| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৬)

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

বাংলা ভাষার উদ্ভব, উনিশ শতকে কলিকাতার সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের দ্বারা সংস্কৃতায়িত বাংলার সৃষ্টি, বাঙালির সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে পরতে পরতে লেখা হয়েছে মিথ্যা আর ভুল তথ্যভিত্তিক বানোয়াট ইতিহাস। দুইশ বছর  ধরে আমরা  অইসব ভুল বা বানানো ইতিহাস মেনে নিয়ে এর ভিত্তিতেই পুনরায় আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির বয়ান রচনা করে গেছি। আর এভাবে বাংলা ভাষা পরিণত হয়েছে সংস্কৃতের উপনিবেশে। এই প্রথমবারের মত বানানো ইতিহাসের স্তর খুঁড়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বাঙালি সংস্কৃতির রদবদলের আদত ইতিহাস উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়েছেন উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম তার “ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস”বইয়ে।

ফয়েজ আলম ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা’ এটি সচেতন চেষ্টায় তৈরি একটি মিথ্যা বয়ান, যে মিথ্যা রচনার পিছনে কাজ করেছে ধর্মীয় আবেগ ও উপনিবেশি প্রশাসকদের প্রশ্রয়। আসলে সংস্কৃত এবং বাংলা দুটো ভাষাই এসেছে স্থানীয় ভাষা থেকে (যাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হয়ে থাকে)। প্রাচীনকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান পাকিস্তানের অংশ বিশেষসহ) প্রচলিত স্থানীয় ভাষাকে কিছু নিয়মে বেঁধে দেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা পাণিনি নামের এক পন্ডিত; সেটিই পরে ধর্মচর্চা আর ধর্মীয় লেখাজোকায় কাজে লাগানো হয় আর সংস্কৃত ভাষা নাম পায়। এটি কখনো কোনো মানবগোষ্ঠির মুখের ভাষা ছিলো না। একই সময়ে আমাদের দেশে প্রচলিত স্থানীয় ভাষা মানুষের মুখে মুখে স্বাভাবিক রদবদলের নানা ধাপ পার হয়ে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বাংলা ভাষার আদি রূপ নেয় । সংস্কৃতের সাথে বাংলার কোনো সরাসরি সম্পর্কই নাই। অথচ দুইশ বছর ধরে ভাষার ইতিহাসে আর পাঠ্য বইপুস্তকে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের মা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এরকম অনেক বানোয়াট ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন ফয়েজ আলম ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস এই ধারাবাহিকে  আজ থাকছে পর্ব- ৬।


 

 

বাংলা ভাষার রূপবদল: ইতিহাসের বিকৃতি, সংস্কৃতির রূপান্তর

 

ভাষার সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক কি রকম? নৃতাত্ত্বিক বিবেচনার বাইরেও কি এই সম্পর্কের কোন পরিসর রয়ে গেছে যা আজও আমাদের চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেনি? একে অপরের প্রভাবে কি বদলে যেতে পারে সংস্কৃতি ও ভাষার রোখ? এমনকি চিন্তার অন্যান্য ক্ষেত্র–যেমন ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, ধর্ম সেখানেও ভাষা কি প্রভাব রাখতে পারে না? এইসব সূত্র ধরে ভাবলে আমরা ভাষার ক্ষমতার এমন নানামুখি তৎপরতার দেখা পেতে পারি আগে যা আমাদের নজরে আসে নাই।

নৃতাত্ত্বিকদের মতে সংস্কৃতি একটি নির্দিষ্ট সমাজের শামিল মানুষের তাবত আচরণের সমষ্টি। আচরণ বলতে বসবাস, খাওয়া-দাওয়া, পরস্পরের সাথে লেনদেন ও যোগাযোগ করা, আনন্দ করা সকলই বুঝায়। এই কাজগুলো নিজেরা সংস্কৃতি না, এগুলোর ধরণটাই সংস্কৃতি। কি খাচ্ছে, কোন সময়, কিভাবে খাচ্ছে, বসবাসের ধরণ কেমন এইসব সংস্কৃতির বিষয়। এরকম ধারণায় ভাষা সংস্কৃতির অংশ মাত্র, সংস্কৃতির অনেকগুলা জিনিষের একটা। মানুষ সংস্কৃতির আর সব উপাদানের মত ভাষাও রপ্ত করে, জন্মের পর স্বাভাবিক শিখনের কায়দাতেই।

সাধারণ অর্থে সকল জীবজন্তুর বেলায় শিখার এই কায়দা সরল। তাদের সংস্কৃতি খুব ধীরে বদলায়; এমনকি কয়েকশ বা হাজার বছরেও পরিবর্তন আসে না, যদি না মানুষের কোন কোন আচরণ অনুকরণের কারনে রদবদল না ঘটে। তাদের বেলায় এই বদলের নিয়ামক হলো আত্মরক্ষামূলক চিন্তা। পরিবেশ পাল্টে গেলে পাল্টানো পরিবেশে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে জন্তুর আচরণও পাল্টায়, খ্যাদ্যাভাসে পরিবর্তন আসে। বদলায় বসবাসের ধরণও। এইসব ধরণ তাদের ছেলেপিলে ও নাতি-নাতকরদের মধ্যে জায়গা করে নেয় মুখ্যত শরীরি কায়দা অনুকরণের মধ্য দিয়ে। জন্তুর বাচ্চারা এগুলো শিখে নেয় মা-বাবার শরীরি আচরণ দেখে।

প্রাগৈতিহাসিক কালেরও আগে যখন আরসব প্রাণীর মত মানুষেরও তৎপরতা মুখ্যত সরল প্রক্রিয়ায় খাদ্য গ্রহণ আর বংশবৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তখন হয়তো মানুষের সাংস্কৃতিক শিক্ষনের প্রক্রিয়া এমন সরল ছিল। কিন্তু উন্নত শিকার কৌশল, গোত্রভিত্তিক জীবন যাপন আর ভাব বিনিময়ের উন্নত মাধ্যম বিশেষত ভাষা রপ্ত করার পর তার শিখনের প্রক্রিয়া  অন্যসব প্রাণীর তুলনায় বদলে যায় আর দ্রুততর হয়। বদলের কারণ ও কায়দাগুলোও নানা রকম আর জটিল হয়ে উঠে। এরপর গোত্র ও গ্রামকেন্দ্রিক জীবনে দলবান্ধা মনোরঞ্জন, মেলবদ্ধতা, মেলের সাংস্কৃতিক আচরণে মিল রাখা ইত্যাদি অভ্যাস সৃষ্টি হয়। আর তখনই সংস্কৃতির সামাজিক মর্যাদাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে; এক সময় যা ছিল শুধু গোত্রগত মান্যতার বিষয়, তখন তা যুক্ত হয় মানুষের ব্যক্তিক অর্জনের তালিকায়। নির্দিষ্ট এক বা একাধিক সাংস্কৃতিক আচরণকারী ব্যক্তিকে সমীহ করার রেওয়াজ তৈয়ার হয় গ্রামসমাজে। সংস্কৃতি হয়ে উঠে কিছুটা সচেতনে আয়ত্ত করার ব্যাপার। তবু আধুনিক সময়ের তুলনায় সে কালের শিখনের প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে কম জটিল পথে এগিয়েছে।

নগরায়নের আগে সংস্কৃতি ছিল জন্মগত আর পরিবার ও সামাজিক নির্দেশনার সূত্রে খানিকটা অসচেতনভাবে খানিকটা সচেতন প্রয়াসে অভ্যাসে নিয়ে আসার বিষয়। নগরায়ানের পর ব্যাপকভাবে বাড়ে মানুষের স্থানান্তর। কাজের সূত্রে ও অন্যান্য কারণে মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বসত শুরু করে, যার অর্থ সে এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে অভিবাসন করে। একই জাতির আবাসগত ভৌগলিক সীমানায় তা ঘটলে সংস্কৃতির পার্থক্য খুব বেশি হয় না,  তবে ভিন্নতা একেবারে কমও নয়। এভাবে নগরায়নের সূত্রে সংস্কৃতি আর অসচেতনভাবে অভ্যাসের বিষয় হয়ে থাকে না, হয়ে উঠে সচতেন অনুকরণ ও আয়ত্তের বিষয়। অন্যদিকে, নগরায়নের মধ্য দিয়ে মানুষ তার জীবন যাপনে আরাম আয়াশ বাড়ানোর কাজে বিশেষ নজর দেয়, সামান্য প্রয়োজনে কখনো বা অপ্রয়োজনে পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ে। আরো নিবিড় হয় সংস্কৃতির সাথে সামাজিক মর্যাদার মাত্রাগত সম্পর্ক। নতুন একদল লোক একটা নতুন সাংস্কৃতিক পরিবেশে এসে বসত করে সামাজিক মর্যাদায় উঠতে চাইলে সংস্কৃতি হয়ে উঠে তার মূল অবলম্বনগুলার একটা। এ পর্যায়ে সংস্কৃতির সামাজিক উপাদানসমূহ যেমন, পোষাক আশাক, সাজসজ্জা, ভাষা, অর্থাৎ ঘর ও পরিবারের বাইরে ব্যক্তিক মর্যাদার সাথে জড়িত উপাদানগুলির গুরুত্ব আলাদাভাবে নির্ধারিত হয়। সংস্কৃতির সামাজিক উপাদানগুলো পরিণত হয় সচেতন সুসংগঠিত শিক্ষা ও আর্থিক ব্যয়ের মাধ্যমে অর্জনের বিষয়।

এই শিক্ষার বেশিরভাগটাই সম্পন্ন হয় ভাষিক নির্দেশনার মাধ্যমে। আর তার চেয়েও বড় কথা, শিক্ষার কায়দাকানুন আর ইতিহাস, তার নথি ও বিবরণ জমানোর প্রয়োজন হয় বাচ্চাদের ও বাচ্চার বাচ্চাদের জন্য। জমানোর জায়গা হলো প্রথমে বংশের ও সমাজের সিলসিলাতে মুখের ভাষায়, আর, লেখা আবিষ্কারের পরে লিখিত ভাষায়। ভাষা পরিণত হয় সমাজের সামগ্রিক সংস্কৃতির বিরাট এক পোটলায়, যেখান থেকে ব্যবহারিক প্রয়োজনে সংস্কৃতির সাথে মানুষের লেনাদেনা চলে। সংস্কৃতি বদলালে ভাষার পোটলায় তার নথিও বদলায়। আবার এই নথি পাঠে মানুষ তার সাংস্কৃতিক আচরণে প্রয়োজনীয় শুদ্ধিও আনে।

ভাষার এই নয়া ক্ষমতার কারণে তা কেবল সংস্কৃতির অংশমাত্র হয়ে থাকে না, হয়ে উঠে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এর ফলে ভাষার পোটলায় সংস্কৃতি ধারণ ও বহনের সময় তার লিখিত নথি বদলে সংস্কৃতির ব্যবহারিক জায়গাটায়ও কৃত্রিম পরিবর্তন নিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হয়। ক্ষমতাধর কেউ চাইলে ভাষার জগতে সঞ্চিত সংস্কৃতির বয়ান পরিবর্তন করে দিতে পারে। ফলে পরের প্রজন্মের মানুষেরা পাবে সংস্কৃতির পরিবর্তিত বয়ান। এ থেকে সে যা শিখবে তার সাথে পূর্বপুরুষের প্রকৃত সংস্কৃতের মিল থাকবে না, বরং ভাষার বয়ানের মধ্যে পরিবর্তিত সাংস্কৃতিক ধরনের সাথে সাদৃশ্য থাকবে। ধরা যাক কোনো একটা আধুনিক জনগোষ্ঠীতে জারিগান একটা সার্বজনীন সাংস্কৃতিক চর্চা হিসাবে বংশপরম্পরায় চর্চিত হয়ে আসছে। এ ইতিহাস লেখা থাকবে তাদের ভাষায়। কোনো একটি বহিরাগত শক্তি বা আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী যদি প্রকৃত ভাষিক বয়ান মুছে দিয়ে জারিগানকে একটি সাম্প্রদায়িক আচরণ হিসাবে বিবৃত করে নতুন বয়ান যুক্ত করে দিতে পারে তাহলে দুএক প্রজন্ম পরে জারিগান সেই মানবগোষ্ঠীর কাছে সাম্প্রদায়িক আচরণ হিসাবেই গণ্য হবে। এ অবস্থাটা সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের বড় একটা উপাদান। উপনিবেশী শক্তি তার যথেচ্ছা ব্যবহার করেছে, ভাষিক বিবরণে স্থানীয়দের সংস্কৃতির ইতিহাস পাল্টেছে, তার উৎস ও পরিচয়ে জুড়ে দিয়েছে নিম্ম মানের কলঙ্ক; নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে সভ্যতা, উন্নতি ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে। এমনকি এখনো রাজনৈতিক মতভেদ বা ভৌগলিক ব্যবধানের কারণে এ ধরণের ভাষিক ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা ঘটে চলেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

আমরা যেমন বলি মানুষ সামাজিক জীব, তেমনি বলা যায় মানুষ ভাষিক জীবও। জন্মগতভাবে বধির মানুষ ছাড়া ভাষার বাইরে চিন্তা, কল্পনা, স্বপ্ন ইত্যাদিও সম্ভব নয়। সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরার জন্যও ভাষার সাহায্য নিতে হয়। আধুনিক শিক্ষিত মানুষের সংস্কৃতি, ইতিহাস, জ্ঞান, ভাববজগত সবই ভাষার কাছে বান্ধা পড়ে আছে, যার অনেখানি আবার লিখিত ভাষা। যারা পড়তে জানেন না তারাও শিক্ষিত জনের পড়া ও প্রচারের মধ্য দিয়ে প্রভাবিত হন ঐ ভাষার দ্বারা। কাজেই বলা যায় “আধুনিক সামাজিক মানুষ কেবল মাটির আশ্রয়ে বাঁচে না, ভাষার মধ্যেও বাঁচে, ভাষার মধ্যে সে মানুষ হয়ে ওঠে। সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তার মূর্তির অনেকটাই ভাষা দিয়ে বানানো। মানুষের আত্ম-চেতনা বা আমিত্বের বোধের বেশিরভাগটাই ভাষার আশ্রয়ে তৈরি। যে-প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশে মানুষের বড়-হওয়া সেই পরিবেশকে সে চৈতন্যে ধারণ করে ভাষার সাহায্যে চিনে নিয়ে।”১ এই ভাষার বেশিরভাগটাই লিখিত  (বা অডিও রেকর্ডকৃত)–বই, পত্রপত্রিকা, চিঠি, আজকালকার কথিত-নথি (অডিও ফাইল) ইত্যাদি। এইভাবে দেখলে আমরা বুঝতে পারি আধুনিক মানুষের জানার জগতটা আসলে কিতাবের জ্ঞান, বয়ানের পাঠ। অতএব কোনো পরিস্থিতিতে যদি একটা জনগোষ্ঠীর ভাষা বদলে যায় বা প্রচলিত ভাষার বানোয়াট রূপান্তর ঘটে তাহলে ব্যাপক পরিবর্তন আসে তার জানার জগতে। নতুন ভাষা বা রূপান্তরিত ভাষায় যেসব বইপত্র রচিত হবে তারা দিন দিন সেগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। পুরানা বইপত্র আস্তে আস্তে তাদের জানার দুনিয়ার বাইরে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে, সেই সঙ্গে তারা হারাবে তাদের মনোজগতের অনেক কিছুই: সংস্কৃতির বয়ান, ইতিহাস, ধর্ম সম্পর্কিত বিবৃতি, সমাজ ও সাহিত্য অনেক কিছু। তাদের মনোজগতে স্থান করে নিবে ভাষার নতুন ধরণে রচিত বইপত্রের মাধ্যমে উপস্থাপিত নতুন জগতের নানা উপাদান। উপনিবেশী শাসকরা এভাবেই শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াটা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে উপনিবেশিতদের হাতে পাঠ্যপুস্তকের নামে তুলে দিয়েছে নতুন পুস্তকরাশি–ভিন্ন এক জগতের ভাষিকমূর্তি।

এই প্রক্রিয়ায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে বাংলা গদ্য তৈরির প্রক্রিয়ায় রচিত হয়েছে নানা ধরণের বইপত্র। এসব বইয়ে বিবৃত সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্মবোধ সবই পূর্বের তুলনায় ভিন্ন। ধারাবাহিক বিশ্লেষণে দেখা যাবে শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের এই বদল বাংলাদেশের মানুষের শত শত বছরের সংস্কৃতি, জ্ঞানচর্চা, ধর্মীয় বিশ্বাসের থেকে ভিন্ন এক সংস্কৃতি, জ্ঞান, ইতিহাস প্রস্তাব করেছে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে সেই জ্ঞান ও সংস্কৃতিই আত্মস্থ করতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। প্রজন্মক্রমে বহু বছর ধরে এই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থেকে ক্রমে পরিবর্তিত সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভাবজগতকেই মেনে নিয়েছে তার মন এবং বুদ্ধিও।


আরো পড়ুন:ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৫)


মধ্যযুগের বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতি ছিল এ কালের থেকে বেশ ভিন্ন। ঐযুগের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের বিবরণ থেকে জানা যায় তখন মুসলমানদের মক্তব মাদ্রাসা, আর হিন্দুদের চতুষ্পাঠী, টোলকেন্দ্রিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। সাধারণত মসজিদে ও সম্পদশালী মানুষের বাড়িতে মক্তব পরিচালিত হতো। মক্তব ছিল প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। মুসলমান শিশুরা মক্তবে পড়তে আসতো। সাধারণত চার সাড়ে চার থেকে ৭ বছরের মধ্যেই বাচ্চাদেরকে মক্তবে পাঠানো হতো। পড়াতেন মৌলভী সাহেব। এ জাতীয় পড়াশোনায় প্রাধান্য পেতো ধর্মীয় শিক্ষাই। রাষ্ট্রীয় এবং অবস্থাপন্ন মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগ উভয় উৎস থেকেই নির্বাহ হতো মক্তবগুলোর ব্যয়ভার। প্রায় প্রতিটি গ্রামে মক্তব পরিচালিত হতো বলে মুসলমান ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার যথেষ্ট সুযোগ ছিল।

আকবরের সময় বাচ্চাদেরকে সহজে পড়াবার নিমিত্তে একটি সহজ পাঠ্যসূচীর প্রণয়ন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। গদ্যে এবং পদ্যে উভয় মাধ্যমে পড়ানো হতো তখন। সে সময় মক্তব পর্যায়ে আরবী শিক্ষা, কোরআন-হাদিস পাঠ, ইসলামের মুলনীতি এবং বাংলা ভাষা শিখানো হতো, সেই সঙ্গে হিসাবনিকাশ সংক্রান্ত প্রাথমিক জ্ঞানও। শমসের গাজীর পুঁথি নামক কাব্যে উল্লেখ আছে, শমসের গাজী একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং ঢাকা থেকে ফারসির, হিন্দুস্তান থেকে আরবীর এবং জুগদিয়া থেকে বাংলার শিক্ষক নিয়ে আসেন। এ ছাড়াও হিসাব নিকাশ সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান বিদ্যালয়গুলোতে দেয়া হতো। প্রাথমিক অর্থাৎ মক্তব পর্যায়ে ছেলেমেয়েরা একসাথেই পড়তো। লায়লী এবং মজনু একসাথেই মক্তবে যেতো বলে বর্ণনা রয়েছে। ফারসি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাও থাকতো কোনো কোনো মক্তবে।

উচ্চ শিক্ষার জন্য ছিল মাদ্রাসা। সারাদেশে মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল যথেষ্ট। সমস্ত নগর ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে মাদ্রাসা পরিচালিত হতো বলে জানা যায়। আরো উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিল উচ্চতর শ্রেণির মাদ্রাসা। এর মধ্যে বাঘা, গৌড়, পান্ডুয়া, সোনারগাঁও, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে পরিচালিত মাদ্রাসায় উত্তর ভারত থেকেও ছাত্ররা পড়তে আসতো।

মাদ্রাসার পাঠ্যসূচী ছিল বিস্তৃত। আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে জানা যায় মাদ্রাসায় নীতিশাস্ত্র, গণিত, কৃষি, পরিমাপ শাস্ত্র, জ্যামিতি, জ্যোতিষবিদ্যা, গার্হ্যস্থ বিদ্যা, আইন, চিকিৎসাবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস ইত্যাদি পড়ানো হতো। এসব মাদ্রাসাগুলো ছিল অবৈতনিক, এমনকি  কোনো  কোনোটায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। ফলে পড়ার সুযোগ পেতো গরীব মুসলমান ছাত্ররাও। ২

মুসলমান সম্পদ্রায়ের মতই হিন্দুদের মধ্যেও শিক্ষার সুব্যবস্থা ছিল। সাধারণত ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতে অথবা বাড়ির সামনে গাছতলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোন চলতো। পড়াশোনা ছিল গুরুকেন্দ্রিক। সচরাচর গুরু একটি টোলে বসতেন আর ছাত্ররা মাদুর পেতে পড়াশোনা করতো। প্রতিটি গ্রামেই এ ধরণের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। এসব বিদ্যালয়েও ছেলেমেয়ে উভয়েই একসাথে পড়াশোনা করতো। তবে আদি মধ্যযুগে পাঠের একচ্ছত্র অধিকার ছিল ব্রাহ্মণ সন্তানদের। পরে এ অবস্থার উন্নতি হয়, পড়াশোনার সুযোগ পায় অন্যরাও। সম্ভবত মুসলিম সমাজে মানুষের শ্রেণিহীন জীবনব্যবস্থা এবং শ্রীচৈতন্যের সাম্যবাদী দর্শনের প্রভাবে এ পরিবর্তন ঘটে থাকবে।

এরপর হিন্দু ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে প্রবেশ করতো টোলে। টোলগুলা ছিল মুখ্যত ব্রাহ্মণ ছাত্রদের সংস্কৃত শিক্ষার  কেন্দ্র। রাজভাষা ফারসি এবং মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থাও ছিল কোনো কোনো টোলে। প্রধান প্রধান পাঠ্য বিষয় ছিল সংস্কৃত ভাষা, কাব্য, ব্যাকরণ, জ্যোতিষশাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, ইতিহাস, ছন্দ, নিরুক্ত প্রভৃতি। কালীদাসের রচনা, অমরকোষ, পাণিনীর ব্যাকরণ, রামায়ন ও মহাভারত ইত্যাদি ছিল পাঠ্যপুস্তক। এগুলোর অধিকাংশই সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বলে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ স্তরের উচ্চ শিক্ষা শেষে আগ্রহী ছাত্ররা আরো এলেম লাভ করার জন্য যেতো নামকরা শিক্ষাকেন্দ্রে। যেমন: নবদ্বীপ, সাতগাঁও, বাকুঁড়া, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানেও বিখ্যাত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র ছিল। বৃটিশ দখলদারিত্বের আগ পর্যন্ত এই ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র।     

বৃটিশরা ক্ষমতা দখলের পর পর রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনেতিক রদবদলের কারণে প্রথমাবস্থায় এ শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। অন্যদিকে, বৃটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয়রা তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য নিজ নিজ দেশের অনুকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠে। ১৭২০ থেকে ৩১ সালের মধ্যে কলিকাতায় প্রথম ইউরোপীয় ধাঁচে একটি চ্যারিটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন রেভারেন্ড বেলামী। এরপর যে স্কুলটির কথা জানা যায় সেটি স্থাপন করেন সুইডিশ ধর্মযাজক জে জে কিয়ারনান্ডার, ১৭৫৮ সালে।৩  এরপর কোম্পানির উদ্যোগেও কিছু স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে হয়তো। কিন্তু এ সকল স্কুলই ছিল ইউরোপীয় ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য। বেলামীর স্কুলে নাকি ৬ জন বাঙালি ছাত্রও ছিল। থাকলেও বা। ওরা তো ইউরোপীয় শিক্ষাই পেতো।

প্রকৃতপক্ষে, বাঙালিদের জন্য প্রথম ইউরোপীয় ধাঁচের স্কুল খুলেন উইলিয়াম কেরি, মদনাবাটিতে ১৭৯৪ সালে। এ স্কুলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল ছাত্রছাত্রী পড়তে পারতো বলে জানা যায়। তাই বলা যায় দেশীয় শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তে ইউরোপীয় কায়দায় স্থানীয়দেরকে শিক্ষাদানের সূচনা এইখানে, মদনাবাটিতে। এরপর থেকে কোম্পানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুলের পাশাপাশি মিনারীদের দ্বারা পরিচালিত স্কুলের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, সমাজে পূর্বের ধনী ব্যক্তিদের পতন ইত্যাদি কারণে চুতুষ্পাঠী, মক্তব, মাদ্রাসা টোলগুলো উঠে যেতে থাকে। তার জায়গায় স্থান করে নেয় ইউরোপীয় ধাঁচের স্কুল। সারা বাংলাদেশেই এ ধরণের স্কুল বসতে থাকে। ১৮১৭ সাল নাগাদ কেবল শ্রীরামপুর ও আশপাশে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ৪৫টি, আর চুঁচুড়ায় ৩৬টি।৪ এসব স্কুলে হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্মের ছাত্ররা পড়াশোনা করতো। কোনো কোনো স্কুল কেবল স্থানীয়দের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮১৭ সালে স্কুল বুক সোসাইটি এবং পরের বছর কলিকাতা স্কুল সোসাইটি স্থাপিত হয় বেসরকারী উদ্যোগে। ১৮২৩ সালে গঠিত হয় ‘জেনালের কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’। এরপর ১৮৩৫ সালে মেকলের শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে টোল-মক্তব-মাদ্রাসা যুগের শিক্ষাব্যবস্থায় স্থায়ী ইতি টানার সূচনা হয়।

এদিকে দ্রুত বাড়তে থাকে ইউরোপীয় ধাঁচের বিদ্যালয়ের সংখ্যা। ১৮২০ সালে কলিকাতায় টোল ছিল ২৮টি, ছাত্র ১৭৩। কলিকাতা স্কুল সোসাইটির রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা শহরে চলমান বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৯০টি বলে উল্লেখ করা হয়, ছাত্র সংখ্যা ৪১৮০।৫ 

বৃটিশ ধাঁচের বিদ্যালয় চালু হওয়ার সাথে সাথে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়নি। ১৮৫৫ সালে পাদ্রী জেমস লঙ অন্য কথা প্রসঙ্গে লিখেন যে, সারা দেশে ৪০ হাজার পুরানা ধাঁচের স্কুল চলছে। গবেষকরা সন্দেহ করেন এ সংখ্যা ফোলানাফাঁপানো। তবে একটা কথা নিদ্বির্ধায় বলা যায় যে বাঙালির নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশই সংকোচিত হয়ে মূল্যহীন হয়ে পড়ছিল। ১৮৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অনেক ইউরোপীয় তথা বৃটিশ ধাঁচের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। সে বছর মেকলের শিক্ষানীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে ভারতে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে যায়। ফলে নতুন ধরণের স্কুলগুলোরই গুরুত্ব বাড়ে।

বাঙালির নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয় তার পাঠ্য কি ছিল সে বিষয়ে জানাই আমাদের এ নাতিদীর্ঘ আলোচনার লক্ষ্য। আমরা জানি মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলিম উভয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মুখ্যত ধর্ম-প্রভাবিত, উদ্দেশ্য ছিল ধর্মবোধ ও ঈশ^র সম্পর্কে জ্ঞানদান এবং ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন উপায়ে জ্ঞানের অন্যান ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক শাখার বিষয়াদি সম্পর্কে শিক্ষাদান। কিন্তু বৃটিশ কায়দার শিক্ষাপদ্ধতি ধর্মকে আর সবকিছু থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। ধর্ম সেখানে জ্ঞান অর্জনের একটা ক্ষেত্র মাত্র, যেমন ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা বা ভুগোল ইত্যাদি। ইউরোপের জ্ঞানর্চ্চার কার্যকারণবাদী বা তথাকথিত আলোকায়নের যুগে ধর্মকে রাষ্ট্র ও সামাজিক বিষয়াদি থেকে আলাদা করে নেয়া হয়। ফলে জ্ঞানচর্চার ভিত্তি হিসাবে ধর্মের আর কোন ভূমিকা থাকেনি। এ কারণে বৃটিশ শিক্ষাপদ্ধতিতে ধর্ম পরিণত হয় জ্ঞানার্জনের আরেকটা বিষয়ে, জ্ঞানার্জনের ভিত্তি বা কৌশল হিসাবে ধর্মের কোনো অবস্থান নেই। এই পরিবর্তনের ফলে নতুন ধরণের বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যসূচীর রদবদল হয় ব্যাপক, বিশেষত ১৮১৭ সালের মে মাসে স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা এবং পরের বছর কলিকাতা স্কুল সোসাইটি গঠনের পর। এ দুই সোসাইটির কাজ ছিল পাঠাশালাগুলোর উন্নতি করা, নতুন পাঠশালা প্রতিষ্ঠা, পাঠশালায় পড়নোর মত উন্নত মানের বইপত্র লিখিয়ে মুদ্রিত করে অল্পমূল্যে প্রচার করা ইত্যাদি। এর আগে পর্যন্ত হাতে লেখা পুঁথিই চলছিল।

নতুন পাঠ্যতালিকায় একদিকে থাকে বৃটিশ জ্ঞানর্চ্চার প্রভাব, অন্যদিকে নীতিগত পরামর্শের সাথে জড়িত পন্ডিতদের পছন্দের কিছু বিষয়, যেমন হিন্দু ধর্মীয় আখ্যান উপাখ্যান, ধর্মীয় লোককাহিনি যেমন রামায়ন মহাভারত ইত্যাদি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন যেটা ঘটে তা হলো নতুন ধাঁচের স্কুল আর পুরানা টোল যাই হোক, সবার পাঠ্যসূচীতে পরিবর্তন আসে স্কুল বুক সোসাইটি ও অন্যান্য তরফে বই ছাপা ও দেশব্যাপী বিলির কারণে। কেবল স্কুল বুক সোসাইটিই ১৮১৭ সাল থেকে ১৮২৫ সালের মধ্যে একলক্ষর বেশি বই ছেপে বিলি করে।৬  উনিশ শতকের প্রথমার্ধের্¦ বিদ্যালয়ে পাঠ্য বইয়ের বাজারে এদেরই ছিল একচেটিয়া কর্তৃত্ব। ক্রমে এদের তৎপরতা কমে আসে, সেই জায়গা দখল করে নেয় সংস্কৃত প্রেস।

এর আগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে লেখা হয়েছে বাংলা গদ্যের ১৩টি বই। সেগুলো অবশ্য কলেজের সাদা ছাত্রদের পাঠ্য। পরবর্তীকালে এগুলোও সাধারণের পাঠ্যে পরিণত হয়। এসব বই এবং অন্যান্য উৎস থেকে উৎপাদিত বইপত্র ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের বিদ্যালয়সহ পড়াশোনা জানা লোকজনের হাতে। শিক্ষার ধর্মভিত্তিক বৈচিত্র শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটাও উল্লেখযোগ্য। যেমন হিন্দুদের শিক্ষার বিষয় ছিল একরকম, মুসলমানদের কিছুটা আরেক রকম, বৌদ্ধদের আরেকটু ভিন্ন ধরণের। এ সকল পার্থক্য ¯্রফে উড়ে যায় বৃটিশদের অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত নতুন ধাঁচের বিদ্যালয়গুলোর একীভুত শিক্ষাপদ্ধতিতে। বিদ্যালয়গুলোতে মোটামুটি সমধর্মী বইপত্রই পড়ানো হতো। এভাবে সমধর্মী পাঠ্যসূচী, একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, একই রকম পাঠদান পদ্ধতি–এসবের মধ্য দিয়ে একটি একমুখি শিক্ষাপদ্ধতি চালু হয়। যদিও টোল ও মাদ্রাসাগুলি তখনো চলছিল, তবু মূল শিক্ষাপদ্ধতি হিসাবে নতুন ধাঁচের শিক্ষাই প্রভাবশালী হয়ে উঠে।

কি পড়ানো হতো ঐসব বিদ্যালয়ে? বিভিন্ন সূত্রে কিছু কিছু বইয়ের নাম পাওয়া যায়। ‘আদিযুগের পাঠ্যপুস্তক’ প্রবন্ধে নিখিল  সরকার কিছু বইয়ের নাম দিয়েছেন। যেমন: মে’র পাটিগণিত, স্টুয়ার্টসের পাঠমালা, রাধাকান্তের নীতিকথা প্রথমভাগ ও ধারাপাত, পিয়ারসনের নীতিকথা দ্বিতীয়ভাগ, রামমকমল সেনের নীতিকথা তৃতীয়ভাগ, ফেলিক্স কেরির  ব্রিটিন দেশীয় বিবরণ সঞ্চয়, তারাচাঁদ দত্তের মনোরঞ্জন ইতিহাস, লসনের পশুবলি, ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের গ্রীসের ইতিহাস, বিষ্ণু শর্মার হিতোপদেশ ছাড়াও বীজগণিত, গণিতসার, জীবতত্ত্ব, পরিমাপ বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, বঙ্গদেশের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক বিভিন্ন বই। পাদ্রী জেমস লঙ ১৮২০ সালে মুদ্রিত বইয়ের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় অধিকাংশ বই কৃষ্ণলীলা, দেবদেবীর উপাখ্যান আর আদিরসাত্মক কাহিনি বিষয়ক। অল্প কিছু আছে ব্যাকরণ, জ্যোতিরবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থ ও পঞ্জিকা, ইত্যাদি। ১৮২৬ সালে ছাপা বইয়ের তালিকাতেও একই অবস্থা: ২৭টি বইয়ের মধ্যে ১৩টি হিন্দুধর্ম বিষয়ক বা  দেবদেবী আর্য রাজাদের আখ্যান। অন্যগুলোর বেশিরভাগই হিন্দু নীতিবোধ, ধর্মীয় সঙ্গীত ইত্যাদি। পাঠকদের আগ্রহ মেটানোর জন্য তালিকা দুটো জুড়ে দেয়া হলো। ৭ 

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ চালু হওয়ার পর বাংলা গদ্যের প্রথম বই রামরাম বসুর প্রতাপাদিত্যচরিত্র, ছাপা হয় ১৮০১ সালে। এটি কোনো বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ। প্রায় সাথে সাথেই বের হয় উইলিয়াম কেরির কথোপকথন। এরপর একে একে প্রকাশ হয় রামরাম বসুর অপর রচনা লিপিমালা (১৮০২), গোলকনাথ শর্মার হিতোপদেশ (১৮০১), মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বত্রিশসিংহাসন (১৮০২), হিতোপদেশ(১৮০৮) ও রাজাবলী(১৮০৮), রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়ের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্যচরিত্রং (১৮০৫), চন্ডীচরণ মুনসির তোতা ইতিহাস (১৮০৫), হরপ্রসাদ রায়ের পুরুষপরীক্ষা(১৮১৫) ইত্যদি। ১৮০১ সাল থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে ৮ জন লেখকের ১৩ টি বই প্রকাশিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে। অন্যদিকে শ্রীরামপুর মিশন থেকে অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি ছাপা হচ্ছিলো রামায়ন, মহাভারত ইত্যাদি লোকআখ্যানও। ছাপাখানার বদৌলতে বই জিনিষিটা সুলভ হয়ে যায় বাঙালির কাছে। আগে যা তারা দলবেধে রীতিমত আনুষ্ঠানিকতা করে কথকের মুখে কাহিনি হিসাবে শুনতো ছাপখানার কারণে সেগুলোর মূল বই-ই তাদের হাতে পৌঁছে যায়। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এ অবস্থাটার কথা তুলে ধরেছেন এভাবে: “শ্রীরামপুরে ছাপা কৃত্তিবাসের রামায়ন ও কাশীরামের মহাভারত গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যায়। জনশিক্ষার জন্য কথকতা, পাঁচালী গান, মঙ্গলগান প্রভৃতি যে-পুরাতন লৌকিক উপাদান আমাদের ছিল শ্রীরামপুরে ছাপা এই বইগুলি তারই স্থান অধিকার করেছিল”।৮ 

ছাপা বইয়ের তালিকায় কেবল ধর্মীয় রচনা বা আর্য দেবদেবী রাজরাজড়াদের আখ্যানের ছড়াছড়ির কারণটা আমরা আগে উল্লেখ করেছি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় ইংরেজরা ধরে নেয় মুসলমান-রা ভালো বাংলা লেখতে পারে না, তবে সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা বাংলা ভাষায় সবিশেষ দক্ষ। সংস্কৃত পন্ডিতদের দ্বারাই বাংলা বইপত্র লেখাতে হবে। তাই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ফারসি ও উর্দু ভাষার বই লেখার জন্য নেয়া হয় মুসলমান মৌলভী। বাংলা বইপত্র লেখার জন্য বাংলা-জানা লোক না নিয়ে ডেকে আনা হয় সংস্কৃত জানা পন্ডিতদের। প্রাক-উপনিবেশ কাল পর্যন্ত যেসব হিন্দু মুসলিম কবি, কবিয়াল, শায়ের, গদ্যলেখক বাংলা সাহিত্যের চর্চা করতেন তারা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বই লেখার সুযোগ পান নাই। এ কারণে বাঙালির আসল ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য, কিস্সা, কাহিনি, সাহিত্যে সমাজের প্রতিফলন সবই চিরতরে হারিয়ে যায়। সেইসঙ্গে হারায় প্রচলিত বাংলাগদ্যের ধরণও। তাছাড়া, ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের হাতে বাংলা বইপুস্তক লেখার ভার পড়ায় লেখা হয় দেবদেবীর উপাখ্যান, ধর্মগ্রন্থ প্রভৃতি। কারণ তারা ছিলেন সংস্কৃত শাস্ত্র ব্যবসায়ী. তাদের বিদ্যার দৌড়ও ঐ পর্যন্ত। এর ফলে বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে দুইটা প্রবণতা জারি থাকে, এক: গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, বীজগনিত প্রভৃতির সাথে বৃটেন দেশীয় ইতিহাস, বিবরণ, ভুগোল ইত্যাদি পড়ার ঝোঁক; দুই: প্রাচীন আর্য, রাজা, ঋষি, সামন্ত, দেবদেবীদের আখ্যান, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি সম্পর্কিত ও  ধর্মীয় বইপত্র পাঠ্য হিসাবে গ্রহণ। বিদ্যালয়ের বাইরে সাধারণের পড়ার জন্য যেসব বই ছাপা হতো তাতেও এগুলারই প্রাধান্য ছিল।

এ অবস্থায় বাঙালি হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের সামনে ছিল দুটো বিকল্প: হয় নতুন ধাঁচের স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করে ইংরেজের চাকরি নিয়ে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করা, নয়তো আগের ধাঁচের ধর্ম-প্রভাবিত ঐতিহ্যভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণ করে হীনতর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানে পতিত হওয়া। এই একই সুযোগ মুসলমান-দের সামনে আসে ভিন্ন ঐতিহ্যিক ও ধর্মীয় সংঘাতময় অবস্থান নিয়ে। মুসলমান-রা হয় মাদ্রাসার শিক্ষা নিয়ে বেকার, দরিদ্র, সামাজিক মর্যাদাহীন জীবন যাপন করবে; অথবা নতুন ধরণের শিক্ষাব্যবস্থায় বৃটেন দেশীয় বিবরণ ও হিন্দু দেবদেবীদের আ্যখান পাঠ করে ইংরেজের চাকরী নিয়ে দু পয়সার মুখ দেখবে।

মুসলমান-দের সামনে এ ছিল প্রকৃতই এক অচলাবস্থা। ইতিহাস থেকে আমরা জানি এ পরিস্থিতিতে মুসলমান দীর্ঘদিন অচল হয়েই বসেছিল, যখন হিন্দুরা এসব বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে চাকুরী নিয়ে রীতিমত ভালো অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নেয়। এডামের রিপোর্টে দেখা যায় সে সময় হিন্দু  মুসলিম ছাত্রের অনুপাত ছিল ১০ : ১।৯  এ চিত্র রীতিমত ভয়াবহ। এর মূল কারণ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার কথা বললেও বিদ্যালয়গুলোতে মূলত পড়ানো হতো ইংরেজের ইতিহাস, ভুগোল, গণিত আর আর্য দেবদেবী রাজরাজড়াদের কাহিনি, তাদের ধর্ম-সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদি। নতুন ধাঁচের শিক্ষায় কেন মুসলমান-রা পিছিয়ে পড়েছিল তারও একটা ভুল ব্যাখ্যা আমাদের ইতিহাসে চালু আছে। বলা হয়ে থাকে ইংরেজি শিক্ষাকে ঘৃণা করেই তারা এসব বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণে এগিয়ে আসেনি। বিদ্যালয়গুলোতে ঐ সময়ের পাঠ্যসূচীর দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে সেটিই একমাত্র কারণ নয়।

যাই হোক, পাঠ্যপুস্তকের এ অবস্থার উন্নতি হয়নি দীর্ঘদিন। এমনকি ১৮৫৭ সালে ছাপা ৩২২টি বইয়ের নাম পরিচয় থেকে দেখা যায় এর মধ্যেও হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ক বই ছিল ১০০টিরও বেশি । এ অবস্থা কাটিয়ে উঠার একমাত্র রাস্তা ছিল ঐসব স্কুলে পড়াশোনা করা এবং সংস্কৃতায়িত বাংলা রপ্ত করে লেখকসাহিত্যিক হয়ে সমাজ পরিবর্তনের প্রয়াসে লিপ্ত হওয়া। মুসলমান তাও করেছিল তবে অনেক পরে। তার মধ্যে পার হয়ে যায় শতকের অর্ধেকেরও বেশি সময়।

এখানে আমরা তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের দিকগুলো চিহ্নিত করে রাখতে চাই, পরবর্তী আলোচনার জন্য। প্রথমত: ইউরোপীয় ধাঁচের বিদ্যালয়ের কারণে অনেক বেশি সংখ্যক ছাত্র পড়ার সুযোগ পায়। সেখানে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব ছাত্রই পড়তে পারতো। যদিও মুসলমানরা একবারে নগণ্য সংখ্যায় যুক্ত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত: পূর্বের ধর্মচর্চাকেন্দ্রিক পাঠ্যসূচীর বদলে নতুন পাঠসূচী চালু হয়। নতুন পাঠ্যসূচীতে ইংরেজি ভাষা, ইউরোপীয় দেশের ইতিহাস, ভারত বর্ষের প্রাচীন ইতিহাস, রামায়ন মহাভারত প্রভৃতি আর্য উপাখ্যান, হিন্দু ধর্মীয় নীতিকথা, গণিত, ভূগোল, ব্যাকরণ ইত্যাদি গুরুত্ব পায়। এই পাঠ্যসূচী ছিল হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান ধর্মনির্বিশষে সকল ছাত্রের জন্য। কাজেই আগের তুলনায় হিন্দু ছাত্রদের পাঠ্যসূচীতে সামান্য পরির্তন আসে, নতুন যুক্ত হয় ইংরেজি ভাষা ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস, ভুগোল ইত্যাদি। কিন্তু মুসলমান বা বৌদ্ধ ছাত্রদের জন্য পুরো সিলেবাসই পাল্টে যায়। নতনু সিলেবাসে এমন হয় যে, রামায়ন মহাভারত আর আর্য দেবদেবীদের কাহিনি ইত্যাদি পড়তে হবে বিধায় দীর্ঘদিন ছেলেমেয়েদেরকে এসব স্কুলে পড়তে পাঠায়নি রক্ষণশীল  মুসলমান-রা।

কিন্তু এ ছিল কালের নির্ধারিত বিন্যাস। ফলে একসময় বাধ্য হয়ে এসব পাঠ্যসূচীর পড়াশোনাতেই অংশগ্রহণ করে মুসলমান-রা। এভাবে ইতিহাস, নীতিবোধ, কল্পনা, চিন্তার এক নতুন জগতে পা ফেলে মুসলমান ছাত্রদের থেকে শুরু করে সাধারণ বাঙালি মুসলমান পাঠক সকলেই।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত