| 24 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গদ্য: চিঠির ব্যথা । পায়েল চট্টোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

কান্না দিয়ে গড়া একটা লোক। ঠিক আমার মত। লোকটা সবসময় কাছে রাখে আমায়। আমার গায়ে লেখা নীল রঙের অক্ষরগুলোয় হাত বুলোয়। কান্না-ফুল ঝরে পড়ে তখন। আমি সব দেখতে পাই। লোকটার সাদা চুলের পাশ থেকে যন্ত্রণা উঁকি দেয়। কষ্ট পায় লোকটা। তখন ওর গা থেকে দুঃখ-দুঃখ গন্ধ বেরোয়। সেই গন্ধ আমি শুষে নিই। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি কি শুধু দুঃখই বয়ে আনি? আচ্ছা এই যে যুগ যুগ ধরে কত চাকরির খবর, প্রেয়সীর ভালো থাকার কথা আমি পৌঁছে দিয়েছি মানুষের কাছে, সে তো সুখের পালক বয়ে আনারই সমান! দুঃখের বার্তাও পৌঁছে দিয়েছি, তাইতো একসঙ্গে আমি জলও ধরে রেখেছি, আবার এক চিলতে হাসিও ধরে রেখেছি।


আরো পড়ুন: কবিতা: ফুল্লকুসুমিত কথাগুলো । অনিন্দিতা গুপ্ত রায়


এখন আমি যার কাছে আছি, লোকটা খুব অদ্ভুত। আমায় হাতে নিয়ে লোকটা কাঁদে, তবুও আমায় যত্ন করে। তাই তো তিরিশ বছর ধরে লোকটা আমায় যত্নে রেখেছে। কখনো বালিশের ভাঁজে রাখে, কখনো টিনের তরঙ্গে লুকিয়ে রাখে। লোকটার মনে কখনো মেঘ জমলে আমায় বের করে। তারপর আমার গায়ে লেখা অক্ষরের হাত ধরে কাঁদে। তবে আমি বুঝতে পারি আসলে লোকটা হাসছে। সব যন্ত্রণা বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে। আমি শুষে নিচ্ছি। লোকটা আমার গায়ে লেখা অক্ষরগুলো পড়ছে। রোজ পড়ে। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি লোকটার দিকে। তবে আমাদের এই আলাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।

আমি লোকটার কাছে যখন এসেছিলাম তখন একটা ঝর্ণার মত মানুষ ছিল সে। লোকটা আমায় ভালবাসত, আমার গায়ে লেখা অক্ষরগুলোকেও অনুভব করেছে।তারপর জীবনের দীর্ঘ পথে আমায় তুলে রেখেছে সযত্নে, স্মৃতির মত করে। সেই সেদিন থেকেই আমি লোকটার সঙ্গী। তবে এখন লোকটাও আমায় অনুভব করে, আবার আমিও সাদা চুলের রূপকথার মত মানুষটাকে অনুভব করি।তবে যেই না দুজনে দুজনকে অনুভব করা শুরু করি, তখনই ওই ছোট্ট মেয়েটা আসে।

একটা পুতুল-পুতুল মেয়ে দৌড়ে আসে। মেয়েটার দুদিকে বিনুনী। মেয়েটা আমায় কেড়ে নিতে চায় রোজ। সাদা চুলের লোকটার হাত থেকে ঝপ করে ছিনিয়ে নেয়। লোকটা আলোর মত আগলে রাখার চেষ্টা করে আমায়। তবুও ছোট্ট মেয়েটার সঙ্গে পেরে ওঠে না। মেয়েটা আমায় দেখে হাসাহাসি করে। আমায় হাতে নিয়েই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সাদা চুলের লোকটার মুখে তখন কুয়াশা। এই বৃষ্টি নামল বলে! আসলে আমার গায়ে লেখা অক্ষরগুলোই যে লোকটার প্রাণভোমরা। মেয়েটা সব জানে। তবুও স্বীকার করতে চায় না আমার অস্তিত্বের গুরুত্ব। মিচকে হেসে বলে ” ঠাম্মির চিঠিটা তুমি এখনো পড়ো, রোজ! চিঠি আবার এখনো কেউ পড়ে নাকি দাদু! তোমায় আমি ইমেইল করা শেখাবো। আর এই চিঠিটা তুমি টাইপ করে কম্পিউটারে রাখবে। চিঠিটা ছিঁড়ে গেলে কি করবে বলো তো? তাই সব শিখে নেবে তুমি। চলো ক্লাস করতে চলো আমার কাছে।”

ছিঁড়ে যাওয়ার কথা শুনে সাদা চুলের লোকটার মুখটা কাঁদো-কাঁদো হয়।গুড়গুড়ি মেঘের মতো ভয় আমায়ও আঁকড়ে ধরে। এদিকে মেয়েটা লোকটার হাত ধরে একটা অন্য ঘরে নিয়ে যায়। আগেও কয়েকবার নিয়ে এসেছে। এই ঘরটা আমার চেনা। তবুও সাদা চুলের লোকটার হাতে আমিও এসে পৌঁছই ঘরটাতে। ঘরটাতে এলেই আমার অস্বস্তি শুরু হয়। ছোট্ট মেয়েটা লোকটার হাত ধরে বসিয়ে দেয় একটা বড় বাক্সের সামনে। একটা যন্ত্র। আলো, শব্দ সব পথ পার করে যন্ত্রটায় একটা সাদা রঙের পর্দা ফুটে ওঠে। ছোট্ট মেয়েটা এইসব যন্ত্র চালানো শেখায় লোকটাকে। লোকটা কাঁপা কাঁপা হাতে চেষ্টা করে। তবে অন্য হাতে মুঠি ভরে আগলে রাখে আমায়। আমি বুঝতে পারি সাদা-চুলের লোকটার শীত করছে। হাত ঘামছে। যত হাত ঘামে, লোকটা আগলে রাখে আমায়। এই ঘরটাতে এলেই আমার অস্বস্তি বেড়ে যায়। মনে হয় কেউ আমায় দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দেবে। আচ্ছা লোকটা যদি আমায় ছুড়ে ফেলে দেয়? কোথায় যাব আমি? সেই যে সাদা ব্যাগের ভেতর অজস্র কাগজের মধ্যে থেকে আমি বেরিয়ে এসে লোকটার কোলে আশ্রয় পেয়েছি, তারপর থেকে তো এখানেই রয়েছি। আমি আশ্রয় হারবার ভয়ে কুঁকড়ে যাই। আমার কান্না পায়।

ওই ছোট্ট মেয়েটা একনাগাড়ে সাদা চুলের লোকটাকে পাখিপড়ার মতো করে যন্ত্র চালানো শেখায়। আমি ভয়ে লোকটাকে আঁকড়ে ধরি। এ সময় দেখি লোকটার চোখে, মুখে, গালে কুয়াশা। আমার গায়েও সোঁদা গন্ধ লাগে। লোকটা ওই বড় ঘরটাতে খানিকক্ষণ থেকেই হাঁপিয়ে ওঠে। উলুম-ঝুলুম কথা বলে বেরিয়ে আসে ঘরটা থেকে। আমার মনে হয় এক সমুদ্র নোনা জল পেরোলাম যেন। আমরা দুজনেই নিশ্চিন্ত হই। আমাদের এই তীব্র, তির্যক বিদ্যুৎমুহূর্ত রোজ আমাদের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে। আমি আর সাদা চুলের লোকটা দুজনেই দুজনকে আঁকড়ে ধরে অন্ধকার পার করি।

নিজের ঘরে ফিরে এসে লোকটার মুখে আবার আলো ফোটে। লোকটা তার সাদা রঙের পকেট থেকে আমায় বের করে। বিড়বিড় করে বলে “জীবনের সব গন্ধকে কি পাল্টে ফেলতেই হবে,এইচিঠিটার গন্ধ আমি কিছুতেই পাল্টাতে দেব না।?” লোকটা তখন আমায় একেবারে তার নাকের কাছে নিয়ে আসে। আমার গন্ধ নেয়। কাঁদে, হাসে। আমি আশ্বস্ত হই। আবার কথা বলেলোকটা।

“শোভা, সেই প্রথম দেখার পর তুমি এই চিঠিটা লিখেছিলে। কত রূপে তারপর দেখেছি তোমায়। প্রেমিকা, মা, স্ত্রী, বৌমা। তবুও চিঠিতে লেখা এই অক্ষরগুলোর মধ্যে যে এক রূপকথার রাজকন্যার খোঁজ পেয়েছিলাম, তাকে আর কখনো পায়নি। তুমি চলে গেছ, কত বছর হয়ে গেছে। আমি তবুও তোমায় আগলে রেখেছি। এই চিঠি দিয়ে। ওরা আমায় সব শিখিয়ে কেড়ে নিতে চায়‌এই আগলে রাখাটা।” শেষের কথাগুলো বলার সময় লোকটার গলা ঘড়ঘড়ে হয়ে আসে। প্রায় রোজই লোকটা এসব কথা বলে। কখনো শব্দগুলো এদিক-ওদিক হয়ে যায়। কথাগুলো বলার সময় লোকটার ভেতরে টলটল করে জল। এর মাঝে লোকটা ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ঘুম আসে না। আমার তখন উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। স্বপ্নপরীর ডানায় ভেসে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। আমার মনে হয় ওই বড় যন্ত্রটা আমায় দেখে হাসছে। সত্যিই তো! এরকম কত যন্ত্র এসে আমাদের পালকের মত উড়িয়ে দিয়েছে। তবুও ধুলো মেখে কোথাও-কোথাও পড়ে থাকি আমরা। কোন সুদূর মেঘের ওপার থেকে বার্তা আসে। জমা থাকে গুমঘরে।  গুমঘরটা তোমরা চেনো। বড় বড় থামওলা বাড়ি। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে সাদা ব্যাগের ভেতর জমা থাকে কথকতা। তোমরা এই সব কিছুকেই চিঠি বল। কিন্তু যে কাগজে ভালোবাসা, যন্ত্রণা, অভিমান, আগলে রাখা, স্নেহ এসব অনুভূতিরা রশ্মির মত ঘুরে বেড়ায় না, সেইসব কাগজ আবার চিঠি নাকি? কিন্তু এখন তো কেউ চিঠিতে কথা বলে না। কথাটা যন্ত্রের ভেতর ছটফট করতে থাকে। ব্যথারা জমে থাকে। আর এভাবেই চিঠিরা অসময়ের মেঘের মতো হারিয়ে যায়। তাই তো আমি কাঁদি। হারানোর দুঃখে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আমার তো তবু ওই সাদা চুলের রূপকথার মানুষটা আছে, তাই আমি বেঁচে আছি। কিন্তু আমার কত বন্ধুরা অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা হয়ে হারিয়ে গেছে। সেসব অনুভূতিরা জায়গা পায়নি কোথাও।

আমার এসব আবোল-তাবোল ভাবনার মাঝে সাদা চুলের লোকটা ঘুম থেকে উঠে পড়ে। কুড়িয়ে নেয় মেঝে থেকে আমায়। আদর করে আবার বালিশের ভাঁজে রেখে দেয়। কোনদিন আবার স্নেহ বুলিয়ে তোরঙ্গেও লুকিয়ে রাখে। আমার মন ভালো হয়ে যায়। আমার মনে হয় এত হারানোর মাঝেও তো আমি বেঁচে আছি। পরীদের গল্পকথার মতই মনে হয় সবটা। আমার হঠাৎ করে মনে হয় আমার গায়ে ডানা লেগেছে। কোন অনন্ত পথের পরিব্রাজকের মতো আমি যেন হেঁটে চলেছি। উড়ে চলেছি। আমার মনে হয় সব যন্ত্র, কৃত্রিমতা, আধুনিকতার মাঝেও হলুদ আলোর মত হেঁটে চলি আমরা, চিঠিরা। হয়তো কোন সন্ধ্যা প্রদীপের আলোর পাশে,তোরঙ্গের ভেতরে, ন্যাপথালিন দেওয়া জামার ভাঁজে আটকে থাকি আমরা, স্মৃতির মত। অমলিন, সোনার জল ঝরানো স্মৃতি।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত