| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিতে ‘মা’

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

সারদা সুন্দরী দেবীর পনেরোটি সন্তানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন চৌদ্দতম। তার কনিষ্ঠ সন্তান ‘বুধেন্দ্র নাথ’ খুব ছোট বয়সে মারা যাওয়ায় রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন সংসারের ছোট ছেলে। আর সংসারের একেবারে ছোট সন্তান একটু বেশিই আদুরে হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের বেলাও তেমনটি হয়েছিল। তবে মাকে খুব একটা কাছে পাননি তিনি। কবির বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর ১০ মাস, তখন তিনি মাতৃহারা হন। তার স্মৃতিতে মায়ের উপস্থিতি খুব একটা ছিল না। মায়ের মৃত্যুর পরও তিনি মাকে নিয়ে কোনো কবিতা লেখেননি। বরং তার সাহিত্যকর্মে দেশমাতৃকা, জগজ্জননী অথবা নিজের সৃষ্ট চরিত্রের মায়ের কথা উল্লেখ আছে। মা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মা হচ্ছেন জগজ্জননী। তার চেয়ে শান্তির ঠিকানা আর কোথাও নেই।’

মা তাকে কেমন স্নেহ করতেন, আদর করতেন, সেসব স্মৃতির প্রতিফলন কবি রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় না। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঘরোয়া’-তে রবীন্দ্রনাথের মাতৃস্মৃতি উদ্ধৃত করেছেন কবির জবানিতে, ‘মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তার ঘরে তক্তপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।’

সারদা সুন্দরী দেবী সন্তানদের প্রতি মনোযোগ দিতে পারতেন না, সেকথা ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়। বস্তুত পক্ষে, সন্তানদের ব্যাপারে সারদা দেবীর এই উদাসীন্য তার মন থেকে ছিল না, তা ছিল বনেদি বাড়ির প্রতিষ্ঠিত প্রথা। তবে কনিষ্ঠ পুত্রটির সঙ্গে তার মায়ের একটু ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধই ছিল।

রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন স্মৃতিকথার সূত্রে জানা যায়, মায়ের ঘরে রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র শয্যায় শুতেন। মা কোনো দিন গল্প শুনিয়ে বা ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে তাকে ঘুম পাড়াতেন কি না এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে কবি তার ‘জীবনস্মৃতি’-তে বলেছেন, ‘ভ‚তের ভয় শিরদাঁড়ার ওপর চাপিয়ে চলে যেতুম মায়ের ঘরে। মা তখন তার খুড়িকে নিয়ে তাস খেলছেন…. এমন উৎপাত বাধিয়ে দিতুম যে, তিনি হাতের খেলা ফেলে দিয়ে বলতেন ‘জ্বালাতন করলে, খুড়ি ওদের গল্প শোনাও গে’। আমরা বাইরের বারান্দার ঘটির জলে পা ধুয়ে দিদিমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় উঠতুম। সেখানে শুরু হতো দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে আনার পালা। মাঝখানে আমারই ঘুম ভাঙায় কে।’


আরো পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের মা । শুভেন্দু দাসমুন্সী


মায়ের স্বাভাবিক সস্নেহ প্রশ্রয় থেকে বঞ্চিত হননি রবীন্দ্রনাথ। যাত্রাপালা দেখার ইচ্ছে নিয়ে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়া রবীন্দ্রনাথকে ঠিক সময়ে জাগিয়ে দিয়েছেন মা। মাস্টার এসেছেন পড়াতে, আর তিনি পড়া ফাঁকি দিতে চান। বানিয়ে মাকে বলতেন পেট কামড়ানির কথা। তারপর, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয়নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, আচ্ছা যা মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না।’

ঠাকুরবাড়ির সব ছেলেকেই ছোট বেলায় পালোয়ানের কাছে কুস্তি শিখতে হতো। এতে গায়ে বেশ মাটি মাখামাখি হতো। কবি লিখেছেন, ‘সকাল বেলায় রোজ এত করে মাটি ঘেঁটে আসা ভালো লাগত না মায়ের, তার ভয় হতো ছেলের গায়ের রং মেটে হয়ে যায় পাছে। তার ফল হয়েছিল, ছুটির দিনে তিনি লেগে যেতেন শোধন করতে। শোধনক্রিয়ার সামগ্রী হিসেবে থাকত বাদাম-বাটা, দুধের সর, কমলালেবুর খোসা, আরো কত কী…।’

‘জীবনস্মৃতি’তে কবি আর এক জায়গায় লিখেছেন : ‘মনে পড়ে বাড়ি-ভিতরের পাঁচিল-ঘেরা ছাদ। মা বসেছেন সন্ধ্যেবেলায় মাদুর পেতে, তার সঙ্গিনীরা চারদিকে ঘিরে গল্প করছে। এই সভায় আমি মাঝে মাঝে টাটকা পুঁথিপড়া বিদ্যের আমদানি করেছি…. পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সবার চেয়ে বেশি বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম। তিনি অত্যন্ত খুশি হইয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি’। রামায়ণের টুকরো আউড়ে দিয়েছি অনুস্বার-বিসর্গ-সুদ্ধ। মা জানতেন না তার ছেলের উচ্চারণ কত খাঁটি, তবু তার বিদ্যের পাল্লা….তাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।’

মায়ের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ হাহাকারে আচ্ছন্ন হয়েছিলন। তবে তা চিরস্থায়ী হয়নি। মাকে স্মরণ করে কবি লিখেছেন, ‘…বড়ো হইলে যখন বসন্ত প্রভাতে একমুঠা অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেলফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম। তখন সেই কোমল চিক্কণ কুঁড়িগুলি ললাটের ওপর বুলাইয়া প্রতিদিন আমার মায়ের শুভ্র আঙুলগুলি মনে পড়িত। আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম যে স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল, সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে…।’

পরিণত মধ্য বয়সেও কবির মনের মাঝে মাতৃস্মৃতি পুনরায় ফিরে আসে। এর প্রমাণ মেলে, ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতন মন্দিরে প্রদত্ত এক উপদেশে। সেখানে তিনি তার দেখা এক স্বপ্নের উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন ‘…আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি, আমি নিতান্ত বাল্যকালে মাতৃহীন। আমার বড় বয়সের জীবনে মার অধিষ্ঠান ছিল না। কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম, আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি। গঙ্গার ধারের বাগান বাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন। মা আছেন তো আছেন। তার আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না। আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তার ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম। বারান্দায় গিয়ে এক মুহূর্তে আমার কী হলো জানি নে। আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে, মা আছেন। তখনই তার ঘরে গিয়ে তার পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এসেছ!’ এইখানে স্বপ্ন ভেঙে গেল।’

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত