| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-৫) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
তিনি ভারতসম্রাজ্ঞী। অথচ পারিবারিক কোন্দল আর ঈর্ষার কারণে সভামধ্যে পরিবারের মানুষেরাই কাপড় খুলে তাঁকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করল। রাজকোষ পরিচালনার দক্ষতা যাঁর ছিল, তাঁকে সাজগোজ করানোর কাজ নিতে হল। যাঁকে চেয়েছিল ভারতবর্ষের তাবৎ পুরুষ, তিনি নিজের বাঞ্ছিত প্রেম পেলেন না। দুইটি পুরুষের পারস্পরিক প্রতিহিংসা সাধনের কারণে তাঁর নিজের জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। নারী যুদ্ধের কারণ? না পুরুষের অহমের আগুনে নারী বলিপ্রদত্ত জন্ম থেকেই? একাকিনী। এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব তেজে ভরপুর অথচ একা এক নারীকে। আজ থাকছে একাকিনীর পর্ব-৫।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, যুথিষ্ঠীর


উপরের ছবিটি দিয়ে শুরু করছি একাকিনীর পঞ্চম পর্বটি। একটা ধাক্কা দিতেই। চতুর্থ পর্ব শেষ হয়েছিল দ্রৌপদীর রূপযৌবন দেখে কামার্ত রাজকূল থেকে সাধারণ মানুষ থেকে ছদ্ম বেশে আসা পঞ্চ পাণ্ডবদের দিয়ে। তাহলে তো তার পরে প্রাচীন বেশভূষায় সজ্জিত, উচ্ছলিত স্তনভার কাঁচুলি থেকে উথলি পড়িয়া যায়, অথচ পীন সেই পয়োধরযুগল, মধ্যে ক্ষীণা, তণ্বী শ্যামা, ডালিম ফলের মত টুকটুকে রসে ভরা ঠোঁট দুখানি, সদ্যস্নাতা, ভেজা ভেজা গা একটি লোভনীয় নারী শরীরের ছবি দেওয়া উচিত ছিল। পুরুষ তো নারীকে চিরকালই এমন ভাবেই দেখতে চেয়েছে। দেখতে চেয়েছে, কামার্ত হতে চেয়েছে আর একান্ত নিজের করে পেতে চেয়েছে। এই মেয়েটি শুধু আমার। আমি কিন্তু যে কারুর হতে পারি। কামার্ত হওয়া আমার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু একটি মেয়ে, সে অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট না হলেও পুরুষের যদি মনে হয় তার স্ত্রী কারুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে পারে, বা সে নিজে যদি জানে, সে তার স্ত্রীর থেকে খানিকটা হলেও নিচুতে আছে, তখন সে হিংস্র হয়ে যায়। আর যদি স্ত্রীর আরও উপরে ওঠার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে, তখন উন্মাদ হয়ে যায়। রাগে আর ঈর্ষায়। তখনই কেতুগ্রামের রেণু খাতুনের মতো মেয়ের ডান হাত কাটা পড়ে। কে কাটে? তার প্রেমিক, যে এখন স্বামী, সে সেই সিদ্ধান্ত নেয় আর কাজে পরিণত করে। এখানেই দ্রৌপদী আলাদা। পঞ্চপাণ্ডব আলাদা। মহাভারতের সময়টা কিছুটা হলেও আলাদা।
স্বয়ংবর সভায় একের পর এক রাজা, যুবরাজ, রাজপুত্ররা পরাজিত হতে থাক। আমরা একটু বড়সড় লাফ দি। হনুমানের সমুদ্র পার হওয়ার মতো না হলেও আদি পর্ব থেকে সভাপর্বের শেষ দিকে আসি। দ্যূতক্রীড়া বা পাশাখেলা শেষ। যুধিষ্ঠির একে একে সব হেরেছেন। যদিও খেলা শুরুই হয়েছিল একটি বেআইনি নিয়ম দিয়ে। পণ দেবে দুর্যোধন আর চাল চালবে শকুনি। যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে রাজি হয়েছিলেন ঠিকই। তবে বারবার আপত্তিও জানিয়েছিলেন খেলা আরম্ভ করার আগে। প্রথমত যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলার জন্য নেমন্তন্ন অফিসিয়ালি করেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। আর মৌখিক ভাবে সেই নেমন্তন্ন পাঠানো হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের প্রিয় কাকা বিদুরের মারফত। ফলে কোনও ভাবেই যুধিষ্ঠিরের হস্তিনাপুর না এসে উপায় ছিল না। দুর্যোধন, শকুনি আর স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র ভালো করেই জানতেন এ কথা যে যুধিষ্ঠির এই ডাক এড়াতে পারবেন না। কারণ পাশাখেলার প্রতি আসক্তি নয়, বরং গুরুজনের প্রতি বিশ্বাস আর ভক্তি। বোধ হয় সেই জন্যই গীতাতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যিনি অশুভ পক্ষে বিরাজমান হন, বয়সে বড় হলেও, এমনকী নানাভাবে তোমার শ্রদ্ধেয় হলেও তার প্রতি কোমল হলে চলবে না।

আরো পড়ুন: একাকিনী (পর্ব-৪) । রোহিণী ধর্মপাল


যুধিষ্ঠির তাই সবার সামনেই, শকুনিকে বলেছিলেন “এই খেলাতে দিব্যি চিটিংবাজি (শঠতা) করা যায়। এই খেলাতে বীরত্ব দেখানোর জায়গাও নেই। নীতি মেনে চলাও খুব একটা হয় না। সুতরাং এমন খেলার কী প্রয়োজন! কাউকে ঠকিয়ে কিছু পাওয়ার তো কোনও মানেই হয় না”! তখন শকুনি যুধিষ্ঠিরের, ক্ষত্রিয়ের বা সাধারণ ভাবে বলা যায় যাতে পুরুষের ইগো আহত হয়, এমন কথাই বললেন। “যদি তে বিদ্যতে ভয়ম্ অর্থাৎ যদি তুমি ভয় পেয়ে থাকো, তাহলে বাপু ছেড়ে দাও। খেলতে হবে না।”
সুতরাং যুধিষ্ঠির জেনেশুনে বিষ করিলেন পান। এমনকী, শুরুর বেআইনি আইনটিও মেনে নিলেন।
যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে খেলা শুরুর প্রথম পণটি ছিল সমুদ্র থেকে পাওয়া একটি দুর্মূল্য দুর্লভ রত্ন। হার শুরু হল সেইটি দিয়ে, শেষ হল দ্রৌপদীকে দিয়ে। সেই সভায় দ্রৌপদী কিভাবে নিজের শাস্ত্রজ্ঞান, উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস ইত্যাদি দেখিয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গে এখন আসব না। আসব দ্রৌপদীর নির্যাতনের চেষ্টার শেষে, যখন ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীকে ভয় পেয়ে– হ্যাঁ, ভয় পেয়েই বলব, কারণ এই সমস্ত কিছু তো আসলে ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছেতেই হচ্ছিল– তাঁকে ঘটা করে প্রশংসা করে বললেন, “তোমার যা ইচ্ছে, তেমন বর চাও”। এবং দ্রৌপদী প্রথমে যুধিষ্ঠির, পরের বরে বাকি চার পাণ্ডবের মুক্তি চাইলেন তাঁদের হৃত সমস্ত ধনসম্পদ সহ।
এইবার শুরু হল ঠাট্টা। কর্ণকে আমরা বড়ই করুণ, বেচারা, আহারে গোছের চরিত্র করে রেখেছি। কর্ণ মোটেও ততোটা বেচারা ছিলেন না। তিনি বলতে শুরু করলেন এমন সব কথা, যার সোজা বাংলা করলে দাঁড়ায় যে এই “বীরপুঙ্গবেরা বউয়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়ে রক্ষা পেল! পাঁচ ভাই তো হালবিহীন আশ্রয়বিহীন নৌকার মতো ডুবে গেছিল। দ্রৌপদী শক্ত হাল হয়ে তাদের পার করল”।
 এই ধরণের কথায় বেশির ভাগ প্রভুরাই চটে ওঠেন। তোমার এখানে কথা বলার কী দরকার”! “তুমি চুপ করো। যা বলার আমি বলব”! নিদেনপক্ষে, সেই পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকতে বাধ্য হলেও ঘরে এসে হম্বিতম্বি করে থাকেন। এমন কী, নিজের অপমানের জন্য স্ত্রীকেই দায়ী করে সমস্ত রীষটুকু তার ওপরেই ঝাড়েন। এখানে কিন্তু তখনও বা পরেও, পাঁচ বীর ভাই দ্রৌপদীকে কখনও এই নিয়ে কোনও রকম কটূক্তি করেন নি। যে শ্রদ্ধা দ্রৌপদীর প্রাপ্য, তা তাঁরা দেখিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত