অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২০) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা।
(২০)
শ্রীমানের সেলফোনটা সাংঘাতিক লয়ে বেজে উঠেছিল।
সে এসেছিল তৈ্রি হতে থাকা বিল্ডিংটার একেবারে ওপর মহলে।
সকালবেলা বাবার সঙ্গে একসঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরে সে কনস্ট্রাকসন সাইটে পৌছেই সোজা একেবারে ওপরে উঠে এসেছিল।বাবা নিশ্চয় এখন নিচের কোনো একটি মহলে কাজ দেখে মিস্ত্রির সঙ্গে তর্ক করছে।সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসে সে একটা আরাম চেয়ারে বসে পড়েছিল।
একা একা বসে সে নানা কথা অসংলগ্নভাবেভাবছিল।জারণির পাশে বাম গর্তে পুঁতে রাখা সেই ছেলে দুটি।আচ্ছাওরা কোথাকার ছিল?কোথায় বা লালিত পালিত হয়েছিল,কোন স্কুলে পড়ত-কী করত?কী ভেবেছিল ওরা,কিছু কি ভেবেছিল!গুলি করে মারার আগে ওদের হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হয়েছিল নাকি?ওরা…ওরা কি কখনও প্রেম করেছিল,জীবনে কখনও মেয়েদের ভালোবাসা পেয়েছিলকি?ইস,এসব কী ভাবছি আমি-শ্রীমান নিজেকে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে মন থেকে চিন্তাগুলি বের করে দেবার চেষ্টা করল।কিন্তু পরের মুহূর্তে নিজের অজান্তেই সে আবার ভাবতে লাগল-মরার আগে ,গুলিটা বিদ্ধ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ,ওরা কী ভাবছিল?কিছু ভাবছিল কি?মন-মস্তিষ্ক সমস্ত খালি হয়ে পড়েছিল নাকি?বালিরখাদানের মরা মানুষটা কী ভাবছিল?
সেই সময়েই সাঙ্গীতিক লয়ে টেলিফোনটা বেজে উঠেছিল।
ঘুম থেকে জেগে উঠা মানুষের মতো দ্রুত সে বেল্টে লাগিয়ে রাখা সেলফোনটা বের করে নিয়েছিল।ছোট্টস্ক্রিনটাতেরমেনের নাম ভেসে উঠেছিল।ফোনটারমেনের কাছ থেকে এসেছে-শ্রীমানের বুকটা হঠাৎ ধপধপ করে উঠল।
‘হ্যালো!’
‘তুই কোথায় আছিস?’রমেনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল।
‘এখানে,কনস্ট্রাকসনে।’
‘তুই ওখানেই থাকিস,কোথাও বেরিয়ে যাবি না।আমি আসছি।’
‘রমেন,’রমেন ফোনটা কেটে দেবার আগেই শ্রীমান বলে উঠল।
‘কী হয়েছে?’
‘খবরের কাগজ দেখেছিস?’
‘কী?’
‘দুটো যুবকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।’
‘জানি।’
‘কী ব্যাপার?’
‘তুই ওখানেই থাক,আমিআসছি।গিয়ে বলব।’
শ্রীমানের আরও চিন্তা হল।রমেনজানে।খবরের কাগজের খবর দেখার কথা বলছে না,অথচ জানে বলেছে।তারমানে সে চিন্তা করাটাই সত্যি।সত্যি আবার গোপন হত্যা আরম্ভ হয়েছে-এবার আরম্ভ হবে প্রতিক্রিয়া।দেড়-দুই বছর ধরে এসব ছিল না,আবার কেন আরম্ভ হল?সেচেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে নিঃসার হয়ে বসে পড়ল।আবার হয়তো অনেক যুবক ছেলের মৃত্যু হবে…
‘বাবা’,সিঁড়ির মুখ থেকে বাবা তাকে ডাকল।
কণ্ঠস্বর শুনে সে ধড়মড় করে চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়াল।
‘তুমি এত ওপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছকেন?’বাবাকে সে বলল।
‘মিস্ত্রিরা ঠিকমতো কাজ করছে না জান বাবা।প্লাস্টার অফ প্যারিস লাগানো ছেলেগুলি এত প্লাস্টার নিচে ফেলেছে তুই কী বলবি,দেখলে খারাপ লাগবে।দেখে যা একবার।’
‘তারজন্য তুমি এত ওপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসবে?চলচল।‘শ্রীমান বাবাকে নিচে নামিয়ে আনল।পথে বাবার দেখানো কাজ দেখে মিস্ত্রি এবং ঠিকাদারকে ধমক দিয়ে সে একেবারে নিচের অফিসে নেমে এল।
‘লিফটগুলিলাগিয়েগেছে,কিন্তু চালানোর নামগন্ধনেই,’বাবা অভিযোগ করল।
‘ট্রান্সফর্মারটাচালু হয় নাই,চালু হলেই লিফট চলবে।
রমেনের গাড়িটা এসে অপেক্ষা করাটা শ্রীমান দেখল।দেখেই সে বাবাকে বলল, ‘বাবা তুমি বিলগুলি পরীক্ষা করে দিও তো।অনেক বিল দিয়েছে সাপ্লায়ার।পেমেন্ট দিতে হবে।’
‘সব টাকা এই সাপ্লায়াররাই নিয়ে যাবে।ক’ত আছে?’
‘আলমারির ফাইলটাতে।এই চাবিটা নাও।’
বাবা তাড়াহুড়ো করে অফিসে প্রবেশ করার পরে শ্রীমান বাইরে বেরিয়ে গেল।রমেন প্রবেশ করেছিল।দুজন এবার সোজা তৃতীয় মহলে থাকা একটা ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকল।দুই একটি চেয়ার টেবিল পেতে রাখা আছে।
‘কী ব্যাপার বল তো,’শ্রীমান উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘কী আর,পুনরায় আরম্ভ হয়েছে।’রমেন বেশ নির্বিকারভাবে উত্তর দিল।
‘কেন,কীভাবে?’
‘কেন হচ্ছে কীভাবে বলবি। সব খবরাখবর রাখিনা, রাখা ও বিপদ।’
শ্রীমান মাথা নাড়ল ।রমেন পুনরায় বলে গেল, আজ কিছুদিন থেকে ছোটো ছোটোকয়েকটি দল নগরে প্রবেশ করেছে বলে একটা খবর বেরিয়েছিল। কাগজে আজকে বেরিয়েছে। একমাস আগে থেকেই খবর গুলো আসছে। কিন্তু এতটা গুরুত্ব দিইনি কারণ এই ধরনের কথা মাঝে মাঝেবেরিয়ে থাকে।’
‘এবার কী হল?’
‘এবার শুনলাম আগের সতীর্থদের মূল টার্গেট করে নিয়েছে।
‘ কখন শুনলি ?’
আজ থেকে পনেরো দিন আগে।’
‘ তারপরে?’
‘তারপরে আর কি ,খোঁজ খবর চলল বোধ হয়।’ পুলিশমিলিটারি সবাই বোধ হয়বেরিয়েছে। সেটাই হয় ।কোনো দুজনকে ধরল বোধহয়। তারপরেখতম। ‘খতম!’
‘ আজকাল ধরতে পারলে আর এরেস্ট করে না। কোর্ট কাছারির বহু ঝামেলা ।সোজাসুজি খতম করে দেয়।’
‘ কে?’
‘ কে কীভাবে বলবি। জিজ্ঞেস করার মতো কথাও নয়। এটাই আজকের কাউন্টারইন্সারজেন্সিবুঝেছিস।’
দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে বসেরইল।
‘ এবার অসুবিধাটা কি হয়েছে জানিস? এই যে বডি দুটো বেরোলো। সেই দুটো নাকি প্রথম সারির আন্ডারগ্রাউন্ডলিডারের। দশ দিন আগেই ওরা ধরা পড়েছিল।’
‘ মারল কখন?’
‘বলতে তো পারি না কখন কে মেরেছে। সঙ্গে সঙ্গেও হতে পারে পরেও হতে পারে। কে বলবে?’
‘ কিন্তু মরার পরে ডেড বডি দুটো লুকিয়েরেখেছিলকেন ?আগেলিডারদের কেউ মরলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে ফোটো টোটো দিয়ে প্রচার করা হত।’
‘ আজকাল কথাগুলো এত সহজ সরল নয়। ধরে মেরে পুঁতে রেখে দিলে কেউ জানল না: যে মেরেছে সে তো জানল! বাকি জনগণ, আন্ডারগ্রাউন্ড কেউ জানতে পারল না‐ছেলেদুটিকোথায়গেল, আছে না নাই, কোথায় আছে, কোথাও বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইছে নাকি, একটা মস্ত কনফিউশনের সৃষ্টি হবে না? এভাবেই চলে আজকের খেলা।’
দুজনেই এবার মনে মনেরইল।
‘আমি তোকে সাবধান করে দিতে এলাম। দুজন প্রথম সারির লিডারকে মারার প্রতিক্রিয়া তো হবেই। তোর আমার মতো মানুষদেরই বেশি বিপদ। আমার তো অস্ত্রশস্ত্র ও নেই। সরকারি ,বে-সরকারি সিকিউরিটি গার্ডও নেই। অথচ আমরাই কাজকর্মের সূত্রে বেশি বাইরে ঘোরাফেরা করি।’
শ্রীমান মাথা নাড়ল।
‘অন্যসময় কোনো সমস্যা নেই কিন্তু এখন যে কেউ যাকে তাকে মারতে পারে। আমাদের নিজেদের সাবধান হতে হবে। নিজেই নিজেকে বাঁচাতে হবে।রমেন দেখল তার কথা শুনে শ্রীমান ভয় পেয়েছে। তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-১৯) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
‘ভয় করিস না’রমেনবলল।‘আমি এরকম অবস্থায় অনেকবার পার করেছি, অনেকবার। মূল কথা সাবধানে বাঁচিয়ে চলতে হবে। এক মাসের মতো দেখে নিতে হবে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।তারপরে পুনরায় আগের মতো হবে।তাড়িয়েনেওয়া শিকার, শিকার মেলা সব সময় চলে না। আসলে আমি এসেছিলাম তোর কাছে গাড়িরকয়েকটি বিষয় নিয়েবুঝেছিস। তুই চালিয়ে থাকা গাড়িটাপুলিশ কোনো একটি অপারেশনে ধরে আনা গাড়ি,আমারটাও।রেজিস্ট্রেশন,রংটং সব একেবারে বদলে রাখা আছে। আবার বদলে ফেলি। বডি দুটো দুটি গাড়িরই খারাপ হয়েছে। রিপেয়ার করার জন্য দিয়ে দিই ।কেউ না কেউ গাড়িটিরনাম্বার লক্ষ্য করে রাখতে পারে। আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি। চল এখন গাড়িরনাম্বার প্লেট খুলে গ্যারেজেদিয়ে দিই। ইঞ্জিন খুব ভালো রয়েছে।রংটং করিয়ে নিলে একেবারে নতুনের মতন হয়ে পড়বে।রমেনের কথা শুনে শ্রীমান যেন ঘেমে উঠল। পকেট থেকে রুমাল বের করে সে জোরে জোরে মুখ মুছতে লাগল।
ফাইলের বিলগুলি পরীক্ষা করে থাকা বাবাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে শ্রীমান আমি একটু আসছি বলে রমেনের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।রমেনেরপেছনপেছন অলিগলির মধ্য দিয়েগিয়ে একটা গ্যারেজের সামনে ওরাদাঁড়াল। অতি সাধারণ একটা গ্যারেজ, একটাও গাড়ি নেই তাতে।
‘ এখানে ভালো করবি নাকি?’ শ্রীমান জিজ্ঞেস করল।
‘ওহো’ বলে রমেন বারিকদা বলে চিৎকার করে কাউকে ডাকল। সেখানে সে গাড়িদুটিরনাম্বার প্লেট খুলিয়েনিল। তারপরে সে দুই কিলোমিটার দূরের অন্য একটি গ্যারেজে গেল। সেখানে অন্য নাম্বার প্লেট লাগিয়েনিল। এবার গাড়ি ভালো করার জন্য নির্দিষ্ট গ্যারাজে গেল। পুরোনোনাম্বার প্লেট নর্দমায়ছুঁড়ে ফেলে দিল।
বিশাল গ্যারেজ। কুড়ি ত্রিশটা মারুতি গাড়ি, ভ্যান ভর্তি হয়ে রয়েছে। শ্রীমানকে সে অবলীলাক্রমে বঙ্গাইগাঁওয়ে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার বলে পরিচয় করিয়ে দিল। দুটি গাড়ির কী কী ভালো করতে হবে, কী রং দিতে হবে ,সমস্ত কথা বিস্তারিত বলে সে কুড়ি হাজার টাকা মালিকের হাতে তুলে দিল। তার কাজকর্ম দেখে শ্রীমান আশ্চর্য হয়ে গেল। মালিকের গ্যারেজেরগাড়ি একটা নিয়ে সে এবং শ্রীমান বেরিয়ে এসে অন্য একটি ঘরে প্রবেশ করল ।সেখান থেকে রমেন জেন গাড়িটানিল। সেখানে গাড়িটারেডি করেই রাখা ছিল।
আমার পরিচিত বন্ধুর গাড়ি,’ পথে সে শ্রীমানকে বলল।‘মাঝেমধ্যে আমি কিছুদিনের জন্য নিই। ভাড়া হিসেবে কিছু একটা দিয়ে দিই। তোর জন্যও এক জায়গায় বিকেলে আমি একটা গাড়ি দিতে বলেছি। দিয়ে যাবে। মারুতি কার। এই কয়েকদিন চালাবি।’
গ্যারাজের মালিক তোকে জানে কি জানে না?’
‘ জানেনা। বঙ্গাইগাঁওয়ের ঠিকাদার বলে জানে। মাঝেমধ্যে সেখানে কাজ করিয়ে নিই।’
রঙ্গিন গ্লাস লাগানো জেনের ভেতর বসে শ্রীমান এক ধরনের নতুন মাদকতা অনুভব করল, আসন্ন অনামী বিপদে এনে দেওয়া এক ধরনের ভয় অথচ পুলকভর্তিমাদকতা।তার মনে এক ধরনের বেপরোয়া মনোভাবএল।তারধমণীর গতি যেন দ্রুত হল,চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল এবং প্রখর হয়ে পড়ল।রক্তের শিরা দিয়ে বইতে লাগল এড্রিনেলেরস্রোত,সবগুলি স্নায়ু ধুয়ে তাকে যেন সতেজ করে তুলল।
‘আমরা এখন কী করব?’রমেনকে সে জিজ্ঞেস করল।
‘অঞ্জুদার কাছে যাব।সেখানেই ঠিক করতে হবে কী করা উচিত।
‘আজ কনট্রাক্টারদেরপেমেন্ট করার কথা ছিল।‘
‘টাকা আছে না নেই?’
‘আছে।কালকেই তুলে রেখেছি। বাবা বিলগুলি পরীক্ষা করে দেখছে।’
‘টাকা কোথায় আছে?’
‘বাড়িতে।‘
‘কাকাকে পেমেন্ট করে দিতে দে।এখন তো কাকু ভাত খেতে বাড়ি গিয়েছে বোধ হয়। চল যাই।‘
দুজন দুপুর বেলা বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।শ্রীমানের মা বেড়ে দেওয়া ভাত দুজনে খুব স্ফুর্তি করে খেল।বাবাকেপেমেন্ট করার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দুজনে আবার বেরিয়ে পড়ল।
একটা বেগে কিছু কাপড়-চোপড়ভরিয়েনে,স্যাণ্ডেলব্রাশ,লুঙি।রাতে আমাদের অন্য জায়গায় থাকতে হতে পারে,রমেনবলল।বাবারচিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,’কাকু চিন্তা কর না,একটু সাবধান হওয়া ভালো।একমাসদেখেশুনে চলতে হবে।কাকিমাকেবুঝিয়ে বলবেন।মোবাইলে যোগাযোগ রাখবেন।’
বাবা দুর্বলভাবে শুধু মাথা নাড়ল।
‘আমাদের কি আজ থেকেই অন্য জায়গায় থাকতে হবে নাকি?’পথে যেতে যেতে শ্রীমান জিজ্ঞেস করল।
‘না লাগতেওপারে।’কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয় আমাদের সমস্ত ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা ভালো।’
রাস্তা থেকে রমেনঅঞ্জুদাকে মোবাইলে ফোন করল।ফোন রেখে বলল,’গোধূলিআটটার সময় ডেকেছে।এতক্ষণ কী করবি?’
‘কোথাও বসি চল।’
‘খারাপ না।কিন্তু আগের যাওয়া পরিচিত হোটেলে নয়,অন্য জায়গায় যাই চল।’
একটা পুরোনো বাড়িতে এসে ওরা প্রবেশ করল।অতি প্রাচীন দোতলা বাড়ির ওপর মহলেরমহানগরের ব্যস্ত বাজার এলাকার কাছে এরকম ঘর আছে বলে বাইরে থেকে ধারণাই করা যায় না।
‘কার বাড়ি? মাড়োয়ারি বলে মনে হচ্ছে।’ শ্রীমান জিজ্ঞেস করল।
‘ব্যাংকারের ঘর।’
‘ ব্যাংকার?’
‘ প্রাইভেট ব্যাংকার। এরা অনেক মানুষের টাকা পয়সা রাখে। ব্যবসায় খাটায়। আজ কুড়ি লাখ টাকা লাগবে বল, বের করে দেবে। মিনিস্টারফিনিস্টার সবার টাকা এই ধরনের মানুষেরাই রাখে। এসব টাকা তো আর ব্যাংকে রাখা যায় না!’
ভেতরে সুদৃশ্য ঘর। একজন ক্ষীণ বুড়ো মানুষ এসে নমস্কার করল । কর্মচারী হবে ।
‘আমরা দু’ঘণ্টা রেস্ট নেব।’
‘ ঠিক আছে স্যার ভাবলেশহীন ভাবে মানুষটা বলল ।’ দুই নম্বর কামরায় রেস্ট নিন ।আমি ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ।আপনাদের যা প্রয়োজন দেবে ।মানুষটা একটা ঘরের দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে দিল। বিশাল বিছানাসহ সুসজ্জিত একটি ঘর।
‘ সুন্দর দেখছি।’
‘ এখানে মাছ মাংস খেতে পারবি না। মদএলাউড।’
একটা ছেলে এল। রমেন তাকে এক বোতল হুইস্কি আর সোডা আনতে টাকা দিল। ছেলেটি ঘরের এসি এবং টিভিটা অন করে দিল।
তাড়াতাড়ি মদ চলে এল। গ্লাসে মদ ঢেলে চুমুক দিয়ে শ্রীমান বলল,’ ঐ সঙ্গী থাকলে বেশ ভালো হত।’
‘শালা,’ রমেন হাসল।’ কখন গুলি খেয়ে মরবে ঠিক নেই তার সঙ্গী চাই।’
‘ সেই জন্যই তো চাই।’
রমেন মোবাইল ফোন চালু করল। অনেকক্ষণ নাম্বার টিপে সে কারও সঙ্গে কথা বলল। তারপর শ্রীমানের দিকে তাকিয়ে বলল,’ ধৈর্য ধর,আসছে।’
বিছানায় বসে দুজনেই টিভি দেখে মদ খেতে লাগল। শ্রীমান ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়ল। হৃদপিন্ডের,শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ যেন বেড়ে যেতে লাগল। সমস্ত শরীরে সে অনুভব করল এক ধরনের অনামী উত্তেজনা। কে আসবে? পরিচিত কেউ নাকি অপরিচিত? রমেনভাবলেশশূন্য ভাবে নীরবে বসে টিভি দেখছে। এটা একটা পশু, শ্রীমান ভাবল। এর কোনো ধরনের ইমোশন নেই, আবেগ নেই। একটা যন্ত্র ,শালা!
এই সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরে রমেন বলল,’ ওরা এসেছে আমি এক জায়গায়দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলাম। এসে গেছে। আমি গিয়েনিয়ে আসি।’
রমেনবেরিয়ে যাবার পরে শ্রীমান পুনরায় তার চিন্তায় ডুবে গেল।
ক্ষনিকের সঙ্গের জন্য বান্ধবী পাওয়াটা আজকাল এত সহজ- কয়েক মাস আগে পর্যন্ত শ্রীমানের এই বিষয়ে কোনো ধারনাই ছিল না। ক্ষণিকের ফুর্তি, সামান্য উত্তেজনা ,সামান্য থ্রিলের জন্য ভালো ঘরের কলেজে পড়া মেয়ে এত সহজে চলে আসতে পারে– কী যে হয়েছে দিনগুলি!
আরে বেটা, কী কথা ভাবছিস তুই এইসব। যতসব বাজে কথা। মানুষের ইচ্ছা করছে, সামর্থ্য আছে, ফুর্তি করছে। তোর এইসব বাজে চিন্তা করার কী দরকার! কেউ আসবে– সেই প্রত্যাশায় তুই অধীর হয়ে পড়িস নি নাকি? শালা কুকুর! আত্ম ধিক্কার দিয়ে উঠল সে এবার। শুয়ে থাকা থেকে সে আবার উঠে দাঁড়াল এবং অস্থিরভাবে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগল। ইসরমেন এতদেরি করছে কেন? টিভির শব্দটা বড়ো বিরক্তিকর হয়ে পড়েছে। রিমোটটা থাপা মেরে ধরে এনে ভলিউমটা কমিয়ে নাই করে দিল। নীরবে কোমর ভেঙে ভেঙে এক ঝাঁক নর্তকীপর্দায় নাচছে। সে সম্মোহিতেরমতো সেই নীরব নৃত্য দেখতে লাগল– শব্দহীন অঙ্গভঙ্গি, শব্দহীন নীরব অভিব্যক্তি তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল।পর্দা টেনে রাখা জানালা দিয়ে ঐ যে মহানগরের ব্যস্ত রাস্তায় নীরবে গাড়ি-মোটর দৌড়ে যাচ্ছে,নীরবে পার হয়ে যাচ্ছে রিক্সা,ঠেলা,অটো,পিঁপড়ের মতো দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে শব্দহীন মানুষ… …
দরজা খুলে তুফানের মতো প্রবেশ করল রমেন।তার পেছন পেছন দুজন হাসতে থাকা মেয়ে।শ্রীমান নির্লজ্জ ভাবে মেয়ে দুটির দিকে তাকাল।কলেজের ছাত্রী হবে।সুন্দর নয়,সতেজ,সপ্রতিভ।ওদের চোখে যেন চকচক করছে আগ্রহ আর প্রত্যাশা।এক মিথ্যা পরিচয় পর্ব চলল। প্রত্যেকেরই নামগুলি মিথ্যা,পরিচয়মিথ্যা।রমেন সময় নষ্ট না করে মেয়েদুটিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ওদের জন্য গ্লাসে মদঢালল,বরফদিল,সোডাদিল।তারপরচারজনেই গ্লাস তুলে ধরে বলল ‘চিয়ার্স।’
রমেন সঙ্গে থাকলে এটাই সুবিধা যে শ্রীমানকে মুখ খুলতে হয় না।সে একাই কথা-বার্তা চালিয়ে নেবে।শ্রীমান সমর্থন জানিয়ে মাঝে মধ্যে একটা দুটো মন্তব্য করলেই হল।অর্থহীন কথা-বার্তা,অর্থহীন উচ্ছল হাসি,অর্থপুর্ণ ইঙ্গিত এইসব অনেকক্ষণ ধরে চলল।মেয়েদুটির দুই-তিন পেগ খাওয়া হয়ে গেছে।রমেন পর্দা টেনে দিল,দরজা বন্ধ করে দিল।লাইটনিভিয়েদিল,কেবল শব্দহীন টিভিটা অন্ধকার ঘরে বিভিন্ন রঙের সাইকোডেলিক আলো বিতরণ করে চলতে থাকল।
কোমল স্পর্শানুভূতিরমাদকতায় ডুবে যেতে যেতে শ্রীমান বুঝতে পারল কোথাও মোবাইল ফোন বাজছে।তার ফোনের কণ্ঠস্বরটা পরিচিত মনে হল-এক জরুরিসাঙ্গীতিক লয়ের তরঙ্গ ঘরটার রঙিণ অন্ধকার আলোর মধ্যে যেন বয়েচলেছে।কিছুক্ষণ পরে তাকে কেউ টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করিয়েদিল।কানের কাছে রমেনের কন্ঠস্বর হিসহিস করে উঠল-‘চল চল ,তাড়াতাড়ি চল ।অঞ্জুদাকে কারা যেন গুলি করেছে।’
এক মুহূর্তের মধ্যে কাপড়-চোপড় পরে দুজনে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসার মতোহল।মেয়ে দুটিকে রমেন কী করল,কী বলল,সেদিকে শ্রীমানের ভ্রূক্ষেপ ছিল না।তার মনের ভেতরে বোঁ-বোঁ করে কেবল দুটি শব্দ ঘোরা ফেরা করছিল-অঞ্জুদাকে গুলি করেছে।সে কেবল অনুভব করল তার বুকের মধ্যে কলজের শব্দটা যেন বড়োবড়ো হতে হতে দুটো কান ঠেসে ধরেছে-ধপ-ধপ-ধপ।
মহানগরের ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে রমেন এগিয়ে চলল।শ্রীমান একটু অবাক হয়ে দেখল বাইরেরপৃ্থিবীরকোলাহলপূর্ণ নিত্য ব্যস্ততা।গাড়িগুলি নিজের গতিতে,নিজের বেগে এগিয়ে চলেছে।পথের পাশের দোকান গুলি আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয়ে মেলে দিয়েছে আকর্ষনীয় অনেক জিনিসের সম্ভার।দুই-তিনজন মহিলা ছেলে মেয়ে নিয়ে বাজার করে হাসতে হাসতে দোকান থেকে হাতে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসছে।পান-দোকানে যুবক ছেলে সিগারেট কিনে জ্বালাচ্ছে,কোথাও ফুল ভলিউমে গান বাজছে,ফাস্ট ফুড কর্ণারের সামনে ছেলে-মেয়ের দল ঘিরেআছে,সিনেমা হলে ভিড়,মদের দোকান থেকে ঐ যে কালো পলিথিনের বেগে বোতল মোড়ে নিয়ে মানুষ দ্রুত সরে যাচ্ছে-যেন বিবেকের কোনো একটি কোণে পাপবোধ বিরক্ত করছে।কোথায়,কোথাও মহানগরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়ে নি… …
অথচ এই মহানগরে গুলি চলেছে-মানুষকে প্রাণে মারার চেষ্টা চলছে-কোথাও যুবক ছেলেকে মেরে পুঁতে রাখা হয়েছে-শিয়াল-কুকুর খুঁড়ে বের করেছে।আরও হয়তো গুলি চলবে,বিস্ফোরণহবে,মানুষমরবে।তার কোনো চিহ্নই নেই নগরের জীবন প্রবাহে… …
‘কোথায় হল ঘটনাটা?’রমেনকে সে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি ভালোভাবে জানতেই পারিনি,’সে বলল।‘কিন্তু,এই ধরনের বড়ো কিছু একটা যে হতে চলেছে আমি অনুমান করেছিলাম।কিন্তু আজকেই… …’
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?’
‘হাসপাতালে।’

অনুবাদক