| 19 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: রাঙাপিসিমা যেমন ছিল । সরোজ দরবার         

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

রাঙাপিসিমার কথা কে না জানে! বলতে গেলে, মল্লিকবাড়ির প্রায় সবারই মুখস্থ। এমনকী তাতুনও এখন দুটো গল্প বলে দিতে পারে। এই ক-বছর আগেও সে রাঙাপিসিমা উচ্চারণ না-করতে পেরে বলত— লাঙাপিতিমা। সেই তাতুন ইদানীং তার বন্ধুদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে— জানিস, রাঙাপিসিমা খুব সাহসি ছিল। একবার ডুমুর গাছে ডুমুর তুলতে গেছে রাঙাপিসিমা…

বন্ধুদের একজন তাতুনকে থামিয়ে বলে, ডুমুর গাছ কেমন দেখতে?

তাতুন নিজেও ডুমুর গাছ দেখেনি কখনও। বিষয়টিতে তাই গুরুত্ব না-দিয়ে সে বলল, শোন না, তো সেই গাছে সবে হাত দিতে যাবে, দেখে কী, ডুমুরের ডাল থেকে ঝুলছে একটা ভয়াল বিষধর সাপ। এই শেষ কথাটা বলার সময় তার চোখ হত বিস্ফারিত, ঠোঁটদুটো যথাসম্ভব ফাঁক করে বড়ো হাঁ করে সে উচ্চারণ করত ভ-য়-আ-ল, আর সঙ্গে সঙ্গে — যতদূর প্রসারিত হয়, তার দু-হাতকে দুই বিপরীত দিকে ততদূর প্রসারিত করে সে সাপের দৈর্ঘ্য নির্দেশ করত। ডুমুর গাছে সাপ থাকতে পারে কি-না, এ-প্রশ্ন কারোর মনে ঘাই দেয় না। কেননা তাতুনের বয়সিরা না দেখেছে ডুমুরগাছ আর না দেখেছে গাছে সাপ ঝুলতে। অতএব যে গাছই হোক না কেন, ঘটনার ভয়াবহতা বুঝে নিতে তাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। তাতুন বলতে থাকে— রাঙাপিসিমা হাতটা সরিয়ে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।

এক বন্ধু বলে, সাপটা কামড়ে দিল না?

অন্যজন বলে, রাঙাপিসিমা ভয়ে পালাল না?

এবার তাতুন ঠোঁটটা বেঁকিয়ে বলে, ভয়ে নাকি পালাবে! রাঙাপিসিমা সাপের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। একটু পরে…

সকলে সমস্বরে জানতে চায়, কী হল?

তাতুন সগর্বে বলে, সাপটা ফণা নামিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল। রাঙাপিসিমাকে কিচ্ছুটি বলল না।

গল্পের মধ্যে সাপের ফণা-তোলা ব্যাপারটা কি আগে ছিল? তা আর কেউ খেয়াল করে না। তবে গল্পটার ভিতর যেরকম মারকাটারি ব্যাপার হওয়ার কথা ছিল, তা যে হল না, বন্ধুদের চোখমুখ দেখে সে-কথা বেশ বুঝতে পারে তাতুন। অথচ সে যখন প্রথম এই গল্প শুনেছিল, ভয়ে-বিস্ময়ে একেবারে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। কেননা ডুমুর গাছ সে কল্পনা করতে পারেনি, তবে সাপটাকে কল্পনা করতে পেরেছিল— টিভিতে দেখা অ্যানাকোন্ডা। রাঙাপিসিমাকে দেখে অ্যানাকোন্ডা চলে যাচ্ছে— ব্যাপারটা ভাবতেই শিহরন জেগেছিল। বন্ধুদের ক্ষেত্রে তা হল না দেখে তাতুন এবার দ্বিতীয় গল্পে যায়— আর-একবার ডাকাত পড়েছিল আমাদের বাড়িতে।

এক বন্ধু বলে, এই বাড়িতে?

তাতুন বলে, না না তখন তো আমরা নৈহাটিতে থাকতাম।

অন্য বন্ধু বলে, তুই থাকতি?

তাতুন বিরক্ত হয়ে বলে, ধুর আমি কেন! দাদু থাকত। শোন না, তো ডাকাতরা তো এসে পড়েছে একেবারে দরজার সামনে। এই-ই-ই তাদের চেহারা — বলতে বলতে তাতুন তার রোগাপ্যাটকা হাত ভাঁজ করে সামান্য তুলে ডাকাতের স্থূলত্ব নির্ধারণ করত। তারপর অবধারিত ডাকাতের চোখ হত ইয়াব্বড়, মাথায় পাগড়ি। হাতে লম্বা লম্বা লাঠি। ডাকাতরা সবাই এসে হুঙ্কার দিয়ে বলল, দরজা খোলো….

বন্ধু বলে, কিন্তু ডাকতরা দরজা খুলতে বলবে কেন? ভেঙে ঢুকতে পারছে না!

তাতুন বলে, কেউ দরজা খুলল না দেখে, ভেঙেই তো ঢুকল। আর ঢুকেই দেখল, সামনে মস্ত একটা অস্ত্র হাতে (তাতুন শুনেছিল— আঁশ বঁটি; জিনিসটা দেখেনি বলে মনেও রাখতে পারেনি) হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাঙাপিসিমা। রাগে গনগন করছে তখন রাঙাপিসিমা। আর তার সেই মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে ডাকাতের সর্দার একেবারে ‘মা, মা গো…’ বলে রাঙাপিসিমার পায়ের তলায় কেঁদে পড়ল। বাড়িতে ডাকাতি তো হলই না। উলটে নাকি রাঙাপিসিমার সব কথা শুনতে শুরু করে দিক ডাকাতরা। ডাকাত থেকে তারা হয়ে উঠল রাঙাপিসিমার ডাকাত-ছেলে, তবে আসলে লক্ষ্মী ছেলে।  

 তাতুনের বন্ধুরা এ-গল্পের অন্তর্গত উত্তেজনায় মোটামুটি সন্তুষ্ট। শুধু তার পরিদিদি একবার এই গল্প শুনে হেসে ফেলেছিল। পরিদিদি, তাতুনের পিসির মেয়ে, তার থেকে অনেক বড়। রাঙাপিসিমার গল্প এ-বাড়ির সবাই বলে, কেউ তা শুনে হাসে না; তবু কেন পরিদিদি সেদিন হেসেছিল, তা তাতুন জানে না।

আসলে ডাকাতদের চলে যাওয়ার কারণটা তো পরি জানে। তাতুন ছোট ছেলে, তাকে আর কী বলবে! সেবার ডাকাতরা এসেছে জেনে, বাড়ির সক্কলে তো ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। পরি আর তাতুনের দাদু— দুলাল মল্লিক— তিনিই তো তখন বলতে গেলে বাচ্চা ছেলে। ভয়ে কান্নাই জুড়ে দিয়েছিলেন। সকলেই যখন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, ঠিক তখনই উঠে দাঁড়িয়েছিল রাঙাপিসিমা। বাড়ির সবাইকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে ভালো করে দরজায় খিল তুলে দিতে বলেছিল ভিতর থেকে। দরজা বন্ধ হতেই উঠোনে নেমে এল রাঙাপিসিমা। দরজায় তখন দম্মাদ্দম ঘা পড়ছে। রাঙাপিসিমা একবার চোখ বুঝে কাকে যেন স্মরণ করল। তারপর খুলে ফেলল পরনের কাপড়। গায়ে সুতোটি নেই। মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল। উঠোনের একপাশে রাখা ছিল মাছ-কাটার লম্বা একখানা বঁটি। সেইটে হাতে তুলে নিয়ে ঠিক যখন উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তখনই ভাঙল দরজাটা। হইহই করে উঠল ডাকাতরা। সর্দার সবেগে ঢুকেই একেবারে হকচকিয়ে গেল। দেখে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে এলোকেশী এক নগ্নিকা। হাতে তার অস্ত্র। ডাকাতদের হাতের আলোয় সে-অস্ত্র যেন ঝলসে ঝলসে উঠছে। নগ্নিকা সেই দেবীমূর্তির চোখে যেন আগুন। কী যে ভাবান্তর হল ডাকাত সর্দারের, সে রাঙাপিসিমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, মা মা গো, তোমার অবোধ সন্তানরে এবারকার মতো ক্ষমা করে দাও মা।

তারপর থেকে সেই ডাকাত নাকি একেবারে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে গিয়েছিল। এমনকী রাঙাপিসিমার ফাইফরমাসও খাটত। নগ্নিকার বিষয়টা তাতুনের মাথায় ঢুকত না, তাই কেউ তাকে বলেনি; সে জানেও না। পরি এ-গল্প শুনেছে তার দিদিমার কাছ থেকে। দিদিমা এখন আর বেঁচে নেই। নইলে আর-একটা খটকা মিটিয়ে নিতে পারত পরি।

সে-গল্পটাও পরিকে বেশ অবাক করেছিল। তখন পরি সবে সবে ঋতুমতী হয়েছে; একদিন দিদিমা তাকে বলেছিল, জানিস পরি, রাঙাপিসিমাও কোনও অযৌক্তিক জিনিস মানত না। কীরকম? পরি জানতে চায়। পরির দিদিমা— সরমা শোনাচ্ছিল গল্প— একবার রাঙাপিসিমা দিব্যি পুজোআচ্চার সব কাজ করছিল। এদিকে ঋতু চলছে কেউ টেরও পায়নি। রাঙাপিসিমা জেনেও কাউকে বলেনি। এ সময় যে পুজোর কাজ করতে নেই— ওসব সে মানতই না। সেই কতদিন আগের কথা! কী সাহস ছিল, ভাব! — বলছিল দিদিমা। আসলে পরি তখন এটাই জানতে চেয়েছিল যে, দিদু, পিরিয়িডিস হলে এত নিয়ম কেন মানতে হয়? তখনই রাঙাপিসিমার এই গল্পটা বলে দিদু বলেছিল, রাঙাপিসিমা যখন মানত না, তখন তুই-আমি কে! অত মানামানির দরকার নেই। তা ছাড়া তোকে কে নিয়ম মানার চাপ দেয়? পরি বলেছিল, আমাকে না, আমার বন্ধুদের দেয়, ওদের বাড়ি থেকে।

পরির সেদিন মাথায় আসেনি। পরে মনে হয়েছিল, রাঙাপিসিমা তো বিধবা হয়ে দাদুদের বাড়ি চলে এসেছিল। তাহলে বিধবা হয়ে কি রাঙাপিসিমা সবরকম শুভ কাজে অংশ নিত? তবে তো রাঙাপিসিমাকে নিয়ে ফেসবুকে লেখা উচিত। মাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল। মা বলেছে, তোমার দিদু থাকলে বলতে পারতেন, আমি ঠিক জানি না। বাকি থাকে দাদু। দাদুকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, রাঙাপিসিমাকে ছাড়া মল্লিকবাড়ির উঠোনের একটা ধুলো অব্দি উড়ত না, জল অব্দি গড়াত না; আর শুভকাজ হবে! ও বিধবা হোক আর সধবা, মল্লিকবাড়ির সবকিছুতে রাঙাপিসিমা থাকত।

নাতনিকে বুঝিয়ে দিলেন বটে, তবে দুলাল মল্লিকের নিজেরও অবশ্য একটা খটকা আছে। রাঙাপিসিমা যখন সগ্‌গে গেল, তখন তিনি তেমন বুঝদার কিছু হননি। তিনি অন্য অনেকের থেকে রাঙাপিসিমার হাজারও গল্প শুনেছেন। এই ডাকাত তাড়ানো কি সাপ চলে যাওয়া— এ সব তাঁর শোনা গল্প। তিনিই বাকিদের বলেছেন। কিন্তু তিনি যা শুনেছিলেন, আর এখন যা শুনতে  পান, দুয়ের মধ্যে বেশ ফারাক। তাহলে কি এরা নিজেরাই খানিক খানিক কল্পনা মেশাচ্ছে রাঙাপিসিমার গল্পে? নাকি সরমা এইসব গল্প নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে বলে গিয়েছে এদের কাছে? এ-কথা ঠিক যে, এই মল্লিকবাড়িকে দাঁড় করাতে অল্পবয়সি বিধবা পিসিমাটা জান-প্রাণ কবুল করেছিল। সরমা পিসিমার যত গল্প শুনত, তত উত্তেজিত বোধ করত। বোধহয় এক পূর্বরমণীর ডানপিটে বেঁচে থাকার গল্পকে মনে মনে খুব সমীহা করত। আর তাই তাতে একটু একটু করে রং চড়িয়ে দিয়ে গেছে। সরমা থাকলে এই খটকা দূর করা যেত। কিন্তু আজ আর তার উপায় কোথায়!

দুলাল মল্লিক ঠিক করলেন, একদিন সবাইকে ডেকে রাঙাপিসিমার গল্পগুলো শুনবেন। তাতে অন্তত গল্পগুলোর চেহারা এখন কী দাঁড়িয়েছে, তা বোঝা যাবে। তিনি বাদ দিয়ে এ-গল্প আর কিছু কিছু জানেন তাঁর খুড়তুতো দাদা বরেন মল্লিক, তিনি এখন তাঁর ছেলের সঙ্গে থাকেন হায়দরবাদে। বহুদিন কথা হয়নি। নম্বর ছিল। একদিন ফোন করলেন দুলাল। বরেন বৃদ্ধ হয়েছেন যথেষ্টই। এই মুহূর্তে কলকাতা আসতে রাজিও নয় তাঁর ছেলে। তবু রাঙাপিসিমার কথা শুনে বরেন জেদ ধরলেন, আসবেনই। বরেনই বললেন, মধুদাকে ফোন করতে। মধুদা তাঁদের রক্তসম্পর্কের কেউ নন, পড়শি। তবে নৈহাটির সেই পুরনো মানুষদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে মধুদাই তো সবথেকে বয়স্ক। তিনি আবার থাকেন বিদেশে। একদিন চেষ্টাচরিত্র করে তাঁকেও ফোনে ধরলেন দুলাল আর বরেন। মধুদা বললেন, আসতে তো পারব না ভাই, তবে ভিডিও কলে থাকব। বরেন বললেন, তাহলেই হবে। দুলাল বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিলেন, একদিন সবাই মিলে রাঙাপিসিমার গল্প শোনা হবে। বরেনও তাঁর বাড়ির সকলকে জানালেন সে-কথা। কিন্তু কোন দিন হলে সুবিধা হয়? ঠিক হল, মহালয়ার দিনটাই ভালো। গল্পকথা শোনা হলেও, সে-ও তো একরকম তর্পণই।

দুলাল বললেন, তার আগে রাঙাপিসিমার একটা ছবি আঁকিয়ে নিলে হয় না?

বরেন ফোনের ওপার থেকে বললেন, দারুন হয়। আজকাল তো সব কম্পিউটরে ছবি-টবি এঁকে দেয়। শুধু একটু মুখে মুখে বলে দিলেই হবে। ওই তো, টকটকে ফর্সা গায়ের রং, ছোট ছোট করে ছাঁটা কদমছাঁট চুল…

দুলাল বাধা দিয়ে বলেন, কদমছাঁট কী করে হবে? ডাকাতরা কী দেখেছিল, মনে নেই! এলোকেশী দাঁড়িয়ে আছেন রাঙাপিসিমা। সে-গল্পটা কি মিথ্যে হয়ে গেল?

বরেন বলেন, তাই তো! কিন্তু বিধবা মানুষ, আমি তো দেখেছি পরনে থান, মাথায় কদমছাঁট! ডাকাত আসার সময় বোধহয় মাথায় একঢাল চুল ছিল। বিধবা হবার পর…

দুলাল বাধা দিয়ে বলেন, ডাকাতের গল্পটা তো রাঙাপিসিমার বিধবা হয়ে এ-বাড়ি চলে আসার পর। তুমি সুব ঘুলিয়ে ফেলছ!

বরেন আবার বলেন, তাই তো! সত্যি সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

দুলাল বলেন, আর টকটকে গায়ের রং কোত্থেকে পেলে? আমার তো যা মনে পড়ছে, একটু ময়লার দিকেই ছিল?

বরেন বলেন, কক্ষনও না। রাঙাপিসিমা কখনও কালো হতেই পারে না। তা ছাড়া আমি তো তোর থেকে বেশিদিন দেখেছি।


আরো পড়ুন: তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: ভালোবাসা কারে কয় । আনিসুজ জামান


দুলাল আর তর্ক বাড়ান না। বর্ণনাটা এক জায়গায় জড়ো করেন— বেশ, তাহলে ফর্সা গায়ের রং, মাথায় একঢাল চুল, আর পরনে থান? এহ্‌হ একেবারেই মানাচ্ছে না! রাঙাপিসিমা থান পরবে! এত সেকেলে ছিল নাকি?

বরেন বলেন, কেন তোর মনে পড়ছে না?

দুলাল জবাব দেন, সাদা কাপড় পরত, মনে তো পড়ছে। কিন্তু থান নয়। শাড়িতে পাড় ছিল। যতদূর মনে পড়ে, তুঁতে রঙের।

বরেন ফোনের ওপারে মাথা নাড়েন। দুলাল ফোনের এপারে ধরে নেন, সাদা থান নয়, রঙিন পাড় থাকবে এমন সাদা শাড়িই পরানো হবে রাঙাপিসিমাকে। আরও একটু কথা হল, তাতে চোখ দুটো দীঘল, আর ঠোঁটটা একটু মোটা— এই সাব্যস্ত করল দুই ভাই।

তাতুনের বাবা— সমীর মল্লিক, বাবার মুখে এ-বর্ণনা শুনে বলল, হতেই পারে না। রাঙাপিসিমার ঠোঁট পাতলা। মা সবসময় বলত, পাতলা ঠোঁট বলেই রাঙাপিসিমা ঠোঁটকাটা ছিল, তার কোনও কথা মুখে আটকাত না। দুলাল, বরেন শুনে বলেন— তাই নাকি! আমরাই কি তবে ভুল বলছি? দুজনেরই বয়স হয়েছে যদিও! কথা আরও গড়াল। পরির মা বলল, পাতলা ঠোঁটই তো। আর তার উপর ছিল একটা সরষেদানা কালো তিল। তিল কোত্থেকে এল? দুলাল প্রশ্ন করেন। হায়দারাবাদ থেকে বরেনের স্ত্রী কণিকা ভাইজিকে সমর্থন করেন। বলেন, তিনিও তাই-ই শুনেছেন। বরেন আবার খানিক ভেবেচিন্তে বলেন, যতদূর মনে পড়ছে তিল ছিল। তবে কী কারণে যেন রাঙাপিসিমা একবার পড়ে গেল, আর সেই ঠোঁট ফেটে গিয়েছিল না? দুলাল বলেন, তিনি ওসব আর মনে করতে পারেন না। একে অত ছোটবেলার কথা। তা ছাড়া রাঙাপিসিমার গল্প এমনভাবে সবাইকে ছেয়ে আছে যে, মানুষটাকেই এখন আর গল্পের এপার থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না।

পরি বলল, ছবিটা সেই-ই আঁকিয়ে আনবে। তার বন্ধুরা এইসব গ্রাফিক্সের কাজে এক্সপার্ট। কিন্তু একটা কথা সে বুঝতে পারছে না, একটা মানুষকে এতজন এতরকম ভাবে কল্পনা করতে পারে কী ভাবে! দাদুকে সে বলে, দাদু এমনটা কী করে হল? একজন মানুষ তো একরকমই হবেন, তাই নয় কি? দুলাল আর কী বলবেন! নিরুত্তর থাকেন। পরি ভাবে, একজন রাঙাপিসিমাই এতগুলো দিন ধরে সবাইকে বেঁধে রাখল। অথচ সবার মনে আলাদা আলাদা একজন রাঙাপিসিমা আছে। আবার একেবারে আলাদাই বা কী করে হবে! যে যেভাবেই মনে রাখুক না কেন, সেই রাঙাপিসিমাকেই তো মনে রাখছে। ব্যাপারটা ভারী অদ্ভুত ঠেকে তার কাছে।

দুলালকে সে জিজ্ঞেস করে, দাদু, যদি সবার কথা শুনে শুনে সবার মতো করে রাঙাপিসিমাকে আঁকা হয়, তাহলেও কি রাঙাপিসিমা সেই একই থাকবে?

দুলাল মাথা নেড়ে পরির কথায় সম্মতি দেন। বলেন, যতরকম ছবিই আঁকিস না কেন, রাঙাপিসিমা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। 

পরি দু-লহমা কী যেন ভাবে। তারপর বলে, ঠিক আছে দাদু, আমি আমার বন্ধুকে এখুনি বলে দিচ্ছি। ও অনেকগুলো রাঙাপিসিমার ছবি করে দেবে। 

মোবাইলে বন্ধুর নাম লিখে নম্বর সার্চ করতে করতে পরি ভাবে, রাঙাপিসিমার একটা ছবি সে-ও আঁকাবে। তার ভাবনার ছবিটায় সে রাঙাপিসিমার কপালে একটা আড়াআড়ি কাটা দাগ এঁকে দিতে বলবে। রাঙাপিসিমা এত নিখুঁত ছিল নাকি! জখমের দাগ ছিল না তার! নিশ্চয়ই ছিল, পরি জানে, সব মেয়েরই তা থাকে।

ফোনটা কানে ঠেকিয়ে সে তার সাড়া পাবার অপেক্ষা করে; অনেকগুলো, তবু একখানা রাঙাপিসিমাকেই সে এই মুহূর্তে যার কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে প্রাণপণে।

                         

                 

          

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত