| 28 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

বিশেষ রচনা: মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় । দিলীপ মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট
অসুরদের অত্যাচারের প্রতিকার প্রার্থনায় দেবী সরস্বতী এলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে। সরস্বতীর বিবরণ শুনে ব্রহ্মা স্তব শুরু করলেন চক্রপাণি নারায়ণের। নারায়ণ তাঁকে অভয় দিয়ে জানালেন যে, কংসের ভগিনী বসুদেবের পত্নী দৈবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন নারায়ণ। তিনিই বিনাশ করবেন কংসকে।
যথাসময়ে বিবাহ হল বসুদেবের। কংসের ভগিনী দৈবকীর সঙ্গে। একদিন বয়স্যদের সঙ্গে ভ্রমণকালে কংস চমকে উঠলেন এক দৈববাণী শুনে। দৈবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান হবেন কংসের মৃত্যুর কারণ। দৈববাণী শুনে কংস আতঙ্কিত। তিনি বসুদেবকে ডেকে বলে দিলেন দৈবকীর গর্ভজাত সমস্ত সন্তানকে তুলে দিতে হবে কংসের হাতে। বাধ্য হয়ে সম্মত হতে হল বসুদেবকে।
একে একে ছয়টি সন্তান হল দৈবকীর। তাদের তুলে দেওয়া হল কংসের হাতে। কংস কিন্তু তাদের হত্যা করেননি। হত্যা করলেন দেবর্ষি নারদের প্ররোচনায়। বসুদেব ও দৈবকীকে নিক্ষেপ করা হল কারাগারে। নিযুক্ত করা হল সতর্ক প্রহরা। রোহিনী ছিলেন বসুদেবের আর এক পত্নী। দৈবকীর সপ্তম গর্ভের সময় ভগবাতী কৌশলে সেই গর্ভকে রোহিনীর উদরে প্রবিষ্ট করালেন। সেই গর্ভ থেকে জ্ন্ম হল বলভদ্র বা বলরামের। দৈবকীর অষ্টম গর্ভের সময় চঞ্চল হয়ে উঠলেন কংস। দৈববাণীতে বলা হয়েছিল এই অষ্টম গর্ভের সন্তান কংসের প্রাণঘাতী হবে। তাই কারাগারে পাহারা আরও কড়াকড়ি ব্যবস্থা করা হল । সেখানকার খবর নিয়মিত রাখতে লাগলেন কংস।
কিন্তু দৈবমায়ায় কংসের সব সতর্কতা ব্যর্থ হল।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমি তিথি। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। রাত্রির প্রথম প্রহরে প্রহরীরা অভিভূত হল নিদ্রায়। দ্বিতীয় প্রহরে আকাশে উদিত হল চন্দ্র। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে জন্মগ্রহণ করলেন নন্দপুরচন্দ্র কৃষ্ণ। অপূর্ব তাঁর রূপশ্রী। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী। দক্ষিণে লক্ষ্মী , বামে সরস্বতী। কৃষ্ণ দৈবকীকে বললেন, ‘ত্রেতাযুগে তোমরা স্বামী-স্ত্রী নিরাহারে তপস্যা করেছিলে দ্বাদশ বৎসর। তাই আমি তোমাদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছি। ’
কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার। তাঁকে প্রণাম করলেন দৈবকী। দৈবমায়ায় বন্ধনমুক্ত হলেন বসুদেব। তারপর শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন গোকুলের দিকে। শৃগালের ছদ্মবেশে মহামায়া তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন বাসুকী।
এদিকে নন্দালয়ে যশোদা প্রসব করেছেন এক কন্যাসন্তানের। আপন পুত্রকে নিদ্রিতা যশোদার কোলের কাছে রেখে যশোদার কন্যাকে কোলে নিয়ে বসুদেব ফিরে এলেন মধুপুরের কারাগারে। কেউ কিছু জানতে পারল না। বসুদেব দৈবকীর কোলে তুলে দিলেন সেই কন্যাসন্তানকে। দৈবমায়ার ঘোর কেটে যাবার পর জাগ্রত হল প্রহরীরা। তারা জানল দৈবকীর গর্ভে জন্ম হয়েছে এক কন্যাসন্তানের। খবর গেল কংসের কাছে। কারাগারে তৎক্ষণাৎ হাজির কংস। নবজাত কন্যাসন্তানকে তিনি শিলাপট্টের উপর আছড়ে ফেললেন। তখনই হল এক দৈববাণী : তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।
প্রথমে একটু অবাক হলেন কংস। এ কি কথা! তাহলে কি তাঁর প্রাণহন্তা আছে গোকুলে? তিনি আদেশ দিলেন গোকুলের সব নবজাত শিশুকে হত্যা করার। সন্ধান পাওয়া গেল নন্দ-যশোদার ঘরে জন্মেছে এক শিশুপুত্র। বিষস্তন পান করিয়ে তাকে হত্যার জন্য পাঠানো হল পুতনা রাক্ষসীকে। কিন্তু পুতনা নিজেই নিহত হল। এ ভাবেই নিহত হল তৃণাবর্ত অসুর। শিশুর এই পরাক্রম দেখে গোকুলবাসী তাঁকে অবতার বলে মনে করল। যশোদাও কৃষ্ণের মুখবিবরের মধ্যে দেখতে পেলেন ব্রহ্মাণ্ডকে। সন্দেহ রইল না আর।
শিশু কৃষ্ণ কিশোর হতে লাগলেন। তাঁর অলৌকিক শক্তি দেখতে লাগল গোকুলবাসী। শাপগ্রস্ত যমল অর্জুনকে মুক্ত করলেন তিনি। বৃক্ষ উৎপাটিত করে উদ্ধার করলেন বৃক্ষরূপী নল-কুবেরকে। ব্রহ্মা তাঁর গোবৎস হরণ করেছিলেন। কৃষ্ণ সেই গোবৎসকে সৃজন করেন অলৌকিক মায়ায়। কালীদহের জল বিষাক্ত করছিল কালীনাগ। কালীদহে নেমে কৃষ্ণ হত্যা করলেন কালীনাগকে। এতে শাপমুক্ত হন কালীনাগ। তিনি কৃষ্ণের পদচিহ্ন মস্তকে ধারণ করে গমন করেন রমনক দ্বীপে। জ্যৈষ্ঠমাসে বনে দাবানল জ্বলে উঠলে কৃষ্ণ তা নির্বাপিত করেন। গোবর্ধন পর্বতকে উপেক্ষা করে ইন্দ্রপূজা অনুচিত বলে কৃষ্ণ বিধান দিলে ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হন। তাঁর নির্দেশে গোকুলে প্রবল বারিপাত শুরু হয়। কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বতকে ছত্ররূপে ধারণ করে রক্ষা করেন গোকুলকে। যমুনার জলে স্নানরত নন্দ ঘোষকে বরুণের দূত পাতালে বন্দি করলে তাঁকে উদ্ধার করে আনেন কৃষ্ণ। বৃন্দাবনে কাত্যায়নী ব্রত উদযাপনের সময় মহাসর্পরূপী এক অভিশপ্ত গন্ধর্ব উপস্থিত হলে কৃষ্ণের পদাঘাতে তার শাপমুক্তি ঘটে।
কৃষ্ণের এই সব অলৌকিক শক্তির সংবাদ পাচ্ছিলেন কংস। আতঙ্কিত হচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন কি ভাবে তাকে হত্যা করা যায়। সে জন্য বিভিন্ন অসুরকে তিনি প্রেরণ করেন গোকুলে। করুণ পরিণাম বরণ করতে হয় তাদের। বকরূপী বকাসুরের ঠোঁট চিরে কৃষ্ণ তাকে দ্বিখণ্ডিত করেন। গলাধঃকরণ করে বকাসুর কৃষ্ণকে হত্যা করতে চান। কৃষ্ণ তখন তার উদরে প্রবেশ করে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে নির্গত হন। ফলে মৃত্যু হয় বকাসুরের। অশ্বরূপধারী কেশী দৈত্য ও ব্যোমাসুর্কেও হত্যা করেন তিনি।
গোকুলবাসী কৃষ্ণের বীরত্বের লীলা যেমন দেখছিল, তেমনি দেখছিল গোপবালিকাদের সঙ্গে তাঁর লীলাও। একদিন গোপবালিকারা যমুনায় স্নান করতে এলে কৃষ্ণ তাঁদের বস্ত্র হরণ করেন। শরৎ পূর্ণিমায় এঁদেরই সঙ্গে বৃন্দাবনে রাসলীলা করেন তিনি।
একদিন অক্রূর এলেন বৃন্দাবনে।
কংসের বার্তাবহ হবে এসেছেন তিনি। কংস আয়োজন করেছেন ধনুর্যজ্ঞের। কৃষ্ণ-বলরামকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। মথুরায় কংসের রাজসভায় যাবার সুযোগ পেয়ে কৃষ্ণ আনন্দিত হলেন। অক্রূরেরও সুযোগ হল কৃষ্ণের নারায়ণরূপ দর্শনের। মথুরায় যাবার পথে কৃষ্ণ যখন স্নান করছিলেন যমুনায়, তখন অক্রূর তাঁর নারায়ণরূপ দর্শন করেন।
মথুরায় এলেন কৃষ্ণ-বলরাম। উঠলেন অক্রূরের আলয়ে। পরদিন প্রভাতে তাঁরা কংসের রাজসভার দিকে অগ্রসরমান হলেন। পথে দেখা হল মালাকরের সঙ্গে। তিনি কৃষ্ণকে পুষ্পমাল্য দান করলেন। সুগন্ধি চন্দন দান করলেন ত্রিবঙ্কা। তাঁদের দুজনকে আশীর্বাদ করলেন কৃষ্ণ।
খবর ছড়িয়ে পড়ল। কৃষ্ণ এসেছেন রাজসভায়। রাজসভায় পদার্পণ করে কৃষ্ণ চললেন কংসের ধর্নুময় যজ্ঞশালা দেখতে। কংস ভীত হয়ে যজ্ঞশালার প্রবেশপথে স্থাপন করলেন কুবলয় হস্তি। কিন্তু কৃষ্ণ অনায়াসে বধ করলেন তাকে। অতঃপর মল্লযুদ্ধের আসরে গেলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ও বলরামের হাতে নিহত হল চানূর ও মুষ্টিক। এবার কৃষ্ণ দ্রুতপদে অগ্রসর হলেন কংসের দিকে। মঞ্চ থেকে ভূপাতিত করে কংসকে হত্যা করলেন। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে এসে সংকল্যকেও নিহত হতে হল। অত্যাচারী কংসের মৃত্যুতে আনন্দের স্রোতে ভাসল মথুরা। কৃষ্ণ মথুরার রাজ্যভার অর্পণ করলেন উগ্রসেনকে।
অবন্তীপুরীতে সান্তিপণি নামে এক দ্বিজ ছিলেন। তাঁর কাছে কৃষ্ণ চৌষট্টি বিদ্যা শিক্ষা করেন। কৃষ্ণ তাঁকে গুরু দক্ষিণা দিতে চাইলে সান্তিপণি সমুদ্রে নিমজ্জিত পুত্রের প্রাণভিক্ষা প্রার্থনা করেন। কৃষ্ণ তখন শঙ্খরূপী পাঞ্চজন্যকে সঙ্গে নিয়ে যমপুরীতে গমন করেন এবং যমরাজকে সন্তুষ্ট করে গুরুর পুত্রকে উদ্ধার করে আনেন।
মগধের সম্রাট জরাসন্ধ ছিলেন কংসপত্নীর পিতা। কংসনিধনের পরে তাঁর বিধবা পত্নী স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পিতার কাছে আবেদন করেন। জরাসন্ধ সে আবেদনে সাড়া দেন। তিনি কৃষ্ণ-বলরামকে মৃত্যুদণ্ড দানের সিদ্ধান্ত করেন। কৃষ্ণের বিপদের দিনে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন দেবতারা। তাঁরা কৃষ্ণকে দান করেন শঙ্খ, চক্র, গদা; বলরামকে দান করেন লাঙ্গল ও মূষল। এছাড়া তাঁরা গরুড়ধ্বজ নামক এক যুদ্ধরথও দান করেন কৃষ্ণ-বলরামকে।
অতঃপর জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল কৃষ্ণ-বলরামের। কৃষ্ণ-বলরামের পরাক্রমে অচিরে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল জরাসন্ধের বাহিনী। পালাতে গিয়ে ধরা পড়লেন জরাসন্ধ। বলরাম তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে দৈববাণী হল : জরাসন্ধ অবধ্য। ছাড়া পেয়ে জরাসন্ধ সৈন্য-সামন্ত সংগ্রহ করে আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। আবারও পরাজিত হলেন। প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে লাগল জরাসন্ধের মনে। তিনি এক বিশাল বাহিনী দিয়ে শাল্বরাজকে মথুরায় পাঠালেন কৃষ্ণ-বলরামকে বধ করার জন্য।
এ রকম আকস্মিক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কৃষ্ণ। তাই তাঁরা আত্মগোপন করলেন সমুদ্রগর্ভে। তাঁদের বসবাসের জন্য সমুদ্র তাঁদের দ্বাদশ যোজন ভূমি দান করলেন। সেই ভূমিতে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা নির্মাণ করে দিলেন এক সুরম্য প্রাসাদ।
জরাসন্ধের সৈন্যরা মথুরা নগরী লণ্ডভণ্ড করতে লাগল। তারা পর্বতের পাদেশের অরণ্যে অগ্নিসংযোগ করল। ফলে ঋষিরা বিপন্ন হলেন । তাঁরা স্মরণ করলেন কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ বিশ্বম্ভর রূপ ধারণপূর্বক পর্বতকে সমুদ্রজলে নিমজ্জিত করে অগ্নি নির্বাপিত করলেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জরাসন্ধের প্রতিনিধি কালযবন পলায়ন করেন। কৃষ্ণ একটি ঘটে একটি কালসর্প স্থাপন করে দূত মারফৎ তা প্রেরণ করেন কালযবনের কাছে। চতুর কালযবন সেই ঘটে প্রচুর পিপীলিকা পূর্ণ করে আবার কৃষ্ণের কাছে প্রেরণ করেন। কৃষ্ণ ঘট খুলে দেখেন পিপীলিকাগুলি ভক্ষণ করেছে কালসর্পকে , অবশিষ্ট আছে কালসর্পের অস্থি।
কৃষ্ণ বুঝলেন কালযবন যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হতে চান না।
তাই যুদ্ধ বাধল আবার। কালযবনকে বধ করার জন্য কৃষ্ণ তখন এক কৌশল অবলম্বন করলেন। পলায়নের ছলনা করে যে গুহায় মান্ধাতার পুত্র মুচুকুন্দ নিদ্রিত ছিলেন, সেখানে প্রবেশ করে মুচুকুন্দের মাথার দিকে লুকিয়ে রইলেন। কালযবন গুহায় প্রবেশ করে মুচুকুন্দকে কৃষ্ণ ভেবে পদাঘাত করলেন। জাগ্রত হয়ে মুচুকুন্দ কালযবনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই সে ভস্মীভূত হল। তারপরে মুচুকুন্দকে বরদান করে বদরিকাশ্রমে পাঠালেন কৃষ্ণ। তিনি কালযবনের সমস্ত সম্পদ নিয়ে এলেন দ্বারকায়।
যুদ্ধ শেষ হবার পরে দ্বারকায় এলেন রেবত রাজা। সঙ্গে তাঁর বিবাহযোগ্যা কন্যা। পিতামহ ব্রহ্মার নির্দেশে তিনি তাঁর কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিতে চান বলভদ্রের। নির্বিঘগ্ন সম্পন্ন হল সে বিবাহ। কিন্তু তারপরে কৃষ্ণের বিবাহকে কেন্দ্র করে দেখা দিল গোলমাল।
বিদর্ভরাজ ভিস্মকের কন্যা রুক্মিণী। তাঁর স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করা হয়েছে। রুক্মিণীর ইচ্ছা তিনি পতিরূপে বরণ করবেন কৃষ্ণকে। রাজারও সেই ইচ্ছা। কিন্তু বাধ সেধেছেন রাজপুত্র রুক্মী। দমঘোষের পুত্র শিশুপাল তাঁর ভগ্নীর পতি হবেন, এই তাঁর ইচ্ছা। রুক্মীর এই ইচ্ছাকে সমর্থন জানান জরাসন্ধের মতো রাজারা। রুক্মী ভগ্নীর বিবাহের দিনক্ষণও স্থির করে ফেললেন। তখন নিরুপায় হবে রুক্মিণী দ্বারকায় কৃষ্ণের কাছে দূত পাঠালেন সংগোপনে। বলে দিলেন তাঁর বিবাহের দিনে কৃষ্ণ যেন তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যান । কৃষ্ণ সেই মতো রুক্মিণীকে হরণ করে তাঁর রথে তুললেন সুকৌশলে। রুক্মী , শিশুপাল প্রমুখেরা আক্রমণ করলেন তাঁদের। যুদ্ধে জয় হল কৃষ্ণের।
কৃষ্ণসখা সত্রাজিৎ বাস করতেন দ্বারকায়। তাঁর কাছে ছিল স্যমন্তক নামে এক মূল্যবান মণি। সে মণি তিনি ভ্রাতা প্রসেনকে দান করেছিলেন। একদিন প্রসেন মণি পরিশোভিত হয়ে শিকারে গমন করেন। অরণ্যে প্রসেনের মৃত্যু হয়। মণিটিরও কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন অনেকের মনে সন্দেহ হল। তাঁরা ভাবলেন মণির লোভে কৃষ্ণই হত্যা করেছেন প্রসেনকে। এই অপবাদ খণ্ডন করার জন্য কৃষ্ণ মণির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। অনুসন্ধানে তিনি অবগত হলেন মণিটি প্রথমে যায় এক সিংহের অধিকারে। তারপর সেটি অধিকার করেন ভল্লুক ঋক্ষরাজ জাম্ববান। তারপর জাম্ববানের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ হয় কৃষ্ণের। পরাজিত হন জাম্ববান। অতঃপর জাম্ববান কন্যা জাম্ববতীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহ দিয়ে যৌতুক হিসেবে স্যমন্তক মণিটি কৃষ্ণকে দান করেন। দ্বারকায় উপস্থিত হয়ে কৃষ্ণ সত্রাজিতের হাতে তুলে দিলেন স্যমন্তক মণি। আনন্দিত সত্রাজিৎ কন্যা সত্যভামার সঙ্গে বিবাহ দিলেন কৃষ্ণের।
কিন্তু সত্রাজিৎ স্যমন্তক মণিটি সুরক্ষিত রাখতে পারেন নি। শতধন্বা নামক এক ব্যক্তি সত্রাজিতকে হত্যা করে সে মণি হস্তগত করে। সে কথা অবগত হন কৃষ্ণ। তিনি শতধন্বাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে শতধন্বা সে মণি অক্রূরের কাছে গচ্ছিত রেখে পলায়ন করতে গিয়ে কৃষ্ণের হাতে নিহত হন । মণির সন্ধান আর পাওয়া যায় না। এতে সত্যভামার মনে ভুল ধারনার সৃষ্টি হয়। তিনি ভাবেন রুক্মিণীকে দিতে চান বলে কৃষ্ণ সে মণি লুক্কায়িত রেখেছেন। অক্রূর সে মণি কৃষ্ণকে ফেরত দিলে সত্যভামার ভুল ধারনা দূরীভূত হয়।
কৃষ্ণের কর্ণগোচর হল পঞ্চপাণ্ডবের মৃত্যুর সংবাদ। দুর্যোধনের চক্রান্তে তাঁরা জতুগৃহে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। প্রকৃত সংবাদ জানার জন্য কৃষ্ণ গমন করলেন হস্তিনাপুর। দেখা হল পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে। শুনলেন জতুগৃহের কাহিনি।
একদিন অর্জুনের সঙ্গে ভ্রমণ করতে গিয়ে কৃষ্ণ এক তপস্যারতা নবযৌবনা নারীকে দর্শন করেন। ইনি সূর্যনন্দিনী কালিন্দী। জনকনন্দিনী সীতার পরামর্শে নারায়নকে পতিরূপে লাভ করার জন্য তাঁর তপস্যা। যুধিষ্ঠিরের উদ্যোগে কৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহ হল কালিন্দীর। তাঁকে নিয়ে দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করলেন কৃষ্ণ। মিত্রাবিন্দার স্বয়ম্বরসভায় যোগদান করে তাঁকে হরণ করেন কৃষ্ণ। ভদ্রাজিৎ রাজার কন্যা ও নগ্নজিৎ রাজার কন্যার সঙ্গেও তাঁর বিবাহ হয়। মদ্রদেশের রাজার কন্যা লক্ষণাকে বিবাহ করলেও সেই রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় কৃষ্ণকে। মদ্ররাজ কুবেরের রথ, ইন্দ্রের অপ্সরা অদিতির কুণ্ডল অপহরণ করেছিলেন। কৃষ্ণের আক্রমণে প্রথমে নিহত হন মদ্ররাজের সখা মুর। তাই কৃষ্ণের নাম হয় মুরারি। তারপর মদ্ররাজকে পরাজিত করে কৃষ্ণ তাঁর ধন-সম্পদ দ্বারকায় নিয়ে যান।
একদা পর্বতের উপরে কৃষ্ণ ও রুক্মিনী মাধাই পূজায় নিয়োজিত ছিলেন। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন নারদ। তিনি কৃষ্ণকে স্বর্গের সমাচার দিয়ে রুক্মিণীকে দিলেন পারিজাতমালা। তারপর তিনি সত্যভামার কাছে গিয়ে বললেন যে কৃষ্ণ তাঁকে বঞ্চিত করে পারিজাতমালা দিয়েছেন আর এক পত্নী রুক্মিণীকে। অভিমানহতা হয়ে সত্যভামা বৈরাগিনীর বেশ ধারণ করলেন। তা দেখে নারদ কৃষ্ণের কাছে এসে সে কথা বিবৃত করলেন। কৃষ্ণ সত্যভামার মান ভাঙালেন অনুনয়-বিনয় করে। প্রতিশ্রুতি দিলেন সত্যভামার জন্য তিনি এনে দেবেন পারিজাতবৃক্ষ। তাই স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে কৃষ্ণ নিয়ে এলেন পারিজাতবৃক্ষ। পারিজাতের গুণে দ্বারকায় জরা-মৃত্যু দূর হল।
শোণিতপুরের রাজা বাণের কন্যা ঊষা। সেই ঊষা পার্বতীকে তপস্যায় তুষ্ট করে অবগত হয়েছিলেন যে বৈশাখ মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে যে পুরুষের সঙ্গে স্বপ্নে তাঁর মিলন হবে, সেই পুরুষই হবেন তাঁর স্বামী। তারপর স্বপ্নে মিলন হল বটে, কিন্তু ঊষা পুরুষটির সম্যক পরিচয় পেলেন না। তাঁর সখী চিত্রলেখা তাঁকে জানালেন যে স্বপ্নের সেই পুরুষ হলেন কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ। চিত্রলেখার সাহায্যে মিলন হল ঊষা-অনিরুদ্ধের। এই সংবাদ শ্রবণ করে ক্রুদ্ধ হলেন বাণরাজা। অনিরুদ্ধকে বন্দি করার জন্য সৈন্য পাঠালে তারা পরাজিত হয়। তখন বাণরাজা নাগপাশে বন্দি করলেন কৃষ্ণপৌত্র অনিরুদ্ধকে। ধ্যানে কৃষ্ণ সে কথা জানতে পেরে অনিরুদ্ধকে রক্ষা করতে মনস্থ করলেন। গরুড়ের সাহায্যে তিনি প্রবেশ করলেন বাণরাজার সুরক্ষিত আলয়ে। বাণরাজার পক্ষে ছিলেন মহাদেব। কৃষ্ণের সঙ্গে মহাদেবের যুদ্ধ হল। কৃষ্ণের বিক্রমে অস্থির হয়ে মহাদেব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করলেন দ্রুত। এবার বাণরাজার সাহায্যে এগিয়ে এলেন পার্বতী। মোহিনী বেশে আবির্ভূতা হবে তিনি নিরস্ত্র করলেন কৃষ্ণকে। সৃষ্ট হল শিবজর ও বিষ্ণুজর। তাঁরা কৃষ্ণের কাছে পরাভূত হলেন। শূল নিয়ে যুদ্ধে প্রবেশ করলেন বাণরাজা। কৃষ্ণের সুদর্শনচক্রে কাটা গেল বাণের সহস্র বাহু। সন্ধি করতে বাধ্য হলেন বাণরাজা। আড়ম্বর সহকারে বিবাহ হল ঊষা-অনিরুদ্ধের।
প্রভাসের সন্নিকটে কৃষ্ণের পুত্ররা খেলা খেলা করতে করতে তৃষ্ণার্ত হয়ে কূপের সন্ধান করেন। তাঁরা একটি কূপের ভিতর এক বৃহৎ কৃকলাসকে দেখতে পান। কিন্তু তাকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ আসেন এবং বাম হাতে উদ্ধার করেন কৃকলাসকে। কৃকলাস তাঁকে জানান যে তিনি আসলে ইক্ষুগ্বানন্দন। অনেক সৎকর্ম তিনি জীবনে করেছেন। কিন্তু ধেনুদানের ব্যাপারে দুষ্ট ব্রাহ্মণকে সন্তুষ্ট না করতে পারায় যমরাজের নির্দেশে তিনি কেঙ্কলাস যোনি প্রাপ্ত হয়ে অধোমুখে ঊর্ধ্বপদে ছিলেন। কৃষ্ণের পবিত্র স্পর্শে তিনি মুক্ত হন।
কন্যা লক্ষণার জন্য স্বয়ম্বরসভার আয়োজন করেছেন দুর্যোধন। নানা দেশের নানা রাজা সমবেত হয়েছেন সেই সভায়। অকস্মাৎ শাম্ব এসে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন লক্ষণাকে। অন্যান্য রাজারা আক্রমণ করলেন শাম্বকে। তাঁকে বন্দি করে নিক্ষেপ করা হল কারাগারে। এ কথা শুনে বলরাম এলেন হস্তিনাপুরে। দুর্যোধনকে তিনি বললেন যে শাম্ব ক্ষত্রিয়সুলভ কাজ করেছেন, তাই তাঁকে বন্দি করা উচিত হয় নি। কিন্তু অহংকারী দুর্যোধন বলরামের কথা গ্রাহ্য করলেন না। তখন বলরামের প্রচণ্ড ক্রোধে শুরু হল ভূমিকম্প। ধৃতরাষ্ট্র , ভীষ্ম প্রভৃতিরা বলরামকে তুষ্ট করতে লাগলেন। দুর্যোধনও নিজের ভুল বুঝতে পারলেন, এবং লক্ষণার সঙ্গে শাম্বের বিবাহ দিলেন।
দ্বারকার রাজসভায় বসে আছেন কৃষ্ণ। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন শৃগাল-বাসুদেবের দূত। এই শৃগাল-বাসুদেব কাশীরাজ। তাঁর ভূষণ শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম। দূতের মাধ্যমে কাশীরাজ জানিয়েছেন কৃষ্ণ যেন তাঁর ভূষণ ত্যাগ করেন। এ কথা শুনে কৃষ্ণ সহাস্যে জানালেন যে তিনি কাশীরাজের সম্মুখেই তাঁর ভূষণ ত্যাগ করবেন। কৃষ্ণের ঔদ্ধত্য সহ্য হল না কাশীরাজের। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। সুদর্শন চক্র দিয়ে কৃষ্ণ তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তখন কাশীরাজের পুত্র পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করলেন। তপস্যায় মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে কৃষ্ণকে পরাভূত করার বর লাভ করেন তিনি। এই হেতু যে যজ্ঞ তিনি করেন, তার থেকে আবির্ভূত হন এক অগ্নিময় পুরুষ। সেই পুরুষ দ্বারকার দিকে ধাবিত হলে দ্বারকাবাসী ভীত হয়ে পড়েন। তারপর কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের দ্বারা তাড়িত হয়ে তিনি দগ্ধ করেন কাশীপুর। কাশীরাজ দগ্ধীভূত হবে প্রাণ হারান।
দিনকয়েক বাদে নারদ এলেন দ্বারকায়। কৃষ্ণদর্শন করতে এসেছেন তিনি। কিন্তু কোন পত্নীর ঘরে আছেন কৃষ্ণ? অতঃপর এক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পেলেন নারদ। দেখলেন সত্যভামা, নগ্নজিতা, জাম্ববতী, লক্ষণা—সকলের ঘরেই আছেন কৃষ্ণ। লীলাময় কৃষ্ণের এই লীলায় নারদ বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। দূতের মুখে কৃষ্ণ শুনতে পেলেন জরাসন্ধের নতুন অত্যাচারের কাহিনি। যে সব রাজা কৃষ্ণের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, তাঁদের বন্দি করেছেন রাজা জরাসন্ধ । বন্দি রাজারা উদ্ধারের আশায় কৃষ্ণের শরণাপন্ন। কৃষ্ণ জরাসন্ধের সন্ধান চান। নারদ তাঁকে জানালেন যুধিষ্ঠিরের রাজসূ্য যজ্ঞে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে উপস্থিত থাকবেন জরাসন্ধ। তাই কৌশলে আক্রমণ করতে হবে। কৃষ্ণ, ভীম আর অর্জুনকে ধারণ করতে হবে সন্ন্যাসীর বেশ। অতঃপর তাঁরা তিনজন সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে জরাসন্ধের পুরীতে গমন করলেন। পথে যেতে যেতে কৃষ্ণ জরাসন্ধ এই নামকরণের কারণ ব্যাখ্যা করলেন। জরাসন্ধের পিতা মগধরাজ বৃহদথ। তাঁর পত্নী দুটি দ্বিখণ্ডিত সন্তান প্রসব করেন। সেই সন্তানকে ফেলে দেওয়া হয় বাঁশবনে। জরা নামক এক রাক্ষসী দ্বিখণ্ডিত সন্তান দুটিকে একত্রিত করে এক পূর্ণাঙ্গ মানবশিশু গঠন করেন। স্নানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন জরাসন্ধ। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন ছদ্মবেশী কৃষ্ণরা। তাঁরা জরাসন্ধের দানশীলতার প্রশংসা করে তাঁদের প্রার্থনা জানাতে চাইলেন । অতিথিদের শরীরে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন দেখে জরাসন্ধ বুঝলেন তাঁরা ব্রাহ্মণ নন, ক্ষত্রিয়। নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্যে তাঁরা ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন। কৃষ্ণ তখন তাঁদের প্রকৃত পরিচয় দিয়ে যুদ্ধের কথা বললেন। কৃষ্ণের নির্দেশে ভীম জরাসন্ধকে দ্বিখণ্ডিত করায় তাঁর মৃত্যু হল। জরাসন্ধের পুত্র সহদেবকে মগধের রাজা করে , বন্দি রাজাদের মুক্ত করে কৃষ্ণ দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করলেন। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন শুরু হয়েছে। এক বিস্ময়কর সভাগৃহ নির্মাণ করেছেন ময়দানব। সোনার লাঙল দিয়ে কর্ষণ করে তৈরি হয়েছে যজ্ঞবেদী। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, কৃষ্ণ, পঞ্চপাণ্ডব, শিশুপাল, যমরাজ, বরুণ, বিদূর সকলেই সমাগত। যজ্ঞের পরে কৃষ্ণকে সম্বর্ধনা দেওয়ার কথা ওঠায় আপত্তি জানালেন শিশুপাল। তারপরে কৃষ্ণনিন্দায় মুখর হবে উঠলেন তিনি। শিশুপালের আচরণে অন্যান্য অতিথি ক্ষুব্ধ হলেন। কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র বধ করল শিশুপালকে।
রাজসূয় যজ্ঞের পরে এক অসুরের মুখোমুখী হলেন কৃষ্ণ। সে অসুরের নাম শাল্ব। রুক্মিণির সঙ্গে তাঁর বিবাহের সময় থেকে শাল্ব তাঁর বিরোধিতা করে আসছে। শিবের বরে শাল্ব অমর। ময়দানব নির্মিত রথে চেপে বিপুল সৈন্য-সামন্ত নিয়ে শাল্ব বেষ্টন করল দ্বারকাপুরী। শুরু করল নির্বিচার হত্যা আর অত্যাচার। কৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্ন যুদ্ধে বধ করলেন শাল্বকে। তার সৈন্যবাহিনী নিক্ষিপ্ত হল সমুদ্রে। কিন্তু মহাদেবের বরে শাল্ব পুনর্জীবিত হল আবার । এবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন কৃষ্ণ। বধ করলেন শাল্বকে। কিন্তু সে আবার জীবিত হয়ে কৃষ্ণের পিতা বাসুদেবকে বন্দি করল। শেষে কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রে নিহত হল শাল্ব। ভোজকূট দেশের রুদ্ধীর নগরে এসেছেন কৃষ্ণ আর রুক্মিণী। রুক্মীরাজের পৌত্রীর সঙ্গে কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের বিবাহ হল। বিবাহের পরে রুক্মীরাজ আয়োজন করলেন পাশাখেলার। বলরামকেও আমন্ত্রণ জানানো হল। কপট পাশাখেলায় পরাজিত হতে লাগলেন বলরাম। তারপর বলরামকে অপদস্ত করা হল। ক্রুদ্ধ বলরাম মুষল দিয়ে বধ করলেন রুক্মীরাজকে।
এক দৈত্যের নাম ছিল বজ্রনাভ । ব্রহ্মার বরে সে ছিল ত্রিভুবনবিজয়ী। নর্মদার তীরে ছিল তার সুবর্ণমণ্ডিত প্রাসাদ । দেবরাজ ইন্দ্রের পুরী সে অধিকার করতে চায় । দেবরাজ শরণ নিলেন কৃষ্ণের। কৃষ্ণের নির্দেশে তাঁর পুত্র প্রদ্যুম্ন গেলেন বজ্রনাভের সঙ্গে যুদ্ধ করতে । বজ্রনাভের এক কন্যা ছিল। তার নাম প্রভাবতী। প্রদ্যুম্ন ও তাঁর সঙ্গীরা ব্রহ্মার বাহন রাজহংসীদের দৌত্যকাজে নিযুক্ত করলেন। প্রভাবতীর সহচরীরা রাজহংসীর রূপ দেখে আনন্দিত হয়ে প্রভাবতীকে জানালেন তাদের কথা। প্রভাবতী সরোবরের তীরে এসে রাজহংসীদের ডাকলে তারা মানুষের ভাষায় জানিয়ে দিল যে তাদের ধরা সহজ নয়। তবে আন্তরিকভাবে ডাকলে তারা ধরা দিতে পারে। প্রভাবতীর আন্তরিকতায় তারা ধরা দিল।
একদিন সূচীমুখী নামে রাজহংসী প্রভাবতীর কাছে কৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্ন, গদ আর শাম্বের রূপের প্রশংসা করায় প্রভাবতী মোহিত হলেন। তিনি প্রদ্যুম্নের সঙ্গে মিলন কামনা করলেন। দ্বারকায় বসে কৃষ্ণ সে সব কথা অবগত হলেন। তিনি ভদ্রনটকে আনার আদেশ দিলেন। সে নৃত্য, গীত, অভিনয়ে পারদর্শী। কৃষ্ণের আদেশে ভদ্রনট প্রদ্যুম্ন, গদ আর শাম্বকে নিয়ে বজ্রনাভের পুরীর দিকে যাত্রা করল। তাদের নৃত্য-গীতে খুশি হলেন বজ্রনাভ। প্রদ্যুম্নরা রাজার বিশ্বাস অর্জন করে সমর্থ হলেন। সূচীমুখী প্রভাবতীকে জানিয়ে দিলেন যে নটদের একজন হলেন প্রদ্যুম্ন। এ কথা শুনে ব্যাকুল হলেন প্রভাবতী। ফুলের মধ্যে আত্মগোপন করে প্রদ্যুম্ন প্রবেশ করলেন রাজপুরীতে। প্রভাবতীর সঙ্গে মিলন হল তাঁর। বিবাহ হয়ে গেল গান্ধর্ব মতে। তারপরে গদ ও শাম্বের সঙ্গে প্রভাবতীর অন্য দুই ভগ্নীর বিবাহ হল তিন ভগ্নীর তিন পুত্রসন্তান হল–চন্দ্রপ্রভ, গুণমন্ত, হংসকেতু। দেবতার বরে জন্মগ্রহণ করেই তাঁরা উপনীত হলেন যৌবনে। নিজেদের লক্ষ্য সম্বন্ধেও তাঁরা সচেতন। বধ করতে হবে বজ্রনাভকে। প্রহরীদের মুখে বজ্রনাভ শুনতে পেলেন অন্তঃপুরে বিচরণ করছে তিনজন অচেনা পুরুষ। তাদের বন্দি করে আনার জন্য পাঠানো হল সেনাপতি তালজঙ্ঘকে। প্রদ্যুম্ন, গদ, শাম্ব এবং তাঁদের তিন পুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল তালজঙ্ঘের। অচিরে নিহত হল তালজঙ্ঘ। তখন বজ্রনাভ অগ্রসর হলেন যুদ্ধের জন্য। ততক্ষণে কৃষ্ণ ও জয়ন্ত প্রদ্যুম্নদের সাহায্যের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। বজ্রনাভ আশ্রয় নিলেন মায়াযুদ্ধের। কৃষ্ণের ইঙ্গিতে প্রদ্যুম্ন অর্ধচন্দ্র বাণের সাহায্যে হত্যা করলেন বজ্রনাভকে। পুত্র, পুত্রবধূ ও প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে কৃষ্ণ ফিরে এলেন দ্বারকায়।
সুদামা কৃষ্ণের বাল্যসখা। অবন্তীনগরে তাঁর বাড়ি। তিনি খুব দরিদ্র। ভিক্ষায় তাঁর সংসার চলে। সুদামার স্ত্রী স্বামীকে কৃষ্ণের সাহায্য নিতে বললেন। স্ত্রীর কথায় সুদামা চললেন কৃষ্ণের কাছে। বন্ধু কৃষ্ণের জন্য সামান্য খুদ এনেছিলেন সুদামা। কিন্তু সামান্য সেই উপহার দিতে সংকোচ বোধ করছিলেন। কৃষ্ণ নিজেই চেয়ে নিলেন সামান্য সেই উপহার। সুদামা কিন্তু কৃষ্ণের কাছে নিজের দারিদ্র্যের কথা বলতে পারলেন না। কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন সুদামার মনের কথা। বাড়ি ফিরে অবাক সুদামা। তাঁর জীর্ণ কুটির পরিণত হয়েছে অট্টালিকায়। পূর্ণ হয়েছে প্রচুর ধন-সম্পদে। সপরিবারে কৃষ্ণ এসেছেন প্রভাসে। গোপ-গোপী,পাণ্ডব-কৌরবরাও সমবেত হয়েছেন। বসুদেব আয়োজন করলেন যজ্ঞের। সেই যজ্ঞকুণ্ড বেষ্টন করে বসলেন ব্যাস, বশিষ্ট, পুলস্ত, নারদ, অঙ্গিরা, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ঋষি। নানা দার্শনিক আলোচনা হল। অন্তঃপুর ভরে উঠল রঙ্গ-কৌতুকে। রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দী যেমন তাঁদের বিবাহ কাহিনি বর্ণনা করলেন ,তেমনি দ্রৌপদীও তাঁর বিবাহ কাহিনি বিবৃত করলেন।নৈমিষ অরণ্যে তর্ক চলছে ঋষিদের মধ্যে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর—এই ত্রি- দেবতার মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, তাই নিয়ে তর্ক। ঋষিদের নির্দেশে ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য ভৃগুমুনি প্রথমে গেলেন কৈলাসে, মহাদেবের কাছে। শিব ভৃগুকে দেখে আনন্দিত হয়ে আলিঙ্গন করতে যেতে ভৃগু সরে দাঁড়ালেন, বললেন যে দিনরাত যিনি ভূত-প্রেতের সঙ্গে বিচরণ করেন, তাঁর স্পর্শে তিনি অশুচি হবেন। শিব ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে তাড়া করলেন। ভৃগু তখন গেলেন ব্রহ্মার কাছে। তখন ব্রহ্মা অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। তাই অতিথি সৎকারে ত্রুটি হল। ভৃগু ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মাকে কটুবাক্য বলায় ব্রহ্মা তাঁকে তাড়া করলেন। ভৃগু তখন গেলেন বিষ্ণু বা কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ তখন পালঙ্কে নিদ্রিত ছিলেন। কৃষ্ণের বক্ষে পদাঘাত করে ভৃগু তাঁকে জাগ্রত করলেন। ক্রুদ্ধ না হয়ে কৃষ্ণ বললেন যে অতিথিকে সমাদর না করতে পারার জন্য তিনি অপরাধী; ভৃগুর পদাঘাতে তাঁর অপরাধ দূর হয়েছে, শুদ্ধ হয়েছে শরীর। তখন ভৃগু ঋষিদের জানালেন যে তিন দেবতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন বিষ্ণু।
কংসের অনুচরের নাম বৃকাসুর। শিবের তপস্যা করে সে এক বর লাভ করেছিল। যার মাথায় সে হাত দেবে সে ভস্মে পরিণত হবে। বকাসুর শিবের মাথায় হাত দিয়ে বরের সত্যতা যাচাই করতে চাইল। মহা বিপদ। শিব ছুটে এলেন ইন্দ্রপুরীতে। কিন্তু সেখানে কেউ তাঁকে সাহায্য করতে পারল না কিছুমাত্র। শিব তখন এলেন দ্বারকায়। কৃষ্ণের কাছে। বৃকাসুরও হাজির সেখানে। কৃষ্ণ বৃকাসুরকে নিজের মাথায় হাত দিয়ে বরের সত্যতা যাচাই করতে বললেন। এভাবে বৃকাসুর পরিণত হয় ভস্মে। শিব তখন কৃষ্ণের মাহাত্ম্য স্বীকার করলেন অকুন্ঠচিত্তে।
দ্বারকা নগরে বাস করতেন এক ব্রাহ্মণ দম্পতি। সুখ ছিল না তাঁদের মনে। ব্রাহ্মণি প্রসব করতেন মৃত সন্তান। একবার তাঁরা মৃত পুত্রকে নিয়ে কৃষ্ণের কাছে গেলেন। কৃষ্ণ তাঁদের পরবর্তী সন্তানকে জীবিত রাখার ভার দিলেন প্রদ্যুম্নকে। কিন্তু ব্যর্থ হলেন প্রদ্যুমন। এভাবে একে একে ব্যর্থ হলেন শাম্ব, সাত্যকি, অনিরুদ্ধ, গদ, উদ্ভব . উগ্রসেন। এবার ডাক পড়ল অর্জুনের। ব্রাহ্মণী মৃত পুত্র প্রসব করলে তাকে নিয়ে চলে গেলেন যম। অর্জুন তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করলেন। কিন্তু হদিশ পেলেন না যমের । অর্জুন তখন অগ্নিতে আত্মবিসর্জন করার সিদ্ধান্ত করায় বাধা দিলেন কৃষ্ণ। এরপর কৃষ্ণ নিজে গেলেন যমরাজের কাছে। উদ্ধার করে আনলেন ব্রাহ্মণের নয়টি পুত্র।
মৃত পুত্র উদ্ধারের কাহিনি শুনে দৈবকী কংস কর্তৃক নিহত তাঁর ছয় পুত্রকে উদ্ধারের অনুরোধ করলেন। সেজন্য কৃষ্ণ গেলেন পাতালে। বলির আলয়ে। সহোদর ছয় ভ্রাতাকে নিয়ে এলেন তিনি দ্বারকায়। এমন সময়ে আকাশে বেজে উঠল দুন্দুভি। নেমে এল ছয়টি রথ। দিব্যদেহ ধারণ করে কৃষ্ণের ছয় ভ্রাতা জানালেন যে তাঁরা মরীচির পুত্র। কৃষ্ণের স্পর্শে তাঁরা শাপমুক্ত হয়েছেন। এবার তাঁর স্বর্গলোকে যাবেন। দ্বারকায় এসেছেন অর্জুন। ধনুর্বাণ সংগ্রহের জন্য তিনি প্রবেশ করেছেন যুধিষ্ঠিরের কক্ষে। সে সময়ে সেখানে ছিলেন দ্রৌপদী। সেই অপরাধে অর্জুনকে এক বৎসর বনবাসে যেতে হয়। বনবাসপর্ব শেষ করে অর্জুন ফিরে এলেন দ্বারকায়। একদিন কৃষ্ণের সঙ্গে ভ্রমণকালে অর্জুন সুভদ্রাকে দেখে মোহিত হলেন। বিবাহ করতে চাইলেন তাঁকে। কৃষ্ণ বিবাহ সমর্থন করলেও বলভদ্রের মত ছিল না । তাই কৃষ্ণ সখা অর্জুনকে সুভদ্রাহরণের পরামর্শ দিলেন। একদিন সুভদ্রা যখন একাকিনী স্নানের জন্য যাচ্ছিলেন, তখন অর্জুন তাঁকে হরণ করেন। সংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ বলভদ্র তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করলেন মূষল হাতে। কৃষ্ণকেও তিনি তিরস্কার করেন এ রকম অপকর্মে অর্জুনকে সাহায্য করার জন্য। কৃষ্ণ বলেন যে সবদিক থেকে অর্জুন সুভদ্রার যোগ্য পতি হতে পারেন। সুভদ্রাকে নিয়ে অর্জুন হস্তিনানগরে উপস্থিত হলে যুধিষ্ঠির তাঁদের বিবাহ দেন।
অজামিল ছিলেন কান্যকুব্জের এক ব্রাহ্মণ । তিনি ব্রহ্মচর্য ব্রত ধারণ করে অন্ধ পিতা-মাতার সেবা করে দিনাতিপাত করতেন। একদিন তিনি পুষ্পোদ্যানে এক নারীকে দেখে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন । নারীটি ছিলেন কুলটা ও ছলনাময়ী। তাঁকে বিবাহ করে অজামিল পিতা-মাতাকে পরিত্যাগ করে দেশান্তরে চলে যান। কালক্রমে তাঁর দশ পুত্র জন্মায় । সর্ব কনিষ্ঠটির নাম নারায়ণ। মৃত্যুকালে অজামিল কনিষ্ঠ পুত্রের নাম ধরে ডাকায় পাপমুক্ত হন। তখন যমদূতদের বিতাড়ন করে বিষ্ণুদূত তাঁকে বৈকুন্ঠে নিয়ে যান। পুত্র –পৌত্র-আত্মীয়-বান্ধবদের নিয়ে সুখে কালাতিপাত করছিলেন কৃষ্ণ। এ সময়ে নিজেকে তিনি যেন বিস্মৃত হয়েছিলেন। তাই ব্রহ্মা প্রমুখ দেবতারা চিন্তিত হন। নারায়ণ তখন জানান যে চিন্তার কোন কারণ নেই, ব্রহ্মার শাপে ধ্বংস হবে কৃষ্ণের বংশ। তখন তাঁকে ফিরে আসতে হবে বৈকুণ্ঠে।
কিছুদিন পরে কৃষ্ণ দর্শনের জন্য দ্বারকায় এলেন মুনি-ঋষিরা। প্রদ্যুম্ন তাঁদের যথোচিত সমাদর করায় তাঁরা প্রীত হলেন। এমন সময়ে শাম্ব এক কাণ্ড করে বসলেন। তিনি এক গর্ভবতী নারীর রূপ ধারণ করে হাজির হলেন ঋষিদের সামনে। তিনি জানান যে তিনি এক বছর কাল গর্ভ ধারণ করে বড় কষ্টে আছেন, ঋষিরা যদি বলে দেন কবে প্রসব হবে হবে এবং পুত্র না কন্যা হবে , তাহলে তিনি কৃতার্থ হবেন। ঋষি দুর্বাসা শাম্বের ছলনা ধরতে পেরে ক্রুদ্ধ হলেন এবং বললেন যে সেই মুহূর্তে তিনি একটি মূষল প্রসব করবেন। এ হল ব্রহ্মশাপ। কাজ হল কথামতো। কৃষ্ণ বিধান দিলেন প্রভাসে গিয়ে মূষল ঘর্ষণ করতে। কিন্তু মূষল সম্পূর্ণ ক্ষয় হল না। অবশিষ্টাংশ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হল। একটি বৃহৎ মৎস্য সেটি ভক্ষণ করল। এক ধীবর সেই মৎস্য ধরে তার লৌহখণ্ড এক শিকারীকে বিক্রয় করল। শিকারীটি সেই লৌহখণ্ড দিয়ে তৈরি করল অস্ত্র। এ ভাবে ব্রহ্মশাপ ফলতে শুরু করল। কৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগের সময় ত্বরান্বিত হল।
সে কথা অনুধাবন করে উদ্ভব কৃষ্ণের কাছে তত্ত্বজ্ঞান প্রার্থনা করলেন। কৃষ্ণ প্রথমে বললেন সংসারের অসারতার কথা। এই অসার সংসারে একমাত্রসারবস্তু নারায়ণ। তাঁর আরাধনায় নিমগ্ন হতে হবে। ঈশ্বর আরাধনার পথ বিবিধ— উত্তম, মধ্যম, অধম। প্রথম স্তরের সাধকদের আত্মপর কোন ভেদ থাকে না। লাভ-ক্ষতি, সম্মান-অসম্মান, সুখ-দুঃখ সবই তাঁদের কাছে সমান। মধ্যম শ্রেণির সাধকরা সংসারকে অসার জানেন , শ্রীহরির ধ্যান করেন তবে একেবারে বিকারমুক্ত হতে পারেন নি। অধম শ্রেণির সাধকরা পূজাপাঠ করেন তবে সংসারের প্রতি তাঁদের আসক্তি আছে। ঈশ্বর সাধনার জন্য গুরুর প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন কৃষ্ণ। এক অবধূতের উল্লেখ করে তিনি চব্বিশজন গুরুর কথা বললেন।
প্রথম গুরু এই বসুন্ধরা। সর্ববিধ ভার সে বহন করে। অথচ তার কোন দুঃখ নেই। সে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। দ্বিতীয় গুরু পবন। সে গুপ্ত না থেকে সর্বত্র নিজেকে সঞ্চারিত করে দেয়। তৃতীয় গুরু আকাশ। তার অস্তিত্বের কোন প্রকাশ নেই, অথচ তার অস্তিত্ব বিস্তৃত। চতুর্থ গুরু জল। সে নির্মল , সে সমস্ত প্রাণীর উপকার সাধন করে। পঞ্চম গুরু আগুন। তার কোন ভেদাভেদ নেই। ষষ্ঠ গুরু চন্দ্র। সে আপনা আপনি না মরে পুন মলা করে ক্ষয়। সপ্তম গুরু সূর্যদেব। সমস্ত চরাচরে সে পরিব্যাপ্ত। অষ্টম গুরু কপোত। কপোতীর মতো শোকে কাতর হয়ে সে সর্বনাশ ডেকে আনে না। নবম গুরু অজগর। আহার্য সন্ধানের চেষ্টা তার নেই; পেলে খায় না হলে অভুক্ত থাকে। দশম গুরু সমুদ্র। সে নিজেই পরিপূর্ণ; তার কোন তারতম্য নেই, আক্ষেপও নেই। একাদশ গুরু পতঙ্গ। বিষয়াসক্তির আগুনে সে নিরন্তর দগ্ধ হয়। দ্বাদশ গুরু মধুকর। সে মধুরূপ নারায়ণকে গ্রহণ করে পুষ্পরূপ সংসারকে পরিত্যাগ করে। ত্রয়োদশ গুরু মধুমাছি। তার মৃত্যুর কারণ হল শিক্ষা সঞ্চয়। চতুর্দশ গুরু গজরাজ। নকল হাতির প্রলোভনে সে বন্দি হয়। পঞ্চদশ গুরু হরিণী। সে সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে আপন সর্বনাশ ডেকে আনে। ষোড়শ গুরু মৎস্য। বঁড়শিতে গাঁথা আহারের লোভে সে প্রাণ হারায়। সপ্তদশ গুরু পিঙ্গলা নামক গণিকা। প্রলোভিত হয়ে সে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। অষ্টাদশ গুরু কুরল পক্ষী। তার মাংস সুস্বাদু, তাই সকলে তার প্রাণ হরণ করতে চায়। ঊনবিংশতি গুরু শিশু। তার মনে কোন জটিলতা নেই, সে সরল, সহজ ও সুন্দর। বিংশতি গুরু কুমারী। সে পবিত্র। একবিংশতি গুরু বক। তার ধ্যাননিমগ্নতা ঈশ্বরে ধ্যাননিমগ্ন হবার শিক্ষা দেয়। দ্বাবিংশতি গুরু সর্প। তার নিজের কোন নির্দিষ্ট নিলয় নেই । ত্রয়োবিংশতি গুরু মর্কট। তার ক্ষুদ্র দেহ বহুসূতা। চতুর্বিংশতি গুরু কুমারিকা পতঙ্গ। সে কৃমি সংগ্রহ করে মৃত্তিকায় আচ্ছাদিত করে নিয়ত।
এসব কথা বলার কৃষ্ণ বললেন যে কেউ কারো গুরু নয় , প্রত্যেকেই নিজেই নিজের গুরু। উদ্ভব কৃষ্ণের কাছে মোক্ষযোগের কথা শুনলেন। তারপরে শুনলেন কর্মযোগের কথা। মানুষকে কর্ম করে যেতে হবে । কিন্তু কর্মে যিন মোহ না জন্মায়।
তারপর কৃষ্ণ উদ্ভবকে জানালেন তাঁকে চেনার উপায়। তিনি সংসারের প্রধান পুরুষ। তিনি সর্বভূতে বিরাজিত। দেব পুরন্দর তিনি। পশুমধ্যে সিংহ, দৈত্যের মধ্যে প্রহ্লাদ, ঋষির মধ্যে ভৃগু, মেরুর মধ্যে গিরিরাজ, বেদের মধ্যে সাম, পিতৃগণের অর্ঘ্য, মরুতে পবন, অশ্বের মধ্যে উচ্চৈঃশ্রবা, গজে ঐরাবত, পক্ষীতে গরুড়, নাগে বাসুকি, নদীর মধ্যে সাগর, তারাদের মধ্যে চন্দ্র, সর্পে অনন্ত, ঋতুতে বসন্ত, বর্ণের মধ্যে মধ্য। তিনি প্রজাপতি। তিনি বুদ্ধিতে বৃহস্পতি। তাঁর থেকেই সকল সংসারের উৎপত্তি।
উদ্ভব দেখলেন কৃষ্ণের বিশ্বরূপ। তাঁর শরীরের উপরিভাগে ঋষিগণ, মধ্যভাগে স্থাবর, জঙ্গম ও প্রাণীকুল, নিম্নভাগে অসুর ও রাক্ষসগণ। তারপর কৃষ্ণের সাম্যরূপ দেখলেন উদ্ভব। দেখলেন শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বনমালীকে।
কৃষ্ণ বললেন, আমার প্রতি মন সমর্পণ করে নিষ্কাম কর্ম করো; ঈশ্বর যে কর্ম সৃজন করেছেন তা পালন করো। ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য, পদ থেকে শূদ্রের জন্ম। ব্রাহ্মণের কর্ম যজন-যাজন-বেদপাঠ, ক্ষত্রিয়ের কর্ম দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন, বৈশ্যের কর্ম কৃষি ও বাণিজ্য, শুদ্রের কর্ম উপরের তিন জাতির সেবা।
এরপর কৃষ্ণ চতুরাশ্রমের বিবরণ দিলেন।
প্রথমে ব্রহ্মচর্য। এ সময়ে গুরুগৃহে বাস করে বেদপাঠ ও গুরু সেবা করতে হবে। দ্বিতীয় গার্হস্থ্য। সুশীলা কন্যাকে বিবাহ করে গৃহধর্ম পালন করতে হবে। তৃতীয় বানপ্রস্থ। এ অবস্থায় সংসার ত্যাগ করে সস্ত্রীক অরণ্যে গমন করে ঈশ্বরচিন্তায় দিনাতিপাত করতে হবে। চতুর্থ সন্ন্যাস। এ অবস্থায় সমস্ত মোহ ত্যাগ করে দণ্ড ও কমণ্ডুলু ধারণ করে দেশে দেশে পরিভ্রমণ করতে হবে।
কাম-ক্রোধ ইত্যাদি পাপের থেকে মোহমুক্ত হবার জন্য কৃষ্ণ উদ্ভবকে অষ্টাঙ্গ যোগ বা সিদ্ধিযোগের বিধান দিলেন। অময়াসন ও প্রাণায়াম আয়ত্ত করতে হবে। কায়াসাধনার বিস্তৃত বিবরণ দিলেন কৃষ্ণ। তিনি দেখালেন তাঁর চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপ। কৃষ্ণের উপদেশে উদ্ভব সংসার ও সম্পদ পরিত্যাগ করলেন।
কালক্রমে পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করল যদুবংশ। পৃথিবীর ভার হরণ করার জন্য যে কৃষ্ণের আবির্ভাব, এবার তিনি যদুবংশ ধ্বংস করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। শুরু হল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। শুরু হল যদুবংশের সন্তানদের কলহ, যার পরিণতি খণ্ডযুদ্ধ। বলরাম সমুদ্রতীরে যোগবলে দেহত্যাগ করলেন। আহত হবে কৃষ্ণ এক বৃক্ষের উপর আরোহন করলেন। জরা নামক এক ব্যাধ কৃষ্ণের লোহিত চরণকে হরিণের কান ভেবে মুষলের আঘাত করল। সে আঘাতে মৃত্যু হল কৃষ্ণের। তাঁর মহিষীরা সহমৃতা হলেন। অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণত্যাগ করলেন বসুদেব- দৈবকী।
সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত হল দ্বারকা নগরী
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত