয়, কী বলো ।

                আমি : ইতি বলিস বা ইটি বলিস, যা ইচ্ছে হয় বলিস । ওগো, হ্যাঁগাও বলতে পারিস ।

                তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, দ্যাট ইজ এ গুড ওয়ান । না, তুমি আমার ড্যাডি, আমি তোমার বেবি এলেকট্রা, ড্যাডি বলেই ডাকব ।

    

               এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

               যেন এমন, যেমন অমন, যেন তেমন নয় ।

                তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, আরে, ফোটো দ্যাখো দ্যাখো, তুমি কোলে নিয়ে আমার গালে চুমো খাচ্ছ ? তখনই চুমো খেয়ে নিয়েছিলে তাহলে ?

                আমি : খেয়েছিলাম, অনেক চুমো খেয়েছিলাম, গালে, পেটে । পেটে ফুঁ দিয়ে হাসিয়েছিলাম , কত হাসতিস খিলখিল,  আমি তোর ন্যাপিও চেঞ্জ করেছি কয়েকদিন ।

               তুই : ওঃ, সব জায়গায় হাত দেয়া হয়ে গেছে ; তাই মনে হচ্ছিল, হাতটা, ঠোঁটটা যেন চেনা-চেনা লাগছে। এখন আরেকবার পেটে ফুঁদিয়ে হাসাতে পারতে ।

               আমি : তুই অ্যাস্ট্রনট হতে চাইছিলি, স্পেস সাইন্টিস্ট হতে চাইছিলি, বাচ্চা নিয়ে কি করে সামলাবি? 

               তুই : সব ব্যাপার ইনডিয়ান পার্সপেক্টিভে ভাবো কেন ? যারা অ্যাস্ট্রনট তাদের কি ওয়াইফ বা হাজব্যাণ্ড বা বেবিজ নেই ? আমার ইনটারভিউটা পড়ে বলছ, বুঝেছি । কয়েকটা রিসার্চ পেপার পাবলিশ করেছি, পিয়ার অ্যাপ্রুভড, আরও কিছু করতে হবে। 

               আমি : তুই স্নান করে নিয়েছিস ?

               তুই : পাগল নাকি ! প্রেম করব বলে প্ল্যান করে তোমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছিলুম, পাউডার পারফিউম মেখে নিয়েছিলুম, লিপ্সটিক লাগিয়ে নিয়েছিলুম, ব্যুরোক্র্যাট বিশ্বামিত্রের চেস্টিটি বেল্টের তালা খোলার পণ করে বসেছিলুম । চলো তোমাকে চান করিয়ে দিই । তুমি আমার ডায়াপার চেঞ্জ করতে, আমি তোমার গায়ের ময়লা ঘষেমেজে তুলি । তোমার পিঠে যথেষ্ট ময়লা জমে আছে, নাকের দুপাশে ব্ল্যাকহেড ফুটে উঠেছে, তোমার পাও বেশ নোংরা ।

               আমি : চল, ওই ঘরের বাথরুমে চল, ওটা বড়ো । স্ক্রাবার আছে । ভাগ্যিস তুই আমেরিকান মেয়েদের মতন গায়ে ট্যাটু করাসনি ; আমার একেবারে ভালো লাগে না কারোর গায়ে উল্কি আঁকা দেখলে ।

               তুই : ধ্যুৎ, ট্যাটু আবার কি করাব ! তামাটে চামড়ায় কেউ ট্যাটু করায় না ।

               আমি : তামাটে নয়, তোর ত্বক হল উজ্জ্বল ।

               তুই : থ্যাংকস ফর দি মিথ্যেকথা । চুলটুল না কামিয়ে তুমি কিন্তু রিয়্যাল হিম্যান । আজকাল বুকে বগলে কুঁচকিতে পুরুষরাও চুল রাখছে না; পুরুষের গা থেকে পুরুষ হরমোনের দুর্গন্ধ না বেরোলে আকর্ষণ গড়ে ওঠে না, মনে হয় ডলফিন ।

               ঘরে ঢুকে, দেখলুম তোর বাক্স খুলে বিছানার ওপর পোশাক টুকিটাকি ছড়িয়ে রেখেছিস, জিগ্যেস করলি, দেয়ালে ওটা কার ফোটো গো ?

              বললুম, চিন্তা করিসনি, ওটা আমার মায়ের । 

              তুই : কোনে রাখা গিটারটা ?

              আমি : ওটা আমার, কলেজে বাজাতাম ।

              তুই : দারুণ হবে, তুমি গিটার বাজাবে আর আমি গাইব, আমার পেনডিং সঙ্গীত সেরিমনি ।

              আমি : গিটার বাজালে আর গান গাইলে পাশের বাংলোয় ‌ভাণ্ডারির মেয়েরা শুনতে পাবে,  আর ওরা দেখতে আসবে, যে আজ অচানক প্রধান সাহেবকো হো কেয়া গয়া, এক লড়কি গা রহি হ্যায় অওর গিটার বজা রহি হ্যায়, কৌন হ্যায় ইয়ে লড়কি ? আমার বাংলোয় তরুণী কেউ তো কখনও আসেনি ।

               তুই : তাহলে নেক্সট হলিডেতে কোথাও বাইরে চলো, দূরে, ধানক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে গিটার বাজিও আর আমি গান গাইব ।

               আমি : মার্কিন গান ? এদিকে ধানের খেত পাবি না, পাবি কালো টাকায় কেনা ফার্মল্যাণ্ড ।

               তুই : না, না, আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারি, আমেরিকায় বাঙালিদের অনুষ্ঠানে গাই ।

               আমি : বারবার আমেরিকা বলছিস, শহরের নাম বলছিস না তো ? কোন রাজ্যের কোন শহর,  কোন রাস্তা, অ্যাঁ?

               তুই : হুঁ হুঁ, আমি যেমন তোমাকে লোকেট করার জন্য খেটে মরেছি, আমি চাই আমি চলে যাবার পর তুমিও সেরকম মরো, তোমার তো লোকবল আছে, কানেকশান আছে, সরকারি যন্ত্র আছে, চেষ্টা চালিও ; আমার ডিসপোজালে কিছুই ছিল না মিস্টার আগামেমনন, কিছুই ছিল না, কাঠের ঘোড়ায় লুকোনো সৈন্যসামন্তও নয়, জাস্ট একা, বুঝেছ, জাস্ট একা । আর আরশুলাকে ঠিক ধরে ফেলেছে টিকটিকি । খুঁজো, আমাকে খুঁজো ।

               আমি : কেনই বা খুঁজব তোকে ?

               তুই : যেদিন যাব সেদিন বলব । রিভেঞ্জ, রিভেঞ্জ, প্রতিশোধ হল সবচেয়ে সুন্দর শিল্প ; প্রত্যেক মাসে আমি রক্ত ঝরাই, কেন ? প্রতিশোধ হল নলেন গুড়ের সন্দেশ ।

               এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

               যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।   

               আমি :আচ্ছা, বাথরুমে চল আপাতত । আমি কিন্তু শর্টস পরে নিচ্ছি, বেশ এমব্যারাসড ফিল করছি এভাবে, অভ্যাস নেই তো।

               তুই : তুমি যাও, আমি একটা জিনিস নিয়ে আসছি । আমারও অভ্যাস নেই, তো তাতে কি । যা-যা করলুম, তার কি অভ্যাস ছিল নাকি, করলুম তো, বিন্দাস, তোমার জন্য ।

               আমি শাওয়ারের তলায় টুলের ওপর বসেছিলাম, তুই হাঁটুগেড়ে আমার সামনে বসলি, নেকেড, শাওয়ারের তলায়, একটা আঙটি হাতের তালুতে রেখে বললি, আমি নেতিস্মর আঁস্তাকুড়বাসিনী, আজ দ্বিপ্রহরের এই ঝরণাতলায়, তোমায় প্রোপোজ করছি, তুমি কি আমাকে গ্রহণ করবে ? 

              বলে,  আমার উত্তরের অপেক্ষা করলি না, বাঁহাতখানা নিয়ে অনামিকায় পরাবার চেষ্টা করলি আঙটিটা, ঢুকল না, তর্জনীতে ঢুকল, বললি, ভালো হল, ওয়েডিং ফিংগারের চেয়ে ডিজিটাল ফিংগার উপযুক্ত, ডিজিটাল ফিংগার ছাড়া প্রেম হয় না, অর্জুনের ডিজিটাল ফিংগার ছিল সবচেয়ে ইমপরট্যান্ট ; অতগুলো মহাকাব্যিক প্রেমিকাকে হ্যাণ্ডল করা সহজ ব্যাপার ছিল না । 

               উঠে দাঁড়িয়ে, বললি, কি কোলে তুলে নিলে না, ছোটোবেলায় তো নিয়েছিলে, নাকে নাক, গালে ঠোঁট ঠেকিয়েছিলে । 

               ডিবেতে দেখলাম তনিষ্ক লেখা ।         

              পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে জিগ্যেস করলাম, কখন কিনলি, যখন এসেছিলি তখন তো দোকান খোলার টাইম হয়নি ।

              গলা জড়িয়ে ধরলি, আমি তোর নাকে নাক গালে ঠোঁট ঠেকাতে, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, হাসতে হাসতে বললি, আমি পরশু এসেছি, হোটেলে উঠেছিলুম, তোমার লোকেশান সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য রিকনাইসান্স ভিজিট করে গেছি, গেটে দেখে গেছি প্রভঞ্জন প্রধানের নাম । 

                ডিটেকটিভ এজেন্সি বাপির, আই মিন আঙ্কলবাপির, আর আন্টিমায়ের অ্যাকাউন্ট ট্রেইল করার সময়ে, তোমার অ্যাকাউন্টও ট্রেইল করেছিল, আর সেখান থেকে এডুকেট এ গার্ল চাইল্ডকে আজও যে টাকা পাঠিয়ে চলেছ তা জানিয়েছিল আমায়; আমি কালকে এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড-এর পরিচালক মিসেস সোমপ্রীত কৌরের সঙ্গে দেখা করেছি, পরিচয় দিয়েছি, কিন্তু ওনারা তোমার সঙ্গে হওয়া কনট্র্যাক্ট আর আঙ্কলবাপির এফিডেভিট দেখতে দিলেন না, সিক্রেট ডকুমেন্ট । 

                ফোটো দেখালেন, ফাইলে, তোমার কোলে, যে ফোটোর কপি রয়েছে তোমার আলমারিতে, প্রায় সেইরকম কয়েকটা ফোটো, নাকে নাক, গালে ঠোঁট । অ্যাকাউন্ট ট্রেইল না করলে তোমার পরিচয়, বাড়ি, এনজিওর ঠিকানা পেতুম না । সরি ফর দি ইনট্রুজান । তুমি আমার লাইফে ঢুকেছ, আমি তোমার লাইফে ঢুকলুম, শোধবোধ । ওকে ?

               ওরকম হাসিসনি, হাসলে তোর বুক দুলে দুলে উঠছে, আর আমি ডিস্টার্বড ফিল করছি, ওদের বাড়িতে থাকার ফলে তোর বুক-পাছাও হয়ে গেছে জাঠনিদের মতন, নিয়ন্ত্রণহীন । 

               থ্যাংকস ফর দি কমপ্লিমেন্ট ড্যাড । 

               আঙটিটা দামি, হিরের, কত ক্যারাট রে ? কিন্তু আমার কাছে তোকে দেবার মতন আঙটি তো নেই, কিনে দেবো, কি বল ?

               না, না, ধ্যুৎ,ওসব করতে হবে না, আমরা এনগেজমেন্ট করছি না, ইউ আর মাই ফ্যাসিস্ট ড্যাডি, দি রিমোট কনট্রোলার, ওই আসনেই থাকো । 

                নামিয়ে দিলাম তোকে শাওয়ারের তলায় ।

                হঠাৎ জিগ্যেস করলি, এর আগে চুমো খেয়েছ কাউকে ?

                বেফাঁস বলে ফেললুম, হ্যাঁ । স্মৃতির চোট খেয়ে কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকত ভেসে উঠেছিল।

                তোর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, কথাটা শুনে চকিতে বদলে গেল অভিব্যক্তি, এক বর্ণনাতীত ক্রোধ ফুটে উঠল, কোমরে দুহাত দিয়ে, নেকেড, তুই জিগ্যেস করলি, কে সে ?

                টের পেলাম, মারাত্মক ভুল  করে ফেলেছি, যৌনসম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা কত যে জরুরি । 

                এসে পর্যন্ত তোর এই রূপ যে লুকিয়ে রেখেছিস, জানতে দিসনি, রগের পাশে উঁচু হয়ে উঠেছে শিরা ।

                কাছে এসে, বাঁহাত দিয়ে আমার বুকে ঠেলা মেরে বললি, কে সে, অ্যাঁ, কে সে ?

                আমি দ্রুত কি উত্তর দেব ভাবছি, ডান হাত দিয়ে বুকে ঠেলা মারলি, বললি, কে মেয়েটি ?

                আবার বাঁহাতে ঠেলা মারলি, আমি দেয়ালে পিঠ, দ্রুত একটা উত্তর খুজছি, মগজকে বলছি, দাও দাও, তাড়াতাড়ি যোগাও মনের মতন উত্তর । তোর ঠেলাও উপভোগ করছি, দেয়ালটা আরেকটু পেছনে হলে আরও কি-কি বলতিস জানতে পারতাম ।

                তুই, আরও ক্রুদ্ধ, আবার বুকে ঠেলা মেরে বললি, আর কি-কি করেছ ?

                নাম কি ?

                অপেক্ষা করতে পারোনি ? 

                আমি তো বড়ো হচ্ছিলুমই, না কি, অ্যাঁ ? হলেইবা বয়সের ডিফারেন্স !

                তিন তিনটে চিঠি লিখেছিলুম, পড়লে তো, তবে ?

                এত তাড়া কিসের ছিল ? 

                তোমার জন্যই যে আমি তা কি জানতে না ?

                তোমার নামের মেহেন্দি লাগিয়েছি কেন দুহাতের চেটোয় ?

                দ্যাখোনি লাভ ব্যাঙ্গলস পরে এসেছিলুম ?

                তোমার কাছে এলুমই বা কেন, অ্যাঁ ?

                হোয়াই আই ওয়াজ সিইং ইউ উইদাউট সিইং ইউ ফর মোর দ্যান টু ডিকেডস, বলো, বলো?

                বলো, বলো, বলো, বলো,বলো, চুপ করে থেকো না, কি কথা নেই কেন ?

                প্রথম রক্ত আর প্রথম স্পার্মের বেবি চেয়েছিলুম আমি, জানতে না ? সেক্স নয়, বেবি, তোমার বাচ্চা চেয়েছিলুম, উইদাউট ব্লেমিশ, জানতে না ?

                এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

                যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

                অন্ধকারে, অন্ধকারে, অন্ধকারে, কেননা তোর দেহ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয় ।

                বানভাসি, বানভাসি, ভাসিয়ে নিয়ে সাগরে, কূলকিনারাহীন । 

               তোর অভিব্যক্তির ভেতর যে বার্তা আবিষ্কার করলুম, তা হল, আমি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারি ভেবে তুই সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে গেছিস, যেন  কখনও কেউ তোকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছিল, আর তাদের কারাগারের কথা চিন্তা করলেই মগজে ছড়িয়ে পড়ছে উষ্মা ।

                আমার মুখের কাছে তোর ঠোঁট হুইস্কির গন্ধের কাছাকাছি নিয়ে এলি, একটা উত্তর আপনা থেকে বেরোলো, দুর্গন্ধের স্মৃতি থেকে, প্রথম চুমুতে ছিল ইনটারপ্রেটার-ট্রানস্লেটারের হাঁ-মুখের দুর্গন্ধ, ক্যাণ্ডললাইট শুয়োর খাবার পরিণাম, বললাম, হ্যাঁ, আমি একটা ছোট্ট মেয়েকে চুমু খেয়েছিলাম, বহুকাল আগে তাকে কোলে তুলে, নাকে নাক ঠেকিয়াছিলাম, নাভিতে ফুঁ দিয়ে কাতকুতু দিয়েছিলাম ।

               আশ্চর্য, যত দ্রুত রেগে গিয়েছিলি, তত দ্রুত তোর উগ্রতা প্রশমিত হয়ে গেল; ফিরে এলি দ্যুতিময়তায় ।

                হাত ধরে শাওয়ারের তলায় টেনে নিয়ে গিয়ে বললি, সরি, তোমার ওপর আর কারো অধিকার, তা আংশিক হলেও, আমি মোটেই বরদাস্ত করব না, যথেষ্ট নিষেধ মাথা পেতে নিয়েছি, আর নয় ।  

               শান্ত গলায় বললি, জানো কি সাইক্লোনের নাম মেয়েদের নামে হয় ? ক্যাটরিনা, লায়লা, নিলম, হেলেন, নিশা ? আমার নামে আছে তোমার দেয়া সুপার সাইক্লোন ।

                টুলের ওপরে গিয়ে বসলাম ; মগজে তখন ভাবনার জেলি তৈরি হয়ে চলেছে, তাহলে কি আমি হেরে গেলাম, তোর সামনে কখনও না গিয়ে তোর ওপরে উল্টে এক কুইন্টালের বাটখারা চাপিয়ে দিয়েছি, যা তুই জীবনে মাথার ওপর থেকে সরাতে পারবি না ? তোকে বড়ো করে তুলে নিজস্ব নারী হিসাবে পেতে চাই বলেই কি এডুকেট এ গার্ল চাইল্ডের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম, আমার একজন তরতাজা মানস-ক্রীতদাসীর প্রয়োজন মেটাবার জন্য ?

                মুষড়ে পড়লাম । 

                তুই বুঝতে পারলি না কেন মুষড়ে পড়েছি, কিন্তু ভাবলি যে তোর কথায় আর বুকে থাবড়ানিতে  অপমানিত আহত হয়ে বাকরুদ্ধ । 

                ক্রোধ নয়, তুই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলি, বজ্রপাত ঘটিয়ে দিলি, এটাই বোধহয় আমাকে টুকরো-টুকরো করে খেয়ে ফেলার আগাম ইশারা । আমাকে বাদ দিলেই যেন তোর সামনে কালো গহ্বর, যেন ওই গহ্বরে তোকে কেউ ঠেলে দিয়েছিল, সেখান থেকে বেরোবার জন্য আমার হাত আঁকড়ে ধরেছিস ।

                বললুম না যে তুই অকারণে ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলি । বললুম ঠিকই করেছিস, ক্রোধ ধরে রাখলে ভেতরটা পচতে আরম্ভ করে, দেখেছিস তো অ্যানিমাল প্ল্যানেটে, বাঘিনীর ক্রোধে তার থাবা থেকে নখগুলো বেরিয়ে আসে, শিকারকে ধরার সময়ে আসে, খাবার আয়োজন করার সময়ে আসে । গোরিলারা নিজেদের বুক থাবড়ায়, তুই আমার বুক থাবড়ালি ।

                  প্রায়শ্চিত্ত করার বা পারস্পরিক দায়মোচনের তরল কন্ঠস্বরে, তুই বললি, ডিয়ার সিলভার-ব্যাক আলফা মেল, এসো, তোমার পায়ের নোংরা ঘষে তুলি, নখে আর পায়ের আঙুলে এতো নোংরা, কখনও কি সাবান লাগাও না ? এত রোজগার করো, স্পাতে গিয়ে পেডিকিওর করালেই তো পারো, কতো স্পা চোখে পড়ল কালকে, এক্সক্লুসিভলি পুরুষদের জন্যে । আমার জন্য তো অনেক কিছু করেছ, এবার না হয় নিজের জন্য করলে 

               শাওয়ারের তলায় আমাকে জড়িয়ে ধরে তুই আবার কবিতাটার আরেক স্তবক আরম্ভ করলি, বললি, লিসন ইউ লাভিং বাস্টার্ড:

                There’s a stake in your fat black heart

                And the villagers never liked you

               They are dancing and stamping at you.

               They always knew it was you

               Daddy, daddy, you bastard, I’m through.

           

               সাবান মাখাবার সময়ে তুই চেঁচিয়ে উঠলি, ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, আইডিয়া ।

               আমি জিগ্যেস করলাম, কী, শুনি ? জারজপুরুষ হিসাবে আমার নামকরণ ?

               তুই বললি, ধ্যুৎ, আরে নাঃ , চলো, আমার জন্মস্হান সেই আঁস্তাকুড়টা দেখে আসি, ফোটো তুলে নেব, আমি ওখানে বসব, তুমি ফোটো তুলে নিও, যদি নোংরা না হয় তাহলে শুয়ে পড়ব, আর শুয়ে থাকার ফোটো তুলে নিও  ।

               দাঁড়িয়ে ফোটো সম্ভব, বসে বা শুয়ে সম্ভব কি না জানি না ; কর্পোরেশানের গাড়ি জঞ্জাল তুলে নিয়ে যাবার পর হয়ত বসতে পারবি ।

               নোংরা তো কি হয়েছে, শুয়ে ছিলুম এককালে, কতক্ষণ শুয়েছিলুম কেউ কি জানে ? ফোটো তুলতে তো কয়েক মিনিট।

               আটপৌরে পোশাক আছে কি তোর ? শাড়ি-ব্লাউজ, চুড়িদার ? আঁস্তাকুড়ে বসতে বা শুতে হলে মার্কিন পোশাক তো চলবে না ।

               স্ট্রেঞ্জ, না ? আমেরিকায় বহু আফ্রিকান-আমেরিকান গারবেজ ডাম্প থেকে খাবার তুলে খায়, তারা কেউ-কেউ রাতে ড্রাগ ফুঁকে শুয়েও থাকে গার্বেজ ডাম্পে । দেখেছ তো হলিউডের ফিল্মে ?

               যাক, সে তুলনায় আমাদের আঁস্তাকুড় বেশি ডেভেলাপড, অনেকের রুজি-রুটির ব্যবস্হা হয়, বাতিল জিনিস  কুড়িয়ে-বাড়িয়ে ।

               যাই, দেখি গিয়ে, কবে যাবে ?

               ঠিক আছে, চল যাওয়া যাক, সেই কতকাল আগে গিয়েছিলাম, দেখে আসি আরেকবার ।

               তুই বললি, আবদারের কন্ঠে, এই প্রথম তোর কন্ঠে ড্যাডের প্রতি মেয়ের কন্ঠস্বর শুনলুম, বললি, চলো না তোমার গ্রামেও একটা ট্রিপ মারি, তোমাদের জমিজমা আছে তো সেখানে ? কোথায় তোমাদের গ্রাম, একটু কানট্রিসাইড ঘুরে নেবো, তোমার জ্ঞাতিদের সঙ্গে তোমার বউয়ের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে ।

               আমার বাবা স্কুল টিচার ছিলেন, হুগলি জেলার আরামবাগে, মাধবপুর গ্রামে জমিজমা ছিল । সম্পত্তি নিয়ে কখনও ভাবনা-চিন্তা করেননি বাবা-কাকারা ; অনেক জমি ছিল, সবই বেদখল হয়ে গেছে, বাবা রাজনীতি করতেন না, হাতছাড়া জমিজমা আর ফেরত পাননি । কাকারা বাবার আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, কোথায় ওনারা থাকেন, খুড়তুতো ভাইবোনরা কে কোথায়, তাও জানি না ।

               আমি আইএএস হবার পর মা-বাবাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছি প্রতিটি পোস্টিঙে; আমরা আর ওমুখো হইনি কখনও।

               তুই বললি, তোমার বাবা অমন সাধাসিধে মানুষ ছিলেন বলে তুমি এরকম নিষ্ক্রিয় টাইপের হয়েছ, প্রিহিসটরিক মরালিটির মানুষ, বর্তমান ভারতবর্ষের অনুপযুক্ত । আন্টিমা বলেন যে একটা ফ্ল্যাটও কিনে রাখতে পারোনি প্রভঞ্জন প্রধান, এমনই ফুলিশ।

               আমি  তোকে জিগ্যেস করলাম, কি করে সন্দেহ করলি যে তোর জীবনের আড়ালে আমি আছি ? আর আমি তোকে সাড্ডল্য সুন্দরী করে তুলছি একদিন তোকে পাবো বলে ? আমার ডারলিং ডটার গ্রোইং আপ ফর মি !

                 তুই বললি, ক্লুটা পেয়েছিলি  কবিতার লাইন থেকে, “আই টক টু গড বাট দি স্কাই ইজ এম্পটি।” তারপর আমার গা তোয়ালে দিয়ে পুঁছতে-পুঁছতে বললি, আমি লেগহর্ন মুর্গি তো, তুমি একদিন যে খাবে আমাকে তা জানতুম ।

                আর তুই ?

                রয়াল বেঙ্গল টাইগ্রেস, টুঁটি ধরে ঝুলিয়ে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে খাবার পরিকল্পনা চালিয়ে গেছি, ঘ্র্যাঁওওওওও । কাল অফিস যাবার সময়ে সরোজিনি নগর মার্কেটে ড্রপ করে দিও, কটা দরকারি জামাকাপড় কিনে নেবো ।

               সরোজিনি নগর মার্কেটে পৌঁছে তোর নজরে পড়ল এক প্রৌঢ় দম্পতি, বললি, পাল্কি ফ্যামিলি, চেনো না বোধহয় । ওনাদের মুখের ভেতর সদাসর্বদা পাঁকের ল্যাণ্ডস্লাইড চলতে থাকে, সাবধান না হলেই ডুববে সেই পাঁকে ।

               পাল্কি ?

               মিস্টার পাল আর মিসেস পাল, এত গুলগল্প ঝাড়েন যে ওনাদের আরিয়ান নাম দিয়েছে পাল্কি, লিপিকা-কিরণশঙ্কর থেকে খামচে তোলা ; দুজনেই বুদ্ধি আর কল্পনায় দেউলিয়া । ওই যে এদিকেই আসছেন, তুমি চেনো না, কাচ তুলে দাও, কাচ তুলে দাও, শিগগির, শিগগির, দেখে ফেললেই কেলেঙ্কারি ।

                গেছেন ওনারা, তোর ভয় পাবার কারণ বুঝতে পারলাম না, আমি যখন তোকে অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছি, তখন যার যা ইচ্ছা হয় বলুক, কিচ্ছু এসে যায় না ।

                ও তুমি বুঝবে না, ওনারা আমাকে তোমার সঙ্গে দেখে ফেললে ভিষণ বিপদ হতো ।

                এখন যা,  কি-কি কিনবি কিনে নে । তুই ওই গাছটার তলায় দাড়িয়ে থাকিস, আমার ড্রাইভার আমাকে পৌঁছে তোকে পিক আপ করে নেবে । তোদের বাড়ি যেতে চাস তো গুড়গাঁও হয়ে আয়, বৈদেহী আছে; জগদীশ-অমরিন্দর তো চণ্ডীগড়ে । নয়তো কলকাতা থেকে ফিরে তারপর যাস ।

              যাবো’খন, তাড়া নেই, তোমার সঙ্গে তো তিনমাস কাটাবো, তোমার বিছানার চাদর থেকে মেমেন্টোটা কেটে রেখে নিয়ে চাদরটা  তোমার আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছি, তোমার সংরক্ষণের মেমেন্টো হিসাবে ; একটা নীল ফুলফুল বেডশিট বিছিয়ে দিয়েছি, রাতে আকাশে বিচরণ করব ।

              স্পর্শের মর্মার্থ, মর্মার্থের রসায়ণ, রসায়নের সম্পর্কে, রেণু, পরাগ, উড়াল, জীবন ।

              চাউনির কোলাহল, উতরোল শ্বাস ।

               এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

               যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

               রাত দুটো নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল । উঠে, তোর দেহের পাশে বসে, নাইটল্যাম্পের ফিকে নীল আলোয়, দেখছি , চিৎ হয়ে ঘুমোচ্ছিস, নেকেড । আমি তো পায়জামা বা শর্টস না পরে ঘুমোতে পারি না ।

               তোর ভুরু দেখছি, সরু করিয়েছিস । ভ্রুযুগল, ভ্রুযুগল ।

               তোর দুজোড়া ঘুমন্ত চোখ দেখছি, আইলাইনার বোধহয় স্মাজফ্রি, রয়েছে এখনও, পাতার তলায় ।

               তোর চোখের পাতা দেখছি । সত্যিকার পক্ষ্ম, পক্ষ্ম, পক্ষ্ম । চাপা দিয়ে রেখেছিস, স্বপ্ন, স্বপ্ন ।

               তোর নাকের পাটা দেখছি, নাকছাবির দাগ রয়েছে, পরতিস হয়তো শখ করে ।

               তোর কান দেখছি, মাকড়ি খুলে রেখে দিয়েছিস ।

               তোর ঠোঁট দেখছি, স্নানের পর আর লিপ্সটিক লাগাসনি । ওষ্ঠ, অধর, ওষ্ঠ, অধর । 

               তোর কোঁকড়া চুল দেখছি, আঁচড়াসনি মনে হল ।

               তোর গলা দেখছি, বেশ লম্বা, ঢ্যাঙাদের গলা বোধহয় এরকমই হয় । 

               তোর বুক দেখছি, শ্বাস নিচ্ছিস, আলতো উঠছে-নামছে ।

               তোর শরীরের গন্ধ নিলাম ঝুঁকে, শোবার আগে পারফিউম মেখেছিস ।

               দেখছি, মানুষীর মাংসল নির্যাস, নীলতিমিরে আচ্ছন্ন প্রতিমা, সেই কবেকার শিশু,  যাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করছি, চিন্তা করা বন্ধ করে  নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দখলে, উদ্বেল হয়ে উঠছি । প্রেম করার সময়ে এভাবে চোখ বন্ধ রাখিস না কেন যাতে তোকে ভালোভাবে দেখে নিতে পারি, তখন তো হাসিস, কবিতার লাইন বলিস, গানের কলি গেয়ে উঠিস, মাংসের সঙ্গে মাংসের সম্পর্ককে চরমে নিয়ে যাবার নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছিস নাকি ?

               বাস্তবকে অবাস্তব করে দিচ্ছিস, তোর জাদুতে আবিষ্ট হই । ঘুমও প্রেমের স্ফূরণ ঘটিয়ে দিল, ঘুমন্ত শরীরও ভালোবাসার জ্যোতি বিকিরণ করতে পারে । কত কিছু জানা ছিল না, তুই এলি, জানতে পারছি ।

##

                ইচ্ছে হল তোর গলা টিপে ধরি, মেরে ফেলি তোকে, যাতে তুই আমাকে ছেড়ে চলে না যাস । 

                তোর দেহের দিকে হাত নামালাম, গলায় নয়, বগলের পাশ দিয়ে দুহাতে তুলে নিলাম তোর ঘুমন্ত শরীর, ঘুমের ঘোরে বললি, আই লাভ ইউ ব্রো-প্রো, আমি অন্যের ভূমিকায় অভিনয় করছি না, আমি রক্তমাংসের জেনুইন প্রেমিকা । 

               অনেকসময়ে তোকে প্রশ্ন করলে কেন চুপ করে থাকিস, তক্ষুনি উত্তর দিস না, কিসের ইঙ্গিত দিস অমন করে, নাকি নিজের মস্তিষ্কে কোনো উত্তর গড়ে ওঠে না ।

               স্বপ্ন দেখছিস, দ্যাখ, দেখে নে স্বপ্নসংকটের স্বপ্ন, ঘুম ভাঙাবো না । 

               আলতো শুইয়ে দিলাম তোকে ।

     

  

তিন

                তোর আবদার ছিল আমরা ফার্স্ট ক্লাস এসির একটা ক্যুপে রিজার্ভ করে ট্রেনের চাকার তালে-তালে প্রেম করতে করতে যাই, তাতা ধিন না, তাতা ধিন না, দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম ব্রিজের ওপর দিয়ে, প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ ।

                 তা সম্ভব ছিল না, আমার পক্ষে অতদিন ছুটি কাটানো অসম্ভব, জানাজানি হলে ঘুষখোর অফিসাররা টানাহেঁচড়া করবে ; তারা ওৎ পেতে আছে বহুকাল যাবত ।

                 আমি আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দুটো এয়ার টিকিট কাটলাম, মিস্টার প্রভঞ্জন প্রধান, মিসেস নেতি প্রধান, দমদমের, ভোরের ফ্লাইট ।  

                 আট নম্বর রোতে সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে তুই বললি, ড্যাড, প্লেনটা যদি ক্রাশ করার মতো হয়, আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরব, তুমিও তক্ষুনি জড়িয়ে ধোরো আমায় ।

                 ছি ছি, কি বলছ গো, যাত্রা আরম্ভ হবে, এখন ওসব কি অলুক্ষুনে কথা । পেছন ফিরে দেখলাম, রিমলেস  বৃদ্ধা । আমি পেছন ফিরেছি দেখে বললেন, আপনার মেয়েকে যথাযথ শিক্ষাদীক্ষা দেননি, এতগুলো মানুষ, আপনার মেয়ে চাইছেন সবাই এক সঙ্গে মরি ।

                উনি আমার মেয়ে নন, স্ত্রী ।

               পেছন থেকে ফিসফিসগুলো ভেসে আসতে লাগল ।

               ফাঁসিয়েছে মালদার আসামী।

               না, তেমন বুড়ো নয় লোকটা, বেশ স্মার্ট, পঁয়তাল্লিশ হবে মনে হয় ।

                মেয়েটা তো তার অর্ধেক, দেখছিস না, তাও আধুনিকা, খাঁজ দেখা যাচ্ছে ।

               বাপের সঙ্গে বেরোলেও মেয়েরা খাঁজ দেখায়, খাঁজ তো আর বাপকে দেখাচ্ছে না, পাবলিককে দেখাচ্ছে; নতুন কি এতে?

               আমি তো বলব লোকটা টাকার টোপ দেখিয়েছিল, মেয়েটা তো কম স্মার্ট নয়, সুশ্রী ।

               ম্যাট্রিমোনিয়াল ডট কমে দিয়েছিল হয়ত, সেখান থেকে খুঁটে তুলেছে রে ।

              দুটোই ডিভোর্সি হবে বোধহয় । 

              ঘাটে-ঘাটে জল খেতে গিয়ে নদীকূলে পরিচয় ।

              মেয়েটা ভাবছে ক্র্যাশ হলে ও বেঁচে যাবে আর আমরা সবাই থেঁতলে ছড়িয়ে থাকব সর্ষের খেতে ।

              হ্যাঁ, গায়ে পড়া টাইপের, হাই-হ্যালো করেছে, ক্যান্ডললাইট ডিনার খেয়েছে, ডিসকোয় নেচেছে, আর ব্যাস, আঙটি বদল আর লেংটি দখল ।

               আমি পেছন ফিরে বলতে চাইছিলাম, না সেসব কিছুই হয়নি, নেতি আমার হাত চেপে বলল, দাও না বলতে, এনজয় করছি, আলোচনার পাত্রী হয়ে উঠেছি, ল্যাজটা না হয় খানিক মোটা হল, বাজেট এয়ারলাইন্সে চাপার এটাই প্লাস পয়েন্ট ; অন্য এয়ারলাইন্সে গেলে বিজনেস ক্লাসে সবাই মুখ গোমড়া করে দার্শনিক সেজে থাকে, বাঞ্চ অফ ওল্ড হ্যাগার্ডস, যেন আইনস্টাইনের পেট থেকে জন্মেছে ।

               ফিসফিস বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল, পেছন ফিরে বললাম, আমি সাতচল্লিশ আর উনি চব্বিশ, প্রেম করে বিয়ে করেছি । উনি আমেরিকা থেকে আমাকে বিয়ে করার জন্য এসেছেন ।

               তা উনি আপনাকে ড্যাড বলছিলেন যে, একজনের যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন ।

               উত্তরটা তুইই দিলি, আমেরিকায় এই কিছুকাল আগে অব্দি হাজব্যাণ্ড আর প্রেমিককে মেয়েরা বেবি বলে ডাকত, এখন বেবি পুরোনো হয়ে গেছে, ড্যাডি বলে ডাকা হয়, আদর করে ডাকতে হলে ব্যাড ড্যাড, শোনেননি সেই গানটা, ব্যাড ড্যাড, ডোন্ট ফিল স্যাড, ইউ আর এ ল্যাড, লে মি ওন ইওর প্যাড, স্নুপি বিচের গাওয়া ?

                এলোচুলে ঢাকা রাজকন্যার মুকুটের ঝিলিক থেকে গানের টুকরো ।

                কিছুটা অপরিচিত থাকার আহ্লাদ ।

                এয়ারপোর্টের কাছের হোটেলে বাক্স-ব্যাগ রেখে তোকে পাশে বসিয়ে বাঁশদ্রোণী বাজারের দিকে চললাম, হোটেলের নির্ধারিত গাড়িতে । তুই চুড়িদার পরে নিয়েছিস ;  বাচ্চাদের মতো চারিদিকে মাথা ঘুরছে তোর । গাড়ির ভেতর থেকে স্মার্টফোনে ছবি তুলছিস, ডাবের ঠেলা, মিনিবাস, রাজনৈতিক দলের ছেঁড়া পোস্টার, মোড়ের হিজড়ে, রাস্তা পেরোনো অলস ভিড়, যা  তোকে অবাক করছিল, তারই ।

               একটাও আঁস্তাকুড় দেখলুম না এখনও, বললি ।

              সমবেদনার মুচকি ঠোঁটে খেলিয়ে, ড্রাইভার বলল, আঁস্তাকুড়ের ফোটো তুলবেন নাকি, দিদি । একটু অপেক্ষা করুন, সকাল এদেশে কুঁড়ে-স্বভাবের, সূর্য একটু জোর পাক গায়েগতরে, দেখতে পাবেন ।

              তুই উত্তর দেয়া দরকার মনে করলি না , ঘাড় নাড়াটা সন্মতিসূচক কিনা বুঝতে পারলাম না।

              আচমকা উচ্ছ্বসিত, বললি, এটা আমার দেশ, ওই বউটা কি বাচ্চা-ফেলে দেয়া মা, আরে ওই লোকটা আমার মতন ঢ্যাঙা, ও নিশ্চয়ই ফেলে দেয়া বাচ্চার বাবা, নাঃ, রাসকেলটা  বুড়ো হয়ে গিয়ে থাকবে, কিংবা নরকে গিয়ে গরম তেলে ঝলসে মরছে । কে জানে, মুসলমানও হতে পারে, মুসলমানরা বেশ লম্বা-চওড়া হয়, তা যদি হয় তাহলে জাহান্নমে অপেক্ষা করছে কয়ামতের জন্য । 

              বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলি, যতই যাই হোক, আঁস্তাকুড়ে জন্মে থাকি বা না থাকি,  এটা আমার মাতৃভূমি, আই লাভ ইট।

              তোকে চিমটি কাটতে হল, ড্রাইভার তো আমেরিকা বা গুড়গাঁওয়ের নয়, যে বাংলা বুঝতে পারবে না! 

              তোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, মাতৃভূমি মানুষকে মূর্খ করে তোলে, আবেগের গাধা বানায় ; মাতৃভূমির প্রেমে পড়ে রাশিয়ানরা কার্ল মার্কসকে বদনাম করে দিলে । শুনেছিস তো মার্কসের নাম ।

             শুনেছি, শুনেছি, দাড়িগোঁপ ছিল, তোর কন্ঠস্বরে অন্য চিন্তাকে বিপথগামী করে দেবার অভিযোগ ।

             ড্রাইভার শুনছিল তোর কথা, বলল, দিদি, মাতৃভূমি আর নেই, এখন যে দল সরকার চালায় সেই দলকে ভালোবাসতে হয় । দেশটাকে তো সবাই মিলে  আঁস্তাকুড় বানিয়ে ফেলেছে । যে লোক নেতা হয়, সে মনে করে সে-ই বুঝি সরকার, তার হুকুম সবাইকে মানতে হবে, নইলেই কেলেঙ্কারি, খুনোখুনি, মাটির তলায় হাড়পাঁজর, ছেলেপুলে কাঁখে গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে । 

             তুই বললি, কী যে বলছেন, সরকার আর মাতৃভূমি তো এক নয় ।

             এখন লোকে মাতৃভূমির জন্য জান দেয় না গো দিদি, দলের জন্য দেয়, শহিদ হয়, যারা মরে আর যারা মারে, সবাই তা দলের জন্য করে, মাতৃভূমির জন্য নয়, বলল ড্রাইভার , নিজের মাকেই বুড়ো বয়সে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দ্যায়, আর আপনি মাতৃভূমির কথা বলছেন । এই তো সেদিন পড়লুম,  মাকে খুন করে তার সম্পত্তি হাতিয়েছে চার ছেলে ষড়যন্ত্র করে, মুখে অ্যাসিড ঢেলে তারপর পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল, যাতে পুলিশ চিনতে না পারে  ।

             যাক, ড্রাইভারটা অন্তত তোকে চুপ করিয়ে দিতে পারল, নয়তো কি-কি বকে যেতিস মাথামুণ্ডু । 

             নাঃ, তুই দমবার নয়, আবার আরম্ভ করলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ওরা সব প্যারানয়েড, বুঝলেন, পশ্চিমবাংলা হল আমার আর আপনার, আমাদের, আমি নলেন গুড়ের সন্দেশ ভালোবাসি, পাটালি গুড়, পাটি সাপটা, জামদানি শাড়ি, দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভাপা ইলিশ, ট্যাংরা মাছের ঝোল, শিষপালঙের চচ্চড়ি, চালতার অম্বল, আমার চাষি-ড্যাডিকে ভালোবাসি, এইগুলোতে কি পশ্চিমবাংলা নেই ?

           এবার ড্রাইভার যা বলল, তাতে তুই একেবারে চুপ করে গেলি, জিগ্যেস করল, আপনি কোথায় থাকেন? 

            তুই বললি, আমেরিকা, আর সামনের আয়নায় দেখতে পেলি ড্রাইভারের ঠোঁটে মৃদু শ্লেষের হাসি ।

            হঠাৎ বলে উঠলি, আচ্ছা, জোনাকি কোথায় দেখতে পাবো ? আমি আজ অব্দি জোনাকি দেখিনি ।

            ড্রাইভার এবারে তোকে বিপদে ফেলল ওর অনুসন্ধিৎসা প্রয়োগ করে, দিদি, কোথায় জন্মেছেন, পশ্চিমবাংলায় কোথায়, যে জোনাকি দেখতে চাইছেন ?

           আঁস্তাকুড়ে, বললি তুই ।

           ড্রাইভার ভাবল ঠাট্টা করছিস, আমাকে জিগ্যেস করল, স্যার কোথাকার লোক আপনারা, আপনার মেয়ে এখনও পশ্চিমবাংলা দেখেননি ?

           উনি আমার মেয়ে নন, আমার স্ত্রী, বললুম, তারপর যোগ করলুম, তুমি আমাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছ, বাঁশদ্রোণী বাজার, সেই বাজারের বাইরে জঞ্জাল ফেলার যে আঁস্তাকুড় আছে, সেখানে এনাকে ফেলে গিয়েছিলেন এনার বাবা কিংবা মা, তখন এনার কয়েকদিন মাত্র বয়স, তারপর স্হানীয় ক্লাব, যাদবপুর থানা, হাসপাতাল, স্হানীয় এনজিও  হয়ে ইনি দিল্লির জনসেবামূলক এক সংস্হায় পৌঁছোন, একটি বাঙালি পরিবারে পড়াশুনা করে আমেরিকায় বড়ো চাকরি করছেন ; ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় দিল্লিতে ।

           দিদি, আপনাকে দেখে বাংলা ফিলিমের  নায়িকা মনে হয়েছিল, এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে ঘটনাটা সত্যি । 

           তুই বললি, গ্রেট, সিনেমা হলে বসে বাংলা ফিল্ম জীবনে দেখিনি, একটা ফিল্মও দেখব ড্যাড । হিরোরা কি বলিউডের মতন মারামারি করে ? নাচে ? ঝিনচাক ঝিনচাক ? আইটেম ডান্স হয় ? বিড়ি জালাইলে ? ঝাণ্ডুবাম ? বেবি ডল ম্যায় সোনে দি হয় ? 

           ড্রাইভার বলল, সব শিল্প পশ্চিমবাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে ।

           শিল্প আবার চলে যাবে কেন, কোটি-কোটি টাকায় আজকাল বাঙালি শিল্পীদের পেইনটিং বিক্রি হচ্ছে ; যারা আর্টিস্ট নয় তাদের পেইনটিংও অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে, পশ্চিমবাংলার আর্ট জগদ্বিখ্যাত ।

           আর্টের কথা বলছে না, বলছে কলকারখানার কথা, ইনডাসট্রির কথা । আমি বললুম ।

            ইনডাসট্রিকে আর্ট মনে করা ভুল, মনে হবে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কলকারখানা বসিয়ে গেছেন ।

           তাই করলেই ভালো হতো দিদি, ড্রাইভার বলল ।

            তুই বললি, এখন তো তাই মনে হয় ; শান্তিনিকেতনে যাবার কথা ভাবি , এবার হবে না ।  রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করব ।

           রবীন্দ্রনাথ বহুকাল আগে মারা গেছেন, বললাম আমি ।

            মারা গেলেই বা, মারা গেলেই তো আর মানুষ মরে যায় না, আমি শান্তিনিকেতনে গেলে রবীন্দ্রনাথের অবশ্যই দেখা পাবো ; জোড়াসাঁকোয় গিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সবাই কে কেমন আছেন খোঁজ নেবো। দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণদেব আর স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে দেখা করব । সুভাষচন্দ্র বসু তো বাড়ি ফেরেননি, নয়তো ওনার সঙ্গেও দেখা করতুম । লোকে বোধগয়ায় যায় কেন ? গৌতমবুদ্ধের সঙ্গে কথা বলবে বলে, ওওওওউউউম মণিপদ্মে হুমমমমমম ।

           তুই ইনকরিজিবল, বললাম গলার স্বর নামিয়ে ।

           এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

           যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

            বাঁশদ্রোণী বাজারের কাছে পৌঁছে ড্রাইভার বলল, এখানে পার্কিং নেই, আপনারা যা কেনাকাটা বা দরকারি কাজ সেরে আমায় ফোন করে দেবেন, এসে যাবো, দেখি কোথায় গাড়ি পার্ক করা যায় । 

           গাড়ি থেকে নামলি, সামনেই সেই জঞ্জালের ভ্যাট বা আঁস্তাকুড়, তুই একেবারে কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিস, তোর মায়ের স্মৃতি টিকে আছে কিনা, হয়তো সেকথাই ভাবছিস, কিংবা কি করে এরকম নোংরা জায়গায় পড়ে থেকেও বেঁচে রইলি । 

             আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দূরে, যাতে তুই নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারিস, বোঝাপড়া করতে পারিস । ফোটো তুলছিস না কেন, বলেছিলিস ফোটো তুলবি, মনে করিয়ে দেব কিনা ভাবছিলাম, তখনই তুই আঁস্তাকুড়ের ভেতরে ঢুকে পচা সবজি, ছাই, মাছের আঁশপোঁটার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লি, নানা ভঙ্গীতে একের পর এক সেলফি তুলতে লাগলি, আর লোক জড়ো করে ফেললি ; আমি দৌড়োলাম তোর দিকে, পরিস্হিতি সামলাবার জন্য ।

            হাত ধরে তোকে টেনে তুলতে যাব, তুই বললি, আমি চিৎ হয়ে, পাশ ফিরে, নানা পোজে শুচ্ছি, তুমি ফোটো তুলে নাও তো । 

           তুই পোজ দিতে লাগলি, আমি ক্লিক করতে লাগলুম । হলুদ রঙের কুর্তার ওপর সবুজ ফুল, সবুজ চুড়িদার, ওড়না নেই ।

            যখন উঠে দাঁড়ালি, ঠাকুমার ঝুলি বইয়ের গাছপাতা-চরিত্র, তোর পোশাকে  ডাস্টবিনের নোংরা জঞ্জাল জেঁকে বসেছে, মাছের আঁশ ঝরছে । 

            দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে বললি, এই দ্যাখো, জঞ্জালমাতা হয়ে গেছি, বিশ্বসুন্দরী প্যাজেন্টে চললুম ।

            কোনো প্রতিযোগীতা আছে কি ম্যাডাম, আঁস্তাকুড়ে সেলফি নেবার ? জানতে চাইল এক পথচারী ।

            অনেক ভালো সেলফি উঠত, আপনার কাছে যদি সেলফি স্টিক থাকত, বলল একজন যুবতী, থলে থেকে লাউ, পালং শাকের আঁটি, সজনে ডাঁটা  বেরিয়ে রয়েছে ।

            আরেকজন জানতে চাইল, কিসের বিজ্ঞাপনের মডেলিং করছেন ম্যাম, হার্বাল প্রডাক্টের ? দেখিনি তো আগে  আপনাকে টিভিতে বা কাগজে ।

            চব্বিশ বছর আগে ওনার মা বা বাবা ওনাকে এই আঁস্তাকুড়ে ফেলে চলে গিয়েছিলেন, বললাম আমি, অগত্যা  । 

            ভিড়ের মেজাজ বোঝা বেশ কঠিন, কখন কোন দিকে মোড় নেবে বলা যায় না । তোর বাহু ধরে একটু এগিয়ে ড্রাইভারটাকে ফোনে ডাকলাম । তোকে বললাম, কি করলি কি, এখন এগুলো পালটাবি কি করে?  ইনফেকশান হয়ে যাবে ।

            হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তুই বললি, কিছুই হবে না, দেখে নিও, আমি জঞ্জালপ্রুফ, লাথিপ্রুফ, ঘেন্নাপ্রুফ, গলাধাক্কাপ্রুফ, নয়তো বাঁচতুম না, তখনই মরে যেতুম । তোমার কি মনে হয় জীবনে ধাক্কা খাইনি ? শুনলে তোমার মাথায় রক্ত উঠে যাবে ।

            একটি লোক আমাদের পেছু নিয়েছিল, বলল, স্যার, আমাদের দোকানে ওনার মাপের চুড়িদার আছে, পোশাক পালটাবার ঘরও আছে ।

            দারুণ তো, বলে লোকটার সঙ্গী হলি তুই, আমি পেছন-পেছন, ড্রাইভারকে বললাম, এক্ষুনি আসতে হবে না, একটু পরে এসো ।

            লাল রঙের কুর্তা কিনলি, তাতে কালো ডোরা লম্বালম্বি, চুড়িদারও লাল । তোকে ঘিরে থাকা ভিড়ে দশ-বারো বছরের একটা ছেলে তোর মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়েছিল, তুই তাকে নোংরা পোশাকের প্যাকেটটা দিয়ে বললি, খোকাবাবু, এটা ওই আঁস্তাকুড়ে ফেলে এসো তো ।

            ছেলেটি বলল, আমার নাম খোকাবাবু নয় ।

            তুই বললি, আচ্ছা নবীনকিশোর, ফেলে এসোতো এটা ।

            ছেলেটি : আপনি কি করে জানলেন আমার নাম নবীনকিশোর ?

            তুই : তোমার গোল মুখ দেখে ; যাদের মুখ গোল হয়, তাদের নাম সাধারণত নবীনকিশোর হয় ।

             বৃদ্ধ কেশিয়ার টাকা গুণতে-গুণতে বলল,  শুনলাম আপনাকে আঁস্তাকুড়ে পাওয়া গিয়েছিল, আমি জানি ব্যাপারটা, অষ্টম সন্তানকে ত্যাগ করার ঘটনা, হইচই হয়েছিল বেশ । শান্তনুর বাচ্চাদের গঙ্গাদেবী জলে ভাসিয়ে দিতেন, গল্প শুনেছেন তো ? শেষে অষ্টম সন্তানকে ভাসাতে গেলে শান্তনু বাধা দিয়েছিলেন, সেই অষ্টম সন্তান ছিলেন মহাভারতের ভীষ্ম ; কত কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল ওনাকে, বিয়ে করতে পারেননি, সংসার করতে পারেননি ।

              তুই আমার দিকে তাকিয়ে বললি, ভাগ্য ভালো যে জোর করে দখল করে নিয়েছি পছন্দের লোকটাকে।               গেঞ্জি কিনছিল এক প্রৌঢ়, বলল, ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টম তিথিতে মথুরার রাজপরিবারে বাসুদেব আর দেবকীর অষ্টম পুত্র হয়ে জন্মেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, জানেন কি ?

             তুই বললি, গল্পটা জানি, অষ্টম গর্ভের কথা জানতুম না, জানা ছিল না, শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে যেমন বয়সে অনেক বড়ো ছিলেন ওনার প্রেমিকা রাধা, তেমনি আমার আর আমার শ্রীকৃষ্ণের বয়সের পার্থক্য ; আমি ওনার এলেকট্রারাধা । আমার দিকে তাকিয়ে তোর উক্তি, কি ঠিক বলেছি না, ড্যাড ?

              বৃদ্ধ বলল,  আমরা শুনেছিলাম সেই বাচ্চাকে কোনো বিদেশি কোল নিয়েছে । নিচের তলায় যান, মাছের বাজারে, অনন্ত নামে একজন মাছ বিক্রি করে, ওর কুটুমের গ্রামের ঘটনা, অবশ্য অনন্ত তখন ছোটো ছিল, গ্রামের এবং পরিবারের তো হালহদিশ দিতে পারবে ।

           শুনেই তুই দৌড়োলি নিচে, মাছের বাজারে, ঢুকেই চেঁচালি, অনন্ত, অনন্ত কে, আপনাদের মধ্যে কার নাম অনন্ত ?

            আঁশবঁটিতে ধড় থেকে তিন কেজি রুইয়ের মুড়ো আলাদা করছিল, লুঙ্গি-পরা মাঝবয়সী মাছবিক্রেতা, সে বলল, আমিই অনন্ত, বলুন, কবেকার অর্ডার, যত ওজনের চাইবেন এনে দেবো, বিয়ের সিজন, দিন পাঁচেক আগে অর্ডার দিতে হবে । 

             আমাদের পেছনে যারা জড়ো হয়েছিল, তাদের একজন বলল, উনি তোমার কুটুমের গ্রামে যাবেন, তোমার কোন এক জ্ঞাতি তার অষ্টম মেয়েকে ফেলে গিয়েছিল বাজারের জঞ্জাল ফেলার জায়গায়, সেই যে কত থানা-পুলিশ কাগজ-কিচাইন হয়েছিল, তারপর যাদের বাচ্চা তারা ধরা পড়ার পর বললে যে, না, তাদের নয়, মনে নেই ? কত কচাল করেছিল লোকেরা । উনি বলছেন যে উনিই সেই বাচ্চা ।

             লুঙ্গিতে হাত পুঁছে উঠে দাঁড়াল চশমা-পরা তেলালো টেরিকাটা অনন্ত, যেন মাছেদের নিশিডাক দিয়ে জালে তুলতে চলেছে । বাকরহিত বলতে যা বোঝায় । বসল, কাৎ করে রাখল মেগাসাইজ বঁটি । বলল, আজকে হবে না দিদি, আজকে আমার ছেলে আসতে পারেনি, আপনি কালকে ভোরবেলা আসুন, ভোর-ভোর না বেরোলে  ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে আপনাদের, দিনকাল ভালো নয় জানেনই তো । গ্রামর নাম লক্ষ্মীপুর, ঈশ্বরপুরের কাছে, জীবনপুরে যাবার পথে, রাজপুর-সোনারপুর বা বারুইপুর হয়ে যেতে হবে । আজকে আপনি ক্লাবে হয়ে আসুন বরং, ওনারাই আপনাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন ।

            তুই : ঈশ্বরপুর, জীবনপুর, লক্ষ্মীপুর, বাঃ, পারফেক্ট নাম, গডলি-গডলি । ঠিক এই কথাই রইল তাহলে, কাল সকাল সাতটায় এসে যাবো, গাড়ি ভাড়া নিয়েই আসব, আমার বরের সঙ্গে ।

            অনন্ত : বিয়েও হয়ে গেছে আপনার ? বর পক্ষ ব্যাপারটা জানে ?

            তুই : ওই তো আমার সুপুরুষ বর দাঁড়িয়ে আছেন ।

            অনন্ত : বড়লোক বর পেয়েছেন দিদি, কি ভাগ্যি আপনার । গিয়ে আপনার বোনেদের দেখবেন, দু-বেলা খেতে পায় না, সবায়ের অ্যাণ্ডাগ্যাণ্ডা  ছেলে-মেয়ে ।

            তুই : বোন ? কতগুলো বোন ? জিগ্যেস করে আমার দিকে ফিরে জয়ের হাসি খেলালি ঠোঁটে ।

            অনন্ত : আপনি অষ্টম গর্ভের সন্তান তো, আপনার আগে আরো সাত বোন, সবাই হয়তো বেঁচেবর্তে নেই, কারা আছে কারা নেই বিশেষ জানি না গো, ছেলেপুলেরা থাকবে । দশ-বারো বছর হয়ে গেল ওমুখো হইনি । ছেলে হয়েছিল ওদের,  আপনার পর, শুনেছি, সেই ছেলে বিয়োতে গিয়ে আপনার মা মরে গিসলো । কি করবে বলুন, খাওয়াতে পারে না, বাচ্চা বিইয়ে চলেছে, গেল শেষে সগগে ।

             তুই : বিইয়ে চলেছে, শুনতে কতো ভালো লাগে, তাই না ? অষ্টম গর্ভ ? এইটথ চাইল্ড ! হুউউউশ ওয়ান, হুউউউশ টু, হুউউউশ থ্রি, হুউউউশ ফোর, এই করে আটবার । ঈশ্বরপুরের মেয়ে, যেতেই হবে, আপনি রেডি থাকবেন, আমরা সাতটায় পোঁছোচ্ছি। 

              বিশাল ভেটকি কেটে খদ্দেরের জন্য ফিলে বানাচ্ছিল যে, সে বলল, কিন্তু ক্লাব তো এখুন তৃণমূল নিয়ে নিয়েচে ।

              শিঙিমাগুর বিক্রেতা : আরে ঘেঁচুবাবু সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে চলে গেচেন, ফুটানিবাবুও ওনার পেচন পেচন গেচেন, ভালোবাবু তো তৃণমূলের কি একটা পুরস্কারও পেলেন, ওনার হ্যাদানে ফোটো আছে ক্লাবঘরে, দুহাতে সেই কেঠো তকতিখানা ধরে আচেন, মুচকি হাসিতে গুটকা-দেঁতো ফোকলা ঢেকে ।

              ভেটকি : তখুন তো অ্যামবুলেন্স পায়নি ওঁয়ারা, চাঁদুচৈতনের বউ রিকশায় চেপে আপনাকে কোলে করে থানায় নিয়ে গিসলো ।

              রুই : চাঁদুচৈতনকে পাবো কি ক্লাবঘরে ?

             শিঙি : না ওনারা দুজনেই গত হয়েছেন ।

              তুই : ক্লাবটা কোথায় ?

             কুচোমাছ বিক্রেতা : অ্যাই বদনা মাছ বাচা বন্ধ রেখে এনাদের নিয়ে যা তো ক্লাবঘরে, ক্যারাম খেলছে বোধহয় ঘেঁচুবাবুর ছেলেরা । তোকে মাছ ছাড়াবার ভরতুকি দিয়ে দেবেন দিদি ।

             তুই : কত দূরে ?

             কুচো : ওই তো রাস্তায় বেরিয়ে দু’পা হাঁটলেই বাঁদিকে ।

             তুই : এটা কি মাছ ?

              অনন্ত : ফলুই ।

             তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, কত্তো রকমের মাছ, কত টাটকা, পাবদা, পারসে, খয়রা, বাটা, গুড়জাওলি, কাজরি, আহা, মনে হচ্ছে কাঁচাই খেয়ে নিই । বাসি মাছ খেয়ে বোর হয়ে গেছি । যে মাছে কাঁটা থাকে না, সে মাছে বোধহয় স্বাদ হয় না ; কাঁটাহীন ইলিশ কি ভাবা যায় ?

             অনন্ত : যা বলেছেন, এদেশে একবার আসে হেঁটে কাঁটার দল, তারা গিয়ে আসে ওপরে কাঁটার দল ।

             তুই : মানে ?

             অনন্ত : মানে ওই ওপরে কাঁটা হেঁটে কাঁটা, এদেশে থাকলে টের পেতেন ।

             নবীনকিশোর ছুটতে ছুটতে এসে জানাল, ক্লাবঘর বন্ধ, তালা দেয়া, ঘেঁচুকাকু আর ফুটানিকাকু দুজনেই কলেজ ইউনিয়ানের নির্বাচন সামলাতে গেছেন ।

             তুই : ধ্যুৎ, এই বয়সে কলেজে পড়েন নাকি তাঁরা ?

             নবীনকিশোর : দিদি, ঘেঁচুকাকু-ফুটানিকাকুকে বাদ দিয়ে এই এলাকায় কোনো ছাত্রের ইয়ে ঝরে না আর কোনো ছাত্রির উয়ো পড়ে না ।

            অনন্তর দিকে তাকিয়ে বললি, সেই কথাই রইল, কাল সকাল সাতটা । 

             আমার দিকে তাকিয়ে বললি, ইয়ে ঝরার পর কিন্তু উয়ো পড়া বন্ধ হয়ে যায় ; ড্যাড, অবসিনিটি ব্যাপারটা জেনারেশান গ্যাপের সঠিক মেজারমেন্ট করে ।

            আমাদের বয়সের পার্থক্যকে টিটকিরি মারলি কিনা বুঝতে পারলাম না, বললাম, জানি, ওসব কুকথা শুনে-শুনেই এখান-ওখানের চুল পাকিয়েছি ।

             তুই কাপড়ের দোকানটায় গিয়ে আবার ঢুকলি, বললি, শুনলুম আমার সাত বোন আছে, তাদের ছেলেপুলে আছে, কতজন তা তো জানি না, আপনি গ্রামে পরা যায় এমন কুড়িটা শাড়ি প্যাক করে দিন, আর আমার মাপের যেকোনো রঙের ব্লাউজ দিন, গ্রামে পরা যায় এমন ।

             দেখলিও না ব্লাউজ আর শাড়িগুলো, দাম যা চাইল মিটিয়ে দিলি । আমি দিতে পারতাম, কিন্তু তোর তো মুখের আগল নেই, বেফাঁস কি বলে ফেলবি, পকেটে হাত ঢুকিয়েও বের করে নিলাম ।

             বাজার থেকে বেরিয়ে দেখলাম আঁস্তাকুড় ঘিরে ভিড় ; একজন করে তার ভেতর ঢুকে জঞ্জালের ওপর শুয়ে সেলফি তুলছে, আরেকজন দ্রুত ঢুকতে চাইছে, বেশ ঠেলাঠেলি, বুম হাতে একজন সাংবাদিকা আর কাঁধে ক্যামেরা তার আধাযুবক সঙ্গী । জঞ্জালের ওপর শুয়ে যে প্রৌঢ়া সেলফি নিচ্ছে, তাকে জিগ্যেস করল, কেমন লাগছে আপনার ?

             সে বলল, ওঃ অসাধারণ অভিজ্ঞতা, কি যে ভালো লাগল, দারুণ দারুণ !

             তোর বাহু ধরে ছুটলাম গাড়ির দিকে ।

            মায়ের ঘরেই শুয়েছিলি তুই, আমাকেও টেনে নিয়ে গিয়েছিলি, দুজনের বেশি আঁটে ওই খাটে, বলেছিলি। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়েছিলি ভোর পাঁচটার, উঠতে যাবো, বললি, অ্যালার্মটা মরনিং গ্লোরির জন্য, বিছানা থেকে বেরোবার জন্য নয়, ভোরের স্পার্ম অব্যর্থ, ঠিক পথ কেটে পোঁছে যায় গন্তব্যে । 

              তোর নির্দেশ  অনুযায়ী গন্তব্যে পাঠিয়ে উঠে পড়লাম, মিনিট তিরিশেক জিমে কার্ডিও না করলে শরীর বেশ ঢিলেঢালা ঠ্যাকে ।

            বেরোবার সময় দেখলাম তুই তোর ব্যাগে একশো টাকার বেশ কয়েকটা প্যাকেট ঢোকালি ; আমিও নিয়েছি, সঙ্গে, যদি দরকার পড়ে । শাড়িগুলো নিয়েছিস প্লাসটিকের প্যাকেটে ।

            তুই পারফিউম লাগাসনি, লিপ্সটিক বোলাসনি ঠোঁটে, নখপালিশ তুলে ফেলেছিস, হাফহাতা সবুজ ব্লাউজ পরেছিস, তার সঙ্গে মানায় না এমন  খয়েরি সিনথেটিক শাড়ি । পায়ে ফ্ল্যাপার । কিন্তু একবার আধুনিকতা যদি আঁকড়ে ধরে, যতই পোশাক-আশাক পালটাও, ছাড়াতে পারবে না ।

           সকালে বাজারের সামনে অনন্ত ধুতি পাঞ্জাবিতে, টেরিকাটা তেলালো চুল, হাতে থলে, সম্ভবত আত্মীয়ের জন্য উপহার নিয়ে যাচ্ছে । 

           ভাজা হচ্ছে দেখে, তুই চেঁচিয়ে উঠলি, জিলাপি জিলাপি জিলাপি জিলাপি ।

           এক চ্যাঁচারি জিলিপি আর রাধাবল্লভি-আলুর দম কিনলাম । তোর বোনেদের জন্য সন্দেশ আর রসগোল্লার হাঁড়ি ।

           অনন্ত ড্রাইভারকে বলল, দুধানি, সাহেবপুর, বোদরা, হয়ে চলুন, বারুইপুর থেকে টার্ন নেবেন, নেত্রা পর্যন্ত ভালো বাঁধানো রাস্তা ছিল, এখন কেমন বলতে পারব না ; জানেন তো রাস্তটা ? 

            ড্রাইভার ঘাড় নাড়ল, যারা ভাড়া নিয়েছে তাদের বদলে একজন সামান্য লোক হুকুম দিল বলে ওর মুখের অস্বস্তি তুই দেখলি আয়নায়, সামলাবার জন্য আমাকে জিগ্যেস করলি, তুমি জানো ?

           বললাম, না, এদিকে কখনও আসিনি, সুন্দরবনে যাবার পরিকল্পনা একবার করেছিলাম, সঙ্গী পেলাম না।

            মুখে জিলিপি নিয়ে বললি, এবার তো সঙ্গিনী রয়েছে, চলো না ঘুরে আসি, দারুণ হবে, টাইগ্রেস অ্যাণ্ড দি টাইগার ইন টাইগারল্যাণ্ড, ঘ্র্যাঁআওওওও ।

            যে কয়দিন ছুটি, তার ভেতরেই সেরে ফেলতে হবে তোর মিশন ; প্রথম মিশন সফল, সেলফি তুলে নিয়েছিস, জেনেও ফেলে থাকবে তোর বন্ধুবান্ধব, নেট থেকে ।

            গ্রামে আমার আত্মীয়স্বজন কারা আছে দেখি, তাদের ফোটো আপলোড করা যাবে কিনা গিয়ে দেখা করলে টের পাবো , গ্রামের ফোটো তুলে নেব।

            গাড়ি বারুইপুর ছাড়ার পর মেঠো সবুজ বাতাসে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল । তুই ঠেলে তুললি, বললি, দ্যাখো-দ্যাখো ধানখেত, খেজুর গাছ, কতো গাছের সারি রাস্তার দুপাশে, আমার মাতৃভূমি । এটা কি গাড়ি, অন্য কোথাও দেখিনি তো, গাদাগাদি মানুষ ?

            মোটরসাইকেলভ্যান, ভটভটিরিকশা ।

            ড্রাইভার মনে রেখেছে তোর কালকের কথোপকথন, পেছন ফিরে হাসল, সমবেদনার মুচকি  ।

           পাখি দেখে চেঁচিয়ে উঠলি, মাছরাঙা, মাছরাঙা ।

          অনন্ত বলল, দিদি ওটা নীলকন্ঠ পাখি ।

          বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবাক করে দিয়ে আরম্ভ করলি, তোর চরিত্রের এই দিকের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না, এত বেশি কনভেন্টি অক্সব্রিজ ইংরেজি দিয়ে আমার বাংলা-টানের ইংরেজিকে আঘাত করছিলি এসে পর্যন্ত, জানতে পারিনি যে আঁস্তাকুড়ে পড়ে থাকার স্মৃতি তোকে এভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে, শুনতে-শুনতে কাঁটা দিতে লাগল গায়ে :

          আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে– এই বাংলায়

          হয়তো মানুষ নয়– হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;

          হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

          কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায় ;

          হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,

          সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে ;

          আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবাসে

          জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায় ;

          হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে ;

          হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে ; 

          হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;

          রূপসার ঘোলাজলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে

          ডিঙা বায় ; — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে

         দেখিবে ধবল বক : আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে– 

          ড্রাইভারই প্রথম মন্তব্য করল, দেখছেন তো আপনিও মানুষ হয়ে আসতে চাইছেন না, শালিক, কাক, হাঁস, লক্ষ্মীপেঁচা, বক হয়ে আসতে চাইছেন, কেউই আর মানুষ হয়ে জন্মাতে চায় না এই পোড়া দেশে ।

         অনন্ত বলল, আপনার গলাটা বেশ মিঠে, শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গিসলুম, ঠিকই বলেছেন আপনি, কেউই আর মানুষ জন্ম চাইছে না , আমি মাছ হয়েও জন্মাতে চাই না, শেষে এই পাপীদের পেটের খিদে মেটাতে হবে, তারচেয়ে মাছরাঙা হব, পানকৌড়ি হব, শকুন হতেও রাজি আছি ।

         তুই বললি, কবিতাটা আমার নয় ।

         আমি জানতে চাইলাম, কার ?

         তুই বললি, বইগুলো তো তুমিই পাঠিয়েছিলে, ভুলে গেলে কি করে ।

         বললাম, আমার এক জুনিয়ার অফিসার, কলকাতায় বাড়ি, তাকে বলেছিলাম, বাংলা সেলেকটেড বইয়ের অর্ডার দিয়ে দিতে, যাতে তোর নামে ওরা জগদীশের গুড়গাঁয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দ্যায় । এরকম যে কবিতা হয় জানতাম না, স্কুলের পর তো আর পড়া হয়নি কবিতা । কার লেখা ?

         তুই বললি, খুঁজো ।

         

         এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

         যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

         পথের বোর্ড দেখে বুঝলাম আমরা ঈশ্বরপুরের  কাছাকাছি এসে পড়েছি । অনন্ত বলল, এবার নাবুন, লক্ষ্মীপুর যেতে কিছুটা কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে হবে । 

         গাড়ি আসছে দেখে দূর থেকে গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা ছুটে এইদিকেই আসছিল ।

         অনন্ত তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, মানিক সর্দারের বাড়িটা কোন দিকে রে, নিয়ে চল তো আমাদের।

         মানিকবুড়ো তো কবেই মরে গেচে, বলল একটি কিশোরী, বেশ কয়েকদিন স্নান করেনি বোধহয়, চুল শুকনো, বাসি বিনুনি, বয়সের চেয়ে বড়ো মাপের ফ্রক ।

         তা জানি, অনন্ত বলল, বাড়ি তো আছে, বাড়ির লোকজন তো আছে ?

         তুই আমার দিকে তাকিয়ে বললি, সি, আই নিউ আই অ্যাম এ সরদারনি । দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলি, জো বোলে সো নিহাল, সত শ্রী অকাল ।

         কয়েকজন বাচ্চা তোর দেখাদেখি দুহাত তুলে চেঁচালো, অকাল অকাল অকাল অকাল, কি মজা, অকাল অকাল, চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়োলো খড়ের চাল দেয়া  কুঁড়েঘরগুলোর দিকে । 

       এরা না চেঁচানো পর্যন্ত মনে হচ্ছিল গ্রামটা মৌনতায় ঝিমিয়ে , দুঃখি-দুঃখি, চুপচাপ শোক পালন করছে ।

        কাপড়ের থলেটা আমার হাতে ধরিয়ে বাচ্চাদের ফোটো তুললি, আমাকে বললি, এদের সঙ্গে কয়েকটা গ্রুপ ফোটো তুলে দাও তো । দিলুম । তুই দুই কিশোরীকে জড়িয়ে উবু হয়ে পথের ওপর । একটি কিশোরী কেঁদে ফেলল, তুই তাকে জড়িয়ে ধরিসনি বলে ; সবাইকে জড়িয়ে সাতটা ফোটো তোলালি । জিলিপি আর রাধাবল্লভির চ্যাঁচারিটা একটি কিশোরীর হাতে দিয়ে বললি, তোমাদের জন্য ।

         আমার দিকে তাকিয়ে বললি, জড়িয়ে পাঁজরের হাড় ঠেকলো, এই পশ্চিমবাংলা দেখতে পাইনি, বাইরে-বাইরে সবুজ দেখছি তখন থেকে, গুড়গাঁওয়ের ময়লাকুড়ুনিয়াদের হাড়পাঁজর দেখি না তো  । এত এত সবুজ অথচ হাড়পাঁজুরে ছেলেমেয়ে ! ম্যালনিউট্রিশান, দেখেই বুঝতে পারছি ।

         বললুম, আঁস্তাকুড়ে সেলফি তুললি আর এখন দারিদ্র দেখতে পাচ্ছিস গ্রামে এসে ?

         তুই বললি, জানি জানি, গরিবের মাংস খেয়ে লোকে ধনী হয়, ধনীর মাংস যদি খেতে না পায় তাহলে গরিব কি করেই বা স্বাস্হ্যবান হবে ! এসে পর্যন্ত যা দেখছি, খাওয়া যেতে পারে এমন ধনী চোখে পড়ল না ।

        অনন্ত বলল, আচে আচে দিদি, তেনারা সব নেতা, গরিব সেজে থাকেন, গরিবেরই মাংস হাপুস-হুপুস করে খান, খেয়ে পিচ করে রক্তের পিক ফ্যালেন ।

        মানিক সর্দারের বাড়ি, খড়ের চালা, বাঁশের বেড়া ভেঙে পড়েছে, একটা খুঁটিতে বাদামি রঙের শিড়িঙে গাইগোরু, পৌঢ়া বেরিয়ে এলেন ডাক শুনে, তোমরা কারা, কাকে খুঁজচ ? কন্ঠস্বর বুড়িদিদিমার মতন, যেন জীবন আর মৃত্যু সম্পর্কে  জানার কিছু বাকি নেই, চোখে বিষন্ন দৃষ্টির অপ্রতিরোধ্য টান, ছানির আড়ালে ।

        অনন্ত বলল, তোমায় তো চিনতে পারলুম না, আমি প্রমথ মাঝির নাতজামাই, অনন্ত ।

        ইনি যে তোর বোন, সন্দেহ নেই, প্রায় তোর মতোই দেখতে, ঢ্যাঙাও তোর মতন , দাঁড়াবার ধরণে যৎকিঞ্চিত টিকে আছে যৌবনকালের মহনীয়তা ।

       নাতজামাই ? অনন্ত ? না গো, মনে পড়তেছে না । প্রমথ নেই, মারা গেচে, দ্যাকো কারা আচেন ওনার বাড়ি, আর তো কোতাও যেতে পারিনে, ভালোও লাগে না ।

       ভবিষ্যতকে অবিশ্বাস করার বয়সে প্রৌঢ়া, যখন জীবন বললে অতীতের কালো গহ্বর বোঝায়, যাদের চাই না, অতীত থেকে তাদের ঝেড়ে ফেলে দিতেও অনিচ্ছা ; এখন আর অতীত থেকে খুঁটে-খুঁটে আহ্লাদের স্মৃতিগুলো তুলে নেবার অবসর নেই ।

       তুমি মানিক সর্দারের কে হও ?

        আমি ? আমি বিন্তি, আমিই আচি শুদু । বাবা তো সব জমিজমা বেচেবুচে বিয়ে দিলে আমার বোনগুনোর, এখন এই এগারো কাটা জমিই বেঁচেচে আর পুকুরটা, এতেই যা হয়, চলে যায় । আমি বাবার বড় মেয়ে, এই যে দুহাতে বাবার ছেঁকা দেয়া বিড়ির দাগ; সব কান্নাই তো আর দ্যাকা যায় না, শোনা যায় না । দাগ দেকে ভেবোনি যে রক্ত শুকিয়ে গেচে । ছেলে তো হয়ে বাঁচেনে, ছেলে-ছেলে করে মাটাকে মেরে ফেললে । 

      ভাবলাম, বিড়ির ছেঁকায় রয়ে গেছে অতীত ; দাগগুলোকে গোপনে ভালোবাসেন বলেই তো মনে হল । আহত বোধ করাও মানুষের অধিকার বৈকি ।    

       তুই জিগ্যেস করলি, বোনেদের কোথায় বিয়ে হয়েছে ? কারোর সঙ্গে দেখা করা যাবে কি ?

        না গো, দুই বোন রিমি আর ঝিমি পাকা সড়কের ওই পারের গাঁয়ে ছেল, এখন সব গ্রামছাড়া, পার্টি করত তো ওদের বরেরা, ওরাও তাতে পোঁ ধরত । ফেলি, কুমু আর চিনুর  বীরভূম-মালদায় বিয়ে হয়েছে, খবরাখবর নেয় না, কোতায় ওদের শশুরবাড়ি, তাও জানিনে । দাঁড়াও তোমাদের বসার মাদুর আনি, আমি বেশিক্ষুণ দাঁড়িয়ে কতা বলতে পারিনে ।

        গ্রাম ছাড়া ? গ্রামও ছেড়ে চলে যেতে হয় নাকি, পার্টি করলে ; পাঞ্জাবের ডিভিশানের সময়ে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিল আণ্টিমায়ের আত্মীয়রা, এখানে এখনও সেই ডিভিশান চলছে ?

        বললাম, ঠিক ধরেছিস, ওই সোয়াইনফ্লুটাই ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবাংলার গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় ।

        মেঘেদের গায়ে খোসপাঁচড়ার দাগ, শূন্যতা চলেফিরে বেড়ায়, অপূরণীয় গহ্বরে একফোঁটা জলের বীজ ।

        জোঁকেদের তুলতুলে ব্যক্তিত্ব, হাওয়ায় মানুষের খোসা উড়ছে ।

        যে মরে যাচ্ছে তার সঙ্গে কথা বলতে শেখানো হয়নি কোনো স্কুলে কলেজে ।

        তলিয়ে যাবার মাধুর্য, সৌষ্ঠব, সদগুণ, কৃপা, প্রসন্নতা, করুণা ।

        গোবর নিকোনো মাটির দাওয়ায় বসে তুই বললি, মাদুরের চেয়ে মাটিতে বসে বেশি আনন্দ । মামারবাড়ি পানিপতে ছোটোবেলায় গিয়েছিলুম একবার, এরকমই দাওয়া ছিল । 

      কি বলতে কি বলে ফেলবি, তোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলতে হল, ডোন্ট টক অ্যাবাউট দোজ থিংস, দিস ইজ ইয়র ফাদার্স হাউস ।

        তুমি কে গা ? তোমাদের তো চিনতে পারচিনে । প্রৌঢ়ার শাদা শাড়ি অতিব্যবহারে ময়লা, মুখও দারিদ্র্যের অন্তর্ঘাতে  বয়সের তুলনায় কুড়ি বছর বেশি বলেই মনে হল ।

        তোমার সবচেয়ে ছোটো বোন কোথায় আছ জানো ?

        বাবা তো কলকাতা যাবার সবজির গাড়িতে চেপে তাকে ফেলে দিয়ে এস্ছিল কলকাতার বাজারের আঁস্তাকুড়ে । থানা-পুলিশ হয়েছেল, বাবা বললে, না, বাচ্চাটা আমাদের বাড়ির নয় । জানিনে সে মরে গেল না বেঁচেবর্তে আচে কোতাও ।

        তুই ফোঁপাতে আরম্ভ করে সামলে নিলি। 

       তোর মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ক্লাস টেনের ইনটারভিউতে তুই সিসটার অ্যানিকে বলেছিলি টি এস এলিয়টের কবিতা ভালো লাগে।  আশ্চর্য, হঠাৎ মনে পড়ে গেল সিলভিয়া প্লাথের নাম আর তাঁর ড্যাডি কবিতাটা, তুই আবৃত্তি করছিলি ;  তখন তোর  কন্ঠস্বরে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম বলে মনে পড়েনি, এখন তোর ক্ষণিক ফোঁপানির জন্য মনে পড়ে গেল । 

       তোর কাঁধে হাত রেখে বললুম, খুঁজে পেয়ে গেছি, সিলভিয়া প্লাথের ড্যাডি।

        জানতুম ড্যাড, পাবে, বাংলা কবিতার কবির নাম এখন খোঁজো, তুই চোখের মৃদু হাসি খেলিয়ে বললি।

       মানিক সরদারের বড় মেয়ে জিগ্যেস করলে, আপনি ওনার বাবা?

       তুই বললি, না, উনি আমার ড্যাড, মানে বর। আর আপনি আমার দিদি, আমাকেই আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছিল আপনার বাবা।

       পৌঢ়া স্তম্ভিত। ঠোঁটের ওপর বেশ কয়েকবার জিভ বুলিয়ে বললে, আপনি আমার বোন? তুমি আমার ছোটো বোন? সবচেয়ে ছোটো বোন ? বাবা ভেবেছেল তুমি ছেলে হবে, যখন মেয়ে হয়ে জন্মালে তখন অষ্টম গর্ভের দোহাই দিয়ে, মাকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে, ফেলে এলো কলকাতার আঁস্তাকুড়ে, গোলোকধাঁধায়।

       প্রৌঢ়াকে তুই জড়িয়ে ধরতে, উনি কাঁদতে লাগলেন, বলতে আরম্ভ করলেন, আমাদের সবকটা বোনকে ফেলে আসতে পারত কলকাতার জঞ্জালে, কলকাতায় তো ভাগাড়ের অভাব নেই, তাহলে আমরা কেউই এই দুঃখের দিন দেখতুম না, বোনরা সোয়ামি পুত্তুর নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত না। বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়ের জীবনকে তালগোল পাকিয়ে অগোছাল করে ফ্যালে, এর কোনো নিদান নেই গো, কাচের বাসনের মতন ভেঙে এমন টুকরো করে দ্যায় যে জুড়লেও ফাটলের দাগ রয়ে যায়, জল খেতে গেলে চুয়ে পড়ে, খাবার খেতে বসলে হাত কেটে যায়। 

         তুই বললি, তবুও তো বাবা-মাকে ভালো না বেসে পারা যায় না।

         যা মনে রাখার প্রয়োজন নেই, তাকেই কেন মনে রাখা? হয়ত মনে রাখার আনন্দের দুর্ভোগ রসিয়ে উপভোগ করতে ভালো লাগে, অতীতের সেই মুহূর্তগুলো বর্তমান হয়ে টিকে থাকে, অতীত হয় না, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায় । অন্যের স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে চায় মানুষ, ভুগতে চায় স্মৃতির যাতনার টিমটিমে আনন্দে, অদ্ভুত।

       স্পর্শের মর্মার্থ, মর্মার্থের রসায়ন, রসায়নের সম্পর্কে, রেণু, পরাগ, উড়াল, জীবন।

       চাউনির কোলাহল, উতরোল শ্বাস।

       মনে রাখার মন। ভুলে যেতেও তো মন। স্মৃতি কোথায় থাকে ? কোন রঙে? রক্তের লাল রঙে?

       খসে পড়ে হলুদ পাতারা, খসে পড়ে পাকা হিমসাগর, ঝড়ে খসে পড়ে কচি-কচি আম। 

       গাছের স্মৃতিতে কে থেকে যায় ? দূরের ওই ফলবণিক ? দূরের ওই কাঠুরে ? 

       কাঁদবেন না, তুই বললি, আপনার এক বোনকে তো দেখতে পেলেন যে সে ভালো আছে ।

       সে ভালো আচে ; বাপের ফাটা থালায় খেয়ে সে রক্ত ঝরায়নে । যাঁরা তোমায় মানুষ করেচেন, নিশ্চই খুব ভালোবাসেন তোমায়, দেখেই বুঝতে পারচি ; বরও তো ভালো পেয়েচ । তা তোমার নাম তো বললে না ?

       আমার নামটা একটু অন্যরকম ; আমার নাম এলেকট্রা ।

       বেশ ভালো নাম রেকেচেন যাঁরা তোমায় পোষ্য করেচেন, বড় করেচেন । আমাদের ক্ষয়ে ন্যাতাজোবড়া হয়ে যাওয়া একঘেয়ে নামের চেয়ে অনেক ভালো ।

       প্লাসটিকের থলেটা এগিয়ে দিয়ে তুই বললি, আমার বোনেদের জন্য শাড়ি এনেছিলুম, আপনি নেবেন যেগুলো আপনার পছন্দ, যদি অন্য বোনেরা কখনও আসেন, আমার কথা বলবেন, তাঁদের দেবেন । আর কিছু মিষ্টি, খাবেন যখন ইচ্ছা হবে ।

      প্রৌঢ়া বললে, একটা চিরুনি আনতে পারতে গা, কতকাল যে চুল আঁচড়াইনে । 

       শুনে, তুই হেয়ার ব্রাশ বের করে দিতে গেলি, তোর দিদির প্রতিক্রিয়ায় অপ্রস্তুত হলি, বললি, দিন আমি আঁচড়ে দিচ্ছি আপনার চুল । 

      তোর ইশারায় ফোটো তুলে নিলাম, দিদির চুল বেঁধে দিচ্ছিস ।

      আপনার ঘরের ভেতরটা তো দেখা হল না, চলুন না দেখি, কোথায় থাকতেন আপনার বাবা-মা ।

      চলো । তুই প্রৌঢ়ার হাত ধরে সাহায্য করলি উঠে দাঁড়াতে, আমার দিকে মুখ করে বললি, আই অ্যাম গিভিং হার এ লিটল মানি টু ক্যারি অন ফর সাম টাইম । 

      কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকলি, ঝোপের আড়ালে গিয়ে হিসি করে এসে বসে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ । 

      অনন্তর পাত্তা নেই । 

      আমার বাবা-মায়ের অনুপস্হিতি মাঝে-মাঝে আমায় নিঃসঙ্গ করে, অথচ জীবনে একটা এমন সময় এসেছে যখন নিজের অজান্তে বাবা-মাকে ছলনা করেছি, সেই স্বরূপের সঙ্গে পরিচয়ে অবাক আর পরাজিত লাগে, নিজেকে বিশ্বাসঘাতক মনে হয়, তাঁদের কাছে আমি যেন আগন্তুক ।

     ছোটো চুবড়ি করে পানিফল নিয়ে এলেন প্রৌঢ়া, বললেন, তোমাদের খাওয়াবার মতন কিচুই নেই গো, এইগুলো খাও পেট ভরে যাবে, অতটা রাস্তা, সন্ধে হয়ে যাবে, খিদে পেয়ে যাবে ।

     প্রৌঢ়ার পেছনে তুই, শাড়ি-ব্লাউজ, দেখেই বুঝলুম, খুলে দিয়ে দিয়েছিস, এই পরিকল্পনা করেই এসেছিলিস তাহলে, ব্যাগের ভেতরে একটা নীল টপ নিয়ে আর শাড়ির তলায় ডেনিম জিনস পরে ।

      শায়া নেই, কি করব, শাড়ির তলায় এটাই পরে এসেছিলুম, বললি । তারপর যোগ করলি, দেয়ার ইজ নো টয়লেট, শি অ্যালাউড মি টু ইউজ দি কর্নার অফ এ রুম শি ইউজেস ডিউরিং নাইট ।

      প্রৌঢ়াকে জিগ্যেস করলি, আঁতুড়ঘরটা কোথায়, যেখানে আমি জন্মেছিলুম ?

      সেসব আর কিচুই নেই গো, যেটুকু ছিল তাও আয়লার ঝড়ে খেয়ে ফেলেচে, ওই দেকচ মাটির ঢিবি, ওইটে ছিল আঁতুড়ঘরের দক্ষিণদিকের দেয়াল, ওই ঘরে আমার মা মারা গেসলো, তোমার পরের বাচ্চাটা বিয়োবার সময়ে ; উচিত শিক্ষে পেয়েছিল বাবা, ছেলে হয়েছিল, মরা, মাও মরে গেল তার সঙ্গে, সেই বাচ্চাটা মাকে নিতেই এস্ছিল । তারপর বাবা ভেউভেউ করে কাঁদত আর মদ খেতো, ধেনো মদে ঝাঁঝরা হয়ে মরল দশাসই লোকটা, অ্যাগবারে দড়িদঙ্কা ।

      তুই বললি, দিদির সঙ্গে আর এই বাড়ির ব্যাকগ্রাউণ্ডে কয়েকটা ফোটো তুলে দাও তো, ধুলোয় মেশা আঁতুড়ঘরেরও, তুলে দিলাম । 

      স্মার্টফোন হাতে নিয়ে বললি, নাঃ, এখানে টাওয়ার নেই, এক্ষুনি আপলোড করা যাবে না । 

       ভারচুয়াল জগতের মাধ্যমে তুই আত্মীয়তা গড়তে চাইছিস, দেখাতে চাইছিস যে তোরও শেকড় রয়েছে পশ্চিমবাংলার মাটিতে । কখনও কি ভেবে দেখেছিস, যারা চোদ্দোপুরুষের শেকড় বেয়ে ডালে-ডালে দোল খাচ্ছে, অসময়ে খসে পড়ছে, তাদের কোনো পরোয়া নেই ।

      তোর দিদি তোর হাতে গুঁজে দিলে রুপোর টাকা, বললে এটা আমার জন্মের সময়ে মুখদেখানি দিয়েছেল আমার বাপের বাপ গৌরহরি সরদার, কাকেই বা দেব যত্ন করে রাখতে, তোমায় দিলুম । তুই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলি, জাঠদের মতন হাঁটু ছুঁয়ে নয়।

      হাতের তালুতে রাখা টাকাটা দেখালি আমায়, ভিক্টোরিয়ার মুখ । চেঁচিয়ে উঠলি, দু হাত উঁচু করে, ইইইইএএএএ, তোর দিদির মুখে হাসি ফুটল, আমরা আসার পর প্রথম।

      খিদে পেলে আমরা পথে কোথাও খেয়ে নেব, অনন্তর কন্ঠস্বর শোনা গেল।

      পেলে কাউকে?

      শালার ছেলেবউরা ছিল, তারা তো আমায় প্রথম দেখল। কলকাতায় প্রায়ই সবজি নিয়ে যায়, মাছের ব্যবসা আর করে না, মাছ নিয়ে বড্ড দলাদলি ইদিকে । বলেছি এবার এলে আমার বাসায় আসতে। ওদের অবস্হাও বিশেষ ভালো নয়, কে যে কোথায় সুখে আছে তা-ই তো বুঝিনে।

      পানিফলগুলো তুই তোর কাঁধের ব্যাগে পুরে নিলি। আরেকবার প্রণাম করলি তোর দিদিকে। তোর দিদি আরেকবার তোকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল, তোরা দুজনেই জানিস আর কখনও দেখা হবে না। না হওয়াই ভালো, তুই গাড়িতে বসে বলেছিলি, এই স্মৃতি অনেক দামি, একে নষ্ট করতে দিতে চাস না, স্মৃতিকে গন্ধের মতন ছড়িয়ে দিতে চাস।

      জোনাকিরা চলে গেছে ফিনফিনে এনডোসালফিনে ।

      সন্ধ্যাকে আলোময় করে তুলছে অন্ধকারের ধুলোট সোঁদা অভিপ্রায়।

       গাড়িতে সকলেই বহুক্ষণ চুপচাপ, অনন্ত বলল, মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল কুটুমের বাড়ি এসে, আপনাদের মনও তো ভার হয়ে রয়েছে, দিদি, আপনি একটা গান ধরুন না, যাতে পথটা কেটে যায়।

      গান? তুই বোধহয় অন্য চিন্তায় ছিলি, দিদির কি হবে, অন্য বোনেদের সঙ্গে দেখা হল না, এইসবই ভেবে চলেছিস হয়তো । 

          গুনগুন করে, মনের ভেতরে গেয়ে নিয়ে, আরম্ভ করলি, আমার দিকে তাকিয়ে বললি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, আই অ্যাম সিংগিং ফর ইউ, সাতরঙা ফ্ল্যাপার খুলে খালি পায়ে আমার জুতোর ওপর পা রেখে, হাতের কবজি ধরে তালের সঙ্গে চাপ দিয়ে, ইশারা করতে লাগলি:

          তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।

          মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই ।।

          সে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা। 

          সে যে নাগাল পেলে পালায় ফেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা ।

          আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই–

          আমি আপন মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই ।।

          তোরা পাবার জিনিস হাতে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে–

          যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে।

          আমার যা ছিল তার গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে–

          আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস বুঝি মরি তারি শোকে?

          আমি আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই।

          আমি আপন মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই…

         অনন্ত নেমে গেল গড়িয়ায়, বলল, মাছের দরকার হলে বলবেন, আবার এলে, ওই বাজারেই দেখা হবে দিদি ।

         হোটেলের লিফ্টের ভেতরে তুই আর আমি একা, লিফ্টম্যান নেই, চুমু খেলুম তোকে, বললুম, এই গান আগেও অনেকবার শুনেছি, কিন্তু গানটায় তোর মতন কেউ সেনশুয়ালিটি আনতে পারেননি ; রবীন্দ্রনাথও নিশ্চয়ই আঁচ করেননি যে এই গানে যৌনতার সঞ্চার করা যেতে পারে ; ইউ আর ইনক্রেডিবল ।

        যাবার ছিল সেকেন্ড ফ্লোর, ডান হাতে আমার কোমর জড়িয়ে, বাঁহাতে তুই টপ ফ্লোরের বোতাম টিপে বললি, ওউ- ওউ-ওউ-ওউ, ড্যাড, থ্যাংকস, লিফ্টে সিসিটিভির ক্যামেরা আছে । ইইইইইইএএএএএ ।

       

        এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

        যেন এমন, যেমন অমন, যেন তেমন নয় ।

চার

        

ইলেকট্রিক ? ঠিক শুনেছিস ? এলেকট্রা বলেছেন বোধহয় ।

        হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, এলেকট্রা নামই বললেন , কিন্তু ইনি আগের ম্যাডাম নন , চাপরাশি নানকু প্রসাদ জানাল, ওর অনুসন্ধিৎসা স্বপ্রকাশ।

        কিন্তু নেতি, মহাকাব্যের এলেকট্রা, তো চলে গেছে,  মেসেজ করেছিল, ফ্র্যাংকফুর্টের পথে, ওখানে ফ্লাইট চেঞ্জ করে আমেরিকার প্লেন ধরবে । আমি তখন অফিসে, সকালেও জানতে দেয়নি যে সেইদিনকেই ও চলে যাচ্ছে, যেমন উদয় হয়েছিল হঠাৎ, তেমনই উধাও হয়ে গেল ।

       আমি মেসেজ করেছিলুম, পৌঁছে জানাস, দেখাল পেনডিং , আজ সকালে এলো ডেলিভার্ড । 

       ওর মেসেজ পেলাম, খুঁজো আমাকে ; তোমার জন্য ব্যবস্হা করে এসেছি ।

       ব্যবস্হা ? তুই তো রাতে চাইতিস ব্রাউন স্ট্যালিয়ন আর ভোর বেলা মরনিং গ্লোরি । 

       আমি বলেছিলাম, তুই এভাবে আমার জীবনে ঢুকে সব নয়ছয় করে দিলি, সিম্পল লাইফ লিড করছিলুম, রুটিন, সেক্সের আর্জ বলতে গেলে, তেমন হতই না, অফিসে কাজ, বাড়িতেও কাজ এনে সকাল-রাত ফাইল ক্লিয়ার করতাম, ড্রিংক করতাম, বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি নিউজ চ্যানেল দেখতাম, চারটে নিউজপেপারে চোখ বোলাতাম, চলছিল এইভাবে; চাকরিতে যোগ দেবার পর যেখানেই পোস্টিং হয়েছে, পোর্ট ব্লেয়ার,  সিলভাসা, দমন, পুডুচেরি, লাক্ষাদীপের কারাভাত্তি আর এখন দিল্লিতে, রুটিন, রুটিন, রুটিন, রুটিন, সকাল-অফিস-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত । 

         এজিএমইউ ক্যাডারের, তাই অমন পোস্টিং, ভালোই তো ছিলাম ।

          তোর তো বেবি চাই, আমাকে যে সঙ্গদানের অভ্যাস করে দিয়ে গেলি, প্রতিদিনের অভ্যাসে অভ্যস্হ প্রাণী বানিয়ে দিলি, প্রতিদিনের, কেননা, তুই যেদিন এসেছিলি তার কুড়ি দিন পরের প্রেগনেন্সি টেসটিং কিট দেখিয়ে খিলখিলিয়ে বলেছিলি, অ্যাচিভড, গন্তব্যে পৌঁছে গেছি, এখন একমাস পর আবার টেস্ট করাব, ইইইইইএএএএ ।

       আমার কর্মচারীদের তুই কখনও টের পেতে দিসনি যে আমরা রাতে একসঙ্গে শুই ; অ্যালার্ম দিয়ে মরনিং গ্লোরি নিয়ে তুই বলতিস, এবার যাও, ঘুমিয়ে নাও ঘণ্টা দুয়েক ।

       মাংসে বুনে-দেয়া মৌনভাঁজের উল্লাস ; তাপের অদৃশ্য শিখা । 

       ষাঁড় হয়ে ওঠার মনোবাঞ্ছা। খুরের দ্রুততায় ছুটন্তের নির্বাণধ্বনি । 

       গর্তের ভেতরে পোকাদের গানের প্রতিধ্বনি; খোলোসের সঙ্গে সাপ  ব্যথা ফেলে  যায় না !

      একদিন কেবল শাঁখ বাজিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছিলি ; আমার মায়ের শাঁখ ।

      বাজাতে পারিস ?

      বাড়িতে পুজোটুজো থাকলে বাজাতে হয়, মা, মানে আন্টিমা, একনাগাড়ে বাজাতে পারেন না, হাঁপান । 

       তুই চলে গেলে আমি কি করব?

        তার ব্যবস্হাও হয়ে যাবে।

       অমন ব্যবস্হা আবার হয় নাকি ; ওসব কল গার্লের পেছনে পড়ার হলে আমি কয়েকজন কলিগের নাইটগ্রুপে কবেই ঢুকে যেতাম, প্রতিটি ইউনিয়ান টেরিটরিতে অমন গিভ-অ্যাণ্ড-টেক ব্যবস্হা আছে, ঠিকাদাররা সবসময়েই খুশি করার জন্য মুখিয়ে ।

       তুই বলেছিলি, চিন্তা কোরো না ; অনেক কিছু যোগাযোগের ফলে ঘটে যায়,  তোমার ক্ষেত্রেও তাই হবে, কে বলতে পারে ? তুমি আমাকে চাইতে, কিন্তু যোগাযোগ করতে ভয় পেতে । আমি যাবার পর তোমার সেক্সের প্রয়োজন হবে, কেউ হয়ত উদয় হবে।

       হতে পারে, হয়তো হতে পারে, সে তো আর এলেকট্রা হবে না, তোর মতন উড়ন্ত জাজিম হবে না, ওউ-ওউ-ওউ-ওউ করে ঠোঁটে ইশারা খেলাবে না।

       মহাকাব্যে হয়ত একজন এলেকট্রা ছিল। এলেকট্রা কমপ্লেক্সে ভোগার মেয়ে তো কেবল একজন নয়, নিও ফ্রয়েডিয়ান ইয়ুংগিয়ান কমপ্লেক্স নিয়ে কেউ হয়তো দেখা দেবে, তখন অবাক হয়ে আমার ভবিষ্যবাণীর কথাটা মনে কোরো, অন্য ইশারে খেলাবে, প্রতিটি যুবতীর জাদুবাক্সে অমন হামিংবার্ড থাকেই।

       এ তো বিশ্বাসঘাতকতা করলি ।

       বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলছ কেন, আমি তো প্রথম থেকেই বলেছি তোমাকে,  আমি তোমার কাছে কি চাই। 

       তুই যা চাইছিলি, তা পেয়ে গেলি ; আমি যা চাইছিলাম, তা এই কয়দিনের জন্য নয়, দিনের পর দিন রাতের পর রাতের জন্য, ছুটির দিনে দুপুরের জন্য, সারাজীবনের, দুজনে একসঙ্গে বুড়ো-বুড়ি হবার।

       আমি চলে গেলে দেখবে সব ব্যবস্হা হয়ে যাবে।

       তুই এইসব কথা বলতিস । জানতাম না যে তোর আইডেনটিটিকার্ডগুলো, স্কুলের রিপোর্ট, ইনটারভিউ, তোর যত স্মৃতি আমি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম, সব তুই নিজের সঙ্গে নিয়ে চলে গেছিস । 

      তুই চলে যাবার পর এত মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল যে আলমারি খুলে দেখি কিছুই নেই, ব্যবহৃত তিনটে প্রেগনেন্সি টেস্টিং কিট আর গায়নাকলোজিস্টের রিপোর্টও সঙ্গে নিয়ে গেছিস , ওগুলো দেখিয়েছিলি স্তোক দেবার জন্য যে আমি তোর বাচ্চার বাবা হতে চলেছি।

      রয়ে গেছে আমার মোবাইলে তোর খোলা-বুকের ফোটো ; তাতে আরও মনখারাপ হয়। কেবল বুক, নিজেই তুলেছিলিস বুকের সেলফি, তোর মুখ নেই ।

       তুই বলেছিলি তোর বেবিকে গিটার বাজিয়ে শোনাতে । নিজে ড্রাইভ করে ছুটির দিনে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম কুতুব মিনারের চত্বরে, শুনিয়েছিলাম গিটার, ওঃ কতদিন পর বাজিয়েছিলাম , তোর দেয়া আঙটি পরেই বাজিয়েছিলাম । 

       আমাকে গিটার বাজাতে দেখে জেএনইউয়ের কয়েকজন যুবকযুবতী, যারা গিটার নিয়ে যুৎসই জায়গা খুঁজছিল, এসে বসে পড়ল আমাদের ঘিরে, আর তখনই তুই আরম্ভ করলি এমন এক গান, যা আমার মনে হল, আঁস্তাকুড়ে পড়েছিলেস বলে খুঁজে চলেছিস, তুই কে, তুই কে, তুই কে ? ওরাও অবশ্য যোগ দিল তোর গানে, আমার গিটারে  :

         

          বুল্লা কি জানা ম্যায় কওন

          না ম্যায় মোমন ভিচ মাসিতা

          না ম্যায় ভিচ কুফর দিয়া রীতাঁ

          না ম্যায় পালন ভিচ পাকিতাঁ

          বুল্লা কি জানা ম্যায় কওন

         

          না ম্যায় অন্দর বেদকিতাবাঁ

          না ম্যায় রেহেন্দা ফাঙ শরাবাঁ

          না ম্যায় রহন্দা মস্ত খারাবাঁ

          বুল্লা কি জানা ম্যায় কওন

          

          না ম্যায় শাদি না ঘমনাকি

          না ম্যায় ভিচ পলিতাঁ পাকিঁ

          না ম্যায় আবি না ম্যায় খাকি

          না ম্যায় আতিশ না ম্যায় পওন

          বুল্লা কি জানা ম্যায় কওন

          

          না ম্যায় আরবি না লাহোরি

          না ম্যায় হিন্দি শেহর নাগোরি

          না হিন্দু না তুর্ক পাশাওরি

          বুল্লা কি জানা ম্যায় কওন

         

          না ম্যায় ভেত মজহব দে পায়া

          না ম্যায় আদম হব্বা যায়া

          না কোই অপনা নাম ধরায়া

          বুল্লা কি জানা ম্যায় কওন

        

          অওয়ল আখর আপনু জানা

          না কোই দুজা হোর পছানা

          ম্যায় তো না কোই হোর সেয়ানা

          বুল্লে শাহ খড়া হ্যায় কোন

          বুল্লা কি জানা ম্যায় কওন

          

          না ম্যায় মুসা না ফারাওয়া

          না ম্যায় জগন না ভিজ সওন

          না ম্যায় আতিশ না ম্যায় পওন

          না ম্যায় রহান্দা ভিচ নাদাওন

          না ম্যায় বৈঠা না ভিচ ভাওন

          বুল্লে শাহ খড়া হ্যায় কওন

          বুল্লা কি জানা ম্যায় কওন

         

         গানের শেষে ছেলেমেয়েগুলো দাঁড়িয়ে নাচতে লাগল, তুইও দুহাত তুলে যোগ দিলি তাদের সঙ্গে । গানটা শুনে আমার তো মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল ; অথচ তোর প্রকৃত আবেগ ধরতে পারলাম না, কেনই বা হঠাৎ এই গানই গাইবার ইচ্ছা হল তোর ! বুল্লে শাহের বেশি প্রচলিত গান তো দমাদম মস্ত কলন্দর ।

       আমি এই নই, আমি ওই নই, আমি সেই নই । আমি কে ? আমি এই নই, আমি ওই নই, আমি সেই নই । আমি কে ? আমি এই নই, আমি ওই নই, আমি সেই নই । আমি কে ? সত্যিই তো, তুই কে ? মহাকাব্যের এলেকট্রা !

       কেন এই প্রশ্ন তোকে ঘিরে ধরল কুতুবুদ্দিন আইবেক আর ফিরোজ শাহ তুঘলকের তৈরি এই মিনার চত্বরে ! অন্তর্দ্বন্দ্বের সঙ্গে শীতযুদ্ধ ? কেন ? দ্রুতির হাতিয়ার চালিয়ে যা আয়ত্ব করতে চাইছিলি, তা করলি । তাহলে ? মস্তিষ্কে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নদের লাই দিলেই ঝামেলা, আমার চেয়ে তুই তা ভালো করে জানিস, তোর সমবেত নাচ দেখতে-দেখতে মনে হল ।   

      অনিশ্চয়তার উত্তর হয় না, না রে ? অনিশ্চয়তাকে সবাই গোপনে ভালোবাসে, এরকম মনে হচ্ছিল ; প্রেমের মতন অনিশ্চয়তা আর নেই। 

       এই কখন, এই কখন, এই কখন, এই কখন ! যাঃ ।

       অনিশ্চয়তার সুস্বাদু বিষ জিভে লেগে থাকুক সবসময়, এরকমই ভাবিস কি ?

       টিভিতে রাব্বি শের গিলকে গাইতে শুনেছি গানটা, তখন বেশ ভালো লাগত । যত বয়স বাড়ে তত অনিশ্চয়তার মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তার প্রকৃতিতে রদবদল ঘটে । 

       জীবনযাপনের  নিত্যকর্মপদ্ধতি হয় না, যতই না কেন দিনযাপনের রুটিন থাকুক !

       তুই চলে যাবার পর খুলে রেখে দিয়েছি আঙটি । সৎ সৎ সৎ সৎ বলার আড়ালে বোধহয় বলেছিস বোকা বোকা বোকা বোকা। 

       আমার পুরোনো আমিকে এখন কি করে ফিরে পাবো , রক্তমাংসের যান্ত্রিক আমি ? তুই আমাকে বিধ্বস্ত করে চলে গেছিস, ধ্বংস করে, চুরমার করে ।

       সিনিয়ার-জুনিয়ার কলিগরা ভেবেছিল যে মালদার পোস্টিঙের জন্য তর্জনীতে পোখরাজের আঙটি পরেছি। হ্যাঁ, তোর দেয়া আঙটি পরে সেরকম উন্নতি হয়েছে আমার, ঘুষের রাজত্বের অংশীদার হয়েছি । অভ্যাস নেই বলে বিভ্রান্ত বোধ করছি ।

       মিস করছি তোর রাঁধা মেক্সিকান কোচিনিতা পিবিলি, শুয়োরের মাংসও তোর হাতে ছোঁয়া পেয়ে ভিনচরিত্র পায়, আমি তো আগে শুয়োর তেমন রেলিশ করতুম না, অ্যালবোনডিগা মিট বল, ভেড়ার মাংসের বার্বাকোয়া, কালদে দ্য পোলো মুর্গির স্যুপ ; টার্কিশ বিরিয়ানি এতলি পিলাফ, টোমাটো পিলাফ ; থাই এঁচোড়ের ডালনা কায়েং কানুন । 

        কুকটা কত চেষ্টা করল, তোর মতন রাঁধতেই পারেনি ; ও বলছে তুই মশলাগুলো সিক্রেট রেখেছিলি । তোর কি সবই সিক্রেট ? 

       পিওনকে বললাম, পাঠিয়ে দাও ।

       তোর মতনই হাতে লাল রঙের স্যুটকেস, কাঁধে হলুদ ব্যাগ, ফেডেড জিন্স, লাল ঢিলেঢালা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি, তার ওপর সাদা ব্লেজার, পায়ে রঙিন ফ্ল্যাপার, ডান হাতে গোটা-পাঁচেক স্লোগানচুড়ি, কানে চুড়ির মাপের লাল রঙের মাকড়ি, হাতের আর পায়ের নখে ব্রাউন-লাল নখপালিশ, হাতের নখ ততো বড় নয়, কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়া চুল, তোর সমান ঢ্যাঙা । 

        আমার চাউনি তোতলাতে থাকে, মগজের ভেতরে লুডোর ঘুটি পড়ার শব্দ, বুকময় স্টেথোস্কোপের স্মৃতি ।

       সেই নারঙ্গঠোঁট কুচকুচে হাঁস । মাছেদের দেখা স্বপ্নে ভারাতুর নদীতে ।

       ঘাসে-ঘাসে তাঁবু ফেলেছে ফড়িঙেরা । সবুজ পৃথিবীকে মৌমাছিদের প্রণাম ।

       কি করে সম্ভব ! যেন তোর পোশাক আর অ্যাকসেসরিজ পরে চলে এসেছে মেয়েটি, কেবল মুখ আলাদা । সুস্পষ্ট ফিচার্স, বেশ সুশ্রী ।

       আমি :তুমি এলেকট্রা ?

       যুবতী : হ্যাঁ স্যার, আমি আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা । আমিই আঁস্তাকুড়ের প্রকৃত এলেকট্রা, যে নিজেকে এলেকট্রা বলে আপনার বাড়ি এসে আপনার জীবনে ঢুকে পড়েছিল, সে মহাকাব্যের এলেকট্রা, তাকে আমি আমার স্বপ্ন প্রায় সম্পূর্ণ দান করে দিয়েছি ।

       আমি :কি বলছ তুমি ? স্পষ্ট করে বলো , হেঁয়ালি কোরো না, আমি বেশ ডিসটার্বড ।

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : স্যার আপনার পিওন বা সার্ভেন্টদের বলুন আমার স্যুটকেস এটসেটরা  পোর্টিকো থেকে নিয়ে আসতে ।

       আমি : বিলংগিংস নিয়ে চলে এসেছ ? আই অ্যাম ব্যাফলড , চলো, ভেতরে চলো, ডিসটার্বড মনে হচ্ছে তোমাকেও, ড্রিংক করো, তাহলে একটু ড্রিংক করে নাও, কিংবা যদি ট্র্যাংকুলাইজার চাও, আছে আমার কাছে ।

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : না, আমি ঠিকই আছি, জিনিসগুলো বাইরে থেকে আনিয়ে নিন আর ভেতরে চলুন।

       আমি : তোমার বাড়ির লোক জানে ?

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : বাড়ির লোক কয়েকবছর থেকে জানে যে আমরা  দুজনেই আপনাকে ভালোবাসি, কিন্তু দুজনের ভালোবাসায় যথেষ্ট পার্থক্য আছে ।  

       আমি : কি বলছ কি বোকার মতন, নেতি নাম তো আমিই নেতিকে দিয়েছিলাম ।

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : সেই নেতি, যে নেতিকে আপনি এতদিন নেতি মনে করে ভালোবাসলেন, সে নেতি নয় স্যার । আমি আছি নেতিতে।

       আমি : দুজন ? স্ট্রেঞ্জ, মেলাতে পারছি না । স্বপ্নদান ? বুঝিয়ে বলো, বুঝিয়ে বলো । ভেতরের ঘরে বসবে চলো ।    

       মনের ভেতরে সমান্তরাল চিন্তার স্রোত বইছিল, আমি কি তাহলে আমার দেয়া নামকেই ভালোবেসে গেছি, সেই নামের বাস্তব যুবতীটিকে নয় ? নামের প্রচণ্ড ক্ষমতা হয়, জানি, ভয় উদ্রেক করা নাম, এড়িয়ে যাবার নাম, রাখা যায় না এমন নাম, কিন্তু ভালোবাসবার নাম ? 

        নেতি বলেছিল একদিন স্নানের সময়, সাইক্লোনের নাম মেয়েদের নামে হয়, তা কি ওর ইঙ্গিত ছিল ? মেয়েদের নাম, কই, বিয়োগিনী রাখা হয় না তো ! ভালোবাসবার আগে শোনা নামের সঙ্গে ভালোবাসবার পরে শোনা নামের তফাত আছে নাকি ! মানুষটা বাস্তব না তার নাম ! গুলিয়ে ফেলছি সবকিছু ।

       নানকু প্রসাদকে বললাম মেয়েটির জিনিসপত্র বাইরে থেকে নিয়ে আসতে ।

       যুবতীটি বলল, স্যার আপনি দিল্লিতে এসেছেন বহুকাল পরে, যখন প্রথমবার আপনার পোস্টিং দিল্লিতে হয়েছিল, ইয়াং ছিলেন,আমার দিদি, যে এতদিন রইল আপনার সঙ্গে, তার ক্রাশ হয়েছিল আপনার সম্পর্কে, মনে করে দেখুন, আপনি কোনো দুর্গাপুজোয় অভিনয় প্রতিযোগীতার বিচারক ছিলেন, তারপর ও আপনাকে  দূর থেকে যখনই দেখেছে, ততো আকৃষ্ট হয়েছে, আপনি তো আমাদের পরিবারের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতেন, ও কিন্তু ঠিক লক্ষ্য রাখত আপনার ওপর, ও আপনার ব্যক্তিত্ব, ম্যাগনানিমিটি আর সততার প্রেমে পড়ে গেল । আঙ্কলবাপি-আণ্টিমা আপনার পোস্টিঙের শহরে ছুটি কাটাতে গেলে, অবভিয়াসলি, আমাদের নিয়ে যেতেন না, কিন্তু অসংখ্য ফোটো তুলে আনতেন ; সেই ফোটোগুলো থেকে আপনার মহাকাব্যের এলেকট্রা,  যাকে নেতি মনে করে সঙ্গ দিলেন, সে আপনার ফোটোগুলো বেছে নিয়ে পার্সোনাল অ্যালবাম তৈরি করেছে ।

       আমি : বসো, বসো, ওই সোফাতে বসে বলো । তুমি কে ?

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : বসছি স্যার । আমি নেতি, আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা । যে এসেছিল সেও এলেকট্রা, এলেকট্রা কমপ্লেক্সের মেয়ে, মহাকাব্যের নায়িকা  । পার্থক্য এই যে আমি আপনাকে ঐশ্বরিক বলে মনে করি ; আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি, আপনি আমার জীবনে না থাকলে যেখানে আমি আজ পৌঁছেছি, সেখানে পৌঁছোতে পারতুম না । আপনি গিফ্টপ্যাকের মতো করে গড়ে দিয়েছেন আমার জীবন ।

       আমি : মানে ?

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : আমাকেই আমার বাবা আঁস্তাকুড়ে ফেলে চলে গিয়েছিলেন । আমি কোনো দিন ওই আঁস্তাকুড় দেখতে যাবো না, আমি জীবনে কখনও কোনো আঁস্তাকুড়ে শুয়ে সেলফি তুলব না, আমি কখনও সেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যাবো না, যারা আমাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছিল, আমি কখনও সেই আঁতুড়ঘর দেখতে যাবো না, যেখানে আমি জন্মেছিলুম । আমি ওই গ্লানি থেকে মুক্ত করে নিয়েছি নিজেকে, আর পিছন ফিরে তাকাতে চাই না। 

       আমি : তুমি বলতে চাইছ যে তুমিই নেতি ?

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : বললুম তো, আমিই নেতি ব্যানার্জি, আমিই সিলিকন ভ্যালিতে অ্যাডভান্সড মাইক্রো সিস্টেমসে চাকরি করি, আজকে রাতের ফ্লাইটে ফিরে যাচ্ছি, যাবার আগে আপনার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তাকে স্হায়ীত্ব দেওয়া  আমার কর্তব্য। বিশ্বাস না হয়, এই দেখুন স্যার, আমার পাসপোর্ট আর ওয়ানওয়ে এয়ার টিকেট ।

       যুবতীর পাসপোর্ট দেখলাম, নেতি ব্যানার্জির নামে, গুড়গাঁওয়ের বাড়ির ঠিকানা, বাবার নাম জগদীশ ব্যানার্জি, ফোটোও এই মেয়েটির, এইচ ওয়ান বি ভিসা  । নেতি ব্যানার্জির নামে এয়ার টিকেট, আজ রাতের ।

       টেবলের ওপরে রাখা ব্ল্যাক ডগের  গ্লাস থেকে এক ঢোঁক খেয়ে বললাম, আমি এখনও কনফিউজড, পাজলড ।

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : আপনি কনফিউজড এই জন্য যে আপনি কখনও জগদীশ ব্যানার্জির বাড়িতে যাননি, তাঁর ছেলেমেয়েদের এড়িয়ে গেছেন, বইপত্র পাঠিয়ে খোঁজ নেননি যে সেগুলো কে পড়ছে, কার কিসে আগ্রহ । আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী, বিজ্ঞানের বই আপনি পাঠাতেন না, ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন, ভারত আর বিশ্বের ইতিহাস বিষয়ে বই পাঠিয়েছেন । এই বইগুলো পড়েছে বৈদেহী আর আরিয়ান । বৈদেহীও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিল। জামিয়া মিলিয়াতে অধ্যাপনা করত বিয়ের আগে ।

      আমি : কেন জানি না মনে হচ্ছে আমাকে ডেলিবারেটলি আঘাত দিয়ে কনফিউজ করতে এসেছো ।

      আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : ছি ছি, আপনার জ্বর হয়েছে বা শরীর খারাপের সংবাদে আমরা বিপর্যস্ত বোধ করেছি । কিন্তু আপনার নিষেধাজ্ঞার জন্য দেখা করতে আসা বা সেবা করা সম্ভব হয়নি । 

      আমি : স্পষ্ট করে বলছই না । যে এসেছিল, মনে হচ্ছে তার পোশাক পরেই এসেছ, এমন জটিলতায় ফেলেছ যে সমাধান করতে পারছি না, যেমন রহস্যময়ী তুমি, তেমনই নেতি, আমাকে একা ফেলে চলে গেল ।

      আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : না, স্যার, এই পোশাকটা আমারই, দিয়েছিলুম বৈদেহীকে । আমি তখন থেকে বৈদেহীর কথাই বলছি, ওর ক্রাশ ছিল আপনার সম্পর্কে, আপনি ছয় বছর আগে দিল্লি সরকারি কর্মচারি ম্যারাথনে প্রথম হয়েছিলেন, টিশার্ট খুলে বিজয় পালন করেছিলেন, তখন আরও কয়েকজনের সঙ্গে বৈদেহীও ফুলের তোড়া দিয়েছিল আপনাকে, বেশ কাছ থেকে দেখেছিল আপনাকে । সেই থেকে ও বিয়ে করতে চেয়েছে আপনাকে, আঙ্কলবাপি আর আন্টিমা বলেছিলেন আপনি ওনাদের চেয়ে নিচু জাতের, তা যে কি করে হয় আপনিই বলুন, আন্টিমা তো নিজে জাঠ পরিবারের ; তাছাড়া ওনারা আপত্তি করেছিলেন আপনাদের দুজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্যের কারণে, বেশি তো পার্থক্য নয়, কুড়ি  বছর বোধহয়, আর তৃতীয় আপত্তি ছিল আপনি অত্যন্ত সৎ বলে আপনার স্ট্যাণ্ডার্ড অফ লিভিং ওনাদের তুলনায় ভালো নয়, আপনি ঘুষ নেন না, নেন না বলে আপনাকে ইউনিয়ান টেরিটরির যেখানে-সেখানে শর্ট নোটিসে পাঠিয়ে দেয়া হয়, অবসর নেবার পর থাকার জন্য ফ্ল্যাটও কিনে রাখেননি ।

     আমি : বৈদেহীই এসেছিল ? সেই জন্যই কি জগদীশ আর অমরিন্দর আগের মতো তেমন যোগাযোগ রাখে না, মনে হতো যেন অ্যাভয়েড করে, কারণ বুঝতে পারিনি এতকাল ।

     আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : হ্যাঁ, বৈদেহী যখন জোরাজুরি করছিল আপনাকে বিয়ে করার জন্য তখন ওনারা ওকে কয়েকদিন ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলেন, তারপর পঞ্চাশ লাখ টাকা আর দু-কিলো সোনার গয়না যৌতুক দিয়ে, এক সমকামী নেশাখোরের সঙ্গে  বিয়ে  দিলেন । যখন ডিভোর্স নিয়ে ফিরে এলো তখন ওনারা বিপদে পড়লেন । ডিভোর্সিকে বিয়ে করার পাত্র, প্রচুর যৌতুক দিতে রাজি থাকলেও, পাচ্ছেন না ওনারা, সবায়েরই ভার্জিন মেয়ে চাই । পাত্রপক্ষরা বিশ্বাস করতে চায় না যে বৈদেহী ভার্জিন, ওর বর ওর সঙ্গে শুতেই চায়নি কখনও । ও যখন বরের সঙ্গে বিয়ে কনজিউমেট করার জন্য প্রেশার দেয়া আরম্ভ করল, তখন শাশুড়ি আর স্বামী দুজনে মিলে বৈদেহীকে দৈহিক যাতনা দিতে লাগলেন ।

    বললাম, জানি ।

    আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : তবে ! কী হত ওর জীবন, বলুন স্যার ? যদি আপনি ওকে অমনভাবে ভালো না বাসতেন ! আমিই ওকে পাঠিয়েছিলুম আপনার কাছে, জোর করে, আমার ড্রেস ওকে পরিয়ে, হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে , যা ও চায় তা যদি বাবা-মা না চান, তাহলে, এত বয়সে কেন মেনে নেবে মেয়ে, কেন বিদ্রোহ করবে না, কেন জীবন নষ্ট হয়ে যেতে দেবে, বলুন? বৈদেহী এখানে গুড়গাঁওয়ের বাড়িতে একা, আঙ্কলবাপি আর আন্টিমা চণ্ডীগড়ে, কতদিন চলতে পারে এভাবে ?

     এরপর মেয়েটি যে কথাগুলো বলল, তাকে স্টানিং বললেও কম বলা হবে ।

     মেয়েটি বলল, সকলেই সমাজবিপ্লবের কথা বলে, তারাই আবার একজন তরুণীর ব্যক্তিগত বিদ্রোহকে খারাপ মনে করে ; বৈদেহী নিজে যা হতে চায় সেটা কি জরুরি নয় ? কেন সারাজীবন মুখোশ পরে কাটাবে ? নিজের ভেতরের নাচকে অমন বেড়ি পরিয়ে রাখার চেয়ে আত্মহত্যা করা শ্রেয় । নিজের জীবনে বিদ্রোহ করব না,  অথচ সামাজিক বিদ্রোহের ঢাকঢোল পেটাব, এটা তো নিছক জোচ্চুরি ।

     আমি তখনও স্মৃতির হাজতে, বললাম, তাহলে স্কুলের আইডেনটিটিকার্ড ?

     আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : কার্ডগুলো আমার কিন্তু তাতে বৈদেহীর ফোটো লাগানো আছে, তাই তো স্ট্যাণ্ডার্ড সেভেন্হ থেকে কার্ডগুলো, যেগুলো দেখে আপনি চিনতে পারেননি যে কার্ডে আমার মুখ না বৈদেহীর মুখ ।

     আমি : তিনটে ক্লাসের প্রেমপত্র ? ওগুলো তোমার নয় ? তুমিই তো স্বাক্ষর করেছ !

     আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : না, স্যার, তিনটে চিঠিই বৈদেহীর লেখা, আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য, দ্যাখেননি কি একই রকম হাতের লেখা, তার কারণ ও একই দিনে বসে লিখেছিল ওগুলো ।

    আমি : আর ইনটারভিউ ?

    আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : ওটা আমার ।

    আমি : তো ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল কেন ? মিথ্যা কথা বলে গেল কেন ? 

    আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : ও আপনাকে ছেড়ে যায়নি স্যার । ও বাড়ি ফিরে গেছে আঙ্কলবাপি আর আন্টিমাকে শেষ পর্যন্ত বাধ্য করার জন্য । প্রেগন্যান্ট হয়েছে জানার পরই ও ফিরেছে । বৈদেহী বাড়িতে বলে এসেছিল যে ও আপনার সঙ্গে লিভটুগেদার করতে যাচ্ছে । আমিই বৈদেহীকে ফোর্স করেছিলুম, আপনার কাছে সরাসরি পৌঁছে আপনাকে দখল করতে, আমি জানি আমার ফাইনানশিয়াল ফাদার হিসাবে আমার প্রতি আপনার সমর্পিত অধিকারবোধ আছে, নয়তো প্রতি ক্লাসের প্রতি বছরের ফিস, অমন রেগুলার বইপত্র, দুর্গা পুজোর পোশাক পাঠাতেন না আপনি । আমি সেকারণেই বলেছি যে আমি ওকে আমার স্বপ্ন প্রায় সম্পূর্ণ দান করে দিয়েছি । আপনার বাড়িতে আমিই বৈদেহীকে আমাদের গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছিলুম । আজকে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গুড়গাঁও ফিরে গেল বৈদেহী ।

     আমি :  বৈদেহীকে ফোন করছি এক্ষুনি চলে আসার জন্য, ওর অভাবে আমি বেশ ডিপ্রেশানে আছি । এখন খেয়াল হচ্ছে, বৈদেহী মাঝে-মাঝে  আঙ্কলবাপির বদলে বাপি আর আণ্টিমার বদলে মা বলে ফেলত । একদিন রাতে ঘুমের ঘোরে বলেছিল যে ও অভিনয় করছে না, ও জেনুইন ।

     আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : আপনি দুদিন অপেক্ষা করুন, বৈদেহীকে সঙ্গে নিয়ে আঙ্কলবাপি আর আন্টিমা সোমবার নিজেরাই আসবেন, আমি ওনাদের ইনফর্ম করে দিয়েছি । বৈদেহী আমাদের গুড়গাঁওয়ের বাড়িতে, আঙ্কলবাপি আর আন্টিমা চণ্ডীগড়ের কোয়ার্টারে ।

     আমি : তোমার ভূমিকায় ও তো দারুণ অভিনয় করে গেল তাহলে ।

     আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : আমার ভূমিকায় নয় স্যার, ও ওইরকমই, আগল নেই  বলতে যা বোঝায়, অ্যাগ্রেসিভ, আনইনহিবিটেড, হ্যাঁ, দিল্লিতে ইংরেজি আর বাংলা নাটকে অভিনয় করত, ছাত্র ইউনিয়ান করত। আমাকে দেখছেন তো, আমি ওর বিপরীত, রিজার্ভড, ইনহিবিটেড, কম কথা বলি, বিশেষ মিশি না, হইচই ভালো লাগে না, ড্রিংক করি না । আপনাকে লোকেট করার আইডিয়াটা আমার ; আমি আর বৈদেহী দুজনেই এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড সংস্হায় গিয়েছিলুম ।

     আমি : তোমরা দুজনেই দাবি করছ কেন যে তোমরা এলেকট্রা ।

     আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : ও এলেকট্রা কমপ্লেক্সের এলেকট্রা, মহাকাব্যের নায়িকা ; আপনাকে সিলভিয়া প্লাথের ড্যাডি কবিতাটা শুনিয়েছে তো, বলেছে আমায় ; অনেকদিন ধরে ও মুখস্হ করেছে দীর্ঘ কবিতাটা, স্রেফ আপনার জন্য, জীবনানন্দ দাশের কবিতাও বেশ কয়েকটা মুখস্হ করেছে, আপনাকে শোনাবে বলে । ও পশ্চিমবাংলাকে ভালোবাসে, নিজেই তার পরিচয় পেয়েছেন। ওর প্রেমকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, হয়তো আপনার প্রতি ওর উন্মাদ ভালোবাসাও ওকে বেপরোয়া করে থাকবে, ওর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয় যে আপনি অন্য কাউকে জীবনসঙ্গিনী করুন ।

    আমি : জীবনানন্দ দাশের কবিতা ? তো উনি বাংলার মানুষ হয়ে জন্মাতে চাননি কেন ?

    আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : উনি জীবনে কাউকেই বিশ্বাসযোগ্য পাননি, আইআইটিতে শুনেছি বন্ধুদের কাছে, ট্রামের ঘণ্টির ছন্দে বিভোর হয়ে মারা গিয়েছিলেন, ট্রামলাইনে শালিক, কাক, পায়রা, শঙ্খচিল  বসেছিল, উড়তে চায়নি ।

     আমি : তুমি ?

     আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : আমি  আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা,  ড্যাডিজ লিটল গার্ল । আমার নাম নেতি রাখার জন্য, আর জন্মদিন পয়লা জানুয়ারি করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ স্যার, নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমার জন্মের ইতিহাস, আর বছরের প্রথম দিনে তা আমায় আমার জন্মের কথা মনে করিয়ে দ্যায় । আমি পশ্চিমবাংলাকে বৈদেহীর মতন ততো ভালোবাসি না । আমার সমস্ত আপনাতে কেন্দ্রিত । 

      পরাজিত বোধ করছি মনে হল । 

       আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : আমি আজ  চলে যাচ্ছি স্যার, আর কখনও ফিরব কিনা জানি না । আপনার সঙ্গে অন্তত একবার দেখা করা জরুরি ছিল । আপনি চেয়েছিলেন নৈনিতালের বোর্ডিং স্কুলে পড়ি, পড়েছি । আপনি চেয়েছিলেন সায়েন্স স্ট্রিম নিয়ে পড়ি, পড়েছি । আপনি চেয়েছিলেন আইআইটির জন্য প্রতিযোগীতা করি, করেছি আর পড়েছি । আপনি চেয়েছিলেন ইলেকট্রনিক্স পড়ি, পড়েছি । আপনি চেয়েছিলেন ভালো চাকরি করি, করছি । আপনার প্রতিটি নির্দেশ পালন করেছি । আপনার পছন্দ বলে চিরকাল টোমাটোরেড লাল রঙের পোশাক পরেছি। প্রতিদান হিসাবে আমি কি আপনার একঘণ্টা সময় পেতে পারি ?    

     আমি : হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসেই তো আছ, রেস্ট নিয়ে নাও, বহুক্ষণের জার্নি ।

     আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা : না, স্যার । আপনি আমার প্রতিষ্ঠাতা, আপনার শরীরের ওপর আমার তেমনই অধিকার আছে, যেমন আমার অস্তিত্বের ওপর আপনার ; আমি যাবার আগে আপনার সঙ্গে একবার মনের মতন যৌনসম্পর্ক পাতিয়ে যেতে চাই, আমি মহাকাব্যের এলেকট্রার সঙ্গে প্রতিযোগীতা করছি না, আমার বাচ্চা চাই না, কেবল এক ঘণ্টা আপনাকে সেক্সুয়ালি পেতে চাই, আর তার জন্য এই নিন রানি ভিক্টোরিয়ার সময়ের রূপোর টাকা, আমার দিদি বৈদেহীকে আমি মনে করে দিয়েছিলেন । আপনার সঙ্গে সম্পর্কের  গোটা বেডশিটই মেমেন্টো হিসাবে নিজের কাছে রাখব আমি, সারাজীবন । 

  

      শিশিরে কেউটের গন্ধ । উতরোল কোলাহল । গাছে-গাছে না-খোলা কাঁচা দরোজার আড়াল ।

      স্ফিংক্স, মরুভূমি, পিরামিড, মমি । চাউনির অতিশয়োক্তি । জলের গভীরে রুপালি মৃগেলতন্বী ।

      পদশব্দ থেকে মুক্ত হয়ে যায় পায়ের পাতা । 

      কৃষ্ণবিবরের অচিন্ত্যনীয় ভর, আলোকেও হয়তো শেষাবধি আটক করে নিয়েছিল ।

      আরেকটা কথা স্যার , বৈদেহী আপনারই মেয়ে ; আপনি যখন দমন-এ পোস্টেড ছিলেন, তখন আপনার কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন আন্টিমা আর আঙ্কলবাপি, হানিমুন আর অফুরন্ত মদ খাবার লোভে । আন্টিমার সঙ্গে পর-পর কয়েকরাত আপনার দৈহিক সম্পর্ক হয়েছিল । আন্টিমা নিজে আমাকে বলেছিলেন, একদিন কান্নামেশা মাতাল অবস্হায়, আপনিই ওনার ভার্জিনিটি ডিফ্লাওয়ার করেছিলেন । সো লেট আস গো ইউ অ্যাণ্ড আই, লাইক টু পেশেন্টস ইথারাইজড আপঅন এ বেড…..

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত