| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-১৪) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


‘ তুই কোনো খোঁজ খবরই করিস না, মনোযোগ দিস না,’ সকালবেলাচায়ের টেবিলে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে বাবা অভিযোগ করলেন।

‘ কীসের খবর করিনি? আমি তো তোমার খোঁজে বিকেলে উকিলের কাছে গিয়েছিলাম।

‘উকিল ?কোন উকিল?’

‘ কেন, সকালবেলা যে গিয়েছিলাম, দত্ত উকিল।’

‘ কখন গিয়েছিলি?’

‘ বাড়ি পৌঁছেই গিয়েছিলাম।’

‘ আমি তার কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু একজন অন্য উকিলের কাছেও গিয়েছিলাম।’

‘ অন্য উকিল?’

‘ হ্যাঁ,জৈন। আমি এমনিতেই তাকে জানি। খবর করে জানতে পারলাম যে তিনি এইসব ওনারশিপ ফ্ল্যাটের কাজকর্মে খুব ভালো। অনেক বড়ো প্রজেক্টে তিনিই নাকি সবকিছু করেন। আর এই সমস্ত বিষয় সম্পত্তির কথায়মারোয়ারি মগজের ওপরে মগজ নেই বুঝেছিস।’

শ্রীমান কিছুই বলল না। মা দিয়ে যাওয়া লাল চায়ে চুমুক দিয়ে সে মাথা নাড়ল।

‘ দত্ত তো ম্যাক্সিমাম ১৫% ফ্লোরস্পেসের কথা বলে, কোনো ক্যাশ  পয়সার কথা বলে না। কিন্তু জৈন বলেছে মিনিমাম ২০% আর ক্যাশ টাকা। আমরা এই পয়েন্টটাতে লেগে থাকতে হবে। রমেন আসবে নাকি আজ?’

‘ বলতে পারছিনা।’

‘ মহা মুশকিল। মহা মুশকিল,’ শুকনো রুটি একটা ছিঁড়ে মিষ্টি কুমড়ো ভাজা দিয়ে রুটি টাকে জড়িয়ে নিয়ে বাবা গ্রাসটা মুখে দিয়েচিবোতে লাগল। মা রুটি এবং মিষ্টি কুমড়ো ভাজার একটা প্লেট শ্রীমানের সামনে রাখল।

‘ আজ পুনরায় রেডগোর্ড শ্রীমান বলল ।

‘ রেড নয়,সুইটগউৰ্ড।’ মা উত্তর দিল। 

‘ আর ও একটি কথা,’ বাবা বলল। আমরা আমাদের ম্যাক্সিমামবেনিফিটের কথাটা দেখতে হবে।’ এবার কথাটা তিনি শ্রীমানকে বাদ দিয়েমায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ আমাদের দুটো ছেলে। দুজনের জন্য দুটি ফ্ল্যাট লাগবে। এমনিতেই মালিক ফাস্ট ফ্লোরপায়। কিন্তু পান বাজারের সেই কমার্শিয়ালজায়গায় সেকেন্ড ফ্লোর হলেও হবে। লিফট তো থাকবেই। নিচে দুটো ভালো রুম লাগবে। সেখানে ও ফার্মেসিখুলে ,দোকান খুলে ,যা খুলে খুলবে। এইটুকুমিনিমাম লাগবে। নাকি বল?’

মা প্রগলভ হয়ে উঠল। কত বড়ো ফ্ল্যাট দেবে? আজকাল মিনিমাম তিনটি বেডরুমের ফ্ল্যাট প্রয়োজন। না হলে অনেক অসুবিধা হবে।’

মা-বাবা দুটো বেডরুম বনাম তিনটি বেডরুমের ফ্ল্যাটের সুবিধা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল।’ ছাদেও আমাদের কিছুটা জায়গা দিতে হবে,’ মা বলল। কাপড়-চোপড় মেলার জন্য কিছু জায়গার প্রয়োজন।’

‘ জৈন এই সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করে দিতে পারবে,’ বাবা বলল।

রুটি মিষ্টি কুমড়ো ভাজা চা খেয়ে টেবিল থেকে উঠে যাবার সময় শ্রীমান বলল প্ল্যানগুলো ভালোই হয়েছে কিন্তু তোমার জৈন ভাড়াটেদের  তাড়িয়েদিয়ে সেখানে বাড়ি বানাতে পারবে কি?’


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-১৩) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


সে মা-বাবার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না। সে অনুমান করতে পারল যে ভাড়াটিয়াদের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাবার মুখটা কালো হয়ে পড়েছে এবং মায়ের মুখের আওয়াজ নাই হয়ে গেছে। সে তার নিজের ঘর থেকে শুনতে পেল মা- বাবা ডাইনিং টেবিলে অনুচ্চ কণ্ঠে কিছু কথা বলছে। নিশ্চয় তার বিষয়ে কথা বলছে –সে ধারণা করল সে পান বাজারের কাজটার বিষয়ে যতখানি আগ্রহ দেখানো উচিত ছিল ততটুকু আগ্রহ দেখায়নি বলে মা বাবা নিশ্চয়ই ভাবছে। ঠিকই অনুমান করেছিল সে কিছুক্ষণ পরে বাবা তাকে ডেকে পাঠাল।

‘তুই কথাটাতে একটু গুরুত্ব দে,’ মা এবার শুরু করল। পানবাজারের সেই জায়গায় আমাদের আসলে অনেকটা জায়গাই  পাওয়া উচিত। যেকোনো বিল্ডার জায়গাটা পেলে সেখানে ঘর বানিয়ে অনেক টাকা লাভ করবে। ওখানে ছোট্ট একটি দোকানের সেলামি নাকি লাখ টাকা। তোর বন্ধু রমেনের সঙ্গে কথাটা ভালোভাবে বল। এতদিনে তো মাটিটা হাত থেকে চলে যাওয়ার মতোই অবস্থা হয়েছিল। এখন কিছু একটা হওয়ার উপক্রম হয়েছে– ন্যায্যটা আমাদের পাওয়া উচিত। আমরা বুড়োবুড়ি তো আর সেখানে থাকতে যাব না– তোদেরই ভবিষ্যতের কথা হবে….’

মা হয়তো আরও কিছু বলত কিন্তু শ্রীমান দ্রুত বলে উঠল ‘ আমি কথা বলব। নগদ টাকার কথাটা বলতে পারব না কিন্তু ২০% ফ্লোরস্পেসটা যুক্তিসঙ্গত কথা। সেটা তো বাজারে চলছে। বাবা, জৈনের কাছ থেকে অন্য কোনো পার্টির এগ্রিমেন্টের কিছু কাগজপত্র পাও যদি নিয়ে আসবে তো। সেগুলো দেখিয়েরমেনের সঙ্গে কথা বলতে আমার সুবিধা হবে ।বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শ্রীমান ঠিক এরকম হওয়াটাই আশা করেছিল। সে আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে মা-বাবা খুশি হবে সে জানত বলেই সে কথাটা এভাবে বলেছিল।

     আমি আজকেই জৈনের কাছে যাব। তারপরে তুই কথা বলবি,’বাবা বেশ ব্যস্তভাবে খাবার টেবিল থেকে উঠল।

 শ্রীমান নিজের ঘরে ঢুকল। রমেন তাকে ফিফটি-ফিফটিপার্টনারশিপের কথা বলেছিল। কিন্তু এখন সে আর একবারও কথাটা উত্থাপন করছে না। অঞ্জুদা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে কথাটা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পড়ল। সে কি এসবে  রাজি হবে? রমেনকে তো অঞ্জুদার আদেশ পালন করা ছাড়া  বেশি কিছু মনে হয় না ।  কীভাবে সে কথাটা উত্থাপন করবে ?অঞ্জুদার সঙ্গে কথাটা বলবে নাকি ? তার তো ইনভেস্ট করার মতো একটি টাকাও নেই । কিন্তু এই ধরনের মার্কেট কাম হাউসিং কমপ্লেক্স তো অন্যের টাকাতেই বানানো হয়…। শ্রীমানের আর চিন্তা করতে ইচ্ছা করল না । গতরাতে প্রায় ঘুমই হল না । আজ সকালে তাই শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না । কিসেপেয়েছিল আমাকে প্রিয়ংবদারগাড়িনিয়ে বালির খাদানের দিকে যাবার। সে ভাবল।সে একটু তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য রওনা হয়ে পড়ল ।প্রিয়ম্বদারবাড়ি হয়ে যাবে নাকি ?ঢুকে যাবে ।গাড়িটানিয়ে যাওয়া কালকের মতো তাকেও নিয়ে যাবে ।কথাটা ভেবে তার মন পুলকিত হয়ে উঠল ।গাড়ির ভেতরে তার শরীর থেকে ভেসে আসাফুরফুরেপারফিউমের সুগন্ধ যেন তার গায়ে এসে লাগল । কিন্তু পরের মুহূর্তে সে ভাবল সে তো আজ তাকে আসতে বলেনি বা প্রতিদিন এসে আমাকে নিয়ে যাবে বলেনি, সে নিজে উপযাজক হয়ে গেলে কী ভাববে ! লজ্জার কথা হবে দেখছি। খবর করার অজুহাত নিয়ে যাবে নাকি? গতকাল গাড়িটাদিয়ে আসার সময়প্রিয়ম্বদা ছিল না? সেভাবে যাওয়া যেতে পারে। তার মনের মধ্যে কিছু টানা-হেঁচড়া চলল। না ,যাব না, সে ভাবল। বেশিএগিয়ে যাওয়া হবে। অফিসে যাব ,সেখানে তো দেখা হবেই।

মা তাকে রান্নাঘর থেকে ডাকল। গিয়ে দেখে মা মাছ বাছছে।

‘ তুই আজকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিস যে? ভাত না খেয়েই যাবি নাকি? মা জিজ্ঞেস করল। রান্নাঘরে মায়ের কাছে মোড়ায় বসে শ্রীমান উত্তর দিল;

‘ রমেন এর কাছে যাব নাকি!’

‘ দেখা হবে গিয়ে?’

‘ হবে। ও দেরি করে উঠে। রাতে দেরি হয় তো,’ কৈফিয়তের সুরে সে বলল।’ এখন গেলে পেয়ে যাব। ওর সঙ্গে কথাটা বলি।’

‘ তোর বাবাও জৈন উকিলের কাছে বেরিয়ে গেল। ভালোভাবে কথা বল। সুযোগ এসেছে যখন সেটাকে কাজে লাগানো উচিত। টুয়েন্টিপার্সেন্ট তো দিতেই হবে আর তাছাড়া ক‍্যাশ টাকার কথা ও বলবি। ওরা সব সারেন্ডার করা ছেলে, এখন ব্যবসায় নেমেছে, ওদের টাকার অভাব নেই। একটু চেষ্টা করলেই হয়ে যাবে। রমেনকে কথাটা বলবি।’

শ্রীমান মুখ দিয়ে মাত্র ওঁ ওঁ শব্দ করল।

ক‍্যাশ টাকা হাতে এলে অনেক কাজ হবে। তুইও একটা স্কুটারটুটার নিতে পারবি। অফিসে যাবার সুবিধা হবে।’ মা আড়চোখে তার দিকে তাকাল।

মায়ের কথাটা শ্রীমানের ভালো লাগল। স্কুটার নয়, একটা হিরো হোন্ডা বা সেকেন্ড হ্যান্ড মারুতি একটা কেনার কথা ভাবা যেতে পারে। আর রমেনপার্টনারশিপের কথাটা বলার মতো করলে তো খুবই ভালো হয়…। তার মুখে অজান্তে হাসি ছড়িয়েপড়ল। তার উজ্জ্বল মুখটা দেখে মায়ের মুখেও হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

‘ এক কাপ চা খাবে নাকি?’

‘ না ,এখন লাগবে না। আমি রমেনের কাছে যাচ্ছি,’ শ্রীমান মোড়া থেকে উঠে দাঁড়াল।

রমেনবাড়িতেনেই।সে সকাল বেলাতেই কোথাও বেরিয়ে গেছে। কখন আসবে কোনো ঠিক নেই। কোথায় গেছে বাড়ির কেউ জানে না। একটু পরেও হয়তো এসে হাজির হতে পারে না হলে অনেক দেরিও হতে পারে– একেবারে রাত। রমেনের মা তাকে বসতে বলল।’ এক কাপ চা খাও, অনেকদিন পরে এসেছ। বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?’ মহিলাটি তাকে বেশ আদর অভ‍্যর্থনা করল। বাড়িতে এসে বহুদিন, বহু বছর পরে এসেছে। বেশিরভাগইরমেনই তার বাড়িতে আসে। তার আসা হয় না।

রমেনদের বাড়িতে প্রচুর পরিবর্তণ এসেছে। পুরো বাড়িটা নতুন করে সাজানো হয়েছে। উপরে আর ও একটি মেজে তৈরি করা হয়েছে, তৃতীয় তলার জন্য ছাদ ঢালাই করে রাখা আছে। পুরোনো ঘরটা ভেঙ্গে বেশ বড়োসড়ো করা হয়েছে। হ্যাঁ এরকম তো আগে ছিল না। এত বড়োসড়ো ছিলনা। এরকম দেওয়াল ছিল না, গ্রিল ছিল না, মেঝেতেমার্বেল এবং সবুজ কাটা পাথর লাগানো ছিল না। ছিলনা এতগুলি ফুলের টব।

বৈঠকখানা ঘরে সুদৃশ্য দামিসোফা, মেঝেতে ভারী কার্পেট, ষ্টোভ লাইট, এত বড়ো টিভি, মিউজিক সিস্টেম ছিল না। সে পুরো বৈঠকখানা ঘরে একবার চোখ বুলিয়েনিল।

‘ পুরো বাড়িটা সে ভেঙ্গেচুরে অপরিচিত করে তুলেছে,’ রমেনের মা বলতে লাগল।’ আগের তিনটি রুমভেঙ্গে এই ড্রয়িংরুম তৈরি করেছে। মিস্ত্রি অনবরত কাজ করতেই থাকে। এখন ও শেষ হয়নি । ওদের নির্দেশ দিতে দিতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেছে মা বেশ গর্বের সঙ্গে বলল।

যত নতুন এবং দামি জিনিস বেরিয়েছে সবই কিনে এনে এই ঘরটাতে যেন ভর্তি করে রাখা হয়েছে । কিন্তু কোথাও কিছু একটা মিল নেই , মিল নেই বলে মনে হয়শ্রীমানের।

রমেন কে না পেয়ে প্রথমে সে অপেক্ষা করবে বলে ভাবেনি। কিন্তু মা জোর করায় বসতে বাধ্য হল। মা আসলে ছেলের বন্ধুদের কাছে ছেলের কাজকর্মগুলোদেখিয়ে যে ভালো পায়, সে কথা সে বুঝতে পারল। সে এটা ওটার প্রশংসা করল। মা  আনন্দে প্রগলভ হয়ে উঠল।

‘ সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে বুঝেছ। বিন্দু মাত্র অবসর নেই। সকালে যায়, কখন ও রাতেও ফেরে না। আমি তাকে এত বলি যে এত কষ্ট করার দরকার নেই, কিন্তু শোনে না,’ মহিলা গর্বের সঙ্গে বলল।

চা, আইসিং করা পেস্ট্রি, মিষ্টি খেতে না খেতেই গেটের সামনে গাড়ি এসে হর্ন বাজাল।

‘এসেছে, সে এসে গেছে। বাহাদুর, বাহাদুর গেট খুলে দে’ মহিলাটিচিৎকার করে উঠল।’ এরকমই তার পরের কথাটা শ্রীমানের দিকে তাকিয়ে বলল। এই আসে, এই যায়।’

গটগট করে রমেন ভেতরে চলে এল। শ্রীমানকে দেখে হেসে বলল,’ তুই কখন এলি?’

‘ হয়েছে, এই কিছুক্ষণ। যাব বলে উঠছিলাম।’

‘ আয়, ভেতরে আয়’, রমেন তাকে নিজের ঘরে ডাকল।’ আসার সময়তুই  আমাকে একটা ফোন করে নিবি। আমি কোথায় আছি জানতে পেরে যাবি। তোকে আমার মোবাইল নাম্বারটা দিই নি ,না?’

সুদৃশ্য মার্বেলের একটা সিঁড়িদিয়েরমেন তাকে উপরের মহলে নিয়ে গেল। শ্রীমান ভাবতে ভাবতে গেল– আগে তো রমেনদেরবাড়ি দোতলা ছিল না।

পকেট থেকে চাবি বের করে রমেন উপর মহলের একটা ঘরের দরজা খুলল।

‘ তুই বন্ধ করে রেখে যাস নাকি?’

‘ অনেক ধরনের জিনিসপত্র থাকে,’ রমেনসাধারণভাবে বলল। ‘খুলে রেখে যাওয়া বিপদজনক। মিস্ত্রিরা  কাজ করে।’

একটা প্রশস্ত ঘরে সবাই বসল।

সোফা সেট থাকা একটা বৈঠকখানা ঘর। এখানেও নতুন টিভি, মিউজিক সিস্টেম আছে। পাশেই একটা কাচের আলমারিতে সারি সারিসাজিয়ে রাখা আছে মদের বোতল-বার। সেটা পার হয়ে রমেনেরশোবার ঘর । বিশাল একটি শোবার ঘরে বিশাল একটা বিছানা। বিছানায়বিশৃংখলভাবে অনেক জিনিসপত্র পড়ে রয়েছে। একটা কালো- নীল রঙের পিস্তল বিছানায়পড়ে আছে।

একটা পিস্তল!

‘ এটা  বেরোনোরসময়নিয়ে যাওয়া হল না,’ রমেন বলল। বিছানায় ফেলে রেখে গেলাম।’ রমেনসাধারণভাবে বলল এবং পিস্তলটা বিছানার মাথার দিকে থাকা প্রকাণ্ড আলমারির মতোহেডবোর্ডটার  একটা দেরাজে ঢুকিয়েরাখল।’

শ্রীমানের হঠাৎ শরীরটা খারাপ লাগতে লাগল। তার মাথাটা যেন সামান্য ঘুরে গেল।

পিস্তল! এরকমই একটি পিস্তল বালির খাদানের  সেই মানুষটার খুলি উড়িয়ে দেয়নি  কি? এরকমই একটি পিস্তল। এই পিস্তলটাই নয়তো? তার বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। সে রমেনেরবিছানায়ধপ করে বসে পড়ল ।

‘বস । হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বস ।’রমেন বলল ।

সে কাপড়চোপড়ছেড়ে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বিছানায়শুয়েপড়ল।

‘ ক্লান্ত লাগছে বুঝেছিস। সেই সকালে বেরিয়ে গেছি, তখন ও আলো ফোটেনি।তোদের কাজটা এগোচ্ছে  বুঝেছিস।’

শ্ৰীমান একটু প্রকৃতিস্থ হতে চেষ্টা করল। সে জোরে জোরে  দুবার শ্বাস নিল। তারপর বিছানার কাছেরটেবিলটাতে থাকা এক গ্লাস জল সে ঢক ঢক করে খেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। রমেনেরকথায় সে মন দিতে চেষ্টা করল

রমেনউকিলটার কথাই বলছিল।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে শ্রীমান হঠাৎ মাঝখানে শুরু করল’ আমি একটা কথা ভাবছিরমেন।’

     রমেন কথা বলার মাঝখানে থেমে গেল। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সে শ্ৰীমানের দিকে তাকাল। ‘আমি একটা কথা ভাবছি, শ্রীমান পুনরায় বলে গেল। ‘কাগজের চাকরিটা ছেড়ে দিই ।কাগজ কখন বের হয় ঠিক নেই। ভাবছি তোদের সঙ্গে একসঙ্গে পান বাজারে আমাদের মাটির প্রজেক্টটাতে যোগ দেব। সেখানকার কাজগুলি নিজে দেখাশোনা করি…  …।’ 

রমেনহঠাৎ লাফিয়ে  উঠল।’ এক্সিলেন্ট। একটা কথার মতো কথা বললি তুই। তুই যদি নিজে কাজটা দেখিস তাহলে আমার কত সুবিধা হবে বল দেখি। আমার কষ্ট অনেক কমে যাবে। আমি অন্য কাজ করতে পারব। আর গুলি মার চাকরি। তোদের কাগজ এমনিতেও বের হবেনা বলে শুনেছি। পয়সার কথা তুই চিন্তা করিস না। চল, চল অঞ্জুদার  কাছে যাই, দাদা কথাটা শুনে খুব খুশি হবে।’

শ্রীমান ঢোক গিলল। রমেন কথাটা এভাবে নেবে বলে সে ভাবতেই পারেনি। মা-বাবাকে সেই টোয়েন্টিপার্সেন্টের কথা রমেনের সামনে উত্থাপিত করবে বলে বলে এসেছিল আর তারই ভূমিকা হিসেবে সে এভাবে কথা শুরু করেছিল। এবার সে তামাশার সুরে বলল।

‘ বুড়ো কিন্তু ২০ পার্সেন্টের নিচে রাজি হবে না।’

‘কীসেরটুয়েন্টিপার্সেন্ট?’

‘ফ্লোর স্পেস।’

‘ হয়ে যাবে। পান বাজারে অনেক স্পেস বানানোর পারমিশন বের করা যাবে। তুই নিজেই জানতে পেরে যাবি। কোন প্রবলেমই হবে না,চল।’

রমেনের পেছনে পেছনবেরিয়ে আসার সময়শ্ৰীমানের নিজেকে নেশাগ্রস্থ মানুষের মতো মনে হল। ঘটনাগুলির আকস্মিকতা এবং দ্রুতগতিতে তার মুখে বোকার মতো একটা হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসিটা নিয়ে সে রমেনেরপেছনপেছন ওপর মহল থেকে নিচে নেমে এল।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত