| 28 মার্চ 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: মায়ের দেশ । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

সকালবেলায় দেরীতে ঘুম ভেঙে মায়ের মুখটাই মনে পড়ল রণজয়ের। মাকে গতকাল মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেছিল । যাতায়াত করতে  মায়ের অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল। গতকাল ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝার বুঝে গেছে রণজয়। মা বেশীদিন থাকবেন না। রে দেওয়া চলছে ঠিকই। কিন্তু কারসিনোমার লাষ্ট স্টেজ। মায়ের  টিউমার হয়েছিল। ডায়গনসিস হবার পর জানা গেল এটা ম্যালিগন্যান্ট। ভেতরে অনেকদূর শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে।তবু হাল ছাড়ে নি  রণজয়।

তবে মা এখন  বিছানায় নেই। বারান্দা থেকে সে দেখল মন্দির ঘুরে  মা আর সুধাদি ফিরছে।  রণজয় সুধাদিকে দেখে হেসে বলল,”তুমি যখন আছ চিন্তা নেই।“

সুধাদি হাসল। তারপর বলল,”মাসিমা কি বলছেন জানিস?”

মা চাপা দিতে চাইল। বলল,“আ! সুধা।“

রণজয় বলল, কি?

সুধাদি বলল,”মাসিমাকে একবার মামার বাড়ি নিয়ে যেতে পারিস। যা একবার ঘুরিয়ে আন।“

     উত্তর চব্বিশ পরগণার এক অখ্যাত গ্রামে  মায়ের  বাড়ি।  মা ছোটবেলায় সেখানে থাকত।খেলে বেড়াত। সেখানে নাকি বিশাল করে কালীপুজা হত। অমাবস্যার দিন জুয়া খেলা হত সারারাত। গাঁ-গঞ্জের লোকরা সেখানে খেলতে আসত।

 কিন্তু একটা কারণে মামার বাড়ি যাওয়া মায়ের বন্ধ হয়ে গেছিল। সেসময়ে তারা খুব গরীব ছিল। মামাবাড়িতে  একটা বিয়েতে নেমতন্ন পাওয়ার পর মা কার থেকে একটা দামী শাড়ী যোগাড় করে পড়েছিলেন। সেটার জন্য নাকি মায়ের রিলেটিভরা খুব হাসাহাসি করেছিলেন। বাবা শোনার পর রাগ করে ফিরে আসেন। মাকে আর কোনোদিন মায়ের বাড়ি যেতে দেন নি। রনজয়ও কোনদিন মামার বাড়ি যায় নি।

 সে বলল,- হুম। দেখি।

“দেখি কেন? মাসিমা যেতে চায় নিয়ে যা।“

 রনজয় এগিয়ে মায়ের হাত ধরল।মা না থাকলে কি হবে,সে কেমন থাকবে ধারনা নেই তার।সুধাদির কথায় সে মাথা নাড়ল।        

রণজয় একটা ছোট অফিসে কাজ করে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যায়। বাড়িতে সুধাদিকে বলা আছে। মাকে সে চোখে চোখে রাখে।

আজ  অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ সুধাদির ফোন এল। রণজয় বুকে আচমকা ভয় অনুভব করল। এ সময় ফোন করার মানে সিরিয়াস কোন ব্যাপার। সুধাদি হয়ত সামলাতে পারছে না মাকে।সে ভীত গলায় বলল,” কি হয়েছে সুধা দি?”

-তেমন কিছু নয়? আশ্বস্ত গলায় সুধাদি বলল। “তুই এখন কোথায়?”

“ট্রেন ধরব।“

“স্টেশনে নামবি যখন মিস্টির দোকান থেকে গরম রসগোল্লা আনবি।মাসিমা খেতে চেয়েছে।গরম ছাড়া আনবি না।“

 মা খেতে চেয়েছে! বিস্ময়ে থমকে গেল রণজয়। আজ পর্যন্ত মায়ের মুখে সে কোন আব্দার শোনে নি।সুধাদিকে সে বলল,“ঠিক আছে। আনব।“

 রাত দশটার  সময় বাড়ি ফিরল রণজয়। সুধাদি দরজা খুলল।সে এসেছে এবার সুধাদি চলে যাবে। সুধাদি পাশেই থাকে। রণজয় হালকাস্বরে জিজ্ঞেস করল,-“ঠিক আছে তো মা?”

“হ্যাঁ। এমনি ঠিক আছে।তবে!”

“তবে কি?”

“ কথা বেশী বলছে না মাসীমা। তুই যা।খাবার করে দিয়েছি। যখন খাবি গরম করে নিস।“

“মা খেয়েছে?”

“না। খায়নি। মুখে রুচছে না। তোর জন্য বসে আছে। ওই গরম রসগোল্লা খাবে।“

রণজয় মাথা নিচু করল রইল কিছুক্ষন। স্টেশনে নেমে সে গরম রসগোল্লার খোঁজ করেছিল। মিষ্টি-দোকানী বলল, “রাত আটটা-সাড়ে আটটায় পাওয়া যায়। তারপরে আর নয়।“

রণজয় বলল,”আমি এনেছি। কিন্তু তা গরম নয়।“

“তাতে কি? রসগোল্লা হলেই হল।তুই দে না।“

“ একটু গরম করে নেব?”

“ধুর। ওভাবে হয় নাকি?”সুধাদি হাসল।“যা তো দে মাকে।আমি চলি।“

হাত-মুখ ধুয়ে রণজয় মায়ের ঘরে ঢুকল।সুধাদি যথেষ্ঠ পরিস্কার করে রাখে।তবুও বাতাসে একটা চাপা ওসুধ-ওসুধ গন্ধ। রণজয় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। চারদিক ঝকঝকে পরিস্কার রাখার পরও গন্ধটা যায় না। বুঝিয়ে দেয় মানুষটা আসলে ভাল নেই।

মা বলল,- “এনেছিস?”

রণজয় মাথা নাড়িয়ে বলল,”রসগোল্লা তো? এনেছি। কটা খাবে বল।“

“গরম?”

“ওই মানে ঠিক।“

“খাব না। তুই নিয়ে যা।“

রণজয় অবাক হয়ে দেখল মা কেমন অভিমানে ফুঁসে উঠছেন।এই প্রথম মাকে রাগতে দেখছে।মায়ের শীর্ণ মুখে কপালের শিরা ফুটে উঠেছে।সে নুয়ে গিয়ে বলল,” আমি কাল আনব মা।আজ খেয়ে নাও।“

“না।“

রণজয় কাছে এগিয়ে গেল।মা ছোটখাট চেহারার মানুষ। তার মনে পড়ল মা পানের সাজিতে পান সাজতেন যখন সে কোন কোনদিন আচমকা মাকে  পেছন থেকে ধরে শূন্যে তুলে ঘোরাত।মা ভয় পেয়ে তার কাঁধ শক্ত করে ধরত আর চিৎকার করত,-ছাড়।ছাড়।পড়ে যাব।এখনও সে ধরনের ইচছা পেয়ে বসল তার।মায়ের কাছে ক্ষমাপ্রাথর্নার ভঙ্গীতে সে বসল।মাকেই তো সব কথা বলা যায়। সে কপট রাগ করে বলল,- “খাও না।“

“না।“

রণজয় চুপ করে রইল।মায়ের রাগের জন্য তার কস্ট হচ্ছে না। সে ভাবছে মায়ের অভিমানের কথা।এমন অভিমান মায়ের ভেতরে চাপা ছিল!কোনদিন তাদের দেখায় নি।অথবা সে বোঝে নি।সে মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,- “আচ্ছা।খেও না।“

মামার বাড়ি যাওয়াটা ফাইনাল করে ফেলল রণজয়। বিশেষত গরম রসগোল্লা খাওয়া নিয়ে মায়ের আচরনের পর। সে সুধাদিকেও যেতে বলেছে। সুধা-দি থাকলে তাদের সুবিধা।কিন্তু একটা চিন্তা এতটা যাবার ধকল মা নিতে পারবে কি না? মা একটুআধটু ভুল বকছেন।  সুতরাং বিলম্ব করা ঠিক নয়।ঝুঁকি নিয়েই এক ছুটির দিন দেখে রণজয় ব্যবস্থা করে ফেলল।সে ঠিক করল সকাল সকাল এখান থেকে বেড়িয়ে যাবে।

সুধাদি জিজ্ঞেস করল,- “ওখানে কারা আছে জানিস?”

রণজয় বলল,”উহু।আমি কারুকে চিনি না।শুধু কয়েকজনের নাম জানি।মালতীমাসী। দ্বিজুদাদু। ছায়াদিদু আর কে কে যেন।মায়ের মুখ থেকেই এদের নাম শুনেছি।“

সুধাদি বলল,”ওরা কি সব আছে এখন?”

“না থাকার কথা নয়। কোনো যোগাযোগ নেই।কতবছর আগের কথা বল তো? মা শেষ গেছিল কার একটা বিয়েতে।

হুম। সেখানেই তো মেশো  রেগে ফিরে এসেছিল।

সুধাদি সব জানে। রণজয় হাসল। বাবা খুব আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন।কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা বজায় রাখতে গিয়ে  মায়ের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেন নি। তাছাড়া মাও কেন নিজের বাড়ি জোর করে যেতে চান নি কেন কে জানে?

রাতে মায়ের ঘরে কিছুক্ষন কাটাল রণজয়।মা একরকম ঝিমোচ্ছেন।বুকের কাছে হাত রেখে। বড় মমতা হয় তার। মাথায় আলতো হাত বোলায় সে। মা আধোতন্দ্রা থেকে জেগে উঠলেন। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটল তার। মা বললেন  “ফিরলি?”

“হ্যাঁ।“

উঠে বসার চেস্টা করল মা। বুঝতে পারল মা উঠতে পারছে না।মা তবু কাত হয়ে বসলেন।মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে বললেন,- “কবে যাব রে?”

“আগামীকাল।“

একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা বললেন।“উফ। খুব আনন্দ হবে।কতদিন পর মালতী   রমা,কুঞ্জ, মিতালী  অপুদের সঙ্গে দেখা হবে। দ্বিজুমামা খুব মাছ ধরতে ভালবাসত।ওদের ঝিলধারে মস্ত বড় উঠোন। সেখানে দাদুরা আড্ডা দিতে বসত।আমরা সারাদিন খেলে বেড়াতাম।ছোট্মামা ছিল মস্ত অভিনেতা। যাত্রা করে বেড়াত।“

রনজয় শুনতে লাগল মন দিয়ে। মা যাদের কথা বলছেন তারা এখন সম্ভবত বেঁচে নেই।কেউ বেঁচে থাকলেও সেখানে আছেন কিনা সন্দেহ। তবু সেই পৃথিবীটা মায়ের কাছে সবচেয়ে সত্য।সে বলল,”কাল সকালে রেডী হয়ে থেক। সুধাদিও যাবে।ওই তোমাকে তৈরী করে রাখবে।“

মা ছোটদের মত মাথা নাড়লেন। মায়ের পায়ের দিকে নজর পড়ল তার। দুটো পা ধীরে ধীরে ফুলেছে।হাত দিয়ে টিপলে পা দেবে যায়।রণজয় মাথা নাড়াল। এসব কিছু সে ভাববে না।তাহলে আর মাকে নিয়ে যাবার সাহস তার হবে না।

সকালে ওঠার পর রণজয় অস্থির হয়ে উঠল মায়ের জন্য।সুধাদি  এসে গেলেই মাকে তৈরী করতে বলবে।শুকনো কিছু খাবার সে যোগাড় করে রেখেছে।সাতটার মধ্যে গাড়ি এসে যাবে। এতদিন পর মায়ের ইচ্ছেপুরন সে করতে পারছে তা বিরাট ব্যাপার।

সে মায়ের ঘরে গেল।আলতো করে হাঁক দিল।মা তার সাহায্য নিয়ে উঠে বসলেন।একটা নি;শ্বাস ফেলে বলল,”ঠিক আছ তো?”

মা অনেক কষ্টে মাথা নাড়ালেন।সে জিজ্ঞেস করল,”আজ যাবে তো?”

“কি বলিস? যাব না। আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।“

সে বলল,”তাহলে তৈরী হয়ে নাও।“

“হবো রে। সুধা আসুক।“

 ঘন্টাখানেকের মধ্যে রণজয়রা রেডী।সুকুমার গাড়ী নিয়ে  চলে এসেছে।ওকে সে বলে রেখেছিল।সুধাদিরা ঠিকসময়ে হাজির।মাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে সুধাদি।কিন্তু হাঁটতে গিয়েই মায়ের বিপত্তি ঘটল।ঠিকমত পা ফেলতে পারছেন না মা।

মা বলল,” রণ।আমি পারছি না।তুই ছেড়ে দে আজ।তাছাড়া ওখানে গিয়ে কি হবে?”

রণজয় বলল,”একটু চেষ্টা কর।আমি ধরছি তোমাকে।“

“হবে না রে।তুই ছাড়।“

রণজয় ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবল।তারপর মাকে সে দু-হাতে দিব্যি তুলে নিল।সুকুমারকে বলল,”চল।গাড়ির দরজা খোল।“

মাকে একটা সীটে সম্পুর্ন রেখে রণজয়রা একদিকে বসল।গাড়ি চলতে শুরু করলে রনজয় তৃপ্তির শ্বাস ফেলল।

 তিনটে মত বাজে।আজ ওয়েদারও ভাল পেয়েছে রনজয়রা।তাপমাত্রা বেশী নয়।বরং একটু-আধটু ফুরফুরে হাওয়া টের পাচ্ছে রনজয়।একএকদিন এরকম হয়।সবমিলিয়ে দিনটা চমৎকার রমনীয় হয়ে ওঠে।মায়ের বহুদিনের গোপন ইচ্ছেটা আর একটু পরেই পুরণ হবে বলেই বোধহয় দিনটা এমন সুন্দর।

একটা-দুটো মাঠ,তারপরে বাড়ি,অনেক পুকুর।রনজয় নিজের চোখে চারপাশ মেলাচ্ছিল।সে তো জানত জায়গাটা গঞ্জ মতো,এখন তার ধারণা পাল্টাচ্ছে। এ অঞ্চল থেকে নদীতে  পাইপ বসিয়ে জল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য শহরে। সেজন্য রাস্তাঘাট খুব খারাপ এখন। গাড়ী কদ্দুর যাবে তা  সন্দেহ  আছে।।

 রাস্তার হাল খুব খারাপ।একটা জায়গায় এসে রনজয়রা এমন ফেঁসে গেল যে বুঝতে পারল না কি করবে? রাস্তার মাঝখানে সাইনবোর্ড ঝোলান।নো এনট্রি।রণজয় গাড়ী থেকে মুখ বার করে দেখল সামনে রাস্তা বলে কিছু নেই।মাটির পাহাড় জমে আছে।

সেসময়ে মা হঠাৎ উঠে বসলেন।এতক্ষন চোখ বুজে ছিলেন ।মা বললেন,”সর দেখি জায়গাটা কোথায়?”

 রনজয় একটু সরে গিয়ে মাকে দেখার জায়গা দিল।

মা চারদিক জরিপ করে বললেন, “এ জায়গাটা মনে হচ্ছে  ঘোষালপাড়া।“

রণজয় জিজ্ঞেস করল, “তুমি চিনতে পারছ?”

“হ্যাঁ।চিনব না কেন? দু-চারটে নতুন বাড়িঘর হয়েছে।এছাড়া সব এক। সুকুমার,তুমি এক কাজ কর।গাড়ী ঘুরিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধর। মিত্রপাড়া পাবে।“

সুকুমার গাড়ী ঘোরাল।এদিকের রাস্তা ঠিক আছে।রনজয়ের চিন্তা একটু দূর হল। মা এলাকা চিনতে পারছে মানে তারা ঠিক জায়গায় এসেছে।মায়ের দিকে তাকিয়ে সে হাসল।কে বলবে মা দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন!

মিত্রপাড়া পৌঁছে  রণজয় জিজ্ঞেস করল,”এবার কি?”

“এবার একটা ছোট মাঠ পড়বে।মাঠের মধ্যে লাইব্রেরী।বিবেকানন্দ পাঠাগার। ওর  এক কোনে অপুদের বাড়ি ছিল।অপু কি সুন্দর গান গাইত।কিশোরকুমারের গান।“

রনজয় অবাক হয়ে বলল,” তাই? তোমরা গান করতে?”

মা লাজুক হেসে বলল “ ওই একটু আধটু। গানের লড়াই খেলতাম।“

রনজয় অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।মাকে সে যেন অচেনা দেখছে।মায়ের মুখ থেকে সে তো কোনদিন  গান শোনে নি।বাহ!

মা রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার একটা বড় পুকুর আসবে। নোনাচন্দনপুকুর।ওই পুকুরে আমরা সবাই চান করতাম।“

 বাঁ-দিকের রাস্তা ধরতেই পুকুর চোখে পড়ল রনজয়ের। অনেকদুরে সে দেখতে পেল কয়েকজন চান করছে।এরকমই কোন দুপুরে মা জলে সাঁতার কাটত। রনজয় তা যেন চোখে দেখতে পায়।

মা  প্রতিটা  রাস্তাই  আগেভাগে বলে দিচ্ছেন।চোখ বুজে আছেন,মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটছে। বেশ চোখ বুজে বলে দিচ্ছেন কোথায় কি আছে!   মায়ের মুখটা দেখছিল রনজয়।গর্বে বুক ফুলে উঠছে তার। সে খেলাচ্ছলে জিজ্ঞেস করল,”আর কদ্দুর তোমার মামার বাড়ী?”

“এই তো এসে গেছি।আর একটুখানি।“

“ কি আছে ওখানে?”

মা হেসে বললেন, “টেষ্ট নিচ্ছিস?”

রনজয় হেসে ফেলল।সে বলল, “ হুঁ। বল দেখি।“

মা  চোখ বুজে  বললেন, “এবার মোড় ঘুরলেই দেখতে পাবি একটা নিমগাছ,তারপাশে দোতলা বড় বাড়ি। কেমন বাড়ী বলত?  তাতে  লম্বা শিক লাগান মস্ত মানুষসমান জানলা। একটা বড় বাগান। বাগানের ভেতর চারটে বড় গম্বুজ। ঐ গম্বুজ গুলোতে আমরা বসতাম। আমি মালতী, অপু ,কৃষ্ণ চোরপুলিশ খেলতাম।কতরকম পাখি আসত সেইসব গাছে।দেখতে পাচ্ছিস রণ?”

 এ বাড়ির কথা রণজয় অনেকবার শুনেছে। মা কখনো গল্পচ্ছলে তাকে বলেছিল। অল্প অল্প মনে পড়ছে রণজয়ের। বড় বাগানে বসে মা আর বন্ধুরা মিলে পিকনিক করত। গম্বুজে বসে মায়েরা গল্প করত।মোড় ঘুরতেই রণজয়  বলল,“ দাঁড়াও দেখছি।“

“দ্যাখ।“

 রণজয় গাড়ি থেকে মাথা বার করল। সে চারদিকে তাকাল।সে কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গেল।সে ঢোক গিলে বলল, “কই? মিলল নাতো?”

“ভাল করে দ্যাখ।“

রণজয় চোখ ভাসিয়ে দিল। বেশ তো মিলে যাচ্ছিল মায়ের কথা।কিন্তু এখন যেন গোলমাল ঠেকছে। কোথায় নিমগাছ? কোথায় লম্বা শিক লাগান বাড়ী? সে কি মাকে চোখ খুলতে বলবে? ও মা! তুমি চোখ খোল এ কোথায় এলাম! সামনে কোন নিমগাছ নেই, কোন বাড়ী নেই।  সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা নিরেট পাথরের মত ফ্ল্যাট। রণজয়ের হাত মুখ ভয়ে সেঁদিয়ে যেতে লাগাল। সে অস্ফুটে বলল,”ও মা নেই তো!”

“আছে।“

“না। নেই।“

মা চোখ খুললেন। চারপাশ দেখেই হঠাৎ চোখ বুজিয়ে ফেললেন।তার ঠোঁট কঁপে উঠল। মা নিচুস্বরে বললেন, “সুকুমার গাড়ী ঘোরাও।“

রণজয়  ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল “ কি হয়েছে মা?”

“কিস্যু হয় নি।সুকুমার চলো।“

“বল না মা।“

মা চাপা গলায় গর্জে উঠে বললেন, “আমাকে আনলি কেন এখানে? তুই খুব নিষ্ঠুর রে।“

চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে রণজয়ের।  মিষ্টি  আনার দিনটার কথা মনে পড়ে ওর। সেদিনের মত সেকি মায়ের পায়ের কাছে বসবে? সে বলবে,”মা আমাকে ক্ষমা কর। আমি ঠিক তোমায় এনে দেব সেই বাড়ী,সেই নিমগাছ,গম্বুজ। আজ অথবা কাল! প্লিজ আমাকে একটু সময় দাও!”

কিন্তু সে জানে  সময় দিলেও সে আর মায়ের দেশ ফিরিয়ে আনতে পারবে না ! মায়ের দেশ বলে আর কিছু রইল না।নিরেট পাথরের মত ফ্ল্যাটটা তাদের দিকে  উপেক্ষার চোখে চেয়ে আছে।

                                     

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত