| 23 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৯) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


বাড়িতে গিয়ে দেখে মা- বাবা কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে‌।

‘ কাজ ছিল না, জ্বর জ্বর বলে মনে হচ্ছে’– শ্রীমান বলল।

মা কপালে হাত দিয়ে দেখল।’ সর্দি লাগবে বোধ  হয়। তুই তাহলে বাড়িতে থাক। শুয়ে থাক। টেবিলে ভাত সাজিয়ে রাখা আছে। মহারের দাদার মৃত্যু হয়েছে। আমরা সেখানে যাচ্ছি। দেরি হবে। সন্ধ্যেবেলা আসব। পারবি তো?’ মা দরজায় তালা  মারার জন্য তালা–চাবিটা তার হাতে তুলে দিল।

বাবা তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। এই চাকরিতে ঢোকার পরে বাবা তার দিকে মমতায় ভরা প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে।

সামনের দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে মা-বাবাকে অটো ধরার জন্য বেরিয়ে যেতে দেখতে থাকল।

খালি বাড়িটাতে ঢুকতে তার ভয় করতে লাগল। বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে যেতে তার সংকোচ হল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে সে এবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। বাইরের দরজাটা ভেতর থেকে খিল লাগিয়ে বন্ধ করে দরজায় হেলান দিয়ে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর ধীরে ধীরেগিয়ে সে তার রুমে উপস্থিত হল।

বিছানা পেতে রাখা আছে।

গোলাপি রঙের একটি হ্যান্ডলুমের বেডকাভার দিয়ে বিছানাটা ঢেকে রাখা আছে। এটা নতুন কথা। তার চাকরি পাওয়ার পরের ডেভলপমেন্ট। আগে মা তার ঘরে ঢুকতই না।

অজান্তে তার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।

সে বিছানাটাতে বসে স্যান্ডেলশু-জোড়া খুলল। তার জুতো নেই। এমনিতে হাওয়াই স্যান্ডেল দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়। এই  স্যান্ডেলশু-জোড়া ভাইয়ের।এবার সে দখল করে নিয়েছিল।এখন সে পরে অফিসে যাওয়া আসা করছে। প্রথম দিন একজন মুচিকে দিয়ে রং করানোর সময় বলেছিল–’ বাবু কতদিন রং করেননি? চামড়া শক্ত হয়ে গেছে।’ সে কিছু বলেনি।

বেডকভারটার ওপরে তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু চাদরটা উঠাতে ও তার আলস্য লাগছিল। অবশেষে সে আলগোছে  তার উপরেই শুয়ে পড়ল।

ভালো লাগছে ।খুব ভালো লাগছে। নতুন গোলাপি বিছানায়শুয়ে তার খুব ভালো লাগছে।

এক চরম প্রশান্তিতে তার চোখ জোড়াবুজে এল। তার হালকাভাবে ঘুম আসতে লাগল।

আকাশটা বেগুনি হয়ে পড়ল। ঠিক উপরেরটুকু পাতলা বেগুনি এবং চারপাশের দিগ্বলয়ের চার-পাশটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর বেগুনি। ঝিরঝির করে হালকা সবুজ বর্ণের বাতাস বইতে লাগল। বাতাসের পিঠে কাঁচা শেওলার গন্ধ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাঁচা শেওলার গন্ধ পিঠে বহন করে আনছে বাতাস। পায়ের নিচে মখমলের কার্পেটের মতো কোমল বালি। কোমল। ইস,হাঁটতে কত ভালো লাগছে। হাওয়াইস্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে হাঁটলে বোধ হয় আরও ভালো লাগবে।

ছাই রঙের সূর্যটি থেকে ঈষৎ উষ্ণ কোমল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সূর্যটা যেদিন ঠান্ডা হয়ে যেতে থাকবে তখন জমাট বেঁধে হয়তোস্থায়ীভাবেরুপোর টাকার মতো হয়ে পড়বে।

ইস, গাঢ় নীল রঙের গাছের পাতাগুলি বাতাসে ঝিরঝির করে নড়ছে।

নদীর তীর ধরে, বালির উপর দিয়ে শ্রীমান ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে। আগুনে আবহাওয়ায় ধীরে ধীরে হাঁটতে তার বড়ো ভালো লাগছে। নাতি দূরে অন্য অনেকেই হাঁটছে। কেউ হয়তো তার দিকেই চলেছে, কেউ আসছে বিপরীত দিক থেকে।

ঠিক নদীর তীর ধরে সামনের দিক থেকে একজন মানুষ আসছে।

শ্রীমানের চিন্তা হল। মানুষ-টা খাড়াইয়ের এত কাছ দিয়ে কেন আসছে? কোনোভাবে যদি পার ভেঙ্গে পড়ে তাহলে মানুষটি নদীতে পড়ে যাবে। ইস,মানুষ-টা কেকিসে পেয়েছে?

মাথা নিচু করে আসতে থাকা মানুষ-টা শ্রীমানের কাছে চলে এল। ইতিমধ্যে উৎকণ্ঠায়  শ্রীমান ঘেমে উঠেছে।

একেবারে কাছে এসে মানুষ-টা শ্রীমানের দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে হাসল। তারপরে দ্রুত পায়ে চলে গেল।

শ্রীমান চমকে উঠল। হাসিটা? মানুষটা?সে ঘুরে তাকাল। মানুষ-টার মাথার পেছনদিকে একটা গোলাকার গর্ত, সেখান থেকে একটা হালকা রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে।

শ্রীমান একটা বিকট চিৎকার করে উঠল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই সেই বালির খাদানেরমানুষটা!

সে ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে বসল।

একলাফে ঘর থেকে সে বেরিয়ে এল। ভাতের টেবিলে ঢেকে রাখা এক গ্লাস জল খেয়ে সে কিছুটা প্রকৃতিস্থ হল। খারাপ স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা নিয়মিত হয়ে পড়েছে। না ঘুমিয়েও এখন সে  স্বপ্ন দেখে। সে দুহাতে মুখটা মুছল। তখনই অত্যন্ত কর্কশ শব্দে কলিং বেলটা বেজে উঠল।


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৮) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


কলিংবেলের কর্কশ শব্দে শ্রীমান লাফিয়ে উঠল।

সে সাংঘাতিকভাবে ভয় পেল। মুখ থেকে তার একটা অস্ফুট  শব্দ বেরিয়ে এল।’আহ-হ-হ’। বুকটা তার খুব জোরে ধপধপ করে উঠল।

পুনরায় একবার কলিং বেলটা বেজে উঠল। এবার কিন্তু শব্দটা আগের মতো কর্কশ  বলে মনে হল না।’নর্মাল’,অন্যদিনযেভাবে বেলটা বাজে সেরকমই বাজছে বলে মনে হল।

খাবার টেবিলের কাছের বেসিনটাতে তাড়াতাড়ি মুখে জল দিয়ে শ্রীমান সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা কাঠের।কাচ না থাকা। চোরা ফুটো নেই যে উকিদিয়েওপাশে কে আছে দেখা যাবে। পাশের জানালার পর্দা তুলে সে বাইরের দিকে উঁকি দিল।

‘ মেয়েদের মতো জানালায় উঁকি দিয়ে কী দেখছিস?’– আগন্তুক বলে উঠল।

‘ও রমেন;রমেন! তার মনটা ভালো হয়ে গেল। অনেকদিন পর রমেন এসেছে। সে নিশ্চয় অনেকক্ষণ বসবে। বড়ো ভালো হবে। মা ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত অন্তত একজন সঙ্গী হবে। তার একা থাকতে ইচ্ছা করছে না। ভয় করছে।

‘ আয়, আয় দরজাটা খুলে দিয়ে শ্রীমান বলল।’ এতদিন কোথায় ছিলি?’

‘ কী হয়েছে তোর? আজকাল মেয়েদের মতো ভেতর থেকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিস?’

শ্রীমান হাসল।

‘বাড়িতে কেউ নেই?’

‘না। মেসোর দাদা মারা গিয়েছে।মা-বাবা সেখানে গেছে। সন্ধ্যেবেলা আসবে। ভাইটি মেডিকেলে। আমার শরীরটা ভালো নেই বলে অফিস থেকে চলে এসে বাড়িতেই বসে আছি।’

শ্রীমান রমেনকে একেবারে তার শোবার করে নিয়ে গেল।

‘ অফিস? রমেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।’কী অফিস? তুই চাকরি করছিস নাকি? ধুৎ শালা।’

‘ কেন? চাকরি করা ঠিক নয় নাকি?’

‘ কত পয়সা পাবি? চলতে পারবি?

‘পয়সাই কী সব?’

‘ মূর্খের মতো কথা বলিস না।হ‍্যাঁ, পয়সাই সব’-রমেন জোর দিয়ে বলে উঠল। ‘আমি শালা তোর কাছে বিজনেসেরপ্রপোজালনিয়ে এসেছিলাম।

‘ চাকরি করলে বিজনেস করা যাবে না এমন কোনো কথা আছে নাকি?’

রমেন তার দিকে একবার তাকাল । তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল–’ এই এতক্ষণে একটাই মাত্র কাজের কথা বলেছিস। আচ্ছা কোথায় চাকরি করিস?

‘ প্রেছে।’

‘ আচ্ছা, কম্পোজিটর না মেশিনম্যান?’

শ্রীমান সশব্দে হাসল। প্রেস বললে শুধু কম্পোজিটর এবং মেশিনমেন‌ বুঝিস? আরে আমি এখন সাংবাদিক বুঝেছিস। শ্রীমান রমেনকে সমস্ত কথা খুলে বলল।

রমেন তার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল। ঠিক লাইন চুজ করেছিস দোস্ত। তোর মাথা আছে। খুব মজার লাইন। অনেক টাকা রোজগার করতে পারবি।’

শ্রীমান কিছু একটা বাধা দিতে চাওয়ায় হাতের ইশারায় তাকে থামতে বলে রমেন বলে গেল’ আর কী খাতির পাবি দোস্ত। মিনিস্টার অফিসার পুলিশ থেকে গুন্ডা– ডাকাত সবাই তোকে এখন খাতির করবে। ফোন করলেই কাজ হয়ে যাবে।’

‘ তুই বড়োপ্রাকটিক্যাল বে। একই রকম রয়েছিস।’

‘ তোর জন্য একটা জিনিস এনেছিলাম’– রমেন বলল। অনেকদিন শিলিগুড়িতে ছিলাম। আজকাল তো গুয়াহাটিতে বিজনেস হয় না, শিলিগুড়িতেই এখন সব বিজনেস হয়, জানিস তো? এখানকার সব মারোয়ারি বিজনেস ম্যানের আসল গদি এখন শিলিগুড়িতে। এখানে লোকদের দেখানোর জন্য একটা মাত্র মুনিম থাকে।’ রমেন বেগের ভেতর থেকে কাগজের মোটা একটা খাম বের করে শ্রীমানের দিকে এগিয়ে দিল।তোর পছন্দের জিনিস।খাসামাল।একবার দেখে নে।’

      শ্রীমান প্যাকেটটা খুলল।আর্ট পেপারে ছাপানো বিদেশি পর্ণোগ্রাফির একটি সুদৃশ্য বই।বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মৈ্থুনরত যুবক-যুবতির ফোটোতে পরিপূর্ণ।শ্রীমান দ্রুত বইটির পাতা উল্টাতেলাগল।রমেনহেসেথাপ মেরে বইটা বন্ধ করে দিল।

      ‘রেখে দে এখন।পরে একা একাদেখবি।আর তোকে সাতদিনেরবেশি রাখতে দেব না।বেশিদিন দেখতে দিয়ে তোর স্বাস্থ্য খারাপ করার বদনাম আমি নিতে পারব না।’

শ্রীমান হেসে বইটা তোষকের নিচে ঢুকিয়েরাখল।

      ‘সাতদিন পরে বইটা কী করবি?’

      ‘বিক্রি করে দেব।ভালো দাম পাব।তুই কেবল পাতাগুলি নোঙরা করিস না।শ্রীমানের জন্য রাখা ভাতটুকু দুই বন্ধু ভাগ করে খেতে খেতে কথা বলতে লাগল।

      ‘ও আমি তোর কাছে আসার কারণটা বলিই নি।আমি তোকে একসঙ্গে ব্যবসা করার প্রস্তাব দিতে এসেছি।’—রমেন বলল।

‘ ঢাল নেই, তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার’‐- শ্রীমান রগঢ় করল।

‘ আছে। আছে। তোদেরই খবর নেই।’

‘কী? কীসের খবর নেই?’

‘ পান বাজারে তোদের মাটি  আছে না? তিনটে টিনের ঘর রয়েছে। ভাড়াটিয়া আছে! দু কাঠার মতো মাটি হবে বোধ হয়। আমার মনে আছে।’

দুটো বড়োরুম। সেগুলি থাকা না থাকা একই কথা।ছশো  টাকা ভাড়া দেয়। কুড়ি বছর ধরে আছে। লম্বায় মাটি কিন্তু অনেকটা আছে– প্রায় তিন কাঠা।’

‘ ভাড়াটিয়া উঠিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।’– রমেন বলল।’ মাটি খালি করার পরে সেখানে মার্কেট বানাব। মালিক হিসেবে তোরা এক অংশ পাবি। বাকিটা বিক্রি করে দেব, ভাড়ায় দেব। তোর আমার ফিফটিফিফটি।’

‘ কিন্তু ভাড়াটিয়া কীভাবে উঠাবি? কোর্টে কেস দিয়েভাড়া জমা দেয়।’

‘ সেটা আমার কাজ।আরে ভাই,প্রাণের ভয় প্রত্যেকেরই আছে। প্রাণ সংশয় দেখলে সুরসুর করে বাড়ি ছেড়ে পালাবে। আরে ভাই আমি অফার দেব মার্কেটের দুটো ঘর কিনে নে। যদি না কেনে একটা দুটোকেউঠিয়েদিলেই খেলা খতম। আমার লোক আছে। দরকার হলে মেরে লাশ গুম করে দিতে পারি।’

‘ কী বলছিস,তুই এসব কি বলছিস?’ শ্রীমান হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল।’ মানুষ মেরে লাশ গুম করে দিবি…’

শ্রীমানের এই ধরনের ভাবান্তর দেখে রমেন আশ্চর্য হল।

‘ কী হল তোর? আমি কথাটা বলেছি হে। আজকাল তো এসবই চলে। মার্ডার করার কথা বলিনি, কিন্তু ভয় না দেখালে কি কাজ চলে?

‘ কিন্তু মানুষ মেরে লাশ গুম করে দেওয়া এসব কী কথা?’

‘ আরে তুই বুঝিস না কেন? মানুষ মারাটা কি এতই সহজ? কথা সেটা নয়। কথাটা বর্তমানের যে অনিশ্চয়তা, যেখানে সেখানে মানুষ মরছে, খুন হচ্ছে, গোপনে কেউ কাউকে মারছে ,এই অবস্থায় প্রত্যেকেরই মনে ভয় ঢুকেছে। এই অবস্থায় আসলে ভয় দেখালে তাড়াতাড়ি কাজ হয়। এতদিন ভাড়াটিয়ারা তোদের ঠগিয়ে এসেছে। আজ যদি আমি আমার ছেলেদের নিয়ে যাই, বন্দুক বারুদ নিয়ে যাই, তাহলে সহজে তারা একটা যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব মেনে নেবে।’

‘ তুই এসব কাজ কোথায় শিখলি? আগে করেছিস নাকি?’

‘ লাইফে অনেক কাজই করেছি দোস্ত’– রমেনবিজ্ঞেরমতো বলল।’ এখন পর্যন্ত মার্ডারকরিনি। কিন্তু দরকার হলে করতে পারব। তুলে নিয়েগিয়ে মেরে লাশ গুম করে দিতে পারব। কিন্তু সেরকম করতে হবে না বলেই মনে হয়।’

শ্রীমান অবাক হয়ে রমনের দিকে তাকাল।’ কাউকে ভয় দেখানোর জন্য উঠিয়েছিস নাকি?’

‘ উঠিয়েছি।’– পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে বেশ স্টাইলের সঙ্গে একটা জ্বালিয়েনিয়ে সে বলল।

‘ বলতো একটা কাহিনি’– শ্রীমান বলল।

‘শোন। একটা লোক খুব দিগদার করছিল। কোথাকার মানুষ কি দিগদার  দিচ্ছিল জিজ্ঞেস করিস না’– রমেনকাহিনি বলতে শুরু করল।’ কোনো যুক্তির কথা শোনে না, বুঝেছিস। একেবারে গোঁয়ার মানুষটা। বেশি অসুবিধা করায় একদিন সন্ধ্যাবেলা উঠিয়েদিলাম, একটা মারুতি গাড়িতে উঠিয়ে চোখ মুখ বেঁধে তাকে  একেবারে নির্জন একটা জায়গায়নিয়ে গেলাম। ব্রহ্মপুত্রের তীরে একটি চর অঞ্চলে। সেখানে পলিমাটিখুড়ে  নিয়ে গর্ত করা ছিল। একটা গর্তের সামনে তাকে হাঁটু মুডে বসতে বাধ্য করলাম, বললাম– শেষবারের মতো চিন্তা করে দেখ। হয় সম্মত হয়েযা, না হলে মেরে এখানেই পুঁতে  রাখব…ঐ তোর কী হয়েছে,শ্রীমান, কী হয়েছে তোর?’নিজের মতে কাহিনি বর্ণনা করে যাওয়া রমেনহঠাৎ শ্রীমানের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। তার চোখ দুটি বড়োবড়ো হয়ে উঠেছে । দাঁতে দাঁত চেপে সে সজোরে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। হাত দুটো সে মুঠো করে ধরে হাঁপানি আক্রান্ত মানুষের মতো নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছে।

‘ আরে, তোর কি হয়েছে?’ এই শ্রীমান? রমেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা এনে একটু জল তার মুখে ছিটিয়েদিল।জল মুখে পড়ায় শ্রীমান যেন সামান্য প্রকৃতিস্থ হল। সে দুহাতে বিছানার কাছটা  ধরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল।

‘ তোর মৃগী  আছে নাকি?’ রমেনভয়পেয়েছিল।

শ্রীমান মাথা নাড়ল। হ্যাঁ আছে। সে মিথ্যা কথা বলল। তার রমেনকে বিরাট ভয় করতে লাগল। সে যেন রমেনের কাছ থেকে দূরে পালিয়ে যেতে পারলে বেঁচে যায়। কিন্তু সে কীভাবে যাবে? কোথায় যাবে? রমেন নিজে থেকে বেরিয়ে না গেলে তো উপায় নেই। সে জড়সড়ো হয়ে বিছানায় বসে পড়ল।

‘ ডাক্তারকে দেখিয়েছিস? ঔষধ খেয়েছিস?রমেন জিজ্ঞেস করল।

‘ খেয়েছি’সে মিথ্যা বলল।’ উত্তেজনায়বেশি অসুবিধা হয়। তোর কথা শুনে আমি আসলে চমকে গেছি ,বুঝেছিস।’ শ্রীমান সাবলীলভাবে মিথ্যা কথা বলে গেল।

রমেন অনেকটা আশ্বস্ত হল। সে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।

‘ তুই থাক। থাকতে পারবি তো? অসুবিধা হবে না তো? আমি আগামীকাল সকালে শিলিগুড়ি যাব।একদিন থেকে আবার ফিরে আসব। তুই তোর বাবার সঙ্গে জমিটা  সম্পর্কে কথা বলে রাখবি। নাকি আমি এসে কথা বলব?’

‘ আমি, আমি কথা বলব।’–শ্রীমান বলল।

‘ ঠিক আছে। তুই বল। বাবা ভয় করতে পারে। বলবি দলিলপত্র আগে সব পাকা করে নেওয়া হবে। গুয়াহাটির আরও কত বড়োবড়ো মানুষের জমি আমি বের করে দিয়েছি, এগ্রিমেন্ট করে দিয়েছি। সব বলব। প্রত্যেকেরই ভালো হয়েছে।’

রমেনকে বিদায় দিয়ে শ্রীমান দরজার হুক লাগিয়ে দিল। বন্ধ দরজায় পিঠ রেখে সে ফোঁপাতে আরম্ভ করল। সে হঠাৎ কেন এত ভয় পেল? কেন? এটা একটা কয়েনসিডেন্স–অন্য কিছু নয়। সে নিজেকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করল। আমাকে এই ভয়টা মন থেকে বের করে দিতে হবে। তাকে পারতেই হবে। সে জোর করে নিজেকে বোঝাল। নিজেকে প্রবোধ দিয়ে এবার সে রান্না ঘরে গেল। গ্যাসে চায়ের জল বসিয়ে দিল। এক কাপ চা করে খেলে ভালো লাগবে। কাপ, ছাঁকনি, চায়ের ডিবে সবকিছু সে নিজের কাছে গুটিয়েনিল। গ্যাসে জলের সসপ্যানটা তুলে দিয়ে জল গরম হতে হতে সে ভাবতে আরম্ভ করলঃ

‘ আচ্ছা, এই রমেনটা এতদিন পরে হঠাৎ কেন এসে উপস্থিত হল? সে আগেও শিলিগুড়িতেগিয়েছে, তাকে এই ধরনের বই বা অন্য কোনো জিনিস এনে দিয়েছে। কিন্তু বহুদিন তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। সে কী করছে? কোথায় আছে সে কিছুই জানে না।আগে সে কারও সঙ্গে ব্যবসা করত। কলেজে পড়ার সময় থেকেই তার এই ধান্দা। বিজনেস করতে হবে। টাকার দরকার। কিন্তু এতদিন পরে এখন হঠাৎ কোথা থেকে এসে উপস্থিত হল। এসে তার কাছে মানুষ উঠিয়েদেওয়া, মেরে লাশ গুম করে দেওয়া, এই সমস্ত কথা বলল। কী, মতবটা কি? সে কি ইচ্ছা করেই আমার সামনে এসব কথা বলছে? বালির খাদানের ঘটনাটা আমি  জানি বলে সে কিছু সন্দেহ করছে নাকি? সেই জন্য কথা বের করার জন্য সে এসেছিল? যে দলে সেই কাজটা করেছিল তার মধ্যে কি জানি ও ছিল। অফিসে যাওয়া বালির খাদানের সেই মানুষটার সঙ্গে ওর কোনো যোগাযোগ আছে নাকি? নাহলে এতগুলি কথা মিলে যাবে কি…’

শ্রীমানের বুকটা পুনরায় ধপধপ করে উঠতে লাগল।

সসপেনের জলটা উথলে উঠে চড়চড় শব্দ করায় তার সম্বিৎ ফিরে এল। সে পুনরায় এক কাপ জল এনে সসপানে ঢেলে দিল। তাড়াহুড়ো করে এক কাপ লাল চা করে সে নিজের শোবার ঘরে গেল । সন্ধে হতে শুরু করেছে ।

সে দ্রুত হাতে ডাইনিংরুম এবং তার ঘরের জানালাগুলি লাগিয়ে দিল। এখনই মশা ঢুকতে শুরু করবে।

জানালা বন্ধ করার পরে সে পর্দা টেনে দিল। ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। সে এবার সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে দিল। লাইট জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। ভেন্টিলেটর গুলির কাচের বাইরে ইতিমধ্যেই অন্ধকার জমা হতে শুরু করেছে।

সে এখন কী করবে?

সর্বনাশা ভয় এবং চিন্তাগুলি থেকে দূরে থাকার জন্য সে কিছু একটা করা উচিত। এখন ও পর্যন্ত মা-বাবাই বা কেন আসছে না। সময় তো অনেক হল। মরা মানুষের বাড়িতে গিয়ে এতক্ষন কী করছে? কেবল মরা মানুষ। মরা মানুষ।

তার হঠাৎ রমেন এনে দেওয়া বইটার কথা মনে পড়ল। সে তোষকের নিচ থেকে বইটা বের করে আনল।

বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়েএকপাতা দু পাতা করে উল্টে সে বইটা দেখতে লাগল। একটা সময় তার উত্তেজনা এসে গেল। হাতটা আপনা আপনি দুই উরুর মাঝখানে এগিয়ে গেল।

একটা সময়ে রঙ্গিণ ছবি দেখতে দেখতে সে স্বমৈথুনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সে চোখ জোড়া জোর  করে বন্ধ করে নিল, শরীরটা ক্রমে ধনুকের আকৃতি হয়ে পড়ল, নিশ্বাস হয়ে পড়ল ঘন ঘন এবং জরুরী, মুখটা থুতুতে ভরে উঠল।

ঠিক‐ঠিক, চরম মুহূর্তটিতে পুনরায় একবার অতি কর্কশ শব্দে কলিং বেলটা বেজে উঠল।

সে ভয়ঙ্কর ভাবে চমকে উঠল। তার মুখে জমা হয়ে থাকা থুতুগুলিতে সে ভয়ানক ভাবে চর্চরিনি খেয়ে কাশতে শুরু করল।

   

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত