| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

মহাভারতের যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান । রানা চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

রচনাকালের দিক থেকে দেখলে মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ খ্ৰীস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় থেকে খ্ৰীস্টিয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যে রচিত; ‘মহাভারত’ রচনা সম্ভবত শুরু হয় খ্ৰীস্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতক থেকে এবং শেষ হয় খ্ৰীস্টিয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ বুদ্ধের পরের আট বা ন’শো বছরের মধ্যে এ দুটি ‘মহাকাব্য’ রচিত হয়; এদের মধ্যে ‘মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়’; ‘রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়’; আগে পূর্ণকলেবর মহাকাব্যের রূপ পায় বলেই সম্ভবত এর নাম ‘আদিকাব্য’। মনে রাখতে হবে, রামায়ণ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে কতকগুলি ‘গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা’ ঘটে; ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰ’, ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্ৰ’, ‘শ্ৰীমদ্ভগবদগীতা’ এবং ‘মনুসংহিতা’, এই ক্রান্তিকালের রচনা। এর কিছু পরেই শুরু হয়ে যায় ‘পুরাণ’গুলির রচনা। ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’-এ পরবর্তী সংযোজিত অংশগুলি ‘অভিপৌরাণিক’, অর্থাৎ পুরাণে প্রতিফলিত যে সামাজিক মূল্যবোধ ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সমাবেশে ‘ভারতীয় ধর্মচিন্তা’ তার বিবর্তিত রূপে ক্ৰমে ‘হিন্দুধর্ম’ বলে অভিহিত হল, এই ‘অভিপৌরাণিক’ অংশেই আমরা সেগুলির সাক্ষাৎ পাই। এ দিকে ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’-এর মূল কাহিনী দুটি সম্ভবত অনেক প্রাচীনকাল থেকেই ‘গাথায়’ ও ‘আখ্যানে’ জনমানসে সঞ্চারণ করছিল; ফলে মহাকাব্য দুটিতে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের দুটি চিত্ৰ পাওয়া যায় – একটি মূল কাহিনীর আর একটি ‘সংযোজিত’ বা ‘প্রক্ষিপ্ত অভিপৌরাণিক অংশের’।

‘মহাভারত’-এ নারীর ‘জীবন-চিত্র’ আরও ‘প্রত্যক্ষ’, ‘ব্যাপক’ এবং ‘নিঃসন্দিগ্ধ’। যেহেতু ‘মহাভারত’-এর কলেবর ‘রামায়ণ’-এর ‘চতু্র্গুণ’ (‘রামায়ণ’-এ শ্লোকসংখ্যা ‘চব্বিশ হাজার’, ‘মহাভারত’-এ ‘এক লক্ষের কিছু কম’) এবং যেহেতু ‘মহাভারত’-এর রচনাকালের ‘ব্যাপ্তি’ রামায়ণ-এর অন্তত ‘দ্বিগুণ’, সে জন্যে এখানে সমাজের যে চিত্রটি পাওয়া যায় তার ‘পরিসর’ ব্যাপকতর। অতএব এর মধ্যে প্রাচীনতর কালের ‘সমাজচিত্র’ও যেমন আছে, ‘রামায়ণ’-এর বহু পরবর্তীকালের চিত্ৰও তেমনই আছে। ফলে মহাকাব্যের কাহিনির সৃষ্টির আদিমতম যুগের – হয়তো বৈদিক যুগের অব্যবহিত পরবর্তী যুগের – যে চিত্র পাওয়া যায়, স্বভাবতই, তা ‘রামায়ণ’-এর চেয়ে অনেক প্রাচীন। এবং যেহেতু এর শেষতম সংযোজনটি ‘রামায়ণ’-এর শেষাংশের চেয়ে অন্তত দু’শ (তিনশো’ও হতে পারে) বৎসর পরের, সেহেতু এতে ‘অভিপৌরাণিক সংযোজনগুলি’ আরও প্রত্যক্ষ ভাবে ‘পুরাণধর্মী’।

‘মহাভারত’-এর ‘আদিমতম অংশ’ থেকে শেষতম অংশের ব্যবধান অন্ততঃ ‘আটশত বৎসর’; এই দীর্ঘকালের মধ্যে সমাজ তো একই অবস্থায় থাকেনি। ফলে বিবর্তনের চিত্ৰও ‘মহাভারত’-এ স্পষ্টতর। ‘আদি ক্ষত্ৰিয়কাহিনী’ রচনার পরে কিছু নৈতিক কাহিনীর সংযোজন হয়, যেগুলি সাৰ্ব্বজনীন; দেশ ও কালের সীমাকে অতিক্রম করে বিরাজিত। শেষতম অর্থাৎ দ্বিতীয় সংযোজনের সৃষ্টিকর্তা ‘ভৃগুবংশীয় ঋষি’রা, এটি ‘ব্ৰাহ্মণ্য সংযোজন’ বলে খ্যাত। ‘নারী ও শূদ্রের অবনমনের স্পষ্টতম চিত্ৰ’ পাওয়া যায় এই অংশে।

‘আদি ক্ষত্ৰিয়কাহিনী যখন ‘গাথারূপে’ রচিত হয় সেই প্রাচীন যুগে নারীর কতকটা স্বাধীন সঞ্চরণের ও আচরণের কিছু চিহ্ন ‘মহাভারত’-এ রয়ে গেছে। ‘গান্ধারী’ বারে বারে ধৃতরাষ্ট্রকে ‘অনুযোগ করছেন’, ‘ধিক্কার দিচ্ছেন’, বলছেন ‘দুৰ্যোধনকে শাসন করতে’, ‘শাসন না মানলে ত্যাগ করতে’; ধৃতরাষ্ট্র নিজে যে পন্থাকে ‘ন্যায়’ বলে বিবেচনা করেন তার ‘অনুসরণ’ করছেন না – ‘কাপুরুষতা ও অন্ধ পুত্ৰমেহের কারণে’ (২:৭৫:৮-১০; ৫:১২২:৯)। দেখা যায়, ‘গান্ধারী’ প্রকাশ্য রাজসভায় স্বামীকে ‘ভর্ৎসনা’ করে সমস্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের জন্যে তাঁকে ‘দায়ী’ করছেন। এখানে ‘প্রচলিত অর্থে’ তিনি ‘পতিব্ৰতা স্ত্রী’ নন। তিনি নারী হয়ে ‘কৃষ্ণ’কে প্রকাশ্যে ‘অভিশাপ’ দিচ্ছেন; কুরুক্ষেত্ৰ যুদ্ধ তিনি নিবারণ করতে পারতেন, অথচ করেননি বলে ‘সবংশে নিধনের শাপ’ (১১:২৫:৪২)। ‘কুন্তী’ প্রচলিত অর্থে ‘স্নেহময়ী জননী’, কিন্তু, যখন তাঁর মনে হল পুত্রেরা ‘ক্ষত্রিয়োচিত আচরণ’ করছে না, তখন তিনি ‘বিদুলার উপাখ্যান’টি কৃষ্ণের মুখে বলে পাঠালেন, যে উপাখ্যানে ‘বিদুলা’ তাঁর পুত্র ‘রাজা সঞ্জয়’কে ‘ক্লীবোচিত নিস্ক্রিয়তা’র জন্যে ‘ধিক্কার’ দিচ্ছেন (৫:১৩২-১৩৫)। ‘দ্ৰৌপদী’ তাঁর স্বামী স্বয়ং ‘ধর্মপুত্র’ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে জীবনের ‘নৈতিক’, ‘রাষ্ট্রক’ ও ‘দার্শনিক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে’ প্রচণ্ড তর্ক করেছিলেন (৩:৩৭, ৩০, ৩২, ৩৭)। প্রচলিত অর্থে এবং পরবর্তী অনুশাসনের দৃষ্টিতে পতিব্ৰতার উপযুক্ত আচরণ এটা নয়। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সঙ্গে ‘কুন্তী’ যখন অরণ্যবাসের বাসনা জ্ঞাপন করলেন তখন পুত্রদের কোনও যুক্তি ও অনুরোধ তিনি মানেননি (১৫:১৬-১৭)। যদিও শাস্ত্ৰ বলে, ‘‘রক্ষান্তি স্থবিরে পুত্ৰাঃ’’ – ‘‘বার্ধক্যে নারীর রক্ষা করবে পুত্ররাই’’। ‘দুষ্মন্ত’ শকুন্তলাকে আশ্রমে রেখে চলে গেলেন। কয়েক বৎসর পরে শকুন্তলা বালকপুত্রটিকে নিয়ে রাজসভায় এসে প্রচুর কটুবাক্য বলে রাজাকে ‘ভর্ৎসনা’ করলেন (১:৬৯:১-২৭)। নারীর মুখে পুরুষের প্রতি এত কঠিন ‘ধিক্কারবচন’ ব্ৰাহ্মণ্য সংযোজনে অকল্পনীয়।

মহাভারতে নারী ‘সোমপান’ করেন (১৫:১৭:১৭); প্রকাশ্যে চলাফেরা করেন এবং নিজেদের সম্বন্ধে বহু ‘সিদ্ধান্ত’ নিজেরাই নেন। পিতৃমতী কন্যা পিতার অনুমতি ব্যতীত পুরুষের সঙ্গে মিলিত হন (‘শকুন্তলা’, ‘সত্যবতী’ এবং আরও অনেকেই); প্রয়োজন হলে নিজের ঈপ্সিত পুরুষটিকে পাওয়ার জন্যে প্রকাশ্য রাজসভায় পিতা রাজার সঙ্গে তর্ক করে নিজের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করেন, যেমন – ‘সাবিত্রী’। ভীষ্ম যখন ‘অম্বা’, ‘অম্বিকা’, ‘অম্বালিকা’কে হরণ করে আনেন তখন ‘অম্বা’ তাঁকে জানান যে তিনি ‘শাল্বরাজ’কে কামনা করেন। শুনে ভীষ্ম তাঁকে শাল্বরাজের কাছে পাঠান। পরবর্তীকালের নারী সাহসই পেত না নিজের ‘গোপন প্রেমের কথা’ পরপুরুষকে জানাতে; এবং সে পুরুষও তাঁর প্রেমের মর্যাদা দিত না। ‘পাণ্ডু’ ‘কুন্তী’কে বলেন, ঋতুকালে নারী যে কোনও পুরুষের সঙ্গে সহবাস করতে পারে, তাতে কোনও দোষ নেই (১:১১৩:২৫-২৬); এবং ‘কুন্তী’ পর্যায়ক্রমে তিনজন দেবের সঙ্গে মিলিত হন। ‘দময়ন্তী’কে পরিত্যাগ করে ‘নল’ যখন চলে যান এবং দীর্ঘকাল যখন তাঁর সন্ধান পাওয়া যায় না; তখন, বয়ঃপ্রাপ্ত দুটি সন্তানের জননী ‘দময়ন্তী’ অসংকোচে মা-কে বলেন নলের বিরহে তাঁর পক্ষে জীবনধারণ করা সম্ভব নয় (৩:৫৩-৭৮), অতএব পুনর্বার যেন দময়ন্তীর ‘স্বয়ম্বর’ আহ্বান করা হয়।

পরের যুগে এমন একটা ব্যাপার কল্পনাও করা যায় না। ‘কচ’ যখন ‘দেবযানী’র প্রেম প্ৰত্যাখ্যান করেন তখন ‘দেবযানী’ তাঁকে ‘শাপ’ দেন। সে শাপ ফলে যায়, এর দ্বারা মহাভারত-কার যেন বলছেন এ শাপ দেওয়ার ‘অধিকার’ দেবযানীর ছিল। পরে ‘শৰ্মিষ্ঠা’র বিবাহের যৌতুকরূপে সে ‘যযাতি’র গৃহে আসে এবং সেখানে নিজের অনুরোধক্রমে, ‘যযাতি’র গোপন প্রেমিক ও তাঁর সন্তানের জননী হয় (১:৫৯)। পরে ‘শর্মিষ্ঠা’ যখন সব জানতে পারে তখন ‘দেবযানী’ ও ‘যযাতি’কে ‘মিথ্যাবাদী’ ও ‘মূর্খ’ বলে ‘তিরস্কার’ করে। ‘রুরু’র প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে ‘প্রমদ্বারা’ তাঁকে বিবাহ করেন। ‘হিড়িম্বা’ ‘ভীমসেন’কে সম্মত করান তাঁর প্ৰেম গ্ৰহণ করতে ও তাঁকে বিবাহ করতে। তেমনই ‘উলুপী’ ও ‘চিত্রাঙ্গদা’ও উপজাজক হয়ে ‘অৰ্জ্জুন’কে প্ৰেম নিবেদন করেন, এঁদের বিবাহ করেন ‘অৰ্জ্জুন’ কিন্তু ‘উর্বশী’কে প্রত্যাখ্যান করেন। নারী স্বয়ং ‘প্রেমপ্রার্থিনী’ হয়ে পুরুষকে যুক্তি ও মিনতির দ্বারা সম্মত করাচ্ছে – এ চিত্র পরে বিরল হয়ে আসে। প্ৰথম যুগের রচনায় পুরুষ যখন নারীর প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে প্রার্থনা জানায় তখন নারী নিজের শক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ‘শর্ত’ স্থাপন করে এবং পুরুষ তা স্বীকার করে; ‘সত্যবতী’, ‘গঙ্গা’, ‘শকুন্তলা’ এর দৃষ্টান্ত। ‘কৌরব’দের মধ্যে ‘নারীর বহুবিবাহ’ প্রচলিত ছিল এমন কথাও জানা যায় দ্ৰৌপদীর বিবাহের সময়ে বাদপ্রতিবাদে (১:১২২:৭)। ‘জটিলা’ এবং ‘বাক্ষী’ও ‘বহুপতিক’ ছিল এমন উল্লেখ আছে (১:১৯৬:১৪-১৫)। নারী নিজের অভিরুচিমত ‘কুমারী’ থেকে ‘তপস্যা’ করতে পারত, তার দৃষ্টান্তও আছে – ‘সিদ্ধা’, ‘শিবা’ (৫:১০৯:১৯) এবং ‘শাণ্ডীল্যের তাপসী কন্যা’র (৯:৫৪:৬-৮) উল্লেখই তার প্রমাণ। পরে নারীর এ অধিকার ‘সম্পূর্ণ প্রত্যাহৃত’ হয়। ‘ঋষি অত্রির স্ত্রী’ স্বামীকে ‘ত্যাগ’ করে ‘তপস্যা’ করতে যান। তার তপস্যায় প্রীত শিব তাঁকে সন্তানের বর দেন এবং তিনি সেখানেই শুধুমাত্র দৈব-বরেই ‘সন্তানবতী’ হন (১৩:১৪)।

‘ব্রাহ্মণ্য সংযোজনে’ যেখানে ‘নারী সর্বতো ভাবে গৌণ’ এবং ‘পুরুষের অধীন’, পূর্বতন অংশে আছে, যে প্রলুব্ধ করতে আসে সতী স্ত্রীর অশ্রু অগ্নি হয়ে তাঁকে দগ্ধ করে (১:১৮২:৬)। এতে ‘সতীত্বের মাহাত্ম্য’ ঘোষণার সঙ্গেই আছে, যে কোনও নারীকে ‘নির্বিচারে ভোগ-অধিকারের অস্বীকৃতি’, যা পরে তেমন ভাবে আর থাকেনি। তবুও, পূর্ববতী অংশে তাঁর অশ্রুর অগ্নিতে পরিণত হওয়ার অপেক্ষা নেই, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর প্রেমেরই সে শক্তি আছে; যে ‘ব্যাধ’ ‘দময়ন্তী’কে কামনা করেছিল, সে দময়ন্তীকে আক্রমণ করতে উদ্যত হওয়ামাত্ৰই ভস্মে পরিণত হল। এ নারী ‘শক্তিমতী’, এ অশ্রুপাত করে না, অন্যায়ের সামনে ক্ৰোধে জ্বলে ওঠে। ‘সৈরিাষ্ট্রীরূপিণী দ্ৰৌপদী’ কামুক ‘কীচক’কে পদাঘাত করে, অপরাধীর দণ্ডের জন্যে ‘অতি প্রাকৃতের প্রতীক্ষা’ করে না, অশ্রুপাতও করে না (৪:১৬:১৯-২০)। নারীর ‘চরিত্র’ ও ‘আচরণ’ নিয়ে শাস্ত্র যেখানে বহু ‘নির্দেশ’ দিয়েছে সেই অংশে দৈবশক্তিতে দেবতার মধ্যস্থতায় অপরাধী ‘দণ্ডিত’ হয়েছে; তার আগে অসংযত কামুকের প্রলোভন ‘প্রতিহত’ করেছে নারী নিজেই উদ্যত ‘ক্রোধ’ ও ‘ঘৃণা’ দিয়ে ‘তর্ক’ করেছে, ‘যুদ্ধ’ করেছে, ‘অভিশাপ’ দিয়েছে, ‘ভর্ৎসনা’ করেছে, ‘পদাঘাত’ করেছে আত্মরক্ষার জন্যে।

মহাভারত-এ ‘কামনায় প্রণোদিত’ হয়ে নারীপুরুষের মিলনের বিরুদ্ধে বিস্তর ‘নিষেধ’ রয়েছে। ‘বিবাহ’ ক্ৰমে ক্ৰমে প্রেমের একমাত্র ‘আশ্রয়ভূমি’ হয়ে উঠল; কন্যা আর বেদের অনুশাসনে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিজের রুচিমত সঙ্গী বেছে নেয় না – ‘‘স্বয়ং সা মিত্ৰং বনুতে জনেচিৎ’’; নির্দেশ মেনে বরং কন্যাকে এখন ‘পিতা দান করেন’ তাঁর রুচিমত পাত্রে। ব্যাপারটা ‘ব্যক্তিগত’ থেকে ‘কুলগত’ হয়ে উঠছে; ‘ধর্মশাস্ত্ৰ’ও বলেছে, কুলেই প্ৰদান করা হয় কন্যাকে। অথচ পূর্বতন অংশে বারবার দেখা যায়, প্রেমে নারীর ‘স্বাতন্ত্র্য’ ছিল, আপনি জীবনসঙ্গীকে সে নির্বাচন করতে পারত, পুরুষের মতোই প্রেমে, প্রেমনিবেদনে এবং প্ৰেমাস্পদকে নিজের অনুকুল করার চেষ্টা করার অধিকার তাঁর ছিল, এর জন্যে সে ‘নিন্দিত’ হত না। স্বয়ং ‘ভীষ্ম’ও ‘অম্বা’র প্রেমের কথা শুনে তাঁকে ‘ধিক্কার’ দেননি।

‘ব্যভিচারের অপরাধে’ নারী পুরুষের ‘সমান দণ্ডের কথা’ দু-একটি স্থলে দেখা যায় (১২:১৬৫৬৩); এমনকী ব্যভিচারে নারী ‘নির্দোষ’, কারণ পুরুষ ‘ধর্ষণ’ করলে ‘নারী অসহায়’ এমন কথাও আছে (১২:২৬৫:৪০)। মহাভারত-এর প্রথম অংশে এমন বহু ব্যভিচারের কাহিনী আছে যার সম্বন্ধে ‘বিচার’ বা ‘দোষারোপ’ নেই, যেন তথ্যই পরিবেশিত হচ্ছে শুধু। এমনই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নরনারীর মিলনের ফলে মহাভারত-এর বহু মুখ্য নায়কেরই জন্ম; ‘বেদব্যাস’, ‘ভীষ্ম’, ‘কৰ্ণ’, ‘পঞ্চপাণ্ডব’ এবং বহু উপনায়কের এ ভাবেই জন্ম। এত অসংকোচ এ ঘটনাগুলির বিবরণ এবং সে বিবরণে ওই মিলনের ধর্মীয়তা প্ৰতিপাদনের কোনও চেষ্টামাত্রই নেই। মনে হয় এমন বহু ঘটনা ‘লোকমুখে চলিত’ ছিল এবং সমাজে যে এমন ঘটনা ঘটে থাকে সে সম্বন্ধে সমাজ অবহিত ছিল। তার ‘সমর্থন’ বা ‘নিন্দা’ কোনওটাই ‘প্ৰকট’ ছিল না।

এই ‘নিন্দা’ যখন ‘উগ্র’ হয়ে উঠল তার আগে নারীর স্থান সমাজে অনেক নেমে গেছে; সে তখন কোনও পুরুষের ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ – হয় ‘পিতা’র, নয় ‘স্বামী’র। ‘কন্যা’ বা ‘পত্নী’ ছাড়াও সমাজে নারী আছে – সেই নারীসাধারণ সম্বন্ধে স্পষ্ট, উচ্চারিত বোধটি হল – নারী নরকের দ্বার। মোহিনীরূপে দেখা দেয় সে, পুরুষের কামনার উদ্রেক করে, অতএব পুরুষ ‘প্রলুব্ধ’ হলে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নারীরই। ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ হয়ে ওঠার পরই তো ‘না বলিয়া পরের দ্রব্য গ্রহণ করা’-র প্রশ্ন ওঠে। ব্ৰাহ্মণ্য সংযোজনের বহু পূর্ব হতেই এ সময়ের সূচনা, যদিও এই সময়কার মনোভাব স্পষ্ট ভাবে লিপিবদ্ধ হয় ব্রাহ্মাণ্য সংযোজনেই। এই অংশে দেখা যায় নারী ‘অশুভ’, সমস্ত ‘অমঙ্গলের হেতু’, কন্যা ‘দুঃখের’ (১:১৫৯:১১)। ‘শান্তিপর্বে’ মুমূর্ষু ‘ভীষ্ম’ ‘যুধিষ্ঠির’কে বলছেন, ‘নারীর চেয়ে অশুভতর আর কিছুই নেই, বৎস, নারীর প্রতি পুরুষের কোনও স্নেহ-মমতা থাকা উচিত নয় (১২:৪০:১; ১৩:৪৩:২৫); পূৰ্ব্বজন্মের পাপের ফলে এ-জন্মে নারী হয়ে আসতে হয় (৬:৩৩:৩২); বা, নারী সাপের মতো, পুরুষের তাঁকে কখনওই বিশ্বাস করা উচিত নয় (৫:৩৭:২৯); ত্ৰিভুবনে এমন কোনও নারীই নেই যে স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য (১২:১০:২০)। এতেও বোধ হয় যথেষ্ট হল না, তাই ‘দেবতার দোহাই’ দেওয়া হল – প্রজাপতির ইচ্ছা যে নারী স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য নয় (১২:২০:১৪); যে ছটি বস্তু এক মুহুর্তের অসতর্কতায় নষ্ট হয় তা হল – ‘গাভী’, ‘সৈন্য’, ‘কৃষি’, ‘স্ত্রী’, ‘বিদ্যা’ এবং ‘শূদ্রের সঙ্গে সম্বন্ধ’ (৫:৩৩:৯০); নারী এক ধর্মাচরণে অধিকারিণী, শুধুমাত্র স্বামীর সঙ্গেই সে ধর্মানুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে (৮:৪:১৩)। শেষেরটি অবশ্য ‘বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়’ থেকেই আছে, সম্ভবতঃ যখন থেকে উপনয়নে তাঁর ‘অধিকার’ প্রত্যাহৃত হল তখন থেকেই; এবং তাও হল আর্যরা যেহেতু প্ৰাগাৰ্য নারী বিবাহ করতে থাকেন। অতএব ‘আৰ্যবৰ্ণ’ ছাড়া অন্য কাউকে ‘উপনয়ন’ দেওয়া কাৰ্যত বন্ধ হয়ে গেল, দু-চারটি ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও।

বহু স্থানে ‘সতী’ ও ‘কর্তব্যপরায়ণা’ নারীর ‘প্রশংসা’ আছে (১:১১০ এবং অন্যত্র)। তাঁর চূড়ান্ত ‘চরিতার্থতা’ হল ভক্তিতে স্বামীকে ‘প্রসন্ন’ করা এবং তাঁর ‘সন্তান’ ধারণ করা। কর্মনিষ্ঠ ‘পতিব্ৰতা নারী’ হল ‘তপস্বিনী’ (১৩:১৪৬:৪৮-৫১), গৃহিণীর ভূমিকায় সার্থকতায় ‘পুণ্য’ আছে এবং এ পুণ্যের প্রশংসায় মহাভারতের ‘ব্রাহ্মাণ্য অংশ’ মুখর। প্রাচীনতর অংশে বহু ‘বিধবা’ আছে। ‘সত্যবতী’, ‘কুন্তী’ এবং বহু মৃত বীরের ও ‘কৃষ্ণের স্ত্রী’দের উল্লেখ আছে, এঁরা কেউই ‘সহমৃতা’ হননি; শুধু ‘মাদ্রী’ একাই ‘সহমৃতা’ হন এবং সেও ‘সমাজের নির্দেশে নয়’, ‘ব্যক্তিগত অপরাধবোধে’। এঁরা কেউই পুনর্বার বিবাহ করেননি, কিন্তু ‘অম্বিকা’ ও ‘অম্বালিকা’ ‘নিয়োগপ্রথা’র দ্বারা ‘সন্তান ধারণ’ করেছিলেন। ‘প্রোধিতভৰ্ত্তকা’র জন্যে কঠোর নির্দেশ আছে, যাতে তাঁর আচরণে শুধু ‘চাপল্য’ নয় কোনও রকম ‘সজীবতা’ও না প্রকাশ পায় (১২:১২৩:১৬, ১৭)। স্বামী কাছে থাকলে যথাসম্ভব ‘মনোযোগ’ ও ‘নিষ্ঠা’র সঙ্গে স্ত্রী তাঁর ‘সেবা’ করবে। যে স্ত্রী ‘মধুরভাষিণী’ তাঁর ‘প্রশংসা’ও যেমন আছে (৫:৩৩:৮৬), যে ‘পরুিষভাষিণী’ তাঁর ‘নিন্দা’ও তেমনি আছে (৫:৩৩:৮৪)। যে বধূর শাশুড়িকে গৃহকর্মকরতে হয় অথবা যে শাশুড়ির কোনও রকম ‘নিন্দা’ করে তাঁর ‘পাপ’ হয় (১৩:৯৩:১৩১)। ‘পতিব্ৰতা সতী’র এমনই ‘মাহাত্ম্য’ যে ‘ধর্মব্যাধের উপাখ্যানে’ তপস্বীকে আসতে হল পতিব্ৰতার কাছে ধর্মে শিক্ষা নিতে (৩:২০৫)।

পরবর্তীকালে বিবাহিতা নারী ‘শিবিকা’য় আরোহণ করে যাতায়াত করতেন (১:৭৩:২১, ৮০:২১; ৩:৬৯:২৩; ১৫:২৩:১২)। লঙ্কাকাণ্ডে যুদ্ধের শেষে রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে ‘সীতা’ও গিয়েছিলেন ‘শিবিকা’য়। তাঁরা পুরুষ সহযাত্রীর তত্ত্বাবধানে যাতায়াত করতেন এবং অন্তঃপুরেও ‘বসনে আবৃত’, ‘অবগুণ্ঠিত’ হয়ে বাস করতেন (৫:৮৬:১৬; ১৫:১৫:১৩)। সভায় যখন আসতেন, তাঁদের বসবার জন্যে স্বতন্ত্র একটি অংশ থাকত (১:১৩৪:১২)। বিবাহিতা নারী দীর্ঘদিন পিত্রালয়ে বাস করলেও সেটা ‘নিন্দনীয়’ বলে গণ্য হত, এতে নাকি তাঁর ‘যশ’, ‘চরিত্র’ ও ‘গুণ’ নষ্ট হয়ে যায় (১:৭৪:১২)। অর্থাৎ ক্রমেই বিবাহিতা নারীর একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল ‘শ্বশুরালয়’। ‘পিত্ৰালয়ে’, দীর্ঘকাল বাস করলে নারী ‘কলঙ্কিনী’ হয় (৫:৩৯:৮০)। কারণটা সহজেই অনুমান করা যায়, তেমন নারীকে ‘স্বামী-পরিত্যক্তা’ বা ‘স্বামী ও শ্বশুরকুলের অপ্রীতিভাজন’ বলে মনে করা হত এবং তাঁর চেয়ে বড় ‘কলঙ্ক’ কমই ছিল। স্বয়ং ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’ নারীর ‘নিন্দা’ করে বলেছেন – নারী হল সমস্ত অমঙ্গলের মূল (১২:৬); ‘ভীষ্ম’ বলেছেন – নারীর দ্বারা ‘বংশ কলঙ্কিত’ হয় (১২:৪-৮); ‘কৃষ্ণ’ বলেছেন – নারী কলঙ্কিত হলে ‘বর্ণসংকর’ হয় এবং তার থেকে ‘চূড়ান্ত সর্বনাশ’ হয় (৬:২৩:৪১)।

ক্ৰমে ক্ৰমে কৈশোরের পরে নারীর বিবাহ ‘বাধ্যতামূলক’ বলে গণিত হল, কুমারী নারীর কথা বড় একটা আর শোনা যেত না। ‘কুণিগর্গের কন্যা’ বহুদিন তপস্যা করার পরে যখন স্বৰ্গে উত্তম স্থান লাভ করার জন্য ‘দেহত্যাগ’ করতে উদ্যত হলেন তখন নারদ এসে তাঁকে বললেন, কুমারী কন্যার জন্যে স্বর্গে কোনও সম্মানের আসন নেই, কারণ, সে ‘অশুচি’। অগত্যা ওই বর্ষীয়সী তাপসীকে বিবাহ করে তার পরে প্রাণত্যাগ করতে হল (৯:৫২:১)। ওই অধ্যায়েই আর একটি ‘অনুঢ়া নারী’র কাহিনী আছে। যৌবনে তিনি বিবাহের অনেক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ কোনওটিই তাঁর মনের মতো ছিল না। বহুদিন তপস্যা করার পর তাঁকেও শুনতে হল ‘অবিবাহিতা নারী অশুচি’, অতএব একরাত্রির জন্য তাঁকে স্ত্রী হতে হল যাতে তিনি স্বর্গে স্থান পান। ‘তপস্বিনী সুলভা’ যখন রাজা জনকের সভায় ‘দার্শনিকতত্ত্ব’ আলোচনার জন্য আসেন তখন ‘জনক’ নানা ‘বিদ্রুপাত্মক কঠোর বাক্যে’ তাঁকে আলোচনা থেকে ‘নিবৃত্ত’ করার চেষ্টা করেন। নিতান্তই জ্ঞানের অন্বেষণে এসে এত রূঢ় কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি পরদিনই সভা ত্যাগ করে চলে যান (১২:৩২০)। উল্লেখ্য, ‘গার্গী’র প্রশ্নে কোণঠাসা হয়ে ‘যাজ্ঞবল্ক্য’ও তাঁকে নিবৃত্ত করার প্রয়াসে বলেন – অতিরিক্ত প্রশ্ন কোরোনা গার্গী, তোমার মাথা খসে পড়বে। এমন কথা কোনও পুরুষ বিদ্যার্থীকে তো ‘জনক’ বা ‘যজ্ঞবল্ক্য’ বলেননি কখনও। এ-কাহিনীগুলি থেকে বোঝা যায়; প্রথমতঃ, অবিবাহিতা নারীকে নিয়ে সমাজ ‘স্বস্তি’ পেত না, বিবাহ তাঁর পক্ষে তাই ‘বাধ্যতামূলক’ হয়ে উঠল। ‘জরৎকারু ঋষি’র ক্ষেত্র ভিন্ন, সেখানে তিনি বিবাহ করে ‘পুত্রসন্তান’ উৎপাদন না করলে পূর্বপুরুষদের পিণ্ড-তৰ্পণের ব্যবস্থা হয় না, তাই তাঁর বিবাহের প্রয়োজন; তাঁর নিজের স্বৰ্গপ্ৰাপ্তির বাধা হত না তপস্যায়। বস্তুত ‘শাস্ত্ৰে’, ‘সাহিত্যে’ বহু অকৃতদার তপস্বীর কথা পাওয়া যায় যাঁদের কৌমার্যের জন্যে স্বৰ্গলাভে কোনও ব্যাঘাত হয়নি। দ্বিতীয়তঃ, শিক্ষিতা নারী সংখ্যায় নিতান্তই মুষ্টিমেয় ছিল বলে সহসা কোনও ‘বিদুষী’ ও ‘বুদ্ধিমতী’ নারীর সামনে এলে পুরুষ কিছু ‘বিচলিত বোধ’ করতেন। ব্ৰহ্মজ্ঞানের ফল যে ‘সমদৰ্শিতা’ সেটা তো নারী ও শূদ্রে এসে বরাবরই ঠেকে গেছে, ‘শিক্ষিতা নারী’ তাই প্রতিপক্ষ পুরুষের উষ্মাই জাগাত, সে শিক্ষার্থিনী হয়ে এলেও পুরুষ হয়তো নিরাপদ বোধ করত না।

নারীর কাছে সমাজের প্রত্যাশা হল সে ‘সুন্দরী’, ‘স্বাস্থ্যবতী’ ও ‘গৃহকর্মনিপুণ’ হবে; স্বামী ও শ্বশুরকুলের জন্যে উদয়াস্ত ‘পরিশ্রম’ করবে; ‘সন্তান’, মুখ্যত পুত্রসন্তানের জন্ম দেবে; তাঁদের ‘লালন’ এবং স্বামী ও তাঁর আত্মীয়দের ‘সেবা’ করবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা তাঁর ‘মন’, ‘চিন্তা’, ‘ব্যক্তিত্ব’ থাকবে না। সে ‘ছায়ানুগামিনী’ হবে তাঁর স্বামীর। যদিও তেমন স্ত্রীর ভাগ্যেও ‘সন্দেহ’ ও ‘লাঞ্ছনা’ জুটবে, এ ‘সীতা’র ভাগ্য থেকেই জানা যায়। নারীর, বিশেষত স্ত্রীর ‘প্রতিশব্দগুলি’, লক্ষ্য করলেও খানিকটা বোঝা যায় সমাজে তাঁর স্থান কী ছিল। রামায়ণ-মহাভারতে এই বর্ণনা ও সম্বোধনে প্রথম এ শব্দগুলির দেখা মেলে; পরবর্তী সাহিত্যে এই জাতীয় বিশেষণাত্মক শব্দ চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে। কয়েকটি দেখলেই বোঝা যাবে কোন সংজ্ঞায় নারী সমাজে ও সাহিত্যে আবির্ভূত – ‘ভার্যা’, ‘যাঁকে ভরণ করা হয়’, ভৃত্যের সঙ্গে এর পার্থক্য শুধু ‘প্রত্যয়’টিতে। এইখানেই পুরুষের জোর স্পষ্টতঃ, নারীকে সে অন্ন জোগায়, কারণ নিজের ভরণপোষণ অর্জন করার মতো বিদ্যা তাঁকে দেওয়া হত না। বৃত্তিতে বা সম্পত্তিতে তাঁকে অধিকারও দেওয়া হত না; তাই সে একান্তই নির্ভরশীল ছিল স্বামীর ওপরে। ‘কামিনী’, ‘রমণী’, কান্তাশেষের দুটি শব্দ পুংলিঙ্গে ‘প্রিয়া’ বোঝায়, অর্থাৎ ‘একটি নারীর পক্ষে যে পুরুষ প্রিয় সে তারই রমণ ও কান্ত’; কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে ব্যক্তিনিরপেক্ষ এই সংজ্ঞা, যেন তাঁর ধর্মই পুরুষের তৃপ্তিবিধান করা। আর একটি প্রতিশব্দ, ‘জায়া’, যাতে পুরুষ সন্তানরূপে জাত হয়। এছাড়াও বৰ্ণনাত্মক সম্বোধনগুলির অধিকাংশই ‘দেহের অনুষঙ্গ বহন করে’, যেমন – ‘রস্তোরু’, ‘সুশ্রোণী’, ‘পীনস্তনী’ ইত্যাদি (আরও নিচে, কতকটা ‘অপমানসূচক’ অথচ বহুলব্যবহৃত শব্দ ‘বরারোহা’ ইত্যাদিও আছে) মুখ্যতঃ ‘যৌনসম্ভোগের বস্তুরূপেই’ নারীর পরিচয়।

নারীকে সমাজে স্থান দেওয়ার প্রশ্নই যাতে না ওঠে এমন কতকগুলি ‘ব্যবস্থা’ ছিল। দুই-একটি ‘ব্যতিক্রম’ বাদে সাধারণ ভাবে শিক্ষায় নারীর ‘অধিকার’ ছিল না। এই সময়কারই রচনা ‘মনুসংহিতা’। সেটি পুত্রের শিক্ষাব্যবস্থার ‘বিধান’ দেওয়ার পর বলেছে – ‘‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযত্নতঃ’’, অর্থাৎ কন্যাকেও এই রকম শিক্ষা দিতে হবে এবং অতি যত্নে পালন করতে হবে; কিন্তু ঠিক তার পরেই বলা আছে – ‘নারীর পক্ষে বিবাহ হল উপনয়ন’, ‘পতিগৃহে বাস হল গুরুগৃহে বাস’ এবং ‘পতিসেবা হল বেদধ্যয়ন’ (মনুসংহিতা ২:৬৭)। অর্থাৎ বিবাহ করে পতিগৃহে থেকে পতিসেবা করাই তাঁর বেদপাঠের বিকল্প, তাতে একই ফল লাভ করবে। ফল যাই লাভ করুক না কেন বিদ্যা তো সে লাভ করল না। এটা ঠিক যে,

‘‘পুরাকল্পে তু নারীণাং মৌঞ্জীবন্ধনমিষ্যতে।
অধ্যাপনঞ্চ বেদনাং সাবিত্রীবচনং তথা।।’’

অর্থাৎ, ‘‘পুরাকল্পে কিন্তু নারীদের উপবীত ধারণ, বেদ অধ্যাপনা এবং সাবিত্রী পাঠ (প্রবর্তিত) ছিল।’’ (স্মৃতি চন্দ্ৰিকা, সংস্কারকাণ্ড, মহীশূর সংস্করণ, ৬২ পৃষ্ঠা)

কিংবা ‘হারীতধর্মশাস্ত্র’-তে রয়েছে, ‘‘দ্বিবিধা স্ত্রিয়ো ব্ৰহ্মবাদিন্যঃসিদ্যোবধাবশাচ’’ – নারী দু-প্রকারের, ‘ব্ৰহ্মবাদিনী’ ও ‘সদোবধূ’। এত কিছু সত্বেও সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যের ‘ব্ৰহ্মবাদিনী’দের আঙুলে গোনা যায়। বাকি সবই তো ‘সদোবধূ’, যাঁদের পতিসেবাই হল বেদাভ্যাস। শিক্ষা ছাড়াও সম্পত্তিতে নারীর ‘অধিকার’ ছিল না। এর ফলেও সমাজে স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে স্থান পাওয়াও তাঁর পক্ষে কঠিন ছিল, কারণ ভরণপোষণের জন্য তাঁকে পরমুখাপেক্ষী হতেই হত, তা সে পিতাই হোক বা স্বামীই হোক। তৃতীয়তঃ, কোনও ‘অর্থকরী বৃত্তির শিক্ষা বা ব্যবহার’ তাঁর পক্ষে ‘নিষিদ্ধ’ ছিল; হয়তো সমাজের একেবারে নিচের স্তরের মেয়েরা ‘কুটিরশিল্প’ ইত্যাদি ‘বৃত্তিকরী বিদ্যার চর্চা’ করে সংসারে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য করতে পারত। কিন্তু, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত স্তরে নারীর কোনও বৃত্তির কথা রামায়ণ বা মহাভারত-এ (বা অন্যত্র কোথাও বড় একটা) পাওয়া যায় না। ফলে সে পুরুষের ওপরে আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল হতে বাধ্য হত। চতুর্থতঃ, সমসাময়িক শাস্ত্ৰে ও সাহিত্যে দেখা যায়, নারীর নিজের দেহের ওপরেও কোনও অধিকার ছিলনা। একমাত্র ব্যতিক্রম ‘গণিকা’, যাঁর শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব ‘রাষ্ট্র’ বহন করত। তাঁর দেহের ওপরে বেশ খানিকটা স্বাধীনতা তাঁর ছিল এবং সে অন্নবস্ত্রের জন্যে কোনও পুরুষের দয়ার ওপরে নির্ভর করত না। যত গর্হিতই হোক তাঁর বৃত্তি – এবং নিঃসংশয়ে তা অত্যন্ত গৰ্হিত ছিল – তার দ্বারা সে স্বাধীন ভাবে উপাৰ্জন করতে পারত।

‘গণিকা’ই হোক ‘কুলবধূ’ই হোক, পুরুষের মনোরঞ্জনের দ্বারাই নারীর ভরনপোষনের সংস্থান হত। মর্তের গণিকা ‘স্বর্গের অপ্সরারূপে চিত্রিত’ – তাঁদের যে বিবরণ পাওয়া যায় তা থেকে সমাজে ‘রূপোপজীবিনীর আচরণ’, ‘ভূমিকা’ ও ‘স্থান’ জানা যায়। রামায়ণ-মহাভারতে সর্বত্রই ‘অপ্সরা’ আসে ঋষির ধ্যানভঙ্গ করতে বা অন্য ভাবে ইষ্টসিদ্ধি করতে, যেমন – ‘ঋষ্যশৃঙ্গ উপাখ্যানে’। এঁরা ‘রূপসী চিরতরুণী’, কিন্তু এঁদের ভূমিকা পুরোপুরি ‘নিষ্ক্রিয়’; ‘ইন্দ্র’ বা অন্য দেবতারা কোনও ঋষির ‘তাপে’ বা ‘যজ্ঞে’ ‘অসহিষ্ণু’ ও ‘বিচলিত’ বোধ করলে অপ্সরা পাঠিয়ে তাঁদের ‘ধ্যানভঙ্গ’ ঘটাতেন। ইষ্টসিদ্ধি হলে পর এঁরা স্বর্গে ফিরে আসত। এই যে চিত্তবৃত্তিবর্জিত দেহসর্বস্ব তরুণীর কল্পনা, মোটের ওপর এই ছিল নারীর কাছে পুরুষের প্রত্যাশা। সে যেন শুধুই ‘ভোগ্যবস্তু’; তা না হলে ‘রাম’ উচ্চারণ করে ‘সীতা’কে বলতে পারতেন না, ‘‘নোৎসাহে পরিভোগায়’’ – ‘‘(তোমাকে) ভোগ করতে পারি না।’’

নারীর এই ‘ভোগ্যবস্তু’ ভূমিকা রামায়ণ-মহাভারতে নানা ভাবে চিত্রিত আছে। প্রথমতঃ উপাখ্যানে। অসংখ্য উপাখ্যানে নারী এই ভূমিকায় অবতীর্ণ। একটি কাহিনী উল্লেখ করা যেতে পারে –

‘‘ঋষিকুমার গালব যযাতির কাছে এলেন। গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সংগতি নেই। তাই রাজা যদি তাঁকে অর্থসাহায্য করেন। ঠিক সেই সময়ে যযাতির অর্থসংকট ছিল, তাই গালবকে বললেন, তুমি আমার এই সুন্দরী তরুণী কন্যা মাধবীকে নিয়ে যাও। কোনও রাজার কাছে এক বৎসরের জন্যে এঁকে দিলে রাজা এঁর কাছ থেকে যে পুত্রসন্তান লাভ করবেন তার বিনিময়ে তোমাকে অর্থ দেবেন। গালব মাধবীকে নিয়ে পরপর তিনজন রাজাকে এক এক বছরের জন্যে ভাড়া দিলেন। বিনিময়ে যে অর্থ পেলেন তা দিয়ে অবশেষে তাঁর গুরুদক্ষিণার উপযুক্ত অর্থ সঞ্চিত হল। তখন তিনি মাধবীকে পিতা যযাতির কাছে এনে ফিরিয়ে দিলেন।’’ (মহাভারত; ৫.১১৮-২২)

এ কাহিনীতে ‘নারীর স্থান’ মর্মান্তিক রূপে স্পষ্ট। প্রথমতঃ, পিতা নিজে অর্থদান করতে না পেরে কুমারী কন্যাকে প্রায় ‘গণিকাবৃত্তি’তে ঠেলে দিচ্ছেন, নিজে ব্ৰাহ্মণকুমারকে গুরুদক্ষিণার অর্থ দেওয়ার পুণ্যটি লাভ করবার জন্যে। দ্বিতীয়তঃ, সমাজে এমন অন্তত তিন জন রাজা পাওয়া গেল যাঁরা সুন্দরী তরুণী কুমারীটির দেহ এক বৎসরের জন্য ভাড়া করতে দ্বিধা করেন না; পুত্রসন্তান লাভ করার কি নিষ্ঠুর হৃদয়হীন উপায়। তৃতীয়তঃ, ব্ৰাহ্মণ ঋষিকুমার অনায়াসে এ-কদৰ্য উপায়ে লব্ধ অর্থ নিলেন এবং নিজের উদ্যমে তিন জন রাজার কাছে মাধবীকে বাঁধা দিয়ে সে অর্থসংগ্রহ করলেন। চতুর্থতঃ, এই ভাবে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে গুরুদক্ষিণা দিতে তাঁর বিবেকে বাধল না। কাহিনীটির কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই ভাবে যে মেয়েটির ‘লাঞ্ছনা’ ও ‘নিগ্ৰহ’ হল ‘যযাতি’ তাঁকে বিবাহ করতে বললেন, সে সম্মত হল না, ‘তপস্যা’ করতে গেল। ‘যযাতি’ স্বৰ্গে যাওয়ার সময়ে দেখা গেল তাঁর সঞ্চিত পুণ্যে কিছু কম পড়ছে, তখন ‘মাধবী’র পুণ্য থেকে সেটুকু পুরণ করে তিনি স্বৰ্গে গেলেন। সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ঐহিক পারমার্থিক সর্বপ্রকার ‘বঞ্চনা’ই ‘মাধবী’র ভাগ্যে জুটল। এসবের পশ্চাতে সমাজমানসে যে বোধটি সক্রিয় ছিল তা হল – ‘নারী ব্যক্তি নয়, বস্তু এবং ভোগ্যবস্তু’।

এই বোধ বারে বারে প্রমাণিত হয় যখন দেখা যায় – ‘হস্তী’, ‘হিরণ্য’, ‘রথ’, ‘অশ্ব’, ‘ভূমি’ ইত্যাদির সঙ্গে নারীও যুক্ত হচ্ছে ‘দানের তালিকায়’ (১:১৯৮:১৬, ৮১; ৮১:৩৭; ২২১:৪৯; ৪:৩৪:৫; ১৫:১৪:৪ এবং অন্যত্র বহু স্থানে)। এ দান ‘বিবাহে’, ‘শ্রাদ্ধে’, ‘বিজয়োৎসবে’, ‘অতিথি আপ্যায়নে’, ‘যজ্ঞে’ এবং ‘সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে’। অর্থাৎ ‘নারীর দেহ ও শ্রম পুরুষের ভোগ্যবস্তু’, এ নিয়ে শাস্ত্রকারদের কিছুমাত্র ‘কুণ্ঠা’ নেই; এবং এ প্রথা চলে আসছিল ‘বৈদিক কাল’ থেকেই। মহাভারতে একাধিক কাহিনী আছে যেখানে অতিথিকে ‘আপ্যায়ন’ করতে গৃহস্বামী আপনি স্ত্রীকে পাঠাচ্ছেন তাঁর শয়নকক্ষে। কখনও বা অতিথির ‘স্বরূপ’ পরে ‘ধ্যানযোগে’ জানা যাচ্ছে যে তিনি সাক্ষাৎ ‘ধর্ম’; কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়; স্ত্রীকে পাঠাবার সময়ে (বা গুরুর অবর্তমানে শিষ্য যখন ‘গুরুপত্নী’কে অতিথির কাছে পাঠায়) তখন তো জানা ছিল না যে, অতিথি সাক্ষাৎ ‘ধর্ম’, তখন ‘মানুষ’ জেনেই তো পাঠানো হয়েছিল।

নারী যে ‘প্রলোভন’ সে কথা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবার জন্য এক নারী অপ্সরা ‘পঞ্চচুড়া’কে দিয়েই বলানো হয়েছে – নারীর কামবৃত্তি স্বভাবতই পুরুষের থেকে অধিক (১৩:৩৮)। অপ্সরা হল ‘গণিকার স্বর্গের প্রতিরূপ’; তাহলেও এ আখ্যান উদ্দেশ্যমূলক তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। ‘ভীষ্ম’ ‘যুধিষ্ঠির’কে বলেন – আদিকালে পুরুষ এতই ধর্মপরায়ণ ছিল যে দেবতাদের ঈর্ষা হল, তাঁরা তখন নারীর সৃষ্টি করলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ধর্মচ্যুত করবার জন্য (১৩:৪২)। এক্ষেত্রে ‘বাইবেল’-এ ঈভের ভূমিকা স্মরণীয়। তবু ‘ঈভ’ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ‘আদম’কে প্রলুব্ধ করেনি, স্বয়ং ‘শয়তান’ তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিল। সেখানে মহাভারতে বলা হয়েছে নারীর স্বভাবই হল পুরুষের অধঃপতন ঘটানো, স্বয়ং দেবতারা তাকে এ কাজের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।

প্রথম যুগের রচিত অংশে নারী ‘পুরুষের সমকক্ষ’ না হলেও অনেক অংশে তাঁর আচরণের ‘স্বাধীনতা’ ছিল; তাঁর চিন্তা করার ক্ষমতা এবং স্বতন্ত্র মানসিকতা স্বীকৃত হয়েছিল। অর্থাৎ তখন সে ‘ব্যক্তি’ ছিল, ‘বস্তু’তে পরিণত হয়নি, যদিও তাঁর চেতনার গভীরে ধীরে ধীরে ‘অনুপ্রবিষ্ট’ হচ্ছিল পুরুষের তুলনায় সে ‘হীনতর জীব’ এবং তাঁর ওপরে পুরুষের যেন এক ‘বিধিনির্দিষ্ট অধিকার’ আছে। একটি উপাখ্যান অনুধাবন করলে এটি স্পষ্ট হয়। দ্যুতসভায় যুধিষ্ঠির যখন জুয়াতে একে একে সব সম্পত্তি, ভাইদের এবং নিজেকেও বাজি রেখে হারলেন, আর কিছুই যখন অবশিষ্ট রইল না; তখন কৌরবদের প্ররোচনায় ‘দ্রৌপদী’কে বাজি রেখে খেললেন, এবং হারলেন। কৌরবদূত যখন অন্তঃপুরে ‘দ্ৰৌপদী’কে এ সংবাদ দিল, মনস্বিনী নারী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘যুধিষ্ঠির কি আগে নিজেকে বাজিত হেরেছেন, না। আগে আমাকে বাজি রেখে হারিয়ে পরে নিজেকে হেরেছেন?’ অর্থাৎ আগে নিজেকে হারলে তো ‘দ্ৰৌপদী’ তখন আর তাঁর ‘সম্পত্তি’ নন। এ প্রশ্নের মধ্যে দ্ৰৌপদীর ‘স্বাধীন চিন্তার পরিচয়’ আছে। কিন্তু ওই তেজস্বিনী নারীও অবহিত ছিলেন না যে, আগে হোক পরে হোক তাঁকে বাজি রাখার অধিকারই যুধিষ্ঠিরের ছিল না। এই ধরনের ছোটখাট উক্তি ও ঘটনার মধ্যেই ধরা পড়ে সমাজে নারীর স্থান তখনই এতটাই অবনমিত যে চেতনায় নারী ‘অধীন’ হয়ে রয়েছে।

‘সাবিত্রীর উপাখ্যানে’ নারীর পূর্বতন কিছু স্বাধীনতা দেখতে পাওয়া যায়। ‘রাজা অশ্বপতি’ পুত্রের জন্য বর চেয়ে পেলেন তেজস্বিনী কন্যা, ‘সাবিত্রী’। সাবিত্রী যৌবনে উপনীতা হলে অশ্বপতি সেই ‘জ্বলন্তীমিব তেজসা’ কন্যাকে বললেন –

‘‘ইদং মে বচনং শ্রাত্বা ভর্তৃরন্বেষণে ত্বর।
দেবতানাং যথা বাচ্যে না ভবেয়ং তথা কুরু।।’’

অর্থাৎ, ‘‘আমার এই কথা শুনে স্বামীর সন্ধানে ত্বরান্বিত হও, যাতে আমি দেবতাদের কাছে নিন্দিত না হই।’’ (৩.২৭৭.২৬)

তখন সাবিত্রী বৃদ্ধ সচিবদের সঙ্গে নিয়ে রথে চড়ে রাজর্ষিদের তপোবনে অন্বেষণ করতে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন সভায় ‘নারদ’ ‘অশ্বপতি’কে অনুরোধ করছেন কন্যার বিবাহের জন্যে। অশ্বাপতি সাবিত্রীকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন ‘দুমৎসেনের পুত্ৰ সত্যবান’কে তিনি ‘নির্বাচন’ করেছেন। নারদ সত্যবানের নানা গুণের প্রশংসা করে বললেন তাঁর একমাত্ৰ দোষ হল, তাঁর পরমায়ু মাত্র এক বৎসর। শুনেই অশ্বপতি সাবিত্রীকে বললেন, তুমি অন্য কাউকে বরণ কর সাবিত্রী। সাবিত্রী বললেন –

‘‘সকৃদংশো নিপততি সকৃৎ কন্যা প্ৰদীয়তে।
সকৃন্দাহ দদানীতি স্ত্রীণ্যেতানি সকৃৎ সকৃৎ।।

দীর্ঘায়ুরথবাল্পায়ুঃ সগুণো নিগুণোপি বা।
সকৃদ্ধৃতো ময়া ভর্তা ন দ্বিতীয়ং বৃণোম্যহম।।

মনসা নিশ্চয়ং কৃত্বা ততো বাচাভিধীয়তে।
ক্রিয়তে কর্মণা পশ্চাৎ প্ৰমাণং মে মনস্ততঃ।।’’

অর্থাৎ, ‘‘(অংশবিভাগের সময়ে) ভাগ একবারই পড়ে; কন্যাকে একবারই সম্প্রদান করা হয়; ‘দান করলাম’ এ কথা একবারই বলা হয় – এ তিনটি একবার একবারই হয়। দীর্ঘায়ু অথবা অল্পায়ু হোন, গুণবান অথবা নিগুণ হোন, একবার স্বামীকে বরণ করেছি, দ্বিতীয় কাউকে বরণ করব না। লোক মনে নিশ্চয় করে, কথায় উচ্চারণ করে বলে, পরে (সেটা) কাজে করে; এ ব্যাপারে আমার মনই প্ৰমাণ।’’ (৩:২৭৮:২৫-২৭)

এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে, ‘পিতা অশ্বপতি’ এবং ‘দেবর্ষি নারদ’, দুই মান্যজনের নির্দেশ পরামর্শ উপেক্ষা করে, প্ৰকাশ্য রাজসভায়, সাবিত্রী যাঁকে ভালবেসেছেন তাঁকেই বিয়ে করবেন এই মর্মে তর্ক করলেন এবং তাঁর মত উপেক্ষিত হল না। তিনি যাঁকে চেয়েছিলেন তাঁকেই বরণ করতে পারলেন। সমাজের এই স্থিতিস্থাপকতা, যা গান্ধৰ্ববিবাহেও স্বীকৃত, তা ক্রমেই লুপ্ত হয়ে গেল। এই সব নারীরা – ‘সাবিত্রী’, ‘সীতা’, ‘দময়ন্তী’ – এঁরা গভীর প্রেমের বশে স্বামীর জন্যে যে ‘ত্যাগস্বীকার’ করেছেন, পরবর্তী যুগে সেইটে ‘পতিব্ৰতা ধর্মের অনুশাসনে’ পরিণত হল কিন্তু যে শক্তিতে তাঁরা তা করতে পেরেছেন সেই মৃত্যুঞ্জয় প্রেমের সার্বভৌমতা, তার কোনও স্বতঃস্ফুর্তি স্বীকার করবার শক্তি সমাজে আর রইল না।

ফলে ‘পতিব্ৰতাধর্ম’ কতকগুলি যান্ত্রিক নির্দেশের সমাহারে পরিণত হল; এর খুব ভাল একটি দৃষ্টান্ত ‘বনপর্বে’ যেখানে ‘সত্যভামা’ ‘দ্রৌপদী’কে প্রশ্ন করছেন, পাঁচটি স্বামীকে তুমি কী উপায়ে তুষ্ট এবং বশীভুত রেখেছ?

‘‘তব বশ্যা হি সততং পাণ্ডবাঃ প্রিয়দর্শনে।
মুখাপেক্ষাশ্চ তে সর্বে তত্ত্বমেতদব্ৰবীহি মে৷।’’

অর্থাৎ, ‘‘অয়ি প্রিয়দর্শনে, পাণ্ডবরা যে সর্বদাই তোমার বশে আছে, তোমার মুখাপেক্ষী হয়ে আছে তার রহস্যটি আমাকে বল।’’ (৩:২২২:৫)

সত্যভামা জানতে চাইলেন কোনও ‘রাসায়নিক চুৰ্ণ’ বা ‘মন্ত্ৰ’ দ্ৰৌপদী ব্যবহার করেন কিনা। দ্ৰৌপদী বললেন –

‘‘ন জাতু বশগো ভর্তা শ্ৰিয়াঃ সান্মন্ত্রকারণাৎ
পাপানুগান্তু পাপাস্তাঃ পতীনুপসৃজন্তুত।
ন জাতু বিপ্ৰিয়ং ভর্তুঃ স্ক্রিয়াঃ কাৰ্য্যং কথঞ্চন।’’

অর্থাৎ, ‘‘ওইসব যারা ব্যবহার করে, তাঁরা পাপিষ্ঠ, পাপের অনুসরণ করে স্বামীদের ক্ষতি করে। স্বামীর অপ্রিয় কিছু করা স্ত্রীর কখনও উচিত নয়।’’ (৩:২২২:১২-১৬)

পরে দ্ৰৌপদী বললেন কি করে তিনি পাঁচটি স্বামীকে তুষ্ট রাখেন –

‘‘‘‘দুব্যাহৃতচ্ছকিমানা দুঃখিতাব্দুরবেক্ষিতাৎ।
দুরসিতাদুৰ্ব্বজিতাদিঙ্গিতাধ্যসিতাদপি।।

না ভুক্তব্বতি নামাতে নাসংবিদ্ষ্টে চ ভৰ্তরি।
ন সংবিশামি নামামি সদা কর্মকারেন্থাপি।।

নিরত্যাহং সদা সত্যে! ভর্তৃণামুপসেবনে।
পত্যাশ্রয়ো হি মে ধর্মে মতঃ স্ত্রীণাং সনাতনঃ।
সব দেবঃ সি গতিনান্য তস্য কা বিপ্ৰিয়ং চরেৎ।।’’

অর্থাৎ, ‘‘মন্দ কথা বলতে আমার শঙ্কা হয়, দুঃখিত হয়ে অপ্রিয় ভাবে দৃষ্টিপাত করতেও, অপ্রিয় ভাবে থাকতে, চলতে, ইঙ্গিত করতে, আসন প্রহণ করতেও শঙ্কা হয়। স্বামীর এবং ভৃত্যদের ভোজন সাঙ্গ না হলে আমি আহার করি না, স্নান সমাপ্ত না হলে স্নান করি না, তিনি না উপবেশন করলে বসি না। সত্যভামা, আমি অহরহ স্বামীদের সেবায় নিরত। আমার মতে স্ত্রীদের সনাতন ধর্মপতিকে অবলম্বন করেই। স্বামীই দেবতা, স্বামীই গতি, এমন যে স্বামী কে তার অপ্ৰিয় আচরণ করবো?’’

নিজের আচরণ সম্বন্ধে দ্ৰৌপদী আরও বলছেন –

‘‘অহং পতীয়াতিশয়ে নাত্যশ্নে নাতিভুষয়ে।
নাপি পরিবদে শ্বশুং সর্বদা পরিযান্ত্রিতা।।’’

অর্থাৎ, ‘‘আমি স্বামীদের চেয়ে বেশি শয়ন, ভোজন ও অলংকরণ করি না। শাশুড়ির সঙ্গে তর্ক করি না, সর্বদা বশবর্তিনী হয়ে থাকি।’’

এই দ্ৰৌপদী প্রাথমিক ক্ষত্ৰিয়কাহিনীর দ্ৰৌপদী নন, আর কিছু না হোক স্বামীদের বিশেষত জ্যেষ্ঠ এবং শ্রেষ্ঠ ধৰ্মজ্ঞ স্বামী যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তিনি শুধু ‘তর্ক’ করেননি, প্রচুর ‘ধিক্কার’ এবং ‘অনুযোগ’ করেছেন। দ্ৰৌপদীর এত বশংবদ রূপ মূল কাহিনিতে পাওয়া যায় না; ব্রাহ্মণ্য অংশের রচয়িতা যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য এক দ্রৌপদী সৃষ্টি করলেন। এর শক্তির আর একটি উৎস ওইখানেই দেওয়া আছে –

‘‘সর্বংরাজ্ঞঃ সমুদয়৷মায়ং চ ব্যয়মেব চ।
একাহং বেষ্মি কল্যাণি! পাণ্ডবানাং যশস্বিনাম।
একাহং বেগ্নি কোশং বৈ পতীনাং ধৰ্মচারিণাম।’’

অর্থাৎ, ‘‘কল্যাণি! রাজার ও যশস্বী পাণ্ডবদের সমস্ত আয় এবং ব্যয় একা আমিই জানি। ধর্মচারী স্বামীদের ধনভাণ্ডারের বিষয়ে একা আমিই জানি।’’

এ দ্ৰৌপদী মূল কাহিনীরর, যাঁর ব্যক্তিত্বকে নানা ভাবে সম্মান দেখিয়েছেন কবি, পরবর্তীর্ণ ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের কালে শেষদিকের ধর্মসূত্রগুলির চাপে সম্পত্তিতে নারীর কোনও অধিকার ছিল না। অবশ্য এখানেও দ্ৰৌপদী আয়ব্যয়ের অধিকারিণী, সে কথা বলা নেই। বলা আছে, তিনি শুধু সব কিছুর খবর এবং হিসাব রাখেন। তবু ‘ধৰ্মসূত্রে’ যেখানে স্বামীর ধন স্বামীর প্রবাসে থাকাকালে স্ত্রী শুধু প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারেন, দান করতে পারেন না, সে যুগের পরে স্বামীরা আয়ব্যয়ের সমস্ত ব্যাপার স্ত্রীর গোচর করে রাখতেন এমন মনে করবার কোনও হেতু নেই। ‘মনু’ এবং অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রকাররা এ ব্যাপারে রূঢ় ভাবেই ‘স্পষ্টভাষী’। দ্রৌপদী ক্ষত্ৰিয়কাহিনীর ‘নায়িকা’, তিনি কিছু কিছু অধিকারে স্বামীদের কাছে ‘সমতা’ ভোগ করতেন – এ সেই প্রথম যুগের নারীর বর্ণনা। তাঁর সঙ্গে তুলনা ‘কুন্তী’র, ‘গান্ধারী’র, যাঁরা প্রয়োজন মতো স্বামীর সঙ্গে ‘তর্ক’ করেছেন, স্বামীকে ‘দোষারোপ’ করেছেন, ‘গঞ্জনা’ দিয়েছেন। অর্থাৎ এ সেই যুগের চিত্র যখনও নারীকে সর্বতো ভাবে ‘পুরুষের বশ্যতাস্বীকার’ করতে হয়নি। ‘মানুষ’ হিসেবে, সমাজে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে কিছু ‘মর্যাদা’ তাঁর অবশিষ্ট ছিল।

তথ্যসূত্র:
১- প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য, সুকুমারী ভট্টাচার্য।
২- Decoding the Metaphor Mahabharata, Diwaker Ikshit Srivastava, Leadstart Publishing Pvt Ltd (২০১৭)।
৩- মহাভারতের চরিতাবলী, সুখময় ভট্টাচার্য, আনন্দ পাবলিশার্স।)

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত