| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-৫) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
যুধিষ্ঠির খুব স্বাভাবিক ভাবেই বসে ছিলেন। তাঁর মুখ দেখে মনের কথা বোঝার উপায় ছিল না। দ্রৌপদীকে দেখে তাঁর মুখে আলো জ্বলে উঠল। 
“এসো কৃষ্ণা। আমার পাশে এসে বসো। এমন ভাবে তুমি মুখ ফিরিয়ে থাকলে আমার কী ভালো লাগে? অর্জুনকে ছেড়ে একটু আমার কথাও ভাবো। আমি কি তোমাকে প্রাণাধিক ভালো বাসি না”? 
বনজঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা কন্যা নগরের মেয়েদের মতো ছলাকলা জানেন না। তাঁর প্রেম যেমন তীব্র, তাঁর অভিমান আর ক্রোধও। কোনও কথা বলার হলে তিনি সরাসরি বলে দিতে জানেন। অথচ বোঝেন না তাঁর কথার, আচরণের এই তীব্রতা সামনে বসা পুরুষের মনে কামের জ্বালা আরও বাড়িয়ে তোলে। 
যুধিষ্ঠিরের কথায় অর্জুনের উল্লেখ দ্রৌপদীকে বিরক্ত করে তুলল। যুধিষ্ঠির তো বলতেই পারতেন, “আমি তোমাকে ভীষণভাবে চাই কৃষ্ণা। আমার থেকে দূরে সরে যেও না। তোমার মনের যা কিছু ভাবনা, আমাকে খুলে বলো। আমি তোমার সঙ্গে আছি। থাকব”। এই নগরের মানুষেরা, রাজারাজড়ারা কেন সহজ কথা সহজ ভাবে বলেন না! উল্টো দিকে সহজ কথা সহজভাবে শুনতেও চান না!
 দ্রৌপদী চুপ করে বসে রইলেন। তাঁর এখন উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ বিনুনি আস্তে আস্তে খুলতে লাগলেন। ভারী গয়নার ভার এক এক করে নামিয়ে রাখলেন। তাঁর এই নীরব থাকা আর গয়না খুলতে থাকা যুধিষ্ঠিরকে উত্তেজিত করে তুলল। মনে ঈর্ষার সঙ্গে তাঁর কাছে কৃষ্ণার থাকার সময় শেষ হয়ে আসছে, এবার একটি বছরের জন্য দ্রৌপদী ভীমের সঙ্গে থাকবেন, এই চিন্তাও তাঁর কামকে বাড়িয়ে দিল। নকুল সহদেবকে নিয়ে তিনি ততোটা ভাবিত নন। তিনি জানেন ওই দুই ছোট ভাইয়ের প্রতি কৃষ্ণার আবেগ অনেকটাই বাৎসল্যজনিত। কৃষ্ণা নকুল সহদেবকে স্নেহ করেন। আর ওরাও বড় তিন ভাইয়ের পর নিজেদের পালা এলে নিজেদের দেবরত্বের ভাবটি পুরোপুরি ভুলতে পারবেন না। সব খোঁজই যুধিষ্ঠির রাখেন। নিজের ভাইদের মনোভাব সম্পর্কে তো বটেই।
যুধিষ্ঠির বিছানায় বসে দেখছেন দ্রৌপদীর উন্মোচন। বিনুনী খোলা হয়ে গেল। ঘন কালো ঈষৎ কোঁকড়ানো চুল যেন পেখমের মতো দ্রৌপদীর পেছনে পাখা মেলল। গলার হার একে একে সরতেই কালো গলাতে পরণের সোনার কাজ করা কাপড়টি জ্বলজ্বল করে উঠল আরও। হাতটি থেকে বাজুবন্ধ, বালা খুলে নিতেই কালো লম্বা নিরাভরণ বাহুদুটি যুধিষ্ঠিরের বুকে যেন সাপের মতো ছোবল মারল। পাণ্ডুপুত্র আর স্থির থাকতে পারলেন না। যে কোনও বিপদে স্থির মস্তিষ্ক রাখতে পারলেও এই একজন নারীর সামনে তাঁর স্থৈর্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। কৃষ্ণাকে বিছানায় শুইয়ে তাঁর বাকি আবরণ আভরণ ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগলেন তিনি। পাগলের মতো কৃষ্ণার দুই স্তন পেষণ করতে লাগলেন। তাঁর তপ্ত ঠোঁট খুঁজতে লাগল কৃষ্ণার সামান্য মোটা রসে ভরা ঠোঁট। যুধিষ্ঠিরের এই চরম উত্তেজনার মধ্যে কৃষ্ণা উঠে বসলেন। যুধিষ্ঠিরকে সরিয়ে গায়ে কাপড়টি জড়ালেন। খোলা চুলের রাশিটি হাত ঘুরিয়ে উঁচু করে বেঁধে নিলেন। তাঁকে এমন অচেনা লাগতে শুরু করল। ধকধকে চোখে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আমার অনুমতি বা ইচ্ছা ছাড়া আর কখনও আমার শরীরে হাত দেবেন না। মনে রাখবেন, আমি আপনার স্ত্রী হলেও আমার শরীরে আমার অধিকারটাই আসল। আপনি আমার স্বামী, প্রজাদের মহারাজ হলেও এই অধিকার আপনার নেই”। স্তম্ভিত যুধিষ্ঠিরকে একা বিছানায় রেখে কৃষ্ণা বেরিয়ে এলেন। অনেক দিন পর নিজের বনচারী রূপটা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল। নিজের ঘরে এসে শ্বাস নিলেন তিনি। গভীরভাবে। এইভাবে কতদিন আটকাবেন? যুধিষ্ঠিরকে আটকালেও ভীম যে বড় অবুঝ! তিনিও যে কৃষ্ণাকে বড়ই ভালোবাসেন। অহম্ নেই তাঁর। শুধুই প্রেম। কিন্তু তাঁর ধৈর্য্য বড়ই কম। তিনি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারেন না। আবার কুস্তির মারপ্যাঁচ আর গদাযুদ্ধও তাঁর খুবই প্রিয়। কিন্তু সেই সবের বিবরণ শুনতে দ্রৌপদীর ইচ্ছা করে না। ক্লান্ত বোধ করেন। অবশ্য তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন দেখলে ভীম একেবারে চুপ করে যান। আর কিছুক্ষণ পরেই শিশুর মতো তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। 
নিজের ঘরে বসে একটি একটি করে বারো বছরের দিন রাত মনে করে যাচ্ছেন তিনি। বারো বছর ধরে এই ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করে আছেন। এই বছরটি সহদেবের। যুধিষ্ঠির ছাড়া আর কেউই তিনি নিজের এই ঘরটিতে থাকলে তাঁকে বিরক্ত করেন না। আর যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই তাঁকে সবথেকে বেশি সময় কাটাতে হয়। তিনি যে পট্টমহিষীও। আর শুধু সেজেগুজে বসে থাকতে তো তিনি পারেন না। ফলে রাজকাজে তিনিও সমানভাবে মাথা দেন। দিন তবু কোনও রকমে কেটে যায়। কিন্তু সূর্য্য পাটে ডোবার সময় হলে, রাজপ্রাসাদের কোণে কোণে দাসীরা পিদ্দিমে আলো জ্বালানো শুরু করলেই তাঁর মনটা কেমন হু হু করে ওঠে! কী করছেন অর্জুন? তাঁর কথা ভাবছেন কি? তিনি যেমন ছটফট করছেন, সেই একই রকম ছটফটানি কি অর্জুনের মধ্যেও? এই ভাবনার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল একাধিকবার করে যুধিষ্ঠির ভীম নকুল সহদেবের সঙ্গে বাসের পালা।
 সহদেবের সঙ্গে রাত কাটাতে দ্রৌপদীর ভালোই লাগে। সহদেব অনেকটাই যেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে মনে করিয়ে দেয়। যা শাস্ত্র সহদব পড়েন, যা শস্ত্র অভ্যাস করেন, সে সব কৃষ্ণার সঙ্গে ভাগ করে নেন তিনি। গরু আর ঘোড়া নিয়েও সহদেবের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আর পড়াশোনা। তাই গোশালা বা ঘোড়াশালে কেউ অসুস্থ হলেই কৃষ্ণা সহদেবের পরামর্শ নেন। তাছাড়াও সহদেবের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বেশ ভালো। কারুর কথার মধ্যে দিয়ে, মুখের ভাবের মধ্যে দিয়ে মনের কথা আন্দাজ করতে পারেন। তাই কৃষ্ণার কষ্ট বুঝে নিতে তাঁরও  সময় লাগে না। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা ব্যক্তিত্ব, কিছুই তাঁর নেই। তিনি শুধু কৃষ্ণার হাত ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকেন। বা অনেকসময়ই দুজনে মিলে মহলের ছাদে চলে যান। দ্রৌপদীর কোলে মাথা দিয়ে সহদেব নক্ষত্র চেনাতে থাকেন। রাতের অন্ধকারে, ফুটফুট করা তারার আলোয় দ্রৌপদীও অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। ফিরে যান ছোটবেলায়। যখন তারা দেখেই সময় গণনা, ঋতু বোঝা শিখেছিলেন মায়ের কাছে।

আরো পড়ুন: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-৪) । রোহিণী ধর্মপাল


সেই সহজ সুস্বাদু জীবন কেমন দ্রুত ফুরিয়ে গেল। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় জঙ্গলে থেকে গেলেই হত! তখন রোমাঞ্চকর জীবনের হাতছানির লোভে পড়েছিলেন। এখন আর কোনও ভাবেই ফেরার উপায়ও নেই। ভাইও তো বিপদে পড়ে যাবে। তাছাড়া শুধু ক্ষত্রিয়রা নয়, তাঁরা বনবাসীরাও কাউকে সাহায্য করার কথা দিলে তা থেকে সরেন না। পাঞ্চালরাজাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞাও তো পূরণ করতেই হবে। সুতরাং এইভাবেই কাটতে লাগল বছরের পর বছর।
বারো বছর যখন প্রায় শেষের পথে, দ্বারকা থেকে দূত এল। অর্জুনের। যুধিষ্ঠিরের কাছে। গোপনে। সেই সংবাদ পেয়ে সেই রাতেই কৃষ্ণা গেলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। তিনি তো স্বাধীন। তিনি চাইলেই প্রধানা মহিষী বলে মহারাজের কাছে যেতেই পারেন।যুধিষ্ঠির যেন তাঁর জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন।
 “এসো কৃষ্ণা। অর্জুনের খবর জানতে চাও তো”? “হ্যাঁ। আপনার কাছে অর্জুন বার্তা পাঠিয়েছেন, এ খবর আমি পেয়েছি। আমরা সবাই তাঁর খবরের জন্য উদ্বিগ্ন। অথচ আপনি কাউকেই কিছু জানান নি। এমনকী, খবর এসেছে, সেটুকুও গোপন রেখেছেন”। যুধিষ্ঠির মৃদু হাসলেন। 
“তোমার কাছে তো গোপন করতে পারিনি পাঞ্চালী! তুমি তো ঠিক জেনে গেছ”। 
“জেনেছি, কারণ প্রতি মুহূর্তেই আমি তাঁর কাছ থেকে সংবাদ আশা করছিলাম কিছুদিন ধরেই। জেনেছি, কারণ আপনার চোখমুখ ঝলমল করছে অনেকদিন পর। জেনেছি, কারণ মা কুন্তীর ঘরে আজ আপনি অনেকক্ষণ কাটিয়েছেন। এ কথা বোঝা কঠিন নয় যে অর্জুনের খবর এসেছে”!
“বাঃ! চমৎকার তো তোমার বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা! একেবারেই যথার্থ ধরেছ তুমি। খবর এসেছে বইকী। তবে একা অর্জুনের নয়। অর্জুন কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে বিয়ে করছে। তাঁকে নিয়ে এখানে আসার অনুমতি চেয়েছে। আমি সানন্দে সেই অনুমতি দিয়েছে। মাও একই কথা বলেছেন”।
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত