| 29 মার্চ 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: গন্তব্য । মৌমিতা ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
কী হয়েছে ম্যাডাম? একটা FIR করাবো। আচ্ছা বসুন, একজন ভদ্রমহিলা তখন কমপ্লেইন করছেন, ওনার কাছে ফোন এসেছিলো আগের কোন ক্রেডিট কার্ড আপডেট করে দেওয়া হবে বলে, তারপর বলা হয় আরেকটা কার্ডের আউট স্ট্যান্ডিং ওয়েভ করে দেওয়া হবে। এই কার্ড থেকে কিছু টাকা পেমেন্ট করে দিলে ইত্যাদি … বলে ওনার পিনটা জেনে আট হাজার টাকার ট্রানজাক্সান হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলাকে দেখে রাগই হচ্ছে আমার। আজকের যুগে এরকম বোকা! বলেই ফেললাম। ‘ম্যাডাম, এতো অ্যাড আসে, মেসেজ আসে যে Don’t disclose your PIN to any one, bank never asks for any pin from any customer.’ তবুও এইসব স্পুরিয়াস কলের ফাঁদে পড়লেন?
অফিসার একটু বিরক্ত হয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি মোবাইলে মনঃসংযোগ করলাম।
ডাক পড়ল আমার
আপনার নাম?
সুচরিতা গাঙ্গুলি।
কী করেন?
একটা কর্পোরেটে জোনাল ম্যানেজার,ফেসিলিটি ।
কী হয়েছে?
আমার সব গয়না চুরি হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে।
কাকে সন্দেহ হয়?
যেখানে ছিল বাড়ির লোক ছাড়া নেওয়া খুব শক্ত।
পুরোটা বলুন…
আমার বিয়ের পর থেকে গত সতেরো বছর আমার গয়না শাশুড়ির আলমারির একটা হিডেন লকারে থাকতো। পুরোন আলমারি, লকার দেখাই যায় না। ওনার মৃত্যুর পরে আমি বাড়ির লোকেদের বলি খুলে দিতে লকারটা। আশ্চর্যভাবে ওই চাবিটা মিসিং। তারপর গত একবছর ধরে আমি বাড়ির লোকেদের অনুরোধ করে যাই। আর তারা কেউ বিষয়টিতে গা না করায় গতকাল আমি একটি আলমারির মিস্ত্রি ডেকে এনে ওটা ভেঙে দিই, দেখি লকারের মধ্যে চারটে বিয়ের কার্ড ছাড়া কিছু নেই। ওই আলমারিটা শাশুড়ির টার্মিনাল ইলনেসের সময় কোন আয়াকে হ্যান্ডেল করতে কখনো দেওয়া হয়নি, যে ওরা লকারের অস্তিত্ব টের পাবে, ওরা অন্য আলমারির থেকে শাশুড়ির নাইটি, তোয়ালে, চাদর বের করেছে। আমার শাশুড়ি খুব সতর্ক মানুষ ছিলেন। ওনার থেকে চাবি নিয়ে চুরি করা ডিফিকাল্ট। তাছাড়া লকারটা খুঁজে পাওয়া চেনা লোক ছাড়া মুশকিল। বাড়িতে কেউ না কেউ সবসময় থাকতো। তাই উনি মারা যাওয়ার পর পরই কেউ সরিয়েছে ও চাবিটা গুম করেছে।
কত গয়না ছিল?
আমার বিয়ের পুরো সেটটা, মানে নেকলেস, কানের দুল, চূড় দুটো, এছাড়া আটটা আঙটি, আরো দুটো নেকলেস, একটা চেইন, তিনটে লকেট। 
কত গ্রাম হবে?
প্রায় তিনশো গ্রাম বা তাঁর বেশি।
চলুন, ভিতরে চলুন।
আগের ভদ্রমহিলা, তার স্বামীকে কনুই দিয়ে ঠেলে বললেন, ‘হেব্বি চালাক’।
আমি পুলিশ অফিসারকে অনুসরণ করলাম।
ভিতরে একটা ঘরে চারজন আলাদা আলাদা করে আবার এক সময় পুরো ঘটনা আবার শুনলেন। মুখের ভাব এমন করলেন যেন আশ্চর্য কিছু বলছি আমি। কখনও মাটির দিকে তাকিয়ে কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে ,টেবিলে তবলা বাজিয়ে আশ্চর্য সব মুখভঙ্গি করলেন এক অফিসার। চারজনকে আবার বলার পর আমি বললাম- শুনুন চারজনকে সব ডিটেইলস দিয়েছি। এখন অন্য কাউকে আর দিতে পারব না। একটা কাগজ দিন, লিখে দিচ্ছি।
না না আর কাউকে বলতে হবে না
আচ্ছা, লকার নেন নি কেন ব্যাঙ্কে?
স্যালারি এক্যাউন্টে লকার হয় না, সংসার আমার টাকায় চলে তাই আমার অন্য এক্যাউন্টে জীবনে দু হাজারের বেশি ব্যালান্স পৌঁছায়নি।
এতদিনে একবারও চেক করলেন না!
গয়না পরিনা, তাই অত নজর দিইনি, তাছাড়া বিশ্বাস করেছিলাম।
দেখুন ম্যাডাম এটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে বাড়ির লোকেদের কাজ।
হয়তো তাই।
হয়তো নয় ম্যাডাম, আমরা এরকম কত কেস হ্যান্ডেল করি আপনি ভাবতে পারবেন না। 
এই শালা, শুয়োরের বাচ্চা, আমাকে চড় মারার অধিকার কে দিয়েছে? Who the hell gave you the right to slap me? U know who am I? I will show u in sometime…
আপনি চুপ করে বসে থাকুন।
my father has reported to you, right? What did I do? U cannot treat me like a criminal, Hey, you, am I a criminal? Why are you treating me as a criminal?
আপনাকে কেউ কিছু বলেনি, চুপ করে বসতে বলা হয়েছে।
বাইরে এই কাজিয়াটা কতক্ষণ ধরে চলছে। বোঝাই যাচ্ছে এই লোকটি মদ খেয়ে বাড়িতে হয় ভাঙচুর করে বা বাবার গায়ে হাত তোলে। তাই বাবা কমপ্লেন করেছে পুলিশ তুলে এনেছে, এবং অতি বাড়াবাড়ি করায় একটা চড় মেরেছে, ঠোঁটটা কেটে গেছে খানিকটা।
লোকটা ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে। ইংলিশ বেশি। আমি হেসে বলেই ফেললাম- মাতাল ইংলিশ জানা হলে খুব মুশকিল। পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন -হ্যাঁ’ ।
এই ভাই তুমি আমাকে কিছু বলার কে? একজন কনস্টেবলকে বলছে লোকটা।
 ‘u r a schedule caste, right?’ লোকটা সিডিউলড্ ট্রাইবই হবেন, চেহারার বৈশিষ্ট্য ছোটনাগপুর অঞ্চলের বাসিন্দাদের মত।
 U r a bloody scheduled caste, আমাদের পায়খানা পরিষ্কার করতিস তোরা, আমাদের পেচ্ছাপ বয়ে নিয়ে যেতিস তোরা, আর আমাকে চোখ রাঙানো? Bloody, son of a beech’. 
আপনি চুপ করে ওখানে বসবেন?
লোকটা ওই কথাটাই নানাভাবে বলতে লাগলো। তোর বাপ দাদারা তো মেথর ছিল, হঠাৎ করে পুলিশ হয়ে মাথা কিনে নিয়েছিস?
কনস্টেবল ভদ্রলোক এসে বললেন -স্যার বাপ তুলে অনেকক্ষণ থেকে গালাগালি দিচ্ছে।
হুঁ শুনছি তো।
আর কতক্ষণ চুপ করে থাকবো স্যার?
স্যার উত্তর দেন না।
আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার স্বামী কী করেন?
ব্যবসা।
কীসের?
একটা ফুড চেনের সঙ্গে।
প্রাইমারি আর্নিং মেম্বার কে?
আমি।
ও, তাহলে নির্ঘাত কিছু সমস্যায় পড়েছিল ব্যবসায়, বেচে দিয়েছেন।
দেখুন, আমার কাছে কারো বিরুদ্ধেই কোন প্রমান নেই। আমার শ্বশুরও করতে পারেন। ওনার বিরাশি বছর বয়সেও একজন বাইরের মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে।
স্যার,আবার বলছে উল্টোপাল্টা।
মাদারচোদ, তোর ইংলিশ তোর গাঁড়ে ঢুকিয়ে দেবো-
বলে পুলিশ ইনস্পেক্টর ওঠে।
আমি ভাবি, দেবে বোধহয় ডান্ডার বাড়ি। গিয়ে খুব চিৎকার করে বলে ;একটা কথা যদি শুনি আর লকআপে ঢুকিয়ে ডান্ডা দেব এমন না, ইংলিশ বলার উপযুক্ত থাকবেন না। চুপ করে বসুন। বসুন বলছি।
Ok, Ok, I am saying sorry to him, Sorry bhai. I apologise. আরে বলছি তো I apologise.
এবারে ওটা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান শুরু হল।
এবারে আমার FIR টা নিয়ে ছাড়ুন আমাকে।
ম্যাডাম, পুলিশকে এতভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে যে আমরা মারতেও পারিনা, আর এসব মাতাল থানার মধ্যে দাঁড়িয়ে কনস্টেবলকে অপমান করে।
আমার FIR টা? তিনঘণ্টা হয়ে গেছে।
দাঁড়ান, misappropriation – এর কেস। আমরা হঠাৎ নিয়ে নিতে পারি না। দুজন গেছে আপনার ওখানে এনকোয়ারি করতে। তারা এলে হবে।
তারপর তারা আমার পুরোন ভাড়া বাড়ি গেলেন, পাঁচবার ফোন করলেন ডিরেকশন জানার জন্য, তারপর নতুন বাড়ি গেলেন, এখন যেখানে ভাড়া থাকি। তারপর শ্বশুরের সঙ্গে কথা বললেন।
বরের ফোন এলো, তোমার পাঠানো পুলিশ ফোন করেছিল আমায়। আমি বলে দিয়েছি, আমি ব্যস্ত আছি। আসতে পারবো না। 
তুমি না ফিরলে তো ওরা ফিরবেন না, আমাকে থানায় বসে থাকতে হবে।
তুমি আমার কথা না শুনে FIR করতে গেছো
Let u be harassed, let your police be harassed…
ও, আচ্ছা।
ওরা ফিরলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম এবার তো নেওয়া হবে FIR?
ম্যাডাম, বসুন, নেওয়া হবে।
আর কত বসবো? না, উনি অ্যাডিশনাল ওসিকে বলতে গেছেন সবটা, তারপরে।
আমি জোর করে ঢুকেই পড়লাম অ্যাডিশনাল ওসির ঘরে, এটা কি মজা হচ্ছে স্যার? আমি একজন মহিলা পাঁচ ঘণ্টা ধরে থানায় বসে আছি একটা FIR করার জন্য, এখনো আপনারা FIR টা নিচ্ছেন না?’
আপনার কাজ করতেই তো ওরা গিয়েছিলেন।
ফিরেও তো এসেছেন।
বসুন, করে দিচ্ছে।
না, বসবো না, আর কিছুতেই বসবো না। পেট ব্যথায় মরে যাচ্ছি, আপনারা আমাকে ফালতু ডিটেইন করাচ্ছেন।
এখুনি করে দিচ্ছে, যান ও ঘরে, সুরজিত করে দেবে।
সুরজিৎ মানে এতক্ষণ যে পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে আমি বসে কথা বলছিলাম, সে আমার কেসের ইনভেস্টিগেটশন অফিসার নয়।
সুরজিৎ বাবু নেই। উনি কোথায়?

আরো পড়ুন: তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: বেলা অ-বেলার গান । রাজীব কুমার ঘোষ


উনি বোধহয় একটু বাইরে গেছেন, একটু বসুন।
একটুও আর বসবো না।
সুরজিৎ এলেন।
কেন আমি লেখাবো কমপ্লেইন? এই কর বাবু, এই দাস বাবু আপনারা চাকরি করেন না, সব আমার বাপের দায় নাকি? আমি কেন লেখাবো?
বড়বাবু বললেন- আমার শরীরটা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে স্যার, আমি পারছিনা।
আমি বললাম, আপনাদের ক্যাচালটা পরে করবেন। একটু, আমাকে ছাড়ুন।
তারপর লেখা হল কমপ্লেইন। সুরজিৎ বললেন, আমি লিখলাম। 
ওরা সরাসরি অ্যাকিউজ করতে বলছিলো, আমি কিছুতেই করলাম না। সেই নিয়ে আবার ওরা অ্যাডিশনাল ওসিকে দেখিয়ে আনলো। কিছুক্ষন নাটক চললো। তারপর একটা লাইন যোগ করে সম্পন্ন হল কমপ্লেইন।
সুরজিৎ আমাকে বলল, একটা এবার ক্যাব বুক করে নিন।
আমি করে নিলাম। দু মিনিট দেখাচ্ছে , ঘড়িতে এগারোটা পনেরো। বাড়ি থেকে ফোন এসেছে কুড়িটা। প্রথমটা ধরেছিলো যাতে একটাই শাসানি ছিল ,ক’র না FIR, ফিরে এসো। পরেরগুলো ধরিনি আমি।
দিন FIR নাম্বারটা, আমার ক্যাব এসে গেছে। FIR Copy তে এই কমপ্লেইনটা তুলতে গেলে আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। কাল এসে নিয়ে যাবেন।
মানে?এতক্ষন আমি বসে থাকলাম কেন যদি FIR কপিই না পাই?’
ম্যাডাম, আসল কাজতো হয়েই গেছে।
এখন কপিটা কাল যখন খুশি এসে নিয়ে যাবেন। আজই উঠে যাবে, আমরা কমপ্লেইনটা রিসিভ করে দিচ্ছি। ডোন্ট ওরি।
I am very much disappointed and disgusted by the kind of service u have provided. You have wasted my 5 hours.
ক্যাবে উঠে গেছি আমি। পিছনে পড়ে রয়েছে একটা ভারতবর্ষ, শ্রেণী বিদ্বেষের, জাতি-বিদ্বেষের, অবিশ্বাসের, ঠগবাজির।
সামনে পড়ে রয়েছে একটা পথ, আজ থেকে গন্তব্যটার নাম শুধু আর বাড়ি রইল না।
ক্যাব চলতে থাকে। সুচরিতা মন দিয়ে লড়াইয়ের পথ গুলো চিনতে থাকে। হাতে ধরা একটা ফোন যেখানে প্রিয় সম্বোধনগুলো চিরতরে মুছে গেছে। সংসারেও সেকেন্ড ক্লাস কিছু সিটিজেন থাকে ওই কনস্টেবলটির মতো। যাদের থেকে যুগ যুগ ধরে ঘাড় নিচু করে সার্ভিস আশা করা হয়। চশমার কাঁচ মুছে নিই। ঝাপসা চোখে সোজাসুজি তাকাতে চাই না, পরিষ্কার কাচের মধ্যে থেকে চোখে চোখ রেখে কথা বলার জন্য তৈরি হতে থাকি আমি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত