| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-৩) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
 ফুডব্লগার রাণীয়া

রান্নাবাড়ি, রেসিপির মত পাতি জিনিষপত্র নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই মিঠির। তবুও অফিসের তুমুল ডামাডোলের টানাপোড়েনেই হোয়াটস্যাপ গ্রুপে ঠিক তখুনি রাণীয়ার পাঠানো চিকেন সিক্সটি ফাইভের গরগরে, তেলতেলে, রঙচঙে ছবি উড়ে এল। সুললিত জ্যুসি মুরগীর ডিশ গারণিশ করা ঘন সবুজ কারিপাতা দিয়ে। মধ্যিখান থেকে উঁকি দিচ্ছে এক আধটুকরো চেরা কাঁচা লঙ্কা। প্রায়শই এমন আসে। পাগলী বোনের অলস মস্তিষ্কের যাপন নিয়ে। রান্নার ডিশের ছবি তোলা তার হবি। এমন লোভ দেখিয়ে বোনটা যে কী শান্তি পায়!
উফ! পারেও বটে রাণীয়া। এই মেয়েটা হল অবসেশড উইথ ফুড। রোজ নিত্যনতুন আইটেম বানিয়ে নিজের বর কে তাক লাগানোতেই মত্ত সে। রাণীয়া তো আর চাকরি করেনা। বুঝবেই বা কী করে? অফিস করে মাসের শেষে লাম্প সাম পে প্যাকেট পাওয়ার কী আনন্দ!  মিঠি স্বাধীন। কারোর কাছে আজ অবধি হাত পাতেনি সে। এর এক অন্য আনন্দ। তা না তার থেকেও বেশী পড়াশুনো করে রাণীয়া আজ শুধু মন দিয়ে সংসার করছে। প্রাণ দিয়ে শুধু বরের জন্য রান্না করে যাচ্ছে। কবে বর একটু বেড়াতে নিয়ে যাবে কিম্বা জুয়েলারি কিনে দেবে। কিন্তু তাই কী? রাণীয়ার কিসের অভাব? আরে বাবা যতই হোক। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তো আর নেই। কুশল ছেলেটা ভালো তবুও নিজের চাকরীর একটা আলাদা ব্যাপার। নিজের খাস রোজগারের টাকায় পছন্দের জিনিষ কেনা আর বরের কাছে হাত পাতায় অনেক ফারাক আছে বৈকি।
এসব হল অফিসের একটা কাজের পরে নিজের ডেস্কে বসে বসে মিঠির অলস মস্তিষ্কের অবসরের মনোলগ।
রাণীয়া কে মিঠি খুব ভালোবাসে যদিও। কিন্তু তার এই রান্নাবাটি যে মিঠির দুচোখের বিষ।

কী করছ? কেউ জিগেস করলে গর্বের সঙ্গে রাণীয়া এখন  বলে ওঠে, “আমি ফুড ব্লগার” ।

তার চেয়ে একটা চাকরী খুঁজতিস যদি… একদিন বলেছিল মিঠি তার বোন কে।

রাণীয়া বলেছিল, সবাই যদি চাকরী করে তাহলে বাকরী করবে কে রে দিদি?
মিঠি বলেছিল এই বাকরী টা কী আবার রে?
রাণীয়া বলেছিল নিজে চাকরী করিস আর বাকরী মানে জানিস না? ঘর সংসারী। আরও সফিস্টিকেটেড ভাষায় হোমমেকারী।
বাঙালি মায়েদের মত গুছিয়ে সংসার করবে কে? গুছিয়ে সংসার করাটাও একটা চাকরী। একটা আর্ট। বুঝলি দিদি? হোম ম্যানেজমেন্ট। দিদা বলত মনে নেই তোর? বাড়ির কোনও বড় কাজে নিজের ক্রেডিট নিত এই বলে… ব্যাবস্থাপনায় শ্রীমতী প্রতিভা দেবী ঠাকরুণ।
মিঠি বলেছিল, ডিসগাস্টিং! এটা একটা লজিক হল? সে যুগে ওরা অত হায়ার স্টাডিজ করতো না। বাড়িতেই থাকত। প্রচুর সময় তাই রান্নাবান্না আর লোক আপ্যায়ন ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। আর মাঝেমধ্যে সেলাই ফোঁড়াই আর ঘর গোছানো।
রাণীয়া বলেছিল আমার এসবই ভালো লাগে। তোর মত ধরাবাঁধা চাকরী আমার দ্বারা হবেনা কোনোদিনও। পোষায় না আমার।
তাহলে এত পড়াশুনো করলি কেন?
রাণীয়া সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল সেটা তো আমার আপব্রিংগিং এ হেল্প করেছে রে । কত লোক তোর মত দশটা পাঁচটার  চাকরী করছে। তবে আমার কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় তোর থেকে বেশী পরিচিতি। সেটাও আমার বড় প্রাপ্তি। সে তুই যাই বল আমায়। দিদি কে সে যাত্রায় মোটেও ছাড়েনি রাণীয়া। বরং এক হাত নিয়েছিল। জানিস? এখন ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে আনলিমিটেড  ক্রিয়েটিভিটি কাজে লাগিয়ে কত মানুষ করে খাচ্ছে।
হাসালি তুই রাণীয়া। কোন প্রত্যন্ত গ্রামের ফোকলা ঠাকুমার জঙ্গুলে রান্না, কোন পাড়াগেঁয়ে মহিলার ছাপাশাড়ি পরে ঘোমটা মাথায় পিঠে ভাজার ছবি, কোন জেলের জ্যান্ত মাছ ধরে নদীর ধারে বসেই সেই মাছ রান্নার ভিডিও আবার সেইসঙ্গে একথালা ভাত নিয়ে সেই গরম মাছ হাউহাউ করে খাবার ভিডিও…এসব বলছিস তো? এসব ওই পর্যন্তই।
কোনো কাজ কে ছোটো করিস না দিদি। সব কাজই কাজ রে। ওরা এখন নামীদামী ডিজিটাল ক্রিয়েটর। ওদের রোজগারপাতি বেশ ভালো। হ্যাঁ। মগজের বুদ্ধি দিয়ে ভিডিও বানাতে হবে। সবার কী আর সেলিব্রিটি স্টেটাস হয়?
মিঠি দমে যাবার পাত্রী নয়। বলেছিল, তার চেয়ে একটা কাজ কর বরং তুই। একটা টেলিভিশন চ্যানেলে যা। তুই রান্নার শো কর বরং। সিভিটা জমা দিয়ে আয়। রোজ সেজেগুজে দাঁড়িয়ে, বকবক করে আরও ফেমাস হয়ে যাবি। সেদিন সত্যিসত্যিই বোনের আঁতে ঘা দিয়েই এই কথাগুলো মিঠি বলেছিল ।
রাণীয়া বলেছিল, দিদি তুই ? তুই শেষমেশ আমায় আওয়াজ দিচ্ছিস?
না, না সিরিয়াসলি বলছি রে। এতদূর যখন এগিয়েছিস, বি প্রোফেশানাল।


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-২) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


দেখ দিদি, রান্না নিয়ে আমার শাশুড়ির কাছে কত খোঁটা খেয়েছি বিয়ের পরপরই। সে তো তুই ভালো করেই জানিস। শ্বশুরবাড়িতে তোর এক প্রবলেম। আমার আরেক। তুই রান্নাঘর মাড়াসনা তাই তোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আর আমি? রান্নাঘরে একটু বেশীই ইন্টারেস্ট দেখাই, মাতামাতি করি সেটাই দোষের। ভালোমন্দ ছাড়া নাকি আমার মুখে কিছু রোচেনা। আমার মুখের খুব তার। মা বদ অভ্যাস করিয়েছে। তাই আমায় রান্নাঘরে ঢুকতেই হয়। ওনাদের সময় ঠাকুর চাকর রান্না করত। বাড়ির মেয়েদের রান্নাঘরে সেখানে ঢোকা নিষেধ ছিল।
সেই শুনে শাশুড়ি মা কে একদিন জিগেস করেছিল রাণীয়া। তাহলে আপনি ভালো রান্না শিখলেন  কী করে?
শাশুড়ি মা নিজের কোর্টে বলটা লুফে নিয়ে বলেছিলেন, বুদ্ধি বুঝেছো? সবাই কী আর পারে?
রাণীয়ার সঙ্গে এমন ঠাণ্ডা লড়াই চলতেই থাকে কুশলের মায়ের।  

তা শুনে মিঠি বলেছিল ধুস! ওসব পাত্তা দিস না একদম। আমার শাশুড়িও বেশ মুখরা। আসলে দাদাগিরি করে ওরা সুখ পায়।
রাণীয়া বলে আরও শোন্।
এমন কি রান্নার লোক ছুটি করলে আমি যখন রান্না ঘরে ঢুকে মনের আনন্দে ইচ্ছেমত সব রান্না একাহাতে করতাম তখনও আমায় শুনতে হয়েছে কত কথা। রান্না করা আর কী এমন কাজ, হালুইকর বামুনরা যা পারে। টেবিলে সাজিয়ে গুছিয়ে দিলে সবাই চেটেপুটে আমার হাতের রান্না খাবে আবার বলতেও ছাড়বে না। এরা এমনি ছিল। তখন থেকে পণ করেছিলাম রান্নাটাকে শুধু এই ডাল ভাত, মাছের ঝোল স্টেজে আর শুধুই রান্নাঘরের ঝুল কালিতে সীমাবদ্ধ রাখব না। রান্না যে একটা শিল্প আর তাকে কোন স্তরে যে নিয়ে যাওয়া যায় সেটাই তখন ছিল আমার কাছে চ্যালেঞ্জ । পাখির চোখ বুঝলি না? রাণীয়া বলল।

এসব শুনে মিঠি বোনের গালের কাছে গাল নিয়ে গেছিল। তখন দুজনেই মায়ের কাছে এসেছিল। সরি বোন। তুই আমার ওপর রাগ করলি না তো? আমি তোর ভালোর জন্যই তোকে বলছিলাম।একটা চাকরীর কথা। তোর নিজের জন্য। তুই এত পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়াবি না তো কে দাঁড়াবে?  
অনসূয়া ঠাট্টা করে বলেছিলেন সেদিন। কেন রে? রাণীয়া কী নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনা? বেশ তো দাঁড়িয়েই আছে দেখছি। পাছে ছোটো মেয়েটা দিদির কথায় দুঃখ পায় তাই মা সামলে দিয়েছিলেন পরিস্থিতি।

রাণীয়ার চোখে জল এসে গেছিল সেদিন । দিদিকে জড়িয়ে ধরে দিদির পিঠে মুখ লুকিয়ে বলল, দিদি তোর জন্য আমার খুব কষ্ট হয় রে । তুই কিছুই পারিস না। রান্নাঘরে ঢুকিস না। কত কথা শুনতে হয় তোকে শ্বশুরবাড়িতে।

মিঠিরা তখনও ব্যাঙ্গালোরে যায়নি। রাণীয়াও তখন আমেরিকায় যায়নি। এসব কথা সেই সময়কার। তবে দুজনেই দুজনের শ্বশুরবাড়ির চাপানউতোর সম্পর্কে দিব্য অবগত ছিল । দুই বোনের দুধরণের প্রব্লেম। মিঠি কে শুনতে হত, মা কোনও কাজ শেখায় নি আর রাণীয়া কে শুনতে হত নিজের খাবার ইচ্ছে হয় বলেই নাকি সে রান্না করতে ভালোবাসে। মিঠির শাশুড়ির একধরণের সুপিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স, রাণীয়ার শাশুড়ির ইগোর দ্বন্দ্ব। এ তো বাঙালি সংসারের চিরাচরিত কিসসা।

এ যুগেও দুই উচ্চশিক্ষিতার কত অপমান! তারপর তো তা তারা আলাদা হল। ওপরওয়ালার কৃপায়। দুজনের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আলাদা সংসার হল যার যার বরের চাকরীস্থলে। তবুও একলার সংসারে মিঠি জীবনেও রান্নাঘরে ঢোকেনা আর রাণীয়া আরও জমিয়ে রান্নাবান্না করে। যার যাতে সুখ। সেই কোন্ ছোটবেলায় ওদের দিদা “রাণীয়া কী করে” জিগেস করলেই আধোআধো স্বরে সে বলত “আনিয়া আন্না কলে, আন্না কলে, আন্না কলে” । “র” বলতে পারতোনা অনেকদিন।
দিদা বলেছিলেন, এ যে দেখছি আমার বাপের বাড়ির ‘দোখনে’ দের মত। র বলতে পারেনা গো। হেসে সবাই কুটিপাটি হত। দিদা বলতেন, আশীর্বাদ করি তুই যেন সত্যিই রাণীর মত হয়েই থাকিস। তা সত্যি রাণীয়া আমেরিকায় রাণীর মতই আছে তবে সেখানে রাণীর দাসী বাঁদি নেই। সব কাজ নিজেকেই করে নিতে হয়। সেই ফাঁকে চলে তার রান্না নিয়ে বিস্তর চর্চা। কোনো রান্না করেই ছবি তুলে, রেসিপি লিখে কিচেন ব্লগে আপডেট রাখা। খুব সিরিয়াসলি কাজটা করে রাণীয়া। তারপর তো শেয়ার, লাইক, কমেন্টে ভরে ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়া থই থই তার পরিচিতি তে।
কোনদিন উপচে ওঠে তার ডোনাট সুখ তো কোনদিন উথলে ওঠে তলা লেগে যাওয়া পায়েসের দুখ।
তবুও এই বেশ ভালো আছে তারা। আমেরিকায় সবাই ভালোই থাকে। সেখানে আসা কুশলের চাকরী সূত্রে। আমেরিকার ডালাস শহরে। কলকাতার অফিস থেকেই পাঠিয়েছে কিছুদিনের জন্য।  
বিয়ের পরে বছর চারেক শ্বশুরবাড়িতে ছিল রাণীয়া। তারপরেই হঠাত একদিন ডালাসে পাড়ি দেওয়া তার। প্রথম আমেরিকা দর্শন হবে সেই ভেবেই উত্তেজনার পারদ চড়তেই থাকল। একধারে আনন্দে সে ডগমগ আর সেই সঙ্গে মনটাও খারাপ  ।
বিমানবন্দর থেকে একে একে চোখের বাইরে চলে গেছিল মা, বাবা আর মিঠির ছলছল চোখ । জামাইবাবু শৈবালও মিস করেছিল মিষ্টি আধাঘরওয়ালি শ্যালিকা কে। অনসূয়া আর তপন বাবু ভাবলেন, কিছুদিন অন্ততঃ শাশুড়ির থেকে দূরে থাকবে মেয়েটা।

জীবনে প্রথম রাণীয়ার বিদেশের বুকে হারিয়ে যাওয়া।

একপাল অপরিচিত মুখ সাদরে অভ্যর্থনা করেছিল ডালাস এয়ারপোর্টে । সবাই কুশলের ভারতীয় কলিগ। একাধিক নামীদামী গাড়ী বরণ করে ঘরে তুলছে তাকে … সে এক অভিনব অভিজ্ঞতা । অথচ মুখে সবাই বলছে, নাও উঠে পড় ভারতীয়দের সেকেন্ড হ্যান্ড গরীব রথে। কারোর মাজদা ৬২৬, কারোর টয়োটা করোলা, কারোর হণ্ডা অ্যাকর্ড। সেই মুহূর্তে রাণীয়ার কাছে সেটাও স্বপ্ন।

অবশেষে তারা পৌঁছেছিল ডালাসের রিচারডশনের ক্লিফব্রুক কন্ডোমিনিয়ামের অ্যাপার্টমেন্টে । কোম্পানি ব্যাবস্থা করে দিয়েছিল অ্যাকোমোডেশনের। জেট ল্যাগের জেরে ঘুমে তখন দুচোখ বুজে আসছে। অথচ বন্ধুদের হল্লা আর হুল্লোড়ের খামতি নেই । গরম ভাত থেকে শুরু করে পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে এনেছে সব বাঙালী বন্ধু পত্নীরা। তাদেরই বাড়িতে।

এর মধ্যে দেশের মানুষগুলোর জন্য মন কেমন করলেই হোয়াটস্যাপ করেছে ফাঁকে ফাঁকে। মা’কে, দিদি কে। তবে বেড়ানোর আনন্দে দখিনের খোলা জানলায় সব ওলটপালট ।

পরেরদিন ভোরেই ঘুম ভেঙে গেছিল। জেট ল্যাগের মহিমায়। ভোরবেলা কিচেন ব্লাইন্ডস সরিয়ে ক্লিফব্রুক কন্ডোমিনিয়ামসের পার্কিং লটে তাকিয়ে থাকা সার সার গাড়ির ছাদে দুধসাদা বরফের চাদর ..তার সঙ্গে সূর্যের আলোর মাখামাখি ! ছবি তুলেই পাঠিয়ে দিয়েছিল বাড়িতে। শেষ শীতের রেশ ছিল সেখানে। সাধারণত বরফ পড়েনা কিন্তু রাণীয়া কে যেন বিধাতা পুরুষ আমেরিকার মাটিতে প্রথম বরফ দেখিয়েই ছাড়বেন। তাই ডালাসেও সেদিন আচমকা তুষারপাত ঘটেছিল মধ্যরাতে। ভোরবেলায় তার রেশটুকুনি চেটেপুটে নিয়েছিল রাণীয়া। সাময়িকভাবে ভুলে গেছিল সদ্য আত্মীয় পরিজন কে ছেড়ে আসার দুঃখটা।

তারপর থেকে রোজ চোখ রেখেছে সে অপার বিস্ময়ে, কখনো ডালাস ডোমের মাথায় গরম কফি হাতে, টেক্সাস ও ওকলাহোমার বর্ডারে অসাধারণ টেক্সোমা লেকের জলের ধারে। কখনো টাইলার রোজ গার্ডেনের গোলক ধাঁধায়, কখনো নেচে উঠেছে প্রাণ টার্নার ঝোরার ধারে, গুহার ভেতর .. গেয়ে উঠেছে মুক্তির আনন্দে, নেচে উঠেছে ঝোরার জলের ছন্দে…এখানকার সংস্কৃতি এটাই। সারা সপ্তাহ চুটিয়ে কাজ করে শুক্রবার সন্ধেবেলায় সবাই মত্ত উইকেন্ড সেলিব্রেশনে। কখনও রাণীয়ার রসনা দেশবিদেশের কুইজ্যিনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। কখনও এক্সপ্রেস ওয়ের ওপর দিয়ে লং ড্রাইভে ছুটছে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হৈ হৈ করে। ইহারে কয় উইকএন্ডট্রিপ! হঠাত প্ল্যান করেই “চলো লেটস গো” বলে বেরিয়ে পড়া আর কি!
হাতের পাঁচ সেদেশে পটলাক পার্টি তো আছেই। নিত্য নতুন রান্নাবান্নায় হাত পাকানো।
যার বাড়িতে পার্টি হবে সে ভাত/রুটি বানানোর দায়িত্বে থাকবে আর অন্যেরা যে যার ইচ্ছেমত ডিশ বানিয়ে আনবে । কেউ আবার পেপারপ্লেট, চামচ আর কোল্ডড্রিংক্সয়ের ভার নেয় তো কেউ স্যুইট ডিশ। সেদেশে তো আর কলকাতার মত মিষ্টির অত দোকান নেই। তবে দারুণ মজা হয় রাণীয়ার এমন পার্টিতে । একঘেয়ে মেনু নয় কিন্তু পট লাক (potluck) অর্থাৎ কোন পটেতে কী আছে সেটা খাবার সময় খুলে দেখবার । আর সবচেয়ে বড় কথা হল যিনি পার্টির জন্য বাড়িতে সকলকে ডেকেছেন তাঁর ওপর অযথা চাপও পড়লনা ।

প্রথম বছরেই রাণীয়া প্রাণভরে রথযাত্রা দেখল বিদেশের মাটিতে। এক টুকরো দেশীয় অনুভূতি বিদেশের মাটিতে উথলে উঠেছিল যেন। ডালাস থেকে অনেকটা দূরে গেছিল তারা ড্রাইভ করে। ইস্কনের কালাচাঁদজীর মন্দিরে রথের রশি টেনে কিছুটা স্বদেশের জন্য ব্যাকুলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। সেইসঙ্গে আমেরিকার মাটিতে প্রথম লুচি আর পাঁচমেশালী একটি তরকারী সহযোগে ভোগপ্রসাদও জুটে গেছিল দিব্য।
সেই মাসেই আবার ৪ঠা জুলাইয়ের সেই লঙ উইকএন্ডের হুল্লোড়? আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। ডালাসের সাবার্বে একটি খোলা মাঠের ওপর বিকেল থেকে জমায়েত হল কয়েক হাজার মানুষ। তারপর সন্ধ্যের ঝুলে একে একে আকাশে ফুটে উঠতে লাগল রঙ বেরঙের ফায়ারওয়ার্কস। আতস বাজি, আলোর বাজি এত সুন্দর ভাবে পরিবেশন আর কোথাও সে দেখেনি। ব্যাবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি নেই। সুষ্ঠুভাবে প্রায় তিন চার ঘন্টা বাজি পোড়ানো হল সেই মাঠের ওপর। কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ল না । অথচ বৈচিত্র্যময়তায় ভরা সেই দীপাবলীর রাত যেন আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল । ফায়ার ওয়ার্কস দেখে সে রাতে প্রোগ্রাম ছিল দল বেঁধে সকলে মিলে পিত্জা হাটে পিত্জা খেতে যাওয়া। অপার বিস্ময়ে রাণীয়া গোগ্রাসে গিলেছিল সেই লোভনীয় ইটালিয়ান খাদ্য ।
আমেরিকার মাটিতে পা দিতেই কুশলের বন্ধুরা তৎপর হয়ে পড়েছিল। এহেন বঙ্গললনা রাণীয়া কে কিভাবে এখানকার সব ডেলিকেসি চাখিয়ে তাক লাগানো যায়।
হোয়াটস্যাপে মিঠি কে লেখে রাণীয়া।  
জানিস দিদি? উইকেন্ডে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে এক একদিন বিকেলে আমার এক একটি পদ পরখ করে দেখার শুরু। সেখানে পথের ধারে ধারে ঝকঝকে ফুড  জয়েন্ট। কোনোটা ড্রাইভ থ্রু। কোনোটা আবার ক্যাফেটেরিয়া, সেলফ সার্ভিস। পকেটমানি যত খসাবে তত কেতার রেস্তোরাঁও রয়েছে প্রচুর। তবে চাকুরে বাঙালি পাতি ফুট জয়েন্টেই আপ্লুত পকেটের কথা ভেবে।
মিঠি কেবল কয়েকটা খাবারের ইমোজি পাঠায়।
আবারও রাণীয়া লেখে…  
ফাইনালি আজ হাতেখড়ি হল আমার ডানকিন ডোনাটস এর সঙ্গে। কফির সঙ্গে জমে গেল এক্কেবারে।
সুপার মার্কেট থেকে আমরা কিনেও আনি ফ্রোজেন ডোনাটসও। কিন্তু এর স্বাদ অন্য। যেন কেক ভাজা টাইপ এটা। তুই খুঁজে দেখ গ্রসারি স্টোরে। ওখানেও পেয়ে যাবি। নেক্সট মান্থে কুশল শিকাগোয় যাচ্ছে। আমিও যাব। ওখানে বিখ্যাত স্ট্যান্স ডোনাটস জয়েন্টে খেতেই হবে গিয়ে।
মিঠির সবসময় অফিস আওয়ারে বোনের এই খাবারের কচকচানি শুনতে আর ভালো লাগেনা। একেক সময় বোনের এই ফুডি ভাবসাব দেখে সে লেখে,
তোর কী আর কোনও কথা নেই রে? শুধু খাওয়া আর দাওয়া।
রাণীয়া বলে ফুডই তো সব। আই লিভ টু ইট। বিকজ আই এক্সপ্লোর মাইসেলফ এভরি মোমেন্ট । ডিসকাভার দ্যা ফুড কালচার অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড।
মিঠি তর্ক জোড়ে। আমি বাবা ইট টু লিভ।
রাণীয়া বলে তাহলে মাঝেমধ্যেই রেস্তোরাঁ থেকে নানারকমের খাবার আনিয়ে খাস কেন?
মিঠি লেখ, টু লিফট মাই মুড অ্যান্ড ইন্ডালজ মাই টেস্ট বাডস।
রাণীয়া বলে তার মানে আমার মত তোর নোলাও মাঝেমধ্যেই শকশক করে। কী বল? 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত