| 19 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা প্রবন্ধ: মাহমুদুল হকের গদ্য বৈচিত্র্য ও ভারসাম্যের স্থাপত্য

আনুমানিক পঠনকাল: 20 মিনিট

উপন্যাস বৃহৎ ক্যানভাসে আঁকা শব্দশিল্প হলেও উপন্যাস কেবল শব্দের বহিঃপ্রকাশ নয়। শব্দ এর মাধ্যম হলেও উপন্যাসের উপাদান বিচিত্র ও বহু। উপন্যাসে থাকে রচয়িতার নিজস্ব ভাষার অভিব্যক্তি এবং উপন্যাসস্থিত চরিত্রসমূহের সংলাপের সক্রিয়তা। এই দুই ধরনের ভাষিকতা এক নয়। লেখকের নিজের সমাজবাস্তবতা এবং তাঁর উপন্যাসে চিত্রিত চরিত্রসমূহের সামাজিক বাস্তবতা ভিন্ন। উপন্যাসের ভাষাশিল্পের ক্ষেত্রে সেই ভিন্নতার প্রভাব অনস্বীকার্য। উপন্যাসের কাহিনি স্থির ও তরঙ্গহীন নয় এর থাকে ওঠানামা ও বাঁক। নাট্যিকতা ও নাটকীয়তা দুই-ই উপন্যাসে ভূমিকা রাখে। এই দুইয়ের প্রভাবে উপন্যাসের ভাষা নতুন গঠন লাভ করে। উপন্যাসে থাকে রচয়িতা এবং তাঁর চরিত্র উভয়ের পর্যবেক্ষণের ফল। সেই পর্যবেক্ষণে দৃশ্য ও চিত্র গুরুত্বপূর্ণ। দৃশ্য-চিত্রের প্রভাব পড়ে ঔপন্যাসিকের ভাষার ক্ষেত্রে। উপন্যাসের ভাষাশিল্প রচয়িতার আবেগ-অনুভূতির চেতনালোক-উৎসারিত বলে এতে থাকে শব্দ-সংবেদনা। একই সমকালে রচিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস শুধু বিষয়-চরিত্রেই আলাদা নয়, ভাষার দিক থেকেও যথেষ্ট পৃথক। একই বিষয় কোনও ঔপন্যাসিকের বর্ণনায় হয়ে ওঠে সাংকেতিক, আবার কারও বর্ণনায় স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। মোটকথা, উপন্যাসশিল্পের ক্ষেত্রে ভাষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমালোচক তাই লেখেন,  ‘Language is indeed the means of the novelist.’ (Lodge 1966 : 70) ঔপন্যাসিকের স্বাতন্ত্র্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাই ভাষার অনিবার্যতাকে অস্বীকার করা যায় না।

বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ প্রত্যেকে তাঁদের উপন্যাসের জন্য এবং উপন্যাসের ভাষার জন্যও স্মরণীয়। সার্থক ভাষাশিল্পের জন্য বাংলাদেশের সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন বহু ঔপন্যাসিক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির এঁদের প্রত্যেকের উপন্যাস তাঁদের স্বকীয় ভাষারীতির ছাপবাহী।

মাহমুদুল হক তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে যেমন স্বতন্ত্র তেমনি বিষয়কে প্রকাশ করবার জন্য তিনি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর নিজস্ব ভাষাশিল্প। তাঁর আটটি উপন্যাস ভাষার নানা অভিব্যক্তি আর বৈচিত্র্যকে ধারণ করে আছে। প্রথম উপন্যাস অনুর পাঠশালা (রচনা ১৯৬৭ প্রকাশ ১৯৭৩) থেকে শুরু করে সর্বশেষ উপন্যাস পাতালপুরী (রচনা ১৯৮১ প্রকাশ ২০০৯) পর্যন্ত প্রায় দেড় দশকের পরিধিতে বিবর্তিত হয়েছে মাহমুদুল হকের উপন্যাসের ভাষা। বিবর্তন এই অর্থে, তিনি তাঁর পূর্ববর্তী উপন্যাসের ভাষারীতিকে পরবর্তী উপন্যাসে ব্যবহার করেন না। বর্ণনার ভাষা, চিন্তনের ভাষা, কথকতার ভাষা সবকিছুকেই তিনি পৃথক-পৃথক মূল্যে পরখ করে দেখার পক্ষপাতী। তাই অনুর পাঠশালা এবং নিরাপদ তন্দ্রা (১৯৭৪) দুটি উপন্যাসের ভাষা একরকম নয়, আবার একই বিষয় মুক্তিযুদ্ধ হলেও জীবন আমার বোন (১৯৭৬) এবং খেলাঘর (১৯৮৮) উপন্যাসের ভাষা এক নয়। বিষয়-চরিত্র-পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী গড়ে উঠেছে মাহমুদুল হকের ভাষাশৈলী। তাঁর উপন্যাসগুলি তাঁর নিজস্ব ভাষারীতিকে আশ্রয় করেই সার্থকতা লাভ করেছে।

 

২.

প্রথমেই ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের বিষয়-চেতনার আলোকে তাঁর ভাষাশিল্পের নান্দনিকতা বিচার্য। তিনটি ধারায় তাঁর উপন্যাসশিল্প বিকশিত হয়েছেÑ মনস্তাত্তি¡ক পর্যবেক্ষণ, জীবন-বাস্তবতা এবং মুক্তিযুদ্ধ। মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ধারায় তাঁর উপন্যাসের সূচনা, তাই তাঁর গোড়ার দিকে তাঁর উপন্যাসের ভাষা কাব্যময়, অনুভূতিপ্রবণ। কিশোর অনুর অন্তর্গত শূন্যতার প্রভাবসম্পাতের ফলে ঔপন্যাসিকের ভাষা হয়ে উঠেছে চিত্রধর্মী। লক্ষণীয়, প্রথম উপন্যাসে তাঁর বাক্য ছোট-ছোট। বাক্য যেখানে দীর্ঘ সেখানেও বাক্যকে যতি-পরম্পরায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কিশোর অনুর মনে যেভাবে তার চারপাশের ছায়া পড়ে এবং জীবনের সহজ-জটিল বিষয় তার মস্তিষ্কে যেভাবে ক্রিয়া করে ঠিক সেভাবেই যেন ভাষাটাও গড়ে ওঠে। উপন্যাসের ভাষার একদিকে থাকে অনুর কিশোর মনের দূরকল্পনার বিস্তার এবং অন্যদিকে তার ব্যক্তিত্বের ছোট্ট চৌহদ্দির সীমাবদ্ধতা। লেখকের জীবনের প্রথম উপন্যাসের (১৯৬৭) প্রথম পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃতি-

দুপুরে অনু একা থাকতে পারে না, ভেবে পায় না কি করবে, কোথায় যাবে। ঘরের সবগুলো দেয়ালের চেহারা ও হাবভাব আগেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো; থমকানো এবং শাদা ভয়ের ছাপ মারা এমন সব অনড় আয়না যাতে কখনো কারো প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে না। বাঞ্ছারামপুরের থানে মোড়া রানিফুফুর কথা মনে হয়; এক ফুৎকারে নিভে যাওয়া নির্বিকার মোমবাতি, ঘুমের ঘোরে খিলখিল করে হাসে। গরম হাওয়ার হলকা চোখে ছোবল মারে বলে এই সময় জানালায় দাঁড়াতেও অনুর তেমন ভালো লাগে না। ঝিমিয়ে পড়া ওলবড়ি গাছ, ঝলসানো কাক ও অন্যান্য পাখির ডাক, তপ্ত হাহা হাওয়া, সবকিছু গনগনে উনুনে পোড়া রুটির মতো চিমসে গন্ধে ভরিয়ে রাখে। লামাদের বাগানে বাতাবি লেবুর ঝোপের পাশে আচ্ছন্ন ছায়ায় পাড়া-বেপাড়ার দস্যুরা পাঁচিল ডিঙিয়ে এই সময় ব্রিং খেলে, জানালায় দাঁড়ালেই সব দেখা যায়। (মাহমুদুল হক ২০০৯ : ৯)

অনুর পাঠশালা কিশোর-উপন্যাস নয় যদিও এটির প্রধান চরিত্র অনু কিশোর। মাহমুদুল হকের ভাষা তিনটি বিষয়কে একসূত্রে গেঁথেছে। অনু কিশোর কিন্তু তার চারপাশের জগত বয়স্কদের জগত, যে-বয়স্করা তার মনের নানা অস্বস্তির কারণ। অনুর কল্পনাপ্রবণ দৃষ্টিতে প্রকৃতি ধরা দেয় কিন্তু ঔপন্যাসিকের ভাষা-প্রয়োগের ফলে আমরা অবগত হই, সে আসলে সংকীর্ণ জায়গায় আবদ্ধ। শহরবাসী অনুর পারিবারিক প্রেক্ষাপট, পরিবারের গ্রামীণ উৎস এবং পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে কিছু তথ্য, চরিত্র ও কাহিনি অল্প কয়েকটি শব্দের আঁচড়ে অনুর পরিমন্ডলের একটা প্রাথমিক রূপ তৈরি করে। সর্বোপরি এসবকিছুর একত্র সম্মিলনে অনুর অভিজ্ঞতাই প্রাধান্য পায়। যেটুকু কাব্যিকতা মাহমুদুল হকের ভাষায় রযেছে তা অনুর মনের বর্তমানতা এবং তার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। ঘরে তার মায়ের রান্নাবান্নার দর্শক অনুর কাছে উনুন এবং রুটি অতি পরিচিত অনুষঙ্গ। তাই কাব্যিকতা সত্তে¡ও অনু যখন তার চারপাশের সবকিছুতে ‘গনগনে উনুনে পোড়া রুটির মতো চিমসে’ গন্ধ অনুভব করে তা বাস্তব এবং সুপ্রযুক্ত হয়। উপন্যাসের কেবল এই অনুচ্ছেদটি পাঠ করে পাঠক অনু নামক একটি কিশোরের একাকিত্বকে অনুভব করে। ক্রমে পাঠকের সেই অনুভূতির প্রসারণ ঘটে এবং তা তীব্রতর হয় উনুনের আগুনের আঁচে। তারপর ‘লামাদের বাগানের’ সংবাদ ও চিত্র অনুর সীমাবদ্ধতাকে করে তোলে প্রকটতর। যখন বাইরের জগতে দুরন্ত ছেলেরা ‘ব্রিং খেলে’ তখন রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর (১৯১২) নাটকের অমলের মতো অনু নিঃসঙ্গ-একা। কিন্তু অমল ছিল শারীরিকভাবে অসুস্থ। অনু অসুস্থ নয় কিন্তু সে তার চারপাশের জগতের যে-পরিস্থিতির শিকার সেসব সুস্থ জীবনের অনুষঙ্গী নয়। একই সঙ্গে স্থান-কাল-চরিত্র, অন্তর্গত জগত ও বহির্জগত ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানকে ভাষায় গ্রন্থনা দিয়ে উপন্যাসের ভাষাকে কাহিনি প্রকাশের ভিন্ন এক আঙ্গিকে পরিণত করেন মাহমুদুল হক।

 

২.১.

মাহমুদুল হকের কালো বরফ (রচনাকাল ১৯৭৭ প্রকাশকাল ১৯৯২) মনস্তাত্ত্বিক ধারার উপন্যাস এবং এর নায়ক আবদুল খালেক প্রাপ্তবয়স্ক ও বিবাহিত। পেশায় সে কলেজ-শিক্ষক। আবদুল খালেক এমন একটি চরিত্র যার অন্তর্গত চেতনায় প্রতি মুহূর্তে বিরাজ করে দোলাচলবৃত্তি। শৈশবানুষঙ্গ তার চিন্তনপ্রক্রিয়ার একটি অনিবার্য দিক। উন্মূল জীবনের বেদনাকে ভুলতে গিয়ে বর্তমানে বসে সে অতীতে আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ বর্তমানে তার চেতনা প্রাপ্তবয়স্কের, কিন্তু সেই চেতনার আধারে ধরা দেয় অন্য এক বয়সের চেতনা। সেই চেতনা যেহেতু গড়ে উঠেছিল তার ফেলে আসা জন্মস্থানে, সেহেতু বর্তমানে বসে মানসিক পর্যটন-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আবদুল খালেকও চলে যায় তার জন্মস্থানে। বাস্তবে সে তার জন্মস্থানে থাকে না, থাকে বাসস্থানে। এই টানাপড়েনের জটিল বাস্তবতাকে ভাষায় মূর্ত করবার কঠিন কাজটি মাহমুদুল হক করেন তাঁর নিজস্ব শৈলীর দ্বারা। অতীত-বর্তমান, দৈনন্দিনতা, জীবনযাপনের চিত্র সবকিছু জড়িয়ে-মিশিয়ে গতিময় এক ভাষা কাঠামোয় উপস্থাপিত হয়। কালো বরফ উপন্যাস থেকে মাহমুদুল হকের ভাষার নমুনা-

এক চামচ গ্লুকোজে পেঁপের আঠার ফোঁটা ফেলে আমাকে খাওয়াতো মা। কোনো কোনোদিন আবার কুমারেশ, কিংবা কালমেঘের বড়ি। বেলপোড়া, বেলের মোরব্বা, কিংবা চুনের পানি, এইসবও চলতো। ঘুম থেকে উঠে সকালে খালি পেটে খেতে হতো।
পোকা, এই ছিল আমার ডাক নাম। কেনারাম বাবুর দেওয়া নাম। তিনি ছিলেন আব্বার বন্ধু। আমরা ডাকতাম কাকা। কেনারাম বাবুকে নিয়ে একটা ছড়া প্রচলিত ছিল:
কেনারাম কিনে আনে
তুলারাম তুলে রাখে
ফেলারাম ফেলে দেয়
বেচারাম বেচে দেয়
কেনারাম কাকাই জানেন আমার নাম পোকা দিয়েছিলেন কেন। ‘পোকা, পোকা, পোকা আছিসÑ’ এই বলে তিনি হাঁকডাক শুরু করে দিতেন।
আমি বেরুলে বলতেন, ‘যা, জুতো পায়ে দিয়ে আয়।’ (২০০০ : ২৪)

মাহমুদুল হকের উপর্যুক্ত ভাষার দৃষ্টান্তে অতিক্রান্ত সময়ের একটা চালচিত্র মেলে। পরিবারে-সমাজে পারস্পরিক বন্ধন গড়া মানুষের একটা ছিমছাম ছবি এটি। ছোট-ছোট কয়েকটি বাক্যে অতীত দিনের কাহিনি জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। আন্তর্সম্প্রদায়ের সম্পর্ক যে-সহজ সৌন্দর্য নিয়ে বিদ্যমান ছিল তারও একটা দিক ফুটে ওঠে। সব মিলিয়ে চিত্রময় এই ভাষা উপন্যাসটির মূল চরিত্র আবদুল খালেকের মনোদৈহিক অবস্থানের সঙ্গে চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে যায়। পর-পর দুটো উপন্যাস থেকে মাহমুদুল হকের ভাষার যে-দৃষ্টান্ত দেওয়া গেল তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট এবং তা তাঁর সকল উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে সাধারণভাবে সত্য। মাহমুদুল হকের ভাষা মেদহীন এবং আতিশয্য দোষমুক্ত। তাঁর ভাষায় ক্ষেত্রবিশেষে কাব্যিকতা বর্তমান কিন্তু তা সংশ্লিষ্ট চরিত্রসাপেক্ষ। তাঁর নির্মেদ ভাষার দক্ষ ব্যবহারের ফলে অনেক বিস্তৃত পরিসর ও জটিল প্রসঙ্গ ধরা দেয় অবলীলাক্রমে। যেমনÑ

মাঝে মাঝে ইরানি জিপসিদের তাঁবু পড়তো হাতিপুকুরের পাড়ে। কুঁচিওলা ঘাঘরা পরা লম্বা লম্বা বেণী ঝোলানো মেয়েরা মাথায় ফুটতোলা রুমাল বেঁধে কালো সুতোর দড়ি পাকাতো। ছুরি, কাঁচি, নানা রঙের পাথর আর মাথার চুলের গুছি, এইসব নিয়ে তারা ঝাঁঝাঁ দুপুরে বাড়ি-বাড়িতে ঘুরতো। (২৫)

একটি বিশেষ কালের এই দৃশ্যাবলী অনেক কাল পরে আবদুল খালেকের মনে ভেসে ওঠে কিন্তু মনে হয় যেন চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে ইরানি জিপসি মেয়েরা। স্মৃতি থেকে আনা এইসব দৃশ্য মাহমুদুল হকের ভাষার গুণে আকর্ষণীয় রূপ নেয়। একটি দুপুরের বর্ণনায় একটিমাত্র ক্ষুদ্র শাব্দিক অভিব্যক্তি (‘ঝাঁঝাঁ) অনির্বচনীয় ব্যঞ্জনার সঞ্চার করে। মাহমুদুল হকের ভাষায় এরকম প্রকাশ মেলে অসংখ্য।

মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ধারার উপন্যাসে মনোজাগতিক বহুমুখিতার ফলে চিন্তনের প্রক্রিয়া হয়ে পড়ে জটিল। সেই চিন্তন হতে পারে বয়স্ক লোকের, হতে পারে অপ্রাপ্তবয়স্কের। ঘটনা, চরিত্র, সময় সবকিছু মনের বিচিত্র অনুভূতির ওঠানামায় মুহূর্তে-মুহূর্তে পরিচিতি-অপরিচিতির দ্যোতনা জাগায়। মাহমুদুল হকের ভাষা চরিত্রের মনোজাগতিক উন্মোচনে বহুতল প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম। অনুর বাস্তবের রুক্ষতা, তার মানসিক অশান্তি, অস্থিরতা এইসব বাস্তব-কল্পনার সংমিশ্রণে ব্যঞ্জনাময়। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে রচিত মাহমুদুল হকের ভাষা আজও দ্যুতি ছড়ায়।

অনু শিউরে ওঠে। বুকের মাঝখানে কাচের নীল পিরিচ ভেঙে খান-খান হয়ে যায়। মা’র যাবতীয় সুন্দর অভিলাষগুলো নির্দয় পাথরে পরিণত; এই বাড়ি ছেড়ে শয়তানের এই থাবা থেকে আর কোনোদিন নিরাপদে পালানো যাবে না। ভয় হয়। তবু এতো ভালোবাসে সে মাকে যে প্রতি মুহূর্তেই উৎকর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করে, রাত্রিবেলা মাঝে মাঝে নির্বোধ শিশুর মতো বিছানা হাতড়ে কি যেন খোঁজে। তার কেবল ভয়, চিরকালের মতো এক দুর্জ্ঞেয় অন্ধকারে একে একে সব মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। মায়ের সব ইচ্ছেগুলো যদি নির্দয় পাথর হয়ে গিয়েও থাকে তবু মনে মনে অনু সেই পাথরটা কেটে টেবিলের ওপরে সাজানো ভাঙা যিশুখ্রিস্টের মূর্তির চেয়ে অনেক সুন্দর তার রূপ দিতে চেষ্টা করে। (২০০৯ : ১৮, ১৯)

নিঃসঙ্গ অনুর মানসিক ভীতি, সঙ্গহীনতার কষ্ট, বাবার সঙ্গে দূরত্ব এবং ক্রমে নিজের মধ্যে একা হয়ে যাওয়ার নানা-রূপ বাস্তবতা মাহমুদুল হকের ভাষায় পরিবেশানুগ আবেদন জাগিয়ে তোলে। প্রলম্বিত লয়ের বর্ণনার পরিবর্তে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বাক্যে বা দৃশ্যে এক বৃহৎ ঘটনাপ্রবাহের কার্যকর ও আবেগী চিত্র আঁকতে পারেন তিনি। ইতিহাস, সময়, সম্পর্ক, মনস্তত্ত¡ সবকিছু ধরা পড়ে এক সূত্রে।

উপন্যাসের শেষে অনুর হতবিক্ষুদ্ধ অবস্থার প্রকাশে লেখক বেছে নেন সুর রিয়েলেস্টিক ফর্ম। ফলে ব্যবহৃত ভাষা অনুর চিন্তনের বহিঃপ্রকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। একটি উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে-

বৃদ্ধ হরিয়া পাখোয়াজ বাজাচ্ছে- খুব জোরে বাজাচ্ছে বুড়ো হরিয়া। আগের চেয়ে জোরে, আরো মাথা নেড়ে, বাবরি ঝাঁকিয়ে, এ-হেহ্-আই হাঁক ছেড়ে, ধোঁয়াচ্ছন্ন এক কুহক থেকে ঘুটঘুটে করাল আরেক কুহকে উন্মাদপ্রায় যাত্রারম্ভ করেছে সে। পাখোয়াজের গায়ে প্রতিটি চাঁটির ভেতর সাবধান সাবধান ধ্বনি চড়বড়িয়ে উঠছে। রণোন্মত্ত হস্তিযূথকে দাবড়ে দিচ্ছে সে। হাতের চাঁটি এবং পাখোয়াজের উদ্ধত ধ্বনি এবং ঘনঘন এ-হেই-আই-ও হুঁহ ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে চলেছে। অভিশপ্ত ভূগর্ভের কালো খোল ফেটে পিচকারির মতো তীব্রভাবে উদ্গীরিত হচ্ছে সেই মদোন্মত্ত ধুপধাপ শব্দলহরী। চিড় খাচ্ছে আর দুড়ুম-দাড়াম করে সেখানে স্থানচুত্য হচ্ছে কঠিন শিলাস্তর, উত্তপ্ত এবং লেলিহান অগ্নিশিখার মতো হলহলিয়ে উঠছে প্রচন্ড এবং ক্রোধান্ধ তুমুল শব্দরাজি; সাবধান এবং ধ্বংস এবং বজ্র এবং মাতঙ্গ এবং গান্ডিব এবং ব্যাঘ্র এবং হলাহল এবং সিংহ এবং ভূজঙ্গ এবং বৃষ এবং খড়্গ প্রভূত শব্দাবলি সেই দুর্দম অগ্নিশিখার মাঝখানে আতসবাজির মতোই মুহুর্মুহু ফেটে পড়ছে। অনুর মনে হলো বুড়ো হরিয়ার হাতের এই প্রলয়ঙ্কর পাখোয়াজ নিঃসৃত শব্দবাণে পৃথিবীর যাবতীয় সভ্যতা ভেঙে চুরমার, খানখান হয়ে যাবে। রক্তবৃষ্টি! মাংসবৃষ্টি! অগ্নিবৃষ্টি! রক্তমাংস অগ্নিবৃষ্টি! (২০০৯ : ৯০, ৯১)

আবার কালোবরফ-এ পারিপার্শ্বিকতার সাথে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ আব্দুল খালেকের মানসিক অবস্থার নির্মাণে লেখক আশ্রয় নেন চেতনা প্রবাহ রীতির। আব্দুল খালেকের অতীত বর্তমানের ভ্রমণশীলতা এবং বর্তমানের মানসিক সংক্ষুদ্ধতার বর্ণনায় যে ভাষার আয়োজন তিনি করেন, তা একটু দেখা যাক-

সেসব কত কথা। ইচ্ছে করলেও এখন আর সব মনে পড়ে না। কত কথা, কত চার ভাঁজ-করা ছবি, তেশিরা কাচ, লালকুঁচ, কত সকাল-দুপুর-বিকেল বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছে পোকা!………যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার জিনজার-গিনজার, জিনজার-হিনজার পোকা শোনে, শুনতে পায়। পোকা পোকা হয়ে যায়। (২০০০ : ৩৭, ৩৮)

এ-ছাড়াও মফস্বলীয় জীবনের প্রেক্ষিতে একটি কিশোরের হৃদয়ভাঙা অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলতে তিনি অবতারণা করেন নাটকীয় পরিস্থিতির। কালো বরফ উপন্যাসে দীর্ঘকালের সঙ্গী ছবিকে ছেড়ে আবদুল খালেকের ‘মনি ভাইজানের’ চলে যাওয়ার যে-দৃশ্য মাহমুদুল হক তাঁর টান-টান বাক্যে আঁকেন তা এককথায় তুলনারহিত-

মনি ভাইজান, পুকুরে ডুবে যাওয়ার মতো হাঁসফাঁস করে বললে, ছবি, আমরা চলে যাচ্ছি। ছবি, আমরা আর এখানে আসবো না, আমাকে মাফ করে দাও। কোনো কথা না বলে মাটির ওপরে বসে পড়লো ছবিদি, ফুঁপিয়ে উঠলো। মনি ভাইজান আবার বললে, আমরা চলে যাচ্ছি ছবি। ছবিদি বললে, মনিদা কোনোদিন মন থেকে তোমাকে গাল দিই নি। মনি ভাইজান বললে, আমাকে কিছু দাও ছবি, আমাকে কিছু দাও। উঠে দাঁড়িয়ে ছবিদি বললে, কি নেবে মনিদা, কি নেবে তুমি? এনি ভাইজান বললে, তোমার যা খুশি, যা দিতে পারো, হাতে সময় নেই, দেরি হযে যাচ্ছে, দাও। ফস করে মাথা থেকে ফিতে খুলে দিল ছবিদি। বললে, এটা নেবে? মনি ভাইজান ভিক্ষা নেওয়ার মতো দুহাত পেতে বললে, তোমার মাথার কাঁটা, ক্লিপ, যা পারো, সব দাও। ছবিদি দিলো। দিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠলো। বললে, মনিদা, আমি মরে যাবো, আমি মরে যাবো। মনি ভাইজান অন্যদিকে তাকিয়ে বললে, আমি আসবো, যে করেই হোক আমি আসবো ছবি, তুমি থেকো। (২০০০ : ১২৮, ১২৯)

আবদুল খালেকদের পরিবারের চিরকালের দেশত্যাগ এবং মনি ভাইজান ও ছবির চিরকালের জন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বেদনাময় দৃশ্যের যে-শাব্দিক ব্যঞ্জনা মাহমুদুল হক সৃষ্টি করলেন তা এতটাই সংবেদনা জাগাতে সক্ষম যে তা সমস্ত রকম ইতিহাস, রাজনীতি আর সামাজিকতার প্রসঙ্গকে নিমেষে তুচ্ছ করে দেয়। বহুদিনের পুঞ্জীভূত ঘটনা, পারস্পরিকতা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, বিশ্বাস-সংস্কারের ধারাবাহিকতা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের পরিণতিতে এসে ঠেকে। বিস্তৃতির জগতকে বাকপরিমিতি দিয়ে জীবন্ত করে তোলেন কথাশিল্পী। হৃদয়ানুভূতির চাইতে পৃথিবীতে আর কোন বড় ধর্ম নেই- মাহমুদুল হকের ভাষা রচনা করে হৃদয়মথিত বর্ণিল রসানুভূতি।

 

৩.

মাহমুদুল হকের ভাষায় ‘জ্যামিতিক’ (সৈয়দ শামসুল হক ২০১০ : ৫০) বিন্যাসের উপস্থিতি লক্ষ করেন সমালোচক। আরেক সমালোচক বলেন, ‘আমাদের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান গদ্য-ভাস্কর মাহমুদুল হক। কথকতাকে ভাস্কর্যশিল্পে রূপান্তরিত করেছেন তিনি।’ (রবিউল হুসাইন ২০১০ : ১০৩)

মাহমুদুল হকের জীবন-বাস্তবতা পর্যায়ের উপন্যাসগুলিতে তিনি আরও তীক্ষ্ন ও ব্যঞ্জনাময়। মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ের তাঁর উপন্যাসগুলোতে কাহিনির পরিবর্তে চরিত্রসমূহের বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিমুখ প্রাধান্য পেয়েছে। অনুর পাঠশালা উপন্যাসে অনুর এবং কালো বরফ উপন্যাসে আবদুল খালেকের চেতনাশ্রয়ী অবলোকন মুখ্য হওয়ায় সেসব উপন্যাসের ভাষায় বাইরের বিস্তৃত জগতের ও বহুতর ঘটনাপ্রবাহের স্থান ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে কম। কিন্তু জীবন-বাস্তবতা ধারার উপন্যাসে আখ্যানের বিস্তার ঘটেছে এবং জীবনের বিচিত্র সব ঘটনা ও অনুভূতি সেই আখ্যানভাগের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। নিরাপদ তন্দ্রায় শহুরে বস্তির প্রেক্ষাপট আর বিচিত্র সব পেশার মানুষজনের সংমিশ্রণে উপন্যাসের জনজীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। তাই পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলোর ভাষারীতি এখানে বদলে যায়। বিশেষ করে সংলাপের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন প্রত্যক্ষ। সামাজিকভাবে নিন্মস্থ বস্তিবাসীদের জীবনচিত্রে ভদ্রোজনোচিত সংলাপের রীতি বর্জন করে মাহমুদুল হক বাস্তবানুকারী ভাষা ব্যবহার করেছেন। সেই ভাষা মধ্যবিত্ত বা অন্যতর শ্রেণির দৃষ্টিতে শ্লীলতার সীমাছাড়ানো বলে প্রতিভাত হলেও মাহমুদুল হক বাস্তববোধের জায়গা থেকে বিচ্যুত হন না। মাটির জাহাজ উপন্যাসে নৌকাযোগে গ্রাম-ভ্রমণকারী জয়নাল এবং মনোহরের কিংবা গ্রাম্য মানুষজনের সংলাপে এবং তাদের জীবনসংক্রান্ত বর্ণনায় কখনও-কখনও ভদ্রেতর ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পাতালপুরী (২০০৯) উপন্যাসে মূলত আমিনুল নামক একটি চরিত্রের চেতনাপ্রবাহের সূত্রে বৃহত্তর সামাজিক জীবনের সংবাদ মেলে। এই উপন্যাসটিতে নাগরিক জীবনের উপস্থাপনায় সংলাপের ব্যবহার অন্যান্য উপন্যাসের তুলনায় অনেক বেশি। সংলাপ নির্মাণে লেখক মুনশিয়ানার পরিচয় দেন।

 

৩.১.

নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসটি মূলত যে-বস্তিকে ঘিরে সেটি শহরের এক সংকীর্ণ আলো-আঁধারি জীবনের চৌহদ্দি। ঔপন্যাসিকের বর্ণনায়-

ফকিরচাঁদ সর্দারের এই বস্তিতে বহু রকমের মানুষের বাস। হরেক রকম পেশা এদের। এদের কেউ কলকারখানায় কাজ করে। কেউ বা রাজমিস্ত্রি। কেউ মাটি কাটে, কেউ আবার সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে। মোল্লা, ঝাঁকামুটে, চাপরাসী, বাবুর্চি, ছিটকাপড়ওয়ালা, শিল-নোড়া কাটাইওয়ালা, জোচ্চোর, গাটকাটা, রংঝালাই মিস্ত্রি, শানওয়ালা, দর্জি, তামার কবচওয়ালা মায় পাখিওয়ালা পর্যন্ত। (২০০৯ : ১৬)

বিভিন্ন পেশার এমন নামোল্লেখ মূলত সামাজিকভাবে নিম্নস্থ শ্রেণির লোকজনের ভিড়ে পরিপূর্ণ একটি বস্তির জীবনচিত্রের প্রামাণ্য অবস্থান তৈরি করে। সেই বস্তির জীবনের ভাষাটাও প্রত্যাশিতভাবে ভিন্ন হতে বাধ্য। পূর্ববর্তী অনুর পাঠশালা উপন্যাসের ভাষা এখানে একেবারে বদলে যায়। এখানেই মাহমুদুল হকের জীবনঘনিষ্ঠতার পরিচয় স্পষ্ট ছাপ বহন করে। সমাজের ব্যবহৃত ভাষারও যে একটা শ্রেণি-বাস্তবতা থাকে সেটির গুরুত্ব বিবেচনায় নেন তিনি। চরিত্রগুলির সংলাপ ছাড়াও রচয়িতার নিজস্ব ভাষার গড়নেও সেই শ্রেণিবাস্তবতার প্রভাব পড়ে। একটি দৃষ্টান্তÑ

ঝোঁকের মাথায় তাড়াহুড়ো করে হিরনকে ভাগিয়ে আনার পর খোলা চোখে তাকে একটা জ্বলজ্বলে বিড়ম্বনা বলে মনে হলো কেরামত আলীর। এরপর পুলিশের হাঙ্গামা। হয়তো এইসব সাতপাঁচ চিন্তা করেই গা-ঢাকা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াটাই তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। বিয়ে করলেও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো সম্ভব ছিলো না। তাতেও শতেক রকমে ঝক্কি পোহাতে হতো। কিছুদিন না কিছুদিন ঠিকই টানা-হ্যাঁচড়া কামড়া-কামড়ি চলতো। (২৮)

উদ্ধৃতিটিতে মাহমুদুল হকের ব্যবহৃত ভাষার সংযোগ উপন্যাসের জনজীবনের সঙ্গে। শব্দপ্রয়োগের কৌশল থেকে বোঝা যাবে ঔপন্যাসিক ভাষাকে জীবনপ্রবাহের আদলে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ ভাষাকে জীবনের স্রোত বা চলমানতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি তিনি। যেজন্যে তাঁর উপন্যাসের ভাষা কৃত্রিমতাগন্ধী না হয়ে প্রকৃত বাহক হয়ে উঠেছে। উপর্যুক্ত উদ্ধৃতির ‘ভাগিয়ে’ ‘কামড়া-কামড়ি’ দুটি অনুষঙ্গই পুরো প্রেক্ষাপটের বাস্তব ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। একই সঙ্গে রচয়িতার বর্ণনার মধ্যে তা সৃষ্টি করে গতিময়তা। মাহমুদুল হকের জীবনবোধ এতটাই প্রখর যে তাঁর ব্যবহৃত সংলাপ সরাসরি উঠে আসে জনজীবনের অভ্যস্ততা নিয়ে। দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে ভাষাও উজ্জ্বলতা ছড়ায় তাঁর গদ্যনির্মাণে। তবে নিরাপদ তন্দ্রা-য় নিম্নবিত্তের মুখের ভাষা হিসেবে প্রমিতের ব্যবহার উপন্যাসটির একটি ত্রুটি হিসেবে গণ্য হতে পারে। কেন না চরিত্রানুগ এবং অঞ্চল অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারে এর আগে আমরা পেয়েছি শহীদুল্লাহ কায়সারের সারেং বৌ (রচনাকাল ১৯৬১), আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলী (১৯৬২) এর মতো উপন্যাস, এবং এর পরে মাহমুদুল হক নিজেই লিখেছেন অশরীরী (২০০৪) এবং পাতালপুরীর (২০০৯) মতো উপন্যাস। আলোচনার স্বার্থে নিরাপদ তন্দ্রা থেকে কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, ‘আকদ্দস ডাট মেরে বললে, ………. লটকে দেবার কায়দা আমরাও জানা আছে। ও তো একটা ছটাকে মিস্ত্রি, আইনের প্যাঁচের ও জানেটা কি!’ (২০০০ : ৪৮) অথচ আকদ্দস বস্তিবাসী, শর্দি, কাশির ট্যাবলেটের ক্যানভাসার। এমন অসঙ্গতির দেখা মেলে এ-পর্বের মাটির জাহাজ উপন্যাসেও ‘…… তোমার যদি মায়ের গর্ভে জন্ম হয়ে থাকে, ……. তাহলে একটা কথা তুমি রেখো জয়নাল ভাই, কখনো ভাতের খোঁটা দিতে পারবে না।’ (১৯৯৬ : ৭০, ৭১)। অথচ উল্লিখিত উক্তিটি গাঁয়ের মাঝি ও শহরের নারী পাচারের দালাল মনোহরের। অন্যদিকে অশরীরী-তে পাওয়া যায় এর বিপরীত, সংলাপ যদিও খুব কম। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহৃত বলেই এই স্বল্পতা। দৃষ্টান্ত- ‘ফাল দেন, আমার লগে ফাল দেন-’ (২০০৪ : ৭১)

মুখের ভাষার সবচেয়ে প্রাঞ্জল ব্যবহার হয়েছে পাতালপুরী-তেÑ আল্লার কসম গুরু, আমার ঝাঁজরা বিধি কলাম ফাল পাইরা উঠতাছে……., (২০০৯ : ৩২) এমন বহু উদাহরণ টানা যাবে পাতালপুরী থেকে। অবশ্য নিরাপদ তন্দ্রা (রচনাকাল ১৯৬৮), অশরীরী (রচনাকাল ১৯৭৭) ও পাতালপুরীর (রচনাকাল ১৯৮১) মধ্যে আছে যথাক্রমে নয় ও তেরো বছরের ফারাক। এই সময়ের ব্যবধান মাহমুদুল হককে নিম্নবিত্তের মুখের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন করেছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় নিম্নবিত্তের মুখের সংলাপের আঞ্চলিক ভাষায় এই ব্যবহার লেখক হিসেবে তিনি যেমন ঋদ্ধ হয়েছেন, তেমনি তাঁর সাহিত্যও হয়েছে সমৃদ্ধ।

 

৩.২.

মাটির জাহাজ উপন্যাসে ব্যবহৃত সংলাপের শক্তি এমনই যে তা লেখকের বর্ণনার ভাষাকেও চ্যালেঞ্জ করে। কেননা, সংলাপকে সেখানে মনে হয় একক ও বিকল্পশূন্য। সেই সংলাপ রচয়িতার বর্ণনার লক্ষে ব্যবহৃত অসংখ্য শব্দের প্রতিস্থাপনা হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ-

গতর যার, সংসার তার, সোজা কথা। এখন চুলের তেল দাও, হাতের চুড়ি দাও, শাড়ি দাও, বিলাউজ দাও, ভালো বিছানা দাও, আমিও ভালো বিছানা চিনি। মোড়ল তুমি কার, মোড়লের তখন বলা উচিত কড়ি যোগায় যে তার, কিন্তু মোড়ল বলতে পারে না, মোড়ল চুপ থাকে, মোড়ল বোতল ভাঙে, মোড়ল বোতল গড়ায়, মোড়লের মেজাজ তখন ছাদে চাপে। বলে বিটিশ দেখেছি, পাঞ্জাবি দেখেছি, ফুল বাঙালি দেখেছি, হাফ বাঙালি দেখেছি, বাঘও দেখেছি, ঘেয়ো কুত্তাও দেখেছি, কুমির কাঁকড়া কুচোচিংড়ি ফুচোচিংড়ি সব দেখেছি, আয়ুব খানের গদিতে মাল সাপ্লাই করেছি, আমার সামনে করো কাউমাউ চিল্লাচিল্লি বেত্তোমিজি। তারপর শুরু হবে মাতম, আলমাছি নিজের বুকে নিজে চাপড় মারবে, খালি বোতল কপালে ভাঙবে, আমারে মাইরা হালাও, আমারে বেইজ্জতি কইরো না, দুনিয়াদারি থিকা দিল উইঠ্যা গ্যাছে আমার, আল্লা আমারে তুমি উঠায়া নাও, আমারে রহম করো, আমারে ফানাফানা কইরা হালাওÑ (১৯৯৬ : ৩৬)

মাহমুদুল হকের উপর্যুক্ত ভাষার দৃষ্টান্ত সামনে রেখে তাঁর সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্যটি একবার পাঠ করা যাক।
এ দেশের নাগরিক কটু-জীবনকে সাবলীল-প্রাকৃতিকতার সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে গাঢ় আর অন্তরঙ্গ ভাস্কর্যের নির্মাতা তিনি। যেন পাহাড়ের একটি ছোট জলধারা সামনের ছোট-বড় পাথর-সাম্রাজ্য পার হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সুরভিত গদ্য এমনই নাটকীয় এবং সঞ্চারী। (রবিউল হুসাইন ২০১০ : ১০৩)

মাহমুদুল হকের জীবন-বাস্তবতা পর্যায়ের উপন্যাসগুলির মধ্যে অধিকাংশেরই প্রেক্ষাপট নিম্নশ্রেণি অধ্যুষিত জনজীবন। ফলে সেখানকার সংলাপে শ্লীল-অশ্লীলতার বিষয়টি গৌণ। যে-সংলাপের ভাষা ও ভঙ্গিকে মধ্যবিত্ত ঔচিত্যবোধের মানদন্ডে বর্জনীয় বলে মনে হবে দেখা যাবে নিম্নবিত্ত মানুষ সেটিই ব্যবহার করে অবলীলাক্রমে। মাহমুদুল হকের ভাষা-বিবেচনায় স্থান পেয়েছে চরিত্রানুগ ভাষাভঙ্গি এবং দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর সংলাপ কৃত্রিমতামুক্ত। নিম্নবিত্ত মানুষ যেমন ভাষা ব্যবহার করে ঠিক তেমন ভাষাই ব্যবহৃত হয় তাঁর উপন্যাসে। এমনকি সেই ভাষার প্রভাব পড়ে ঔপন্যাসিকের বর্ণনার ভাষার ওপরেও। কয়েকটি নমুনা পরখ করা যাক। এগুলো মূলত ঔপন্যাসিকের বর্ণনা কিন্তু এগুলোকে উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর সংলাপ বলে ভ্রম হওয়া স্বাভাবিক। কখনও-কখনও রচয়িতার বর্ণনা এবং উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর ব্যবহৃত সংলাপের মধ্যে কোন ব্যবধান থাকে না।

(ক) কি করছে এখন আলমাছি বিবি! বুবির সঙ্গে গুঁতোগুঁতি, না টাইমের বাবুদের কাউকে বুঝ দিচ্ছে। … … বুবিটা ত্যাঁদড় আছে ভেতরে ভেতরে; জুলপিঝোলা ঝাঁকড়াচুলো ছোকরাগুলোকে একটু বেশি খেলা দেয়। (মাহমুদুল হক ১৯৯৬ : ৩০)
(খ) গজারাম লেনের অমন সুবিধের বাড়িটাই ছাড়তে হলো ছোকরার উৎপাতে, কি মজান মজিয়েছিল বুবিই জানে। পেতলের খুন্তি গরম ক’রে ছ্যাঁকা দিয়েছিল বুবির পাছায়, (৩১)
(গ) এখন হাতে পেয়ে লেজ নেড়ে নেড়ে খেলা দেখাচ্ছে মনোহর আলী। কিসের এতো দর কষাকষি, মেজাজই খাট্টা হয়ে গেছে, জয়নাল এইসব পা ঘষাঘষি অনেক দেখেছে। (৩২)
(ঘ) সন্ধ্যার আগে থেকেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। ফাঁকে ফাঁকে বাড়ে কমে, কখনো একেবারেই ছেড়ে যায়। বৃষ্টি হলেও ভ্যাপসা গরম আরো গুমোট বাঁধে, গা চিড়বিড়ানি বাড়ে। (৬২)

উপর্যুক্ত ভাষার দৃষ্টান্ত মাটির জাহাজ উপন্যাস থেকে দেওয়া যাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এবং মাহমুদুল হকের অন্যান্য উপন্যাসেও এমন ভাষাভঙ্গি সুলভ। এটি তাঁর রচনারীতিরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ভাষা-ব্যবহারের সচেতনতা মাহমুদুল হকের এই গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য।


আরো পড়ুন: কবিতাগুচ্ছ । চৈতালী চট্টোপাধ্যায়



মাহমুদুল হকের মুক্তিযুদ্ধ ধারার উপন্যাস তাঁর গদ্যের শক্তিতে ভাস্বর। অনুর পাঠশালা এবং কালো বরফ উপন্যাসের মনস্তাত্ত্বিক উন্মোচন তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে মুখ্য নয়। আবার, নিরাপদ তন্দ্রা এবং মাটির জাহাজ-এর নিম্নবিত্ত জীবনও এসব উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধই এখানে প্রধান, যুদ্ধের সর্বগ্রাসিতায় সৃষ্টি হয়েছে নতুন ধরনের বাস্তবতাÑ ভাষা সেই বাস্তবতাকে ধারণ ও প্রকাশ করেছে। ভাষা পরিবেশানুযায়ী বদলেও গেছে। জীবন আমার বোন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় পাত্র-পাত্রীরা মূলত শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত এবং উপন্যাসটির পরিপ্রেক্ষিত ঢাকা শহর। খেলাঘর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রেরা মূলত ঢাকাবাসী কিন্তু উপন্যাসটির একটি বড় অংশ ঢাকার অদূরবর্তী গ্রাম-এলাকা। অশরীরী উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ঢাকা শহর। বিষয় সমধর্মী হলেও তিনটি উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত এবং বিন্যাস একরকম নয়। যুদ্ধের বাস্তবতা, জনজীবনের যুদ্ধের প্রভাব, বিভিন্ন চরিত্রের মনস্তত্ত্বে যুদ্ধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নানা মাত্রার প্রভাব পড়েছে উপন্যাসগুলোর ভাষার ওপর। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি মাহমুদুল হকের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোতে সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে। তাদের চিন্তা-দর্শন-সংলাপ সবই নিম্নশ্রেণির চাইতে আলাদা। তাই, নিরাপদ তন্দ্রা এবং মাটির জাহাজ উপন্যাসের ভাষাভঙ্গি এসব উপন্যাসে লক্ষযোগ্য নয়। মাহমুদুল হকের ভাষা তাঁর বিষয় ও পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে অন্বিত। বিষয় এবং পরিপ্রেক্ষিতকে প্রকাশের জন্য এ-পর্বের উপন্যাসগুলোতে তিনি প্রাধান্য দেন সংলাপের। সংলাপধর্মিতার কারণেই উপন্যাসগুলো স্বতন্ত্র্য হয়ে আছে। রচনার বিষয় ও ভাব উপস্থাপনে তাঁর উপন্যাসের সংলাপধর্মিতা বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর অবস্থানকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে। সমালোচকের মতে, ‘সাহিত্যে আঞ্চলিক বা উপভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্যিকরাই প্রথম সংলাপের সচেতন ব্যবহার শুরু করেন।’ (মুনীর চৌধুরী ১৯৭০ : ৩৫) তাঁর মতকে আমরা সত্য প্রমাণিত হতে দেখি শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা (১৯৫৪), আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৫৫), আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০), শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬৩) প্রভৃতি উপন্যাসে। তবে এদের রচনার সংলাপের ব্যবহারের সাথে মাহমুদুল হকের সংলাপের ব্যবহারের পার্থক্য বিস্তর। তার সংলাপ বা কথপোকথন কখনও স্পষ্ট করেছে চরিত্রের মনস্তত্ত্বে, কখনও দেশকালের অবস্থা, কখনও বা নিম্নবিত্তের কঠোর জীবন সংগ্রাম। এই সংলাপ কখনও বা যুদ্ধাহতের ফেলে আসা দুঃসহ জীবন ভুলে থাকার কারণেও ব্যক্ত। এসব দিক থেকে তিনি পূর্ববঙ্গ নয় বরং কিছুটা যেন পাশ্চাত্যের Ernest Hemingway, the sun also rises (1926), The old man and the sea (1952), Katherine mansfield. ‘A cup of tea’, The garden party and the other stories (1922), Italo calvino. ‘Adam, one afternoon’, Adam, one afternoon (1957) এর উত্তরসূরি। উল্লিখিত লেখকগণ তাদের উল্লিখিত রচনার সংলাপের মাধ্যমে পরিষ্কার করেছেন চরিত্রের মনসত্ত¡, সমসাময়িক প্রেক্ষিত। মাহমুদুল হকের সংলাপ নির্ভর এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুটি উপন্যাস জীবন আমার বোন ও খেলাঘর। এবার উপন্যাস দুটির গদ্যকে বিশ্লেষণ করা যাক।

৪.১
জীবন আমার বোন উপন্যাসের গদ্যের সবচেয়ে বড় গুণ এর সংলাপধর্মিতা। শুধু সংলাপের মাধ্যমে পুরো উপন্যাসকে স্পষ্ট করে তোলার অনন্যসাধারণ উদাহরণ জীবন আমার বোন। উপন্যাসটির শুরু হয়েছে সংলাপের মাধ্যমে, শেষও হয়েছে সংলাপের মধ্য দিয়েই। অথচ শেষের সংলাপটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র খোকা স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকা তার হারিয়ে যাওয়া (হয়তো মৃত) ছোট বোন রঞ্জুর। একজনের স্মৃতিরোমন্থনের মধ্য দিয়ে সংলাপের এমন উপস্থাপন উপন্যাসটিকে দিয়েছে বৃহত্তের ব্যঞ্জনা। সংলাপ জীবন আমার বোন-এর সবচেয়ে বড় শক্তি। Ernest Hemingway তাঁর Old man and the sea-তে বৃদ্ধ নাবিকের একাকী মানসিকতার উপস্থাপনে এক অদৃশ্য সত্ত্বার উপস্থির মাধ্যমে আশ্রয় নিয়েছেন সংলাপের (সান্তিয়াগো যার সাথে কথা বলত বাস্তবে তার কোনও উপস্থিতি ছিল না)। তেমনি দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভকাল এবং সেই সময়ে জনজীবন ও তাদের মানসিকতার প্রকাশ্যে মাহমুদুল হক এই উপন্যাসে ব্যবহার করেন সংলাপের পর সংলাপের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখকের পক্ষ থেকে কোনও বর্ণনা নেই। সংলাপের মাধ্যমেই উঠে এসেছে পারিপার্শ্বিকতা-

মুরাদ বললে, ‘বাজে কথা রাখ, রেসকোর্সে যাচ্ছিস তো কাল?’
‘কালকের কথা কাল হবে, তুই কি এখন উঠছিস?
‘যেতে হবে না?…. প্রত্যেকটা দিন এখন ইতিহাসের একেকটি পাতা; আমরা একেজন একেটা সাক্ষী হয়ে থাকবো।’ (মাহমুদুল হক ২০০৮ : ৫২)
‘দেশ দেশ করে চাষার মতো অমন চিৎকার জুড়ছিস কেন? দেশ বলতে কী বুঝিস তুই?………… নিজের বেকারত্ব নিয়ে হাবুডুবু খেতে এখন হঠাৎ দেশ দেশ করে পাগলা হয়ে উঠেছিস, আমাদের ময়নার বাপ যেমনভাবে বলে জয়বাংলা কায়েম হলেই আর কাজ করাতে হবে না তার মেয়েকে! (৫৪)
‘কার যে ঘটবে? সাংঘাবিক একটা কিছু হয়ে যেতে পারে কালকের মিটিং এ!’ (৫৮)
‘তুই খোকাগাহ শিকড়সুদ্ধ মুখ থুবড়ে পড়ে যাবি;’ (৫৯)

পুরো সাত পৃষ্ঠা জুড়ে চলা এই সংলাপ একই সাথে আমাদের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের সংবাদ যেমন দেয় তেমনি দেয় যুদ্ধ নিয়ে খোকা ও তার বন্ধুদের মানসিকতার সংবাদও।

উপন্যাসটিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সমান্তরাল দুটি রেখার মধ্যে অন্যতম। মূল চরিত্র খোকার তৎপরতা এবং নীলাভাবীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার জীবনকাহিনিই উপন্যাসটির অন্যতম রেখা। খোকা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং তার চিন্তাজগতের প্রভাব উপন্যাসটির ভাষারীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। খোকাকে ঘিরে অন্যান্য চরিত্রের সক্রিয়তাতেও খোকার কেন্দ্রিকতা হারায় না। মোটকথা খোকার সত্তা জীবন আমার বোন উপন্যাসের ভাষার বিন্যাসকে প্রভাবিত করেছে। খোকা চরিত্রের মধ্যে রয়েছে বেদনা, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, বিযুক্ততা এসব নেতিবাচক অনুভূতির উপস্থিতি। কখনও-কখনও এই নেতিবাচকতা খোকার মধ্যে জন্ম দেয় অবিশ্বাস বা আস্থাহীনতা। কোনও কিছুকেই সে সহজে মেনে নিতে অপারগ। খোকার মানসিক রুচিবোধ ও বৈদগ্ধের দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। দেশি-বিদেশি সাহিত্য পাঠ-করা খোকার মননাভিজাত্যের ছাপ থাকে তার ভাষাতেও। ফলে, তার সংলাপে এবং তার সম্পর্কে বলা লেখকের কথায় থাকে বাক্বৈদগ্ধ। নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসের বস্তিবাসীদের জীবননির্ভর ভাষায় সেই বাক্বৈদগ্ধ অনুপস্থিত। সমাজভাষার অনুসৃতি মাহমুদুল হকের সচেতন ভাষাপ্রয়োগের ফল। জীবন আমার বোন উপন্যাসের ভাষা বিশ্লেষণকালে স্মরণ রাখতে হয়, সময় উপন্যাসটির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যুদ্ধের আসন্নতা একটি জনপদকে প্রতিমুহূর্তে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্যে ছিল সর্ব অর্থেই এক নতুন অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া যুবকদের মনস্তত্ত্ব উপন্যাসের জন্যে একটি অনিবার্য দিক। কেন না, শিশু বা বয়স্করা নয়, যুদ্ধে যাবে যুবকরাই। কাজেই যুদ্ধ সমগ্র যুবমানসকে আচ্ছন্ন করে প্রবলভাবে। উপন্যাসের ভাষায় সেই মানসের ছাপ প্রত্যাশিত এবং জীবন আমার বোন উপন্যাসে সেটি প্রত্যক্ষ। যুদ্ধের বাস্তবতাস্পৃষ্ট বাইরের বৃহত্তর জীবন এবং নীলাভাবী ও অন্যদের সংলগ্নতায় খোকার অন্তর্জীবন, এই দুইয়ের মধ্যে চলে দ্বৈরথ। খোকার ভাষাকে তাই মনে হয় বেপরোয়া, দর্পিত ও তীব্র। খোকা ১৯৭১ সালের সমকালীন যুদ্ধ-বাস্তবতার প্রতিনিধি। তার ভাষা সেভাবেই বিচার্য। যুদ্ধের আসন্নতায় খোকার উচ্চারণ-

যে দেশ রক্ত দাও, রক্ত দাও বলে দুশো বছর ধরে চিৎকার করে চলেছে আমাদের কেউ নয় সে, দেশমাতৃকা তুই নস ! যে দেশ কেবল জন্মান্ধ রাক্ষসপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে লক্ষ লক্ষ দরিদ্রকে তোড়ের মুখে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ভুরিভোজের উৎসবে নিমন্ত্রণ করে হাঙরকে, তাকে বিশ্বাস নেই, দেশমাতৃকা তুই নস! (৭৮)

খোকার চিন্তাজগত, তার চেতনার প্রবহমানতা, অস্থির মানসিক পর্যটন, যুদ্ধের আগমনী-বার্তায় ভবিষ্যৎ কর্তব্যকর্ম স্থির করার ক্ষেত্রে তার অন্তরস্থিত বিক্ষিপ্ততা এসবকিছু টুকরো-টুকরো দৃশ্য-চিত্রের মতো নানা দিক থেকে একটি ভাষা-ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে। সেই ভাষা-আবর্তের খানিকটা দৃষ্টান্ত।
সবকিছুই একটা স্বপ্ন। স্বপ্নের ভিতরে আমরা জন্মাই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা চিৎকার করে উঠি, ঝনঝন ভেঙে যায় সব কাচ, তির তির করে কেঁপে ওঠে দুধের সর, কৌমার্যের পাতলা পর্দা। স্বপ্নের ভিতরে আমরা স্তন্যপান করি, স্বপ্নের ভিতরে আমরা শিল কুড়াই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা বকুল ফুলের মালা গাঁথি, স্বপ্নের ভিতরে অঞ্জু পুকুরে পড়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে মঞ্জু তাকে ধরতে যায়, স্বপ্নের ভিতরে নীলাভাবী কাচের চুড়ির শোকেস হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে রাজীব ভাই বৈদুর্য-বিদ্রƒম হাতড়ায়, স্বপ্নের ভিতরে ফিয়াট ঝড় হয়ে ওড়ে, স্বপ্নের ভিতরে বেলী ব্লাউস ছিঁড়ে ফ্যালে, স্বপ্নের ভিতরে লিপস্টিক জড় হয়, স্বপ্নের ভিতরে লুলু চৌধুরী কান ধরে টানে, স্বপ্নের ভিতরে মোদিলি¬য়ানী রঙ ছুঁড়ে দেয়, স্বপ্নের ভিতরে অর্ধেন্দু মুখ পুড়িয়ে ফেলে, স্বপ্নের ভিতরে মতিয়ুর শালিক হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে প্রীতি বিষ গলায় ঢালে, স্বপ্নের ভিতর হাইপোস্টাইল হল ভেঙে পড়ে, স্বপ্নের ভিতর পার্থেনন গমগম করে বাজে, স্বপ্নের ভিতরে পাপ পুণ্য হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে আত্তিলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে, স্বপ্নের ভিতরে অন্ধকার হড়াম করে ওঠে, স্বপ্নের ভিতরে দেখতে দেখতে আমরা আরেক স্বপ্ন হয়ে যাই। (৯৪)

সমকাল, অতীত, আসন্ন ভবিতব্য সবকিছু একটি সত্তা হয়ে এক ঝলকে দুলে ওঠে চোখের সামনে। পুরো বিবরণ একটি দাড়িচিহ্নের যতিপাতে এসে নিষ্পন্নতা লাভ করে। এই ভাষায় লেখক সৃষ্টি করেছেন ব্যক্তি ও জাতির চেতনা, সমকালের অনিশ্চিত-সংশয়ী অবস্থা, খোকা ও তার মতো যুবকদের যুদ্ধকালীন মনস্তত্ত¡ এবং সর্বোপরি একটি ঋজুরেখ গতি। পুরো উপন্যাসের ভাষায় পূর্বাপর এই গতি বিদ্যমান। এই গতির সঙ্গে যুক্ত হয় খোকার নিজস্ব দার্শনিকতা যা যুক্তিতর্কের চরিত্রে প্রকাশ পায়। জীবন আমার বোন উপন্যাসের অনেকখানি জুড়ে থাকে এমন যুক্তিতর্কের গদ্য। আমাদের মনে রাখতে হয়, ১৯৭২ সালে রচিত এই উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রাথমিক পর্বে রচিত গুটিকয়েক উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম। মাহমুদুল হকের সামনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের আদর্শ বলতে ছিল একটি কি দুটি উপন্যাস। মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন উপন্যাসের বিষয়, আঙ্গিক এবং গদ্য সবকিছুই মুক্তিযুদ্ধনির্ভর বাংলাদেশের অন্য যে-কোনও উপন্যাসের চেয়ে আলাদা। এই স্বাতন্ত্র্য জীবন আমার বোন-এর সম্পদ। উপন্যাসটির শিল্পনির্মিতিতে ঔপন্যাসিকের ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

 

৪.২.

মাহমুদুল হকের খেলাঘর উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির আশ্রয়ে লেখা। যুদ্ধের ঘটনা ও দৃশ্যাবলী ঔপন্যাসিক বর্ণনা করেন বাহুল্য, অলংকার এসব বাদ দিয়ে প্রত্যক্ষ ও সরাসরিভাবে। বাস্তবে যেমন-যেমন ঘটে ঠিক তেমন তাঁর বর্ণনার ভাষা। কখনও তা রিপোর্টাজ বা প্রতিবেদনধর্মী বলেও মনে হয় কিন্তু ঘটনার নিখুঁত ও প্রামাণ্য উপস্থাপনা তাঁর গদ্যের শক্তি। যেমন-

হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাঁতিরা, চোখ তুলে তাকাবার মতো ফুরসত নেই, দিনরাত তাঁত চালায় আর সেই শব্দের ভেতর জয়বাংলার ধ্বনি শোনে। ইছামতি পার হয়ে হুট করে ঝাঁপিয়ে পড়লো আর্মিরা। তাঁত আর তাঁতিÑ তাদের লক্ষ্য দু’টোই। নদীর দিক থেকে বেড় দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা এগিয়ে এলো; আগুন ধোঁয়া আর চিৎকারের মাঝখানে যে যে-দিকে পারে ছুটে পালায়, যারা পারে না তাদের ধরে ধরে জ্বলন্ত তাঁতের ওপর ছুঁড়ে দিতে থাকে। (২০০৪ : ৪০)

আবার এ-উপন্যাসেই লেখক যখন মিঠুসার গ্রামে আশ্রয় নেওয়া রেহানা আর ইয়াকুবের ক্ষণকালীন যৌথ জীবনের বর্ণনা দেন তা সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহ এনে দেয়। ছোট-ছোট বাক্য ও সংলাপে রেহানার অস্তিত্বের ভঙ্গুরতা ও অনিশ্চয়তা চিত্রিত হয়। উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতিÑ

মাথার বালিশটাকে দলামোচড়া করে তার ভেতর নাকমুখ চুবিয়ে পড়ে আছে আন্না।
বললাম, ‘পায়ের আঙুল নড়ছে কেন?’
‘নড়ছে তাইÑ’
বললাম, ‘উঠবে না?’
‘একবারও বলেছো উঠতে?’
‘বলতে হবে?’
‘না ডাকলে আমি উঠবোই নাÑ’
‘আন্না, এ আন্না এবার ওঠো; সেই কখন সকাল হয়েছে; সকালের ঘুম শয়তানেরÑ’
চোখ খুলে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো আন্না। বললে, ‘আমার একটা হাত ধরে টেনে তোলো তবেÑ’
টেনে তোলার পর আন্না বেশ কিছু সময় নিয়ে চোখ রগড়ায়। (৪৩)

ওপরে যে-দৃশ্যায়ন ঘটলো তাকে আন্না বা রেহানা ও ইয়াকুবের জীবনের স্বপ্নীল একটি পর্ব বলেই পাঠকের মনে হওয়া স্বাভাবিক। এখানে বাক্যগুলো বেশ সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাতে আবেগের ঘাটতি নেই। একে দাম্পত্য জীবনের সংলাপ বলেও মনে হতে পারে যদিও বাস্তবে তারা দম্পতি নয়। একটা মধুরিমা ছড়ানো এই দৃশ্যায়নই পাঠকের নিকটে পুনর্পাঠে বেদনাময় বলে মনে হবে যখন জানা যাবে যে মিঠুসার গ্রামে আসার আগে রেহানা পাকিস্তানি হানাদারদের ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। পরিস্থিতির নাট্যিকতা এবং নাটকীয়তা সৃষ্টিতে এরকম ছোট-ছোট বাক্য বা সংলাপনির্ভর গদ্যরীতির ভূমিকা খেলাঘর উপন্যাসে অধিক। এদিক থেকে মাহমুদুল হকের এ-উপন্যাস তাঁর অন্যান্য উপন্যাস থেকে স্বতন্ত্র। খেলাঘর উপন্যাসেও আছে প্রচুর সংলাপ। তবে এগুলো তৎকালীন দেশের অবস্থা বোঝাতে রচিত হয়নি। এই সংলাপ রেহানার ‘বাচালতা’। এবং সমগ্র উপন্যাস জুড়ে রেহানার এই বেশি কথা বলার অভ্যাসে আমরা তাকে প্রগলভ আখ্যা দিতে পারি। তার এই সংলাপ তার চিত্তচাঞ্চল্যের বহিঃপ্রকাশ বলতে পারি। তাছাড়া রেহানার বাচলতাকে, তার অস্থিরতাকে শুধু স্বভাবদোষ হিসেবে দেখলে তার প্রতি অন্যায় হবে, লেখকের ভাষার ব্যবহারের ভুল ব্যাখ্যা হবে। এবং উপন্যাস শেষে আমাদের উপলব্ধি হবে রেহেনার বাচালতা ধর্ষিতার রেহানার (যা প্রথম থেকে গোপন রেখে উপন্যাসের শেষে স্পষ্ট করেছেন লেখক) কষ্টের প্রশমনের ক্ষেত্রে কত জরুরি ছিল। একটি উদাহারণ দেখা যাক- ‘ঝুমি নাম তোমার পছন্দ; ঝুমি বলে ডাকত আমার দাদা ভাই……. ইচেছ করে না যেতে, কাছে থাকিস আমার সোনার পুতুল। দাদা ভাইয়ের কী কান্না।’ (২৩, ২৪, ২৫, ২৬)

প্রায় চার পৃষ্ঠা জুড়ে একাই কথা বলে গেছে রেহানা। রেহানার সংলাপে তার মানসিক অস্থিতা প্রকাশের পশাপাশি তার স্মৃতিকাতরতাও উঠে আসে। পাঠকের হৃদয়াঙ্গম হয় এই রেহানা একদিন ঝুমি ছিল। দাদা, দাদি আর বন্ধুদের নিয়ে তার নিজস্ব চমৎকার একটি ভুবন ছিল।

 

৪.৩.

উপন্যাসের গদ্যে থাকে যুগপৎ ঔপন্যাসিকের এবং তাঁর চরিত্রের মানসের ছাপ। কখনও-কখনও এই দুয়ের একটি অন্যটির সঙ্গে এমনভাবে সংমিশ্রিত হয়ে থাকে যে কোন্টি চরিত্রের আর কোন্টি রচয়িতার তা স্থির করা দুরূহ হয়ে পড়ে। চরিত্র হতে পারে রচয়িতার নিজস্ব বিশ্বাস ও ভাবনার সরাসরি প্রতিনিধি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরে (১৯১৬) উপন্যাসের নিখিলেশ চরিত্রের কথা বলা যায়। চরিত্রটিকে তার ভাষা-প্রকাশের মাধ্যমে আমরা রবীন্দ্রনাথের মানস-প্রতিনিধি বলে চিহ্নিত করতে পারি। কিংবা, শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক (১৯৬৫) উপন্যাসে জাহেদ চরিত্রটি। এটি ঔপন্যাসিক শহীদুল্লা কায়সারের মানস-ছায়া। যে-সংলাপ জাহেদ ব্যবহার করে এবং যে-গদ্য জাহেদকে ঘিরে ঔপন্যাসিক প্রকাশ করেন তাতে রচয়িতার মানস-প্রতিফলন সুস্পষ্ট। অশরীরী উপন্যাসের আম্বিয়া চরিত্রটিতে ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের মানস প্রতিফলন ঘটেছে। আম্বিয়ার চোখ দিয়ে তিনি তাঁর দেখা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ঢাকা শহর এবং সেখানকার পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। বন্দি আম্বিয়ার চোখে শহরে ঘটে যাওয়া হত্যাকাÐের দৃশ্য চিত্রণে ঔপন্যাসিক ধীর-গম্ভীর ও খানিকটা প্রলম্বিত বাক্যরীতির আশ্রয় নেন। এই ভাষা তাঁরই মুক্তিযুদ্ধাশ্রিত উপন্যাস খেলাঘর থেকে আলাদা। দৃষ্টান্তÑ

অনেক আগেই পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলোয় নি পানি চাওয়ার। নদীর পানিতে এখানে-ওখানে ভাসছে অসংখ্য মানুষের লাশ। জানালায় চোখ রেখে নীরবে এইসব দেখে আম্বিয়া। কোনো-কোনো লাশ খুব তাজা, তবে অধিকাংশ গলিত, বিকৃত। কোনো-কোনো লাশের হাত কিংবা পা আকাশমুখো। ঢেউয়ের বাড়ি খেয়ে ধারে গিয়ে ঠেকে আছে, এমন লাশও অনেক, সেখানে শকুন আর কুকুরের ভিড়, কামড়াকামড়ি। (২০১০ : ৬৯)

উপর্যুক্ত গদ্যভঙ্গি উপন্যাসটিতে মূলত ব্যবহৃত হয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি, যুদ্ধের পরিণাম, অবরুদ্ধ দেশ সবই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আশ্রয়ে রচিত। এ-গদ্য পাঠ করলে এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধুমাত্র কল্পনার মাধ্যমে এমন গদ্য রচনা করা সম্ভব নয়। এমনকি শত্রু-ক্যাম্পে অন্তরিণ আম্বিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যের সংলাপটিও লক্ষ করবার মত। সৈন্যটি যখন বাংলা ভাষায় আম্বিয়াকে হুমকি দিয়ে কথা বলতে শুরু করে তখন তা মুক্তিযুদ্ধেরই অন্যতর বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। সৈন্যটির ¯ø্যাং সম্পূর্ণরূপে অশ্লীল কিন্তু তা উপন্যাসটির মেজাজের সঙ্গে কোনও বিরোধাভাস রচনা করে না বরং তা অশরীরী উপন্যাসকে আরও প্রকট এবং বাস্তব করে তোলে। উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতিÑ

‘কি নাম?’
‘আম্বিয়া!’
‘জাম্বুরা!’ টেবিলের সামনে খাতা নিয়ে বসে থাকা লোকটি আম্বিয়ার পেটে কলমের ছোট্ট
একটা খোঁচা দিয়ে বললে,
‘কি হাইক্লিস নাম, মারভিলিস্ নাম, পাইনমারা বোঝস খানকির পুত, তোর পাইন মারমু।
বোঝছস কি কইলাম, তরে গাঙ কইরা দিমুÑ’ (৭৮)

মাহমুদুল হকের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি উপন্যাসের গদ্য একরকম নয়। একই লেখকের পক্ষে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে পৃথক-পৃথক গদ্যরীতির প্রয়োগ সহজ কাজ নয়। সচেতন অনুধ্যান আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রচেষ্টা ছাড়া তা সম্ভবপর হয় না। জীবন আমার বোন উপন্যাসে খোকার, খেলাঘর-এ আন্না বা রেহানার এবং অশরীরী-তে আম্বিয়ার প্রেক্ষণবিন্দু মূলত আশ্রিত হয়েছে। এই তিনটি চরিত্রের মধ্যে পারস্পরিক তুলনা থেকেও দেখা যায় যে তারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্রÑ অনুভবে এবং প্রকাশে। তাই তাদের কেন্দ্রিকতায় নির্মিত ভাষাও পরস্পর পরস্পর থেকে পৃথক হতে বাধ্য। মামুলি লেখকের পক্ষে সম্ভব নয় সে-পৃথকতা সৃষ্টি করা। কিন্তু মাহমুদুল হক এক্ষেত্রে বিস্ময়কর রকমের সফল। পরিস্থিতি-প্রতিবেশ এবং চরিত্রানুয়ায়ী গদ্যের নির্মিতি গড়ে তুলেছেন তিনি।

 

৫.

বাংলাদেশের সাহিত্যের উপন্যাস বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সমালোচক মন্তব্য করেছিলেন, ‘আধুনিক ঔপন্যাসিকের অভিজ্ঞতাকে হতে হয় জীবনমূলস্পর্শী; শিল্পসৃষ্টির প্রশ্নে পরীক্ষাপ্রবণ ও সমকালশাসিত।’ (সৈয়দ আকরম হোসেন ১৯৯৭ : ১২২) মাহমুদুল হকের উপন্যাসসমূহের আলোকে তিনি সমালোচক কথিত তেমনই একজন ঔপন্যাসিক। তাঁর কোনও একটি উপন্যাস আরেকটির মতো নয় না নির্মাণে, না চরিত্রের সংগঠনে, না গদ্য-ব্যবহারে। তাঁর উপন্যাসের ভাষা তাঁর সচেতন গদ্যচিন্তার প্রকাশ এবং তাঁর ভাষা স্বতঃস্ফূর্ত ও গতিময়। মাহমুদুল হকের সবগুলো উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে একটা স্পন্দিত জীবনের প্রবাহ। তাঁর ভাষা সেই প্রবাহকে এগিয়ে নেয় সুষম বিন্যাসের মধ্য দিয়ে। মোটকথা, তাঁর উপন্যাসের গদ্য এবং তাঁর উপন্যাসের বিষয়, এই দুইয়ের একটি অন্যটির সহযোগী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের উপন্যাসের জগতে যেসব ঔপন্যাসিক কেবলমাত্র কাহিনি-বর্ণনের কথাকার হিসেবে স্মরণীয় হবেন না, হবেন তাঁদের উপন্যাসের সামগ্রিক নির্মাণের জন্য, তাঁদের মধ্যে মাহমুদুল হক অন্যতম। তাঁর উপন্যাসশিল্প তাঁর গদ্যশিল্পের ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর।

সহায়ক পঞ্জি:

আবু ইসহাক (২০১২), সূর্যদীঘল বাড়ি, ত্রয়োবিংশ সংস্করণ, নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, ঢাকা
আলাউদ্দিন আল আজাদ (২০১২), তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, ষষ্ঠ মুদ্রণ, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ঢাকা
শামসুদ্দীন আবুল কালাম (২০১৬) কাশবনের কন্যা, বিভাস, ঢাকা
মুনীর চৌধুরী (২০০১), রচনা সমগ্র-৩, (সম্পাদনা: আনিসুজ্জামান), অন্যপ্রকাশ, ঢাকা
মাহমুদুল হক (২০০৯), অনুর পাঠশালা, পঞ্চম মুদ্রণ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা
(২০১০), অশরীরী, দ্বিতীয় মুদ্রণ
(২০০০), কালো বরফ, দ্বিতীয় মুদ্রণ
(২০০৪), খেলাঘর, দ্বিতীয় মুদ্রণ
(২০০৮), জীবন আমার বোন
(২০০৯), নিরাপদ তন্দ্রা
(২০০৯) পাতালপুরী
(১৯৯৬) মাটির জাহাজ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৬), ঘরে বাহিরে, বিশ্বভারতী, কলকাতা
(১৯১২), ডাকঘর
রবিউল হুসাইন (২০১০), ‘একজন শব্দ-ভাস্কর, মাহমুদুল হক’, আলোছায়ার যুগলবন্দি : মাহমুদুল হক
স্মরণে, (সম্পাদনা : আবুল হাসানাত ও অন্যান্য), সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা
শওকত ওসমান (২০০৭), ক্রীতদাসের হাসি, চতুর্থ মুদ্রণ, সময় প্রকাশন, ঢাকা
শহীদুল্লা কায়সার (২০০০), সংশপ্তক, জোনাকী প্রকাশনী, ঢাকা
সৈয়দ আকরম হোসেন (১৯৯৭), প্রসঙ্গ : বাংলা কথাসাহিত্য , মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা
সৈয়দ শামসুল হক (২০১০), ‘গদ্যের জাদু কোথায়’, আলোছায়ার যুগলবন্দি : মাহমুদুল হক স্মরণে,
(সম্পাদনা : আবুল হাসানাত ও অন্যান্য), সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা

Lodge David (1966), Language of fiction, Columbia University Press, USA

Hemingway Ernest (2006), The Sun also rises , Scribner, USA

      (1995), The old man and the sea

Calvino Italo (2001), ‘Adam, One afternoon’, Adam, One afternoon, Vintage Publishing,

      USA

Mansfield Katherine (2015), ‘A cup of tea’, The garden party and other stories, Createspace

      Independent Publishing Platform, USA

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত