| 19 এপ্রিল 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

মৃত্যুবিষয়ক কবিতাগুচ্ছ । প্রথম পর্ব । দিলীপ মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

 

 

১.

চলতে শুরু করেছে চুল্লিটা ,

খাচ্ছে সে , গোগ্রাসে খাচ্ছে ।

কাম-প্রেম-ঘৃণা-প্রীতি চল্লিশ মিনিটে

একমুঠো ছাই ।

প্রজ্ঞা ও প্রতিভা বড় বোকা বনে যায়  ।

২.

ঘাট থেকে উঠে আবার ঘাটে নামা

নিরবধি ।

কূটতর্ক করে যাই আমরা যে যার মতো ,

মেলে না উত্তর ।

অবশিষ্ট থাকে শুধু প্রগাঢ় বিস্ময় ।

৩.

রোদে-ঝড়ে অনেক চলেছে ,

থামতে হল ।

এ থামাও চলা ? এ কথা জানলে

ভাবনাহীন ।

৪.

জবাব দিয়েছে ডাক্তার । সে যাচ্ছে ।

কেমন ঘোলাটে চোখ । অস্থির অস্থির ।

এখনও ভাবছে কিছু ? বলতে চায় ?

অলৌকিক দৃশ্য কিছু ? অন্ধকার  টানেলের মতো ?

আমরা এখানে আছি । তার এত তাড়াহুড়ো কেন ?

৫.

আমরা দেখি নি কেউ তাকে ।

হয়তো মুমূর্ষু দেখে । দেখতে পায় ।

তখন সে অভিভূত । বলার আগেই

সিগন্যাল ক্লিয়ার হয়ে যায় ।

৬.

মৃতদেহ দেখে হাসতে লাগল উলু পাগলি ,

আপনমনে বলল , যাচ্ছিস ? যা , যা ।

কেউ ধমকে উঠল , তাড়া করল কেউ,

হাসির তরঙ্গ কিন্তু ঘুরে ঘুরে দিগন্তে ছড়ালো :

যাচ্ছিস ? যা , যা …..

৭.

শ্বাস উঠছে । গঙ্গাজল দাও মুখে । হরিবোল হরিবোল ।

কেন ? বিশ্বাসের হেতু ? আঃ, সান্ত্বনা , সান্ত্বনা ।

থাকুন বা না থাকুন শ্রীহরি সহায় ।

৮.

মধ্যরাত । অসতর্ক প্রতিপক্ষ । নিদ্রার আবেশ ।

ভাবলেশহীন আঙুল ট্রিগার চাপে । শেয ।

৯.

হার্টব্লক ছিল । চলে গেল ঘুমোতে ঘুমোতে ।

মানুষটি পয়মন্ত । দুশ্চিন্তার দিল না সুযোগ ।

ঘুমের ভেতরে কোন কা্য়াহীন ছায়া

ডেকেছিল কি না তাকে জানাই গেল না  ।

 

১০.

আছে কি মৃত্যু-র কোন রঙ ?

যে দেখে সে বলার আগেই বিমানগতিতে যায়

বিদেশ বিভুঁই ।

১১.

বড়দিনের সন্ধ্যা । পার্কস্ট্রিট । জমজমাট ।

আচমকা বাসের ধাক্কা । একটু চিৎকার ।

পড়ে আছে । রক্তমাখা দেহ । পুলিশের গাড়ি ।

তুলে নিল । স্বাভাবিক । সব স্বাভাবিক  ।

১২.

জনগণমননন্দিত মানুষটি শ্মশানে । নিঃসাড় ।

একই  শ্মশানে শুয়ে আছে নকুলচন্দ্রের দেহ ।

ক-অক্ষর গোমাংস নকুল নিতান্তই নামগোত্রহীন ।

অথচ একই শ্মশান । দুজনেই সেখানে ‘বডি’ ;

সমপরিমাণ আগুন লাগবে দুজনের ।

চুপচাপ দুজনেই হয়ে যাবে গোত্রহীন ছাই ।

১৩.

টেবিলে হিসেবের খাতা ।

পরিচ্ছন্ন , নিটোল ।

হিসেব মেলে নি কিন্তু শেযে ;

ভাবে নি সে আচমকা চলে আসবে পেয়াদা পাইক ।

১৪.

বুদ্ধি দিয়ে , বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিয়ে

ঠেকাবার চেষ্টা করে যাই ,

তথাপি গড়াই ,

গড়াতে গড়াতে সেই মূক তমিস্রায় ,

ক্রমাগত যার দিকে চলেছি গড়িয়ে ।

১৫.

জানালাগুলো হাট করে খোলা ,

হুড়মুড় করে ঢুকছে হাওয়া,

উড়িয়ে নিয়ে যাক টুকরো টুকরো ছবি

ধুলো জমার আগে ,

যে নাই তার জন্যে থেমে নেই কিছু ।

১৬.

তার সঙ্গে আমাদের লুকোচুরি খেলা ।

এ ভাবে পা ফেলে আসে সেই কালবেলা ।

তখনও তেমনি থাকে মোহিনী আড়াল  ।

বাজায় নতুন বাঁশি কালের রাখাল ।

১৭.

ছবিগুলো দেখি । ঘটনার ক্রম মনে পড়ে যায় ।

মনে পড়ে মনে পড়ে , আর কিছু নয় ।

তুমি তো কেবলই ছবি ইট কাঠ পাথরের মতো ,

কায়াহীন ছায়া ।

বছর গড়িয়ে গেলে পড়ে থাকে অনাদৃত অ্যালবামের কোণে ।

১৮.

রাত গভীর । বৈতরণীর তীর । নিস্তব্ধ নির্জন ।

অন্ধকারে একাকার । চেতনার মানে নেই কোন ।

অন্ধকার ।  আশাহীন ভাষাহীন অন্ধকার । হয়তো মরণ ।

 

 

 

১৯.

ফাঁকা মাঠ । একটা দেহ । নিথর । অজ্ঞাতকুলশীল ।

ধীরে ধীরে তাকে টানছে মাটি ।

সে মিশছে মাটির সঙ্গে । হয়ে যাবে মাটি ।

২০.

এপি সেন্টারের কাছে বাড়ি । মা-বাবা বাইরে ।

ফুটফুটে শিশুদুটি ঘুমে অচেতন ।

কলঙ্কিত করে নি পৃথিবী তারা , ছড়ায় নি বিষ ।

ফুটফুটে শিশুদুটি দেবতার মতো ।

দেবতার রুদ্র রোষ ছুঁয়ে গেল তাদের শরীর ।

২১ .

শব্দটব্দ থেমে যায় । নিভে যায় আলো ।

অন্ধকার দুহাত বাড়ালো ।

মুছে যায় দৃশ্যপট । স্মৃতিও লোপাট ।

অর্থহীন প্রাক্তন সে হাট-মাঠ-ঘাট ।

২২.

মৃতদেহ একটা আয়নার মতো ,

যে আয়নায়  ফুটে ওঠে নিজের মৃত্যুর ছবি ।

সে ছবি দেখামাত্র পাশ কাটাই ।

যাঃ , দিব্যিতো আছি , আমার কেন …….

ঘন্টা বাজিয়ে যায় মৃতদেহ দারুণ নীরবে ,

ভিতরে  কম্পন জাগে , ভয় ভয় ভয় ….

 

 

 

২৩.

সৌরজগতের ঘূর্ণিপাক ,

ফিরে পাক এবং হারাক ।

২৪.

গুছিয়ে টুছিয়ে রাখে । যাবার প্রস্তুতি ।

যাবার সময় হলে বৈরাগ্য উধাও ।

আর্ত কাতরতা মাখে তার কণ্ঠস্বর :

কেন যাব ? কেন যাব ? কেন যেতে হবে ?

২৫.

কুয়াশা যে ! চোখ চলে না । কোথায় যাবো ?

উঁচুতে কি ! অনেক নিচে ! সব যে সমান ।

উঠবে কি রোদ ? স্বচ্ছ হবে ? দেখতে পাবো ?

এতটা কাল যা দেখেছি সে সব আছে ?

২৬.

নিয়মের পৃথিবীতে সব কিছু নিয়মেই চলে ।

ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক ঠিক ঠিক ।

কে বলেছে ? বাজে কথা । মৃত্যু-কে চেনে না ।

মৃত্যু বড়  স্বেচ্ছাচারী । মানে না নিয়ম ।

২৭.

আচমকা এসে যাবে মায়াবী ঘাতক ,

যার কথা ভেবে ভেবে শঙ্কিতভবদুপযানম ।

তমসার রঙ মেখে দাঁড়াবে দুয়ারে  ।

শব্দহীন সেই ডাক বড়ই অমোঘ ।


আরো পড়ুন: সুবীর সরকারের কবিতা


২৮.

সে ছিল রোদের মতো অকপট অসহ্য সুন্দর ।

রোদ কিন্তু আসে যায় বিরামবিহীন ।

সে ছিল বৃষ্টির মতো স্নিগ্ধ শান্ত পেলব সুন্দর ।

বৃষ্টি কিন্তু আসে যায় বিরামবিহীন ।

সে কিন্তু সেই যে গেল এল না তো আর –

পৃথিবীর দুই গতি নিরুদ্দেশে নিয়ে গেছে তাকে ।

২৯.

সিঁদ কাটে । সামগ্রী ছোঁয় না । কি করে সে ?

ঘুমপাড়ানি গান গায় শুধু ।

সে গানের সুরে আছে তীব্র সম্মোহন ,

অবাধ্য স্নায়ুরা হয় ধীরে ধীরে অবশ শিথিল ,

রক্তে জাগে হিম শীতলতা ।

৩০.

যথেচ্ছ রোদ্দুর মাখছি হররোজ ,

কাঠ[পাতা জ্বালিয়ে আগুন ,

শুনেছি শীতের দেশ , শরীর অসাড়

হবার আগেই চাই আগুনের ঘনিষ্ঠ উত্তাপ ।

৩১.

প্রখর এই মধ্যাহ্নে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে

যে উদ্ভিন্নযৌবন,

সে সত্যি পাগল কি না বলবে কোন পাগল ?

 

 

৩২.

চিনচিনে ব্যথা বুকের বাঁদিকে । ছড়াচ্ছে ছড়াচ্ছে ।

শরীরে ঘাম । অস্থির অস্থির । সে আসছে ।

জিভের তলায় সরবিটেট । কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে

দস্যুশিরোমণি ?

৩৩.

কোন কথাই শোনে না পাগল ।

কবরখানার মাটি খুঁড়ছে দিনরাত ।

বিড় বিড় করে বলছে আপনমনে :

এ মাটির মধ্যে আছে সেই প্রাণকণা ।

৩৪.

এমন নিঃশব্দে কেউ দাঁড়ায় দুয়ারে ?

দাঁড়ায় সম্মুখে চুপচাপ ?

নিয়ে যায় শব্দহীন পথে ?

৩৫..

‘আসছি’ বলে চলে গেল নাচতে নাচতে ,

ফিরেও এল নাচতে নাচতে খাটিয়ায় ,

তখন মুখর ছিল , এখন সে মূক,

অবারিত সূর্যালোক আগেকার মতো  ।

৩৬.

লরির ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাজপথে ,

আহা ঘুমোক ঘুমোক  ।

পরিশ্রান্ত ছিল বড় , শরীর মনের

বড়ই ধকল গেছে , এই অবসরে

একটু ঘুমোক এই মুখরিত ব্যস্ত রাজপথে ।

৩৭.

মৃত্যু কাছে দাঁড়িয়ে শ্বাস ফেললে

কেমন বোকা বোকা হয়ে যায় মানুষ ;

মৃত্যু হাত বাড়ালে একটু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়

আছে , আছে , কিছু একটা আছে ।

৩৮.

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো । বৈরাগ্য মাখেনি ।

মৃত্যুকে মৃত্যুর মতো মনেই হয় নি । তাই

অকম্পিত সে এখন অজস্র মজলিশে

অসীম অতৃপ্তি নিয়ে হইহই ঘোরে ।

৩৯.

রক্তের বিকল্প নেই । তবু রক্ত ঝরে

নগরে প্রান্তরে ।

রক্তের বিকলপ নেই । রক্তে হোলিখেলা ।

আসে কালবেলা ।

রক্তহীন শবগুলি রক্ত চায় ।

নীতিকথা বড় অসহায় ।

৪০.

নার্স জানে , কিন্তু আজ যে এসেছে এই বেডে

সে কিছু জানে না ।

কাল ছিল এই বেডে একজন , তরতাজা যুবক ।

চলে যেতে হল তাকে জরুরি তলবে ।

তার খোঁজে কেউ যেন এসেছিল আজ,

সে বলে : কেমন করে কি যে হয়ে গেল,

এই ছিল এই নেই , খেই নেই খেই নেই ।

৪১.

একেবারে রবাহূত । না চাইলেও আসে ।

ছিন্নমূল করে দেয় । অজানা প্রবাসে

অস্বস্তি যে হতে পারে ভাবে না সে কথা ।

বিতর্ক অযথা ,

কারণ সে গোঁয়ার বড় এবং বধির,

শ্রেণি বিভাজন নেই পুরুষ নারীর ।

৪২.

বহুকাল মৃত্যু-র মতো স্তব্ধতায় যাপন করে

মৃত্যুবরণ করলেন সুচিত্রা ।

জীবন ও মৃত্যু-র সীমারেখা মুছে দেওয়া এ যাপন

ব্যতিক্রমী অথবা অদ্ভুত ।

৪৩.

পল্টুদার বডি এল । পল্টুদা কোথায় ?

বডির ভেতরে থাকে যে মানুষ

নিরুদ্দেশে সে কেন হারায় ?

৪৪.

দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ফিরে এল । বিভ্রম ।

ফিরে আসে যদি ! ডাক দেয় আগেকার মতো !

ঘটে যা তা সব সত্য নয় , এই কথা ভেবে

দরজার পাশে বসে স্নায়ু টান টান ।

৪৫.

রাস্তার কুকুর মরে পড়ে আছে রাস্তার উপর ।

অত্যন্ত নিস্পৃহভাবে তাকে দেখে চলে যাচ্ছে রাস্তার কুকুর –

ব্যথাহীন , প্রতিক্রিয়াহীন ।

কিভাবে আয়ত্ত করে স্টয়িক দর্শন ?

৪৬.

তিনশো আশি কোটি বছর আগে মূক এই পৃথিবীতে

এসেছিল প্রাণকণা । কত জন্ম মৃত্যুর ভিতর দিয়ে তার

রূপান্তরের লীলা সমানে চলেছে বিশ্বে….যখন নিশ্চিন্ত হব

আমি সেই , আমি সেই , তখন এ মৃত্যুভয়

দূরে চলে যাবে , করণ তখন আমি জরা-মৃত্যুহীন ।

৪৭.

সুহাসকে সুপুরুষ বলা যায় । বিয়ে-থা করেনি ।

চাপা স্বভাবের ছেলে, জানত না কেউ

মনের গভীরে তার  কি খেলা চলেছে  ।

সুহাসকে জিতেন্দ্রিয় বলা যায় , ধর্মে-কর্মে মতি,

সে সুহাস আত্মঘাতী হল কেন এমন সকালে !

হতবাক আত্মীয়-বান্ধব খোঁজে লৌকিক কারণ ।

 

৪৮.

দেশের জন্য মরতে পারে অনেকে ,

প্রেমের জন্য মরতে পারে অনেকে ,

মরার জন্য মরতে পারে যারা

তারা কি পাগল কিংবা বুদ্ধিহীন নয় !

৪৯.

ট্রেনে-বাসে যাবে বহুদূর । লটবহর কম নয় বড় ।

প্যাকারকে ডাকা হয় । ঠিকঠাক বাঁধাছাঁদা চাই ।

দুপুর দুটোয় গাড়ি । আসে ছোট হাতি ।

হঠাৎ কি হল তার ! পড়ে গিয়ে চুপ !

সব কিছু ঠিকঠাক , যে যাবে সে নেই ।

চলে গেছে বহুদূর , পাবে না হদিশ ।

৫০.

এ তার উৎকট শখ—সুযোগ পেলেই

নাড়েচাড়ে মৃতদেহ , তন্ন তন্ন খোঁজে

কোনখানে প্রাণ ছিল , কোনখানে ঠিক !

 

 

 

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত