| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

গল্প: চোরের সর্দার । ইকবাল তাজওলী

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

                                    

আমি একজন চোর। আসলে আরও ক্লিয়ার করে বললে চোরের সর্দার। চোরের সর্দার হলেও ওই চোরই তো। চোর থেকে চোরের সর্দার হয়েছি।

তবে হ্যাঁ, চোর হলেও আমার কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষা আছে। একদম বকলম বলে উল্লেখ করা যাবে না আমাকে। নিজেকে স্বশিক্ষিত বলে জোর আমি দাবি করি এবং করছিও। নিশ্চয়ই আমার কথা বলার প্রবণতা থেকে আপনারাও কমবেশি আন্দাজ করতে পারছেন। কোনো রকম টেনেটুনে এইট পাশ করে নাইনে ওঠার সুযোগ এই আমার মতো একজন অধমের কিন্তু হয়েছিল। এবং মাস ছয়েক নাইনের ক্লাসও এই আমার মতো আদমও কিন্তু করেছিল!

একদম ছিন্নমূল পরিবারের সন্তান হলেও যে কোনো মূল্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেও আমার প্রবলভাবে ছিল। কিন্তু ওই আক্কাস শালার কারণে আমার সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। কসম খোদার, আক্কাস যদি আমাকে আমার জন্মদাত্রী মা তোলে অশ্লীল গালিটি উচ্চারণ না করত, তাহলে তাকে আমি স্টেবিং করতাম না, আর স্কুল থেকে বহিস্কারও হতাম না। এখানে একটা কথা যোগ করে নেয়া ভালো, আমাদের সমাজে, আরও ক্লিয়ার করে বললে আমাদের কারুরই ব্যক্তিগত ভকাবুলারিতে শ্লীল- অশ্লীল বলে কোনো বিদঘুটে শব্দ জমা নেই। সবই শ্লীল, আবার সবই অশ্লীল। তারপরও, মায়ের ওপর কেউ ইলজাম লাগিয়ে দিলে আর তার রক্ষা নেই। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন। একবার তো এই কারণে ক্লাসমেট এক পুলিশের ব্যাটাকে টিফিন পিরিয়ডের পর অ্যায়সা প্যাঁদানি দিয়েছিলাম যে, রাগে আর না হয় ভয়ে ভীতুর ডিম শালা আমাদের নিজেদের ক্লাসরুমে প্যান্ট ভরে হিসি করে দিয়েছিল! তখন অবশ্য ক্লাস ফোরের ছাত্র ছিলাম আমি। আব্দুল আলি স্যার এসে আমাকে দুএকটা কিল-ঘুসি-চড় মেরে শাসন করে তারপর তাঁর ক্লাস আরম্ভ করেছিলেন। ক্লাস ফোরে পড়লেও তখন আমার বয়স ছিল কিন্তু বারো, আর ওই ভদ্রলোকের সন্তানদের গড়পড়তা বয়স ছিল কিন্তু দশ।

যাইহোক, স্কুলে আমার আরও অনেক ঘটনা আছে। আমি আর আমার ক্লাসমেট চোরের ব্যাটা চোর খাইরুলের কাজই ছিল নিয়মিত কারুর না কারুর কলম হাতিয়ে নেয়া। তারপর তো লোভ আমার আরও বেড়ে গেল। লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু কথাটা জানলেও আমি পাপ আর মৃত্যুর ভয়ে সেই সময়ে ভীতু ছিলাম না। ব্যাটা ছেলে হয়ে জন্মেছি যখন, তখন এইসব কথায় আমার চিঁড়েও ভিজিত না। কাজেই, কাজ চালিয়ে যাওয়া অব্যাহত রেখেছিলাম এই আমি।

আর ওই আক্কাস শালার প্রতি রিষ ছিল আমার আগে থেকেই। একবার না, পর পর দুবার আমার সঙ্গে রং করার সাহস দেখিয়েছিল শালার ব্যাটা শালা। প্রথমবার তো কিছুই বলিনি, কিন্তু দ্বিতীয়বার আর ব্যাটাকে ছাড় দিইনি।

ওকে স্টেবিং করার আরও একটি কারণ ছিল, আমাদের ক্লাসের রোল নং ওয়ান ইমতিয়াজ মাহমুদ একদিন হারমোনিকা নিয়ে এসে ক্লাসে টিফিন পিরিয়ডের সময়ে রোমান্টিক গানের সুরে হারমোনিকায়  ঝড় তোলে খুব ভাব নিচ্ছিল, এমন ভাব যে, আমার খাতিরের মানুষ সুয়াদা পর্যন্ত টাসকি খেয়ে মুগ্ধ  হয়ে হা করে ইমতিয়াজ মাহমুদের দিকে তাকিয়ে মনের স্বাদ মেটাচ্ছিল! আমার আবার সিঁদুরে মেঘ দেখার ভয় আছে প্রবলভাবে ! তখন কেবল সুয়াদার সঙ্গে ভাব বিনিময় এই আরকি  শুরু করেছি একটু-আধটু। আর ইমতিয়াজ মাহমুদ মটুর ব্যাটা মটু হারমোনিকা নিয়ে এসে সবকিছু জয় করে নিয়ে যাবে! তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মটু ইমতিয়াজের হারমোনিকা লোপাট করে লাপাত্তা করে দিতে হবে যে কোনো উপায়ে। যেই ভাবা সেই কাজ। রেকি-টেকি করে পাক্কা তিনদিনে কাজটি সম্পন্ন করেছিলাম। মটু ইমতিয়াজ টেরই পায়নি। কেবল হাপিত্যেশ করে একে ওকে বলে মনকে হালকা করেছিল। এটি নাকি ওর বড়োভাই ফিনল্যাণ্ড না কোত্থেকে ওর জন্যে পাঠিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হারমোনিকাটি আমি লাপাত্তা করিনি। দিন সাতেক লুকিয়ে রেখে স্কুলের বাইরে হাটে-মাঠে-ঘাটে সর্বত্রই বাজিয়ে ভাব নেয়ার চেষ্টা করেছি।

আমার আবার সুর কী! ওগুলো আমি তো আমি, আমার বস্তিরও কেউ কখনো বাজাতে পারত না। তারপরও যখন বাজানোর একটা চেষ্টাচরিত্র করতাম, মনে একটা জোশ এসে যেত। আর সেই জোশে আমার আরেক খাতিরের মানুষ আমাদের বস্তির মারজিয়া এসে আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করত। বলত,‘ বড়ো মৌজে আছিস দেখি, আনিস।’

পিতৃপ্রদত্ত নাম আমার আনসার আলি হলেও মারজিয়ার কাছে আমি কেবল আনিস আর আনিস। তখন পর্যন্ত মুচকি হেসে মারজিয়ার কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতাম এই আমি আনিস।

একদিন মারজিয়া বলেই ফেলল,‘কী হইছে! কথা বলিস না কেন, আনিস! তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। একটু সময় দিস।’

আর শালা হারামজাদা আক্কাস, তুই আমার গরিবের ভাই গরিব হয়েও ওই বড়োলোকের ব্যাটা মটু ইমতিয়াজকে বলে দিলি! ঠাপ তো আমি দিই না শালা। ওই বড়োলোকের ব্যাটারাই তো দেয়। নাকি কালু গুন্ডার সাঙাত হয়ে সাপের পাঁচ পা দেখতে শুরু করে দিয়েছিলি! শালা, তোকে তো তখন জানে মারিনি আমি। সেই হিসাব আছে তোর!

তারপর কী আর করা, নিজ থেকেই আলিয়া মাদ্রাসায় গেলাম আরকি। মাস ছয়েক মাদ্রাসায় যাওয়া-আসা করেছি।

ওই সময় সরকারের শিক্ষা জরিপ না কী একটা জরিপ চলছিল মাদ্রাসা সহ বেসরকারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আমাদের জনাবদের মধ্যে আমির উদ্দিন নামে একজন জনাব ছিলেন বিএসসি টিচার। চলনেবলনে কী তুখোড় শিক্ষক ছিলেন তিনি! আমরা তাঁকে মাদ্রাসার সেরা শিক্ষক মানতাম, এবং সেইভাবে সম্মানও করতাম। সেই আমির উদ্দিন জনাব ধরা খেয়ে গেলেন! তাঁর নাকি বিএসসি ডিগ্রিই ভূয়া! আরেকজন কামিল নামও তাঁর কামিল ডিগ্রিও তাঁর কামিল সঙ্গে বিএ। এই তিনি সর্বশেষ বিএ ডিগ্রির সার্টিফিকেট দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন!

আর বাবা আমার তখনও বদমাশ-লুচ্চাদের দলে নিজের নাম অ্যান্ট্রি করেননি। সে সময়ে কী পরিশ্রমই না তিনি করতেন! সংসারের চারটা ডাল-ভাতের জন্যে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হন্যে হয়ে রিক্সা চালাতেন। তারপর ঘরে ফিরে চা-বিড়ি খেয়ে লোকার এলিটদের ক্লাবে গভীর রাত পর্যন্ত ফরমায়েশ খাটতেন। ওখানেই সুরায় তাঁর দীক্ষা হয়েছিল। এলিটদের খেয়ে তলানিতে কিছু রয়ে গেলে সেটা তিনি গলাধঃকরণ করতেন। তারপর বাড়ি এসে প্রায় প্রতিদিনই মাকে মারধর করতেন। দেখতে দেখতে একদিন অ্যায়সা বুজরুকি দেখালাম, আর থাকলেন না; পালিয়ে গেলেন। তখন জানলাম, তিনি আমার মায়ের স্বামী। বাবা নন আমার। কিন্তু বাবা না হলেও তিনি আমার বাবাই ছিলেন।  কেবল জন্ম দিলেই তো বাবা হওয়া যায় না; পিতা হওয়া যায় না। আরও অনেক যোগ্যতা লাগে। সেইসব যোগ্যতা অনায়াসে তিনি উতরে গিয়েছিলেন! একটা সময় তাঁকে হন্য হয়ে খুঁজেছি। শহর-বন্দর-গ্রামে কোথাও তাঁকে আর পাইনি। পেলে তাঁর চরণ ধূলি নিতাম। প্রায়শ্চিত্ত করতাম। বাজান বলে জড়িয়ে ধরতাম।

এতদিন তো যা-ই খাই সরকারি হোটেলেই খাচ্ছিলাম। বাবা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে আমাদের মা-ছেলেকে নিঃস্বার্থভাবে খাওয়াচ্ছিলেন। তা লাটে উঠল আমারই দোষে।

খেতে তো হবে, তাই পড়ালেখায় ইতি টেনে পৃথিবীর পাঠশালায় ছাত্র হয়ে গেলাম।

বাড়িও ছাড়লাম।

দিন সাতেক এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করেছি। রিক্সাও চালিয়েছি বছর খানেক নিজ শহর থেকে লাগোয়া আরেকটি শহরে। সৎপথেই জীবনযাপন করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ওই যে আমার শৈশব-কৈশোরের অভ্যাস। ওই অভ্যাসই আমাকে ছাড়ল না। অভ্যাসের দাস হয়ে গেলাম আমি। তারপর নেমপ্লেট সরিয়ে চোরাই বাজারে রিক্সা বিক্রি করে বাড়ি ফিরলাম।

মা কাঁদতে কাঁদতে বরণ করলেন।

বললেন,‘যাই করিস বাপ, বাড়ি থেকে কর।’

বিকেলবেলা মারজিয়াকে দেখলাম। সাজুগুজু করে কোথায় যেন যাচ্ছে। দেখেও না দেখার ভান করল! চোখ আমার মানুষ চিনতে ভুল করে না। নটী-বেশ্যার খাতায় কোথাও নাম লিখিয়েছে আর কি মারজিয়া।

 

পুরোনো সাঙাতদের খুঁজে পেতে সময় লাগেনি আমার। শুক্কুর, জাম্বু, জিয়াফত, রবিন, আর ল্যাঙড়া্ হারুণকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেল চোরচক্র গঠন করে বেঁচে-বর্তে থাকার জন্যে দুনম্বরি কাজ শুরু করেছিলাম। শুক্কুর আর জাম্বু খুবই এক্সপার্ট ছিল। নিমিষেই কাজ সম্পাদন করে ফেলত। টার্গেট ছিল আমাদের মাসে অন্তত দুটো নতুন মোটরসাইকেল কবজায় নেয়া। কোনো কোনো মাসে তিনটি এমনকি চারটিও কবজায় নিতে পারতাম।

লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু কথাটি আগেই বলেছি। তারপরও এই লোভ সামলাতে পারিনি। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্র করেছিলাম। উত্তর এসেছিলো,‘দেখাও তো সমাজে কে ভালো মানুষ? তোমার জনাবদের-স্যারদেরও তো এই ভালো মানুষদের কাতারে রাখা যায় না। তাহলে কে ভালো মানুষ! কাজেই, দুনিয়াটা মস্ত বড়ো, খাওদাও ফুর্তি কর।’

লিডার মানুষ। চোরচক্রের লিডার হলেও লিডারই তো। তাই মোটরসাইকেলে বাড়ি যাই, আবার বাড়ি থেকে আসি মোটরসাইকেলে।

এভাবে সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই মারজিয়া দেখি সিগন্যাল একটা দিল।

‘আনিস ভাই, একটু দাঁড়াও।’

আশ্চর্য হলাম একটু। আবার ভাবও এলো মনে। যাক তাহলে ভাই ডাক শুনতে পাচ্ছি। আমি তো ভাইই। শুক্কুর, জাম্বু আর রবিনরা তো ভাই ডাকে আমাকে। কেবল ল্যাংড়া হারুন বস ডাকে। তবে বসই সুন্দর। একটা লিডার লিডার ভাব আসে মনে।

‘কী রে মারজিয়া, কী? ভালো আছিস?’

‘আমাদের আর ভালো থাকা!’

‘কেন, কী হইছে?’

‘একটা উপকার কর।’

‘বল।’

‘আক্কাসের কাছে থেকে আমার টাকা উদ্ধার করে দাও। কোন দিন নিছিল, আর ফেরত দেয় না।’

‘আমার কি ক্ষমতা আছে?’

‘আছে। এটা তোমার জন্যে কোনো ব্যাপারই না।’

মারজিয়া তাহলে আজকাল আমার সব খবরই রাখে। ল্যাংড়া হারুণকে দিয়ে খবর পাঠালে কাজ হয়ে যাবে। জীবনে কারুরই তো কোনো উপকার করতে পারলাম না। এই উপকারটুকু অন্তত করি। টাকা উদ্ধার করে দিই।

কিন্তু টাকা উদ্ধার হলো না। বরং ল্যাংড়া হারুণ খুন হয়ে গেল।

ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে হারিয়ে আমার তখন রক্ত উঠে গেছে মাথায়। শুক্কুর, জাম্বু আর রবিনকে নিয়ে ওইদিন রাতে ওত পেতে থেকে আক্কাসকে শেষ করলাম। তারপর তার বস কালু গুন্ডাকে।

             

                                   

না, আমার কিছুই হয়নি। জেলও হয়নি, ফাঁসিও হয়নি।

আমি তো আর আনসার আলি না। আর আমার জন্মনিবন্ধনও নেই। ইচ্ছে করেই জন্মনিবন্ধন করিনি। খামোখা করে প্যাচ লাগাবার দরকারটা কী, তাই করিনি। বরং ন্যাশনাল আইডি কার্ড করার সময় বুদ্ধি করে নিজের নাম, মায়ের নাম আর বাজানের নাম বদলিয়েছিলাম বলেই পুলিশ আদালতে শুক্কুর, জাম্বু আর রবিনের অনুপস্থিতিতে বিচার চলা কালে আমি যে আনসার আলি তা চেষ্টা সত্ত্বেও প্রমাণ করতে পারেনি। কেবল লাভের ওপর বছর চারেক জেলখানায় অর্থাৎ সরকারি হোস্টেলে বসবাস করতে হয়েছে এই আর কি।

তবে মারজিয়া আর নেই। ওই সরকারি হোস্টেলে বসবাস করার সময় কে বা কারা মারজিয়াকে নৃশংসভাবে খুন করেছে শুনেছি।

মারজিয়ার জন্যে দুঃখ হয়। সামান্য কটা টাকা উদ্ধার করে দিতে পারলাম না তাকে। জীবনে অন্তত একটা ভালো কাজ হতো আমার দ্বারা। হায় রে মারজিয়া।

                                                                                   

 

 

                                                                                

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত