| 29 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: মেসিন মেসিন । অমর মিত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট
 
লোকটা এসেছে পালিয়ে। লোকটা একটা ঘর চায়। ছোট এই গঞ্জের নাম কলকাতা। কিন্তু এইটা সেই কলকাতা নয়, যে কলকাতা আমাদের রাজ্যের রাজধানী। ব্রিটিশ ভারতে ১৯১১ অবধি দেশের রাজধানী ছিল। পরে যে শহর হয়েছে বাংলার রাজধানী। যে শহরে এক কবি জন্মেছিলেন , পরে যিনি নোবেল প্রাইজ পান। এই গঞ্জ সেই কলকাতা থেকে অনেক দূর। এই গঞ্জের পশ্চিমে পাহাড় আছে, সেই কলকাতার পশ্চিমে নদী। আসলে এই কলকাতা সেই কলকাতা থেকে আলাদা। শুধু নামই এক। কিন্তু নাম এক নয়। আরো কিছু মিল আছে। যেমন এই কলকাতায় একটা শ্যামবাজার আছে। এই কলকাতায় একটা রাধাবাজার আছে। বড় বাজার আছে। ধর্মতলা আছে। কিন্তু এই কলকাতা সেই কলকাতা নয়। এই কলকাতা খুঁজে বের করতে হয়েছে লোকটাকে। ট্রেন, বাস, নৌকো, অটো এতসব যানবাহন লেগেছে এখানে পৌঁছতে। এই জায়গা কিন্তু কলকাতার ভিতরে কলকাতা নয়। কলকাতার বাইরে এই কলকাতা। আসলে শোনা যায়, এই কলকাতা, কুসুমপুর, উসুমপুর, মাসুমপুর…এখানকার মানুষ ঐ কলকাতা দখল করতে গিয়ে না পেরে তার ডুপ্লিকেট এক কলকাতা গঞ্জের পত্তন করেছিল এখানে। গঞ্জ আড়ে বহরে বাড়েনি তেমন। কিন্তু রয়ে গেছে অক্ষম নির্মাণ হয়ে। সেখানে মাঝে মধ্যেই ভবঘুরে এসে পড়ে, পলাতক আসামী এসে পড়ে। আত্মগোপন করে থাকার এত ভালো জায়গা আর নেই।
 
 
লোকটা লম্বা। রোগা। মাথায় একটা হ্যাট। গায়ে শার্টের উপর ময়লা জিন্সের জ্যাকেট, ময়লা রংজ্বলা টেরিকটনের প্যান্ট। বুট জুতো। পিঠে একটা বড় রুকস্যাক বলি, ব্যাগ বলি তা রয়েছে। রাধাবাজারের ঘড়ির দোকানে এসে বলল, এখানে কোনো ঘর মিলবে স্যার ?
 
 
ঘড়ি দোকানি সারাদিন একা বসেই থাকে। আগে, এই কলকাতার পত্তনের কালে ঘড়ির কত কদর ছিল। এই গঞ্জেরই বা কত কদর ছিল। এক লেখক, এক অভিনেত্রী, এক রাজনীতিবিদ এখানে বাড়ি করেছিলেন। কিন্তু তা রেখে দিয়ে চলে গেছেন। সেই সব বাড়িতে এখন ভূতের বাস। ঘড়ি দোকানির কাছে ভার আছে তিন বাড়ির। ভবঘুরেদের ভাড়া দেয় সে। পলাতকদের ভাড়া দেয় । ঘড়ির দোকানে বসে চুক্তি করে। ঘড়ি দোকানি অনন্তর মনে হয় এই কলকাতা যা ঐ কলকাতা দখল না করতে পেরে তার পূর্ব পুরুষ পত্তন করেছিল, তা আবার তার পূর্ব নামে ফেরত যাক। কুসুমপুর, উসুমপুর, মাসুমপুর। এই কলকাতা সেই কলকাতার মতো হতে পারল না। এ যেন এক পতিত গঞ্জ হয়ে গেছে। ঘড়ি দোকানির পূর্ব পুরুষ সেই কলকাতা থেকে ঘড়ির কাজ শিখে এসে এই দোকান বসিয়েছিল। এখন ঘড়ির দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। ব্যবসা তার বাবার আগে ঠাকুরদার ছিল। তার আগে তার বড় ঠাকুরদার ছিল। প্রপিতামহের। এই ব্যবসা করে দোতলা বাড়ি। বাড়ির নিচে অনন্তর ঘড়ির দোকান। তার দোকানে অনেক অচল ঘড়ি। সারাতে দিয়ে ফেরত নিতে আসেনি কেউ। দোকানিও সারিয়ে দম না দিয়ে ফেলে রেখেছে। ঘড়ির দম দরকার হয়। হয় ব্যাটারিতে নতুবা হাতে চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। এতগুলো দম বন্ধ ঘড়ি নিয়ে মধ্যবয়স্ক বিরলকেশ লোকটি, অনন্ত বসে থাকে সকাল আটটা থেকে বেলা বারোটা। আবার বিকেল চারটে থেকে রাত ন’টা। ঘড়ি ব্যবসায়ী বা বেদম ঘড়ির কারবারীর চোখে একটি চশমা। গোল ফ্রেম। ফ্রেমটি তার বাবার ছিল। পাওয়ার বদল করে তার। কেউ কেউ বলে লোকটাকে তার বাবার মতো দেখতে। চশমায় অবিকল সেই ঘড়িওয়ালা জীবন্ত। কেউ কেউ বলে তার বাবাকে আবার তার ঠাকুরদার মতো দেখতে ছিল। ঠাকুরদা বেঁচে থাকলে ১২৫ হত। ঠাকুরদার বাবা ১৫০। ১৫০ বছর আয়ু নিয়ে ঘড়ি দোকানি অনন্ত রাধাবাজারে ঘড়ি সাজিয়ে বসে থাকে। ঘড়ির দোকানে আয় নেই। কিন্তু তার অন্য আয় আছে। কুঠী বাড়ির আয়। কুঠী বাড়ি ভাড়া দেয় চড়া দামে। লোকজন আসে। দেখতে আসে যে কলকাতা এখন একটা গঞ্জ হয়ে গেছে, সেই কলকাতা কেমন। পরিত্যক্ত তিন বাড়ি থেকেও আয় হয় কম না। পলাতক আসামীদের কাছ থেকে ইচ্ছে মতো আদায় করা যায়। ঘুরুয়া মানুষদের কাছ থেকে ভালো আদায় হয়। এই লোকটা কে, পলাতক আসামী না ঘুরুয়া মানুষ। ইতিহাসকার, লেখক ?
 
 
যে লোকটা এই কলকাতায় নতুন, সেই লোকটা ঘড়ির দোকানের খোঁজ পেয়েছিল ভাতের হোটেল থেকে। ভাতের হোটেল হাতিবাগানে। হ্যাঁ, পশ্চিমে পাহাড়, তার আগে জঙ্গল, জঙ্গলে হাতিরা নেমে আসে পাহাড় থেকে। মাঝে মধ্যে কলকাতার বাইরের ফসলের ক্ষেতে হামলা চালিয়ে আবার ফিরে যায়। তবু এইটা কলকাতা। কে এই কলকাতা বানিয়েছিল, সেই কলকাতা থেকে ফিরে এসে অবিকল সেই রকম গড়ে তুলেছিল তা নিয়ে একটা বয়ান দিয়েছি। আরো বয়ান আছে। এই হোটেলওয়ালা বলে, তার ঠাকুরদার ঠাকুরদা হবেন তিনি। সেই প্রপ্রপিতামহ কলকাতায় একটা হোটেল করেছিলেন। কিন্তু সকলে খেয়ে যেত দাম দিত না। লোকসান করে ফিরে এসে এই হোটেল হাতিবাগানে। হাতিবাগান এই কলকাতায় আগেই ছিল, এখান থেকে যারা সেই কলকাতায় গিয়েছে, তারা এখানকার নাম সেখানে দান করে এসেছে, হোটেলওয়ালার সেই মত। যে কেউ যে কোনো মত তো দিতেই পারে। যত মত তত পথ। কেউ যদি বলে পাহাড় ছিল চলমান, মানতে পারো, না পারো। হোটেলে পঞ্চ ব্যঞ্জনে ভাত খেয়েছিল লোকটা। বেতো শাক ভাজা, ফুলবড়ি ভাজা, পোস্তোর বড়া, ডাল, বেগুন ভাজা, পালঙের ঘন্ট, কাতলা মাছের কালিয়া, টম্যাটোর চাটনি, দই। তারপর বলেছিল, অনন্তর ঘড়ির দোকানে যান, পাবেন ঘর, তারপর বলেছিল, সাবধানে থাকবেন।
 
 
কেন, কী হয়েছে ? লোকটা জিজ্ঞেস করেছিল।
 
 
আমি জানি না, কিন্তু মনে হলো আপনাকে সাবধান করা উচিত, কাঁপুনি হলে মাটিতে বসে পড়বেন, হোটেলিয়া বলল। সে একটা বৃহৎ ভুড়ির গোল মানুষ। সে অনেক রকম রান্না জানে। আমিষ নিরামিষই দুইই। হোটেল চালিয়ে সে মাটির বাড়ি পাকা করেছে। পোস্তোর অনেক রকম পদ জানে। ডিম পোস্তো, কুমড়ো পোস্তো, মাছ পোস্তো, লাউ পোস্তো… কতরকম। এই সব রান্না এসেছে সাবেক কুসুমপুর থেকে। কুসুমপুরের মানুষ এমনি তরিবৎ করে খেত।
 
 
কলকাতার লোকটা ঘড়ির দোকানে এল। তার কব্জিতে একটা অ্যাংলো সুইস কোম্পানির ফেবারলিউবা ঘড়ি। ঘড়ির কাঁটা বন্ধ। অনেকদিন ব্যবহার হয় না। কলকাতা ছাড়ার আগে বাবার ঘড়িটা নিয়ে এল কেন তা সে জানে না। ভেবেছিল ঘড়িটা সারিয়ে নেবে। কিন্তু হবে কী? তার একটি মোবাইল ফোন আছে। সেখানে সময় দেখা যায়। তবে এখন সেটিতে চার্জ নেই, তাই বন্ধ হয়ে আছে। সময়ের ব্যাপারে সে উদাসীন। তার নির্দিষ্ট কোনো সময়ে নির্দিষ্ট কোথাও যাওয়ার নেই। কলকাতা থেকে কলকাতায় এসে গেছে, আবার কী ? লাট সায়েবের কলকাতায় থাকতে ভয় করছিল। তাই রওনা হয়েছিল অন্ধকার থাকতে, কাকপক্ষীর ঘুম না ভাঙতে। পৌঁছে গেছে। হোটেলওয়ালা মানে ভজহরি মান্নার হোটেলের মালিক লোকটা বলেছিল, এখন অনন্তর ঘড়ির দোকানে যেতে পারেন, কিন্তু কেন যাবেন ? এই সময়ে দোকানের শাটার নামানো থাকে। দুপুরে সে ঘুম দেয়, রাত্তিরে নাকি জাগে। তখন লোকটা অন্য পথে গেল।
 
 
হোটেলওয়ালার পথ নির্দেশে সে অনন্তর ঘড়ির দোকানে এসে গেছে। একটু ঘুরে এসেছে। আসার পথে ধর্মতলায় একটি বটগাছের নিচে বিশ্রাম নিয়েছিল। সেখানে কিছু সময় ঘুম এসেছিল। বটমূলে ধর্ম ঠাকুরের থান ছিল। বড় এক পাথরের ঠাকুর। তার গায়ে সিঁদুর লেপা। সেখানে বসে ভাবছিল এই থান তার কলকাতার ধর্মতলায় ছিল। এখন নেই। রাস্তার নামও নেই। তার কলকাতা উত্তর দক্ষিণ এবং পুবে বেড়েই যাচ্ছে। পশ্চিমে নদী। নদী পার হয়েই সে এই গঞ্জে এসেছে। লোকটা ঘুমিয়ে ঝিমিয়ে নিয়ে বেলা পড়তে রওনা হয়ে ঘড়িবাড়ি খুঁজতে লাগল। যেতে যেতে একটা মজা দিঘি দেখতে পায়। দিঘির পারে একটা বকুল গাছ। বকুল ফুলের গন্ধ এত বেলায় পাওয়া যায় না, কিন্তু সে গন্ধটা পায়। তার সঙ্গে মিশে আছে পেট্রল মোবিল, লোহার উপর মরচে, আর বাতিল লোহার গন্ধ। লোকটা দেখল বকুলতলার পিছনে ভাঙা গাড়ি, চেয়ার টেবিল, সোফাসেট, যন্ত্রপাতি, অচল মেসিন ডাঁই করা। সেখানে কুকুর ঘুরছে মেসিন শুঁকে শুঁকে। কুকুরগুলি ক্যাংলা, দুবলা, একবেলাও খাওয়া জোটে কি না সন্দেহ। সে ঝিনঝিনে ভাব টের পেল তার পায়ে। দ্রুত পায়ে পার হয়ে গেল বকুলতলা। তারপর খুঁজে পেল ঘড়িবাড়ি। ঘড়িবাড়িতেই ঘড়ির দোকান। সেখানেই ঘর পাওয়া যেতে পারে। সে ঘড়ি দোকানে এসে জিজ্ঞেস করল, ঘর হবে ?
 
 
ঘড়ি দোকানি তাকে দেখে বলল, এগার মাস হয়নি কারো যে ঘর দেব। তবে পরিত্যক্ত কুঠী আছে, লেখকের সিনেমা অভিনেত্রীর, রাজনীতিকের, সেখানে থাকতে পারেন।
 
 
নিভৃত বাসের জন্য তার দরকার, অসুবিধে নেই। লোকটা বলল।
 
 
ঘড়ি দোকানি অনন্ত জিজ্ঞেস করল সে কোথা থেকে আসছে। জবাব পেয়ে ঘড়ি দোকানি জিজ্ঞেস করল শ্যামবাজারের ঘড়ি দোকানগুলো আছে ?
 
 
আছে কি নেই বলতে পারব না, এখেনে আছে ?
 
 
অনন্ত বলল, এই তো দেখছ।
 
 
লোকটি জিজ্ঞেস করল, এই জায়গা শ্যামবাজার না রাধাবাজার ?
 
 
এইটা মানিকতলা জানি। ঘড়ি দোকানি বলল।
 
 
তোমার বাড়ির মাথায় ঘড়ি আছে ?
 
 
ছিল, বাজ পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ঘড়িওয়ালা বলল, মানিকতলা বাজারের মাথায় যে ঘড়িটা ছিল, সেইটা আছে ? অনন্ত জিজ্ঞেস করল।
 
 
খেয়াল নেই, অনেক দিন ওদিকে যাওয়া হয়নি। বলতে বলতে লোকটি দেখছিল কতরকম দেওয়াল ঘড়ি , কোনোটার পেন্ডুলাম, কোনোটার ব্যাটারি…সব চুপ করে আছে। দম বন্ধ করে রেখে দিয়েছে দোকানি। সে বলল, আমার ঘর চাই যে, ঘরের জন্য সেই কলকাতা ছেড়ে এই কলকাতায় এলাম। ঘড়ি দোকানি তার টাকে হাত বুলিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল, লেখকের কুঠীতে নিয়ে যাচ্ছি, উনি বহু বছর আসেননি, বলেছেন আর আসবেন না, ওখানে একটা লোক থাকত, সেই বেঁটে লোকটা মুম্বই গেছে, ফিরতে সাতদিন, তুমি এখন কুঠীতে থাকতে পারো, তবে ঐ কুঠীর কোনো জিনিশে হাত দেবে না।
 
 
সে কোন মুম্বই গেছে ? লোকটা জিজ্ঞেস করল।
 
 
তা তো জানি না, মুম্বই কি অনেক আছে ? ঘড়ি দোকানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
 
 
থাকতে পারে এই কলকাতার মতো, আচ্ছা সেখানে আন্ধেরি আছে ?
 
 
আছে শুনেছি।
 
 
সেখানে নরিম্যান পয়েন্ট ?
 
 
সে তো জানি না। ঘড়িওয়ালা বলল।
 
 
ধারাবি বস্তি ? লোকটা জিজ্ঞেস করল।
 
 
না থাকার কথা নয়, কিন্তু আমি তো মুম্বই যাইনি, জানি না মুম্বই কেমন, কোথায় কী। ঘড়ি দোকানি বলল।
 
 
যেমনি এখেনে আছে ? লোকটা জিজ্ঞেস করল, হাতিবাগান, চোরবাগান, রাধাবাজার, শ্যামবাজার, মানিকতলা।
 
 
তাইই মনে হয়, আলাদা কোনো মুম্বই আছে নাকি ?
 
 
মুম্বই থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য আছে আর এক মুম্বই, সে কোথায় গেল আপনাকে জানতে হবে, এখন আমাকে ঘর দেখিয়ে দিন।
 
 
দুই
 
কুঠী বাংলো এক মাইলও নয়। একটু ঘুরে পাহাড়ের দিকে। খুব যত্ন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংলো, উদ্যান, কুয়ো। ফুলের বাগান ছিল, এখন নেই। সেই বাংলোর একটি ঘরে লোকটার জায়গা হলো। সেই ঘর কেমন সাজানো। আলমারিতে কত বই। কিন্তু তালা মারা। দেওয়ালে বন্ধ গ্রান্ড ফাদার ক্লক। নিঝুম ঝুলে আছে। বইয়ের আলমারির গায়ে উইয়ের চলার পথ এঁকে বেঁকে গেছে। দক্ষিণে বড় জানালা আছে। পশ্চিমে দেওয়াল। পুবে ছোট জানালা, উত্তরে দেওয়াল। একটি খাট। সেখানে গদি, তোষক, বালিশ, চাদর। ঘরে একটি মিটসেফ আছে, তার ভিতরে মুড়ি বিস্কুট আপেল সাজানো। মাথায় একটি সিলিং ফ্যান। বনবন করে ঘুরত একদিন, এখন ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ঘোরে কিন্তু বাতাস দেয় না। যে ছিল, সেই মুম্বই যাওয়া লোকটি যেন কলকাতার লোকের জন্য সব রেখে গেছে। ঘরে একটি ছোট টিভি আছে। টিভি এই লোকটি দ্যাখে না। টিভি দেখলে ভয় করে। একটি রেকর্ড প্লেয়ার আছে। এ জিনিশ সেই কলকাতায় ছিল, এখন নেই। তারও একটা ছিল মনে পড়ে গেল। এখন কোথায় গেছে মনে নেই। সে দেখল রেকর্ড রয়েছে। ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে… শচীনদেব, হেমন্ত, মান্না দে, লতা মঙ্গেস্কর, সুবীর সেন, ইলা বসু, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকটা ঠিক করে নিল নিভৃতবাসে গান শুনবে। দক্ষিণের জানালা দিয়ে পাহাড় দেখা যায় পশ্চিম কোণে। সে ভাবল পাহাড় দেখে আর গান শুনে কাটবে নিভৃত অবসর। ঘড়ি দোকানি বলল, এসবই রেখে চলে গেছেন লেখক গৌতমবুদ্ধ রায়। লেখকরা কি অমনি হন, ফেলে রেখে চলে যান ?
 
 
লোকটা জিজ্ঞেস করল, বইয়ের আলমারি খোলা যাবে না ?
 
 
না চাবি হারিয়ে গেছে, ভালোই তো আছে, নইলে বই চুরি হয়ে যেত। ঘড়ি দোকানি বলল।
 
 
সে ইজিচেয়ারে চিত হলো। হয়ে ভাবতে লাগল এরপর কী হতে পারে। যে লোকটা এই ঘরের ভাড়াটে, সে মুম্বই গিয়ে তাকে বাঁচিয়ে দিল। সে মুম্বই থেকে সাত দিন বাদে ফিরবে কি ? ফিরবে কি ফিরবে না তা সাত দিন না গেলে বোঝা যাবে না। সতের দিনের জন্য গেছে। তার দশ দিন গেছে। ফিরে আসতে পারে। সে যদি মুম্বই গিয়ে থাকে, তবে কোন মুম্বই তা না জানা গেলে কিছুই হবে না। কিন্তু বইগুলো সব উইয়ে খেয়ে নেবে। উফ। সারারাত ধরে উইয়ে বই খাবে।
 
 
ঘড়ি দোকানি রাত ন’টার সময় বাংলোয় এল। বসল চেয়ারে। বলল, আপনি এলেন কেন এখানে ?
 
 
পালিয়ে এসেছি, পালাতে পালাতে দেখি কলকাতায়, কিন্তু অন্য কলকাতা।
 
 
ঘড়ির দোকানি বলল, এই কুঠীর লোকটা একদিন সকালে বলল সতের দিনের জন্য মুম্বই যাবে, আচ্ছা সতের দিন কেন ?
 
 
কলকাতার লোক বলল, সে সতের দিনের জন্য আসেনি, সে কতদিনের জন্য এসেছে জানে না।
 
 
তা হোক, কিন্তু আপনাকে ঠিক করে নিতে হবে। ঘড়ি দোকানি বলল।
 
 
নেব, ভাবা যাবে পরে।
 
 
ঘড়ি দোকানি বলল, কলকাতায় কী হয়েছে ?
 
 
ঘুমজ্বর আসছে খুব।
 
 
ঘুমজ্বর কী ?
 
 
ঘুমের ভিতর জ্বর। কলকাতার লোক বলল।
 
 
জেগে উঠলে ? ঘড়ি দোকানির আগ্রহের শেষ নেই।
 
 
জ্বর নেই, কিন্তু ঘুমের ভিতর জ্বরে মরে যাচ্ছে লোক।
 
 
হার্ট অ্যাটাক ?
 
 
না জ্বর। লোকটি বলল।
 
 
মহামারী হয়ে গেছে ?
 
 
বলতে পার, তাই নিয়ে খুব ভয় ধরে গেছে সকলের, আমাকে আমার বাড়িওয়ালা বলল, পালিয়ে যাও।
 
 
বাড়িওয়ালা পালিয়েছে ? ঘড়ি দোকানি জিজ্ঞেস করল।
 
 
লোকটা বলল, না, তার ঘুমজ্বর আসেনি তো।
 
 
তোমার এসেছিল ? জিজ্ঞেস করল ঘড়িওয়ালা অনন্ত।
 
 
এসেছিল মনে হয়, বাড়িওয়ালা জ্বর মেপেছিল, ১০৪ ডিগ্রি, ঘুমের ভিতরে একদিন যেন স্পষ্ট দেখলাম, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা, তখন ভয়ে আমার ঘুম চলে গেল, অনেক দিন ঘুমতে পারিনি রাতে, ঘুমজ্বর রাতেই আসে, তাই লোকে দিনে ঘুমতে লাগল, আমিও তাই, কিন্তু দিনের ঘুম কি ঘুম, সকলে জাগিয়া রহে , আমি রই ঘুমায়ে।
 
 
রাতে না ঘুমিয়ে কী করতে ? ঘড়ি দোকানির যেন সবই জানা দরকার।
 
 
বই পড়তাম, ঘুম তাড়াতাম, ঘুম তাড়ানোর জন্য কত কী করতাম, কিন্তু ঘুম এসে যেত, আর তারপর জ্বর।
 
 
ঘড়ির দোকানি অনন্ত বলল, থাকো, আজ দ্যাখো ঘুমজ্বর আসে কি না।
 
 
লোকটা বইয়ের আলমারির কাচ ভেঙে বই বের করবে ভাবল। নাহলে সব বই উইয়ে কাটবে। কিন্তু সেটা আজই করা যাবে না। কাচ ভাঙার একটা হাতুড়ি চাই। বই সব উইয়ে খাচ্ছে। তার কষ্ট হতে লাগল। সে দেখল মহাভারতে উই প্রবেশ করেছে। তাকে এই দেখতে হবে। বইয়ের মৃত্যু। সে গ্রামোফোনের রেকর্ড দেখতে লাগল। কত সব হারানো দিনের গান। কত সব হারানো দিনের সুর। সেই সব সুর মনে জেগে উঠতে লাগল। সে গুনগুণ করতে লাগল মনে মনে। যেন গানই শুনছে, শুনতে শুনতে ইজিচেয়ারে বসে দূরের আকাশে তারাদের দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তে লাগল। ঘুমিয়েই পড়ল। এ ব্যতীত উপায় ছিল না। কেন না গ্রামোফোনটি খারাপ ছিল। তার পিন ছিল ভোতা। দম রাখতে পারছিল না। কিন্তু রেকর্ড দেখে দেখে গান তো মনে মনে গাওয়া যায়। সেই রকম গাইতে গাইতে, মনে মনে শুনতে শুনতে সে নিদ্রামগন হয়েছিল। ঘুমের ভিতর জ্বর এল কি না বোঝা যাবে সে জাগলে। মাঝরাতে ঘড়িওয়ালা বাংলোয় এল। সে তো নিশাচর। দেখল লোকটার মুখের উপর নরম হাসির মতো তারার আলো পড়েছে। ঘড়িওয়ালা চলে গেল। তার বাড়িতে দুটি ঘড়ি সচল আছে। সে ভাবল একটির ব্যাটারি খুলে দেয়। এইটা তার একটা পরীক্ষা। ব্যাটারি খুলে বন্ধ ঘড়িকে সে এক একজনের নামে উৎসর্গ করে দেয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। ঘড়ি অচল হয়ে গেলেও লোকটা, যার নামে উৎসর্গ করেছে সে নানা সময়ে , সে বা তারা বেঁচে থেকেছে। এই যে ঘড়িওয়ালা, তার দোকানে যে অত অচল ঘড়ি, সে মনে করে সব এক একটি মানুষের বন্ধ হৃদপিণ্ড। ঘড়ির ব্যাটারি বন্ধ হয়েছিল কেউ না কেউ মরে যেতে। যে লোকটি মুম্বই গেল, তার জন্য কতবার ব্যাটারি খুলে নিয়েছে সে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। আসলে লোকটা এমনিই ভাবে। তার ভিতরে হননের ইচ্ছা প্রবল। নিঃশব্দে মানুষ মারবে। হত্যাকারী হত্যার চিহ্ন রেখে যায়। সূত্র রেখে যায়। যুদ্ধবাজরা বোমা বর্ষণ করে মানুষ মারে। কত মারণাস্ত্র বেরিয়েছে নরহত্যার জন্য। পারমাণবিক বোমা দুটি শহরকেই শেষ করে দিয়েছিল। এই ঘড়িওয়ালা চায় নিঃশব্দে মানুষ মারতে। মহামারী হোক। যেমন ঘুমজ্বরে মরে মানুষ, অজ্ঞাত এক ভাইরাসে মরে মানুষ, মরা ইঁদুর বা পাখি, হাঁস কিংবা মুর্গির পচা দেহে জন্ম নেওয়া জীবানুতে মরে মানুষ। ঘড়ি বন্ধ হয়ে ঘুমঘোরে মরবে মানুষ। তা টের পেয়েই মুম্বই চলে গেছে কুঠীবাড়ির আগের লোকটা।
 
 
দোকানি পরদিন ভোরে আশায় আশায় কুঠীবাড়ি চলল। হাতে বন্ধ ঘড়ি। সে কুঠীবাড়ির সামনে এসে শুনতে পেল লোকটা গান গাইছে, মধুমতী যায় বয়ে যায়…। রেকর্ডটা ঘরে আছে। বাজে না। অদ্ভুত লোক রেকর্ড দেখে দেখে গান গাইছে। এর মানে লোকটার বুকের ঘড়ি চালু আছে। সে বারান্দায় উঠে গেল, গুড মর্নিং।
 
 
সুপ্রভাত। গান থামিয়ে লোকটা বলল।
 
 
ঘড়ির দোকানি বলল, অসুবিধে হয়নি তো।
 
 
না, কখন ঘুমিয়েছি তা বুঝিইনি। হেসে বলল লোকটা।
 
 
দোকানি জিজ্ঞেস করল, ঘুমজ্বর ?
 
 
হয়নি মনে হয়। বলল লোকটা।
 
 
এবার ঘড়ি দোকানি অনন্ত বলল, এখানে একটা অসুখ আসে প্রায়ই, ঘুরে ঘুরে আসে, ক’দিন থাকে, তারপর মিলিয়ে যায়, সেই ভয়ে তো পালিয়ে গেল আগের লোকটা মুম্বই।
 
 
কী অসুখ ? লোকটা ভাবল তার বাড়িওয়ালার মতোই কথা বলছে এই লোক। তাকে পালিয়ে যেতে বলছে, তাহলে ঘর ফাঁকা হয়ে যাবে। কিন্তু সে তো একদিন এসেছে, এর ভিতরে বলবে কেন ? ভয় দেখানোর একটা সময় আছে তো।
 
 
লোকটা বলল, ঝিনঝিনে, হাত পা ঝিনঝিন করত, কাঁপুনি বলতে পারো, থিরথির করছে, সিলিং ফ্যানটা যেমন তেমনি, ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর, তখন মুখের কথা গোঙানির মতো হয়ে যেত, প্রচুর জল ঢেলে সামলাতে হত।
 
 
এই রোগ কবে এল ? লোকটা জিজ্ঞেস করল।
 
 
কবে এল কতদিন থাকল, তা মনে নেই, তবে এসেছিল তা জানি।
 
 
তাতে মানুষ মরত ? লোকটা জিজ্ঞেস করল।
 
 
মরত, না মরলে আর রোগ কিসের, লোকে ভয়ই বা পাবে কেন ? অনন্ত ঘড়িওয়ালা বলল।
 
 
রোগটা এল কেন ? লোকটা জিজ্ঞেস করল।
 
 
জানি না, কিন্তু বুড়োরা কেউ কেউ বলেছিল, আমারও মনে হয়েছিল, রোগটা বন্ধ হয়ে যাওয়া মেসিন থেকে এসেছিল।
 
 
চমকে উঠল লোকটা। মনে পড়ে গেল বকুলতলার কথা। মনে পড়ে গেল, গ্রামোফোনটি কাল কত রাত অবধি বাজানোর চেষ্টা করে বিফল হয়েছে সে। তখন কি হাত-পা কাঁপতে আরম্ভ করল ? তালাটি টেনে ভেঙে বই বের করতে চেষ্টা করেছে। তার হাত পা কাঁপছিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ঝিনঝিন করছিল সারা দেহ। তখন সে ইজি চেয়ারে শুয়ে কিছুতে কিছু না করতে পেরে রেকর্ড হাতে গান গাইতে আরম্ভ করেছিল। চম্পাকলি গো, কত নামে ডেকেছি তোমায়। হারিয়ে যাওয়া ফুরিয়ে যাওয়া গান। তারপর তার ঘুম এসেছিল।
 
 
এখেনে যে বকুলতলা আছে, সেখানে থানা থেকে সিজ করা গাড়ি রেখে দেওয়া হতো, তারপর ধরুন লোকের বাড়িতে অচল রেডিও, গ্রামোফোন, টেবিল ক্লক, ক্যামেরা, জল তোলার মেসিন, কাপড় কাচার মেসিন… অচল হয়ে পড়ে থাকত, সব সেখেনে ফেলে দিয়ে আসে লোকে, তা থেকেই ঝিনঝিনে রোগের জন্ম, মেসিন খারাপ হলে যেমন কাঁপতে কাঁপতে কাঁপতে…, ঘড়ি দোকানি বোঝাতে লাগল।
 
 
আপনার দোকানে যে অচল ঘড়ি অত ? লোকটা গম্ভীর মেঘের গলায় জিজ্ঞেস করে।
 
 
সে তো মানুষের মরার পর অচল। ঘড়িওয়ালা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল।
 
 
লোকটা বলল, মেসিন রোগ আর হয় না ?
 
 
হয় না বললে হবে না, তবে মহামারী তো এক নাগাড়ে চলতে থাকে না, বিশ্রাম নেয় ক’দিন। গ্রাফ নেমে আসে। আবার হবে একদিন, বকুলতলা ভরে গেছে অচল গাড়িতে, সেই সব গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে দুমড়ে গিয়েছিল, তোমার ঘুম জ্বর চলে যাবে, কিন্তু মেসিনের ঝিনঝিনে থামবে না, কলসি কলসি জলেও থামবে না, কাঁপতে কাঁপতে…।
 
 
লোকটা বলল, মেসিন ভাইরাস, কাল জব্দ করে দিয়েছি।
 
 
কী করে, তোমাকে ধরেছিল নাকি ? ঘড়িওয়ালা জিজ্ঞেস করল।
 
 
হ্যাঁ, আসলে রেকর্ডগুলো এত ভালো, গানগুলো এত ভালো, যে আমি কোনোদিন গান গাইনি, কেমন সুরে গেয়ে দিলাম। হাসতে হাসতে সুরে গেয়ে দিল যেন লোকটা। তারপর বলল, ঘড়ি সচল করব, বই পড়ব, অচল সচল করব।
 
 
ঘড়ির দোকানি এবার কাঁপতে লাগল। লোকটা তখন গুনগুন করতে লাগল টিকটিক, টিকটিক, ঢংঢং, ঢংঢং…। ঘড়ি বাজাতে লাগল লোকটা। ঘড়ির কাঁটা সরতে লাগল। ঘড়িওয়ালার কাঁপুনি যদি থেমে যায় এতে। মানুষই মারতে পারে, বাঁচাতেও। সে বলল, আলমারির কাচ ভেঙে মহাভারত, রামায়ণ সব বের করে আনব, একটা হাতুড়ি দিও, মানুষের মাথায় মারা হাতুড়ি দিয়ে বইয়ের আলমারি থেকে বই সব বাঁচাব আমি, ওহে ঘড়িওয়ালা, গ্রান্ড ফাদার ক্লক, দম নিতে পারছ ?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত