| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: উত্তরাধিকার । প্রতিমা রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট
জায়গাটা দ্রুত বদলাচ্ছে। চোখের সামনে তিল থেকে হয়ে উঠছে তিলোত্তমা।
 
দেখেছ মোহিতেশ- স্টেশনের সামনে পুরানো লজঝড়ে বাসুর ভাতের হোটেলটাও তার অস্তিত্ব নিয়ে কেমন বিলীন হয়ে গেল!
 
বনেদি চুন সুরকির বাড়িগুলো ভেঙে তার জায়গায় দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে মাথা উঁচু করে ফ্ল্যাটবাড়িগুলো গড়ে উঠছে। পুরানো মানুষজন অনেকটা জবুথবু, সেই জায়গায় নতুন হাওয়া নতুন আলো নিয়ে রামধনু রঙা সব নতুন মানুষজন গায়ে ভুরভুরে গন্ধ নিয়ে আসছে। ভাঙা হৃদয়ের মতো ভাঙা রাস্তাঘাটে কালো তরল পিচের ছোঁয়া পুবে পশ্চিমে আড়াআড়ি লম্বালম্বি হয়ে তা অনেক দুরে গিয়ে হারিয়ে গেছে। ব্যবসা বানিজ্যের বেড়া ঘেরা উঠোনে শুরু হয়েছে নতুন নতুন আবাদ ।
 
হুঁ। বাবা প্রমথেশ বসাকের কথার উত্তরটা দায়সারা ভাবেই দেয় মোহিতেশ। আসলে তার ভেতরে ভেতরে ও একটা কালো মেঘ জমেছে, আর সেই মেঘের ডানায় স্তব্ধ হয়ে আছে একটা ঝড়ের মতো উষ্ণতা। সে তো জানে সেই জায়গায় গড়ে উঠছে গুঁইন বার কাম রেস্টুরেন্ট। এক্কেবারে ঝাঁ চকচকে চারতলা বিল্ডিং বেশ সুন্দর করে সাজানো গোছানো, ঠিক যেন ঘাগরা চূর্ণি চুড়ি টিকলিতে একেবারে বিয়ের কনে। সন্ধ্যা হলেই অন্যরূপ। নিয়ন আলো মেখে কী অপরূপ মায়াবী। তার হাতছানিতে রাতের স্টেশন চত্বর গমগম করে। সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছেও কয়েকদিন। তখন তার মনে হত এই মাঝ বয়সে ব্যবসার কত পুঁতিগলির উপর দিয়ে হেঁটে আসা সেও পারত এমন কোন আলোর অংশ হতে।
 
নিজের ভাবনার গলায় ঘোড়ার মুখে লাগাম পরানোর মতো নিজেই লাগাম পরায়। বাবা তুমি তো নিজেই চাও না আর ব্যবসা বাড়াতে, তাহলে নিজের ভাবনাচিন্তার ডালাটা তোমার সামনে খুলে বসে কি লাভ? তবু কি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা উচিত বাবার মনোভাব বদলাতে? মোহিতেশের মনের ভেতর জমা ঝড়ের উষ্ণতার শক্তিটা ঘূর্ণি হয়ে উপরে উঠতে গিয়ে ও থেমে যায় ছককাটা মন্থর গতিতে। একবার নিজেদের দোকানের দিকে তাকায়, না তার এখন দোকানে না গেলেও চলে, বাবা ক্যাসে বসে আছে। দোকানে কাস্টমারদের যেটুকু ভীড় ও কর্মীরাই সামলে নেবে। তার কালো বাইকটায় বসে ডান হাত দিয়ে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দেয়, প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যার আড্ডাস্থল গঙ্গার পাড়ের দিকে।
 
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে। বিস্তীর্ণ কালো আকাশ জুড়ে চাঁদের হাসি ঝরে পড়ছে জ্যোৎস্না হয়ে। রাস্তার দুপাশে জ্বলে ওঠা স্ট্রিট লাইটকে ঘিরে শীতের প্রথম তুষারের মতো অজস্র আলো পোকা উড়ছে। বাইকটা স্ট্যান্ড করে গঙ্গার পাড়ের পার্কের পাশে ঘাসে ঢাকা সবুজ জমিতে বসে পড়ে।
 
কি রে আজ তোর এত দেরী? কখন এসেছি আমরা, ওঠার সময় হয়ে গেল বলতে বলতে তারিপ হাতের জ্বলন্ত সিগারেটের গায়ে আলতো একটা টোকা দেয় আহ্লাদে সিগারেটের জ্বলতে থাকা মুখটা আরো লাল হয়ে ওঠে।
 
আড্ডার মধ্যমণি বিনোদ। বিনোদ থাকলেই আড্ডা দুধের ওপর সরের মতো জমে যায়। গার্মেন্টস ইমপোর্টের ব্যবসা থেকে সময় পেলেই আড্ডাতে চলে আসে সে। সেদিন একটু আধটু কারণবারি সবার পেটে পড়ে। ওদের এই আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা আড্ডাটা ওরা নিজেরাই ঠিক করেছে, সারাদিন গায়ে পরে থাকা ব্যবসায়িক জামাটা খুলে একটু নির্ভার হয়ে তা হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে। ঘাসের মাথায় পেপার পেতে কাজু কিসমিসের প্যাকেট আর নামী ব্রান্ডের ওয়াইনের বোতলের কর্কটা খোলে বিনোদ। পেপার গ্লাসে ঢেলে এক এক করে সবার সামনে ধরে দেয়।
 
গঙ্গার থেকে উঠে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় রূপালী বরফের মতো গা থেকে ঝরে ঝরে পড়ে সারাদিনের ক্লান্তি।দুদন্ড আরাম তুলে নিতে অন্যদের মতো ঘাসের চাদরে শরীর এলিয়ে দেয় মোহিতেশ। তারপর তাকিয়ে থাকে গঙ্গার অপার রহস্যের দিকে। তরঙ্গায়িত গঙ্গার জলরাশির ভেতর পথরেখা কোথায়? শুধু তো জল আর জল আর সেই জলরাশির কুলকুল বয়ে চলার জলোধ্বনি। একটা স্রোতের উপর আরেকটা স্রোত ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়ছে, তাতে তৈরি হচ্ছে কলিশন, আর তার থেকেই উঠে আসছে কলকল খলখল শব্দ। মোহিতেশ আজ স্রোতের বিপরীতে বসে বৈঠা টানছে।স্রোতের বিপরীতে হাঁটা কষ্টদায়ক। তবু কখনো কখনো হাঁটতে হয়। সে বাবাকে আজ বোঝাবে। হাতের পেপার গ্লাসের তরলে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করে সুবোধ- কল্যাণী রোডের ঐ তিনমাথার জমিটা হলো মোহিতেশ?
 
না। মাথা নাড়ে মোহিতেশ।
 
নিভে আসা সিগারেটটা অনেক পায়ের স্পর্শে ঝুঁকে পড়া দূরের ঘাসের উপর ছুঁড়ে দেয় , তারপর তারিফও তরল পানীয়র গ্লাসটা নিয়ে বলে- কল্যাণী রোডের ও জায়গাটা কিন্তু “বামাল”। লাভের ঘরে শুধু বৃহস্পতি। ওদের বন্ধু মহলে বামাল কথার মানে বিরাট লাভজনক।
 
ওটা হবে না । বোধহয় পার্টি ঠিক হয়ে গেছে।
 
ওটা এখনো বিক্রি হয়নি। যতদূর জানি ঝুনঝুনওয়ালা ও জায়গাটার দালালির দায়িত্বে আছে।
 
তারিফের মুখের কথা টেনে নেয় সুবোধ। হোটেল ব্যবসা ওখানে কিন্তু জমবে ভালো। শিকারি বাঘের শিকারের আগের মুহূর্তের লোলুপ দৃষ্টির মতো চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে সুবোধের। এই তীক্ষ্ম দূরদৃষ্টির জন্যই সুবোধ সামান্য সাইকেল মেরামতির দোকান থেকে নামী এসি কোম্পানির ডিলারশিপ নিয়ে শোরুম খুলে ফেলেছে।
 
সুবোধ বলে চলে-কল্যাণী রোডের এমনিতেই গুরুত্ব বাড়ছিল, এখন কল্যাণীতে এইমস মেডিক্যাল কলেজ চালু হওয়ায় জায়গা জমি প্লাটিনামের চেয়েও দামি হয়ে উঠেছে, হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাইরের পাটি এসে প্রচুর দাম দিয়ে কিনে নিচ্ছে। এবার এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসবে চিকিত্সার জন্য, লোকজনের ভিড় বাড়বে। মানুষজন আসলেই ব্যবসা বানিজ্য তরতর করে এগিয়ে যাবে।
 
কথাগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে মোহিতেশের কানে ঢোকে, এতক্ষণের আলোমাখা চাঁদ ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়ালে ক্রমশ মুখ লুকিয়ে যাওয়ার মতো।গঙ্গার বুক থেকে উঠে আসছে তীব্র শিরশিরানি হাওয়া। চব্বিশ নম্বর গেটের সামনের জুট মিল থেকে হুহু করে হুটার পড়ার আওয়াজ ভেসে আসে, তার সঙ্গে গলা মেলায় রতনেশ্বর শ্মশানঘাটের ওপাশে কচু আর বুনো ঝোপের ভেতর আশ্রয় নেওয়া একদল শেয়াল। আগে গঙ্গার এদিকটায় বুনো ঝোপ আর সাপ খোপের আড্ডা ছিল। আর মাঝে মাথা উঁচু করে ছিল জুট মিলগুলো। তার সবকটাই এখন ধুঁকছে নয় বন্ধ হয়ে গেছে, ডারবান মিলের চাকায় কবেই জং ধরে গেছে, পাওয়ার হাউস তালাবন্ধ। অন্নপূর্ণা কাপড় মিলের গেটের তালা কখনও খোলে, কখনো বন্ধ হয়। সময়ের কী নিদারুণ ছাপ এক সময় দাপিয়ে বেড়ানো এসব শিল্পকারখানার গায়ে।
 
তারিফ কাজুর দানা মুখে তোলে। চেবানোর চকাম আওয়াজ হয়। গ্লাসের শেষ তলানিটুকু গলায় ঢালতে ঢালতে বলে- ব্যবসা হলো গিয়ে সময়ের দোসর। সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে যেমন ব্যবসার মালিকানা বদলায়, তেমন তার অভিমুখও বদলায়। আমাদের ও আপ ডেট থাকতে হয। যেমন দেখ- আগে লোকে রাস্তার পাশের দোকান থেকে রুটি পরোটা ঘুঘনি ছোলা সেদ্ধ বয়েলড ডিম চা এসব খেত এখন সে জায়গায় চাহিদা বেড়েছে চাইনিজ ফুডের চাউমিন এগরোল মোগলাই পরোটা। দেদার বিকোচ্ছেও। পুরানো জিনিসকেও নতুন মোড়কে ঢেকে সময়ের সঙ্গে চলতে হয়।
 
এগজ্যাক্টলি। এই কথাটাই বলছিলাম। সুবোধ হাতের আঙুলগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে। আগে আমাদের এই শ্যামনগরের খ্যাতি ছিল মোহিতেশদের বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি। এখন গুঁইন বিরিয়ানিও দ্রুত নাম কামাচ্ছে। অথচ এই গুঁইনরাই দুপুরুষ আগে এই শ্যামনগরের এইটি ফাইভ রুটের ফুটপাতে পুরানো ঘড়ি সারাইয়ের কাজ করত। হঠাৎ করে ভাগ্যলক্ষী কেমন করে তার ঝাঁপি খানা নিয়ে এসে গুঁইনদের ঘরে আসন পেতে বসল। গুঁইনদের পরিতোষ গুঁইন বাপের এককাঠা জায়গার উপর আটচালা বানিয়ে খুলে ফেলে একখানা বিরিয়ানির দোকান। আর তারপরেই কিস্তিমাত। শুরু হলো নতুন ইতিহাসের, শ্যামনগরের বিরিয়ানির। এখন তো নেতা মন্ত্রী থেকে আমজনতা বিরিয়ানির গন্ধেই শ্যামনগর চেনে।
 
ওয়েদারের ভাবগতিক ভালো মনে হচ্ছে না । আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘকে সেলাই করে কেউ যেন ঝুলমাখা কালো চাদর বানিয়ে ফেলেছে। ওদিকে মিলের নাইট শিফটের হুটার বেজে উঠল হু হু। বিনোদ ঝিম লাগা ঘোরে পকেট থেকে মোবাইলখানা বের করে দেখে রাত্রি দশটা বেজে গেছে। ঘাসের ওপর পাতানো পেপারটা গোছাতে গোছাতে বলে – এবার আমাদের উঠতে হবে কিন্তু।
 
এত তাড়াতাড়ি? মোহিতেশের জীব জড়াচ্ছে। আজ দু পেগ নিয়েছে। বলতে বলতেই মিহি কাঁচের মতো বৃষ্টির ফোঁটা ওদের আলতো করে ছুঁয়ে যায়। সবাই উঠে পড়ে দ্রুত বাইকে চাবি ঘোরায়, মোহিতেশ ও তার কালো বাইকখানায় উঠে হেলমেট পরতে থাকে। আড্ডার আসর ভেঙে যায় ।
 
বাড়ি ফিরেও মোহিতেশের মাথাখানা ঝিম মেরে থাকে। এখন বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকা যাবে না। বাবা দোকান থেকে চলে এসেছে। ঠিক বুঝতে পারবে মোহিতেশের অবস্থা। বাবা এসব জীবনেও ছুঁয়ে দেখেন না। গেস্টরুমের পাশে তার অফিসরুমে ঢুকে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে পড়ে। মোহিতেশের ভেতরে একটা আস্ত দামোদর নদ কুলকুল করে বইছে, নিজের ব্যবসায়িক সত্তার সঙ্গে নিজেই লড়াই করে চলেছে বেশ কিছুদিন ধরে। আচ্ছা সে যদি ব্যবসায়ী না হয়ে দোকানে প্রায় মাধুকরী করতে আসা ফকিরটার মতো হতো তাহলে কি বেশি সুখী হতো? যদি কখনো এসব ছেড়ে লাল গেরুয়া বসন পরে হাতে কমণ্ডলু নিয়ে হরিহরছ্ত্র আশ্রমে দীক্ষা নিয়ে সংসারে আর না ফেরে কেমন হয়! স্পষ্ট শুনতে পায় বাবা শব্দ করে তিনটে মুখ পাশে এসে দাঁড়ায়। ও তোমরা? পিয়া মিমি রিনি! মোহিতেশ- এর তিন কন্যা। একজনও তোমরা পুত্রসন্তান হলে না! বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের উত্তরাধিকারের কি হবে? পারিবারিক ব্যবসার ব্যাটন বাইরের লোকের হাতে চলে যাবে এই চিন্তায় তোমাদের ঠাকুরর্দা প্রমথেশ বসাকের মতো ঝানু ব্যবসাদার ব্যবসা থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তোমরা জানো?
 
না, আর পারছে না। কম্পিউটারের স্কিনে সারা মাসের ব্যালেন্স শিটে চোখ বোলাতে বসে একটা শূন্য গোলকের মতো মনে হয় নিজের মাথাটাকে। গোলকের গায়ে কি আঁকিবুঁকি টানা না কোরা কাগজের মতো সাদা। না, ওতে একটা কালো সাদা ছকটানা দাবার বোর্ডটা ভেসে রয়েছে। ছোটতে দাবা খেলাটা বেশ ভালো উপভোগ করত মোহিতেশ। স্পষ্ট দেখতে পায় বোর্ডের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ঘুঁটিগুলো- রাজা রানী নৌকা গজ বোড়ে। কিস্তিমাত করতে হলে দাবার চালের চেয়েও দাবার গুটি সাজানোটা জরুরি। বাবাকে না জানিয়েই মোহিতেশ পাশে রাখা এনরয়েড ফোনটা তুলে নিয়ে ফোন করে ।
 
হ্যালো, শুনুন স্টেশনের পাশে কল্যাণী রোডের ওপর জায়গাটা আমার চাই।
 
ও জায়গা তো পেরাই দরদাম হয়ে গেছে । ফোনের ও প্রান্তে অবাঙালি কন্ঠ স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ।
 
আরে গোলি মারুন ও দরদামে। বলুন আমাকে কত দিতে হবে। আমি বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মোহিতেশ বসাক বলছি- আপনি রফাতে আসুন।
 
বললাম না ও জায়গা হচ্ছে না, ও জায়গার ফাইনাল হয়ে গ্যাছে।
 
ডিল ক্যানসেল করুন। চড়া দাম দেবো।
 
ঝুনঝুনওয়ালা কথার খিলাপী করে না। আর ও জায়গা লেকে কি করতেন, আপকো পিতাজী তো আপনা খানদানের বাইরে যেতে নারাজী। সেই সুইটস বানিয়ে সবার সুগার ধরিয়ে দেবেন। হা হা ওখানে সুপার মার্কেট হবে। কত বড় ওপেন বাজার বসবে, লোকের রুজি রোজগার বাড়বে শ্যামনগর টু কল্যাণী গ্লামারাস হয়ে যাবে বুঝলেন ।
 
বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার শ্যামনগরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান। মানুষ এখনও বসাকের মিষ্টি দই আর জলভরা খেতে এখানে ছুটে আসে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে বহাল তবিয়তে আছে, কোন ফুটপাত থেকে উঠে আসিনি-কথাবার্তা ঠিকঠাক বলুন। প্রচন্ড ক্রোধে খাঁটি বাঙলা গালাগাল বেরিয়ে আসে মোহিতেশ-এর মুখ থেকে।
 
সো কুল বাপি। আবার মাথা গরম করছো? ঠান্ডা মাথায় পৃথিবীর তাবৎ কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। গ্রান্ডপার কথায়- যেখানে ছুঁচ চলে না, সেখানে ফাল চালানো যায়। এইজন্য সময় পেলে গোয়েন্দা গল্প পড়ো- শার্লক হোমস, আগাথা ক্রিস্টি, এডগার অ্যালান পো না হলে শরদিন্দু সত্যজিৎ নীহার রঞ্জন গুপ্তও চলবে, সেখানে দেখবে বড়ো বড়ো খুন করেছে খুনি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, কোন ক্লু না রেখে। দুঁদে গোয়েন্দা ও হিমশিম খাচ্ছে সে খুনের কিনারা করতে। বলে হা হা হা করে হাসে পিয়া। কখন যে ঘরে এসেছে পিয়া মোহিতেশ টের পায়নি ।
 
কি রে কখন এসেছিস মা?
 
অনেকক্ষণ। তুমি টেরই পাওনি বাপি। এত রাতে এ ঘরে আলো জ্বলছে দেখে বুঝলাম কেস সুবিধার নয়। এসে দেখলাম ঠিক তাই। রাতের খাবার আর ওষুধ খাবে চলো।
 
তুই এত সব খেয়াল রাখিস মা?
 
তারপরও তুমি ত ভরসা করতে পারো না। ব্যাঙ্গালুরু থেকে এম বি এ করা তেইশ বছরের পিয়া যেন বাবার উপর একটু অভিমানী হয়ে ওঠে।
 
এই ভরসাটা যে কিসের, পিয়ার কথা মোহিতেশ বোঝে।
 
মোহিতেশ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভরসার জায়গাটা খোঁজার চেষ্টা করে। মেয়ের কপালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে- আহা! তার আত্মজা, তার হৃদয় নিংড়ানো ধন। পর মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নেয়- মেয়ে পরধন, পরের বাড়ি চলে যাবে। পারিবারিক ব্যবসার মূল্য কি বুঝবে? মুখে বলে তুই যা মা আমি আসছি।
 
ব্যবসায় ব্র্যান্ড ভ্যালু খুব মূল্যবান। সেটা একদিনে আসে না। তিল তিল করে গড়ে তুলতে হয়। বাবা এখনও বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ঐতিহ্য সুনাম বজায় রাখতে মিষ্টি তৈরির নানা উপকরণ দুধ ছানা ঘি মধু ময়দা চিনি সব খাঁটি জিনিস নিয়ে আসেন, এমনকি কারডামম, রোসওয়াটার বা সেফরন বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সঠিকটা জিনিসটা বেছে নেন। কোয়ালিটির সঙ্গে নো কমপ্রোমাইস। বাড়ির লাগোয়া কারখানায় কারিগররা রাতে যখন মিষ্টি তৈরি করে উপকরণের উপাদানের রেসিও নিজে যাচাই করে নেন। আর পুরভরা সন্দেশের রেসিপি বসাকদের একান্ত নিজস্ব। এ মিষ্টি তৈরি করার সময় প্রমথেশ বসাক নিজে বা মোহিতেশ মিষ্টি কারখানায় গিয়ে উপাদান তৈরি করেন। তাই এত বছর ধরে আশেপাশে এত মিষ্টান্ন ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে, জলভরা সন্দেশ নানা জায়গায় তৈরি হচ্ছে কিন্তু খ্যাতির মুকুট সেই বসাকদের মাথাতেই রয়ে গেছে।
 
তবে সময়ের আঁচ পড়ছে মিষ্টি শিল্পের গায়েও। এখন খাঁটি উপকরণ সংগ্রহ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।হলে তার কস্ট প্রাইস বেড়ে যাচ্ছে। তখন সেলস অনেকটা ধাক্কা খাচ্ছে। কোয়ালিটির সঙ্গে কম্প্রোমাইস না করলে সেলস আরোও বাড়ানো দরকার। তারিফ ঠিকই বলে-আমাদের আপ ডেট থাকতে হয়। সেলস বাড়াতে হলে আরো ব্রাঞ্চ খোলা জরুরি। মোহিতেশের মাথা আবার ঝিম মেরে আসে, এবার সেখানে ঘুলি ঘুলি অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে। তার ভেতর উঠে আসে একটা ছায়া ছায়া ছবি- কল্যাণী রোডের ঐ জায়গাটার উপর শুরু হয়েছে ভিত পূজা, তারপর তরতরিয়ে উঠছে ব্লিডিং একতলা দোতলা তিনতলা। তারপর একদিন গলায় সাতনরী হারের মতো আলোকমালা পরে বিজ্ঞাপনের ব্যানার ফেস্টুনে মুখ ঢেকে গেটে তোরণ সাজিয়ে উদ্বোধন হচ্ছে গুঁইন সুপার মলের। মোহিতেশ কি হেরে যাবে? একটা টানাপোড়েনের নৌকায় বসে হাল কতক্ষণ ঠিক রাখতে পারবে? মাথার ভেতর দাবার বোর্ড সরে গিয়ে সেখানে একটা আগুনের মশাল ধক করে জ্বলে ওঠে।
 
এই মশালের আগুনের আঁচটা কি দোকানের ভেতরেও চলে এসেছিল অজান্তে! যার কারনে আজ দুপুরে এই কলিশন!
 
এইটি ফাইভ রুটের একদিকে বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার । রুট ক্রস করে ঠিক উল্টো দিকে গুঁইন বিরিয়ানি শপ।প্রতিদিনের থেকে আজ দুই দোকানে ভিড় একটু বেশি। জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে গুঁইন বিরিয়ানি দোকানের সামনে কাস্টমারদের ভিড় বাড়তে বাড়তে এপাশে বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছে চলে এসেছে। কখন তা বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনেটা কভার করে পেরিয়েও গেছে। হয়, এরকম তো কতদিন হয়েওছে। কিন্তু আজ শুরু থেকেই দিনের সুর তাল লয় সব কেমন ভাঙা ভাঙা বেসুরো। পাটভাঙা সূর্যের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে প্যাচ প্যাচে গরম। বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে প্রথম লটের মিষ্টি শেষ হয়ে, আসছে দ্বিতীয় লটের মিষ্টি , ঠান্ডা পানীয় মিষ্টি দই আইসক্রিম। দোকান সামলাতে এতজন কর্মী একেবারে হিমসিম। তার উপর মুশকিলটা হলো কি বসাকদের দোকানের কাস্টমাররা কেনাকাটা করার জন্য দোকান থেকে ঢুকতে বেরোতে বাধা পাচ্ছে। প্রথমে বসাকরা আওয়াজ দেয়- দোকানের সামনেটা খালি করুন, আমাদের কাস্টমারদের অসুবিধে হচ্ছে। তাতে কিছু কাজ হয় না।
 
এবার বসাকদের এক কর্মী একটা পেপারকে মাইকের চোঙের মতো ধরে বলতে শুরু করে- আপনারা আপনা আপনা দোকানের সামনে খাঁড়া হোন।
 
না, তাতেও বিশেষ কাজ হয় না। সিভিক ভলান্টিয়াররা এসে লাইন একটু দূরে হঠিয়ে দেয়। একটু পরে যে কে সেই। এবার বসাকরা রাস্তায় নামে নিরীহ নিরস্ত্র হয়ে। কিন্তু ব্রহ্মাস্তটি তূণ থেকে বের করে কিউইর মধ্যে দুজন কর্মী এসে খবরটা বেশ সুন্দর করে ছড়িয়ে দেয়- গুঁইন বিরিয়ানিতে নেশার ওষুধ মেশানো আছে। এইজন্য অন্য দোকানের বিরিয়ানি নয়, বারবার লোকে গুঁইন বিরিয়ানির খোঁজে আসে।
 
আজ তা পরিমানে মেশানোটা বেশি মাত্রায় হয়ে গেছে। এইমাত্র খবর এলো আজকের বিরিয়ানি খেয়ে দুজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ব্যস শব্দ ব্রহ্মের অভিমুখ সোজা নিশানায় আঘাত করে। গুঁইন বিরিয়ানির লাইন ফাঁকা হতে থাকে। কথাটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে গুঁইনদের দোকানের সামনে পাক খেয়ে আছড়ে পড়ে। নিউটনের থার্ড ল মেনে- প্রত্যেক ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে। মধ্য গগনে লাল সূর্যের তীব্র উপস্থিতি উপেক্ষা করে লাঠি সোটা নিয়ে এসে সরাসরি বসাকদের আক্রমণ করে বসে গুঁইনরা। এর আগেও দু দোকানের কর্মীদের ভেতর ছোটোখাটো ঝামেলা হয়েছে কিন্তু আজকের ঝামেলা একটা উচ্চতায় পৌঁছে যায়। দু দোকানের কয়েকজন জখম, একজনের মাথাও ফেটে রক্ত নামছে মুখের দিকে চুইয়ে চুইয়ে। ব্যাপারটা থানা পর্যন্ত গড়ায়।
 
দুই
 
ঘটনাটা ধাক্কা দেয় অশীতিপর অশোক গুঁইনকে। দোকানের ভেতরে তিনি একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে। মনের ভেতর একটা চিন্তার গভীর সমুদ্র প্রবল গর্জন করে ঢেউ তুলে তীরে আছড়ে পড়ছে। আর তিনি লাইট হাউসের চুড়ায় বসে সেই উথালপাতাল ঢেউ দেখছেন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে। এই সময় তিনি নিজের হাতে এ ঘরে বিরিয়ানির মশলা বানান। আজ তিনি হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। ব্যবসাতে ঈর্ষা রেষারেষি থাকেই। একজনকে ধোঁকা দিয়ে অন্যজনের বেরিয়ে যাওয়া ও নতুন কিছু নয়। তার এত বছরের ক্যারিয়ারে এমন উথালপাতাল করা কত ঘটনা তিনি সাহসের সঙ্গে সামলেছেন। এজন্য তার ঠান্ডা মাথা আর দূরদর্শিতা কাজ দিয়েছে। তবে আজকের ঘটনায় তিনি মর্মাহত, আশাহতও বটে। গোটা ঘটনার নেতৃত্বে যে পরীক্ষিত তার সান ইন ল। তবে কি ভবিষ্যত প্রজন্ম এরকমই! এদের মধ্যে ধৈর্য সহনশীলতা একেবারেই নেই, হাতের মুঠো ফোনে নিমেষে দুনিয়ার সব পেয়েছির দেশে বিচরণ করতে করতে বাস্তবের মাটি থেকে নিজেদের পা তুলে রেখেছে! আঙুলের টাচে এভাবে সব সমস্যার চটজলদি সমাধান চায়!
 
ঢুকে পড়েন নিজের বৃত্তে। সেই বৃত্তে সাইকেল রেসিং করে বেড়াচ্ছে বছর সাতাশের এক যুবক। রোগা ক্ষয়াটে চেহারা চোয়াল বসে বাটির মতো গর্ত, গা থেকে বেরোচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্তের গন্ধ। কিন্তু চোখ দুটো স্বচ্ছ দিঘির কালো জলের মতো চকচকে গভীর। আর তাতে মাথা তুলে দোল খাচ্ছে ফুটে থাকা পদ্মের মতো একটা স্বপ্ন। বড় হবার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দেখতে পারা থেকেই তো পৃথিবীতে সব জীবনের থেকে মানুষ জীবন আলাদা হতে পেরেছে। দুটো হাত দুটো পা দুটো চোখ সম্বল করেই সাতাশ থেকে বিরাশির পথ পরিক্রমা, তাতেই দাঁড়িয়ে গুঁইন বিরিয়ানি শপ। তবে শেষবেলায় আরও একটা কাজ বাকি, এই স্বপ্ন প্রসবিত সন্তানের ভবিষ্যত যোগ্য মানুষের হাতে সমর্পণ।
 
ছেলে পলুকে ডাকেন অশোক। পলু অত্যন্ত সাদাসিধে। ব্যবসার ব্যাপারে বাবাই তার সব। সেরকম মাথা ঘামাতে পারেনও না। পলু কাছে এসে বলে- বাবা আমায় ডাকছো?
 
হাঁ। পরীক্ষিত কোথায়?
 
জানিনা । এখন আর কোথায় হবে, হয়তো বন্ধু বান্ধব নিয়ে এই সন্ধ্যার সময় কোথাও আড্ডা মারছে। রাত্রি দশটার আগে তো বাড়ি ঢোকে না।
 
যখনই ফিরুক তাকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও।
 
মাথা নাড়ে পলু।
 
রাতের ডিনার শেষ হলেই সাধারণত শুয়ে পড়েন অশোক গুঁইন । আগে জাগলেও এখন বয়স আর সাথ দেয় না। শুয়ে শুয়ে চিন্তার একটা স্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করে চলেছেন। সেই রূপরেখার কেন্দ্রে এখন শুধুই স্টেশনের পাশে কল্যাণী রোডের তিনমাথার জমিটা। ঝুলেপড়া চামড়ার মুখের উপর আস্তে আস্তে হাত বোলালেন, পরিতৃপ্তি খেলে গেল সারা শরীরে। এই বয়সেও ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে এখনও তালাচাবি পড়েনি তাহলে। কত লাইন পড়েছিল যেন যুনঝুনওয়ালার মতে- ষাইট সত্তর হোগা। বাহার কা আদমী ভি থা।
 
অশোক গুঁইনের মনে হয় সংখ্যাটা আরো বেশি হতে পারে। তবে শেষ হাসিটা তিনি হাসতে পেরে সত্যিই মনে মনে এক অদ্ভূত শিহরনে ভেসে গেছিলেন কদিন। অংকের নিয়মে প্লেস ভ্যালু ফেস ভ্যালুর মতো জায়গাটার প্লেস ভ্যালু সত্যিই দারুন। যে কারো কাছে এ জায়গা লোভনীয়। হাওয়ায় একটা উগ্র গন্ধ ভেসে এসে নাকে লাগতেই ভাবনায় ছেদ পড়ে। কানে এল ডাক-দাদু, ও, দাদু। আওয়াজটা কেমন যেন জড়ানো, কথাগুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে বাতাসে।
 
বিছানা থেকে উঠে বসে পেছনে ঘুরে দেখেন- পরীক্ষিত। পা দুটো তখনও টলছে, মুখের ভেতর ভকভক করে বেরিয়ে আসছে বিদেশি মদের গন্ধ। এ জিনিস যে তিনি সহ্য করতে পারছেন না। একটা চরম অস্বস্তি সামনে এসে দাঁড়ায় । এতক্ষণের সুখী সমুদ্র কোথায় কি সামনে যে ধূ ধূ বালুরাশির চর। তার উপর করুণার একখানি চাদর বিছানো, কিন্তু সেখানা কি অশোক গুঁইন নিজেই নিজের গায়ে জড়াবেন নাকি পৌত্রের গায়ে জড়িয়ে দেবেন। পরীক্ষিতের মুখের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকেন।
 
দাদু তুমি আমায় ডেকে ছিলে?
 
আজ যাও কাল সকালে তোমার সঙ্গে কথা বলবো।
 
পরীক্ষিত এবার সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়ে। পেটে দ্রব্য পড়ায় আজ তার ভেতরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠে উত্তপ্ত লাভা হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রথমেই চোখ দিয়ে নোনা জলের স্রোত বেরিয়ে আসে। দাদু তুমি আমায় খুব খারাপ ভাবছো, বিশ্বাস করো দুপুরের ঘটনাটা আমি ঘটাতে চাইনি কিন্তু রাগ আর সামলাতে পারছিলাম না। ছ বছরের রিলেশনশিপ এক নিমেষে ভেঙে দিলে। দাদুর হাতের উপর মুখটা রেখে হু হু করে কেঁদে ফেলে।
 
অশোক নাতির পিঠে হাত বোলান। তুমি যে আমার পরীক্ষিত। মহাভারতের পরীক্ষিতের মতো তোমার হাতে আমার এই সাম্রাজ্যর ভার দিয়ে যে আমি মহাপ্রস্থানে যাব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু এ কী অবস্থা মাই গ্রেট সন। মুখে বলেন – ছ বছরের রিলেশন সে টা কি তার সঙ্গে বসাকরা কিভাবে জড়িয়ে ?
 
পরীক্ষিত মুখ তুলে এবার প্রশ্ন করে- তুমি কখনো ভালোবেসেছো দাদু? ভালোবাসা মানে লাভ। কারো প্রেমে পড়া, তার জন্য অপেক্ষা করা। তাকে নিজের করে পেতে আকুল হয়েছে কখনো তোমার হৃদয়?
 
অশীতিপর অশোক গুঁইন মনে মনে বলেন- আমাদের সময় অধিকাংশ ভালো বাসাবাসি তো বিবাহ পরবর্তী। ভালো তো বেসেই ছিলাম, নাহলে গ্রেট গ্র্যান্ডসন তোমারা পৃথিবীতে আসতে কিভাবে? ভালোবাসা প্রেম এগুলো যে জীবনের আধার। সন্ন্যাসীরাও ঈশ্বরে প্রেম করেন। তবে এতদিন বিরিয়ানির কারবারে শু্ধু বিরিয়ানির গন্ধ শুঁকেছেন। আজ এক অন্য গন্ধ যেন নাকে এসে লাগে। তাঁর ধুরন্ধর দূরদৃষ্টি দুইয়ে দুইয়ে চার করে প্রশ্ন করলেন- তুমি কি প্রেমে পড়েছো মাই গ্রেট গ্র্যান্ড সন? সে মেয়ে কি বসাকবাড়ির মোহিতেশের মেয়ে পিয়া?
 
অন্যসময় হলে কি হতো বলা মুশকিল। আজ যে পরীক্ষিতের সাচ্চা জীবন। আজ সে মাথা নেড়ে সত্যিটা বলেই ফেলল- হাঁ দাদু। পৃথিবীর সবচেয়ে দুখি মানুষের মতো মাথা না তুলেই বলে চলল- সে আর ভালোবাসলো কই। তিনদিন আগেই ব্রেক আপ হয়ে গেছে। ভালোবাসায় কি শর্ত চলে? সে শর্ত দিল। আমি বললাম- আমাদের শুরুতে তো কোন শর্ত ছিলনা। তবে এখন কেন? ভালোবাসা তো কোন ডিল নয়। ও বলল- সবকিছু বদলায়- সময় বদলায়, মানুষ বদলায় দেশ বদলায় নদীর স্রোত গতি বদলায় গাছ তার আকার বদলায় পৃথিবীও তার অ,,ব,, স্থা ন বদলায় তবে,,, চোখ দুটোতে এক নদী জল, অশোক নাতির মাথায় সস্নেহে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন- তবে কি সেই শর্ত দাদু ভাই।
 
ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলে চলে পরীক্ষিত- হুঁ শর্ত ।
 
তিন
 
ভিত খোঁড়ার পর তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছয়তলার বিল্ডিংটা। কল্যাণী রোডের উপর তিনমাথার শূন্যস্থানের মতো জায়গাটার গায়ে এখন রাজার সাজ। সবাই ঘাড় উঁচু করে দেখতে থাকে বিল্ডিংটাকে। সুপারমার্কেট শব্দটা ঠেকে আড্ডায় পথে ঘাটে বেশ জোরদার ওজন করে নেয় । হাতের চায়ের ভাঁড়ে আঙুল ছুঁইয়ে টুসকি মেরে ঝেড়ে চুমুক দিতে দিতে সুবোধ বলে- বিল্ডিংটা দারুণ ডেকোরেশন করছে, সিংহ দরজার মতো গেট পেরিয়ে ডানদিকে কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, বামদিকে ঝঁ চকচকে রিশেপশন পেরিয়ে ফুল ঢাকা লন। তারপরই কাঁচের দরজার ওপারে ঠান্ডা রুমে সেজে থাকবে সুপার মলের পণ্য রা।
 
বিনোদ খালি চায়ের ভাঁড়টা ফেলে ইশারায় সতু চাওয়ালাকে ডাকে- দে সবাই কে আরো এক ভাঁড় করে। গঙ্গার পাড়ে আড্ডার মানুষদের কাছে এই ভ্রাম্যমান চাওয়ালা সতুর খুব কদর। অন্যদের থেকে সতু চা টা ভালো বানায়। চা ভাঁড়ে ঢালতে ঢালতে- সতু বলে আচ্ছা সুপার মার্কেটটা কবে থেকে খুলবে?
 
কেন তুই কি এবার থেকে ওখানে চা বিক্রি করবি নাকি? হাতে ভাঁড় তুলে তারিফ জিজ্ঞাসা করে।
 
মুচকি হেসে সতু বলে ও জায়গাটার কদর ক্রমশ বাড়ছে। ক’দিনেই ভোল বদলে রাস্তাঘাট চকচকে, বড়বড় বিল্ডিং উঠে গেল। সবাই বেশি বিক্রি বাটার আশায় ওখানে এনটিরি নিতে চাইছে । আমি বাদ কেন বাবু।
 
হাওয়াকলে হাওয়া ঘুরছে। সুন্দর সন্ধ্যায় গঙ্গার পাড়ের লাগানো বাতিস্তম্ভের আলোয় সহস্র খুশির মতো লহর তুলে পাড়ের বুকে আছড়ে পড়ছে জোয়ারের জল। সেদিকে মুখ করে সুবোধ বলে- শুনলাম একেবারে কমপ্লিট প্যাকেজ থাকছে, এক ছাদের তলায় সবকিছু ।
 
ওদের আড্ডায় এখন আর মোহিতেশ আসে না। তাই সবার ভেতরের কথাটা হাট করে খুলে তারিপ বলে দেয়- শ্যামনগরের এক নম্বর ব্যবসায়ীর ব্যাটনটা এবার বসাকদের হাত থেকে গুঁইনদের হাতে চলে যাবে।
 
মাথা নাড়ে বিনোদ। সুপারমলটার কি যেন একটা সুন্দর নামও দিয়েছে।
 
ফাল্গুনস্য প্রথম দিবসে সুপারমলের সমস্ত আলো ঝলমল করে জ্বলে ওঠে। আহা! এই চত্বরে এই প্রথম এত বড় সুপারমার্কেট। মানুষের উত্তেজনা তুঙ্গে। উদ্বোধন দেখতে মানুষজন মুখিয়ে। আর মার্কেটিং করতে কলকাতায় দৌড়াতে হবে না, ব্র্যান্ডেড জিনিস এখানেই মিলবে। উদ্বোধনের আগে সুপারমলের ফুটবল মাঠের মতো ছাদের উপর নহবতের সুরে সবাই অবাক। বিয়ে! কার! বিস্ময়ের মুখে তুড়ি মেরে ততক্ষণে ছ’তলার বিল্ডিংয়ের টপে সোনার জলের রঙে লেখা জ্বলজ্বল করে ওঠে- ‘ওয়েডিং অফ পিয়া অ্যান্ড পরীক্ষিত।‘
 
বিয়ের সকালেই ফিতে কেটে উদ্বোধন হয়ে যায় সুপার মার্কেটের। খুলে যায় সুপারমলের গেট। চন্দনচর্চিত ব্রাইডাল সাজে পিয়ার অপূর্ব মুখখানির মতোই ঝলমল করে ওঠে মলটা। গ্র্যাউন্ড ফ্লোর জুড়ে পিয়াস্ উইমেনস কালেকশন, ফাস্টফ্লোরে পরীক্ষিতের মেনস ওয়ারের সম্ভার। সেকেন্ড ফ্লোর কিডস সেকশন। মার্কেটিং শেষে ফোর্থ ফ্লোরের রেস্টুরেন্টে খাবার সুব্যবস্থা। মিলবে গুঁইন বিরিয়ানি। ফেরার সময় থার্ডফ্লোর থেকে বসাকের জলভরা দই মিষ্টি প্যাকেজিং করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, বাইরেও এক্সপোর্ট হবে। ছয়তলাতে অবসর বিনোদন বা থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে।
 
নিমন্ত্রিত হয়ে তারিফ বলে- মোহিতেশ ?
 
সুবোধ বলে- মোহিতেশ?
 
মোহিতেশ বলে- সন্তান বড় ধন। বাবা ডাকে কোনরকম ফারাক নেই রে।
 
অতিথি অভ্যাগতদের হৈ হুল্লোড় সানাই নহবত ব্যান্ডপার্টির সুর মূর্ছনার ভেতর রাতি বারটার শুভ লগ্নে বাঁধা পড়ে দুটি হৃদয়। সবকিছু মিটিয়ে একটু জিরিয়ে নিতে রাত্রি দুটোর সময় মোহিতেশ পিলুর হাত ধরে বলে- চলুন, একটু নীচে নেমে ঘুরে আসি। ছ’তলা থেকে নীচে নেমে লন ধরে হাঁটতে গিয়ে থমকে যায়। বাগানে পাতানো গার্ডেন চেয়ারে মুখোমুখি বসে রঙিন ধুতি পাঞ্জাবিতে সজ্জিত লম্বা দুই বৃদ্ধ মানুষ! সাইক্লেডিক আলোয় তাদের ছায়া আরো লম্বা হয়ে উঠেছে! পিলুর হাতটা শক্ত করে ধরে মোহিতেশ। পিলু বলে- ঠিকই দেখছেন। তাঁদের মাঝখানে টেবিলে রাখা দামী ওয়াইনের বোতল। ততক্ষণে তাঁরা তা খুলে তরল পানীয় কাঁচের গ্লাসে ঢেলে গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে অদ্ভুত আনন্দে বলে উঠলেন- ‘ চিয়ার্স ‘।
 
আর ঠিক সেই মুহূর্তে ‘উত্তরাধিকার’ সুপারমলের মাথার উপর দিয়ে ক্যারাও ক্যারাও করে উড়ে গেল গোল তীক্ষ্ম চোখের সাদা ডানার দুটো লক্ষ্মী পেঁচা।
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত